Online Upanyas in Bengali – Joynal Abedin
পর্ব – ২২
সন্ধ্যার পরেই সত্যেন বাবু স্ত্রী এবং নাতনিকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলেন। রাত্রি নটা পাঁচে ট্রেন। সৌজন্য দেখাতে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিলে শঙ্খ। একটা ট্যাক্সি ধরে সকলে উঠে চলে যাবার পর, কেমন একটা স্বস্তি বোধ হলো ওর। দোকান থেকে একটা সিগারেট নিয়ে অগ্নিসংযোগ করে বেশ তৃপ্তির একটা টান দিতে তাতে। এমন একটা নেশা দ্রব্য মনটাকে বেশ ধরা তাজা করে দেয়।
রাতের খাবার খেয়ে ছেলেদের নিয়ে শুয়ে পড়লো শঙ্খ। ছেলে দুজন ঘুমিয়ে পড়লেও ওর চোখে ঘুম আসছে না। পরশু সকালের ট্রেনে দুই ছেলেকে বোর্ডিংয়ে রেখে আসতে হবে। ভর্তি সংক্রান্ত কাজ মিটিয়ে টাকা পয়সা জমা দিয়ে আর কলকাতা আসবেনা। সোজা চলে যেতে হবে কোচবিহারের সীমান্তের ব্যারাকে। এ মাসে একটা বদলির অর্ডার আসতে পারে ক’জনার। আবার নতুন কোন ঠিকানায় যেতে হবে আগাম জানা যাচ্ছে না। শরীর মন কেমন একটা অবসন্নতায় ভুগতে থাকে এ সময়। সংসার জীবনে চাই- চাই করতে- করতে কেমন একটা পিচ্ছিল পথে হাঁটতে শুরু করেছিল প্রথম থেকেই। বাস্তব জীবনকে সুখী করতে স্বোপার্জিত অর্থ বিনিয়োগ করতে হবে, এমন ভাবনা কোনকালেই ছিল না তার মধ্যে। দাদাদের উপর জুলুম করেই ভবানীপুরের বাড়ি খানা পেয়েছে এককভাবে। এমন একখানা জমি সহ তৈরি বাড়ি পাওয়া বিরাট লাভজনক। একটু নতুনত্ব আনার জন্য খরচের সমস্ত টাকাটাই শ্বশুরবাড়ির থেকে আনতে হয়েছে স্বাতীকে। মানসিকভাবে বিরোধটা ছিল এখানেই স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে।
স্বাতী বলতো – বারবার কেন টাকা চাইতে যাব আমি ? আমি এভাবে চাইতে পারবো না। তোমার দরকার তুমি চাও।
শঙ্খ বললে – এতে তোমার আমার ভাবছো কেন? আর ভবিষ্যতে তো ওই সম্পত্তির মালিক আমরাই হবো। তখন কি আমরা ওখানে গিয়ে বাস করব ? বিক্রি করে টাকাটাই তো নেব।
স্বাতী বলতো – অনেক দূর ভেবে রেখেছো তাহলে? যার জায়গা জমি সে অন্য কাউকেও তো লিখে দিতে পারে ? সে স্বাধীনতা তার আছে তো ? তুমি পাওয়ার জন্য ভেবে রাখছো কেন ?
শঙ্খ বললে – আমি না ভাবলেও মেয়ে হিসেবেই সম্পত্তির ভবিষ্যৎ মালিক তুমি হবে। এটা তো কোনো বেআইনি কথা নয়।
স্বাতী কেমন ঝাঁঝিয়ে বলেছিল, – সেজন্যই বারবার টাকা হাতানোর ফন্দি এঁটে রেখেছো নির্লজ্জের মতো। আত্মীয় বাড়িতে হাত পাততে কষ্ট হয় না তোমার ? একজন পুরুষ হয়ে কি করে এতটা নিচে নামতে পারো ?
শঙ্খ এবার বিস্ময়ে বললে, – ভাষা সংযত করো। সংসারটা আমার একার নয়। ভবিষ্যতের কথা দুজনেরই ভাবা দরকার। ছেলে- মেয়ের কথা তোমারও ভাবনায় থাকা উচিত।
— ঠিকই তো ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ গড়তে আমি নিরীহ বাপের কাছে হাত পেতে টাকা আনবো, আর তুমি তা দিয়ে ইমারত গড়বে। তার থেকে তুমি চুড়ি পরে ঘরে থাকো। আমি বাইরে বেরোই স্বাতীর শ্লেষাত্মক কথা।
এভাবেই স্মৃতি পটে ভাসতে থাকা ছবির সঙ্গে অবচেতন মনটা কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।
সকাল থেকেই একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ল শঙ্খ। চা-জল খাবার খেয়ে ছেলেদের নিয়ে বাজারে বের হলো। প্রয়োজনীয় জামা-প্যান্ট, গেঞ্জি, জুতো-মোজা আরো কিছু কিছু ওদের দরকারি জিনিস কিনে নিলে। ভরা বাজারে কেনা কাটায় বেশ কিছুটা সময় চলে গেল। তৈরি করা জিনিস সামগ্রী কেনার তালিকা দেখেই কেনা শেষ হয়েছে ।বাড়ি ফেরার পথে একটু মাংস নিয়ে সকলে বাড়ি ফিরলে। চান খাওয়া স্বার্থে একটু বেলা হল দুপুর গড়িয়েছে কিছু আগেই বিছানায় বীজ পাতলো বাপ ছেলে। সন্ধ্যাটা তাদের বেশ আলসে ভাবেই কাটলো সকলের। চা খাওয়া। ব্যাগ গোছগাছ করা। কাল সকাল সাড়ে সাতটায় ট্রেন। শিলিগুড়ি পৌঁছাতে সেই সন্ধ্যে ।এত বড় বাড়ি টাকে একা রেখে চলে যেতে হবে। দেখার কেউ নেই। কেমন অসহায় একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায়। হঠাৎই মনে হলো রথীনদার কথা। সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদের ঘরে রেখে বেরিয়ে পড়লো। হাঁটতে- হাঁটতে রথীনদার দোকান।
শঙ্খ বললে – একটু কথা ছিল দাদা।
রথীন দা বললে – আয় ভেতরে আয়। বল কি বলতে চাস ?
শঙ্খ বললে – বাড়িতে তো কেউ থাকছে না এখন । তাই ভাবছি দুটো ঘর ভাড়া দেব। আমার একটা থাকবে। একদিকে রক্ষণাবেক্ষণ হবে। আবার ভাড়াটাও পাবো।
রথীনদা বললে – মন্দ নয় । তাই কর।
শঙ্খ বললে – আমি দরজায় লিখে রাখছি। দুটো ঘর ভাড়া দেয়া হবে। যোগাযোগ রথীনদার দোকান। তুমি কথা বলবে, ঠিক হলে আমাকে ফোনে জানাবে। আমি একদিনের জন্য হলেও ঠিক চলে আসবো।
সঠিক সময়েই হাওড়া থেকে ট্রেন ধরল শঙ্খ সেটা দুটোকে নিয়ে। সকালে টিফিন। দুপুরের খাবার। ট্রেনেই বরাদ্দ ছিলো। ট্রেন চলেছে বেশ দ্রুত গতিতে। শুভ্র-অভ্র খুনসুটিতে মেতে। মনের কোনে ডানা ঝাপটায় স্মৃতি। সাজানো-গোছানো বাড়িটা ফাঁকা রেখে চলে যেতে হচ্ছে। জীবনটা কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। স্বাতী কেন যে কোন কনসিডার করতে পারলো না। বড় অবাক লাগে। ভীষণ জেদি মেয়ে। সংসার জীবনে এত জেদি হওয়া কিন্তু ভালো নয়। কোন মেয়ের জন্য। পুরুষ কিছুটা অগোছালো হতেই পারে। সংসারের বাঁধন সব পুরুষের মধ্যে থাকে না। কিন্তু একজন নারীর প্রকৃতি- গুছিয়ে সংসার- জীবন, সন্তান-সন্ততি, লালন-পালন এটাই সহজাত। নারী একটা সংসারের সৌন্দর্য। সবকিছুর সমন্বয় রক্ষাকারী। স্বাতীর মধ্যে তো সমস্ত গুণই ছিলো।বড় নির্লোভ ছিল তার জীবনটা। চাহিদা নিজের জন্য কিছুই ছিলো না। স্বার্থপরতা সহ্য করতে পারতো না কোনদিন আর এখান থেকেই কেমন পাল্টে যাচ্ছিলো মনে হয় তার জীবন সংগ্রাম। উজ্জ্বল মানসিকতা। চাপা একটা ক্ষোভ আস্তে আস্তে বাসা বাধছিল তার অন্তরে। শঙ্খ হয়তো বা অনুভব করতো ঘটনার প্রারম্ভিকতা। তবে তেমন আমল দিতো না। তার চরিত্রগত অভ্যাস অনুযায়ী নিজের ইচ্ছাকে পরিপূর্ণ করাই তার একমাত্র সাধনা ছিলো। জীবনে তার দাদাদের সঙ্গে কোন আপোষ করতে পারেনি। নিজের ইচ্ছা পূরণ আলোয়- অন্ধকারে যেভাবেই হোক করে চলতো। জীবনের লক্ষ্যমাত্রা সঠিকভাবে কোনদিন নির্বাচন করেনি, করতে পারেনি। বস্তুবাদী ভোগের লালসায় বাস্তবকে কেমন অস্বীকার করে চলতো। তাই জীবনে বাস্তব-অবাস্তবের দ্বন্দ্বে জীবনটা কেমন একটা অন্ধকার ছায়া ফেলতে চলেছে। মহীরুহ হতে গিয়েও শাখা-প্রশাখা আজ কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে।
গাছপালা ছাড়িয়ে দ্রুত গতিতে ট্রেন এগিয়ে চলেছে। চোখটা কেমন জুড়ে আসছিল। সকালের খাবার খেয়ে শুভ্র-অভ্র বেশ খুশি খুশি ভাব। হঠাৎ শুভ্রর প্রশ্ন করল বাবাকে, – মা কি কোনদিন আর আসবেনা আমাদের কাছে? কেন বাবা, মায়ের কি হয়েছে গো ?
শঙ্খ কেমন কেঁপে উঠলে প্রশ্ন শুনে, বললে – কেন? এভাবে জিজ্ঞেস করছ কেন? যে কোন সময় চলে আসবে।
অভ্র বললে- সেই কবে থেকেই একই কথা শুনছি! মা ঠিক চলে আসবে। কবে আসবে শুনতে চাইছি।
শঙ্খ একটু মৃদু শাসনের ভঙ্গিতে বললে, – তোমরা পড়াশোনায় থাকো। বাড়ির কথা ভাবতে হবে না। মা তাড়াতাড়ি চলে আসবে। এমন হলে তোমাদের কাছে ঘুরতেও আসতে পারে।
এমন কথায় দুই ভাই মনে হল একটু খুশি হয়েছে। কিছুটা সামাল দিতে পেরে শঙ্খ একটু স্বস্তি পেলো। কিন্তু ঘটনার বেড়াজালে- বনে গিয়েও এখন আর মনের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না শঙ্খ। এমন এক অভিশপ্ত জীবন সে তো কখনোই কামনা করেনি। তার ভাবনায় সে কোনদিন কোন অন্ধকার পথে হাঁটেনি। তাহলে নিজের জীবনটা কেন অন্ধকার হয়ে আসছে। আর শেষ পরিণতি টই বা কি হতে চলেছে। একদিকে শ্বশুরমশাই মেয়েকে ফিরে না পেলে কেস কাবারি করলে, কি সমস্যা হবে ভাবতে পারছে না। আবার কেস কাবারির সমস্যায় চাকরিতে কোন ঝামেলা হতে পারে কিনা সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। কলকাতার আলো ঝলমলে বাড়িতে লোক- প্রাণীর অভাবে অন্ধকার ভূতের বাড়ি হয়ে যাবে। ত্রিশঙ্কু এক কালো আবরণে শঙ্খকে ঘিরে ধরেছে। মাঝে মাঝে দম বন্ধ অবস্থা হচ্ছে তার।
সন্ধ্যা মুখো শিলিগুড়ি পৌঁছালো সকলে। তাড়াতাড়ি স্টেশন থেকে বাইরে এসে একটা গাড়ি ধরে ছেলেদের হোস্টেলে পৌঁছল। অফিস জানালে, কাল সকালে এসে এ্যাডমিশন করে দেবেন।
— আজকে অফিসিয়াল কাজটা হয়ে গেলে খুব ভালো হতো। কাল সকালেই আমাকে অফিস জয়েন করতে হবে। শঙ্খ একটু অনুনয়ের সঙ্গে বললো।
— আজ আর কেউ নেই স্যার। টাকা পয়সার ব্যাপার তো, কে দায়িত্ব নেবে। ভদ্রলোক বললেন।
শঙ্খ বললে – সকাল মানে তো সেই দশটা সাড়ে দশটা।
— মোটামুটি ঐরকমই। আপনি আসুন না। প্রথমেই আপনারটা ব্যবস্থা করে দেব। ভদ্রলোক আশ্বাস দিলেন।
অগত্যা বাইরে এসে কাছাকাছি একটা হোটেলে রাত্রিবাসের জন্য ব্যবস্থা করলে শঙ্খ। বাইরে থেকেই চা খেয়ে রুমে ঢুকলো। জামা-কাপড় ছেড়ে একটু তিতু হয়ে বিছানায় বসে একটা সিগারেট ধরালো। আগামীকালের কাজের ছবিটা মনে মনে ছক করে নিলে। সকাল সকাল উঠে রেডি হয়ে ব্রেকফাস্ট। স্কুলে পৌঁছাতে হবে। স্কুলের কাজ সেরে কাগজপত্র ছেলেদের কাছে রেখে বের হতে হতে প্রায় দুপুর। স্কুল থেকে বের হয়ে সোজা বাস টার্মিনাস। দুপুরে খাবার খেয়ে কোচবিহারের বাসে চেপে বসা। হঠাৎ কেমন যেন একটা দীর্ঘশ্বাস পড়লো শঙ্খের।
পর্ব – ২৩
আসমা বেগম চর্চিত একটা নাম। বস্তির গুমটির চায়ের দোকানে সকাল থেকেই উচ্চারিত হচ্ছে। কে যেন বলেছিল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্ট হচ্ছে চায়ের দোকান। যতক্ষণ খোলা থাকে সমস্ত ব্যাপারে আলোচনা চলে এখানে।
— সেই তো বিয়ে হলো, তাহলে এত ধানাই পানাই করে কি লাভ হয়েছে। কে একজন কথাটা উচ্চারণ করলো।
— খাবার আগে একটু চেখে দেখা হচ্ছিল ভাই। ভালো না মন্দ। মাতাল রিয়াজের টিপ্পনী কাটা জবাব।
ফোঁস করে উঠলো মির্জা হাসান, – মুখের ভাষা ঠিক করো। যা মুখে আসে তাই বলে দেবে। তাহলে কিন্তু ধোলাই খাবে।
গুমটির ভিতর থেকে কাশেম বললে,- ভুলটা কি এমন বলেছে?
হাসানের ছোট ভাই মাসুম বসেছিল গুমটির ভিতরে। হয়তো বা কাশেমের পাশেই। হঠাৎই তার জামার কলার ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। রিয়াজ ঠিক কথা বলেছে ? বলেই দুই থাপ্পড় কথায় কাশেমের চোয়ালে।
রিয়াজ বললে, – এটা কি হলো ?
