Online Galper Diary | Best Bengali Story Collection

Sharing Is Caring:

হাতির স্মৃতি – প্রীতম সরকার

“এর তো একটা সমাধান করতে হয় কানাই! এভাবে তো প্রতি বছর আমাদের ক্ষতি আর আমরা স্বীকার করে নিতে পারছি না!” শম্ভু কানাইকে আশ্বস্ত করতে বললো!

“কি উপায় করবি কানাই! ইলেকট্রিকের বেড়া দিতে তো বনকর্তারা বারবার নিষেধ করে গিয়েছেন! কিন্তু হাতির এই তাণ্ডব তো আমাদের জীবনের উপর দিয়ে চলছে! প্রতি বছর এই এক ক্ষতি! আমি তো আর ভাবতেই পারছি না!” হতাশ কানাই শম্ভুর কথার জবাব দেয়।

গতরাতে হাতির পাল তছনছ করে দিয়ে গিয়েছে কানাই এর ধানের জমি। রাতে যখন পাশের বাড়ির শম্ভু ওঁকে ডেকে তুলে জমিতে এনেছিল, তখন হাতির দলটি সারা জমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুঁড়ে করে ধানের গাছগুলিকে তুলে তুলে যত না খাচ্ছিল, তার চেয়ে প্রায় পনেরো-কুড়িটা দাঁতালের দলটি অনেক বেশি ক্ষতি করেছে ধান ভর্তি গাছগুলোকে মাড়িয়ে নষ্ট করে।

আজ সকালে সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া ধানের ক্ষেতের পাশে মাটির আলে বসে মাথায় হাত দিয়ে গত রাতের হাতির তাণ্ডবের ফলে ক্ষেতের অবস্থা দেখছিল কানাই। জমির থেকে তাঁর নিজের বাড়ি গ্রামের একধারে, বেশ কিছুটা দূরে। গ্রামের প্রায় শেষ প্রান্তে জঙ্গল লাগোয়া তাঁর আট বিঘা জমিতে কানাই এবার ধান লাগিয়েছে! সেই ধানের জমির ফসল প্রায় কাটার সময় হয়ে এসেছিল! এরমধ্যে এই কাণ্ড! গতরাতের সেই ঘটনার পরে আর বাড়ি আর ফিরে যায়নি কানাই। সারারাত এখানেই জমির এক পাশে বসে কাটিয়েছে। ভোরের দিকে যখন হাতির পাল জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিল, কানাই ভেবে পাচ্ছিল না, এবছর কিভাবে মহাজন মধুসূদন হাজরার টাকা সে শোধ করবে! আশা ছিল, জমির ধান বিক্রির টাকায় সে এবছর ফাল্গুন মাসে তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবে। মেয়ের জন্য পাত্রও দেখা হয়ে গিয়েছে। পাত্রপক্ষ সোনালিকে পছন্দও করে গিয়েছে! কিন্তু বড় মেয়ের বিয়ের জন্য যে টাকার দরকার, কানাই ভেবেছিল, এবছর জমিতে যে ধান হয়েছে, সেটা বিক্রি করে মেয়ের বিয়ের খরচের কিছুটা জোগাড় করবে! কিন্তু হাতির দল তাঁর সব আশা শেষ করে দিল‌।

কানাই-এর সঙ্গে গত রাতে গ্রামের আরও অনেক লোকজন এলেও সারা রাত কেউ ছিল না। ভোরের দিকে সূর্য এখন পূব আকাশে অনেকটাই উপরে উঠে গিয়েছে। আবার সেই শম্ভুই ফিরে এসেছে কানাই এর পাশে। গতরাতে শম্ভু যা করেছে, কানাই হয়তো কখনও শম্ভুকে ভুলতে পারবে না!

