Nishim Prantare | নিঃসীম প্রান্তরে | শওকত নূর | 2023

Sharing Is Caring:
Nishim Prantare

নিঃসীম প্রান্তরে – শওকত নূর [Nishim Prantare]

মকরম মিয়া দীর্ঘক্ষণের অচেতন-দশা কাটিয়ে যখন সম্বিতে ফিরলো, বাতাসে কান ফেলে পার্থিব ন্যূনতম কোন সাড়াশব্দের উপস্থিতি সে আবিষ্কারে সক্ষম হল না। চোখ খুলে তার মনে হল নিঃসীম মহাসমুদ্রের মাঝ-বিন্দুতে অমাবস্যার গহীন অন্ধকারে বুঝি সে আমূল মিশে আছে। পরক্ষণেই সে অনুভব করল, যদি সে সমুদ্রের মাঝ-বিন্দুতে বসে থাকবে, তবে তার নির্ঘাত ডুবে যাওয়ার কথা। কিন্তু নিতম্বের নিচের শক্ত অবস্থান তাকে জলভাগের ধারণা থেকে ভূ-ভাগের ধারণায় নিয়ে এলো। হয়তো সীমাহীন কোন স্থলচত্বরে এতক্ষণ সংজ্ঞাহীন সে পড়েছিল। বিগত সময়ে সে গাঁয়ের পর গাঁ, মাঠের পর মাঠ, পথের পর পথ, প্রান্তরের পর প্রান্তর না খেয়েদেয়ে উন্মত্তের মতো হেঁটে পেরিয়েছে। কখন সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত, সকাল, দুপুর বিকেল কি সন্ধ্যা গেছে কিছুই তার খেয়ালে আসেনি। তার চোখেমুখে-তামাম অস্তিত্ব জুড়ে একটাই শুধু ভাবনা ছিল। সে ভাবনাঘোর কবে,কখন কিভাবে এ সীমাহীন চত্বরে তাকে টেনে এনেছে তার কিছুই সে জানে না। চারদিকে তাকিয়ে সমস্ত শরীরে শিহরণ খেলে গেল তার। এমন নিঃসীম চত্বর, এমন ধূসর অন্ধকার- এমন একাকীত্ব, এমন নিস্তব্ধতা এ যে অপার্থিব-একান্ত অপার্থিব। চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে স্থির হয়ে সে লক্ষ্য করল তার দু’চোখে অশ্রু ঝরছে।

আরো একবার চারদিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে জায়গাটার একটা নিশানা আবিষ্কারের চেষ্টা করল সে। চারদিকে নিঃসীম অন্ধকার ছাড়া কিছুই আবিষ্কারে সক্ষম হল না সে। এবারে সে ভাবতে লাগল এখানে কিভাবে আর কেনই বা তার আবির্ভাব ঘটল, আর এখান থেকে বেরিয়েই বা সে যাবে কোন পথে কী উপায়ে। পথ অনাবিষ্কৃত তবু যেতে তো হবেই। কিন্তু কোন দিকে সে পা বাড়াবে? এখানে দিক নিশানা বলতে কিছুই যে নেই। অগত্যা যেদিকে মুখ করে সে দাঁড়িয়েছিল সেদিকেই এগোতে থাকল। কতক্ষণ সে হাঁটলো,তার কিছুই অনুমানে থাকল না তার। একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল সে। ঠিক সামনেই হাত দশেক দূরে ছায়ামূর্তির মত কী একটা দেখা যায়। অবয়বে মনে হচ্ছে কেউ একজন বিশালদেহী চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, এক পা আরেক পায়ের ওপরে তোলা। পাশ দিয়ে অতিক্রম করে যাবার সময় সেদিক থেকে ভেসে এল গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরটি, দাঁড়াও।

কে? হকচকিয়ে বলল মকরম মিয়া।

এইতো আমি, দেখতেই পাচ্ছ। কী, পাচ্ছ না?

জি, পাচ্ছি।

কে আমি?

জানি না।

তুমি পথে বেরিয়েছ কেন তা নিশ্চয়ই জানো?

জি।

কেন বেরিয়েছ?

আমার মেয়েটির খোঁজে।

কী বৃত্তান্ত তোমার মেয়ের?

