Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math – অভিজিৎ পাল – সূচিপত্র
বেলুড় মঠের দুর্গাপূজা : চিন্তনে ও মননে – অভিজিৎ পাল
বেলুড়ে যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত একটি স্থায়ী মঠ তৈরি হওয়ায় স্বামী বিবেকানন্দ অনেকখানি তৃপ্তি পেয়েছিলেন। কথিত, একবার শারদীয়া দুর্গাপূজার আগে বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রথম অধ্যক্ষ স্বামী ব্রহ্মানন্দ (রাজা মহারাজ) মঠের প্রাচীন ভবনটির বারান্দায় গঙ্গাতীরের দিকে কাঠের বেঞ্চে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখতে পেয়েছিলেন, স্বয়ং জগজ্জননী ভগবতী দেবী দুর্গা গঙ্গাপথে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির দিক থেকে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে বেলুড় মঠের দিকে মুখ করে এগিয়ে আসছেন। স্বামী বিবেকানন্দও এই সময়ে মনে মনে বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা করার কথা চিন্তা করছিলেন। কিন্তু নিজস্ব চিন্তার কথাটি তাঁরা পরস্পরের মধ্যে তখনও ভাগাভাগি করেননি। শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর লেখা ‘স্বামী-শিষ্য সংবাদ’-এ রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ এই সময়ে একটি রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতিতত্ত্ব এনে দেওয়ার জন্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু রঘুনন্দনের উক্ত স্মৃতিগ্রন্থ দিয়ে কি হবে জিজ্ঞেস করায় স্বামীজী উত্তর দিয়েছিলেন : “এবার মঠে দুর্গোৎসব করবার ইচ্ছা হচ্ছে। যদি খরচার সঙ্কুলান হয় তো মহামায়ার পুজো করব। তাই দুর্গোৎসব বিধি পড়বার ইচ্ছা হয়েছে।” (স্বামী-শিষ্য সংবাদ—শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তী, পৃঃ ২২৮-২৯)
ক্রমশ বেলুড় মঠে এই দুটি বিষয় জানাজানি হলে দুর্গাপূজার আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠার সময় শ্রীরামকৃষ্ণের শক্তি সারদাদেবীর নামেই পূজাদির সংকল্প করা হয়েছিল। সারদাদেবীই ছিলেন বেলুড় মঠের শেষ কথা, তথা ‘হাইকোর্ট’। তাঁর নামে সংকল্পিত হওয়া বেলুড় মঠে দুর্গাপূজা হবে, কিন্তু তার জন্য সবার আগে সারদাদেবীরই অনুমতি চাই। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস যেমন কারো ভাব নষ্ট করার পক্ষে ছিলেন না, সারদাদেবীও ঠিক তেমনই ছিলেন। বেলুড়ে সাধুরা যখন পূজার অনুমতি লাভের আকাঙ্ক্ষায় ব্যগ্র হয়ে রয়েছেন, সেই সময়ে সারদাদেবী বাগবাজারে অবস্থান করছিলেন (তখনও কলকাতায় সারদাদেবীর জন্য স্থায়ী আবাস নির্মাণ করা যায়নি। বাগবাজারের বর্তমান মায়ের বাড়িটি আরও পড়ে তৈরি হয়েছিল। শ্রীমা সারদাদেবী কলকাতায় আসলে বলরাম বসুর বাড়িতে বা ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করতেন।)। সবকিছু শুনে তিনিও সানন্দে রাজি হয়ে তাঁর আদরের সন্ন্যাসী সন্তানদের বেলুড় মঠে দুর্গাপূজার আয়োজন করার জন্য সাগ্রহে অনুমতি দান করলেন। তখন শারদীয়া দুর্গোৎসবের মাত্র তিন সপ্তাহ মতো বাকি। ১৯০১-এর কলকাতার কুমোরটুলিতে যে আজকের মতো এত অল্প সময়ের মধ্যে মূর্তি পাওয়া সম্ভব ছিল, এমন ভাবা ভুল হবে। তবে কথায় বলে, যে খায় চিনি তাকে জোগায় চিন্তামণি। এখানেও যেন ঠিক তেমনটাই হলো।
শ্রীমায়ের সানন্দ অনুমতি পেয়ে স্বামী বিবেকানন্দের নির্দেশ মতো কলকাতার কুমোরটুলিতে গিয়ে চিন্ময়ী দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তির অনুসন্ধান করা হলো। পূজার মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকা সত্ত্বেও শেষে কুমোরটুলিতেই একটি একচালার মূর্তির সন্ধান পাওয়া গেল। সেই মূর্তির শিল্পী কে ছিলেন, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। স্বামী ব্রহ্মানন্দ তখন মঠের প্রধান সেবক (তথা অধ্যক্ষ), তাঁকে শ্রীরামকৃষ্ণ সাম্রাজ্য শ্রীরামকৃষ্ণের মানসপুত্র হিসেবে দেখা হয়, তাঁর ওপরেই পড়লো পূজার আয়োজনের যাবতীয় সব দায়িত্ব। ১৭ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার (৩১শে আশ্বিন) শুভ পঞ্চমী তিথিতে যথা সময়ে কুমোরটুলি থেকে দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা এসে পৌঁছালো বেলুড় মঠের ঘাটে। আনন্দের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে গোটা মঠ। রাজা মহারাজ পূজার সমস্ত উপকরণ সংগ্রহ করে দিয়েছিলেন। ১৮ই অক্টোবর, শুক্রবার (১লা কার্তিক) শুরু হলো ষষ্ঠীর কল্পাদি। সেবারে দুর্গাপূজার পূজার আসনে বৈদান্তিক নিষ্কাম সন্ন্যাসীর অধিকার না থাকায় পূজকের পদে ব্রতী হন ব্রহ্মচারী কৃষ্ণলাল। আর তন্ত্রধারকের আসনে বসেন শ্রীরামকৃষ্ণের অন্যতম সন্ন্যাসী সন্তান স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের (শশী মহারাজ) পিতা শ্রীঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য। শশী মহারাজের পিতা সুপ্রসিদ্ধ তান্ত্রিক সাধক পণ্ডিত শ্রীজগন্মোহন তর্কালঙ্কার মহাশয়ের প্রত্যক্ষ শিষ্য ছিলেন। স্বামী বিবেকানন্দের প্রার্থনায় স্বয়ং জগজ্জননী শ্রীমা সারদাদেবীও সেবারে দুর্গাপূজায় সপার্ষদ অংশ নিয়েছিলেন। সেই বছর তাঁর নামেই দুর্গাপূজার সংকল্প করা হয়। শ্রীমায়ের পার্থিব তনুত্যাগের পরেও সারদাদেবীর নামেই মঠের দুর্গাপূজা সহ বিভিন্ন পূজার সংকল্প করা বন্ধ করা হয়নি। যে দেবী সর্বভূতে মাতৃরূপে অবস্থান করেন তিনি তো চিরজাগ্রতই। এখনও সেই প্রথার কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯০১-এ সেই যে যাত্রা হলো শুরু, সেই অভিযাত্রা কালের দুর্বার গতির সঙ্গে তালে তালে এখনও সচল।
বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের মধ্যে বেশ কিছু নিজস্বতা রয়েছে। মূলত প্রাচীন পূজারীতি ও ঐতিহ্যকে পূর্ণমাত্রায় বহন করে চলেছে এই প্রতিষ্ঠানটি। শ্রীরামকৃষ্ণের নামাঙ্কিত এই শতাব্দী প্রাচীন মঠে একই সঙ্গে পূজাবিধির নিয়মানুযায়ী আচার-অনুষ্ঠান ও অন্তরের গভীরতা মাখানো ভক্তিরসের মেলবন্ধন ঘটে চলেছে। এখানে একই সঙ্গে মৃন্ময়ী মায়ের সঙ্গে চিন্ময়ী মায়ের মেলবন্ধন ঘটে।
(ক) কাঠামো পূজা ও উপকরণ সংগ্রহ