হাতির তান্ডবে ধ্বংস হয়ে যাওয়া জমির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নিজেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো শম্ভু। কানাইকে সান্ত্বনা দিতে শম্ভু বললো, “আর ভেবে কি করবি কানাই। এটাই আমাদের নিয়তি। আমি তো ভাবছি, আজ রাত থেকে জমির কাছেই পলিথিনের তাঁবু খাটিয়ে সেখানে রাতে থাকবো! অন্তত রাতে হাতির পাল জমিতে হামলা করলে আগে থেকে আগুন জ্বালিয়ে, ফটকা ফুটিয়ে সেগুলিকে তাড়িয়ে অন্য দিকে পাঠিয়ে দিতে পারবো! এভাবে যদি হাতির হাত থেকে কিছুটা ধান ঘরে তোলা পর্যন্ত রক্ষা করতে পারি!”

“কিন্তু আমার কি হবে রে শম্ভু! আমার সবই তো শেষ করে দিল হাতির দল! আমার মেয়ের সামনে বিয়ে! মহাজন মধুবাবুর ধারের টাকা শোধ দিতে হবে! আমার যে মাথা কাজ করছে না!” কানাই মানসিকভাবে যথেষ্ট ভেঙ্গে পড়েছে।

“শোন কানাই, তোর মেয়ে তো আমাদেরও মেয়ে! ওঁর বিয়ে নিয়ে তুই কিছু চিন্তা করিস্‌ না! একটা ব্যবস্থা সবাই মিলে করবো ঠিকই। কিন্তু তাতে নিজেদের জমির ফসলকেও তো হাতির হাত থেকে বাঁচাতে হবে! আর মধুবাবু তো এই গ্রামেরই মানুষ। তিনি কি তোর এই অবস্থা বুঝবেন না!”

শম্ভু কানাই-এর সঙ্গে যখন কথা বলছে, ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হলো ওদের গ্রামের নারান। নারায়ন নাম হলেও গ্রামের সবাই ওঁকে নারান বলেই ডাকে। ওঁর ছেলে এবছর শিলিগুড়ির কলেজে ভর্তি হয়েছে। ছেলের পড়াশোনা নিয়ে একটা বেশ গর্বও আছে নারানের। নারানও রাতে শুনেছিল, কানাই-এর জমিতে হাতি হামলা করেছে। পরে পটকার শব্দও শুনেছে। কিন্তু শরীর সেভাবে ভালো না থাকায় রাতে কানাই-এর জমিতে হাতির তান্ডবের সময় আসতে পারেনি। তাই সকালেই কানাই এর বাড়ি ঘুরে তাঁকে সেখানে না পেয়ে জমিতে খুঁজতে চলে এসেছে। রাতেই শুনেছে, গ্রামের অন্য সবাই মিলে আগুনের মশাল নিয়ে ধাওয়া করেও ভোরের আগে হাতির পালকে জঙ্গলে ফেরত পাঠাতে পারেনি।

নারানের নিজেরও পাঁচ বিঘা ধানি জমি রয়েছে। ভুটান পাহাড়ের হাতি সেখানেও যেকোন রাতে হামলা করতে পারে ভেবে সে নিজেও গ্রামের অন্যদের মতো চিন্তায় রয়েছে। সে কানাই আর শম্ভুর কাছে এসে বললো, “তোদের নিশ্চয়ই এখনও চা খাওয়া হয়নি! চল গ্রামের মোড়ের গুরুপদ-এর চা এর দোকানে! আমি তোদেরকে চা খাওয়াচ্ছি!”

আসলে নারান কানাই এর শোক ভোলানোর চেষ্টা করতেই এ’কথাগুলো বলেছিল। নারানের কথা শুনে কানাইকে জোর করলো শম্ভুও। তিনজন মিলে যখন গুরুপদের চা এর দোকানে পৌঁছালো, গুরুপদ তখন সবেমাত্র দোকানের উনুনের কয়লার আঁচে তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করছে। এখনও চা বানানো শুরু করেনি।

কানাইকে দেখে গুরুপদ বললো, “আমি নিজেও তো কাল রাতে তোমার জমিতে গিয়েছিলাম কানাইদা! অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। নিজের চোখে দেখলাম, হাতিগুলো কিভাবে তোমার জমির ফসল নষ্ট করে দিল! কিন্তু কি করবো বলো! এটা তো কোন নতুন ঘটনা নয়! প্রতি বছরই এই সময়ে জঙ্গল থেকে দাঁতাল হাতিগুলো বেরিয়ে এসে এই কান্ড ঘটায়। ক্ষতি মেনে নেওয়া ছাড়া তুমি তো কিছু করতে পারবে না গো দাদা!”