বড় দুর্বল, নম্র আর ঋজুদেহি আমার মেয়েটি। ওর পা দু’টি…।

কী? বলে ফেল মেয়ের পা দু’টির কথা।

বড় ঋজু, বড় হালকা। মেয়েটিও আমার হালকা-পাতলা। তবু পা দু’টি হালকা বলেই–।

কী?

পা দুটি হালকা বলেই, উ- হু-হু-হু।

কেঁদো না, কেঁদে হবে না কিছু। সত্যিগুলো বলে যাও। বলো তোমার মেয়ের পা দুটি হালকা হওয়াতে কী সমস্যা হয়েছে।

ওই যে দৌঁড়াতে গিয়ে উবু হয়ে পড়ে গেল। আর তখনই…।

কী?

দানবগুলো পিছু ধাওয়া করে ধরে ফেলল তাকে। যদি পা দুটি তার শক্ত হত…।

কী হত তাতে?

পা দুটো শক্ত হলে আরেকটু দৌঁড়ে খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়তে পারত সে।

তাতে কী হত? দানবরা খোলা গেট দিয়ে ঢুকেই ধরে ফেলত তাকে। রক্ষা পেত না মেয়েটি।

না, পেত সে রক্ষা।

কিভাবে?

মহল্লা পেরিয়ে ও দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে খোলা গেটটির অদূরে উবু হয়ে পড়ে যায়। ঠিক তখনই বাড়ির মালিক গেট দিয়ে ঢুকে ভেতর থেকে গেটটি আটকে দেয়। সে লক্ষ্যও করেনি ওকে। যদি ওর পা দুর্বল না হত তবে ও আগেই খোলা গেটে ঢুকে পড়ত। ঠিক ক’ সেকেন্ডের মাথায় মালিক ঢুকে গেটটি বন্ধ করে দিত। বেঁচে যেতো ও। আমি ভাবতে পারি না দৃশ্যটি। বুক ধরে আসে।

এখন তুমি কী চাও? প্রতিশোধ?

হুম।

তাহলে পাশের বুথটিতে ঢুকে যাও।

কেন?

ওখানে তোমার প্রতিশোধের বস্তুটি আছে।

মানে?

মূল যে হায়েনাটি তোমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে, তার কিশোরী মেয়েটি ওখানেই আছে। তুমি এবার শত্রুর মেয়ের সর্বনাশ ঘটিয়ে প্রতিশোধটি বুঝে নাও, কেমন?

না না জনাব, সে আমি পারব না? সে কিছুতে হয় না।

কেন পারবে না? যে তোমার মেয়ের সর্বনাশ করেছে, তুমি তার মেয়ের সর্বনাশ ঘটিয়ে প্রতিশোধটি নেবে, এ তো সহজ কাজ হে? সমস্যা কী তোমার?

জনাব, এমন প্রতিশোধ আমি চাই না।

কেন?

জনাব, এ যে বড় অধর্ম, বড় অপরাধ। এই মেয়েটি আর আমার মেয়েটিতে কোন পার্থক্যই যে আমার দৃষ্টিতে নেই। তাছাড়া অধম অধমের কাজ করেছে, একই কাজ যদি আমিও করি, তবে তাতে আমাতে পার্থক্য কী? উত্তম অধমে তফাৎ কী?

প্রতিশোধের দ্বিতীয় সুযোগটি তবে তুমি গ্রহণ করতে পার।

কী সেটা?

তুমি ঠিক পরের বুথটিতে ঢুকে যাও।

কী সেখানে?

প্রতিশোধের দ্বিতীয় বস্তুটি ওখানেই আছে। এই নাও তলোয়ার।

কী করব তলোয়ার দিয়ে?

যে তোমার মেয়ের সর্বনাশ ঘটিয়েছে, তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়। এবার তো আপত্তি থাকার কথা নয়।

জনাব, জনাব …।

কী এত কাপুরুষের মতো মিনমিন করছ?কোন প্রতিশোধই যদি নিতে না পার তো এতটা পথ পেরিয়ে এসেছ কেন? নাও, তলোয়ার নাও, তারপর তিল তিল করে বুঝে নাও প্রতিশোধ।

জনাব, দিন তলোয়ার।

এই নাও।

মকরম মিয়া তলোয়ার নিয়ে বুথের দরজায় উঁকি দিয়ে দেখল কেউ একজন উবু হয়ে পড়ে আর্তনাদ করছে। সে হুংকার দিয়ে বলল, এবারে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়ে নে, নরাধম।

কে তুমি?