প্রতি বছর শ্রীকৃষ্ণ-জন্মাষ্টমী তিথিতে কাঠামো পূজাবিধির মাধ্যমে বেলুড় মঠে দুর্গোৎসবের শুভ সূচনা হয়। বেলুড় মঠের নিজস্ব নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক বছর একই কাঠামোর ওপরে দেবী দুর্গার প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। বিগত বছরে পূজান্তে দশমীর দিনে বিসর্জনের সময়ে পর গঙ্গায় মাতৃবিগ্রহ নিরঞ্জন করার পর মূল কাঠামোটি আবার তুলে রাখা হয় পরবর্তী বছরে মূর্তি তৈরির জন্য। দশমীর পর গঙ্গা থেকে সেই তুলে আনা কাঠামোটি সারা বছর ধরে অনেক যত্ন করে সংরক্ষণ করা হয়। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের প্রাচীন পূজা প্রতিষ্ঠানের পূজাবিধিতে এই নিয়মটি কমবেশি প্রায় একই। বিশেষ করে বাংলার বিভিন্ন গ্রামের অধিষ্ঠাত্রী কালীদেবীর কাঠামোকে এভাবেই সংরক্ষণ করার রেওয়াজ আছে। প্রাচীন দুর্গোৎসবগুলিতে কাঠামো পূজা হয় সাধারণত অক্ষয় তৃতীয়া, স্নানযাত্রা বা রথযাত্রার দিনে। কিন্তু বেলুড় মঠে প্রত্যেক বছর জন্মাষ্টমী তিথিতে সেই তুলে আনা কাঠামোটির পুনরায় পূজা করে তাতে নতুন বছরের নতুন প্রতিমা তৈরির জন্য প্রথম মাটি দেওয়া হয়। সাধারণত যে নবীন ব্রহ্মচারী মঠের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট হয়ে কাঠামোটি পূজার শেষে সেই কাঠামোতে প্রথম মাটির প্রলেপ দেন, তিনিই সেই বছরের দুর্গাপূজার পূজকের পদ পান। এটি বর্তমানে এই প্রাচীন প্রতিষ্ঠানের একটি সুন্দর রীতি।
সারা বছর ধরে এত শুভতিথি থাকার পরেও এই জন্মাষ্টমী তিথিকে কেন হঠাৎ করে কাঠামো পূজার জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে তার পিছনে একটি সুন্দর পৌরাণিক অনুসঙ্গ রয়েছে। শ্রীমদ্ভাগবতের পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে জন্মাষ্টমী তিথিতে যখন মথুরারাজ কংসের কারাগারে আবদ্ধ বসুদেব ও দেবকীর গর্ভে স্বয়ং পদ্মনাভ নারায়ণ শ্রীকৃষ্ণ রূপে জন্ম হয়েছিল, সেদিনই একই তিথিতে বৃন্দাবনে নন্দরাজ ও যশোদা দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন স্বয়ং দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়া। সেই অর্থে দেবী মহামায়ার কায়িক রূপ লাভের তিথি হিসেবে জন্মাষ্টমীকেই চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রতি বছর বেলুড় মঠে এবং তার অধিকাংশ শাখাকেন্দ্রে শারদীয়া দুর্গোৎসবের আয়োজনের আনুষ্ঠানিক সূচনা হয় এই দিনে এই রীতিতেই। এরপর ধীরে ধীরে একদিকে যেমন দেবীর মূর্তি নির্মাণের কাজ চলতে থাকে, তেমনই নানা স্থানে লোক পাঠিয়ে দুর্গাপূজার যাবতীয় খুঁটিনাটি উপকরণ একটি একটি করে সংগ্রহ করা শুরু হয়। কলির অশ্বমেধ যজ্ঞ এই দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজার উপকরণ তালিকা দেখলেই বোঝা যায় কথাটি নেহাত কথার কথা নয়। আজকের বারোয়ারী দুর্গোৎসবের আয়োজনে যে পরিমাণ ফাঁকি রয়েছে তাতে দুর্গাপূজার উপকরণের সেই বিস্তৃত ধারণাটি সাধারণ মানুষ হয়তো আন্দাজই করতে পারবেন না। বেলুড় মঠে দেবীর অভিষেকের জন্য সাধারণত ভুবনেশ্বরের বিন্দু সরোবরের জল সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও গঙ্গা সহ বিভিন্ন নদীর জল, শিশিরের জল, সুগন্ধি জল, সোনা-রূপার জল সংগ্রহ করা হয়। শাস্ত্রীয় বিধান মেনে নানাস্থান থেকে সংগ্রহ করা হয় পনেরো রকম মৃত্তিকা। সেগুলি হলো গজদন্ত-মৃত্তিকা, বরাহদন্ত-মৃত্তিকা, চতুষ্পথ-মৃত্তিকা, রাজদ্বার-মৃত্তিকা, গঙ্গা-মৃত্তিকা, বল্মীক-মৃত্তিকা, বেশ্যাদ্বার-মৃত্তিকা, বৃষশৃঙ্গ-মৃত্তিকা, পর্বত-মৃত্তিকা, দেবদ্বার-মৃত্তিকা, গোষ্ঠ-মৃত্তিকা প্রভৃতি। এই বিপুল বৈচিত্র্য থেকে শারদীয়া দুর্গোৎসব যে বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মানুষের মিলনোৎসব তা নিশ্চিত করে বলা যায়। অন্যান্য উপকরণের সঙ্গে সংগ্রহ করা হয় উত্তম বস্ত্র। পুষ্প, মালা, বেলপাতার নিত্য জোগান দেওয়া হয়। এছাড়া অন্যান্য সাধারণ উপাচার তো রয়েছেই। এখানে ষোড়শোপাচারে সপার্ষদ সপরিবারে জগজ্জননী দেবীর পূজা হয় দুর্গোৎসবের প্রতিদিন। সংস্কৃতজ্ঞ সন্ন্যাসীরা বিশুদ্ধ উচ্চারণে বিধিপূর্বক শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করেন।
(খ) আগমণী সঙ্গীত ও মাতৃবন্দনা
শোনা যায় আগে বেলুড় মঠে কাঠামো পূজার দিন থেকেই উমা বিষয়ক বিভিন্ন আগমনী গান গাওয়া শুরু হতো, কিন্তু এখন মোটামুটিভাবে মহালয়ার পবিত্র তিথি থেকে বেলুড় মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যান্য শাখাকেন্দ্রে আগমনী গান গাওয়া প্রারম্ভ হয়। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনে আবাসিক জীবনে দেখেছি মোটামুটিভাবে মহালয়া তিথি থেকেই উমাসঙ্গীত বা আগমনী গানের একটি অকথিত হিল্লোল বয়ে বেড়াত আশ্রমের কোণায় কোণায়। এই আগমনী গানগুলি অখণ্ড বাংলাদেশের নিজস্ব গান। ঘরের মেয়ে সুন্দরী উমাকে বাৎসরিক একবার করে কাছে পাওয়ার, বুকে জড়িয়ে ধরার আবেগ রয়েছে এই সব গানে। মাতৃহৃদয় ও পিতৃহৃদয়ের উজাড় করা ভালোবাসা, সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম বাৎসল্য দেখে মনে হয় এ যেন আমাদের প্রত্যেকের ঘরের মেয়ের কথা। শুধু গিরিরাজ ও মা মেনকার কন্যা নয়, উমা আপনার আমার ঘরের সেই আদরের মেয়েটি, যে মেয়েটি পিতৃপরিবার ছেড়ে পতিপরিবারে সংসার সাজিয়ে বসেছে। কন্যা থেকে যে গিন্নি হয়ে ওঠার পরেও পিতা-মাতার কাছে রয়ে গেছে আদরের শিশুই।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের বিভিন্ন শাখায় বিশেষ করে কবি দাশরথী রায়ের লেখা ও স্বামী বিবেকানন্দের অন্যতম প্রিয় আগমনী গান ‘গিরি গণেশ আমার শুভকারী।/ পূজে গণপতি পেলাম হৈমবতী/ চাঁদের মালা যেন চাঁদ সারি সারি।।’ গানটি দিয়েই আগমনী গান গাওয়া প্রারম্ভ হয়। এছাড়াও এই সময়ে গাওয়া হয় মূল সংস্কৃত ভাষায় ‘শ্রীশ্রীমহিষাসুরমর্দিনীস্তোত্রম্’, স্বামী বিবেকানন্দের লেখা ‘অম্বা-স্তোত্রম্’ সহ আরো অজস্র মাতৃস্তব ও গান। গানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রামপ্রসাদ সেনের পদ ‘গিরি, এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাব না।/ বলে বল্বে লোকে মন্দ, কারো কথা শুন্বো না।।’, কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের লেখা, ‘আমি কি হেরিলাম নিশি-স্বপনে!’, ‘কবে যাবে বল গিরিরাজ, গৌরীরে আনিতে।/ ব্যাকুল হৈয়েছে প্রাণ উমারে দেখিয়ে হে।’, গঙ্গানারায়ণের লেখা ‘শঙ্খে শঙ্খে মঙ্গল গাও জননী এসেছে দ্বারে।