কাশেমকে ছেড়ে রিয়াজের গালেও ঘা-দুই কষিয়ে দিলে মাসুম।
মুহূর্তে উত্তপ্ত হয়ে উঠল পরিবেশ। বস্তির চালচিত্র বড়ই অস্থিরতাপূর্ণ। সামান্য তিল থেকে তাল হয়ে ওঠা, এটাই এখানকার চরিত্র। কাজের মানুষগুলো সকাল- সকাল বেরিয়ে যায়। রুটি- রুজির টানে। অকাজের মানুষজন বিভিন্ন চর্চায় দিন কাটায়। পরের কথায় মাথা দিয়ে নিজেরা ঝগড়া করে। চেঁচামেচির মধ্যেই গলা উঁচিয়ে মির্জা হাসান বললে, – আরশাদের চরিত্র খারাপ। নেশা- ভাং খায়। এমন কথা কারো জানা আছে ? যেদিন রাত্রে আরশাদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। বস্তির সব লোক কেন সেদিন থানার মাঠে জড়ো হয়েছিল। মনে নেই।
বৃদ্ধ দরবেশ চাচা বললে, – সব ঠিক আছে বাবু । তবে মানুষের পা হড়কাতে সময় লাগে না কিন্তু!
মির্জা হাসান বললে, – সকলের পা হড়কায় না চাচা। যার হড়কায় সে এসে বলে যাবে না। কখনো বস্তির ঘরে- ঘরে উঁকি দিয়ে দেখলে বুঝবে । কতো মেয়ে হেল্পারের ঘরে, রাত কাটিয়ে যাচ্ছে মিস্ত্রি। না হলে নাকি কাজ পাবে না। কেউ খবর রেখেছো কোনদিন। একটা ঘটনা সামনে এলে সস্তায় কিস্তিমাত করতে অনেকেই পারে।
মাসুম বললে, – অকর্মের ঢেঁকি গুলো কাজকামের ধান্দা নেই। সকাল থেকে চা গুমটিতে বসে যতসব গেল্লাগুজুল্লি, নোংরা ঘাটা অভ্যাস হয়ে গেছে। এমন কথা কানে এলেই, আচ্ছা করে পেটাই দেবো।
হই চই করার ইচ্ছা থাকলেও কেমন যেন সব গুম খেয়ে গেল। সারাদিনের চর্চার বিষয়টা মনে হচ্ছে আলোচ্য সূচি থেকে বাদ চলে যেতে বসলো।
সকালের প্রাত্যহিক কাজে রিজিয়ার সঙ্গে হাত লাগায় আসমা। দিদি বলেই সম্বোধন করে তাকে রিজিয়া। সকালের নাস্তা হলে- খেয়ে টিফিন ক্যারিয়ারে দুপুরের খাবার নিয়ে বের হয় আরশাদ। ছেলেমেয়েকে নিয়ে এরা দুজন খাবার পর আন্টির কাছে পড়তে বসে ছেলে-মেয়ে। এই আন্টি ডাক রাখতে চায় তাহলে ছেলেদের জন্য দুজনেই। বস্তির পড়শী শুধু চারজন বেলা হলে দেখতে আসে রিজিয়ার সতীনকে। কেউ- কেউ টেরা মন্তব্য করতেও ছাড়ে না ।
— উপকারের ফল পেলি তো রিজিয়া। আরশাদ ভাই উপকার করে তবু বউ পেলো। তোর বাড়া ভাতে যেন ছাই না পড়ে দেখিস।
— কথায় বলে না এক রামে রক্ষে নেই, তায় আবার সুগ্ৰীব দোষর।
রিজিয়া চুপচাপ শুনছিল কথাগুলো। নতুন মানুষটার কানে কথা গেলেও অসহায় পাবে উদাস হয়েছিলো।
এবার রিজিয়া বললে, – আগুনে ঘি ঢালতে এসেছো তো তোমরা ? আমাদের সংসারে অভাব এলে তোমাদের কিছু দিতে হয়েছে কোনদিন ?
প্রথমজন বললে, – বেশ চ্যাটাম-চ্যাটাম কথা হয়েছে তো তোর। ভালো কথা বলতে এলুম! তোর কাছে উল্টো হলো ।
রিজিয়া বললে, – এমন ভালো কথার দরকার নেই । আমাদের সংসারে আমরা যেমন আছি বেশ আছি গো ।
দ্বিতীয় একজন বললে, – ঠেকায় না পড়লে বিড়াল গাছে ওঠে না। যখন সময়ে ঠেকায় পড়বি তখন দেখবো কেমন থাকিস। এমন কথার জবাব তখন পাবি।
রিজিয়া বললে, – নসিব ছাড়া মানুষের কোন গতি নেই। কপালে যা আছে- তা হবেই। ভালো থাকলে ভালো হবে, মন্দ থাকলে মন্দ হবে। আগেভাগে এত কিছু চিন্তা করে লাভ নেই। যে যার কপাল নিয়ে ভাবো এখন।
কিছুটা ধাক্কা খেয়ে মেয়েগুলো রাগে গজগজ করতে-করতে ঝুপড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
রিকশা স্ট্যান্ডের লাইনে গাড়িটা লাগায় আরশাদ। মানসিক বিপর্যয় যেমন নয় আবার আত্মতৃপ্তি তেমন কিছুই নেই মনের মধ্যে। হাসিখুশি ভাব যেমন নেই- তেমনি হতাশায় বিষন্নও নয় মোটেই।
— কি গো, আরশাদ ভাই। মিষ্টি খাওয়াতে হবে তো? এমনি এমনি ছেড়ে দেবো না কিন্তু। লাইনের এক রিক্সাওয়ালা বললে আরশাদকে।
— মিষ্টি এমনিতেই খাওয়া হতেই পারে।তবে যে জন্য বলতে চাচ্ছো, সেটা কিন্তু বিয়ে করার জন্য করিনি ভাই। শুধুই মানুষটাকে বাঁচানোর জন্য করেছি। একটু আহত মনে কথাগুলো বললে আরশাদ।
— না গো, আরশাদ ভাই। আমি মজা করে বললাম তোমাকে। কতো বছর একসঙ্গে রয়েছি কাজের ক্ষেত্রে। তোমাকে আমরা চিনি না।
— সেটা ঠিক কথা ভাই। তবে সবকিছু জেনেও আমার প্রতিবেশী কতো মানুষ । কেমন অপমান করে কথা বলে। বড কষ্ট হয় তখন। একটু অসহায় বোধ করে আরশাদ।
ছেলেটা একটুও বা মর্মাহত। মনে মনে ভাবে, এভাবে কথাটা না বললেই ভালো হতো। আরশাদ দা দোষ নিও না। তোমার মতোজন আমাদের সঙ্গে আছো, এটা আমাদের গর্ব। কিছু মানুষের দোষ খোঁজা একটা স্বভাব। সে ভালো মন্দ বোঝে না। দেখেও না। নিন্দা করে কথা বলা তাদের অভ্যাস।
আরশাদ বললে, – কষ্ট লাগে সেখানেই ভাই। সবকিছু জেনেও যারা মিথ্যে দোষারোপ করে। তারা কি পায় বলো ? অন্য মানুষকে হেয় করলে তাদের কি লাভ হবে তাতে।
ছেলেটা বললে, – যাদের কোন কাজ থাকে না। ঘরে থাকলে বউয়ের গালাগাল শুনতে হয়। তারাই বাইরে চায়ের দোকানে- রাস্তাঘাটে পরনিন্দা করে দিন কাটায়।
আরশাদ বললে, – একদম ঠিক বলেছ ভাই। বাস্তব সত্য কথা বলেছ।
এর মাঝেই ট্রেন এলো সকালের। প্যাসেঞ্জার উঠলো রিক্সাগুলোয়। শুরু হলো দিনের কর্মব্যস্ততা। এমনভাবে যাতায়াতে দুপুর হয় আরশাদের। বাড়ি থেকে আনা টিফিন খায়। একটু বিশ্রাম করে। আবারও যাতায়াত শুরু হয়। কষ্ট হলেও রোজগার করতে হবে। বউ-বাচ্চার খাওয়া পরার যেনো অভাব না থাকে। এমন চিন্তাভাবনার মানুষ আরশাদ বরাবরই। চুপচাপ ঘরে বসে সময় কাটায়নি কোনদিন। নেশা ভাং। বধ সঙ্গী। এসব থেকে সব সময় দূরত্ব রেখে চলতো সে ।এক কথায় আজাদ কলোনির বস্তিতে আরশাদের একটা ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলো। এখনো আছে। কথায় বলে যে যেমন- তার জোটে ও তেমন। রিজিয়া আরশাদের সার্থক জুটি। স্বামীর মঙ্গল কামনায় এমন স্ত্রীর ভূমিকা ঈশ্বরপ্রদত্ত। স্বামীর গরবে গরবিনী। স্বামীর সেবায় নিয়োজিত প্রাণ। স্বামী সঙ্গ তার জীবনের একমাত্র সুখ।
আসলে রিজিয়া দুঃখকে জয় করতে শিখেছে সেই ছোট্ট থেকেই। আজও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে জীবনে। যাদের জীবনে চাওয়াটা নিতান্তই কম, পাওয়াটা ছোট্ট হলেও কম মনে হয় না। আজ পাকেচক্রে দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়েছে তার স্বামীকে। একপ্রকার বাধ্য হয়ে। তাতে কোন বিরোধীতা নেই রিজিয়ার। সে ভাবতো, যে মেয়েটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জীবন বিপন্ন করে ছুটে আসতে পারে শুধুমাত্র তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য। তার জীবন বাঁচানোর দায়িত্ব আমাদের থাকা উচিত। যে মেয়েটা বারবার চলে যেতে চেয়েছে, কিন্তু অজানা ঠিকানায়। এমন একটা মেয়েকে একা ওভাবে চলে যেতে দেওয়া কি যায় ? এ সংসারে থেকে ও তার কোন চাহিদা নেই। দুমুঠো খাওয়া পেতে এমন লেখাপড়া জানা শহরের মেয়ে, কতটা অসহায় হয়েছে বলেই তো থেকে যেতে হলো। কিছু মানুষের চাপে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে থাকার জন্যই শুধু বিয়েতে বাধ্য হলো।
বারবার বলেছে আসমা রিজিয়াকে। আমি তোমার স্বামীর ভাগ চাই না। চাইবো না কোনদিন। আশ্রয়টুকুই আমার কাছে অনেক। ছেলে- মেয়েকে শুধু কেড়ে নিও না ।ওদের মানুষ করার দায়িত্বটা আমারই থাক। রিজিয়ার চোখের কোন চিকচিক করছিলো অশ্রু ফোঁটায়। কোনভাবে সামলে ছিলো তখন। মনে মনে বলেছিল, – হে খোদা, এমন একটা ফুলের মতো জীবনকে তুমি একটু সাহারা দিলে না। মেয়েদের জীবনে স্বামী- বাচ্চা- সংসার আর কি বা চাই। সেটা তুমি দিয়েও এভাবে নিঃস্ব করে দিলে। সেই মানুষটাকে একটু সিধা করে দিলে তাহলে এত কষ্ট পেতে হতো না নিরীহ মেয়েটাকে। রোজকার মতোই সন্ধ্যা মুখে আরশাদ ফিরলে বস্তির বাড়িতে। কলতলায় গিয়ে স্নান সারলো। চা-জল খাবার খেয়ে বসে রইলো। ছেলে- মেয়ে পড়ায় ব্যস্ত আন্টির কাছে। নিত্যদিনের রুটিন মতোই চলতে থাকলো।
পর্ব – ২৪
সকালের ডিউটিতে জয়েন করেছে শঙ্খ। বদলির খাঁড়া থেকে রেহাই পেয়েছে এ যাত্রা। তবুও ক্রমশ সে একটা অসহিষ্ণুতায় ভুগতে থাকছে দিনের পর দিন। মাথার উপর একটা অদৃশ্য খড়্গ ক্রমাগত ঝুলছে। যেটা দিনের পর দিন এক জটিলতায় পরিপূর্ণ হচ্ছে। শেষ কোথায় শঙ্খ সে হিসেবে মেলাতে পারছে না। কথায় বলে, তিল থেকে তাল হয়ে যায়। শঙ্খ কোনদিন এসব প্রবাদ কথাকে আমল দিত না। কিন্তু প্রবাদ কথার একটা সারবত্তা থাকে। এমনি এমনি একটা কথার জন্ম হয় না। বিশেষভাবে এর সত্যতা যাচাই করে তবে শব্দগুলো প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আজ যখন অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে ফেলেছে সমস্যাখানা। একটু হলেও টাল খেয়েছে বিশ্বাসের স্তম্ভ। বিষবৃক্ষের ডাল- পাতা বেশ বড় আকার নিয়েছে। অনেকটা জায়গা জুড়েছে মনের সীমানা ছাড়িয়ে। একটা অশনি সংকেত দেখা দিচ্ছে বারে বারে মনের দরজায়, আর তার থেকেই শঙ্খ একটু একটু করে অস্থিরতায় ক্রমশ দুর্বল হতে থাকছে। মনের কোনে একটা প্রশ্ন চিহ্ন তৈরি হচ্ছে ক্রমশ।
উৎস থেকে মোহানা পর্যন্ত নদীর গতিপথ পরিবর্তন হতেই থাকে। চড়াই- উতরাই। মাটি- পাথর। নরম মাটি- শক্ত মাটি। বহু ঘাত- প্রতিঘাতে একটু একটু এগিয়ে যায়। ঢালু পথে খরস্রোতা। সমতলে মন্থর। ঠিক যেন শঙ্খর জীবনের মতোই। শুরু থেকে তরতরিয়ে এগিয়েছে গতি মন্থরতায় ভোগেনি কখনো। বাধা পথ অতিক্রম করেছে প্রবল খরস্রোতে, অথচ আজ জীবনটা এমন এক সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। ঠিক মোহানার মুখোমুখি। তবে সাগরে মেশা তার এ জীবনে হবে কিনা সে ভেবে পাচ্ছে না। সুর- তাল- লয়, কেমন ভিন্ন পথে গমন করছে মনে হচ্ছে তার। চাতক পাখিটার মতো মেঘ হোক- মেঘ হোক, ডাক সারা আকাশ জুড়ে। একটু বৃষ্টির জন্য। হয়তো সব সময় এমন প্রার্থনার ডাক নয়। কিছুটা চাওয়া পাওয়ার জন্য। আবার কিছুটা চাওয়া চিরাচরিত অভ্যাসের জন্য ই। মানুষ অভ্যাসের দাস।
দিন রাতের রোজনামচায় শঙ্খের সময় অতিবাহিত হয়। সময়ের কষাঘাতে মনের সুপ্ত ভাবনাগুলো কখনো ভেঙে চুর চুর হয়। কখনো মনের আঙ্গিনা জুড়ে ভয়-ভীতির একটা অন্ধকার নিকষ কালো গলিপথে আটকে যায়। দুটো পা এগোতে পারে না যেমন পিছতে পারেনা এক পা। নিদারুণ অস্থিরতায় কেঁপে ওঠে কখনো- কখনো। ঘুমের মাঝে সারা শরীর ঘেমে চান করার মতো হয়ে যায়। বিছানায় বসে জোরে পাখা চালিয়ে হাওয়া নেয় সারা শরীরে। অক্টোপাসের মতো ঘিরে ধরতে থাকে সমস্যার তীরগুলো। মেজদার আঙুল উঁচানো শব্দগুলো, – ঘরের মানুষটাকে মানুষের মতো দেখেছিস ? তাকে তো যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছিস। জন্তুর মতো দিনের পর দিন শাসন-শোষণ করেছিস। মানুষের মতো তার জীবনে স্বাধীনতা থাকলে, সংসার ছেড়ে কেউ একা- একা, এমনি- এমনি চলে যায় না। যেতে চায়না।
শ্বশুরমশাইয়ের বেশ উত্তেজিত কন্ঠস্বর, – তুমি ভাবছো ও তোমার সংসারে না এলেও তোমার চলে যাবে। কিন্তু ওই মেয়েটা আমার একমাত্র মেয়ে। আমার ওকে চাই। তোমাকে পনেরো দিন সময় দিলাম। ওকে আমার কাছে ফিরিয়ে এনে দাও। না হলে এর প্রতিফল কি হবে তুমি ভাবতে পারবে না। তোমার লাইফ হেল হয়ে যাবে। চিরকালের জন্য জেলের গরাদে জীবন কাটবে বলে দিলাম।
ট্রেনে বসে শুভ্র বলেছিল, – মা কি আর কোনদিন আসবে না আমাদের কাছে? কেন বাবা- মায়ের কি হয়েছে গো ?
