Online Archive Story – Shawkat Noor
সংসদ ভাই – শওকত নূর
এখানে এ সময়টুকুই আমার অতি ঘোরের মধ্যে কাটে। মাথায় ঘুরানি, চোখে ঝাপসাভাব ভর করে। নিজেকে প্রায়শ অতি ক্ষুদ্র, বোধহীন, তাৎপর্যহীন, তামাশাকর লাগে, সীমাবদ্ধ গণ্য হয়। চুপচাপ তা মেনে নিই, আবদ্ধ থাকি। এখানে মানে হচ্ছে এক ড্রইং রুমে। যে সময়ের কথা বয়ান হচ্ছে, সে সময়ে এতে আলো-আঁধারি আবহ থাকে। সূর্যাস্তক্ষণ। কাহিনীস্থলের স্বত্বাধিকারী সংসদ ভাই খাটো এক টেবিলের ওপর চিৎ-সটান শুয়ে দু’পা উঁচিয়ে ওদিকের দেয়ালে ঠেকিয়ে তাদেরকে দুর্দাম নাড়াতে নাড়াতে ক্ষুদ্রান্ত চাপে উচ্চশব্দে উপর্যুপরি বেশ কয়েক কিস্তি বায়ু নিষ্ক্রান্ত করতে থাকেন। আমি দরজার ওপাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে এ লজ্জা- অরুচি-তামাশাকর পর্বটি শেষের অপেক্ষায় পরম উৎকণ্ঠায় তার পরিহাস-কাণ্ডগুলো একের পর এক পর্যবেক্ষণ করে চলি।
মাঝারি আকৃতির গোলগাল ভারী ফর্সা মুখমণ্ডল ঝাঁকড়াচুল বাঁকা নাক কুঁজো পিঠ খাটো গ্রীবা খুদে চোখ সংসদ ভাইর মাথার পাশেই প্রশস্ত টি-টেবিলের ওপর বই-পুস্তকের উঁচু স্তূপ। ছোট বড়, বিখ্যাত, অবিখ্যাত নবীন প্রবীণ জীবিত- প্রয়াত নানান ধরনের লেখক, কবি প্রাবন্ধিকের মলাটস্থ লেখার প্রারম্ভিক দু’এক লাইন পড়ে পড়ে তিনি শ্লীল, অশ্লীল ভাষায় তীব্র কটাক্ষের সাথে অদ্ভুত কণ্ঠে অট্টহাসি হাসেন। সেইসাথে পুস্তকটি প্রবল হ্যাঁচকায় ছুঁড়ে মারেন বিপরীত দেয়ালে। বাড়ি খেয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়ে পুস্তক- চিৎ, কাৎ, উপুড় হয়ে। যেগুলোর প্রচ্ছদ ফ্ল্যাপের ছবি বেরিয়ে যায়, তা যত বড় মাপের কবি সাহিত্যিক, দার্শনিক, প্রাবন্ধিকেরই হোক, সংসদ ভাই ঘাড় বাঁকিয়ে একবার হলেও সেদিকে ভেংচি কাটবেন, দাঁত বিজলাবেন। অস্ফুট বিড়বিড় করতে থাকবেন।
ছুঁড়ে মারা ও কটাক্ষ পর্ব সমাপ্ত হলে শুরু হয় আমার কর্তব্য কাজ। বইগুলোকে মেঝে থেকে সযত্নে তুলে সযত্নে শেলফ এর যথাস্থানে পুনস্থাপনই আমার নিত্যকার কর্তব্য কাজ। কর্তব্য কাজ মানে হচ্ছে (আপাতত এ-ই, বলতে দ্বিধা নেই, তৎসঙ্গে সংসদ ভাইর কথা কাজে বুঝে না বুঝে হু হা জানানো) আমার বর্তমান স্বল্পবৈতনিক চাকরি। জীবিকার তাগিদ বলতে কথা – ফলে পুরো প্রহসন পর্বটি তাই আমাকে অতি বিনয় ও ধৈর্যের সাথে অতিক্রম করে যেতে হয়। যাচ্ছি নিয়মিতই।
আজকের সদ্য সমাপ্ত প্রহসন পর্বে তার পাঠকৃত বিভিন্ন পুস্তকের লাইন ও তৎসঙ্গে ছুঁড়ে দেয়া কটাক্ষগুলোর উপস্থাপন এ কাহিনীর মৌলিক উপজীব্য সমূহের অন্যতম বিধায় তাদের উল্লেখ জরুরি গণ্যে তারা এক্ষুনি নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তারা নিম্নরূপ:
পুস্তক পাঠ – ১: রিক্সা থেকে নেমেই ভীষণ হকচকিয়ে গেলেন মোতাহার আলী সাহেব।
কটাক্ষ – ১: হাঃ হাঃ হাঃ! হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ! আ হা হা! কী লাইনের লাইন! ইস! কী সাহিত্যের অভ্যুদয়! বাস থেকে নেমেই, হেঃ! হকচকিয়ে গেলেন ব্যাটা মোতাহের! হেঃ! ব্যাটা মোতাহেরের কলমী জনক! কলম হস্তে যথাচিন্তা মস্তিষ্কে আস্ফালিত হয়, তথার প্রসবন ঘটালেই বুঝি লেখক হওয়া গেল! হেঃ! আমার কলম আর হস্ত বিদ্যমান, আমি লিখি; অত-এব, আমি লেখক! হেঃ! লেখক!
পাঠ – ২: আমরা যখন নদীর তীর ধরে হাঁটছিলাম, মধুসূদন তখন নৌকো করে প্রায় নদীর ওপারে পৌঁছে গেছে।
কটাক্ষ – ২ : হেঃ! নদীর তীর ধরে হাঁটছিলাম, আর আরেকজন তখন নদীতে নৌকা বাইচ মারাচ্ছিল! এ কোন লাইন হলো? আমার – – লিখেছে ব্যাটা আহাম্মুক। কলম হাতে নিলেই বুঝি লেখক হওয়া যায়! হেঃ! মধুসূদন, হেঃ! সংসদ ভাইর ভাষা ক্রমশ শ্রবণ-অযোগ্য হতে থাকে।
তৃতীয় পুস্তকটির পাতা উল্টে কিছুক্ষণ বিড়বিড় করলেন সংসদ ভাই; হুম- কী লিখেছে, কী লিখল, হুম– এ শালী লিখেছে—-এ জাতীয় বিড়বিড়ানি। তারপর উচ্চ-শব্দ পাঠ ধরলেন তিনি।
পাঠ – ৩: আনতারা আঁচলে চোখ মুছে উঠানে এসে দাঁড়াল। পুব আকাশে চেয়ে দেখল ঝলমলে গোল চাঁদ উঠেছে।
পাঠ শেষে আবারও কিছুক্ষণ বিড়বিড়ালেন সংসদ ভাই। ক’ সেকেন্ড চুপ থাকলেন। তারপর আচমকা যারপরনাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন।
কটাক্ষ – ৩: হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ! হুঃ হাঃ হাঃ হাঃ! গোলচাঁদ উঠেছে! গোলচাঁদ! চাঁদের আবার গোল অগোল! যত্তসব মোটা-মুণ্ডু গো মূর্খের দল! যত্তসব! ফুল, পাখি, আকাশ, চাঁন্দ, সমুদ্দুরকে কলমে প্রসব করলেই বুঝি লেখক হওয়া গেল! ফালিচাঁদ গোলচাঁদ বললেই লেখক হওয়া চলল! হেঃ! সে কি ছেলের হাতের মোয়া! ধরলাম, চেটে খেলাম, কামড়ে খেলাম আর কম্ম সাবাড়! ক্রন্দসী আনতারা উঠানে দাঁড়াল, আকাশে উঠল গোলচাঁদ, আ হা হা! আর আমি লেখক বনে গেলাম। আহাম্মুক আর বলে কাকে!
