Bengali Novel Online Reading – Shawkat Noor
দূর নীলিমার চাঁদ – শওকত নূর
এক
নৌকা যখন এপারের ঘাটে বাড়ি খেয়ে সশব্দে থেমে যায়, হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়ে যাত্রীরা সব। ধীরে নিচে পা ফেলেন তিনি। একবার ঘুরে তাকান পেছনে ফেলে আসা নৌপথে । বিস্তৃত পানিরাশির ওপারে প্রায় দু’কিলোমিটার দূরের অস্পষ্ট-দৃশ্যমান শহরের ওপর দিয়ে পাট বরাবর অস্তাচলে অদৃশ্য হয়েছে সূর্য। পানিপৃষ্ঠ জুড়ে যেসব ঝিলিমিলি লালরশ্মিরেখা এতক্ষণও দৃশ্যমান ছিল, এখন তারা কালচে বর্ণে প্রায় মিলিয়ে যাবার পথে।
গন্তব্যপথের দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি। এরই মধ্যে বিস্তীর্ণ বালুচর ধরে হেঁটে প্রায় অদৃশ্য হবার পর্যায়ে চলে গেছে নৌকা থেকে নেমে যাওয়া যাত্রীসকল। পা চালালেন তিনি দ্রুত। বালুচর পেরিয়ে লোকালয় সীমায় এসে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বে তাকালেন। খাড়া মাথার ওপরকার কমলা-সাদা মেঘগুলো বিলীন হচ্ছে ক্রম ঘনায়মান অন্ধকারে। নাক বরাবর পুবাকাশে ক’টা তাঁরা ফুটেছে। এক সরু সড়কপ্রান্ত এখানে বালুচরের ঢালে মস্তক অবনত করতে করতে মিশে গেছে চরে।
পথের মাথায় একটা অনুচ্চ ন্যাড়া মাঁন্দারকাঁটার গাছে একজোড়া লম্বা-লেজ কালো পাখির টানা শিসের সাথে পুচ্ছ দোলানোতে কতক্ষণ দৃষ্টি ধরে রাখলেন তিনি। চোখ ধরে এলে পথ মাড়িয়ে এক বিস্তীর্ণ ফসলী বৃত্ত-চরের পথে পা ফেললেন। আগপিছ না তাকিয়ে হাঁটতে থাকেন তিনি। টানা চলতে থাকেন মিনিট বিশের মতো।
এখন তিনি চরের মাঝবিন্দুতে। জ্যামিতিক বৃত্তের ধারণা জাগল তার মনে। শরীর ঘুরিয়ে চারদিকে নজর করলেন একবার। যেন তিনি কাটাকম্পাস, এক পা বৃত্তের কেন্দ্রে রেখে আরেক পা ঘুরিয়ে আনলেন ব্যাস ছুঁয়ে। আসলে পা নয়, দৃষ্টি তার কাজ করল সেভাবে।
চারদিকে ধূসর অন্ধকার। মিনিট পনেরোর মতো হবে সন্ধ্যা নেমেছে। অন্ধকার পূর্ণ গাঢ়তায় রূপ নিতে আরো কিছুটা সময় নেবে। এর বিস্তৃতি বিশালতা তার মনকে উৎফুল্ল না করে অপ্রশস্ত ভারাক্রান্ত করে তুলল। শোনামতে, যেখানে তিনি দণ্ডয়ামান, একটা সময় সেখানে প্রমত্তা যমুনার স্রোত ছিল। এই বিস্তৃত সুবিশাল চর রেখে নদী সরে গেছে দূরে। বৃত্তের এই কেন্দ্রে ও চারপাশ জুড়ে ফসলী চর, স্থানেস্থানে বাঙ্গী, তরমুজ, চীনাবাদামের খেত, দূরে চারদিকে দৃষ্টির শেষ সীমায় ছাড়াছাড়া বাড়ির গ্রাম। গ্রামগুলো যেন ঝড়ে নুয়ে পড়া ঝাউমাথার মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে নিশ্চুপ।
এখন আধো অন্ধকার। এখানটা ফাঁকা জায়গা না হয়ে গ্রামবহুল, বৃক্ষবহুল জায়গা হলে হয়তো অন্ধকারের গাঢ়তর রূপই চোখে পড়ত। পা বাড়ালেন তিনি নিরুত্তাপ। অপরিবর্তিত পুবমুখী। গন্তব্য সোজা পুবের গ্রাম।
হাঁটার ফাঁকে থেকে থেকে থমকে দাঁড়ান তিনি। অন্ধকার জমে উঠতে থাকলেও এখনও নিশ্ছিদ্র নয়। তবু তিনি যেন দেখতে পাচ্ছেন স্থানেস্থানে গরুর লম্বা কিংবা রম্বসাকৃতির বাথান, অথবা মহিষ ছাগল, ভেড়ার। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলা ঝাঁকপাখির সমবেত ডাকে সম্বিতে ফেরেন তিনি। ভাবেন, নিছক মনের ভুল কল্পনা; এখন আর চরে কোনও গবাদিপশুর অস্তিত্ব নেই। রাখালেরা সূর্যাস্ত নাগাদ যার যার গ্রামের দিকে ফিরে গেছে সব গবাদির দলবল সমুলে নিয়ে।
দ্রুত হাঁটেন তিনি। হাঁটতে হাঁটতে বেশ কিছুদূর চলে আসেন। অদূরেই তার গন্তব্য চর-গাঁ বলদিয়া। হঠাৎই সামনের দিক থেকে গাছিয়ে পড়ে দু’জন মানুষ। গা খালি কিংবা তারা কালো। বিড়বিড় করে তারা, বায়া, আবার আয়া পড়লেন? আয়া ভালা করছেন।
হুম, আসলাম। কই যাচ্ছেন ?
