Shikhar Chera Jiban | শিকড় ছেঁড়া জীবন | New Article 2023

Sharing Is Caring:
Shikhar Chera Jiban

শিকড় ছেঁড়া জীবন – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা [Shikhar Chera Jiban]

শহরতলির ব্যস্ত স্টেশন। ট্রেন ভর্তি ঘরে ফেরা মানুষ। ক্লান্ত, শ্রান্ত, কেউ বা পরিপাটি হয়ে ফিরছে ঘরে সারাদিনের শ্রম শেষে অথবা অন্য কোন …। নির্মলবাবু আর আমি এই বিষণ্ণ বিকেলে প্ল্যাটফর্মে বসে আছি, যাত্রীদের জায়গা দিব্যি দখল করে। রোজ বিকেল হলে, একটা নেশার মত হয়ে গেছে। ছেলেটা কাজ থেকে ফেরে রাতে, বৌমাও। গিন্নি বেশিরভাগ সময় পুজো আচ্চা নিয়ে ব্যস্ত।বিকেলর এই সময়টা আমার আর নির্মলবাবুর ‘স্পেশাল’।

আমাদের এই অবসন্ন সময়ের গল্পের বিষয়, বৈচিত্র্যে ভরপুর। ফেলে আসা দিন থেকে নব প্রজন্মের ভবিষ্যৎ, দাঁত নখ বের করা রাজনীতি, সত্যি গুলো কেমন মিথ্যে হয়ে যাওয়া,মানুষের পরিবর্তনশীল স্বভাব,পরিবেশ দূষণ, নির্বাচন, ধর্ষণ, এলাকা দখল, সিন্ডিকেট…..। কত যে পেশা আর নেশার উদ্ভব হল এই কদিনে তার দু-মুখি ভাষণ দুজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। দুজনে দুজনের সমর্থক অথবা অসমর্থক। সন্ধ্যা একটু গাঢ় হলে শীর্ণ হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে চলে যাই, ঘরে নয় বাসায়।

নির্মলবাবু প্ল্যাটফর্মে মাঝে মাঝে তার গ্রাম জীবনের কথা বলে, তখন কেন জানি তার মন উদাস হয়ে যায়। ভাবান্তর হয় বোধ করি। এই শহরতলির ছোট ঘরের যান্ত্রিক বাতাস তার যেন বিষাক্ত লাগে। মনে পড়ে তার সেই ছবির মত সাজান জন্ম গ্রামের কথা। তার নাকি ছিল এক স্বপ্নের জীবন, সেই শৈশব থেকে পাঁচটি দশক ।চাকুরে একমাত্র ছেলের টানে পরবাসী মন নিয়ে এক অবাঞ্ছিত সময় ভেলায় তার যাত্রা । তাদের ছিল এক যৌথ পরিবার। ঠাকুরমাকে দেখেনি, ঠাকুরদার কথা আবছা মনে পড়ে, – ছয় ভাই এক বোন, দিদিমা, আর মা বাবাকে নিয়ে ,এক মধ্যবিত্ত নয় দারিদ্র্য লাঞ্ছিত সংসার। তবুও সে জীবনে ছিল এক অনন্য মায়াবী মোড়ক। মাটির ঘর, গোয়ালঘর, রান্নাঘর, হাঁস মুরগির খুপরি ঘর আর ছিল এক টালির চণ্ডীমণ্ডপ । কৃষিজীবী বাবার সংসারে অভাব ছিল প্রকট, তবে সেখানে প্রশান্তি ছিল কানায় কানায় ভরে। সংসারে ছোট থেকে বড় সবাই ‘সৈনিক’ । নিরক্ষর দিদিমা, বাবা মা কোন মন্ত্রবলে যেন শিখেছিল শিক্ষার গুণ। শুরু হল দিদিমার কঠোর অনুশাসন, নাতি নাতনিদের স্কুল পাঠানোর অসম্ভব উদ্যোগ। গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ওদের ভর্তি করে মাস্টারকে বলতো, – ‘ মাস্টার মাস তোমার, হাড্ডি আমার।’ অবশ্য নাতি নাতনিদের পড়া শুনোর প্রবল উৎসাহ, দিদিমার ওই কথার প্রয়োগ কোনদিন হয়নি। স্কুল চলো, মাঠে চলো, চাষে চলো ,সংসারের কাজে চলো, নিজের কাজ নিজে কর, অন্যের সাহায্য কর, – এই ছিল ওদের অলিখিত মন্ত্র। যাপনের। আর সেই মন্ত্র বলে গরীবের সংসারেও যেন চাঁদের আলো ঝলমল।