প্রায় ঘণ্টা খানেক বইপত্র ঢিলাঢিলির পর সংসদ ভাই ক্লান্ত হয়ে কাজে ক্ষান্ত দিলেন। এবারে সোফায় গা এলিয়ে সন্মুখের টেবিলে পা তুলে দেন তিনি। প্রতিদিনের অভ্যাসমত টানা বার পাঁচেক কোথ দিয়ে সশব্দ বায়ূ ত্যাগ করেন। তারপর সোফার পেছন রেলিং এ হাতদুটো সটানে বিছিয়ে দিয়ে জোর দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললেন, বুঝলি মর্গান? এঃ! মর্গান নাম! বিড়াবিড়ালেন তিনি।
জি, ভাইয়া। বললাম আমি।
কী বুঝলি?
জি, কিছু না।
শোন তবে।
জি, বলুন।
কী বলব যেন?
ভাই, ওই যে কারা কবি,গল্পকার কিংবা সাহিত্যিকের জাতই নন, তারা লিখেছেন –, এ ধরনের কী সব বলছিলেন যে!
ও একজাক্টলি, আলবৎ মনে পড়ছে। তারা লিখেছে ওই – -, মুখের ভাষা কোন ব্যাপার নয়, বুঝলি মরগান? সব ভাষাতেই শ্লীল অশ্লীল থাকে। সব মিলিয়েই ভাষা, যেমন সব মিলিয়ে মানুষ।
জি, ভাই। কিন্তু ভাই, আপনি কি সব লেখকের সব লেখা পড়ে দেখেন, বিশেষ করে যাদের বইপুস্তক নিয়মিত ছুঁড়ে মারেন?
শোন মরগান, নিজের লেখা ছাড়া আর কারো লেখাই আজকাল আমার পাঠ হয়ে ওঠে না। মোদ্য কথা হচ্ছে পড়তে ইচ্ছা হয় না, তাই পড়ি না। বলতে চাচ্ছিস, কেন? উত্তর এক কথায় যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে, পাঠনুপযুক্ত। মানে পড়ার মতো নয়, বুঝলি?
কিন্তু ভাই, কতজন কত কিছু লিখছে, সবই কি অনুপযুক্ত?
নিশ্চয়ই, যে জিনিসে পাঠাকর্ষণ, পাঠ- মাহাত্ম্য নেই , তাকে কেন বলব পাঠানুরাগ সৃষ্টিকারী?
ভাই, আপনি–।
আহা মিনমিনাস নাতো। যুক্তি খাড়া করাবার প্রয়াস ঘটাস না। বললাম না, ওই আহাম্মুকরা লিখেছে আমার – -। যত্তসব!
তা ভাই, কেউই যদি ভালো না লিখে তবে পাঠকরা পড়ে কেন?
পাঠক! হাঃ হাঃ হাঃ! খামোখা ইস্যুতে হাসালি তুই আমাকে। হাঃ হাঃ হাঃ!
ভাই, এভাবে হাসছেন যে?
আহা, হাসির কথা বললে হাসব নাতো কি পান খেয়ে গান গাবো?
হাসির কথা?
কাদের তুই পাঠক বলছিস? তারা পাঠক, নাকি আমরা? এরা হচ্ছে ছাগলের পাল।
মানে?
মানে অতি সহজ। ছাগলকে তুই যা খেতে দিবি, সে তা-ই খাবে। ঘাসমাঠে দাঁড় করালে ঘাস খাবে, ধানমাঠে দাঁড় করালে ধান, আমগাছে ওঠালে আমপাতা, কাঁঠালগাছে দাঁড় করালে কাঁঠালপাতা, এমনকি পানের খেতে দাঁড় করালে পানপাতা চিবিয়ে দিব্যি স্বস্তিতে পিক ফেলে সুর তাল লয়ে ম্যা ম্যা ধরবে। সাধে তো আর কথার আবিষ্কার হয়নি, ছাগলে কী না খায়! হাঃ হাঃ হাঃ!
সংসদ ভাইর কথা শুনে যেমন হাসি পাচ্ছিল, তেমনই কষ্ট হচ্ছিল মনে। নিজেকেও মনে হচ্ছিল ছাগল ছাগল। যুক্তিবিদ্যার সংজ্ঞায় আমুল বিদ্ধ হওয়া ছাগল। কিন্তু কোন কষ্টসূচক শব্দ উচ্চারণের উপায় নেই। ছেলেবেলায় ছাগলের ডাক বেশ ভালো পারতাম। ইচ্ছে হচ্ছিল তাৎক্ষণিক কোনও ঘাসমাঠে গিয়ে পেটপুরে ঘাস চর্বণ করত ইম্যা ইম্যা করে মনের ক্ষেদ লাঘব করে আসি।
হঠাৎ ভাবনা কেটে চমকে উঠি। সংসদ ভাই ডাকছেন, কী রে মরগান, একেবারে চুপ মেরে গেলি যে? ভাবছিস, কোন সংজ্ঞার আওতাভুক্ত হয়ে কিসে বুঝি রূপান্তরিত হয়ে উঠলি, ঠিক বললাম কি না? নে, এবার ওই আবর্জনাগুলোর কাগজী তালিকা বানিয়ে নিত্যকার মতো যথাস্থানে গুছিয়ে রাখ। ক’জন কলিগ আসার কথা আছে। এরা হচ্ছে গিয়ে আরেক – – – -নির দল। শালারা যদি এসে এই এলেবিচ্ছিরি অবস্থা দেখতে পায় তো রাতের মধ্যে মোবাইলে মোবাইলে রটিয়ে দেবে আমি উন্মাদ হয়ে গেছি। আর কাল অফিসে পা দিয়েই সে কুরটনার কুপ্রভাব হাঁড়ে হাঁড়ে টের পাওয়া যাবে। এসব আক্রমণের একটাই কারণ, তা হচ্ছে আমি লেখক। – এর লেখক আমি। গাছ চিনিস তো, গাছ?
