Shiva in Orissa Patashilpa | Best Article 2023

Sharing Is Caring:

ওড়িশা পটশিল্পে শিব – অভিজিৎ পাল [Shiva in Orissa Patashilpa]

কথামুখ

নির্গুণ নিরাকার পরমব্রহ্মের গুণময় পুরুষতত্ত্বের প্রধান তিনজন দেবতা—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব। তাঁরা তিনজনই স্বরূপত অদ্বৈত। আবার তাঁরা জগতের সৃজন, পালন ও লয়ের যাবতীয় কার্যকলাপ সম্পাদনের জন্য ত্রিরূপ ধরেছেন। মহাদেব শিব ভারতীয় সনাতন ধর্মের এক অপূর্ব দেবতা। দেবতা থেকে দানব, মানব থেকে অশরীরী প্রাণ, সবার জন্য শিবের অবারিত দ্বার। যাকে কেউ চায় না, শিব তাকেও চান। অহৈতুকী কৃপাসিন্ধু যেচে গিয়ে তার পরম আশ্রয় হয়ে ওঠেন। শিব অপূর্ব বৈপরীত্য ধারণ করেন। আবার বলা যেতে পারে কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞায় বা শব্দবন্ধে তাঁকে বাঁধা যায় না।

মহাদেব শিব অব্যক্ত, অচিন্ত্য, মহাশূন্যময়; তিনিই আবার ব্যক্ত চরাচরে চেতনাস্বরূপ, তিনি অনাদিলিঙ্গের মতো সাকারও, তিনি আকাশের মতো সর্বব্যাপী নিরাকার। তিনি সংসারে থেকেও তীব্র বৈরাগ্যময়, তিনিই বৈরাগ্যের পরাকাষ্ঠা হলেও স্ত্রী-পুত্রাদির সঙ্গে সংসারধর্ম করেছেন। তিনি বৈরাগ্যে ত্যাগীর আদর্শ, গার্হস্থ্যে গৃহীর আদর্শ। তিনি জন্মহীন ও মৃত্যুহীন। আবার তিনিই প্রতিটি জীবের সঙ্গে জন্ম নেন, জীবের সঙ্গে লয় হন। প্রতিটি জীবই শিব, শিবই প্রতিটি জীব হয়েছেন। অগ্নি, বায়ু, জল, আকাশ, মৃত্তিকা—এই পঞ্চমহাভূতের নাথ তিনিই ভূতনাথ। তিনি অনাদিলিঙ্গের মতো অনাদিঅনন্ত, তিনিই আবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রতম কঙ্করে কঙ্করে নিজেকে প্রকাশ করেছেন। শিব সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ, আনন্দস্বরূপ, সুন্দরস্বরূপ, বিদ্যাস্বরূপ। পৃথিবীতে যা কিছু শুভ সবই শিব। অশুভ থেকে শুভতে যাত্রা হলো অশিব থেকে শিবের দিকে যাত্রা। বিশ্বময় সমস্ত প্রাণী তাঁর ধ্যান করেন, তিনিই আবার স্ব-স্বরূপের ধ্যানে মগ্ন থাকেন। তিনি নিজে কোনো ঐশ্বর্য ধারণ করেন না, অথচ আশুতোষ শিব তাঁর ভক্তকে ষড়ৈশ্বর্য দিয়ে সহজেই ভরিয়ে দেন। তিনি ভক্তকে ঐশ্বর্য দেন, অথচ নিজে ভিক্ষান্নে তৃপ্তি পান। সৌন্দর্যের পরিভাষা শিব, সামান্য পরিচর্যাহীন আকন্দ-বেলপাতাতেও তাঁর অপূর্ব রূপ খেলে যায়। তিনি স্বরূপও সুন্দর। মদনমোহন তিনি অথচ চিতাভস্মে ভূষিত থাকেন, রূপ ঢেকে রাখেন। এই বাহ্যভস্ম পার হয়ে তাঁকে চিনতে হয়। স্বয়ং মদনও তাঁর তাপে দগ্ধ হন এমনই ইন্দ্রিয়সংযমী তিনি। নৃত্যে নটরাজ তিনি। শাস্ত্রীয় রুদ্রবীণাধর তিনি, তিনিই আবার লৌকিক গালবাদ্যে সহজে মাতেন। তিনি একই সঙ্গে জটাজুটে পতিত হয়ে পড়া চন্দ্র ও দিব্য পাবনী শক্তির আধার গঙ্গাকে ধারণ করেন। ব্যাঘ্রাম্বর তিনি, দিগম্বর তিনি, তাঁর বিরাটত্বকে কোনো বস্ত্র আবৃত করা যায় না। ভোজন রসিক তিনি, অথচ তিনিই আশুতোষ শম্ভু। সাত্ত্বিকাদি সমস্ত গুণের আধার তিনি। তিনিই আবার ত্রিগুণাতীত তুরীয়‌। সমস্ত বর্ণের তাঁর ওপর অধিকার রয়েছে। সমস্ত ভাব, সমস্ত উপাসনা তাঁর মধ্যে এসে লীন হয়ে যায়। তিনি অব্যয়, তিনি দ্বন্দ্বাতীত। শিব চেতনাস্বরূপ শুধু নন, তিনি সাক্ষাৎ চেতনার তুঙ্গ অবস্থা বা চৈতন্য। তিনি ধ্যান, তিনিই ধ্যেয়।

ওড়িশাবাসী জগন্নাথের মতো শিবের প্রতি সমান আস্থাশীল। পুরীর শ্রীমন্দিরের মতো একই শৈলীতে ওড়িলায় তৈরি হওয়া প্রাচীন লিঙ্গরাজ মন্দির তার একটি জীবন্ত প্রমাণ। এছাড়া ওড়িশাবাসী বিশ্বাস করেন জগন্নাথের নিত্য সহচর প্রভু বলভদ্রদেব সাক্ষাৎ শিব। বলভদ্র ও শিব ওড়িশা সংস্কৃতিতে সাক্ষাৎ গুরুতত্ত্বের প্রতীক। এখানকার সাধারণ মানুষের বিশ্বাস রয়েছে, বলভদ্ররূপ শিবের কৃপা ছাড়া জগন্নাথের কৃপা লাভ হয় না। ওড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ সংস্কৃতিতে সুভদ্রা সৃজনী শক্তি, জগন্নাথ পালন শক্তি ও বলভদ্র সংহার শক্তি। ওড়িশায় তাই শিব বিষ্ণুর সমান মর্যাদায় পূজিত হন। ওড়িশায় শিবের শাস্ত্রীয় রূপই প্রসিদ্ধ। ওড়িশায় সোনা, রূপা, তামা, পিতল, অষ্টধাতু, শ্বেত পাথর, কষ্টিপাথর, দারুব্রহ্মে শিবের পূর্ণাবয়ব বিগ্রহ তৈরি করা হয়। এছাড়াও ওড়িশাবাসী শিবলিঙ্গে শিবের পূজা করেন। ওড়িশার লিঙ্গরাজ শিবের মন্দিরে শিবরাত্রির মহানিশায় অজস্র ভক্ত জাগরণ করেন ও শিবের চিন্তায় মন্দির চত্বরে সারারাত ধ্যান করেন। বঙ্গের পাশ্ববর্তী রাজ্য হলেও ওড়িশায় শিবের স্থূলকায় লৌকিক রূপ মান্যতা পায়নি। ওড়িশার ঐতিহ্যবাহী ধর্মচিন্তায় শিব ধ্রুপদী রূপ নিয়েছেন। শিবের শাস্ত্রীয় ধ্যানমন্ত্রে যে শিবরূপের চিন্তা বা বর্ণনা করা হয়েছে, তা সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে ওড়িশার পটচিত্রের শিব চরিত্রে। শিবের বহুল প্রচলিত একটি ধ্যানমন্ত্রে রয়েছে :

