Best New Bengali Famous Story | Bishonno Biday

Sharing Is Caring:

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১)

খোকা,

এই কাগজখানা যখন তুই হাতে পাবি তখন আমি অনেক দূরে চলে যাব।এটি তোর ব্যাগের মধ্যে রেখে গেলাম; না হলে গায়েব হয়ে যেতে পারে। আমাকে খোঁজাখুঁজি করিস নে,বার যখন হয়ে পড়েছি আর ফিরব না ।নতুন করে লাঞ্ছনা গঞ্জনার‌ মুখোমুখি আর হতে চাই না।

সংসারে অশান্তির কারণে তোকে কোনদিন কিছু জানাইনি।নীরবে মুখ বুজে সব নির্যাতন সহ্য করে এসেছি। এখন অবস্থাটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে। বৌমার ভাই-ভাজের সঙ্গে তার বাবা মায়ের তেমন বনিবনা হচ্ছে না, তারা বছরের অধিকাংশ সময়টা মেয়ের বাড়িতে কাটাতে চায়। বৌমার তাতে সম্মতি এবং আগ্ৰহ খুব‌ই; এই মর্মে তাদের পরামর্শে আমাকে‌ বৃদ্ধাশ্রমে রাখার ব্যবস্থা করবে খুব শীঘ্র।

সংসারের জন্য প্রাণপাত করেছি। এই সংসার ছাড়ার কথা কোনোদিন চিন্তায় আনতে পারিনি। দাদুভাইরা আসার পর সংসারের মায়ায় আরো‌ জড়িয়ে গেছি। কত কিছু ছেড়ে, কতটা ত্যাগ স্বীকার করে বার হয়ে এসেছি তা একমাত্র ঈশ্বর জানেন। তুই সব সময় অফিসের কাজে ব্যস্ত, তাই বিশ্বাস করে আমার দায়িত্ব বৌমার উপর ছেড়ে নিশ্চিন্ত থেকেছিস, কোনোদিন সেভাবে কোন খোঁজখবর রাখতে পারিসনি। কিন্তু বৌমা খুব স্বার্থপর।

কী ছেড়ে গেলাম, কতটা ছেড়ে গেলাম, তোকে বোঝাতে পারব না। চোখের জল কোন সময়ের‌ জন্য শুকাচ্ছে না,তবে ক’টা দিন পার হয়ে গেলে অনেকটা সামলে উঠতে পারবো; তুই চিন্তা করিস নে। সবাই ভালো থাকিস।

–- তোর মা

প্রতিদিন সকাল সাতটার মধ্যে উঠে পড়ে গার্গী। তার বহু আগে বিছানা ছাড়েন আনন্দময়ী,গার্গীর শাশুড়ি‌। তেমন কোন গৃহকর্ম থাকে না,তবু এটি তাঁর বারো মাসের অভ্যাস। বাথরুম থেকে বেরিয়ে গার্গী রান্নাঘরে ঢোকার মুখে দেখল শাশুড়ির ঘরের দরজা বাইরে থেকে ছিটকিনি‌ লাগানো, ভিতরে অন্ধকার ।এমনটা তো কোনদিন হয় না। ঘরের দরজা শীতকাল ছাড়া বরাবরই ভোর থেকে খোলা থাকে, ভিতরে আলো‌ জ্বলে। গার্গী দরজা খুলে ভিতরে উঁকি দিল। ঘর ফাঁকা, ভিতরে কেউ নেই। কলতলা, রান্নাঘর ঘুরে কোথাও শাশুড়িকে দেখতে পেল‌‌ না সে। কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষে স্বামীকে জাগিয়ে তুলল।ছেলে মেয়ে দুজন অকাতরে ঘুমিয়ে ।আধো ঘুম চোখে ব্যাপারটি শুনে মুহূর্তে বিছানা ছেড়ে ঘরের বাইরে এল শেখর। মায়ের ঘর, বাস্তুর চারদিক, ছাদ, সর্বত্র সন্ধান করল, কোথাও মাকে পাওয়া গেল না। তাদের নতুন পল্লীর সব ঘরের সবাই তখনও ওঠেনি। আনন্দময়ী‌ যে যে বাড়িতে যাতায়াত করতেন সেই সমস্ত জায়গায় গিয়ে জানা গেল, সেখানেও যাননি। অবাক কাণ্ড! মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে একটা মানুষ হাওয়া হয়ে গেল! কোন রকম সম্ভাব্য ধারণা‌ মাথায় আনতে পারল‌ না শেখর। ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীর কাছে কিছু জানতে চাইল সে। গত রাতে মা কি খেয়েছিলেন, মায়ের শরীর সারাদিন কেমন ছিল, কোনখানে যাওয়ার কথা বলেছিলেন কি না, ইত্যাদি ইত্যাদি। এভাবে বহু প্রশ্ন করে মায়ের গতদিনের‌ অবস্থান সম্পর্কে অবগত হতে চাইল শেখর। তারপর‌ গার্গীকে ফোনটা এনে দিতে বলল।

— কোথায় ফোন করবে?
— দেখি, বাসন্তীর ওখানে গেল কি না।
বাসন্তী শেখরের একমাত্র বোন। ডায়মন্ডহারবারে‌ তার শ্বশুর বাড়ি ।অনেক সময় একা একা সেখানে গিয়েছেন আনন্দময়ী।
…. না! বাসন্তীর ওখানে যাননি মা। খবর নিল মামার বাড়িতে। সেখানেও না।
কী খবর গার্গী জানতে চাইল স্বামীর কাছে ।উত্তরে শেখর জানাল,
–- বাসন্তীর ওখানে বা মামাদের ওখানে কোথাও যাননি মা।
বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল শেখর, দিশেহারা অবস্থা তার।আশে পাশের বাড়ির থেকে বয়স্ক কয়েকজন ততক্ষণে চলে এসেছেন। শেখর যেন কিছুটা স্বস্তিবোধ করল। এ অবস্থায় অভিজ্ঞ মানুষ জনের সুপরামর্শ খুব‌ই জরুরি। আগত ব্যক্তিগণ সবাই তাকে অবিলম্বে থানাতে ডায়েরি করার কথা বললেন। শেখরও ঠিক এই কথাটাই চিন্তা করছিল। এছাড়া অন্য কোন পন্থা সে আপাতত দেখছিল না।

কাগজ কলমের প্রয়োজনে শেখর উঠে ঘরের মধ্যে গেল। কিন্তু ব্যাগটি পাওয়া যাচ্ছিল‌ না, হঠাৎ মনে পড়ল, গতকাল অফিস থেকে ফিরে মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে মায়ের ঘরে‌ ব্যাগটি রেখেছিল সে। মায়ের ঘরে গিয়ে দেখল যেখানেই রেখেছিল সেখানেই আছে বস্তুটি। ব্যাগটি নিয়ে বারান্দায় এসে খুলে কাগজ‌ কলম বের করতে গিয়ে পাওয়া গেল একটা ভাঁজ করা কাগজ।‌ এখানে এমনভাবে কোন কাগজ তো শেখর রাখেনি!‌ কৌতূহল বশে সেটি খুলে দেখল পাতা ভর্তি লেখা। মুহূর্তে চিনতে পারল মায়ের হাতের অপটু অক্ষরগুলিকে।এক নিঃশ্বাসে‌ পড়ে ফেলল বেশ খানিকটা, তারপর পড়া অসমাপ্ত রেখে কাগজটি হাতে ধরে হতভম্বের মতো শূন্যে চেয়ে বসে র‌ইলো। কয়েকটা মুহূর্ত। চোখ থেকে জল গড়িয়ে এল। বিস্মিত সবাই জানতে চাইল, কী হলো! একটু ধাতস্থ হয়ে শেখর মায়ের লেখা চিঠিটির প্রথম কয়েক ছত্র সবাইকে পড়ে শোনাল।সকলেই নিশ্চিত হতে পারল যে,আনন্দময়ী বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন।

চিঠির অবশিষ্ট অংশটুকু শেখর আর পাঠ করল না। এবং তা ইচ্ছা করেই। পড়শির বিপদে যে ক’জন সহানুভূতিও সৌজন্যবশত‌ এসেছিলেন, তাঁরা অনেক দুঃখ প্রকাশ করে সান্ত্বনা ‌দিয়ে উঠে পড়লেন। তবুও একটা ডায়েরি করে রাখা দরকার বলে অভিমত প্রকাশ করলেন প্রায় সকলেই। ছেলেমেয়ে দুজন উঠে পড়েছিল।গার্গী তাদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। শেখর উঠে আবার মায়ের ঘরে গেল।একা একা চিঠিখানা বার কয়েক পড়ল। চোখে জল আর নেই। বুকের মধ্যে একটা অব্যক্ত হাহাকার থেকে থেকে মনটাকে বিষণ্ণতার অন্ধকারে নিমজ্জিত করছিল। তার‌ আত্মীয়জন এবং একান্ত আপন জনের অমানবিক আচরণের কারণে মা আজ গৃহছাড়া। হতাশা, রাগ, ক্রোধ, সব মিলিয়ে তার মনের মধ্যে একটা ঝড় ব‌ইছিল। ছেলে মেয়ের সামনে কোন রকম হঠকারিতা না দেখিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল সে। এক সময় থানার প্রসঙ্গ টেনে পরিচিত অন্তরঙ্গ বন্ধু বান্ধবের সাথে পরামর্শ করার উদ্দেশ্যে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে গেল শেখর।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ২)

সকাল থেকে বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনের আগমন ঘটতে থাকল। পাড়ার লোকজন তো দল দল আসছে, ফিরে যাচ্ছে ।একা গার্গীর পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ল। ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গার্গীর মা সৌজন্য বশতঃ জামাইকে সমবেদনা জানাতে এসেছেন। গার্গীর বাবার শরীর খারাপ থাকার কারণে আসতে পারেননি। শেখরের দুই মামা ও দুই মামি একটু বেলার দিকে এসে পৌঁছলেন। মা-য়ের বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হ‌ওয়ার খবর পেয়ে শাশুড়িকে সঙ্গে নিয়ে সকালে চলে এসেছে বাসন্তী। অফিসে জরুরি প্রয়োজন থাকায় দেবাংশু আসতে পারেনি; তবে অফিস ঘুরে সন্ধ্যার পর আসবে বলে জানা গেল। আত্মীয় আর পাড়া প্রতিবেশীরা সবাই নিজেদের মধ্যে নানান কথার আলোচনা সমলোচনা করতে থাকল। তাদের মুখে হাজারো প্রশ্ন। বেশির ভাগ জনে নিজেরা প্রশ্ন করছে আবার নিজেরাই তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে দিচ্ছে ।আনন্দময়ীর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কারণ নিয়ে এক এক জনের এক এক রকম অভিমত। শাশুড়ি-বৌমার মধ্যে খুব যে একটা সোহগ-সৌহার্দ্য ছিল না, তা কমবেশি সকলেই অবগত ছিল। কিন্তু ব্যাপারটা যে এতদূর গড়াবে এবং এমন চরম পরিণতি ঘটবে এতটা কেউ অনুমান করেনি।

পাশের বাড়ির ন’গিন্নি গার্গীকে জিজ্ঞেস করল – হ্যাঁ বৌমা, তোমরা কোন আভাস – ইঙ্গিত পাওনি?
-– না খুড়িমা, ঠিক এমন চিন্তাটা আমাদের ভাবনায় আসেনি কোনদিন। উত্তর দেয় গার্গী।
–- আমরা তো ভাবিনি, মেজদি এমনভাবে চলে যাবে।
–আমরাও কি ভেবেছি? কার সংসারে না টুকটাক ঠোকাঠুকি হয়?তাই বলে ছেলে-বৌ, নাতি-পুতি ফেলে রেখে চলে যেতে হবে, এটা কোন কথা হলো! একটু ঝাঁঝভরে কথাগুলো‌ গড়গড় করে বলে ফেলে সবার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে র‌ইল বড়বাবু নৃপেন ঘোষালের মা।

বাসন্তী সবার সাথে বেশ কিছুক্ষণ বসেছিল, কোন কথা বলার মতো মনের অবস্থা ছিল না তার; মাঝে মাঝে দু’চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছিল।‌ অভুক্ত শাশুড়ির জন্য একসময় উঠে রান্নাঘরে চলে গেল। গার্গী সেখানে রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। দুই মামি‌ তাকে সাহায্য করছিল। সপ্তর্ষি ও সুজাতা আজকের পরিস্থিতি লক্ষ্য করে কিছুটা হলেও হকচকিয়ে গিয়েছে।আসলে আজ সমস্ত বাড়িটার স্বাভাবিক ছন্দটা কেটে গিয়েছে। শেখর সেই যে থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল এখনও পর্যন্ত বাড়িতে ফিরে আসেনি। তার অফিস, ছেলে মেয়ের স্কুলে যাওয়া, সব আজ বন্ধ। মাকে দিদির বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ঘন্টা খানেক পরে গার্গীর ভাই ঘরে ফিরে গেল। বাবার শরীর খারাপের কারণে গার্গী থাকার জন্য জোরাজুরি করল না; তাছাড়া এ-অবস্থায় আত্মীয়তা পালনের প্রশ্ন‌ই নেই। পরিচিত আত্মীয়-স্বজন যেমন স্বেচ্ছায় আসছে তেমন সৌজন্য সহানুভূতি জানিয়ে ফিরে যাচ্ছে, কারও কিছু মনে করার বা আপ্যায়নের ভালো-মন্দ বিচার করার সময় এটা নয়। সবাই একটা দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে আছে।

শেখরের দুই মামা বারান্দায় চেয়ারে বসে নিজেদের মধ্যে কথা বলাবলি করছিলেন। সবাই তাঁরা অপেক্ষা করে আছেন শেখরের জন্য। সে না ফেরা পর্যন্ত পরবর্তী করণীয় কিছুই ঠিক করা যাচ্ছে না; সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। শুষ্ক মলিন মুখে ঘরে ফিরে এল শেখর। বাড়িতে প্রচুর লোকজনের সমাগম। দুই মামাকে দেখে শেখর তাদের কাছে গিয়ে বসল। মেজো মামা তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করল –কোন ব্যবস্থা করা গেল শেখর?
–- ব্যবস্থা বলতে মামা, …থানায় একটা প্রাথমিক ডায়েরি করে রাখলাম। আমার কয়েকজন পরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাহায্যে কয়েকটি অনুসন্ধান সংস্থায় ইনফরমেশন পাঠিয়েছি। মায়ের ছবি দিয়ে এবার দু’একটা সংবাদপত্রের নিরুদ্দেশ কলমে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করব।
–- বেতার মারফত অনুসন্ধানের একটা ব্যবস্থা করলে বোধহয় ভালো হতো।
–- হ্যাঁ মামা, সে ব্যবস্থাও করার ইচ্ছা‌ আছে। কাল-পরশু অফিসে না গেলে কিছু করতে পারছি না। আমাদের স্টাফের ‌একজনের এক আত্মীয় রেডিও অফিসে কাজ করে।

শেখরের ছোট মামা কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন – দিদি একা একা কোথাও যেতে তেমন সাহস করতনা। কী এমন হলো যে, এই রকম একটা দুঃসাহসিক ঝুঁকি অনায়াসে নিয়ে ফেলল! ভাবতে অবাক লাগে! মামার কথাগুলো শেখর নীরবে শুনে গেল। গ্ৰহণযোগ্য কোন ব্যাখ্যা শেখরও দিতে পারল না সংসারে শাশুড়ি-বৌ বা অপরাপর সদস্য যারা থাকে তাদের মধ্যে অনেক সময় মান-অভিমান বা মনোমালিন্যের কারণ ঘটে থাকে কমবেশি সব সংসারে। কিন্তু সংসার ছাড়ার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত গ্ৰহণের কারণ সামান্য হতে পারে না। মায়ের চিঠির প্রেক্ষিতে শেখর তা অনেকটা উপলব্ধি করতে পেরেছে; তবে তা বিশ্লেষণ করে কাউকে বোঝানো বোধকরি ঠিক হবে না। মেজো মামা শেখরের কাছে জানতে চাইলেন – তোর মা না কি চিঠি লিখে রেখে গেছে, কী লিখেছে তাতে?

যত‌ই নিকট বা দূর সম্পর্কের আত্মীয় হোক না কেন, মায়ের চিঠিখানা দেখানো বা তার বিষয়বস্তু সমস্ত সর্বসমক্ষে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে সাংসারিক তথা সামাজিক মান-মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে আছে বলে শেখরের ধারণা। সে মামাকে বলে – মায়ের চিঠিতে তেমন কিছু নেই মামা ।মূল বক্তব্য হলো, সংসারের বোঝা হয়ে থাকতে নারাজ, তাই চলে গেছেন। অকারণ তাঁকে যেন খোঁজাখুঁজি করা না হয়। …এই জাতীয় সব বক্তব্য।
–- মানুষ‌ মারা গেলে সে যে আর কখনোই ফিরে আসবে না, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হ‌ওয়া যায়। কিন্তু বেঁচে আছে অথচ তার কোন সংবাদ বা সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না; ব্যাপারটা খুবই বেদনাদায়ক! নানাভাবে অনুসন্ধান‌ করার চেষ্টা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই খোকা, ছটফট করারও কিছু নেই।
সান্ত্বনার ছলে মেজো মামা কথাগুলো আউড়ে চলেন। তারপর শেখরকে উদ্দেশ্য করে‌ বলেন – বাড়িতে লোকজন তো আছে। দু’একজন আসতেও‌ পারে।তোর মামিকে গোটা-দুই ব্যাগ দিতে বলতো, বাজার থেকে একবার ঘুরে আসি।
মেজো মামা বরাবর‌ই বেশ করিতকর্মা মানুষ, যে বৈশিষ্ট্যের জন্য শেখর মামাকে খুবই পছন্দ করে। সে নিজে রান্নাঘর থেকে দুটো ব্যাগ নিয়ে এসে কিছু টাকা সমেত মামার হাতে ধরিয়ে দিল।

সন্ধ্যার পর মামা-মামিরা সবাই বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে‌ পড়লেন। সারা দিনের শেষে দাদাকে একান্তে পেল বাসন্তী। জানতে চাইল মায়ের কথা।
–- দাদা, মা তোমাকে কোনদিন কিছু জানিয়েছিল?
দু’মিনিট চুপ থেকে শেখর বলল – ন! বাড়ি ত্যাগ করে যাওয়ার মতো কোন কারণ আমাকে জানায়নি; তবে মায়ের চিঠি পড়ে কারণটা জানতে পারলাম।
–- চিঠিতে নিশ্চয়‌ই বৌদির প্রসঙ্গ আছে? আর তার বাবা মায়ের ভূমিকার কথা?
–- তুই এতকিছু জেনেও আমার কাছে তো কিছু বলিস নি? মা এবং গার্গীর পারস্পরিক সম্পর্ক তেমন ভালো ছিল না তা প্রথম থেকেই জানতাম। কিন্তু এত বছর পর সেই সম্পর্কের মধ্যে গোপনে এতটা অবনতি ঘটেছে এবং তাতে আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ইন্ধন যুগিয়ে আসছেন,আদৌ বুঝতে পারিনি। সামনা-সামনি গার্গীর ব্যবহারে কোন অসঙ্গতি লক্ষ্য করিনি আর মা আমাকে কোনদিন কিছু বিন্দুমাত্র জানাননি! আক্ষেপ ফুটে ওঠে শেখরের গলায়। নিজেকে অপরাধী মনে করে সে।। দাদার কথার প্রেক্ষিতে বাসন্তী জানায় – গত মাসে মা‌ আমাদের‌ ওখানে গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিল; তবে কোন কথা‌ তোমাকে জানাতে নিষেধ করে।

পাখি উড়ে যাওয়ার পর খাঁচার সুরক্ষা নিয়ে ভাবনা করে মানুষ। মায়ের অভাব অভিযোগ সম্পর্কে উদাসীন এবং এড়িয়ে থাকার অপরাধবোধ এখন কুরে কুরে খাচ্ছে শেখরকে। সেই দুঃখ-যন্ত্রণাটা সহোদরা বাসন্তীর সঙ্গে শেয়ার করতে পারায়‌ অনেকটা স্বস্তিবোধ হলো তার। ভিতরে ভিতরে এতটা ধ্বস নিয়ে সংসারটা যে দাঁড়িয়েছিল‌ বর্তমান পরিস্থিতিতে ভাবতে গিয়ে শেখর সঠিক কোন দিশা খুঁজে পায় না। এখন সমস্ত কিছুর মধ্যে ধৈর্য ধারণ করাটাই যে মূল চাবিকাঠি তা কিন্তু শেখর গভীরভাবে উপলব্ধি করত পারছে। কান্না থামছে না বাসন্তীর। শেখর তাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, সান্ত্বনা দেয়। মা যে বেঁচে আছেন সে কথা বলে নানা উপায়ে মায়ের সন্ধান করার প্রতিশ্রুতি দেয় সে। ভাই-বোনের কথার মাঝে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে দেবাংশু। বাসন্তী উঠে গিয়ে সমাদরে তাকে মায়ের ঘরে নিয়ে যায়; ছেলে-মেয়ের খোঁজখবর নিতে শেখরও উঠে পড়ে।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৩)

অনেক কষ্ট, অনেক দুর্ভোগ সহ্য করে বহু পথ ঘুরে ঘুরে পাঁচ দিনের মাথায় বৃন্দাবনে পৌঁছলেন আনন্দময়ী। সারা পথের পরিশ্রম আর দুশ্চিন্তার শেষে বৃন্দাবনে যে পা রাখতে পেরেছেন এই ভাবনাটাই তাঁকে স্বস্তি দিল। এখানে রাধামাধবের চরণে কোথাও না কোথাও ঠাঁই একটা মিলে যাবে। সপ্তর্ষি-সুজাতা তখন জন্মায়নি। স্বামীর সাথে উত্তর ভারত ভ্রমণে এসে বৃন্দাবনে দুটো দিন কাটিয়েছিলেন আনন্দময়ী। সেদিনের বৃন্দাবনধামের অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে আজ।প্রকৃতির আপন রূপসজ্জা ছাপিয়ে নাগরিক সভ্যতার প্রলেপ কমবেশি সর্বত্র চোখে পড়ে।

মথুরা স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে ওখানে কেটে যায় এক রাত। পরের দিন যমুনা পেরিয়ে এসে ওঠেন বৃন্দাবনধামে। বৃন্দাবনের ঐতিহ্য হল, এখানে খাওয়া পরার অর্থাৎ ভাত-কাপড়ের অভাব হয় না। যে কোনো একটা মন্দিরে গিয়ে আশ্রয় নিলে দুবেলা প্রসাদ পাওয়া যায়। শেঠজিদের মন্দিরে প্রায় সময় বস্ত্র বিতরণ করা হয়। বিশেষ করে ষাটোর্ধ বিধবাদেরকে বহু মন্দির বা আশ্রমে সহানুভূতির সাথে আশ্রয় দানের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। একাধিক ভজনাশ্রম আছে যেখানে‌ মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে বহু অসহায় নরনারী সেবাদান আর ভজন সাধন করে সময় কাটান। সেবাদান কর্ম বিভিন্ন ধরণের আছে, যেমন আশ্রমের বাসন ধোওয়া, ঘর- দুয়ার মোছা, প্রসাদ পরিবেশন, ভোগ রন্ধনে সাহায্যদান ইত্যাদি। নির্দিষ্ট কোনো একটি আশ্রমে দীর্ঘদিন ধরে একনিষ্ঠভাবে সেবাদান করে গেলে পরে পরে একটা স্থায়ী পদে তার পদোন্নতি হয়।