/ সপ্তসিন্ধুকল্লোল রোল বেজেছে সপ্ত তারে।।’, গিরিশচন্দ্র ঘোষের লেখা ‘কেমন করে হরের ঘরে ছিলি উমা বল মা তাই,/ কত লোকে কতই বলে‚ শুনে প্রাণে মরে যাই।।’, ‘কুস্বপন দেখেছি গিরি, উমা আমার শ্মশানবাসী; অসিত বরণা উমা, মুখে অট্ট অট্ট হাসি।’, গোবিন্দ চৌধুরীর পদ ‘গিরি, গৌরী আমার এল কৈ?/ ঐ তৈরি সবাই এসে, দাঁড়ায়েছে হেসে, শুধু সুধামুখী আমার প্রাণের উমা নেই।’, দীনেশশরণ বসুর গান ‘এলি কিগো উমা, হর মনোরমা, কৈলাস চন্দ্রমা হলি কি উদয়।’ ইত্যাদি। বিবিধ বাদ্যের মিশ্রণে ও পদগুলি আরও আকর্ষণীয় হয়ে যায়। এই গানগুলির ভেতরে লুকিয়ে থাকা যে শারদীয় মাধুরী রয়েছে, তাতে বেলুড় মঠ প্রত্যক বছর সঞ্জীবনী সুধা ঢেলে দেয় বাইরে থেকে আগত ঈশ্বরমুখী দর্শনার্থীদের মনে। এই আগমনী সঙ্গীতের মধ্যে একটি অসামান্য ও চিরন্তনী আনন্দযজ্ঞের আভাস যেন মেলে। দুর্গা পূজার প্রতিদিন দেবীর মণ্ডপে বিভিন্ন বয়সের অসংখ্য সাধু-ব্রহ্মচারী ও ভক্তেরা একের পর এক মাতৃগীতি গেয়ে শোনান। ‘একবার বিরাজ গো মা হৃদি কমলাসনে’ যে কতবার গাইতে শুনেছি তার কোনো ইয়াত্তা নেই। ঐ গানটির ভেতরে যেন কি একটা আছে যা যে কোনো মানুষকে একাগ্র করিয়ে নিয়ে সীমার জগতের মাঝেও অসীমের স্বাদ আস্বাদন করিয়ে দেয়। এছাড়াও গাওয়া হয় ‘কথামৃত’-এ উল্লিখিত শ্রীরামকৃষ্ণের প্রিয় গানগুলি।
(গ) পঞ্চমী, ষষ্ঠীর বোধন ও অধিবাস
বেলুড় মঠে দুর্গোৎসব উপলক্ষে আগে বাইরে থেকে একাধিকবার প্রতিমা আনা হলেও বহু বছর ধরে এখন বেলুড় মঠেই দেবীর মৃন্ময়ী প্রতিমা তৈরি করা হয়। অবশ্য আগে একাধিকবার বিবিধ অভাবের কারণে দেবীর ঘটে ও পটে পূজা হয়েছে। মূর্তি নির্মাণের মতো অবস্থা ছিল না। পঞ্চাশের মন্বন্তরে যখন বাংলা জুরে অভাব, তখনও ঘটে ও পটে পূজা উদযাপন করা হয়েছিল। অসাধারণ দক্ষতায় শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরের বামপাশে তৈরি করা হয় অস্থায়ী অথচ পাকা দুর্গাবেদি। সাদা-কালো মেলানো মার্বেল পাথরের বাঁধানো সেই সুন্দর দুর্গামণ্ডপে বসানো হয় সদ্যনির্মিত সপরিবার-দুর্গামূর্তি। এখানে দুর্গামূর্তিতে রয়েছে ঐতিহাসিক পরম্পরায় পাওয়া ঐতিহ্যবাহী ছাপ। একচালার প্রমাণ মাপের এই দুর্গামূর্তির গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল কাঞ্চনমালা। দুর্গা দেবীর বামভাগে ওপরের দিকে থাকেন বিদ্যার দেবী সরস্বতী ও নিচের দিকে থাকেন দেবসেনাপতি ময়ূরবাহন কার্তিক। দুর্গাদেবীর ডানে ওপরের দিকে থাকেন ঐশ্বর্যের দেবী লক্ষ্মী ও তাঁর নিচে থাকেন গণনায়ক গণেশ। দুর্গাদেবী এক পা পশুরাজ সিংহের পিঠে ও এক পা মহিষাসুরের শরীরের রেখে একই সঙ্গে রণরঙ্গিনী ও মাতৃময়ী রূপে বেলুড় মঠের প্রাঙ্গণ আলো করে থাকেন।
দেবীর ঠিক পিছনে ঐতিহ্যবাহী চালচিত্র দেখা যায়। এই চালচিত্র আজকের দিনে অধিকাংশ পূজাতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেক পূজা কমিটির মূর্তিতে চালচিত্র দেখা গেলেও লক্ষ্য করা যায়, শাস্ত্রীয় চালচিত্রের ছাপ তাতে নেই। এর কারণ অনেক প্রতিমা শিল্পীই চালচিত্রের শাস্ত্রীয় দেব-দেবীর মূর্তিগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত জানেন না, পূজা কমিটির লোকজনেরও তার অজ্ঞাত। কিন্তু বেলুড় মঠের দুর্গাপূজায় প্রাচীন এই ঐতিহ্যের বিন্দুমাত্র নড়াচড়া হয়নি। প্রাচীন ও শাস্ত্রীয় চালচিত্র যদি কেউ অবিকৃত অবস্থায় দেখতে চান, তাহলে বেলুড় মঠের প্রতিমার চালচিত্রকেই বিশেষ নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বলা যায়।
বেলুড় মঠে কোনো শালগ্রাম শিলা নেই। এই কারণে প্রত্যেক বছর দুর্গাপূজার পঞ্চমী তিথিতে বেলুড় মঠের দক্ষিণ দিকে গঙ্গাতীরে অবস্থিত প্রাচীন জগন্নাথ মন্দির থেকে রাজসমাদরে মঠে নিয়ে আসা হয় পবিত্র শালগ্রাম শিলা। একই সঙ্গে একইভাবে বেলুড়ের সারদাদেবীর মন্দির থেকে নিয়ে আসা হয় পবিত্র বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ। কথিত বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ ও শালগ্রাম শিলা পরস্পরের পরিপূরক। পঞ্চমী থেকে দশমী পর্যন্ত দেবী দুর্গার বহুমাত্রিক আরাধনার পাশাপাশি শালগ্রাম শিলায় নারায়ণ ও নর্মদেশ্বর বাণেশ্বর শিবের বিশেষ পূজাও চলে। পঞ্চমী থেকে দশমীর ভোগের সময় পর্যন্ত এই দুই পবিত্র শিলা ও লিঙ্গ দুর্গামণ্ডপেই রাখা হয়। বিজয়া দশমীর পূজাদির শেষে শালগ্রাম শিলা আবার জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে যান এবং বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ ফিরে আসেন সারদাদেবীর মন্দিরে। এই বাণেশ্বর শিবলিঙ্গ সারাবছর সারদাদেবীর মন্দিরেই দেখা যায়। সারদাদেবীর মন্দিরে সারদা মায়ের ছবির বামপাশে রৌপ্য আসনে বাণেশ্বর শিবের অবস্থান।
দুর্গাপূজার এই রীতির কোনোদিনই অন্যথা হয় না। বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা অনুসারে মহাষষ্ঠীর শুভ সন্ধ্যায় শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ধ্যারতির পরে একটি ছোট বিল্ববৃক্ষমূলে রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতিতত্ত্ব অনুসারে শুরু হয় দেবীর বোধন, অধিবাস। বলা যেতে পারে বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিক শুরু ঠিক এই সময় থেকেই। বোধনের পূজা সমাপ্ত হলে, শুরু হয় দেবীর অধিবাস। বরণ ডালায় রাখা দ্রব্যগুলি একটি একটি করে দেবীর দিব্যশরীরে স্পর্শ করানো হয়। ধীরে ধীরে দেবীকে নানাবিধ অলংকারে আরো সুসজ্জিত করে তোলা হয়। দেবী দিব্যকান্তি ঈশ্বরানুরাগী মানুষের বুকে আনন্দের হিল্লোল তুলতে থাকে। অজস্র মানুষ সেই দৃশ্য দেখার জন্য দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন।
বেলুড় মঠে অভিজ্ঞ ঢাক, ঢোল, কাঁসর, সানাইবাদকেরা বংশ পরম্পরায় আমন্ত্রিত হয়ে আসছে। এঁদের মধ্যে ঢুলি পঞ্চানন হাজরার বংশধররা বায়না পেয়ে আসছেন প্রায় আনুমানিক সত্তর বছরের বেশি সময় ধরে। এটিও বেলুড় মঠের একটি রীতি বলা যায়। ষষ্ঠীর শুভদিন থেকে সানাইয়ের সুর ভেসে বেড়ায় মঠের চত্বরে। একটি অস্থায়ী নহবত সাজানো হয় প্রাচীন রীতি অনুযায়ী। বিভিন্ন বাদ্য বাদকেরাও পূজার এই কদিন বেলুড় মঠেই থাকেন এবং বারেবারে বাদ্যের কলতানে সকলের মনে আনন্দ বৃদ্ধি করেন। বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে তাঁদের যেন দুর্গোৎসবের এই কদিনে কোনোরকম অসুবিধা না হয় তার সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাঁদের সমাদরেও বেলুড় মঠের মহারাজরা কোনো ত্রুটি রাখেন না।