ওঁ ধ্যায়েন্নিত্যং মহেশং রজতগিরিনিভং চারুচন্দ্রাবতংসং
রত্নাকল্পোজ্জ্বলাঙ্গং পরশুমৃগবরাভীতিহস্তং প্রসন্নম্।
পদ্মাসীনং সমন্তাৎ স্তুতমমরগণৈর্ব্যাঘ্রকৃত্তিং বসানং
বিশ্বাদ্যং বিশ্ববীজং নিখিলভয়হরং পঞ্চবক্ত্রং ত্রিনেত্রম্।।

এই ধ্যান মন্ত্রের অর্থ, রজতগিরির মতো শুভ্র উজ্জ্বল কান্তিময় মহাদেব শিবের নিত্য ধ্যান করি। মনোহর চন্দ্রের কলা তাঁর ললাটে ভূষিত। তিনি রত্নভূষিত দেহে সমুজ্জ্বল। তাঁর বাঁ হাতে পরশু ও মৃগমুদ্রা তিনি ধারণ করেন। তাঁর ডান হাতে শোভা পায় বর ও অভয়মুদ্রা। তিনি ব্যাঘ্রাম্বর ধারণ করেন। তিনি পদ্মাসনে প্রফুল্লভাবে বসেন। সমস্ত দেবতা তাঁকে চারদিক থেকে স্তব, স্তুতি, বন্দনা করেন। তিনিই জগৎ চরাচরের আদি ও মূল কারণ। তিনিই নিখিলের যাবতীয় ভয়হারী। তিনি পঞ্চানন ও তাঁর প্রতিটি আননেই তিনটি করে নেত্র শোভিত। শিবের এই ধ্যানমন্ত্রটি রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত সঙ্ঘ ও তাদের সব শাখায় পঠিত হয়।

ওড়িশার মহাদেব শিবের পটচিত্রের কয়েকটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে— ১) ওড়িশার ঐতিহ্যবাহী পটচিত্রশিল্পে শিবের গাত্রবর্ণ সবসময় সাদা রঙে আঁকা হয়। ২) ওড়িয়া পটচিত্রে শিবের মুখে কালো রঙে পরিপাটি করে পাকানো গোঁফ ও গালের রেখা বরাবর দাড়ি আঁকা হয়। ৩) ওড়িশা পটে শিব একই সঙ্গে বস্ত্র ও বাঘছাল এবং রুদ্রাক্ষ ও ধাতুর গহনায় সাজেন। ৪) ওড়িশা পটশিল্পে শিবের সাধারণত চতুর্ভুজ মূর্তি আঁকা হয়। এছাড়াও দশভুজ ও ষোড়শভুজ শিবের বিশেষ পট আঁকা হয়। ৫) ওড়িশার পটচিত্রে শিবের শান্ত রূপ ও উগ্ৰ রূপ প্রায় সমান সংখ্যক পাওয়া যায়। ৬) শিবের অস্ত্রে ত্রিশূল ছাড়াও মৃগ-রূপ অস্ত্র বা মৃগমুদ্রার বিশেষ গুরুত্ব থাকে; অনেক পটচিত্রে শিবের ওপরের ডান হাতে উত্থিত মৃগের একটি আকৃতি দেখা যায়। এমনকি ওড়িশার অনেক পটচিত্র ও ভাস্কর্যে দেখা যায় শিবের হাতে ত্রিশূল না থাকলেও মৃগের অবয়বের গুরুত্ব রয়েছে। ৭) অধিকাংশ শিবের পটচিত্রে শিবের বাহন নন্দীকে ষণ্ডরূপে দেখা যায়। ৮) ওড়িশা পটশিল্পে শিবের কপালস্থিত তৃতীয় নয়ন উন্মুক্ত অবস্থায় আঁকা হয়। ৯) পটচিত্রে শিবের গাত্রবর্ণ সাদা হয় বলে পটের ফ্রেমের অংশে সাধারণত ঘন বা গাঢ় রঙের ব্যবহার করার রীতি রয়েছে। ১০) শিবের বস্ত্রের রঙে সাধারণত হলুদ আর সাদা রঙের ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কোনো কোনো পটচিত্রে হালকা রঙের নীল ও সবুজ রঙের ব্যবহার দেখা যায়। তবে লালের ব্যবহার প্রায় হয় না বললেই চলে। ১১) শিবের কণ্ঠে এক ছিঁটে নীল রঙ দেওয়া হয়। এটি শিবের হলাহল পানের ঘটনার অন্যতম স্মারক।

মহাযোগী শিব পট

শিব মহাযোগী। তিনি যোগশাস্ত্রের প্রাণময় রূপ। শিব আদি যোগী ও যোগগুরু। তিনি গুরুতত্ত্ব, তাই তিনি নিত্য সাধনারত বা ধ্যানরত। তিনি যোগীদের আরাধ্য। সর্বভারতে শিবের ধ্যানমূর্তির প্রসিদ্ধ স্থাপত্য কমবেশি পাওয়া যায়। ওড়িশায় একটি প্রচলিত মত রয়েছে, শিব দেবতত্ত্বের সংহারমূর্তি। তাঁর তৃতীয় নয়নের অগ্নি জাগ্রত হলে সংহার ও লয় অনিবার্য। তিনি নিজের ক্রোধাগ্নিকে শান্ত রাখেন ধ্যানের শক্তিতে। তাই তিনি ধ্যানরত। ওড়িশায় মহাযোগী শিবের যোগরত অবস্থার পটচিত্র আঁকা হয়। শিবের সর্বভারতীয় ধ্যানমূর্তিই এই ধরনের পটচিত্রের মূল বিষয়। পটচিত্রে কৈলাস পর্বতে বাঘের ছালের আসনে শিব পদ্মাসনে বসে ধ্যান করেন। শিবের নিচের দুটি হাত হাঁটু বা কোলের ওপর ন্যস্ত থাকে। ওপরের দুই হাতে অস্ত্র শোভা পায়। এই সময়ে শিবের ত্রিশূল সাধারণত হাতের বদলে তাঁর ডানদিকে আঁকা হয়। শিবের প্রাগুক্ত ধ্যানমন্ত্রের বর্ণনার সঙ্গে এই পটচিত্রের শিবরূপে মিল থাকে। শিবের মহাযোগী পটচিত্রের কোনো কোনো পটে শিবের বাহন হিসেবে শিবের সামনে ষণ্ডরূপ নন্দী বসে থাকেন। মহাযোগী শিবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নন্দীকে ষণ্ডরূপে মহাদেবের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখা যায়। পটচিত্রের এই বিষয়টি আপাতভাবে দেখে মনে হতে পারে, আরাধ্যের ধ্যানে নন্দীও শিবের কাছে ধ্যানমগ্ন হয়ে রয়েছেন। ওড়িশায় শিবের মহাযোগী পট আজও খুবই জনপ্রিয়। সারা ভারতময় এই ধরনের শিবপটের খুবই বাণিজ্যিক চাহিদা রয়েছে।

