Best New Bengali Famous Story | বিষণ্ণ বিদায়

Sharing Is Caring:

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১) – প্রবোধ কুমার মৃধা

খোকা,

এই কাগজখানা যখন তুই হাতে পাবি তখন আমি অনেক দূরে চলে যাব।এটি তোর ব্যাগের মধ্যে রেখে গেলাম; না হলে গায়েব হয়ে যেতে পারে। আমাকে খোঁজাখুঁজি করিস নে,বার যখন হয়ে পড়েছি আর ফিরব না ।নতুন করে লাঞ্ছনা গঞ্জনার‌ মুখোমুখি আর হতে চাই না।

সংসারে অশান্তির কারণে তোকে কোনদিন কিছু জানাইনি।নীরবে মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করে এসেছি। এখন অবস্থাটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। বৌমার ভাই-ভাজের সঙ্গে তার বাবা মায়ের তেমন বনিবনা হচ্ছে না, তারা বছরের অধিকাংশ সময়টা মেয়ের বাড়িতে কাটাতে চায়। বৌমার তাতে সম্মতি এবং আগ্ৰহ খুব‌ই; এই মর্মে তাদের পরামর্শে আমাকে‌ বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করবে খুব শীঘ্র।

সংসারের জন্য প্রাণপাত করেছি। এই সংসার ছাড়ার কথা কোনোদিন চিন্তায় আনতে পারিনি। দাদুভাইরা আসার পর সংসারের মায়ায় আরো‌ জড়িয়ে গেছি। কত কিছু ছেড়ে, কতটা ত্যাগ স্বীকার করে বার হয়ে এসেছি তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন। তুই সব সময় অফিসের কাজে ব্যস্ত, তাই বিশ্বাস করে আমার দায়িত্ব বৌমার উপর ছেড়ে নিশ্চিন্ত থেকেছিস, কোনোদিন সেভাবে কোন খোঁজখবর রাখতে পারিসনি। কিন্তু বৌমা খুব স্বার্থপর।

কী ছেড়ে গেলাম, কতটা ছেড়ে গেলাম, তোকে বোঝাতে পারব না। চোখের জল কোন সময়ের‌ জন্য শুকাচ্ছে না,তবে ক’টা দিন পার হয়ে গেলে অনেকটা সামলে উঠতে পারবো; তুই চিন্তা করিস নে। সবাই ভালো থাকিস।

–- তোর মা

প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যে উঠে পড়ে গার্গী। তার বহু আগে বিছানা ছাড়েন আনন্দময়ী,গার্গীর শাশুড়ি‌। তেমন কোন গৃহকর্ম থাকে না,তবু এটি তাঁর বারো মাসের অভ্যাস। বাথরুম থেকে বেরিয়ে গার্গী রান্নাঘরে ঢোকার মুখে দেখল শাশুড়ির ঘরের দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি‌ লাগানো, ভিতরে অন্ধকার ।এমনটা তো কোনদিন হয় না। ঘরের দরজা শীতকাল ছাড়া বরাবরই ভোর থেকে খোলা থাকে, ভিতরে আলো‌ জ্বলে। গার্গী দরজা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। ঘর ফাঁকা, ভিতরে কেউ নেই। কলতলা, রান্নাঘর ঘুরে কোথাও শাশুড়িকে দেখতে পেল‌‌ না সে। কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষে স্বামীকে জাগিয়ে তুলল।ছেলে মেয়ে দুজন অকাতরে ঘুমিয়ে ।আধো ঘুম চোখে ব্যাপারটি শুনে মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে এল শেখর। মায়ের ঘর, বাস্তুর চারদিক, ছাদ, সর্বত্র সন্ধান করল, কোথাও মাকে পাওয়া গেল না। তাদের নতুন পল্লীর সব ঘরের সবাই তখনও ওঠেনি। আনন্দময়ী‌ যে যে বাড়িতে যাতায়াত করতেন সেই সমস্ত জায়গায় গিয়ে জানা গেল, সেখানেও যাননি। অবাক কাণ্ড! মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে একটা মানুষ হাওয়া হয়ে গেল! কোন রকম সম্ভাব্য ধারণা‌ মাথায় আনতে পারল‌ না শেখর। ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে কিছু জানতে চাইল সে। গত রাতে মা কি খেয়েছিলেন, মায়ের শরীর সারাদিন কেমন ছিল, কোনখানে যাওয়ার কথা বলেছিলেন কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে বহু প্রশ্ন করে মায়ের গতদিনের‌ অবস্থান সম্পর্কে অবগত হতে চাইল শেখর। তারপর‌ গার্গীকে ফোনটা এনে দিতে বলল।

— কোথায় ফোন করবে?
— দেখি, বাসন্তীর ওখানে গেল কি না।
বাসন্তী শেখরের একমাত্র বোন। ডায়মন্ডহারবারে‌ তার শ্বশুর বাড়ি ।অনেক সময় একা একা সেখানে গিয়েছেন আনন্দময়ী।
…. না! বাসন্তীর ওখানে যাননি মা। খবর নিল মামার বাড়িতে। সেখানেও না।
কী খবর গার্গী জানতে চাইল স্বামীর কাছে ।উত্তরে শেখর জানাল,
–- বাসন্তীর ওখানে বা মামাদের ওখানে কোথাও যাননি মা।
বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল শেখর, দিশেহারা অবস্থা তার।আশে পাশের বাড়ির থেকে বয়স্ক কয়েকজন ততক্ষণে চলে এসেছেন। শেখর যেন কিছুটা স্বস্তিবোধ করল। এ অবস্থায় অভিজ্ঞ মানুষ জনের সুপরামর্শ খুব‌ই জরুরি। আগত ব্যক্তিগণ সবাই তাকে অবিলম্বে থানাতে ডায়েরি করার কথা বললেন। শেখরও ঠিক এই কথাটাই চিন্তা করছিল। এছাড়া অন্য কোন পন্থা সে আপাতত দেখছিল না।

কাগজ কলমের প্রয়োজনে শেখর উঠে ঘরের মধ্যে গেল। কিন্তু ব্যাগটি পাওয়া যাচ্ছিল‌ না, হঠাৎ মনে পড়ল, গতকাল অফিস থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মায়ের ঘরে‌ ব্যাগটি রেখেছিল সে। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল যেখানেই রেখেছিল সেখানেই আছে বস্তুটি। ব্যাগটি নিয়ে বারান্দায় এসে খুলে কাগজ‌ কলম বের করতে গিয়ে পাওয়া গেল একটা ভাঁজ করা কাগজ।‌ এখানে এমনভাবে কোন কাগজ তো শেখর রাখেনি!‌ কৌতূহল বশে সেটি খুলে দেখল পাতা ভর্তি লেখা। মুহূর্তে চিনতে পারল মায়ের হাতের অপটু অক্ষরগুলিকে।এক নিঃশ্বাসে‌ পড়ে ফেলল বেশ খানিকটা, তারপর পড়া অসমাপ্ত রেখে কাগজটি হাতে ধরে হতভম্বের মতো শূন্যে চেয়ে বসে র‌ইলো। কয়েকটা মুহূর্ত। চোখ থেকে জল গড়িয়ে এল। বিস্মিত সবাই জানতে চাইল, কী হলো! একটু ধাতস্থ হয়ে শেখর মায়ের লেখা চিঠিটির প্রথম কয়েক ছত্র সবাইকে পড়ে শোনাল।সকলেই নিশ্চিত হতে পারল যে,আনন্দময়ী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।

চিঠির অবশিষ্ট অংশটুকু শেখর আর পাঠ করল না। এবং তা ইচ্ছা করেই। পড়শির বিপদে যে ক’জন সহানুভূতিও সৌজন্যবশত‌ এসেছিলেন, তাঁরা অনেক দুঃখ প্রকাশ করে সান্ত্বনা ‌দিয়ে উঠে পড়লেন। তবুও একটা ডায়েরি করে রাখা দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করলেন প্রায় সকলেই। ছেলেমেয়ে দুজন উঠে পড়েছিল।গার্গী তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শেখর উঠে আবার মায়ের ঘরে গেল।একা একা চিঠিখানা বার কয়েক পড়ল। চোখে জল আর নেই। বুকের মধ্যে একটা অব্যক্ত হাহাকার থেকে থেকে মনটাকে বিষণ্ণতার অন্ধকারে নিমজ্জিত করছিল। তার‌ আত্মীয়জন এবং একান্ত আপন জনের অমানবিক আচরণের কারণে মা আজ গৃহছাড়া। হতাশা, রাগ, ক্রোধ, সব মিলিয়ে তার মনের মধ্যে একটা ঝড় ব‌ইছিল। ছেলে মেয়ের সামনে কোন রকম হঠকারিতা না দেখিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। এক সময় থানার প্রসঙ্গ টেনে পরিচিত অন্তরঙ্গ বন্ধু বান্ধবের সাথে পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেল শেখর।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ২) – প্রবোধ কুমার মৃধা

সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আগমন ঘটতে থাকল। পাড়ার লোকজন তো দল দল আসছে, ফিরে যাচ্ছে ।একা গার্গীর পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গার্গীর মা সৌজন্য বশতঃ জামাইকে সমবেদনা জানাতে এসেছেন। গার্গীর বাবার শরীর খারাপ থাকার কারণে আসতে পারেননি। শেখরের দুই মামা ও দুই মামি একটু বেলার দিকে এসে পৌঁছলেন। মা-য়ের বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হ‌ওয়ার খবর পেয়ে শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে সকালে চলে এসেছে বাসন্তী। অফিসে জরুরি প্রয়োজন থাকায় দেবাংশু আসতে পারেনি; তবে অফিস ঘুরে সন্ধ্যার পর আসবে বলে জানা গেল। আত্মীয় আর পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই নিজেদের মধ্যে নানান কথার আলোচনা সমলোচনা করতে থাকল। তাদের মুখে হাজারো প্রশ্ন। বেশির ভাগ জনে নিজেরা প্রশ্ন করছে আবার নিজেরাই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে দিচ্ছে ।আনন্দময়ীর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে এক এক জনের এক এক রকম অভিমত। শাশুড়ি-বৌমার মধ্যে খুব যে একটা সোহগ-সৌহার্দ্য ছিল না, তা কমবেশি সকলেই অবগত ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে এবং এমন চরম পরিণতি ঘটবে এতটা কেউ অনুমান করেনি।