উই যে তমরুজের খ্যাত পাহারা দেওন লাগব। খ্যাতে আবার রাইতবিরাইত না থাকলি চলে না।
চুরিটুরি হয় বুঝি ?
কী যে কন বায়া, পাহারা না দিলি তমরুজ কি খ্যাতে থাকব? হালার বায়েরা তমরুজের গাছ পন্ত চাবায়া খায়া ফালাব। চরের হালাগো কতা আর কী কমু? মাইনষের জাতইনা হালার বাই হালারা।
বলেন কী?
হে বায়ে, চরের লোহেগো কি আপনে বালা মানুষ ঠাউরায়ছেন? হালার বায়েরা আলি আলি চোর বাটপার আছে। থাকতে থাকতে ট্যার পায়া যায়বেন। সাবদানে যায়েন, বায়া। উইযে বালুর ডিবা, দুই হালার বায়ে বয়াবয়া বিড়ি খায়তাছে। যাইচা নিজের পরিচয় কয়েন। নয়লে ঠাবায়া বেবাক কিছু লয়া লয়ব আপনের।
জি, ঠিক আছে।
ঢিবিটা অদূরে উঁচু পেঙ্গুইনের মতো দাঁড়িয়ে আছে। বৈশাখের ভ্যাপসা গরম বালুচরে যে বিদঘুটে অস্বস্তি ছড়িয়েছিল, এতক্ষণে একপশলা ঠান্ডা-পুবাল হাওয়ায় যেন তার যবনিকাপাত ঘটল। চোখ বুজে দাঁড়িয়ে পড়লেন তিনি ঠায়। আঙ্গুল চেলে খুলে দিলেন শার্টের বুক বোতামজোড়া। বিড়ির ধোঁয়ার গন্ধে নাকে আচমকা ধাক্কা খেলেন তিনি। নাক চেপে ধরলেন ডান হাতে। দৃষ্টি সম্মুখে। উঁচু পেঙ্গুইনের গা ঘেঁষে দুটো শয়তানমূর্তি যেন গনগনে চোখে দণ্ডায়মান।
কতক্ষণ শ্বাস চেপে রাখা চলে? এবারে মুখ খুলে বাতাস নিলেন তিনি শ্বাসপথে। বাতাসের স্বাদটা অরুচিকর। ওদিক থেকে হাঁক ভেসে এলো, ও বায়ে, ক্যাডো খাড়ায়া ওইঠায়? কতা কন না কেরে? মূহের মধ্যে কি ঢিবলা দেছেন নাহি, বায়ে? ইয়া গুনছে মুহে। বিড়বিড় করল তারা।
ওডো ক্যাডো গো? চোরের বাই ডাহাইত আয়ছে নাহি, ও বায়ে–। ক্যাডো খাড়ায়া আছেন? চোর ডাহাইত না ওলি আয়া পড়েন জলদি । আয়া পড়েন। টিরিট টিরিট টিট টিরিট। টিরিট টিরিট টিট। কণ্ঠধরন পাল্টাল তারা।
ধীর পায়ে এগোতে থাকেন তিনি। শয়তান-চোখদুটো এখন নিভে গেছে। মূর্তি দুটো আছে। তিনি এতটা কাছে চলে এসেছেন যে বিড়বিড়ানো শোনা যাচ্ছে, দ্যাখছো এ্যাহন ক্যাডো? কবি এ্যাংকালে আয়া পড়ছে। এ্যাংকালে বালা বালা গপ ল্যাহে। আমগোর কতা কবে লেখপো? লেকপো কি?
