Best Online Upanyas in Bengali | খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী

Sharing Is Caring:

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ২২) – জয়নাল আবেদিন

সন্ধ্যার পরেই সত্যেন বাবু স্ত্রী এবং নাতনিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। রাত্রি নটা পাঁচে ট্রেন। সৌজন্য দেখাতে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলে শঙ্খ। একটা ট্যাক্সি ধরে সকলে উঠে চলে যাবার পর, কেমন একটা স্বস্তি বোধ হলো ওর। দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে বেশ তৃপ্তির একটা টান দিতে তাতে। এমন একটা নেশা দ্রব্য মনটাকে বেশ ধরা তাজা করে দেয়।

রাতের খাবার খেয়ে ছেলেদের নিয়ে শুয়ে পড়লো শঙ্খ। ছেলে দুজন ঘুমিয়ে পড়লেও ওর চোখে ঘুম আসছে না। পরশু সকালের ট্রেনে দুই ছেলেকে বোর্ডিংয়ে রেখে আসতে হবে। ভর্তি সংক্রান্ত কাজ মিটিয়ে টাকা পয়সা জমা দিয়ে আর কলকাতা আসবেনা। সোজা চলে যেতে হবে কোচবিহারের সীমান্তের ব্যারাকে। এ মাসে একটা বদলির অর্ডার আসতে পারে ক’জনার। আবার নতুন কোন ঠিকানায় যেতে হবে আগাম জানা যাচ্ছে না। শরীর মন কেমন একটা অবসন্নতায় ভুগতে থাকে এ সময়। সংসার জীবনে চাই- চাই করতে- করতে কেমন একটা পিচ্ছিল পথে হাঁটতে শুরু করেছিল প্রথম থেকেই। বাস্তব জীবনকে সুখী করতে স্বোপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে, এমন ভাবনা কোনকালেই ছিল না তার মধ্যে। দাদাদের উপর জুলুম করেই ভবানীপুরের বাড়ি খানা পেয়েছে এককভাবে। এমন একখানা জমি সহ তৈরি বাড়ি পাওয়া বিরাট লাভজনক। একটু নতুনত্ব আনার জন্য খরচের সমস্ত টাকাটাই শ্বশুরবাড়ির থেকে আনতে হয়েছে স্বাতীকে। মানসিকভাবে বিরোধটা ছিল এখানেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।

স্বাতী বলতো – বারবার কেন টাকা চাইতে যাব আমি ? আমি এভাবে চাইতে পারবো না। তোমার দরকার তুমি চাও।
শঙ্খ বললে – এতে তোমার আমার ভাবছো কেন? আর ভবিষ্যতে তো ওই সম্পত্তির মালিক আমরাই হবো। তখন কি আমরা ওখানে গিয়ে বাস করব ? বিক্রি করে টাকাটাই তো নেব।
স্বাতী বলতো – অনেক দূর ভেবে রেখেছো তাহলে? যার জায়গা জমি সে অন্য কাউকেও তো লিখে দিতে পারে ? সে স্বাধীনতা তার আছে তো ? তুমি পাওয়ার জন্য ভেবে রাখছো কেন ?
শঙ্খ বললে – আমি না ভাবলেও মেয়ে হিসেবেই সম্পত্তির ভবিষ্যৎ মালিক তুমি হবে। এটা তো কোনো বেআইনি কথা নয়।
স্বাতী কেমন ঝাঁঝিয়ে বলেছিল, – সেজন্যই বারবার টাকা হাতানোর ফন্দি এঁটে রেখেছো নির্লজ্জের মতো। আত্মীয় বাড়িতে হাত পাততে কষ্ট হয় না তোমার ? একজন পুরুষ হয়ে কি করে এতটা নিচে নামতে পারো ?
শঙ্খ এবার বিস্ময়ে বললে, – ভাষা সংযত করো। সংসারটা আমার একার নয়। ভবিষ্যতের কথা দুজনেরই ভাবা দরকার। ছেলে- মেয়ের কথা তোমারও ভাবনায় থাকা উচিত।

— ঠিকই তো ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তে আমি নিরীহ বাপের কাছে হাত পেতে টাকা আনবো, আর তুমি তা দিয়ে ইমারত গড়বে। তার থেকে তুমি চুড়ি পরে ঘরে থাকো। আমি বাইরে বেরোই স্বাতীর শ্লেষাত্মক কথা।
এভাবেই স্মৃতি পটে ভাসতে থাকা ছবির সঙ্গে অবচেতন মনটা কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

সকাল থেকেই একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল শঙ্খ। চা-জল খাবার খেয়ে ছেলেদের নিয়ে বাজারে বের হলো। প্রয়োজনীয় জামা-প্যান্ট, গেঞ্জি, জুতো-মোজা আরো কিছু কিছু ওদের দরকারি জিনিস কিনে নিলে। ভরা বাজারে কেনা কাটায় বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। তৈরি করা জিনিস সামগ্রী কেনার তালিকা দেখেই কেনা শেষ হয়েছে ।বাড়ি ফেরার পথে একটু মাংস নিয়ে সকলে বাড়ি ফিরলে। চান খাওয়া স্বার্থে একটু বেলা হল দুপুর গড়িয়েছে কিছু আগেই বিছানায় বীজ পাতলো বাপ ছেলে। সন্ধ্যাটা তাদের বেশ আলসে ভাবেই কাটলো সকলের। চা খাওয়া। ব্যাগ গোছগাছ করা। কাল সকাল সাড়ে সাতটায় ট্রেন। শিলিগুড়ি পৌঁছাতে সেই সন্ধ্যে ।এত বড় বাড়ি টাকে একা রেখে চলে যেতে হবে। দেখার কেউ নেই। কেমন অসহায় একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। হঠাৎই মনে হলো রথীনদার কথা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লো। হাঁটতে- হাঁটতে রথীনদার দোকান।

শঙ্খ বললে – একটু কথা ছিল দাদা।
রথীন দা বললে – আয় ভেতরে আয়। বল কি বলতে চাস ?
শঙ্খ বললে – বাড়িতে তো কেউ থাকছে না এখন । তাই ভাবছি দুটো ঘর ভাড়া দেব। আমার একটা থাকবে। একদিকে রক্ষণাবেক্ষণ হবে। আবার ভাড়াটাও পাবো।
রথীনদা বললে – মন্দ নয় । তাই কর।
শঙ্খ বললে – আমি দরজায় লিখে রাখছি। দুটো ঘর ভাড়া দেয়া হবে। যোগাযোগ রথীনদার দোকান। তুমি কথা বলবে, ঠিক হলে আমাকে ফোনে জানাবে। আমি একদিনের জন্য হলেও ঠিক চলে আসবো।

সঠিক সময়েই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরল শঙ্খ সেটা দুটোকে নিয়ে। সকালে টিফিন। দুপুরের খাবার। ট্রেনেই বরাদ্দ ছিলো। ট্রেন চলেছে বেশ দ্রুত গতিতে। শুভ্র-অভ্র খুনসুটিতে মেতে। মনের কোনে ডানা ঝাপটায় স্মৃতি। সাজানো-গোছানো বাড়িটা ফাঁকা রেখে চলে যেতে হচ্ছে। জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। স্বাতী কেন যে কোন কনসিডার করতে পারলো না। বড় অবাক লাগে। ভীষণ জেদি মেয়ে। সংসার জীবনে এত জেদি হওয়া কিন্তু ভালো নয়। কোন মেয়ের জন্য। পুরুষ কিছুটা অগোছালো হতেই পারে। সংসারের বাঁধন সব পুরুষের মধ্যে থাকে না। কিন্তু একজন নারীর প্রকৃতি- গুছিয়ে সংসার- জীবন, সন্তান-সন্ততি, লালন-পালন এটাই সহজাত। নারী একটা সংসারের সৌন্দর্য। সবকিছুর সমন্বয় রক্ষাকারী। স্বাতীর মধ্যে তো সমস্ত গুণই ছিলো।বড় নির্লোভ ছিল তার জীবনটা। চাহিদা নিজের জন্য কিছুই ছিলো না। স্বার্থপরতা সহ্য করতে পারতো না কোনদিন আর এখান থেকেই কেমন পাল্টে যাচ্ছিলো মনে হয় তার জীবন সংগ্রাম। উজ্জ্বল মানসিকতা। চাপা একটা ক্ষোভ আস্তে আস্তে বাসা বাধছিল তার অন্তরে। শঙ্খ হয়তো বা অনুভব করতো ঘটনার প্রারম্ভিকতা। তবে তেমন আমল দিতো না। তার চরিত্রগত অভ্যাস অনুযায়ী নিজের ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ করাই তার একমাত্র সাধনা ছিলো। জীবনে তার দাদাদের সঙ্গে কোন আপোষ করতে পারেনি। নিজের ইচ্ছা পূরণ আলোয়- অন্ধকারে যেভাবেই হোক করে চলতো। জীবনের লক্ষ্যমাত্রা সঠিকভাবে কোনদিন নির্বাচন করেনি, করতে পারেনি। বস্তুবাদী ভোগের লালসায় বাস্তবকে কেমন অস্বীকার করে চলতো। তাই জীবনে বাস্তব-অবাস্তবের দ্বন্দ্বে জীবনটা কেমন একটা অন্ধকার ছায়া ফেলতে চলেছে। মহীরুহ হতে গিয়েও শাখা-প্রশাখা আজ কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে।