চিনবো না কেন?
বেড়াটি?
উহু।
বেড়াটি হচ্ছে এক ধরনের লতানো আগাছা। এর কাজ হচ্ছে যে গাছটাই মাথা উঁচু করবে, তার সাথেই বেড়াবেড়া করা। তুই মাটিতে ন্যুয়ে থাকলে সমস্যা নেই, মাথা উঁচালেই হলো! শুরু হয়ে যাবে বেড়াবেড়া।
মানে?
মানে হচ্ছে, বাড়তে না দিতে পেঁচিয়ে ধরা। থুপথাপ করে মাটির ধারেকাছেই আবদ্ধ রাখা। এই বেড়াটিরা নানা অবস্থায়, নানা ছদ্মবেশেই থাকে। আচ্ছা, তুই এসব বুঝবি না। যে কাজ করছিস, তা-ই কর। তলে তলে পড়িসতো আমার ছুঁড়ে মারা সব আবর্জনা। রতনে রতন চিনে শুওর চিনে কচু। বিড়বিড়ালেন সংসদ ভাই।
কিছুক্ষণ নীরবে কাটছে। ঘর গোছানের সাথে ভেতরে কথাও গোছাতে থাকি আমি। নানা ভাবনা ঘূর্ণিপাক দিচ্ছে মাথায়। মনও অশান্ত হয়ে উঠেছে। শেষ দুটো বই শেলফে স্থাপন করে মেঝেতে বসার ফাঁকে ফোস করে দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বললাম, ভাই, একটা কথা বলি।
কী কথা? হাই তুলে বললেন সংসদ ভাই।
আপনি তো বেশ প্রতিষ্ঠিত লেখক।
হুম, তাতে কী?
ভালোই কিছু স্বীকৃতি পেয়েছেন।
এসব ভণিতা রেখে আসল কথাটা বলে ফেল।
কারো লেখা না পড়েই কি এতদূর পৌঁছে গেলেন? নাকি আগে পড়তেন অন্যদের লেখা?
বটে! সংসদ ভাই হাতের কাছ থেকে দ্রুত একটা এ্যান্টাসিড বড়ি নিয়ে মুখগহ্বরে ছুঁড়ে দিয়ে চোখের মনি বড় করার চেষ্টা নিলেন।
এখন যেসব মন্তব্য করেন তা কি একেবারেই না পড়ে? তা নিশ্চয়ই নয়। না-ই যদি পড়েন তবে কী করে বোঝেন যে ওসব উপযুক্ত নয়?কেউ যদি ভালো না লিখে তো লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে না। আপনা থেকেই ঝরে যাবে। তা নিয়ে তো মাথাব্যথার কিছু নেই। গালিগালাজেরও কিছু নেই। সত্যিকারে কি অন্যের লেখা পড়েন আপনি?
পড়ি, তবে যৎসামান্য। ওটুকুতেই আসে মূল্যায়ন। এ্যান্টাসিড চিবানো ধরেছেন তিনি।
ওটুকু কি লেখকের চোখে পড়েন, নাকি পাঠকের চোখে?
ও বুঝেচি, জ্ঞান দিচ্চিস মনে হচ্চে। সাহস বেড়ে গেচে। দুঃসাহসে দুঃখ হয়। শেষের দু’বাক্য বিড়বিড় করলেন।
না ভাই, জ্ঞান দিচ্ছি না। ওটা দেবার মতো অপইচ্ছা নেই আমার। অযৌক্তিক দুঃসাহসও নেই।
শোন, এই জগৎটা হচ্ছে অতি পিচ্ছিল, বুঝলি? পা ফসকাতে সময় লাগে না। হু- হু -উ-ম। হাঃ!
ভাই, পিচ্ছিল মানে?
পিচ্ছিল মানে গুঁতাগুঁতির। গুঁতা খেয়ে প্রায়ই মন উতলা থাকে, অস্থির থাকে, ছটফটে হয়। যে যত বড়ই হই, গুঁতা খেয়ে পিছলে একান্ত নিজের পথেই ফিরে আসতে হয়। ফলে নিজেকে নিয়েই যত ভাবনা ব্যতিব্যস্ততা বাড়ে। নিজেকে হারিকেন জ্বালিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে হয়; কোন্ শালা আবার কোন্ সাদায় ব্ল্যাক স্পট তৈরি করে। ফলে অন্যকে নিয়ে ভাবনা, অন্যের লেখায় মনোযোগ দেবার মতো মনোরস খুব বেশি উৎসারিত হয় না। বড় সংকুচিত জগৎ। প্রায়ই শক্ত করে ভাবি, এ বদ-সংস্কৃতি পাল্টানো প্রয়োজন। কথায় আছে, আপনি আচরি ধর্ম শেখাও পরকে। মনে মনে শতবার নিজের শিং ছাটি, কিন্তু অন্য সব শিংভীতি আবারও আগের অবস্থায় ধাক্কে নেয় , বুঝলি? এত অত শিং, অথচ গয়রহ সবই মানব দরদী, সমাজ দরদী। বোঝা মুশকিল, কোনটা সত্যিকারে মানব দরদের নির্যাস, আর কোনটা জনপ্রিয়তা অর্জনের অস্ত্র মাত্র। আসলে কি জানিস? জানিস না আদৌ। জানলে এতসব প্রশ্ন করতে আসতি না।
কী জানি না, ভাই?
ওসব তোর মাথায় খেলবে না। তোর তো ছাগ-মাথা। ঘোরপ্যাঁচ ধরতে পারিস না।
বলুন তবু, শুনি।
এই ধর, তোর যদি প্রচুর অর্থ থাকে তো তুই অন্যদের দান করতে পারবি; আত্মার খুব বেশি কষ্ট হবে না। তোর যদি পর্যাপ্ত জ্ঞান থাকে, তাও তুই অকাতরে বিলাতে পারবি, আত্মা সন্তুষ্ট থাকবে। একইভাবে ব্যাপক খাদ্য থাকলে অপরকে খাইয়ে প্রসাদ মিলবে, আত্মার কষ্ট হবে না। আত্মার যত কষ্ট তা হচ্ছে ওই হ্যাঁচ্চু– – যত্তসব!
ভাই, কী যতসব?
আত্মার যত কষ্ট তা হচ্ছে ওই অপরের ভালোটাকে ভালো বলে মেনে নেয়া, স্বীকৃতি দেয়া। এ বড় কষ্টরে, বড় মুশকিলের!
ভাই, আপনি নিজে অপরের ভালো দিককে স্বীকার করেন ?
সে করি না করি, অন্তত বিকল্প হিসেবে খুঁতানুসন্ধানে আত্মপ্রসাদের পথাবিষ্কার করি না, বুঝলি? হ্যাচ্চু!