পাশের বাড়ির ন’গিন্নি গার্গীকে জিজ্ঞেস করল – হ্যাঁ বৌমা, তোমরা কোন আভাস – ইঙ্গিত পাওনি?
-– না খুড়িমা, ঠিক এমন চিন্তাটা আমাদের ভাবনায় আসেনি কোনদিন। উত্তর দেয় গার্গী।
–- আমরা তো ভাবিনি, মেজদি এমনভাবে চলে যাবে।
–আমরাও কি ভেবেছি? কার সংসারে না টুকটাক ঠোকাঠুকি হয়?তাই বলে ছেলে-বৌ, নাতি-পুতি ফেলে রেখে চলে যেতে হবে, এটা কোন কথা হলো! একটু ঝাঁঝভরে কথাগুলো‌ গড়গড় করে বলে ফেলে সবার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে র‌ইল বড়বাবু নৃপেন ঘোষালের মা।

বাসন্তী সবার সাথে বেশ কিছুক্ষণ বসেছিল, কোন কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না তার; মাঝে মাঝে দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছিল।‌ অভুক্ত শাশুড়ির জন্য একসময় উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। গার্গী সেখানে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। দুই মামি‌ তাকে সাহায্য করছিল। সপ্তর্ষি ও সুজাতা আজকের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে কিছুটা হলেও হকচকিয়ে গিয়েছে।আসলে আজ সমস্ত বাড়িটার স্বাভাবিক ছন্দটা কেটে গিয়েছে। শেখর সেই যে থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল এখনও পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে আসেনি। তার অফিস, ছেলে মেয়ের স্কুলে যাওয়া, সব আজ বন্ধ। মাকে দিদির বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ঘন্টা খানেক পরে গার্গীর ভাই ঘরে ফিরে গেল। বাবার শরীর খারাপের কারণে গার্গী থাকার জন্য জোরাজুরি করল না; তাছাড়া এ-অবস্থায় আত্মীয়তা পালনের প্রশ্ন‌ই নেই। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন যেমন স্বেচ্ছায় আসছে তেমন সৌজন্য সহানুভূতি জানিয়ে ফিরে যাচ্ছে, কারও কিছু মনে করার বা আপ্যায়নের ভালো-মন্দ বিচার করার সময় এটা নয়। সবাই একটা দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে।

শেখরের দুই মামা বারান্দায় চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিলেন। সবাই তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন শেখরের জন্য। সে না ফেরা পর্যন্ত পরবর্তী করণীয় কিছুই ঠিক করা যাচ্ছে না; সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মলিন মুখে ঘরে ফিরে এল শেখর। বাড়িতে প্রচুর লোকজনের সমাগম। দুই মামাকে দেখে শেখর তাদের কাছে গিয়ে বসল। মেজো মামা তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করল –কোন ব্যবস্থা করা গেল শেখর?
–- ব্যবস্থা বলতে মামা, …থানায় একটা প্রাথমিক ডায়েরি করে রাখলাম। আমার কয়েকজন পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাহায্যে কয়েকটি অনুসন্ধান সংস্থায় ইনফরমেশন পাঠিয়েছি। মায়ের ছবি দিয়ে এবার দু’একটা সংবাদপত্রের নিরুদ্দেশ কলমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
–- বেতার মারফত অনুসন্ধানের একটা ব্যবস্থা করলে বোধহয় ভালো হতো।
–- হ্যাঁ মামা, সে ব্যবস্থাও করার ইচ্ছা‌ আছে। কাল-পরশু অফিসে না গেলে কিছু করতে পারছি না। আমাদের স্টাফের ‌একজনের এক আত্মীয় রেডিও অফিসে কাজ করে।

শেখরের ছোট মামা কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন – দিদি একা একা কোথাও যেতে তেমন সাহস করতনা। কী এমন হলো যে, এই রকম একটা দুঃসাহসিক ঝুঁকি অনায়াসে নিয়ে ফেলল! ভাবতে অবাক লাগে! মামার কথাগুলো শেখর নীরবে শুনে গেল। গ্ৰহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা শেখরও দিতে পারল না সংসারে শাশুড়ি-বৌ বা অপরাপর সদস্য যারা থাকে তাদের মধ্যে অনেক সময় মান-অভিমান বা মনোমালিন্যের কারণ ঘটে থাকে কমবেশি সব সংসারে। কিন্তু সংসার ছাড়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্ৰহণের কারণ সামান্য হতে পারে না। মায়ের চিঠির প্রেক্ষিতে শেখর তা অনেকটা উপলব্ধি করতে পেরেছে; তবে তা বিশ্লেষণ করে কাউকে বোঝানো বোধকরি ঠিক হবে না। মেজো মামা শেখরের কাছে জানতে চাইলেন – তোর মা না কি চিঠি লিখে রেখে গেছে, কী লিখেছে তাতে?

যত‌ই নিকট বা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হোক না কেন, মায়ের চিঠিখানা দেখানো বা তার বিষয়বস্তু সমস্ত সর্বসমক্ষে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সাংসারিক তথা সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বলে শেখরের ধারণা। সে মামাকে বলে – মায়ের চিঠিতে তেমন কিছু নেই মামা ।মূল বক্তব্য হলো, সংসারের বোঝা হয়ে থাকতে নারাজ, তাই চলে গেছেন। অকারণ তাঁকে যেন খোঁজাখুঁজি করা না হয়। …এই জাতীয় সব বক্তব্য।
–- মানুষ‌ মারা গেলে সে যে আর কখনোই ফিরে আসবে না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হ‌ওয়া যায়। কিন্তু বেঁচে আছে অথচ তার কোন সংবাদ বা সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না; ব্যাপারটা খুবই বেদনাদায়ক! নানাভাবে অনুসন্ধান‌ করার চেষ্টা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই খোকা, ছটফট করারও কিছু নেই।
সান্ত্বনার ছলে মেজো মামা কথাগুলো আউড়ে চলেন। তারপর শেখরকে উদ্দেশ্য করে‌ বলেন – বাড়িতে লোকজন তো আছে। দু’একজন আসতেও‌ পারে।তোর মামিকে গোটা-দুই ব্যাগ দিতে বলতো, বাজার থেকে একবার ঘুরে আসি।
মেজো মামা বরাবর‌ই বেশ করিতকর্মা মানুষ, যে বৈশিষ্ট্যের জন্য শেখর মামাকে খুবই পছন্দ করে। সে নিজে রান্নাঘর থেকে দুটো ব্যাগ নিয়ে এসে কিছু টাকা সমেত মামার হাতে ধরিয়ে দিল।

সন্ধ্যার পর মামা-মামিরা সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে‌ পড়লেন। সারা দিনের শেষে দাদাকে একান্তে পেল বাসন্তী। জানতে চাইল মায়ের কথা।
–- দাদা, মা তোমাকে কোনদিন কিছু জানিয়েছিল?
দু’মিনিট চুপ থেকে শেখর বলল – ন! বাড়ি ত্যাগ করে যাওয়ার মতো কোন কারণ আমাকে জানায়নি; তবে মায়ের চিঠি পড়ে কারণটা জানতে পারলাম।
–- চিঠিতে নিশ্চয়‌ই বৌদির প্রসঙ্গ আছে? আর তার বাবা মায়ের ভূমিকার কথা?
–- তুই এতকিছু জেনেও আমার কাছে তো কিছু বলিস নি? মা এবং গার্গীর পারস্পরিক সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না তা প্রথম থেকেই জানতাম। কিন্তু এত বছর পর সেই সম্পর্কের মধ্যে গোপনে এতটা অবনতি ঘটেছে এবং তাতে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ইন্ধন যুগিয়ে আসছেন,আদৌ বুঝতে পারিনি। সামনা-সামনি গার্গীর ব্যবহারে কোন অসঙ্গতি লক্ষ্য করিনি আর মা আমাকে কোনদিন কিছু বিন্দুমাত্র জানাননি! আক্ষেপ ফুটে ওঠে শেখরের গলায়। নিজেকে অপরাধী মনে করে সে।। দাদার কথার প্রেক্ষিতে বাসন্তী জানায় – গত মাসে মা‌ আমাদের‌ ওখানে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিল; তবে কোন কথা‌ তোমাকে জানাতে নিষেধ করে।

