Lost music and culture in Bengali wedding ceremonies | Bengali Article

Sharing Is Caring:
Lost music and culture in Bengali wedding

বাংলার বিয়ের আসরে হারিয়ে যাওয়া গান ও সংস্কৃতি – রণবীর চন্দ [Lost music and culture in Bengali wedding ceremonies]

এককালে বাংলার সমাজজীবনে তা সে বাঙালি, আদিবাসী, হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টান যে জাতি বা ধর্মের লোকই হোক না কেন বিয়ের আসরে ছড়া ও গানের বহুল প্রচলন ছিল। বিয়ের আগের দিন গঙ্গাকে নিমন্ত্রণ করতে যাওয়া বা বাসর রাত জাগার সময়েই হোক না কেন বিয়েতে ছড়া ও গান থাকতই। বিয়ের গানের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয় মঙ্গলকামনার সঙ্গে সাধারণ মানুষের আশা আকঙ্খা ভালোবাসা। একসময় বিয়ের গানের উৎপত্তি হয়েছিল বাঙালী বৌদ্ধ এবং আদিবাসী সমাজে পরে তা ছড়িয়ে পরে মঙ্গলকাব্যে, প্রধানত হিন্দুসমাজে। আরও পরে মুসলমান সমাজেও বিয়ের গানের অনুষ্ঠান গৃহীত হয়।

একসময় বাংলার বিশেষ করে বাঙালী বৌদ্ধ ও হিন্দু সমাজে নানা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে মঙ্গল গানের প্রচলন ছিল। আর বিয়ে বা বিবাহ ছিল হিন্দু বাঙালী সমাজে খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশ্বাস করা হতো যে বিয়ের মাধ্যমে মানুষ এক জীবন থেকে আরেক জীবনে প্রবেশ করে। এই নতুন জীবনের মঙ্গল কামনার উদ্দেশে হিন্দু বিয়েতে একটা প্রধান অঙ্গ হিসেবে মঙ্গল গানের প্রচলন হয়েছিল যার ধারা পরবর্তীতে মুসলমান বিয়েতেও যুক্ত হয়। আগেকারদিনে বিবাহকে ঘিরে পালনীয় নানা আচারের মধ্যে বিয়ের এ মঙ্গলগীত ছিল হৃদয়স্পর্শী একটি পরিবেশনা।

আস্তে আস্তে এই বিয়ের গান নানারকম ঠাট্টা ও রসাত্মকবোধক রচনাতে অত্যন্ত জনপ্রিয়তা হয়ে ওঠে। এই গানগুলি অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় গাওয়া হতো। ফলে এতে আঞ্চলিক ভাষার মাধুর্য মিশে থাকত । গানের গঠনও হতো ভিন্ন ভিন্ন ভাবে। কোথাও গানে তিন অন্তরা, আবার কোথাও এর বেশী লক্ষ্য করা যায়। আবার এটা নির্ভর করে কতটুকু সময় পাওয়া যাবে গানটি গাইতে, তার ওপর। কিন্তু বর্তমানে সময়ের আধুনিকতা ও নগরায়নের ফলে বাঙালীর বিয়ের আসরের এই গানগুলো এসে দাঁড়িয়েছে বিলুপ্তির দ্বারে। আমাদের একটাই আক্ষেপ যে বাংলার সমাজজীবনে একদা প্রবল প্রচলিত এই ছড়া বা গানগুলি ঠিকমতো সঙ্কলিত হয়নি। এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্মে মূলত শ্রুতিধরের মৌখিক ব্যবহারেই থেকে গিয়েছে। একসময় আমিও অনেক বিয়েবাড়ীতে দেখেছি যে বিয়ের আসরে কেউ একজন তিনি সাধারণত কনের জামাইবাবু বা ওরকম কেউ হতেন এসে সবার হাতে হাতে একটা ছাপানো কাগজ ধরিয়ে দিতেন, তাতে বর ও কনেকে নিয়ে নানারকম মজার মজার ছড়া থাকত। একসময় রাজশাহী জেলায় প্রচলিত ছিল হলুদ কোটার ছড়া: ‘শোনে হরিণের ডাক/ ওই না হলদি কুটতে ক’নার মা।/ শোনে বাঘের ডাক/ দৌড় দিয়ে যায় ক’নার মা।’ এখনও এরকম দুই একটা ছড়া গানের প্রচলন আছে, যেমন- ‘এলাম সই তোদের বাড়ি মালা দিতে/ মালা দিতে লো সজনী বর দেখিতে/ আমি রসেরও মালিনী/ রসের খেলা কতই জানি।’

