Best Long Emotional Story Bangla | খামার মালিক

Sharing Is Caring:

খামার মালিক – শওকত নূর

পর্ব ১

খামার মালিকের আচরণ ক্রমশ আগন্তুকের পছন্দ- অপছন্দ দুই কলামের ডানটিতে ঠাঁই করে নিচ্ছিল। প্রথম দর্শনেই লোকটিকে ঘিরে তার মনে দ্বিধা সংশয় ভর করেছিল। কথায় আছে, আগে দর্শনদারী, তারপর গুনবিচারী। যদিও বিষয় বিতর্কের, তদুপরিও গতানুগতিকেই হোঁচট খেয়ে যান আগন্তুক। দর্শনদারীর কথায় পরে আসা চলবে। প্রাসঙ্গিক অন্যবিধ কিছু বিষয়াদি এখানে টেনে আনা যাক ।

ভরদুপুরে খামারের বন্ধ দরজায় কড়া নেড়ে আগন্তুক যখন ভেতর-দারোয়ানের দৃষ্টি আকর্ষণে প্রচেষ্টারত, মূলত প্রারম্ভিক হোঁচটটি তার অন্তরাত্মায় তখনই এসে গাঁথে। দারোয়ানের কে’ প্রশ্নের জবাবে ভেতর থেকে ঝাঁঝালো মালিক-কণ্ঠটি ভেসে আসে, আরে বাপু, যে খুশি সে হোকগে। ভরদুপুরে গেট খোলা নিষেধ আছে না? সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা! এসময় বাপের ভাই খুঁড়া আসুকগে, তোমার মুখ খোলার দরকার কী হে? আছে কোন দরকার? তুমি চুপ থাকবে। প্রয়োজন থাকলে ধৈর্য ধরে বাইরে দাঁড়াবে, না থাকলে পথ মাপবে। তুমি বাপু আগ বাড়িয়ে কে কে করতে যাও! চুপ থাকতে সমস্যাটা কী তোমার? একই ভুল কতবার করবে তুমি, এ্যা? আর ওই যে যতসব পঙ্গপালের ঝাঁক তোমার নাকের ডগা দিয়ে গাছের কচিকাঁচা ডালপালা ভেঙে আমার খামারের চৌদ্দটা বাজিয়ে গেল, আমার – -মেরে গেল, তুমি টু শব্দটি করলে না পর্যন্ত। চেয়ে চেয়ে দেখলে। আমারই কি কর্তব্য ছিল, গাছের তলে দৌড়ে গিয়ে তাদের গলাধাক্কায় থামানো, শাসানো? নাকি এখন এখানে দাঁড়াইয়া থাকব প্রস্থান পথে তাদের প্যাদানি- বিদায়ের উদ্দেশ্যে? বলি, এত উদাসীনতায় তোমার চাকরি কি থাকা উচিৎ? আমার মতো একটা হগাইর অধীনে আছো বলেই না তা করেকেটে খাচ্ছো হে! বয়স কত হলো তোমার, বয়স? বোধজ্ঞান কি তোমার কব্বরে গিয়া পরিপক্ক হবে? নাকি সেখানেও তুমি হাদারামই থেকে যাবে? যত্তসব!

বাইরে থ’ হয়ে আছেন আগন্তুক। দ্বিতীয়বার প্রবেশদ্বারে কড়া নাড়ার সাহসটি জাগাতে ব্যর্থ হন। হাই তুলে ঘুরে দাঁড়ান পেছনের পথে। খরতাপ গ্রীষ্ম। ভয়াল রোদ উঠেছে। তারওপর দীর্ঘক্ষণের বাতাসহীনতা পথশ্রান্তিতে চূড়ান্ত মাত্রা যোগ করায় অবসন্ন বোধ করছিলেন তিনি। ভাবছিলেন, ভরদুপুর অবস্থা অতিক্রান্ত হতে আরো ঘন্টা দেড়েক সময় পার হওয়া চাই। এখানে এ বৈরি আবহাওয়ায় কোথায় কিভাবে তিনি তা কাটাবেন? খরখরে শুকনা মাটির মরা পথ, পরিত্যক্ত, জরাজীর্ণ ঘাস লতাপাতার পথপ্রান্ত- একটিমাত্র গাছ চোখে পড়ছে, প্রায় ন্যাড়া, যদিও তার নিচে কিছু শুকনো লতাপাতার চিড়ে চ্যাপ্টানো স্তূপ কোনও ভারী জীবের শুয়ে-বসে থাকার ধারণা জোগায়।

আগন্তুক জ্বলন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে হাতের চেটোয় কপালের ঘাম মুছে সেদিকেই এগোলেন। দুটো দাঁড়কাক তার আগমন ভীতিতেই বোধকরি বিরক্তিতে তার দিকে মাথা ঝুঁকে তাৎক্ষণিক যুগপৎ উড়ালে গাছ ছাড়ল। ইতঃস্তত পায়ে গাছটার নিচে গিয়ে উল্লিখিত পাতাস্তূপের ওপর গেড়ে বসলেন আগন্তুক। ব্যাগ হাতড়ে পানির বোতল বার করে গলায় পানি চাললেন। কিছুটা পানি চোখে ছিটালেন। তারপর ঢি’ দিয়ে বসে রইলেন খামার-প্রবেশদ্বারে দৃষ্টি ধরে।

অর্ধপাতা গাছটি উত্তাপ নিবারণে ব্যর্থপ্রায়। থেকে থেকে গরম বাতাসের হলকা এসে আগন্তুকের ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডলের উষ্ণতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করে যায়। তদুপরিও একসময় পথক্লান্তি খানিকটা নেমে এলে ঈষৎ স্বস্তিতে ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বার করে তাতে মনোযোগ ঢালেন আগন্তুক। সময়সময় কাগজ থেকে মুখ তুলে দৃষ্টি ছোঁড়েন খামার-প্রবেশদ্বারে। এভাবে অতিক্রান্ত হয় ঘণ্টাখানেক।

কাগজপত্রে মাথা ঝুঁকে ঝিমাচ্ছিলেন আগন্তুক। হঠাৎই ওদিকে প্রকট হইহট্টগোলের শব্দে সচকিত মুখ তুলে ওদিকে দৃষ্টি ছুঁড়লেন। দলবদ্ধ কারা বেরোচ্ছে প্রবেশদ্বার পথে। হ্যাংলাপাতলা দু’জন মধ্যবয়সী লোক, তাদের পেছনে দলবদ্ধ কিশোর-কিশোরী। প্রত্যেকের পরনে ইউনিফরম; অনেকেরই হাতে লতাপাতা বা গাছের সরু-ছোট তরতাজা ডাল। এরা স্কুল শিক্ষার্থী হয়ে থাকবে। বয়সী দু’জন নিশ্চয়ই তাদের শিক্ষক। ভেতরে দারোয়ানের ডালপালা ভাঙা সংক্রান্ত যারপরনাই চিল্লাপাল্লার মুখে চাপা গুঞ্জরনে বিপরীত দিকে দ্রুত হেঁটে খামারপ্রাচীরের ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেল তারা। তাদের মধ্য থেকে কেউ একবার শুধু উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, চামাড়খানা থেইকা বাইর হইয়া আসলাম গো! এই শেষ! তারপর নৈঃশব্দ্য।

খোলা প্রবেশদ্বারটি বন্ধ হতে গিয়ে খুলে গেল। একটা মুখ বেরোল দরজাপথে। তা থেকে আগন্তুকের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হলো, হে ভাই, এইযে! আপনেই তো? আছেন এখনও?

— জি। আগন্তুক চেঁচালেন।
— আপনে আসেন এখন ভিতারে। জলদি আসেন। খাওনের টাইম। গেট বন্ধ দিব। কী যেন বিড়বিড়াল দারোয়ান।
— জি, আসছি।

দারোয়ানের সাথে প্রবেশদ্বার ধরে ভেতরে পা ফেলতেই যে দৃশ্যপটের অবতারণা হয়, তা-ই আগন্তুকের মনে জোর হোঁচটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল মর্মে গল্পপ্রারম্ভে উল্লিখিত হয়েছে। তার ঈষৎ-বিস্তৃত বয়ান এখানে বর্ষিত হতে যাচ্ছে:

একটা মাঝারি আমগাছের নিচে চেয়ারে বসে আছেন খামার মালিক। উঁচু-ভারীক্কি গা খালি, ট্রাউজার পরা দু’পা সটানে সামনের বেঞ্চিতে স্থাপিত ; তার মাথার চুল উস্কখুস্ক তথা প্রবল খাড়া, পুরু গোঁফের দু’প্রান্ত পাকানো ধরনের উঁচানো, কুচকুচে কলপ-কালো ভ্রু জোড়া প্রগাঢ়, গোল চোখদুটি ক্রুর। আগন্তুকের দিকে বিরক্তিকর অভিব্যক্তিসূচক মুখাবয়ব ও দৃষ্টিতে দুপা প্রবল নাড়াচ্ছিলেন তিনি। একটা শার্ট ঝুলছে তার মাথার ওপরে গাছের নিচু ডালে। আগন্তুক ওদিকে ক’পা এগোতেই তিনি রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠলেন, এই ভরদুপুরে কী মনে করে?কোত্থেকে আসা হচ্ছে?

বিড়বিড় করে অস্পষ্ট যা বললেন তিনি, আগন্তুকের আংশিক শ্রুতি ও অনুমানের গড়ফলে তা নিম্নরূপ :

এই ভরদুপুরে – – করতে (অশ্লীল) আসছে। শালা মানুষের অত্যাচারে আর বাঁচি না। ভরদুপুরে আমার – – বাঁশ দিতে আসছে।

— জি, আসসালামু আলাইকুম। আগন্তুক বিনীত বললেন।
বললেন নাতো কোত্থেকে আগমন! কী মনে করে ভরদুপুরে আগমন!
— জি, বলছি। বসি, নাকি?
— ব- সে- ন! সরাৎ করে পা গুটালেন তিনি সামনের বেঞ্চি থেকে।
— ভালো আছেন আপনি? আগন্তুক বিনীত বললেন।
— আপনার পরিচয়?
— জি, একটা চিঠি নিয়ে এসেছি। আগন্তুক শার্টের পকেট হাতড়ালেন।
— ওটা পকেটেই রাখেন! বার করার দরকার নেই। তা কয়দিন থাকবেন খামারে?
— জি, দিন দশেক।
— দি-ন দশেক।
— জি।
— খানাপিনার ব্যবস্থা?
— জি, সাথে অর্থকড়ি আছে। বাইরে খাবারের বন্দোবস্ত করে এসেছি। খাওয়ার সময়গুলোতে গিয়ে খেয়ে আসব।
— খেয়ে আসবেন। ও-ই যে কোনার ঘরটা খালি আছে, জঙ্গলের ধারে, যান। ওঠেন ওইটাতে।
— জি।

আগন্তুক আর উচ্চবাচ্য না করে খামার মালিকের নির্দেশিত ঘরটির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। হাঁটার ফাঁকে এদিকসেদিক দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছেন গোটা খামার পরিসর। মোট আয়তন বোধকরি অর্ধ বর্গকিলোমিটার এর কাছাকাছি হবে। চারধারে প্রাচীরের গা ঘেঁষা ছোট ছোট দৃশ্যমান ঘরগুলো সম্ভবত পোষা জীবজন্তুর। নানা প্রজাতির দু’চারটা করে চড়ছে প্রতিটির সামনে। মাঝের বিস্তৃত বিশাল পরিসরে সরু আল দেয়া অগণিত ফসলের খেত। সরু আল ধরেই হাঁটছেন তিনি। দক্ষিণ পশ্চিমে পাঁচিল ডিঙিয়ে গাছগাছালির ওপর দিয়ে অদূরের নগর-চূড়া দেখা যায়। তার ওপরে তার নজরে পড়ছে অবারিত রোদ ঝলসানো নীলাকাশ।

হাঁটতে হাঁটতে নির্দেশিত ঘরটির খোলাদ্বারে উপনীত হন আগন্তুক। দরজায় পা রাখতেই ভেতরের অগোছালো দৃশ্যপট দৃষ্টি কাড়ল তার। এইমাত্র প্রবেশদ্বার পথে যে দলটি বেরিয়ে গেল, তারাই সম্ভবত সদ্য বারোটা বাজিয়ে গেছে ঘরটার। বাদাম- কলা- কমলার খোসা পড়ে আছে মেঝে জুড়ে । ভাঙা গোছের খাট, চেয়ার টেবিলে পড়ে আছে গোলআলু, গম, পেঁয়াজ, রসুন, বেগুন, টমেটো, কালোজিরা, সজ, মরিচ – ছেঁড়া কাগজ, কিছু ক্ষুদ্রকায় লতাপাতা।

