Pancha Byanjan | পঞ্চব্যঞ্জন | জয়ন্ত কুমার সরকার | রম্যরচনা | 2023

Sharing Is Caring:
Pancha Byanjan

পঞ্চব্যঞ্জন – জয়ন্ত কুমার সরকার [Pancha Byanjan]

কোন কোন কথা, কোন কোন সুর কখনও ভোলা যায় না, মনের গভীরে অবচেতন স্মৃতিতে অমলিন থেকে যায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। তখন, ছেলেবেলা, কাজ করতে করতেই মা গুনগুন করে গাইতেন পুরানো দিনের নানা গান। রেওয়াজ করা গলা নয়, কিন্তু বেশ সুরেলা লাগত তখন, মায়ের গলায় গান শুনতে শুনতেই মুখস্থ হয়ে যেত গানের প্রথম কলিগুলো। তপু, আমার সবচেয়ে ছোট ভাই,কোলের ছেলে বলে মায়ের পিছু পিছু ঘুরত আর মায়ের সাথেই গুনগুন করে গাইত। মায়ের গানের সুরে করুণ আর্তি, নি:শর্ত আবেদন! বিমোহিত হয়ে শুনতাম, ‘‘আমার সাধ না মিটিল আশা না ফুরিল, সকলি ফুরায়ে যায় মা….” কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্যের লেখা পান্নালাল ভট্টাচার্যের দরদী গলায় গানের কথাগুলোর কি গভীর ব্যঞ্জনা, কি আবেগ, সর্বশক্তিমানের কাছে নিজেকে সমর্পণের কি গভীর আকুতি, সংসারের মোহ থেকে মুক্তি আর কালিমা মুছিয়ে দেওয়ার কি করুণ আর্তি গানের প্রতিটি লাইনে, প্রতিটি ছন্দে। মায়ের সুরে সুর মিলিয়ে ওর আধো গলায় গানের কথাগুলো আজও আমার বুকে বাজে, হৃদয় মুচড়ে দেয়, কান্না দলা পেকে যায় বুকে। তখন অভাবের সংসারে ছেলের আবদার পূরণ করতে না পারার ব্যথাটা যেন মায়ের গানে কান্নার আকারে ঝরে পড়ত। ভাবতাম বড় হয়ে ভাইটার সব আবদার পূর্ণ করব। কিন্তু নাঃ! সাধ অপূর্ণই থেকে গেল। শ্রাবণের এক অভিশপ্ত সন্ধ্যা, আগের রাত থেকে অবিশ্রান্ত বর্ষণে মাঠ-ঘাট পুকুর জলে থৈ থৈ। পাশের পুকুরটায় জল টইটুম্বুর। এক প্রতিবেশী নিজের বাড়ি তৈরীর মাটি নিয়েছিল চৌবাচ্চার মত অনেকটা জায়গায়। বৃষ্টির জলে অন্য খালডোবের সঙ্গে ওটাও ভরে উঠেছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়স, লম্বা হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, আমার আদরের ছোট ভাই, এখন বেশ স্পষ্ট মনে আছে মুখের আদল, কোঁকড়া একমাথা চুল, হাসি হাসি মুখ ভাইকে কেড়ে নিয়েছিল ওই পুকুর, যে পুকুরের পাড়ে আমাদের বাড়ি। মায়ের কোল শূন্য করে চলে গেল, শুধু হাহাকার আর কান্না সম্বল হয়েছিল মায়ের। সেই থেকে মায়ের কান্না প্রায়ই গানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেত, ভাইয়ের শোকে মা পাগল প্রায়, এক বুক ব্যথা চেপে রেখে আমাদের লালন করতেন আমাদের বাবা । আমাদের বুঝতে দিতেন না, কত বড় শোক, কি বিষম যন্ত্রণা বুকের মধ্যে পালন করছেন ওঁরা। অনেক চড়া্ই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে কেটে গেছে জীবনের অনেকগুলো অধ্যায়। মা চলে গেছেন কয়েকবছর হল, বাবা তার আগেই । রেডিওতে গানটা শুনলে এখনও বুকে বাজে মায়ের গানের সেই আর্তি, সেই আকুতি, ভাইয়ের সেই নিষ্পাপ মুখ আর মায়ের করুণ চোখ।