বৃন্দাবনের প্রায় সমস্ত আশ্রমে নিয়মিত ভোর তিনটে নাগাদ স্নান করে সাধন-ভজনে অংশগ্ৰহণ বাধ্যতামূলক। এই ভজন কীর্তন সকাল সাঁঝে দুবেলাই হয়ে থাকে। কিছু কিছু পালনীয় বিধি নিষেধ বা নিয়মকানুন আশ্রমবাসী সেবায়েতদের মেনে চলতে হয়; যেমন, মাথার চুল ছোট করে কাটতে হবে, শ্বেত চন্দনের তিলক কপালে, কর্ণমূলে ধারণ করতে হবে। দিবসের কোনো একটা সময় মাধুকরী বৃত্তির অনুশীলন সাধনমার্গীদের পালনীয় ধর্মীয় কর্তব্যের মধ্যে গণ্য হয়। প্রথম দুটি মাস আনন্দময়ী বিভিন্ন মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে ঘুরে আশ্রয় নিয়ে কাটালেন।এরমধ্যে একদিন দুই পরিচিতা বিধবার সঙ্গী হয়ে রাধাকুন্ডে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। রাধাকুন্ডে অধিক সংখ্যক বাঙালির বাস।নিজের ভাষায় কথা বলে অনেকটি তৃপ্তি হল বটে, মনের স্থিরতা বা মানসিক শান্তি তেমনভাবে মিলল না।

বৃন্দাবনে বিভিন্ন প্রকারের মানুষ এসে জড়ো হয় পৃথক পৃথক উদ্দেশ্য নিয়ে। অনেকে সংসারের জ্বালা -যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পেতে স্বেচ্ছায় চলে আসেন। বিধবাদের মধ্যে বেশির ভাগ‌ই এসেছেন পরিবার-পরিজনের অত্যাচার, অনাদর-অবহেলায় বাধ্য হয়ে। তবে বৃন্দাবনে যে যে-কারণেই আসুন না কেন, অন্তরের ভক্তি ছাড়া মুক্তি বা শান্তি এখানে নেই। ভক্তি ছাড়া কৃষ্ণপ্রাপ্তি সম্ভব নয়। তাই অনেকেই কিছুদিন এখানে কাটিয়ে ভক্তির অনুশীলনে ব্যর্থ হয়ে আবার স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করেন। অনেকে দু-চার দিন ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বৃন্দাবনে এসে কিছু অর্থ-কড়ি ব্যয় করে আবার অন্যত্র পাড়ি জমান।এই জাতীয় মানুষজনের কেবল ভ্রমণটাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, সাথে কিছু ধর্ম সঞ্চয়ের বাসনা অন্তর গভীরে কাজ করে।

বৃন্দাবনে প্রায় ৬০০০ আশ্রম, বহু বৃদ্ধাবাস, বিধবাশ্রম, ‘গিল্ড অফ সার্ভিস’ নামে একটি সংস্থা, এছাড়া বহু এন-জি-ও আছে যারা বৃন্দাবনে আগত অবহেলিত, অসহায় নারী এবং শিশুদের কল্যাণে কাজ করে থাকে। ছ’মাসের অধিককাল বৃন্দাবন বাসিনী আনন্দময়ী। এখনও পর্যন্ত সংসারত্যাগী মনটাকে মনে প্রাণে ঘরবিবাগী করে তুলতে পারলেন না তিনি। বৃন্দাবনের বিভিন্ন আশ্রম এবং তার আশপাশের এলাকা মিলিয়ে বহু বিধবা বাস করেন। সবাই যে মনের দিক দিয়ে খুব শান্তিতে আছেন তেমনটা নয়; তারমধ্যে বড়ো একটা অংশ বহুদিন ধরে এখানে বাস করতে করতে এখানকার জীবনধারার সঙ্গে নিজেদেরকে যথাসাধ্য মানিয়ে নিতে পেরেছেন; অনেকে খাপ খাওয়াতে না পারলেও অন্য কোথাও যাওযার বিকল্প উপায় নেই তাদের। শেষ সম্বল হিসেবে রাধামাধবের চরণ আশ্রয়ে মৃত্যু বরণের অপেক্ষায় কোনোক্রমে দিনাতিপাত করে চলেছেন।আনন্দময়ী এখনও দোলাচলে; কোথাও কোনো কিছুতে মনটাকে স্থির করতে পারছেন না। জীবনের এতগুলো বছর‌ যে ধারায় জীবন কাটিয়েছেন তার সঙ্গে এখনকার এই জীবন যাপনের কোনো‌দিক থেকে মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। নারী স্বভাব সুলভ সহজাত ভক্তির অধিকারিণী হলেও যে ভক্তি সম্বল থাকলে রাধামাধবের লীলাক্ষেত্রে নিজেকে যুক্ত করে শান্তির ঠিকানা খুঁজে পাওয়া সম্ভব, তা তাঁর হৃদয়ে সঞ্চিত নেই। তবু ও রাধাকৃষ্ণ পাদপদ্মে নিজেকে সমর্পণ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এখানে এই আশ্রমিক ক্রিয়াকর্মে কোনো ছুটি নেই; কর্মপ্রবাহের কোনো বিরতি নেই। দিনের পর দিন এক‌ই নিয়মে ঘটে চলেছে। সবাই সর্বক্ষণ সেবাদানে ব্যস্ত। বসে থাকলেও নাম জপ, নাম সংকীর্তন ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেদেরকে সক্রিয় রাখতে হয়। এই অভ্যাসে যারা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাদের অন্য কোনো চিন্তা নেই। সকাল শুরু হলে অনায়াসে সন্ধ্যা নেমে আসে , রাত্রি শেষে আবার একটা নতুন দিনের শুরু হয়। এমনি অলস ধারায় কেটে যায় দিনগুলি। কাজ বলতে তেমন কায়িক শ্রমের কিছু নেই। নাওয়া-খাওয়া, অল্প-বিস্তর সেবাদান, দুবেলা নাম সংকীর্তন, দিনে একবার মাধুকরী ইত্যাদির ভিতর দিয়ে গতানুগতিক মন্দ লয়ে দিনাতিপাত। সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়ে রাধামাধবে মনোনিবেশ‌ই একমাত্র লক্ষ্য। বৈচিত্রহীন একঘেয়েমিই অধিক বলে ধারণা হল আনন্দময়ীর। মনের দিক থেকে আনন্দময়ী যেন অনেকটা নিঃসঙ্গ। এত দিনের মধ্যে কারো সাথে তেমনভাবে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠার মতো ঘনিষ্ঠতা তৈরি হল না। পরিচয় হয়েছে অনেকের সাথে, এক পথে পথ চলতে গেলে যতটুকু সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তার বেশি নয়। নবাগতা যারা, তাদের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপনের প্রচেষ্টাটাই অধিক।

ইতিমধ্যে একদিন সদ্য পরিচিতা দু’জনের সাথে বিশ্রাম ঘাটে স্নান করতে গিয়েছিলেন আনন্দময়ী। সেখানে আরো দু’জনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাঁরা এসেছেন পাগলা বাবার মন্দির থেকে। সবাই মিলে গল্পে গল্পে বেশ কয়েক ঘন্টা কেটে যায়।যমুনা পাড়ে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের পাদস্পর্শধন্য বিশ্রাম ঘাট আনন্দময়ীকে গভীরভাবে আকর্ষণ করল। সেখানে নব পরিচিত দু’জনের মুখে পাগলা বাবার মন্দিরের গল্প প্রথম শুনলেন তিনি। বেশ বড়ো এবং স্বনামখ্যাত মন্দির। বহু আশ্রমিক, বহু অসহায়া বিধবার বসবাস সেখানে। ভ্রমণকারী দর্শনার্থীদের দশ টাকার টিকিট সংগ্ৰহ করে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। সেখানকার ব্যবস্থাপনা এবং নিয়ম কানুন জিজ্ঞেস করে করে জেনে নিলেন আনন্দময়ী। তারপর সবাই একসাথে শ্যামকুন্ড, রাধাকুন্ড ঘুরে সন্ধ্যার আগে আগে তিনজনে বর্তমান আশ্রমে ফিরে এলেন। তখনও নাম জপ আরম্ভ হয়নি। আনন্দময়ীরা সন্ধ্যার নাম সংকীর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আশ্রম প্রাঙ্গণের আলোক বাতিগুলি ততক্ষণে জ্বলে উঠেছে।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৪)

যা’র কারণে সংসারের ছন্দটা বিঘ্নিত হচ্ছিল বলে ধারণা গড়ে উঠেছিল গার্গীর মনে, এখন দেখল তার‌ই জন্য স্বাভাবিক গতিতে চলতে থাকা সংসারের নিত্য দিনের সুখ-দুঃখের প্রবাহটা বাঁকে বাঁকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। ছেলে মেয়ের মধ্যে ঠাকুর মায়ের স্নেহের অভাব জনিত ঘাটতির আভাসটা প্রকট হয়ে উঠতে দেখছে গার্গী। তাদের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ও নিঃশব্দে একটা ব্যবধান তৈরি হতে শুরু করেছে। সব কিছু জেনে বুঝে ও স্বামীকে কোনো প্রশ্ন করার ভরসা পাচ্ছে না সে। শাশুড়ির লেখা চিঠিটা একবার দেখতে চেয়েছিল। নিষ্পয়োজন বলে শেখর এড়িয়ে গিয়েছে। গার্গী ও দ্বিতীয় বার দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে নি। তবে চিঠির বাকি অংশে কি থাকতে পারে তার কিছুটা আন্দাজ করতে অসুবিধে হয় নি তার। তাছাড়া শেখরের এড়িয়ে যাওয়ার কারণে অনুমানটা আরো দৃঢ় হয়। মায়ের গৃহত্যাগের কারণ শেখরের কাছে স্পষ্ট। কিন্তু তা নিয়ে প্রকাশ্যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করেনি শেখর। তার এই নীরবতাই গার্গীর মনের অস্বস্তিটা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাড়িতে কিছু না জানিয়ে একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের নিয়ে বহু জায়গায় খোঁজ খবর চালাল শেখর। বহু অনুসন্ধান সংস্থার সাথে যোগাযোগ করল। মায়ের ছবি ও নিজের ফোন নম্বর দিয়ে রেখে প্রতিদিন আগ্ৰহ নিয়ে প্রত্যাশা করে এই বুঝি কোনো একটা সংবাদ এসে পৌঁছল।দিন শেষ হয়ে যায়, নতুন দিনের শুরুতে আবার নতুন আশায় বুক বেঁধে ক্ষত-বিক্ষত হয় শেখর। না! মায়ের সন্ধান কেউ দিতে পারছে না! তবে কি মা আর বেঁচে নেই! ভাবতে ভয় পায় সে। সহসা উদ্গত অশ্রুতে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসে। কিন্তু মা যে বেঁচে আছেন, মন যেন সে কথাই বার বার বলে তাকে।
শেখর যতক্ষণ বাড়িতে থাকে তার বেশিরভাগ সময়টা মায়ের ঘরে কাটায়। নিজের হাতে ঘরটি পরিপাটি করে রাখে। ছেলে মেয়ে দুজন কোনো কোনো দিন শেখরের সাথে এসে জোটে। ছেলে সপ্তর্ষি এখন অনেকটা বুঝতে শিখেছে। সে জানে ঠাকুর মা হারিয়ে গিয়েছে। প্রথম প্রথম বাবাকে অনেক প্রশ্ন করেছে, বার বার জানতে চেয়েছে; এখন আর কিছু বলে না। মেয়ে সুজাতা পড়ালেখার ফাঁকে ফাঁকে খেলনা পাতি নিয়ে এসে খেলা করে। তার মনে কোনো জিজ্ঞাসা আছে কি না তা বলা যায় না, তবে সে যে অনেক সময় ঠাকুরমার সাহচর্য চাইছে তা অনুমান করা যায়। বাচ্চা মানুষ, তার অসহায় চাহনি দেখে শেখর বুঝতে পারে; মনটা তখন তার বিষাদে ভরে ওঠে। বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আনন্দময়ী নিরুদ্দেশ হ‌ওয়ার দিন শরীর খারাপ থাকার কারণে শেখরের শ্বশুর আসতে পারেন নি। মাঝে একদিন শেষ খবরাখবর কি আছে জানতে এসেছিলেন। অনেক জেদাজেদির পরে একটা বেলা যে কোনো‌ রকমে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরে যান।একটা বিষয় খুবই লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে যে, শেখর, গার্গী এবং গার্গীর বাবা মায়ের মধ্যে আত্মীয়তার শৈথিল্যের চোরা স্রোত অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতো নিঃশব্দে বয়ে চলেছে। পারস্পরিক স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে কোথায় যেন একটা প্রাচীর উঠে যাচ্ছে যা এতদিন ছিল না। মা বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হয়েছে কেন শেখর জেনেছে। কিন্তু ব্যাপারটি নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা বা বিচার-সালিশির পথে হাঁটার মতো প্রবৃত্তির মানুষ নয় শেখর। তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক প্রায় এক দশকের বেশি হতে চলল। ছেলে মেয়ে দুজন যথেষ্ট বড়ো হয়ে উঠেছে; ঘরে বাইরে সম্মান হানি এবং সামাজিক মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হ‌ওয়ার কারণে সমস্ত ঘটনাটি যথাসম্ভব আত্মসম্বরণ দ্বারা নিরসনের চেষ্টা করে চলেছে সে। অন্তরের অন্তর্দাহ বাইরে প্রকাশ না করে যতটা স্বাভাবিকতা বজায় রেখে চলা যায় তা নিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সে। এমনিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটির জন্য বন্ধু -বান্ধব বা পরিচিত মহলে মনে মনে যথেষ্ট লজ্জিত। শ্বশুর-শাশুড়িকে ততটা দোষ দিতে পারছে না শেখর। কারণ, গার্গীর সমর্থন বা উৎসাহ না পেলে তাঁদের পক্ষে পৃথক একটা পরিবারের বিষয়ে অনধিকার চর্চা করার মতো অবুঝ তাঁরা নন; বিশেষ করে শেখরের শ্বশুর মশাই। ঘটনার পর মনের দিক থেকে তিনি খুবই সংকুচিত। শেখরের মেজো মামা প্রায় সময় ফোনে শেখরের সঙ্গে কথা বলে, জানতে চায় তার দিদির কোনো সংবাদ আছে কি না। অন্য আত্মীয়-স্বজন এখন আর তেমন ভাবে খোঁজ খবর রাখে না। কিন্তু আনন্দময়ীর সন্ধান পাওয়া নিয়ে মনে মনে আশাবাদী সবাই।

মায়ের জন্য বিরাট একটা শূন্যতা অন্তরে বহন করে চলেছে শেখর। কিন্তু সব থেকে দুঃসহ বেদনা নিয়ে দিন কাটছে গার্গীর। কাছে আছে অথচ সাথে নেই এমন একটা চাপা অস্বস্তিকর সম্পর্কের বাতাবরণের মধ্যে আর যেন জুঝে উঠতে পারছে না সে। মা- বাবা আর আগের মতো আসে না, তারা ও যেন অনেক দূরত্ব তৈরি করে ফেলেছে এ বাড়ির সঙ্গে। সংসারের কাজের ফাঁক বুঝে গার্গী ও এক-আধ বেলা বাপের ভিটেয় পা রাখত; সংসারের এই ঘটনার পর আর যাওয়ার ভরসা পায় না। কী যেন একটা অপরাধ বোধ আপন থেকে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়া প্রতিবেশী, জ্ঞাতিগোত্রের সাথে দুদণ্ড কথা বলে মনটা হালকা করবে সে পথ ও বন্ধ। শাশুড়ির সাথে গার্গীর সম্পর্ক যে মধুর ছিল না, আনন্দময়ীর বিদায়ে তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে; আর সেই কথা মনে মনে চিন্তা করে গার্গী অপ্রয়োজনে কারো সঙ্গে মেলামেশা করতে চায় না।

এক ছুটির দিনে শেখর মায়ের ঘরে বসে একান্তে ফাইল-পত্র নিয়ে কাজ করছিল। ছেলে মেয়ে দুজন বাড়িতে পড়াতে আসা আন্টির কাছে পড়াশুনোতে ব্যস্ত। হঠাৎ গার্গী নিঃশব্দে শাশুড়ির ঘরে ঢুকে শেখর যে বিছানায় বসে কাজ করছিল তার এক পাশে গিয়ে বসল। শেখর একবার মুখ তুলে চেয়ে দেখে আপন মনে কাজ করে চলল। মিনিট দুয়েক পরে মুখ না তুলেই শেখর বুঝতে পারল গার্গী কাঁদছে। শেখর একটু অবাক হল,কাজ থেকে মন সরিয়ে গার্গীর উদ্দেশ্যে বলল, — কি হল, হঠাৎ কান্নাকাটি কেন? শরীর খারাপ হয়নি তো? শাড়ির আঁচলটা মুখে চেপে ধরে গার্গীর কান্না এবার প্রচণ্ড বেড়ে গেল।কান্নার দমকে সারা শরীরটা আন্দোলিত হতে থাকল।এতক্ষণে শেখর কাছে এসে গার্গীকে দুহাতে কাছে টেনে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে কারণ জানতে চাইল। মিনিট দুয়ের মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়ে গার্গী কান্নাভেজা স্বরে বলে,– আমি আর পারছি নে, কি করব আমি? এক কথায় শেখর ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে নিজেকে আগের মতোই সংযত রেখে বলল, — অসুবিধে কি হচ্ছে?
গার্গী চুপ করে থাকে।

— অসুবিধে হ‌ওয়ার কথা তো নয়, বরং সুবিধে হবে ভেবে তো পরিকল্পনাটা করে ছিলে।
শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে কথাগুলো জানাল শেখর।

— তুমি পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়ে যেভাবে একতরফা সুখ ভোগের জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল তেমনটাই তো হয়েছে। তাহলে না পারার কি আছে আর কান্নার কি আছে! তোমাদের মনোগত ইচ্ছাই তো পূর্ণ হয়েছে। কাউকে অপরাধী না করে আপন দায়িত্ব মাথায় নিয়ে নিঃশব্দে মানুষটা সরে গেল, এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে?

একটানা কথাগুলো বলতে পেরে এতদিন পর শেখর অনেকটা হালকাবোধ করতে লাগল।উভয়ে উভয়ের কাছে এতদিনের এই মানসিক অচলাবস্থা চলার অনালোচিত কারণটি অল্প কথায় পরিষ্কার হ‌ওয়াতে কিছুটা হলেও সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। শেখরের এত কথার প্রেক্ষিতে গার্গী কোনো উত্তর না দিয়ে আবার কাঁদতে লাগল।মা চলে গেছেন দীর্ঘ কয়েক মাস হয়ে গেল। এই ক’মাসের গুমোট ঠাণ্ডা লড়াইয়ের পরিবেশটা শেখরের যে ভালো লাগছে না তা সে হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে পারছে। ইচ্ছে করেই সে এই নির্লিপ্ত অবস্থানটি গ্ৰহণ করেছিল। মায়ের জন্য প্রথম প্রথম মনের মধ্যে একটা ঝড় গেছে।পুত্র পরিবার সব‌ই থাকা সত্ত্বেও মা যে পথে পথে ভিখারির মতো ঘুরে ঘুরে বেড়াবে, এই ভাবনাটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। এখন ও সর্বক্ষণ মায়ের কথা তার চিন্তার অর্ধেক অংশ জুড়ে থাকে।ব্যাপারটি তাকে স্বস্তি দেয় না। গার্গীর উপর সময়ে সময়ে মনের বেভুলে একটা প্রতিশোধ স্পৃহা জাগে মনে, পরক্ষণেই সন্বিত ফিরে পায়, নিজের কাছে নিজে লজ্জা পায়; ছেলে মেয়ে দুটোর মুখ মনে পড়ে,যত‌ই হোক গার্গী তার সন্তানদের জননী। এ যেন ঠিক এক হাত কামড়ালে অপর হাতে ব্যথা বাজে।

শান্ত হয়ে চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থেকে গার্গী ধীরে ধীরে ঘরের বার হয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল। সেদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে শেখরের বুক থেকে টানা একটা নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল। এখন আর কাজে মন দিতে ভালো লাগছে না।কাগজপত্র গুছিয়ে রেখে শেখর উঠে বাইরে এল। সদর দরজার দিকে চোখ পড়তে দেখতে পেল বোন বাসন্তী বাড়ির মধ্যে ঢুকছে, সঙ্গে দেবাংশুও।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৫)

একদিন মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসল শেখর। সেই অবস্থায় বিলম্ব না করে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল সে। তারপর ঘর রান্নাঘর করে বাড়ির সমস্ত জায়গায় খুঁজে দেখল।।কোথা ও নেই ! হতাশ ও নিরুৎসাহ হয়ে মায়ের ঘর খুলে ভিতরে ঢুকল শেখর। অজান্তে কখন চোখে জল এসে গেছে বুঝতেই পারেনি। শেখর ঘুমিয়েছিল। ঘুমের মধ্যে স্পষ্ট মায়ের গলা শুনতে পেয়ে তার ঘুম ভেঙে যায়। মা যেন ফিরে এসেছেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘খোকা খোকা’ বলে বেশ কয়েক বার ডেকেছেন; সে তো ভুল শোনেনি, স্বপ্ন এমন স্পষ্ট হতে পারে?

কাঙ্ক্ষিত বস্তু পেয়ে হারাবার মতো যন্ত্রণাবিদ্ধ হাহাকার তার হৃদয়কে দুমড়ে মুচড়ে দিতে লাগল। নাড়ি স্পন্দনের গতি এতটাই দ্রুত চলছে বুঝে মায়ের ঘরের উজ্জ্বল আলোখানা জ্বালিয়ে দিয়ে স্থির হয়ে বসে থাকার চেষ্টা করল সে। এ অবস্থায় এখন আর ঘুম আসতে পারে না। অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে উঠে আসার শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল গার্গীর। জেগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর শেখর আসছে না দেখে সে ও বাইরে বেরিয়ে এল। দেখল মায়ের ঘরে আলো জ্বলছে। ধীর পায়ে সেখানে গিয়ে শেখরকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করল,— কি গো, এতরাতে হঠাৎ উঠে এখানে এলে কেন?