সংসদ ভাই আকস্মিক কথা থামিয়ে মোচড়ে শরীর ঘুরিয়ে আবারও জোরে কোঁথ দিয়ে সশব্দ বায়ু ত্যাগে ব্রতী হলেন। তড়িঘড়ি টানা বার করলেন কয়েক কিস্তি। কারণটা নিশ্চয়ই কলিং বেলের শব্দ। তার কলিগরা নির্ঘাত এরই মধ্যে এসে গেছেন। তিনি ধড়মড় উঠে বসলেন। হাত ইশারায় আমাকে পাশের কক্ষে গিয়ে চুপচাপ বসতে বললেন। বারগমনে নিষেধাজ্ঞা দিলেন। আমি তার কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি।
আমি ভেতর কক্ষের অন্ধকারে বসে ওদিকে দৃষ্টি ধরে রাখি। সংসদ ভাই সোফা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। ক’জন লোক হুড়মুড় করে ভেতরে ঢোকেন। দেখলাম সব ক’জনারই উদ্ভ্রান্ত চেহারাছবি। তারা সোফায় বসেই কথা পাড়েন। সবচে’ উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ছাপ যার চেহারাছবিতে, তিনি মাথা ঝুঁকে ড্যাবড্যাবে চোখে চেয়ে বললেন, তা ভাই, রাজনীতি নিয়া কী ভাবতাছেন?
রাজনীতি নিয়ে আর কী ভাবব? আমি তো আর রাজনৈতিক নই। সংসদ ভাই চোখ বুজে বললেন।
মানে বলতেছি, কারা নির্বাচনে জিতবে বলে আপনার মনে হয়? আর কারা হারবে বলে ভাবতেছেন? ইলেকশান তো ঘাড়ের উপর চইলা আসছে। আপনি লেখক মানুষ, কী ভাবতেছেন?
কঠিন প্রশ্ন। এ জন্যেই কি ঘটা করে আসা?
এ আর কী কঠিন? নিজের মনের কথা বলবেন, কঠিনের কী আছে? অবশ্য আমাদের আসাটা ভিন্ন কাজে। আপনার মনের কথা নিতে নয়। রাজনীতি নিয়া নানান তোলপাড় হইতেছে, তাই ভাবলাম -।
নিজের মনের কথা ব্যক্ত করাটাই সবচেয়ে কঠিন, বুঝলেন?
এ কেমন কথা?
এটাই কথা। আপনি কী বললে খুশি হবেন, কী বললে বেজার হবেন, আগে তা-ই বলুন। তারপর বলি রাজনীতির খবর। সংসদ ভাই চোখ বুজে বললেন।
বড় জটিল কথা বলতেছেন, ভাই।
কথা জটিল হলেও ব্যাখ্যা অতি সহজ।
মানে?
মানে হচ্ছে আগে আমাকে কিছু বিষয়ে নিশ্চয়তা দিন, পরে সব বলি।
কী বিষয়ের নিশ্চয়তা?
রাজনীতির বা ভোটের লড়াইটা তো এদেশে মূলত দুই দলের। উত্তর পার্টির আর দক্ষিণ পার্টির, নাকি?
হ্যাঁ, তাই তো!
আপনি যদি উত্তর পার্টির লোক হন তো আমি যদি বলি দক্ষিণ পার্টি হারবে, তবে আপনি খুশি হবেন।
অবশ্যই।
আবার আপনি যদি দক্ষিণ পার্টির লোক হন তো আপনি খুশি হবেন যদি আমি বলি উত্তর পার্টি হারবে, নাকি?
অবশ্যই।
প্রথম ক্ষেত্রে আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে হবে আপনি উত্তর পার্টির লোক হওয়া স্বত্বেও, আমার কথায় খুশি হওয়া স্বত্বেও, আজই এখান থেকে গিয়ে দক্ষিণ পার্টির লোকদের সাথে গোপনে যোগাযোগ করে আমি তাদের পরাজয়-সম্ভাব্যতা তথা তাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছি মর্মে তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলবেন না। এখন তো তথ্য প্রযুক্তির যুগ; চাইলে সশরীর দেখা না করেও অন্যের বিরুদ্ধে কথা লাগানো যায়। অনেকে তা করেও।
আর কী নিশ্চয়তা?
বলছি, আবার আপনি যদি দক্ষিণ পার্টির লোক হন, তবে আমি যদি আপনাকে বলি যে উত্তর পার্টিই হারবে, সেক্ষেত্রেও যে আপনি দক্ষিণ পার্টির লোক হওয়া স্বত্বেও, খুশি হওয়া স্বত্বেও, গোপনে উত্তর পার্টির লোকেদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের হেরে যাবার সম্ভাব্যতা ঘোষণা করায় আমার বরোটা বাজাবার চেষ্টা করবেন না, সে নিশ্চয়তাও দিতে হবে। বলুন আগে, কী বললে আপনি খুশি হবেন।
এতসব জটিল কথা বলতেছেন যে?
বলাচ্ছেন, তাই বলি। ভেবে দেখুন, অনেক যৌক্তিক কারণ আছে।
বুঝতে পারছি ভাই, মহাজটিল লোক আপনি।
আপনারা তো সরল। কতটা সরল? এই যে পাঁচজন একত্রে এসেছেন, একই দলের সমর্থক – হয় উত্তর, নয়তো দক্ষিণ। কথাও বলেন একই সুরে, যেন সবাই মিলে দেশটাকে, সমাজটাকে পরম উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবতা কী?
কী বাস্তবতা?
বাস্তবতা হচ্ছে- এই পাঁচজনই যদি উত্তর পার্টির হন, আর যদি পাঁচজনকে একই সমাজে স্থাপন করা হয়, যেখানে দক্ষিণ পার্টির কেউ নেই, অথবা যদি পাঁচজনই দক্ষিণ পার্টির হন, পাঁচজনকে একই সমাজে স্থাপন করা হয়, যেখানে উত্তর পার্টির কেউ নেই, তবে তো আশা করা সঙ্গত যে পাঁচজন মিলে বাধাহীনভাবে সমাজটাকে পরম ও চরম উচ্চতায় নিয়ে যাবেন। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটে?
কী ঘটে?
ভাগের লড়াইয়ে পাঁচজন মিলে সমাজটাকে একতরফা এমনভাবে কামড়াবেন যে কামড়াকামড়িটা শেষ পর্যন্ত নিজেদের গায়ে গায়ে স্থানান্তরিত হবে ; তা-ই হয়ে থাকে। কখনো প্রকাশিত হয়, কখনো ধামাচাপা থাকে।
ভাই, আপনি আমাদের অবিশ্বাস করলেন?