ভুলের ভেলকি

সক্কালবেলা মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল, সবে মুখ ধুয়ে টেবিলে চায়ের অপেক্ষায় বসেছি, রান্নাঘরের ওপ্রান্ত থেকে ঝনঝনে গলা ভেসে এল, বলি বেলা তো অনেক হল, এবার দয়া করে বাজারে যাও। এরপর কখন বাজার আসবে, বেলা যেন ছুটছে, আমি রাঁধব কখন, দশটায় ভাত দিই কি করে, আমার হয়েছে যত জ্বালা! একটানা বেজে থেমে গেল। আমি অনেক কষ্টে ধৈর্য নিজেকে শান্ত করলাম। এখন বুঝতে পারি বয়স হচ্ছে, রাগ পুষে রাখতে নেই, রাগ আদতে ক্ষতিই করে। উত্তেজনা রক্তচাপ বৃদ্ধি করে,মাথাব্যথার করণ হয়, মাত্রা ছাড়ানো রাগ মারাত্মক ক্ষতি করে মানুষের শরীরে। ইনসেমিয়া, অ্যাংজাইটি, হাট-অ্যাটাকের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। এসব সাত-পাঁচ ভেবে ঠিক করে ফেললাম, যতই মারকাটারি গলা হোক, ভাবছে তো সে আমারই জন্য; গলায় সুধা ঝরিয়ে বললাম, সকালবেলা বাজার তো যাবই, একটু চা-টা দিলে হত না! শ্রীমতী খটমট করে এসে চায়ের কাপ নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। বলি, কি আনতে হবে বল! রান্নাঘরের ও প্রান্ত থেকে উত্তর এল, চচ্চড়ির পালং আনবে, ফুলকপি এনো না, কাগজী আনবে, কাঁচকলা একটাও নয়, বেগুন বড় দুটো, গাজর আছে, পেঁয়াজ ১ কেজি, কাঁচালঙ্কা ১০০ গ্রাম, টমেটো এনো না, পিড়িং শাক এনো,মোচা এনো একটা, সীম নয়, বিন এনো, আর…….। শুনলেন তো, কি আনতে হবে না বলে পুরো ফর্দটা এক নিঃশ্বাসে ঝেড়ে দিল। বাজারে গিয়ে যা হবার তাই হল। অনেকগুলি দরকারি জিনিস ভুলে গেলাম, বাড়তি কিছু জিনিস নিয়ে এসে গৃহিণীর রাগের কারণ হলাম, ঝাড় খেলাম।

মানুষের স্মৃতি বড় দুর্বল, তাই সন্তান শোক ভুলেও মানুষ নতুন করে বাঁচার পথ পায়। ভুলে যাই বলেই সংসার বাঁচে। আসলে সময় অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয় ; অন্যায়ের প্রতিশোধ স্পৃহা অহরহ জাগরিত থাকলে খুনোখুনিতে পৃথিবী ধ্বংসস্তূপে পরিণত হত। কিছু ঘটনা ভুলে যেতে হয়। ভালবেসেই মানুষকে আপন করা যায়, হিংসা দিয়ে নয়। এটাই আমাদের দেশের সনাতন শাশ্বত বাণী । বয়স বাড়লে স্মৃতিভ্রংশ হয়। ভুলে যাওয়াটা রোগে দাঁড়ায়। বয়স্ক মানুষটি অনেক কিছু ভুলে যান, খেয়ে মনে পড়ে না, বাড়ি ভুলে পড়শির দরজায় কড়া নাড়েন, আত্মীয়-বন্ধু চিনতে পারেন না। আবার ভুলের মাশুলও গুনতে হয় সময় বিশেষে। তবুও আবার ভুল হয় আর ভুলের ভুলভুলাইয়ায় মানুষ ঘুরতেই থাকে।