শিবের বিবাহের পট

শিবের বিবাহ সর্বভারতীয় শিল্প-সংস্কৃতিতে একটি জনপ্রিয় বিষয় হয়ে রয়েছে কমপক্ষে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের মহাকবি কালিদাসের কুমারসম্ভবের যুগ থেকে। সারা ভারতেই শিবের বিবাহ দৃশ্যে উপাস্যকে উপাসকের জনজীবনের সামাজিক সংস্কৃতির বলয়ে টেনে আনা হয়েছে। ওড়িশাতেও এই সর্বভারতীয় রীতির খুব বেশি ব্যতিক্রম হয়নি। ওড়িশায় শিবের বিরাট সংসার। পাত্র-মিত্র মিলে সে যেন এক বিরাট ব্যাপার। শিবের সঙ্গে কারও বৈরীর সম্পর্ক নেই। এমন অনন্য দেবতার বিবাহ খুব স্বাভাবিকভাবেই ত্রিভুবনের সকলের কাছে আনন্দের। শিব সকলের সুখ-দুঃখের সঙ্গী, তাই শিবের বিবাহে সবার জন্য সমান আমন্ত্রণ। শিবের বিবাহের মূলত দুটি ধরনের পটচিত্র দেখা যায়। প্রথমটি, বিচিত্র পাত্র-মিত্র সহ বৈরাগী শিবের নন্দীর পিঠে চড়ে বিবাহযাত্রা। দ্বিতীয়টি, শিব ও শক্তির বিবাহের অনুষ্ঠানের দৃশ্য। এই প্রথম শ্রেণির শিবের বিবাহের পটচিত্রে দেখা যায় বিভূতিভূষিত শিব বিবাহযাত্রা করেছেন। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, ইন্দ্র, চন্দ্র, সূর্য, কুবের, নারদ, ঋষি, মুনি, সাধু, কাপালিক, ভূত, প্রেত সবাই। এই বিচিত্র মহামিছিলে প্রত্যেক চরিত্রের পূর্ণ অবয়ব দেখা যায় না। শুধুমাত্র শিবকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে আঁকা হয় বলে শিবের পূর্ণাঙ্গ শরীর দেখা যায়। শিবের বিবাহযাত্রার পোশাক ও গহনায় ধ্রুপদী ওড়িয়া রীতির পোশাক ও গহনার বিপুল ছায়া রয়েছে। শিবের বিবাহের পটচিত্রে রঙের বৈচিত্র্য থাকে। এত চরিত্রের ঘনঘটা ও বিবাহের মতো আনন্দের অনুষ্ঠানকে আরও উজ্জ্বল করে তুলতে সূক্ষ্ম অলংকরণের বাহুল্য থাকে। প্রত্যেক চরিত্রের পোষাক ও গহনার বৈচিত্র্য থাকে। দেববর্গের পোশাকের শৈলীর সঙ্গে সহজেই ঋষিবর্গের পোশাকের বাহ্য পার্থক্য থাকে। বেশিরভাগ গহনায় ঐতিহ্যবাহী ওড়িশা শিল্পের ছাপ থাকে। বিশেষ করে কিছু গহনায় তা বিশেষভাবে মান্যতা পায়, যেমন তাবিজ, চন্দ্র-সূর্য, নাসা, কুণ্ডল, মকর ইত্যাদি। এই পটচিত্রে বিভিন্ন মার্গের ঋষিদের বোঝাতে তাঁদের বসনে সাদা, গৈরিক, হলুদ ও লাল রঙের ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও তাঁদের কপালের তিলকে বৈচিত্র্য থাকে। শিবের দ্বিতীয় শ্রেণির পটচিত্রের বিষয় যেহেতু শিবের বিবাহের অনুষ্ঠান, সেহেতু এখানেও অজস্র চরিত্রের আয়োজন থাকে। এই ধরনের পটচিত্রে মুখ্য চরিত্র শিব ও শক্তি। শক্তি হিসেবে সতী দেবী ও পার্বতী দেবী উভয়ের চিত্রই ভিন্ন ভিন্ন পটচিত্রে দেখা যায়। এই পট চেনার উপায় দেবী ভগবতীর পিতা হিসেবে অজমুখ দক্ষরাজ ও দেবমুখ হিমাদ্রীর মধ্যে পটচিত্রে কার উপস্থিতি রয়েছে তা নির্ণয় করা। শিব ও শক্তির বিবাহের দৃশ্যও শিবের বিবাহযাত্রার পটের মতো একই উপায়ে অপর দেবতা প্রভৃতি চরিত্র আঁকা হয়। শিবের বিবাহের পটচিত্রে দেবী শক্তির গাত্রবর্ণ সবসময় হলুদ রঙে আঁকা হয়। তবে এই শ্রেণির পটচিত্রে বহু চরিত্রের ঘনঘটা থাকায় এই ধরনের পটশিল্পের বাজারমূল্য অনেক বেশি। কিন্তু খুব বেশি দাম দিয়ে পটচিত্র সংগ্ৰহ করার লোকজনের সংখ্যা অনেকটাই কম। বহু চরিত্রের আয়োজন থাকায় এই ধরনের পটচিত্রে তৈরি করতে একজন শিল্পীর অনেক সময় ব্যয় হয়। সেই তুলনায় বিক্রি ও বাণিজ্যিক লাভ পাওয়া যায় না বলে এই ধরনের পটচিত্র আঁকার সংখ্যা একেবারে কমে এসেছে। বহু শিল্পীই এখন এই ধরনের পটচিত্রে আঁকেন না।