কী কও তুমি? চরের হুমুন্দীগো কতা কী লেকপার কও? চরে মানুষ আছে নাহি? বেবাকই তো হালার চোর বাটপার।
কিন্তুক আমগো দুইজনার কতা? হেইতা লেকপো।
হালার বাই, কী কও তুমি? আমরাও তো হালার চোর, চইরা চোর। কী গপ আছে আমাগোর দুইজনার, কও দেহি?
উই যে তুমি আর আমি যে জরিনাক লয়া চরে হাডছি, নায় চইড়া বিরিজে গেছি, ফিরার পথে জরিনাক চুমা খায়ছি, হেই কতা লেকপো।
আরে ধূর হালার বাই, এই গপ লেকপার কওয়া যায়ব না। জরিনার বাপ পড়লি দুইজনাক জুতাপিডা করব। ছেমড়িডারও কফালে দুখ নামব- সোয়ামীয়ে অক তালাক ফালাব। ভুলেও এই কতা মাতায় আনবা না। বেবাক ভুয়লা যাও কয়তাছি।
বালুচরে মানুষ এদিক সেদিক এলোমেলো পা ফেলে চললেও চলতে পারে। কিন্তু পায়ের নিচের মাটি শক্ত না হলে হাঁটা সহজ হয় না। ফলে সব মানুষ নির্দিষ্ট রেখা বরাবর চলে, সে বরাবর বালি শক্ত হয়ে পথ তৈরি হয়। কবি-লেখক ফকির শাহ’র এ মুহূর্তের সেরূপ গন্তব্যপথটি চলে গেছে কথিত ঢিবির গা ঘেষে। অতএব, তাকে শয়তান-মূর্তি দুটির পাশ দিয়েই অতিক্রম করে যেতে হবে।
মৃর্তিদ্বয়ের বিড়বিড়ানো ফিসফিসানো থেকে কিঞ্চিৎ ভীতি-সংশয় জাগলেও দাঁড়ালেন না কবি ফকির শাহ। মন্থরতা আনলেন না পায়ের গতিতে। ঢিবি ঘেষতেই সরব হয়ে উঠল মূর্তিদ্বয়, সালামালেকুম কবি এ্যাংকাল, সালামালেকুম।
ওয়ালেকুম।
আবার আয়া পড়লেন চরে?
হুম।
আমরা তো ভায়বা বয়া আছি আপনেক আর চরে কুনুদিন নজরেই পামু না। তা এ্যাংকাল, আমগোর লয়া কি কুনুদিন গপসপ লেকবেন না?
হুম, চরের মানুষ নিয়েই তো লিখতে এসেছি।
কিন্তুক, আমগোরে দুইজনার কথা?
কী করেন আপনারা চরে ?
উই যে তমরুজ, বাঙ্গী, বাদাম চু-। থুক্কু।
হুম, বলে ফেলুন কী করেন।
এ্যাংকাল, আমরা হয়লাম যায়া ছিপনাওয়ের বাইছাল। নাও বাইছ কয়রা পাল্লা দেই, লাঠিবাড়ি খেলাই, নানান কামই করি।
কী লিখব আপনাদের নিয়ে?কোন বিষয়ে?
এ্যাংকাল, উই যে জরিনাক, থুক্কু।
এ্যাংকাল, তমরুজ খাবাইন? এইযে পাক্কা তমরুজ। ভিতরে গোলাপী রোঙ, একদম পাক্কা, ঢুপঢুপ! এইডো কালা তমরুজ না, কালা তমরুজের ভিতারে টুকটুকা লাল হয়া থাহে। কী কন, এ্যাংকাল? খায়া দেহেন এক চাহা। খায়লে ছুরি দিয়া ফালা ফালা কয়রা দিমু। কী কন?
চলি।
এ্যাংকাল, তালিপর লেকপেন না আমাগোর লয়া?
লিখব।
কী লেকপেন, জরি—– থুক্কু।
লিখব আপনারা খুব ভালো লোক। পথে রাতবিরাত বসে থাকেন, ক্লান্ত ক্ষুধার্ত পথিকদের ডেকে তরমুজ খাওয়ান।
Two men in the sand
Stolen watermelon in hand
Frighten away passers – by
Who scare and stand.
হুররে হু, ঠ্যাংখাউ এ্যাংকাল, ম্যালা ম্যালা ঠ্যাঙখাউ। ইংরাজি কবিতা লেইক্যা ফালায়ছেন।
তা কী নাম যেন দু’জনার?