দরজায় দাঁড়িয়ে হেঁটে আসা পথ বরাবর তাকালেন আগন্তুক। খামার মালিকের অবস্থিতি এখন আর সে গাছটির তলায় নেই। খামারের দক্ষিণ পাঁচিলের ওদিকে একটি একতলা লম্বাকৃতির পাকা দালানের বারান্দায় তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন এদিকে বার-গলা দৃষ্টি ধরে। আগন্তুক তার নজরবিদ্ধ হওয়া মাত্রই তিনি শরীর ঘুরিয়ে বারান্দা মাড়িয়ে দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেলেন ভেতরে।

আগন্তুক ঘুরে দাঁড়িয়ে ঘরের চারপাশটা ভালোমত দেখে নিলেন। চারদেয়ালসহ আসবাবগুলো পুরনো, ধূলিধূসর, জরাজীর্ণ, ভাঙা খাটের কোনায় ভাজ করা কাঁথা কম্বল এবং তৎসংলগ্ন বালিশ জোড়াও ধূলিধূসর। দৃশ্যমান অবস্থা কিছুতেই তাকে ধারণা দিচ্ছিল না, সম্প্রতি কোনও সদ্ব্যবহার ওসবের ঘটে থাকবে। খাটের স্ট্যান্ডের সাথে এক বৃক্ষ-ডাল ঝাড়ু ঝুলন্ত ছিল। সেটির রশি ছাড়িয়ে মিনিট পাঁচেকের মতো খাট ও তার আশপাশ ঝাঁট দিলেন আগন্তুক। কাঁথা কম্বল বালিশ হাতে তুলে ঝেঁকে বিছানায় পুনঃস্থাপন করে আরামে বসে গেলেন খাটে। ব্যাগ থেকে শুঁকনো হালকা খাবারের প্যাকেট বার করতেই পেছন দিকের বেড়ার গায়ে জোর ঠকঠক শব্দ শুনে সচকিত হলেন। তখনই খানিকটা আতঙ্ক প্রথমবারের মতো মৃদু কাঁপাল তাকে।

বেড়ার ওপরদিকটা ফাঁকা-সেপথে ভেতরে ঢুকে আছে কিছু খোকশা বা অনুরূপ ডালপালা। পরক্ষণেই সম্বিতে এলেন তিনি। ভাবলেন, এ তো কৃষি খামার, বন নয়। কাজেই ওদিকটা ঝোপঝাড়ময় হলেও প্রাণসংহারী বিশেষ কোনও প্রাণী এখানে থাকবার কথা নয়। তাছাড়া, এই চৈত্র খরায় ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা প্রায় না থাকার মতোই। কাজেই এ নিয়ে আর ভাবনা বিস্তৃত করতে চাইলেন না তিনি। হালকা কিছু মুখে পুরে পানি গিলে আয়াসে চোখ বুঁজলেন।

পড়ন্ত বেলায় খামারের আলপথে হাঁটছেন আগন্তুক। ক্লান্ত শরীরে খানিকটা ঘুমিয়ে নেয়াতে আগের সে ক্লান্তিটা এখন নেই। হাঁটার ফাঁকে তিনি ভাবছেন খামার মালিকের কথা। তার সাথে তার আলোকপাতের বিশেষ কিছু নেই। তিনি আশ্রয় মঞ্জুর করলে এখানে অবস্থান করে তিনি গবেষণা কাজ সম্পন্ন করবেন। আশ্রয় জুটেছে, যদিও একটা তালগোল রয়ে গেছে -এই আর কি। একান্তই তা খামার মালিকের অস্বাভাবিক আচরণ। যাক, থাকুক চিঠিটা তার পকেটেই। ভাবছেন, আশ্রয় জুটেছে, তিনি কাজ শেষে চলে যাবেন, ব্যস!

এরপরও অন্যমনস্ক চারদিকে দৃষ্টি ঘোরালেন তিনি। কোথাও খামার মালিকের টিকিটি পেলেন না। কৃষকরা যার যার মতো কাজে ব্যস্ত। কেউ কারো দিকে ভ্রুক্ষেপে নেই, তার দিকেও নেই। তিনি ভাবছেন, কী যায় আসে? প্রয়োজনে তিনিই তাদের সাথে কথা বলবেন, সমীক্ষা চালাবেন। এ হচ্ছে খামারবাড়ি – তার মতো কতজনই হয়তো নিয়মিত আসে যায়। ব্যাপারটা স্থানীয়দের কাছে নিশ্চয়ই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বিকালটা যতদূর সম্ভব তিনি ঘুরেফিরে দেখবেন। পরদিন ভোর থেকে শুরু করবেন কাজ। যতটা সম্ভব নির্বাক আল ধরে হেঁটে সূর্যাস্তের পূর্বে ঘরে ফিরবেন।

সন্ধ্যার পর আলো জ্বেলে গভীর মনোযোগে কাগজপত্র ঘাঁটছিলেন তিনি। আচমকা যুগপৎ পদশব্দ ও ঝাঁঝালো কণ্ঠে চমকে উঠলেন । দেখলেন খামার মালিক চৌকাঠে স্থির দাঁড়িয়ে। চোখেমুখে প্রবল বিরক্তির ছাপ। তার পেছনে মুখ কাঁচুমাচু দণ্ডায়মান দারোয়ান। চোখমুখ উল্টে চেঁচিয়ে উঠলেন মালিক, আপনি আমার বিনা অনুমতিতে খামারে হাঁটতে গেছেন কেন? ব্যাপারখানা কী? আমার খামারে কাজ শুরু করবেন, অথচ আমাকে জানানোর তোয়াক্কা করবেন না! এ কী আচরণ!

— জি, আমি- -। থতমত খেলেন আগন্তুক।
— আপনার কি ভদ্রতাবোধ নেই নাকি?সৌজন্য শেখেন নাই?
— জি, আমি -।
— আপনি বসেন চুপ করে। আমার বিনা অনুমতিতে খামারে হাঁটতে গেলেন আপনি! আশ্চর্য!
— জি, আমি ভেবেছিলাম আপনি- -।
— ভাবলেন মানে? কী ভাবলেন আপনি ? আর কখখনো এমন ভাবতে যাবেন না। আমার অনুমতি ব্যতিরেকে কখখনো খামারে হাঁটতে যাবেন না, খবরদার, বলে যাচ্ছি!
— জি, তাহলে অনুমতি?
— কালকে জানাব আপনাকে!
— জি।

খামার মালিক হনহন করে চলে গেলেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে বাইরে নিস্তব্ধতার আভাস পেলেও ভেতরের উৎকট শব্দ আকস্মিক উদ্বেগে অস্থিরতায় ঠেললো আগন্তুককে। ঘরের মেঝের মাঝবিন্দু বরাবর কাঠের ধর্ণা থেকে ঝুলে থাকা হলদে রঙের অতি পুরনো ধাঁচের যে সিলিং ফ্যানটি বৈরি উষ্ণতায় খানিকটা হলেও লাগাম টানছিল, তার ভোঁ ভোঁ শব্দটি হয়তো বরাবরই ছিল, কাজের ঘোরে তার খেয়াল করা হয়ে ওঠেনি। এতক্ষণে ঘুমাতে যাওয়ার ক্ষণে যেমন তা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, তেমনি কানে বুকে তীক্ষ্ণভাবে বিঁধছে। তিনি ফ্যানটি বন্ধ করে ঘুমাবেন, নাকি শব্দের মধ্যেই ঘুমাবার চেষ্টা চালাবেন- এই দোটানায় পায়চারি ধরতেই হুট করে বিদ্যুৎ চলে গেল।

অন্ধকার নিশ্ছিদ্রের কাছাকাছি হওয়াতে একমাত্র দরজাটি খুলে দিলেন তিনি। ঠিক তখনই পেছনের ঝোপে প্রবল তোলপাড়ময় শব্দাবহ তৈরি হয়ে গেল। এতক্ষণে চিন্তিত হলেন তিনি। ত্বরিত দরজা বন্ধ করে ভাবনাচ্ছন্ন হলেন। কিসের শব্দ হতে পারে ওটি? কোন খামারের মধ্যে বন্য প্রাণীর এমন কোন প্রজাতি থাকা সম্ভব, যার শব্দপাত এমন তেজোময় হতে পারে? আর যাই হোক, একটা খামার-ঝোপে ততটা ভয়ংকর কেউ হবার সম্ভাব্যতা কতটুকু? ঘরের কোনে পড়ে থাকা যে শুকনা ডালটি তিনি সন্ধ্যা প্রাক্কালে লক্ষ্য করেছেন, নিশানা মতো হেঁটে গিয়ে সেটি তুলে আনলেন তিনি। দু’হাতে শক্ত করে ধরে উত্তরের ভাঙা বেড়ার নিচ বরাবর জোরছে বাড়ি ঝেড়ে মুখে হুটহুট শব্দ করলেন ক’বার। শব্দটি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে দূরে সরে যেতে যেতে অশ্রুত হয়ে এলো। প্রবলতর হবার পর্যায়ে তার মনে হচ্ছিল,বাইরের ঝোপঝাড় ডালপালা বুঝি চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

আগন্তুক কিছুক্ষণ অন্ধকারে চুপচাপ শুয়ে রইলেন। শরীর এরই মধ্যে ঘামে ভিজে গেছে। আধোঘণ্টার মতো পার হলেও বিদ্যুৎ এলো না। খাট থেকে উঠে দরজা খুলে বাইরে এলেন তিনি। স্থির দাঁড়িয়ে খামার মালিকের বাসস্থান বরাবর দৃষ্টি ছুঁড়তেই মাঝারি অন্ধকার ভেদ করে দেখলেন বারান্দায় দণ্ডায়মান একটা মূর্তি তড়াক করে ভেতরে অদৃশ্য হলো। মূর্তি যে খামার মালিকের বৈ অন্য কারো নয়, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ জাগলো না আগন্তুকের মনে।

খামার মালিক – শওকত নূর

পর্ব ২

কুটিরের গণ্ডির মধ্যেই খামারের আলপথে হাঁটতে লাগলেন আগন্তুক। একসময় খামার-গণ্ডি পেরিয়ে দৃষ্টি গেল তার অদূরের সুউচ্চ নগর মোবাইল- টাওয়ারের গাঢ় লাল আলোয়। সুউচ্চ ভবন শীর্ষের অন্যবিধ আলোও দৃষ্টি কাড়ল তার। কিন্তু সেসব আলোর কোনও প্রভাব খামার পরিসরে নেই। চারদিকের ছোট ছোট বসতিঘরগুলো আলোহীন নিস্তব্ধ। খেতে খেতে থাকা ফসলগুলোও যেন অন্ধকারে নিষ্প্রাণ। কিছুক্ষণ হাঁটার পর ঘরে ফিরলেন আগন্তুক। দরজা বন্ধ করে খাটে উঠলেন। শরীর এখন বেশ অবসন্ন লাগছে। অন্ধকারে উষ্ণতার মধ্যেও গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলেন তিনি।

এক ঘুমে রাত পার হয়ে গেছে বিধায় রাত ঘিরে মনে স্থান করে নেয়া অনেক আতঙ্ক, বিসংবাদ, ঝক্কি পোহানো থেকে বেঁচে গেছেন তিনি । দিনের আবহাওয়া ভালো। মেজাজ মোটামুটি শান্ত। প্রাতঃকাজ সেরে নাস্তার উদ্দেশ্যে বেরোলেন তিনি। খামার দ্বারে এসে দেখলেন দারোয়ান বিষণ্ন ঝিমানিগ্রস্থ চোখেমুখে বসে আছে। উচ্চবাচ্য না করে দরজা খুলে দিলে বেরিয়ে যান তিনি। নাস্তা সেরে দুপুরের খাবারের প্যাকেট নিয়ে যখন গেটে ফেরেন, তখন দেখলেন দারোয়ানের চোখদুটো ক্রুর আর মুখমণ্ডল রাগত হয়ে আছে। তার সামনে দিয়ে নির্বাক হেঁটে এসে কুটিরে উঠলেন তিনি।

ঘরে বসে মিনিট দশের মতো তিনি কাগজপত্রে চোখ বুলিয়েছেন । এরই মধ্যে খোলা দরজায় আচমকা বার-দুই জোর শব্দ হলো। লাঠি কিংবা বাঁশ কাঠের মাথা দিয়ে ঘা বসানো হলো বুঝি দরজায়। তিনি ডেকে উঠলেন, কে?