অভ্র বলেছিল, – সেই কতদিন একই কথা শুনে আসছি! চলে আসবে- চলে আসবে। সেই দিনটা কবে গো ?
একটু তরল পানীয় গলায় ঢালে শঙ্খ রাতের বিভীষিকা ভোলার মানসিকতায়। একটা সিগারেট জ্বালিয়ে পরপর কয়েকটা টানে বেশ বুঁদ হয়ে বসে থাকে অনেকটা সময়। ব্যারাকের বাইরের রাস্তায় ক’টা কুকুর ঘেউ ঘেউ শব্দে ডেকে চলেছে কিছুটা সময়। ভারী গাড়ি যাওয়ার বেশ গম্ভীর শব্দ পরপর কয়েকটা। আবারো শুয়ে পড়ে বিছানায় ঘুমিয়েও পড়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে।
সকালের ডিউটিতে মগ্ন শঙ্খ। সহকর্মী বন্ধুদের সঙ্গে ঠাট্টা- তামাশয় সময়ের কবলে রাতের অন্ধকার দিকটা মুছে যায়। প্রাণের মৃত্যু সহজে হয়, সাধারণ মানবিক ঘটনা প্রবাহে সহজে মেনে নিতেই হয়। কিন্তু সম্পর্কের মৃত্যুর সহজে হলেও মন সহজে মেনে নেয় না। মনের ধর্ম এমনটাই। ইচ্ছে করে মুছে ফেলা যায় না। তবে যে সম্পর্কের মৃত্যু ঘটে, দীর্ঘ বঞ্চনা- অবমাননা অভব্য ব্যবহারের কারণে। যে সম্পর্কের শুরুতেই মনের মৃত্যু ঘটে। সামাজিকতার সৌজন্যে জীবিত থাকে মান্যতাটুকু। বেঁচে থাকার স্বার্থেই বাঁচিয়ে রাখতে হয় সম্পর্কটাকে। জোড়া দিয়ে রাখা সময়ের তালে- তাল মিলিয়ে রাখতে হয়।
দিনরাত সময়ের টানে টিকটিক ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে এগিয়ে যায়। পরিবর্তনের স্রোতে শুরু থেকে বছর শেষ হয়ে আসে। সবকিছুর বয়স বাড়ে প্রকৃতির নিয়মে। সন্ধ্যার আকাশটা আজ কেমন মোহাচ্ছন্ন। আকাশে ছড়িয়ে থাকা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। গোধূলি রঙে যেন পটে আঁকা কোন অদৃশ্য শিল্পীর অসাধারণ একটা ছবি। রংয়ের কারুকার্যে চোখ আটকে থাকে। মন ভালো করে একটু সময়ের জন্য। বেশ কটা দিন হয়ে গেল সন্ধ্যা থেকেই মদের মাত্রাটা একটু বেড়েছে শঙ্খর। নেশার মোহে সবকিছু ভুলে থাকতে চায় এখন। ডিনার শেষে একটু পায়চারি করে। সিগারেট টানে। মনটাকে একটা সুতোয় বেঁধে রাখতে চায়। অনিষ্ঠ আশঙ্কাই মনের ধর্ম। চেপে রাখা যায় না। ঘুণ পোকার মতো কুরে কুরে মনের থেকে বার করে সবকিছু। ভুলতে দেয় না। মাকড়সার জালের মতো ঘিরে ফেলা সমস্যা মনের কোণে লুকিয়ে রাখা যায়! বিছানায় একটু আয়েশ করে বসলে শঙ্খ। টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে উঠলো। উঠে গিয়ে রিসিভার কানে রেখে বললে, – হ্যালো।
— হ্যালো, রথীনদা বলছি, শঙ্খ বলছিস তো ?
— হ্যাঁ, রথীনদা। কি খবর বলো।
— দিন কয়েক আগে একজন এসেছিল বুঝলি। বাঙালি লোক। পুনেতে চাকরি করে। কলকাতায় বদলি হয়েছে। কলকাতার অফিসে এসে কার কাছে খোঁজ পেয়ে দেখা করে গেল। রথীনদা বললে।
— কি কথা হলো? উৎসুক শঙ্খ।
— সামনের মাসে দু তারিখে জয়েন করবে। কটা দিন একা অফিস গেস্ট হাউসে থাকবে। এখানে সেটেল হলে। পুনে থেকে মালপত্র নিয়ে বাড়ির লোকেরা চলে আসবে। রথীনদা জানান দিলো।
— তাহলে, আমাকে কবে নাগাদ যেতে হবে ? শঙ্খ জানতে চায়।
— ভদ্রলোক জয়েন করে আমার কাছে আসবে। ঠিকঠাক কথা হলে তোকে জানাবো। কবে আসবে ।বাকি কাজ তোর। আমি যোগাযোগ করে দেব। রথীনদার কথা।
— এভাবে বলো না রথীনদা। কথার সময় তোমাকে সামনে রেখেই বলা হবে। উকিল দিয়ে চুক্তিপত্র তো করতে হবে। তুমি না থাকলে হয়।
— ঠিক আছে সময় হলে দেখা যাবে।
ফোন রেখে আবার বিছানায় এসে বসলো শঙ্খ। হঠাৎ ভাবনাটা কিছুটা টাল খেলো তার। বাড়ি ভাড়া দিয়ে রাখলে পয়সা আসবে ঠিকই। এমনিতে স্বাতীকে নিয়ে ক্রমশ শ্বশুর মশাই- মেজদার কাছে ব্যাক ফুটে চলে যাচ্ছে সে। তাদেরকে না জানিয়েই সিদ্ধান্ত নেয়াটা কি একটু বেশি রিস্ক হয়ে যাবে না। শ্বশুর- শাশুড়ি মেয়ের বাড়ি রক্ষা করতে গ্রামের বাড়ি অন্যের ভরসায় রেখে চলে আসে। এখন না জানিয়ে এমন একটা কাজ করলে। মরার উপর খাঁড়ার ঘা পড়তেই পারে। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে শঙ্খর। আবারও একটা সিগারেট মুখে লাইটার জ্বালায়। একটা সুখ টানে মনটাকে ভিজিয়ে নেয়।
পর্ব – ২৫
প্রকৃতি আর প্রকৃত দুটিই সত্য। একটা দৃশ্যত। অপরটি দৃষ্টির বাইরে। মনের মাধুরী। দুটো শব্দের সঙ্গেই সত্যেন বাবুর আত্মিক যোগ। চাষ-আবাদে সবুজ দিগন্ত। মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহ। প্রকৃতির রূপ মনকে তরতাজা করে দেয়। মাথার উপর নীল আকাশ। নকশা কাটা সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। নিচে যতদূর চোখ যায় সবুজ গাছ- গাছালি, যৌবনপ্রাপ্ত ধানের গাছ। এমন দৃশ্যের মুখোমুখি হয়ে মনটা কেমন সতেজ হয়ে ওঠে।
কিছুদিন যাবত সত্যেন বাবু এত সব কিছুর মাঝেও যেন হতাশায় ঝলসে যাচ্ছে রোদে পোড়া গাছের মতো। একমাত্র মেয়ে স্বাতীর জীবন যে বিপন্ন অবস্থায়। জীবিত না মৃত জানে না সে। মানুষের জীবন যে এভাবে দুর্বিষহ হয়ে যেতে পারে কল্পনার অতীত। সুন্দর মনের সহজ- সরল মেয়েটা লোভাতুর একটা মানুষের জন্য, কেমন যেন হারিয়ে গেলো। অথচ মেয়েটার সুখী জীবন গড়ে তোলার জন্য, কতো অন্যায় আবদার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছে তাকে।
— আচ্ছা মাস্টার, তোমাকে এদানিং দেখি কি যেন ভাবো সব সময় ? কাজে কি ভাবে ভুল হয়েছে গো আমার ? আসগারের জিজ্ঞাসা।
— আরে না- না। তোর কাজে ভুল ধরার কি আছে। মনটা খারাপ অন্য কারণে।
— সেই তো কলকাতা থেকে ফিরে আসার পর থেকেই দেখছি। কেমন যেন আনমনা হয়ে থাকো। তাই বললাম আর কি। আশঙ্কার কথা জানালে আসগার।
— হুম, তোর আশঙ্কা মিথ্যে নয় । মেয়েটার জন্য একটু চিন্তায় আছি। মাস্টারের ছোট্ট জবাব।
— কেন গো, মামুনির শরীল খারাপ ? প্রশ্ন আসগারের।
— হ্যাঁ, সেই রকমই। তুই নিড়ানীটা একটু দেখে যাস। আমি চললাম।
জমির আলপথ ধরে রাস্তায় উঠলো সত্যেন মাস্টার। গুটিগুটি পায়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলে। পথে দুই এক জনের সঙ্গে দেখায় সৌজন্য বিনিময়। দু এক মিনিট সাধারণ কথা বার্তা। গ্রামীণ একটা ধারাবাহিকতা। মাথার উপর সূর্যটা তখন হেলেছে একটু। বাড়ি ফিরে চান খাওয়া সেরে ভাত ঘুমের লক্ষ্যে বিছানায় জায়গা নিলে মাস্টার। গত কিছুদিন হয়ে গেল সত্যেন বাবু শঙ্খের মেজদার সঙ্গে একটু কথা বলার ইচ্ছে করেছিলো। সময় অভাবে করে উঠতে পারছিলো না। আজ সন্ধ্যা মুখো চা খেয়ে একটু রাস্তায় বের হলো। মোড়ের দোকানের ফোন থেকে কথা বলার উদ্দেশ্যে। নাম্বার মিলিয়ে বাড়ির ফোনটায় কল দিলে। শঙ্খর মেজদা রিসিভার তুলে কানে দিলেন।
— হ্যালো, কে বলছেন ?
— মেজ বাবু, আমি শঙ্খর শ্বশুর- মশাই বলছি।
— আরে! মেসোমশাই, কেমন আছেন ? বাড়ির সব খবর ভালো তো?
— হ্যাঁ বাবা, সকলেই ভালো আছি। তোমাদের বাড়ির সকলে কুশলে আছে তো ? কদিন টা ভাবছিলাম একটু কথা বলবো। চাষ বসেছে। তেমন আর সময় করতে পারছিলাম না।
— তা বলুন মেশোমশাই, কি খবর?
— বলছিলাম বাবু। এখনো তো কোনো কিছু খবর পাচ্ছি না। আমার মেয়েটার কি কোন হদিশ পাবো না? আমি কিন্তু বাবু ভীষণ অস্থির হয়ে পড়েছি। ভাবছি আমাদের লোকাল থানায় শঙ্খের নামে একটা ডায়েরি করে রাখবো। আমার মেয়ের জীবন সংশয়ের জন্য। সত্যেন বাবু আবেগের বশে কথাগুলো বলে ফেললেন।
শঙ্খের মেজদা একটু কেমন যেন নড়ে উঠলেন। অনিষ্ঠ আশঙ্কা ঘুরপাক খেলে তার মনের মধ্যে। যদি এমন কিছু হয়েই থাকে। তাহলে তো শঙ্খের জীবনে একটা দুর্যোগ ঘনিয়ে আসতে চলেছে। ছেলেটা নিজের চাহিদা নিজের ইচ্ছা পূরণের লক্ষ্যে, নীতি- দুর্নীতির তফাৎ করতে পারলো না। অশ্বমেধের ঘোড়ার মতো শুধুই ছুটতে শিখেছে। থামতে শিখলো না। থামতে হয় শেখার চেষ্টাই করলো না। আজ যদি জীবনের চরম সময় সামনে এসে দাঁড়ায়। পাশ কাটিয়ে ফেরার কোন রাস্তা সামনে আসবে কিনা জানি না।
— মেসোমশাই, আপনি একটু সময় দিন আমাকে। আমি একটু কথা বলি ওর সঙ্গে। তারপর একটা সিদ্ধান্তে আসা যাবে। আপনার আশঙ্কা বা আপনার করণীয় ভাবনার সঙ্গে আমি একশো ভাগ একমত। আমার মেয়ের জন্য হলে আমিও হয়তো তাই ভাবতাম।
— আমি এই মুহূর্তে বড় অসহায় মেজ বাবু। কিছু ভাবতে পারছি না। কি করবো- কিভাবে ভাববো। ঠিক আছে, তোমার কথা মতো আরো কটা দিন দেখি। তুমি একটু ব্যবস্থা করো। গলাটা কেমন ধরে এলো সত্যেন বাবুর।
ফোন কলের পয়সা মিটিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে এলো। সামনা-সামনি দেখা হওয়া ক’জনার সঙ্গে কুশল বিনিময় হলো। নাতনির জন্য বিস্কুট টুকটাক ক’টা জিনিস কিনে বাড়ির পথ ধরলো সত্যেন বাবু।
রাতের খাবার শেষে ব্যারাকের ভিতরে একটু পায়চারি করলো শঙ্খ। এটা ওর রোজকার অভ্যাস। সন্ধ্যা নাগাদ আজ এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে। চারিদিক একটা নিঝুম পরিবেশ। আকাশটা এই মুহূর্তে বেশ পরিষ্কার। দূর পর্যন্ত তাকালে তারার ঝিকিমিকি নজরে আসে। লুকিয়ে- চুরিয়ে কোথায় কয়েকটা ঝিঁঝিঁ পোকা একটানা ডেকে চলেছে। রাস্তায় মাঝে- মধ্যে ভারী গাড়ি যাওয়ার শব্দ। আস্তে- আস্তে নিজের রুমে ঢুকলো শঙ্খ। জামা খুলে পাখা চালিয়ে বিছানায় বসলে। সিগারেটের প্যাকেট খুলে মুখে দিয়ে লাইটারের আগুনে জ্বলন্ত ধূমপানে মনটাকে এক সূত্রে বেঁধে নিল যেন। তৃপ্তিতে চোখ বুজলো এক মনে। বেশ কটা দিন পর হঠাৎ আজ টেলিফোনটা ক্রিং… ক্রিং.. শব্দ বেজে উঠলো। উঠে গিয়ে রিসিভার তুলে বললে, — হ্যালো, কে শঙ্খনীল বলছি । ওহ্ মেজদা, কেমন আছো তোমরা? বাড়ির সকলের খবর ভালো তো?