সব বিয়েতেই মোটামুটি তিনটি মূল অংশ থাকে – যেমন, গায়ে হলুদ, বিয়ে এবং বৌভাত বা ওয়ালিমা। বিয়ের একেক আয়োজনে একেক ধরনের গান গাওয়া হতো। যেমন বরকে বরণ করার সময় যে গান গাওয়া হতো তাতে আনন্দের সুর ভরে উঠত আবার তেমনি কনের বিদায়ের সময় যে গান গাওয়া হতো তাতে দুঃখ বেদনা ফুটে উঠত। বাঙালীর আদি সমাজ ব্যবস্থা থেকেই অন্তপুরের মহিলাদের অলংকার হিসাবে বিয়েতে নাচ-গানের প্রচলন ছিল। তারা নিজেরা বংশ পরস্পরায় অনেক যত্নে লালন ও পরিবেশনা করতো এইসব গান। আজ থেকে ষাট – সত্তর বছর আগেও দেখা গেছে পূর্ব বাংলা থেকে আগত গ্রামীণ বাঙালি সমাজের বিয়েতে বিশেষ করে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য ‘গীত গাওনি’ মহিলাদের ডাক পড়ত। তাদের অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর। এসব গান আঞ্চলিক ভাষায় ও স্বতঃস্ফূর্ততায় গীত গাওনি মহিলাদের নিজস্ব ছন্দে রচিত হতো। সাধারনত বয়স্করা যখন বিয়ের অনুষ্ঠানে গান করেন তখন তাদের ঘিরে শিশুরা এসব গান শুনে বেড়ে ওঠে। এরপর যখন তারা গান পরিবেশনার উপযুক্ত হতো, তখন মূল গানের সঙ্গে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করলেও মূল গানের সুর ও রস থাকত অপরিবর্তিত। এই ধরণের গানে মেয়েদের মনের আনন্দ-বেদনা, আবেগ-উৎকণ্ঠার যেমন প্রকাশ ঘটে তেমনি আবার নতুন দাম্পত্য জীবনের হাসি-ঠাট্টা, পরস্পরকে চেনার আনন্দ মিশে থাকে গানের কথার প্রচলিত সুরে।

পূর্ব বাংলার বাঙালী সমাজের বিয়েতে বিয়ের আগের রাতে ধান ভানার সাথে সাথে গান গাওয়া হতো। নতুন ঢেঁকি ছাঁটা চাল দিয়ে বর বা কনের জন্য তৈরী করা হতো ঐতিহ্যবাহী খাবার। যার আঞ্চলিক ‘থুবড়া’ – এর সাথে থাকতো রসগোল্লা, ক্ষীর এবং ভাপা পিঠা। আবার মুসলমান সমাজের বিয়েতে এর সাথে যুক্ত হতো ফিরনি। এইসব খাবার পরিবেশনের সময় কনে এবং বরের সামনে গোল হয়ে গাওয়া হতো নানা ধরণের গান – “আলুয়ার চালে কাঞ্চন দুধে ক্ষীরোয়া পাকালাম, সেই না ক্ষীরোয়া খেতে গরমি লেগেছে।কোথায় আছ বড়ভাবি পাক্কা হিলোয়রে”। তারপর কনেকে স্নান করানো, ও কনে বিদায় লগ্নে যেসব গান গাওয়া হতো তা ছিল অত্যন্ত করুন ও আবেকস্পর্শী।

গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে আবার শোনা যেত, “কন্যা ডাক দেও তোর জননী না মাইরে, মাও দিয়া যাওক সোনা মুখে হলদিরে হলুদা, ডাক দেও তোর জনমদাতা বাপেরে, বাপ দিয়ে যাউক তোর সোনা মুখে হলদিরে”। বোনেরা গাইত : “হামার ভাইয়ের হলদি মাখিবার, মনে নাহি ছিলরে জোর। বেজোর হলদি মাখলে, জোনাকু শালার বহিনরে।’ আবার কনের বাড়িতে এসে বরযাত্রীটা ঠাট্টার সুরে গেয়ে উঠতো-“বসবোনা, বসবোনা, ছিঁড়া ছোপে আমরা বসবো নারে, আরশের বাবা কি জানে নারে”। শালিকারা গাইতো, “শ্যালক গিয়েছে শহরে, আনবে নাকের নথরে, সেই নথ নাকে দিয়ে নাক ঘুরিয়ে নাচবো রে”। বউকে সাঁজাতে সাঁজাতে পড়শিরা কনেকে ঘিরে দল বেধে ঠাট্টার সুরে গেয়ে উঠত-

“আইছে বর সাহেব হইয়া,
বইছে মুখে রুমাল দিয়া।
পুলা তোমায় আগে করি গো সাবধান,
চান্দের আলো দেইখা তুমি হইয়ো না অজ্ঞান।
আলতার মধ্যে গঙ্গাজল গায়ে লাগেনা,
এতো সস্তায় আকাশ পাওয়া যাবেনা”।

এককালের বাঙালীর বিবাহের আসরে নাপিত বা নরসুন্দরদের ভূমিকা ছিল গৌরবের। শাস্ত্র-নির্দেশিত ক্ষৌরকর্ম পালনের পরে তাকে সেই আসরে বিবাহের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে হত পয়ার ছন্দের পাঁচালি গেয়ে— ‘শুনুন শুনুন মহাশয় করি নিবেদন/ রামসীতার বিবাহ কথা করুন শ্রবণ/ প্রজাপতি নির্বন্ধ কহেন সর্বলোকে/ কন্যাদান মহাফল সর্বশাস্ত্রে লেখে।’ এ ছাড়া বাসি বিয়ের আসরে কন্যার সখিদলের গানেও থাকত শ্রীরামের মহিমা, ‘শ্রীরামচন্দ্রের বাসি বিয়া মিথিলায়/ দেখিতে রামের বিয়া/ স্বর্গপুরের বাসী যারা/ গোপনে থেইকে চায়।’

বাবার বাড়ি থেকে শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার সময় কনেকে বাবার বাড়ির হাজার স্মৃতি ভুলে অত্যন্ত কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হয় শ্বশুরবাড়ি।তার সামনে থাকে অনেক অজানা শঙ্কা। কনে বিদায়ের তেমন লগ্নে আত্মীয় স্বজন গাইত, “মন বিন্দাইলাম বনে বনে, আরো কান্দন কান্দে গো মায়ারও মনে মনে”। এ ধরনের অসংখ্য বিয়ের গান বাড়ির মেয়েরা মুখস্থ করে রাখত। সাথে মিশে থাকতো অসাধারণ সব নাচ। সাধারণত, বিয়ের কনের বিদায় লগ্নে যে সব গান গাওয়া হতো তার সুর ভীষণ করুণ ও আবেগ স্পর্শী হতো। যে কেউ শুনলেই সেই সব গানের সুর সহজে ভূলতে পারে না। যেমন, বিয়েতে বরও বধুর উদ্দেশ্যে বিশেষ গীতি কবিতা লেখা হতো আর তা লিখতেন সাধারণত শ্যালক , ভায়রাভাই বা পাড়ার বৌদিরা। সেগুলো বিয়ের দিন আসর বসিয়ে সুর করে পাঠ করা হতো। এগুলি সাধারণত ছাপিয়ে সবার হাতে হাতে দেওয়া হতো ও তারপর আবৃতি করা বা গান গেয়ে শুনানো হতো। এগুলি বেশ কৌতুকপূর্ণ হতো।

“হাত ছাড়ো,হাত ছাড়ো গো বন্ধু
হাতে পাইব ব্যথা
ভিন্ন নারীর হাত ধরেছ,
বলছ রসের কথা”

