Bangla Galper Archive | Best Bengali Story in Online

Sharing Is Caring:

আঁচল – শাশ্বত বোস

“তুর গতর টোয় আর আগের মত মজ নাই রে, দিখলে খিদা লাগেক লাই বটে।”
ডগরের দড়ি পাকানো, বিবস্ত্র দেহটাকে, বিছানায় একপাশে ফেলে, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পরে “দেবু সারেন”। তাঁর বলিষ্ঠ সুঠাম দেহে, কাষ্ঠল পেশীগুলো ক্রমশঃ ফুটে উঠতে থাকে, যেন মদন মোহন মন্দিরের গায়ে, বিষ্ণুপুরী টেরাকোটা ভাস্কর্য। ডগর তখনও পরে থাকে একে বেঁকে, যেন আস্ত একটা কালাচ সাপ, ঘন শীতের, অপাংক্তেয় সূর্যের আলো থেকে সরে গিয়ে, কুন্ডলী পাকিয়ে চলে গেছে, মোক্ষম এক শীত ঘুমে। দেবু সম্পর্কে ডগরের ভাসুর হয়। ওর মরদটা পাগল হয়ে ঘর ছেড়েছে বছর দশেক হলো। শেষবার পাড়ার লোকে জঙ্গলে যেতে দেখেছিল। সময়টা দিন আর সন্ধ্যের মাঝামাঝি। সমস্ত জঙ্গল জুড়ে তখন রং লেগেছে। মেরুদন্ড বেয়ে, শব্দ তোলা চরম শ্বাসে, বড় বড় পলাশ গাছগুলোতে, আকাশ কুসুম দোল দিচ্ছে। ঠিক যেরকম একদিন, দোলায় চেপে, মরদের হাত ধরে, দুলতে দুলতে, ডগর শ্বশুর বাড়ি এসেছিল, দলমার শরীরের, যাযাবরী মজ্জার পার্বত্যপথ পেরিয়ে। সেও ছিল, কোন এক জন্মান্তরের সময়, শীতের শেষ, বসন্তের শুরু। মরদ টা ছেড়ে যাবার পর থেকেই, ডগর দেবুর সাথে শোয়, দেবুই ওকে ডেকেছিল একদিন। লোভী পায়ে এগিয়ে গিয়ে, প্রায় লোহা হয়ে যাওয়া শরীরের, বিবর বেয়ে চুঁয়ে পরা, মসৃণ স্বেদ চেটে নিয়েছিল ডগর, তার শ্রীহীন জিভ টা দিয়ে। যৌবনের অমেধ্য কাঁটা তারে, কৃষ্ণবেনী এক সাঁওতাল তরুণীর, অনতিক্রম্য মেয়েলী লাবণ্য, পিষে গিয়েছিল, দেবুর ভীমসম, উষ্ণ মর্দনে। অথচ প্রথমে, দেবু ডগরকে, নিজের ছোট ভাইয়ের বৌয়ের চোখেই দেখত। এ যেন এক নির্বাণী অজাচার।

জঙ্গলে পূর্ণিমা হলে, যেমন রাতের শেষ টুকু, ডুব দেয় গর্ভবতী কাঁসাইয়ের কোলে, সেইরকম বাসি শরীরের, এঁটো অতৃপ্তি নিয়ে, দেবুর বিছানা ছেড়ে উঠে পরে ডগর। এবেলা জঙ্গলে যেতে হবে, মহুয়া ফুল কুড়োতে। এইসব করেই, দুবেলা খাবার জোটে ওদের, এই অবাধ, দুয়ারে সরকারি সুবিধার, নশ্বর দুনিয়াতেও। “ডগর সারেন” ঠিক কবে, এই আপাদমস্তক সাঁওতালী লাল পেরে, শাড়ী জড়ানো, শুশুনিয়ার কোলে, দাঁত বের করে হাসতে থাকা, কালো কুচকুচে শিউলিবনায় এসেছিল, তা আর তার মনে পরে না। তখন সে বছর ষোলোর “ছুড়ি”। বিয়ের পর, মরদের সাথে সে জঙ্গলে যেত, পাতা কুড়োতে, সাথে কুড়াত “মহুল” ফুল। বাড়িতে এনে, হাঁড়ির জলে খেঁজুর পাতা দিয়ে ভিজিয়ে, তাতে পচ ধরলে, কুড়োনো শুকনো পাতা আর ডাল জ্বালিয়ে, গনগনে আঁচে জ্বাল দিত, যতক্ষণ না অবধি মারটা গাঢ় হয়। এই গন্ধটায় নেশা ধরে যায়। আশে পাশের জঙ্গল থেকে ভাল্লুক বেরিয়ে আসে কখনো। গন্ধটার সাথে ডগরের ভালোবাসা হয়ে গেছিল। এরকম ভালোবাসা হয়ত তার মরদের সাথেও ছিল না। মরদটা তার চিরকালই একটু বেখেয়ালে। হাঁড়িয়া বানাত কখনো কখনো, কখনো দিশি মদ। তারপর সেই মহুয়া-হাড়িয়া-চোলাই, বড় হাড়ি করে চালান দিত, আশেপাশের গ্রামে। বসন্তের শেষ রোদ তখন, তেরছা হয়ে পরে, মিলিয়ে যেতে চাইছে, শাল সেগুনের ছায়াটার সাথে। গোল করে ছড়িয়ে পড়া রোদটা, যেন ডগরেরই মত, সিঁদুরে রঙের আঁকিবুঁকি আঁকত, ওদের বাড়ির দেওয়ালে,উঠোন জুড়ে, যেমনটা ডগর দিত “বাঁদনা” পরবের দিন। কার্তিকের অমাবস্যায়, জঙ্গলটার যেন রূপ খোলে। যেন জঙ্গলেতে আরেক ডগর, অনেক ডগর, ওরা সবাই কালো। পলাশের দিনে, ডগর ঝুমুর নাচত। ওর মরদ মাদল বাজাত। দেবু আর বাকি মুরুব্বিরা, দূরে বসে দেখত আর হাসি তামাশা করত। ওর পেলব শরীরের বর্গক্ষেত্রের ভাঁজে, যেন লুকিয়ে ছিল সাক্ষাৎ মরণ, ওর মরদের মরণ। জঙ্গলে গিয়ে “ভুলাকন্যা” মাড়িয়েছিল নির্ঘাৎ। সে গাছ মাড়ালে, আর কেউ ফেরে না। যমের মতো টেনে নিয়ে যায়, জংলী রাস্তার বাঁকে। ঘন জঙ্গলে, উঁচু উঁচু গাছের শরীর বেয়ে, গড়িয়ে আসা রোদ আর হিমেল কুয়াশার সর, তাকে ডাকে, পথ হারিয়ে মাথা কুরে মরে সারা জীবন। তারপর একদিন যখন, শরীরে আর জোর থাকে না,বাঘ কিংবা হায়নায় ছিঁড়ে খায়। হয়তো ওর মরদেরও এই হাল হয়েছিল। ডগর খোঁজ করেছিল কিন্তু বেশী তদ্বির করতে পারেনি। লুকিয়ে চোলাই হাড়িয়া সাপ্লাই করে যারা,তারা হঠাৎ একদিন, জঙ্গলের চৌরাস্তায় মিশে গেলে, বেশী দৌড়ঝাঁপ করতে নেই।