দুপুরে রাতে মায়ের রান্না শেষ হলে, কোন এক ভাই সকলের জন্য নির্দিষ্ট কাঠের পিঁড়ি মেঝেতে পাতে, নির্দিষ্ট জায়গায়। ভায়েরা এসে বসে রান্নাঘরে পাতা ঢেঁকির ওপর। অপেক্ষা, কখন মা বলবে বসতে। বাবা, দাদা, ভাই বোন মিলে সীমিত ক্ষমতার মায়ের হাতের রান্না আহার আর অপরিমিত আনন্দে সবার পেট ও মন যায় ভরে। নির্মল বাবুর খুব মনে পড়ে তার মায়ের কথা, বাবার কথা, দাদার কথা। দিদিমা পিসিমা অনেক দিন তো নেই !

গ্রীষ্মের দিনে ছিল মর্নিং স্কুল। খুব ভোরে ওঠে সবাই । তখন ভোরের নরম বাতাস, দোয়েলের ডাক কখন ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তারপর আলো আঁধারিতে আম বাগানে । মা পান্তা বেড়ে ডাকে। তাল পাটালি দিয়ে সে পান্তা খাওয়ার মজা ভাষায় কী প্রকাশ করা যায় ! তারপর বইয়ের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে খালি পায়ে শুকনো ধান জমির পায়ে পায়ে তৈরি মেঠো পথ ধরে সহপাঠীরা মিলে স্কুল যাওয়া। তখনও পুবের সূর্যটা হয়তো ওঠেনি। দুপুরে ছুটি হলে বাড়ি ফিরে স্কুল ব্যাগ ফেলে, আমগাছ, জাম গাছ, জামরুল গাছে । তারপর বড় পুকুরের জলে তেল মেখে ঝাঁপিয়ে পড়া। অনাবিল অবগাহন , অতিরিক্ত হলে দিদিমার বকাবকি। সে এক নাকি জীবন ছিল। দুপুরে ছিল পরের দিনের হাতের লেখা, বাড়ির অঙ্ক, আর কিছুটা পড়া এগিয়ে নেওয়া। বিকেলে নির্ভেজাল খেলা। ধান জমিতে তৈরি হত গোজি খেলার কোর্ট, ফুটবল মাঠ, – সন্ধ্যে নামে খেলা যেন শেষ হয় না। তখন গ্রামে বিদ্যুৎ আসেনি। সন্ধ্যায় ঝোপে ঝাড়ে জোনাকির স্বপ্নময় আলোর বাহার। শুরু হয় সন্ধ্যার বই পড়া, উঠোনে মাদুর পেতে হ্যারিকেনের আলোতে। সবাই মিলে সরব পাঠ। গম গম করে পাড়ার আবহ। এভাবেই পড়াশুনো এগিয়ে চলত। সকালে বিকালে গরু চরানো ছিল পালা করে। সেই যে রাখল জীবন! বর্ষীয়ান নির্মল বাবু কোনদিন ভুলতে পারে না। কিশোর কালের সেই স্মৃতিময় দিন গুলো বুকের প্রান্তরে চরে বেড়ায় নিরন্তর। তখন তার নাকি খুব কষ্ট হয়।

যখন ওর বাবা বর্ষার মাঠে লাঙ্গল দিত, সকালে পান্তা নিয়ে যেত ভায়েরা এক এক দিন পালা করে, লেখাপড়ার ফাঁকে। বাবা পান্তা খেত এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে, হয়তো বা নামত বৃষ্টি। ছিল তাল পাতার শার্শি। কিছু পান্তা রেখে দুটো বলদের মুখে ধরলে তৃপ্তি করে তারা খেত। প্রথম বর্ষাতে বেশি জল মাঠে থাকতো না। তখন পান্তা খাবার সময় বলদের জোয়াল খুলে কিছুক্ষণ দিত ঘাস খাওয়ার ছুটি। তার খুব মনে পড়ে এক দিন প্রচণ্ড বৃষ্টিপাতের দিন মাঠে ভায়েরা কাজে ক্ষান্ত দিয়ে বাড়ি ফিরে ছিল। বাবা তাদের কিন্তু সেই দুর্যোগের মধ্যে ফেরে নি লাঙ্গল গরু নিয়ে। বাবাকে ওভাবে রেখে এসে ওরা খুব কষ্ট পেয়েছিল। নির্মলের এখন খুব কষ্ট হয়, শহরতলির ঘরে ঘরবন্দী নাতি নাতনিদের দেখলে। ওরা কোনদিন মুক্ত মাঠের ঘাস পর্যন্ত দেখলো না। আবেগমথিত দৌড় দৌড়ল না কোনদিন। পুকুরের জলে সাঁতার কাটলো না কোনদিন। শুধু বইয়ের পাহাড় দেখে দেখে আসল মুক্তির পথ গেল ভুলে বোধ করি।