শেখর তৎক্ষণাৎ কোন উত্তর দিতে পারল না। কয়েক মুহূর্ত পরে বলল, — আচমকা একটা আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে এসে কিছু দেখতে পেলাম না। গার্গী আর অপেক্ষা করল না। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করল। বাচ্চা দুটো অন্ধকারে ঘুমাচ্ছে। সকাল হতে তখন ও ঘন্টা দুয়েক বাকি। শেখর উঠে আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল। গার্গী জেগেই ছিল। স্বামীকে ঘরে ফিরতে বুঝে ও কোনো সাড়া দিল না। শেখর ছেলে সপ্তর্ষিকে একটু সরিয়ে দিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ল।

সকালে গার্গী রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। শেখরের অফিস টাইম, ছেলে মেয়ের স্কুল,সব কিছুর জন্য সকালটা বড়ো ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে। একহাতে সব কিছু সামলাতে দম ফেলার সময় থাকে না বেচারির।
এমন সময় একেবারে হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ঢুকল গার্গীর ভাই গগন।এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে দিদিকে রান্নাঘরে দেখতে পেয়ে সে সেখানে প্রবেশ করল। গার্গীর রান্নার কাজ প্রায় শেষের পথে; ভাইকে সস্নেহে বলল, — চল্‌, ঘরে গিয়ে বসবি চল্।
— না ঠিক আছে, এখানেই বসছি।
ভাইয়ের ভাবভঙ্গি লক্ষ্য করে গার্গীর কেমন যেন খটমট লাগল।কাজ থেকে মন সরিয়ে গগনের উদ্দেশ্যে বলল, — হঠাৎ চলে এলি, কোনো খবর আছে? মা- বাবা কেমন আছে?
— ভালো।
গগনের গলার আওয়াজটা অস্বাভাবিক গম্ভীর শোনাল। গার্গী বুঝতে পারলো, কিছু একটা ঘটেছে এবং সেটা মা- বাবাকেই নিয়ে। সে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে নিরীক্ষণ করতে লাগল।
— আজ তুই একবার চল্ দিদি। একটা ব্যবস্থা করে দে। আর ভালো লাগছে না।
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অভিমানী ভঙ্গিতে নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা হেঁট করে চুপ হয়ে গেল গগন।

গার্গীর অনুমান ঠিক। বাপের ঘরে বর্তমানে ওই একটাই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সংসারে অভাব য‌তটা না আছে, স্বভাবে অসঙ্গতিটা মাথা তুলেছে তার চারগুণ।আগে এমন ছিল না। ভাইয়ের বিয়ের পর থেকে সাংসারিক ঝামেলা কমবেশি লেগেই আছে। মা- বাবা অশিক্ষিত মূর্খ মানুষ।সেকেলে ধ্যানধারণায় অভ্যস্ত। কলেজে পড়া গগন মা- বাবার অমতে এক শিক্ষিত আধুনিকা ব্যবসায়ী- কন্যাকে ভালোবেসে বিয়ে করে ঘরে তুলেছে। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণে অগ্নিসাক্ষী রেখে নব দম্পতি পরিণয় বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে কি না কেউ তা জানে না।মা- বাবার প্রথম আপত্তি এবং সন্দেহ সেখানেই। শাঁখা সিঁদুরের বালাই নেই; শাড়ি পরতে জানে না নতুন বৌমা। ঘরের কাজ কর্ম তথৈবচ, ঘর বারান্দায় যেখানকার বস্তু সেখানেই পড়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। এক টিপ পুরু ধুলো ময়লার উপর দিয়ে জুতো পায়ে গটগট চলা ফেরা করে; পরিষ্কার তো দূরের কথা, কোনো দিন ঝাঁটা হাতে ধরে না। কাজের মধ্যে কেবল বিদেশি ধাঁচে কিছু রান্নাবান্না করে স্বামী স্ত্রী দুজনের মতো ভাত তরকারি নিয়ে ঘরে ঢোকে। শ্বশুর শাশুড়ি কি খাচ্ছে কি না খাচ্ছে সে দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না।

একটা মাত্র ছেলে। মা- বাবার কত আশা ছিল, দেখে শুনে পছন্দ মতো একজন বৌমা নিয়ে আসবে। সে গুড়ে বালি। ছেলে এখন সেয়ানা হয়েছে, বাবা – মা’ র কথা এক কান দিয়ে শুনে আর এক কান দিয়ে বের করে দেয়। মাসের মধ্যে তিন চার বার বৌয়ের হাত ধরে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে ওঠে।চাষ- আবাদ, বাগান – বাগিচা, কোনো কিছুতে তার নজর নেই; খোঁজ খবর ও রাখে না। দেখে শুনে বিরক্ত বিপিন বাবু দু’ চার কথা শুনিয়ে দেয় আর তখনই তা নিয়ে বাধে গণ্ডগোল। পাড়া-প্রতিবেশিরা এসে সাময়িক মিটমাট করে দিয়ে যায়। সে আর কতক্ষণ, আবার যে কে সেই। বনেদি গৃহস্থ বাড়ির ঐতিহ্যমান- সম্মান কিছুই আর অবশিষ্ট থাকল না।

গার্গী বলে — আবার বাবা-মা’ র সাথে ঝামেলা করেছিস নিশ্চয়।
— ঝামেলা আমরা করছি না, করছে তারা। আমাদের বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যেতে বলছে।
ক্ষোভ ভরে জবাব দেয় গগন।
— তা যাঃ! তোদের তো যাওয়ার জায়গার অভাব নেই। তাছাড়া বাবা -মায়ের বয়স হয়ে গেছে, আর কতদিন খাটাখাটনি করবে। কোনো আয়ের পথ দেখিস না; কেবল বসে বসে খেয়ে যাচ্ছিস আর ফুর্তি করে বেড়াচ্ছিস। এভাবে কতদিন চলবে?

গার্গীর কথা শুনে গগন চুপ করে থাকে। মনে মনে বুঝতে পারে দিদি সম্পূর্ণভাবে বাবা- মায়ের পক্ষে; তবু গার্গীকে একবার যাওয়ার জন্য জেদ ধরে এবং আজ‌ই। অনেকটা নরম হয়ে গিয়ে গগন বলে,– কাল থেকে রান্না খাওয়া প্রায় বন্ধ। মিলি জেদ ধরেছে বাপের বাড়িতে চলে যাবে; সে ভীষণ কান্নাকাটি করছে। স্বেচ্ছায় বাপের ভিটেয় যেতে আগ্ৰহ দেখাতে পারছে না গার্গী। তার উপর সংসারের সব কিছুই তাকে সামলাতে হয়; কোথাও যেতে গেলে দুদিন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। ভাইকে গার্গী বলে, — তোর দাদাবাবুকে গিয়ে বল খুব জরুরি প্রয়োজন, তোমাকে যেতে হবে। গগন ধীরে ধীরে উঠে বারান্দায় শেখরের কাছে গিয়ে সব কথা সংক্ষেপে জানাল এবং শেষে তাকে যাওয়ার জন্য আন্তরিক আবেদন জানাল। শেখর শুনল সব, কিন্তু খুব একটা আগ্রহ দেখাল না। তার শ্বশুরের সংসারে ইদানিং টুকটাক ঝগড়া- ঝাঁটি, বিবাদ-বিতর্ক নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রান্নার কাজ সমাধা হয়ে গিয়েছিল গার্গীর। বারান্দায় এসেছিল ছেলে মেয়ের স্নানের উদ্যোগ নিতে। স্বামীকে উদ্দেশ্যে করে বলল, — গগন কি বলে শুনেছ? পারলে একবার যাওয়ার চেষ্টা করো।ও তো নাছোড়বান্দা, আমি গেলে সংসারের সমস্ত কিছুই থমকে যাবে। স্বামীকে যেতে বলার মধ্যে মূলত দুটি উদ্দেশ্যে ছিল গার্গীর। স্বামীর উপর দায়িত্ব দিয়ে বাপের বাড়ির বিষয়ে নিজে কতটা অনুৎসাহী তা প্রমাণ করা; দ্বিতীয়তঃ বাবার সংসারের বর্তমান সমস্যার সাথে শেখরকে যুক্ত করা। শেখর স্ত্রীকে বলে, — জরুরি মনে করলে তুমি নিজে যাও; প্রয়োজনে আমি আজ অফিস বন্ধ করছি। যে কথা জোর দিয়ে তোমার বলার এক্তিয়ার আছে, আমার পক্ষে তা বলা যেমন সম্ভব নয়, তেমন সঙ্গতিপূর্ণ ও না। মেয়েকে নিয়ে তুমি ঘুরে এসো।

এই সব মুহূর্তে মায়ের কথা বেশি করে মনে পড়ে শেখরের। মা থাকলে তাকে আজ অফিস কামাই করার কথা ভাবতে হতো না। ছেলের স্কুলে যাওয়া আর বাড়ি পাহারা দেওয়া, দুটোই মা ঠিক সামলে নিতে পারতেন। গার্গী যে বুঝতে পারে না তা নয়। শুধু আজ নয়, কোনো কোনো দিন সংসারের এমন অনেক ছোটখাটো ব্যাপারের মুখোমুখি হতে হয় তাকে যখন শাশুড়ির অনুপস্থিতির অভাবটা গভীরভাবে উপলব্ধি করে সে। কিন্তু মনের ভাবনা মনেই মিলিয়ে যায়, প্রকাশ করার ক্ষেত্র কোথায়! গার্গীর যাওয়ার গরজ খুব একটা ছিল না। কিন্তু ভাইয়ের অনুনয় বিনয় আর বাবা – মায়ের কথা চিন্তা করে একটিবার ঘুরে আসা জরুরি হয়ে পড়ল। ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে তাৎক্ষণিক করণীয় কাজ কিছু দ্রুত গুছিয়ে নিল গার্গী। পরিকল্পনামতো শেখর আজ অফিস না গিয়ে বাড়িতে থেকে গেল। গার্গী ও স্বামীর ভরসায় ছেলে এবং সংসারের ভার দিয়ে মেয়েকে নিয়ে ভাইয়ের সাথে ব্যস্তভাবে বেরিয়ে পড়ল।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৬)

দোল বা হোলি উৎসবের সময় বৃন্দাবনের সামগ্ৰিক চেহারাটাই বদলে যায়। বসন্ত উৎসবের সেই বাসন্তী রঙিন উন্মাদনা তরুণ তরুণীদের উন্মাদ প্রায় করে তোলে; তার ছোঁয়া লাগে বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মনেও। বৃন্দাবনে একটা জায়গা ‘বিধবা নগরী’ নামে পরিচিত। প্রায় ১৫-২০ হাজার বিধবার বাস সেখানে। বহু এনজিও এবং সরকারি সাহায্যে এখানকার বৃদ্ধাবাসগুলি চলে। মথুরার আকর্ষণীয় হোলি উৎসবের মতো বৃন্দাবনের হোলি উৎসবের নজরকাড়া আকর্ষণ হল, বিধবাদের রঙের উৎসব। আত্মীয় পরিজন পরিত্যক্ত এই সমস্ত অসহায় বৃদ্ধাগণ, যাদের জীবন থেকে রঙিন হারিয়ে গিয়েছে; একটা দিনের জন্য হলেও ভুলে যাওয়া রঙিন স্বপ্নটাকে জাগিয়ে দিতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‌’সুলভ ইন্টারন্যাশানাল’- এর তরফ থেকে প্রতি বছর হোলিতে বিধবাদের জন্য একটি অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্ধারিত দিনে প্রতিটি বিধবা যাতে তাদের শ্বেত পরিধেয় রাঙিয়ে নিয়ে উৎসবের অংশীদার হতে পারেন, সেদিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখা হয়। এতদিন হয়ে গেল, পিছুটান আনন্দময়ীকে এখনও টানছে। চেষ্টা করেও সবার রঙে রং মেলাতে পারছেন না।

আজ হোলির দিনের উন্মাদনা আর প্রাণভরা উল্লাস আনন্দময়ীর মনে কেমন একটা রূপান্তর এনে দিয়েছে। ‘রাধে রাধে’ ধ্বনিতে সারা বৃন্দাবনের আকাশ বাতাস মুখরিত হতে দেখে আনন্দময়ী নিজেকে আর দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। পরিচিত সকলের সাথে তাল মিলিয়ে আনন্দ উৎসবের সামিল হয়ে পড়লেন। হোলি উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব অনুষ্ঠানের জের চলে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। অনুষ্ঠানগুলি অনুষ্ঠিত হয় এক একটি পর্যায়ে। যেমন, ব্রজকি হোলি, লাঠমার হোলি, ফুল‌ওয়ালি হোলি প্রভৃতি। আনন্দময়ী এই প্রথম এমন মহা আনন্দ আর উন্মাদনাভরা উৎসবের মুখোমুখি হলেন। বাংলার দোল উৎসব দেখেছেন। সেখানে দোল অনুষ্ঠিত হয় যে বাড়িতে, সেই বাড়ির লোকজন ও দোল উপলক্ষে গৃহে আগত আত্মীয়-স্বজনরা একটা কি দুটো দিন কিছুটা আনন্দ করে থাকেন। মথুরা বৃন্দাবনের মতো সমাজের সর্বস্তরের আপামর জনসাধারণ পাগলের প্রায় মেতে ওঠেন না। বাংলায় দোল উৎসবের দিন হালে পাড়ার কিশোর কিশোরীরা নির্ধারিত ক’টা ঘন্টা মাত্র রং নিয়ে মাখামাখি করে।

বৃন্দাবনের হোলি উৎসব চলাকালীন কখনোই মনে হবে না যে, এখানে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীরা ব্যতীত অপর ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষ বাস করেন।সবাই এমন একাত্মভাবে হোলি উৎসবে নিজেদেরকে যুক্ত করতে পারেন, যা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমন কি দেশের ভিন্ন প্রদেশ বা বিদেশাগত যে সমস্ত পর্যটকগণ হোলি উৎসবের সময় বৃন্দাবন ভ্রমণে আসেন, তাঁরা ও উৎসবের সমান অংশীদার হয়ে ক’টা দিন মহা আনন্দ উপভোগ করেন। যত দিন যাচ্ছে উৎসব-প্রিয় বহিরাগত পর্যটকবৃন্দ ব্যাপক সংখ্যায় অংশ নিয়ে বৃন্দাবনের হোলি উৎসবকে এক উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিচ্ছে। সপ্তাহকালব্যাপী চলতে থাকা আনন্দ উৎসবের সামিল হচ্ছেন কমবেশি সবাই। এতদিন পর কিছুটা হলেও আনন্দময়ী বুঝতে পারলেন, আত্মীয় বন্ধু -বান্ধব ছেড়ে আসা বিধবা সকল কি নিয়ে, কিসের টানে এখানে পড়ে আছেন। উৎসবের দিনগুলো কেমন একটা ঘোরের মধ্যে কেটে গেল।রাধামাধবের অদৃশ্য আকর্ষণ কতটা গভীর ও সর্বব্যাপ্ত তার সামান্য আভাস উপলব্ধি করতে পেরে মনে মনে নতুন করে এক ধরণের অনাস্বাদিত আনন্দানুভূতি আনন্দময়ীর হৃদয় স্পর্শ করে গেল।এমনি করে করে বোধকরি সংসারের মায়ার বাঁধন ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে।তা সম্ভব না হলে বৃন্দাবনবাস সব দিক থেকে কণ্টকময় হয়ে উঠত। অতি প্রাচীন কাল থেকে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ওড়িষা প্রভৃতি অঙ্গরাজ্য থেকে সংসার নির্বাসিতা বিধবাগণ সুদূর বৃন্দাবনে এসে বাকি জীবনটা রাধামাধবের শ্রীচরণাশ্রিত হয়ে কাটিয়ে দেন। নিছক ক’টা দিনের তীর্থবাস নয়; জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবিচল থাকার একটা নিগুঢ় মাহাত্ম্য নিশ্চয়ই আছে।

বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর সাক্ষাৎকালে সম্বোধনের বাক্যবন্ধ বা সম্ভাষণ রীতি পৃথক। বৃন্দাবনের বৈষ্ণব সম্প্রদায় পরস্পর সাক্ষাতে ‘রাধে রাধে’ উচ্চারণে নিজেদের মধ্যে সৌজন্য বিনিময় করে থাকেন। হোলির ক’টা দিন অলিতে গলিতে এই রাধে রাধে রবের বন্যা বয়ে যায়। তাদের দেখাদেখি বহিরাগত যারা হোলির সময় বৃন্দাবনে উপস্থিত থাকেন তাদের সবার‌ই মুখ থেকে ‘রাধে রাধে’ বুলি স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসে।এতে তাঁরা যেমন উৎসবের ভাগীদার হয়ে যান তেমনি প্রাণভরে হোলির আনন্দ উপভোগ করে নিজেদেরকে ধন্য মনে করেন। উৎসবের আকর্ষণে বৃন্দাবনে জনসমাগম হয় সর্বাধিক।দেশ বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা পুণ্যার্থী পর্যটকদের অংশগ্ৰহণে চেনা বৃন্দাবন অচেনা রূপ ধারণ করে।সেই হাজারো মুখের ভিড়ের মাঝে মনে মনে চেনা মুখের সন্ধানে ফেরেন আনন্দময়ী।এই অনুসন্ধানের মধ্যে এক প্রকার আনন্দ থাকে, কিন্তু দিনের শেষে নিরাশ হয়ে সবার অলক্ষ্যে আপন থেকেই চোখে জল এসে যায়; তখনই রাধামাধবের চরণে আশ্রয় মাগে,একটু শান্তি লাভের আশায় কাতর প্রার্থনা জানায়।

হোলির আনন্দ উৎসব মিটে গিয়ে বৃন্দাবন আবার ধীরে ধীরে বৃন্দাবনের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করল। সেই ছকে বাঁধা একঘেয়ে কর্ম অনুশীলনের গতানুগতিক সাধন সম্বল জীবন ধারা।বাধ্যবাধকতার শৃঙ্খলা না থাকলে ও অলিখিত নিয়মের নিগড়ের বাঁধন একটা থেকেই গিয়েছে; যার কারণে আপন বিবেকের নির্দেশে এবং সঙ্গীসাথিদের দেখাদেখি সবাই এক‌ই পথ অনুসরণ করে দিনাতিপাত করতে থাকে। কথায় বলে সৎ সঙ্গে কাশীবাস, বৃন্দাবনবাস ও তার থেকে কোনো অংশে পিছিয়ে নেই বরং অনেকটাই এগিয়ে। এখানে রাধামাধবের মাহাত্ম্যগুণে বৃন্দাবনবাসী সকল বৈষ্ণবগণ ভক্তি ভাব-সাগরে নিত্য নিয়ত অবগাহন করে মানসিক শান্তি লাভের উপায় অনুসন্ধান করে। আংশিক সফল হয় অনেকে, অনেকে সফল হ‌ওয়ার চেষ্টায় থাকে। সাধনমার্গে যে যতটা অগ্ৰসর হতে পেরেছে, আড়ম্বরহীন সহজ সরল জীবন ধারণের মধ্যে সে ততই নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কৃতকার্য হয়েছে।আত্ম সুখ-সম্পদের চিন্তা নয়, তার ঊর্ধ্বে উঠে রাধামাধবের পাদপদ্মে আত্মনিবেদন করার মধ্যে লুকিয়ে আছে পরম আনন্দ,পরম প্রাপ্তি।যে প্রাপ্তির অংশীদার হতে পারলে আর কোনো চাওয়া পাওয়ার বাসনা থাকে না।ইহজীবনের পরমপ্রাপ্তি লাভ হলে জীবন সার্থক হয়,মানব জনম সফল হয়। কিন্তু সেই পরম প্রাপ্তির ধনটি কী, তার সন্ধান মানুষ আজ পর্যন্ত পেয়েছে বলে জানা নেই। জাগতিক চাওয়া পাওয়ার মধ্যে অনেক কিছুই হয়তো অনেকের প্রাপ্তি ঘটে, তবু যেন কি না-পাওয়ার বেদনা,এক অতল গভীর বিরহ একান্ত অবসরে মনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। মুহূর্তে মন ছুটে চলে সেই মনের মানুষটির উদ্দেশ্যে।’ কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’ হতে পারেন তিনি মানুষ,হতে পারেন তিনি ত্রিতাপ দুঃখহারী অনন্ত ঈশ্বর; ছায়ারূপ বা কায়ারূপ, তে রূপেই বিরাজ করুন, কোথায় তিনি, কতদূরে? জাগতিক ভোগবাসনায়,ধনে জনে জড়ায়ে থেকে ও অন্তিমে মন শুধু তাঁর‌ই পায়ে আশ্রয় মাগে! জীবন ভরে সেই অধরাকে ধরার,তাকে পাওয়ার আকুল আবেদন, অথচ জন্ম জন্মান্তরের অপ্রাপ্তি হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। বুকের মাঝে অতল রোদন জাগে। সান্ত্বনা খুঁজতে যাই অধ্যাত্ম্য দর্শনের মোহমুক্তির বাণীর বার্তায়–

কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ সংসারোহয়মতীব বিচিত্রঃ।
কস্য ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয়ঃ তদিদংভাতঃ।।

আমাদের সকল পাওয়ার মাঝে না পাওয়ার বেদনার সুর যে একটা বেজে যায়,তা শুধু নাই আর নাই! এ ব্রহ্মান্ডে শেষ নাই, সীমা নাই,অনন্ত অসীম!