— হ্যাঁরে, আমাদের বাড়ির খবর সব ভালো। তোর কি খবর ? ছেলেদের সঙ্গে যোগাযোগ করিস মাঝে মাঝে, পড়াশোনা কেমন চলছে ওদের ?
— অফিসে মাঝে-মধ্যে ফোন করি। ঠিকই আছে।
— তোর শ্বশুর মশাই কদিন আগে ফোন করেছিলো। বৌমার কোন খবর পেয়েছিস ? না ভুলে গেছিস ? সে তো থানায় অভিযোগ জানাতে চায়। তুই তার মেয়েকে মেরে লাশ গুম করে দিয়েছিস। ক্ষোভ প্রকাশ করলো যেন মেজদা।
— কি যে বলো মেজদা ! সেটা কি সম্ভব ? উনার মাথায় এমন ভাবনা আসার মানে কি হলো ? ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের একসঙ্গে থাকা। মেরে দিলাম, ছেলে- মেয়ে দেখতে পেল না ? বাড়ি থেকে সকালে বেরিয়ে গেছে, ওরা তো জানে। কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে শঙ্খ।
— আরে সে তো খুনের আসামি নয়, যে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে আছে। আত্মগোপন করে আছে বছর পার হয়ে গেলো। খোঁজার চেষ্টা নেই কেন ? লোকাল থানায় ডায়েরি করে বসে থাকলে হবে? লালবাজার যেতে হবে, এস পি , এস ডি ও লেভেল এ যোগাযোগ করতে হবে। বেশ অভিযোগের সঙ্গে বললো মেজদা।
— আমার সীমিত সময়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব আমি তো করছি- করেছি তো। কলকাতায় থাকতে কয়েকবার থানায় গেছি। কিছু জায়গায় খোঁজ খবরও নিয়েছি। এখন সে যদি আত্মগোপন করে থাকে, তাহলে তো মুশকিল। কিছুটা সাফাই গাইলো শঙ্খ।
— তাহলে তুমি এখন কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছ? আর খোঁজ পাবেনা? অতএব কষ্ট করে খোঁজার দরকার নেই ?পরিণতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে তোমার উপলব্ধি আছে ? ভেবেছ একটু ? নোংরামির শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছো তুমি। তোমার বাস্তব জীবন যে পর্যায়ে এসে থামতে চলেছে। কল্পনা করতে পারছ না। তোমার শ্বশুর মশাই যদি তোমার বিরুদ্ধে মেয়েকে খুনের কেস করে থাকে। কেউ তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তোমার চাকরি, টাকা- পয়সা, মান- সম্মান সব ধুলোয় লুটিয়ে যাবে। বাকি জীবন। সন্তানদের ভবিষ্যৎ। মেয়েটার কথা ছেড়েই দিলাম, সে না হয় দিদিমার ভরসায় থাকবে। কি করবে তখন? মেজদার গলা ধরে এলো ক্রমশ।
স্তম্ভিত শঙ্খ কিছুটা সময়ের জন্য। ভয়ের আবহে শরীরটা যেন কেঁপে উঠল মনে হয়। সত্যিই কি ক্রমশ অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে। শেষ কোথায় হতে পারে আগে কোনদিন ভাবেনি। তাছাড়া মান- অভিমানের তো একটা সময় পর্যন্ত থমকে থাকে অনেকে। থেকে যায়। মনের চরম অবস্থায় তারপর আস্তে- আস্তে থিতিয়ে যায়। গ্লাসে থাকা ময়লা জলের মতোই । তখন আবার ফিরে আসে সাময়িক বিরতির পর। জীবনের অভিমানের পালা চুকিয়ে শুরু হয় বাকি থাকা অধ্যায়ের।
— মেজদা, আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তোমরা যেভাবে ভাবছো। কেন এভাবে ভাবছো। আমি জানি না।
— আরে, শোন শোন। আমরা ভাবছি না। তোর শ্বশুর মশাই ভেবেছেন- তিনি আমাকেও ভাবাচ্ছেন। তবে ভাবনাটা কি ভুল বলে মনে হয় তোর ?
— না, না- মেজদা। একেবারে ভুল ! আমাকে এভাবে ভাবা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। এতো নিষ্ঠুর আমি নই। কিছুক্ষণ বাকরুদ্ধ, হতাশ শঙ্খ। কথা বলার শক্তি যেন কেউ কেড়ে নিলে মনে হচ্ছে তার।
— ঠিক আছে, কে ভুল- কে ঠিক, আমি বলে দিলেই তো হবে না। তুমি সরাসরি তোমার শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে কথা বলো। তার বক্তব্য শোনো। সমাধান করো। তা না করে, তুমি তো একরকম এড়িয়ে- এক কথায় পালিয়ে বেড়াচ্ছ। কেন, মানুষটার প্রতি তোমার নিজস্ব দায়িত্ব নেই ? সে কি বানের জলে ভেসে এসেছিলো?
— মেজদা, তোমরা যেভাবে রিঅ্যাক্ট করছো। মনে হচ্ছে আমি তাকে মেরে দিয়েছি বা তাড়িয়ে দিয়েছি। আর ফেরাতে চাচ্ছি না। সত্যি বলছি, এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যে বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হয়েছে। আগের দিন বাপের বাড়ি থেকে না ফেরার জন্য একটু রাগারাগি করেছিলাম। ও চিরটাকাল যেমন মুখোমুখি তর্ক করে করেছিলো। বারবার বারণ করা সত্ত্বেও যেভাবে অসংলগ্ন ভাষা ব্যবহার করছিলো। তাতে আমি রাগে দুঘা চড় মেরে দিয়েছিলাম। সেটা রাতের ঘটনা। তারপর যেমন রোজের মতো খেয়ে-দেয়ে আমরা ঘুমিয়েছি সকলে। সকালে দেখলাম কোথাও নেই বাড়ির মধ্যে। বাইরের দরজা খোলা ছিলো। তখন বুঝলাম বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। ভেবেছিলাম রাগে চলে গেছে। রাগ কমলে ফিরে আসবে। শঙ্খ মেজদাকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
— আরে ও গল্প তো আমি শুনেছি আবারও শুনলাম। তা রাগে চলে গেছে বছর পার হয়ে গেল তো। এই এক বছরে তোমার খোঁজ- খবর নেওয়ার গল্পটা কি সেটাই বলো? কি প্রচেষ্টা নিয়েছো? কোথায়- কোথায় দরবার করেছো? পুলিশ কি স্টেটমেন্ট দিয়েছে? ডাইরি করা ছাড়া আর কি- কি ব্যবস্থা নিয়েছো? সেই গল্প শোনাও। এবার মেজদা বেশ ধাঁতানি দিলে একটু।
— আমার আর বলার কিছু নেই মেজদা। সামনের মাসে শেষের দিকে মাস খানেকের জন্য ছুটির দরখাস্ত দিয়েছি। ছুটি পেলে বাড়ি ফিরে একটা হেস্তনেস্ত করবো। আজ আমি খুব ক্লান্ত। দুদিন পর না হয় আমি তোমাকে ফোন করবো। অপর প্রান্ত থেকে মেজদার ছোট্ট উত্তর। ঠিক আছে। ফোনটা কেটে দিলো।
মাথার চুলের মধ্যে দুহাতের আঙুল ঢুকিয়ে চুপচাপ বসে রইল শঙ্খ। অনেকটা সময় একই ভাবে কাটার পর, উঠে গিয়ে বোতল খুলে তরল পানীয় গলায় ঢালে বেশ কিছুটা। বিছানায় বসে একটা সিগারেট ধরালো। ধোঁয়ার কুণ্ডলীতে মন কে ছাঁকতে চাইলে একটুও বা। বনের আগুন যখন মনে লাগে। সে উত্তাপ সহ্যের ক্ষমতা সকলের থাকে না। মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করতে থাকল। সিগারেট ফেলে শটান বিছানায় পিঠ পাতলো শঙ্খ। নিস্তব্ধ হতে বেশি সময় লাগলো না।
পর্ব – ২৬
দিনগুলো কতো তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে কেমন। বস্তির এই দর্মাঘেরা ঘরটায় নতুন এক জীবনের শুরু হয়েছিল। দেখতে- দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেল। যেভাবে শুরু হয়েছিল সেভাবেই চলছে মসৃণ পথে কোন সমস্যা নেই। কোন চাহিদার টানাপোড়েন নেই। সহজ- সরল রিজিয়ার জীবনে সুখ- দুঃখের সহাবস্থান আজও বিরাজমান। দুটো নারীর জীবনে কেমন আপোসে চলে দিন যাপন। আসমা ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে দিন কাটায়। তাদের পড়াশুনা, চান-খাওয়ার দায় দায়িত্ব পালন করে সময় কাটায়। রিজিয়া সংসারের দায়ভার যেমন বহন করতো আজও করে চলেছে। আরশাদ যেমন সকালে খেয়েদেয়ে বের হয় তেমনি যায়। সন্ধ্যা মুখো ঘরে ফেরে।
রিকশা স্ট্যান্ডে কয়েকজন সহকর্মী নতুন জীবনের সংবাদ চায়। একটু হেসে দেয় আরশাদ বলে, – আমার এ জীবন নতুন নয় গো ভাই! সেই পুরনো জীবনটাই বয়ে যাচ্ছি। যেমনটা এতো বছর বয়ে এসেছি।
— পিন্টু বললে, – সে কি গো দাদা ? নতুন ভাবি হলো। আর একটা একটু হলেও খুশির খবর তো থাকবে ?
— অখুশি আছি বলিনি তো। আরশাদের জবাব।
— জসিম বললে, – দাদা কি মুখে সব কথা বলবে রে, বুঝে নিতে হবে।
— পিন্টু বললে, – আরশাদ দার হাফ-ভাব একই রয়েছে। বোঝার কোন উপায় নেই তেমন।
— ওরে পাগল, এমনি বিয়ে করিনি। করতে বাধ্য হয়েছি। একটা জীবনের বিনিময়ে জীবন বাঁচিয়েছি। আরশাদ বললে।
— জসিম বললে, – সে তো জানি গো, নাকের বদলে নরুন পাওয়া।
— ঠিক তাই, খুব দামী কথা বললি ভাই।
স্টেশনে ট্রেন আসে। ওরা সকলে প্যাসেঞ্জার নিয়ে ছুটে যায় দিক- বিদিক। যাওয়া- আসা চলতেই থাকে দিনভর। রাতে একসঙ্গে খেতে বসে আরশাদ বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে। রোজগার দিনের মতোই রিজিয়া খাবারের থালা এগিয়ে দেয় সকলের সামনে। আসমার গা ভেসে ছেলে- মেয়ে। পাশাপাশি আরশাদ – রিজিয়া। খেতে খেতেই আরশাদ বলে উঠলো, — দিদিমণি আপনার কোন অসুবিধা হচ্ছে না তো ? বস্তির মানুষ, পাঁচ কথা বলা মুখ তো।
আসমা বললে — অভ্যাস করে নিয়েছি। কারো মুখে তো হাত চাপা দেওয়া যাবে না।
রিজিয়া বললে — ক’জনকে তো মুখের উপর জবাব দিয়েছি। এখন আর তেমন কেউ মুখ খোলে না। কথায় বলে না, যেমন কুকুর তেমন মুগুর চাই। সেটাই করতে লেগেছি।
আরশাদ বললে — কিছু কিছু মানুষের সমস্যা এখানেই। কেউ একটু ভালো থাকতে চাইলে, তাকে ভালো থাকতে দেওয়া হবে না। কেউ কোনো ঝঞ্ঝাটে থাকতে না চাইলে, তাকেই ঝঞ্ঝাটে ফেলে দেবে এরা।
আসমা বললে — মানুষের জীবন বোধ আর জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা আমাদের অনেকেরই নেই। কি শহর- কি গ্রাম- কি বস্তি। সবখানেতেই একই ধারা। শিক্ষার যেখানে চেতনা নেই, শিক্ষিত মানুষ যদি মানুষের মর্যাদা দিতে না শেখে। সেখানে অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ তো করতেই পারে। তাদের জীবনে তো বোধের অভাব থাকবেই।
আরশাদ বললে — আপনার সব কথার মানে না বুঝলেও। যেটা বলতে চেয়েছেন বুঝেছি। খাঁটি কথা বলেছেন। আপনারা শিক্ষিত মানুষ, বুঝন ক্ষমতা তাই অনেক বেশি।
আসমা বললে — জ্ঞানের আলো শুধু শিক্ষিত মানুষের মনে আছে, কথাটা পুরোটা সত্য নয়। জ্ঞান পাপী মানুষ সমাজে ঠেসে বসে আছে। তার থেকে তথাকথিত অশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত অনেক মানুষ আছে, যাদের ভেতরটা আলোর মতো উজ্জ্বল।
রিজিয়া বললে — মানুষ তো এখন শিয়াল- কুকুরের মত গো। দেখা হলে কামড়াকামড়ি, খাবার খেতে কামড়াকামড়ি। ঠিক কথা না, বলো দেখি দিদি।
আসমা একটু হেসে ফেললে। বললে — একদম ঠিক কথা বলেছ। আমরা এখন মনুষ্যত্ব হারিয়ে পশুত্ব গ্রহণ করেছি। বস্তি থেকে গ্রাম- গ্রাম থেকে শহর, সবখানে আজ একই ধারা।
আরশাদ বললে — কথাটা কিন্তু খাসা বলেছেন দিদি মণি। এক ঘর কথা।
খাওয়া শেষ হলো। রিজিয়া এঁটো থালা-বাসন ধুতে লাগলো। আসমা বাচ্চাদের নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল। সারাদিনের ক্লান্তির অবসানে বিছানায় পিঠ পাতলে। সকালের বস্তির আকাশে পুরো আলো ফুটে উঠেনি তখনো। সকালে ট্রেনখানা ঝমঝম শব্দে শহরের দিকে মেদিনি কাঁপিয়ে ছুটে গেল। অভ্যস্ত জীবন যাপনে অসুবিধার কিছু নেই কারো। সারাদিনে কতবারই এমন শব্দের যাতায়াত। কলতলায় হাঁড়ি- কলসির ঠোকাঠুকি। ফাঁকা বালতির ঝনঝনানি। দৈনন্দিন কাজের কলকাকলি। মাঝেমধ্যে চিৎকার- চেঁচামেচি। আগে- পিছে হিসাব নিকাশ। জনাকয় পুরুষজন বালতি বোঝাই জল নিয়ে নালার মুখে স্নানে ব্যস্ত। সূর্যটা লাল থালা থেকে মাথা উঁচিয়ে আলো ছড়ায় চারিদিক। অনেকটা থিতু হয় কলতলা। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে থাকে মানুষগুলো। বসতি এখন বেশ কিছুটা কোলাহলমুক্ত। রুজির টানে মানুষগুলো ছড়িয়ে পড়ে দিক- বিদিক ঠিক পাখির মতো। খাবারের সন্ধানে, বেঁচে থাকার- বাঁচিয়ে রাখার অঙ্গীকার পূর্ণ করার লক্ষ্যে। মানুষও কেমন পাখির জীবনকে আপন করে নিয়েছে। সারাদিন খাবার অন্বেষণ। দিন পাতা। সন্ধ্যে বাসায় ফিরে কোলাহল। গুঞ্জন। আওয়াজ নিভতে-নিভতে মধ্যরাত্রি। গড়পড়তা জীবনের একটা রুটিন। সকালের নাস্তা খেতে বসে আসমা আরশাদকে বললে — কদিন ভাবছিলাম একটা কথা বলবো। ভুল ভাববেন না কিন্তু।