— আমি দারোয়ান! দরজায় আরেকবার জোরছে শব্দ হলো।
— জি, দাঁড়ান, আসছি। চেঁচালেন আগন্তুক।
— দরজা খুলতে হইব না। কী কই, কান ফালাইয়া শুনেন খালি।
— জি, বলুন।
— মালিকে জিগাইছে আপনে রাত্রে খামারে হাঁটছেন ক্যান। রাত্রে খামারে হাঁটতে কড়া নিষেধ করছে। আর হাঁটবেন না, খবরদার! ঘরের ধারে-কাছ দিয়াও হাঁটন যাইব না। ওইগুলানও খামারের অংশ। বলছে, এই কথা মনে যেন থাকে।
— জি, ঠিক আছে।
— দিনে হাঁটার অনুমতি দিছে খালি, দিনে।
— জি, ঠিক আছে।
— যাইতেছি!

খামার মালিকের অনুমতি মেলাতে শীঘ্রই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন আগন্তুক। আলপথ ধরে হাঁটতে থাকেন খামারে। খামারকর্মীরা এরই মধ্যে কাজে লেগে গেছে। আগন্তুক জমিগুলোর ফসল মাটি পরীক্ষার ফাঁকে কর্মীদের এটাসেটা জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। নোটবুকে টুকে নিচ্ছেন নানা তথ্য। কখনো বা কাঁধের ব্যাগ থেকে কাগজপত্র বার করে পড়ছেন, কলম ধরছেন, হাঁটছেন । এভাবে প্রায় বেলা আড়াইটা নাগাদ পার করে দুপুরের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে ঘরে ফেরেন তিনি।

খাবার গ্রহণের পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে তিনি কাজে বেরিয়ে পড়েন । পড়ন্ত বেলার দিকে হেঁটে চলে আসেন খামার মালিকের বাসস্থানের পেছন দিকে। এদিকের জমিগুলো নির্জন। ক’টা কুকুর অবশ্য খেতের আলে কী শুঁকছে। লালচে আলোয় বেজি আর ধবধবে সাদা খরগোশগুলো ছোটাছুটি করছে এদিকসেদিক। বাসস্থানের পেছনের তালসমান উঁচু পাঁচিলের বাইরের আলটি ধরে অনুচ্চ কিছু গাছপালা, ঝোপঝাড় আছে। গাছগুলোর অধিকাংশই গুল্ম কিংবা বাবলাকাঁটা জাতীয়। ওপাশের দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় খানিকটা পরিসর নিয়ে বৈচিত্র্যময় চারা-কলমের উদ্যান। একটা ছায়াঘন গাছের কাছে দাঁড়িয়ে সেদিকে দৃষ্টি ধরে ডায়েরিতে তথ্য লিপিবদ্ধ শুরু করতেই বাসস্থানের ভেতরের এক উচ্চস্বর কথোপকথনে তার মনোযোগবিদ্ধ হয়। বাকবিতণ্ডা সুলভ কথোপকথনটি খামার মালিকের সাথে তার স্ত্রীর। অনিচ্ছায় আগন্তুকের কানে উঠলেও তার মর্মার্থ তাকে খানিকটা আচ্ছন্ন রাখে :

শোনো, এই লোকটার বয়স এখন নব্বইয়ের ওপরে। আজীবন একজন গতিশীল কর্মঠ মানুষ ছিলেন তিনি। একটা বড় পরিবারের কর্তা। তার তেরোজন ছেলেমেয়ে আমরা। আমি দশম। আমাদের প্রত্যেকের সন্তানসন্তুতি আছে। সন্তানসন্তুতিরও সন্তানাদি আছে। এতকাল সবার প্রতি তার খেয়াল ছিল, করেছেনও সবার জন্য। বার্ধক্যে এসে স্রেফ একটা শিশুতে পরিণত হয়েছেন। শারীরিক অক্ষমতা তার গতি থামিয়ে দিয়েছে, দেহের গতি। কিন্তু পদার্থবিদ্যার গতিজড়তার মতো মনের গতিটা রয়ে গেছে। সেটা থেকেই নানা কথা বলতে চায়। দুর্বলতা সত্ত্বেও এটাওটা করতে চায়। এই চাওয়াটুকুই এখন তার জীবন- কর্ম। এসবের জন্য তার সাথে রুক্ষস্বরে কথা বলো না। খারাপ আচরণ করো না। যার যা বলার সবাই বুঝিয়ে বলো। কণ্ঠটি খামার মালিকের।

— ঠি-ই-ক আছে, কিচ্ছু বলব না ওনাকে। ভারিক্কি নারী-কণ্ঠস্বরটি খামার মালিকের স্ত্রীর।
— ওনাকে মানে? ওনাকে কী? সম্মান দিয়ে কথা বলো।
— আচ্ছা ঠিক আছে, সম্মান দিয়েই বলব।
— ফায়জুল, ঝগড়া করিস না, বাপ আমার । আমার জন্য মাথা গরম করিস না। সম্মান কোন ব্যাপার না। একটা বার্ধক্য- ভারাক্রান্ত কণ্ঠ বলল।
— বাবা, চুপ করো। খামার মালিক চেঁচালেন।
— আইচ্ছা।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটলো। হঠাৎই ঝাঁঝালো কণ্ঠ উঁচিয়ে উঠলো খামার মালিকের, বাবা, তোমার কাজকর্ম এখন সহ্যের বাইরে। কে বলেছে তোমাকে এসব কাপড়চোপড় আনতে উঁচু বারান্দা থেকে নিচে নামতে? এরকম করেই দুই দুইবার আছাড় পড়ে বুকে পিঠে স্থায়ী ব্যথা বানিয়েছ তুমি । কতবার নিষেধ করি, তুমি মানো না। সারাক্ষণ খুটুরমুটুর না করলে তোমার ভালো লাগে না। সারাক্ষণ তোমার হাত পা তরতর করে। তোমাকে একটা ওষুধও আমি আর কিনে দেব না। ডাক্তারের কাছে নেয়াও বাদ। চলো তুমি তোমার ইচ্ছাস্বাধীন, ব্যস!

— আহা বাবা, রাগ করস খালি আমার উপর। বৃষ্টি নামলে তর এই শার্ট প্যান্ট লুঙ্গি ভিজব না? না তুললেও তো আমার দোষ হবে। বলবি আমি কোন কাজকর্ম করি না।
— খবরদার বাবা, মিথ্যা কথা বলবে না। কে তোমাকে দোষ দেয়? কে তোমাকে বলে তুমি কাজকর্ম করো না? খবরদার, এসব মিথ্যা কথা বলবে না। তোমার এখন কাজ করার বয়স আর শারীরিক সামর্থ্য আছে? বুঝি না আমরা? তাছাড়া কোনদিন কি তোমাকে কোন কাজ করতে বলি আমরা?
— আমি কি মিথ্যা বলতেছি?
— হ্যাঁ বাবা, তোমার মাথা গেছে।
— আইচ্ছা, আর কিছু করব না।

কিছুক্ষণ নীরবে কাটার পর একটা কিশোর-কণ্ঠ চেঁচিয়ে উঠল, আম্মু, দেখো, দাদু কী করতেছে!

— কী করে?
— দেখো আইসা।
— বাবা, আপনি আবার আচার ধরছেন! এই যে এত করে বলি, আচারে আপনার পেট ভর্তি গ্যাস হয়। কথা শোনেন না। খান বেশি বেশি। আমি চেঁচালেই তো আপনার ছেলে রাগ করে। খামার মালিকের স্ত্রী বলছিলেন।
— বাবা, খবরদার, বৈয়ম দাও আমার হাতে। আর একটা আচার যদি খেয়েছ! খবরদার বলতেছি, রাখো বৈয়ম। খামার মালিক চেঁচালেন।
— না, তরা সবাই আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করস। সায়দুলরা তো আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করত না। একটু আচার খাইলে কী আর এমন খরচা বাড়ব তোদের সংসারে?
— বাবা, ওই সায়দুলই তোমার সবচেয়ে ভালো ছেলে। ওর সাথে তোমার পড়ত ভালো। ও বেঁচে থাকলে বেশ ভালো হতো তোমার জন্য। দু’জন একসাথে বসে হেসে হেসে আচার, ডাল, মিষ্টি, সিঙ্গারা, পুরি খেতে। খুব ভালো লাগত তোমার।
— হ্যাঁ, লাগত তো।
— ওরও ভালো লাগত- অবাধে সব খেত। খেয়ে খেয়েই তো আগে বিদায় নিয়েছে। সবাইকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে গেছে। আমরা কড়াকড়ি না করলে তুমিও অচিরেই ভাসবে। ভেসে ভেসে ওর কাছে চলে যাবে।
— কী বলস এইসব? তুই বড় নিষ্ঠুর। তোর বউ- পোলাপান সবাই নিষ্ঠুর। উ- হু – হু!
— দাদু, কান্না করবা না। নিষ্ঠুরতাই তোমার জন্য ভালো। আমরা নিষ্ঠুর না হয়ে তোমাকে স্বাধীনতা দিলে তুমি হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাবা। চুপ থাকো এখন। আমি পড়তেছি। একটা যুবতী- কণ্ঠ আকস্মিক চেঁচিয়ে উঠল।
— পাপড়ি, চুপ কর। সবাই বাবার সাথে খারাপ আচরণ করিস না। এই বয়সে মানুষ নাতি নাতনিদের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে ওঠে। তাদের কাছে ভালো আচরণ প্রত্যাশা করে। স্যরি বল।

— বলতেছি, বাবা। দাদু, স্যরি, চলো ওষুধ খাওয়াই।
— ওষুধ? ওষুধ তো তরা দেস না আমাকে ঠিকমত।
— দেই, সবই দেই, তোমার মনে থাকে না, চলো।
— এই যে এই ওষুধটাতো কবে শেষ! ফায়জুলের কি টাকা শেষ? আনে তো না। আমার তো আছে টাকা ব্যাগে। নে, আমি দেই।
— আহা দাদু, এ ওষুধটার তো কোর্স টাইম শেষ। এইজন্য আনে না। টাকার জন্য না। নাও, ছয়টার ওষুধ নাও।
— দাদুভাই!
— হ্যাঁ, দাদু বলো।
— এত ওষুধ যে খাই, আমার অসুখ তো ভালো হয় না। পায়ের ব্যথা তো যায় না। কবে ভালো হবে অসুখ?
— আহা দাদু, স্ট্রোক হইছিল না তোমার? পুরাপুরি কি আর ভালো হবে? সহ্য কইরা থাকতে হবে। ছোটবড় কত মানুষেরই তো ব্যথা থাকে। ছোটদেরও থাকে। সহ্য কইরা চলো।
— ভালো হবে না? কী বলস?

পাপ-ড়ি! খামার মালিক চেঁচালেন।

— জি, বাবা।
— এইরুমে আয় তো জলদি!
— জি, বাবা।

অসুস্থ ব্যক্তিকে এরকম নেতিবাচক কথা বলতে আছে! এসব শিখাইনাই তোমাদের?

— কী নেতিবাচক বললাম, বাবা?
— ওই যে বললে, পুরোপুরি ভালো হবে না! অসুখ বাস্তবে পুরোপুরি ভালো হোক না হোক, পুরোপুরি ভালো হয়ে যাবে – এটাতো অসুস্থ ব্যক্তির একটা আশা বা স্বপ্ন। পুরোপুরি সুস্থ হবার আশা, স্বপ্ন বা বিশ্বাস না থাকলে তারা কি সুস্থ থাকবে? দুশ্চিন্তা আর হতাশায়ই দ্রুত শেষ হয়ে যাবে। তাদেরকে অভয় দিয়ে কথা বলতে হয়। কতবার এসব শিখিয়েছি তোমাদের!
— স্যরি বাবা, ভুল হয়ে গেছে। মনে ছিল না।
— এখন গিয়ে অভয় দিয়ে বলো, যাও।
— আচ্ছা বাবা, বলতেছি।
— দা-দু!