দেবুর পাশ থেকে উঠে, আজ আবার জঙ্গলে গেল ডগর সারেন। হয়ত বা আজ তার হারিয়ে যাবার পালা। জঙ্গল কি তাকে নেবে? সতী হবার কোন সাধ, আর তার নেই। বরং তার দেহের এই, স্বার্থপর যৌনলিপ্সা মেটানোর, আক্ষরিক চেষ্টার সাক্ষী থাকে, এই গোলার্ধের, নৈসর্গিক অন্ধকারের প্রতি অমনোযোগী, সূর্য্যশোক। জঙ্গলে ঢোকার মুখে তার সাথে দেখা হয়ে যায় “মাগলা” খুড়ার। বুড়া তখন, ক্ষেতের আলে ধুনি জ্বালিয়ে, ধেড়ে ইঁদুর ধরছে। পিছনে তার মস্ত ঝুড়িটা হাওয়ায় দোল খায়। ডগরের বিগত যৌবনা শরীরের, সমস্ত আকাঙ্খা, ক্রোধ, সমবেদনা, সব জাগতিক অনুভূতিগুলো থেকে, পিছলে আসা রোদের, অতিবেগুনী রশ্মি টাকে, বুড়া যেন চাপা দিয়ে রেখেছে, ওর এই ঝুড়িটা দিয়ে। ফাঁক থেকে উঁকি মেরে, ডগরের সাথে অহরহ, “কানা মাছি” খেলে চলেছে ওরা। বুড়া আগে ভালো “ছৌ” নাচত। নাচতে নাচতে, শূন্যে উঠে, লাফ দিয়ে ঘুরপাক খেত। সে সময়ে পৃথিবীর গতি, স্তব্ধ হয়ে যেতে দেখেছে ডগর। একদিন পরে গিয়ে বুড়ার ঠ্যাং ভাঙলো, নাচ ছেড়ে বুড়াও এখন হাড়িয়া বেঁচে।

জঙ্গলের শুরুতে গাছপালা অল্প। যুবতীর শরীর হাতড়ালে, সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে, জঙ্গলও তাই। ঘন থেকে গাঢ় হয় ক্রমশঃ। শেষ আলোটার মুখে, লেগে থাকে অন্ধকারের এঁটো। ছোট ছোঁড়া দুটোও আজ সঙ্গে এলো। ভুলিয়ে ঘরে রেখে আসা গেলো না কিছুতেই। মায়ের সাথে হাত লাগিয়ে, শুকনো পাতা মুঠো করে কুড়িয়ে, চুপড়িতে ভরতে লাগলো। কিছুদূর গেলেই মহুয়া গাছ। ছোট ছোট ঝড়িয়া ঘাসের পথরেখা, গায়ের রোমকূপ ঢেকেছে, লাল পলাশের কাঁচুলিতে। ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করতে থাকে, “বেশী দাঁত টো বিগলাইস না, মারিকে তুর দাঁত গুলা ঝরিং দিব।”
আধখানা কাস্তের মতো পিছনে বেঁকে, ধমক দিয়ে ওঠে ডগর, “এই ছোড়া, ঝামেলাটো পাকাইনছিস কেনে রে? চোপার বারি দিয়া কান টো কাটাইন ফিলে দিব।”
ছেলেদুটো আবার চুপ করে যায়। বাইরে থেকে নিদ্রাবিলাসী জঙ্গলের বুক চিরে “ঝুমুর” গান ভেসে আসে।

“ঝুমুর নাচে ডুমুর গাছে ঘুঙুর বেঁধে গায় (লো)।
নাচন দুজন মাদল, বাঁশি, নূপুর নিয়ে আয় (লো)।”

গাছপালা-মাঠ-প্রান্তর ছাড়িয়ে, একটা অদ্ভুৎ গন্ধ ভেসে এসে, ডগরের নাক দিয়ে ঢুকে, উরোজে সজোরে টোকা মারে। গন্ধটা ওর বিয়ের দিনের গন্ধ। দূরের বনবীথি আর গন্ধটার মাঝে, এখন শুধু ও আর ওর আত্মজ। পাশের গাছটা দিয়ে, একটা কাঠবেড়ালি, একটা মহুয়া ফল মুখে করে নিয়ে দৌড়ে যায়, একটু থেমে ভেংচি কাটে। জটিল অববাহিকা বেয়ে, দূরে একটা “বৌ কথা কও” ডেকে ওঠে। ধোঁয়ায় কুন্ডলি পাকিয়ে, হাতির ডাক ভেসে আসে। এ দিকটায় এখন, দলমা থেকে, হাতির পাল নেমে আসে। ক্ষেতে ঢুকে যায়, ফসল নষ্ট করে, বাড়ি ঘর দোর ভেঙে দেয়। ছেলেগুলো ভয়ে ডগরকে ঘেঁষে দাঁড়ায়। অল্প এগিয়ে থমকে যায় ডগরও। সামনের জমিতে স্তূপ করে কিছু ওষুধ পরে। সাথে বেলুন, সাদা রঙের। এরকমটা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে দেয়, ডগর চিনতে পারে। সামনে বেশ কিছু সিরিঞ্জ পরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এগুলোও ডগর চেনে। অজানা বিপদের আশংকায় বুক কাঁপে ওর। দু পা পিছিয়ে আসে। হঠাৎ পেছন থেকে দুটো ছায়ামূর্তি, ঝাঁপিয়ে পরে ওর ওপর। ওর কয়েকদিনের ঠিক করে না খেতে পাওয়া শরীর টা নিয়ে, ডগর আছড়ে পরে মাটির ওপর। ওর ওপরে লোক দুটো, টেনে হিঁচড়ে ওর কাপড় খুলতে চায়। ওরা যেন এখন জংলী চিতার থেকেও হিংস্র। একটা লোক ডহরের হাতদুটো চেপে ধরে। অন্য লোকটা ওর ওপর শুয়ে পরে, ওর কান গলা বরাবর দাঁত ঘষতে থাকে। ডগরের ছেলেগুলো, দূরের শালগাছটার আড়ালে লুকিয়েছে তখন। হঠাৎই ওর নিজের ছেলেদের কথা মনে পরে। সারা শরীর জুড়ে ওর, এক নিদারুণ ত্রিভঙ্গী ভোল্টেজ খেলে যায়। এক ঝটকায় ওর ওপরের লোকটাকে সরিয়ে, কোমরে লুকানো হাঁসুলী টা বার করে ডগর, মাথার উপর তুলে ঘোরাতে থাকে। দাঁত মুখ খিচিয়ে, সমাপনী তীব্রতায় ছুটে যায়, লোকগুলোর দিকে। দীক্ষিত পৃথিবীর বুকে, শ্লথ গতিতে জমা, পাপ স্খলনের লক্ষ্যে বৃষ্টি নামে। সোঁদা মাটির, জংলী বাসন্তিক আঘ্রাণে, উলঙ্গ গাছেরা নৃত্য শুরু করে। লোকদুটো পালাতে, ছেলেদুটো ছুটে এসে ডগরকে জড়িয়ে ধরে। ডগর তার পরনের ছিন্ন বস্ত্র খন্ডের “আঁচল”, মেলে ধরে ওদের মাথায়। অসময়ের বৃষ্টিতে, ওর ছোড়া গুলোর অসুখ করতে পারে।