আসলে ভুলে যাওয়াটা আসলে আমাদের মত গড়পড়তা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। |সব কিছু নিখুঁত মনে রেখে সঠিক সময়ে সব কাজ সামলানো খুব লোকই পারে, এক্ষেত্রে গরীব দিনমজুর থেকে টপ এক্সিকিউটিভ সকলে একই গোত্রে পড়বে। কিছু আপনভোলা মানুষ আছেন যাঁরা তাঁদের নিজস্ব ভাবনার রাজ্যে প্রায়ই হারিয়ে যান, ভুলে গিয়ে উল্টো-পাল্টা কাজ করে বসেন। ভুল করে অন্যের বাড়িতে ঢুকে পড়েন; রিকশা ডেকে আনছি বলে স্ত্রীকে বসিয়ে রেখে একাই বাড়ি ফিরে এসেছেন….এরকম কত গল্পই শোনা যায় লোকমুখে; এই সব ভুল স্বাভাবিক, নিজের ইচ্ছেয় হয় না। সাংসারিক দৈনন্দিন জীবনে অনিচ্ছায় ঘটে যাওয়া ভুলগুলি পরে শুধরে নেওয়ার সুযোগ থাকে ; আবার শর্টটার্ম মেমরি লস অর্থাৎ সাময়িক স্মৃতি বিভ্রম মানুষের জীবনের মোড়টাই ঘুরিয়ে দিতে পারে । একেবারেই স্মৃতিলোপ পেয়ে অন্য মানুষ। স্মৃতি বরাবরের জন্য হারিয়ে গিয়ে ক্ষ্যাপামি থেকে পাগল হয়ে যায়, ভীষণ কষ্টকর এই জীবন; যা ব্যথিত করেছে আমাদের। কিন্তু কিছু ভাল থাকে, যা সংশোধনের সময় পেরিয়ে গিয়ে থাকলে আর সংশোধন হয় না, এই ভুলের খেসারত দিতে হয়, চরম ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়, জীবনও চলে যেতে পারে। রঙিন নেশায় আসক্ত মানুষ চরম ক্ষতির মুখোমুখি হয়, তখন ফিরে আসার উপায় থাকে না, শরীর ক্ষয় হতে হতে মৃত্যু হয় ; জীবন দিয়ে ভুলের মাশুল দিতে হয় ; এই নেশা চরম সর্বনাশা ; ভুল করেই নেশাগ্রস্ত হয়, তখন নেশার জিনিষ না হাতে পেলে সংসারের চরম ক্ষতি, খুনোখুনি, মারধোর কোন কিছুই বাদ যায় না; মেয়েদেরই এই ঝক্কি সামলাতে হয়, কারণ ঘর সামলায়, সন্তান প্রতিপালন তো বাড়িতে থেকে মায়েদেরই করতে হয় ; ভুল করে একজন, আর সেই ভুলের মাশুল দেয় তার পরিবার; এজন্য প্রমীলাবাহিনীই মদের ঠেক ভাঙতে দল বাঁধে।