(ঘ) সপ্তমী ও অষ্টমীপূজা
ষষ্ঠী তিথিতে বোধন ও অধিবাসের পর সপ্তমী থেকে দুর্গাপূজার শুভ সূচনা হয়। বেলুড়ে সপ্তমীর দিন ভোরে সারদাদেবীর মন্দিরের সামনের ঘাটে বিধিমতে স্নান করানো হয় নবপত্রিকাকে। এই নবপত্রিকাকে সাধারণ মানুষ চেনে কলাবউ নামে। এই নবপত্রিকা আসলে নয়টি গাছের সমাহার। নবপত্রিকা স্নান ও পূজা শারদীয়া দুর্গাপূজার একটি বিশিষ্ট অঙ্গ। দেবীর দুর্গার পূজার আগে নবপত্রিকাকে পূজা করা হয়। নবপত্রিকার এই নয়টি গাছ হলো, যথাক্রমে : কলা, কচু, হরিদ্রা বা হলুদ, জয়ন্তী, বেল, দাড়িম্ব বা ডালিম, অশোক, মান ও ধান। একটি নাতিদীর্ঘ সপত্র কলাগাছের সঙ্গে প্রাগুপ্ত বাকি আটটি সমূল গাছকে একত্র করে এক জোড়া নিখুঁত বেল সহ শ্বেত অপরাজিতা গাছের লতা দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিয়ে তৈরি করা হয় নবপত্রিকাকে। তারপর তাকে স্নান করিয়ে শাড়ি জড়িয়ে একটি ঘোমটা দেওয়া সলজ্জ বধূর আকার দেওয়া হয়; তারপর তাতেই সিঁদুর দিয়ে দেবীপ্রতিমার ডান দিকে সাধারণত গণেশের পাশে স্থাপিত করে বিধিমালা অনুযায়ী পূজা করা হয়। শাক্ত বিষয়ে গবেষণা করে আচার্য শশিভূষণ দাশগুপ্ত লিখেছেন: “এই শস্যবধূকেই দেবীর প্রতীক গ্রহণ করিয়া প্রথমে পূজা করিতে হয়, তাহার কারণ শারদীয়া পূজা মূলে বোধহয় এই শস্য-দেবীরই পূজা। পরবর্তীকালের বিভিন্ন দুর্গাপূজার বিধিতে এই নবপত্রিকার বিভিন্ন ব্যাখ্যা দেওয়া হইয়াছে। …বলাবাহুল্য এই সবই হইল পৌরাণিক দুর্গাদেবীর সহিত এই শস্যদেবীকে সর্বাংশে মিলাইয়া লইবার একটা সচেতন চেষ্টা। এই শস্য-দেবী মাতা পৃথিবীরই রূপভেদ, সুতরাং আমাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমাদের দুর্গাপূজার ভিতরে এখনও সেই আদিমাতা পৃথিবীর পূজা অনেকখানি মিশিয়া আছে।”(ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্তসাহিত্য—শশিভূষণ দাশগুপ্ত, পৃ. ২৫-২৬)। আচার্য শশিভূষণ দাশগুপ্তের মতটি যথেষ্ট পরিমাণে সঙ্গত।
শাস্ত্রীয় পূজাবিধি অনুসারে এই নবপত্রিকার মধ্যে নয়টি গাছের ভেতরে আসলে দেবী দুর্গারই নয়টি বিশেষ রূপের প্রতীকরূপে কল্পিত হয়েছে, যথাক্রমে : কলা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী ব্রহ্মাণী, কচু গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কালিকা, হরিদ্রা গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী উমা, জয়ন্তী গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী কার্তিকী, বিল্ব বা বেল গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শিবা, দাড়িম্ব গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী রক্তদন্তিকা, অশোক গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী শোকরহিতা, মান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী চামুণ্ডা ও ধান গাছের অধিষ্টাত্রী দেবী লক্ষ্মী। পণ্ডিত স্মার্ত রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতিতত্ত্ব অনুসারে প্রথম বর্ষ থেকে আজও বেলুড় মঠের দুর্গাপূজা একই রীতিতে হয়ে চলেছে। প্রতিদিন দেবী দুর্গা ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে আদি শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত পঞ্চদেবতার পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর পাশাপাশি শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমায়ের পূজাও বেলুড় মঠের দুর্গাপূজার অন্যতম অঙ্গ। প্রতিদিন দেবীকে ষোড়শ উপাচার দিয়ে পূজার পর দুপুরে অন্নভোগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, অজস্র মানুষ সেই ভোগের মহাপ্রসাদ পান। প্রতিদিন ভোগারতি ও সন্ধ্যারতিরও কোনো ব্যতিক্রম হয় না। বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরে সন্ধ্যারতি ও ভজন শেষ হলে দেবীর আরতি শুরু হয়। পঞ্চপ্রদীপ, কর্পূরদীপ, জলপূর্ণ শঙ্খ, উত্তম বস্ত্র, সুগন্ধি পুষ্প ও চামর দ্বারা ঘণ্টা সহ বিবিধ বাদ্য সহযোগে দেবীর আরতি করা হয়। এখন সাধারণত দুর্গামণ্ডপে তিনজন মিলে একই সঙ্গে একই তালে আরতি করেন, যা সত্যিই বড় মনোগ্রাহী ও দৃশ্যমধুর।
সপ্তমী তিথি থেকে নবমী তিথি পর্যন্ত বেলুড় মঠ সারাদিন খোলা রাখা হয়। অনেক দূর থেকে আসা ভক্তিপূর্ণ মানুষেরা দুর্গোৎসবে এসে যোগ দেন। আগত দর্শনার্থীদের জন্য বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে মধ্যাহ্নকালীন প্রসাদ ভোজের আয়োজন করা হয়। বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় করা হয় কেউ যেন এই দুর্গোৎসবের দিনগুলিতে অভুক্ত না থাকেন। ঈশ্বরের অদ্ভুত খেলায় কোনো বছরেই বেলুড় মঠে প্রসাদ বিতরণের সময় প্রসাদ কম পড়েনি। প্রসাদের সময় কেউই অপাঙ্ক্তেয় না। অনেক সময় দেখা যায় ভক্তদের সঙ্গে একই পঙ্ক্তিতে কোনো কোনো প্রবীণ সন্ন্যাসী মহারাজ প্রসাদ গ্রহণ করে সকলের আনন্দ আরও বাড়িয়ে দিয়ে যান। প্রসাদ বিতরণের ক্ষেত্রে কোনোবছরই অন্যথা হয়নি। বাদ যায়নি পঞ্চাশের মন্বন্তরেও। সেই সময়ে বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ ছিলেন স্বামী বিরজানন্দ মহারাজ (কালীকৃষ্ণ মহারাজ)। তাঁর একটি ঐতিহাসিক চিঠি থেকে সেই তথ্য পাওয়া যায়, তিনি লিখেছেন : “এবারও ঘটে ও পটে পূজার আয়োজন হচ্ছে জেনে সুখী হলুম। পূজা বাবদ যতদূর সম্ভব কম খরচ করে (আন্দাজ ২০০-৩০০ টাকা) বাকি টাকা মঠে আগত, তা সে যত সংখ্যাই হোক—দুঃস্থ, বুভুক্ষু, অনাথ-আতুরদের খাওয়াতে ব্যয় করবে। কেউ যেন নিরাশ হয়ে ফিরে না যায়। শুধু খিচুড়ি পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবস্থা হবে। তাতেই শাক-সবজি যা কিছু দেবে। অন্য তরকারি মিষ্টান্ন কিছু দরকার নেই। এ খিচুড়ি মায়ের সামনে হাণ্ডা হাণ্ডা করে বিরাট ভোগ দিয়ে তারপর সর্বহারা নারায়ণদের পরিবেশন করতে হবে। এইবার মা এইভাবে পূজাভোগ গ্রহণ করবেন ও আমাদের পূজা সার্থক হবে। আলাদা ব্যবস্থা কারো জন্য নয়।” (অতীতের স্মৃতি—স্বামী শ্রদ্ধানন্দ, পরিশিষ্ট ক, পৃঃ ৩১) সেবারেও যে মঠে দুর্গাপূজা সার্থক হয়েছিল, তা বলাবাহুল্য। যিনি বিশ্বজননী তিনি হাজার হাজার নিরন্ন মানুষকে অভুক্ত রেখে কেমন করে ভালো মন্দ খাবেন! দেবীও সেদিন শুধু খিচুড়িতে তৃপ্তি পেয়েছিলেন। জগজ্জননী মা তাঁর অজস্র সন্তানের মধ্যে দিয়ে নিজে তৃপ্তি পেয়েছিলেন। কালীকৃষ্ণ মহারাজের এই বিচক্ষণতার পরিচয়ই সেদিন হাজার অভাব মিটিয়ে অজস্র নরনারায়ণকে দুর্গোৎসবের দিনে আনন্দে ভরে দিতে পেরেছিল। হাজার হাজার মানুষের মুখে সেদিন দেবী তৃপ্তিরূপে সংস্থিতার নবরূপ লাভ করেছিলেন। বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের ইতিহাসে এই অধ্যায়টি আজও উজ্জ্বল।