বাঙালি বৌদ্ধ সমাজে এক কালে প্রচুর বিয়ের ছড়া ও গান প্রচলিত ছিল। আজ অব্যবহারে হারিয়ে গেছে অধিকাংশ রচনা, কোনও সঙ্কলনগ্রন্থ নেই, গবেষণায় আগ্রহীর সংখ্যাও নগণ্য। বাপের বাড়ি থেকে বিদায়লগ্নে বৌদ্ধ কন্যা মনের দুঃখে চোখের জল মুছতে মুছতে বলছে: ‘ঢোল বাজে আর মাইক বাজে/ আঁর পরাণে ক্যান গররের/ ক্যান গরি আঁই যাইয়ম পরের ঘর।’ এই গানটিতে ‘মাইক বাজে’ বলে বোঝা যাচ্ছে যে গানটি খুব বেশী দিনের পুরানো নয়। আবার এমনও হতে পারে মূল গানটি হয়ত অনেক প্রাচীন পরে মাইক বাজানো কথাটি প্রক্ষিপ্ত হয়েছে।

বিবাহ ইসলাম ধর্মে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও পুণ্যকর্ম। হাদিসে বলা হয়েছে: ‘যখন কোনও বান্দা বিবাহ করে, সে তার ধর্মের অর্ধেক ইমান পূর্ণ করে।’ তাঁদের বিশ্বাস— বিয়ের কাপড় মুসলমানের সঙ্গে বেহেশ্ত পর্যন্ত যায়। বাঙালি মুসলিম সমাজে প্রচলিত আছে সহস্রাধিক বিয়ের গান। এই গীতি শুরু হয় আল্লাহর বন্দনা দিয়ে: ‘পাঁচোপির পাঞ্জাতন/ সালাম বাজাই জনার জন/ সেই সালামটি বাজাই আমার আল্লার রসুলকে।’ এখানে ‘পাঞ্জাতন’ হলেন হজরত মহম্মদ, হজরত আলি, হজরত ফাতেমা, হজরত হাসান এবং হজরত হোসেন। এঁদের বন্দনার পর স্মরণ করা হয় ইমাম হোসেন, বড় পিরসাহেব, খাজা পিরসাহেব প্রমুখকে।

বিয়ের আগের দিন ‘ঢেঁকি-মুঙ্গলা’ গ্রামীণ মুসলিম বিবাহরীতির এক অতি প্রাচীন আচার। সাত এয়ো স্ত্রী ঢেঁকির পাড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মঙ্গলগীত গায়— ‘চোখ মুজি মুজি চোখে ছাই/ ঢেঁকি মুঙ্গলানো দেখে যাই/ গাল ভ’রে পান পাই/ মাথা ভ’রে তেল পাই।’ গালভরা পান এবং মাথাভরা কেশরঞ্জনীর সামান্য প্রাপ্তির আন্তরিক খুশি আমরা ভুলেই গেছি। হিন্দুদের মতোই বাঙালি-মুসলমান সমাজে বাসর-জাগা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে গানের রেওয়াজ। বর-কনেকে মাঝে রেখে মেয়েরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে এই গান গায়, ‘তার-ই-তসন (অপূর্ব সুন্দরী) মেয়ে আমার, জামাই কেন মোর কালো গো?/ হোক না মা তোর কালো জামাই, আঁধার ঘরে ভালো গো।/ তার-ই-তসন মেয়ে আমার, জামাই কেন মোর দেঁতড়ো গো?/ হোক না মা তোর দেঁতড়ো জামাই, কচু ছিলবার ভালো গো।”

বিয়ের আগের দিন ‘ঢেঁকি-মুঙ্গলা’ গ্রামীণ মুসলিম বিবাহরীতির এক অতি প্রাচীন আচার। সাত এয়ো স্ত্রী ঢেঁকির পাড়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মঙ্গলগীত গায়— ‘চোখ মুজি মুজি চোখে ছাই/ ঢেঁকি মুঙ্গলানো দেখে যাই/ গাল ভ’রে পান পাই/ মাথা ভ’রে তেল পাই।’ গালভরা পান এবং মাথাভরা কেশরঞ্জনীর সামান্য প্রাপ্তির আন্তরিক খুশি আমরা ভুলেই গেছি। হিন্দুদের মতোই বাঙালি-মুসলমান সমাজে বাসর-জাগা গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে বরকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করে গানের রেওয়াজ। বর-কনেকে মাঝে রেখে মেয়েরা দু’টি দলে ভাগ হয়ে প্রশ্নোত্তরের ভঙ্গিতে এই গান গায়, ‘তার-ই-তসন (অপূর্ব সুন্দরী) মেয়ে আমার, জামাই কেন মোর কালো গো?/ হোক না মা তোর কালো জামাই, আঁধার ঘরে ভালো গো।/ তার-ই-তসন মেয়ে আমার, জামাই কেন মোর দেঁতড়ো গো?/ হোক না মা তোর দেঁতড়ো জামাই, কচু ছিলবার ভালো গো।”