গাছপালা ছাড়িয়ে দ্রুত গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। চোখটা কেমন জুড়ে আসছিল। সকালের খাবার খেয়ে শুভ্র-অভ্র বেশ খুশি খুশি ভাব। হঠাৎ শুভ্রর প্রশ্ন করল বাবাকে, – মা কি কোনদিন আর আসবেনা আমাদের কাছে? কেন বাবা, মায়ের কি হয়েছে গো ?
শঙ্খ কেমন কেঁপে উঠলে প্রশ্ন শুনে, বললে – কেন? এভাবে জিজ্ঞেস করছ কেন? যে কোন সময় চলে আসবে।
অভ্র বললে- সেই কবে থেকেই একই কথা শুনছি! মা ঠিক চলে আসবে। কবে আসবে শুনতে চাইছি।
শঙ্খ একটু মৃদু শাসনের ভঙ্গিতে বললে, – তোমরা পড়াশোনায় থাকো। বাড়ির কথা ভাবতে হবে না। মা তাড়াতাড়ি চলে আসবে। এমন হলে তোমাদের কাছে ঘুরতেও আসতে পারে।

এমন কথায় দুই ভাই মনে হল একটু খুশি হয়েছে। কিছুটা সামাল দিতে পেরে শঙ্খ একটু স্বস্তি পেলো। কিন্তু ঘটনার বেড়াজালে- বনে গিয়েও এখন আর মনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শঙ্খ। এমন এক অভিশপ্ত জীবন সে তো কখনোই কামনা করেনি। তার ভাবনায় সে কোনদিন কোন অন্ধকার পথে হাঁটেনি। তাহলে নিজের জীবনটা কেন অন্ধকার হয়ে আসছে। আর শেষ পরিণতি টই বা কি হতে চলেছে। একদিকে শ্বশুরমশাই মেয়েকে ফিরে না পেলে কেস কাবারি করলে, কি সমস্যা হবে ভাবতে পারছে না। আবার কেস কাবারির সমস্যায় চাকরিতে কোন ঝামেলা হতে পারে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। কলকাতার আলো ঝলমলে বাড়িতে লোক- প্রাণীর অভাবে অন্ধকার ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে। ত্রিশঙ্কু এক কালো আবরণে শঙ্খকে ঘিরে ধরেছে। মাঝে মাঝে দম বন্ধ অবস্থা হচ্ছে তার।

সন্ধ্যা মুখো শিলিগুড়ি পৌঁছালো সকলে। তাড়াতাড়ি স্টেশন থেকে বাইরে এসে একটা গাড়ি ধরে ছেলেদের হোস্টেলে পৌঁছল। অফিস জানালে, কাল সকালে এসে এ্যাডমিশন করে দেবেন।
— আজকে অফিসিয়াল কাজটা হয়ে গেলে খুব ভালো হতো। কাল সকালেই আমাকে অফিস জয়েন করতে হবে। শঙ্খ একটু অনুনয়ের সঙ্গে বললো।
— আজ আর কেউ নেই স্যার। টাকা পয়সার ব্যাপার তো, কে দায়িত্ব নেবে। ভদ্রলোক বললেন।

শঙ্খ বললে – সকাল মানে তো সেই দশটা সাড়ে দশটা।
— মোটামুটি ঐরকমই। আপনি আসুন না। প্রথমেই আপনারটা ব্যবস্থা করে দেব। ভদ্রলোক আশ্বাস দিলেন।

অগত্যা বাইরে এসে কাছাকাছি একটা হোটেলে রাত্রিবাসের জন্য ব্যবস্থা করলে শঙ্খ। বাইরে থেকেই চা খেয়ে রুমে ঢুকলো। জামা-কাপড় ছেড়ে একটু তিতু হয়ে বিছানায় বসে একটা সিগারেট ধরালো। আগামীকালের কাজের ছবিটা মনে মনে ছক করে নিলে। সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট। স্কুলে পৌঁছাতে হবে। স্কুলের কাজ সেরে কাগজপত্র ছেলেদের কাছে রেখে বের হতে হতে প্রায় দুপুর। স্কুল থেকে বের হয়ে সোজা বাস টার্মিনাস। দুপুরে খাবার খেয়ে কোচবিহারের বাসে চেপে বসা। হঠাৎ কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো শঙ্খের।

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ২৩) – জয়নাল আবেদিন

আসমা বেগম চর্চিত একটা নাম। বস্তির গুমটির চায়ের দোকানে সকাল থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। কে যেন বলেছিল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্ট হচ্ছে চায়ের দোকান। যতক্ষণ খোলা থাকে সমস্ত ব্যাপারে আলোচনা চলে এখানে।
— সেই তো বিয়ে হলো, তাহলে এত ধানাই পানাই করে কি লাভ হয়েছে। কে একজন কথাটা উচ্চারণ করলো।
— খাবার আগে একটু চেখে দেখা হচ্ছিল ভাই। ভালো না মন্দ। মাতাল রিয়াজের টিপ্পনী কাটা জবাব।
ফোঁস করে উঠলো মির্জা হাসান, – মুখের ভাষা ঠিক করো। যা মুখে আসে তাই বলে দেবে। তাহলে কিন্তু ধোলাই খাবে।
গুমটির ভিতর থেকে কাশেম বললে,- ভুলটা কি এমন বলেছে?
হাসানের ছোট ভাই মাসুম বসেছিল গুমটির ভিতরে। হয়তো বা কাশেমের পাশেই। হঠাৎই তার জামার কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। রিয়াজ ঠিক কথা বলেছে ? বলেই দুই থাপ্পড় কথায় কাশেমের চোয়ালে।
রিয়াজ বললে, – এটা কি হলো ?
কাশেমকে ছেড়ে রিয়াজের গালেও ঘা-দুই কষিয়ে দিলে মাসুম।

মুহূর্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠল পরিবেশ। বস্তির চালচিত্র বড়ই অস্থিরতাপূর্ণ। সামান্য তিল থেকে তাল হয়ে ওঠা, এটাই এখানকার চরিত্র। কাজের মানুষগুলো সকাল- সকাল বেরিয়ে যায়। রুটি- রুজির টানে। অকাজের মানুষজন বিভিন্ন চর্চায় দিন কাটায়। পরের কথায় মাথা দিয়ে নিজেরা ঝগড়া করে। চেঁচামেচির মধ্যেই গলা উঁচিয়ে মির্জা হাসান বললে, – আরশাদের চরিত্র খারাপ। নেশা- ভাং খায়। এমন কথা কারো জানা আছে ? যেদিন রাত্রে আরশাদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। বস্তির সব লোক কেন সেদিন থানার মাঠে জড়ো হয়েছিল। মনে নেই।
বৃদ্ধ দরবেশ চাচা বললে, – সব ঠিক আছে বাবু । তবে মানুষের পা হড়কাতে সময় লাগে না কিন্তু!