এ্যাংকাল, হরমুজ আর খরমুজ।
বাহ্। চলি।
এগিয়ে চলেন কবি ফকির শাহ। তার গন্তব্য গাঁয়ে মাইক্রোফোনে এশার আযান উঠেছে। তিনি ভাবেন, চরের গাঁগুলো অসচ্ছল। অসচ্ছলতার মধ্যেও আযানের মাইক থাকে প্রত্যেক গাঁয়ে। খয়রাতি অর্থে খোদার ঘর মসজিদ তুলতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা থাকে না কারো। যাদের দু’বেলা ভালো আহার জোটে না, দলবদ্ধ নামাজের কাজটি তাদের ইটখোয়ার পাকা ঘরে না সেরে শন বা টিনের ঘরে সম্পাদিত হলে কী পাপ হবে তা একমাত্র বিধাতাই জানেন।
পেছনের হাঁকে ভাবনায় ছেদ পড়ে তার। একবাঁক চোখ ঘুরান তিনি। শয়তানমূর্তি দুটি থেকে একটি করে চোখ যেন জ্বলে উঠেছে আবার। মাইক্রোফোনের আযান সমাপ্ত হয়ে যাওয়ায় দ্বিতীয় হাঁকে মূর্তিদের বাক্যবাণ স্পষ্টতর কানে ওঠে তার, কবি এ্যাংকাল, যান গিয়া। গুলফাত মিয়ায় বাড়িত নাই, ফুর্তি করেন যায়া।
আন্ধারি রাইত, কেডো দেখবো আপনে আয়ছেন। কী ফুর্তি!
কুইঙ্গিতপূর্ণ কথা, কুলোকের যা ভাবনা স্বভাব। গুলফাত মিয়া তার ফুঁপাত ভাই। একটা সময় মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল। মুল বাড়ি তথা গাঁ নদীগ্রাসে যাওয়ায় চরে ওঠা জমিতে এসে বাড়ি করেছে। সেও একযুগ।
ফুঁপাত ভাইটি তার চেয়ে বয়সে ঢের ছোট। যুবতী স্ত্রী তার, দেখতে সুশ্রী। তিনি তাকে নিজ বোনের চোখে দেখেন। ভাইয়ের মেয়েটি স্কুলপড়ুয়া। তাকেও নিজ মেয়ের মতো গণ্য করেন। লেখার স্বার্থে তার ওখানে এসে থাকা ঘিরে নিচুমনের লোকদের ফোসফাস আছে। কু-চিন্তাচেতনার বহিঃপ্রকাশ আগেও তিনি কিছুটা আন্দাজ করেছেন; আমলে নেননি। আজ অনেকটাই স্পষ্ট হলো; আজও আমলে নিচ্ছেন না তিনি। নিজেকে নিজে তিনি ভালো চেনেন, জানেন- এটিই তার কাছে সবচে’ বড় কথা। এগিয়ে চলেন তিনি। গন্তব্য আর মিনিট দশেকের পথ।
দুই
গাঁয়ের এ অংশের বিস্তৃতি উত্তর-দক্ষিণে। পুব-পশ্চিমের বাড়িগুলো গাঁয়ের প্রস্থসীমা তৈরি করে আছে। কবি ফকির শাহ’-র গন্তব্য-বাড়িটি প্রস্থসীমা বাড়িগুলোর পশ্চিমের শেষ প্রান্তে। উত্তর-দক্ষিণ দৈর্ঘ্য রেখার মাঝামাঝি। বাড়ির বাইর অর্থাৎ পশ্চিম গা ঘেঁষে পথ চলে গেছে উত্তর-দক্ষিণে। মসজিদে ফরজ নামায শেষ করে নিজ নিজ বাড়িমুখো হওয়া লোকেরা পথ ধরে চলে যাচ্ছে। তিনি বাড়ির প্রবেশদ্বারে পৌঁছতে পৌঁছতে পথটি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। বাড়ি বলতে দুটো টিনের ঘর। বড় ঘরটি উত্তরমুখো, পেছনের জামগাছটি বালুমাটির গাছ তুলনায় বেশ সুস্বাস্থ্য নিয়ে অস্তিত্বমান। পুব প্রাচীরের গাছগুলো বালুমাটির মতোই খরখরে। ক্ষীণ ডালপালা-অঘন-পত্রপল্লভ। দ্বিতীয় ঘরটি দক্ষিণমুখো, অপেক্ষাকৃত ছোট। গোয়ালঘর কাম ছোট্ট কাছারি। পেছনে কলার ঝোপ। উঠানের পেয়ারাগাছটা ডালপালাহীন মাথাবহুল; প্রয়োজনের তুলনায় লম্বা ও সরু।
ভেতরে বাতি নেই, বাসিন্দারা ঘুমিয়ে গেছে নিশ্চয়ই। ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে গেটে দাঁড়িয়ে মিনিট খানেক হাওয়া নিলেন কবি । একটু চাঙ্গা হয়ে কড়া নাড়লেন নলখাগড়ার বেড়ার গেটে। ভেতরের দক্ষিণ ঘর থেকে পরপর দুটি কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ক্যাডো? কড়া লাড়ায় ক্যাডো?