আমি সেই হতভাগা পিতা যার হতদরিদ্র হবার দুর্বলতাকে পুঁজি করে তুই তার অসহায় মেয়েটির সর্বনাশ করেছিস। এক্ষুণি তোর ভবলীলা সাঙ্গ করে দেব আমি।

আগন্তুক, আমি তো সেই অপেক্ষাতেই আছি। এত যন্ত্রণা যে আর সইতে পারছি না। তারচে’ তুমি আমাকে ওপারে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা কর, তাতেই মঙ্গল। তাতেই আমি বেঁচে যাই। শীঘ্র তা সম্পন্ন করো।

কী হয়েছে তোর?

এই যে দুর্ঘটনায় আমার দুটি হাত গেছে, দুটি পা কাটা গেছে। আছে শুধু এই শরীরটুকু। ভাবতে পারো, চলৎশক্তিহীন কী নির্মম যন্ত্রণা এই বেঁচে থাকার! তুমি বরং এই যন্ত্রণা থেকে আমাকে মুক্তি দাও, পাপের শেষ প্রায়শ্চিত্তটুকুও হোক। চলে যাচ্ছ কেন তুমি? এসো, আমাকে শেষ কর।

মকরম মিয়া ফিরে এসে তলোয়ার হাতে ছায়ামূর্তির সামনে দাঁড়াতেই মূর্তি বলল, কী খবর বলো। প্রতিশোধ নিলে বুঝি?

না জনাব, প্রতিশোধ আমি নিইনি।

কেন?

এমন প্রতিশোধ কী করে নিই? সে তো এমনিতে…।

ঠিক আছে চল তবে আমার সাথে।

কোথায়?

কোথায় আবার? যেখান থেকে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলে।

ছায়ামূর্তি ত্বরিত সরে বুথটির সামনে গিয়ে স্থির হয়ে বলল, রজব মিয়া।

জি জনাব!

তোমার কি মনে পড়ে?

কী, জনাব?

তোমার সব অপরাধের কথা?

জি জনাব, পড়ে।

তুমি যে এই হতদরিদ্র লোকটির অসহায় নিষ্পাপ কুসুম কোমল মেয়েটির সর্বনাশ করেছ?

জি জনাব, সব মনে পড়ে।

সে তো প্রতিশোধ চায়।

জনাব, আমি তো প্রস্তুত। কিন্তু সে ফিরে গেছে। বলুন তাকে প্রতিশোধ নিতে। আমি একান্তভাবে সেটাই চাই।

কিন্তু প্রতিশোধের দুটি পছন্দক্রম থাকবে। যে কোন একটিতে তুমি সম্মতি জানাতে পারবে। তবেই সে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি নেবে।

কী পছন্দ, জনাব?

হয়, তুমি যেমন এই নিরীহের মেয়ের সর্বনাশ করেছ, সেও তেমনি তোমার নিজ মেয়েটির সর্বনাশ করবে, নয়তো সে তোমাকে হত্যা করবে। কোনটি তুমি চাও?

আমি চাই সে আমাকে হত্যা করুক। তবু আমার মেয়েটি বেঁচে থাক, ভালো থাক?

এ প্রত্যাশা তো তারও ছিল, কিন্তু তুমি তার মেয়েটিকে রেহাই দাওনি। অতএব, নিজ মেয়েটিকে এবার হারাতে হবে তোমার। মেয়ে হারিয়ে সে যেমন বেঁচে আছে, তুমি তেমনি বেঁচে থাকবে। এটি হচ্ছে তার পছন্দকৃত সিদ্ধান্ত। তোমাকে পছন্দক্রম দিয়ে শুধু যাচাই করা হল, উপলব্ধি করানো হল মেয়ে হারাবার যন্ত্রণা কী।

না জনাব, না। মেয়ে হারিয়ে আমি বাঁচতে চাই না। নিজেকে উৎসর্গ করে মেয়েটিকেই বাঁচাতে চাই। এই আমার শেষ ইচ্ছা। বলুন তাকে।

কিন্তু তাতে তো ন্যায় বিচার হয় না। অতএব, তুমিই বরং বেঁচে থাকো, তোমার মেয়েটি চলে যাক। এই নিরীহের মেয়েটির কাছে চলে যাক। সমানে সমান হোক।

না জনাব, না, আমি বাঁচতে চাই না, বাঁচতে চাই না, আমি মরতে চাই! যদি দশটি প্রাণ আমার থাকত, তার সব কটি দিয়ে আমার প্রাণপ্রিয় মেয়ের একটি প্রাণই আমি বাঁচাতাম। জনাব, তাকে বলুন আমাকে এক্ষুণি তিলে তিলে শেষ করে দিতে। বলুন তাকে।জনাব, উ-হু-হু-হু!