শিব পরিবার পট

শিবের সংসার স্ত্রী-পুত্রাদি নিয়ে বেশ বড় সংসার। এই সংসারে রয়েছেন শিব, পার্বতী, গণেশ, কার্তিক, গঙ্গা ও শিবগণ। আরও রয়েছেন শিবের বাহন নন্দী, পার্বতীর বাহন সিংহ, গণেশের মূষিক, কার্তিকের ময়ূর, শিবকণ্ঠে নাগরাজ। পটচিত্রে শিবগণ এক একজন এক একরকম। শিবের এমনই বিচিত্র আর বিরাট সংসার। ভিক্ষাজীবী শিবের এই বড় সংসার অন্ন-বস্ত্রে সামলে দেন দেবী অন্নপূর্ণা-পার্বতী‌। এত বৈচিত্র্য অথচ এরপরেও তাঁদের সংসারে আনন্দের পূর্ণঘট সবসময় ভরা থাকে। শিব পরিবার পটচিত্রের প্রেক্ষাপটে থাকে কৈলাস পর্বত। পার্বত্য ভূমির দৃশ্য বোঝাতে শিবের পশ্চাৎপটে পর্বতসদৃশ তুলির আঁচড় দেওয়া হয়। শিব ও পার্বতী বসেন তুষারময় সাদা রঙের একটি পার্বত্য বেদিকার ওপর। শিবের বামভাগে থাকেন দেবী পার্বতী। শিব ও শক্তির দুপাশে থাকেন গণেশ ও কার্তিক। কোনো কোনো পটচিত্রে বৈচিত্র্য আনার জন্য পার্বতীর কোলে গণেশ ও কার্তিক অথবা পার্বতীর কোলে গণেশ ও শিবের কোলে কার্তিককে দেখা যায়। আবার এমন পটচিত্রও রয়েছে যেখানে শিবের বাম কোলে পার্বতী বসেছেন ও পার্বতীর কোলে বসেছেন তাঁদের দুজন সন্তান। পটচিত্রের নিচের দিকে নন্দীরাজ ও পশুরাজ বসা অবস্থায় থাকেন। তাঁদের সকলকে ঘিরে থাকেন শিবগণ। শিবের মাথায় গঙ্গাদেবীকে দেখা যায়। এই পটচিত্রে শিবের গাত্রবর্ণ সাদা, দেবী শক্তি ও কার্তিকের হলুদ, গণেশের গোপালী আঁকা হয়। ওড়িশায় লোকমান্যতা রয়েছে শিবের পারিবারিক দৃশ্য সম্বলিত এই ধরনের পটচিত্র গৃহস্থ পূজা বা সংরক্ষণ করলে গৃহকোণে পারিবারিক ধর্ম নিত্য বজায় থাকে। এই ধরনের পটচিত্রের চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে।

বৃষবাহন নন্দীনাথ শিব

মহাদেবের কৃপাশীর্বাদে নন্দীর জন্ম হয়েছিল। নন্দী শিবের জন্য ছেলেবেলা থেকেই সমর্পিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে নন্দী মহাদেব শিবের প্রধান অনুচর ও বাহনের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন। আর একটি মত প্রচলিত রয়েছে, মহাদেব কৈলাস পর্বতে একদা একাকিত্ব অনুভব করলে তিনি নিজের শরীর থেকে নন্দীরাজের উৎপত্তি করেছিলেন। সারা ভারতে বিশ্বাস করা হয়, নন্দীর কানে কোনো প্রার্থনা করলে সেই প্রার্থনা অচিরেই শিব পূরণ করেন। এছাড়াও সমগ্র দেশেই প্রায় সমস্ত প্রাচীন শিব মন্দিরে শিবের সঙ্গে নন্দীকে দেখা যায়। শিবের দিকে মুখ করে নন্দী নিত্য শিবের প্রতি তাঁর ভক্তি উৎসর্গ করেন। নন্দী শিবভক্তির আদর্শ সংরূপ। শিব নন্দীর সূত্রেই বৃষবাহন ও নন্দীনাথ নামে পরিচিত হয়েছেন। ওড়িশায় শিবের এই ঐতিহ্যবাহী ও শাস্ত্রীয় স্বরূপটি পটচিত্রশিল্পে ধরা পড়ে। এই ধরনের পটচিত্রে দেখা যায় শিব ধ্যানমগ্ন ও নন্দী তাঁর সামনে শিবের ধ্যান লীন হয়ে রয়েছেন। আবার আর এক ধরনের নন্দীনাথ শিবের পটচিত্রে শিবকে নন্দীর ওপর বসে থাকতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে নন্দী সদা সতর্ক। এক্ষেত্রে শিব সাধারণত এক পা তুলে নন্দীর পিঠে বসে থাকেন। নন্দী এই ধরনের পটচিত্রে স্থির ও অচঞ্চল। আরও দুটি ভিন্ন রকমের নন্দীনাথ শিবের পট দেখা যায়। এই পটের বিষয়বস্তুতে থাকে, পটের ডান দিকে মুখ করে নন্দী চলেছেন তাঁর পিঠে বসেছেন শিব। শিবের মুখও সামনের দিকে ফেরানো। এছাড়া এই ধরনের কোনো কোনো পটচিত্রে শিবের কোলে দেবী ভগবতী পার্বতীকেও দেখা যায়। নন্দীনাথ শিবের পটচিত্রে শিবের হাতের সংখ্যা চার হলেও দেবী আদ্যাশক্তির হাতের সংখ্যা মাত্র দুই। নন্দীর গাত্রবর্ণ সাধারণত সাদা রঙে আঁকা হলেও কোনো কোনো পটচিত্রে নন্দীর গাত্রবর্ণ সাদা-মিশ্রিত কালো, মেটে হলুদ রঙের আঁকা হয়। নন্দীনাথ শিবের পটচিত্রে শিবের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নন্দীকে আঁকা হয়। যখন শিব ধ্যানমগ্ন, তখন নন্দী ধ্যানমগ্ন। যখন শিব বাহ্যভাব মণ্ডিত, তখন নন্দীও একই অবস্থায় থাকেন। আবার শিবের মুখ যখন ডানে ফেরানো তখন চলমান অবস্থায় নন্দীর মুখও ডানদিকে ফেরানো থাকে। বৃষবাহন নন্দীনাথ শিবের পট ওড়িশায় সুলভ ও এই ধরনের পটচিত্রের বাণিজ্যিক চাহিদা রয়েছে।