মির্জা হাসান বললে, – সকলের পা হড়কায় না চাচা। যার হড়কায় সে এসে বলে যাবে না। কখনো বস্তির ঘরে- ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলে বুঝবে । কতো মেয়ে হেল্পারের ঘরে, রাত কাটিয়ে যাচ্ছে মিস্ত্রি। না হলে নাকি কাজ পাবে না। কেউ খবর রেখেছো কোনদিন। একটা ঘটনা সামনে এলে সস্তায় কিস্তিমাত করতে অনেকেই পারে।
মাসুম বললে, – অকর্মের ঢেঁকি গুলো কাজকামের ধান্দা নেই। সকাল থেকে চা গুমটিতে বসে যতসব গেল্লাগুজুল্লি, নোংরা ঘাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। এমন কথা কানে এলেই, আচ্ছা করে পেটাই দেবো।
হই চই করার ইচ্ছা থাকলেও কেমন যেন সব গুম খেয়ে গেল। সারাদিনের চর্চার বিষয়টা মনে হচ্ছে আলোচ্য সূচি থেকে বাদ চলে যেতে বসলো।

সকালের প্রাত্যহিক কাজে রিজিয়ার সঙ্গে হাত লাগায় আসমা। দিদি বলেই সম্বোধন করে তাকে রিজিয়া। সকালের নাস্তা হলে- খেয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার নিয়ে বের হয় আরশাদ। ছেলেমেয়েকে নিয়ে এরা দুজন খাবার পর আন্টির কাছে পড়তে বসে ছেলে-মেয়ে। এই আন্টি ডাক রাখতে চায় তাহলে ছেলেদের জন্য দুজনেই। বস্তির পড়শী শুধু চারজন বেলা হলে দেখতে আসে রিজিয়ার সতীনকে। কেউ- কেউ টেরা মন্তব্য করতেও ছাড়ে না ।
— উপকারের ফল পেলি তো রিজিয়া। আরশাদ ভাই উপকার করে তবু বউ পেলো। তোর বাড়া ভাতে যেন ছাই না পড়ে দেখিস।
— কথায় বলে না এক রামে রক্ষে নেই, তায় আবার সুগ্ৰীব দোষর।

রিজিয়া চুপচাপ শুনছিল কথাগুলো। নতুন মানুষটার কানে কথা গেলেও অসহায় পাবে উদাস হয়েছিলো।
এবার রিজিয়া বললে, – আগুনে ঘি ঢালতে এসেছো তো তোমরা ? আমাদের সংসারে অভাব এলে তোমাদের কিছু দিতে হয়েছে কোনদিন ?
প্রথমজন বললে, – বেশ চ্যাটাম-চ্যাটাম কথা হয়েছে তো তোর। ভালো কথা বলতে এলুম! তোর কাছে উল্টো হলো ।
রিজিয়া বললে, – এমন ভালো কথার দরকার নেই । আমাদের সংসারে আমরা যেমন আছি বেশ আছি গো ।
দ্বিতীয় একজন বললে, – ঠেকায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। যখন সময়ে ঠেকায় পড়বি তখন দেখবো কেমন থাকিস। এমন কথার জবাব তখন পাবি।
রিজিয়া বললে, – নসিব ছাড়া মানুষের কোন গতি নেই। কপালে যা আছে- তা হবেই। ভালো থাকলে ভালো হবে, মন্দ থাকলে মন্দ হবে। আগেভাগে এত কিছু চিন্তা করে লাভ নেই। যে যার কপাল নিয়ে ভাবো এখন।

কিছুটা ধাক্কা খেয়ে মেয়েগুলো রাগে গজগজ করতে-করতে ঝুপড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রিকশা স্ট্যান্ডের লাইনে গাড়িটা লাগায় আরশাদ। মানসিক বিপর্যয় যেমন নয় আবার আত্মতৃপ্তি তেমন কিছুই নেই মনের মধ্যে। হাসিখুশি ভাব যেমন নেই- তেমনি হতাশায় বিষন্নও নয় মোটেই।
— কি গো, আরশাদ ভাই। মিষ্টি খাওয়াতে হবে তো? এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না কিন্তু। লাইনের এক রিক্সাওয়ালা বললে আরশাদকে।
— মিষ্টি এমনিতেই খাওয়া হতেই পারে।তবে যে জন্য বলতে চাচ্ছো, সেটা কিন্তু বিয়ে করার জন্য করিনি ভাই। শুধুই মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য করেছি। একটু আহত মনে কথাগুলো বললে আরশাদ।
— না গো, আরশাদ ভাই। আমি মজা করে বললাম তোমাকে। কতো বছর একসঙ্গে রয়েছি কাজের ক্ষেত্রে। তোমাকে আমরা চিনি না।
— সেটা ঠিক কথা ভাই। তবে সবকিছু জেনেও আমার প্রতিবেশী কতো মানুষ । কেমন অপমান করে কথা বলে। বড কষ্ট হয় তখন। একটু অসহায় বোধ করে আরশাদ।

ছেলেটা একটুও বা মর্মাহত। মনে মনে ভাবে, এভাবে কথাটা না বললেই ভালো হতো। আরশাদ দা দোষ নিও না। তোমার মতোজন আমাদের সঙ্গে আছো, এটা আমাদের গর্ব। কিছু মানুষের দোষ খোঁজা একটা স্বভাব। সে ভালো মন্দ বোঝে না। দেখেও না। নিন্দা করে কথা বলা তাদের অভ্যাস‌।
আরশাদ বললে, – কষ্ট লাগে সেখানেই ভাই। সবকিছু জেনেও যারা মিথ্যে দোষারোপ করে। তারা কি পায় বলো ? অন্য মানুষকে হেয় করলে তাদের কি লাভ হবে তাতে।
ছেলেটা বললে, – যাদের কোন কাজ থাকে না। ঘরে থাকলে বউয়ের গালাগাল শুনতে হয়। তারাই বাইরে চায়ের দোকানে- রাস্তাঘাটে পরনিন্দা করে দিন কাটায়।
আরশাদ বললে, – একদম ঠিক বলেছ ভাই। বাস্তব সত্য কথা বলেছ।

এর মাঝেই ট্রেন এলো সকালের। প্যাসেঞ্জার উঠলো রিক্সাগুলোয়। শুরু হলো দিনের কর্মব্যস্ততা। এমনভাবে যাতায়াতে দুপুর হয় আরশাদের। বাড়ি থেকে আনা টিফিন খায়। একটু বিশ্রাম করে। আবারও যাতায়াত শুরু হয়। কষ্ট হলেও রোজগার করতে হবে। বউ-বাচ্চার খাওয়া পরার যেনো অভাব না থাকে। এমন চিন্তাভাবনার মানুষ আরশাদ বরাবরই। চুপচাপ ঘরে বসে সময় কাটায়নি কোনদিন। নেশা ভাং। বধ সঙ্গী। এসব থেকে সব সময় দূরত্ব রেখে চলতো সে ।এক কথায় আজাদ কলোনির বস্তিতে আরশাদের একটা ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলো। এখনো আছে। কথায় বলে যে যেমন- তার জোটে ও তেমন। রিজিয়া আরশাদের সার্থক জুটি। স্বামীর মঙ্গল কামনায় এমন স্ত্রীর ভূমিকা ঈশ্বরপ্রদত্ত। স্বামীর গরবে গরবিনী। স্বামীর সেবায় নিয়োজিত প্রাণ। স্বামী সঙ্গ তার জীবনের একমাত্র সুখ।

আসলে রিজিয়া দুঃখকে জয় করতে শিখেছে সেই ছোট্ট থেকেই। আজও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে জীবনে। যাদের জীবনে চাওয়াটা নিতান্তই কম, পাওয়াটা ছোট্ট হলেও কম মনে হয় না। আজ পাকেচক্রে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়েছে তার স্বামীকে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে। তাতে কোন বিরোধীতা নেই রিজিয়ার। সে ভাবতো, যে মেয়েটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জীবন বিপন্ন করে ছুটে আসতে পারে শুধুমাত্র তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য। তার জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের থাকা উচিত। যে মেয়েটা বারবার চলে যেতে চেয়েছে, কিন্তু অজানা ঠিকানায়। এমন একটা মেয়েকে একা ওভাবে চলে যেতে দেওয়া কি যায় ? এ সংসারে থেকে ও তার কোন চাহিদা নেই। দুমুঠো খাওয়া পেতে এমন লেখাপড়া জানা শহরের মেয়ে, কতটা অসহায় হয়েছে বলেই তো থেকে যেতে হলো। কিছু মানুষের চাপে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে থাকার জন্যই শুধু বিয়েতে বাধ্য হলো।