“দে তো গুরুপদ, আমাদের তিনজনকে কড়া করে চা বানিয়ে! এমনিতে কানাই সারারাতে জেগে রয়েছে!” নারান বলে গুরুপদকে।

তিনজন বসেছে গুরুপদ-এর চায়ের দোকানের সামনে বাঁশের তৈরি মাঁচাতে। কেউ কোন কথা বলছে না!

গুরুপদ কেটলি থেকে চা সস্‌প্যানে ছাঁকতে ছাঁকতে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো,” তা নারানদা, তোমার ছেলে তো পড়াশোনায় বেশ ভালো এবার শিলিগুড়ির কলেজেও ভর্তি করলে! সে কি কিছু উপায় করতে পারেনা এই হাতি তাড়ানোর!”

“জানিস না, বন অফিসাররা গ্রামে কি বলে গিয়েছে! কোন ইলেকট্রিক তারের বেড়ায় যদি কোন হাতি মারা যায়, তবে জমির মালিককে সোজা থানায় ঢুকিয়ে দেবে!”

“হ্যাঁ, সেটা তো শুনেছি! গত দুবছর আগে আমাদের পাশের দোহাট্টা গ্রামের স্বপন সেই ইলেকট্রিক তারের বেড়া দিয়েছিল তো! সেই বেড়ায় লেগে একটা হাতি মারা যাওয়ার পরে ওঁকে থানা পুলিশ কোর্ট করতে হয়েছিল, সে কথা কি আমরা ভুলে গিয়েছি! এখনও কেস চলছে কোর্টে! তাই এবার আর কেউ ইলেকট্রিক তারের বেড়া দিচ্ছে না!” গুরুপদ জবাব দেয়!

“তবে! তুই কি আমাদেরকেও পুলিশের ঝামেলায় ফেলতে চাইছিস না কি!” নারান বেশ জোরেই কথার জবাব দিল।

শম্ভু বললো, “আমি তো ঠিক করেছি, আজ রাতে থেকে জমির পাশেই তাঁবু বানিয়ে রাতে ঘুমোবো! তাতে অন্তত হাতি এলে আগে জানতে পারবো! সঙ্গে মশাল, পটকা রেখে দেবো। জমিতে তান্ডব চালাতে দেবো না!”

গুরুপদ ফের কথার ফুট কাটলো, “তা সেই আগেরবার যখন মধুবাবু তাঁর নিজের বন্দুক থেকে ওপেন ফায়ার করলেন, তখন হাতির দঙ্গল চলে গিয়েছিল বটে, কিন্তু পুলিশ আর বোন কর্তারা কিন্তু মধুবাবুকে সহজে পুলিশ ছাড়েনি। থানায় নিয়ে গিয়ে নাকি জেরা করেছিল, বন্দুকের গুলি হাতির শরীরে লেগেছিল কি না! আমরা তো দেখেছিলাম, একটা দাঁতাল হাতি সামান্য আহত হয়েছিল। কিন্তু তখন তো কেউ মুখ খুলিনি। আর মধুবাবু বলে কথা, গ্রামের কত লোককে যখন লাগে তখন টাকা ধার দেন তো! তা নিন না কিছু সুদ, কিন্তু গ্রামের গরীব লোকের সেই সময় সমস্যার হাল তো হচ্ছে! আর মধুবাবু বলেই, পুলিশ সে যাত্রায় খুব বেশি ঘটনাকে ঘাটায়নি।”

কানাই চুপচাপ বসে ছিল। সে শুধু ভাবছিল, সামনের ভবিষ্যতে কিভাবে দিন কাটাবে, সেই চিন্তাতেই মাথা ভারী হয়ে ছিল। তার উপর কাল সারারাত তাঁর নিজের মনের উপর দিয়ে যে ঝড় চলে গিয়েছে!