জঙ্গল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে, একটা মাঝারি হাতির পাল। এতক্ষণ ভাবা গেছিল, নিদাঘ ধরিত্রীর বুকে, দুধ এনে দেবে, আপোষহীন বৃষ্টিটা। কিন্তু এবার সেটা ওদেরও, একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয় খুঁজে পাবার, তাগিদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদের দলের সব থেকে ছোট বাচ্চাটা, ওর মায়ের পেটের তলায় ঢুকে হাঁটছে। ওদের সবার এখন একটা আঁচল দরকার। দলবদ্ধভাবে একটা নিষ্কাম আচ্ছাদন আজ বড় প্রয়োজন।

রূপান্তরের পথে – শাশ্বত বোস

কদিন ধরেই একটা ঝিমধরা মনখারাপ ঘিরে ধরেছে আমাকে। যেন নতুন শীতের ভোরের কুয়াশার মতো প্রচ্ছন্ন, অবিন্যস্ত জমাট ধোঁয়ার কুণ্ডলী। একঘেঁয়ে একটা ভালো- না- লাগা যেন আমার আমিকে গ্রাস করে নিচ্ছে ক্রমশ। কাল আবার দেখলাম স্বপ্নটা। এখন প্রায়ই দেখি বিভিন্ন চেনা মানুষকে স্বপ্নের ভেতর, জীবিত কিংবা মৃত। আচ্ছা মানুষ কি কেবল মৃত মানুষকেই স্বপ্নে দেখে? তাহলে আমি মিলি কে দেখি কেন? আমাদের সম্পর্কটা তো শেষ হয়ে গেছে প্রায় চার বছর হল। খুব ভালোবাসতাম ওকে, প্রাণের থেকেও বেশী। স্বপ্নের জায়গাটা ভালো করে চিনতে পারি না। হয়তো ওর বাড়ির গলি, সরু খোয়া ভরা, এবড়ো-খেবড়ো। ঠিক সেখানেই একটা বাসে উঠে মিলি একটা ছেলের পাশে বসে। বাসটা ছেড়ে দেয়। আমার মাথাটা গুলিয়ে যায়, বুকের ভেতরটা মুচড়ে ওঠে। একটা বুকফাটা দলাপাকানো কষ্ট, কান্না হয়ে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। আমি স্পষ্ট বুঝি ঘুমের মধ্যেই আমি কেঁদে চলেছি। কখনো বা দেখি মিলি ওর বাড়ির বারান্দায় বসে আছে আমার পছন্দের সালোয়ারটা পরে। বসে আপন মনে গান গাইছে। যখনই স্বপ্নে ওকে দেখি, তার কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি মিলি আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে। সেটা স্বপ্নে নয়, ঘোর বাস্তবে, কখনও আননোন নাম্বার থেকে কল করে, কখনও সোশ্যাল মিডিয়ায় রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে। তাহলে মিলি কি এখনও ভালোবাসে আমায়? তাহলে আমার সাথে এটা ও কেন করল? শুধু আমার চাকরি নেই বলে? রঞ্জনের সাথে ফাঁকা ঘরে জাস্ট শুয়ে পড়ল? আমি তো ওকে ভালোবাসতাম, ভীষণ ভালোবাসতাম, আমি তো ওকে এভাবে পেতে চাইনি। আমি তো চেয়েছিলাম আমাদের প্রেম নিষ্কাম হোক, হোক পবিত্র। মিলিও তো তাই চাইত। অন্তত মুখে তো তাই বলতো। মাথাটা আমার আবার অন্ধকার করে আসছে। যেন একরাশ বর্ষার কালো মেঘ রাতের আকাশের দক্ষিণে জমাট বেঁধে আছে, সাথে অসম্ভব গুমোট লাগছে চারিদিক। একটা অদ্ভুত অসারতা গ্রাস করছে আমায়। আমি যেন ভাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি ক্রমশ, উফ কি কষ্ট! মা মাগো।

একটু পায়চারি করা দরকার। একটু মুক্ত বাতাস বুকে আসুক। এই যন্ত্রণা আমি গত চার বছর ধরে সহ্য করে চলেছি। ডাক্তার দেখিয়েছি, বলেছে দীর্ঘদিন ধরে অ্যাকিউট ডিপ্রেশনে ভুগে অবশেষে আমি এখন “সাইকোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার” এর পেশেন্ট। দুপুরে, রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর রীতিমতো সিডাক্টিভ পিলস নিতে হয় আমায়। তাতেও অবস্থার তো কোন উন্নতি হচ্ছে না!

ঘরের জানলাটা দিয়ে দমকা একটা বাতাস ঘরে ঢুকছে। একটা সোঁদা গন্ধ নাকে এসে লাগছে। বহু বিনিদ্র রজনী পার করে আমার চোখ এখন পিয়াসী চাতকের মতো তৃষ্ণার্ত, শুধু একটু শান্তির ঘুমের আশায়। পিলসের নরমাল ডোজে তো ঘুম আসে না। আজ রাতের ডোজটা তাই বাড়িয়েছি। ঘরের দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম। বারান্দার খোলা জানলা দিয়ে ভারী বাতাস ঢুকছে। দূরে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়েছে। যদি রাতে বৃষ্টি হয়! বাজ পরে! তাড়াতাড়ি করে গিয়ে জানলাটা টেনে ছিটকিনিটা লাগিয়ে দি। লবির আলোটা খারাপ হয়ে গেছে। পাশের ঘরের দরজায় আলতো কান পাতি। নাহ মা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ইদানিং আমার চিন্তায় মা ও আধমরা হয়ে যাচ্ছে। পুরো বাড়ি জুড়ে বাবার স্মৃতি ছড়িয়ে আছে। বাবা তো সেই কবেই আমাদের ফেলে চলে গেছে। সল্টলেকের এই দোতলা বাড়িটায় এখন আমি আর মা একা থাকি। মা-বাবারও তো লাভ ম্যারেজ, তাহলে আমার এমন হলো কেন? আমি কেন আমার ভালোবাসাকে পেলাম না? আমি এমনিতেই একটু লাজুক, মুখচোরা। মিশনে পড়াশোনা করে বেশ বড় বয়স অবধি মেয়েদের মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দ্বিধা-বোধ করতাম। মিলি যেদিন প্রথম আমাকে ফেসবুকে প্রপোজ করল, মনে হয়েছিল এক আকাশ গোলাপের তোড়ায় বুক ভরা ভালোবাসার এসেন্স লাগিয়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। কেন এরকম করলে মিলি? তুমি যাওয়ার পর থেকে আমার ঘরটাতে ই নিজেকে বেঁধে ফেলেছি আমি। আর কিছু ভালো লাগে না, এমনকি বাইরের কারও সাথে মিশতেও না। আগে আগে ছোটমামীরা আসতো, সান্ত্বনা দিত। মা মামীকে আমার জন্য মেয়ে দেখতে বলতো। মা আমায় কত বুঝিয়েছে, বলেছে কেরিয়ারে মন দিতে, ভালো মেয়ে দেখে আমার বিয়ে দেবে। কিন্তু আমি কিছুতেই তোমায় ভুলতে পারিনি মিলি। তোমার সাথে কাটানো প্রতিক্ষণ, তোমার বলা-না-বলা সব কথা, তোমার গভীর গাঢ় শ্বাস, এখনো আমার শরীরে লেগে আছে।