আবার পশ্চিম বাংলার সাঁওতালি সমাজের বিয়ের গানে উঠে আসে তিতি পাখির কথা। তিতি নামের পাখিটি একা থাকতে পারে না। তাদের অটুট জোড়ের মিথ উঠে আসে সাঁওতাল সমাজের বিয়ের আচারে। বরের আশীর্বাদ অনুষ্ঠানে তাদের গান: ‘আরুরে বিহুরে সেহে’লে তিতি দ’, মানে, তিতি পাখির মতো হোক হবু দম্পতির নবজীবন। বিবাহে গ্রামের জগমাঁঝির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হলুদ বাটার দিন জগমাঁঝির স্ত্রী তিনটি আইবুড়ো মেয়েকে নিয়ে আসে। তারা পুবপানে মুখ রেখে বরের মা-বাবার উদ্দেশে গান গেয়ে হলুদ বাটে: ‘বাছাও সাসাং রিৎ রিৎতে/ ধিরি মা রাপুৎএন্…।’ বাছা, হলুদ পিষতে পিষতে শিল ভেঙে গেল, ওগো বরের বাবা-মা, শিল কিনতে লোক পাঠাও।

উত্তরবঙ্গের হাজংদের বিয়েতে ‘গীদাল’দের আমন্ত্রণ জানানো হয়ে থাকে। গানের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে তাঁরা ‘গীদাল’; সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানে গান-বাজনার দায়িত্ব তাঁদের। বিয়ের যাবতীয় খুঁটিনাটি গানের মধ্য দিয়ে এঁরা রাঙিয়ে তোলেন।পাশাপাশি মেচ-সমাজে বিবাহ রীতিমতো উৎসব হয়ে ওঠে নানা ধরনের সঙ্গীত ও নৃত্যানুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রায় প্রতিটি আচারের সঙ্গে গান এদের বিয়ের মূল বৈশিষ্ট্য। গান ও সুরার যৌথতায় কনেপক্ষ বিয়ের আসরে আগমন উদ্যত বরের পথ রুদ্ধ করে বলে ওঠে: ‘ফাসা-গহবলি-লাইলুলাই’, গভীর বনের হে নববর, তোমার বিয়ের হাঁড়িয়া (মদ) নিয়ে এসো।

কোড়া জনজাতি সমাজে বিয়ের গানকে বলা হয় ‘আড়দি দুরাং’ মানে বিয়ের গান। এদের বিয়েতে নানা আচারে এই ‘আড়দি দুরাং’ প্রচলিত। যেমন কনেকে ছাঁদনাতলায় নিয়ে আসার আগে যে আচারটি পালনীয় তার নাম ‘লুড়গু আড়গু’। মেয়ের বাবা হাঁটুতে নোড়া রেখে মাথা ঠেকায়, তখন পার্শ্ববর্তী মেয়ের দল গান ধরে: ‘অকয় লুড়গু আড়গু ইকে?’— কে নোড়া নামাচ্ছে? যে নিজের বাবা সে নোড়া নামাচ্ছে। লোধা সমাজে কুলবধূর দল জলাশয় থেকে জল ভরে মঙ্গলঘট নিয়ে ফেরার পথে কোকিল পাখির উদ্দেশে গান ধরে: ‘কুইলি, কুইলি, ওগো কুইলি,/ এ পথে না করিও বাসা গো।/ এখনি আসিবে বর যাতরি,/ ভাঙ্গিবে কুইলির বাসা গো।’ উত্তরবঙ্গের আর এক জনজাতি ধিমালদের বিয়ের দিন গ্রামের পথে বরযাত্রীদের আটকানো হয়। তার পর গানে গানে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলে কন্যাপক্ষ। বরকে বলা হয়: ‘রেমকা বেজান কেলাকো মাপিঙ্গেরে…’— আমাদের সুন্দর মেয়েটাকে তোমার কাছে দেব না। এর পর মদ ও চুরুট বিনিময়ের পর পথ অবরোধ তোলা হয়।