ফায়জুল ডাইকা নিয়া কী বললো, দাদুভাই ? আমার উপর কি রাগ করল? বকাঝকা করল খুব ?
— আহা দাদু, বকাঝকা করবে কেন?
— ওই যে খালি বলি, সুস্থ হই না কেন, এইজন্যে?
— না না, আমি ভুলে তোমাকে বলছিলাম পুরোপুরি সুস্থ হবে না তুমি; বাবা আমার ভুল ভাঙাইয়া দিলো। ভালো কথা বলছে।
— কী বললো ফায়জুল?
— বলছে, তুমি অবশ্যই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। তবে নিয়ম করে চলতে হবে।
— আইচ্ছা।
— দাদু, আমার পড়া আছে, চুপ করে থাকো, যাই।
— আইচ্ছা।

অদূরেই ক’টা কুকুর আচমকা ঘেউঘেউ করে উঠলে মাথার ওপরে পাখির শোরগোল তীব্রতর হয়। আগন্তুক হঠাৎ সম্বিতে ফিরে পশ্চিমাকাশে তাকান। সূর্য পাটে চলে গেছে কখন।ডায়েরি গুটিয়ে ঘরে ফেরার উদ্দেশ্যে দ্রুত হাঁটেন তিনি।

পরদিন ভোরে আগন্তুকের আচমকা ঘুম ভাঙে দরজায় প্রবল কড়াঘাত, সেই সাথে কাদের হইহট্টগোলের শব্দে। তিনি চোখ খুলেই বাইরে রোদের উপস্থিতি টের পেলেন। রাতে ঘুম হয়েছে বেশ। কিন্তু সাতসকালে কারা এসে হাজির হলো ওরকম উপদ্রব হয়ে? হকচকিয়ে গিয়ে তড়িঘড়ি দরজা খুললেন তিনি। ছোটখাটো একটা দলকে দেখতে পেলেন। খামার মালিক, লাঠি হাতে দারোয়ান, এক কিশোর, এক যুবতী ও এক বালক।

প্রত্যেকের চোখেমুখে-অভিব্যক্তিতে ক্ষুব্ধতার পরিস্ফুটন, যদিও স্লিপিং পোশাক পরিহিত সুশ্রী যুবতী ও কিশোর, যাদের হাতে যথাক্রমে বেল্ট-গলা পোষা বিড়াল ও কুকুরের রশি; কথাও বলছিল তারা প্রাণী দুটির সাথে। সাথের বালকটিকে অন্য সবার চেয়ে আলাদারূপে দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো আগন্তুকের কাছে। গায়ে ছেঁড়া পাতলা জিন্স শার্ট, পরনে জীর্ণ ময়লা হাফপ্যান্ট, মাথার কোঁকড়া খুদে চুল ধূলিধূসর, গায়ের রঙ কুচকুচে কালো, এক চোখ বড়, ঠোঁট কিঞ্চিৎ ওল্টানো। তার হাতে একটা শালিকপাখির ছানা।

খামার মালিক আগন্তুকের দিকে চোখ পাকিয়ে বললেন, আপনি বাসভবনের পেছন দিকে হাঁটতে গেছেন কেন? আপনার কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছু নেই নাকি?

— জি, মানে আমি-। আগন্তুক বিড়বিড়ালেন।
— হ্যাঁ আপনি। এই তাসকির, উদ্যানের ওইপাশে দাঁড়াইয়া ভিতরের কথাবার্তা শুনতেছিল, এই ব্যক্তি না?
— হ হুজুর, এই লোকোই। আমি তহন পিছনের গাছের মাথায় চইড়া শালিকের বাচ্চা ধরতেছিলাম। বাগানের গাছ গুনতাছিল, আর দেইখা দেইখা কী জানি লেখতাছিলো।
— হু-উ-ম! শুনুন, আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, যে কয়েকদিন আছেন, ওদিকে হাঁটবেন না খবরদার। আমার বাবা বৃদ্ধলোক, কানে একেবারে কম শুনেন। আমরা খুব জোরেশোরে কথাবার্তা বলি, অভ্যাস হওয়ায় প্রায়ই অপ্রয়োজনেও চেঁচিয়ে বলি। উঁচু পাঁচিল তো আর কথা আটকে রাখে না, মনে থাকে যেন।
— জি।

মালিক হনহন করে হাঁটা ধরলে দলটি তাকে অনুসরণ করে। আগন্তুক কতক্ষণ থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর চৌকাঠ থেকে খাটে ফেরেন।

পর্ব ৩

আজ আর নাস্তার উদ্দেশ্যে বাইরে বেরোলেন না আগন্তুক। সঙ্গে থাকা শুকনো খাবারের সাথে বোতলজাত পানি গিলে ঘরেই সেরে নিলেন নাস্তাটা।

খানিক বিশ্রামের পর কাগজ কলম ডায়েরি হাতে বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। হাঁটতে লাগলেন খামারের নতুন নতুন অংশে। তখন রোদবাও উঠে গেছে। রীতিমত কর্মব্যস্ত রূপ পরিগ্রহ করেছে খামার। একটা হাইব্রিড রসুন মাঠে রসুন তোলার দৃশ্যে মনোযোগ ধরে মাঠকর্মীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য নিচ্ছিলেন তিনি। পাশেই এক উঁচু ভুট্টাখেত। ওদিকে চোখ যেতেই দল-কুকুরের আর্তচিৎকার ভেসে আসছিল ভুট্টাগাছের আড়াল থেকে। প্রতি আর্তচিৎকারের সাথে ভেসে আসছিল খামার মালিকের রূঢ়কণ্ঠ, বদ কুত্তার দল, পিটাইয়া হাড্ডি গুড়-ড়া করে দেই তোদের! হা-ড্ডি গুড়- ড়া করে দেই! শরীরের চাম-ড়া উঠাইয়া দেই! কথায় আছে না, কুকুরকে মুগুর মারো। মারতেছি মুগুর! এই! এই! এই! বো-ঝ এইবার ঠেলা! বোঝ শয়তানের দল! হেই!

ভৌ- ভুক! ভুক! ভুক! ভৌ- – – – -ঘা-উ-র -কুউঃ- –

আগন্তুক দেখলেন ভুট্টা খেতের ওপাশ থেকে সাত আটটার মতো নাদুসনুদুস কুকুর সশব্দ দৌড়ে খামার মালিকের বাসার সেই পেছন দিকটায় যাচ্ছে, যেখানে আগের দিন তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। খানিক পর তিনি দেখলেন খামার মালিক মুগুর হাতে সেদিকে ছুটে যাচ্ছেন। ওদিকে পৌঁছেই আবারও তিনি প্রবল আক্রোশ-ভঙ্গিমায় মুগুর উঁচাতে লাগলেন মাটিতে মুখ শুঁকারত কুকুরগুলোর পিঠে। জায়গাটার দূরত্ব এখান থেকে বেশ। আগন্তুক দেখলেন কুকুরগুলোকে ভয়ালভাবে আঘাত করা হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকে মাঠ ধরে দিগ্বিদিক দৌড়ে আগন্তুকের ঘরের ওপাশের জঙ্গলের দিকে অদৃশ্য হতে লাগল।

আগন্তুক এবার কাজে মনোযোগী হলেন। নতুন ফসল-মাঠগুলোর দিকে সরে গেলেন তিনি। ভরদুপুর নাগাদ কাজে ব্যস্ত রইলেন। রোদে ক্লান্তি-শ্রান্তি এলে ফিরতি পথ ধরলেন। ভাবলেন, ঘরে ফিরে ঘণ্টা খানেক বিশ্রামে ভরদুপুর পার করে বাইরে বেরোবেন খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে। খামারঘরের প্রায় শ’ গজের মতো দূরে উপনীত হতে লক্ষ্য করলেন ঘরটির কোনায় কালোমত কী দুটি জন্তু মাটিতে মুখ শুঁকছে। কিছুদূর যেতেই অবয়ব স্পষ্ট হলো তাদের। বৃহদাকার শুকর। তাৎক্ষণিক তার মনে হলো, এরা নিশ্চয়ই পেছনের জঙ্গলের বাসিন্দা, অথবা খামারে পালা জন্তুদের অন্যতম সদস্য। নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে হাঁটছিলেন তিনি। কিন্তু তাদের হাত দশেক নিকটে উপনীত হতেই তার মনের নির্ভীকতাটুকু রীতিমত উবে গেল। মাটি থেকে মুখ তুলে তাকে নজরে পড়তেই তার দিকে তুমুল বেগে ধেয়ে আসতে লাগল প্রাণী দুটি। আতংকে ভীষণ হকচকিয়ে গেলেন তিনি।

দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে অদূরে মাটিতে পড়ে থাকা এক বাঁশখণ্ড হাতে তুলে দাঁড়িয়ে গেলেন স্থির। ওদুটো থামল না। দাঁত উঁচিয়ে বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে গেল তার দিকে। থেমে রইলেন না তিনিও। আত্মরক্ষার্থে কিছু একটা করা চাই। বাঁশখণ্ড দিয়ে ওদের মুখমণ্ডল বরাবর তুমুল আঘাতের ভান করলেন। ওরা পেছন ফিরে দৌড়ে পালিয়ে গেল ঘরটির পেছন দিকে।

ঘরের তালা খুলে ঘরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন আগন্তুক। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছেন তিনি। তার বুক ঢিপঢিপ করছে। খাটে বসে হতাশ ভাবছেন তিনি, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে যে অভয়টুকু মনে অটুট ছিল, তা এক্ষুনে উবে গেল। হঠাৎ দরজার বাইরে পদশব্দ ও তৎক্ষণাৎ দরজার পাল্লায় প্রকট বাড়ির শব্দে হকচকিয়ে উঠলেন তিনি। তড়িঘড়ি খাট থেকে নামার ফাঁকে কাঁপা গলায় বললেন, কে?

ঘরেই থাকুন আপনি! দরজা খোলার দরকার নেই! খামার মালিকের রূঢ় কণ্ঠ।

— জি।
— আপনি প্রাণীর গায়ে আঘাত করেছেন কেন বলুনতো! মনে হচ্ছে বড় অস্বাভাবিক স্বভাবের লোক আপনি! রূঢ় প্রকৃতির!
— জি, মানে?
— শুনুন, আপনার মতো রূঢ় প্রকৃতির লোক আমি নই। তখন আমি কুকুরগুলোর একটিরও গায়ে ন্যূনতম আঘাত করিনি। কোনদিনই করিনি। রসিকতা ছলে কখনও বা বিরক্তি প্রশমনে আঘাতের ভান করি মাত্র। আজও তা-ই করেছি। অথচ আপনি কী ভেবে বসলেন! যার যা স্বভাব, তার তেমন ভাবনা!
— জি, আমিও শুকরগুলোকে কোন আঘাত করিনি। আত্মরক্ষার্থে মারার ভান করেছি মাত্র। আমিও কোনদিন কোন প্রাণীকে আঘাত করিনি। আপনি ভুল ভেবেছেন।
— দরজা খুলুন।
— জি।

আগন্তুক দরজা খুলে দিলে খামার মালিক তার আপাদমস্তকে একনজর দৃষ্টি ছুঁড়ে বললেন, আর ক’ দিন বাকি আপনার?