বারবার বলেছে আসমা রিজিয়াকে। আমি তোমার স্বামীর ভাগ চাই না। চাইবো না কোনদিন। আশ্রয়টুকুই আমার কাছে অনেক। ছেলে- মেয়েকে শুধু কেড়ে নিও না ।ওদের মানুষ করার দায়িত্বটা আমারই থাক। রিজিয়ার চোখের কোন চিকচিক করছিলো অশ্রু ফোঁটায়। কোনভাবে সামলে ছিলো তখন। মনে মনে বলেছিল, – হে খোদা, এমন একটা ফুলের মতো জীবনকে তুমি একটু সাহারা দিলে না। মেয়েদের জীবনে স্বামী- বাচ্চা- সংসার আর কি বা চাই। সেটা তুমি দিয়েও এভাবে নিঃস্ব করে দিলে। সেই মানুষটাকে একটু সিধা করে দিলে তাহলে এত কষ্ট পেতে হতো না নিরীহ মেয়েটাকে। রোজকার মতোই সন্ধ্যা মুখে আরশাদ ফিরলে বস্তির বাড়িতে। কলতলায় গিয়ে স্নান সারলো। চা-জল খাবার খেয়ে বসে রইলো। ছেলে- মেয়ে পড়ায় ব্যস্ত আন্টির কাছে। নিত্যদিনের রুটিন মতোই চলতে থাকলো।

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ২৪) – জয়নাল আবেদিন

সকালের ডিউটিতে জয়েন করেছে শঙ্খ। বদলির খাঁড়া থেকে রেহাই পেয়েছে এ যাত্রা। তবুও ক্রমশ সে একটা অসহিষ্ণুতায় ভুগতে থাকছে দিনের পর দিন। মাথার উপর একটা অদৃশ্য খড়্গ ক্রমাগত ঝুলছে। যেটা দিনের পর দিন এক জটিলতায় পরিপূর্ণ হচ্ছে। শেষ কোথায় শঙ্খ সে হিসেবে মেলাতে পারছে না। কথায় বলে, তিল থেকে তাল হয়ে যায়। শঙ্খ কোনদিন এসব প্রবাদ কথাকে আমল দিত না। কিন্তু প্রবাদ কথার একটা সারবত্তা থাকে। এমনি এমনি একটা কথার জন্ম হয় না। বিশেষভাবে এর সত্যতা যাচাই করে তবে শব্দগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আজ যখন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ফেলেছে সমস্যাখানা। একটু হলেও টাল খেয়েছে বিশ্বাসের স্তম্ভ। বিষবৃক্ষের ডাল- পাতা বেশ বড় আকার নিয়েছে। অনেকটা জায়গা জুড়েছে মনের সীমানা ছাড়িয়ে। একটা অশনি সংকেত দেখা দিচ্ছে বারে বারে মনের দরজায়, আর তার থেকেই শঙ্খ একটু একটু করে অস্থিরতায় ক্রমশ দুর্বল হতে থাকছে। মনের কোনে একটা প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি হচ্ছে ক্রমশ।

উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতেই থাকে। চড়াই- উতরাই। মাটি- পাথর। নরম মাটি- শক্ত মাটি। বহু ঘাত- প্রতিঘাতে একটু একটু এগিয়ে যায়। ঢালু পথে খরস্রোতা। সমতলে মন্থর। ঠিক যেন শঙ্খর জীবনের মতোই। শুরু থেকে তরতরিয়ে এগিয়েছে গতি মন্থরতায় ভোগেনি কখনো। বাধা পথ অতিক্রম করেছে প্রবল খরস্রোতে, অথচ আজ জীবনটা এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক মোহানার মুখোমুখি। তবে সাগরে মেশা তার এ জীবনে হবে কিনা সে ভেবে পাচ্ছে না। সুর- তাল- লয়, কেমন ভিন্ন পথে গমন করছে মনে হচ্ছে তার। চাতক পাখিটার মতো মেঘ হোক- মেঘ হোক, ডাক সারা আকাশ জুড়ে। একটু বৃষ্টির জন্য। হয়তো সব সময় এমন প্রার্থনার ডাক নয়। কিছুটা চাওয়া পাওয়ার জন্য। আবার কিছুটা চাওয়া চিরাচরিত অভ্যাসের জন্য ই। মানুষ অভ্যাসের দাস।

দিন রাতের রোজনামচায় শঙ্খের সময় অতিবাহিত হয়। সময়ের কষাঘাতে মনের সুপ্ত ভাবনাগুলো কখনো ভেঙে চুর চুর হয়। কখনো মনের আঙ্গিনা জুড়ে ভয়-ভীতির একটা অন্ধকার নিকষ কালো গলিপথে আটকে যায়। দুটো পা এগোতে পারে না যেমন পিছতে পারেনা এক পা। নিদারুণ অস্থিরতায় কেঁপে ওঠে কখনো- কখনো। ঘুমের মাঝে সারা শরীর ঘেমে চান করার মতো হয়ে যায়। বিছানায় বসে জোরে পাখা চালিয়ে হাওয়া নেয় সারা শরীরে। অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরতে থাকে সমস্যার তীরগুলো। মেজদার আঙুল উঁচানো শব্দগুলো, – ঘরের মানুষটাকে মানুষের মতো দেখেছিস ? তাকে তো যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছিস। জন্তুর মতো দিনের পর দিন শাসন-শোষণ করেছিস। মানুষের মতো তার জীবনে স্বাধীনতা থাকলে, সংসার ছেড়ে কেউ একা- একা, এমনি- এমনি চলে যায় না। যেতে চায়না।

শ্বশুরমশাইয়ের বেশ উত্তেজিত কন্ঠস্বর, – তুমি ভাবছো ও তোমার সংসারে না এলেও তোমার চলে যাবে। কিন্তু ওই মেয়েটা আমার একমাত্র মেয়ে। আমার ওকে চাই। তোমাকে পনেরো দিন সময় দিলাম। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও। না হলে এর প্রতিফল কি হবে তুমি ভাবতে পারবে না। তোমার লাইফ হেল হয়ে যাবে। চিরকালের জন্য জেলের গরাদে জীবন কাটবে বলে দিলাম।

ট্রেনে বসে শুভ্র বলেছিল, – মা কি আর কোনদিন আসবে না আমাদের কাছে? কেন বাবা- মায়ের কি হয়েছে গো ?
অভ্র বলেছিল, – সেই কতদিন একই কথা শুনে আসছি! চলে আসবে- চলে আসবে। সেই দিনটা কবে গো ?

একটু তরল পানীয় গলায় ঢালে শঙ্খ রাতের বিভীষিকা ভোলার মানসিকতায়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে পরপর কয়েকটা টানে বেশ বুঁদ হয়ে বসে থাকে অনেকটা সময়। ব্যারাকের বাইরের রাস্তায় ক’টা কুকুর ঘেউ ঘেউ শব্দে ডেকে চলেছে কিছুটা সময়। ভারী গাড়ি যাওয়ার বেশ গম্ভীর শব্দ পরপর কয়েকটা। আবারো শুয়ে পড়ে বিছানায় ঘুমিয়েও পড়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে।

সকালের ডিউটিতে মগ্ন শঙ্খ। সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা- তামাশয় সময়ের কবলে রাতের অন্ধকার দিকটা মুছে যায়। প্রাণের মৃত্যু সহজে হয়, সাধারণ মানবিক ঘটনা প্রবাহে সহজে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু সম্পর্কের মৃত্যুর সহজে হলেও মন সহজে মেনে নেয় না। মনের ধর্ম এমনটাই। ইচ্ছে করে মুছে ফেলা যায় না। তবে যে সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে, দীর্ঘ বঞ্চনা- অবমাননা অভব্য ব্যবহারের কারণে। যে সম্পর্কের শুরুতেই মনের মৃত্যু ঘটে। সামাজিকতার সৌজন্যে জীবিত থাকে মান্যতাটুকু। বেঁচে থাকার স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হয় সম্পর্কটাকে। জোড়া দিয়ে রাখা সময়ের তালে- তাল মিলিয়ে রাখতে হয়।

দিনরাত সময়ের টানে টিকটিক ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে এগিয়ে যায়। পরিবর্তনের স্রোতে শুরু থেকে বছর শেষ হয়ে আসে। সবকিছুর বয়স বাড়ে প্রকৃতির নিয়মে। সন্ধ্যার আকাশটা আজ কেমন মোহাচ্ছন্ন। আকাশে ছড়িয়ে থাকা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। গোধূলি রঙে যেন পটে আঁকা কোন অদৃশ্য শিল্পীর অসাধারণ একটা ছবি। রংয়ের কারুকার্যে চোখ আটকে থাকে। মন ভালো করে একটু সময়ের জন্য। বেশ কটা দিন হয়ে গেল সন্ধ্যা থেকেই মদের মাত্রাটা একটু বেড়েছে শঙ্খর। নেশার মোহে সবকিছু ভুলে থাকতে চায় এখন। ডিনার শেষে একটু পায়চারি করে। সিগারেট টানে। মনটাকে একটা সুতোয় বেঁধে রাখতে চায়। অনিষ্ঠ আশঙ্কাই মনের ধর্ম। চেপে রাখা যায় না। ঘুণ পোকার মতো কুরে কুরে মনের থেকে বার করে সবকিছু। ভুলতে দেয় না। মাকড়সার জালের মতো ঘিরে ফেলা সমস্যা মনের কোণে লুকিয়ে রাখা যায়! বিছানায় একটু আয়েশ করে বসলে শঙ্খ। টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। উঠে গিয়ে রিসিভার কানে রেখে বললে, – হ্যালো।