আম্মা, ক্যাডো? বাজান কি ফিরা আয়লো?
উত্তর দেবার প্রয়োজন মনে করলেন না কবি। শুধু চেনা শব্দে গলা খাঁকরালেন একবার। ভেতর থেকে উচ্চারিত হলো, গেদি, কবি বায়ে আয়ছে।
কবি কাক্কা?
হুম।
ঘরে বাতি জ্বলে ওঠার সাথে সাথে খুট করে দরজা খোলার শব্দ হলো। হারিকেন হাতে উঠান পেরিয়ে এলেন যুবতী। গেট খুলে কবিকে সালাম ঠুকলেন। তার মাথায় ওড়নার ঘোমটা। চোখে বিস্ময়। অস্ফুট সালামের জবাব করলেন কবি। যুবতী প্রশ্ন করলেন, বায়জানের কি শরীল খারাপ হয়েছে?
নাহ।
বাসার সপ ভালা আছে? গ্যাদাগেদিরা, ভাবী, আম্মাজানে?
হ্যাঁ, সব ভালো আছে? তোমরা কেমন আছো?
খোদায় রাখছে ভালা।
তা গুলফাতের কী খবর?
হ্যাতে বাইত্তে নাই, কলা, বাঙ্গি আর তরমুজ লয়া সদরে গেছে। ব্যাবাকটি বেইচা শেষ করবার পারে নাই, বেইচা শেষ কয়রা কাইল ফিরা আয়বো?
কথা বলতে বলতে হেঁটে উঠান পেরোলেন তারা। পেয়ারাগাছটার নিচে এসে দাঁড়ালেন কবি। বললেন, কাছারিতে কি তালা?
হে বায়জান, তালা, খুলুমনি পরে। ঘরে যায়া খায়াদায়া আহেন আগে। আমি আতমুক ধোওনের পানি আনতাছি।
আমার ক্ষুধা নেই। বন্দর থেকে খেয়ে এসেছি। টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে আসতেছি। তুমি কাছারির তালাটা খুলে দাও। একটা গ্লাস দিলে ভালো হত।
বায়জান, ঘর থেইকা জগ গিলাস কাছারিত লয়া আয়তাছি। আফনে আতমুক ধয়া আয়েন।
হুম।
কাছারিতে হারিকেন দেয়া হয়েছে। কবি টিউবওয়েল থেকে হাতমুখ ধুয়ে এসে হেলনা বেঞ্চিতে বসলেন। এশার নামাজ সমাপ্ত করা মুসল্লিরা বারপথ ধরে বাক্যালাপে হেঁটে যাচ্ছেন। কাছারির পার্টিশনের ওপাশটা, অর্থাৎ মূল ঘরের দুই তৃতীয়াংশে থাকা গোয়ালে গো-মহিষের বিচিত্র শব্দপাত। বার দুই হাম্বা ডেকে উঠল একটা বাঁছুরগরু। বৈশাখে ঝড়বৃষ্টি সময়সময় থাকলেও এসময়টা টানা খরার। আকাশে মেঘের ছিটেফোটা নেই। কাছারির খোলা দরজায় তাঁরাখচিত দক্ষিণাকাশ চোখে পড়ছিল কবির। পুবাল হাওয়া খানিকটা জোরালো। এমন হাওয়া দীর্ঘক্ষণ বইলে পশ্চিম থেকে ঝড়বাদলা উঠে আসার সম্ভাবনা থাকে।
শরীরের ক্লান্তি খানিকটা দূর হওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন কবি। দরজায় দাঁড়িয়ে তাল সমান উঁচু বেড়ার ওপর দিয়ে দৃষ্টি তুলে পশ্চিমাকাশটা দেখে নিলেন। শুধু ঈশান কোণে দুখণ্ড সাদাটে মেঘ জলরঙ ছবির ক্যানভাসের মতো তার চোখে পড়ল। তারই গা ঘেঁষে থেকে থেকে মৃদু বিদুৎ চমকাচ্ছে। কিছু লিখতে শুরু করবেন কি-না ভাবলেন তিনি। ওঘরের আলো এখনও নেভেনি। দরজাটা খুলে গেল মৃদুশব্দে। যুবতী দাঁড়ালেন দরজায়। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললেন, বায়জানের কি কিছু লাগব আর? কাগজ? কলম?