— আটদিন।

খামার মালিক কোন উচ্চবাচ্য না করে শরীর ঘুরিয়ে হনহন করে হাঁটা ধরলেন। কিছুক্ষণ পর দরজা এঁটে খাটে এসে উঠলেন আগন্তুক।

খামার মালিক – শওকত নূর

পর্ব ৪

আগন্তুক খাটের ওপর চিৎশোয়া অবস্থায় ভাবছিলেন নানা কথা। তিনি অনুভব করছিলেন, তার শরীর মন দুই-ই অনেকটা দুর্বল জরাগ্রস্ত হয়েছে। একবার ভাবলেন, দুপুরের খাবার না খেয়েই ঘুমিয়ে নেবেন কিছুক্ষণ। বিকালে ঘুম থেকে জেগে ঘণ্টা-খানেকের মতো কাজ সেরে বেরিয়ে পড়বেন বাইরে। সন্ধ্যাসন্ধি দুপুর ও রাতের খাবার একযোগে খেয়ে ফিরে আসবেন খামারে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবলেন, এমন অনিয়ম তার মোটেও স্বভাবসিদ্ধ নয়। এমনিতেই সকালের নাস্তাটা গেছে একান্ত হালকার ওপরে, দুপুরে অনাহারী- – বলতে গেলে অনিয়মের চূড়ান্ত পর্যায়ে গড়াবে ব্যাপারটা, যা একান্তই তার বিবেচনা -বিরুদ্ধ। অতএব, গড়িমসি নয়, গায়ে শার্ট চড়িয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লেন তিনি ঘর থেকে।

বারগেটের দিকে হেঁটে অন্তত গজ পঞ্চাশের মতো দূর থেকে তিনি লক্ষ্য করলেন দারোয়ান তার দিকে ঢি’ ঢি’ চোখে তাকিয়ে আছে। তিনি তাকে অতিক্রমকালে সে অস্ফুট বলল, কুত্তায় কাপড় খাইছে।

আগন্তুক ফিরে তাকিয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও থামলেন। দারোয়ান এমনভাবে মাথা নিচু করে আছে যে তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করে নিজের সময়ক্ষেপণের কোনও সদিচ্ছা জাগল না তার মনে। হেঁটে গেট পেরিয়ে গেলেন তিনি। কিছু দূর এগোতেই খামার অভ্যন্তরে দলকুকুরের উজবুক খাউখাউ ঘাউঘাউ শব্দ শুনতে পেলেন।

নিকটস্থ বাজার-রেঁস্তোরায় খাবার সেরে এদিকসেদিক কতক্ষণ হাঁটলেন আগন্তুক। বেলা এখন গড়াবার কাছাকাছি। একখণ্ড মেঘ সূর্যকে গ্রাস করার পর্যায়ে। মৃদু মেঘ-গর্জন ভেসে আসছিল অদূরের শহরের পেছনদিক থেকে। হাঁটার গতি বাড়াচ্ছিলেন তিনি। ভাবছিলেন, এখানে তিনি গবেষণাকাজে আসাতে সময় একেবারেই ছকে বাঁধা। চৈত্রে ঝড়বৃষ্টি বিচিত্র কিছু নয়, তবে মেঘডাকের সাথেসাথেই ঝড়বৃষ্টি উঠে আসার দৃষ্টান্ত তেমন নেই। হাঁকডাক করে উঠে আসতেও অনেকসময় ঘণ্টা পেরিয়ে যায়। কাজেই ঘরে পৌঁছে বিনা বিশ্রামে বেরিয়ে পড়বেন তিনি খামারে। উদ্দিষ্ট সময়টুকু ব্যয় করবেন কাজে।

আগন্তুক খামারসীমায় পা রেখেই ভেতরে গেটের ওদিকটাতে দলকুকুরের হাঁকডাক শুনতে পাচ্ছিলেন। তিনি যখন এসে গেটে পা বাড়িয়েছেন, তখনই ডানে হাঁকডাকের তীব্রতায় সেদিকে তার দৃষ্টি ঘুরে গেল। তিনি চেয়ে দেখলেন দীর্ঘ এক বাঁশ তালসমান উঁচুতে প্রস্থাপ্রস্থি খুঁটির সাথে রশি দিয়ে বাঁধা । তা থেকে পাকানো জীর্ণ কাপড় দেড় দুই হাত দূরে দূরে ঝুলানো আছে। দশ বারোটা কুকুর লাফিয়ে লাফিয়ে ঝুলন্ত কাপড়ে খাবলা বসাচ্ছে, আর এক দুই খাবলার পর মাথা ঝুঁকে মাটিতে মুখ গুজছে। কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে থাকার পর খানিকটা নিস্তেজতা নিয়ে একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে তারা। আগন্তুক বিস্মিত হয়ে মিনিট কয়েক দাঁড়িয়ে দৃশ্য অবলোকন করলেন। এরপর দ্রুত হেঁটে কুটিরে এসে উঠলেন।

কিছুক্ষণ খাটে হেলানে থেকে খোলা দরজায় বাইরের আবহাওয়ায় নজর রাখলেন তিনি। যতদূর দৃষ্টি পৌঁছে, দেখলেন রোদ মিলিয়ে আবছায়া ভর করেছে। মেঘের মৃদু ডাক থেকে থেকে চড়ে গেলেও অবস্থাদৃষ্টে এখনও মনে হচ্ছে না তুমুল কোন ঝড়বাদল শুরু হয়ে যেতে পারে। খাট থেকে নেমে দাঁড়ালেন তিনি। তখনই জোর পদশব্দে দারোয়ান এসে দরজায় দাঁড়াল। আগন্তুক কথা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি মুখ খোলার আগেই সে চেঁচিয়ে বলল, কুত্তাগুলান বদের হাড্ডি, বুঝলেন?

— জি।
— কর্মচারীগ তফোন( লুঙ্গি), গামছা, খ্যাঁতা- চাদ্দোর খাবলাইয়া ছিঁড়া ছুটাইয়া ফালাইছে গত কয়দিন, বুঝছেন?— জি।
— হ্যাতেরা কুত্তার বিরুদ্ধে কমপ্লেইন করলে মালিক এই ট্রায়ালের ব্যবস্থা দিছে।
— কোন ব্যবস্থা?
— উই যে দেখলেন, নিমপাতা, নিশিন্দা বাটা মিশাইনা পানিতে ভিজাইনা কাপড়ে খাবলা মাইরা মাইরা তিত্তা স্বাদ পাইয়া হারামজাদাগুলান কেমন মাটিতে মুখ ঠেকাইয়া প্রায়চিত্ত করতাছে।
— হুম, বুঝেছি, কিন্তু আমি এসব জেনে কী করব? আমি তো এখন পর্যন্ত কোন কাপড়চোপড় ধুইনি। শুকাতে দেয়ার প্রশ্ন তো পরের ব্যাপার।
— মালিকে কইছে এই বৃত্তান্ত আপনেরে জানাইয়া যাইতে, জানাইয়া যাইতাছি।
— হুম, বুঝেছি।
— যাই তালি!
— জি, যান।

দারোয়ান হেঁটে কিছুদূর এগোতেই আগন্তুক ঘর থেকে ত্বরিত বেরিয়ে খামার পথে পা ফেলেন। হাঁটতে থাকেন তিনি যেদিকগুলোতে এখনও যাওয়া হয়নি, সেগুলোর একটি বরাবর।

বেলা এখন তিনটার কাছাকাছি বোধকরি। দেখতে দেখতে এরই মধ্যে পুরোটা আকাশ মেঘে ছেয়ে গেছে। দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় জমে থাকা মেঘ আকাশের অন্য যেকোন অংশে থাকা মেঘের তুলনায় জমাটপুঞ্জ, গাঢ়তর কালো দেখালেও ঝড়বৃষ্টির লক্ষণ ততটা জোরালোভাবে ফুটে উঠছে না। কিন্তু হঠাৎ করেই শুরু হয়ে গেছে বিকট শব্দে বজ্রপাত। শব্দের ধাঁচে আগন্তুক আঁচ করতে পারছিলেন, বাজগুলো ধারেকাছেই কোথাও পড়ছিল। মফস্বল শহর অনতিদূরে হলেও এ খামার পৌর সীমানার বাইরে। কোনও বজ্রনিরোধক খামারের অভ্যন্তরে থেকে থাকবে বলেও অনুমিত হলো না তার কাছে। কাজেই বুকে ভয় নিয়েই হাঁটছিলেন তিনি।

খামারকর্মীরা একান্ত কাজে নিমগ্ন। তারাও সম্ভবত এ ধরনের মেঘ থেকে ঝড়বৃষ্টির আশংকা তেমন একটা করছে না। কিন্তু বজ্রপাতের শব্দ হওয়া মাত্রই তারা কাজ থেকে মুখ ওপরে তুলছে। এদিকসেদিক তাকিমাকি করছে। আগন্তুক অবস্থাদৃষ্টে খুব বেশি দূরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে মনে মনে সরে এলেন।

ঘরে ফিরে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে কাজে নিমগ্ন হলেন তিনি। কাগজ-পৃষ্ঠায় মনোযোগ এতটাই গভীর ছিল যে এরই মধ্যে কখন ঘণ্টা দুই পেরিয়ে গেছে তা টেরও পাননি। কক্ষের ভেতরে হঠাৎই যেন আলোর বড় ধরনের এক ব্যবধান তাকে নাড়িয়ে দিল। মুখ তুলে দরজায় তাকালেন তিনি। বাইরে লালরোদ। বেলা রীতিমত পড়ে এসেছে। দুর্যোগ আবহাওয়ার রেশমাত্র এখন নেই। আকাশ পরিচ্ছন্ন। নেই মেঘের কোনও হাঁকডাক। তিনি ভাবলেন, সূর্যাস্ত যেতে আরও আধাঘণ্টা বাকি। এসময়টুকু কাজে লাগালে কেমন হয়- মাঠে তো কর্মীরা আবারও কখন কাজ শুরু করে দিয়েছে।

যেই ভাবা সেই কাজ। ঝটপট খাট থেকে উঠে গায়ে শার্ট চড়িয়ে বেরিয়ে পড়লেন তিনি ঘর থেকে। খামারপথে গজ দশের মতো এগোতেই পেছন দিকে উচ্চস্বর ডাক শুনতে পেলেন, হে ভাই, এই যে দাঁড়ান। আগন্তুক পা থামিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখলেন দারোয়ান দৌড়ে আসছে। কিছুটা ভয় বিরক্তিতে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি তার অপেক্ষায়।

দারোয়ান অদূরে থেমে হাঁপাতে হাঁপাতে চেঁচাল, শুনেন, মালিকে বলছে সে আর আপনার কর্মকাণ্ড লইয়া বেশি চিল্লাপাল্লা করতে পারবে না। সহ্যের একটা সীমা আছে। সে অপারগ।

— ঠিক আছে।
— শুনেন, সে বলছে আপনারে নিজের বিবেকবুদ্ধি খাটাইয়া চলতে ফিরতে। না পারলে অনতিবিলম্বে খামার ছাইড়া চইলা যাইতে। কারো গবেষণার লাইগা তার বাপের শ্রাদ্ধ ঠেকেনাই।
— ঠিক আছে।
— সে কালকে সকাল সকাল তার বাপেরে নিয়া শহরে যাবে। দুইজনারই চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন শহরে থাকবে। বলছে, আপনে জানি তার কথায় ভগিচগি না করেন। উল্টাপাল্টা কাজ বন্ধ করতে না পারলে খামার দখল কইরা থাকার দরকার নাই। বলছে, তার কথাবাত্রা এই রকমোই।
— ঠিক আছে।
— আর জানি কী বলছে! ও শুনেন, আপনে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তখন খামারে হাঁইটা চরম অন্যায় করছেন। ভাইবা দেখেন ভালোমতন।
— ঝড়বৃষ্টি তো তখন আসেনি। আমি সতর্ক ছিলাম।
— ঠাঠাতো ছিটকাইয়া পড়ছে আসমান থেইকা, যেইখানেই পড়ুক। কোন অঘটনের ঝুটঝামেলা কাঁন্ধে নিতে সে রাজি না। আমারে আপনার লগে এত বেশি বকবক করতে মানা করছে। তার কথা না মানতে পারলে মানবেন, না পারলে পথ মাপতে বলছে। পরের সমস্যা লইয়া সে কোন ভোগান্তিতে যাইতে পারবে না।
— আচ্ছা, ঠিক আছে।

শহরে গেলেও সে ঠিকই আপনার কাজকর্মের খোঁজখবর রাখবে। কালকে থেইকা তার চাচায় খামার দেখশুনে আসবে।
— আচ্ছা, ঠিক আছে।
— গেলাম তাইলে।
— জি, যান।
— দারোয়ান বিপরীতে হেঁটে চলে যায়।