পাখি উড়ে যাওয়ার পর খাঁচার সুরক্ষা নিয়ে ভাবনা করে মানুষ। মায়ের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে উদাসীন এবং এড়িয়ে থাকার অপরাধবোধ এখন কুরে কুরে খাচ্ছে শেখরকে। সেই দুঃখ-যন্ত্রণাটা সহোদরা বাসন্তীর সঙ্গে শেয়ার করতে পারায়‌ অনেকটা স্বস্তিবোধ হলো তার। ভিতরে ভিতরে এতটা ধ্বস নিয়ে সংসারটা যে দাঁড়িয়েছিল‌ বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবতে গিয়ে শেখর সঠিক কোন দিশা খুঁজে পায় না। এখন সমস্ত কিছুর মধ্যে ধৈর্য ধারণ করাটাই যে মূল চাবিকাঠি তা কিন্তু শেখর গভীরভাবে উপলব্ধি করত পারছে। কান্না থামছে না বাসন্তীর। শেখর তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, সান্ত্বনা দেয়। মা যে বেঁচে আছেন সে কথা বলে নানা উপায়ে মায়ের সন্ধান করার প্রতিশ্রুতি দেয় সে। ভাই-বোনের কথার মাঝে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেবাংশু। বাসন্তী উঠে গিয়ে সমাদরে তাকে মায়ের ঘরে নিয়ে যায়; ছেলে-মেয়ের খোঁজখবর নিতে শেখরও উঠে পড়ে।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৩) – প্রবোধ কুমার মৃধা

অনেক কষ্ট, অনেক দুর্ভোগ সহ্য করে বহু পথ ঘুরে ঘুরে পাঁচ দিনের মাথায় বৃন্দাবনে পৌঁছলেন আনন্দময়ী। সারা পথের পরিশ্রম আর দুশ্চিন্তার শেষে বৃন্দাবনে যে পা রাখতে পেরেছেন এই ভাবনাটাই তাঁকে স্বস্তি দিল। এখানে রাধামাধবের চরণে কোথাও না কোথাও ঠাঁই একটা মিলে যাবে। সপ্তর্ষি-সুজাতা তখন জন্মায়নি। স্বামীর সাথে উত্তর ভারত ভ্রমণে এসে বৃন্দাবনে দুটো দিন কাটিয়েছিলেন আনন্দময়ী। সেদিনের বৃন্দাবনধামের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে আজ।প্রকৃতির আপন রূপসজ্জা ছাপিয়ে নাগরিক সভ্যতার প্রলেপ কমবেশি সর্বত্র চোখে পড়ে।

মথুরা স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে ওখানে কেটে যায় এক রাত। পরের দিন যমুনা পেরিয়ে এসে ওঠেন বৃন্দাবনধামে। বৃন্দাবনের ঐতিহ্য হল, এখানে খাওয়া পরার অর্থাৎ ভাত-কাপড়ের অভাব হয় না। যে কোনো একটা মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিলে দুবেলা প্রসাদ পাওয়া যায়। শেঠজিদের মন্দিরে প্রায় সময় বস্ত্র বিতরণ করা হয়। বিশেষ করে ষাটোর্ধ বিধবাদেরকে বহু মন্দির বা আশ্রমে সহানুভূতির সাথে আশ্রয় দানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। একাধিক ভজনাশ্রম আছে যেখানে‌ মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে বহু অসহায় নরনারী সেবাদান আর ভজন সাধন করে সময় কাটান। সেবাদান কর্ম বিভিন্ন ধরণের আছে, যেমন আশ্রমের বাসন ধোওয়া, ঘর- দুয়ার মোছা, প্রসাদ পরিবেশন, ভোগ রন্ধনে সাহায্যদান ইত্যাদি। নির্দিষ্ট কোনো একটি আশ্রমে দীর্ঘদিন ধরে একনিষ্ঠভাবে সেবাদান করে গেলে পরে পরে একটা স্থায়ী পদে তার পদোন্নতি হয়।

বৃন্দাবনের প্রায় সমস্ত আশ্রমে নিয়মিত ভোর তিনটে নাগাদ স্নান করে সাধন-ভজনে অংশগ্ৰহণ বাধ্যতামূলক। এই ভজন কীর্তন সকাল সাঁঝে দুবেলাই হয়ে থাকে। কিছু কিছু পালনীয় বিধি নিষেধ বা নিয়মকানুন আশ্রমবাসী সেবায়েতদের মেনে চলতে হয়; যেমন, মাথার চুল ছোট করে কাটতে হবে, শ্বেত চন্দনের তিলক কপালে, কর্ণমূলে ধারণ করতে হবে। দিবসের কোনো একটা সময় মাধুকরী বৃত্তির অনুশীলন সাধনমার্গীদের পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হয়। প্রথম দুটি মাস আনন্দময়ী বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে ঘুরে আশ্রয় নিয়ে কাটালেন।এরমধ্যে একদিন দুই পরিচিতা বিধবার সঙ্গী হয়ে রাধাকুন্ডে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। রাধাকুন্ডে অধিক সংখ্যক বাঙালির বাস।নিজের ভাষায় কথা বলে অনেকটি তৃপ্তি হল বটে, মনের স্থিরতা বা মানসিক শান্তি তেমনভাবে মিলল না।

বৃন্দাবনে বিভিন্ন প্রকারের মানুষ এসে জড়ো হয় পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেকে সংসারের জ্বালা -যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতে স্বেচ্ছায় চলে আসেন। বিধবাদের মধ্যে বেশির ভাগ‌ই এসেছেন পরিবার-পরিজনের অত্যাচার, অনাদর-অবহেলায় বাধ্য হয়ে। তবে বৃন্দাবনে যে যে-কারণেই আসুন না কেন, অন্তরের ভক্তি ছাড়া মুক্তি বা শান্তি এখানে নেই। ভক্তি ছাড়া কৃষ্ণপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। তাই অনেকেই কিছুদিন এখানে কাটিয়ে ভক্তির অনুশীলনে ব্যর্থ হয়ে আবার স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করেন। অনেকে দু-চার দিন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বৃন্দাবনে এসে কিছু অর্থ-কড়ি ব্যয় করে আবার অন্যত্র পাড়ি জমান।এই জাতীয় মানুষজনের কেবল ভ্রমণটাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, সাথে কিছু ধর্ম সঞ্চয়ের বাসনা অন্তর গভীরে কাজ করে।

বৃন্দাবনে প্রায় ৬০০০ আশ্রম, বহু বৃদ্ধাবাস, বিধবাশ্রম, ‘গিল্ড অফ সার্ভিস’ নামে একটি সংস্থা, এছাড়া বহু এন-জি-ও আছে যারা বৃন্দাবনে আগত অবহেলিত, অসহায় নারী এবং শিশুদের কল্যাণে কাজ করে থাকে। ছ’মাসের অধিককাল বৃন্দাবন বাসিনী আনন্দময়ী। এখনও পর্যন্ত সংসারত্যাগী মনটাকে মনে প্রাণে ঘরবিবাগী করে তুলতে পারলেন না তিনি। বৃন্দাবনের বিভিন্ন আশ্রম এবং তার আশপাশের এলাকা মিলিয়ে বহু বিধবা বাস করেন। সবাই যে মনের দিক দিয়ে খুব শান্তিতে আছেন তেমনটা নয়; তারমধ্যে বড়ো একটা অংশ বহুদিন ধরে এখানে বাস করতে করতে এখানকার জীবনধারার সঙ্গে নিজেদেরকে যথাসাধ্য মানিয়ে নিতে পেরেছেন; অনেকে খাপ খাওয়াতে না পারলেও অন্য কোথাও যাওযার বিকল্প উপায় নেই তাদের। শেষ সম্বল হিসেবে রাধামাধবের চরণ আশ্রয়ে মৃত্যু বরণের অপেক্ষায় কোনোক্রমে দিনাতিপাত করে চলেছেন।আনন্দময়ী এখনও দোলাচলে; কোথাও কোনো কিছুতে মনটাকে স্থির করতে পারছেন না। জীবনের এতগুলো বছর‌ যে ধারায় জীবন কাটিয়েছেন তার সঙ্গে এখনকার এই জীবন যাপনের কোনো‌দিক থেকে মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। নারী স্বভাব সুলভ সহজাত ভক্তির অধিকারিণী হলেও যে ভক্তি সম্বল থাকলে রাধামাধবের লীলাক্ষেত্রে নিজেকে যুক্ত করে শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব, তা তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত নেই। তবু ও রাধাকৃষ্ণ পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এখানে এই আশ্রমিক ক্রিয়াকর্মে কোনো ছুটি নেই; কর্মপ্রবাহের কোনো বিরতি নেই। দিনের পর দিন এক‌ই নিয়মে ঘটে চলেছে। সবাই সর্বক্ষণ সেবাদানে ব্যস্ত। বসে থাকলেও নাম জপ, নাম সংকীর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদেরকে সক্রিয় রাখতে হয়। এই অভ্যাসে যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের অন্য কোনো চিন্তা নেই। সকাল শুরু হলে অনায়াসে সন্ধ্যা নেমে আসে , রাত্রি শেষে আবার একটা নতুন দিনের শুরু হয়। এমনি অলস ধারায় কেটে যায় দিনগুলি। কাজ বলতে তেমন কায়িক শ্রমের কিছু নেই। নাওয়া-খাওয়া, অল্প-বিস্তর সেবাদান, দুবেলা নাম সংকীর্তন, দিনে একবার মাধুকরী ইত্যাদির ভিতর দিয়ে গতানুগতিক মন্দ লয়ে দিনাতিপাত। সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে রাধামাধবে মনোনিবেশ‌ই একমাত্র লক্ষ্য। বৈচিত্রহীন একঘেয়েমিই অধিক বলে ধারণা হল আনন্দময়ীর। মনের দিক থেকে আনন্দময়ী যেন অনেকটা নিঃসঙ্গ। এত দিনের মধ্যে কারো সাথে তেমনভাবে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার মতো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হল না। পরিচয় হয়েছে অনেকের সাথে, এক পথে পথ চলতে গেলে যতটুকু সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তার বেশি নয়। নবাগতা যারা, তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রচেষ্টাটাই অধিক।