রত্নসিংহাসনা শিব

রত্নসিংহাসন ওড়িশার পটশিল্প-সংস্কৃতিতে একটি জনপ্রিয় কাল্ট (cult) বা রূপকল্প। প্রায় সমস্ত দেবদেবীর পটচিত্রে ও মূর্তিশিল্পেই কমবেশি রত্নসিংহাসনের ব্যবহার দেখা যায়। পুরীর শ্রীমন্দিরের মূল রত্নসিংহাসনে বিরাজিত চতুর্ধা বিগ্ৰহের ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। ওড়িশা প্রদেশে রত্নসিংহাসন সাধারণত ডমরু আকৃতির ও এতে প্রস্ফুটিত পদ্মের উন্মুক্ত দলের শিল্পকলা থাকে। বর্তমানে শ্রীমন্দিরের রত্নসিংহাসনের অনুসরণেই পটচিত্রে রত্নসিংহাসন আঁকা হয়। রত্নসিংহাসনের ওপরে শিব দাঁড়িয়ে বা বসে বা নৃত্যরত বা সঙ্গীতরত অবস্থায় থাকেন। রত্নসিংহাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পটের ভেতরের অংশে শ্রীজীউর মহলের মতো আকৃতি দেওয়া হয়। মেঝেতে সাদা-কালো বা হলুদ-কালো রঙে সাধারণত চকমেলানো শৈলী দেখা যায়। রত্নসিংহাসনা শিবের পটচিত্রে রত্নসিংহাসনের নীচে রত্নসিংহাসনের গায়ে খোদিত নন্দীমূর্তি বা রত্নসিংহাসনের সামনে নন্দীকে ষণ্ডরূপে বসে থাকতে দেখা যায়। কোনো কোনো পটচিত্রে রত্নসিংহাসনে বিরাজিত শিবের দু’পাশে দুজন পুরুষ বা দুজন নারীকে চামড় ব্যঞ্জনরত অবস্থায় দেখা যায়। কোনো পটচিত্রে রত্নসিংহাসনের দুপাশে গণেশ-কার্তিক বা ব্রহ্মা-নারায়ণ অথবা নারদ-নারায়ণকে দেখা যায়। আবার কোনো পটচিত্রে দেখা যায় রত্নসিংহাসনে দাঁড়িয়ে শিব নটরাজ স্বরূপে নৃত্যশিক্ষা দান করছেন এবং শিবের দুইদিকে দুজন কিন্নর-কিন্নরী বা গন্ধর্ব নৃত্যকলা শিখছেন। রত্নসিংহাসনে বিরাজিত শিবের রুদ্রবীণা বাজানোর রূপটিও এখন ধীরে ধীরে জনমানসে জনপ্রিয় বিষয় হয়ে উঠেছে। রত্নসিংহাসনা বিভিন্ন দেবদেবীর পটচিত্র সমগ্র ওড়িশায় প্রচলিত। তাছাড়া বিশেষ করে রত্নসিংহাসনের নিজস্ব শিল্পসুষমা ও সৌন্দর্যের জন্য ওড়িশার জনমানসে এর জনপ্রিয়তা যথেষ্ট তুঙ্গে থাকে।

নটরাজ শিব

ওড়িশী নৃত্যকলা জগন্নাথকে উৎসর্গীত। নৃত্যের মাধ্যমে জগন্নাথের প্রীতিলাভ ও নৃত্যের মাধ্যমে জগন্নাথকে আনন্দসেবার জন্য ওড়িশী শিল্পীরা নৃত্যের সাধনা করেন। নটরাজ শিব নৃত্যকলার আদিতম শিক্ষক। ওড়িশায় জনবিশ্বাস রয়েছে, জগন্নাথ, সরস্বতী ও শিবের কৃপা ভিন্ন নৃত্যে পারঙ্গম হওয়া যায় না। শিব সেই শিক্ষক যিনি জানেন ও যিনি শেখাতে পারেন কীভাবে নৃত্যেও জগন্নাথলাভ হয়। কমবেশি সারা ভারতেই শিবের নটরাজ রূপের সঙ্গে নৃত্যবিদ্যার সংযোগ রয়েছে। ওড়িশার পটচিত্রশিল্পে শিবের নৃত্যরত নটরাজ রূপের প্রসিদ্ধি প্রাচীন সময় থেকে খুব সম্ভবত এই একই উপায়ে বিস্তার লাভ করেছিল। শিবের নটরাজ রূপের ওড়িশী পটচিত্রে দেখা যায়, রত্নসিংহাসনের ওপর এক পায়ে দাঁড়িয়ে অন্য পা শূন্যে তুলে শিব মগ্ন হয়ে নৃত্য করছেন। শিবের এই নৃত্য যে ধ্বংসলীলা নয়, তা পটচিত্রে শিবের হাস্যময় শান্ত মুখশ্রী দেখেই বোঝা যায়। নটরাজ শিবের চার বা দশ হাতে বিভিন্ন নৃত্যমুদ্রা দেখা যায়। আবার কোনো কোনো পটচিত্রে দেখা যায় শিবের এক একটি হাতে এক একটি অস্ত্র রয়েছে এবং একেবারে সামনের দুই হাত অস্ত্রহীন ও নৃত্যমুদ্রায় ন্যস্ত। নটরাজ শিবের পটচিত্রে শিবের জটাজাল চারিদিকে উন্মুক্ত অবস্থায় থাকে। শিবের জটার একেবারে শিখরে গঙ্গা দেবীর মুখ দেখা যায়। ওড়িশার পটচিত্রশিল্পে নটরাজ শিবের আরেক ধরনের পট দেখা যায় যেখানে শিবের সঙ্গে তাঁর শিক্ষার্থীরা সমবেত নৃত্য করেন। কোনো কোনো পটচিত্রে নৃত্যরত শিবকে রুদ্রবীণা বাজাতেও দেখা যায়। নটরাজ শিবের উগ্ৰরূপও কিছু দেখা যায়। এক্ষেত্রে নটরাজ শিবের পিছন দিকের আবহে আগুনের রেখা দেখা যায়। নটরাজ শিবের পটচিত্রে শিবের রুদ্র ও শান্তমূর্তি উভয় দেখা গেলেও শিবের সৌম্যশান্ত নটরাজ রূপই জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