আমি তো এখনও মিলি কে ভালোবাসি। মিলির সাথে সম্পর্কটা ভেঙে যাবার পর, প্রথমদিকে তো আমি চোখ বন্ধ করে শুধু ওকেই দেখতাম। আমার চেতন অবচেতন জুড়ে তো শুধু মিলিই ছিল, বিচ্ছেদের পরও। বাসে, ট্রামে, রাস্তায় আমি তো শুধু ওকেই দেখতাম। আসলে বিচ্ছেদ তো শুধু অভ্যাসটাতে ইতি টানে। মননে তো শুধু তার সাথেই সহবাস। আবার কষ্ট হচ্ছে, বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে। আবার সেই বুক ভাঙা কান্নাটা পাচ্ছে আমার, ভীষণ একা লাগছে, পাশের ঘরে মা থাকা সত্ত্বেও। এই করে আমার পড়াশুনা, গান-বাজনা সব ঘুচে গেছে। আমার এখন শুধু মরে যেতে ইচ্ছে করে, বাঁচার ইচ্ছেটা দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে যেন।

কতদিন মিলিকে দেখিনি, ওর ওই জ্যোৎস্নার মতো ফুটফুটে মুখে ক্লান্ত মেঘরাশির মতো এলানো চুলে বিলি কাটিনি, বনপলাশের মতো ওর রাঙা দুটো ঠোঁটে এঁকে দিইনি আমার হৃদয় ভাসি উদ্বেল ভালোবাসার স্পর্শ। আগে আগে লুকিয়ে ওকে তবু দেখতাম ফেসবুকে। ওর ছবির দিকে চাইলেই গা টা আমার গুলিয়ে উঠত, অঝোর ধারায় কান্না এসে নিঃশব্দে ভিজিয়ে দিত আমার মাথার বালিশটা। নিবিড় অন্ধকারে ভয়, ঘৃণা, শ্লেষ আর অসূয়ার অদৃশ্য চতুষ্কোণ আঁকা চলত আমার চারপাশে।

এখন আর লুকিয়েও দেখিনা ওকে, দেখতে পারি না।

আচ্ছা, মিলি কি আদৌ কোনোদিন আমাকে ভালোবেসেছিল? তবে আমাকে ও ঠকালো কেন? যেদিন ও ধরা পরে গেল, ফোনে তুমুল অশান্তির মাঝে ওর হাত থেকে ওর মা ফোনটা নিয়ে আমায় যাচ্ছেতাই করে অপমান করলেন। আমি কিছু বলিনি, শুধু চুপ করেছিলাম।

আমি মিলিকে ঘেন্না করি এখন, নষ্টা মেয়ে একটা!

আচ্ছা, আমার সামনে, আমারই বিছানায় ওটা কে শুয়ে আছে? ঠিক যেন আমারই মতো দেখতে। ফর্সা, গোলগাল, এক মাথা চুল। আমারই ফ্লাওয়ার প্রিন্টের শার্টটা গায়ে পরেছে, সাথে আমারই মতো ট্রাউজার। প্রেমঘন কথক দুটো চোখে অনেক বিনিদ্র রজনী পেরিয়ে, এসেছে শান্তির ঘুম। যেন এক রাজপুত্র মাথায় জিয়নকাঠি ছোঁয়ানোর অপেক্ষা করছে, আর পথ চেয়ে বসে আছে তার স্বপ্নের রাজকন্যার।

ওমা! ছেলেটার গলায় একটা লকেট, অন্ধকারেও চকচক করছে। লকেটটা আমার খুব চেনা। ঠিক এমনটা তো আমার গলাতেও ছিল। আমার ২০ বছরের জন্মদিনে মা করিয়ে দিয়েছিল। মিলির সাথে আলাপ হওয়ার এক বছরের মাথায়, আমি মাকে না জানিয়ে, লকেটের ভেতর থেকে মায়ের ছবিটা সরিয়ে, মিলির ছবি এমব্লেম করিয়েছিলাম, চিৎপুরের সোনার দোকান থেকে। ওটাই ছিল আমার কাছে মিলির শেষ স্মৃতিচিহ্ন। এই চার বছরে মিলির আর কিছুই আমায় রাখতে দেয়নি মা। আমার অজান্তেই সব চিঠি, সব ছবি পুড়িয়ে ফেলেছে। শুধু এই লকেটটার কথা মা জানতো না। কারণ কখনো আমি ওটা কাছছাড়া করতাম না।

তাহলে কি ?!!!

সল্টলেকের এই আপাত শান্ত, নির্জন, ভদ্র বেশী উচ্চবিত্ত পাড়াতে, আজ সকাল থেকেই একটা চাপা গুঞ্জন ভেসে বেড়াচ্ছে। ‘D-46’ বাড়িটার সামনে ছোট একটা জটলা শুরু হয়ে গেছে। লোকাল থানা থেকে পুলিশ ভ্যান এসেছে, সাথে অ্যাম্বুলেন্স। পাড়ায় বাড়ি বাড়ি কাগজ দেয় ছেলেটা, পাড়ার মোড়ে র চায়ের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল। সাইকেল থেকে না নেমে চায়ের দোকানের হারুকে ভুরু উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল “কি কেস রে?” হারুর দোকানে তখন দু এক পিস লোকাল ছেলে-ছোকরা বসে চা খাচ্ছে। আজকের মতো এটাই এদের কাছে ‘বিশাল আলোচনা’ র বিষয়। চায়ের কেটলিটা ওভেন থেকে নামাতে নামাতে হারু বিজ্ঞের মতো উত্তর দিল, “আরে ওই ন্যাকাচো* ছেলেটা রে, মাকে নিয়ে ঐ ৪৬ এ থাকত। কাল রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরেছে। সুইসাইড কেস!”। চা দোকানের খদ্দেরদের মধ্যে একটা চাপা হাসাহাসি শুরু হয়ে গেলো। রোগা মতন মাতব্বর গোছের ছেলেটা, কাউন্সিলার এর চামচা গিরি করে খায়, বলে উঠলো “আরে ভাই বলিস না, বড়োলোকের ছেলেগুলো সব ভ্যাদামার্কা। মাগীর লাথি খেয়ে বাবু সব ছেড়েছুড়ে বাড়িতে বসে থাকবেন! ইদানিং তো মালটা বিশেষ বেরোতও না কোথাও। এদিকে সে পাখি তো অন্যজনের সাথে ভাগলবা।” চোখ টিপে আরেকটি ছেলে পাশ থেকে বলে উঠলো, “খোঁজ নিয়ে দেখ, মালটা ঠিকঠাক দিতে পারতো না বোধহয়!” ক্রমে চায়ের দোকানের পরিবেশটা উপস্থিত কয়েকজনের লঘুভাষণে, সস্তার রিপু রসে মধুময় হয়ে ওঠে। ৪৬ নং বাড়িটা থেকে বেরোতে বেরোতে লোকাল থানার আইসি পেছন ফিরে বয়স্ক ভদ্রমহিলাকে বলেন “খুবই স্যাড কেস মাসিমা! আজকালকার সব এইটুকু ছেলে পুলে, কেন যে এ রাস্তা বেছে নেয়, কে জানে? যাই হোক, দেখে তো সুইসাইড কেস বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু কোন নোট যখন পাওয়া গেল না, তখন ড্রাগ ওভারডোজ ও হতে পারে। আপনার ছেলে, অ্যান্টি ডিপ্রেসিভ পিল নিত, বললেন তো? যাই হোক, বডি অটোপসি তো করতেই হবে। তা আমাদের সঙ্গে আপনাদের কে যাবেন? পোস্টমর্টেম হয়ে গেলে বডি নিয়ে আসতে হবে মর্গ থেকে।” বৃদ্ধা ভদ্রমহিলা ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন। তার চোখের সামনে দিয়ে যখন তার একমাত্র ছেলের নিথর দেহটা তুলে নিয়ে চলে গেলো পুলিশের লোক, শুধু ডুকরে কেঁদে উঠলেন তিনি, “বাবান এ কি করলি তুই? ফিরে আয়, বাবা ফিরে আয়, তুই ছাড়া যে কেউ নেই আমার! কাকে নিয়ে থাকবো আমি!”