সেদিন চৈত্রমাস

তখন বিষ্ণুপুর থেকে তালডাংরা রুটে বাস ধরতাম। রোজ একই বাসে বন্ধু সুরেশও যেত; বসন্তের রঙিন ছোঁয়া সুরেশের জীবনে লাগল কিনা তাই নিয়েই কথা আজ বসন্তের মধুমাসে। রোজ বাসে ছয়-সাতজন আমরা। কালিসেন-চৌকিমুড়া স্টপেজ থেকে স্কুলের ছেলেমেয়ে, কলেজ পড়ুয়া তিন-চারটি মেয়ে রোজ বাসে উঠত। মেয়েগুলির কলকলিয়ে কথাবার্তা, খিলখিল হাসি বেশ ভাল লাগত, আমরা ওদের সারল্যে মুগ্ধ হতাম, এদের মধ্যে একজনকে চোখে পড়ার মত, ফর্সা, দোহারা মেয়েটি, সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকত। টুকটাক কথায় জেনেছিলাম ওরা সারদামনি গার্লস কলেজে পড়ে। হঠাৎ একদিন লক্ষ করলাম, সুরেশের সঙ্গে ঐ মেয়েটির চোখের ঈশারা চলছে । প্রথমে গুরুত্ব দিইনি, পরের দিন খেয়াল রাখলাম, চৌকিমুড়ায় মেয়েটি বাসে উঠেই সুরেশকে দেখে একটু মুচকি হাসল, চোখের ইশারায় কিছু বলার চেষ্টা চলছে। আমি যে দেখছি, বুঝতে দিই নি। একদিন দেখলাম টুকটাক কথাবার্তাও হচ্ছে, বোঝা গেল রঙ লেগেছে ওদের মনে, মেয়েটির চোখে খুশীর ঝলক। আমরা হালকা ইয়ার্কি শুরু করলাম। ওদের মন তখন বসন্তের ছোঁয়ায় পলাশ লাল। সুরেশই একদিন আমায় বলল, ও নন্দিনীকে ভালবাসে, ওরা বিয়ে করতে চায়। কিন্তু নন্দিনীর বাড়ি রাজি নয়। আমি ধৈর্য ধরতে বললাম। পরের কয়েকদিন অসুস্থতার জন্য অফিস যাইনি। সেদিন বাসে সুরেশকে দেখতে পেলাম না, চৌকিমুড়ায় মেয়েটিকেও দেখলাম না। সহপাঠিনীরা জানাল, নন্দিনী কোন আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছে। খোঁজ নিলাম,সুরেশও বাড়িতে নেই। ব্যস, আর কোন খবর নেই! বেশ কয়েক বছর পর সুরেশের সঙ্গে দেখা, জানলাম, নন্দিনীর অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। সুরেশ রামকৃষ্ণ ভাবধারায় দীক্ষিত হয়ে আশ্রমে থাকে, অন্য এক জীবনের খোঁজ পেয়েছে সুরেশ। ভাল লাগল ওর কথাবার্তায়। বসন্তের ছোঁয়া না পেয়েও সুরেশ এখন ভাল আছে।

হাসিতে-খুশীতে

হাসিতে-খুশীতে থাকতে কে না চায়, যেমনই চেহারা হোক না কেন, হাসলে সকলকেই দেখতে সুন্দর লাগে, হাসলে মন ভাল থাকে, কাজে উদ্দীপনা পাওয়া যায়, হৃদপিন্ড সহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল থাকে; সকালে রাস্তায় বেরিয়ে কারোর সঙ্গে দেখা হলে হালকা করে হাসুন, দেখুন সে-ও উত্তরে হাসবে, সারাটা দিন ঐ অনুভূতিটা আপনার ভাল লাগবে। মন খারাপ কার না হয়, মন খারাপ বা না হাসা কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, তাই চাহিদা কমাতে হবে, অল্পে খুশী থাকার চেষ্টা করতে হবে, যতদিন জীবন আছে খুশীতে বাঁচার সংকল্প করতে হবে, আর খুশীতে বাঁচতে গেলে চাওয়া পাওয়া কমাতে হবে, বেশী চাইলেই সমস্যা। জীবনে যা পেয়েছি তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা, সমস্যা হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে একটা একটা করে সমাধান করা, মেডিটেশন করা, পরিবারের সঙ্গে বেশী করে সময় কাটানো, বাবা-মার কাছে পুরানো দিনের গল্প শোনা… এসবই হোল খুশীতে থাকার উপায় আর খুশীতে থাকতে গেলে অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেই হবে, নইলে নিজের অজান্তেই ব্লাড সুগার, প্রেসার কোলেস্টেরল আপনাকে বিপাকে ফেলবেই।