আরশাদ বললে — বলেন।ভুল ভাবার কি আছে।
আসমা বললে — বস্তির কিছু ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে যদি পড়াশোনার ব্যবস্থা করি। তাহলে কি কিছু অসুবিধা হবে।
রিজিয়া বললে — দিদির যেমন কথা! ছেলে পড়ালে তো ভালো হবে গো ।
আরশাদ সায় দিয়ে বললে — হোক না অসুবিধের কি আছে। বাচ্চারা পড়ালেখা করলে তো খুবই ভালো।
অভীষ্ট লক্ষ্যে বেশ কিছুটা এগিয়ে গেল আসমা। সন্তানদের সেবার মাধ্যমে পিতা-মাতার মানবিক উন্নতির একটা সুন্দর রাস্তা নিলে সে। যোগাযোগের একটা সেতু তৈরি হলো এভাবেই।
ছেলে-মেয়েকে পড়িয়ে নিয়ে, ওদের হাত ধরেই বাইরে এলো আসমা। এভাবে বাইরেটা প্রথম দেখতে পেল সে। কটা ঘরের দরজায় দেখা করলে প্রথম দিন। দুটো মায়ের দেখা মিলল ঘরে। বাকিরা দুজনাই কাজে বেরিয়েছে। বাচ্চা কজন সারাদিন প্রায় ঘরবন্দী বললে হয়। বাচ্চাদের পড়ালেখার কথায় দুজন মায়ের বেশ উৎসাহ দেখা গেল। বললে, — ওর বাবা ফিরলে, কথা বলে ‘হ্যাঁ’ বললে নিয়ে যাবো তোমাদের ঘরে। বেশ আগ্রহের সঙ্গে বললে একজন। কয়েকদিনের অভিযানে, আসমা বেশ উৎসাহ পেল। জনকয়েক বাবা-মা সেদিন সন্ধ্যের পর দেখা করেও গেল। বাড়ির দুজন ছেলে-মেয়ে। নতুন পাঁচজন মিলে শুরু হল স্বাক্ষরতা অভিযান। আসমা সময়কে কাজে লাগানোর জন্য কিছু কাজ চায়। কাজের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ রেখে অনেক কিছু ভুলতে চায়। পুরনো খোলস শরীর থেকে ঝেড়ে ফেললেও, মন থেকে পুরনো সকল সহজে সরানো যায়নি। যত সময় অবসর। তত সময় জুড়ে স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলো পাতা উল্টাতে- উল্টাতে সামনে চলে আসে। এটাই স্বাভাবিক। সূর্যের আলোর মতো সত্য। স্রোতের অনুকূলে ভেসে বেড়ানো নৌকোর কসরত অনেক কম। স্বাচ্ছন্দ্য অনেক বেশি। তরতরিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। শরীরখানা ভাসিয়ে রেখে নিশানা সঠিক রেখে এগিয়ে চলা। উজান ঠেলে স্রোতের বিপরীতে যাওয়া, বেশ সময় সাপেক্ষ। বেশ কষ্টকর। নিশানা আর কসরত সমান তালে এগিয়ে চলা।
স্বাতীলেখা আর আসমা। দুটো চরিত্র- একই মুখ। ভীষণ বিপরীতমুখী। সরল স্বাভাবিক জীবন শুরু হলেও, ক্রমশ অমানবিকতার শিকার হতে হয় তাকে। ঘাত- প্রতিঘাত, নীতি- নৈতিকতায় বারবার খুন হতে থাকে সরল একটা মন। প্রতিবাদের ভাষা দমন-পিড়নের যাঁতাকলে কতবার পেশাই হয়েছে। সত্যিই কি নারীদের কোন নিজস্ব ঠিকানা নেই? নেই কোথাও নিরাপত্তা ? নারীর কোন স্বাধীন মতামত দেবার অধিকার নেই ? চাপিয়ে দেওয়া মতামত- মতবাদ সেই ছোট্টবেলা থেকেই মেনে চলতে হবে ? সংসার জীবনেও অনুগতদাস হিসাবে জীবন- যাপন ? কিন্তু কেন ? মানুষ হিসেবে কি নারীর কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না ? থাকতে নেই ? স্বাতীলেখা সইতে- সইতে সংযমী থাকতে- থাকতে কেমন দিশেহারা হতে থাকলে ক্রমশ। প্রতিবাদী ভাষা প্রয়োগে মাথা ফেটেছে মায়ের হাতের বেলনে । প্রতিবাদের প্রতি উত্তরে স্বামী শঙ্খের হাতের মারে ঠোঁট কেটেছে তার। তিন সন্তানের জননী হয়েও সংসার জীবনে পায়ের তলার মাটি শক্ত হয়নি। নিজের মতো চলার- বলার অধিকার তৈরি হয়নি একটু ও। সন্দেহের বাতাবরণে হুকুম- তামিল করা ছাড়া এ নারীর জীবনে আর করার কিছুই ছিলো না।
একটা চরম সিদ্ধান্তের সাহসিকতায় ঝাঁপিয়ে পড়া মেয়েটা প্রতিবাদের আগুন ঝরিয়েছিল সেদিন থানার ভেতরে। একটা নিরপরাধ মানুষকে মিথ্যে শাস্তির অজুহাতে বন্দিত্ব ঘুঁচিয়ে ফেরত এনেছিল তার সংসারে, তার স্ত্রী পুত্র- কন্যার কাছে। তারপর শুরু জীবনের কৃচ্ছসাধন। নিজের সংসারে অপাংক্তেয়। নিখোঁজ জীবনের শুরু। এক কালো অধ্যায় ।দীর্ঘ সময়। দীর্ঘদিন। মাস- বছর। আজ নতুন নাম আসমা। নতুন জীবন । বস্তির পলিথিন ঘেরা ঘরে।
পর্ব – ২৭
ভিতরে ভিতরে কেমন বিধ্বস্ত শঙ্খ। মাথার উপর চাপটা বেশ জোরালো হচ্ছে। এতটা ভীত- সন্ত্রস্ত হবার ছেলে নয় সে। তবুও কি করে যেন একটু হলেও নুয়ে পড়েছে। ঠিক যেন ঝড় বিধ্বস্ত গাছ, ফলের ভার বহন করতে গিয়ে মাথাটা নুইয়ে ফেলে। বাস্তব বড় কঠিন জায়গা। কল্পনাপ্রসূত কোন পরিকল্পনা, বাস্তবায়িত হওয়ার লক্ষ্যে কখনো কার্যকর- আবার কখনো মারাত্মক অনিশ্চয়তা। গলায় ঠিক ফাঁস লাগার মতোই বেশি নড়াচড়াতে আঁটতে থাকে। আসলে, সঠিক পরামর্শ করার মতো কোনো কাছের লোককে পাচ্ছে না। সত্যি কথাটাও কাউকে জানাতে পারছে না। বলতে গেলে পারবেও না। কি বলবে, কিভাবে বলবে সেদিনের ঘটনা। মনে করলে ভাবনাগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। কেন যেভাবে রিয়াক্ট করল সে। এটা তো হওয়ার কথা ছিল না। স্বাতী কে পাঠিয়েছিল বাবা-মার কাছ থেকে কিছু টাকা আনতে। সে কাজটা হাসিল করতে পারেনি। চাইলেই যে সব সময়ে সব কিছু পাওয়া যায়। এমন ভাবনাটা ও তো ঠিক নয়।
কিন্তু এমন হঠকারিতা কি করে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। দুর্যোগপূর্ণ রাতে এক অসহায় মহিলাকে, বিশিষ্টজনের অনুরোধে যদি নিজের বাড়িতে কেউ থাকার ব্যবস্থা করে। তাহলে সে ব্যক্তি তো মহৎ কাজ করার পুরস্কার পেতে পারে। তার বদলে সে তিরস্কৃত হল যে প্রক্রিয়ায়। এটাইতো একটা ঘৃণ্য অপরাধ। ভালো কাজ করার পরিণাম যদি থানার লকআপ হয়ে থাকে। অন্যায় পদ্ধতিতে যে মানুষটা সত্যের অপলাপ ঘটালো তার এমন পাপের কি সাজা হওয়া উচিত? অপ্রিয় এই সত্য কথাগুলো আজ বেশ পীড়া দেয় শঙ্খকে। মাথার উপর বোঝার মতো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। পৃথিবীতে এমন ঘটনা বলে নিজের অপরাধের কিনারা করবে, তেমন কেউ নেই তার। থাকতে পারেও না। যে মানুষটা জীবনে শুধু চাই- চাই শব্দে সামনে এগিয়েছে। পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রায় কোন আপোষ করেনি কখনো। তার তো বন্ধু- স্বজন থাকতে পারে না।
জীবনকে শুধু নিজের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে, তার একটা প্রতিক্রিয়া জীবনে একদিন আসবে। আসতেই হবে। চাওয়া- পাওয়ার সঙ্গে, দেওয়া- নেওয়ার একটা সেতু থাকা প্রয়োজন। হাত চিৎ করে শুধু নিতে শিখলেই হয় না। হাত উপুড় করে দেওয়াটাও শিখতে হবে। অভ্যাস করতে হবে। না হলে শুধু একটা বদভ্যাসে আবদ্ধ থাকতে হবে। আর এমন লালসা চরিতার্থ করতে গিয়ে দুরূহ অবস্থানে পৌঁছাতে সময় লাগে না। লালসার পাহাড় চূড়ায় উঠে ও সামনে চলার অভ্যাসে যেতে গিয়ে, খাদের কিনারায় যখন পৌঁছে যেতে হয়। তখন তো সামনে আর কোন পথ থাকে না। অথচ, পেছনে আসার পথ আর মসৃণ নেই। পেছনে তাকানোর অনভ্যাসে রাস্তা খোঁজাও বড় দুরূহ প্রচেষ্টা হয়ে পড়ে বৈকি!
শঙ্খ আজ ঘরে বাইরে চাপের মুখে। এমন এক জটিল আবর্তে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে। সোজা ভাবে বেরিয়ে আসা বড়ই দুষ্কর। মাথার মধ্যে অনেক চিন্তার টুকরো- টুকরো দৃশ্য। ছোট- বড় ঘটনা সিনেমা দৃশ্যের মতোই সরে সরে যায়। ভাবনায় বুঁদ হয়ে ক্রমশ মাথা ভারি হতে থাকে। যে মানুষটার টানা দু’মাস ডিউটি করার পরই বাড়ি ফেরার একটা তাগিদ থাকতো। স্ত্রী- সন্তান-সম্পত্তি নিয়ে ভাবনা চিন্তা ছিল। সে আজ কেমন নিষ্ক্রিয়। ছেলে দুটো হস্টেলে আছে । মেয়ের খোঁজ রাখতেই হয় না। সে এখন দিদিমার জিম্মায়। স্ত্রী, জীবিত না মৃত জানেনা। বাড়িঘর তালা বন্ধ মাসের পর মাস। এমন আশ্চর্য জীবনে হাঁটতে হচ্ছে শঙ্খকে, জেতার আবিষ্কর্তা সে নিজেই ! নিজে না চাইলেও তার আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকলাপ তাকে এই পথে টেনে এনেছে। মনের অজান্তেই একটু- একটু ঢুকে পড়েছে।
সামনে গরমের ছুটি। শুভ্র- অভ্র বাড়ি ফিরবে। মানে বাড়িতে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তারপর ? মায়ের খোঁজে পাগল করে তুলবে। কি জবাব দেবে শঙ্খ। কার কাছে থাকবে দু’ভাই ।রান্না- খাওয়া, পরিচর্যা কে সামলাবে। কেমন হতাশ হয়ে পড়ে সে। ইউনিফর্ম পরেই এভাবে কতক্ষণ বসে ছিল শঙ্খ মনে নেই। তাড়াতাড়ি কাপড় ছাড়লো। মুখে হাতে জল দিয়ে একটু ফ্রেশ হলো। নিজেকে একটু প্রাসঙ্গিক করার জন্য ক্যান্টিনে ঢুকলো চা খেতে। বেরিয়ে ব্যারাকে চৌহদ্দির রাস্তায় একটু ঘোরাঘুরি করলে। রাস্তার কোনায় ঝাঁকড়া কদম গাছের তলায় বসলে একটু। সিগারেট জ্বালালে একটা। বাতাসে ধোঁয়া উড়িয়ে মনটাকে ছাঁকতে চাইলো যেন।
আকাশে ক্ষয়ে যাওয়া এক টুকরো চাঁদ। পূর্ব সীমানা ছেড়ে একটু উপরে এসে দাঁড়িয়ে। কয়েকটা চাপ- চাপ সাদা মেঘ ঠায় ভেসে আছে। রাস্তার নিয়ন আলো গুলো লালচে আলোয় অন্ধকার সরিয়েছে। দূরে রাস্তায় গাড়ির হেডলাইট জ্বেলে দ্রুত যাওয়া আসা। শঙ্খ চোখ আটকে রেখেছিল এমনতর দৃশ্যে। শহরের মানুষ হলেও চাকরির জীবনটা গ্রাম ঘেরা এক সীমান্ত এলাকা । গাছ-গাছালি, ধু-ধু জমি, দূরে পাহাড়ি এলাকার কোথাও কাঁটাতার- কোথাও খোলা জায়গা। পিলার সর্বস্ব সীমানা। জনপদহীন বললেই চলে। অবৈধ যাতায়াত। মানুষ আর মালপত্র। চোরা চালান রক্ষা করার দায়িত্ব পালন করতে- করতে মানুষগুলো কেমন রুক্ষ হয়ে ওঠে। জীবনের স্বাদ যেন আপন থেকেই ফিকে হয়ে যায়। রাতের অন্ধকার এমন এলাকা বেশ অস্বস্তিকর, ভয়ংকর। গোলা-গুলির আদান- প্রদান সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। আবার অবাধে যাতায়াত করতে পারলে কোন সমস্যা থাকে না। মনে হয় কত শান্ত এলাকা।
অনেকটা সময় কাটলো আজ শঙ্খর। এমন প্রকৃতির মুখোমুখি। হাজারো চিন্তার জাল ঘিরে ধরা মানুষটা, একটু বৈচিত্র্য আনতে চেয়ে মনটাকে হালকা করতে চেষ্টা করছিল। রাতের খাওয়া সেরে গুটি- গুটি পায়ে রুমে ফিরল শঙ্খ। ঘড়ির কাঁটা দশটা পঁয়ত্রিশে দাঁড়িয়ে। কাপড় ছেড়ে রাত পোশাকে বিছানায় বসল। একটা সিগারেট মুখে খানিকটা গল গলে ধোঁয়া ছাড়লো। টেবিলে রাখা ক্যালেন্ডারে চোখ বুলালো একুশ তারিখ নাগাদ ছুটি নিয়ে বেরোতে হবে। তেইশ থেকে শুভ্র- অভ্রর গরমের ছুটি শুরু হবে। ওদেরকে নিয়ে কলকাতায় ফিরতে হবে। কুড়ি দিনের ছুটি হিসাব কষে, কতদিন ছুটি নিতে হবে তাকে। আবারো দিন কাটানোর গোলক ধাঁধায় চমকে উঠল মন টা। কিভাবে কাটবে এতগুলো দিন ? রান্না- খাওয়া ? ছেলে দুটোর পরিচর্যা ? তাহলে কি আবারও শ্বশুর-শাশুড়ির দ্বারস্থ হতে হবে ? আবারো প্রশ্ন বাণে জর্জরিত হতে হবে সবগুলো দিন ? অগোছালো পড়ে থাকা ঘর-দোর সাফ- সাফাই করতেই তো দুটো দিন কেটে যাবে। কে কিভাবে করবে ।এভাবে জীবন কাটানো যায় না লুকোচুরি খেলে কিছু সময় কাটানো যায় কটা দিন কাটানো যায়। কিন্তু দিনের পর দিন কাটানো যায় না। একটা হেস্তনেস্ত- একটা শেষ কিছু হওয়া দরকার। সমস্যার জাল ছিঁড়ে বেরোতে চাইছে মন।
রাতেই ফোন করলে মেজদাকে।
— হ্যাঁ বলো, কি খবর তোমার ?