লাশকাটা ঘরের যান্ত্রিক হিম গায়ে মেখে ডাই সেকশন টেবিলে লাশটা পরে আছে অনেকক্ষণ। সাদা চাদরে আপাদমস্তক মোড়া, পায়ের আঙ্গুলে একটা টিকিট সুতোয় করে বাঁধা। সেই দুপুরে এসেছে বডিটা। অটোপসির ডাক্তার আজ অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন। বডিটা তাই আটকা পরে আছে। মর্গ অ্যাসিস্ট্যান্ট “কালু ডোম” ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বডিটার দিকে, “আজকে তাড়াতাড়ি বাড়ি কাটতাম। তা না, অসময়ে বডিটা এসে সব কেলিয়ে ক করে দিল! শালা হারামি ডাক্তার এরও দেখা নেই! যত ঝক্কি শালা এই কালুকে পোয়াতে হয়!” মুখে একরাশ অবজ্ঞা আর বিরক্তি নিয়ে লাশটার কাপড় চোপড় খুলিয়ে পরিষ্কার করে ফর্ম্যালিন মাখাতে শুরু করে সে। লোভাতুর চোখে লাশটার মাথা থেকে পা অবধি মাপতে মাপতে কালুর চোখ যায় ছেলেটার গলার রুপোর লকেটের দিকে। ষাট ওয়াটের হ্যালোজেনের আলোতে বেশ চকচক করছে জিনিসটা। ক্ষিপ্র বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে জিনিসটা লাশের গলা থেকে ছিনিয়ে নেয় কালু। এসব কাজে সে সিদ্ধহস্ত। এই করেই তো ছেলেটাকে কলেজে পড়াচ্ছে সে। আজ ছেলেটার জন্মদিন, বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় পইপই করে তার বৌ বলে দিয়েছিলো, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা। “উফফ কখন যে আসবে ডাক্তারটা”, অধৈর্য হয়ে লকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে থাকে কালু। অন্ততঃ ভরি দেড়েক তো হবেই, রুপোর এখন যা দর!

মাথার মধ্যে এই অস্থির ভাবনা নিয়ে আঙ্গুলের চাপে লকেটটা খুলে ফেলে সে,পকেট থেকে চুল্লুর পাউচটা বের করে দাঁত দিয়ে একটা কোন ফুটো করে চোঁ চোঁ করে এক ঢোকে পুরোটা মেরে দেয় কালু। ভেতরে একদিকে একটা মেয়ের ছবি। বছর ২০-২২ বয়স হবে, বেশ ‘রাগচিক’ দেখতে! অন্য দিকটা ফাঁকা। যেন একটা ছবি লাগানো ছিল, কেউ খুলে দিয়েছে। লকেটটা হাতে নিয়ে আকাশকুসুম চিন্তায় ডুবে যায় কালু। হঠাৎ খেয়াল হয় তার, ঘরটা যেন ধোঁয়া ধোঁয়া কুয়াশায় ভরে উঠেছে। কি আশ্চর্য! ধোঁয়া ঢুকলো কোথা থেকে?

রেফ্রিজারেটারের ঠান্ডাটা যেন পেয়ে বসে তাকে। হাত পা ক্রমশ অসার হতে শুরু করে কালুর। হঠাৎই যেন লকেট এর সেই শূন্য দিকটায় একটা ছেলের মুখ ভেসে ওঠে। প্রচন্ড আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে কালু। একি! এতো তার নিজের ছেলের ছবি। নিজের দু হাতে নিজের দু চোখ কচলে ওঠে কালু। “নাহ আজকে নেশাটা একটু বেশিই করা হয়ে গেছে”। নিজের চোখ, কানকে সে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। সারহীন পা দুটো নিয়ে টেবিলের কাছে এগিয়ে যায় কালু। প্রচন্ড ভয়ে তার চোখদুটো ঠেলে বেরিয়ে আসতে চায়। এ যে তাঁর নিজের ছেলের লাশ! যে ছেলের জন্মদিন করবে বলে সে লাশকাটা ঘর থেকে ছুটি চেয়েছিল তাড়াতাড়ি, সেই ছেলে লাশ হয়ে শুয়ে রয়েছে ডাই সেকশন টেবিলে। সহসা কালুর চোখ মুখে খেলে যায় বিদ্যুতের ঝলক! কোনরকমে উল্টোদিকে হেঁটে ঘরের দরজার কাছে পৌঁছায় সে, দু হাতে উন্মাদের মতো ধাক্কা দিতে থাকে। ঘরের ধাতব দরজায় তার সেই প্রাণপণ আঘাতের বিভীষিকাময় জান্তব প্রতিধ্বনি খেলে যায় পুরো ঘরে। দরজাটা খোলে না। লাশকাটা ঘরের হিমেল নিস্তব্ধতা চিরে “কালু ডোম” এর প্রাণফাটা আর্তনাদের সাথে মৃদু লয়ে মিশে যায় এক তরতাজা ব্যর্থ প্রেমিকের নিভু কলতান “মিলি! মিলি! আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম!”