না না, তা করব কেন? আপনারা যে যা বা যতটুকু তাতে আমার বিন্দুমাত্র অবিশ্বাস নেই। ঠিক সে মাপকাঠিতেই মাপি। মাপযন্ত্রে ত্রুটি নেই কোন।
না ভাই, আপনি আমাদের অবিশ্বাস করতেছেন, মানুষই মনে করতেছেন না। আপনি আসলে সুবিধাবাদী লোক।
তা বটে, যাকে অকারণে গোপনে প্রকাশ্যে সব শক্তির প্রয়োগে নাস্তানাবুদে চূড়ান্ত ধ্বংসে ঠেলা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তাকে সুবিধাবাদীই মনে হয়। মরগান, মরগান।
জি, ভাই।
ভাইদের চা বিস্কুট দে, জলদি। রাত হয়ে যাচ্ছে।
না ভাই, না, আর চা বিস্কুট না, বিদায়।
আহা ভাই, মুল কথাটাই তো বললেন না আপনারা। এত কষ্ট করে এলেন!
না ভাই, না, তার আর দরকার নাই, বিদায়, চলি।
চা টা খেয়ে গেলে ভালো হত না? রাতকরে এলেন, বেহুদা কিছু বাদানুবাদ হলো-এভাবে চলে গেলে মনটা খারাপ থাকবে। বসুন দয়া করে, মর-গান!
আসছি, ভাই। চা- বিস্কুট রেডি।
ভাই, চলি, বিদায়।
তারা চলে যাচ্ছেন। খট করে দরজা বন্ধ হওয়ার সাথে কিছু বিড়বিড়ানো শব্দ ভেসে এলো, আর চা বিস্কুট! আগে – – – -মাইরা তারপরে সালাম!
বাইরে নৈঃশব্দ্য ভর করলে সোফার ওপর সোজা হয়ে বসলেন সংসদ ভাই। কী যেন ভাবতে শুরু করেছেন গভীর মনে। আমি পাশের বারান্দা থেকে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গলা খাঁকারিতে বলি, ভাই, এনারা আসলে কোন পার্টির লোকজন?
সংসদ ভাই আমার কথার কোন জবাব না দিয়ে মাথা চুলকে বললেন, সমাজে কোন শ্রেণির লোক সবচেয়ে অনিরাপদ জানিস? সবচেয়ে অসহায়?
না- আ।
যারা আত্মসম্মানহানীর ভীতিতে সদা সন্ত্রস্ত, তারাই। এই যে দেখলি, এরা আছে বলেই ও জিনিসটা কখনো নিরাপদ নয়।
তবে কি আত্মসম্মান নিয়ে চলা যাবে না?
যাবে, তবে এদের বিষয়ে অনিশ্চয়তা কাঁধে নিয়ে। কারণ, স্বার্থ হাসিলের প্রশ্নে এরা উত্তর দক্ষিণ দুই-ই। নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে যখন সদলবলে মাঠে নামে, তখন যে কোনও ফিকিরে অন্যের ও জিনিসটাকে গুড়িয়ে দেয়াটাকেই তারা লক্ষ্য গণ্য করে থাকে । অতএব–।
এটুকু বলেই সেদিনের মতো চুপ গেলেন সংসদ ভাই।
কিছু নই – শওকত নূর
আলোর তির্যকতা পর্যাপ্ত ছিল। অধিকন্তু তা গাছপালার ফোকর গলিয়ে আসায় হয়তো তীক্ষ্ণভাবেই আঘাত হানছিল বিজ্ঞানীর চোখে, যদিও সময়টি ছিল একেবারে পড়ন্ত বেলা। উৎসুক চোখে দেখলাম দীর্ঘ এলোরেশমি চুলের বিলিকাটায় ধরে রাখা চোখ দুটি একেবারে শান্ত নিরীহ। ভাবলাম, বিজ্ঞানী অথচ ধারেকাছে কোন যন্ত্রপাতি নেই। বেলার দিকে চেয়ে আছেন কেমন একদৃষ্টে। বেলার দিকে অপলক চেয়ে থাকাই যদি জরুরি কাজ হয় তো গাছপালার ফাঁক দিয়ে না তাকিয়ে বাইরের খোলা মাঠে গিয়ে সরাসরি তাকালেই হয়। কী দেখছেন তিনি?কিছু বলব ভেবে মিনিট বিশেক ধরে প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু তা শুধু নিসপিস আর চাপা গলাখাঁকারিতেই সীমাবদ্ধ রইল। বলা আর হল না। ভাবলাম,বিজ্ঞানী মানুষ, কী বলতে কী হয়ে যায়? তারচে বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করা শ্রেয়। চেয়ারের হেলনায় মাথা ঠেকিয়ে তাই নির্জীবের মতো লেপ্টে রইলাম। সারাদিনের দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি থেকেই চোখে তন্দ্রা নামে। যখন হুড়মুড় জেগে সোজা হয়ে বসি তখন রীতিমতো সন্ধ্যা। আবছায়া কেটে খানিক আগেই বোধ করি অন্ধকার ঘনাতে শুরু করেছে । স্পষ্টত অনুভব করছি আমার তন্দ্রা কাটা আপনা থেকে ঘটেনি। বাইরে যারা প্রবল উল্লাস কি শোকেতাপে হুয়া হুয়া করেছে, তারাই নির্ঘাত এর হোতা।
ক সেকেন্ড ধরে ভাবছিলাম বিজ্ঞানী বুঝি তন্দ্রায় আছেন। কিন্তু আকস্মিক শব্দ প্রয়োগে আমার ভুল ভাঙালেন তিনি। হাই তুলে বললেন, এরা আছে এখানে। হার সুখকর। বললাম, স্যার, কারা? কিসের হার?
তিনি আমার কথায় কোন উচ্চবাচ্য না করে বলে চললেন, এখানে যেসব কারণে এরা আছে ওইসব কার্যকারণসমূহ এদের বিলুপ্তির স্থানাদিতে উদঘাটন পূর্বক প্রয়োজনীয় নিয়ামকসমূহ উপস্থাপনের বলিষ্ঠ উদ্যোগ নেয়া হলে বিলুপ্তরা কি ফিরে আসবে?গত হয়ে যাওয়ারা ফিরবে না নিশ্চয়ই। তবে এখানকার এদের অংশ বিশেষকে সেখানে নিয়ে প্রতিস্থাপন করা গেলে বিলুপ্তির ব্যাপারটি মোটামুটি হলেও রহিত হতে পারে।ত-ই সম্ভাব্য!
আমি গলা ঝেরে বললাম, স্যার, কাদের কথা বলছেন? কাদের প্রতিস্থাপন? কী নিয়ামক? কারা বিলুপ্ত? স্যার!