এবার নিস্তব্ধতা। মকরম মিয়া চেয়ে দেখল বুথের ভেতরে একটি নিস্পন্দ কালোছায়া পড়ে আছে। সে বলল, জনাব, আমি এখান থেকে যেতে চাই।

যাবে, তবে এই শাস্তিপ্রাপ্তের মেয়েটির কী হবে? তোমার মতে সে তো নির্দোষ; যেন সে তোমার নিজেরই মেয়ে। এই নিঃসীম প্রান্তরে একাকী বুথে ফেলে যাবে তাকে?

না জনাব, না। আমার হারানো মেয়েটিকে মনে করে, তাকেই ফিরে পেয়েছি ভেবে সাথে করে নিয়ে যাব আমি একে। আপনি অনুমতি দিন।

হ্যাঁ যাবে, তবে এখানকার আরও কিছু বিষয় দেখে যেতে হবে তোমাকে। এতটা দূর পথ অতিক্রম করে, এতটা কষ্ট স্বীকার করে এখানে এসেছ তুমি!

জি জনাব, আপনি যা চান, তাই করব আমি।

তবে এ প্রান্তরের ওই মাথাটায় গিয়ে তুমি দাঁড়াও। চোখ ও কান এদিকটায় রাখবে যতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকো।

জি, জনাব। তাই করছি।

মাথার ওপর আকাশের অস্তিত্ব নেই। রাত মানেই হয় রূপালী চাঁদ থাকবে, নয়তো অগণিত নক্ষত্রবীথি অন্ধকারে ঝলমল করবে, অথবা থাকবে মেঘের ঘনঘটা। ওপরে তাকিয়ে শুধু সীমাহীন ধূসর অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখতে পেল না মকরম মিয়া। সেই সীমাহীন ভয়াল নৈঃশব্দ্য আবারো তার শ্বাসরোধ করে চলছিল। হঠাৎই ও দিকের দৃশ্যে মনোযোগ আকৃষ্ট হল তার। ছায়ামূর্তিটির সামনে কেউ একজন দাঁড়িয়েছে, ঠিক সেই ভঙ্গিমায়, যে ভঙ্গিমায় সে-ও দাঁড়িয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। গভীর মনোযোগে সেদিকে কান পাতল মকরম মিয়া।

জনাব, আমার ছেলেটি খুব ভারিভুরি, অথচ খুবই নিরীহ-সরল; বলতে গেলে একেবারে হাবাগোবা ছিল, আর এমন ছিল বলেই …।

থামলে কেন, বলো ছেলেটিকে তার হাবাগোবা হবার মাশুল কীভাবে গুণতে হল।

শত্রুপক্ষের এমন ঘোর শত্রুতা, এর মধ্যেও সরল ছেলেটিকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তারা নদীর ওপাড়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নদীর ওপাড়ে ঘন বন। ছেলেটি আমার খুব পাখি পছন্দ করত, বন্য পশুও। দিনে তিন বেলা সে গামলা ভরে পশু-পাখিদের খাওয়াত। ক্লান্ত দুপুরে নদীর তীর ধরে স্কুল থেকে একাকী ফিরছিল সে। আমরা কেউ কখনো ভাবিনি কোন শত্রুতার জের এমন হাবাগোবা ছেলের ওপরও বর্তাবে। আমরা বরাবর নিশ্চিন্ত ছিলাম।

শত্রু অমানুষ হলে তার কাছে হাবাগোবা বলতে কোন কথা নেই। সে যে কোন মূল্যে চায় প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে। তারপর কী হল বলো।

ওকে ভুলিয়ে ভালিয়ে পশুপাখি ধরে দেবার নাম করে নৌকায় তুলে সবার অলক্ষ্যে তারা নদীর ওপাড়ে নিয়ে যায়, একেবারে বন এলাকায়। বনের লোকজনের সাথে ওদের গোপন ভাব আছে।

তারপর?