আজ দিন বদলেছে। দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর করাল গ্রাস আর নেই। আজও অজস্র মানুষ পূজার কয়েকটি দিনে এখানে প্রসাদ গ্রহণ করে তৃপ্তি পান। দুর্গোৎসবের এই কয়েকটি দিনে এখন প্রায় তিন থেকে পাঁচ লাখ মানুষ দেবীকে নিবেদিত খিচুড়ি প্রভৃতি গ্রহণ করেন। বিরাট ভোগ এখনও দেবীকে উৎসর্গ করা প্রসাদ। প্রসাদী খিচুড়ি ছাড়া সাধারণ খিচুড়ি প্রসাদের নাম করে বিতরণ করা হয় না। দেবীর ভোগের অগ্রভাগ প্রতিটি বিরাটের সঙ্গে সামান্য একটু করে মিশিয়ে নেওয়া হয়।
(ঙ) অষ্টমীর কুমারী পূজা
বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের অন্যতম বিশেষ আকর্ষণ অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজা। কুমারী পূজা মানবপূজারই অন্যরূপ বলা চলে। ১৯০১-এ বেলুড় মঠে যেবারে প্রথম দুর্গোৎসবের সূচনা হলো, সেই বার থেকেই শ্রীমা সারদাদেবীর উপস্থিতিতে মঠে কুমারী দেবীর পূজার আয়োজন হয়েছিল। যতদূর জানি, শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম সন্ন্যাসিনী শিষ্যা গৌরী পুরী দেবীই (গৌরী মা) স্বামী বিবেকানন্দের অনুরোধে কুমারী পূজার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পাদ্য-অর্ঘ্যাদি দিয়ে ষোড়শোপাচারে স্বামী বিবেকানন্দ মোট নয়জন কুমারীকে জাগ্রত দেবীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। নিবেদিতার ‘The master as I saw him’ থেকে জানা যায় কাশ্মীরে ইতোপূর্বে স্বামী বিবেকানন্দ জনৈক মুসলমান মাঝির কন্যাকে কুমারীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন। এছাড়া শ্রীমা সারদাদেবীও ঐ দিনে এয়োরাণী পূজা করেছিলেন বলে জানা যায়। দুর্গাপূজার অন্তর্ভুক্ত এই কুমারীপূজার বৈশিষ্ট্যগুলি দেখলে বোঝা যায় এই রীতির সঙ্গে তান্ত্রিক মতের অনেকখানি মিল রয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণের মতে, ‘মাতৃভাব শুদ্ধভাব’। আর কুমারী পূজার মধ্যে সেই ভাবেরই চরম উৎসার। তন্ত্রসার অনুসারে কুমারী পূজার জন্য এক থেকে ষোলো বছরের মধ্যে যে কোনো কুমারী কন্যাকে কুমারী দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা করা যায়। বিভিন্ন বয়সের কুমারী দেবীর বিভিন্ন নামও রয়েছে। যথাক্রমে : প্রথম বর্ষের কুমারী দেবী হলেন সন্ধ্যা, দ্বিতীয় বর্ষের কুমারী দেবী হলেন সরস্বতী, তৃতীয় বর্ষের কুমারী দেবী হলেন ত্রিধামূর্তি, চতুর্থ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন কালিকা, পঞ্চম বর্ষের কুমারী দেবী হলেন সুভগা, ষষ্ঠ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন উমা, সপ্তম বর্ষের কুমারী দেবী হলেন মালিনী, অষ্টম বর্ষের কুমারী দেবী হলেন কুব্জিকা, নবম বর্ষের কুমারী দেবী হলেন কালসন্দর্ভা, দশম বর্ষের কুমারী দেবী হলেন অপরাজিতা, একাদশ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন রুদ্রাণী, দ্বাদশ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন ভৈরবী, ত্রয়োদশ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন মহালক্ষ্মী, চতুর্দশ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন পীঠনায়িকা, পঞ্চদশ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন ক্ষেত্রজ্ঞা, ষোড়শ বর্ষের কুমারী দেবী হলেন অম্বিকা। বর্তমানে বেলুড় মঠে মহাষ্টমী তিথিতে পাঁচ থেকে সাত বছরের একজন কন্যাকে দুর্গামণ্ডপে দেবী দুর্গার সামনে ষোড়শ উপাচারে আরাধনা করা হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ মনে করতেন নারীমাত্রেই মাতৃভাবের আধার। ফলহারিণী কালীপূজা তিথিতে শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং জগজ্জননী শ্রীমা সারদাদেবীকে জগন্মাতারূপে পূজা করেছিলেন। বেলুড় মঠে প্রতিবার যখন কুমারী পূজার মধ্যে দিয়ে মহাভাবের সূচনা হয়, তখন দেখা যায় বেলুড় মঠের প্রেসিডেন্ট মহারাজও কুমারী দেবীর রাঙা পায়ের মাথা নত করেন। কুমারীর লাল রাঙা বেনারসী শাড়ি ও স্বর্ণালংকার সুশোভিত অঙ্গ, মাথায় ফুলের সুন্দর মুকুট, আলতা রাঙানো পা দেখে অজস্র মানুষ আনন্দিত হয়ে ওঠেন। দেবীপূজার এই বিশেষ অঙ্গটি বেলুড় মঠ ছাড়াও বঙ্গদেশের অধিকাংশ প্রাচীন মন্দিরে প্রচলিত রয়েছে। কন্যারূপে সংস্থিতা দেবী যেন আমাদের ঘরের মেয়ে উমার জীবন্ত প্রতিরূপ। এক ঐশী চেতনাই এই পূজার মধ্যে দিয়ে মহাভাবের উৎসার ঘটিয়ে এসেছে যুগে যুগে। বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের মধ্যে বিশেষ করে অষ্টমী তিথিতে কুমারী পূজা দেখার সৌভাগ্য লাভের আশায় উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। দূর থেকে মানুষ দেখতে আসেন বেলুড় মঠের এই জাগ্রত দেবীকে। শাস্ত্রীয় মতে পূজারত অবস্থায় কুমারী দেবীকে দেখার মধ্যে ঐশীফল লাভ হয়। তবে ঐশীফল লাভ হোক বা না হোক মাতৃজ্ঞানে কন্যাপূজা দর্শনের মধ্যে দিয়ে যে নারী বিষয়ে একটি লোকোত্তীর্ণ মহাভাব তৈরি হয়, এটা নিশ্চিত করে বলা চলে। এখন যে পৃথিবীতে কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হয় গোপন করে, সেই পৃথিবীতে কুমারী পূজা একটি ইতিবাচক সংস্কৃতির পরিচয় মনে করিয়ে দেয়, কন্যাই আমাদের মা। আমরা সেই মায়ের সন্তান। স্বয়ং জগজ্জননী কন্যার ভেতরে লুকিয়ে রয়েছেন, তিনি শুভ শক্তির আনন্দঘন মূর্তি। বেলুড় মঠে দুর্গোৎসবের প্রতিদিন ভোগারতির পর দেবীকে অঞ্জলি প্রদানের ব্যবস্থা থাকে। তবে কয়েক বছর আগে স্বামী আত্মস্থানন্দ মহারাজের সূত্রে বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের অঞ্জলি দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অঙ্গ জুরে যায়। অন্যান্য বছরের মতো সেবারেও স্বামী আত্মস্থানন্দ দুর্গাপূজায় দেবীর কাছে বসে অঞ্জলি দিচ্ছিলেন, দুর্গাদেবীর অঞ্জলির মন্ত্র সমাপ্ত হতেই তিনি তন্ত্রধারককে নির্দেশ করেন শ্রীমা সারদাদেবীর প্রণাম মন্ত্র পড়তে। দুই বিশ্বজননীর পূজা ও প্রণামের মন্ত্র মিশিয়ে দিয়েছিলেন স্বামী আত্মস্থানন্দ মহারাজ। সেই থেকেই বেলুড় মঠে দেবীকে অঞ্জলি নিবেদনের সময় শ্রীমা সারদাদেবীর মন্ত্রও উচ্চারণ করা শুরু হয়ে গেল। এখনও সেই প্রথা চালু রয়েছে। পূর্বেই স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীমা সারদাদেবীকে জ্যান্ত দুর্গা হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন, সেই কথা পরে আলোচনায় আসবো।