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৭)

এক রবিবার ছুটির দিন পেয়ে সকালে দেবাংশু এল শ্বশুর বাড়িতে।একা। হঠাৎ করে। আগাম কোনো খবর ছিল না। শেখর বাজারে বেরিয়েছিল। গার্গী সমাদরে আপ্যায়ন করল; বসতে জায়গা দিয়ে বাড়ির কুশল সংবাদ নিল।
— দাদা কি বাজারে বেরিয়েছে বৌদি? [দেবাংশু গার্গীর কাছে জানতে চাইল।]

— হ্যাঁ ভাই, সারা সপ্তাহের মধ্যে এই দিনটাতেই কেবল সুযোগ পায় কিছু কেনাকাটা করার।
একটু সময় চুপ করে থেকে দেবাংশু বলে, জরুরি প্রয়োজনে আসতে হল বৌদি। তোমাদের কাছে একটা পরামর্শ নেওয়া দরকার।
— ঠিক আছে দেবাংশু, তোমার দাদা এখনি এসে যাবে। তুমি পোশাক পালটে কিছু মুখে দাও, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

কিসের পরামর্শের প্রয়োজন হয়ে পড়ল জানার জন্য মনে মনে ভীষণ কৌতূহলী হয়ে পড়েছিল গার্গী; তবে কি ভেবে আপাতত নিজে থেকে সে কিছু জানতে চাইল না। আধ ঘন্টার মধ্যে শেখর বাজার থেকে ফিরে এল, দু-তিন খানা ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে। দেবাংশুর আগমনে সে খুব খুশি হল। জিজ্ঞেস করল,- দেবাংশু কখন এলে? বাড়ির সংবাদ সব ভালো তো? বাসন্তীকে দেখছি না।
— হ্যাঁ দাদা, সব ভালো। ও আসেনি। বিশেষ একটা প্রয়োজনের কারণে হঠাৎ আমাকে আসতে হল। দেবাংশুর কথায় একটু থমকে গিয়ে শেখর তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, প্রয়োজন না থাকলে তাহলে আসা যাবে না বলো।
দেবাংশু কিছুটা বিব্রতবোধ করল। তৎক্ষণাৎ উত্তরে বলল‌‌,- না না, ঠিক…তা নয় দাদা।আসতে তো হবে।

সপ্তর্ষি সুজাতা অদূরে খেলা করছিল এতক্ষণ। বাবাকে বাজার থেকে ফিরতে দেখে কাছে এসে জুটল। সকালে এক কাপ চা ও দুখান বিস্কুট খেয়ে বাজারে গিয়েছিল শেখর। বাজার নামিয়ে রেখে গার্গীকে বলল,–হাত-পা ধুয়ে আসছি, আমাদের সবাইয়ের টিফিনের ব্যবস্থা করো।
এতক্ষণে দেবাংশু নিজের অভিপ্রায়টা ব্যক্ত করার সুযোগ পেল।

— দাদা, বৌদি ও এখানে আছে, আমি যেজন্যে এসেছি। সামনের মাসের শেষের দিকে ডেলিভারির ডেট দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। কিন্তু সমস্যা হল, তারপর ওখানে রাখব কোথায়? বাড়িতে তো দেখার কেউ নেই।দু-চারটে মাস অন্তত সামলে না দিলে আমরা বড়ো নাচারে পড়ে যাব। আপনার বোন ও ভীষণ চিন্তায় আছে ।
দেবাংশুর বক্তব্যের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটা স্পষ্ট বুঝতে অসুবিধে হল না শেখরের। গার্গী ও আন্দাজ করতে পারল সহজে। দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে মুখ চাওয়া-চায়ি করল। দেবাংশু শেখরকে উদ্দেশ্যে করে আবার বলতে থাকল,– এই অবস্থায় কি করা দরকার একটা পরামর্শ দেন আপনারা।

দেবাংশুরা তিন ভাই। দেবাংশু ছোটো। ভাই ভাই সবাই পৃথক। মা বেঁচে আছেন। এক এক মাস পালা করে তিন ছেলের কাছে কাটান তিনি। শরীর তেমন ভালো নয়। বার্ধক্য জনিত নানান উপসর্গ সময়ে সময়ে মাথাচাড়া দেয়। দেবাংশুদের সংসারের বর্তমান পরিস্থিতি শেখরের জানা ছিল। বোন বাসন্তী যে সন্তানসম্ভবা তাও জানত। কিন্তু দেখতে দেখতে দশমাস পূর্ণ হতে চলেছে সে খেয়ালটা তার ছিল না। আজ মা উপস্থিত থাকলে সমস্যাটার সমাধান সহজ হতো। দেবাংশুর কথার উত্তরে শেখর জানাল,– দেখো দেবাংশু, এখন তোমাদের অবস্থাটা বুঝতে পারছি; তবে এ ব্যাপারে আমি খুব একটা কাজে আসতে পারব না ভাই। দিনের অধিকাংশ সময়টা কেটে যায় অফিসে। এ অবস্থায় তোমাকে সাহায্য করতে হলে তোমার বৌদি ছাড়া আমার সংসারে তো আর বাড়তি লোক নেই! তোমার বৌদি কি বলে শোন।

দেবাংশু গার্গীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে গার্গী বুঝল তাকে কিছু একটা উত্তর দিতে হবে। আপাতত দুই কুল বজায় রেখে যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিল সে। বলল, — দেবাংশু, তোমাদের সমস্যা শুধু তোমাদের নয়, আমাদেরও, আমরা এড়িয়ে থাকতে পারি না। যাতে সবার সুবিধে হয় তেমন একটা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করার মতো সময় আমাকে দাও। এ নিয়ে খুব একটা চিন্তা ভাবনা ক’রো না, আমরা তোমাদের সাথে আছি। এখন সময় মতো চান খাওয়া করো। উপায় একটা হয়ে যাবে।
দেবাংশু অনেকটা আশ্বস্তবোধ করল। গার্গীর জবাব শুনে শেখর মনে মনে তাকে তারিফ না করে পারল না। তার উত্তর দানের সঙ্গে শেখরের ইচ্ছার যথেষ্ট সাদৃশ্য পেয়ে সে খুশিই হল‌। দুপুরে খেতে বসে শেখর দেবাংশুর কাছে জানতে চাইল, কোথায় কি ব্যবস্থা করার কথা ভেবে রেখেছে তারা। দেবাংশু বলল,– সময় মতো ডায়মন্ডহারবারের হসপিটালে ভর্তি করা হবে। যে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে আছে বাসন্তী, তিনিই এমনটি ঠিক করে রেখেছেন। ডাক্তারবাবু ওই হসপিটালের‌ই ডাক্তার।

— ডাক্তারবাবু যদি বলে থাকেন তো সেমতো‌ই চলা উচিত। বলে অভিমত প্রকাশ করে শেখর।
আহারাদির পর আনন্দময়ীর ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল দেবাংশু। শেখর ও গার্গী নিজেদের ঘরে বাসন্তীদের বিষয়টি নিয়ে আলাপ আলোচনা করছিল।
— একার সংসার, নিজেদের দুটো ছেলে মেয়ে, সমস্যা হয়ে গেল! কি উপায় হবে বলো তো?
স্বামীর চিন্তিত ভাব লক্ষ্য করে গার্গী বলে,– চার-ছ’ মাসের ব্যাপার তো, নিজেদের সমস্যা থাকলেও সামলে নিতে হবে। নিজেদের মেয়ে, কোথায় ফেলবে তাকে!
একটা বিষয় শেখর হালে খুব নজর করছে, মা চলে যাওয়ার পর থেকে কথায় বার্তায়, আচার ব্যবহারে গার্গী যেন বেশ পরিণত এবং অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছে। সংসারের ঘাত-প্রতিঘাত কাউকে কাউকে দ্রুত পরিপক্ক করে তোলে। গার্গী যেন তাদের একজন।

সবে মাত্র বিকেল‌ শুরু হয়েছে। চৈত্র মাসের পড়ন্ত দুপুরের রোদটা তখন ও ঝাঁ ঝাঁ করছে। শেখর প্রস্তুত হয়ে মায়ের ঘরে গিয়ে দেখে দেবাংশু বিছানায় বসে আছে। সদ্য ঘুম ভেঙে উঠেছে বলে মনে হল। শেখর দেবাংশুকে বলল,– দেবাংশু, আমি একটু বের হবো ভাই। বিশেষ একজনের সাথে সাক্ষাতের কথা আছে। তোমাকে আটকাবো না, সময় মতো সাবধানে ফিরো; প্রয়োজনে খবর করতে কোনো রকম দ্বিধা কোরো না কেন।
— হ্যাঁ দাদা, আমাকে বাড়িতে ফিরতেই হবে। উত্তরে জানায় দেবাংশু।

শেখর আর বিলম্ব না করে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল। শেখর বেরিয়ে যাওয়ার পর গার্গী ঘর -বারান্দা করে টুকটাক কাজে ব্যস্ত ছিল। দেবাংশু ঘরের বাইরে এসে বারান্দায় পাতা চেয়ারে বসেছিল, গার্গীকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞেস করল,– বৌদি, মায়ের কোনো খবর আর পাওয়া গেল না তাহলে?
আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য গার্গী প্রস্তুত ছিল না। তাছাড়া ব্যাপারটাতে গার্গী এতটাই স্পর্শকাতর হয়ে আছে যে, শাশুড়িকে নিয়ে সরাসরি তার কাছে কেউ কিছু জানতে চাইলে সে ভীষণ সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার নিজের মনের মধ্যে জমে থাকা অপরাধবোধটা তাকে একতরফা অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দেয়। সে মন থেকে চায় না শাশুড়িকে নিয়ে কোনো প্রসঙ্গ কেউ তার কাছে তুলুক। তা যে সম্ভব নয়, সে কথা গার্গী ভালো মতোই জানে। পাড়া প্রতিবেশীরা থেকে শুরু করে আত্মীয় স্বজনদের অনেকের কাছে ও বেচারি দোষীর কাঠগড়ায়। হাজার চেষ্টা করলেও তা থেকে নিস্তার পাওয়ার সুযোগ নেই। মাছরাঙার কলঙ্কের মতো কলঙ্কটা তার নামের সঙ্গে গেঁথে গিয়েছে। নিজের থেকে তো দূর করার ব্যর্থ চেষ্টার পথে তাই সে হাঁটে না। অগত্যা দেবাংশুর জিজ্ঞাসার জবাবে গার্গী জানায়,– না ভাই, কোনো সংবাদ মিলল না; এখনও পর্যন্ত তোমার দাদা নানাভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে, কতদিনে কিভাবে কি হবে তা ঠাকুর জানে!

দেবাংশু শেখরের নিকট শাশুড়ির কথা জিজ্ঞেস করতে ভরসা পায় না,শুধু শাশুড়ির কথা নয়, সে শেখরকে যথেষ্ট সমীহ করে কিন্তু গার্গীর কাছে নিজেকে অনেকটা সাবলীল মনে হয় তার।গার্গীর উত্তরের প্রেক্ষিতে দেবাংশু আপন মনে বলতে থাকে, — আমাদের দুর্ভাগ্য! মা থাকলে এই সময়টা অন্তত আমরা অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম। তোমাদের উপর ঝামেলাটা অনেক কম হতো।
— ঝামেলা কেন বলছ দেবাংশু, এ সব তো পারস্পরিক দায়-দায়িত্বের মধ্যে পড়ে যায়। আমাদেরকে তোমাদের সংসারের থেকে পৃথক করে ভাবছ কেন?
দেবাংশু নীরব হয়ে যায়। ‘ঝামেলা’ কথাটা বলে ফেলেই মনে মনে শুধরে নেবার চেষ্টা করতে লাগল যেন। গার্গী ও আর কোনো কথা না তুলে ঘুম থেকে ওঠা মেয়ের চোখমুখ ধোয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

ঘন্টা খানেকের মধ্যে দেবাংশু বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ল। গার্গীকে সম্বোধন করে বলল,– বৌদি বেরিয়ে পড়লাম, হয়তো খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা সাক্ষাৎ হবে। গার্গী দেবাংশুকে সতর্ক করে বলল,– যে কোনো খবর হোক, জানাতে বিলম্ব কোরো না। ওকে খুব সাবধানে থাকতে বলবে। ঠাকুর মঙ্গল করুন। তুমি ও সাবধানে ফিরো।
দেবাংশুকে ছাড়তে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে সদর দরজা পেরিয়ে পথে বেরিয়ে এসেছিল গার্গী। দেবাংশু চলে যাওয়ার পর পিছন থেকে ছেলে সপ্তর্ষির ডাক শুনতে পেয়ে আর বিলম্ব করল না, দ্রুত বাড়ির মধ্যে ফিরে গেল।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৮)

বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে গার্গী বুঝতে পারল অবস্থাটা কতদূর গড়িয়েছে। সম্পূর্ণ বাড়িটাই নিঃশব্দ নীরব, কোথাও মানুষজনের কোনো সাড়া শব্দ নেই। সদর দরজা পেরিয়ে গগন মিলির নাম ধরে কয়েকবার ডাকার পর ঘরের দরজা খুলে মিলি বারান্দায় এসে দেখা দিল। রান্না ঘরে গার্গীর মা বিনতা দেবী কিছু একটা করছিলেন, গগনের গলা শুনে বাইরে তাকিয়ে মেয়েকে দেখতে পেল। দ্রুত বেরিয়ে এসে নাতনিসহ মেয়েকে নিয়ে ঘরের বারান্দায় উঠে এল। অক্ষয়বাবু ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিলেন। শরীরটা ভালো ছিল না, তার সঙ্গে মনটাও। মেয়ে এসেছে বুঝতে পেরে বিছানা ছেড়ে বাইরে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।

বদ্ধ বাস্তুটার মধ্যে যেন এক ঝলক বাইরের বাতাস বয়ে গেল। মিলি এসে গার্গীদের পাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। সহাস্যে গার্গী তাকে জিজ্ঞেস করল — কিরে, রান্না হয়ে গেছে, আমাদের জন্য রেঁধেছিস তো?
আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না মিলি। প্রথমটা সে কিঞ্চিত থমকে গেল। কোনো রকমে উত্তর দিল — মা রান্নাঘরে ছিল এতক্ষণ, বোধহয় রান্না হয়ে গেছে।

— তোর কি শরীর খারাপ? তোর রান্না খাইনি অনেক দিন।যা, রান্নাঘরের দিকে গিয়ে দেখ।বলে বাপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল — বাবা, সকালে কি খেয়েছ, তোমার চোখ-মুখ শুকনো শুকনো দেখাচ্ছে বড়ো। শরীর ভালো আছে তো? প্রেসারের ওষুধটা ঠিক মতো খাচ্ছ?

অক্ষয়বাবুরা দুজনে নাতনি সুজাতাকে কোলের কাছে নিয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছিলেন। মেয়ের কথার উত্তর না দিয়ে বললেন — জামাই, নাতি ওরা সব ভালো আছে?

— হ্যাঁ ভালো আছে। বলে গার্গী মায়ের হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে মাকে বলল– মা, এর ভিতর ফল মিষ্টি আছে, বাবাকে কিছু খেতে দাও।আর তুমি সকাল কি খেয়েছ?
মা কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যাগটি নিয়ে উঠে ঘরের মধ্যে গেলেন। গার্গী ও রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

দুপুর হয়ে গিয়েছে। গগন ঘর বার করতে করতে চানে চলে গেল। আজ অনেক বিলম্ব হয়ে গেছে। দুপুরের আহারটা সবাই একসাথে খেতে বসলো। গার্গী গগনের কাছে জানতে চাইল — কিরে, সকালবেলা হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে আমাকে নিয়ে এলি, কি হয়েছে তোদের? আর কতদিন এভাবে চলবে?
গগনের ক্ষোভটা তখন ও যায়নি।সে তৎক্ষণাৎ উত্তরে বলল‌‌ — আমাদের কোনো কিছুই বাবা-মায়ের ভালো লাগে না। কিভাবে থাকবো আমরা এখানে?

— কেন ভালো লাগছে না, কিভাবে ভালো লাগানো যায় সে চিন্তা-চেষ্টা করে দেখেছিস কোনোদিন? এতদিন তো ঠিক ছিল। আজ তোদের ভালো লাগে না — তাদের ও ভালো লাগে না।কেন? কথাগুলি বলে ভাইয়ের মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে গার্গী।

গগনকে নীরব থাকতে দেখে গার্গী বলে — সংসারটা কার? বাবা -মায়ের বয়স হয়ে গিয়েছে, এখন ধীরে ধীরে তোদের সংসারের দায়িত্ব তোরা যদি বুঝে না চলিস তো আলাদা ব্যবস্থা দেখতে হয়।

এতক্ষণে বিনতা দেবী মেয়েকে সম্বোধন করে বলতে থাকলেন – শোন মা, কী করে ভালো লাগবে তুই বল। ওদের বিয়ের দু’বছর পূর্ণ হল। সেই উপলক্ষে গত সপ্তাহে বুধবার বাইরে থেকে বন্ধু-বান্ধব জুটিয়ে এনে অর্ধেক রাত পর্যন্ত ঘরের মধ্যে খাওয়া -দাওয়া, হৈ-হল্লা হল।আমরা কিছু জানলাম না, সে রাতে আমাদের কিছু জুটল না। শুধু ওদিন নয়, এখন মাসের প্রায় অর্ধেক দিন আমরা অভুক্ত থাকি। শরীর ভালো থাকলে দুটো ফুটিয়ে নিতে পারি, ন‌ইলে উপোষ ছাড়া উপায় নেই। মায়ের কথা শুনে গার্গী অবাক হয়ে গেল। বিস্মিত গার্গী মিলিকে জিজ্ঞেস করল — কি মিলি, মা যা বলছে তা ঠিক? মিলি গার্গীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ঈষৎ মাথা নিচু করে অনুচ্চ স্বরে বলল — তোমার ভাইকে জিজ্ঞেস করো।

গার্গীর বিস্ময়ের বহর আরো বৃদ্ধি পেল।সমস্ত কিছুর আসল কারিগর যে গগন তা আজ অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেল গার্গীর কাছে। মা-বাবার দুর্গতির নতুন ঘটনা অবগত হয়ে মনে মনে গার্গী ভীষণ অস্থির হয়ে উঠল।ভাই যে এতটা অমানুষ হয়ে উঠতে পারে তা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তায় আনতে পারেনি সে। ক্ষোভে-দুঃখে চোখ দিয়ে জল এসে গেল মেয়েটার। কিছুক্ষণের জন্য তার মুখ দিয়ে কোনো কথা ফুটল না। মায়ের মুখ থেকে ওদিনের ঘটনার কথা শোনার পর দিদি যে দারুণ ভাবে আঘাত পেয়েছে তা অনুমান করতে ভুল হল না গগনের। মনে মনে অনুতপ্ত হল সে। সেদিনের ঘটনার দায় মিলি যে এভাবে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেবে তা নতুন করে ভাবিয়ে তুলল তাকে।তাহলে কি মিলি এতটা বাড়াবাড়ি অন্তর থেকে সমর্থন করে না!

মা-বাবার কাছ থেকে সেভাবে সাড়া মিলবে না জানে গগন, তাই ধনী বাড়ির মেয়েকে খুশি রাখতে সে যথাসাধ্য চেষ্টা করে।তা যে বাড়াবাড়ির সীমা অতিক্রম করছে এবং তার কারণে মা-বাবা বিশ্রীভাবে অবহেলিত হচ্ছে যা উটপাখির মতো তার নজরে পড়ছে না। সমস্ত ব্যাপারটাকে জটিল করে তোলার জন্য সে যে মুখ্যত দায়ী আজকের ঘটনা যেন সেই দিকে ইঙ্গিত করছে। মনে মনে শঙ্কিত এবং লজ্জিত হয়ে পড়ল গগন। গার্গী ভাইকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।বেশ ধীর ও গম্ভীর স্বরে বলল— এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না,প্রয়োজনে পাকাপাকি ব্যবস্থার পথে হাঁটবো। জানতাম অন্য ভাগি-সাথি আছে, যাদের দোহাই দিয়ে বাবা-মাকে এড়িয়ে চলছিল তোরা। তা তো নয়, বৌ- বেটা থাকতে মা-বাবা যদি দুটো ভাত না পায়, কোথায় যাবে তারা? লোকে শুনলে ছি-ছি করবে।

এক দিকে বাবা-মা,আর এক দিকে ভাই-ভাজ, কা’কে ফেলে কা’কে রাখব? একসাথে থাকতে না পারলে কোথায় তোদের শান্তি হয় সেখানে চলে যা — না হলে আমার পক্ষে সংসার ফেলে দুবেলা ছুটোছুটি করে আসা সম্ভব নয়। একমাত্র গার্গী ছাড়া দ্বিতীয় কেউ কোনো টু-শব্দও করছে না। দিদি যে ভীষণ ভাবে ক্ষুব্ধ, তার শরীরী ভাষায় তা প্রমাণ। কিছুটা হলেও বিষয়টি উপলব্ধি করতে পেরে গগন মনে মনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। নিজের স্বপক্ষে সাজিয়ে তোলার মতো কোনো যুক্তি তার মাথায় আসছে না। আশা ছিল দিদি এসে তাদের পক্ষ নেবে কিন্তু কার্যক্ষেত্রে হল তার বিপরীত। তার উপর মিলিও যেন সমস্ত দায়ভারটা প্রকারান্তরে গগনের দিকে ঠেলে দিতে চাইছে।

মাকে উদ্দেশ্যে করে খুবই শান্তস্বরে গার্গী বলল– মা, তোমাদের ও বলছি, তোমাদের সময় এক রকম কেটেছে, এখন দিন কালের অবস্থা আগের মতো নেই; বিষয়টা মানিয়ে নেবার দায়িত্ব তোমাদেরও আছে।
মা কাতর স্বরে বলে – দেখ মা, ওরা আমাদের নাগালের মধ্যেই চলতে চায় না। আমরা এখন দুবেলা দুটো ভাত-পান্তা পাওয়ার প্রত্যাশী, তার বেশি তো দাবি করছি না।তাও আমাদের কপালে জুটছে না। কেন? কী অপরাধ করেছি আমরা!

এতক্ষণ চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলেন গার্গীর বাবা অক্ষয়বাবু। এবার কথা বললেন — ওকে বহুবার বলেছি, চাষবাস, বাগান-বাগিচার দায়িত্ব ধীরে ধীরে বুঝে নে– না হলে সব কিছুই পড়ে পড়ে নষ্ট হয়ে যাবে।কা’র কথা কে শোনে! কী করে খেতে চায় ও? জানতাম চাকরি-বাকরি আছে যে সেখান থেকে দুটো পয়সা আসবে! সে দিকে তো লবডঙ্কা! এবার ভাবছি সব বিক্রি-বাঁটোয়ারা করে দিয়ে আমরা কোনো বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।

— অবস্থার প্রেক্ষিতে সে ভাবনা আমার মাথায় আছে বাবা। এই বয়সে ওসব নিয়ে আকাশ-পাতাল চিন্তা করে করে শরীর দুর্বল কোরো না।
এত সময়ের মধ্যেও মিলি কিন্তু একটা কথাও বলেনি। গার্গী এবার তাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন রাখল–মিলি, তুই বল, তোর তো ভাই-ভাইবৌরা আছে,তারা যদি তোর বাবা-মায়ের সঙ্গে এমন ব্যবহার করতো তাহলে তোর কেমন লাগতো? মেনে নিতে পারতিস?