ওরা নিজেরাই ওকে খুন করে ওর রক্তমাখা কাপড়-চোপড় ঢুকিয়ে দেয় বাঘের গর্তে, যাতে ভাবা হয় ওকে বাঘে খেয়েছে। ছোপছোপ রক্তও গর্ত থেকে নদীর দিকে মেখে দেয়া হয়।

এখন তোমার কী চাওয়া? ছেলেকে তো আর পাবে না। নিশ্চয়ই প্রতিশোধ চাও?

জি, জনাব।

তবে এগুলো নাও।

কী?

দেখতেই পাচ্ছ, বাঘের মুখোশ, চামড়া আর ভয়ংকর নখড়যুক্ত থাবা।

জনাব, এসবে কী হবে?

বোকার মতো কথা বল না। এসব পরে চলে যাও আমার ডান দিকের প্রথম বুথটিতে।

জনাব, মানে?

ওখানেই আছে তোমার প্রতিশোধের বস্তুটি।

জনাব, কী সেটা?

তোমার শত্রুর কিশোর ছেলেটি ওখানেই আছে। বাঘের থাবায় তার ওপর চরম প্রতিশোধটি তুমি নাও।

কিন্তু জনাব,ওই ছেলেটি তো নির্দোষ, আমার ছেলেটির মতোই হাবাগোবাও। আমাদের শত্রুতায় তার কোনও ভূমিকা নেই, ছিল না। ওকে হত্যা করাতো হবে নিজ ছেলেকে হত্যারই শামিল। এ আমি পারব না, জনাব। বাপ হয়ে ছেলেকে কী করে শেষ করি?

তাহলে দ্বিতীয় পথটি বেছে নাও।

জনাব, কী?

তোমার ছেলের হত্যাকারী ঠিক পরের বুথটিতেই আছে। যাও, গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড় তার ওপর। এতটা পথ কষ্ট করে এসেছ। ছেলেকে তো আর পাবে না, তার হত্যাকারীকে নিঃশেষ করে দাও। দেরি করো না, যাও।

লোকটি অন্ধকারে হেঁটে পরের বুথটির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মকরম মিয়া কান পেতে কিছু শুনতে পেল না। দেখল কিছুক্ষণ পর লোকটি ফিরে আসছে। ছায়ামূর্তির কাছাকাছি আসতেই মূর্তি বলল, কী রহমত মিয়া, প্রতিশোধ হল?

না জনাব, এ প্রতিশোধ আমি নিতে পারিনি।

কেন পারনি?

সে তো মৃতের চেয়েও করুণ অবস্থায় বেঁচে আছে। বাঘের থাবায় তার চোখ দুটি উঠে গেছে। গলার রগ ছিঁড়েছে, দুটি কান চলে গেছে, পা দুটিও খোঁড়া। এখন মৃত্যুই তার একান্ত কাম্য। সে কেঁদেকেটে বারবার অনুরোধ জানাল যেন তাকে অবশ্যই নির্মমভাবে হত্যা করি , আর বিনিময়ে তার সরল ছেলেটির জান ভিক্ষা দিই। জনাব, কী হবে এমন প্রতিশোধ নিয়ে? আমাকে বরং এখান থেকে যাবার ব্যবস্থা দিন।

ওই শোন, তোমার শত্রুর পার্থিব শেষ শব্দটি বুঝি এবার হল। এটিই নির্ঘাত শেষ।

হয়তো বা। তাইতো মনে হল।

এখন তুমি কি একা ফিরে যাবে?

জনাব, মানে?

যাকে নিজ ছেলের সমতুল্য ভেবে করুণা দেখালে, তাকে একাকী ফেলে যাবে এই নিঃসীম প্রান্তরে?

না জনাব, না, কিছুতেই না।

কী করবে তবে?

আমি তাকে সাথে করে নিয়ে যাব। আমার নিজ ছেলেটিকেই উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছি বলে ধরে নেব।