পর্ব ৫

আগন্তুক এ ধরনের ছাতা এই প্রথম দেখছেন। দোচালা টিনের ঘরের মতো গড়ন, রঙ গাঢ় সবুজ, পরিসর অস্বাভাবিক বড়। নাটক সিনেমার গ্রাম্য মাতবর ধাঁচে একজন ধরে আছে আরেকজনের মাথার ওপর। দুজনই হাঁটছে লক্ষ্য করার মতো ধীরগতিতে। আগন্তুক অনুমান করলেন, যার মাথার ওপর ছাতা ধরা আছে, তিনিই হবেন খামার মালিকের কথিত চাচা, বদলি খামার দেখভালকারী। গুরুগম্ভীর মুখাবয়ব, নাক লম্বা, চুল গোঁফ পাকা, থুতনির বৃত্তাকার দাড়িটুকু কাঁচা, গায়ে সবুজ ফতুয়া, পরনে সাদা পাজামা- সব মিলিয়ে ভদ্রলোককে খামার মালিকের চেয়ে কম বয়সী বলে মনে হচ্ছে। ছাতা ধরা লোকটা তার সমবয়সী হবে হয়তো; আকারে ছোট, পেট মোটা, নাক ছোট, চোখ ভাসা, মাথায় অর্ধটাক। দু’জন আলাপচারিতাবিহীন একান্ত নির্বাক হাঁটছে খামার পথে।

দুপুর বারোটার কাছাকাছি সম্ভবত। সূর্য প্রায় মাঝ আকাশে চলে এসেছে। রোদ যতটা ঝাঁঝিয়ে উঠেছে, গরম ততটা অসহনীয় মাত্রায় নেই। মৃদু ঝিরি বাতাসে খানিকটা শীতলতার পরশ মিলছিল। আগন্তুক একটা হাইব্রিড রসুন খেতে বসে এক খামারকর্মীর সাথে কথা বলছিলেন আর রসুনের নতুন জাতের নমুনা পরখ করছিলেন। ছাতাযুগল এতক্ষণ তার অদূরেই দাঁড়িয়ে এদিকসেদিক দৃষ্টি ঘুরাচ্ছিলেন। তারা হেঁটে একেবারে তার কাছাকাছি এসে পৌঁছলে আগন্তুক উঠে দাঁড়ালেন। সালাম দিলেন, কিন্তু মুল ভদ্রলোক তাৎক্ষণিক ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ছুঁড়লেন। সালামের কোন প্রত্যুত্তর শুনতে পেলেন না আগন্তুক।

সেদিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে হাঁটা ধরে তারা তার হাত দুই আড়াই কাছাকাছি এসে পৌঁছলে তিনি আবারও জোরেসোরে সালাম দিলেন। কিন্তু দু’জনই পাথরমুখো হয়ে পূর্ণ নিঃশব্দে পেরিয়ে গেলেন তাকে। ভাবটা এমন যেন আগন্তুক তাদের সামনে নেই, কিংবা তারা দেখেনি, অথবা পৃথিবীতে আদাব সালামের মতো প্রচলন বলতে কিছু নেই। আগন্তুক বিস্ময়াহত হলেও তৎপ্রসূত ভাবনানুভূতি মন থেকে মুছে পুনরায় কাজে মনোযোগী হলেন।

হাঁটতে হাঁটতে প্রান্তিক ঘরগুলোর দিকে চলে গেলেন ছাতাযুগল। আগন্তুক এবার ডায়েরি লিখাযোখা রেখে উঠে দাঁড়ালেন। পূর্বপরিকল্পনা মাফিক তিনিও প্রান্তিক পশুখামারগুলোর দিকে যাবেন। তবে তার গন্তব্য ওই দুই ব্যক্তি থেকে অন্তত একশ হাত দূরে, উত্তর পশ্চিম কোনার দিকে। হাঁটতে লাগলেন তিনি। কিছুদূর যাবার পর লক্ষ্য করলেন, ওই দুই ব্যক্তি এমনভাবে হাঁটা ধরেছেন যেন হাঁটাটা তাদের অনুদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা তিনি তাদের আদৌ লক্ষ্যবস্তু নন, অথচ উভয়পক্ষ হাঁটা অব্যাহত রাখলে মুখোমুখি হওয়া বা পরস্পরকে অতিক্রম করে যাওয়া হবে বাধ্যতামুলক।

ভেতরে খানিকটা আন্দোলিত হলেন আগন্তুক। মুহূর্তে সামলে নিলেন নিজেকে এই ভেবে-কী যাবে আসবে এই পারস্পরিক মুখোমুখি হওয়া না হওয়াতে বা অতিক্রম করে যাওয়াতে। নেহায়েত নিজের ভদ্রতা বা সৌজন্য বজায় রাখতে উত্তর পাবার কোনরূপ সম্ভাবনা নেই জেনেও তাদেরকে সালাম ঠুকে ভেতরে ভেতরে সম্ভ্রমাক্রান্ত তথা খাটো বোধ করবেন-এই আর কী। কী যায় আসে তাতে? তিনি তো আর চিরকাল এখানে থাকতে আসেননি। কাজের খাতিরে এসেছেন, আবার কাজ ফুরালে চলে যাবেন। এদের সমাজে এরা থাকবেন, তাদের সমাজে তিনি।

মিনিট দশের মাথায় দ্রুত অতিক্রম করলেন তারা পরস্পরকে। একই ঘটনা ঘটল; আগন্তুকের সালামের কোনও প্রত্যুত্তর করলেন না যুগল- তার নাকের ডগা দিয়ে সরব তাকে অতিক্রম করে গেলেন। আগন্তুক এবার দাঁড়ালেন। এখানে একটা সুপরিসর পুকুরের চালা। চালায় দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরে তাকালেন তিনি। দেখলেন যুগল অনতিদূরে স্থির দাঁড়িয়ে পুকুরচালার দিকেই তাকিয়ে আছেন। আগন্তুক লক্ষ্য করলেন, রৌদ্রতাপে রীতিমত ঘেমে নেয়ে উঠেছেন তিনি। ভাবলেন, পুকুরে নেমে একটু হাতমুখ ধুয়ে সতেজ হয়ে নেয়া যাক। সন্মুখের এক শীর্ণ খোলা পথ ধরে পুকুরের ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছেন তিনি নিচে। কী ভেবে ঢালে থেমে মুখ ঘুরিয়ে দেখলেন পশ্চাৎযুগল নির্বাক সেদিকে তাকিয়ে আছেন।

এবারে মুখ ঘুরিয়ে শা শা করে ঢাল পেরিয়ে পানির কিনারার দিকে চলে এলেন তিনি। পানিতে পা ঠেকাতে যাবেন, এরই মধ্যে বিপরীত চালার ওপাশের একচালা ঘরের দিক থেকে চিৎকার ভেসে এলো, এ ভাই, ক্যাডা আপনে? সাবধান পানিতে নাইমেন না। জলদি সইরা যান পানির কিনারা থেইকা। বাঁচতে চাইলে সরেন বলতেছি। এইটা কুমীরের পুকুর। না সরলে এক্ষুনি মারা পড়বেন আপনি। কুমীরের পেটে যাইতে না চাইলে সরেন।

আগন্তুক দ্রুত ঢাল বেয়ে কম্পমান বুক শরীরে ওপরে উঠে এলেন। তখনই পুকুরের পানিতলের দিকে ঘুরে তাকিয়ে ওপাশ থেকে চিৎকারকারীর চিৎকার- সতর্কতার চরম সত্যতা পেয়ে গেলেন। আবারও আতঙ্কে সারা শরীর কেঁপে উঠল তার। খামারের দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি। দেখলেন ছাতাযুগল নির্বাক শরীর ঘুরিয়ে আলপথে হাঁটা ধরলেন।

আগন্তুক থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লক্ষ্য করলেন, ওপাশ থেকে সতর্ককারী লোকটা কী একটা বোর্ড হাতে দৌড়ে আসছেন। চালার যে সরু প্রবেশপথ ধরে আগন্তুক পুকুরে নামতে গেছিলেন, লোকটা এসে সে পথের মুখে হাতের ভারী বোর্ডটা নামিয়ে দাঁড় করিয়ে পথটা বন্ধ করে দিলেন। আগন্তুকের উদ্দেশ্যে বললেন, নতুন আসছেন?

— জি।
— ঘটনাটা বইলেন না কাউকে।
— জি, আচ্ছা।
— দুইজন লোক যে ওইদিকে হাঁইটা গেল, তারা কি কিছু বলছে আপনারে?
— জি না।
— আচ্ছা, যান গিয়া। বোর্ডটার লেখার উপর দিয়া রঙের তুলি ঘুরাইয়া লেখা গাঢ় কইরা শুকাইতে দিছিলাম। সতর্কবাণী তো!
— জি, বুঝেছি।

সেদিন পুরোটা বিকেল ঘরের ভেতরে লেখাযোখায় ব্যস্ত রইলেন আগন্তুক। এতটাই নিমগ্ন রইলেন যে কাগজপত্র থেকে মুখ তোলার ফুরসত খুব কমই হলো। খোলা দরজায় বাইরের নানা শব্দপাত যেমন তার কানে এসে আঘাত হানছিল, তেমনই দরজার এপাশ দিয়ে বয়ে চলা নানা ছায়াদৃশ্যও যেন তিনি তৃতীয় চোখের মধ্যস্থতায় দেখতে পাচ্ছিলেন: কৃষকদের দ্রুত কিংবা ধীরপায়ে হাঁটাচলা, জোড়া পাখির ফুড়ুৎ, কুকুরের লাফিয়ে ছোটা, শুকরের ঘোৎচাল, ছাতাযুগলের দূরবর্তী স্থিতাবস্থান, যুবক-যুবতী, কিশোর কিশোরী, ঘুড়ি, ছাগল, বিড়াল, কুকুর- সঙ্গী একদল, তাদের মৃদু হৈ-হুল্লোড়, ছোটাছুটি, ঠোঁট ওল্টানো শ্যামকিশোরের ঘরের দরজায় উঁকি-প্রস্থান প্রভৃতি।

সূর্যাস্ত নাগাদ তিনি লেখাযোখায় বিরতি আনেন। শরীর মনে খুব ক্লান্তি ভর করেছিল। সান্ধ্যভোজ অথবা রাতের খাবার কখন খাবেন, আদৌ খাবেন কি খাবেন না, সে বিষয়ক ভাবনা তথা হিসেবেনিকেশে কী কারণ বিরত থাকেন। সূর্যাস্তের পরবর্তী নিস্তব্ধতায় খাটে শরীর ঢেলে ঘুমে আচ্ছন্ন হন। অচেতন দশায় নানাবিধ স্বপ্নদৃশ্যে অবতীর্ণ হন। সেসবের অধিকাংশই অদ্ভুত – অস্বাভাবিক : তিনি বৃক্ষঝোপে পরিণত হয়েছেন, মাথায় মৌচাক বসেছে, সরু এক মই বেয়ে অনেক ওপরে উঠেছেন-এমন সময় মইটি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়তে পড়তে স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে, প্রস্রবণের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরেও কোন উপযুক্ত স্থান খুঁজে পাচ্ছেন না, একটা ধবধবে সাদা লম্বাশিং গাইগরু একজোড়া শুকর পিঠে নিয়ে খামার জুড়ে চক্রাকারে উড়ছে, খামার মালিক খামারের কেন্দ্রবিন্দুতে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন- অস্বাভাবিক দীর্ঘ শরীর – তার মাথায় কোলাহলরত শালিকপাখিরা ঝাঁক বেঁধে উড়ে বসে তার ঊর্ধ্বাঙ্গ অদৃশ্য করে দিচ্ছে- এমতাবস্থায় তিনি চিৎকার করে উঠলে পাখিরা তুমুল কিচিরমিচিরে তাকে ছেড়ে খামার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, খানিকক্ষণ চক্কর দিয়ে আবার এসে তাকে ঢেকে দিচ্ছে, তিনি আবারও চিৎকার করছেন। এমনই একবারের চিৎকারে আগন্তুকের ঘুম ভেঙে যায়।

তিনি চোখ কচলে চেয়ে দেখলেন ঘর বাতিহীন। খোলা দরজায় উঁকি দিচ্ছে বাইরের অন্ধকার। মাথার ওপরকার চালে কিসের মুটমুট শব্দ হচ্ছে। টিনের ওপর কিছু ঘষাঘষির শব্দও যেন বেগবান হচ্ছে। দরজায় খিল আঁটতে উঠে এলেও কৌতূহল তাকে বাইরে টেনে আনে। সামনের খোলা পরিসরে দাঁড়িয়ে ঘরের চালে দৃষ্টি ছোঁড়েন তিনি। ভয়ে আবেগে শিউরে ওঠেন। দিব্যি কে একজন চালের মাঝামাঝি আয়াসে বসে আছে। আকৃতি মাঝারি, কান বড়, গায়ের রঙ কালো। আচমকা উঠে দাঁড়ালে পরিচয় স্পষ্ট হলো তার। সে চারপেয়ে, উঁচু-লেজ- একবার সন্মুখ হাত/ পা উঁচিয়ে ভেংচি কাটল আগন্তুকের উদ্দেশ্যে। তারপর শরীর ঘুরিয়ে উঁচু লেজ আরও উঁচিয়ে হেঁটে লাফিয়ে নামল উত্তরপাশের ঝোপে।