সংসারে সম্মানের সাথে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা নিয়েই তো সন্তুষ্ট থাকা যায় তবুও আমরা বুঝেও বুঝি না, আমরা কেউ কেউ একটুতেই সন্তুষ্ট থাকি, বেশীর ভাগ আমরাই অল্পে খুশী থাকি না, নিজেই নিজের অ-সুখের কারণ হই ; আরো সুখ, আরো অর্থ, গাড়ী-বাড়ীর নেশায়, বিলাসিতার চরম শিখরে পৌঁছেও আরো সুখ খুঁজে বেড়ায়, আরো পাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি, আমরণ ছুটে বেড়াই সুখ নামের মরীচিকার সন্ধানে। ভেবে দেখুন, চাইলেই কি সবাই সব পাবে, চাইলেই ছেলে-মেয়ে দারুণ বুদ্ধিমান হবে, ক্লাসে ফার্স্ট, অঙ্কনে, নাচে গানে কুইজে…. সব প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেই হবে, প্রতিযোগীতার ইঁদুরদৌড়ে ছেলেমেয়েগুলোকে ছোটাচ্ছি তো আমরাই, কেবল টাকা রোজগার নয়…. ভাল লেখাপড়া করে ভাল মনের মানুষ হতে শেখাই না । যার বেশী অর্থ আছে, তার চিন্তা চুরির ভয়, রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম আসে না, আর যার পরের দিন খাবারের ঠিক নেই, দিনের শেষে নি:সাড়ে কেমন শান্তিতে ঘুমায় ! সেই বরং ভাল থাকে; পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়, কোন প্রাণীও নয়। কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারে না, এই সত্যটা বুঝেও বুঝি না আমরা…এটাই অ-সুখ…অল্পেতে খুশীর থাকার পথে এটাই বাধা…জীবনে শান্তির সন্ধানে এই বাধা কাটাতে হবে, এই চেষ্টায় রইলাম।