ডরাইয়া মরে – শাশ্বত বোস

জলা-জঙ্গলে ঘেরা জায়গাটা, মফস্বলের মূল শহরের বাইরে। পুরো এলাকাটার বেশীর ভাগই বাঁশবন, মাঝে দুটো ডোবা, জলা ধান জমি, ভয়ানক সাপের উপদ্রব। পুরো এলাকায় ভদ্র ঘর বলতে দুটি, বাকি সব কিছুদূর অন্তর ধোপাদের বস্তি। জায়গাটা আগে শ্রীরামপুরের ছোটোখাটো জমিদার দে-মল্লিকদের বাগানবাড়ি লাগোয়া ছিল। দীপাবলির আগের চতুর্দশীর সন্ধ্যেয় গোল হয়ে চ্যাটার্জ্জী বাড়ির ছানাপোনারা গল্প শুনছিল। গোবর আর কাঁচা মাটিতে নিকোনো উঠোনে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাচ্ছিলেন তাদের মা প্রভাবতী দেবী। কার্তিকের হিমেল ঠান্ডা হাওয়ায় ঘরের লম্পটা দপদপ করছে মাঝে মাঝে। অমাবস্যার নিকশ কালো অন্ধকারকে ফালাফালা করে মাঝে দূরে ধোপা বস্তিতে দু-একটা তুবড়ি জ্বলতে দেখা যাচ্ছে। তাকিয়ায় হেলান দিয়ে ফতুয়া গায়ে আধবোজা চোখে গল্পটা বলছিলেন বাড়ির কর্তা শ্রী দীননাথ চট্টোপাধ্যায় মহাশয়। পাকানো পৈতেটা তাঁর ফতুয়ার ফাঁক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আছে। দীনুবাবুর বড় মেয়ে “মিনু” রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে বাবার জন্য চা তৈরী করছে। দীনুবাবুর মোট চার মেয়ে, দুই ছেলে, বাকিরা সবাই আসরে উপস্থিত। পূর্ববঙ্গের বরিশালের বাসিন্দা হলেও, দেশভাগেরও আগে ঠাকুরদা-জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে দীনুবাবুরা সপরিবারে কলকাতায় পাড়ি জমান চাকরির উদ্দেশ্যে। তাই তাঁদের হাবেভাবে, ঘরানায় বাঙাল ছাপ স্পষ্ট। যদিও তাঁদের কথাবার্তায় বরিশালি অপিনিহিতির সাথে শুদ্ধ বাংলা মিশে জন্ম নিয়েছে বাংলা ভাষার এক নতুন বাগ্ ধারা। এটা ৭৮ এর শেষ দিক, কদিন আগের ভয়াল বন্যা রেখে গেছে ধ্বংসের নির্মম নিদর্শন, গরু-বাছুর নিয়ে বাড়ির ছাদে দিন কাটাতে হয়েছে তাঁদের। বাটি থেকে অল্প মুড়ি নিয়ে চিবোতে চিবোতে দীননাথ বলছিলেন, “মোগো পাশের গ্রাম ‘উদয়হাটি’। তখন গ্রামকে গ্রাম উজাড় হইয়া যাইতো কলেরায়। হেইবারে তেমনি মড়ক লাগছিলো, পুরো গ্রামই প্রায় উজাড় হইয়া গ্যাসে। মোগো গাঁয়েরই ছেলে দুলাল, তার দিদির বিয়া দিসিল উদয়হাটিতে। বহুদিন দেখা সাক্ষাৎ হয় নাই, তাই হেইবারে গেসিল দিদিরে দ্যাখতে। প্রায় তিন ক্রোশ পথ হাইট্যা যাওন ছাড়া উপায় নাই। পৌঁছাইলো যখন, তখন হইন্ধ্যা নাইম্যা গ্যাসে। নদীর ধারডাতে দিদিদের বাড়ি, পাশডাতে বাঁশবন। দিদিরে গিয়া দ্যাখল ক্যামন যেন হুকাইয়া গ্যেসে। ভাবল বুঝি শ্বশুর শাশুড়ি খাইতে দেয় না। কিছু কইতে গেলেই দিদি শুধু ফ্যালফ্যাল কইরা মুখের দিকে চাইয়া থাকে, কোন কথা কয় না। দিদির ফ্যাকাশেপানা মুখটা দেইখ্যা কেমন যেন মায়া হয় দুলালের। বাড়ির আর লোকদ্যারও দ্যাখতে পাইতাসে না। দিদি কিন্তু যত্নআত্তিতে ত্রুটি রাহে নাই, সময়ে সময়ে হাত পা ধোয়ার জল, গামছা-কাপড়, জল-বাতাসা সবই গুছাইয়া রাখছে। রাতে খাবার পান্তা আর ইলিশ ভাজা, সাথে চাউম্যার ঝাল রাইধ্যা দিসে। খাইতে বইয়া কেমন য্যান একখান আঁশটানি গন্ধ পাইলো দুলাল। দুলাল কয় ‘দিদি নেবু হইলে ভাল হইত’। দিদি উইঠ্যা চইল্যা যায় লেবু আনতে। সময় পার হইয়া যায় দিদি আর আসে না। ঝোড়ো হাওয়ায় পাশের বাঁশবনে বাঁশগুলান ঠোকাঠুকি খাইয়া মরমর শব্দ করতাসে। হাওয়ার দাপটে হ্যারিকেনখান ফড়ফড় করিতে লাগিল। মনটা কেমন ভয় ভয় কইরা ওঠে দুলালের। খাওয়া ছাইড়া উইঠ্যা পরে দুলাল। ঘটিটা হাতে লইয়া হাত ধুইতে যাইবে, এমন সময় বাঁশবাগানে তাকাইয়া চক্ষু কপালে ওঠে দুলালের। দ্যাহে বাঁশবাগানে বাঁশ গাছে উইঠ্যা দিদি লিকলিকে বাঁশের ডগার মতন হাত বাড়াইতেসে পাশের লেবু গাছটার দিকে। কঙ্কালসার পা দুইখান হাওয়ায় দুলতাসে আর ঠোকাঠুকি খাইতাসে বাঁশের কচি আগার সাথে। সেই দেইখ্যা দুলাল পড়ি কি মরি কইরা দৌড় দ্যায় উল্টো দিকের ছিলা দিয়া। চারপাশডায় বাঁশবাগানে লিকলিকে সব হাত পা কাঁপছে শনশন কইরা। দূর থেইক্যা পাতিহালের ডাক ভাইস্যা আসছে। পিছন থেইক্যা আওয়াজ আসছে “অঁ ভাঁইটি, নেঁবু দিয়াঁ ভাঁত খাঁইয়া যাঁ।”

দীনুবাবুর ছোট মেয়ে পৃথা চোখ বড় বড় করে গল্পটা শুনছিল। মেয়েটা বড় রুগ্ন, একবার টাইফয়েড হয়ে গেছে। লিকলিকে প্যাকাটির মতো চেহারা, দুদিকে বিনুনি করা ছোট্ট মায়াময় মুখে ডাগর চোখ দুটো কোটরে ঢুকে গেছে। মেয়েটা একটু ভীতু প্রকৃতির। দূরের পুকুরটার জলে কালো অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। ঐ পুকুরধারেই সবেদা গাছের তলায় একটা ছোট্ট কুঁড়েঘরে থাকত “ভিখারিনী” তার বুড়ি মাকে নিয়ে। গেল বন্যায় তাদের কুঁড়েঘর ভেসে গেছে। সাপের কামড়ে মারা গেছে ভিখারিনীর মা। ভিখুদের অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু বন্যার জল সরে যাওয়ার পরেও সবেদা গাছটার দিকে আর কেউ যায় না বড় একটা। কেউ কেউ নাকি ভিখুর মাকে ঐ সবেদা গাছে দেখেছে সন্ধেবেলা এলো চুল ছড়িয়ে বসে থাকতে। পাড়ার ছেলে শৈলেন একটু ডানপিটে প্রকৃতির। সাহস করে উঠেছিল গাছটায় ঘুড়ি পারতে। প্রায় মগডালে আটকে ছিল ঘুড়িটা। হঠাৎ পা পিছলে মাটিতে পরে যায় ছেলেটি। অত ওপর থেকে পরার ধকল নিতে পারেনি ছোট শরীরটা, কোমর থেকে প্যারালিসিস হয়ে গেছে। পাড়ার এর ওর বাড়ি থেকে হাঁস মুরগী, এর ওর বাগান থেকে ফুল কিংবা পাকা ফল চুরি করার বদনাম ছিল শৈলেনের। ঐ টুকু বয়সেই বেশ ডেপো। পৃথাদের বাড়ির পোষা হাঁসটাকেই চুরি করে মেরে পিকনিক করেছিল শৈলেনরা, পৃথাদেরই বাড়ির পিছনে ফাঁকা জমিতে। পাড়ার সবাই বলাবলি করত ছেলেটার এই বদ স্বভাবের জন্য ভিখুর মা তাকে শাস্তি দিয়েছে। পৃথার চোখ চলে গেল দূরের সবেদা গাছটার দিকে। সেটাকে ঘিরে একটা জমাট অন্ধকার বাসা বেঁধেছে। অমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে গাছটাকে ঠিক গল্পে শোনা যক্ষিণীর মতো লাগছে। পৃথার মনে হল গাছটা যেন অদ্ভুত রকম স্থির, সেটার গায়ে যেন বাতাস খেলছে না।