ইতিমধ্যে একদিন সদ্য পরিচিতা দু’জনের সাথে বিশ্রাম ঘাটে স্নান করতে গিয়েছিলেন আনন্দময়ী। সেখানে আরো দু’জনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁরা এসেছেন পাগলা বাবার মন্দির থেকে। সবাই মিলে গল্পে গল্পে বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে যায়।যমুনা পাড়ে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পাদস্পর্শধন্য বিশ্রাম ঘাট আনন্দময়ীকে গভীরভাবে আকর্ষণ করল। সেখানে নব পরিচিত দু’জনের মুখে পাগলা বাবার মন্দিরের গল্প প্রথম শুনলেন তিনি। বেশ বড়ো এবং স্বনামখ্যাত মন্দির। বহু আশ্রমিক, বহু অসহায়া বিধবার বসবাস সেখানে। ভ্রমণকারী দর্শনার্থীদের দশ টাকার টিকিট সংগ্ৰহ করে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। সেখানকার ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ম কানুন জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিলেন আনন্দময়ী। তারপর সবাই একসাথে শ্যামকুন্ড, রাধাকুন্ড ঘুরে সন্ধ্যার আগে আগে তিনজনে বর্তমান আশ্রমে ফিরে এলেন। তখনও নাম জপ আরম্ভ হয়নি। আনন্দময়ীরা সন্ধ্যার নাম সংকীর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আশ্রম প্রাঙ্গণের আলোক বাতিগুলি ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৪) – প্রবোধ কুমার মৃধা

যা’র কারণে সংসারের ছন্দটা বিঘ্নিত হচ্ছিল বলে ধারণা গড়ে উঠেছিল গার্গীর মনে, এখন দেখল তার‌ই জন্য স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকা সংসারের নিত্য দিনের সুখ-দুঃখের প্রবাহটা বাঁকে বাঁকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ছেলে মেয়ের মধ্যে ঠাকুর মায়ের স্নেহের অভাব জনিত ঘাটতির আভাসটা প্রকট হয়ে উঠতে দেখছে গার্গী। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ও নিঃশব্দে একটা ব্যবধান তৈরি হতে শুরু করেছে। সব কিছু জেনে বুঝে ও স্বামীকে কোনো প্রশ্ন করার ভরসা পাচ্ছে না সে। শাশুড়ির লেখা চিঠিটা একবার দেখতে চেয়েছিল। নিষ্পয়োজন বলে শেখর এড়িয়ে গিয়েছে। গার্গী ও দ্বিতীয় বার দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে নি। তবে চিঠির বাকি অংশে কি থাকতে পারে তার কিছুটা আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় নি তার। তাছাড়া শেখরের এড়িয়ে যাওয়ার কারণে অনুমানটা আরো দৃঢ় হয়। মায়ের গৃহত্যাগের কারণ শেখরের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তা নিয়ে প্রকাশ্যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করেনি শেখর। তার এই নীরবতাই গার্গীর মনের অস্বস্তিটা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাড়িতে কিছু না জানিয়ে একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে বহু জায়গায় খোঁজ খবর চালাল শেখর। বহু অনুসন্ধান সংস্থার সাথে যোগাযোগ করল। মায়ের ছবি ও নিজের ফোন নম্বর দিয়ে রেখে প্রতিদিন আগ্ৰহ নিয়ে প্রত্যাশা করে এই বুঝি কোনো একটা সংবাদ এসে পৌঁছল।দিন শেষ হয়ে যায়, নতুন দিনের শুরুতে আবার নতুন আশায় বুক বেঁধে ক্ষত-বিক্ষত হয় শেখর। না! মায়ের সন্ধান কেউ দিতে পারছে না! তবে কি মা আর বেঁচে নেই! ভাবতে ভয় পায় সে। সহসা উদ্গত অশ্রুতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কিন্তু মা যে বেঁচে আছেন, মন যেন সে কথাই বার বার বলে তাকে।
শেখর যতক্ষণ বাড়িতে থাকে তার বেশিরভাগ সময়টা মায়ের ঘরে কাটায়। নিজের হাতে ঘরটি পরিপাটি করে রাখে। ছেলে মেয়ে দুজন কোনো কোনো দিন শেখরের সাথে এসে জোটে। ছেলে সপ্তর্ষি এখন অনেকটা বুঝতে শিখেছে। সে জানে ঠাকুর মা হারিয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম বাবাকে অনেক প্রশ্ন করেছে, বার বার জানতে চেয়েছে; এখন আর কিছু বলে না। মেয়ে সুজাতা পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে খেলনা পাতি নিয়ে এসে খেলা করে। তার মনে কোনো জিজ্ঞাসা আছে কি না তা বলা যায় না, তবে সে যে অনেক সময় ঠাকুরমার সাহচর্য চাইছে তা অনুমান করা যায়। বাচ্চা মানুষ, তার অসহায় চাহনি দেখে শেখর বুঝতে পারে; মনটা তখন তার বিষাদে ভরে ওঠে। বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আনন্দময়ী নিরুদ্দেশ হ‌ওয়ার দিন শরীর খারাপ থাকার কারণে শেখরের শ্বশুর আসতে পারেন নি। মাঝে একদিন শেষ খবরাখবর কি আছে জানতে এসেছিলেন। অনেক জেদাজেদির পরে একটা বেলা যে কোনো‌ রকমে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরে যান।একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে, শেখর, গার্গী এবং গার্গীর বাবা মায়ের মধ্যে আত্মীয়তার শৈথিল্যের চোরা স্রোত অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। পারস্পরিক স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে কোথায় যেন একটা প্রাচীর উঠে যাচ্ছে যা এতদিন ছিল না। মা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে কেন শেখর জেনেছে। কিন্তু ব্যাপারটি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা বা বিচার-সালিশির পথে হাঁটার মতো প্রবৃত্তির মানুষ নয় শেখর। তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক প্রায় এক দশকের বেশি হতে চলল। ছেলে মেয়ে দুজন যথেষ্ট বড়ো হয়ে উঠেছে; ঘরে বাইরে সম্মান হানি এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হ‌ওয়ার কারণে সমস্ত ঘটনাটি যথাসম্ভব আত্মসম্বরণ দ্বারা নিরসনের চেষ্টা করে চলেছে সে। অন্তরের অন্তর্দাহ বাইরে প্রকাশ না করে যতটা স্বাভাবিকতা বজায় রেখে চলা যায় তা নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে। এমনিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির জন্য বন্ধু -বান্ধব বা পরিচিত মহলে মনে মনে যথেষ্ট লজ্জিত। শ্বশুর-শাশুড়িকে ততটা দোষ দিতে পারছে না শেখর। কারণ, গার্গীর সমর্থন বা উৎসাহ না পেলে তাঁদের পক্ষে পৃথক একটা পরিবারের বিষয়ে অনধিকার চর্চা করার মতো অবুঝ তাঁরা নন; বিশেষ করে শেখরের শ্বশুর মশাই। ঘটনার পর মনের দিক থেকে তিনি খুবই সংকুচিত। শেখরের মেজো মামা প্রায় সময় ফোনে শেখরের সঙ্গে কথা বলে, জানতে চায় তার দিদির কোনো সংবাদ আছে কি না। অন্য আত্মীয়-স্বজন এখন আর তেমন ভাবে খোঁজ খবর রাখে না। কিন্তু আনন্দময়ীর সন্ধান পাওয়া নিয়ে মনে মনে আশাবাদী সবাই।

মায়ের জন্য বিরাট একটা শূন্যতা অন্তরে বহন করে চলেছে শেখর। কিন্তু সব থেকে দুঃসহ বেদনা নিয়ে দিন কাটছে গার্গীর। কাছে আছে অথচ সাথে নেই এমন একটা চাপা অস্বস্তিকর সম্পর্কের বাতাবরণের মধ্যে আর যেন জুঝে উঠতে পারছে না সে। মা- বাবা আর আগের মতো আসে না, তারা ও যেন অনেক দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে এ বাড়ির সঙ্গে। সংসারের কাজের ফাঁক বুঝে গার্গী ও এক-আধ বেলা বাপের ভিটেয় পা রাখত; সংসারের এই ঘটনার পর আর যাওয়ার ভরসা পায় না। কী যেন একটা অপরাধ বোধ আপন থেকে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোত্রের সাথে দুদণ্ড কথা বলে মনটা হালকা করবে সে পথ ও বন্ধ। শাশুড়ির সাথে গার্গীর সম্পর্ক যে মধুর ছিল না, আনন্দময়ীর বিদায়ে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে; আর সেই কথা মনে মনে চিন্তা করে গার্গী অপ্রয়োজনে কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে চায় না।

এক ছুটির দিনে শেখর মায়ের ঘরে বসে একান্তে ফাইল-পত্র নিয়ে কাজ করছিল। ছেলে মেয়ে দুজন বাড়িতে পড়াতে আসা আন্টির কাছে পড়াশুনোতে ব্যস্ত। হঠাৎ গার্গী নিঃশব্দে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে শেখর যে বিছানায় বসে কাজ করছিল তার এক পাশে গিয়ে বসল। শেখর একবার মুখ তুলে চেয়ে দেখে আপন মনে কাজ করে চলল। মিনিট দুয়েক পরে মুখ না তুলেই শেখর বুঝতে পারল গার্গী কাঁদছে। শেখর একটু অবাক হল,কাজ থেকে মন সরিয়ে গার্গীর উদ্দেশ্যে বলল, — কি হল, হঠাৎ কান্নাকাটি কেন? শরীর খারাপ হয়নি তো? শাড়ির আঁচলটা মুখে চেপে ধরে গার্গীর কান্না এবার প্রচণ্ড বেড়ে গেল।কান্নার দমকে সারা শরীরটা আন্দোলিত হতে থাকল।এতক্ষণে শেখর কাছে এসে গার্গীকে দুহাতে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে কারণ জানতে চাইল। মিনিট দুয়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে গার্গী কান্নাভেজা স্বরে বলে,– আমি আর পারছি নে, কি করব আমি? এক কথায় শেখর ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেকে আগের মতোই সংযত রেখে বলল, — অসুবিধে কি হচ্ছে?
গার্গী চুপ করে থাকে।

— অসুবিধে হ‌ওয়ার কথা তো নয়, বরং সুবিধে হবে ভেবে তো পরিকল্পনাটা করে ছিলে।
শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো জানাল শেখর।

— তুমি পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়ে যেভাবে একতরফা সুখ ভোগের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল তেমনটাই তো হয়েছে। তাহলে না পারার কি আছে আর কান্নার কি আছে! তোমাদের মনোগত ইচ্ছাই তো পূর্ণ হয়েছে। কাউকে অপরাধী না করে আপন দায়িত্ব মাথায় নিয়ে নিঃশব্দে মানুষটা সরে গেল, এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে?