— হ্যালো, রথীনদা বলছি, শঙ্খ বলছিস তো ?
— হ্যাঁ, রথীনদা। কি খবর বলো।
— দিন কয়েক আগে একজন এসেছিল বুঝলি। বাঙালি লোক। পুনেতে চাকরি করে। কলকাতায় বদলি হয়েছে। কলকাতার অফিসে এসে কার কাছে খোঁজ পেয়ে দেখা করে গেল। রথীনদা বললে।
— কি কথা হলো? উৎসুক শঙ্খ।
— সামনের মাসে দু তারিখে জয়েন করবে। কটা দিন একা অফিস গেস্ট হাউসে থাকবে। এখানে সেটেল হলে। পুনে থেকে মালপত্র নিয়ে বাড়ির লোকেরা চলে আসবে। রথীনদা জানান দিলো।
— তাহলে, আমাকে কবে নাগাদ যেতে হবে ? শঙ্খ জানতে চায়।
— ভদ্রলোক জয়েন করে আমার কাছে আসবে। ঠিকঠাক কথা হলে তোকে জানাবো। কবে আসবে ।বাকি কাজ তোর। আমি যোগাযোগ করে দেব। রথীনদার কথা।
— এভাবে বলো না রথীনদা। কথার সময় তোমাকে সামনে রেখেই বলা হবে। উকিল দিয়ে চুক্তিপত্র তো করতে হবে। তুমি না থাকলে হয়।
— ঠিক আছে সময় হলে দেখা যাবে।

ফোন রেখে আবার বিছানায় এসে বসলো শঙ্খ। হঠাৎ ভাবনাটা কিছুটা টাল খেলো তার। বাড়ি ভাড়া দিয়ে রাখলে পয়সা আসবে ঠিকই। এমনিতে স্বাতীকে নিয়ে ক্রমশ শ্বশুর মশাই- মেজদার কাছে ব্যাক ফুটে চলে যাচ্ছে সে। তাদেরকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়াটা কি একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাবে না। শ্বশুর- শাশুড়ি মেয়ের বাড়ি রক্ষা করতে গ্রামের বাড়ি অন্যের ভরসায় রেখে চলে আসে। এখন না জানিয়ে এমন একটা কাজ করলে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা পড়তেই পারে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে শঙ্খর। আবারও একটা সিগারেট মুখে লাইটার জ্বালায়। একটা সুখ টানে মনটাকে ভিজিয়ে নেয়।

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ২৫) – জয়নাল আবেদিন

প্রকৃতি আর প্রকৃত দুটিই সত্য। একটা দৃশ্যত। অপরটি দৃষ্টির বাইরে। মনের মাধুরী। দুটো শব্দের সঙ্গেই সত্যেন বাবুর আত্মিক যোগ। চাষ-আবাদে সবুজ দিগন্ত। মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির রূপ মনকে তরতাজা করে দেয়। মাথার উপর নীল আকাশ। নকশা কাটা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। নিচে যতদূর চোখ যায় সবুজ গাছ- গাছালি, যৌবনপ্রাপ্ত ধানের গাছ। এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে মনটা কেমন সতেজ হয়ে ওঠে।

কিছুদিন যাবত সত্যেন বাবু এত সব কিছুর মাঝেও যেন হতাশায় ঝলসে যাচ্ছে রোদে পোড়া গাছের মতো। একমাত্র মেয়ে স্বাতীর জীবন যে বিপন্ন অবস্থায়। জীবিত না মৃত জানে না সে। মানুষের জীবন যে এভাবে দুর্বিষহ হয়ে যেতে পারে কল্পনার অতীত। সুন্দর মনের সহজ- সরল মেয়েটা লোভাতুর একটা মানুষের জন্য, কেমন যেন হারিয়ে গেলো। অথচ মেয়েটার সুখী জীবন গড়ে তোলার জন্য, কতো অন্যায় আবদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছে তাকে।

— আচ্ছা মাস্টার, তোমাকে এদানিং দেখি কি যেন ভাবো সব সময় ? কাজে কি ভাবে ভুল হয়েছে গো আমার ? আসগারের জিজ্ঞাসা।
— আরে না- না। তোর কাজে ভুল ধরার কি আছে। মনটা খারাপ অন্য কারণে।
— সেই‌ তো কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর থেকেই দেখছি। কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকো। তাই বললাম আর কি। আশঙ্কার কথা জানালে আসগার।
— হুম, তোর আশঙ্কা মিথ্যে নয় । মেয়েটার জন্য একটু চিন্তায় আছি। মাস্টারের ছোট্ট জবাব।
— কেন গো, মামুনির শরীল খারাপ ? প্রশ্ন আসগারের।
— হ্যাঁ, সেই রকমই। তুই নিড়ানীটা একটু দেখে যাস। আমি চললাম।

জমির আলপথ ধরে রাস্তায় উঠলো সত্যেন মাস্টার। গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলে। পথে দুই এক জনের সঙ্গে দেখায় সৌজন্য বিনিময়। দু এক মিনিট সাধারণ কথা বার্তা। গ্রামীণ একটা ধারাবাহিকতা। মাথার উপর সূর্যটা তখন হেলেছে একটু। বাড়ি ফিরে চান খাওয়া সেরে ভাত ঘুমের লক্ষ্যে বিছানায় জায়গা নিলে মাস্টার। গত কিছুদিন হয়ে গেল সত্যেন বাবু শঙ্খের মেজদার সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছে করেছিলো। সময় অভাবে করে উঠতে পারছিলো না। আজ সন্ধ্যা মুখো চা খেয়ে একটু রাস্তায় বের হলো। মোড়ের দোকানের ফোন থেকে কথা বলার উদ্দেশ্যে। নাম্বার মিলিয়ে বাড়ির ফোনটায় কল দিলে। শঙ্খর মেজদা রিসিভার তুলে কানে দিলেন।

— হ্যালো, কে বলছেন ?
— মেজ বাবু, আমি শঙ্খর শ্বশুর- মশাই বলছি।
— আরে! মেসোমশাই, কেমন আছেন ? বাড়ির সব খবর ভালো তো?
— হ্যাঁ বাবা, সকলেই ভালো আছি। তোমাদের বাড়ির সকলে কুশলে আছে তো ? কদিন টা ভাবছিলাম একটু কথা বলবো। চাষ বসেছে। তেমন আর সময় করতে পারছিলাম না।
— তা বলুন মেশোমশাই, কি খবর?


— বলছিলাম বাবু। এখনো তো কোনো কিছু খবর পাচ্ছি না। আমার মেয়েটার কি কোন হদিশ পাবো না? আমি কিন্তু বাবু ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছি। ভাবছি আমাদের লোকাল থানায় শঙ্খের নামে একটা ডায়েরি করে রাখবো। আমার মেয়ের জীবন সংশয়ের জন্য। সত্যেন বাবু আবেগের বশে কথাগুলো বলে ফেললেন।

শঙ্খের মেজদা একটু কেমন যেন নড়ে উঠলেন। অনিষ্ঠ আশঙ্কা ঘুরপাক খেলে তার মনের মধ্যে। যদি এমন কিছু হয়েই থাকে। তাহলে তো শঙ্খের জীবনে একটা দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে চলেছে। ছেলেটা নিজের চাহিদা নিজের ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে, নীতি- দুর্নীতির তফাৎ করতে পারলো না। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো শুধুই ছুটতে শিখেছে। থামতে শিখলো না। থামতে হয় শেখার চেষ্টাই করলো না। আজ যদি জীবনের চরম সময় সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশ কাটিয়ে ফেরার কোন রাস্তা সামনে আসবে কিনা জানি না।