গুরুপদ তিনজনের হাতেই গরম চা-এর গ্লাস ধরিয়ে দিয়েছে। গ্লাসে চুমুক দিয়ে নারান বললো, “আজই তো আমার ছেলের শিলিগুড়ির কলেজ থেকে বাড়িতে আসার কথা। দেখি ওঁর সঙ্গে আলোচনা করে! যদি কোন উপায় বের করতে পারে!”

“তার আগে কানাইকে নিয়ে একবার যেতে হবে মধুসূদন হাজরার বাড়িতে! ওঁর তো অনেক টাকা ধার আছে মধু বাবুর কাছে! যদি মধুবাবু এবছরটা ওঁর সুদটা মাফ করে দেন, তবে কানাই এর বড় উপকার হয়! সেটাও তো আমাদেরই দেখতে হবে! কি বলিস নারান!”

“ঠিক কথা! চল সকাল সকালই মধুবাবুর বাড়িতে যাই। কাল রাতের হাতির তান্ডবের কথা নিশ্চয়ই মধুবাবুর কানে এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে! আমরা সবাই মিলে তাঁর কাছে একবার অনুরোধ করলে আশাকরি কথা ফেলবেন না।” চা এর কাঁচের গ্লাসটা দোকানের সামনের বাঁশের মাঁচায় রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বললো নারান।

গুরুপদ-এর দোকান থেকে চা শেষ করে রাস্তায় নেমে বিড়ি ধরালো শম্ভু। একটা বিড়ি দিল নারানকে। আর একটা বিড়ি কানাই এর দিকে এগিয়ে দিতেই সেটা নিতে অস্বীকার করলো কানাই।

তিনজনে মধুবাবুর বাড়ি যখন পৌঁছলো, মধুবাবু সেসময় মুখ ধুয়ে গরম চা খেতে খেতে বারান্দায় চেয়ারে বসে হিসাবের খাতা মেলাচ্ছিলেন! কানাইকে দেখেই বললেন, “এসো কানাই, ভালোই করেছো আমার কাছে এসে! আজই আমি তোমার বাড়িতে দেখা করার খবর দিতে লোক পাঠাতাম। তা কানাই, তোমার তো সুদে আসলে সব বেড়ে অনেক টাকা দাঁড়িয়েছে! এবছর যেন টাকা দিতে আর টালবাহানা কোরো না! আমার কিন্তু আবার গাড়ি কেনার কথা! ভাবছি এবার ধানটা উঠে গেলেই গাড়ি নিয়ে আসবো শহর থেকে।”

মধুবাবুর কথা শুনে কানাই কিছু বলার আগে শম্ভুই বললো, “আজ্ঞে! আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন, কাল রাতে কানাই এর জমির সমস্ত ফসল হাতিতে নষ্ট করে দিয়েছে! ও কি এবার টাকা শোধ দিতে পারবে!”

“তুমি একটু চুপ করো তো বাপু! তা টাকাটা ধার নিয়েছিল কে! তুমি না কানাই! কথা তো আমি কানাই এর সঙ্গে বলছি!” গর্জে উঠলেন মধুবাবু।

মধুবাবুর আপত্তি সত্বেও থামেনা শম্ভু। সে বলে চলে, “ শম্ভুর গতরাতে হাতির হামলায় ফসলের ক্ষতির সেই কথাটা জানাতেই আমরা তিনজন আপনার কাছে এলাম, অনুরোধ করতে যদি এবারটা ওঁর সুদটা আপনি মাফ করে দেন! তাছাড়া সামনেই ওঁর মেয়ের বিয়ে! সেটাও তো আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে!”