হঠাৎ তার মনে হল লম্ফের আলোটা বড় হতে হতে লিকলিক করে লম্বা হচ্ছে আর সরু হাত বার করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। সহসা সেও যেন শুনতে পেল সেই অশরীরি কথন, “অঁ ভাঁইটি, নেঁবু দিয়াঁ ভাঁত খাঁইয়া যাঁ”।

ধুপ করে একটা শব্দ শুনে চোখ খুললেন দীনুবাবু। ততক্ষণে বাকি ছেলেমেয়েদের ভেতরও গুঞ্জন শুরু হয়ে গেছে, জটলার দিকে তাকিয়ে বুঝলেন তার ছোট মেয়েটা গল্প শুনে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। চিৎকার করে প্রভাবতীকে ডাক দিলেন তিনি, “মিনুর মা, শিগগিরি জল লইয়া আইস”।

প্রতিপাদে চ্যাটার্জ্জী বাড়িতে বাঙাল রীতি মেনে মহাসমারোহে ভাইফোঁটা হত, কষ্টশিষ্টের সংসারেও আয়োজনে কোনো ত্রুটি রাখতেন না আমাদের দাদামশাই ।পরবর্তীতে আমাদের সময়ে সেই ভাইফোঁটা হত দ্বিতীয়ায়, ঠিক যেমন ঘটিদের হয়। আমার মায়ের কথায়, “বাবা মারা যাবার পর ঘটি পাড়ায় ঘটিদের সাথে মিশে গেছিলাম”। মায়েদের সময় দ্বিতীয়ার দিন মাটিতে আসন পেতে সব ছেলেমেয়েদের বসিয়ে দাদামশাই গণ্ডূষ করাতেন হাতে ধান-দুব্বো আর শিশির দিয়ে। নিজে শ্বেতশুভ্র বসনে তাকিয়ার উপরে বসে জোরে জোরে মন্ত্র পড়তেন

“ওঁ অন্নপতেঃন্নস্য নো দেহ্যনমীবস্য শুষ্মিণঃ।
প্র প্র দাতারং তারিষ ঊর্জং নো ধেহি দ্বিপদে চতুষ্পদে।।“

আর তার ছেলেমেয়েরা মুখে মুখে সেই মন্ত্র আওড়াত, সব মিটে গেলে প্রত্যেকের হাতে একটা করে মিষ্টিভর্তি থালা দিতেন আমাদের দিদিমা প্রভাবতী দেবী। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েগুলো নিজেরা ভাইফোঁটার মন্ত্র বানিয়েছিল, “দ্বিতীয়ায় দিয়া নিতা, আমি খাবো গোটা গোটা”। মিষ্টির প্লেটটা ধরে নিজের মুখে সেই মন্ত্র আওড়াতো সব।

এসব কথা বলতে বলতে স্মৃতিমেদুর হয়ে পড়েন আমার মা ।

“বাবার আমার খুব সাহস ছিল। আর আমি ছিলাম ততোধিক ভীতু। একবার মাথার এলো চুল উল্টো করে মাথার পেছন দিক থেকে সামনে ফেলে, লাল পেড়ে শাড়ি পরে, মেজদি এমন ভয় দেখিয়েছিলো, আরেকটু হলে ভিরমি যাই আর কি! বাবার মুখে অঁ ভাঁইটি র গল্প শুনে আমরা ভাইবোনেরা বাবার সাদা পাঞ্জাবির হাতায় হাত গলিয়ে কত ভয় দেখিয়েছি একে অন্যকে। ওটা আমাদের একটা খেলা হয়ে গেছিলো। কত বড় বয়স অবধি রাত্রিবেলা ঘরের আলো বন্ধ করে একলাফে মেঝে থেকে খাটে উঠতুম। মনে হতো এই বুঝি খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে সাদা ভূত আর কালো ভূতে পা ধরে টানলো।” কথাগুলো শেষ করে আপনমনে হেসে ওঠে মা। ঠিক যেন একটি শিশুর মেয়েবেলার দিনযাপনের ছবি ফুটে ওঠে তাঁর মুখের প্রতিটি কোণায়।

“আমার বাবা খুব ছোটবেলায় মা কে হারিয়েছিল তো, তাই আমাকেই মা বলে ডাকত। খুব ভালোবাসত আমায়। পুজো পার্ব্বণে ভাইবোনের মধ্যে জামা আসবে শুধু বড় মেয়ে আর বড় ছেলের। আর আমি বায়না করতাম বলে আমার জন্য আসবে একটা। বাকিরা কেউ পাবে না। আসলে আর এম এসের কেরানীগিরি করে অতগুলো পেট চালানোই তো দুষ্কর হতো। সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা অবধি অফিস করে তার পর আবার ওভারটাইম, তাতেও টেনেটুনে সংসার চালাতো বাবা।”

বেশ বুঝতে পারি ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করতে করতে আমার মা ফিরে গেছেন স্মৃতির সরণির উপান্তে, ঠিক যেখানে সযত্নে রক্ষিত আছে তাঁর বড় আদরের আশ্রয়, তাঁর একান্ত নির্ভরতার ধন, বটবৃক্ষ সম পিতার সকল স্মৃতি। যদিও খুব বেশিদিন সেই নিশ্চিন্ত আশ্রয় আমার মা এর কপালে জোটেনি, খুবই ছোট বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েছে।

“বাবা আমার বেশ একটু গোলগাল, ফর্সা, ছোটোখাটো দেখতে ছিল। পেটের কাছে চামড়াটা তো পুরো বাঘের পেটের মতন নরম ছিল। তাই বাবার ডাকনাম ছিল ঠাকুর। সকালে ধবধবে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি পরে, পায়ে নিউ কাট জুতো গলিয়ে যখন বাবা অফিস যেত পুরো মনে হতো আর বাংলার জমিদার। বাবা বলত একবার বাবাদের দেশ বরিশালের ঝাল কাঠিতে খাটো ধুতি পরে সব ছেলে ছোকরারা বাতাপী লেবু নিয়ে মাঠে ফুটবল খেলছে। তখন গ্রামকে গ্রাম কলেরায় উজাড় হয়ে যেত। সেবার বাবাদের গ্রামেও একই অবস্থা, সন্ধ্যে হলেই ভূতের ভয়ে বাড়ি থেকে আর কেউ বেরোয় না। সেদিন খেলতে খেলতে অন্ধকার প্রায় হয় হয়। হঠাৎ পায়ের লেবুটা চলে গেল মাঠের পাশের কলাবাগানে। বল আনতে আর কেউ এগোল না, সবাই একে ওকে ঠেলছে। হঠাৎ দেখে দূরে মাথায় ঘোমটা দিয়ে একটা বউ ছায়ার মতো হাতে করে আঁচলটা টেনে কোমর দুলিয়ে নাচছে আর হাওয়ার তালে তালে তার পুরো শরীরটা দুলে উঠছে। সূর্যের আলো তখন দিগন্তে মিশেছে। সেই আলো আঁধারির আবছায়াতে ওই দৃশ্য দেখে বাকি ছেলেপুলেরা তো উল্টো দিকে দে ছুট। ছুটতে ছুটতে তো একটা ছেলে ভিরমি খেয়ে পরে গোঁ গোঁ করতে লাগল। বাবা কিন্তু সাহস করে মাটি থেকে একটি শুকনো ডাল তুলে সেই দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে কেউ কেউ বলে উঠল “ঠাওরে যাইও না, চইল্যা আইস”। বাবা কোন দিকে কান না দিয়ে সোজা এগিয়ে গেল। ছায়াটা থেকে যখন বাবা ঠিক এক হাত দূরে, সজোরে ডালটা দিয়ে এক বারি মারল ছায়াটার উপর। অমনি দুটো কলাগাছের বড় পাতা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। সন্ধ্যের চাঁদের আলো মাঠের ধারে খালের জলে পরে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। সেই আলোতে ওই কলাগাছই এই ভ্রমের কারণ। বাবা বলত, আমাগো দ্যাশে পোলাপান সব ডরাইয়া মরত, কেউ আর আগাইয়া দ্যাখে না, হেইডা আসলে কি? যম? না যমডার পুত। বলেই হো হো করে হেসে উঠত।”