— মেসোমশাই, আপনি একটু সময় দিন আমাকে। আমি একটু কথা বলি ওর সঙ্গে। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। আপনার আশঙ্কা বা আপনার করণীয় ভাবনার সঙ্গে আমি একশো ভাগ একমত। আমার মেয়ের জন্য হলে আমিও হয়তো তাই ভাবতাম।
— আমি এই মুহূর্তে বড় অসহায় মেজ বাবু। কিছু ভাবতে পারছি না। কি করবো- কিভাবে ভাববো। ঠিক আছে, তোমার কথা মতো আরো কটা দিন দেখি। তুমি একটু ব্যবস্থা করো। গলাটা কেমন ধরে এলো সত্যেন বাবুর।
ফোন কলের পয়সা মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। সামনা-সামনি দেখা হওয়া ক’জনার সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো। নাতনির জন্য বিস্কুট টুকটাক ক’টা জিনিস কিনে বাড়ির পথ ধরলো সত্যেন বাবু।

রাতের খাবার শেষে ব্যারাকের ভিতরে একটু পায়চারি করলো শঙ্খ। এটা ওর রোজকার অভ্যাস। সন্ধ্যা নাগাদ আজ এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। চারিদিক একটা নিঝুম পরিবেশ। আকাশটা এই মুহূর্তে বেশ পরিষ্কার। দূর পর্যন্ত তাকালে তারার ঝিকিমিকি নজরে আসে। লুকিয়ে- চুরিয়ে কোথায় কয়েকটা ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা ডেকে চলেছে। রাস্তায় মাঝে- মধ্যে ভারী গাড়ি যাওয়ার শব্দ। আস্তে- আস্তে নিজের রুমে ঢুকলো শঙ্খ। জামা খুলে পাখা চালিয়ে বিছানায় বসলে। সিগারেটের প্যাকেট খুলে মুখে দিয়ে লাইটারের আগুনে জ্বলন্ত ধূমপানে মনটাকে এক সূত্রে বেঁধে নিল যেন। তৃপ্তিতে চোখ বুজলো এক মনে। বেশ কটা দিন পর হঠাৎ আজ টেলিফোনটা ক্রিং… ক্রিং.. শব্দ বেজে উঠলো। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে বললে, — হ্যালো, কে শঙ্খনীল বলছি । ওহ্ মেজদা, কেমন আছো তোমরা? বাড়ির সকলের খবর ভালো তো?

— হ্যাঁরে, আমাদের বাড়ির খবর সব ভালো। তোর কি খবর ? ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করিস মাঝে মাঝে, পড়াশোনা কেমন চলছে ওদের ?
— অফিসে মাঝে-মধ্যে ফোন করি। ঠিকই আছে।
— তোর শ্বশুর মশাই কদিন আগে ফোন করেছিলো। বৌমার কোন খবর পেয়েছিস ? না ভুলে গেছিস ? সে তো থানায় অভিযোগ জানাতে চায়। তুই তার মেয়েকে মেরে লাশ গুম করে দিয়েছিস। ক্ষোভ প্রকাশ করলো যেন মেজদা।


— কি যে বলো মেজদা ! সেটা কি সম্ভব ? উনার মাথায় এমন ভাবনা আসার মানে কি হলো ? ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের একসঙ্গে থাকা। মেরে দিলাম, ছেলে- মেয়ে দেখতে পেল না ? বাড়ি থেকে সকালে বেরিয়ে গেছে, ওরা তো জানে। কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে শঙ্খ।
— আরে সে তো খুনের আসামি নয়, যে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। আত্মগোপন করে আছে বছর পার হয়ে গেলো। খোঁজার চেষ্টা নেই কেন ? লোকাল থানায় ডায়েরি করে বসে থাকলে হবে? লালবাজার যেতে হবে, এস পি , এস ডি ও লেভেল এ যোগাযোগ করতে হবে। বেশ অভিযোগের সঙ্গে বললো মেজদা।
— আমার সীমিত সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব আমি তো করছি- করেছি তো। কলকাতায় থাকতে কয়েকবার থানায় গেছি। কিছু জায়গায় খোঁজ খবরও নিয়েছি। এখন সে যদি আত্মগোপন করে থাকে, তাহলে তো মুশকিল। কিছুটা সাফাই গাইলো শঙ্খ।


— তাহলে তুমি এখন কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছ? আর খোঁজ পাবেনা? অতএব কষ্ট করে খোঁজার দরকার নেই ?পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তোমার উপলব্ধি আছে ? ভেবেছ একটু ? নোংরামির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছো তুমি। তোমার বাস্তব জীবন যে পর্যায়ে এসে থামতে চলেছে। কল্পনা করতে পারছ না। তোমার শ্বশুর মশাই যদি তোমার বিরুদ্ধে মেয়েকে খুনের কেস করে থাকে। কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমার চাকরি, টাকা- পয়সা, মান- সম্মান সব ধুলোয় লুটিয়ে যাবে। বাকি জীবন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ। মেয়েটার কথা ছেড়েই দিলাম, সে না হয় দিদিমার ভরসায় থাকবে। কি করবে তখন? মেজদার গলা ধরে এলো ক্রমশ।

স্তম্ভিত শঙ্খ কিছুটা সময়ের জন্য। ভয়ের আবহে শরীরটা যেন কেঁপে উঠল মনে হয়। সত্যিই কি ক্রমশ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ কোথায় হতে পারে আগে কোনদিন ভাবেনি। তাছাড়া মান- অভিমানের তো একটা সময় পর্যন্ত থমকে থাকে অনেকে। থেকে যায়। মনের চরম অবস্থায় তারপর আস্তে- আস্তে থিতিয়ে যায়। গ্লাসে থাকা ময়লা জলের মতোই । তখন আবার ফিরে আসে সাময়িক বিরতির পর। জীবনের অভিমানের পালা চুকিয়ে শুরু হয় বাকি থাকা অধ্যায়ের।

— মেজদা, আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তোমরা যেভাবে ভাবছো। কেন এভাবে ভাবছো। আমি জানি না।
— আরে, শোন শোন। আমরা ভাবছি না। তোর শ্বশুর মশাই ভেবেছেন- তিনি আমাকেও ভাবাচ্ছেন। তবে ভাবনাটা কি ভুল বলে মনে হয় তোর ?
— না, না- মেজদা। একেবারে ভুল ! আমাকে এভাবে ভাবা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। এতো নিষ্ঠুর আমি নই। কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ, হতাশ শঙ্খ। কথা বলার শক্তি যেন কেউ কেড়ে নিলে মনে হচ্ছে তার।
— ঠিক আছে, কে ভুল- কে ঠিক, আমি বলে দিলেই তো হবে না। তুমি সরাসরি তোমার শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলো। তার বক্তব্য শোনো। সমাধান করো। তা না করে, তুমি তো একরকম এড়িয়ে- এক কথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছ। কেন, মানুষটার প্রতি তোমার নিজস্ব দায়িত্ব নেই ? সে কি বানের জলে ভেসে এসেছিলো?

— মেজদা, তোমরা যেভাবে রিঅ্যাক্ট করছো। মনে হচ্ছে আমি তাকে মেরে দিয়েছি বা তাড়িয়ে দিয়েছি। আর ফেরাতে চাচ্ছি না। সত্যি বলছি, এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হয়েছে। আগের দিন বাপের বাড়ি থেকে না ফেরার জন্য একটু রাগারাগি করেছিলাম। ও চিরটাকাল যেমন মুখোমুখি তর্ক করে করেছিলো। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও যেভাবে অসংলগ্ন ভাষা ব্যবহার করছিলো। তাতে আমি রাগে দুঘা চড় মেরে দিয়েছিলাম। সেটা রাতের ঘটনা। তারপর যেমন রোজের মতো খেয়ে-দেয়ে আমরা ঘুমিয়েছি সকলে। সকালে দেখলাম কোথাও নেই বাড়ির মধ্যে। বাইরের দরজা খোলা ছিলো। তখন বুঝলাম বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। ভেবেছিলাম রাগে চলে গেছে। রাগ কমলে ফিরে আসবে। শঙ্খ মেজদাকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
— আরে ও গল্প তো আমি শুনেছি আবারও শুনলাম। তা রাগে চলে গেছে বছর পার হয়ে গেল তো। এই এক বছরে তোমার খোঁজ- খবর নেওয়ার গল্পটা কি সেটাই বলো? কি প্রচেষ্টা নিয়েছো? কোথায়- কোথায় দরবার করেছো? পুলিশ কি স্টেটমেন্ট দিয়েছে? ডাইরি করা ছাড়া আর কি- কি ব্যবস্থা নিয়েছো? সেই গল্প শোনাও। এবার মেজদা বেশ ধাঁতানি দিলে একটু।
— আমার আর বলার কিছু নেই মেজদা। সামনের মাসে শেষের দিকে মাস খানেকের জন্য ছুটির দরখাস্ত দিয়েছি। ছুটি পেলে বাড়ি ফিরে একটা হেস্তনেস্ত করবো। আজ আমি খুব ক্লান্ত। দুদিন পর না হয় আমি তোমাকে ফোন করবো। অপর প্রান্ত থেকে মেজদার ছোট্ট উত্তর। ঠিক আছে। ফোনটা কেটে দিলো।