মিলি কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করল। তারপর বলল– দিদি, আমাদেরকে ক্ষমা করতে পারবে কি না জানিনা, তবে শেষ বারের জন্য একটা সুযোগ দাও, কথা দিচ্ছি এমন ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার চেষ্টা করবো। গার্গী মনে মনে খুব খুশি হল।সে জানে গগনকে স্বাভাবিক পথে ফেরাতে হলে মিলিই মূল হাতিয়ার। পরক্ষণে নিজের কথা স্মরণ হতে গার্গী মিলিকে আর কিছু বলল না, সে জানে মিলি মূর্খ নয়।

গগনকে উদ্দেশ্যে করে কেবল বলল— দেখ ভাই, বাবা -মা আর কতদিন। সামনে তোদের দীর্ঘ ভবিষ্যৎ পড়ে আছে। বাবার যা আছে করে খেলে ভাত-কাপড়ের অভাব হবে না। নিজেদের সংসার নিজেরা বুঝে নে।
সুজাতা ঘুম থেকে উঠে পড়ে মাকে ডাকাডাকি করছে শুনে উঠে পড়ল গার্গী। মিলিকে বলল– তোর ফোন নম্বরটা আমাকে দিবি, দরকারে তোর জামাইবাবুর ফোন থেকে খবরাখবর নেব।

উঠে পড়েছিল সবাই। বহুদিন পরে বোধহয় এমন সম্মেলন হল বাড়িতে। খুশি দেখালো সবাইকে। সন্ধ্যার আগে-ভাগে মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল গার্গী। মিলি আর গগন কথা বলতে বলতে অনেকটা পথ অবধি সঙ্গে এল বিদায় জানাতে।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ৯)

হোলি উৎসবের পর পেরিয়ে গিয়েছে মাস দুয়েক।সপ্তাহকাল ব্যাপী উৎসবের আনন্দ ও উন্মাদনা আনন্দময়ীর চিন্তা-চেতনায় বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়ে অন্তর্লোকে এনে দিয়েছে প্রচ্ছন্ন ভাবান্তর। আগের সেই অস্বস্তি, মনের অস্থিরতা অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছে। বৃন্দাবন বাসের মূলধন যে রাধামাধবের প্রতি আন্তরিক ভক্তি, প্রীতি — আপন অন্তরে তার মৃদু আভাস উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন আনন্দময়ী। সর্বক্ষণের জন্য এখন মনটা উন্মনা হয়ে থাকে না, মাঝে মাঝে আত্মমগ্ন চিন্তার মাঝে ডুবে থাকেন।

নির্মলা নামের প্রায় সম বয়সি এক আশ্রমিকের পরামর্শ তাঁর মনে ধরেছে। পূর্ব বঙ্গের মেয়ে নির্মলা।অর্ধযুগ হয়ে গেল নির্মলা বৃন্দাবন বাসিনী। তাঁর মতে, অশান্ত মনকে শান্ত করার প্রধান উপায় হতে পারে বৃন্দাবনে অবস্থিত ভক্তিধামগুলি, রাধাগোবিন্দ মন্দিরগুলি পরিক্রমা করা।দু-চার দিন সেখানে বসবাস করে সেই সাধন ক্ষেত্রের অপার মাহাত্ম্যকে অনুধাবন করার চেষ্টা করলে মন ধীরে ধীরে দ্রবীভূত হতে থাকে।তাতে মনের মধ্যে ভক্তির সঞ্চার যেমন হবে, তেমন সুস্থিতির পথে ক্রমশ উন্নতি ঘটবে।। নির্মলার কথাবার্তা, আচার -ব্যবহার আনন্দময়ীর অপছন্দ নয়। তাঁর এই বৎসরাধিক কালের বৃন্দাবন বাসে অনেকের সঙ্গ-সান্নিধ্য লাভ হয়েছে, তবে আঁকড়ে ধরার মতো বিশেষত্ব খুঁজে পাননি তিনি। বাকিদের সঙ্গে তুলনা করলে নির্মলা একেবারে আলাদা প্রকৃতির। তাঁর নিঃস্বার্থ, আন্তরিক ও অকৃত্রিম ব্যবহার সহজেই মনকে আকর্ষণ করে, সঙ্গ লাভের আগ্ৰহ জাগায়।নির্মলাকে আনন্দময়ী মনে মনে হিতৈষী বন্ধু রূপে গ্ৰহণ করলেন।

বৃন্দাবনের বিভিন্ন ধাম ও তার মাহাত্ম্য, তার গুণাগুণ, সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসমূহের কার্যকলাপ ও সুযোগ-সুবিধে সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল নির্মলা। একদিন আনন্দময়ীকে নিয়ে স্থানীয় বিবেকানন্দ ট্রাস্টের মাধ্যমে দু-টাকার বিনিময়ে রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করে দিলেন নির্মলা। বৃন্দাবনে এমন বহু ট্রাস্ট আছে, যারা জনসাধারণের, বিশেষ করে বৃন্দাবন বাসিনী আবাসিক বিধবাগণের কল্যাণে কাজ করে থাকে। আনন্দময়ী অনেক দিন থেকে শুনে আসছিলেন এই রেশন কার্ডের গল্প। কিন্তু কোথায়, কিভাবে তা পাওয়া সম্ভব তার বিন্দু-বিসর্গ জানতেন না ; অথচ এই কার্ড থাকলে বিনামূল্যে চাল, ডাল, আটা, চিনি, তেল ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সমূহ সময়ে সময়ে সংগ্ৰহ করা যায়। নিজের প্রয়োজনে তো লাগবেই, উপরন্তু উদবৃত্ত দ্রব্য বিক্রি করে দিলে দুটো পয়সা সঞ্চয় হয়।

এতদিন মনটা উড়ু-উড়ু থাকার কারণে এ সবের ভাবনা তেমন আমলে পায়নি। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঠিক সময়ে ভবিষ্যৎ ভাবনা অনুযায়ী একটা পাকাপাকি ব্যবস্থা জুটতে অত্যধিক খুশি হয়েছেন আনন্দময়ী। এখন নিজেকে বৃন্দাবন বাসীদের একজন বলে ধারণা করতে পারেন তিনি। আনন্দময়ীর প্রস্তাবে নির্মলা উৎসাহের সাথে রাজি হয়ে গেলেন।সপ্তা খানেকের সময় নিয়ে দুজনে মিলে বৃন্দাবনের কিছু প্রাচীন ধাম, কিছু মন্দির পরিক্রমার বাসনায় যাত্রা শুরু করলেন। ভিন রাজ্য থেকে আগত হাজার হাজার বিধবা বাস করেন বৃন্দাবনে। তাঁরা সবাই যে খুব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটান তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো আশ্রম বা মন্দিরের ব্যবস্থাপনা মোটের উপর সুখপ্রদ হলেও সব ক্ষেত্রের ব্যবস্থা সমান নয়।

‘সুলভ ইন্টারন্যাশনাল’ – এর বিধবা আশ্রমে আশ্রিত বিধবাগণ অপেক্ষাকৃত সুস্থ পরিবেশে বাস করেন। তুলনায় বাঁকে বিহারী মন্দিরের বিধবাদের অনেকের অবস্থা যথেষ্ট করুণ।ভিক্ষা করে, মন্দিরের সিঁড়ি বা চাতালে আশ্রয় নিয়ে অনেকের দিন কাটে। মন্দির বা আশ্রম কর্তৃপক্ষকে সম্পূর্ণ দায়বদ্ধ করা যায় না। তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসারে একান্ত আপন জনদের কাছ থেকে বিতাড়িত, অবহেলিত, এমন হাজার হাজার অসমর্থ, অর্ধসমর্থ দুঃস্থ আশ্রয়কারীদের সবাইকে সর্বক্ষণ সেবা দিয়ে, পরিচর্যা দিয়ে লক্ষ্য রাখা সম্ভব নয়। তার মধ্যে যথাসাধ্য পরিষেবা প্রদানের প্রচেষ্টা বহাল রাখতে কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে চেষ্টার বিরাম নেই।

মন্দিরের বা আবাসের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা নিজেদেরকে মানিয়ে নিতে পেরেছেন, রাধামাধবের চরণপদ্মে যারা আত্ম সমর্পণ করতে সক্ষম হয়েছেন, নিজের থেকে তাঁরা অনেকটা সুস্থ-স্বাভাবিক অবস্থায় আছেন। বাকিদের পক্ষে দিন গুজরান বড়ো কষ্টদায়ক। মাতৃ মন্দির বিধবা আশ্রমের আবাসিকগণ খুব সুখে-শান্তিতে না থাকলে ও একেবারে দুর্গতির মধ্যে নেই। ভালো-মন্দ মিলিয়ে সেখানকার ব্যবস্থাপনা মাঝামাঝি গোছের। আসল ব্যাপার হল, অশীতিপর অথবা নবতিপর যে সমস্ত বিধবা বৃন্দাবনে বাস করেন, তাঁরা যেখানেই যে আশ্রমে বাস করুন না কেন, বার্ধক্যজনিত সমস্যার কারণে তাঁদের কেউই তেমন স্বাচ্ছন্দ্যে নেই, থাকা সম্ভব নয়। সংসার যাঁদেরকে‌ বোঝা মনে করে ঝেড়ে ফেলেছে, তাঁদের দুর্ভাগ্যের দুঃখ-যন্ত্রণার ভার লাঘব করতে যে সহানুভূতি, সহমর্মিতা প্রয়োজন তা সরকারি বা বেসরকারি কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে জুগিয়ে যাওয়া আদৌ কতটা সম্ভব তা ভেবে দেখার বিষয়, কারণ এমন হাজার হাজার দুঃস্থকে নিয়ে তাদের চলতে হয়।

সাধারণ মানুষের ধারণা, যে সমস্ত বিধবাগণ বৃন্দাবনের পুণ্য ভূমিতে বাস করেন, তাঁরা ভালোই থাকেন। কিন্তু ভালো থাকেন কি মন্দ থাকেন সে অভিজ্ঞতা যাদের নেই তারা অমন কথা ভাবতে পারেন। প্রত্যক্ষদর্শীগণ তাতে সহমত হতে পারেন না। স্বজন ছেড়ে, স্বভূমি ছেড়ে দূর পরবাসে পড়ে থাকতে বাধ্য হয়েছেন যাঁরা, জীবনের বরাদ্দ অবশিষ্ট দিনগুলি পার করাই তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য। ভালো -মন্দের বিচার সেখানে মুখ্য নয়। ভক্তি ক্ষেত্রের কয়েকটির ভালো মন্দ বৈচিত্র্যে ভরা ব্যবস্থাপনা দর্শন করে আনন্দময়ী একাধারে বিস্মিত এবং ব্যথিত হয়ে পড়েছেন। নির্মলার কাছে ব্যাপারটা আদৌ নতুন নয়।এ সমস্ত বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে তিনি পূর্ব পরিচিত। অনেক দিন হয়ে গেল তিনি বৃন্দাবনে আছেন, ভালো মন্দ সব রকম দেখেছেন, জেনেছেন এবং মানিয়ে নিয়েছেন। সংসারের মায়া নির্মলাকে আর তেমন করে টানে না।

কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু কিছু বিধবার দুর্গতি আনন্দময়ীর মনকে যে গভীরভাবে বিষাদময় করে তুলেছে তা তাঁর চোখ -মুখের ভাবে নির্মলা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছেন। তাই এবার তিনি মনে মনে ঠিক করলেন বাকি ক’টা দিন এমন এমন স্থানে আনন্দময়ীকে নিয়ে যাবেন যেখানকার প্রাঙ্গণ চত্বর এবং তার পারিপার্শ্বিকের আবহাওয়া রাধামাধবের মাহাত্ম্যগুণে অন্তর ভক্তিভাবে ভরে ওঠে – মন প্রশান্তিতে পূর্ণ হয়। সমগ্ৰ বৃন্দাবন জুড়ে শুধু মাত্র মন্দিরের সংখ্যা পাঁচ হাজারেরও উপর। এছাড়া আছে বহু পুণ্য ক্ষেত্র,তীর্থ ধাম, আশ্রম ,আবাস, অসংখ্য সরকারি বেসরকারি সংস্থা, বহু দর্শনীয় স্থান, রাজপ্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি।

আনন্দময়ীর বহুদিনের মনোবাসনা, বৃন্দাবন ধামের চুরাশি ক্রোশ পরিক্রমার। তবে তাঁর বিশ্বাস ভাগ্যে না থাকলে এ সমস্ত পুণ্য ক্ষেত্র দর্শন কপালে জোটে না। আপাতত আনন্দময়ী ও নির্মলার হাতে আছে মাত্র দুটো দিন। বেশি বাছাবাছি‌ না করে উভয়ে গিয়ে পৌঁছলেন রঙ্গনাথ মন্দিরে। এই জাতীয় ভক্তিসাধন ক্ষেত্রগুলিতে পর্যটক পুণ্যার্থীদের ভিড় থাকে বারোমাস। এখানেই অবস্থিত কিংবদন্তী স্বরূপ সেই সোনার তালগাছ।যার দর্শনাভিলাষ আগত পুণ্যার্থীদের কাছে মূল আকর্ষণ। রঙ্গনাথ মন্দির চত্বরে এই সোনার তালগাছ আসলে একটি স্তম্ভ। কথিত আছে তালগাছ রূপী দীর্ঘ স্তম্ভটি সাড়ে পাঁচশ’ কেজি স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে অবস্থিত রঙ্গনাথজী মন্দিরের দর্শনীয় বহু কিছুর মধ্যে অন্যতম হল এই সোনার তালগাছ।

রঙ্গনাথজী মন্দিরের ভাগ্য দুয়ার পেরিয়ে আনন্দময়ীর অন্তরটা পরম তৃপ্তিতে ভরে গেল। তবে কি কারণে এই ভালো লাগা অনুভূতিটা জাগল তা‌ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন না। তবে কি নতুন করে সৌভাগ্যের প্রত্যাশী আনন্দময়ী? কী সেই সৌভাগ্য? কি তার লাভালাভ, কি তার প্রয়োজন! রঙ্গনাথ মন্দিরে আগত দর্শনার্থী মাত্রেই ভাগ্য দুয়ার পার হতে আগ্ৰহী।পুরনো ভাগ্য টাকে নতুন করে ঝালাই করার বাসনা যদি তাদের মনের উদ্দেশ্য হয়, তেমন একটা প্রচ্ছন্ন ইচ্ছা কি তবে আনন্দময়ীর মনে ও জাগে? রাধাগোবিন্দের কৃপায় দিন তো পার হয়ে যাচ্ছে, স্বেচ্ছায় বৃন্দাবন বাস কালে জীবনের শেষ অধ্যায়ে এ অপেক্ষা পরম বস্তু আর কি-ই বা চাওয়ার থাকতে পারে!

হঠাৎ আজ অনেক দিন পর শেখরের মুখটা এবং আরো সব….,বার বার কেন যেন মনে জাগছে – চোখ ভারি হয়ে আসছে আনন্দময়ীর। রঙ্গনাথ মন্দিরে দুটো দিন খুব তাড়াতাড়ি যেন কেটে গেল। এবার ফেরার পালা। সন্ধ্যা নামার আগে আগে নির্মলা আনন্দময়ীকে নিয়ে রঙ্গনাথজী মন্দিরকে বিদায় জানিয়ে পুরনো আশ্রমের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লেন।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১০)

অফিস যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল শেখর। এমন সময় তার ফোনে একটা কল এল। সাধারণত এ সময়ে কল খুব একটা আসে না। ব্যাগটা কাঁধে ঝোলাতে ঝোলাতে ফোনটা ধরল সে। দেখল নম্বরটা দেবাংশুর। হঠাৎ শেখরের বুকের মধ্যে একটা অজানা আশঙ্কার আভাস তড়িৎ বেগে খেলে গেল।
— হ্যালো। হ্যালো।
ওপার থেকে টেনশন ভরা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ ভেসে এল।
— হ্যাঁ দাদা, আমি আ-মি দেবাংশু বলছি।
— বলো বলো দেবাংশু, কি খবর বলো।
— আধ ঘণ্টা মতো হল বাসন্তীকে হসপিটালে ভর্তি করেছি। বাইরে বেরিয়ে এসে আপনাকে ফোন করছি।
— সঙ্গে কে আছে? …না তুমি একা?
— না – না, সঙ্গে বড়ো ভাইপো আছে, পাড়ার আরো দুজন আছে।
— ঠিক আছে, ঠিক আছে, চিন্তা করো না, আমি আসছি। বলে ফোন কেটে দিল শেখর।

গার্গী বারান্দায় ছিল। ফোনে শেখরের কথাবার্তা শুনে আন্দাজে কিছুটা বুঝতে পেরেছিল ব্যাপারটা। উদ্বিগ্ন ভাবে ঘরে ঢুকে স্বামীর কাছে জানতে চাইল — কী খবর?
শেখর অল্প কথায় জানালো ব্যাপারটি।বাসন্তী কে ডায়মন্ডহারবার হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েছে। ভাইপো সহ আরও দুজন লোক দেবাংশুর সাথে আছে।
— তোমাকে তো যেতে হবে? উৎকণ্ঠিত গার্গী জানতে চাইল।
— হ্যাঁ যেতে তো হবে, আমি এখনি বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি বেশি চিন্তা করো না। আমি পৌঁছে তোমাকে ফোনে জানাব।

হালে শেখর একটা ফোন কিনে দিয়েছে গার্গীকে। বাড়িতে ফোন একটা না থাকায় কতটা যে অসুবিধে হচ্ছিল, ফোনটি কেনার পর তার অপরিহার্য উপযোগিতা বুঝতে পারা যাচ্ছে। এখন ফোন ছাড়া একটা দিনও চলে না। ভালো হোক বা মন্দ হোক, ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়, সেই অকুস্থলে উপস্থিত থাকলে অনুভূতিটা হয় একরকম — কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে দূরে থাকলে সর্বক্ষণের জন্য অনেকটা বাড়তি উৎকণ্ঠা এসে গ্ৰাস করে। গার্গীর হয়েছে সেই অবস্থা। শেখর বেরিয়ে যাওয়ার পর থেকে মনটা ঘুরে ফিরে হসপিটালের আশেপাশে বার বার চলে যেতে লাগল।
কী হচ্ছে, কী হবে, সময়ে সময়ে জানতে না পারার কারণে সংসারের সব কাজে হঠাৎ একটা শিথিলতা এসে গেল। সব কিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ঠিকমতো মন বসাতে পারছে না শেখর নিয়মিত সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ অফিসে বেরিয়ে যায়। তারপর ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠানো, সংসারের যাবতীয় কাজ কর্ম প্রায় রুটিন মাফিক করে চলে গার্গী। শাশুড়ি চলে যাওয়ার পর প্রথম প্রথম বেশ কিছু দিন পর্যন্ত পরিবর্তিত নতুন ব্যবস্থাকে স্বাভাবিক ধারায় রপ্ত করতে অসুবিধে হয়েছিল খুব। এখন কোনোরকম অসঙ্গতি বোধ হয় না। কিন্তু আজ শেখর চলে যাওয়ার পর থেকে সবকিছুতে অভ্যস্ত ছন্দটা পদে পদে থমকে থমকে যেতে থাকল।

হসপিটালে পৌঁছে শেখর দেখল দেবাংশুও তার বড়ো ভাইপো সন্দীপ ওয়েটিং রুমে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। শেখরকে দেখে দেবাংশু ব্যস্তভাবে‌ উঠে দাঁড়াল, ভাইপোও।
— আরে বসো বসো তোমরা। আর দুজন কোথায়? শেখর দেবাংশুর কাছে জানতে চাইল।
— তারা এখানেই ছিল, একটু আগে বাইরের দিকে গেল।
— খেয়েছে সবাই কিছু?
— হ্যাঁ দাদা, হালকা টিফিন করেছি সবাই।
— ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?
— ডাক্তারবাবু এখনও আসেননি। অফিসে গিয়ে জানলাম, ডাক্তারবাবু শীঘ্র এসে যাবেন, চিন্তার কিছু নেই।

শত চেষ্টা করেও দেবাংশু ভিতরের উৎকন্ঠিত ভাবটা প্রশমিত করতে পারছিল না। শেখর পৌঁছে যাওয়াতে অনেকটা সাহস ফিরে পেয়েছে। ওয়েটিং রুমের মধ্যে বেশ কিছু লোকের উপস্থিতি এবং কথাবার্তার শব্দে অসুবিধে হবে বুঝে বাইরে এসে বাড়িতে ফোন করল শেখর। ও প্রান্ত থেকে সাড়া দিল গার্গী।
— হ্যাঁ বলো।
— আমি পৌঁছে গেছি, অযথা চিন্তা করার কিছু নেই। বাবু স্কুলে চলে গেছে? মেয়ে কি করছে?
— হ্যাঁ বাবু স্কুলে পৌঁছে গেছে। মেয়েকে আজ স্কুলে পাঠাবো না, ওর হালকা ঠান্ডা লেগেছে। সাবধানে থেকো সবাই, সময়ে সময়ে খবর দিও। রাখছি।
— আচ্ছা, ঠিক আছে। ফোন কেটে দিল শেখর।

বেলা বাড়ার সাথে সাথে হসপিটাল চত্বরের ভিড় ক্রমশঃ বাড়তে থাকল। দুর- দূরান্ত থেকে কত রকমের রোগ নিয়ে কত মানুষ যে নিত্যদিন সরকারি হসপিটালে এসে ভিড় জমায় তার হিসেব রাখা মুশকিল। অধিকাংশ‌ই গরীব। অসহায় মানুষগুলো অনেক আশা ভরসা নিয়ে ছুটে আসে সরকারি ব্যবস্থাপনার সাহায্য নিতে। সবার আশা পূরণ হয় না — যাদের হয় তারা ভাগ্যবান; বাকিরা দিনের পর দিন হেঁটে হেঁটে কেউ বা সাময়িক নিরাময় পেয়ে প্রসন্ন হয়, কেউ বা গভীর হতাশায় আশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বর্তমান দুনিয়াটা অর্থহীনদের জন্য উপযুক্ত নয়। সর্বত্র পয়সার কদর— অর্থের আরাধনা।

বিকেল চারটে নাগাদ বাসন্তী এক কন্যা সন্তানের জন্ম দিল। নরম্যাল প্রসব করানোর জন্য অপেক্ষা করতে হল অনেকটা সময়। ডাক্তারবাবুকে দেবাংশু পূর্ব থেকেই আবেদন করে রেখেছিল। ডাক্তারবাবু ও জানতেন বাসন্তীর শরীরে অস্ত্রোপচারের ঝুঁকির কথা। সেকারণে নার্সিং হোমে‌ না দিয়ে হসপিটালে ভর্তি করেছিল বাসন্তীকে। হসপিটালের চারপাশে নার্সিং হোম গজিয়ে উঠেছে ব্যাঙের ছাতার মতো। সেখানকার ডেলিভারি কেশগুলো এই হসপিটালের ডাক্তারবাবুদের কেউ না কেউ করে থাকেন। সব প্রসূতির বাড়ির লোকের পক্ষে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে নার্সিং হোমে রোগী ভর্তি করার সাধ্য যেমন নেই, তেমন সাধ ও নেই। ভালো – মন্দ যাই হোক হসপিটাল‌ই তাদের একমাত্র ভরসাস্থল। শিশুকন্যা সহ বাসন্তী সুস্থ‌ই আছে। মেয়ে হ‌ওয়াতে দেবাংশু মনে মনে খুশি হয়েছে মনে হয়। কারণ বংশ কন্যা সন্তান নেই।বড় দাদার দুই ছেলে, মেজো দাদার ও দুই ছেলে। কন্যা সন্তান বড়ো মায়াশীল হয়। যথা সময়ে খবর পেয়েছিল গার্গী। বিকেলে শেখরের ফোন আসতেই অনুমান করতে পেরেছিল সে।

— হ্যালো হ্যালো, শুনতে পাচ্ছি, কী খবর বলো। খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল গার্গী।
— একটা মেয়ে হয়েছে বাসন্তীর।মা- মেয়ে দুজনেরই ভালো আছে। চিন্তা করো না, আমি সময় মতো ফিরব।
— ওদের ছাড়বে কবে?
— এখন ও কিছু জানা যায়নি, তবে আজ তো ছাড়ছে না।বাবু স্কুল থেকে ফিরেছে? মেয়ে কেমন?
— হ্যাঁ বাবু ফিরেছে, মেয়ে ভালো আছে।
— আচ্ছা ঠিক আছে, ছাড়লাম।বলেই ফোন ছেড়ে দিল শেখর।