একটানা কথাগুলো বলতে পেরে এতদিন পর শেখর অনেকটা হালকাবোধ করতে লাগল।উভয়ে উভয়ের কাছে এতদিনের এই মানসিক অচলাবস্থা চলার অনালোচিত কারণটি অল্প কথায় পরিষ্কার হ‌ওয়াতে কিছুটা হলেও সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শেখরের এত কথার প্রেক্ষিতে গার্গী কোনো উত্তর না দিয়ে আবার কাঁদতে লাগল।মা চলে গেছেন দীর্ঘ কয়েক মাস হয়ে গেল। এই ক’মাসের গুমোট ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরিবেশটা শেখরের যে ভালো লাগছে না তা সে হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারছে। ইচ্ছে করেই সে এই নির্লিপ্ত অবস্থানটি গ্ৰহণ করেছিল। মায়ের জন্য প্রথম প্রথম মনের মধ্যে একটা ঝড় গেছে।পুত্র পরিবার সব‌ই থাকা সত্ত্বেও মা যে পথে পথে ভিখারির মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, এই ভাবনাটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। এখন ও সর্বক্ষণ মায়ের কথা তার চিন্তার অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকে।ব্যাপারটি তাকে স্বস্তি দেয় না। গার্গীর উপর সময়ে সময়ে মনের বেভুলে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা জাগে মনে, পরক্ষণেই সন্বিত ফিরে পায়, নিজের কাছে নিজে লজ্জা পায়; ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ মনে পড়ে,যত‌ই হোক গার্গী তার সন্তানদের জননী। এ যেন ঠিক এক হাত কামড়ালে অপর হাতে ব্যথা বাজে।

শান্ত হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে গার্গী ধীরে ধীরে ঘরের বার হয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শেখরের বুক থেকে টানা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। এখন আর কাজে মন দিতে ভালো লাগছে না।কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে শেখর উঠে বাইরে এল। সদর দরজার দিকে চোখ পড়তে দেখতে পেল বোন বাসন্তী বাড়ির মধ্যে ঢুকছে, সঙ্গে দেবাংশুও।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৫) – প্রবোধ কুমার মৃধা

একদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল শেখর। সেই অবস্থায় বিলম্ব না করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে। তারপর ঘর রান্নাঘর করে বাড়ির সমস্ত জায়গায় খুঁজে দেখল।।কোথা ও নেই ! হতাশ ও নিরুৎসাহ হয়ে মায়ের ঘর খুলে ভিতরে ঢুকল শেখর। অজান্তে কখন চোখে জল এসে গেছে বুঝতেই পারেনি। শেখর ঘুমিয়েছিল। ঘুমের মধ্যে স্পষ্ট মায়ের গলা শুনতে পেয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। মা যেন ফিরে এসেছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘খোকা খোকা’ বলে বেশ কয়েক বার ডেকেছেন; সে তো ভুল শোনেনি, স্বপ্ন এমন স্পষ্ট হতে পারে?

কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে হারাবার মতো যন্ত্রণাবিদ্ধ হাহাকার তার হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিতে লাগল। নাড়ি স্পন্দনের গতি এতটাই দ্রুত চলছে বুঝে মায়ের ঘরের উজ্জ্বল আলোখানা জ্বালিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করল সে। এ অবস্থায় এখন আর ঘুম আসতে পারে না। অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে উঠে আসার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল গার্গীর। জেগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেখর আসছে না দেখে সে ও বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল মায়ের ঘরে আলো জ্বলছে। ধীর পায়ে সেখানে গিয়ে শেখরকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,— কি গো, এতরাতে হঠাৎ উঠে এখানে এলে কেন?

শেখর তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত পরে বলল, — আচমকা একটা আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে এসে কিছু দেখতে পেলাম না। গার্গী আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। বাচ্চা দুটো অন্ধকারে ঘুমাচ্ছে। সকাল হতে তখন ও ঘন্টা দুয়েক বাকি। শেখর উঠে আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। গার্গী জেগেই ছিল। স্বামীকে ঘরে ফিরতে বুঝে ও কোনো সাড়া দিল না। শেখর ছেলে সপ্তর্ষিকে একটু সরিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল।

সকালে গার্গী রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। শেখরের অফিস টাইম, ছেলে মেয়ের স্কুল,সব কিছুর জন্য সকালটা বড়ো ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। একহাতে সব কিছু সামলাতে দম ফেলার সময় থাকে না বেচারির।
এমন সময় একেবারে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকল গার্গীর ভাই গগন।এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দিদিকে রান্নাঘরে দেখতে পেয়ে সে সেখানে প্রবেশ করল। গার্গীর রান্নার কাজ প্রায় শেষের পথে; ভাইকে সস্নেহে বলল, — চল্‌, ঘরে গিয়ে বসবি চল্।
— না ঠিক আছে, এখানেই বসছি।
ভাইয়ের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে গার্গীর কেমন যেন খটমট লাগল।কাজ থেকে মন সরিয়ে গগনের উদ্দেশ্যে বলল, — হঠাৎ চলে এলি, কোনো খবর আছে? মা- বাবা কেমন আছে?
— ভালো।
গগনের গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক গম্ভীর শোনাল। গার্গী বুঝতে পারলো, কিছু একটা ঘটেছে এবং সেটা মা- বাবাকেই নিয়ে। সে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
— আজ তুই একবার চল্ দিদি। একটা ব্যবস্থা করে দে। আর ভালো লাগছে না।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অভিমানী ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা হেঁট করে চুপ হয়ে গেল গগন।

গার্গীর অনুমান ঠিক। বাপের ঘরে বর্তমানে ওই একটাই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সংসারে অভাব য‌তটা না আছে, স্বভাবে অসঙ্গতিটা মাথা তুলেছে তার চারগুণ।আগে এমন ছিল না। ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে সাংসারিক ঝামেলা কমবেশি লেগেই আছে। মা- বাবা অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ।সেকেলে ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত। কলেজে পড়া গগন মা- বাবার অমতে এক শিক্ষিত আধুনিকা ব্যবসায়ী- কন্যাকে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে অগ্নিসাক্ষী রেখে নব দম্পতি পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে কি না কেউ তা জানে না।মা- বাবার প্রথম আপত্তি এবং সন্দেহ সেখানেই। শাঁখা সিঁদুরের বালাই নেই; শাড়ি পরতে জানে না নতুন বৌমা। ঘরের কাজ কর্ম তথৈবচ, ঘর বারান্দায় যেখানকার বস্তু সেখানেই পড়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। এক টিপ পুরু ধুলো ময়লার উপর দিয়ে জুতো পায়ে গটগট চলা ফেরা করে; পরিষ্কার তো দূরের কথা, কোনো দিন ঝাঁটা হাতে ধরে না। কাজের মধ্যে কেবল বিদেশি ধাঁচে কিছু রান্নাবান্না করে স্বামী স্ত্রী দুজনের মতো ভাত তরকারি নিয়ে ঘরে ঢোকে। শ্বশুর শাশুড়ি কি খাচ্ছে কি না খাচ্ছে সে দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

একটা মাত্র ছেলে। মা- বাবার কত আশা ছিল, দেখে শুনে পছন্দ মতো একজন বৌমা নিয়ে আসবে। সে গুড়ে বালি। ছেলে এখন সেয়ানা হয়েছে, বাবা – মা’ র কথা এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দেয়। মাসের মধ্যে তিন চার বার বৌয়ের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ওঠে।চাষ- আবাদ, বাগান – বাগিচা, কোনো কিছুতে তার নজর নেই; খোঁজ খবর ও রাখে না। দেখে শুনে বিরক্ত বিপিন বাবু দু’ চার কথা শুনিয়ে দেয় আর তখনই তা নিয়ে বাধে গণ্ডগোল। পাড়া-প্রতিবেশিরা এসে সাময়িক মিটমাট করে দিয়ে যায়। সে আর কতক্ষণ, আবার যে কে সেই। বনেদি গৃহস্থ বাড়ির ঐতিহ্যমান- সম্মান কিছুই আর অবশিষ্ট থাকল না।

গার্গী বলে — আবার বাবা-মা’ র সাথে ঝামেলা করেছিস নিশ্চয়।
— ঝামেলা আমরা করছি না, করছে তারা। আমাদের বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেতে বলছে।
ক্ষোভ ভরে জবাব দেয় গগন।
— তা যাঃ! তোদের তো যাওয়ার জায়গার অভাব নেই। তাছাড়া বাবা -মায়ের বয়স হয়ে গেছে, আর কতদিন খাটাখাটনি করবে। কোনো আয়ের পথ দেখিস না; কেবল বসে বসে খেয়ে যাচ্ছিস আর ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিস। এভাবে কতদিন চলবে?