মাথার চুলের মধ্যে দুহাতের আঙুল ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে রইল শঙ্খ। অনেকটা সময় একই ভাবে কাটার পর, উঠে গিয়ে বোতল খুলে তরল পানীয় গলায় ঢালে বেশ কিছুটা। বিছানায় বসে একটা সিগারেট ধরালো। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে মন কে ছাঁকতে চাইলে একটুও বা। বনের আগুন যখন মনে লাগে। সে উত্তাপ সহ্যের ক্ষমতা সকলের থাকে না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকল। সিগারেট ফেলে শটান বিছানায় পিঠ পাতলো শঙ্খ। নিস্তব্ধ হতে বেশি সময় লাগলো না।

খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ২৬) – জয়নাল আবেদিন

দিনগুলো কতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে কেমন। বস্তির এই দর্মাঘেরা ঘরটায় নতুন এক জীবনের শুরু হয়েছিল। দেখতে- দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেল। যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই চলছে মসৃণ পথে কোন সমস্যা নেই। কোন চাহিদার টানাপোড়েন নেই। সহজ- সরল রিজিয়ার জীবনে সুখ- দুঃখের সহাবস্থান আজও বিরাজমান। দুটো নারীর জীবনে কেমন আপোসে চলে দিন যাপন। আসমা ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটায়। তাদের পড়াশুনা, চান-খাওয়ার দায় দায়িত্ব পালন করে সময় কাটায়। রিজিয়া সংসারের দায়ভার যেমন বহন করতো আজও করে চলেছে। আরশাদ যেমন সকালে খেয়েদেয়ে বের হয় তেমনি যায়। সন্ধ্যা মুখো ঘরে ফেরে।

রিকশা স্ট্যান্ডে কয়েকজন সহকর্মী নতুন জীবনের সংবাদ চায়। একটু হেসে দেয় আরশাদ বলে, – আমার এ জীবন নতুন নয় গো ভাই! সেই পুরনো জীবনটাই বয়ে যাচ্ছি। যেমনটা এতো বছর বয়ে এসেছি।
— পিন্টু বললে, – সে কি গো দাদা ? নতুন ভাবি হলো। আর একটা একটু হলেও খুশির খবর তো থাকবে ?
— অখুশি আছি বলিনি তো। আরশাদের জবাব।
— জসিম বললে, – দাদা কি মুখে সব কথা বলবে রে, বুঝে নিতে হবে।
— পিন্টু বললে, – আরশাদ দার হাফ-ভাব একই রয়েছে। বোঝার কোন উপায় নেই তেমন।
— ওরে পাগল, এমনি বিয়ে করিনি। করতে বাধ্য হয়েছি। একটা জীবনের বিনিময়ে জীবন বাঁচিয়েছি। আরশাদ বললে।
— জসিম বললে, – সে তো জানি গো, নাকের বদলে নরুন পাওয়া।
— ঠিক তাই, খুব দামী কথা বললি ভাই।

স্টেশনে ট্রেন আসে। ওরা সকলে প্যাসেঞ্জার নিয়ে ছুটে যায় দিক- বিদিক। যাওয়া- আসা চলতেই থাকে দিনভর। রাতে একসঙ্গে খেতে বসে আরশাদ বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে। রোজগার দিনের মতোই রিজিয়া খাবারের থালা এগিয়ে দেয় সকলের সামনে। আসমার গা ভেসে ছেলে- মেয়ে। পাশাপাশি আরশাদ – রিজিয়া। খেতে খেতেই আরশাদ বলে উঠলো, — দিদিমণি আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ? বস্তির মানুষ, পাঁচ কথা বলা মুখ তো।
আসমা বললে — অভ্যাস করে নিয়েছি। কারো মুখে তো হাত চাপা দেওয়া যাবে না।
রিজিয়া বললে — ক’জনকে তো মুখের উপর জবাব দিয়েছি। এখন আর তেমন কেউ মুখ খোলে না। কথায় বলে না, যেমন কুকুর তেমন মুগুর চাই। সেটাই করতে লেগেছি।
আরশাদ বললে — কিছু কিছু মানুষের সমস্যা এখানেই। কেউ একটু ভালো থাকতে চাইলে, তাকে ভালো থাকতে দেওয়া হবে না। কেউ কোনো ঝঞ্ঝাটে থাকতে না চাইলে, তাকেই ঝঞ্ঝাটে ফেলে দেবে এরা।
আসমা বললে — মানুষের জীবন বোধ আর জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমাদের অনেকেরই নেই। কি শহর- কি গ্রাম- কি বস্তি। সবখানেতেই একই ধারা। শিক্ষার যেখানে চেতনা নেই, শিক্ষিত মানুষ যদি মানুষের মর্যাদা দিতে না শেখে। সেখানে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ তো করতেই পারে। তাদের জীবনে তো বোধের অভাব থাকবেই।

আরশাদ বললে — আপনার সব কথার মানে না বুঝলেও। যেটা বলতে চেয়েছেন বুঝেছি। খাঁটি কথা বলেছেন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ, বুঝন ক্ষমতা তাই অনেক বেশি।
আসমা বললে — জ্ঞানের আলো শুধু শিক্ষিত মানুষের মনে আছে, কথাটা পুরোটা সত্য নয়। জ্ঞান পাপী মানুষ সমাজে ঠেসে বসে আছে। তার থেকে তথাকথিত অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত অনেক মানুষ আছে, যাদের ভেতরটা আলোর মতো উজ্জ্বল।
রিজিয়া বললে — মানুষ তো এখন শিয়াল- কুকুরের মত গো। দেখা হলে কামড়াকামড়ি, খাবার খেতে কামড়াকামড়ি। ঠিক কথা না, বলো দেখি দিদি।
আসমা একটু হেসে ফেললে। বললে — একদম ঠিক কথা বলেছ। আমরা এখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্ব গ্রহণ করেছি। বস্তি থেকে গ্রাম- গ্রাম থেকে শহর, সবখানে আজ একই ধারা।
আরশাদ বললে — কথাটা কিন্তু খাসা বলেছেন দিদি মণি। এক ঘর কথা।

খাওয়া শেষ হলো। রিজিয়া এঁটো থালা-বাসন ধুতে লাগলো। আসমা বাচ্চাদের নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। সারাদিনের ক্লান্তির অবসানে বিছানায় পিঠ পাতলে। সকালের বস্তির আকাশে পুরো আলো ফুটে উঠেনি তখনো। সকালে ট্রেনখানা ঝমঝম শব্দে শহরের দিকে মেদিনি কাঁপিয়ে ছুটে গেল। অভ্যস্ত জীবন যাপনে অসুবিধার কিছু নেই কারো। সারাদিনে কতবারই এমন শব্দের যাতায়াত। কলতলায় হাঁড়ি- কলসির ঠোকাঠুকি। ফাঁকা বালতির ঝনঝনানি। দৈনন্দিন কাজের কলকাকলি। মাঝেমধ্যে চিৎকার- চেঁচামেচি। আগে- পিছে হিসাব নিকাশ। জনাকয় পুরুষজন বালতি বোঝাই জল নিয়ে নালার মুখে স্নানে ব্যস্ত। সূর্যটা লাল থালা থেকে মাথা উঁচিয়ে আলো ছড়ায় চারিদিক। অনেকটা থিতু হয় কলতলা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে থাকে মানুষগুলো। বসতি এখন বেশ কিছুটা কোলাহলমুক্ত। রুজির টানে মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়ে দিক- বিদিক ঠিক পাখির মতো। খাবারের সন্ধানে, বেঁচে থাকার- বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার পূর্ণ করার লক্ষ্যে। মানুষও কেমন পাখির জীবনকে আপন করে নিয়েছে। সারাদিন খাবার অন্বেষণ। দিন পাতা। সন্ধ্যে বাসায় ফিরে কোলাহল। গুঞ্জন। আওয়াজ নিভতে-নিভতে মধ্যরাত্রি। গড়পড়তা জীবনের একটা রুটিন। সকালের নাস্তা খেতে বসে আসমা আরশাদকে বললে — কদিন ভাবছিলাম একটা কথা বলবো। ভুল ভাববেন না কিন্তু।