এ প্রান্তে ফোন রেখে গার্গী একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। আপাতত উৎকণ্ঠার অবসান, এখন শুধু শেখরের ফেরার অপেক্ষা। সন্ধ্যার পর সবাই হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পড়ল। সুকন্যা বাসন্তী ছুটি পাবে তিনদিন পর। হসপিটালে মা-মেয়ের তত্ত্বাবধানে রাখার মতো বাড়ির কাউকে পাওয়া যাবে না জেনে একজন আয়া নিযুক্ত করা হয় তিনদিনের জন্য। সমস্ত কিছুর বন্দোবস্ত ঠিকঠাক করে দিয়ে দেবাংশুরা ফিরে গেল; শেখরও ট্রেন ধরার উদ্দেশ্যে একটা অটো ধরে নিল। শেখর অফিসে বেরিয়ে গিয়েছে। ছেলেমেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে গার্গী মায়ের ঘরটি পরিষ্কার – পরিচ্ছন্ন করতে হাত লাগাল।আর মাত্র একটা দিন পরে বাসন্তী সদ্যোজাত মেয়েকে নিয়ে এই ঘরে এসে উঠবে। মায়ের ঘরে আজ অধিকক্ষণ কাজ করার দৌলতে শাশুড়ির কথা বার বার মনে পড়ছিল গার্গীর। এখনও অনেক কিছুতে শাশুড়ির হাতের স্পর্শ লেগে আছে। দাঁত থাকতে দাঁতের মূল্য বুঝতে পারে না মানুষ, কথাটার মর্ম নতুন করে যেন উপলব্ধি করতে পারল সে। নিজের ভুলের মাশুল নিঃশব্দে গুনতে হচ্ছে নিজেকে; কার ও কাছে প্রকাশ করতে না পারার বেদনাটাই তাকে অহরহ আঘাত করে। এ ব্যথার বিশল্যকরণীর সন্ধান তার জানা নেই। আজ ভোর ভোর বেরিয়ে গিয়েছিল শেখর। খুব সকালে পৌঁছে গেল হসপিটালে। তার আগে অবশ্য সন্দীপকে সঙ্গী করে দেবাংশু সেখানে অপেক্ষা করছিল। ইতিমধ্যে ওরা একটা ট্যাক্সি ঠিক করে ফেলেছে। হসপিটাল থেকে ছাড়া পেলেই র‌ওয়ানা দেবে,যত শীঘ্র পৌঁছানো যায় সে কথা মাথায় রেখে।

বাড়িতে পৌঁছতে শেখরদের দুটো বেজে গেল। ডাক্তারবাবু আসতে বিলম্ব করায় হসপিটালেই অনেকটা সময় অতিবাহিত হল। সন্দীপ ফিরে গিয়েছে বাড়িতে। সঙ্গে এসেছে দেবাংশু। সপ্তর্ষি -সুজাতা আজ স্কুলে যায় নি। মেয়ে নিয়ে পিসিমা আসবে শুনে ভাই-বোনে খুব ফুর্তিতে ছিল। কিন্তু খেলনা পুতুলের মতো অতটুকু বাচ্চাকে দেখে দুজনে বড়ো অবাক হয়ে গেল — আরো অবাক হল সেই পুতুলের পিট-পিট করে তাকানো আর হাত-পা নাড়া দেখে।এই কি পিসিমার মেয়ে! না কি পুতুল, ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তারা। ঘুরে ফিরে কেবল‌ই অসীম কৌতূহল ভরা চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১১)

অনেক দিনের দুশ্চিন্তা আপাতত মিটল বটে কিন্তু অন্যদিকে দেবাংশুর সমস্যা গেল বেড়ে। সমস্যাটা তখন মনে হয়নি, এখন আশু সমাধানের কোনো পথ দেখছে না।দু-দিন শ্বশুরবাড়ি তো দু-দিন নিজের বাড়ি, এইভাবে তাকে তাঁতের মাকুর মতো একবার এবাড়ি, একবার ওবাড়ি করতে করতে নাজেহাল দশা তার।

ছেলে – মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়ার পর গার্গীর হাতে জরুরি কাজ খুব একটা থাকে না। তখন টানা বেশ খানিকটা সময় কাটায় বাসন্তীর মেয়েকে নিয়ে। সংসারের সমস্ত কিছু একহাতে সামলে আবার একজন প্রসূতি এবং বাচ্চাকে পরিচর্যা করা গার্গীর উপর কতটা চাপ সৃষ্টি করছে, বাসন্তী মনে মনে উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। এনিয়ে দেবাংশুর সঙ্গে একদিন আলোচনা করেছিল সে। কিন্তু মুশকিল হল, এই ক’টা মাসের জন্য কোনো একজন পরিচারিকা রাখার প্রসঙ্গ নিজের থেকে বাসন্তী বা দেবাংশু যেমন বলতে পারছে না, তেমন স্বেচ্ছায় কিছু তারা করতেও‌ পারছে না। অথচ বাস্তব পরিস্থিতিটা সর্বক্ষণের জন্য বাসন্তীকে বসে বসে দেখে যেতে হচ্ছে। এক দু-মাস না গেলে টুকটাক কাজকর্মে হাত লাগাতে পারছে না সে।তা সংসারের পক্ষে যেমন সত্য, শরীরের পক্ষেও। দেবাংশু সেদিন উপস্থিত ছিল। অফিস থেকে ফিরে শেখর মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের ঘরে এল ভাগ্নির খবর নিতে। অফিসের কাজের চাপ থাকায় দিনের ভাগে প্রায়ই বাড়ির কোনো ব্যাপারেই তেমন লক্ষ্য রাখতে পারে না।

দাদাকে ব্যস্ততামুক্ত পেয়ে বাসন্তী প্রসঙ্গটা উল্লেখ করে বলল — দাদা, তোমার কাছে একটা কথা বলব বলব করে বলতে পারছি না, কারণ…।
— কারণ যাই থাক; কথা বলবি তাতে বাধা কোথায়? কী বলবি বল।
— বলছিলাম, এখনও তো তিন -চার মাস থাকতে হবে; দেখছি বেচারি বৌদির উপর খুব চাপ পড়ে যাচ্ছে। তাই এই ক’টা মাসের জন্য আমাদের গোপালের মাকে নিয়ে এলে… ।
— আরে আগে তো বলবি, আমি আর তোর বৌদি এনিয়ে অনেক ভেবেছি, মুশকিল হচ্ছে এখানে তেমন কাউকে পেয়ে উঠছি না।
— আমাদের গোপালের মা একদম হাত-পা ঝাড়া মানুষ, কোনো ঝামেলা নেই, মন দিয়ে কাজ করতে পারবে। ব্যবহার এবং কাজ দুটোই অসম্ভব ভালো।
— তোর বৌদিকে তো আগে বলতে পারতিস।

দেবাংশুকে লক্ষ্য করে বলল — তাহলে দেবাংশু, দু-এক দিনের মধ্যে তাকে তুমি নিয়ে এসো।
দেবাংশু অনুচ্চ স্বরে বলল — ঠিক আছে দাদা, বৌদি কবে আনতে বলে জানি।

সংবাদটা শুনে গার্গী আন্তরিকভাবে খুশি হল। বাস্তবিক তার উপর কাজের চাপ অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। কিন্তু বিকল্প কোনো উপায়ের ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিল না। অথচ গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো, নবজাতককে দেখতে দুই তরফের আত্মীয়স্বজন দু-একজন, দু-একজন করে মাঝে মাঝে আসছে — সে সমস্ত বাড়তি চাপটা গার্গীকে সামাল দিতে হচ্ছে। জন্ম সার্টিফিকেট পেতে বিলম্ব আছে; এখনও নামকরণ ঠিক হয়নি। আপাতত একটা আটপৌরে নামের খুবই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। সে সমস্যার একপ্রকার সমাধান করে দিয়েছে গার্গী।

একদিন মায়ের কোলে বোনুকে খিল খিল করে হাসতে দেখে ছেলে সপ্তর্ষি মাকে জিজ্ঞেস করেছিল — মা, বোনুর নাম কি?
একদন্ড ভাবতে হয়েছিল গার্গীকে। তারপর ছেলেকে বলেছিল — ওর নাম… হাসি।
ছেলেও‌ হাসতে হাসতে বলেছিল — তাই ও-অত হাসছে?
— হ্যাঁ, হাসি নাম বলে তো এত হাসছে।
সেই থেকে ধীরে ধীরে সবাই হাসি নামে ডাকতে শুরু করে।

রবিবারে দেবাংশু এল গোপালের মাকে সঙ্গে নিয়ে। দেবাংশুর মা-ও সঙ্গে এসেছেন। নাতনির মুখ দেখার জন্য খুবই অস্থির করে তুলেছিলেন দেবাংশুকে। মায়ের শরীর খুব ভালো নয়, সুবিধে হয়েছে গোপালের মা সঙ্গে থাকাতে। দেখা গেল, গোপালের মা যেমন দিলখোলা তেমন অতিমাত্রায় মিশুকে স্বভাবের মানুষ। বাড়িতে ঢোকার ঘন্টা খানেকের মধ্যে সবাইকে এমন আপন করে নিল যে, দেখে মনে হয় যেন কত কালের পরিচিত আত্মীয়। গার্গীকে নিরস্ত করে তার হাতের কাজ যেভাবে নিজের হাতে করতে শুরু করল, দেখে গার্গী একাধারে খুশি ও বিস্মিত না হয়ে পারল না। সারা বাড়ির মধ্যে একটা উৎসাহের প্লাবন এনে দিয়েছে গোপালের মা। মানুষ যে এতটা উচ্ছ্বল প্রাণ-শক্তিতে ভরপুর হতে পারে, বিশেষ করে একজন মহিলা, গোপালের মাকে না দেখলে গার্গীর অভিজ্ঞতায় ঘাটতি থেকে যেত।

গোপালের মাকে নিয়ে আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, নবজাত শিশুটিকে দেখভালের দায়িত্ব সামাল দেওয়া। গোপালের মা কিন্তু নিজেকে সেই সীমিত সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখতে পারল না। রাঁধাবাড়া ছাড়া গার্গীর সংসারের সমস্ত কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেল।বাধ্য হয়ে নয়, স্বেচ্ছায়। কারণ কাজের মধ্যে যে আনন্দ লুকিয়ে থাকে তার সন্ধান পেলে গোপালের মায়ের উৎসাহে জোয়ার আসে। এমনি স্বভাবের মানুষ সে। নিজের সংসারের হাল ভাঙা, পরের সংসারকে আপন করে নিয়ে যতটা আনন্দ খুঁজে পাওয়া যায়, তার‌ই চেষ্টা করে বেঁচে থাকতে চায় গোপালের মা। দেবাংশুর মা ক’টা দিন কাটিয়ে ফিরে গেলেন। শরীরটা তাঁর ভালো যাচ্ছিল না। নিয়মিত যে ডাক্তারবাবুকে দেখান, তিনি বসেন ডায়মন্ডহারবারে।‌ এখান থেকে তাঁকে দেখাবার সুযোগ কম। অগত্যা দেবাংশু মাকে সঙ্গে নিয়ে দাদাদের কাছে রেখে এসেছে। শাশুড়ি ফিরে যেতে মায়ের কথাটা এখন বেশি বেশি করে মনে পড়ছে বাসন্তীর। নাতনিকে দেখলে মায়ের যে কত আনন্দ হতো তা উপলব্ধি করে বাসন্তীর চোখে জল এসে যায়। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে উদ্গত বেদনাকে সামাল দিয়ে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করে সে।আজ মা উপস্থিত থাকলে তার মেয়েকে পরিচর্যার জন্য বিকল্প ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়ত না।

ছেলে সপ্তর্ষির স্কুলে গার্জেন-মিটিং থাকার কারণে আজ অফিস বন্ধ করতে হয়েছিল শেখরকে। দুপুরের পর মিটিং শেষে স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে এসেছে। কাজের দিনগুলিতে ইচ্ছা থাকলেও ভাগ্নিকে নিয়ে একটু আদর করার অবকাশ থাকে না শেখরের।আজ সেই সুযোগ পেয়ে হাসিকে নিয়ে বসল। দেখতে পেয়ে মেয়ে সুজাতা এসে বাপের পাশে বসে বোনুর গায়ে হাত বোলাতে লাগল। সে যে নিছক খেলার পুতুল নয় সেই ধারণাটা এখন অনেকটা তৈরি হয়েছে সুজাতা-সপ্তর্ষি দুজনের। পুতুল ধীরে ধীরে তাদের খেলার সঙ্গী হয়ে উঠছে – সেই আনন্দে দুজনে খুব খুশি থাকে। হাসিও সুজাতাকে খুব পছন্দ করে। তাকে কাছে পেলে উৎসাহিত হয়ে হাত-পা নাড়ে আর ঘন ঘন হাসির মাধ্যমে নিজের ভালোলাগার অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে থাকে। পর পর দুটো দিন ছুটি পেয়ে দেবাংশু বাড়িতে ছিল। দ্বিতীয় দিন সকালে বাসন্তীর বড়ো ও মেজো জা এল হাসিকে দেখতে। দুই অতি পরিচিত মানুষকে কাছে পেয়ে গোপালের মা বেজায় খুশি। বাইরের কাজকর্ম দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করে রান্নাঘরে গিয়ে গার্গীর কাজে সহযোগিতা করতে লেগে গেল। হাসি এখন তার জ্যাঠাইমায়েদের কোলে কোলে। নতুন মুখ দেখে বার বার মুখের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, তবে কান্নার কোনো লক্ষণ দেখা গেল না।

দুটো থালা ভর্তি খাদ্যবস্তু নিয়ে গোপালের মা বারান্দায় এসে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলল — বড়দি, মেজদি, ওকে আমার কাছে দিয়ে তোমরা কিছু খেয়ে নাও।
বলে হাসিকে নিজের কাছে নিয়ে আদর করতে লাগল।সাথে সাথে জলের পাত্র নিয়ে গার্গীও‌ এসে পৌঁছেছিল। সে অতিথিদেরকে মুখে কিছু দেওয়ার আবেদন জানাল। বাজারে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু বাড়িতে নতুন আত্মীয় আসার কারণে মাংসের দরকার হয়ে পড়ে।
সাইকেল নিয়ে গিয়েছিল শেখর – খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এল। আত্মীয়-কুটুম বাড়িতে এলে সপ্তর্ষি – সুজাতা খুব আনন্দ পায়। ভালো লাগে, খাওয়া – দাওয়াও ভালো হয়। তবে তাদের চলে যাওয়াটা খুশি মনে মেনে নিতে পারে না।

দুপুর গড়িয়ে এল। বাসন্তীর জায়েরা আর অপেক্ষা করল না। শেখর -গার্গী তাদেরকে বার বার থাকার জন্য বলছিল। বড়ো জা বলল — বাড়িতে বৃদ্ধা শাশুড়ি ছাড়া মেয়ে – ছেয়ে আর কেউ নেই। এ অবস্থায় থেকে যাওয়া ঠিক হবে না। সে কথার সত্যতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সবাই। অগত্যা শেখর তাদের এগিয়ে দিতে বেশ কিছুদূর সঙ্গে গেল। গোপালের মা ও গার্গী বাড়ির বাইরে চলে এসেছিল, পথের বাঁকে দৃষ্টির আড়াল হতে তারাও ধীরে ধীরে ঘরের পথে পা বাড়াল।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১২)

কিছু দিন পর হঠাৎ মন খারাপ করা একটা সংবাদ শুনে ভীষণভাবে আশাহত হলেন আনন্দময়ী। বৃন্দাবনে বসবাসকারী বিধবাদের কল্যাণে কাজ করা এক এন-জি-ও সংস্থা থেকে স্বেচ্ছা সেবক হিসেবে নিযুক্তির প্রস্তাব পেয়েছেন নির্মলা। উক্ত সংস্থায় যোগদানের আন্তরিক ইচ্ছা তার প্রবল।কারণ এমন সুযোগ সকল সময় সবার আসে না। আনন্দময়ীর চোখ-মুখে বিষণ্ণতার ছায়া লক্ষ্য করে নির্মলা বললেন – দিদি, আমি চলে যাব জেনে আপনি দুঃখ পেয়েছেন মনে হয়। কোনো চিন্তা করবেন না; আপনার সঙ্গে যোগাযোগ থাকবে। কেবল আপনার সঙ্গে বা বলি কেন, পরোক্ষে যোগাযোগ থাকবে সবার সঙ্গে। বহু জায়গায়, বহু কাজে ঘুরতে হবে আমাকে, কোনো রকম প্রয়োজন পড়লে অবশ্যই আমাকে জানাতে ভুলবেন না।কারণ আমাদের সংস্থার কোন না কোনো প্রতিনিধি এখানেও যোগাযোগ রেখে চলবেন। নির্মলার কথায় ক্ষীণ আশার আলো দেখলেন আনন্দময়ী। দূরে গেলেও তাকে যে প্রয়োজনে নাগালের মধ্যে পাওয়া যাবে, নির্মলার মুখের এমন আশ্বাস বাক্যে অনেকটা স্বস্তিবোধ করলেন তিনি।তবুও চিন্তার গভীরে একটা কিন্তু কিন্তু ভাব মাঝে মাঝে মনের বেভুলে উঁকি দিতে থাকল।

দু’ দিন পর এন-জি-ও সংস্থা থেকে গাড়ি এসে পৌঁছল নির্মলাকে নিয়ে যেতে। বিধবাশ্রমের‌ সবাই মিলে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাকে বিদায় জানাল। অনেকেই চোখের জল ফেলছিল, কারণ সবাইয়ের সঙ্গে নির্মলার ব্যবহার ছিল খুবই আন্তরিক।তার প্রাণবন্ত ও সক্রিয় কর্মকুশলতার দ্বারা সকলকে উজ্জীবিত করে রাখতেন নির্মলাজী। আনন্দময়ীসহ‌ বেশ কয়েকজন আশ্রমের বাইরে নির্মলাজীর সঙ্গে অনেকটা দূর পর্যন্ত এসেছিলেন। পরে গাড়ি দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেলে সবাই তারা বিষণ্ণ চিত্তে, নিঃশব্দে আশ্রমে ফিরে এলেন। বর্ষা শেষ হয়ে শরৎ দেখা দিল। মাথার উপর অসীম নীল আকাশ, মাঝে মাঝে পরিচলন বৃষ্টি ধারায় ধৌত হয়ে আরো নীল, গাঢ় নীল বর্ণে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।সবুজে ভরা প্রান্তর, ছায়াঘন শ্যাম বনানী, শরতের অমল মহিমা যেন দূর স্বপ্নলোকের বার্তা বয়ে আনে।

এর‌ই মাঝে এসে পড়ল জন্মাষ্টমী। বৃন্দাবন লীলা বিহারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মহান জন্মতিথি উদযাপন। উৎসব নগরী বৃন্দাবনে, উৎসব মুখর হয়ে ওঠার উপলক্ষের অভাব নেই। বৃন্দাবনের শ্রেষ্ঠ উৎসব ঝুলন পূর্ণিমা বা হোলি উৎসবের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎসব বোধকরি শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী বা গোকুলাষ্টমী।‌ হোলি উৎসবের মতো উন্মাদনা ততটা থাকে না বটে, তবে জন্মাষ্টমীর পুণ্য তিথিটিকে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও মাঙ্গলিক আচার অনুষ্ঠানের দ্বারা সার্থকভাবে সম্পাদন করার মধ্যে যে সার্বিক আন্তরিকতা, আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন ঘটতে দেখা যায়, তা এক কথায় অতুলনীয়। সমগ্ৰ বৃন্দাবন জুড়ে মাতৃস্নেহের বিগলিত মন্দাকিনী ধারার স্রোত ব‌ইতে থাকে বাল-গোপালের জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে। যার ঢেউ আছড়ে পড়ে মথুরাসহ সারা দেশের বুকে।

মাতৃ মন্দির বিধবা আশ্রমের দুজন সঙ্গিনীসহ আনন্দময়ী বেরিয়ে পড়লেন গোকুলের উদ্দেশ্যে।নন্দালয়ে জন্মাষ্টমী পালনের মাহাত্ম্য ও মহিমা সশরীরে উপস্থিত থেকে উপলব্ধি করার ঐকান্তিক বাসনা বহুদিন যাবত সঞ্চিত ছিল মনের গহনে। বৃন্দাবনের বহু মন্দিরে সাড়ম্বরে পালিত হয় শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী; বহু দর্শক সমাগম হয়। কিন্তু নন্দালয়ে জন্মাষ্টমী উদযাপনের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহ্য আলাদা। উক্ত তিথিতে গোকুলের মাটি স্পর্শ করা পরম সৌভাগ্যের বিষয় বলে অনেকের বিশ্বাস। দুপুরের পর আনন্দময়ীরা নন্দালয়ে পৌঁছে গেলেন। অনেকেই এসেছেন, আসবেন অনেকে; মূল অনুষ্ঠানটি উদযাপিত হবে মধ্যরাতে। চলছে তার‌ই প্রস্তুতি। বেশ কিছুক্ষণ থেকে আনন্দময়ী লক্ষ্য করছেন, আগত মহিলাদের থেকে একজন বার বার তাঁকে নিরীক্ষণ করে চলেছেন।তাঁর‌ই সম বয়সী, তবে বেশ সক্রিয় এবং সপ্রতিভ। বিধবা বটে, তবে পরণে সাদা থানের পরিবর্তে সরু পাড়ের এবং হালকা গেরুয়া রঙের জমিযুক্র শাড়ি। সহসা সেই মহিলা আনন্দময়ীর অত্যন্ত নিকটবর্তী হয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন – কিছু মনে কোরো না, তোমার বাড়ি কোথায় বলো তো !

আগন্তুক মহিলার প্রশ্ন শুনে অনাগ্ৰহী আনন্দময়ী সংক্ষেপে উত্তর দিলেন – দেবগ্ৰাম।
— মামার বাড়ি?
— হরিশ্চন্দ্রপুর।
— তোমার নাম কি আনন্দময়ী?