কুড়মি সমাজেও বিয়ের আসরে নানারকম গানবাজনার আয়োজন হয়। কুড়মিদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে ‘ঘর আর বর/ মাঘ ফাল্গুনে কর’ মানে বাড়ি বানানো আর বিয়ে মাঘ আর ফাল্গুন মাসেই করতে হয়। কুড়মি-কন্যা যখন বাবা-মায়ের কাছে বিদায় নেয় তখন পাত্রপক্ষের গান: ‘তর বিটিকে লিয়ে যাচ্ছি বাইজ-বাজনা করে/ থাক লো কইন্যার মা শুধা ঘরটি লয়ে।’ এর পর বর বাবাজীবন নবপরিণীতাকে নিয়ে নিজগৃহে প্রবেশ করে। ননদিনী রায়বাঘিনীর দল ঠাট্টা, বিদ্রুপ শুরু করে গানে, ছড়ায়। এমনকি সেই রাতে খেতে দিয়ে নতুন বৌয়ের খাওয়া নিয়েও ঠাট্টা করে ননদকুল: ‘আছাঁটা চাউলের ভাত আলতি বেসাতি/ খা বলতে খালি, বহু এতই ভখে ছিলি!’ সংসার যে সমরক্ষেত্র, তার ইঙ্গিত কি এই ছড়াতেই পেয়ে যায় নতুন বৌটি? শবর-সমাজে গায়ে হলুদের সময়েই ‘বিপদ’-এর পূর্বাভাস পায় পাত্র অথবা পাত্রী। এদের গায়ে হলুদের নাম ‘গাঁইডা হুড়িৎ’। হলুদ মেখে স্নান করে এল ছেলে বা মেয়েটি, বৌদি আকন্দ ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন, তখনই সমবেত গানে ফুটে ওঠে সাবধানবাণী: ‘ফুলের মালা পরিস না রে/ যাবেক জাতের কুল।’

কুড়মি সমাজেও বিয়ের আসরে নানারকম গানবাজনার আয়োজন হয়। কুড়মিদের মধ্যে একটা কথা প্রচলিত আছে যে ‘ঘর আর বর/ মাঘ ফাল্গুনে কর’ মানে বাড়ি বানানো আর বিয়ে মাঘ আর ফাল্গুন মাসেই করতে হয়। কুড়মি-কন্যা যখন বাবা-মায়ের কাছে বিদায় নেয় তখন পাত্রপক্ষের গান: ‘তর বিটিকে লিয়ে যাচ্ছি বাইজ-বাজনা করে/ থাক লো কইন্যার মা শুধা ঘরটি লয়ে।’ এর পর বর বাবাজীবন নবপরিণীতাকে নিয়ে নিজগৃহে প্রবেশ করে। ননদিনী রায়বাঘিনীর দল ঠাট্টা, বিদ্রুপ শুরু করে গানে, ছড়ায়। এমনকি সেই রাতে খেতে দিয়ে নতুন বৌয়ের খাওয়া নিয়েও ঠাট্টা করে ননদকুল: ‘আছাঁটা চাউলের ভাত আলতি বেসাতি/ খা বলতে খালি, বহু এতই ভখে ছিলি!’ সংসার যে সমরক্ষেত্র, তার ইঙ্গিত কি এই ছড়াতেই পেয়ে যায় নতুন বৌটি? শবর-সমাজে গায়ে হলুদের সময়েই ‘বিপদ’-এর পূর্বাভাস পায় পাত্র অথবা পাত্রী। এদের গায়ে হলুদের নাম ‘গাঁইডা হুড়িৎ’। হলুদ মেখে স্নান করে এল ছেলে বা মেয়েটি, বৌদি আকন্দ ফুলের মালা পরিয়ে দিলেন, তখনই সমবেত গানে ফুটে ওঠে সাবধানবাণী: ‘ফুলের মালা পরিস না রে/ যাবেক জাতের কুল।’