“মেয়ের বিয়ে তো আমি কি করবো! বড় জোর নেমন্তন্ন করলে খেতে যেতে পারি! আর হাতিতে ধান নষ্ট করেছে, আমারও তো জমির সব ধান সেবছর একই ভাবে হাতি তান্ডব চালিয়ে নষ্ট করেছিল। আমি তো সবাইকার কাছে লোকজনকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে ব্যাঙ্কের ম্যানেজারকে বলিনি, স্যার আমার এবছরের সুদটা মকুব করে দিন! যদিও বলতাম, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার কি শুনতেন আমার কথা! তবে আমি কেন শুনবো! আর এবারের সেটা আমি ভাবতে গেলে যে এবছর আমার নতুন গাড়িটা যে কেনা হবে না কানাই। ও আর এমন কি ব্যাপার! হাতি তো প্রতি বছরই গ্রামের ধান পাকার আগেই জমিতে হানা দেয়! সেবার হাতিকে লক্ষ্য করে রাইফেল থেকে শূন্যে গুলি ছুঁড়ে আরও বিপত্তি হয়েছিল! হাতির দলের বড় দাঁতালটার গায়ে লেগেছিল, ছড়রা গুলির কয়েকটা। হাতিটা তো মরেইনি, উলটে বেঁচেও থাকলো, মধ্যেখান থেকে পুলিশকে একগাদা টাকা ঘুষ দিয়ে কেস মেটাতে হলো! ওসব কথা ছাড়ো, আমি আর সময় দিতে পারবো না! আমার টাকাটা কিন্তু চাই কানাই। একেবারে সুদে-আসলে!”

কানাই অপমানে, লজ্জায় মাটিতে প্রায় মিশে যেতে যেতে শম্ভুকে চুপ করতে বললো! মধুবাবুর সামনেই নিজের পাশের বাড়ির বন্ধু শম্ভুর কাছে হাত জোড় করে অনুরোধ করে, “কথা বাড়িয়ে কোন লাভ নেই রে! চল দেখি কি করতে পারি! তেমন হলে মেয়ের বিয়েটাকেই না হয় কিছুদিন পিছিয়ে দেবো!” নিজের ডান হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মোছে কানাই।
মধুবাবুর বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে এবার গর্জে উঠলো নারান, “এ লোক তো মহা চশোমখোর রে! সামান্য দয়ামায়া নেই! দাঁড়া, দেখি আমিই কিছু উপায় বের করতে পারি কি না!”

সেদিন রাত আটটা নাগাদ প্রায় ছুটতে ছুটতে শম্ভুর বাড়িতে নারান এসে শুনলো, শম্ভু রাতে হাতির কারণে জমিতে থাকবে বলে সন্ধ্যার সময়ই রাতের খাবার, লাঠি, মশাল, পটকা সঙ্গে নিয়ে জমি লাগোয়া আলের ধারে তাঁবু বানিয়ে সেখানে আছে! শুনেই জমির দিকে ছুটলো নারান। তাঁর ছেলে যে দুর্দান্ত এক বুদ্ধি আবিষ্কার করেছে! ইলেকট্রিক তারের সাহায্য না নিয়েও হাতি তাড়ানোর এক উপায় বাতলেছে নারানের ছেলে সমীর। সেই কথা নারান শম্ভুকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না! সে তো বটেই, গ্রামের কেউই চায় না কানাই এর মতো অবস্থা অন্য কারো হোক্‌!

শম্ভুর জমির ধারের আলের উপর তৈরি পঞ্চায়েত থেকে পাওয়া যে পলিথিনের তাঁবু দিয়ে রাত কাটানোর উপায় করেছে, সেখানেই নারান খুঁজে পেল শম্ভুকে। নারান যখন সেখানে পৌঁছলো, শম্ভু তখন রাতের খাওয়া সেরে বাইরে বেরিয়ে হাত মুখ ধুচ্ছিল। সে তখন নারানকে সেখানে দেখে তো অবাক! শম্ভুর মনে কু- ডেকে উঠলো! তবে কি মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্থ হয়ে কানাই কোন কিছু অপকর্ম করে বসেছে! যে কথা জানাতে রাতেই ছুটে এসেছে নারান! হয়তো কানাই প্রচন্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছে! তাঁকে শহরের হাসপাতালে ভর্তি করতে নিয়ে যেতে হবে!