আরশাদ বললে — বলেন।ভুল ভাবার কি আছে।
আসমা বললে — বস্তির কিছু ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে যদি পড়াশোনার ব্যবস্থা করি। তাহলে কি কিছু অসুবিধা হবে।
রিজিয়া বললে — দিদির যেমন কথা! ছেলে পড়ালে তো ভালো হবে গো ।
আরশাদ সায় দিয়ে বললে — হোক না অসুবিধের কি আছে। বাচ্চারা পড়ালেখা করলে তো খুবই ভালো।
অভীষ্ট লক্ষ্যে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল আসমা। সন্তানদের সেবার মাধ্যমে পিতা-মাতার মানবিক উন্নতির একটা সুন্দর রাস্তা নিলে সে। যোগাযোগের একটা সেতু তৈরি হলো এভাবেই।

ছেলে-মেয়েকে পড়িয়ে নিয়ে, ওদের হাত ধরেই বাইরে এলো আসমা। এভাবে বাইরেটা প্রথম দেখতে পেল সে। কটা ঘরের দরজায় দেখা করলে প্রথম দিন। দুটো মায়ের দেখা মিলল ঘরে। বাকিরা দুজনাই কাজে বেরিয়েছে। বাচ্চা কজন সারাদিন প্রায় ঘরবন্দী বললে হয়। বাচ্চাদের পড়ালেখার কথায় দুজন মায়ের বেশ উৎসাহ দেখা গেল। বললে, — ওর বাবা ফিরলে, কথা বলে ‘হ্যাঁ’ বললে নিয়ে যাবো তোমাদের ঘরে। বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললে একজন। কয়েকদিনের অভিযানে, আসমা বেশ উৎসাহ পেল। জনকয়েক বাবা-মা সেদিন সন্ধ্যের পর দেখা করেও গেল। বাড়ির দুজন ছেলে-মেয়ে। নতুন পাঁচজন মিলে শুরু হল স্বাক্ষরতা অভিযান। আসমা সময়কে কাজে লাগানোর জন্য কিছু কাজ চায়। কাজের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে অনেক কিছু ভুলতে চায়। পুরনো খোলস শরীর থেকে ঝেড়ে ফেললেও, মন থেকে পুরনো সকল সহজে সরানো যায়নি। যত সময় অবসর। তত সময় জুড়ে স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো পাতা উল্টাতে- উল্টাতে সামনে চলে আসে। এটাই স্বাভাবিক। সূর্যের আলোর মতো সত্য। স্রোতের অনুকূলে ভেসে বেড়ানো নৌকোর কসরত অনেক কম। স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বেশি। তরতরিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। শরীরখানা ভাসিয়ে রেখে নিশানা সঠিক রেখে এগিয়ে চলা। উজান ঠেলে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া, বেশ সময় সাপেক্ষ। বেশ কষ্টকর। নিশানা আর কসরত সমান তালে এগিয়ে চলা।

স্বাতীলেখা আর আসমা। দুটো চরিত্র- একই মুখ। ভীষণ বিপরীতমুখী। সরল স্বাভাবিক জীবন শুরু হলেও, ক্রমশ অমানবিকতার শিকার হতে হয় তাকে। ঘাত- প্রতিঘাত, নীতি- নৈতিকতায় বারবার খুন হতে থাকে সরল একটা মন। প্রতিবাদের ভাষা দমন-পিড়নের যাঁতাকলে কতবার পেশাই হয়েছে। সত্যিই কি নারীদের কোন নিজস্ব ঠিকানা নেই? নেই কোথাও নিরাপত্তা ? নারীর কোন স্বাধীন মতামত দেবার অধিকার নেই ? চাপিয়ে দেওয়া মতামত- মতবাদ সেই ছোট্টবেলা থেকেই মেনে চলতে হবে ? সংসার জীবনেও অনুগতদাস হিসাবে জীবন- যাপন ? কিন্তু কেন ? মানুষ হিসেবে কি নারীর কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না ? থাকতে নেই ? স্বাতীলেখা সইতে- সইতে সংযমী থাকতে- থাকতে কেমন দিশেহারা হতে থাকলে ক্রমশ। প্রতিবাদী ভাষা প্রয়োগে মাথা ফেটেছে মায়ের হাতের বেলনে । প্রতিবাদের প্রতি উত্তরে স্বামী শঙ্খের হাতের মারে ঠোঁট কেটেছে তার। তিন সন্তানের জননী হয়েও সংসার জীবনে পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়নি। নিজের মতো চলার- বলার অধিকার তৈরি হয়নি একটু ও। সন্দেহের বাতাবরণে হুকুম- তামিল করা ছাড়া এ নারীর জীবনে আর করার কিছুই ছিলো না।

একটা চরম সিদ্ধান্তের সাহসিকতায় ঝাঁপিয়ে পড়া মেয়েটা প্রতিবাদের আগুন ঝরিয়েছিল সেদিন থানার ভেতরে। একটা নিরপরাধ মানুষকে মিথ্যে শাস্তির অজুহাতে বন্দিত্ব ঘুঁচিয়ে ফেরত এনেছিল তার সংসারে, তার স্ত্রী পুত্র- কন্যার কাছে। তারপর শুরু জীবনের কৃচ্ছসাধন। নিজের সংসারে অপাংক্তেয়। নিখোঁজ জীবনের শুরু। এক কালো অধ্যায় ।দীর্ঘ সময়। দীর্ঘদিন। মাস- বছর। আজ নতুন নাম আসমা। নতুন জীবন । বস্তির পলিথিন ঘেরা ঘরে।

জয়নাল আবেদিন | Joynal Abedin

ট্যাটুর ইতিহাস ও আমরা | History of Tattoo | Reasons for using tattoos | 2023

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Rabindranath Tagore’s love for art and literature

Porokia Prem Ekaal Sekaal | পরকীয়া প্রেম (একাল সেকাল) | 2023

Online upanyas in bengali pdf | Online upanyas in bengali pdf download | Free online upanyas in bengali | Best online upanyas in bengali | bengali story books pdf free download | bangla pdf book download | bengali books online free | Buy Bengali Upanyas Books | Online Upanyas in Bengali | Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online 2023 | New Online Upanyas in Bengali | Bangla Upanyas Online Read | Read Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online pdf | Download Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online Series

Shabdodweep | Sabuj Basinda | High Challenger | Shabdodweep – Bangla Upanyas Online | Bangla Upanyas Online – Joynal Abedin | Bangla Upanyas Online Show | Shabdodweep Writer | Shabdodweep Novel Writer | New Bengali Novel | Online Upanyas in Bengali in PDF | Free Novel Download | Top Bengali Novel | Famous Bengali Writer | Best Selling Bengali Story | Pratilipi Story | StoryMirror Story | Bangla Upanyas Online Book | Sabuj Basinda Website | Top Bengali Writer | High Challenger Motivational Blog | Full Story in Bengali | Bengali Story Reader | New Bengali Story 2023 | Bangla Galpo | Natun Bangla Galpo

Natun Bangla Galpo 2023 | Story Writing Competition | Online Upanyas in Bengali 2024| Writing Competiton 2023 | Shabdodweep Online Upanyas in Bengali | Full Web Stories | Bangla Galper Series | Online Upanyas in Bengali in Netflix Bangla | Download Online Upanyas in Bengali | Bengali Story in USA | Online Upanyas in Bengali in Bangladesh | Indian Bengali Story | Google Online Upanyas in Bengali | Sera Bangla Galpo | 18+ Online Bangla Novel Reading | Adult English Story | Adult Bengali Story

Adult Bangla Galpo | Bangla Upanyas 2023 | Natun Bangla Upanyas | Shabdodweep Upanyas | Shabdodweep New Novel | Attractive Online Upanyas in Bengali | Attractive Bengali Story | Shabdodweep Forum | Shabdodweep Story Collection | Bengali Web Novel APK | Bengali Web Novel Website | Bengali Literature | Online Upanyas in Bengali in Audio Platform

Leave a Comment