হরিহর শিবের পট

হরি ও হর একই সত্তার দুটি প্রকাশ। যিনি হরি তিনিই হর। হরির হৃদয়ে হরের বাস, হরের হৃদয়ে হরির বাস। হরি ও হর একে অপরের গুরু, একে অপরের শিষ্য। একজন অন্যজনের সাধ্য ও সাধক। ওড়িশায় হরিহর রূপের চিন্তাটি জগন্নাথ ও বলভদ্র উভয়ের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে। এমনকি জগন্নাথের রথযাত্রায় রথের তিনদিকে যে নয়জন দেবমূর্তি থাকেন তাঁদের মধ্যেও হরিহর একজন। হরিহর রূপটি বিষ্ণু ও শিবের মিলিত রূপ। একই সত্তার অর্ধেক অংশ শিবের ও অর্ধেক অংশ বিষ্ণুর। হরিহর বিগ্ৰহে শিবের অর্ধাঙ্গ বিষ্ণুর, বিষ্ণুর অর্ধাঙ্গ শিবের। হরিহর পটচিত্রে হরিহর দেবের ডান দিকের অংশ বিষ্ণুস্বরূপ ও বাঁদিকের অংশ শিবস্বরূপ। হরিহর বিগ্রহ মূলত চতুর্ভুজ মূর্তি। হরিহরের ডানদিকের ওপরের হাতে সুদর্শন ও নিচের হাতে শঙ্খ থাকে এবং বাঁদিকে ওপরের হাতে ডমরু ও নিচের হাতে ত্রিশূল দেখা যায়। হরিহরের বিষ্ণুরূপ ডানদিকের অংশের রঙ আকাশবর্ণ নীল ও শিবরূপ বাঁদিকের অংশ সাদা রঙে আঁকা হয়। হরিহরের অর্ধাঙ্গে রত্নমুকুট, অর্ধাঙ্গে জটাজুট, অর্ধাঙ্গে প্রস্ফুটিত বনমালা, অর্ধাঙ্গে রুদ্রাক্ষ ও নাগহার, অর্ধাঙ্গে পীতবাস, অর্ধাঙ্গে ব্যাঘ্রাম্বর। হরিহর বিগ্রহ সাধারণত রত্নসিংহাসনের বিরাজমান অবস্থায় দেখা যায়। হরিহরের দুদিকে গরুড়রাজ ও নন্দীরাজকে দেখা যায়। এছাড়াও হরিহর রূপের দুই দিকে হাতে পদ্ম ধরে থাকা অবস্থায় লক্ষ্মী ও পার্বতী দেবীকে দেখা যায়। হরিহর পটচিত্রে সাধারণত দেবতার সৌম্যরূপ দেখা যায়। হরিহর পটচিত্রে মৈত্রী, সৌভ্রাতৃত্ব, সমন্বয়চেতনার প্রতীক। হরিহর পটচিত্র অনেকে পূজা করেন। একই সঙ্গে তুলসী ও বিল্বপত্র হরিহরে অর্পণের রীতি রয়েছে। ওড়িশার লিঙ্গরাজ শিব ও যমেশ্বর মহাদেবের সঙ্গেও হরিহর বিগ্ৰহের সাদৃশ্য রয়েছে। কোনো কোনো হরিহর পটচিত্রে জগন্নাথের অনবসর পটচিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি করতে হরিহরের হরির অংশটুকু কৃষ্ণবর্ণে রঞ্জিত করা হয়। এছাড়া অন্যান্য বৈশিষ্ট্য একই থাকে।

অর্ধনারীশ্বর শিবের পট

পৌরাণিক তত্ত্বদৃষ্টিতে শিব ও শক্তি অভেদ। একই চিন্ময় বা চৈতন্য সত্তার অর্ধেক পুরুষ, অর্ধেক প্রকৃতি। সাধারণভাবে বলা যায়, শিবের অর্ধাঙ্গ যেমন শক্তির, শক্তির অর্ধাঙ্গও শিবের। অর্ধনারীশ্বর পটে সাধারণত শিবের পট হিসেবে গণ্য করা হয়। তবে এই পটে শিবের যতখানি গুরুত্ব ততখানি গুরুত্ব শক্তিরও। এক্ষেত্রে আমরা অর্ধনারীশ্বর পটকে একই সঙ্গে শিবের পট ও দুর্গার পট হিসেবে দেখতে পারি। অর্ধনারীশ্বর পটে চৈতন্যরূপ একই দেহের অর্ধেকটা শিব, অর্ধেকটা শক্তি। সাধারণত অর্ধনারীশ্বরের দেহের ডান দিকে শিব ও বাঁদিকে দুর্গার অবস্থান আঁকা হয়। এই সাধারণ বিগ্ৰহ চতুর্ভুজ। তবে দশভুজ বিগ্ৰহও কিছু কিছু পটচিত্রে দেখা যায়। অর্ধনারীশ্বর রূপের শিবের অংশে তাঁকে নাগহার, রুদ্রাক্ষ, ব্যাঘ্রাম্বর, শ্বেতাম্বরে দেখা যায়। শিবের মাথায় জটা থাকে। শিবের দুই হাতে মূলত ত্রিশূল ও ডমরু থাকে। শিব মাথায় চন্দ্রকে ধারণ করেন। আবার কয়েকটি পটে শিব-বিষ্ণুর একাত্ম তৈরির জন্য ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে শিবের নিচের হাতে ত্রিশূল ও ওপরের হাতে সুদর্শন দেখা যায়। কোনো কোনো পটে শিবের ওপরের হাতে মৃগ-অস্ত্র ধরা থাকে। এখানেও শিবের গাত্রবর্ণ সাদা। অন্যদিকে দুর্গা দেবীর অংশে তাঁকে বনমালা, পুষ্পলতা, স্বর্ণগহনা, রক্তাম্বরে শোভিত দেখা যায়। তাঁর মাথায় থাকে সোনার মুকুট। দেবীর গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের মতো উজ্জ্বল হলুদ। দেবীর দুই হাতে থাকে পদ্ম ও অসি। দশভুজ অর্ধনারীশ্বরের পটে তাঁর দশভুজে শিবের পঞ্চানন রূপের অস্ত্রগুলিই শোভা পায়। অর্ধনারীশ্বরের দুই দিকে নন্দী ও সিংহকে দেখা যায়। সাধারণত অর্ধনারীশ্বর পদ্মে বা রত্নসিংহাসনে দাঁড়িয়ে অথবা বসে থাকেন। ওড়িশায় শিবের অর্ধনারীশ্বর পটকে দাম্পত্যধর্মের প্রতীক ধরা হয়। এছাড়াও সাধকেরা অর্ধনারীশ্বর পটকে সৃষ্টিতত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে অনুধ্যান করেন। ওড়িশায় অর্ধনারীশ্বর পট হরিহর পটচিত্রের মতোই সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