তবে নারানের কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শম্ভু। যাক দুঃশ্চিন্তার কোন ঘটনা অন্তত ঘটেনি।

“শোন শম্ভু! আমার ছেলে সমীর এক দারুণ বুদ্ধি বলেছে! এটা যদি আমরা ঠিকভাবে করতে পারি, তবে হাতির জমিতে অত্যাচার চালানো বন্ধ করতে পারবো! তাতে ইলেকট্রিক তারে হাতিও মরবে না! বন্দুক থেকে গুলিও চালাতে হবে না! আমাদেরও জমির ফসল রক্ষা পাবে! তবে শুধু আমাদেরকে জমিতে সজাগ থাকতে হবে!” নারান উত্তেজিতভাবে বললো।
“হাতি তাড়ানোর উপায় বের করেছে তোর ছেলে! সেটা কি রকম শুনি একবার!” শম্ভু ভাবলেষীনভাবে জানতে চাইলো। একটা বিড়ি নারানের দিকে এগিয়ে নিজেরটা ধরালো শম্ভু! মুচকি মুচকি হাসছে আর বিড়িতে টান দিচ্ছে।

“শোন, হাতির পাল তো হঠাৎ করেই হামলা চালায় জমিতে! আমরা যখন সেটা টের পাই, তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়! এই যে তুই, রাতে এই তাঁবুতে থাকবি, হাতির দল যদি জমিতে হামলা করে, সেটা বুঝবি কি করে! আগে থেকে যদি আমরা বুঝতে পারি, হাতি আমাদের জমির দিকে আসছে, তখন সবাই সবাইকে মোবাইল ফোনে ডেকে নিতে পারবো! হাতি জমিতে হামলা করার আগেই তাদের আগুন জ্বালিয়ে, পটকা ফুটিয়ে, টিন বাজিয়ে আওয়াজ করে, অন্যদিকে পাঠিয়ে দিতে পারবো! তাই না!” উত্তেজনার সঙ্গে জানালো নারান।

“কিন্তু বুঝবো কিভাবে যে হাতি আমাদের গ্রামের জমিতে আসছে! রাতের অন্ধকারে তো সেটা আগে থেকে দেখা যাবে না!” সন্দিগ্ধ মনে প্রশ্ন করে শম্ভু!

“বুঝবো, আমরা ঠিকই বুঝতে পারবো! তবে সবাইকে নয়, গ্রামের কয়েকজনকে পালা করে রাতে গ্রামের কয়েক জায়গায় পাহারা দিতে হবে!” জানালো নারান।

“সেটা আবার কি রকম!” প্রশ্ন করে শম্ভু।

“শোন, আমরা জমির চারদিকে, এমনকি গ্রামের চারদিকে দড়ি টাঙিয়ে দেবো…”

“দড়ি দিয়ে তুই হাতি আটকাবি! ইয়ার্কি পেয়েছিস্‌!” হাসতে হাসতে বলে শম্ভু।

“আরে কথাটা শেষ পর্যন্ত শোন না! দড়িতে প্লাস্টিকের যে জলের বোতল পাওয়া যায়, তার মধ্যে নদীর ধার থেকে নুড়ি পাথর কুড়িয়ে এনে ভরে দেবো। হাতি যতই শব্দ না করে আসুক না কেন, সেই দড়িতে হাতির শরীরের ধাক্কা লাগবেই। এমনকি দড়ি ছিঁড়েও যেতে পারে! কিন্তু বোতলের ভিতরে থাকা নুড়ি পাথরে আওয়াজ হবেই। সেই শব্দ শুনেই আমাদেরকে বুঝতে হবে হাতি গ্রামের জমিতে হামলা করতে আসছে! সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে সবাইকে ডেকে নিতে হবে! সবাই মিলে একসঙ্গে আগুন, পটকা, টিনের আওয়াজ করতে শুরু করলে হাতি আর জমিতে হামলা করতে পারবে না। আমাদের জমির ফসল রক্ষা পাবে! কি রে, কেমন বুদ্ধি আমার ছেলের!” বিড়িতে ঘন ঘন টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে এবার উলটে প্রশ্ন করে নারান।

“কথাটা খারাপ নয়! তবে সবাইকে রাতে অ্যালার্ট থাকতে হবে! আর পালা করে গ্রামের কয়েক জায়গায় এরকম তাঁবু বানাতে হবে! আর সবার মোবাইল ফোন চালু রাখতে হবে, তবেই এটা সম্ভব!”