বিজ্ঞানী এবারও আমার কথায় কোন সাড়াশব্দ করলেন না। ভাবটা এমন যেন তিনি ছাড়া অন্য কেউ নেই-ই এখানে। চাবি ঠেলে ইজিচেয়ারটা আরো বেশি হেলনা করে তার সাথে একেবারে মিইয়ে গেলেন। এবারে হতাশার প্রথম দীর্ঘশ্বাসটি ফোঁস করে বেরিয়ে গেল আমার নাসারন্ধ্র পথে। এদিকে বাগানের ঘন গাছপালায় অন্ধকার গাঢ়তর হয়ে রীতিমতো ভৌতিক আবহ নেমেছে। অদূরের অন্ধকার বাংলোটির অস্তিত্ব খুব বেশি আবিষ্কার করা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে বাংলো চত্বরের বেষ্টনীর চারধারে শুরু হয়েছে নানা প্রকার বুনো শব্দপাত। পূর্বে যারা হুয়া হুয়া দিয়ে তার সূত্রপাত ঘটিয়েছিল, কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর তারা আবারো উল্লাস কিংবা শোকাফসোস ধরেছে রীতিমতো বর্ধিত কলেবরে। ভাবলাম, এ কী ভুল আমি করলাম? অনেক দিন পর বিজ্ঞানী এখানে এসেছেন শুনে এতদিনের গলদঘর্ম যোগসাজশে যে এ্যাপয়েনমেন্টটি করে নিজেকে ধন্য মনে করে বিগত রাত থেকে রোমাঞ্চিত হয়ে আসছিলাম, তার এই বুঝি শেষ প্রতিফল? মনে মনে দোষারোপ করতে লাগলাম বিজ্ঞানীর সহকারী ডা. মেহমুদ কিরগিজ আলী আয়মানকে। এতদিন ধরে টেলিফোনে কথা বার্তা- বিজ্ঞানীর এহেন আচার-আচরণ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা যদি তিনি দিতেন তবে এতটা গলদ ঘর্ম হয়ে এতোটা পথ অতিক্রম করে কে আসত এমন কুস্থানে, এমন নীরস ব্যক্তির সান্নিধ্যে? ভদ্রলোক দীর্ঘক্ষণ চত্বরের বাইরে আছেন। বললেন বাইরে নামায আদায় করতে যাচ্ছেন। কিন্তু তার বেশভূষা, চুলের স্টাইল, কথাবার্তার ধরন প্রভৃতিতে মনেই হল না তিনি আন্তরিক একজন নামাযী। সেই যে গেলেন আর ফেরার নাম নেই। মাগরিব পেরিয়ে এশার আযান গেছে সেই কোন কালে! পরমুহূর্তে আবার খোদাভীতি বহমান ভাবনায় খানিকটা শীতল পানি ঢালে। মানুষের ইমান আমান একান্তই তার ভেতরের। বাহ্যিক বেশভূষায় তার আন্দাজে যাওয়া ভুলও হতে পারে- এই উল্টো চিন্তায় তাই ক্ষমা প্রার্থনায় অস্ফুট খোদাকে ডাকি। তখনই আকস্মিক আলোর বিস্কোরণে আপাদমস্তক লাফিয়ে উঠি। দেখি বিজ্ঞানী সামনের টি টেবিলটিতে রীতিমতো মাথা ঝুঁকেছেন। হাতে খোলা বই। টেবিলল্যাম্পটি ইজিচেয়ারের পাশের সুইচ টিপে তিনিই জ্বেলেছেন। ভাবলাম, এবারে জিজ্ঞাসা করি এত গভীর মনোযোগে তিনি কী পড়ছেন। কিন্তু এহেন উৎসাহ দেখাবার পূর্ববর্তী ফলটির পুনরাবৃত্তি না ঘটাতে নিশ্চুপ থাকি।
বিজ্ঞানী বইয়ের পাতায় ক্রমশ মাথা ঝুঁকছেন, পাতা উল্টে সামনে যাচ্ছেন, মুহূর্তে পেছন পাতায় ফিরে আসছেন-যেন এই নিভৃত জগৎ শুধুই তার, একান্তই নিজের ।
ভাবলাম এভাবে আর আহাম্মুকের মতো বসে থাকা নয়? বাংলোর দিকে বরং একটু ঢুঁ দেয়া যাক। বাংলোতে আলোর অনুপস্থিতি সহকারীর না ফেরার বিষয়টিই নিশ্চিত করছে। তবু একঘেয়েমী কাটাতে ওদিকে যাওয়াটাকেই একান্ত কর্তব্য গণ্য করি।
বাংলোর বারান্দায় অন্ধকারে বসে রইলাম আধো ঘন্টার মতো। যে সোফাটাতে বসেছি তা ধূলিমলিন, পরিত্যক্তের মতোই। দিনে এখানে ওঠার সময়ই তা দেখেছি। পাশেই পত্রিকা ম্যাগাজিনের স্তূপ। কিন্তু সুইচ টিপে আলো জ্বালতে সাহস না হওয়ায় ওগুলোর দিকে চেয়ে উসখুস করতে লাগলাম। হঠাৎই গলা খাঁকারির শব্দে চমকে উঠি। এই তো ডা. মেহমুদ কিরগিজ আলী সাহেব এসে গেছেন। বাংলোয় পা তুলেই বললেন, এখানে বসে আছেন? এই অন্ধকারে?
জি, কতক্ষণ আর ওখানে থাকব? ভাবলাম, দেখি আপনি ফিরলেন কী-না।
তা ভালই করেছেন। কথা না বলে কতক্ষণ কোন জীবন্ত মানুষের সান্নিধ্যে থাকা যায়? চলুন, ভেতরে চলুন। এখানে আলো না জ্বেলে বসে ভাল করেছেন। আপনি আলো জ্বাললে আপনাকে অবহিত না করার জবাবদিহিতাটি আমাকেই করতে হত। তালা খোলার ফাঁকে তিনি বলছিলেন কথাগুলো।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই আলো জ্বাললেন তিনি। বললেন, দ্রুত প্রবেশ করুন। ভেতরে ঢোকামাত্র দরজা বন্ধ করলেন তিনি। চারপাশে নজর বুলিয়ে বললেন, তা কেমন দেখলেন বিজ্ঞানী আহমাদ নগিব নাওশির আলীকে?
ভাল। কথা না বাড়াতে ঝটপট বললাম।
ভাল,তবে বুঝলেন নিশ্চয়ই যে এই জাতের মানুষের সাথে কোন আলাপ পরিচয় করা চলে না। করা না করা সমান। চলুন ওপাশটাতে ছোট্ট যাদুঘর আছে। একজন জীববিজ্ঞানীর সংগ্রহে যা থাকে তাই নিয়ে যাদুঘর। ভাল লাগবে আশা করি।
জি চলুন।
যাদুঘরে গিয়ে ডোডো ডায়নোসর সহ বেশ কিছু বিলুপ্ত প্রাণীর ফসিল, কংকাল, চামড়া হাঁড়গোড় প্রভৃতি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কিছু বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীর প্রতিকৃতি সহ তাদের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও দেখলাম। হল ঘরের একেবারে শেষ দিকটায় এসে দাঁড়ালেন আয়মান সাহেব। বললেন, এবারে চাইলে আপনি বিজ্ঞানীর কথা শুনতে পারেন। বললাম, মানে?