Shikhar Chera

মুক্ত প্রকৃতির কোলে সাবলীল যে জীবন নিয়ে নির্মলদের বাঁচা, সে বাঁচা এখন স্বপ্ন মাত্র। সেই স্বপ্নের দিন ভুলে কাজের তাগিদে ছেলে হল শহরবাসী। ভাইরাও একই কারণে ঠাঁইনাড়া। গ্রামে পিতৃপুরুষের ভিটে পড়ে থাকে মুষ্টিমেয় কজনের উপস্থিতিতে। আর বুঝি ফেরা হল না তার স্বপ্নের গ্রামে। পরবর্তী প্রজন্ম ভুলে গেল, একান্নবর্তী পরিবার, ঠাকুরদা ঠাকুরমা, জ্যাঠা জেঠিমা, কাকা কাকিমা, পিসিমা, মাসিমার চিরন্তন মায়াবী ভালোবাসা, আদুরে শাসন, তুত ভাইবোনদের সঙ্গে খেলা আর ঠুনকো ঝগড়া, মাতামাতি। তখন যেন পাড়াটাই একটা একান্ন বর্তী পরিবার। … ঝলমলে এক যাপন চিত্র।

প্রকৃতির কোলে মাটির ঘরবাড়ি,গাছ গাছালির ছায়া ঘেরা। মানুষ আর পশু পাখি, পোষ্যদের এক সম্মিলিত জীবন, অদ্ভুত বাস্তুতন্ত্র। পৌষ মাসে যখন উঠোন ভরে যেত নতুন সোনালী ধান, শুরু হত পিঠের উৎসব। সমস্ত ঋতুচক্র জুড়ে এক ছন্দময় জীবন রেখা, দারিদ্রকে অবহেলায় পরাজিত করে !

কথা শেষে দেখি নির্মল বাবুর চোখের কোন ভেজা। ৬টা ৫০ এর লোকাল ডাউন ট্রেনটা ঢুকলে বোঝা গেল আমাদের ফেরার সময় হল। সেই কানাগলির চেনা পথ ধরে কোথায় যে ফিরি আমরা ! মানুষ একবার আসে ,যায় ফিরে একবার। নির্মল এলো গ্রাম থেকে শহরতলিতে ছেলের টানে, আর বুঝি গ্রামে ফেরা হল না। নাতি থাকে কোন সুদূরের দেশ সুইডেন। সে কী আর ফিরবে তার মাতৃভূমিতে! গ্রাম থেকে শহর, শহর থেকে ভিনরাজ্য। তারপর সুদূরের কোন বিদেশ বিভূমি। ধীরে ধীরে শিকড় ছিঁড়লো, নির্মলের গ্রামে ফেরা হল না আর কোনদিন।

কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya

Shankhakshetra Puridham and Madala Panji | শঙ্খক্ষেত্র পুরীধাম ও মাদলা পাঁজির রাজবৃত্তান্ত

Pancha Byanjan | পঞ্চব্যঞ্জন | জয়ন্ত কুমার সরকার | রম্যরচনা | 2023

Machipaat | মাছিপাত | রানা জামান | Bangla Galpo 2023

Natun Bangla Galpo 2023 | গল্পগুচ্ছ | দেবযানি দত্ত প্রামাণিক | New Bengali Story

শিকড় ছেঁড়া জীবন | শিকড় ছেঁড়ার স্বাদ | শিকড় ছেঁড়া মানুষ | ছেঁড়া শিকড়ের মাটি | ছেঁড়া শিকড় | ছেঁড়া ছেঁড়া জীবন | ছেঁড়া পালক | শিকড় ছেঁড়ার ইচ্ছা | শিকড় ছেঁড়া বাচ্চারা | শিকড় ছেঁড়ার বেদনা | বাংলা প্রবন্ধ | বাংলার লেখক | প্রবন্ধ ও প্রাবন্ধিক | সেরা প্রবন্ধ | শব্দদ্বীপ | শব্দদ্বীপের লেখক

Shikhar Chera Jiban | Shikhar Chera Jiban pdf | Shikhar Chera Jiban – new article | Trend Article – Shikhar Chera Jiban | Bengali Article | Shikhar Chera Jiban pdf article | new article download – Shikhar Chera Jiban | Shikhar Chera Jiban – article in Bengali | new journal – Shikhar Chera Jiban | Trending article – Shikhar Chera Jiban | Shikhar Chera Jiban – Krishna Kishore Middya | Shabdodweep Founder | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Story | Shabdodweep Writer

Leave a Comment