না না, এমনি দাঁড়িয়েছি আমি। তোমরা ঘুমিয়ে পড়ো। কাগজ কলম দুটোই সঙ্গে আছে।
ভাবলাম, আপনের কিছু দরকার পড়ল কি না। আমরা ঘোমাই নাই অহনও। গেদি পড়তাছে।
ঘুমাও তুমি।
বাঁছুরডো দুইদিন ধয়রা জ্বালাতন করে। মইষজোড়া কি ভায়বা থাইক্যা থাইক্যা ফাল পায়ড়া উঠে। হে বাড়িত থাকলি দেখবার পারত কী সমেস্যা।
আচ্ছা, ঘুমাও তোমরা।
হে, বায়জান।
খুঁট করে আবারো দরজা বন্ধ হলো। কবি কাগজকলম হাতে নিলেন। লিখলেন ক’ লাইন:
এই চর বিস্তৃত বালুকার চর
চর নিবাসী যত মানুষেরা
সারি সারি খেত বাদাম তরমুজ বাঙির
আছে গোমহিষাদি ভেড়া ছাগলের দল।
হঠাৎই ওঘরের টিনের ওপর ধুপ করে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলে লেখা থামিয়ে সচকিত হলেন তিনি। নিমিষে আরো একটা শব্দ হলো তার আশ্রয় নেয়া কাছারির চালে। সন্দিহান হলেন তিনি। ভাবলেন, কিসের শব্দ। ওঘর থেকে যুবতী চেঁচালেন, বায়জান, ডরায়েন না, ওডো ডর পাওনের কিছু না। একটো নোঙর আছে মাতার উফুরকার গাছে। রাইতের বেইল গাছ থেইক্যা চালের উফর ফাল দিয়া পড়ে।
কবি লেখা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা ধরলেন। কিন্তু ঘুম নামছে না চোখে। একে তো গরম, তার ওপর গো-মহিষাদির নানা শব্দপাত-ফোসফুস, চটচাট, খটখট, থপথপ, শ্রিপ শ্রিপ- দুর্গন্ধ, সব মিলিয়ে ঘুম নির্বাসনে পাঠানোর জন্য যথেষ্ট। এটা যে আজই নতুন তা নয়, মাঝেমধ্যেই এমনটি হয়। আসলে যেদিন ঘুমের চাপ প্রবল থাকে, সেদিন এসব সমস্যা কোনই ব্যাঘাত সৃষ্টি করে না, যেদিন শরীরবৃত্তীয় তথা মনোবৃত্তীয় কারণে ঘুমে সমস্যা তৈরি হয়, সেদিনই গোয়ালঘরের এ সমস্যাগুলো প্রকট হয়ে অনুভূতিতে আটকে যেতে থাকে। শরীর মনে চাপ পড়ার মতো চলক এরই মধ্যে তো বেশ তৈরি হয়ে গেছে। পথে শয়তানমূর্তির আচরণকে নেহায়েত তুচ্ছ করা চলে না। তার ওপর যুবতীর ঘরের দু’চালে হওয়া শব্দপতনকে লাফাঙ্গা প্রাণী নোঙরের করা শব্দ ঠাউরালেও কবির মনে তা নানাবিধ বিষয়ে সংশয়ের কারণ হিসেবে জেগেছে।
দুই ঘরের মধ্যবর্তী যে দূরত্ব তথা উঠান, এক চাল থেকে আরেক চালে লাফিয়ে পৌঁছাবার মতো শক্তি পৃথিবীর কোনও নোঙর প্রাণী রাখে বলে তার কাছে মনে হয়নি। এ একেবারেই অসম্ভব-অবিশ্বাস্য। তার কেবলই সন্দেহ হচ্ছে পথের ওই দুই শয়তানমূর্তির ওপর। এ নির্ঘাৎ তাদেরই কুটকাজ। তাছাড়া আর কার হতে পারে?