ওই দেখুন।
ডানে চেয়ে দেখলাম মাঝারি এক টেবিলের ওপর ধারাবাহিকভাবে কতগুলো সাউন্ডবক্স দাঁড়ানো আছে। ওগুলোতে পর্যায়ক্রমে সাঁটানো আছে আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, টমাস আলভা এডিসন এবং উইলবার রাইট ও অরভিল রাইট তথা রাইট ব্রাদারস এর ছবি। সব শেষে এক ফাঁকায় দাঁড়ানো সাউন্ডবক্সের গায়ে সাঁটানো আছে যার কাছে এতটা কৌতূহল, উচ্ছ্বাস আগ্রহ নিয়ে এসেছি, সেই বিজ্ঞানী ড. আহমাদ নগিব নাওশির আলীর ছবি। ডা. মেহমুদ কিরগিজ আলী সাহেব বললেন, কার কথা আগে শুনবেন, বলুন।
যার কাছে এসেছি!অকপটে বললাম।
ওকে। অডিও সুইচে তৎক্ষণাৎ টিপ দিলেন তিনি।
এক্ষুণি অডিও যন্ত্রে বিজ্ঞানী ড. আহমাদ নগিব নাওশির আলীর কথা শুনতে যাচ্ছি। এতক্ষণে মনের ক্ষেদ রীতিমত ঘুচে গেছে। বেশ রোমাঞ্চিত হচ্ছিলাম এই ভেবে যে শেষ পর্যন্ত সরাসরি না হলেও রেকর্ড যন্ত্রে প্রিয় বিজ্ঞানীর কথা শুনে যাবতীয় কৌতূহল মেটাবার অভাবনীয় সুযোগটা হয়ে যাচ্ছে। গভীর মনোযোগে কান পাতি। খানিকক্ষণ খুঁটখাট শব্দের পর শুরু হল তার বক্তব্য।
আমি আসলে কিছুই নই। জ্ঞানত আপনাকতৃক আমাকে শোনার জানার অথবা আপনাকে শোনাবার জানাবার আমার কিছুই নেই। আপনাকে ধন্যবাদ দিতে পারছি না। কারণ, অহেতুক এতটা দূর থেকে এতটা কষ্ট স্বীকার করে, নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করে আপনি আমার মতো এক মূল্যহীনের কাছে এসেছেন। এতটা ঔৎসুক্য ব্যয় করলেন,অথচ আমি কিছু্ই নই। বিদায়!
গুরুগম্ভীর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে আবারো সেই খুঁটখাট শব্দ শুরু হলে ডা. মেহমুদ কিরগিজ আলী আয়মান সাহেব দ্রুত সুইচ টিপে অডিওযন্ত্রটি বন্ধ করেন। আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, এবার নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হলেন?
জি, আসলে-আমি- আসলে–।
বলুন, কী আসলে।
উনি এত বড় একজন বিজ্ঞানী -এতগুলো আবিষ্কার, আন্তর্জাতিক কত স্বীকৃতি ওনার! কতটা আগ্রহ নিয়ে দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় এ্যাপয়েনমেন্ট করে ওনার কাছে এলাম, অথচ উনি বলছেন– ।
উনি কিছুই নন। ঠিক আছে, তবে অন্যদের কথা শুনুন।
জি, তাই শোনান।
ধারাবাহিক সব শুনতে পাবেন।
আইনস্টাহন থেকে শুরু। শুরু হল, কেমন?
জি।
বিজ্ঞানী ড. আহমাদ নগিব নাওশির আলী ঠিকই বলেছেন। এর থেকে ভিন্ন কিছু আমিও ভাবতে পারি না। বলতেও পারি না ভিন্নতর কিছু। আসলে আমিও কিছু নই। হয়তো ভাবছেন আমার E=mc2 এর মাহাত্ম্যের কথা। এটিই সম্ভাব্য, হাঃ হাঃ হাঃ! অনেকের কাছে এটা ভীতিপ্রদ। তাদের মতে না থাকলেই ভাল ছিল। আবার যারা এটাকে মারা কিংবা ভয় দেখাবার কাজে ব্যবহার করেন তাদের কাছে মহামূল্যবান, পরম পূজনীয়। যারা ভয় দেখাচ্ছেন, কিংবা যারা ভয় পাচ্ছেন তারাই প্রকৃত প্রস্তাবে সবকিছু। জগৎ জুড়ে তাদেরকেই সর্বস্তরের মানুষ চেনে এবং জানে। আমাকে কজন চেনে জানে কিংবা মনে রাখে? আবিষ্কারটা কবে, সত্যিকার কী মর্মে হল -তা-ই বা শতকরা কজনের জানা? অতএব, আমি কিছুই নই, হাঃ হাঃ হাঃ।
দুই
আমি নিউটন । যুবকাবস্থায় উদাসচুলো একটা ছবি আমার দেখলেও দেখে থাকতে পারেন। যাহোক, আমার পূর্ববর্তী বক্তা ভুল কিছু বলেননি। তার সাথে সুর মিলিয়ে বলতেই হয়, আমিও কিছু নই। বৃক্ষফল অনেকের মাথার ওপরেই পতিত হয়। ঘাতে প্রতিঘাত, সেও অনেকে দেখায়। তাদের অনেককেই জগৎব্যাপী অনেকে ভাল চেনে এবং জানে। আমাকে শতকরা কজন চেনে জানে? অতএব, আমি কিছুই নই, হাঃ হাঃ হা!