আগন্তুক স্থির দাঁড়িয়ে একবার চারদিকে নজর করলেন। প্রান্তিক চালাঘরগুলোর কোনটিতে আলোর উপস্থিতি নেই। শুধু খামার মালিকের বাসভবনের পাশের ছোট্ট একতলাটির ভেতরে আলো জ্বলছে। গোটা খামার আবহ বিশেষভাবে টানলেও আগন্তুক আলপথে পা বাড়াতে সাহস করলেন না। বাইরে বেরোবার সময় পেরিয়ে যাওয়াতে তিনি রাতের খাবার আপাতত চিড়ামুড়িতে সেরে নেয়ার সিদ্ধান্তে ঘরে ঢুকে গেলেন।

হালকা পানাহারের পর কিছুক্ষণ কাগজপত্র ঘেটে ঘুমিয়ে গেলেন তিনি। ঘুমঘোরে একইরূপ স্বপ্ন দেখতে লাগলেন, যেমনটি সান্ধ্যঘুমে দেখেছেন। মাঝরাতে যখন ঘুম থেকে জাগলেন, তখন ঘরের চাল ও পেছনের ঝোপে বাতাসের ছন্দময় শব্দ শুনতে পেলেন। দূরে কোনওদিকে কেউ আপন মনে বাঁশিতে সুর তুলছে। কান ফেলে তিনি বোঝার চেষ্টা করলেন শব্দটি খামারের ভেতর থেকেই হচ্ছে, নাকি বাইরে থেকে ভেসে আসছে। শব্দ অতি ক্ষীণ হওয়ায় সঠিক দিক নিশানায় ব্যর্থ হয়ে আবারও ঘুমানোর চেষ্টায় মনোনিবেশ করলেন তিনি।

আবছায়া ভোরে দমকা বাতাসের সাথে টিনের চালে ভারী বড় বৃষ্টির ফোঁটার শব্দে ঘুম কাটল আগন্তুকের। তিনি ভাবলেন, দিনের আবহাওয়াটা বুঝি আজ বৈরী হয়ে গেল। কিন্তু মিনিট দশের মাথায় তিনি লক্ষ্য করলেন, বৃষ্টি বাতাসের শব্দগুলো একেবারে মিলিয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ বিছানায় ঢি’ মেরে শুয়ে রইলেন আগন্তুক। চারদিক থেকে পাখি ও বুনো খামারি জীবজন্তুর করা শব্দপাত কানে এসে উঠছে। ধীরে ধীরে খামার থেকে ভেসে আসছে খামারকর্মীদের হাঁকডাক কথোপকথনের শব্দ। আলসেমি মোটামুটি কমে এলে বিছানা থেকে মাথা তোলেন তিনি। বাইরের রোদের আবহ ঘরে এসে পড়েছে।

খাট থেকে নেমে দরজা খুলে বাইরে তাকালেন তিনি। রীতিমত রোদ উঠে গেছে। প্রকৃতিতে বৃষ্টিবাদলার ন্যূনতম ছাপ নেই। ঘরের ওপাশে হেঁটে গিয়ে ট্যাপকলের পানিতে মুখহাত ধুয়ে এলেন তিনি। খাটে বসে কাগজপত্রে মাথা ঝুঁকলেন। ভাবছেন ঘণ্টাখানেক কাজের পর বেরোবেন নাস্তা-হোটেলের উদ্দেশ্যে। হঠাৎই কাদের পায়ের শব্দ সচকিত করে তুলল তাকে। কে এলো আবার? কৌতূহলে মুখ তুললেন তিনি। দেখলেন তিন সদস্যের এক দল চৌকাঠে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ্য করছে। বয়স তাদের আট থেকে বারোর মধ্যে হবে। দুজন ছেলে, একজন মেয়ে। সাজপোশাকে তাদের গ্রাম্য বলে ঠাউরাচ্ছিলেন আগন্তুক। ছেলে দুটির একজন হুট করে চৌকাঠ মাড়িয়ে ঢুকে গেল ঘরে। আগন্তুক তৎক্ষণাৎ বললেন, কে?

— আ- মি।
— নাম?
— আজমির।
— আজমির শরীফ?
— নাহ!
— কী?
— আজমির!
— ঘরে কী কাজে এলে?
— আপনের কাজ নাই? খামারে সবাই কাজ করতেছে!
— এই যে আমি কাজ করছি।
— কই?
— এইযে লিখছি।
— ও- -।
— তুমি কোথায় থাকো? বাড়ি?
— ওইধারে, দুই মাইল দূরে।
— খামারে কেন এসেছ?
— ফুঁবারে দেখতে আসছি।
— কে তোমার ফুঁপা?
— এই জমিনের মালিক।
— আপন?
— কী জানি, মায় জানে – বাবায়, দাদীয়ে।
— কিন্তু উনিতো শহরে চিকিৎসার জন্য গেছেন।
— আইজগা চইলা আসব।
— কখন?
— দুফুরে।
— সাথে ওরা কারা?
— আমার বইন, চাচতভাই।
— তা কখন এসেছ সবাই?
— এইমাত্রোক।
— কে কে? কতজন?
— এই তিনজন, বাবায়, মায়, দাদীয়ে।
— ওনারা কোথায়?
— ওই দালানে গেছে।
— তা সবাই এত সকালে চলে এসেছ?
— ফুঁবারে দেইখা বিকালে চইলা যাব। এইহানে থাকনের ব্যবস্থা নাই। থাকলে ফুঁবায় রাগ করে।
— বুঝেছি।
— যাইগা অহন। খামারে ঘুরুম। ওই চল, ওইযে কুমীরের ধারে যাই।
— হো -ও- ও -কুমীর দেহিগা, কু-মী-র – -।

সংখ্যা নগন্য হলেও প্রবল শোরগোল করে খামার পথে দৌড়ে চলে গেল তিন সদস্যের দলটি। আগন্তুক কালবিলম্ব না করে গায়ে শার্ট চড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লেন নাস্তা-হোটেলের উদ্দেশ্যে। গেটের কাছাকাছি এসে দেখলেন বাঁ দিকের গাছগাছালির নিচে এক প্রৌঢ়, এক প্রৌঢ়া ও এক বৃদ্ধা দাঁড়িয়ে মগডালের মৌচাক দেখছে। ক’টা কুকুর ঘুরঘুর করছে তাদের গা ঘেঁষে। দারোয়ান তাদের সাথে কী কথোপকথনে ব্যস্ত। গেট খুলে বেরিয়ে বার থেকে চাপিয়ে রাস্তায় পা ফেললেন আগন্তুক।

নিকটস্থ রেস্তোরাঁয় নাস্তা সেরে কিছুক্ষণ বাইরের পথে হাঁটাহাঁটির পর তিনি যখন খামার গেটে পৌঁছেন, তখন বেলা বেশ ওপরে উঠে গেছে। গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই তিনি খামারে ব্যস্ত চিত্র দেখতে পেলেন। সামনে দু’ কদম ফেলতেই ডানে কিসের আর্তডাক শুনে সেদিকে দৃষ্টি ঘোরালেন। দেখলেন, ওদিকের মরা কাঁটা-ঝোপ তথা বড় ধরনের কাঁটাবহুল শুকনা ডালের ফাঁকায় দেয়ালের গা ঘেঁষে একটা সাদা ধবধবে হলুদ চোখের খরগোশ শব্দটি করছে। দেখে মনে হচ্ছিল যেন গাছের ডালের চিপায় কিংবা কাঁটার খোঁচায় আটকে আছে।

আগন্তুক স্থির দাঁড়িয়ে গেলেন। খানিকটা বিব্রত বোধ করলেন। ওদিকে অদূরে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন আগের দিনের সেই ছাতা-যুগল। নির্বাক দুজনেরই দৃষ্টি আগন্তুকের দিকে। আগন্তুক সাতপাঁচ না ভেবে ওই কাঁটাঝোপ তথা ডালটির গোড়া ধরে সরাৎ করে জাগিয়ে তুললেন। খরগোশটি তৎক্ষণাৎ দৌড়ে গেল বটে। কিন্তু ডালটি জাগিয়ে তোলা মাত্রই ঘটে গেছে এক বিপত্তি। একঝাঁক হলুদ রঙা বিশেষ প্রজাতির বড় মৌমাছি দেয়ালগাত্রের ছোট্ট বাটির মতো মেটে চাক থেকে তীর বেগে ছুটে এসেছে তার দিকে। তিনি দু’হাতে মুখ ঢাকলেও রক্ষা পাননি। চোখের নিমিষে বেশ কটি হুল ফুঁটে গেছে তার দু’হাতের চেটো ও ঘাড়ের দু’পাশে।

ক’ সেকেন্ড এর মাথায় তীব্র ব্যথা টের পেতে থাকেন তিনি। তিনি লক্ষ্য করলেন, ছাতা-যুগল এতক্ষণে শরীর ঘুরিয়ে হাঁটা ধরেছেন। ব্যথায় কাতর দ্রুত হেঁটে ঘরে এসে পৌঁছলেন তিনি। ব্যাগ থেকে শেভ লোশন বার করে ফুলে ওঠা আক্রান্ত স্থানগুলোতে লাগিয়ে পরিত্রাণ পেতে চাইলেন। ব্যথার তীব্রতায় উবু হয়ে শুয়ে পড়লেন তিনি বিছানায়। আশংকা করতে লাগলেন শরীরে জ্বরটর এসে যায় কী না। এখানে এ মুহূর্তে শরীর খারাপ হওয়া মানেই বড় ধরনের বিপত্তি।

পর্ব ৬

ব্যথায় কাতর বিছানায় পড়ে রইলেন আগন্তুক। ঘরের দরজা খোলা রেখেছেন। দৃষ্টি বাইরের খামার- খেতখোলা, দক্ষিণের পাঁচিল, তারও ওপর দিয়ে দৃশ্যমান গাছপালার শীর্ষ পেরিয়ে রোদঝাঁঝালো নীলাকাশে। শরীরের যন্ত্রণার সাথে তার মনও বিষিয়ে উঠেছে। বলতে গেলে এ মুহূর্তে ওই দুর্ঘটনাচক্রে অনাহূত সময় অপচয় হচ্ছে তার। তীব্র আলোকোজ্জ্বল দুপুরটি ক্রমশ অতিক্রম করে যাচ্ছে। খাবার খাওয়া জরুরি, অথচ সে উদ্দেশ্যে বাইরে যেতে কিছুতেই মন টানছে না তার। এরই মধ্যে বেশ ক’বার কাগজ কলম ডায়েরি টেনে নিয়েছেন তিনি, কিন্তু কাজে মনোযোগ আসেনি। ভাবলেন, দুপুরে বাইরে না গিয়ে চিড়ামুড়ি খেয়ে, সাথে থাকা প্যারাসিটামল সেবন করে দেখবেন কী ফলশ্রুতি দাঁড়ায়।

বেলা গড়াবার উপক্রম হলে চিড়ামুড়ির প্যাকেট নিয়ে বসেন তিনি। মুঠো দুই চিবিয়েছেন, এরই মধ্যে খামার গেটের দিকে হৈ-হুল্লোড়ের সাথে মোটরগাড়ির শব্দ শুনতে পেলেন। খাট থেকে নেমে দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। ওদিকে দৃষ্টি ধরে দেখলেন খোলা গেট পথে একটা মোটরগাড়ি ঢুকছে, আর একদল আবালবৃদ্ধবনিতা ঘিরে ধরেছে গাড়িটিকে। কেউ কেউ খোলা জানালায় উঁকিঝুঁকি দেয়ার চেষ্টা করছে। গাড়িটি ভেতরের লনে দক্ষিণমুখো হয়ে শা শা করে ওদিকের ভবন-সম্মুখে দাঁড়িয়ে গেল। খামার মালিক ও তার বাবা গাড়ি থেকে নেমে চারদিকে তাকালেন একবার। তারপর লোকপরিবেষ্টিত হয়ে বারান্দা মাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন একতলা ভবনটিতে। আগন্তুক দরজা ছেড়ে খাটে উঠে পুনরায় চিড়ামুড়িতে মনোনিবেশ করলেন।

খাওয়া শেষে একটা প্যারাসিটামল মুখে নিয়ে খাটে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। ভাবছেন, ব্যথা মোটামুটি নেমে যদি যায় তো কাজে বেরিয়ে পড়বেন। প্রান্তিক অনেক দিকই এখন পর্যন্ত তার পরিদর্শন হয়ে ওঠেনি। আজ সেসবের উল্লেখযোগ্য কিছু দিকে যাবেন, যদি শরীর অনীহা প্রকাশ না করে। ফাঁকে খানিকটা ঘুমিয়ে নিতে পারলে ভালো হতে পারত বলে ভাবছেন তিনি। ঘুমের ব্যথা উপশমকারী ভূমিকা থাকে। ভাবনাঘোরে মিনিট দশেক চোখের পাতা বন্ধ করে রাখার পর তন্দ্রাচ্ছন্নতায় হারান তিনি। হঠাৎ দরজায় মাঝারি মাত্রার বাড়ির শব্দে লাফিয়ে ওঠেন। বলেন, কে?