গার্গীর কথা শুনে গগন চুপ করে থাকে। মনে মনে বুঝতে পারে দিদি সম্পূর্ণভাবে বাবা- মায়ের পক্ষে; তবু গার্গীকে একবার যাওয়ার জন্য জেদ ধরে এবং আজ‌ই। অনেকটা নরম হয়ে গিয়ে গগন বলে,– কাল থেকে রান্না খাওয়া প্রায় বন্ধ। মিলি জেদ ধরেছে বাপের বাড়িতে চলে যাবে; সে ভীষণ কান্নাকাটি করছে। স্বেচ্ছায় বাপের ভিটেয় যেতে আগ্ৰহ দেখাতে পারছে না গার্গী। তার উপর সংসারের সব কিছুই তাকে সামলাতে হয়; কোথাও যেতে গেলে দুদিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। ভাইকে গার্গী বলে, — তোর দাদাবাবুকে গিয়ে বল খুব জরুরি প্রয়োজন, তোমাকে যেতে হবে। গগন ধীরে ধীরে উঠে বারান্দায় শেখরের কাছে গিয়ে সব কথা সংক্ষেপে জানাল এবং শেষে তাকে যাওয়ার জন্য আন্তরিক আবেদন জানাল। শেখর শুনল সব, কিন্তু খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। তার শ্বশুরের সংসারে ইদানিং টুকটাক ঝগড়া- ঝাঁটি, বিবাদ-বিতর্ক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রান্নার কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছিল গার্গীর। বারান্দায় এসেছিল ছেলে মেয়ের স্নানের উদ্যোগ নিতে। স্বামীকে উদ্দেশ্যে করে বলল, — গগন কি বলে শুনেছ? পারলে একবার যাওয়ার চেষ্টা করো।ও তো নাছোড়বান্দা, আমি গেলে সংসারের সমস্ত কিছুই থমকে যাবে। স্বামীকে যেতে বলার মধ্যে মূলত দুটি উদ্দেশ্যে ছিল গার্গীর। স্বামীর উপর দায়িত্ব দিয়ে বাপের বাড়ির বিষয়ে নিজে কতটা অনুৎসাহী তা প্রমাণ করা; দ্বিতীয়তঃ বাবার সংসারের বর্তমান সমস্যার সাথে শেখরকে যুক্ত করা। শেখর স্ত্রীকে বলে, — জরুরি মনে করলে তুমি নিজে যাও; প্রয়োজনে আমি আজ অফিস বন্ধ করছি। যে কথা জোর দিয়ে তোমার বলার এক্তিয়ার আছে, আমার পক্ষে তা বলা যেমন সম্ভব নয়, তেমন সঙ্গতিপূর্ণ ও না। মেয়েকে নিয়ে তুমি ঘুরে এসো।

এই সব মুহূর্তে মায়ের কথা বেশি করে মনে পড়ে শেখরের। মা থাকলে তাকে আজ অফিস কামাই করার কথা ভাবতে হতো না। ছেলের স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি পাহারা দেওয়া, দুটোই মা ঠিক সামলে নিতে পারতেন। গার্গী যে বুঝতে পারে না তা নয়। শুধু আজ নয়, কোনো কোনো দিন সংসারের এমন অনেক ছোটখাটো ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয় তাকে যখন শাশুড়ির অনুপস্থিতির অভাবটা গভীরভাবে উপলব্ধি করে সে। কিন্তু মনের ভাবনা মনেই মিলিয়ে যায়, প্রকাশ করার ক্ষেত্র কোথায়! গার্গীর যাওয়ার গরজ খুব একটা ছিল না। কিন্তু ভাইয়ের অনুনয় বিনয় আর বাবা – মায়ের কথা চিন্তা করে একটিবার ঘুরে আসা জরুরি হয়ে পড়ল। ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে তাৎক্ষণিক করণীয় কাজ কিছু দ্রুত গুছিয়ে নিল গার্গী। পরিকল্পনামতো শেখর আজ অফিস না গিয়ে বাড়িতে থেকে গেল। গার্গী ও স্বামীর ভরসায় ছেলে এবং সংসারের ভার দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের সাথে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে পড়ল।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৬) – প্রবোধ কুমার মৃধা

দোল বা হোলি উৎসবের সময় বৃন্দাবনের সামগ্ৰিক চেহারাটাই বদলে যায়। বসন্ত উৎসবের সেই বাসন্তী রঙিন উন্মাদনা তরুণ তরুণীদের উন্মাদ প্রায় করে তোলে; তার ছোঁয়া লাগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মনেও। বৃন্দাবনে একটা জায়গা ‘বিধবা নগরী’ নামে পরিচিত। প্রায় ১৫-২০ হাজার বিধবার বাস সেখানে। বহু এনজিও এবং সরকারি সাহায্যে এখানকার বৃদ্ধাবাসগুলি চলে। মথুরার আকর্ষণীয় হোলি উৎসবের মতো বৃন্দাবনের হোলি উৎসবের নজরকাড়া আকর্ষণ হল, বিধবাদের রঙের উৎসব। আত্মীয় পরিজন পরিত্যক্ত এই সমস্ত অসহায় বৃদ্ধাগণ, যাদের জীবন থেকে রঙিন হারিয়ে গিয়েছে; একটা দিনের জন্য হলেও ভুলে যাওয়া রঙিন স্বপ্নটাকে জাগিয়ে দিতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‌’সুলভ ইন্টারন্যাশানাল’- এর তরফ থেকে প্রতি বছর হোলিতে বিধবাদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্ধারিত দিনে প্রতিটি বিধবা যাতে তাদের শ্বেত পরিধেয় রাঙিয়ে নিয়ে উৎসবের অংশীদার হতে পারেন, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়। এতদিন হয়ে গেল, পিছুটান আনন্দময়ীকে এখনও টানছে। চেষ্টা করেও সবার রঙে রং মেলাতে পারছেন না।

আজ হোলির দিনের উন্মাদনা আর প্রাণভরা উল্লাস আনন্দময়ীর মনে কেমন একটা রূপান্তর এনে দিয়েছে। ‘রাধে রাধে’ ধ্বনিতে সারা বৃন্দাবনের আকাশ বাতাস মুখরিত হতে দেখে আনন্দময়ী নিজেকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। পরিচিত সকলের সাথে তাল মিলিয়ে আনন্দ উৎসবের সামিল হয়ে পড়লেন। হোলি উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব অনুষ্ঠানের জের চলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। অনুষ্ঠানগুলি অনুষ্ঠিত হয় এক একটি পর্যায়ে। যেমন, ব্রজকি হোলি, লাঠমার হোলি, ফুল‌ওয়ালি হোলি প্রভৃতি। আনন্দময়ী এই প্রথম এমন মহা আনন্দ আর উন্মাদনাভরা উৎসবের মুখোমুখি হলেন। বাংলার দোল উৎসব দেখেছেন। সেখানে দোল অনুষ্ঠিত হয় যে বাড়িতে, সেই বাড়ির লোকজন ও দোল উপলক্ষে গৃহে আগত আত্মীয়-স্বজনরা একটা কি দুটো দিন কিছুটা আনন্দ করে থাকেন। মথুরা বৃন্দাবনের মতো সমাজের সর্বস্তরের আপামর জনসাধারণ পাগলের প্রায় মেতে ওঠেন না। বাংলায় দোল উৎসবের দিন হালে পাড়ার কিশোর কিশোরীরা নির্ধারিত ক’টা ঘন্টা মাত্র রং নিয়ে মাখামাখি করে।

বৃন্দাবনের হোলি উৎসব চলাকালীন কখনোই মনে হবে না যে, এখানে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা ব্যতীত অপর ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।সবাই এমন একাত্মভাবে হোলি উৎসবে নিজেদেরকে যুক্ত করতে পারেন, যা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমন কি দেশের ভিন্ন প্রদেশ বা বিদেশাগত যে সমস্ত পর্যটকগণ হোলি উৎসবের সময় বৃন্দাবন ভ্রমণে আসেন, তাঁরা ও উৎসবের সমান অংশীদার হয়ে ক’টা দিন মহা আনন্দ উপভোগ করেন। যত দিন যাচ্ছে উৎসব-প্রিয় বহিরাগত পর্যটকবৃন্দ ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নিয়ে বৃন্দাবনের হোলি উৎসবকে এক উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। সপ্তাহকালব্যাপী চলতে থাকা আনন্দ উৎসবের সামিল হচ্ছেন কমবেশি সবাই। এতদিন পর কিছুটা হলেও আনন্দময়ী বুঝতে পারলেন, আত্মীয় বন্ধু -বান্ধব ছেড়ে আসা বিধবা সকল কি নিয়ে, কিসের টানে এখানে পড়ে আছেন। উৎসবের দিনগুলো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল।রাধামাধবের অদৃশ্য আকর্ষণ কতটা গভীর ও সর্বব্যাপ্ত তার সামান্য আভাস উপলব্ধি করতে পেরে মনে মনে নতুন করে এক ধরণের অনাস্বাদিত আনন্দানুভূতি আনন্দময়ীর হৃদয় স্পর্শ করে গেল।এমনি করে করে বোধকরি সংসারের মায়ার বাঁধন ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে।তা সম্ভব না হলে বৃন্দাবনবাস সব দিক থেকে কণ্টকময় হয়ে উঠত। অতি প্রাচীন কাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িষা প্রভৃতি অঙ্গরাজ্য থেকে সংসার নির্বাসিতা বিধবাগণ সুদূর বৃন্দাবনে এসে বাকি জীবনটা রাধামাধবের শ্রীচরণাশ্রিত হয়ে কাটিয়ে দেন। নিছক ক’টা দিনের তীর্থবাস নয়; জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল থাকার একটা নিগুঢ় মাহাত্ম্য নিশ্চয়ই আছে।