পঞ্চানন শিব

মহাদেবের পঞ্চানন রূপটি পৌরাণিক যুগ থেকে সর্বভারতে প্রসিদ্ধ হয়েছে। শিবের পঞ্চানন রূপটি তাঁর পাঁচটি প্রধান রূপের সমাহার। শিবের পঞ্চানন মূর্তির প্রতিটি রূপের পৃথক পৃথক নাম রয়েছে, যথা— সদ্যোজাত শিব, তৎপুরুষ শিব, বামদেব শিব, অঘোর শিব ও ঈশান শিব। পঞ্চামৃত দ্বারা মহাদেবের অভিষেকের সময় তাঁকে এই পাঁচটি নামে পূজা করা হয়। শিবের পঞ্চানন রূপটি পাঁচ মহাভূতের প্রতীক। এছাড়াও এই রূপটি পঞ্চ জ্ঞান ইন্দ্রিয় ও পঞ্চ কর্ম ইন্দ্রিয়ের ভাব বহন করে। ওড়িশার পটশিল্পে শিবের পঞ্চানন রূপের জনপ্রিয়তা রয়েছে। পঞ্চানন শিবের পটচিত্রে শিবের একই শরীর পাঁচটি মুখ থাকে। শিবের মূল শরীরে সাদা রঙের ব্যবহার করা হলেও তাঁর পাঁচটি মুখে সাদা, সবুজ, হলুদ, লাল ও খুব হালকা আকাশবর্ণ রঙের ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও কোনো কোনো পটচিত্রে শিবের পাঁচটি মুখেও সাদা রঙের ব্যবহার করা হয়। পঞ্চানন শিবের পটচিত্রে শিবের পাঁচটি মুখের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে অনেক সময় শিবকে দশভুজে দশ রকমের অস্ত্রে সাজানো হলেও বেশিরভাগ পঞ্চানন পটচিত্রে শিবের চতুর্ভুজ মূর্তিই দেখা যায়। সাধারণত শিবের পঞ্চানন রূপটি রত্নসিংহাসনে বিরাজিত অবস্থায় চিত্রিত হয়। পঞ্চানন শিবের সঙ্গেও নন্দীকে দেখা যায়। পঞ্চানন শিবের দশ হাতে ত্রিশূল, জপমালা, ধনুর্বান, ডমরু, কমণ্ডলু, কপাল, শঙ্খ, চক্র, গদা, হল, বজ্র, পাশ, বীণা ইত্যাদি দেখা যায়। পটচিত্র ভেদে ও শিল্পীর পছন্দ অনুযায়ী শিবের দশবাহুতে উপকরণ ও অস্ত্রের পার্থক্য দেখা যায়।

সর্বদেবপূজ্য শিব

মহাদেব শিব দেবাদিদেব। তিনি দেবতা-দানব-মানব সকলের আরাধ্য দেবতা। বেদ-পুরাণ-তন্ত্রশাস্ত্র সর্বত্র রুদ্র তথা শিবকে পরমপূজ্য দেবতা বলা হয়েছে। আশুতোষ শিবের নিরন্তর কৃপাদৃষ্টির আকাঙ্ক্ষায় দেবতা-দানব-মানব সকলেই তাঁর সাধন-ভজন-গুণকীর্তন করেন। ওড়িশায় সর্বজনপূজ্য শিবের পট খুব বেশি আঁকা হয় না। অল্প সংখ্যক আঁকা হলেও অন্য শিবপটের চেয়ে এই পটের আঙ্গিকে অনেকগুলি দিকেই বিশেষত্ব দেখা যায়। এই ধরনের শিবের পটের ঠিক মধ্যভাগে কৈলাস পর্বতে তপস্যারত মহাদেবকে দেখা যায়। চতুর্ভুজ শঙ্করকে ঘিরে চারিদিকে বিভিন্ন দেবদেবী থাকেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ব্রহ্মা, বিষ্ণু, সুরেশ, গণেশ, কার্তিক, চন্দ্র, সূর্য, যম, অগ্নি, পবন, কুবের, লক্ষ্মী, পার্বতী, সরস্বতী, হনুমান, নন্দী, ভৃঙ্গী, গরুড়, যক্ষ, দক্ষ, নারদ, দধীচি, রাবণ, গন্ধর্ব, অপ্সরা ও শিবগণ। এই শ্রেণির পটচিত্রেও মহাদেব পরিপূর্ণ শুভ্র ও শান্তশ্রী মণ্ডিত অবস্থায় থাকেন। অনেক পৌরাণিক চরিত্রের ঘনঘটা থাকায় এই ধরনের পটচিত্রে শিল্পীর অনেক সময় ব্যয় হয়। কিন্তু শ্রমের অনুপাতে অর্থলাভ না হওয়ায় এই ধরনের পটচিত্র আঁকার ক্ষেত্রে ধীরে ধীরে শিল্পীদের আগ্রহ কমেছে। ফলে ধীরে ধীরে এই ধরনের পটচিত্রটি অবলুপ্ত হতে চলেছে। এখন এই ধরনের পটচিত্রটি প্রায় দেখা যায় না বললেও চলে।

শ্রীক্ষেত্রের পঞ্চমহাদেব পট

ওড়িশায় শিব জগন্নাথের উপাসক এবং জগন্নাথই সাক্ষাৎ শিব। ওড়িশার লোকবিশ্বাস অনুযায়ী দ্বাপর যুগে যখন ভগবান বিষ্ণু কৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন শিবের প্রতিনিধি হিসেবে পঞ্চপাণ্ডব কৃষ্ণের লীলাবর্ধন ও গুণকীর্তনের জন্য এসেছিলেন। এই পঞ্চপাণ্ডবের প্রতিনিধি হিসেবেই যেন শ্রীমন্দিরে পঞ্চমহাদেব রয়েছেন। এঁরা হলেন— লোকনাথ শিব, মার্কণ্ডেশ্বর শিব, কপালমোচন শিব, যমেশ্বর শিব ও নীলকণ্ঠেশ্বর শিব। শ্রীমন্দিরের এই পাঁচজন মহাদেবকে এক সঙ্গে পঞ্চমহাদেব বলা হয়। এঁদের প্রত্যেকের শারীরিক গড়ন ও বসার ভঙ্গিতে একটু করে পার্থক্য রয়েছে। সমগ্র ওড়িশা প্রদেশে এই পাঁচ মহাদেবের বিপুল জনপ্রিয়তা থেকেই পঞ্চ মহাদেবের পটচিত্র আঁকার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। একই পটচিত্রের পাশাপাশি পাঁচটি ব্লগে একজন করে মোট পাঁচজন মহাদেবের ছবি আঁকা হয়। পাঁচজন শিবই রত্নসিংহাসনে বিরাজিত থাকেন।

বলভদ্র-শিব পট

ওড়িশার জগন্নাথ-সংস্কৃতিতে জগন্নাথের বড় ভাই বলভদ্রদেব। কানাই-বলাইয়ের বৃন্দাবনলীলার অনুসঙ্গে শ্রীমন্দিরে বলভদ্রের এই পরিচয় গড়ে উঠেছে। বলভদ্র অনন্তনাগের অবতার। এর পাশাপাশি আরও একটি মত রয়েছে যে, শ্বেতবর্ণ বলভদ্র সাক্ষাৎ শিব, পীতবর্ণা সুভদ্রা সাক্ষাৎ শক্তি ও কৃষ্ণবর্ণ জগন্নাথ সাক্ষাৎ বিষ্ণু। শ্রীমন্দিরে বলভদ্রের আনন্দের জন্য রুদ্রাষ্টকম্ পঠিত হয়। বলভদ্রের কাছে রুদ্রাষ্টকম্ পাঠ করলে বলভদ্ররূপ শিবের প্রত্যক্ষ আশীর্বাদ পাওয়া যায়। এছাড়াও শ্রীমন্দিরে বলভদ্রকে হরি ও হরের মিলিত বিগ্ৰহ রূপে পূজা করা হয়। জগন্নাথ ও বলভদ্রের একটি প্রসিদ্ধ বেশের নাম ‘হরিহর বেশ’। হরিহর বেশের সময় শুধুমাত্র বলভদ্রকেই অর্ধাঙ্গে হরি, অর্ধাঙ্গে হর স্বরূপে সাজানো হয়। মূলত বলভদ্রের হরিহর বেশই ওড়িশা পটশিল্পে বলভদ্র-শিবের পট তৈরিতে সহায়তা করেছে। এই ধরনের পটচিত্রে দেখা যায় এককভাবে বলভদ্র অথবা জগন্নাথ-বলভদ্র-সুভদ্রা রত্নসিংহাসনে বিরাজিত। বলভদ্রের পোশাকের অর্ধেক অংশের রঙ সাদা ও অর্ধেক অংশের রঙ কালো। এই দুটি রঙ যথাক্রমে শিব ও নারায়ণের গাত্রবর্ণের অনুসঙ্গ বহন করে। বলভদ্র-শিব পটে বৈচিত্র্য তৈরির জন্য অনেক সময় বলভদ্রের চার হাত আঁকা হয় এবং তাঁর চার হাতে হল, মুষল, ডমরু, ত্রিশূল দেখা যায়। বলভদ্র-শিব পটকেও এক রকম ভাবে হরিহরের পট বলা যেতে পারে।