পরের দিন সকালেই গ্রামের মোড়ের মাথার চা এর দোকানে গুরুপদকে দায়িত্ব দেওয়া হলো গ্রামের সবাইকে জানিয়ে দিতে হাতি নিয়ে আজ সন্ধ্যায় ওঁর দোকানের সামনে জরুরী মিটিং আছে! মিটিং ডেকেছে নারান স্বয়ং। গুরুপদ মিটিং-এর আলোচনা শুনতে আগেই দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে দিয়েছে। নারান, শম্ভু থেকে শুরু করে কানাই পর্যন্ত সবাই হাজির হলে নারান হাতি তাড়ানোর যে উপায় তাঁর ছেলের বুদ্ধি, সেই কথাটা সবাইকে জানায়। কেউ কেউ গররাজি হলেও বেশিরভাগ রাজি হওয়ায়, ঠিক হয় পঞ্চায়েত থেকে পলিথিন নিয়ে এসে গ্রামের চারদিকে অন্তত দশটি তাঁবু তৈরি করা হবে আর সেখানে গ্রামের অল্প বয়সী ছেলে ছোকরারা পাহারায় থাকবে। তবে রাতে তাঁবুতে পাহারার দায়িত্ব সপ্তাহে দুদিন করে প্রত্যেকের ভাগে পড়বে! প্রত্যেকের কাছে গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মোবাইল ফোনের নম্বর থাকবে। যে আগে শব্দ শুনবে, সে বাকি অন্যদের সজাগ করে দেবে। শেষ জন সজাগ করবে গ্রামের বয়স্ক কাউকে। এভাবে সারা গ্রাম জেগে উঠবে আর সবাই মিলে একজোট হয়ে হাতি তাড়ানোর অভিযানে সামিল হবে।

আলোচনা মতো গ্রামকে হাতির তান্ডব থেকে রক্ষা করতে সব জিনিসপত্র জোগাড় করে ব্যবস্থা করতে দিন দু’য়েক সময় গেল। এরমধ্যে আর হাতির দল এই গ্রামে তান্ডব চালায়নি। যাঁরা পাহারার দায়িত্বে ছিল, তাঁদের উৎসাহেও ভাঁটা পড়তে লাগলো। সপ্তাহখানেক পরে, গুরুপদ-র চা-এর দোকানেই কম বয়সী ছোকরা, যাঁরা পাহারার দায়িত্বে এই ক’দিন ছিল, তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলো, আগামীকাল থেকে আর পাহারার প্রয়োজন নেই। এই খবরটা গ্রামের বয়স্কদের জানিয়ে দিতে হবে। কারণ গ্রামের অধিকাংশ লোকের জমির ধান কাটা হয়ে গিয়েছে। তাঁরা ফসল ঘরেও তুলে নিয়েছে। এদিকে ঠান্ডাও পড়ছে রাতের দিকে! তাই সেদিন রাতের পরে আর তাঁবুতে হাতির জন্য পাহারা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। গুরুপদর সামনেই চা খেতে খেতে তাঁরা ঠিক করলো, খবরটা পৌঁছে দিতে হবে নারান কাকার কাছে! কারণ, সেদিনের হাতি তাড়ানোর মিটিং ডেকেছিল নারান কাকা।

ঠিক সেই রাতেই হঠাৎ শব্দ করে উঠলো দড়ির সঙ্গে লাগানো প্লাস্টিকের বোতলের ভিতরে রাখা নুড়ি পাথরগুলো। বেশ ঠান্ডার মাঝরাতের নিঃশব্দ অন্ধকারে সেই আওয়াজ এতটাই জোরে শোনালো যে, আর গ্রামের সবাইকে মোবাইল ফোনে জাগাতে হলো না! ওই শব্দের আওয়াজে সারা গ্রামের লোক আগেই ঘুম থেকে উঠে গিয়েছে! গ্রামের লোকজন ইতিমধ্যে এসে জড়ো হয়েছে, ভুটান পাহাড়ের দিক থেকে যেপথে হাতি আসে, সেই দিকে। সবার হাতেই দাউদাউ করে আগুনের মশাল জ্বলছে। সঙ্গে আওয়াজ করে কেউ কেউ বাজাচ্ছে ফাঁকা টিনের উপর লাঠির দিয়ে শব্দের আওয়াজ। কেউবা ফটকা ছুঁড়ছে হাতির দলটির দিকে।