— মেজদা, ভালো খবর। আমি ছেলেদের নিয়ে বাড়ি ফিরব চব্বিশ তারিখ। তেইশ থেকে ওদের গরমের ছুটি পড়ছে। কিন্তু সমস্যা হল বাড়িতে কেউ না থাকলে কিভাবে চলবে। শ্বশুর- শাশুড়িকে বলার মতো মুখ আমার নেই। তুমি যদি একটু বলে- কয়ে ওদের আসার ব্যবস্থা করতে পারো তাহলে ভালো হয়। একটানা কথাগুলো বললে শঙ্খ।
— কিছু কথা বলার মতো মধুর সম্পর্ক তুই রাখতে পেরেছিস ? মেজদার গম্ভীর জিজ্ঞাসা।
— এখন সব দোষ আমার, ধরেই নিলাম। ওরা আসুন, তুমিও থাকবে। পরিষ্কারভাবে সব আলোচনা হবে। শঙ্খ কিছুটা নরম।
— ঠিক আছে, আমি বলবো আসার জন্য। তবে কি করবে তাদের ব্যাপার। সোজাসাপ্টা কথা মেজদার। ফোনটা কেটে দিলো।
একটু চাপমুক্ত, ভার মুক্ত হতে গিয়ে। মাথা আরো ভার- ভার লাগলো শঙ্খর। গ্লাসে একটু তরল পানীয় ঢেলে এক চুমুকে শেষ করে সটান বিছানায় শুয়ে পড়লো। কিছুক্ষণের মধ্যে চুপচাপ ঘুমের দেশে বলে পড়লো।
পর্ব – ২৮
আট জন বহিরাগত, ঘরের দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে মোট দশ জনের একটা পাঠশালা তৈরি হলো আসমার। মনের মধ্যে কাজ শুরু করতে পারার একটা প্রচ্ছন্ন উচ্ছ্বাস। সকাল থেকে এক দুপুর অনাবিল আনন্দে সময় কাটানোর এক আনন্দ আশ্রম। খুশি রিজিয়া অখুশী নয় আরশাদ ও। আরশাদের বস্তির ঘরটায় এক উজ্জ্বল আলো ফুটে উঠেছে। যারা এতদিন এই ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে কটূক্তি করত। মনুষ্যত্বের অপলাপ ঘটাতো। ব্যক্তি চরিত্র হননের কুপ্রচেষ্টায় সদা ব্যস্ত থাকতো। তারাই এখন চায়ের গুমটির দোকানে মেয়েটার কাজের প্রশংসা করে। তার প্রচেষ্টা সার্থকতা দেখতে চায়। আর কিছু না হোক বস্তির ছেলে-মেয়েগুলোর অন্তত অক্ষর পরিচয় হোক। নাম সই করা শিখতে পারবে।
হাসান বললে – তাহলে সব মেঘে যে বৃষ্টি হয় না, সেটা আগে বুঝতে পারোনি আবহবিদরা। শুধু যাতা একটা ঘোষণা করতে শিখেছ? তাই না?
কাশেম বললে – ট্যারা কথা বলে লাভ নেই ভাই। মেঘ কে মেঘ – বৃষ্টিকে বৃষ্টি বলতে তো হবে ? ভালো কাজকে ভালো- মন্দ কাজকে মন্দ বলাতে দোষ তো নেই।
মাতাল রিয়াজ বললে – এই সমাজে বোবা হয়ে থাকলেই ভালো, বুঝলে কাশেম। দেখে ও দেখবে না। কানে এলে ও শুনবি না। তাহলেই তুই ভালো হবি এজগতে।
হাসান বললে – এটাই তো মূর্খের মতো কথা হলো। চকচক করলেই সোনা বলে চেঁচালে হবে না মিঞা। ভালো করে পরখ করো। সবকিছু শোনা কথা বিশ্বাস করার আগে যাচাই করতে হবে। মনে রেখো মুখের কথা গলার ফাঁস। সবকিছু মুখ আছে বলে বলে দিলাম বুমেরাং হতে পারে।তাই ভেবে বলা ভালো।
কাশেম বললে – আমরা অতো প্যাঁচের কথা বলতে পারি না। বুঝিও না। সোজা কথা- পড়ন কথা বলি। কে চটবে– কে পটবে জানিনা।
হাসান বললে – প্যাঁচের কথা বলতে হবে না। সোজা কথাই বলো । তবে জেনে বুঝে বলো। না হলে শুধু চটবে না — চাঁটাও দেবে।
মবিন হাসানকে ডেকে নিলে – এই চল, ওদের সাথে ফালতু বকে লাভ আছে।
ওরা চলে গেল। সকালে চায়ের দোকানের আলোচনায় লাশ থেকে বাঁশ। হিরে থেকে জিরে সবই হতে থাকে। বেলা বাড়তে থাকে। বস্তির কাজের মানুষগুলো চলে যায় যে যার কাজে। সংসারের কাজের মানুষগুলো ঘরের কাজে ব্যস্ত। অ-কাজের পুরুষগুলো অ-কাজেই ব্যস্ত। গুমটির চায়ের দোকানে। গলির মুখের বাঁশের মাঁচায়।
আসমা তার পাঠশালায় দশটা ছেলেমেয়ে নিয়ে তাদের অক্ষর পরিচয় থেকে– আচার-আচরণ বিধি শেখাতে ব্যস্ত। প্রথম কটা দিন বাচ্চাগুলোর একটু জড়তায় কেটেছিলো। নাম বলতেও অস্পষ্টতা ছিলো। আসতে আস্তে সেই সমস্যা কাটতে চলেছে। ভাষা ব্যবহারের অপূর্ণতা একটু- একটু করে মেরামত করছে তাদের শিক্ষিকা আসমা।
সংসারের কাজের অবসরে রিজিয়া পড়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় নিঃশব্দে। একদৃষ্টে দেখতে থাকে আসমার প্রচেষ্টা। নিজের শৈশবে ফিরে যায় অচিরেই। এই বয়সে সেও পড়তে যেত মক্তবে। বাংলা- আরবি পড়তে ভালোই লাগতো। তারপর হল্লা বাধলো দেশে। পাকিস্তানি সৈনিকেরা মারতে লাগলো বাঙালিদের। সে এক অন্ধকার সময় মানুষের জীবনে। দলে দলে মানুষ পালাতে লাগলো দেশ ছেড়ে। আমাদেরও চলে আসতে হল রাতের অন্ধকারে। কিভাবে- কোথা, দিয়ে শুধু হাঁটতে– হাঁটতে চলেছিলাম। কখনো বাবার হাত ধরে। কখনো দাদার হাত ধরে। ওদের মাথায় কাপড়ের ব্যাগ। টুকিটাকি ঘর গেরস্থালীর সামান। দিনের আলো ফুটতে যেখানে এসে পৌঁছেছিলাম সেটা এই দেশ।তারপরে কিভাবে কাদের সাহায্যে জানা নেই, জানতে পারিনি ওই বয়সে। নদীর পাড়ে কালো তাঁবুর ঘর করে বসবাস। বেশ কটা দিন প্রায় অভুক্ত কেটে ছিলো।
স্মৃতির ডানায় ভর করে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলো রিজিয়া।
— ভেতরে এসো না। আসমা উঠে কাছে এলো।
— নাগো দিদি, একটু দাঁড়িয়ে লেখাপড়া দেখছিলুম।
— এখন পড়তে ইচ্ছা করে না?
— কি যে বলো না দিদি? এই বয়সে আবার কেউ লেখাপড়া করে? কেমন লজ্জা পেল রিজিয়া।
— লেখাপড়ার কোন বয়স নেই গো। শেখার ইচ্ছা থাকলে যে কোন বয়সে শেখা যায়। একটু হাসলে আসমা।
লজ্জায় নিজের কাছে চলে গেল রিজিয়া। আসমা পড়াশোনায় ফিরে এলো। মানুষের জীবন এমনই এক সুতোয় বাঁধা। দুলতে থাকে- চলতে থাকে, অথচ নিজের ইচ্ছে মতো হয় না। নিয়মের বেড়াজালে- নিয়তির মাপকাঠিতে ঘড়ির কাঁটার মতোই টিক-টিক এগোনো শুধু।
প্যাসেঞ্জারের অপেক্ষায় বসে-বসে কতো কথাই ভাবছিল আরশাদ। সরল জীবনটার উপর কেমন একটা দাগ পড়ে গেল। এমনটা তো কোনদিন ভাবেনি সে। সারাদিন রিক্সার প্যাডেল কষা খাটুনি। কষ্টের রোজগার তাই সংসারে অভাব নেই। দিনের শেষে বাড়ি ফিরে চান-খাওয়া। নিশ্চিন্তে রাতের ঘুম। বস্তির কোন ঝঞ্ঝাট- ঝগড়াঝাঁটি তার সাদা চরিত্রে কালি ছেটাতে পারেনি। কেউ তুই বলে সম্বোধন করেনি কখনো। অথচ উপকার করার বিনিময়ে এ কোন উপহাস অপেক্ষা করেছিলো তার জন্য- তার জীবনে।
— কি আরশাদ ভাই, কি ভাবছো এতো ? ছোট্টু সামনে এসে দাঁড়ালো।
— না গো, ভাবার আর কি আছে ? আজ গাড়ি এতো লেট কেন গো ? এই সময়ে দুটো গাড়ি এসে যাবার কথা। আরশাদ বললে।
— লাইনের কোন গন্ডগোল আছে মনে হয়। মাস্টার ও তো একবার হাঁকছে না মাইকে। প্লাটফর্মে ভিড় রয়েছে বেশ। ছোট্টুর যুক্তি।
— হতেও পারে, আমাদের আর কি করার আছে। বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া। একটু হতাশ আরশাদ।
অপেক্ষার প্রহর গোনে লাইনের রিকশা চালকেরা। বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ অনেকের ভাষাতে। একটা উশখুশ চাঞ্চল্যতার মাঝেই ঘোষণা হলো। ডাউন মুর্শিদাবাদ লোকাল এক নম্বর প্লাটফর্মে আসছে। যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য ট্রেন এক ঘন্টা কুড়ি মিনিট লেট আছে। আপ গাড়ির কোন খবর এখনো হয়নি। হলে জানিয়ে দেওয়া হবে। একটু চঞ্চলতা রিকশাচালকদের মধ্যে। সকাল থেকে অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে। ট্রেন আসার পরে যাত্রীবোঝাই করে জাতীয় সড়কের বাস রাস্তায় পৌঁছানো। ফিরতি ওখান থেকে ট্রেন যাত্রীদের স্টেশনে নিয়ে আসা। অবিরত যাতায়াত শুরু হলো। সকালে সময়টা চুপচাপ বসে থাকার যেন খেসারত দিতে হচ্ছে রিকশাচালকদের। তবে মনে মনে অখুশি নয় তারা। অনেকেই আজ দুপুরে খাবার সময় পায়নি। আরশাদ স্টেশনে ফিরতি এসে- প্যাসেঞ্জার নামিয়ে লাইনে গাড়ি রাখে। টিফিন টা সেরে নেয়। আজকে তার জিরিয়ে নেবার সুযোগ নেই। খেয়ে নিয়ে আবার ছুট। সারাদিনের ক্লান্ত দেহ নিয়ে যখন বাড়ি ফিরলো আরশাদ। তখন সন্ধ্যে গড়িয়ে কিছুটা রাতের সময় চলে এসেছে। নিয়মমাফিক স্নান সেরে একটু চা খেয়ে বিশ্রাম নিলে।
সংসারের প্রাত্যহিকীতে রিজিয়া। সান্ধ্য চা- জল খাবারের পর রাতের খাবার তৈরির প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। অলস মন নষ্টামির পাথেয়। আরশাদের পরিবারে অলসতার কোন প্রভাব নেই। যার যা কাজ, সময়ের সময় ধরে করে যায়। বিশ্রাম আছে। চান- খাওয়া আছে। কিন্তু কোন আলসেমি নেই। নেই কোন পরচর্চা। অন্যের ব্যাপারে কোন মাথা ব্যথা নেই। লোভ- হিংসা নেই। বড় সরল- সাদাসিধে একটা পারিবারিক জীবন। যেমনটা এ জীবনে আনন্দ- উচ্ছ্বাস নেই। তেমনই গভীর দুঃখে আচ্ছন্ন ও হয়নি কোনদিন। চাওয়া- পাওয়ার উত্তাপ নেই।ক্ষোভ- অভিমানের তাপ- উত্তাপ নেই। বড় অদ্ভুত আরশাদের জীবনধারণ। নিজের মনের একশ শতাংশ সমান্তরাল স্ত্রী রিজিয়া। তাদের সংসারের একদিনের অতিথি হতে আসা মানুষটা। আজ সংসারের একজন সদস্যা। এক কথায় রিজিয়ার সতীন। কোন চাপ নেই রিজিয়ার। ভাগবাটোয়ারার কোন সংশয় নেই। সংসার যদি মানিয়ে নেওয়ার পীঠস্থান হয়। উভয়ের মানিয়ে চলার আদর্শ পথ তৈরি হয়। এমন সুখ যে কোন আস্তানায় হতে পারে। সে অট্টালিকা হোক বা বস্তির ঝুপড়ি। মস্ত অফিসারের সংসার অথবা ধনী ব্যবসায়ীর হতে পারে। যদি মেনে চলার মানসিকতা বা মানিয়ে চলার আন্তরিকতা থাকে। জীবনে সুখের অভাব হবে না।
রিজিয়া- আরশাদ- আসমা। তিনটে মানুষের চাহিদা বিহীন এক সুখের সংসার।
পর্ব – ২৯
আবারো নিজের জমি-জিরেত, ঘর-বাড়ি, বাগান-পুকুর অন্যের ভরসায় ফেলে রেখে কলকাতায় জামাইয়ের ঘর-দোর সাফ- সাফাই, রক্ষণা-বেক্ষণের জন্য চলে এলেন স্ত্রী ছোট নাতনি সহ সত্যেন মাস্টার। সকাল-সকাল পৌঁছেই ঘর-দোর ঝাড়-পোঁছ করতে ব্যস্ত হলো মাস্টার গিন্নি। ধুলো-ময়লায় ভরে চারিদিক। যেন এক ভুতুড়ে ঘর। জন-মনিষ্যি নেই। এক সন্ধে বাতি দেবার প্রাণী নেই। কেমন যেন শ্রীহীন অবস্থা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সেরে স্নান করলে। খুঁজে-ঢুঁড়ে দুটো ধুপ নিয়ে জ্বালিয়ে ঠাকুরের ছবির সামনে দিলে। সংসারে নারী ছাড়া কেমন শ্রীহীন হয়ে থাকা ঘরদোর স্বমহীমায় ফিরে এলো মাস্টার গিন্নির হাতে। সত্যেনবাবু নাতনিকে নিয়ে পাড়ার দোকান থেকে চা-জল খাবারের জন্য পাউরুটি-কলা, একটু মিষ্টি, মুদির দোকান থেকে চা-দুধ নিয়ে ফিরল। সকালে চা- পর্ব মিটিয়ে মাস্টার থলে হাতে বাজার করতে বের হলো। চাল- ডাল- মসলা- পাতি। তেল- নুন সবকিছু কেনার তালিকায় আলু- পিয়াজ, মাছ, কাঁচা সবজি, দুটো ব্যাগে ভরে বেশ কষ্ট করেই বাড়ি এলো।
— হ্যাঁগো, চাল- ডাল একটু বেশি নিলে পারতে। পরশু সকালে তো জামাই শুভ্র-অভ্র কে নিয়ে আসবে। রান্নাঘরে বাজারগুলো গোছগাছ করে রেখে এসে বললে মাস্টার গিন্নি।
— যতটা বয়ে আনা সম্ভব এনেছি। বাকিটা কাল আবার নিয়ে আসবো। ওটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সত্যেন মাস্টার আশ্বস্ত করলো।
বাড়ির দরজা খোলা আছে দেখে, এক ভদ্রলোক ঢুকে শঙ্খের নাম ধরে বার কয়েক ডেকে উঠলো।
— কাকে চাই ? সত্যেন বাবু জানতে চাইলে।
— আজ্ঞে, আমি রথীন। পাড়ায় আমার দোকান আছে, দরজা খোলা দেখে ভাবলাম শঙ্খ এসেছে বুঝি। তাই ডাকলাম। ভদ্রলোক একটু অস্বস্তিতে পড়ে বললে।
— বিশেষ কোন দরকার ছিল কি ? বলতে পারেন। আমি ওর শ্বশুরমশাই।
— না তেমন কিছু নয়। তবে কি ক’মাস আগে চাকরিতে যাবার সময় আমার দোকানে গিয়েছিল। বলেছিল দুটো কামরা ভাড়া দেবে, সেই তো ফাঁকা পড়ে থাকে। ওরা সকলেই তো বাইরে থাকে। একটা কামরা নিজেদের জন্য থাকবে, মাঝেমধ্যে এসে থাকবে তাতে।
— তারপর কি হলো ?