জগন্নাথ শিব

ওড়িশার জগন্নাথ-সংস্কৃতিতে জগন্নাথ সাক্ষাৎ সর্বদেবদেবীর পূর্ণ বিগ্রহ। তিনিই বৃহত্তর জগৎ চরাচরের সবকিছু হয়েছেন। ওড়িশার তন্ত্রে জগন্নাথই বিমলার ভৈরব। বিমলা এই ক্ষেত্রপীঠের পীঠাধিশ্বরী মহাদেবী। তাঁকে নিত্য সান্নিধ্য দেন জগন্নাথ। শ্রীক্ষেত্রে জগন্নাথই শিব। এমনকি দুর্গামাধব পূজায় তিনি শক্তিদেবীর শিবরূপেই প্রকাশিত হন। শ্রীমন্দিরে বলভদ্রকে যেমন শিবস্বরূপে প্রত্যক্ষভাবে স্তুতি করা হয় তেমনই জগন্নাথকেও শিবরূপ চিন্তা করা হয়। তন্ত্রচিন্তায় বিরাট চরাচরের সমস্ত পুরুষই শিব, সমস্ত নারীই শক্তি। আবার জগন্নাথই পুরুষ, জগন্নাথই প্রকৃতি। ওড়িশা পটশিল্পে জগন্নাথকে শিবরূপে চিন্তার আয়োজন রয়েছে। এই ধরনের পটচিত্রে দেখা যায় জগন্নাথ ও বিমলা দেবী পাশাপাশি রত্নসিংহাসনে বসে রয়েছেন। জগন্নাথকে শিবরূপে চিহ্নিত করতে পটচিত্রের বিভিন্ন অংশের অলংকরণে ত্রিশূলের চিহ্ন আঁকা হয়।

অন্যান্য পটে শিব

ওড়িশা পটশিল্পে জগন্নাথের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি। জগন্নাথের কিছু পটে শিবকে জগন্নাথের বন্দনারত অবস্থায় দেখা যায়। এক্ষেত্রে সাধারণত জগন্নাথের ডানে ব্রহ্মা ও বাঁয়ে শিব জগন্নাথের দিকে তাকিয়ে তাঁর বন্দনা করেন। দশমহাবিদ্যা পটে শিবের প্রাধান্য রয়েছে। বিশেষত কালী, তারা, ষোড়শী দেবীর পটে শিবকে দেখা যায়। এছাড়াও শিবসংযুক্ত কয়েকটি পৌরাণিক ঘটনা কিছু কিছু পটচিত্রে চিত্রিত হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য — সতীর তনুত্যাগের পর শিবের তাণ্ডবলীলা ও একান্নটি শাক্ত মহাতীর্থের আবির্ভাবের প্রাক্ ঘটনা, মহাভারতের কিরাতার্জুনীয়র ঘটনা, যমরাজের হাত থেকে মার্কণ্ডেয় মুনিকে রক্ষার ঘটনা, সমুদ্র মন্থনের, ভগবতীর দুর্গা ও জগদ্ধাত্রী রূপে প্রকাশের ঘটনা, শিবের বিশ্বরূপের ঘটনা, পার্বতীর শিবলিঙ্গের পূজার্চনা এবং দত্তাত্রেয় মুনির পূর্ণাবয়ব পটচিত্র। এছাড়াও পূর্ণাবয়ব শিবকে কেন্দ্রে রেখে দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অনুসরণে পটচিত্র আঁকার প্রথাও রয়েছে। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের পটচিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্য রয়েছে।

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

Buddhist philosophy and Sudhindranath’s poetic thought | 2023

Role of parents in raising children | Bengali Article 2023

Political Consciousness of Marquez | মার্কেসের রাজনৈতিক চেতনা | Article 2023

Lost music and culture in Bengali wedding ceremonies | Bengali Article

Shiva in Orissa Patashilpa | Shiva in Orissa Patashilpa | Online Shiva in Orissa Patashilpa | Best Articles | Read Shiva in Orissa Patashilpa Online | Shiva in Orissa Patashilpa Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Read Shiva in Orissa Patashilpa in pdf | Bengali Literature | Shiva in Orissa Patashilpa – viral | Shabdodweep Web Magazine | Live Bangla Golpo Read Online | Shabdodweep Writer | Shiva in Orissa Patashilpa 2023 pdf | Bengali Article | Shabdodweep Article | Best Articles Forever | Shiva in Orissa Patashilpa in pdf online | Trending topic – Shiva in Orissa Patashilpa | New Articles in pdf | Shabdodweep Article | All Articles collection | Library of Literature | International Article | Long Article | Viral topic – Shiva in Orissa Patashilpa | Short Article | Trending Articles – Shiva in Orissa Patashilpa | All best articles in Bengali | Article Factory | New Article Generation | Historical Articles | Shiva in Orissa Patashilpa mp4 | Shiva in Orissa Patashilpa in pdf | Shabdodweep Article in English | All Bengali Articles in pdf | Patriotism of Rabindranath Tagore Images | Article – Shiva in Orissa Patashilpa | Online Read Shiva in Orissa Patashilpa | Article Submission | Shiva in Orissa Patashilpa – Articles | Best Article – Shiva in Orissa Patashilpa | Full pdf – Shiva in Orissa Patashilpa | Read Online Article – Shiva in Orissa Patashilpa | New Article – Shiva in Orissa Patashilpa | Great Article – Shiva in Orissa Patashilpa | Shiva in Orissa Patashilpa – Avijit Pal | Article Collection – Shiva in Orissa Patashilpa | Shiva in Orissa Patashilpa – Online Article

Leave a Comment