মাঝরাতের পর আচমকা ঘুম ভেঙেছে কবির। প্রতিরাতেই মাঝপথে এমন ঘুম ভাঙে। তিনি খোলা কিংবা বোজা চোখে চিৎশোয়া চর নিয়ে অনেক কিছু ভাবেন-ধূধূ চর, খেতখামার, গো-মহিষ ছাগল-ভেড়ার অজস্র বাথান, ছাড়া ছাড়া গাঁ, গ্রামবাসী- তাদের জীবনাচার। দূরে নদী, নৌযান, পাখির ঝাঁক। সূর্য, চন্দ্র, মহাকাশ, অনেক কিছু, অনেক ভাবনা। কিন্তু আজ ঘুম ভাঙার পর কোনও ভাবনা যেমন তার হলো না, তেমনি হলো না শুয়ে থাকার অবকাশও। ত্বরিত উঠে বসলেন তিনি বিছানায়। কখন ঝড় সৃষ্টি শুরু হয়েছে কালবৈশাখীর প্রবল তাণ্ডব। বাইরে চারদিকে ভূমি থেকে উর্ধ্বাকাশে অদ্ভুত শব্দ তোলপাড় কানে উঠে তামাম অস্তিত্বে অভিনব ঘোর তৈরি করছে। এ চরে তিনি এসেছিলেন গেল শীতে। বৈশাখে রাত কাটালেও ঝড়ের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। চরে ঝড়বাদলের শব্দ বুঝি এমন অদ্ভুত হয়। গাছপালাহীন চরের ওপর দিয়ে পশ্চিম থেকে বয়ে আসা দুর্দাম হাওয়া এখানে এসে প্রথম বাধা পাচ্ছে বাড়ির বার প্রাচীরে, দ্বিতীয় পর্যায়ে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ভেতরের ঘর দুটিতে, স্বল্প সংখ্যক গাছপালায়। প্রবল ঝটকায় মাঝ উঠানের পেয়ারা গাছটির ঘাড় মটকে গেল বুঝি। পেছনের ও পুবের কলাবনের বাতাস সম্পূর্ণ ভিন্ন শব্দ দিচ্ছে। গোহালের গরুগুলো প্রথমত নিশ্চুপ থাকলেও বিজলির চমকের সাথে প্রচণ্ড বজ্রশব্দে হাঁকডাক করে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে তারা। প্রতি মুহূর্তে কবির আতঙ্ক হচ্ছে -এই বুঝি মাথার ওপরকার চাল এক ঝটকায় উড়ে গেল। বুঝি তাকেও উড়িয়ে নিয়ে আছড়ে মারার পরিকল্পনা হচ্ছে। অথবা ঘর দুটির কোনওটিতে বাজখাই শব্দে বুঝি আছাড় পড়ল ঠাঠা।
কবি ভাবছেন, তিনি চিরাচরিত দেখেছেন রাতে ঝড় হলে আগে মনুষ্য-মেঘের হাঁকডাকে তার ঘুম ভাঙে, যদি ঘুমন্ত অবস্থায় তা ঘটে। মেঘের মানুষের হাঁকডাক প্রথমে মৃদু থেকে শুরু হয়ে প্রবলতর হয়ে থাকে। আজ কখন যে সেসব পর্ব গেছে তার কিছুই তিনি জানেন না। সারাদিনের কর্মক্লান্তির এই চিরফল- রাতে অবধারিত বিভোর ঘুম। হঠাৎই ঘোর কেটে সচকিত হলেন তিনি। বৃষ্টি বাতাস খানিকটা দম নেয়ার পথে। এমতাবস্থায় মাথার ওপরকার চালে শুরু হল ঢুপ ঢুপ শব্দ। ওপর থেকে ইটপাথরের খণ্ড পড়ার শব্দের মতো। প্রথমে তিনি ভাবলেন বৃষ্টি কমে শিলাবৃষ্টি শুরু হয়েছে বুঝি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই শব্দের ধরণ পাল্টে অন্য রকম হলো, মনে হচ্ছে না এ শিলা পড়ার শব্দ। তিনি লক্ষ্য করলেন শব্দগুলো ওঘরের চালেও হচ্ছে। আকস্মিক এমন দুটো শব্দ প্রায় একযোগে দু’ঘরের চালে হলো যেন মনে হলো খেলাধুলার ছোটখাটো লৌহগোলক ওপর থেকে চালে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এবারে তার সন্দেহ ঘনীভূত হতে লাগল। কোনও মনুষ্য-কারসাজী, মনুষ্য-কুটকাজ কি ? তাকে তাড়াবার, ভয় দেখাবার কোনও ফন্দি, সাথে ও ঘরের নিরীহ প্রাণীদুটোকে ভয় দেখিয়ে অনৈতিক বিনোদন নেয়া।
কিশোরী মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী। হয়তো চোখ পড়েছে কোনও চরদানবের। ওই দুই তরমুজ দানবই কী? হরমুজ আর খরমুজ? কে জানে, কে বা কারা নেপথ্যে?