আপন আমার আপন

আমার ঘর যে আমার এত আপন, আমার শৈশবের..আমার কৈশোরের…আমার যৌবনের সেই সোনাঝরা দিনগুলি যে আমার এত কাছের, এত মন-কেমনের তা আগে বুঝিনি। বুঝলাম যখন পারিবারিক কারণে আমার নিজের ঘর ছেড়ে নিজের পাড়া ছেড়ে বাইরে বেরতে হল। বেশি দূরে না হলেও, একই শহরে হলেও সেখানে আমি নতুন, নতুন এলাকা, আশেপাশের নতুন মানুষজনকে নতুন ভাবে নতুন করে চিনতে হল, সবই প্রথম থেকে শুরু করা, ধীরে ধীরে মানিয়ে চলা..নিজের মনকে মানিয়ে নেওয়া। মেয়েদের একটা সহজাত প্রবৃত্তি থাকে নতুন পরিবেশে মানিয়ে চলার, প্রকৃতিগত ভাবেই যেন তারা তৈরী থাকে। বিয়ের পরে যেতে হয় অন্য বাড়িতে অন্য কোনখানে, কিন্তু আমার তো তা নয়। কাজের সূত্রে মেস বা বাসা বাড়িতে সাময়িক থাকাটা অন্য রকম, এটা জানা তাকে যে, সময় শেষে বাড়ি ফিরবই, দিন চলে যাবে কোন রকমে। কিন্তু যদি নিজের বাড়ি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে অন্য কোনখানে থেকেই যেতে হয় আজীবন, তখন অনুভূতিটা হয় অন্যরকম। আমি ইচ্ছে করলেই আর আমার আপন ঘরে যদি ফিরে যেতে না পারি, তখন মনের কষ্টটা হয় অনেক বেশি, এটা বলে বোঝানো যায় না, ; যখন বুঝতে পারি আমি উঠানে হামাগুড়ি দিয়ে বড় হলাম, যে ঘরদোর আমার শৈশবের লীলাভূমি, একটু একটু করে বেড়ে ওঠার সময়টা, আমার গায়ের গন্ধ লেগে থাকা লোহার থাম, রেলিং, সিঁড়ির ধাপ এখন আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। ছিন্নমূল বাস্তুহীন হয়ে আসা অসহায় মানুষদের মতই কতকটা মনে হয়েছিল তখন নিজেকে। আপন ঘরকে বিদায় জানানোর যে কি কষ্ট তা মর্মেমর্মে উপলব্ধি করি আমি ; আমার নিজের ঘর,পড়ার জায়গা, সন্ধ্যাপ্রদীপ হাতে তুলসীমঞ্চে মায়ের আবছায়া মুখ, ছো্ট্ট খাটে গাদাগাদি করে ভাইবোনেদের খুনসুটি, মায়ের রান্না ঘরের অপ্রশস্ত জায়গা, সন্ধ্যায় পড়ার ফাঁকে রেডিও তে তরজা আর যাত্রা শোনা, বাবার কাছে সবাই একসাথে গল্পশোনা …এগুলো কালের নিয়মে অতীত আজ। পাড়ার মাঠে দুপুর রোদে ঘুড়ি নিয়ে দৌড়ানো মাঠ-পুকুর-আমগাছ-জামগাছে, পেয়ার গাছে দুপুর কাটানো… আমার মনকে বিবশ করে ।এখন হয়ত আরও উন্নত হয়েছে জীবনযাত্রা। স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে আগের থেকে, কিন্তু সেই ভাল লাগার দিন গুলি অতি সাধারণভাবে জীবনযাপন,পাড়ার সব কিছুতে মেতে থাকার আনন্দই আলাদা। পাড়ার দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তা ছিলাম আমি। ক্লাবের সেক্রেটারির দায়িত্বের কারণে আমার উদ্যোগটা বেশিই ছিল। ক্লাবের ছেলে-ছোকরা আর ষোলআনার যৌথ মেলবন্ধন ঘটাই, অনেক দৌড় ঝাঁপ করে পত্তন করি দুর্গাপূজার আজ থেকে ৩০ বছর আগে। কালের নিয়মে আমার পরের ছেলেরা এখন দায়িত্ব পালন করছে। হাজির হলে অনেকে সম্মানও করে, কিন্তু আগের মত ছোটাছুটি করতে পারি না এখন, পরামর্শ দিয়েই ক্ষান্ত থাকতে হয়। প্রকৃতির নিয়মেই বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীর-মন থিতু হতে চায়। বয়সের সাথে অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে। কোনটা খারাপ কোনটা ভাল বোঝার ক্ষমতা আগের থেকে অনেক বেশী, তাই আবেগে আর কাজ করতে পারি না। এখনও পুজোর সময় ঐ কয়েকদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে আগের কত টুকরো সংলাপ আর মজার ঘটনা কথায় কথায় ফিরে আসে ; স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে উঠে পাড়ার গলি, চায়ের দোকান, কালিমন্দর, ক্লাবঘরে নাটকের মহড়া, পাড়ার দাদা-ভাই-ইয়ার-দোস্ত-এর সঙ্গে রকে বসে আড্ডার ছবি, কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে সমবয়সী মেয়েদের সাথে খুনসুটি, আড়চোখে চাওনি, একটু ভাল লাগা একটু ভালবাসা, চাপা রহস্যে ঢাকা কোন কোন সম্পর্ক, বাঁকা চাউনি, মুচকি হাসি, পাড়ার বৌদি-কাকিমা-পিসিমাদের অনাবিল ভালবাসা আর ওদের কাছ থেকে পাওয়া হালকা অন্যায় প্রশ্রয় আর আবদার ….এগুলো… কোথায়… কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। আমার আপন ঘর তো এসব নিয়েই । শুধু আমার বাড়ির সীমানা নয়, সীমানার ওপারেও পাড়ার সব কিছু মিলিয়েই আমার ঘর। ছাত্রাবস্থায় গোপনে পড়ার বইয়ের আড়ালে বড়দের উপন্যাস গিলে খাওয়া, বাড়ীর গুরুজনদের চোখেকে ফাঁকি দিয়ে ম্যাটিনি শো তে ঢুকে পড়া, সমবয়স্ক বন্ধুদের সাথে পাড়ার মেয়েমহলে একটা হিরোইসম দেখানোর রেষারেষির ছবি..সবমিলিয়ে একটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। তাই এখন আমার আপন ঘরের ছবি আমার কাছে এক সুখ-মিশ্রিত অনাবিল অপার্থিব জলছবি।