তবে নির্মলেন্দু চৌধুরী বাঙালির বিয়ের আসরে গাওয়া গানকে অমর করে রেখে গেছেন তাঁর সেই বিখ্যাত,

“সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি
নাচো তো দেখি
বালা নাচো তো দেখি
নাচেন ভাল সুন্দরী এই
বাঁধেন ভাল চুল
নাচেন ভাল সুন্দরী এই
বাঁধেন ভাল চুল
হেলিয়া দুলিয়া পরে
নাগ কেশরের ফুল
রুনু ঝুনু নুপুর বাজে
ঠুমুক ঠুমুক তালে
রুনু ঝুনু নুপুর বাজে
নয়নে নয়ন মেলিয়া গেল
শরমের রঙ লাগে গালে
যেমনি নাচে নাগর কানাই
তেমনি নাচে রাই
নাচিয়া ভুলাও তো দেখি
নাগর কানাই’’

পূর্ব বাংলার বাঙালি হিন্দু সমাজে বিয়ের রাতে বা বাসর রাতে আর একটি বিখ্যাত গান গাওয়া হতো –

“ভালো করিয়া বাজাও গো
দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে
সুন্দরী কমলা চরণে নূপুর
রিনিঝিনি করিয়া বাজে রে
সুন্দরী কমলা পরণে শাড়িয়া
রৌদে ঝলমল করে
সুন্দরী কমলা নাকে নোলক
টলমল করিয়া দোলে রে
ভালো করিয়া বাজাও গো
দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে
এ বাড়ি হইতে ও বাড়ি যাই রে
ঘাটাপানি ঝিলমিল পানি রে
আমারি ভিঝিল জামা জোড়া
কন্যার ভিজিল শাড়ি রে
ভালো করিয়া বাজাও গো
দোতারা সুন্দরী কমলা নাচে
সুন্দরী কমলা চরণে নূপুর
রিনিঝিনি করিয়া বাজে রে”

সেই সময় বিয়েতে স্বপরিবারে আত্মীয়-স্বজন আসতো সপ্তাহ খানিক আগে। বিয়ের শেষদিন অবধি চলতো মশকারি নামক ঘরোয়া নাচ-গান আর রঙ খেলা। আজকের দিনে এসব জিনিস লোকে ভুলে গেছে। বিয়ের অনুষ্ঠানও অনেক ছোট হয়ে গেছে। একদিনের জন্য বিয়ের বাড়ি ভাড়া করে একদিনেই বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ ! ফলে এসব গান, কবিতা বা ছড়া লেখার বা শোনার লোকও এখন নেই বললেই চলে। এইসব বিয়ের গান বা ছড়া যুগোপযোগী করে যদি তুলে ধরা যায় তবেই এই সংস্কৃতি বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। উত্তর ভারতের বিয়েতে মেহেন্দী পরানোর অনুষ্ঠান যদি জমকালো ভাবে হিন্দি সিনেমার মাধ্যমে ফিরে আসতে পারে তবে বাংলার পরস্পরাগত এই গ্রামীণ সংস্কৃতিই বা পারবে না কেন?

শচীনদেব বর্মণ পূর্ব বাংলার এরকম অনেক গান থেকে হিন্দি সিনেমার গানের সুর তৈরী করেছিলেন। একবার সিলেটের এক বিয়ের আসরে শুনেছিলেন, বর যখন বিয়ে করতে যাচ্ছে বরযাত্রী মেয়েরা তখন সুর করে গেয়ে উঠছে ” ছেলে যাবে শ্বশুরবাড়ি, আল্লাদে খায় গড়াগড়ি।” গানের সুরটি উনি তৈরী করে রেখেছিলেন, কিন্তু ব্যবহার করতে পারেননি। অনেকপরে ছেলে রাহুলদেব বর্মণ অনুসন্ধান সিনেমায় সেই সুরটি ব্যবহার করেন- ” ফুলকলি রে ফুলকলি, বলতো এটা কোন গলি ?” প্রেমানারায়ণের নাচে সুপার ডুপার হিট হয়ে আছে অসাধারণ এই গানের সুরটি।