বেশ, তবে তাই হোক। সাথে করে নিয়ে যাও তোমার ছেলেকে।

জি জনাব, তাই যাব।

ওই যে ও প্রান্তে চেয়ে দেখো তোমারই মতো একজন দাঁড়িয়ে আছে তার কিশোরী মেয়েকে নিয়ে। এ ছেলেটি যেভাবে তোমার ছেলে হল, ও মেয়েটিও সেভাবে তার মেয়ে হয়েছে। উভয়ে একইরূপ নিঃস্ব তোমরা। আবার উভয়েই এদের সহায়রূপে পেয়েছো।তুমি তোমার ছেলেকে বুথ থেকে নিয়ে গিয়ে তার সঙ্গী হও। তারপর ওখান থেকে সোজা উল্টা দিকে ঘুরে হাঁটা ধরবে। ওটাই তোমাদের পুব দিক। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় এ অন্ধকার নৈঃশব্দ্যের প্রান্তরের শেষে পৌঁছে ঠিক সামনে তোমাদের চির-চেনা আসমানে গোলগাল চির-চেনা চাঁদের উদয় দৃশ্য দেখবে। তোমরা না থেমে একই দিকে হাঁটতে থাকবে। হাঁটতে হাঁটতে একই দিকে একটা সময় একই চির-চেনা আকাশে চির-চেনা সূর্যোদয় দেখতে পাবে। থামবে না তোমরা। হাঁটতে হাঁটতে একটা সময় সামনে আরেক চন্দ্রোদয়, পেছনে সূর্যাস্ত একই সময়ে দেখতে পাবে। ঠিক তখনই তোমরা তোমাদের চির-চেনা লোকালয়ের নিশানাটি খুঁজে পাবে। সমস্যা হবে না আর। বিদায় তবে এবার।

জি জনাব, বিদায়।

ছায়ামূর্তির নির্দেশমতো নিবিড় আলাপচারিতায় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাঁটতে থাকে মকরম মিয়া ও রহমত মিয়া। ছেলেমেয়ে দুটি তাদের থেকে আগে। সময়ের হিসেব-নিকেশ কিছুই তাদের জানা নেই; কোনও পার্থিব ক্লান্তি অবসন্নতাও শরীর মনে নেই। প্রথম তারা যখন ক্লান্ত ও অবসন্ন অনুভব করল , তখন পূবে চন্দ্রোদয় পশ্চিমে সূর্যাস্তের দৃশ্যের যুগপৎ আবির্ভাব ঘটেছে। এই প্রথম তারা নিজেদের কথোপকথন চির-চেনা সুরে শুনতে পাচ্ছে। মকরম মিয়া ও রহমত মিয়া নিজেদের ভাই সম্বোধন করছে। ছেলেমেয়ে দুটি নিজেদের সম্বোধন করছে ভাই-বোন হিসেবে।

একটা ছোট্ট খোলা ফসলের মাঠে বসেছে ওরা দুজন। পুবে রূপালী গোল চাঁদ অপূর্ব আলো ঢেলে দিয়ে গাঁয়ের মাথায় উঠে যাচ্ছে ধীরে। গোধূলির লালাভায় পশ্চিমাকাশ ভরে দিয়ে বিদায় নিচ্ছে সূর্য। চারদিকে অগণিত পাখির কলরব, মানুষের কথোপকথন, জীবজন্তুর হাঁকডাক।

মরকম মিয়া ও রহমত মিয়া ছেলেমেয়ে দুটি থেকে একটু দূরের এক ঘাস-চত্বরে বসতে বসতে নিজেদের দীর্ঘ নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পেয়ে মৃদু শিহরিত হল। পরস্পরের চোখে চেয়ে এই প্রথম তারা চিরচেনা পৃথিবীর নির্ভরতা খুঁজে পেল।

শওকত নূর | Shawkat Noor

Machipaat | মাছিপাত | রানা জামান | Bangla Galpo 2023

Pancha Byanjan | পঞ্চব্যঞ্জন | জয়ন্ত কুমার সরকার | রম্যরচনা | 2023

Aged chicken meat | বুড়ো মোরগের মাংস | 2023 New Story

Shree Jagannath Bijay Kabya | ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ কাব্য প্রসঙ্গে | 2023

Shabdoweep Founder | Nishim Prantare | Bengali Story – Nishim Prantare | Nishim Prantare – Shwkat Noor | Natun Bangla Galpo – Nishim Prantare | Nishim Prantare 2023 | Nishim Prantare – Video story | Nishim Prantare – Audio Story | Nishim Prantare – Story in pdf | Nishim Prantare – Story 2023 | Nishim Prantare – Full story | Nishim Prantare – Trending Story | Nishim Prantare – Vital Story | Nishim Prantare – Visual story | Shabdodweep Story – Nishim Prantare | Story – Nishim Prantare | Nishim Prantare Story 2023 | Indian Story – Nishim Prantare | Bangladesh Story – Nishim Prantare | Best Story – Nishim Prantare | Top Story – Nishim Prantare | Nishim Prantare story in mp3

Leave a Comment