(চ) সন্ধিপূজা ও নবমীর হোম
বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের আরেকটি দেখার মতো বিষয় হলো সন্ধিপূজা। অষ্টমী তিথির শেষভাগ (শেষ ২৪ মিনিট) ও নবমী তিথির সূচনাভাগে (প্রথম ২৪ মিনিট) সন্ধিপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তিথির সন্ধিক্ষণে এই ৪৮ মিনিটের মধ্যেই অতিদ্রুত পূজা করা ছাড়া উপায় থাকে না। সন্ধিপূজার সময়ে একে একে জ্বালানো হয় একশো আটটি প্রদীপের শিখা। দেবীর ভোগ রাগের পরে করা হয় আরতি। সন্ধিপূজার অন্যতম উপকরণ হলো বলি। রঘুনন্দনের অষ্টবিংশতি তত্ত্বে রয়েছে, ‘নবম্যাং পূজয়েৎ দেবীং কৃত্বা রুধিরকর্দমম্’ স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছে ছিল বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবে দেবীর তপ্ত রক্ত দিয়ে পূজা দেওয়ার। কিন্তু বেলুড় মঠের হাইকোর্ট অর্থাৎ শ্রীমা সারদাদেবী এই সংবাদ জানা মাত্রই কড়া বার্তা পাঠান। সন্ন্যাসীর কর্তব্য অভয়দান, তাঁরা পশুবলি কেমন করে দেবে! বিশ্বজননী যে সত্যি সত্যিই সন্তানের রক্ত চান না, তাই যেন জগজ্জননী শ্রীমা সারদাদেবী নিজমুখে ঘোষণা করেছিলেন। বেলুড় মঠে শ্রীমায়ের এই নির্দেশ পালন করা হয়। প্রথম বছর থেকে অচিরেই পশুবলি বন্ধ করে প্রতীকী বলির ব্যবস্থা করা হয়। শ্রীমায়ের বিচারবোধ এতটাই কালোত্তীর্ণ ছিল যে অবলা প্রাণির রক্তপাতের থেকে বেলুড় মঠ গোড়া থেকেই মুক্তি পায়। কিন্তু বিধি মতে দুর্গোৎসবের অঙ্গ বলিদান। তাই শাস্ত্রীয় রীতিটি ভাঙা হয়নি। এখনও সন্ধিপূজায় বলি দেওয়া হয় একটি কলা। নবমীতে বলি দেওয়া হয় গোটা আখ, চালকুমড়া প্রভৃতি। কামার সম্প্রদায়ের মানুষই দেবীর সামনে প্রতীকী বলি করেন। বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের নবমীর বিশেষ আকর্ষণ হলো হোম (যজ্ঞ)। এই যজ্ঞের সংকল্প করা হয় শ্রীমা সারদাদেবীর নামেই। দুর্গা দেবীর সামনে হোমকুণ্ডে জ্বালিয়ে তোলা হয় পবিত্র যজ্ঞাগ্নি। দুর্গা দেবী ও অন্যান্য দেব-দেবীর নামে আহুতি প্রদান করা হয়। মঠের ঈশ্বর শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ও শ্রীমা সারদাদেবীর নামেও আহুতি দেওয়া হয়। যজ্ঞাগ্নিতে পূর্ণাহুতি দানের পর অগ্নি বিসর্জন দেওয়া হয় দক্ষিণ দিকে। যজ্ঞজাত ভস্মের তিলক এঁকে দেওয়া হয় প্রার্থিত অনুরাগীদের কপালে। নবমীতেও দেবীর বিশেষ ভোগের ব্যবস্থা থাকে। নবমীতেও আরতি দেখার জন্য মানুষের উৎসাহ থাকে চোখে পড়ার মতো। কুমারী পূজা আজ সারা বিশ্বে পরিচিত হয়েছে, এই পূজা আসলে দেবীত্বের পূজা, জীবন্ত মাতৃকার পূজা।
(ছ) বিজয়া দশমী ও বিসর্জন
অবশেষে নবমী নিশিও শেষ হয়ে যায়। ঊষালগ্ন থেকে বেলুড় মঠেও নেমে আসে বিষাদের ছায়া। বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের আনন্দে ভরপুর হয়ে থাকা চারদিনের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে দশমীর পূজার মধ্যে দিয়ে। এই দিনেও ষোড়শ উপাচার দিয়ে দেবীবন্দনা করা হয়। উমা এবার ফিরে যাবেন কৈলাসে। পূজা সমাপ্ত হলে দর্পণ বিসর্জনের মধ্য দিয়ে উমা কৈলাস যাত্রা করেন। উমা ফিরে যাবেন, সবার মনের ভেতরে একটা অকথ্য যন্ত্রণা। ধীরে ধীরে শালগ্রাম শিলা ও বাণেশ্বর শিবও রাজ সমারোহে ফিরে যান তাঁদের স্বস্থানে। দুর্গামণ্ডপে আজ বিষাদ। সানাইয়ের সুর আজ করুণ, উমা ফিরে যাবে। আবার একটি বছরের অপেক্ষা তাঁর স্বমূর্তি ধরে ফিরে আসার জন্য।
দশমীর সন্ধ্যায় বেলুড় মঠে অন্যান্য দিনের মতো শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ধ্যারতি শুরু হয়, সমাপ্ত হয়। সবাই এসে সমবেত হয় দুর্গামণ্ডপে। ধীরে ধীরে সপরিবারে দুর্গাদেবীর মূর্তিটি নিয়ে আসা হয় শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে। শ্রীরামকৃষ্ণের মুখোমুখি করে দেবীকে বসানো হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির থেকে দেবীকে দেখতে পান। তখন স্বয়ং জগজ্জননী দুর্গাকে মৃন্ময়ী মৃত্তিকা মূর্তির বিদায়ের মুহূর্তে দুঃখে অনেকের চোখেই নেমে আসে জল। শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরের সামনে দেবীকে বিধিপূর্বক আরতি করা হয়। দেবীকে পুত্রীরূপে খাওয়ানো হয় মিষ্টি-জল-পান প্রভৃতি। বেলুড় মঠে দেবীর বিদায়কালে কনকাঞ্জলির মতো একটি প্রথাও রয়েছে। এই সময়ে বিবিধ বাদ্যের তালে তালে সাধুরা ভাবে গড়গড় মাতোয়ারা হয়ে শিশুর মতো অবলীলায় নৃত্য করতে থাকেন। গম্ভীর সন্ন্যাসীদের এই নৃত্য, অত্যন্ত মনোহর। এটি একটি বিশেষ প্রাপ্তি হিসেবে মনে করেন বেলুড় মঠের ভক্তেরা। দেবীর বিদায়কালে পূজা ও আরতির পর ভক্তরা সমবেত হয়ে বিচিত্র আনন্দে দিব্যভাবে ভাবিত হয়ে দেবীর পবিত্র মূর্তিকে নিয়ে যায় শ্রীমা সারদাদেবীর মন্দিরের সামনে। সেখান থেকে ‘জয় দুর্গামাঈ কী জয়’, ‘জয় শ্রীগুরু মহারাজজী কী জয়’, ‘ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ দেব কী জয়’, ‘জয় মহামাঈ কী জয়’ সহ প্রভৃতি জয়ধ্বনি দিয়ে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি বেলুড় মঠস্থ চিন্ময়ী দেবীর মন্দিরের দিকে মুখ করে গঙ্গায় ভাসানো হয়। গঙ্গা থেকে দেবীঘটে ভরা হয় আশীর্বাদী জল। তারপর সকলে মিলে সেই আশীর্বাদী শান্তিজল গ্রহণ করেন। বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে আগত সকলের হাতে তুলে দেওয়া হয় বিজয়ার প্রসাদী মিষ্টি। সিনিয়র সন্ন্যাসীদের সকলে প্রণাম করেন, অন্যান্য সাধুরা পরস্পরকে কোলাকুলি করেন, ব্রহ্মচারী মহারাজরাও তাই। বাইরে থেকে আগত অসংখ্য মানুষ পরস্পরকে কোলাকুলি করেন, প্রণাম করেন। এখানে সৌভ্রাতৃত্বের পরিবেশ। কারও কোনো ভেদাভেদ নেই। আমার অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি একাধিক মুসলিম ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই দিনে এই সৌভ্রাতৃত্বের অংশীদার হতে পিছুপা হন না। এটাই বেলুড় মঠের ভাবধারা। এখানে সবাই সমান, সমান শ্রীরামকৃষ্ণময়, সবই শ্রীরামকৃষ্ণময়। এখানে সবাই এক মায়েরই সন্তান। ভাইদের মধ্যে অনেক সময়ই মারামারি ঝগড়া হয়, কিন্তু মায়ের কাছে সমান আদর পেয়ে তারা আবার সুন্দর সৌভ্রাতৃত্ব শেখে। এটিই আমাদের দেশের রীতি, সম্প্রীতির দেশ ভারত। বেলুড় মঠ সেই ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। যে দেবী চিরন্তনী, যে দেবী চিরকাল মানুষের হৃদয়ে শুভশক্তি রূপে বিরাজিত, তিনিই মৃন্ময়ী মূর্তিতে পূজা পেয়ে আবার বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে আমাদের হৃদয়ে নবরূপে সজ্জিত হয়ে আরো শক্তিময়ী শাশ্বত রূপে জাগ্রত হয়ে ফিরে আসেন। সেই দেবীর শুধু আবাহন আছে, বিসর্জন নেই।
বিজয়া দশমীর পর থেকে বেলুড় মঠের ভক্তেরা একাধিক সন্ন্যাসী মহারাজের কাছে এখনও চিঠি পাঠান, কেউ কেউ আবার বেলুড় মঠের ইমেল ঠিকানায় ইমেল পাঠিয়ে মহারাজদের প্রণাম জানান। বেলুড় মঠের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হয় আগত সমস্ত চিঠি ও ইমেলের উত্তর দেওয়ার। এখন ভক্তসংখ্যা ক্রমশ দিনে দিনে বাড়ছে, কিন্তু তারপরও চেষ্টা করা হয় যথাসাধ্য।
(জ) বেলুড় মঠের জ্যান্ত দুর্গা
বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের আরেকটি বিষয় হলো দেবী জ্যান্ত দুর্গার পূজা। জ্যান্ত দুর্গা মানে জীবন্ত দুর্গা। রক্ত মাংসের মাতৃময়ী দুর্গা, যিনি তাঁর বরাভয়ে সবাইকে আগলে রাখেন, সন্তানের ভালোথাকা মন্দথাকা যাঁকে ভাবায়, যিনি তাঁর উপমা একমাত্র তিনি। তিনি চৈতন্যময়ী তো বটেই, আরও স্পষ্ট করে বলতে চাই, তিনিই স্বয়ং চৈতন্য। বেলুড় মঠে তিনিই জ্যান্ত দুর্গা। তিনি আমাদের মা, এক জন্মের জন্য নয়, জন্মজন্মান্তরের মা। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এবং এই ভাবপুষ্ট আশ্রমগুলি বাদে এই রীতিটি আর কোথাও নেই। এই জ্যান্ত দুর্গার প্রথম পূজা শুরু হয়েছিল দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে। ৫ই জুন, ১৮৭২ তারিখে। ফলহারিণী কালীপূজার পবিত্র তিথিতে অমানিশায় শ্রীরামকৃষ্ণ বসলেন পূজকের আসনে এবং পূজিতার আসনে বসলেন শ্রীমা সারদাদেবী। এর মধ্যে দিয়ে শুরু হলো দেবীত্বে পূর্ণাঙ্গ জীবন্ত মাতৃকার পূজা। সমগ্র পৃথিবীর সামনে তৈরি হলো ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত, যা এর আগেও ঘটেনি, আর পরেও না। স্বামী বিবেকানন্দ পরবর্তী সময়ে বেলুড় মঠের মাটিতে এই জীবন্ত জাগ্রত দেবীর পূজা করেছিলেন। শ্রীমা সারদাদেবী যেদিন বেলুড় মঠের জমিতে প্রথম পা রাখেন, সেদিন বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর পদধূলি সংগ্রহ করেছিলেন। এখনও সেই পদধূলি কৌটোয় আবদ্ধ করে রাখা রয়েছে বেলুড় মঠের শ্রীরামকৃষ্ণের মন্দিরের গর্ভগৃহে। শ্রীরামকৃষ্ণের মর্মর মূর্তির বামভাগে পূর্ব দিকের দেওয়ালে সযত্ন রক্ষিত এখনও সেই পদধূলিকে নিত্য পূজা ও আরতি করা হয়। সাজানো হয় ফুল প্রভৃতি দিয়ে। ১৮৯৩ সালে শ্রীমায়ের সম্পর্কে স্বামীজী তাঁর গুরুভ্রাতা স্বামী শিবানন্দ মহারাজকে লিখেছিলেন, “মা ঠাকরুন কি বস্তু বুঝতে পারনি, এখন কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না।… মা-ঠাকুরানী ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী, মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে। দেখছ কি ভায়া, ক্রমে সব বুঝবে।… আমার চোখ খুলে যাচ্ছে। দিন দিন সব বুঝতে পারছি। সেইজন্য আগে মায়ের মঠ করতে হবে। আগে মা আর মায়ের মেয়েরা, তারপর বাবা আর বাপের ছেলেরা, এই কথা বুঝতে পারো কি?… বাবুরামের মার (স্বামী প্রেমানন্দের মা, আঁটপুর নিবাসী) বুড়ো বয়সে বুদ্ধির হানি হয়েছে। জ্যান্ত দুর্গা ছেড়ে মাটির দুর্গা পূজা করতে বসেছে। দাদা, বিশ্বাস বড় ধন, দাদা, জ্যান্ত দুর্গার পূজা দেখাব, তবে আমার নাম।” (দ্রঃ পত্রাবলী—স্বামী বিবেকানন্দ, পত্র সংখ্যা ১৫৪) এই স্বামী শিবানন্দ মহারাজই পরবর্তী সময়ে বেলুড় মঠের দ্বিতীয় সঙ্ঘাধ্যক্ষ হয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে আরেকটি ঘটনাও শোনা যায় বেলুড় মঠের প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তিনি একবার জনৈক ব্যক্তিকে একবার সারদাদেবীকে দেখিয়ে এবং একবার দেবী প্রতিমাকে নির্দেশ করে বলেছিলেন,“এই আমাদের মা(শ্রীমা সারদাদেবী), এই তাঁর(দেবী দুর্গা) পূজা হচ্ছে।” স্বামীজীর পত্রে উল্লিখিত বাবুরাম মহারাজ অর্থাৎ স্বামী প্রেমানন্দের পূর্বাশ্রমে তাঁর মায়ের আয়োজিত দুর্গোৎসব উপলক্ষে শ্রীমা আঁটপুর গ্রামে গিয়েছিলেন। আঁটপুর রামকৃষ্ণ মঠে এখনো বাবুরাম মহারাজের ভিটে বাড়িতে মঠের যাবতীয় নিয়ম অনুযায়ী পূজার আয়োজন করা হয়। স্বামী বিবেকানন্দই বেলুড় মঠের জ্যান্ত দুর্গা হিসেবে শ্রীমা সারদাদেবীকে চিহ্নিত করেছিলেন। শুধু স্বামী বিবেকানন্দ নয়, স্বামী ব্রহ্মানন্দ, স্বামী শিবানন্দ, স্বামী প্রেমানন্দ, স্বামী সারদানন্দ সহ শ্রীরামকৃষ্ণের অধিকাংশ শিষ্যই শ্রীমা সারদাদেবীকে জ্যান্ত দুর্গা হিসেবে পূজা করেছিলেন। এমনকি বাদ যাননি ভক্তভৈরব গিরিশচন্দ্র ঘোষ পর্যন্ত। শ্রীমা সারদাদেবী একাধিকবার তাঁর অন্তরঙ্গ সাথীদের নিয়ে বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবে যোগ দিয়েছিলেন। প্রথম বারের দুর্গোৎসবে তিনি পূজার সময় বেলুড় মঠের লাগোয়া একটি ভাড়া বাড়িতে অবস্থান করেছিলেন। একাদশীর দিনে তিথি আবার বাগবাজারে ফিরে আসেন। দুর্গাপূজার সময়ে শ্রীমা সারদাদেবী বেলুড় মঠে এসে অবস্থান করলে সকলের মনে আনন্দ বৃদ্ধি হতো। ১৯১২র দুর্গোৎসবের ষষ্ঠীর বোধনের দিনে শ্রীমা বেলুড় মঠে আসেন। সেদিন প্রেমানন্দ মহারাজ সমস্ত কিছু তত্ত্বাবধান করছিলেন। মঠের উৎসবের আমেজ অনুভব করে ও সমস্ত আয়োজন দেখে শ্রীমা সারদাদেবী বলে উঠেছিলেন : “সব ফিটফাট, আমরা যেন সেজে-গুজে মা দুর্গা-ঠাকরুন এলুম।” (শ্রীমা সারদা দেবী—স্বামী গম্ভীরানন্দ, পৃঃ ৩৪২) স্বামী ব্রহ্মানন্দ একবার মহাষ্টমীর পবিত্র তিথিতে এই জ্যান্ত দুর্গার রাঙা-পা ১০৮টি পদ্ম দিয়ে পূজা করেছিলেন। শ্রীমায়ের