এখন শুধুই বৃষ্টির সাথে মাঝারি বাতাস বইছে। সাথে এলেবিচ্ছিরি বিজলির চমক ও ঘনঘন বজ্রপাত। খানিকটা আশ্বস্ত হয়েছেন কবি। এখন আর মাথার ওপরের চাল উড়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। শুধু বজ্রাঘাত না হলেই হলো। হারিকেন জ্বাললেন তিনি। তখনই ও ঘরের দরজা থেকে ডাক ভেসে এলো, রায়জান/ কবি কাক্কা।
হ্যাঁ।
ডয়ায়েন না। ঝড় চয়লা গেছে।
না না, ভয় পাচ্ছি না। তোমরা সাবধানে থাকো।
আইচ্ছা, ঠিক আছে।
আবারো দু’চালে গোলক পড়ার মতো শব্দ হলো। ওঘর থেকে শব্দ ভেসে এলো, বায়জান, ডরায়েন না। চালে গাছের ডাইল উইড়া আয়া পড়ছে।
না না, ভয় পাচ্ছি না। তোমরা শান্ত থাকো।
কবি ভয় না পেলেও মহাচিন্তিত হলেন। দুর্বৃত্তরা যে আজ গৃহকর্তার বাড়িতে না থাকা ও ঝড়-এ দুয়ের সুযোগ বেছে নিয়ে অপকাজ চালাচ্ছে, তাতে সন্দেহ নেই। কে জানে এ নিয়ে তাদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা কী? কতদূর এগোবে তারা, কোন নিকৃষ্টতায় তারা তাদের লালসা চরিতার্থে প্রবৃত্ত হবে, তা কে জানে? এখন বৃষ্টি মুষলধারে রূপ নিয়েছে। কবি বৃষ্টির শব্দে কান পেতে বিছানায় মিইয়ে রইলেন। শীঘ্রই তলিয়ে গেলেন অতল ঘুমে।
শওকত নূর | Shawkat Noor
100 questions and answers about Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে প্রশ্ন ও উত্তর
Shankhakshetra Puridham and Madala Panji | শঙ্খক্ষেত্র পুরীধাম ও মাদলা পাঁজির রাজবৃত্তান্ত
Anabasarakalina besha of Jagannath | অনবসরকালীন বেশ | অভিজিৎ পাল
19 types of Mashan Thakur | মাসান ঠাকুর | Ranabir Chanda
Bengali Novel Online Reading | Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online 2023 | New Bengali Novel Online Reading | Bangla Upanyas Online Read | Read Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online pdf | Download Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online Series | Shabdodweep | Sabuj Basinda | High Challenger | Shabdodweep – Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online – Joynal Abedin | Bangla Upanyas Online Show | Shabdodweep Writer | Shabdodweep Novel Writer | New Bengali Novel | Bengali Novel Online Reading in PDF | Free Novel Download | Top Bengali Novel | Famous Bengali Writer | Best Selling Bengali Story | Pratilipi Story | StoryMirror Story | Bangla Upanyas Online Book | Sabuj Basinda Website | Top Bengali Writer | High Challenger Motivational Blog | Full Story in Bengali | Bengali Story Reader | New Bengali Story 2023 | Bangla Galpo | Natun Bangla Galpo | Natun Bangla Galpo 2023 | Story Writing Competition | Bengali Novel Online Reading 2024| Writing Competiton 2023 | Shabdodweep Bengali Novel Online Reading | Full Web Stories | Bangla Galper Series | Bengali Novel Online Reading in Netflix Bangla | Download Bengali Novel Online Reading | Bengali Story in USA | Bengali Novel Online Reading in Bangladesh | Indian Bengali Story | Google Bengali Novel Online Reading | Search Bengali Novel Online Reading | Sera Bangla Galpo | 18+ Online Bangla Novel Reading | Adult English Story | Adult Bengali Story | Adult Bangla Galpo | Bangla Upanyas 2023 | Natun Bangla Upanyas | Shabdodweep Upanyas | Shabdodweep New Novel | Attractive Bengali Novel Online Reading | Attractive Bengali Story | Bengali Novel Online Reading Collection | Bengali Story Collection | Story in Bangla | Bangla Galper Episode | Bengali Novel Online Reading Episode | Shabdodweep Forum | Shabdodweep Story Collection | Bengali Web Novel APK | Bengali Web Novel Website | Bengali Literature | Bengali Novel Online Reading in Audio Platform | Bengali Novel Online Reading Audio Book | Bengali Novel Online Reading Series
গ্রাম বাঙলার মৌখিক এই ভাষা আজকাল অনেকেই বুঝবে না। রচনার কারুতে লেখা মায়াবী হয়ে উঠেছে।