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর সাক্ষাৎকালে সম্বোধনের বাক্যবন্ধ বা সম্ভাষণ রীতি পৃথক। বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সম্প্রদায় পরস্পর সাক্ষাতে ‘রাধে রাধে’ উচ্চারণে নিজেদের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় করে থাকেন। হোলির ক’টা দিন অলিতে গলিতে এই রাধে রাধে রবের বন্যা বয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি বহিরাগত যারা হোলির সময় বৃন্দাবনে উপস্থিত থাকেন তাদের সবার‌ই মুখ থেকে ‘রাধে রাধে’ বুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে।এতে তাঁরা যেমন উৎসবের ভাগীদার হয়ে যান তেমনি প্রাণভরে হোলির আনন্দ উপভোগ করে নিজেদেরকে ধন্য মনে করেন। উৎসবের আকর্ষণে বৃন্দাবনে জনসমাগম হয় সর্বাধিক।দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পুণ্যার্থী পর্যটকদের অংশগ্ৰহণে চেনা বৃন্দাবন অচেনা রূপ ধারণ করে।সেই হাজারো মুখের ভিড়ের মাঝে মনে মনে চেনা মুখের সন্ধানে ফেরেন আনন্দময়ী।এই অনুসন্ধানের মধ্যে এক প্রকার আনন্দ থাকে, কিন্তু দিনের শেষে নিরাশ হয়ে সবার অলক্ষ্যে আপন থেকেই চোখে জল এসে যায়; তখনই রাধামাধবের চরণে আশ্রয় মাগে,একটু শান্তি লাভের আশায় কাতর প্রার্থনা জানায়।

হোলির আনন্দ উৎসব মিটে গিয়ে বৃন্দাবন আবার ধীরে ধীরে বৃন্দাবনের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করল। সেই ছকে বাঁধা একঘেয়ে কর্ম অনুশীলনের গতানুগতিক সাধন সম্বল জীবন ধারা।বাধ্যবাধকতার শৃঙ্খলা না থাকলে ও অলিখিত নিয়মের নিগড়ের বাঁধন একটা থেকেই গিয়েছে; যার কারণে আপন বিবেকের নির্দেশে এবং সঙ্গীসাথিদের দেখাদেখি সবাই এক‌ই পথ অনুসরণ করে দিনাতিপাত করতে থাকে। কথায় বলে সৎ সঙ্গে কাশীবাস, বৃন্দাবনবাস ও তার থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই বরং অনেকটাই এগিয়ে। এখানে রাধামাধবের মাহাত্ম্যগুণে বৃন্দাবনবাসী সকল বৈষ্ণবগণ ভক্তি ভাব-সাগরে নিত্য নিয়ত অবগাহন করে মানসিক শান্তি লাভের উপায় অনুসন্ধান করে। আংশিক সফল হয় অনেকে, অনেকে সফল হ‌ওয়ার চেষ্টায় থাকে। সাধনমার্গে যে যতটা অগ্ৰসর হতে পেরেছে, আড়ম্বরহীন সহজ সরল জীবন ধারণের মধ্যে সে ততই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কৃতকার্য হয়েছে।আত্ম সুখ-সম্পদের চিন্তা নয়, তার ঊর্ধ্বে উঠে রাধামাধবের পাদপদ্মে আত্মনিবেদন করার মধ্যে লুকিয়ে আছে পরম আনন্দ,পরম প্রাপ্তি।যে প্রাপ্তির অংশীদার হতে পারলে আর কোনো চাওয়া পাওয়ার বাসনা থাকে না।ইহজীবনের পরমপ্রাপ্তি লাভ হলে জীবন সার্থক হয়,মানব জনম সফল হয়। কিন্তু সেই পরম প্রাপ্তির ধনটি কী, তার সন্ধান মানুষ আজ পর্যন্ত পেয়েছে বলে জানা নেই। জাগতিক চাওয়া পাওয়ার মধ্যে অনেক কিছুই হয়তো অনেকের প্রাপ্তি ঘটে, তবু যেন কি না-পাওয়ার বেদনা,এক অতল গভীর বিরহ একান্ত অবসরে মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। মুহূর্তে মন ছুটে চলে সেই মনের মানুষটির উদ্দেশ্যে।’ কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’ হতে পারেন তিনি মানুষ,হতে পারেন তিনি ত্রিতাপ দুঃখহারী অনন্ত ঈশ্বর; ছায়ারূপ বা কায়ারূপ, তে রূপেই বিরাজ করুন, কোথায় তিনি, কতদূরে? জাগতিক ভোগবাসনায়,ধনে জনে জড়ায়ে থেকে ও অন্তিমে মন শুধু তাঁর‌ই পায়ে আশ্রয় মাগে! জীবন ভরে সেই অধরাকে ধরার,তাকে পাওয়ার আকুল আবেদন, অথচ জন্ম জন্মান্তরের অপ্রাপ্তি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। বুকের মাঝে অতল রোদন জাগে। সান্ত্বনা খুঁজতে যাই অধ্যাত্ম্য দর্শনের মোহমুক্তির বাণীর বার্তায়–

কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীব বিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয়ঃ তদিদংভাতঃ।।

আমাদের সকল পাওয়ার মাঝে না পাওয়ার বেদনার সুর যে একটা বেজে যায়,তা শুধু নাই আর নাই! এ ব্রহ্মান্ডে শেষ নাই, সীমা নাই,অনন্ত অসীম!

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৭) – প্রবোধ কুমার মৃধা

এক রবিবার ছুটির দিন পেয়ে সকালে দেবাংশু এল শ্বশুর বাড়িতে।একা। হঠাৎ করে। আগাম কোনো খবর ছিল না। শেখর বাজারে বেরিয়েছিল। গার্গী সমাদরে আপ্যায়ন করল; বসতে জায়গা দিয়ে বাড়ির কুশল সংবাদ নিল।
— দাদা কি বাজারে বেরিয়েছে বৌদি? [দেবাংশু গার্গীর কাছে জানতে চাইল।]

— হ্যাঁ ভাই, সারা সপ্তাহের মধ্যে এই দিনটাতেই কেবল সুযোগ পায় কিছু কেনাকাটা করার।
একটু সময় চুপ করে থেকে দেবাংশু বলে, জরুরি প্রয়োজনে আসতে হল বৌদি। তোমাদের কাছে একটা পরামর্শ নেওয়া দরকার।
— ঠিক আছে দেবাংশু, তোমার দাদা এখনি এসে যাবে। তুমি পোশাক পালটে কিছু মুখে দাও, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

কিসের পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়ল জানার জন্য মনে মনে ভীষণ কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল গার্গী; তবে কি ভেবে আপাতত নিজে থেকে সে কিছু জানতে চাইল না। আধ ঘন্টার মধ্যে শেখর বাজার থেকে ফিরে এল, দু-তিন খানা ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে। দেবাংশুর আগমনে সে খুব খুশি হল। জিজ্ঞেস করল,- দেবাংশু কখন এলে? বাড়ির সংবাদ সব ভালো তো? বাসন্তীকে দেখছি না।
— হ্যাঁ দাদা, সব ভালো। ও আসেনি। বিশেষ একটা প্রয়োজনের কারণে হঠাৎ আমাকে আসতে হল। দেবাংশুর কথায় একটু থমকে গিয়ে শেখর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রয়োজন না থাকলে তাহলে আসা যাবে না বলো।
দেবাংশু কিছুটা বিব্রতবোধ করল। তৎক্ষণাৎ উত্তরে বলল‌‌,- না না, ঠিক…তা নয় দাদা।আসতে তো হবে।

সপ্তর্ষি সুজাতা অদূরে খেলা করছিল এতক্ষণ। বাবাকে বাজার থেকে ফিরতে দেখে কাছে এসে জুটল। সকালে এক কাপ চা ও দুখান বিস্কুট খেয়ে বাজারে গিয়েছিল শেখর। বাজার নামিয়ে রেখে গার্গীকে বলল,–হাত-পা ধুয়ে আসছি, আমাদের সবাইয়ের টিফিনের ব্যবস্থা করো।
এতক্ষণে দেবাংশু নিজের অভিপ্রায়টা ব্যক্ত করার সুযোগ পেল।

— দাদা, বৌদি ও এখানে আছে, আমি যেজন্যে এসেছি। সামনের মাসের শেষের দিকে ডেলিভারির ডেট দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। কিন্তু সমস্যা হল, তারপর ওখানে রাখব কোথায়? বাড়িতে তো দেখার কেউ নেই।দু-চারটে মাস অন্তত সামলে না দিলে আমরা বড়ো নাচারে পড়ে যাব। আপনার বোন ও ভীষণ চিন্তায় আছে ।
দেবাংশুর বক্তব্যের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা স্পষ্ট বুঝতে অসুবিধে হল না শেখরের। গার্গী ও আন্দাজ করতে পারল সহজে। দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চায়ি করল। দেবাংশু শেখরকে উদ্দেশ্যে করে আবার বলতে থাকল,– এই অবস্থায় কি করা দরকার একটা পরামর্শ দেন আপনারা।