এখলাস মিয়া! টানটান কণ্ঠ।

এখলাস কে?

দারো-য়ান! গলা চিনবার পারেননাই?

হু-ম, ঘুমাচ্ছিলাম তো। আপনার নাম জানতাম না এতদিন।

সমেস্যা নাই, খুলেন।

জি।

এইটা নেন।

কী এই কাগজে?

চুনা, চুনা, পানের চুনা।

কিন্তু পানতো আমি খাই না। পান নেইও কাছে।

আপনে না খাইলেও আমিতো খাই।

কিন্তু আমি শুধু এ চুনা দিয়ে কী করব?

আহা, আপনেরে বল্লায় কাঁমড়াইছে না? তহন যে গেট থেইকা দাঁবড়াইয়া আইলেন! ঘরে থিকাও বাইর হইতেছেন না।

ও হ্যাঁ, বেশ ক’টা মৌমাছি তখন কাঁমড়েছে।

ব্যথা আছে না?

জি, তা আছে।

তাইলে এই কাগজের চুনা কাঁমড়ানির জায়গায় লাগাইয়া দেখেন। একটু দেরি অবশ্যি হইয়া গেছে।

আমি আবার একটু ব্যস্ত হইয়া পড়ছিলাম। তখন আসব ভাবলেও আসতে পারিনাই। মালিকে ফিরলো তখন৷

আচ্ছা সমস্যা নেই, কিন্তু এ চুনায় কি কোন কাজ হবে?

আলবৎ, ক্যান হবে না? জাগাত জাগাত অহনি লাগাইয়া দেন। আমার তো ঠিকই কাজ হয়। কতবার দিছি!

আচ্ছা, ঠিক আছে, দিচ্ছি আমিও শীঘ্রই।

আমি তাইলে যাই।

জি।

আগন্তুক বাইরে গিয়ে দু’হাত ভালোমতো ধুয়ে এলেন। গামছায় মুছে আক্রান্ত স্থানগুলোর প্রতিটিতে চুনা লাগিয়ে আবারও বিছানায় গা এলিয়ে দ্রুত ব্যথা নেমে যাওয়ার অপেক্ষায় চোখ বুজে রইলেন। প্রথমে একটু জ্বালাপোড়া বোধ হলেও ধীরে ধীরে ব্যথা নেমে যাওয়ার ব্যাপারটি টের পেতে লাগলেন। খানিক আরামে আবারও তন্দ্রাচ্ছন্ন হলেন তিনি।

আধাঘণ্টা পর তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেলে বিছানা থেকে উঠে বসেন তিনি। অনুভব করলেন, ব্যথা অনেকটা নেমে গেছে। হাতদুটি স্বাভাবিকের চেয়ে ভারী বোধ হলেও কাজে বেরোবার ক্ষেত্রে তা প্রতিবন্ধক হবে বলে গণ্য করছিলেন না। মুখ হাত ধুয়ে গায়ে শার্ট চড়িয়ে ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লেন তিনি খামারে।

ক’ কদম হাঁটতেই পেছনে কারো উচ্চস্বর ডাক শুনতে পেলেন, কই যাইতেছেন? ও ভাই, দাঁড়ান!

আগন্তুক থমকে দাঁড়ালেন। পেছন ফিরে দেখলেন দারোয়ান দৌড়ে আসছে। কিছুটা বিরক্তি-কৌতূহল নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। দারোয়ান খুব কাছাকাছি এসে ফ্যাসফেসে গলায় বলল, শিগগিরি সুস্থ হইয়া গেছেন তাইলে? ওষুধে কাজ হইছে ভালো, না?

জি।

এইজন্যই ডাকতেছিলাম। খুব ভালো হইছে, যান এখন।

জি।

দারোয়ান উল্টা ঘুরে হাঁটা ধরে। আগন্তুক আলপথে পা চালান। হাঁটতে হাঁটতে আজ চলে আসেন উত্তরদিকের প্রান্তিক ঘরগুলোতে। এদিকে প্রতি ঘরের সামনে দিয়ে একটা করে পশু খামার- গরু মোষ ছাগল ভেড়ার। উত্তরের দেয়ালে ঠেক-খাওয়া পথসহ বেশকিছু জায়গা ফাঁকা। ফাঁকা জায়গার ডানে ছোট্ট এক বনের মতো- ঘন ঝোপঝাড় ও উঁচু উঁচু গাছপালা। আগন্তুক নিশানায় ঠিক করলেন, এই ঝোপ ঘেঁষে ওপ্রান্ত বরাবর দক্ষিণেই তার ঘরটি। ঝোপের ভেতর দিয়ে গমনাগমনের পথ থাকলে দূরত্বটি সামান্যই।

গাছপালাগুলোতে প্রচুর পাখপাখালি আছে। ডালে ডালে বেশকিছু সংখ্যক বাঁদরের আনাগোনাও আগন্তুকের চোখে পড়ল। গবাদিপশুগুলোর অধিকাংশই খাদ্যগ্রহণে ব্যস্ত। কেউ কেউ শুয়ে জাবর কাটছে। এখানকার কর্মীদের সাথে কথাবার্তা বলে তিনি নানা তথ্য লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন।

এদিকের পথটি ধরে পুব বরাবর অগ্রসর হয়ে শেষ কুটিরটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনি। এখানে একটি মহিষের খামার আছে। বিশ পঁচিশটির মতো মহিষ খাদ্যরত, দাঁড়িয়ে-বসে নানাভাবে আছে। কুটিরবাসীর সাথে আলোচনার ফাঁকে আগন্তুক দক্ষিণে তাকিয়ে লক্ষ্য করলেন ছোট আকারের এ বনঝোপটি এদিকে পুব পাঁচিলের কাছাকাছি এসে শেষ হয়েছে। তিনি উপলব্ধি করলেন, এই বরাবর দক্ষিণে ২০০ হাতের মতো দূরত্বেই খামারের মুল প্রবেশদ্বার। কিন্তু ওদিকে যাবার পথটি কাঁটাতারের বেড়া ও একটি লৌহদরজায় তালা লাগিয়ে রুদ্ধ করা আছে। কাজেই সংক্ষেপে ফিরে যাবার পথ থেকেও নেই; যেপথে তিনি এদিকে এসেছেন, সেপথ ধরেই আবার ফিরতে হবে।

এখানকার তথ্যাহরণ শেষে আগন্তুক কোনরূপ বিলম্ব না করে করলেনও তা-ই। বনঝোপের উত্তরপাশ দিয়ে চলা পশ্চিমমুখো পথ, অর্থাৎ উল্টাপথ ধরে গন্তব্যে ফেরার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলেন। বেলা একেবারে পড়ে এসেছে। অস্তাচলগামী লালাভায় তামাম ঝোপাঞ্চল, ডান-পাঁচিলগাত্র ও সম্মুখের শায়িত পিচপথ যেন ঝলসে উঠেছে। চারদিকে বিশেষ করে ঝোপ জুড়ে অসংখ্য পাখি কলকাকলি ধরেছে, সরব হয়ে উঠেছে পশুখামারগুলোর অধিকাংশ পশুও।

আগন্তুক হাঁটছেন আনমনে। এখানে আসা অবধি এই প্রথম যেন মুক্তির কী এক স্বাদ মনেপ্রাণে উপলব্ধি করছেন। বলতে গেলে এই পিচপথ, উঁচু-কালো খামার- পাঁচিল, বনসাদৃশ্য ঝোপ, মাথার ওপরে অবারিত নীলাকাশ, পাখি জীবে কোলাহল, মুক্ত বাতাস, লাল সূর্যাভা- সবে মিলে মনের ভেতরে ভালো লাগার অনুপম এক ঢেউ তুলেছে। সে উচ্ছল ঢেউয়ে পালতোলা ডিঙিনৌকা করে তিনি যেন ভেসে চলেছেন কোনও অজানালোকে। বেশ লাগছে তার আজ এ মুহূর্তটিতে। মাঝদূরত্বে ফিরে হাঁটা থামিয়ে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি।

আবারও হাঁটা ধরলেন তিনি। সূর্যাস্ত গেল। এদিকসেদিক আযান বাজছে। এখান থেকে খামারের দক্ষিণপশ্চিম কোনার পাঁচিল ও উঁচু গাছপালা ভেদ করে অদূরের নগর-শীর্ষের মোবাইল টাওয়ার, ওয়্যারলেস টাওয়ারে সদ্য জ্বলে ওঠা লাল আলো দৃষ্টি কাড়ছিল তার। হাঁটতে হাঁটতে ঘরের সামনে এসে থেমে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। তারপর ঘরের তালা খুলে ঘরে ঢুকে বাতি জ্বেলে দিলেন।

পোশাক পাল্টে খাটে গা এলিয়ে দিলেন তিনি। ভাবছিলেন, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর লেখাযোখায় মনোনিবেশ করবেন। মিনিট দশেক পর সে উদ্দেশ্যে খাট থেকে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি, ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ পেলেন। সাথে সাথে দারোয়ানের কণ্ঠ ভেসে এলো, শুনতেছেন নাকি, ও ভাই?

জি, বলুন।

আপনের বিশেষ খবর আছে।

জি, বলুন।

মালিকে জানাইছে কালকে থেইকা আপনে মুক্ত-স্বাধীন।

মানে? চলে যেতে বলেছেন নাকি?

না না, তা বলেনাই। বলছে এখন থেইকা আপনে খামারে যখন মন চায় তখনই ঘুরাফেরা করতে পারবেন। যেদিক মন চায় সেইদিকই যাইতে পারবেন। মালিকের দালানের পিছনের ধারেও। মালিকের শরীল এখন খুব ভালো। তার বাপেও ভালো আছে।

আচ্ছা ঠিক আছে।

আমি গেলাম।

জি।

শওকত নূর | Shawkat Noor

Famous Poetry in Bengali | Shabdodweep Bangla Kabita

Best Bangla Limerick Collection | Shabdodweep Kobita

Best New Bengali Famous Story | বিষণ্ণ বিদায়

World of Possibilities Mean | Best Shabdodweep Article

Anandabazar Bengali Short Story | Bengali Short Story | Pratilipi Horror Stories in Bengali | Lifestyle Web Stories in Bangla | Trending online bangla golpo pdf free download | Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | Long Emotional Story Bangla pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic Long Emotional Story Bangla | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Long Emotional Story Bangla in english | Trending online bangla golpo pdf download

suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Long Emotional Story Bangla | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Long Emotional Story Bangla | Pdf Long Emotional Story Bangla | Long Emotional Story Bangla App | Full Long Emotional Story Bangla Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Trending online bangla golpo pdf

Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Long Emotional Story Bangla 2024 | New Long Emotional Story Bangla – Episode | Golpo Dot Com Series | Long Emotional Story Bangla Video | Story – Long Emotional Story Bangla | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Long Emotional Story Bangla Netflix | Audio Story – Long Emotional Story Bangla | Video Story – Long Emotional Story Bangla | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Top Long Emotional Story Bangla | Long Emotional Story Bangla Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Trending online bangla golpo book pdf

Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Long Emotional Story Bangla | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Trending online bangla golpo free download

Leave a Comment