গ্রামবাসীদের এই আক্রমণে কিছুটা পিছু হটলেও এক জায়গায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একটা দাঁতাল হঠাৎ তেড়ে গেল গ্রামের মধুসূদন হাজরার বাড়ির উঠান লক্ষ্য করে! সেই দাঁতালের পিছু নিল দলের বাকি হাতিগুলোও। মধুসূদন বাবুর বাড়ি পাকা দালানের হলেও বাড়ির বাইরে ইটের তৈরি আলাদা কোন প্রাচীর নেই। মধুসূদন বাবু ধান কেটে বাড়ির উঠোনে গোলায় ভরে রেখেছিলেন। দাঁতালের সঙ্গে বাকি হাতিদের আক্রমণে সেই ধানের গোলা ভেঙ্গে গেল নিমেষেই। গোলার ধান নিয়ে খেতে লাগলো হাতির দলটি। শুঁড়ে করে ছড়াতে লাগলো গোলায় রাখা ধানগুলিকে। হাতির তান্ডব বন্ধ করতে গ্রামের লোকজন মিলে মধুবাবুর বাড়ির উঠোনে তাণ্ডব করতে থাকা হাতির দলকে পটকা ফুটিয়ে তাড়াতে পারলেও ততক্ষণে মধুসূদন বাবুর ধানের গোলার প্রায় সব ধানই নষ্ট হয়ে গিয়েছে। মধুবাবু ঘর থেকে এই ঘটনার পরে ঘুম থেকে জেগে উঠে বাইরে এলেও বাড়ির উঠোনে দাঁতাল হাতির তান্ডব দেখে এতটাই হতবাক হয়ে গেলেন যে, ঘরে গিয়ে রাইফেলটি আনার কথা ভুলেই গেলেন। মধুবাবু চিনতে পারছেন সেই দাঁতাল হাতিটিকে! গতবার মধুবাবুর রাইফেলের গুলিতে যে দাঁতালটি আহত হয়ে জঙ্গলে ফিরে গিয়েছিল। মধুবাবুর বিশ্বাস হলো, হাতির স্মৃতি ভীষণ বেশি। মধুবাবুকে মনে রেখেছে দাঁতালটি। কিন্তু তাঁর বাড়ি চিনলো কি ভাবে! সেই প্রশ্ন করার মতো কাউকে পাশে পেলেন না মধুবাবু।

দূর থেকে ঘটনা দেখছিল কানাই। তাঁর চোখে তখন জলের ধারা নেমে এসেছে! হঠাৎ শম্ভু এসে কানাই এর পিঠে হাত রেখে , “দেখলি তো, ধর্মের কল কেমন বাতাসে নড়ে!”

প্রীতম সরকার | Pritam Sarkar

1st Meeting of Rabindranath and Ramkinkar | Best 2023

Values and Hopes for Freedom | Best Article 2023

A Train to Israel via Purulia | Best Article 2023

Education Quality of Public Representatives | Best 2023

Anandabazar Bengali Short Story | Bengali Short Story | Pratilipi Horror Stories in Bengali | Lifestyle Web Stories in Bangla | Trending online bangla golpo pdf free download | Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | Online Galper Diary pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Online Galper Diary in english | Trending online bangla golpo pdf download

suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Online Galper Diary | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Trending Online Galper Diary | Pdf Online Galper Diary | Online Galper Diary App | Full Online Galper Diary Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Trending online bangla golpo pdf

Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Online Galper Diary 2024 | New Online Galper Diary – Episode | Golpo Dot Com Series | Online Galper Diary Video | Story – Online Galper Diary | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Online Galper Diary Netflix | Audio Story – Online Galper Diary | Video Story – Online Galper Diary | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Top Online Galper Diary | Online Galper Diary Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Trending online bangla golpo book pdf

Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Online Galper Diary | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Trending online bangla golpo free download

Leave a Comment