এতক্ষণ পর আনন্দময়ী মনোযোগ দিয়ে প্রশ্নকর্ত্রীর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবতে লাগলেন, সামনে উপস্থিত মহিলাকে কোনো সূত্রে চেনা যায় কি না! কারণ ভদ্রমহিলা তাঁর নামটি পর্যন্ত জানে। এতক্ষণে ভালো করে তাকাতে তাকাতে দেখলেন, চিবুকের বাম পাশে নিচের দিকে একটা তিল, যেটি এখন বেশ বড়ো আকারের হয়ে উঠেছে। কয়েক সেকেন্ড অনুধাবনের পর আনন্দময়ী যেন অনেকটা আন্দাজ করতে সফল হলেন। বললেন – হ্যাঁ, আমি আনন্দময়ী। তুমি কি কনক?
— চিনতে পেরেছিস তাহলে! বলে আনন্দময়ীকে জড়িয়ে ধরে হৃদয়ে বহুদিনের সঞ্চিত আবেগ,আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে লাগলেন। এতদিন পরে দুই বাল্য সখির মিলনের আনন্দাশ্রু নামতে থাকলো দু-জোড়া চোখ বেয়ে।

কয়েকটা মুহূর্ত। বহুকাল যাবত এত আনন্দ, এতটা তৃপ্তি, এতটা মানসিক প্রশান্তি অধরা ছিল আনন্দময়ীর জীবনে।আজ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মের পুণ্য তিথির মহা লগ্নে রাধামাধবের শ্রীচরণে বার বার প্রণতি জানালেন মনে মনে। দূর প্রবাসে কনকলতার সাথে সাক্ষাতটাকে ব্রজ বিহারী গোপালের দান রূপে গ্ৰহণ করায় মনের মধ্যে আনন্দের লহরী বয়ে চলল আনন্দময়ীর। আনন্দময়ীর হাত ধরে আকর্ষণ করতে করতে কনকলতা বললেন – চল্‌, একটা ফাঁকা জায়গায় বসি দুজনে। অনেক কথা জমা হয়ে আছে।

কনকলতা হরিশ্চন্দ্রপুরের মেয়ে। তাঁদের‌ই বাড়ির পাশে ছিল আনন্দময়ীর মামার বাড়ি। ছোটো বেলায় বেশ কয়েকটা বছর মামার বাড়িতে কেটেছিল আনন্দময়ীর। সেখানেই পরিচয় কনকলতার সাথে। তারপর ধীরে ধীরে তারা সখ্যতার নিবিড় সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। গ্ৰামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহপাঠী তারা; সকাল-বিকাল পুতুল খেলার সঙ্গীও দুজনে। দুই সখিরে পথ চলার যুগল দৃশ্য পাড়ার পথের বাঁকে বাঁকে, গাছ-গাছালির ছায়ায় ছায়ায় বোধকরি আজ‌ও ভেসে ওঠে। তারপর পেরিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ কয়েক যুগ। জীবন প্রবাহিত হয়েছে উৎস থেকে সমাপ্তির অভিমুখে; চড়াই উৎরাইয়ের সেই পথ চলা আজ‌ও অব‌্যাহত‌, আজ‌ও গতিশীল। পরম আত্মীয়ের মতো আন্তরিকতায় কনকলতা জিজ্ঞেস করলেন – তুই বৃন্দাবনে কবে এসেছিস, সঙ্গে কে আছে?

আনন্দময়ী বাল্য সহচরীর মুখের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে রইলেন নির্বাক নেত্রে। তাঁর দৃষ্টির অসহায় আর্তি কনকলতাকে বিস্মিত করল।
— কী রে, চুপ করে আছিস যে!
আনন্দময়ীর দুচোখ জলে ভরে গিয়েছে। নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে মুখ খুললেন
— একাই এসেছি, দু-বছরের অধিক হয়ে গেল।
কনকলতার বিস্ময় আরো বেড়ে গেল। কিছুই অনুমান করতে পারলেন না; বাল্য সখির জীবনের বর্তমান অবস্থা একেবারে অজ্ঞাত তাঁর কাছে; তবে বার্ধক্যে অনেকের অসহায় পরিণতির অভিজ্ঞতা কনকলতার হয়েছে।নিজে‌ও ভুক্তভোগী। সেই নিরিখে আনন্দময়ী সম্পর্কে অহেতুক অনেক ভাবনাই মাথায় ভিড় করতে লাগল। জিজ্ঞেস করলেন
— বৃন্দাবনে তুই আছিস কোথায়?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আনন্দময়ী বললেন
— বর্তমানে মাতৃমন্দির বিধবাশ্রমে আছি।
— বাপের ঘরে থাকতে থাকতে তোর বিয়ে হয়ে যাওয়ার খবর শুনেছিলাম। তারপর নিজের বিয়ে হয়ে গেল। জীবনের গতিপথ গেল ঘুরে; আর কোনো খবর রাখতে পারিনি।ঝর্ণা যখন নদী হয় তখন তার একটা পরিচয় থাকে। কিন্তু সমুদ্রে মিশে গেলে সে পরিচয় তার হারিয়ে যায়।
— তোর স্বামী মারা গেছে কতদিন হল? আনন্দময়ী জানতে চাইলেন।
— সে অনেক দিন হল, বারো-তেরো বছর হবে। তার আগে বাবা মারা গেছিল। পরে বিদায় নিল মা। বাপের ভিটেয় পা রাখিনি বহুদিন। আমার মেয়ে দুটোর বিয়ের পর এখানে -ওখানে ঘুরে ঘুরে শেষটায় রাধামাধবের চরণে ঠাঁই মিলল।

কিছুটা আক্ষেপের সুরে আনন্দময়ী বললেন
— স্বামীর অবর্তমানে মেয়েরা সংসারে অনেকটা ‌
আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে — মনের দিক দিয়ে তো বটেই!
মেয়ে বাসন্তীর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর স্বামী মারা গেল। ছেলের সংসারে শেষ পর্যন্ত আর টিকে থাকতে পারলাম না। ছেলের কোনো দোষ ছিল না, শুধু ওর সংসারে অশান্তি এড়াতে নিজে থেকেই সরে এসেছি।

গল্পে গল্পে অনেকটা সময় কেটে গেছে। আনন্দময়ীর সঙ্গিনীদ্বয় ঘুরতে ঘুরতে চাঁপা গাছের তলায় এসে পৌঁছায়। কনকলতা আর আনন্দময়ী দুজনেই ব্যস্ত হয়ে উঠে পড়েন আজকের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। নন্দালয়ে জনসমাগম ততক্ষণে অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। সারা রাত চলবে ব্রত উদযাপন অনুষ্ঠান। ভজন,কীর্তন, ধর্মীয় শোভাযাত্রা, মধ্যরাতের নিশি জাগরণ ইত্যাদি বহুপ্রকার আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পালিত হয় এই গোকুলাষ্টমী ব্রত। জন্মাষ্টমী ব্রত উদযাপন উপলক্ষে কনকলতা প্রতিবছর এই নন্দালয়ে আসেন।সমগ্ৰ বৃন্দাবন-মথুরা জুড়ে মহা সমারোহে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম মহোৎসব জন্মাষ্টমী উদযাপিত হয়। কিন্তু ধর্মীয় কারণে হোক বা সংস্কারবশতঃ হোক, জন্মাষ্টমী ব্রতসাধন‌ মানসে গোকুলের আকর্ষণ কনকলতাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করে।তার‌ই টানে নন্দালয়ে তাঁকে আসতেই হয় ।আজ এখানে এসে আনন্দময়ীর সাক্ষাৎ লাভকে গোকুল গৌরব বাল-গোপালের পরম কৃপা মনে করে কনকলতার অন্তর বাড়তি আনন্দে ভরপুর হয়ে উঠল।
আনন্দময়ীও আজকের দিনের এই প্রাপ্তিকে পরম সৌভাগ্য ভেবে শ্রীগোবিন্দের শ্রীচরণে ভক্তিভরে মাথা নোয়ালেন বার বার। এতদিন পর পরিপূর্ণ এক আনন্দানুভূতি আবিষ্ট করে রাখল তাঁকে। সারা রাতের আনন্দ অনুষ্ঠান আজ সত্যিকারের আনন্দের স্পর্শ দিয়ে গেল তাঁর বিষাদিত অনুতপ্ত জীবনে।

রজনীর অবসানে আনন্দের অবসান ভাবনায় বিষণ্ণ হয়ে উঠল আনন্দময়ীর অন্তর।প্রশ্ন মনে জাগছে কিন্তু অজ্ঞাত কি এক দ্বিধায় প্রকাশ করতে পারছেন না তিনি। মন চাইছে অথচ অমূলক সংশয় একটা বাধার প্রাচীর তুলে আটকে দিতে চাইছে মনের ইচ্ছাকে। সকাল হয়ে এল। আনন্দময়ী ফিরে যাবেন তাঁর আশ্রমে।কনকলতা‌ও ফিরে যাবেন তাঁর ঠিকানায়।জমে থাকা অনেক কথা, অনেক ব্যথার ভিড়ে সময় কেটে গেছে,জানা হয়নি কনকলতার বর্তমান ঠিকানা।সংশয়ের নিরসন করলেন স্বয়ং কনকলতা।

বিদায় মুহূর্তে আনন্দময়ীর হাত‌ ধরে বললেন — শোন্ আনন্দি‌! বহু বছর ধরে আমি আছি পাগলা বাবার মন্দিরে। তুই গিয়েছিস সেখানে কোনোদিন?
পাগলা বাবার মন্দিরের কথা অনেক শুনেছেন আনন্দময়ী। কিন্তু কোনোদিন যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। কনকলতার প্রশ্নের উত্তরে জানালেন
— না! যাওয়ার সৌভাগ্য ঘটেনি কোনো দিন।
— ঠিক আছে, শোন্‌ যা বলি। দুদিন পর একটা বিশেষ কাজে আমাকে ইসকন্‌ মন্দিরে যেতে হবে।ওখান থেকে ঘুরে তোর মাতৃমন্দির বিধবাশ্রমে যাব।তোর অত্যাবশ্যকীয় যাকিছু শুধু সেগুলিই গুছিয়ে নিয়ে প্রস্তুত থাকিস। আমি গিয়ে তোকে নিয়ে আসব আমার পাগলা বাবার মন্দিরে। এখন থেকে আমরা একসাথে থাকব।

আবেগের ঘোরে আনন্দময়ীর মুখে কোনো বাক্য সরল না। কনকলতার মুখের পানে তাকিয়ে মৃদুভাবে মাথা নাড়লেন কেবল।
ব্যস্ত হয়ে কনকলতা বললেন – চলি রে, আমার অনেক কাজ আছে। তুই কিন্তু প্রস্তুত থাকিস।ভুলিস না।

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১৩)

কনকলতার কথাগুলি অবিশ্বাস করতে পারেননি আনন্দময়ী। তবু যেন মনের কোণায় সামান্য সংশয় থেকে থেকে উঁকি দিতে থাকল। অনেক দিন আছে এখানে। মনে হয় অনেক কাজে ব্যস্ত থাকে কনক। মনে থাকবে তো? দুদিন পর পড়ন্ত দুপুরে সব সন্দেহ -সংশয় দূর করে মাতৃমন্দির বিধবাশ্রমে এসে হাজির হলেন কনকলতা। আনন্দময়ী দেখলেন এই আশ্রম কর্তৃপক্ষের কার‌ও কার‌ও সাথে কনকের চেনা -জানা আছে। সবাই তাঁরা যথেষ্ট আগ্ৰহ নিয়ে আলাপ করলেন কনকলতাজীর সাথে। অভিভূত আনন্দময়ী।বার বার মন চাইছে রাধামাধবের চরণে প্রণতি জানাতে।ভাসতে ভাসতে এতদিন পর যেন কূলের নিশানা দেখতে পাচ্ছেন।

গৃহের গণ্ডির বাইরে যে বিস্তৃত জগৎ পড়ে আছে, নর্মলা বা কনকলতাদের মতো মানুষজনের সান্নিধ্যে না এলে তার মহিমা উপলব্ধির সৌভাগ্য ঘটত না। আনন্দময়ী বুঝতে পারেন তার মধ্যে সর্বজনীন ধারণার উন্মেষ ঘটা সম্ভব নয় — নিজে বড়ো আত্মকেন্দ্রিক। তবু দু-এক জন উদারচেতা মানুষজনের সঙ্গলাভে নিজের সংকুচিত অন্তরাত্মাকে যতটা প্রসারিত করা যায়, সেটুকুই তাঁর কাছে পরম পাওয়া, বিশুদ্ধ আনন্দ। আনন্দময়ী একপ্রকার প্রস্তুত হয়েই ছিলেন।গোছ – গাছ করার মতো বেশি কিছু ছিল না। জিনিস পত্রের মধ্যে কয়েকখানা পরিধেয় ছিল মুখ্য। পরিচিত কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ সেরে কনকলতা আনন্দময়ীর নিকট এসে জিজ্ঞেস করলেন —– তোর হয়েছে? আর বিলম্ব করা যাবে না।
— হ্যাঁ। বলে আনন্দময়ী ব্যস্তভাবে উপস্থিত সঙ্গিনীদেরকে‌ বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে কনকলতার সাথে মাতৃ মন্দির বিধবাশ্রম ত্যাগ করলেন।আশ্রম প্রান্তে দাঁড়িয়ে মন্দিরস্থিত রাধাগোবিন্দের উদ্দেশ্যে শেষ প্রণাম জানিয়ে আর পিছু তাকালেন না।

সন্ধ্যারতির প্রাক মুহূর্তে আনন্দময়ীসহ কনকলতা পাগলা বাবার মন্দিরে প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে সোজা নিজের ঘরে গিয়ে উঠলেন। একেবারে নতুন অপরিচিত জায়গা। আনন্দময়ীর গতিবিধির মধ্যে জড়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছিল।তা কিন্তু কনকলতার দৃষ্টি এড়ালো না। তিনি বললেন — আনন্দি‌, ভয়ের কিছু নেই আর সংকোচের কিছু নেই। বড়ো মহারাজজী সব জানেন। এখন বস্ত্র পালটে ঠাকুরের মন্দিরে যাই চল।সন্ধ্যারতি শুরু হয়ে গিয়েছে। কনকলতার সঙ্গী হয়ে মন্দিরে উপস্থিত হলেন আনন্দময়ী। সন্ধ্যারতির আয়োজন এবং জাঁকজমক দেখে আনন্দময়ী বিস্মিত হলেন। সাধারণ সন্ধ্যারতিতে এত জনসমাগম, এত সমারোহ, এপর্যন্ত তিনি দেখেননি। দেখলেন, উপস্থিত সকলেই শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে, আন্তরিক ভক্তি শ্রদ্ধা সহকারে মন্দিরে অবস্থিত রাধামাধবের ভজন-কীর্তনে অংশগ্ৰহণ করে তন্ময় হয়ে আছেন। চন্দনের ফোঁটা প্রদান, প্রসাদ বিতরণ ইত্যাদি মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানাদি সমাপ্ত হতে লেগে গেল ঘন্টাখানেকের উপর।

মন্দির থেকে ঘরে ফিরে আনন্দময়ী জিজ্ঞেস করলেন — কনক, সন্ধ্যারতিতে অংশগ্ৰহণকারী সকলেই কি আশ্রমিক, না বাইরের দর্শনার্থী আছেন কিছু?
আনন্দময়ীর জ্ঞাতার্থে কনকলতা বললেন — সন্ধ্যারতিতে সকল সময় বাইরের কেউ থাকেন না সাধারণত। সবাই এখানকার আশ্রমিক। তবে তীর্থভ্রমণকারী পর্যটকদের অংশগ্ৰহণে যেকোনো বাধা নেই। উপস্থিত থাকলে অনেক সময় থাকেন অনেকে। আনন্দময়ীকে ভরসা জুগিয়ে বললেন — আজ তো এসেছিস। দেখতে পাবি কত বড়ো আশ্রম এবং কত সংখ্যক আবাসিক।
হঠাৎ একটু ব্যস্ত হয়ে বললেন — আনন্দি‌, তুই বিশ্রাম কর, আমি একবার দেখে আসি আমার গ্ৰুপের আবাসিকরা সবাই আবাসে ফিরল কি না। বলতে বলতে কনকলতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

চুপচাপ একা বসে আনন্দময়ী ভাবছিলেন যে,কনক বোধকরি ভালো আছে। তার ভালো থাকার ছোঁয়াচ যেন আনন্দময়ীর মধ্যে চারিত হয়েছে। বহুদিন পর আপন অন্তরে স্বস্তিবোধের স্বাচ্ছন্দ্য উপলব্ধি করতে পারছেন। নিঃসংশয়ে নির্ভর করার মতো সাথি পেয়ে সর্বক্ষণের জন্য সংকুচিত থাকার বদ্ধতা থেকে মুক্তি লাভ ঘটেছে।ভরসা করার মতো নির্ভরযোগ্য অবলম্বন খুঁজে পেয়েছেন। নিজেকে নিজে টেনে নিয়ে যাওয়ার একঘেয়েমি থেকে অব্যাহতি পেয়ে অনেকটা যেন হালকা বোধ করছেন আনন্দময়ী। প্রায় আধ ঘন্টা পর ফিরে এলেন কনকলতা। জনা পঞ্চাশ আবাসিকের দায়িত্ব কনকলতার হাতে। তাঁদের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান সব কিছুর দেখভাল করতে হয় তাঁকে। তাঁর মতো আরও কয়েকজন আছেন যাঁদের উপরে এক একটা গ্ৰুপের দায়িত্ব ন্যস্ত আছে। বিভিন্ন রকমের মানুষগুলোর জ্বর-জাড়ি,সুখ-দুঃখ, উৎসব-আনন্দ, বিনোদন ইত্যাদি প্রাত্যহিকের জীবন ধারণের সমস্ত কিছু লক্ষ্য রাখতে হয় কনকলতাদের। আজ কনকলতাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি। তাঁর গ্ৰুপের সবাই ফিরে এসেছেন সন্ধ্যারতি শেষে। রাতে আহারের প্রয়োজন যাঁদের তাঁরা ঠিক সময়ে যথাস্থানে পৌঁছে যাবেন, কিছু বলতে হবে না। আনন্দময়ীকে নিঃশব্দে বসে থাকতে দেখে কনকলতা জিজ্ঞেস করলেন — কি রে আনন্দি, খারাপ লাগছে?

— না-না, খারাপ লাগছে না।তোর কাজ শেষ?
— হ্যাঁ, আজকের মতো শেষ। আবার কাল সকাল থেকে নতুন করে শুরু হবে।
— তোর কাজটা কী?
— পঞ্চাশ জনের মতো একটা গ্ৰুপের দেখভালের দায়িত্ব পালন করা।
— আচ্ছা কনক, এখানে যারা আছেন, তাঁরা সবাই কি বিধবা রমণী?
— না! তা নয়! অনেক অসমর্থ, অসহায়, স্বজনহীন বয়স্ক পুরুষমানুষ‌ও আছেন।আর আছে অনাথ শিশুরা; তবে তাদের সংখ্যা অল্প।
— সবার দেখভালের দায়িত্ব কি মেয়েরাই করে থাকেন?
— না রে আনন্দি! পুরুষদের দায়িত্ব সামলায় পুরুষরা। আর অনাথ শিশুদের দেখাশোনা করেন স্ত্রী- পুরুষ উভয়েই।

একটা বিষয় আমাকে বড়ো অবাক করে, যার কুল-কিনারা খুঁজে পাই না আমি।
— বিষয়টা কী? জিজ্ঞেস করেন কনকলতা।
— মন্দির বলি আর আশ্রম বলি, এই সমস্ত বিশাল কর্ম-কান্ডের বিপুল খরচ—- সে অর্থ কারা জোগায়, কোথা থেকে আসে?

কনকলতা মৃদু হেসে উঠে বললেন — না জানলে যে কার‌ও মনে এমন ধারণা হ‌ওয়া স্বাভাবিক।আমার‌ও মনে হতো,তবে পরে পরে সব জানতে পারি। আশ্রম বা মন্দিরের আর্থিক উৎসের বিভিন্ন ক্ষেত্র আছে। আর্থিক সহায়তা আসে সরকার থেকে, বিভিন্ন এনজিও সংস্থা থেকে, বিদেশি মিশন থেকে, তবে সিংহভাগ সাহায্য আসে ধনী ব্যক্তিবর্গের দান থেকে। এছাড়া প্রণামী বাবদ কিছু তো হয় বারোমাস।
একটা বিষয় কি জানিস, অন্তর থেকে মানুষের কল্যাণ করতে চাইলে অর্থের অভাবে তার গতিরোধ হয় না — কোন পথে যে ঠাকুর জুটিয়ে দেবেন তার আগাম বোঝার উপায় নেই। আসল হল সদিচ্ছা।

কনকলতার বিবৃতি শুনে আনন্দময়ী ক্ষণিক চুপ হয়ে গেলেন। ভাবতে লাগলেন যে, মানুষের জন্য মানুষের প্রাণ কাঁদে; ঠাকুর-দেবতা উপলক্ষমাত্র– শুধু মানুষের অন্তরে বসে তার মনে সদিচ্ছাটা জাগিয়ে দেন।
হঠাৎ কিছুটা ব্যস্ত হয়ে কনকলতা বলে উঠলেন —- আনন্দি! আজ আর না, ঘুমিয়ে পড়, সকালে উঠে আমার সাথে যেতে হবে। আমার কাজটা একটু রপ্ত করার চেষ্টা করবি। সময় কাটবে, ন‌ইলে নিষ্কর্মা হয়ে চব্বিশটা ঘন্টা কাটানো এখানে বিষম বিরক্তিকর।পরে পরে নিজে‌ই বুঝতে পারবি।
সকালে ঘুম ভেঙে চোখ চাইতে আনন্দময়ী দেখলেন, কনকলতা ঘরে ঢুকছেন। আনন্দময়ী জানতে চাইলেন — এত সকালে কোথায় গিয়েছিলিস কনক?
কনকের পরিধেয় থেকে অগুরু চন্দন আর সুগন্ধি ধূপের সুবাস তখন‌ও অল্প অল্প ছড়াচ্ছিল।শান্ত স্বরে কনকলতা উত্তর দিলেন — মন্দিরে ভোরের প্রার্থনা সেরে আসছি; ঘুমাচ্ছিস দেখে তোকে আর ডাকি নি — ক’ দিন পর আপন থেকেই যাওয়ার ইচ্ছা জাগবে।

আনন্দময়ী উঠে পড়লেন। সকালে কনকের সঙ্গে যেতে হবে।রাতে ঘুম ভালো হ‌ওযায় শরীর মন দুই-ই চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারলেন,সমস্ত রকম জড়তা কাটিয়ে সময়ের গতির সাথে গতি মিলিয়ে চলাই এসমস্ত জায়গায় ধর্ম।সময় এখানে থেমে থাকে না, কাজের মাধ্যমে ক্রিয়াশীল হয়ে সক্রিয় থাকে। সক্রিয় রাখে। কনকলতার সাথে আবাসিক চত্বরে উপস্থিত হয়ে আনন্দময়ী দেখলেন,কর্ম-চঞ্চল হয়ে ওঠার পূর্বে আবাসের জীবনযাত্রা ধীরে ধীরে সজাগ হতে শুরু করেছে। নানা বয়সের, নানা বর্ণের বিধবা আবাসিকগণ কনকতাজীকে দেখেই উৎসাহিত হয়ে ‘ রাধে, রাধে ‘ ধ্বনিতে অভিনন্দন জানালেন। কনকলতাও‌ সবাইয়ের কুশল কামনা করে সার্বিক খোঁজখবর করতে থাকলেন। আনন্দময়ী বিস্ময়ভরা চোখে চারদিক অবলোকন করতে ব্যস্ত। কনকলতা অনেকের সাথে আনন্দময়ীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে আগামী দিনের পূর্বাভাস দিয়ে রাখলেন।

এরপর আবাসিক চত্বরের একটা অংশ ঘুরে ঘুরে দেখিয়ে কনকলতারা ঘরে ফিরে এলেন। দীর্ঘ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে কনকলতা আনন্দময়ীর উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন — এখন থেকে বেশ কয়েক ঘণ্টা অর্থাৎ বিকেল পর্যন্ত সময়টা একেবারে নিজস্ব।এ সময়ে নিজের প্রয়োজনে ছাড়া কোথাও যেতে হবে না বা অন্যের কোনো কাজ করতে হবে না — তবে ব্যতিক্রম ঘটে, জরুরি কোনো কাজের ডাক এলে তখন। গতকাল থেকে আনন্দময়ী কেবল দেখে চলেছেন। এমন যে তিনি প্রথম দেখছেন তা নয়। তবে আগের দেখা আর এখনকার দেখার মধ্যে ভাব-ভাবনার বিস্তর তফাত।কনকের আন্তরিকতা আনন্দময়ীর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির রূপান্তর ঘটিয়েছে।এজন্য বাল্য সখির কাছে তিনি মনে মনে কৃতজ্ঞ।

আনন্দময়ীর ভাবান্তর লক্ষ্য করে কনকলতা পরম মমতায় জানতে চাইলেন — আনন্দি! গতকাল থেকে তোকে ভীষণ চুপচাপ থাকতে দেখছি, এখানে কি তোর ভালো লাগছে না? ধীর শান্ত স্বরে আনন্দময়ী উত্তর দিলেন —- না কনক! এখানে যা কিছু দেখছি অবাক হয়ে যাচ্ছি; ভালো লাগছে, অনেক দিন এত ভালো আগে লাগেনি।… তুই আছিস ভালো!
— হ্যাঁ রে! অনেক উত্থান -পতন , অবজ্ঞা-অবহেলার পর্ব পার হয়ে হয়ে শেষে রাধামাধবের চরণে ঠাঁই পেয়ে সুখে না হলেও নিজের মতো করে শান্তিতে আছি।আর একটা আসল সত্যি কি জানিস— সুখ-দুঃখ, আনন্দ -বেদনা এই আপেক্ষিক জিনিসগুলো অনেকটা নির্ভর করে মনের উপর, নিজের গ্ৰহণযোগ্যতার উপর।মন্দের‌ও ভালো আছে,তা খুঁজে নিতে হয়। তুই ঠিক বলেছিস, আমি খারাপ নেই। ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করি জীবনের বাকি দিনগুলো যেন এভাবেই পার হয়ে যায়!