দেবাংশুরা তিন ভাই। দেবাংশু ছোটো। ভাই ভাই সবাই পৃথক। মা বেঁচে আছেন। এক এক মাস পালা করে তিন ছেলের কাছে কাটান তিনি। শরীর তেমন ভালো নয়। বার্ধক্য জনিত নানান উপসর্গ সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দেয়। দেবাংশুদের সংসারের বর্তমান পরিস্থিতি শেখরের জানা ছিল। বোন বাসন্তী যে সন্তানসম্ভবা তাও জানত। কিন্তু দেখতে দেখতে দশমাস পূর্ণ হতে চলেছে সে খেয়ালটা তার ছিল না। আজ মা উপস্থিত থাকলে সমস্যাটার সমাধান সহজ হতো। দেবাংশুর কথার উত্তরে শেখর জানাল,– দেখো দেবাংশু, এখন তোমাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছি; তবে এ ব্যাপারে আমি খুব একটা কাজে আসতে পারব না ভাই। দিনের অধিকাংশ সময়টা কেটে যায় অফিসে। এ অবস্থায় তোমাকে সাহায্য করতে হলে তোমার বৌদি ছাড়া আমার সংসারে তো আর বাড়তি লোক নেই! তোমার বৌদি কি বলে শোন।

দেবাংশু গার্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে গার্গী বুঝল তাকে কিছু একটা উত্তর দিতে হবে। আপাতত দুই কুল বজায় রেখে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল সে। বলল, — দেবাংশু, তোমাদের সমস্যা শুধু তোমাদের নয়, আমাদেরও, আমরা এড়িয়ে থাকতে পারি না। যাতে সবার সুবিধে হয় তেমন একটা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করার মতো সময় আমাকে দাও। এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা ভাবনা ক’রো না, আমরা তোমাদের সাথে আছি। এখন সময় মতো চান খাওয়া করো। উপায় একটা হয়ে যাবে।
দেবাংশু অনেকটা আশ্বস্তবোধ করল। গার্গীর জবাব শুনে শেখর মনে মনে তাকে তারিফ না করে পারল না। তার উত্তর দানের সঙ্গে শেখরের ইচ্ছার যথেষ্ট সাদৃশ্য পেয়ে সে খুশিই হল‌। দুপুরে খেতে বসে শেখর দেবাংশুর কাছে জানতে চাইল, কোথায় কি ব্যবস্থা করার কথা ভেবে রেখেছে তারা। দেবাংশু বলল,– সময় মতো ডায়মন্ডহারবারের হসপিটালে ভর্তি করা হবে। যে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আছে বাসন্তী, তিনিই এমনটি ঠিক করে রেখেছেন। ডাক্তারবাবু ওই হসপিটালের‌ই ডাক্তার।

— ডাক্তারবাবু যদি বলে থাকেন তো সেমতো‌ই চলা উচিত। বলে অভিমত প্রকাশ করে শেখর।
আহারাদির পর আনন্দময়ীর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল দেবাংশু। শেখর ও গার্গী নিজেদের ঘরে বাসন্তীদের বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল।
— একার সংসার, নিজেদের দুটো ছেলে মেয়ে, সমস্যা হয়ে গেল! কি উপায় হবে বলো তো?
স্বামীর চিন্তিত ভাব লক্ষ্য করে গার্গী বলে,– চার-ছ’ মাসের ব্যাপার তো, নিজেদের সমস্যা থাকলেও সামলে নিতে হবে। নিজেদের মেয়ে, কোথায় ফেলবে তাকে!
একটা বিষয় শেখর হালে খুব নজর করছে, মা চলে যাওয়ার পর থেকে কথায় বার্তায়, আচার ব্যবহারে গার্গী যেন বেশ পরিণত এবং অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। সংসারের ঘাত-প্রতিঘাত কাউকে কাউকে দ্রুত পরিপক্ক করে তোলে। গার্গী যেন তাদের একজন।

সবে মাত্র বিকেল‌ শুরু হয়েছে। চৈত্র মাসের পড়ন্ত দুপুরের রোদটা তখন ও ঝাঁ ঝাঁ করছে। শেখর প্রস্তুত হয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে দেবাংশু বিছানায় বসে আছে। সদ্য ঘুম ভেঙে উঠেছে বলে মনে হল। শেখর দেবাংশুকে বলল,– দেবাংশু, আমি একটু বের হবো ভাই। বিশেষ একজনের সাথে সাক্ষাতের কথা আছে। তোমাকে আটকাবো না, সময় মতো সাবধানে ফিরো; প্রয়োজনে খবর করতে কোনো রকম দ্বিধা কোরো না কেন।
— হ্যাঁ দাদা, আমাকে বাড়িতে ফিরতেই হবে। উত্তরে জানায় দেবাংশু।

শেখর আর বিলম্ব না করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। শেখর বেরিয়ে যাওয়ার পর গার্গী ঘর -বারান্দা করে টুকটাক কাজে ব্যস্ত ছিল। দেবাংশু ঘরের বাইরে এসে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসেছিল, গার্গীকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করল,– বৌদি, মায়ের কোনো খবর আর পাওয়া গেল না তাহলে?
আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য গার্গী প্রস্তুত ছিল না। তাছাড়া ব্যাপারটাতে গার্গী এতটাই স্পর্শকাতর হয়ে আছে যে, শাশুড়িকে নিয়ে সরাসরি তার কাছে কেউ কিছু জানতে চাইলে সে ভীষণ সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার নিজের মনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধবোধটা তাকে একতরফা অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। সে মন থেকে চায় না শাশুড়িকে নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ কেউ তার কাছে তুলুক। তা যে সম্ভব নয়, সে কথা গার্গী ভালো মতোই জানে। পাড়া প্রতিবেশীরা থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনদের অনেকের কাছে ও বেচারি দোষীর কাঠগড়ায়। হাজার চেষ্টা করলেও তা থেকে নিস্তার পাওয়ার সুযোগ নেই। মাছরাঙার কলঙ্কের মতো কলঙ্কটা তার নামের সঙ্গে গেঁথে গিয়েছে। নিজের থেকে তো দূর করার ব্যর্থ চেষ্টার পথে তাই সে হাঁটে না। অগত্যা দেবাংশুর জিজ্ঞাসার জবাবে গার্গী জানায়,– না ভাই, কোনো সংবাদ মিলল না; এখনও পর্যন্ত তোমার দাদা নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, কতদিনে কিভাবে কি হবে তা ঠাকুর জানে!

দেবাংশু শেখরের নিকট শাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে ভরসা পায় না,শুধু শাশুড়ির কথা নয়, সে শেখরকে যথেষ্ট সমীহ করে কিন্তু গার্গীর কাছে নিজেকে অনেকটা সাবলীল মনে হয় তার।গার্গীর উত্তরের প্রেক্ষিতে দেবাংশু আপন মনে বলতে থাকে, — আমাদের দুর্ভাগ্য! মা থাকলে এই সময়টা অন্তত আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম। তোমাদের উপর ঝামেলাটা অনেক কম হতো।
— ঝামেলা কেন বলছ দেবাংশু, এ সব তো পারস্পরিক দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আমাদেরকে তোমাদের সংসারের থেকে পৃথক করে ভাবছ কেন?
দেবাংশু নীরব হয়ে যায়। ‘ঝামেলা’ কথাটা বলে ফেলেই মনে মনে শুধরে নেবার চেষ্টা করতে লাগল যেন। গার্গী ও আর কোনো কথা না তুলে ঘুম থেকে ওঠা মেয়ের চোখমুখ ধোয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে দেবাংশু বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। গার্গীকে সম্বোধন করে বলল,– বৌদি বেরিয়ে পড়লাম, হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা সাক্ষাৎ হবে। গার্গী দেবাংশুকে সতর্ক করে বলল,– যে কোনো খবর হোক, জানাতে বিলম্ব কোরো না। ওকে খুব সাবধানে থাকতে বলবে। ঠাকুর মঙ্গল করুন। তুমি ও সাবধানে ফিরো।
দেবাংশুকে ছাড়তে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে পথে বেরিয়ে এসেছিল গার্গী। দেবাংশু চলে যাওয়ার পর পিছন থেকে ছেলে সপ্তর্ষির ডাক শুনতে পেয়ে আর বিলম্ব করল না, দ্রুত বাড়ির মধ্যে ফিরে গেল।

প্রবোধ কুমার মৃধা | Probodh Kumar Mridha

Why 15th August chosen as Independence Day? | Probodh Kumar Mridha

Goddess Dakshina Chandi 2023 | Barid Baran Gupta | Best Article

Best Bangla Golpo Reading 2023 | তৃতীয় পক্ষ | Nasir Waden

Galpo Holeo Sotyi | কোনো এক গ্রাম্য বধূ | Debraj Krishnananda Bhattacharya | Best 2023

New Bengali Famous Story 2023 | Top Online Bangla Golpo Reading | New Online Bangla Golpo Reading | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep New Bengali Famous Story | Shabdodweep Writer | Best Bangla Galpo Online pdf | World’s Famous Online Bangla Golpo Reading | Pdf New Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story Reading | Full Best Bangla Galpo Online | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Online Bangla Golpo Reading | Best Online Bangla Golpo Reading Ebook | Full Online Bangla Golpo Reading | New Live Online Bangla Golpo Reading | New Bengali Web Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Horror Web Story in Bengali Video | Horror Live Online Bangla Golpo Reading | New Bengali Web Story Audio | New Web Story in Bengali Video | New Bengali Famous Story Netflix | Audio New Bengali Famous Story | Video Best Bangla Galpo Online | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2023 | Trending New Bengali Famous Story | Recent Online Bangla Golpo Reading | Top Live Bengali Story | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2023 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bengali Famous Story | Best Online Bangla Golpo Reading in pdf | New Bengali Famous Story Download | Best Bangla Galpo Online mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | New Bengali Famous Story mp4 | Online Bangla Golpo Reading Library | Online Bangla Golpo Reading Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Online Bangla Golpo Reading – audio | Best Bangla Galpo Online – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Collection Bangla Golpo Online Reading

Leave a Comment