বলতে বলতে কিছুটা সময় আনমনা হয়ে পরেন মা। বয়সের বলিরেখা সারা মুখমণ্ডলে ছাপ রেখেছে তাঁর। অস্পষ্ট ঘোলাটে চোখে সিলিং পাখাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন একমনে কিছুক্ষণ। স্পষ্ট বুঝতে পারি বাস্তব আর পরাবাস্তবের মাঝে এক ক্ষণস্থায়ী সাম্যালয়ে বিরাজ করছেন আমার মা। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাঁর ক্ষীণ অশ্রু ধারা। বাঁ হাতের তালু দিয়ে সেটা মুছে মা বলতে থাকেন, “গল্পটা কিন্তু এখানেই শেষ না। সেদিন বাবাও সত্যি ভূত দেখেছিল। আসলে বাবারা খুব সৎ নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ ছিল। ভোরে উঠে গায়েত্রী মন্ত্র জপ না করে মাটিতে পা ফেলতো না। ও দেশে থাকার সময় বাড়ির নারায়ণ মন্দিরে শালিগ্রাম শিলায় তুলসী না দিয়ে কেউ জল গ্রহণ করতো না। বাবা বুঝতে পারত কোনো কিছু অতি-লৌকিক উপস্থিতি। যা কেউ দেখতে পেত না, কেউ বুঝতে পারত না, আমার বাবা ঠিক টের পেতো। সেদিন সেই জ্ঞান হারানো ছেলেটাকে অজ্ঞান অবস্থায় ধরাধরি করে বাকিরা বাড়ি দিয়ে এসেছিল। বাবা খালের জলে পা ধুয়ে বাড়ি ফেরার সময় দেখে এক বিধবা মহিলা চুল ছেড়ে খালের পাড়ের নৌকা বাঁধার ঘাটে, জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে, মাথার চুল খালের কালো জলে মিশে এক অব্যক্ত বেদনা ফুটিয়ে তুলেছে, চারপাশের হাওয়ায় ভেসে আসছে এক অদ্ভুত ডাক, ও চানু জল দে, বড় তেষ্টা পাইসে।”

আমাদের পুরোনো ঘরটার সিলিঙের পলেস্তারা খসে পরে তখন তৈরী করেছে বিশ্ব মানচিত্রের এক আজব নকশা। একটি কল্পনা প্রবণ মন সেই দৃশ্য সম্ভারে ভর করে আপন মনগাঁথায় কত সহস্র শব্দ রচনা করতে পারে, সৃষ্টির নিঃসীম ছন্দে এঁকে ফেলতে পারে কাব্যিক জীবনের এক অমোঘ এপিটোম। ষাটের কোটায় পৌঁছে আমার মা সেই ভাইফোঁটার সকালে তখন রচনা করে চলেছেন নিজ শৈশবের এক আশ্চর্য্য আরব্য রজনী। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে শঙ্খ- উলু ধ্বনি। আমাদের ফোঁটা উঠে গেছে সেইবছর থেকেই। ভাইবোনেরা সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে দেশে বিদেশে। গেলো বছর ভাইফোঁটায় মায়ের হাত থেকে ফোঁটা নেওয়া আমার বড় মামা, গত হয়েছেন শেষ বৈশাখে। মাতৃকুলে আমার আর কেউ নেই এই এক মা ছাড়া।

“কথাগুলোকে মিথ্যে ধরি কি করে বল? একবার তো ওপারে থাকতে ভোররাতে আমার বাবা শ্রীকৃষ্ণের পা দেখেছিলো। রাঙা দু খানি পায়ে ঝরে পরছে ভোরে সদ্য ফোটা ফুল। বাবা আমার সত্যিই বুঝতে পারতো এসব।” আহ্লাদী মা আমার ততক্ষণে আবার ফিরে গেছেন স্মৃতি-তটিনী র ওপারে। দীর্ঘ দিনের ডায়াবেটিস থেকে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া স্বরূপ আসা “শর্ট টার্ম মেমরি লস” কিন্তু হরণ করতে পারেনি মায়ের এই একান্ত আপন মধুভান্ড। মায়ের ঝাপসা চোখ তখন আবার আনমনা। শূন্যে তাকিয়ে সেদিনের ছোট্ট পৃথা যেন দেখতে পায় খাটের উপর তার বাবা স্থূল উদর-সম্বলিত মেদবহুল শরীরে বাবু হয়ে বসে, পৈতেটা দু হাঁটুর মাঝে নিয়ে পাঁক দিচ্ছেন “কাশ্যপ, আবৎসার, নৈদ্রুব, শ্রী দীননাথ চট্টোপাধ্যায়, দেবশর্মন..”। আর মেদবর্তী লোলুপ গন্ডদেশযুক্ত মায়াময় মুখটিতে ক্ষুদ্র দুটি চোখে স্নেহভরা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে বলছেন, “মাইয়া আমার ডরাইয়া মরে।”

শাশ্বত বোস | Saswata Bose

Bengali Story 2023 | পরিচারিকা পাপিয়া | প্রবোধ কুমার মৃধা

Bengali Story 2022 | নকুল পাগলা | প্রবোধ কুমার মৃধা

Bengali Story 2022 | বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে | প্রবোধ কুমার মৃধা

Bengali Story 2023 | শুভদীপ দত্ত প্রামানিক | অণুগল্পগুচ্ছ ২০২৩

bengali story new | indian poems about death | bengali story | bengali story books for child pdf | bengali story books for adults | bengali story books | bengali story books for child | bengali story books pdf | bengali story for kids | bengali story reading | short story | short story analysis | short story characteristics | short story competition | short bengali story definition | short story english | short story for kids | short bengali story generator | bengali story 2023 | short story ideas | short story length | long story short | long story short meaning | long bengali story | long story | long story instagram | story writing competition | story writing competition topics | story writing competition for students | story writing competition malayalam | story writing competition india | story competition | poetry competition | poetry competitions australia 2022 | poetry competitions uk | poetry competitions for students | poetry competitions ireland | poetry competition crossword | writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | bengali story writing | bengali story dictation | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bengali story news| article writing on global warming | article writing pdf | article writing practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Short Article | Long Article | Bangla kobita | Kabitaguccha 2022 | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | Shabdodweep Bengali Story | Bangladesh Bengali Story | Indian Bengali Story | Top Hit Bengali Story | Trending Bengali Story | Recent Bengali Story | All new Bengali Story | Book fair bengali story | adventure bengali story | google top bengali story | top 10 bengali story | attractive bengali story | world demand bengali story | memorable bengali story

Leave a Comment