বিষণ্ণ বিদায় (পর্ব ১৪)

দিনটা ছিল বুধবার। কি‌ একটা উপলক্ষে সরকারি ছুটির দিন থাকায় অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ সব বন্ধ। বাড়িতেই ছিল শেখর। ছুটির দিন মানে ঘরের বকেয়া কাজগুলো সেরে ফেলার দিন। সারা সপ্তাহ ধরে জমে থাকা কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল শেখর। বারান্দায় ছেলেমেয়ে দুজন হাসিকে নিয়ে মেতে ছিল। হাসি এখন মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে শিখেছে। আর ঘনঘন উপুড় হয়ে বিছানায় মুগ ঘষতে থাকে।

ছুটির দিনে সংসারের সমস্ত কিছুই চলে একটু ঢিমে তালে। সকালের জলখাবার খেতে খেতে ন’টার উপর হয়ে গেল। ‌এমন সময় বাড়িতে এল গার্গীর ভাই গগন। শেখর, গার্গী তাকে সাদরে আপ্যায়ন জানাল। গার্গী ব্যস্তভাবে জানতে চাইল- কি রে ভাই, মা-বাবা সবাই ভালো আছে তো?
— মা ভালো আছে, বাবার শরীর ভালো নেই, ভালো যাচ্ছে না, সেই নিয়ে কথা বলতে আসতে হল।
— কাল যখন ফোন করলাম তখন তো কিছু জানালি নে!
— ফোনে সব বলা যায় না, তাছাড়া দাদাবাবুর সঙ্গে একটা পরামর্শ করা দরকার; জানি আজ ছুটির দিন, তাই চলে এলাম।
— বেশ করেছ। সাংসারিক বুদ্ধি-সুদ্ধি ধীরে ধীরে মাথায় জমছে দেখছি। তারপর গার্গীকে উদ্দেশ্যে করে শেখর বলল- ওকে কিছু খেতে দেওয়ার ব্যবস্থা কর।

সপ্তর্ষি-সুজাতা বোনুকে রেখে মামার কাছে এসে জুটেছিল। তারা খুব খুশি। মামাকে ভীষণ ভালোবাসে। বাড়িতে এলে সহজে যেতে দিতে চায় না। গার্গী টিফিন নিয়ে এলে গগন জিজ্ঞেস করল- দাদাবাবু কোথায় গেল, দিদি?
— ডাকবো?
— হ্যাঁ! কথা আছে তো?

শেখর রান্নাঘরের পিছনে গোপালের মাকে কি একটা দেখিয়ে দিচ্ছিল। গার্গী ছেলেকে বলল- বাবু, যা দেখি, তোর বাবাকে এখনি ডেকে নিয়ে আয়। বলবি মামা ডাকছে।
শেখর বাড়ির মধ্যে ঢুকছিল। সপ্তর্ষি চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল- বাবা, বাবা, মামা তোমাকে ডাকছে।
শেখর এসে গগনের কাছে বসল। গগন বিলম্ব না করে বলতে লাগল- দাদাবাবু, বাবার শরীর খুব খারাপ। প্রেসার তো আগে থেকেই ছিল, এখন সুগার, থাইরয়েড ইত্যাদি ইত্যাদি বহু রকম উপসর্গ মাথাচাড়া দিয়েছে। দিদি আর আপনি একবার চলুন; চোখে না দেখলে ঠিক অনুমান করতে পারবেন না।

বাবাকে যে ডাক্তার দেখেন তিনি কি বলছেন? শেখর জানতে চাইল।
— উনি হসপিটালে বা নার্সিংহোমে নেওয়ার কথা বলছেন। বাবা হসপিটালে যেতে কোনো মতেই রাজি নয়।
মিনিট দুয়েক ভেবে নিয়ে শেখর স্ত্রীকে উদ্দেশ্যে করে বলল- পরে সময় হবে না, চলো আজ একবার দেখে আসা যাক।
গার্গী শেখরের প্রস্তাবে সম্মত হল। বলল- গোপালের মা, বাসন্তী, সবাই আছে। আমরা যত তাড়াতাড়ি পারি ফিরে আসব। ছেলেকে ওদের কাছে রেখে যাব।

বিলম্ব না করে যথাসম্ভব দ্রুততার সাথে স্নান-খাওয়া করে নিয়ে প্রস্তুত হয়ে পড়ল। গোপালের মাকে ডেকে গার্গী বলল- দিদি, তোমার ভরসায় রেখে যাচ্ছি ওদের। ছেলে র‌ইল, হাসি, বাসন্তী সবাইকে দেখে রেখো। আমরা অযথা সময় ব্যয় করব না সেখানে।
—— অসুবিধে হবে না। আমি, ছোটদি তো আছি। তোমরা সাবধানে যাও, সাবধানে ফিরে এসো।

বাপের বাড়িতে যখন পৌঁছল গার্গীরা তখনও আহারাদির পালা চলছিল। অক্ষয় বাবু বারান্দায় পাতা চেয়ারের উপর চুপচাপ বসেছিলেন। বিনতাদেবী বারান্দার এক কোণায় কী যেন একটা কাজে ব্যস্ত। মিলি ছিল রান্নাঘরে। আসলে গগন বেরিয়ে যাওয়ার পর মিলির মা-বাবা এসেছেন মেয়ের বাড়িতে। একহাতে জো-জোগাড় করতে করতে দুপুর গড়িয়ে গেছে। তবে শ্বশুর-শাশুড়িকে সময় মতো খাওয়ার বন্দোবস্ত করে দিয়েছিল মিলি। ভালোই হল, সবাই মিলে একটা পরামর্শ করা যাবে। তাছাড়া শেখর-গার্গীদের সাথে মিলির বাবা-মায়ের অনেকদিন দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। আনন্দময়ীর নিরুদ্দেশ হ‌ওয়ার খবর পেয়েছিলেন ওনারা, তবে বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জানাবার সময়-সুযোগ করে উঠতে পারেননি। ভীষণ ব্যস্ত মানুষ গগনের শ্বশুর বরদাপ্রসাদবাবু। এ-ক্লাস কন্টাক্টর। সরকারি-বেসরকারি বহু কাজের বরাত সামলান তিনি। দিনের বেশিরভাগ সময়টা বাইরে বাইরে কেটে যায়; অনেকদিন রাতেও ঘরে ফিরতে পারেন না।

শেখর আর গার্গীকে একসাথে পেয়ে খুবই উৎফুল্ল হয়ে বলতে লাগলেন- কি সৌভাগ্য আমাদের, বহুদিন পর তোমাদের সাথে দেখা হল বাবা, খুব ভালো লাগল।
সুজাতার চিবুক ধরে নেড়ে দিয়ে আদর করে বললেন- বাঃ! দিদিভাই বেশ ফুটফুটে হয়েছে দেখছি। ছেলের এখন কোন ক্লাস হচ্ছে- তাকে নিয়ে আসতে পারতে।
বিনম্র স্বরে শেখর বলল- সৌভাগ্য আমাদের‌ও, আপনাদের সাথে দেখা হয়ে গেল। নিজেদের কাজে সবাই আমরা এতটাই ব্যস্ত থাকি যে, আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও সবসময় হয়ে ওঠে না। ছেলে এখন ক্লাস ফাইভে পড়ে। আজ আসার পরিকল্পনা ছিল না, হঠাৎ হয়ে গেল।
— তা বাবা, তোমরা দুটো খাওয়া-দাওয়া করো।
গার্গী উত্তর দিল- খেয়ে উঠেই সঙ্গে সঙ্গে বার হয়ে পড়েছি। এখন আর কিছু খেতে পারব না বাবা; আপনারা খেয়েছেন তো?
— হ্যাঁ মা, আমরা এই খেয়ে উঠলাম।

গার্গী দেখল, তার বাবা চেয়ারে নিঃশব্দে বসে বসে অসহায় দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাচ্ছেন। শরীরটা তাঁর অদ্ভুত রকমে ভেঙে পড়েছে। মুখ দেখলে অনুমান করা যায় শরীর অভ্যন্তরে অস্বাভাবিক কিছু অস্বস্তি সর্বক্ষণের জন্য ঘটে চলেছে; যা ঠিক ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। সবাই এসে অক্ষয়বাবুর পাশে বারান্দায় সমবেত হল। গার্গী বাবাকে জিজ্ঞেস করল- বাবা, সারাদিন তোমার কি অসুবিধে হয়?
মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে অক্ষয়বাবু ক্ষীণ কণ্ঠে জানালেন- কী বলব? কত রকম কি যে হচ্ছে,সব আমি বলে বোঝাতে পারব না।শুয়ে-বসে স্বস্তি নেই,দমের কষ্ট, প্রেসার, গাঁটে গাঁটে যন্ত্রণা, খেতে অরুচি, ঘুম না হ‌ওয়া, কত বলব! মনে হয় ভালোমতো চেক‌আপ হলে সবগুলো ধরা পড়ে।
অনুচ্চ কণ্ঠে শেখর বলল- আপনি তো হসপিটালে যেতে রাজি হচ্ছেন না! আমরা যে যাই মনে করি না কেন, হসপিটালের পরিকাঠামো-পরিষেবায় যে সুযোগ লাভের সম্ভাবনা ঘটে, সব নার্সিংহোমে তা‌ পাওয়া যায় না; অথচ অর্থ ব্যয়ের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। সব হসপিটাল যেমন সমান নয় তেমনি নার্সিংহোমগুলির মধ্যেও‌ গুণগত পার্থক্য আছে।

মিলির বাবা শেখরকে উদ্দেশ্য করে বললেন- বাবা শেখর, দাদা যখন হসপিটালে যেতে মনের দিক থেকে প্রস্তুত নয়, সেখানে আমাদের জোর করার কিছু নেই- তাতে হিতে বিপরীত হ‌ওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
— সে কথা অবশ্যই ঠিক। আমি এমনিই বলছিলাম। রোগীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করলে রোগ বৃদ্ধির কারণ ঘটতে পারে।… এখন দেখতে হবে কোথায় কোন নার্সিংহোমে যাওয়া যেতে পারে।এদিকটায় আমার তেমন চেনা-জানা নেই।
— শোনা বাবা! আমার কাজের দৌলতে আমাকে তো বহু জায়গায় ঘুরতে হয়! চেনা-পরিচিত লোকের সংখ্যাও কম নয় তোমাদের বাবা-মায়ের আশীর্বাদে।

আমাদের বাড়ি থেকে কিলোমিটার পাঁচেক দূরে ‘সারদা সেবা সদন’ নামে একটি নার্সিংহোম আছে। খারাপ নয়। আমার একজন অতি পরিচিত ডাক্তারবাবু ওখানে কাজ করেন। হোমের মালিকের সাথেও আলাপ আছে। আমি বলি, ওখানে একবার নিয়ে যাওয়া যাক। কি বলো তোমরা?
মিলি, মিলির মা, গগন, গগনের মা, গার্গী সবাই এতক্ষণ ছিল নীরব শ্রোতা। এক্ষণে একসাথে সবাই সাড়া দিল।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ভালো, তাই করা হোক।
— শেখর বলল- আমাদের দ্বিমত করার কোনো কারণ দেখি না। অবিলম্বে বাবাকে ডাক্তারের চিকিৎসাধীন করার খুবই প্রয়োজন।আপনি অভিজ্ঞ এবং আমাদের অভিভাবক স্বরূপ, আপনার নির্দেশ মতোই কাজ হোক, আমরা আপনার সঙ্গে আছি।
— শোনো বাবা শেখর, তুমি একা মানুষ, তার উপর তোমার দশটা-পাঁচটা সার্ভিস একটা আছে; সেটা বজায় রাখতেই হবে। গগন‌ও একা, ওর সাংসারিক বুদ্ধি-বিবেচনা এখনও অপরিণত। অত‌এব নিজে যতটা পারি চেষ্টা করব- তোমরা অবশ্যই যোগাযোগটা রেখো।

শেখর বিমুগ্ধ। মানুষটার সঙ্গে তার তেমন চলাচল নেই। মনের অজান্তে হয়তো অবজ্ঞা বা উপেক্ষার ভাব জমা ছিল। আজ তাঁর বুদ্ধি, অভিজ্ঞতা এবং আন্তরিকতা শেখর কে সমৃদ্ধ করল।বিনম্র শ্রদ্ধায় শেখর জানাল- যথাসাধ্য চেষ্টা করব বাবা, আমাদের তরফ থেকে যোগাযোগ রাখার কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, তবু যে আপনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, এতেই আমরা ধন্য।
— তাহলে এই সিদ্ধান্ত‌ই পাকা র‌ইল। কালকে হয়তো হবে না, আগামী পরশু ছেলেকে দিয়ে গাড়ি পাঠাব। গগন, তুমি কিন্তু প্রথম দিনটা সঙ্গে থাকবে।মিলির দিকে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন- মিলি মা, বেয়ানকে নিয়ে প্রয়োজনে তোকে দু-একটা দিন থাকতে হতে পারে, সাবধানে থাকিস। অবশ্য ফোনে সবসময় যোগাযোগ থাকবে।

আলাপ-আলোচনায় অনেকটা সময় কেটে গেল। সন্ধ্যা নামার বেশি বাকি নেই। বরদাবাবু ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন- আর অপেক্ষা করা যাবে না। শেখর, তোমরা…. ।
— আমরাও একসাথে বেরিয়ে পড়ব, বাড়িতে ছেলেটা অস্থির হয়ে পড়ছে।
শেষ মুহূর্তে বিনতাদেবী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বরদাবাবু কারণ বুঝতে পেরে হাত ধরে বললেন- কেন বেয়ান, ভয়ের তো কিছু দেখছি না। রোগ হলে ডাক্তারের কাছে তো যেতেই হবে। একদম চিন্তা করবে না, আমরা তো সবাই আছি। দাদা শীঘ্র সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন।
গার্গী মাকে সান্ত্বনা দিয়ে কান্নাকাটি বা চিন্তা করতে নিষেধ করল।
কথায় কথায় সস্ত্রীক বরদাবাবু শেখরদেরকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কিছুটা পথ একসাথে যেতে পারবেন।

প্রবোধ কুমার মৃধা | Probodh Kumar Mridha

Why 15th August chosen as Independence Day? | Probodh Kumar Mridha

Goddess Dakshina Chandi 2023 | Barid Baran Gupta | Best Article

Best Bangla Golpo Reading 2023 | তৃতীয় পক্ষ | Nasir Waden

Galpo Holeo Sotyi | কোনো এক গ্রাম্য বধূ | Debraj Krishnananda Bhattacharya | Best 2023

Shabdodweep Web Magazine | New Bengali Famous Story | Probodh Kumar Mridha

Bengali literature has always been a source of great pride, with a rich tradition of storytelling that spans centuries. In recent years, a new wave of Bengali stories, or Bangla Golpo, has captivated the hearts of readers across the globe. As we look into the New Bengali Famous Story of 2025, we see a fusion of tradition and innovation, breathing new life into Bengali storytelling. This article explores the emergence of contemporary Bengali stories, highlights the role of Shabdodweep Web Magazine in this literary revolution, and introduces writer Probodh Kumar Mridha, whose works have contributed significantly to the Bengali literary scene.

The Rise of New Bengali Famous Story

Bengali literature has always had a remarkable ability to reflect the complexities of human emotions, society, and culture. Over time, it has evolved to include various forms of expression, including modern short stories, poems, and even eBooks. Today, the New Bengali Famous Story is emerging through the fusion of traditional Bengali storytelling with modern narratives. Writers are increasingly experimenting with themes like social justice, individual identity, and the impact of technology on society.

These stories have become popular not just in Bengal but across the world. With the advent of digital platforms, Bengali stories are now accessible to a global audience. This has led to the rise of Bangla Online Stories, allowing readers from diverse backgrounds to explore the beauty and intricacies of Bengali literature.

Shabdodweep Web Magazine: A Platform for Bengali Literature

Shabdodweep Web Magazine has become a prominent platform for contemporary Bengali literature. The magazine is known for publishing a wide range of content, including Bengali Stories, Bengali Ebook Stories, and Bangla Golpo. It has gained popularity among readers who appreciate high-quality Bengali writing that speaks to the pulse of modern society.

One of the key features of Shabdodweep is its ability to showcase diverse voices. From thought-provoking poems to powerful narratives, the magazine offers a space for both established and emerging writers to share their stories. The publication has become a go-to destination for those seeking new Bengali literature, and its focus on modern, relevant themes resonates with a wide audience.

Probodh Kumar Mridha: A Writer in Bengali Literature

Among the many talented writers contributing to Shabdodweep Web Magazine is Probodh Kumar Mridha. Known for his profound storytelling and ability to capture the essence of human emotions, Mridha has written numerous New Bengali Famous Story or stories that have gained widespread acclaim. His unique approach blends traditional storytelling with contemporary sensibilities, making his works highly relatable to modern readers.

Probodh Kumar Mridha’s contributions to Bengali literature are significant, with a range of stories that explore the complexities of human relationships, the nuances of cultural identity, and the challenges faced by individuals in today’s world. His stories often provide a window into the lives of ordinary people, revealing their inner struggles, triumphs, and moments of introspection.

Through Shabdodweep Web Magazine, Mridha’s works have found a global audience, allowing readers from different parts of the world to connect with the rich tapestry of Bengali literature.

The Future of Bengali Literature: E-books and Online Stories

As the literary landscape continues to evolve, the emergence of Bengali Ebook Stories and Bangla Online Stories marks a significant shift in how Bengali literature is consumed. Digital platforms like Shabdodweep Web Magazine are helping bridge the gap between traditional literature and the digital age. Readers can now access their favorite New Bengali Famous Story or stories from the comfort of their homes, whether on a laptop, tablet, or smartphone.

The transition to digital has opened up new opportunities for writers to experiment with form, structure, and content. Authors are no longer limited by traditional publishing methods, allowing for greater creative freedom. This has led to the proliferation of innovative Bengali stories that tackle contemporary issues, provide new perspectives, and challenge societal norms.

The Role of Shabdodweep Web Magazine in Promoting Bengali Stories

Shabdodweep Web Magazine is playing a crucial role in promoting modern Bengali literature. It acts as a bridge between the past and the present, offering readers access to timeless stories as well as fresh narratives that reflect the changing dynamics of Bengali society. Whether it’s poetry or prose, Shabdodweep Web Magazine provides a platform for writers like Probodh Kumar Mridha to showcase their work and reach an engaged, global audience.

FAQ: New Bengali Famous Story

Here are some frequently asked questions about the New Bengali Famous Story and the role of Shabdodweep Web Magazine in promoting contemporary Bengali literature.

  1. What is a New Bengali Famous Story?
    A New Bengali Famous Story refers to the latest wave of Bengali short stories, novels, and narratives that reflect modern themes and issues. These stories explore a wide range of subjects, including relationships, identity, culture, and technology, all while staying true to the rich tradition of Bengali storytelling.
  2. Who writes the New Bengali Famous Story featured on Shabdodweep Web Magazine?
    Shabdodweep Web Magazine features stories from both established and emerging writers. One such writer is Probodh Kumar Mridha, whose works have been widely appreciated for their depth, emotional resonance, and modern sensibilities.
  3. Where can I read New Bengali Famous Story online?
    You can read New Bengali Famous Story on Shabdodweep Web Magazine. The magazine offers a wide variety of Bengali literature, including Bangla Golpo, Bengali Ebook Stories, and poetry. Visit the website for the latest updates and to explore the vibrant world of Bengali storytelling.
  4. What makes Shabdodweep Web Magazine a great place for Bengali literature?
    Shabdodweep Web Magazine is an authoritative platform for Bengali literature, known for its high-quality content, diverse voices, and commitment to promoting both contemporary and classic Bengali stories. The magazine provides readers with a unique opportunity to explore new Bangla Online Story and Bengali Ebook Stories by talented writers like Probodh Kumar Mridha.
  5. How can I contribute my own Bengali story to Shabdodweep Web Magazine?
    If you’re an aspiring writer, Shabdodweep Web Magazine welcomes submissions from writers who want to showcase their work. You can submit your Bangla Golpo or Bengali Ebook Story through the magazine’s submission guidelines. It’s a great way to share your stories with a wider audience and be part of the vibrant Bengali literary community.

Conclusion

The New Bengali Famous Story represents a dynamic shift in the world of Bengali literature. Through the efforts of platforms like Shabdodweep Web Magazine, contemporary writers such as Probodh Kumar Mridha are contributing to a vibrant literary culture that is gaining international recognition. Whether you’re a long-time lover of Bengali literature or a newcomer exploring Bangla Golpo for the first time, there has never been a better time to dive into the world of New Bengali Famous Stories.

Leave a Comment