— একজন এসেছিল মাসখানেক আগে। শঙ্খকে ফোনে বলেও ছিলাম। তারপরও আর কিছু জানায়নি। ভাবলাম, এসেছে বুঝি তাই দেখা করতে এসেছিলাম। আচ্ছা আমি আসি। লোকটা চলে গেল।
দুটো দিন যেন কেমন ভাবে কেটে গেল। আজ সকালে শুভ্র-অভ্রকে নিয়ে শঙ্খ আসবে। একটু বেলায় শঙ্খের মেজদা আসার কথা আছে। বলতে গেলে মেজ বাবুর কথাতেই সত্যেন মাস্টার দুদিন হলো কলকাতায় এসেছে। না হলে আসার কোন প্রয়োজনই ছিল না। কাল রাতেই বাজারের কেনাকাটা সেরেছে। সকালে যাতে বের হতে না হয়।
সকাল থেকেই কেমন একটা মানসিক চাপ অনুভব করছে সত্যের মাস্টার। চা খাওয়া শেষ হয়েছে একটু আগে। তার মাঝেই হই-হই করে বাড়ি ঢুকলে শুভ্র-অভ্র। দাদু-দিমাকে দেখে মুখ খানা হাসিতে উজ্জ্বল। শঙ্খ নিঃশব্দে ঘরে ঢুকলো। একটু বাদেই কথা মতোই বাড়িতে এলো শঙ্খের মেজদা। কুশল বিনিময়ের পর পাশের ঘরে গিয়েই বসল দুজনে। হাতমুখ ধুয়ে শঙ্খ এলো ঘরে। চা- জল খাবার দিয়ে গেল মাস্টার গিন্নি। বাচ্চাগুলোকে অন্য ঘরে খেতে ডেকে নিল। চায়ের কাপটা শেষ করে মেজদা বললে, — বছর পার হয়ে গেল। বর্তমান অবস্থাটা কি একটু পরিষ্কার করে বলতো। শঙ্খ কে প্রশ্ন করলো।
— কোন কিছু দিশা আমি পাইনি। থানার কোন মেসেজ নেই। আমার নিজের পক্ষে তো খুঁজতে বের হওয়া সম্ভব নয়। কটা দিনের জন্য ছেলেদের নিয়ে আসি। ওদেরকে দেখবো, না খুঁজতে বের হবো।
— তাহলে আমাকে ধরে নিতে হবে আমার মেয়ে বেঁচে নেই। হয় তুমি তাকে খুন করিয়ে দিয়েছো। না হলে সে তোমার অত্যাচারের লজ্জায় নিজে আত্মহত্যা করেছে। তাই তো ? সরাসরি জানতে চায় সত্যের মাস্টার।
বালাই-ষাট! তা হবে কেন। বলে ফেললে শঙ্খ।
মেজদা বললে — তাহলে কোনটা ঠিক। অবস্থানটা কোথায়।
শঙ্খ বললে — মেজদা, আমার পক্ষে কি এর অবস্থান বলা সম্ভব। তুমি একটু বিবেচনা করে বলো।
মেজদা বললে — আজ হয়তো তোর কথা মতো অবস্থান বলা সম্ভব নয়। মেনে নিলাম। কিন্তু প্রথম থেকে তো এমন অবস্থা ছিল না। চলে যাওয়ার পর কি ব্যবস্থা নিয়েছিলি?
— পরিচিত জন। আত্মীয়-স্বজন। দু- চারজনের কাছে খোঁজখবর নিয়েছি। পরে থানায় মিসিং ডায়েরি করেছি। সংক্ষেপে উত্তর।
মেজদা বললে — চলে যাওয়ার কতদিন পর থানায় ডায়েরি করেছিস ?
— এক দেড় মাসের মধ্যেই হবে।
সত্যেনবাবু মুখ খুললে। বললে — সবকিছু করেছো তুমি। কিন্তু সর্বশেষ ফলটা কি হলো? কোন খবর নেই? তোমার হাত পা ঝাড়া। তাহলে কি আমার মেয়েকে তুমি খুন করে লাশ গায়েব করে দিয়েছো ? সেই মর্মে তোমার নামে থানায় এফ-আই-আর করে একটা মামলা ঠুকবো। কতো ধানে কতো চাল হয় দেখাবো। বেশ উত্তেজিত মাস্টার।
মেজদা বললে — আপনি শান্ত হোন মেসোমশাই, এই ঘটনায় একটা যে চক্রান্ত আছে। সেই কারণেই খোঁজ খবরেই অবহেলা চলছে, এটা আমার কাছে কিছুটা পরিষ্কার। এখন সমাধানের রাস্তা কোথায়? সেটা শঙ্খই বলুক।
শঙ্খ বললে — সেই রাতের ঘটনা আমি আগেও বলেছি। রাতে না ফেরার ঘটনায় জানতে চেয়েছি। বাইরে রাত কাটানোর জন্য নিন্দা করেছি, তাই নিয়ে বাধানুবাদ হয়েছে। ওর মুখে মুখে তর্ক করাটা সহ্য করতে না পেরে গায়ে হাত তুলেছি। রাতে স্বাভাবিক ছেলেমেয়ে নিয়ে একসঙ্গে খেয়েছি আমরা। ঘুমিয়েছি সকলে। সকালে উঠে দেখতে না পেয়ে বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি পাইনি। অপেক্ষা করেছি কয়েকটা দিন। তারপর বিভিন্ন জায়গায় খোঁজখবর নিয়ে পাইনি যখন। ডাইরি করেছি। এবারে আমার চাকরি আছে। বাধ্য হয়ে ছেলেদের বোর্ডিংয়ে ভর্তি করা। এসব তো ছেড়ে দিয়ে নিজেই দিনরাত খুঁজে বেড়াবো তা তো হয় না।
মেজদা বললে — মোটকথা এটাই হলো। বছর পেরিয়ে গেল মানুষটা ফেরেনি। আর কোনদিন ফিরবে না তাইতো?
শঙ্খ বললে — এ কথার কোন উত্তর আমার কাছে নেই।
সত্যেনবাবু বললে — কিন্তু এর উত্তর তো তোমাকেই দিতে হবে। তুমি ঘটনা ঘটিয়েছো। নিখোঁজ হওয়া বা মৃত্যু যেটাই হোক তার জন্য দায়ী কে?
শঙ্খ বললে — যে চলে গেছে দায় তার। তাকে তো চলে যেতে কেউ বলেনি।
মেজদা বললে — তোমার স্ত্রী বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। অকারণে নিশ্চয়ই নয়, সেই কারণটা তোমার সন্দেহজনক প্রশ্নবাণ। আচ্ছা তুমি তোমার স্ত্রীকে অসৎ বা অসচ্চরিত্রের এমন সন্দেহ করো?
শঙ্খ চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে। এর উত্তর তার কাছে নেই। ফাঁদে পড়া পাখির মতো বুকের ভিতর একটা ছটফটানি শুরু হয় তার। এ কথার কি কোন সমাধান সূচক বার্তা তার পক্ষে দেওয়া সম্ভব।
— কি হলো কথার উত্তর দাও? মেজদা বললে।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর শঙ্খ বললে — এ কথার কি উত্তর দেব।
সত্যেনবাবু বললে — তাহলে আমার মেয়ের মিসিং হবার দায় সম্পূর্ণ তোমার। একদিকে তোমার লোভ-লালসা অন্যদিকে তোমার কথা মতো না আনতে পারলে তোমার হিংসার আচরণ। পূর্বেও ঘটেছে। সেদিনও চরম পর্যায়ে ঘটেছে। এটাই আমার বিশ্বাস। তুমি তাকে খুন করিয়ে লাশ গুম করে দিয়েছো। আর এ বাড়িতে কেউ থাকবে না বলেই, ভাড়াটিয়া বসানোর তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছো।
— না- না, এভাবে বলবেন না বাবা। বিচলিত শঙ্খ।
সত্যেনবাবু বললে — তাছাড়া আর বলার কি আছে। আমি সার বুঝে নিয়েছি। আমি যেটা করা দরকার সেটা করবো। এ নিয়ে বছর ভোর অনেক কথার কচকচানি হয়েছে আর নয়। আর মেজবাবু, আজ রাতেই আমরা ফিরে যাবো। আর এক মুহূর্ত আমার এখানে থাকার প্রয়োজন নেই। মেয়েটা যেমন আমার কাছে আছে থাক ওর সারা জীবনের দায়িত্ব আমি নিলাম।
মেজদা বললে — আপনার সিদ্ধান্তে আমি বাধা দেব না।
শঙ্খ সেভাবেই মাথা নিচু করে বসে আছে। কথা বলার ভাষা তার মুখে নেই। শুধু তার শরীরটা কেমন তিরতিরিয়ে কেঁপে উঠল যেন।
বিকালে চা খাওয়ার পর বেরোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সত্যেনবাবু।
শুভ্র বললে — দাদু তোমরা কি এখন চলে যাবে ?
অভ্র বললে — কেন দুদিন থেকে যাও। আমরা তো সবে আজ এলাম। দিদাও চলে গেলে কার কাছে থাকবো আমরা? মা তো নেই।
কথাটা শুনে সত্যেনবাবুর বুকটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। কোন শব্দও মুখ দিয়ে বের হলো না।
দিদা বললে — বাড়িতে চাষের কাজ চলছে তো। তোমরা থাকো বাবার কাছে। শান্ত হয়ে থাকবে। আমরা পরে আবার আসবো। দিদার চোখে ছলছলে জল। দুই নাতীকে বুকে জড়িয়ে রাখল কিছুটা সময়।
পর্ব – ৩০
রিজিয়ার সুখের সংসারে হঠাৎই নেমে এসেছে ঘন কালো অন্ধকার। জেলা হাসপাতালে গুরুতর জখম অবস্থায় কয়েকদিন হলো ভর্তি রয়েছে আরশাদ। সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত আসমা পড়ে আছে রোগীর পাশে। এমন দুঃসময়ে আসমা যেন সংসারের অন্ধের যষ্টি। রিজিয়া কেঁদে বুক ভাসায়। ছেলে-মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আর্তনাদ করে।
— এ আমার কি সর্বনাশ হলো গো দিদি। আমি কি নিয়ে বাঁচবো এখন ?