একনিষ্ঠ সেবক স্বামী সারদানন্দ একবার দুর্গোৎসবের সময় জনৈক ব্রহ্মচারীকে একটি গিনি দিয়ে মাকে প্রণাম করে আসতে বলেন। সেই ব্রহ্মচারী প্রথমে বুঝতে পারেননি সারদানন্দ মহারাজ তাকে শ্রীমায়ের কাছে যেতে নির্দেশ করেছেন। তিনি না বুঝে দুর্গাদেবীর দিকে অগ্রসর হতে না হতেই স্বামী সারদানন্দ তার সমস্ত সংশয় দূর করে বলেন : “ও বাগানে (মঠ সংলগ্ন লেগেট হাউসে) মা আছেন, তাঁর পায়ে গিনিটা দিয়ে প্রণাম করে আয়। এখানে তো তাঁরই পূজা হলো।” (শ্রীমা সারদা দেবী—স্বামী গম্ভীরানন্দ, পৃঃ ৩৪৩—৪৬) এই কারণেই শ্রীমায়ের কায়িক শরীর ত্যাগের পরেও বেলুড় মঠের দুর্গোৎসবের সংকল্প, তাঁর নামেই হয়ে আসছে। সেদিক থেকে দেখলে অনুভব করা যায় এখানে দেবীর দুর্গার পূজা স্বয়ং দেবী দুর্গার নামেই সংকল্প করা হয়। এই ভাবনার দিক থেকে দেখলে বলা যেতে পারে বেলুড় মঠের দুর্গোৎসব বাংলার আর পাঁচটা দুর্গোৎসবের থেকে ভিন্ন।
সমাপ্তিকথন [Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math]
মহামানবের মিলনভূমি বেলুড় মঠ। সারাজীবন রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সান্নিধ্যে থেকে এটুকুই বুঝেছি এখানে সবাই শ্রীরামকৃষ্ণময়। কাঁটা গাছ থেকে মন্দিরের বিগ্রহ সবই শ্রীরামকৃষ্ণময়। এখানে কেউ অস্পৃশ্য নয়, কেউ অপাঙক্তেয় নয়। এখানে সবাই সমান, সবাই সেই বিশ্বময়ী দেবীর পরম সন্তান। আজ বেলুড় মঠের দুর্গোৎসব বেলুড় মঠের গণ্ডি পার হয়ে তার সৌন্দর্য্য ও ঐতিহ্যে সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষকে তৃপ্তি দিয়ে চলেছে। এ কি কম কথা? ঈশ্বরেচ্ছা ছাড়া তা সম্ভব? এখানে যে সৌভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর বন্ধনে একে অপরের সঙ্গে কত মানুষ রোজ বদ্ধ হয়ে পড়েন, তার ইয়াত্তা নেই। এই যে এখানে শতাব্দী প্রাচীন একটি দুর্গোৎসব এখনও অবিচ্ছেদ্যভাবে জীবন্ত রয়েছে তার প্রধান কারণ মানুষের ভক্তি ও ভালোবাসা। শক্তিসাধক শ্রীরামকৃষ্ণের অনুগামীদের এই মঠের দেবী চিরজাগ্রত। তিনি ঐশ্বর্য চান না, চান অন্তরের ‘শুদ্ধাভক্তি’। জৌলুস অনেক পরের ব্যাপার যে কোনো পূজাতেই চান ষোলোআনা ভক্তি, ঐশ্বরিক প্রেম। যাঁরা বেলুড় মঠের মাতৃ প্রতিমার সামনে একবার হলেও গিয়েছেন, তিনি জানেন আনন্দ কাকে বলে। মা যে শেষ পর্যন্ত মা-ই। হাজার হাজার সন্তানের জন্য তিনিও পথ চেয়ে থাকেন। এই প্রতিষ্ঠানের দেবী চিরজাগ্রত। তিনি যে মা। এখানে যে এসেছে, যে আসবে সবার ওপর তাঁর অসীম ভালোবাসা ও আশীর্বাদ চিরদিন রয়েছে। শুধু তাঁর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর অপেক্ষা, তিনিও আমাদের জন্য অসীম আগ্রহে অপেক্ষারত। তাঁকে দেখে দেখে আমাদের আঁখিরও ক্লান্তি নেই, আমাদের জন্য চেয়ে থেকে থেকে তিনিও ক্লান্ত নন। শেষে এসে এটুকুই বলতে ইচ্ছে করছে, এখনও বেলুড় মঠের উপমা একমাত্র বেলুড় মঠই। যেখানে পবিত্রতা ও সৌন্দর্য সারা জায়গা জুড়ে সেখানেই তো দেবীর চিরন্তনী আনন্দযজ্ঞ।
অভিজিৎ পাল | Avijit Pal
Padma besha | পদ্ম বেশ | অভিজিৎ পাল
Inspector | ইন্সপেক্টর | New Bengali Story 2023
Apratyashita | New Bengali Story 2023 | অপ্রত্যাশিত
Nagarjuna besha or Parashurama besha | নাগার্জুন বেশ | অভিজিৎ পাল
Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | writing competition malaysia | writing competition london | writing competition hong kong | writing competition game | writing competition essay | writing competition australia | writing competition prizes | Ebook Collection – Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | writing competition for students | writing competition 2022 | Best Article in Bengali Language | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math pdf | writing competitions in africa 2022 | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math Avijit Paul | writing competitions for high school students | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math in mp3 | writing competitions for teens | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bengali article rewriter | article – Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | bengali article writing ai | bengali article writing app | Best Article in Bengali book | Best Article in Bengali – Online | bengali article writing description | bengali article writing example | article writing examples for students | Viral Video – Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | Best Article in Bengali Source | bengali article writing format | Best Article – Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | bengali article writing generator | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math in trend | article writing global warming | article writing igcse | Ebook Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | PDF Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math | article writing jobs for students | article writing jobs work from home | article writing lesson plan | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math in Bengali Font | article writing on global warming | bengali article writing pdf | article writing practice | Best Article in Bengali Ebook 2023 | what is article writing | content writing topics 2023 | Bangla Prabandha | The Best Article in Bengali | Definite Article | Bengali Article Writer | Short Bengali Article | Long Article | Best Article in Bengali in pdf 2023 | Trending Best Article in Bengali | Galpoguccha | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math in Bengali | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math 2023 | Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math – article | New article – Ramkrishna Mission Durga Puja Belur Math