তথ্যসূত্র

১. শুভাশিস চক্রবর্তী, বিয়েতে হারিয়ে যাওয়া ছড়া-গানের লোকাচার, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ ডিসেম্বর,২০২০

২. জান্নাতুল রায়হানা, বিয়ের গীতের মানসপট-বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ফিরে দেখা, কৌলাল, ৪ আগস্ট, ২০২১

৩. Somdev Banik, The Oral Tradition of Bengali Folk Songs in Tripura, National Conference on Texts, Manuscripts and Oral Traditions of Tripura At:Department of Sanskrit, Tripura University, Tripura, March, 2016

৪. সোমনাথ রায়, বিয়ে বাড়ির হারিয়ে যাওয়া উপহার ও অনুষঙ্গ, Durga Puja 2020, Durga Puja News In Bengali, Bengali Podcast For Durga Puja (Bangla podcast from EiSamay Gold)

৫. আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোক-সংস্কৃতি, ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইন্ডিয়া, নতুন দিল্লি, ২০০৫, মুদ্রণ, পৃ. ৫৯-৬৩

রণবীর চন্দ | Ranabir Chanda

Best Tattoo Machine 2023 | ট্যাটু মেশিনের ক্রমবিকাশ | প্রবন্ধ ২০২৩

Top Bengali Article 2022 | বসন্ত উৎসব | প্রবন্ধ ২০২২

Rabindranath Tagore’s love for art and literature

Loukik Debota Masan Thakur | লৌকিক দেবতা মাশান ঠাকুর | 2022

বাংলা প্রবন্ধ | বাংলার লেখক | প্রবন্ধ ও প্রাবন্ধিক | সেরা প্রবন্ধ ২০২২ | শব্দদ্বীপ | শব্দদ্বীপের লেখক | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন

bengali article writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | writing competition hong kong | writing competition game | writing competition essay | writing competition australia | writing competition prizes | writing competition for students | writing competition 2022 | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bengali article rewriter | article writing | bengali article writing ai | bengali article writing app | bengali article writing book | bengali article writing bot | bengali article writing description | bengali article writing example | article writing examples for students | article writing for class 8 | article writing for class 9 | bengali article writing format | article writing gcse | bengali article writing generator | article writing global warming | article writing igcse | article writing in english | bengali article writing jobs | article writing jobs for students | article writing jobs work from home | article writing lesson plan | article writing on child labour | article writing on global warming | article writing pdf | article writing practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Short Article | Long Article | Bangla kobita | Kabitaguccha 2022 | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | Lost music and culture in Bengali wedding – article | Lost music and culture in Bengali wedding 2023 | New article – Lost music and culture in Bengali wedding | Lost music and culture in Bengali wedding pdf | trend topic – Lost music and culture in Bengali wedding | Lost music and culture in Bengali wedding – web series | Lost music and culture in Bengali wedding – new journal | New video – Lost music and culture in Bengali wedding | video download – Lost music and culture in Bengali wedding | video 2023 – Lost music and culture in Bengali wedding | pdf 2023 – Lost music and culture in Bengali wedding | pdf download – Lost music and culture in Bengali wedding | pdf book – Lost music and culture in Bengali wedding | article book – Lost music and culture in Bengali wedding | top article – Lost music and culture in Bengali wedding | top pdf – Lost music and culture in Bengali wedding | free video – Lost music and culture in Bengali wedding | free pdf – Lost music and culture in Bengali wedding | bestseller – Lost music and culture in Bengali wedding | best article – Lost music and culture in Bengali wedding | bengali article – Lost music and culture in Bengali wedding | article collection – Lost music and culture in Bengali wedding | article store – Lost music and culture in Bengali wedding | video collection – Lost music and culture in Bengali wedding | series – Lost music and culture in Bengali wedding | series 2023 – Lost music and culture in Bengali wedding | top series – Lost music and culture in Bengali wedding | full pdf – Lost music and culture in Bengali wedding

Leave a Comment