তিন
আমি এডিসন। আমার পূর্ববর্তী বক্তাদের সাথে কিছুতে দ্বিমত পোষণ করতে পারছি না। তাদের মতো আমিও কিছু নই। এই যে ঘরে ঘরে এতো আলো, সভ্যতার এই বর্ণিল বিচ্ছুরণ, অথচ আমি একেবারে অন্ধকারে। আমাকে ব্যবহার কারীদের অনেককেই অনেকে ভাল চেনে ও জানে? আমাকে কজন চেনে?বইপত্র বরাতে যারাও বা আমাকে বিশদ জানে তাদের অনেকে আমার কাজের চেয়ে বরং ছেলেবেলায় আমার সেই অকর্মা অকেজো দশার কথা শুনেই বরং অনেক বেশি পুলক বোধ করে । চাইলে আপনি আপনার আলোঝলমলে আধুনিক গাঁয়ের ঘরে ঘরে গিয়ে আমার বিষয়ে সরেজমিন সমীক্ষা নিতে পারেন। দেখবেন, আমার নাম শুনে এই বর্ণিল আলোতেও তাদের চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। অতএব, আমি কিছু নই।
চার
আমরা হতভাগা রাইট ভাতৃদ্বয়। আমাদের সংক্রান্ত ব্যাপার আসলে তেমন কিছুই নয়। ওই পাখিদের ওড়াউড়ি দেখেই মূলত দুভাইয়ের মাথায় মানুষ ওড়াবার উদ্ভট ভাবনাটা আসে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ!হয়ে গেল, ব্যস!শেষ পর্যন্ত উড়ে উড়ে কতজন কত দূরেই তো গেল। কত কিছুই কতজন হল। ওড়াটাকে কতশত কাজেই তো লাগানো হল। তা থেকে কেউ কেউ জগৎময় এমন পরিচিতি পেয়েছেন যে জগৎ যতদিন আছে আবালবৃদ্ধবনিতা যত্রতত্র তাদের নাম স্মরণ রাখবে। আমাদের তেমন কেউ স্মরে না। চেনে জানেই বা শতকরা কজন? এই মুহূর্তেও যারা শূন্যে উড়ন্ত অবস্থায় আছেন তাদের ও অনেকেই জানেন না আমরা কারা, কিংবা ওড়াউড়ির কাণ্ডটাই বা আমরা কবে থেকে চালু করেছিলাম। নিজেরা ওড়েন,অথচ ওড়ার ব্যবস্থাটা কার দ্বারা সাধিত হল, কবে থেকে হল, তা জানেন না। অতএব, আমরা কিছু নই, হাঃ হাঃ হাঃ!
শেষ বক্তব্যের শেষে ভারাক্রান্ত মনে উঠে দাঁড়াই। ক্ষীণ কণ্ঠে বলি, এ কেমন কথা হল? এত মহান সব বিজ্ঞানী, যাদের মহান আবিষ্কারগুলো না হলে কোথায় কোন তিমিরে পড়ে থাকত এ পৃথিবী, অথচ তারাই কি না বলছেন তারা কিছু নন, যা কিছু সবই অন্যরা। এমন অসম্ভব কথা কী করে মেনে নেয়া চলে? না না, কিছুতেই একমত হতে পারছি না এসবে। আমি অবোধ অবুঝ মানুষ, কিছুতে মাথায় ধরছে না কিছু। সত্যি করে বলুন তো ওনারা নিজেরা কি বলেছেন এমন সব নিষ্ঠুর আত্মঘাতী কথাগুলো?
না না, ওনারা তো মরে গেছেন সেই কবেই। মরে মাটি হয়ে আছেন আমূল! তাহলে?
আহা, আজ ওনারা ওপার জগৎ থেকে কথা বলতে সক্ষম হলে তো আমরা এমন সব কথাই কান পেতে শুনতে পেতাম। ভেবে দেখুন একটু গভীর করে।
তা কে ভাবল এমন কল্পিত সব কথা?
কেন, আমাদের প্রিয় বিজ্ঞানী ড. আহমাদ নগিব নাওশির আলী সাহেব!
ও –তাই বলুন।
ওনার আরো একটা গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আছে। এ যাবৎকালের সর্বশেষ আবিষ্কার সেটি।
কী তা, বলুন জলদি।
সেটা এখান থেকে বেরিয়ে যাবার পথে শুনতে পাবেন। আপনার তো যাবার সময় প্রায় হয়ে হলো।
জি হ্যাঁ, তাই তো। রাত দশটা দশ বাজে। ঠিক সাড়ে দশটায় এখান থেকে বেরিয়ে যাবার কথা আছে।
সমস্যা নেই! যাবার পথটা একেবারেই নিরাপদ সংরক্ষিত এলাকাভুক্ত। তা যাবার আগে আরও কোনও কৗতূহল?
স্যার, থাক আজকের মতো। শরীরটা মোটেও ভাল লাগছে না। সময়ও চূড়ান্ত পর্যায়ে। চলি এবার,বিদায়।
বিদায়!
বাংলোর আঙিনা পেরিয়ে অটোলক বহিঃগেটটির বাইরে গিয়ে বার থেকে তা ভেজিয়ে দিতেই বাংলোর দিক থেকে বিস্ময়কর ধরনের শব্দপাত ভেসে আসে। থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতি। মনে হচ্ছে সম্মিলিত কণ্ঠের এক অডিও বাজছে। মিষ্টি রোমাঞ্চকর ভৌতিক আবহের ভিন্ন কোনও অডিও: আমি/আমরা কিছুই নই, কিছুই নই, হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ! হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ!আমরা কেউ কিছুই নই। ইট ম্যাটারস নাথিং। উই আ(র) অল হ্যাপি, এভা(র) হ্যাপি ফেলোস! ডু উ্য রিমেম্বার দ্যা হালুই করস অব ইওর ভিলেইজ মার্কেট হু হার্ডলি হ্যাভ দ্যা উইলিংনেস টু টেস্ট দ্যা সুইটস দে প্রিপেয়ার?হাঃ হাঃ হাঃ!
উই হার্ডলি থট এ্যান্ড থিংক হোয়েদার দ্যা হিউম্যানস রিমেম্বারড অর রিমেম্বার আওয়া(র) নেমস এ্যান্ড ডিডস। ইটস বিকজ উই আর এভা(র)ওয়েল উইশারস টু দ্যা হিউম্যানস! হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ! হোঃ হাঃ হাঃ হাঃ!থ্যাংকস টু ভিজিট এ্যান্ড হিয়ার আস,স্ট্রেঞ্জার! মেনি মেনি থ্যাংকস!বা–ই,বা—ই,বা—-ই!
ভারাক্রান্ত পা চালাবার ফাঁকে মনে মনে ভাবলাম, এই তাহলে বিজ্ঞানী ড. আহমাদ নগীব নাওশির আলী সাহেবের সর্বশেষ আবিষ্কার? মহান অথচ মমার্থ দাঁড়ায় – ‘কিছু নই’।
শওকত নূর | Shawkat Noor
Bengali Story 2023 | ভবতোষ মাস্টার | গল্পগুচ্ছ ২০২৩
Bengali Story 2023 | রূপান্তরের পথে | ডরাইয়া মরে
Bengali Story 2023 | কর্ণফূলী | গল্পগুচ্ছ ২০২৩
Bengali Story 2023 | নিষিদ্ধ আনন্দ | গল্পগুচ্ছ ২০২৩
Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | bangla golpo pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Suspense story in english | suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Online Archive Story | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Online Archive Story | Pdf Online Archive Story | Online Archive Story App | Full Online Archive Story Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Online Archive Story 2024 | New Online Archive Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Online Archive Story Video | Story – Online Archive Story | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Online Archive Story Netflix | Audio Story – Online Archive Story | Video Story – Online Archive Story | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Recent Online Archive Story | Top Online Archive Story | Online Archive Story Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Online Archive Story | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Online Archive Story – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Story Collection – Modern Online Archive Story