জয়ন্ত কুমার সরকার | Jayanta Kumar Sarkar

New Bengali Article 2023 | বাংলায় শিল্পে বিনিয়োগ সামান্যই

New Bengali Poetry 2022 | কবিতাগুচ্ছ | বিকাশ চন্দ

New Bengali Poetry 2023 | সুশান্ত সেন | কবিতাগুচ্ছ

New Travel Story 2023 | লাচুং-নাথালু’র সীমান্ত ছুঁয়ে | জয়ন্ত কুমার সরকার

Pancha Byanjan | Bangalir Pancha Byanjan | Pancha Byanjan 2023 | Bengali story Pancha Byanjan | Pancha Byanjan pdf story | Pancha Byanjan – Bangla Galpo | Pancha Byanjan – audio story | Pancha Byanjan – video story | New story – Pancha Byanjan | Shabdodweep story Pancha Byanjan | Pancha Byanjan – short film | Pancha Byanjan movie download | Short film Pancha Byanjan | Pancha Byanjan in India | Pancha Byanjan Restaurant | Pancha Byanjan in USA | Pancha Byanjan in Bangladesh | Top story – Pancha Byanjan | Web series – Pancha Byanjan | Pancha Byanjan in Netflix | Shabdoweep Founder | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Writer

2 thoughts on “Pancha Byanjan | পঞ্চব্যঞ্জন | জয়ন্ত কুমার সরকার | রম্যরচনা | 2023”

  1. পঞ্চব্যঞ্জন আর সেদিন চৈত্রমাস চমৎকার লাগলো। কঠোর সত্য আর ছড়িয়ে থাকা কল্পনার সম্ভাব্যতার মিশ্রণে অপূর্ব হয়ে উঠেছে। বাকি লেখা গুলিও সুন্দর কিন্তু সাহিত্যের অঙ্গনে বিমিশ্র নৈতিকতার ঠাস বুনন সাহিত্য রস সৃষ্টিতে কোথাও একটি প্রতিবন্ধকতার কাজ করে । তার চেয়ে লেখকের কথায় “কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে সমবয়সী মেয়েদের সাথে খুনসুটি, আড়চোখে চাওনি, একটু ভাল লাগা একটু ভালবাসা, চাপা রহস্যে ঢাকা কোন কোন সম্পর্ক, বাঁকা চাউনি, মুচকি হাসি, পাড়ার বৌদি-কাকিমা-পিসিমাদের অনাবিল ভালবাসা আর ওদের কাছ থেকে পাওয়া হালকা অন্যায় প্রশ্রয় আর আবদার ….এগুলো… কোথায়… কোথায় যেন হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে” মুহূর্ত গুলো বরং সত্য আর কল্পনার নিবিড় বন্ধনে আলোকসামান্য হয়ে দেখা দিক শক্তিশালী ও গুণী এই সাহিত্যিকের কাছে এই দাবী ও প্রত্যাশা রইলো।

    Reply
  2. ধন্যবাদ। বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ বাস্তবসম্মত। আপনার সুচিন্তিত মতামত গ্রহণ করলাম। এভাবেই পরবর্তীতে মতামত জানান। শুভেচ্ছা জানাই। জয়ন্ত কুমার সরকার।

    Reply

Leave a Comment