— এভাবে বলতে নেই। মানুষের শরীর খারাপ হতেই পারে। সান্ত্বনা দেয় আসমা।
সেদিন নিয়মমাফিক সকালে খেয়ে দেয়ে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে যায় আরশাদ। আসমা পড়াতে বসে ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে। রিজিয়া সংসারের প্রাত্যহিকীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সূর্য বললে হয় তখন মধ্য গগনে। কে যেন এমন বিপদের খবর নিয়ে এলো তাদের ঝুপড়ির ঘরে। অসহায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলো রিজিয়া। কানাকানি হতে কিছু লোকজন জমা হলো ঘরের সামনে।
আসমা বললে — কি হয়েছে, ঠিক করে বলো তো ভাই ? কম বয়সী রোগা রোগা ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলে।
— প্যাসেঞ্জার নিয়ে সকাল থেকে যাতায়াত করছিল দাদা, দুপুরের সময় ভাড়া নামিয়ে গাড়ি ঘোরানোর সময় পেছন থেকে আসা একটা ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। রিকশা ভেঙে গেছে আর দাদার কোমরে পায়ে বেশ জখম হয়েছে। বাড়ি থেকে কেউ যেতে হবে সদর হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। ছেলেটা একদমেই কথাগুলো বলে ফেলল।
আসমা বললে — চলো ভাই আমি যাবো।
রিজিয়া বললে — আমিও যাবো।
আসমা বললে — তোমাকে যেতে হবে না। বাচ্চাদের নিয়ে থাকো। হাসপাতালে ভর্তি হলে লেখা জোকার ব্যাপার থাকবে। চলো ভাই। এক কাপড়ে বেরিয়ে গেল সে।
ডান পায়ের হাঁটু থেকে কোমরের অনেকাংশে ভেঙেছে আরশাদের। এক্সরে করে দেখে ভাঙা হাড় সেটিং করে দেখা চলছে। এরপর পুরো অংশটা প্লাস্টার করা হতে পারে। এক প্রকার অচৈতন্য হয়ে বেডে শুয়ে আছে আরশাদ। যন্ত্রণার ইঞ্জেকশনে চুপচাপ ঘুমিয়ে আছে। স্যালাইনের বোতল ঝুলছে মাথার কাছে। আসমা সমস্ত কাগজপত্র সই করেছে স্ত্রী হিসাবে।
সকাল থেকে সারাটা দিন হাসপাতালে কাটিয়ে রাত্রি করে ফেরে আসমা। রাত্রিটুকু একটু বিশ্রাম। পড়ানোর আপাতত ছুটি চলছে কটা দিন। একদিন ছাড়া বাচ্চাসহ রিজিয়াকেও নিয়ে যায়। ছেলে-মেয়ে বাপের মুখের দিকে শুধুই তাকিয়ে থাকে। কি হয়েছে- কেন হয়েছে, কিছুই বোঝে না তারা। বোবা কান্নায় বুক ভাসে রিজিয়ার। জীবনে এমন চরম আঘাত আসবে ভাবতেই পারে না সে।
রিক্সা স্ট্যান্ড থেকে দু চারজন করে রিক্সা চালক, রোজই প্রায় আসে হাসপাতালে। খবরা-খবর নেয় পরিস্থিতির। চাঁদা তুলে একদিন আসমার হাতে কিছু টাকা দিয়েছিল একজন।
— ভাবি, এই টাকাটা রাখেন। আপাতত এটা আমরা তুলেছি নিজেদের মধ্যে। ছেলেটা হাত বাড়িয়ে টাকাটা দিলে আসমার হাতে।
— তোমাদের অসুবিধা হবে না তো ভাই ? গাড়ি বন্ধ করে হাসপাতালে আসছো। চাঁদা পয়সা তুলছো। আসমা কিছুটা আফসোস করলে।
— না ভাবি, অসুবিধা নাই। তাছাড়া দাদা আমাদের সকলের কাছের মানুষ। ওর জন্য কিছু তো করতেই হবে। দাদাকে আমরা সকলেই খুব সম্মান করি। পাশের জন উৎসুক হয়ে বললে কথাগুলো।
চলতে থাকলো বেশ কটা দিনে এভাবেই। সংসারের খোলা দরজায় এবার অভাব এসে পৌঁছে গেছে। চিকিৎসার খরচ না থাকলেও যাতায়াত খরচ হয়। সংসারে বাচ্চা নিয়ে চার জনের খাবার জোগাড়। কিছুটা দিশেহারা আসমা- অসহায় রিজিয়া। খবর শুনে রিজিয়ার জ্ঞাতি সম্পর্কের ক’জন এসেছিল সেদিন। বাড়ি হয়ে হাসপাতালেও গিয়েছিলো। একপ্রকার জোর করে রিজিয়ার হাতে কিছু টাকা দিয়েছিল একজন। বলেছিলো –চিন্তা করিস না। তোর আব্বা নেই তো কি হয়েছে? আমি তো বেঁচে আছি এখনো। তোর দাদারা তো আছে। রিজিয়া শুধু ডুকরে কেঁদেছিলো সেই সময়। সামনের দিনগুলোর তাদের জন্য কি অপেক্ষায় আছে সে জানে না- বোঝেও না কিছু।
রাতে বিছানায় শুয়ে আসমা ভাবছিলো, আগামী দিনগুলোর কথা। কিভাবে চলবে। আরো কটা ছেলে- মেয়ে পড়ুয়া হিসেবে বেড়েছে সংখ্যায়। এটাকেই কিছুটা রোজগারের হাতিয়ার করার ভাবনায় রয়েছে তার। যেভাবেই হোক ক’জনার ডাল- ভাতের জোগাড় করতেই হবে। হাত পেতে সাহায্য নেওয়ার প্রত্যাশী সে নয়। দায়িত্ব বহন করার লক্ষ্যে সম্মানের সঙ্গে রোজগার করার পক্ষপাতি সে। ঘড়ির কাঁটার মতোই টিকটিক করে সময়টা এগিয়ে যায়। দিনের শেষে রাত। রাত পেরিয়ে আবার নতুন দিন। নয় নয় করে আজ তিনটে মাস হয়ে গেলো আরশাদ গত হয়েছে। ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর ধমক শরীর সামলে উঠতে পারেনি। পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলো সে।
অথৈ জলে রিজিয়ার পরিবার। বাবলু, সজল, আমিন ভাই সকলেই এসেছিল দাফনের কাজে। কাজ শেষে যাবার সময় রিজিয়া, আসমা দুজনকে দেখে আমিন ভাই বলেছিল — বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। আপনারা ভেসে যাবেন না। আমরা কিছু একটা ব্যবস্থার চিন্তাভাবনা করছি। কাশী বাবুর সঙ্গে সকালে আমার কথা হয়েছে। দু-একদিনের মধ্যে দাদাকে নিয়ে আপনাদের ঘরে আমরা আসবো। রিজিয়ার জ্ঞাতি কাকা, দাদারা চেয়েছিলো তাদের সঙ্গে চলে যাবার জন্য। কোচবিহার সীমান্তে তাদের বসবাস। পারাপারের কাজে আয় নাকি মন্দ নয়। সকলের সঙ্গে সেটিং আছে। অসুবিধার নেই। তোদের থাকা- খাওয়ার অভাব হবে না। রিজিয়া আপাতত না করে দিয়েছে। যদি অসুবিধা হয় তখন অবশ্যই যাবো। বলে দিয়েছে দাদাদের।
রাতের অন্ধকারে বিছানায় পিঠ পেতে দুটো মানুষ একটু আলোর সন্ধান করার কথা ভাবতে থাকে। আসলে কেউ কাউকে ছেড়ে যেতে চায় না। রিজিয়া ভাবে, দিদি আমাদের জন্য নিজের ছেলেমেয়ে সংসার ফেলে চলে এসেছিলো। কতোদিন হয়ে গেলো। বছরের পিঠে বছর চলে গেলো। ধর্ম খুইয়ে আমাদের আপন করে নিলে। আজ ওকে ছেড়ে একা ফেলে রেখে কোথাও যাবো না। না খেয়ে থাকলেও সকলেই শুখবো। আসমা জীবনের হিসেব-নিকেশের শেষ অধ্যায়ে। যেভাবেই হোক এদের কষ্টের সময় হাল ধরতেই হবে। বাচ্চা দুটোকে মানুষ করতেই হবে। বাচ্চাদের পড়ানো টা কিছুটা পেশা হিসেবে এগোতে হবে। একটু একটু করে সংখ্যায় বেড়েছে ছাত্রছাত্রী। এমন ধারাবাহিকতা থাকলে আমাদের অসুবিধা হবে না।
দিন পনেরো পর কাশীনাথ বাবু, সজল, বাবলু, আমিন ভাই আরো জনা দুই মিলে আরশাদের ঝুপড়ির ঘরে এসেছিল। একটা সুরাহার আশ্বাসে। কাশীনাথ বাবু বললে — তুমি তো বাচ্চাদের এই ঘরে পড়াচ্ছো এখন। আমি এমএলএ সাহেবের সাথে কথা বলেছি। তুমি যদি এটাকে “শিশুশিক্ষা কেন্দ্র” হিসাবে চালাতে চাও তাহলে সরকারি সাহায্য পাবে। বই- খাতা’ সিলেট- পেন্সিল, ব্ল্যাকবোর্ড যাবতীয় জিনিস তুমি পাবে প্রতি মাসে প্রয়োজন মতো। তুমি একটা মাসিক ভাতা পাবে। পড়ানোর সাথে সাথেই পড়ুয়ার জোগাড় তোমাকেই করতে হবে। আমিন ভাই বললে — ছাত্র-ছাত্রী জোগাড় করতে বস্তির ঘরে ঘরে যাওয়ার জন্য আমরা তোমার সঙ্গে সময় দেবো। তাতে অসুবিধা নেই।
আসমা বললে — আপনারা সাহায্য করলে অবশ্যই ছেলে-মেয়ের সংখ্যা বাড়বে। আমার দিক থেকে ওদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিতে কোন অসুবিধা নেই।
কাশীনাথ বাবু বললে — আগামী বুধবার বি ডি ওর শিশু শিক্ষা মিশন থেকে এনকোয়ারি করতে আসবে। রোজের মতো বাচ্চারা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে পড়তে আসবে। পড়ানোর জায়গা একটু সাফসাফাই করে রাখবে। এনকোয়ারী না হওয়া অবদি কাউকে ছুটি দেবে না।
সকলেই চলে গেল। অসহায় আসমা বর্তমান অন্ধকার জীবনে একটু আশার আলো দেখে। রিজিয়া অনেক কিছু না বুঝলেও তবে এটুকু বুঝেছে, আজ যে মানুষটা নিজের সর্বস্ব হারিয়ে অসহায় ছিলো। আজ সে আমার অসহায়ের সহায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের উপকার পাওয়া সেদিনের মানুষটা, আমাদেরই উপকারের জন্য নিজের সর্বস্ব খুইয়ে ছুটে এসেছিলো। ফিরে যাবার কোন রাস্তা ছিলো না তার জীবনে। আমাদের আশ্রয়ে জীবন বাঁচিয়েছিলো। আজ সেই মানুষটা আমাদের তিনটে প্রাণের দায়িত্ব নিতে তৎপর হয়েছে। চোখের কোনটা কেমন চিকচিক করে উঠলো রিজিয়ার। মৃত আরশাদ আজ নতুন করে জীবিত হলো, নিজেরই ঝুপড়ির ঘরে “আরশাদ শিশু শিক্ষা কেন্দ্র” নামে একটা বোর্ড লাগানো হলো। উদ্বোধন করতে বেশ কিছু লোকজন এসেছিলো। কাশীনাথ বাবু, বি ডি ওর এক প্রতিনিধি। দু-একজন সামান্য সময়ের বক্তব্য রেখে সকল অভিভাবকদের ছেলে-মেয়ে কে পড়াশোনার ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ করলেন। আগামী দিনে বেশি ছেলে- মেয়ে পড়াশোনা করতে নতুন করে স্কুল ঘর করে দেওয়ার কথা বলেন।
দিন যায়। রাত যায়। সময়ের পিঠে চেপে সময় চলে ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে। বস্তির ঝুপড়ি ঘরে “শিশুশিক্ষা কেন্দ্র” আজ এলাকার চেহারা বেশ কিছুটা পাল্টে দিয়েছে। ঘরের কাছাকাছি কলতলায় এখন আর আগের মতো চিৎকার- চেঁচামেচি হয় না। হাঁড়ি- থালার ঝনঝনানি নেই। বালতি ভরে জল নিয়ে রাস্তায় চান করার সেই চেনা দৃশ্য আজ উধাও। মানুষগুলো কেমন যেন একটু- একটু করে পাল্টাতে শুরু করেছে। জীবন যাত্রার মান হয়তো পরিবর্তন হয়নি তেমন। তবে একটু হলেও আচার-আচরণে একটা বদল হয়েছে। এখন অনেক ঘরের বাচ্চারা পড়তে আসে বই- সিলেট, পেন্সিল- খাতা- কলম ছেলেমেয়েরা এমনিতেই পাচ্ছে। এখন কোন কিছু কিনতে লাগে না পড়ানোর জন্য। রুক্ষ পরিবেশ কেমন একটু একটু করে যেন সবুজায়ন হতে চলেছে। যে আসমা একদিন বস্তির ঘৃণার খোরাক হয়ে উঠেছিলো। সকাল থেকে চা গুমটিতে তার নামে আরশাদ কলঙ্কিত হতো। বাদ প্রতিবাদে দুটো শিবির গরম হয়ে থাকতো। নষ্টামির গন্ধ শুঁকতো কিছু মানুষ।
সেই মহিলা আজ বস্তির লক্ষ্মী। মানুষ গড়ার কারিগর। সকলের কাছে না হলেও অনেক মহিলা ছেলে-মেয়ের হাত ধরে তাকে এসে সালাম জানায়। ঋতু পরিবর্তনের মতো কতো মানুষের পরিবর্তন হয়েছে বস্তিবাসীর মধ্যে।
জয়নাল আবেদিন | Joynal Abedin
ট্যাটুর ইতিহাস ও আমরা | History of Tattoo | Reasons for using tattoos | 2023
Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্শা ও তাৎপর্য | 2023
Rabindranath Tagore’s love for art and literature
Porokia Prem Ekaal Sekaal | পরকীয়া প্রেম (একাল সেকাল) | 2023
Shabdodweep Web Magazine | Online Upanyas in Bengali | Episodic Bengali Novel
In today’s digital age, the way we access literature has changed dramatically. No longer are readers limited to physical copies of books, especially when it comes to Bengali literature. The rise of online platforms has made it easier than ever to explore the richness of Bengali fiction, from classic works to contemporary stories. One of the most popular trends in the Bengali literary world is reading online Upanyas in Bengali (episodic Bengali novels). Whether you are a seasoned reader of Bengali literature or just starting to dive into the world of Bangla fiction, online Upanyas provide an excellent opportunity to engage with new and exciting content.
Here, we’ll explore the growing popularity of online Upanyas in Bengali, the convenience of buying Bengali books online, and how you can access some of the best-selling and rare Bengali books online, including thriller books, historical fiction, and more.
The Rise of Online Upanyas in Bengali
In traditional Bengali literature, Upanyas refers to novels, often written in episodic formats. The beauty of online Upanyas lies in their accessibility. Readers can enjoy their favorite novels chapter by chapter, over time, without needing to wait for a physical release. This shift to digital formats has revolutionized the way Bengali books are consumed. Readers now have the ability to access a wide variety of Bengali fiction books from the comfort of their homes, making it easy to read Bengali books online free or purchase them via trusted platforms.
Why Read Online Upanyas in Bengali?
Online Upanyas in Bengali provide an immersive experience that combines the traditional charm of Bengali literature with the convenience of modern technology. Here’s why you should consider reading online Upanyas:
Ease of Access: No need to visit physical bookstores or libraries. You can search Bengali ebooks online or access free digital editions from websites like Shabdodweep.
Variety: The world of Bengali Upanyas is diverse, with genres ranging from historical fiction to thrillers. You can find everything from Kahini Bengali Book PDF Download to Bengali fiction books covering themes of love, betrayal, and adventure.
Cost-Effective: Many platforms offer free Bengali books or affordable eBook options. You can explore collections like rare Bangla books or famous works without burning a hole in your pocket.
Episodic Experience: Online Upanyas often release chapters periodically, which creates suspense and keeps you coming back for more. These serialized stories encourage readers to engage deeply with the plot over time.
Convenient for Busy Lives: With smartphones and digital devices, readers can enjoy their favourite Bengali novels online anytime, whether they’re commuting, taking a break, or relaxing at home.
Famous Writers of Online Upanyas in Bengali
When talking about online Upanyas in Bengali, one cannot ignore the contribution of talented writers who have made their mark in the digital space. One such writer is Joynal Abedin, whose novel Khuje Feeri Vishalyakarani has captivated readers on Shabdodweep Web Magazine. Known for his gripping narratives and deep understanding of human emotions, Joynal Abedin’s work has become a favourite among readers of online Upanyas in Bengali.
FAQs About Online Upanyas in Bengali on Shabdodweep Web Magazine
- Where can I read Online Upanyas in Bengali?
You can read a wide range of online Upanyas in Bengali on Shabdodweep Web Magazine. We offer a variety of episodic Bengali novels, including thrillers, historical fiction, and children’s stories, available for free or for purchase. - Can I download Bengali novels for free?
Yes, Shabdodweep Web Magazine offers several Bengali novels for free download in PDF format. You can find Kahini Bengali Book PDF Download and many more at no cost. - Who is the writer of the famous novel ‘Khuje Feeri Vishalyakarani’?
The renowned writer Joynal Abedin penned the popular online Upanyas Khuje Feeri Vishalyakarani, available to read on Shabdodweep Web Magazine. His work has been widely appreciated by readers for its compelling storytelling and deep emotional resonance.
Conclusion
Online Upanyas in Bengali have become an essential part of the Bengali literary world, offering readers access to a wide variety of genres and stories. With platforms like Shabdodweep Web Magazine, you can explore an extensive collection of Bengali books, from thrilling novels to historical epics, and enjoy them at your convenience. Whether you want to read Bengali books online free or purchase the latest best-sellers, there’s something for everyone.
Don’t miss out on discovering the best Bengali literature available today. Visit Shabdodweep Web Magazine and immerse yourself in a world of captivating Bengali Upanyas. Happy reading!
Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio