Shree Jagannath Bijay Kabya | ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ কাব্য প্রসঙ্গে | 2023

Sharing Is Caring:
Shree Jagannath Bijay
Image Credit – Wikipedia

‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ কাব্য প্রসঙ্গে – অভিজিৎ পাল [Shree Jagannath Bijay Kabya]

সাল ২০১৪-১৫। জগন্নাথ, জগন্নাথ সংস্কৃতি, জগন্নাথ সভ্যতা, জগন্নাথ ধর্ম, জগন্নাথ সাহিত্য প্রভৃতি সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ তৈরি হতে থাকে। বাংলার বিভিন্ন জগন্নাথতীর্থ, জগন্নাথ মন্দির, গৃহস্থের দেবালয় থেকে বৈষ্ণব পাটবাড়িতে বাংলার জগন্নাথের বৈচিত্র্যময় প্রকাশের আখ্যান আমাদের আকর্ষণ করতে শুরু করে। ক্রমশ বাংলার জগন্নাথ সংস্কৃতি ও সাহিত্য বিষয়ে শুরু হয় আমাদের অনুসন্ধান। এই সময় থেকেই শুরু হয় উৎকল ও বঙ্গের জগন্নাথ সম্পর্কিত একাধিক আখ্যান, উপকাহিনী, ছবি, বই, গান সংগ্রহ শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের জগন্নাথের পূজা ও রথোৎসবের সরেজমিনে চর্চা শুরু হয়। রথোৎসবের মধ্যে দাঁড়িয়ে জগন্নাথকে কেন্দ্র করে স্থানীয় মানুষের হৃদয়ের কথা অনুভব করতে শেখাও শুরু হয়। শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর সব রকমের জগন্নাথ-সাধকই তো দেখলাম। বুঝলাম, জগন্নাথের বিচিত্র সংসার। বৈচিত্র্যই জগন্নাথ আহ্লাদনের মূল উপাদান। সেই শুরু, তারপর চলছেই। মাঝখানে কোথা দিয়ে এতগুলি বছর কেটে গেছে। এখনও মনে হয় যেন আমরা এত বৃহত্তর পরিধিতে ব্যাপ্ত জগন্নাথ সংস্কৃতি, জগন্নাথ সভ্যতা, জগন্নাথ ধর্ম, জগন্নাথ সাহিত্য প্রভৃতির অনুপাতে কিছুই শুরু করে উঠতে পারিনি। না, আমাদের সঙ্ঘবদ্ধ প্রয়াস নেই, প্রয়োজনীয় অর্থপুঁজি ও আধুনিক নানা যন্ত্রও নেই। অনেকগুলি নেই-এর মধ্যে রয়েছে শুধুমাত্র সঠিক অনুসন্ধানের ইচ্ছা। আর এই ইচ্ছা থেকেই সময়ের ধুলোয় ম্লান হয়ে থাকা বেশ কিছু অমূল্য রত্ন খুঁজে পেয়েছি। আমাদের এই অসঙ্ঘবদ্ধ নাতিদীর্ঘ যাত্রাপথে সামান্য যে কয়েকটি উৎকৃষ্ট ফসল হাতে এসেছে তার মধ্যে একটি হলো গোপালচন্দ্র গোঁসাই-এর নাতিদীর্ঘ কাব্য ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ [Shree Jagannath Bijay]। কেউ যদি ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’কে [Shree Jagannath Bijay] দীর্ঘকবিতা বা আখ্যানকবিতা হিসেবে চিহ্নিত করতে আগ্রহী হন, তাতেও অসন্তোষের অবকাশ তৈরি হয় না। কবি গোপালচন্দ্র গোঁসাই-এর ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ [Shree Jagannath Bijay] অলংকারবহুল নয়। সাধারণ বঙ্গজনতার উপযোগী ধীর লয়াশ্রিত পাঁচালীর সুরযুক্ত এই কাব্যে সারল্যই সবচেয়ে বড় গুণ। সরল ভাষাবিন্যাস এর প্রাণ। সমগ্র কাব্যে মাত্র একটিই প্রবাদের ব্যবহার করা হয়েছে। কাব্যের কয়েকটি অংশে সাধু-চলিতের দ্বন্দ্ব রয়েছে। অনুমিত হয়, বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সাধু-চলিতের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে চলিতের জয়যাত্রার মধ্যবর্তী সময়ের আঘাত এসে লেগেছিল এই লোককাব্যে। তাছাড়া লোককাব্য শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমে এগিয়ে চলে। লোকসাহিত্যে লিপিবদ্ধ করার তাগিদ শুরু হয়েছে মূলত বিংশ শতাব্দী থেকে। এখনও লোকসাহিত্যের একটি বড় মাপের অংশ অলিখিত রয়েছে। প্রাপ্ত ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’-এর [Shree Jagannath Bijay] লিপিকার কে তা অজ্ঞাত। যে তুলোট কাগজের পুথিটি (বলা ভালো খাতাটি) আমাদের দেখার সুযোগ ঘটেছিল সেই পুথিটির লিপিকার গোপালচন্দ্র গোঁসাই নন, আবার ক্ষেমঙ্করী মাতাজীও নন। ক্ষেমঙ্করী মাতাজীর মত অনুযায়ী এই গুরুপরম্পরার মধ্যবর্তী কোনো একজন সাধক অধুনা প্রাপ্ত বর্তমান মূল পুথি অনুলিপি করেছিলেন। পূজনীয়া শ্রীমতী ক্ষেমঙ্করী মাতাজীর একটি ছোট খাতা ও পূজিত পুথি থেকে সংগৃহীত পাঠ। পাঠ সংগ্রহের তারিখ ১৭-০৭-২০১৮। মাতাজীর নিজস্ব ছোট খাতাটিতে মূল পুথি থেকে পাঠ অনুলিপি করে নিয়েছেন তিনি। মূল পুথিটি লাল শালুতে বেঁধে রাখেন তিনি। জল বাতাস থেকে মূল পুথিকে রক্ষা করার জন্য লাল রঙের একটি প্লাস্টিকের আবরণ দিয়ে রেখেছেন তিনি। প্লাস্টিকের আবরণের ভেতরে আর একটি লাল শালু দিয়ে মূল পুথিটি আবৃত। মাতাজী তাঁর গুহ্য নিত্যপূজার সময় নিত্য সচন্দন তুলসী লাল শালুর ওপরে দেন। তুলসী বা চন্দনের দাগ মূল পুথিতে লাগে না। মূল পুথিটি রক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি যথেষ্ট সতর্ক। ক্ষেমঙ্করী মাতাজীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে ও মূল পুথির সঙ্গে মিলিয়ে সংগ্রহ করা হয়েছে বর্তমান মূল পাঠ। ক্ষেমঙ্করী মাতাজী আনুমানিক ষাট বছর বয়সী। তিনি সহজিয়া বৈষ্ণব সাধিকা। অতি হালকা রঙের গৈরিক কাপড় তাঁর পরনে। তাঁর কোনো নিজস্ব স্থায়ী আখড়াবাড়ি বা সাধনকুঠির নেই। মাতাজী গুরুনির্দেশিত পথে একক সাধন করেন। তিনি কৃষ্ণস্বরূপ জগন্নাথকে কান্তরূপে ভজেন। তিনি নিজেও গান বাঁধেন। তবে নিজের বাঁধা গানে তিনি ভণিতার ব্যবহার করেন না। প্রতিদিন মাধুকরীতে সংগ্রহ করা দ্রব্যে দেবতার ভোগের পর তিনি প্রসাদ গ্রহণ করেন। তাঁর মতে মাধুকরীর অন্ন বিশুদ্ধ। ক্ষেমঙ্করী মাতাজী কোনো মোবাইল বা অন্য কোনো আধুনিক যন্ত্র বা প্রয়োজন অতিরিক্ত অর্থ সঙ্গে রাখেন না। সর্বত্র তিনি পাদুকাহীন পায়ে হেঁটে পথ চলেন। তিনি তাঁর পরম্পরার যাবতীয় রীতি যথাসম্ভব বহন করেন। তাঁর জীবন যাপন ও সাধন ভজনের মধ্য দিয়ে তাঁর গুরু পরম্পরার একটি জীবন্ত চিত্র দেখা যায়। দক্ষিণ কলকাতার বাইপাসের কাছে মুকুন্দপুর অঞ্চলের জগন্নাথ চৈতন্যদেবের অনুরূপে ঊর্ধ্ববাহু। খুব সম্ভবত জগন্নাথের মূর্তি তৈরির ক্ষেত্রে এখানে বঙ্গীয় গৌর-জগন্নাথ তত্ত্বের একটি প্রকাশ ঘটেছে। পুরীর শ্রীমন্দিরের সিংহদ্বারের একক পতিতপাবন বিগ্রহের মতো মুকুন্দপুরের জগন্নাথ ঊর্ধ্বে হাত তোলা অবস্থায় পদ্মের ওপর বিরাজিত। খুব সম্ভবত এই জগন্নাথের আকর্ষণেই ক্ষেমঙ্করী মাতাজী রথযাত্রার সময় এখানে এসেছিলেন। মাতাজী মেলার সময় পথে পথে একাই ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ [Shree Jagannath Bijay] সুর করে গান গাইছিলেন। কোভিড-১৯ অতিমারীর সময়ে ২০২০ থেকে তাঁকে আর এদিকে দেখা যায়নি। ২০২০ থেকে মুকুন্দপুর অঞ্চলের রথযাত্রা উৎসব অনেক সংক্ষিপ্ত আকারে হয়ে চলেছে। হয়তো এই কঠিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলে মুকুন্দপুরের রথযাত্রার আগের মতো ঐশ্বর্যপূর্ণ আয়োজন হলে আবার মাতাজীকেও এখানে দেখা যাবে।। ২০১৮ সালে তাঁর কাছে ও তাঁর গুরু পরম্পরার অনেক শিষ্যদের কাছে এমন আরও কয়েকটি খাতা আছে বলে শুনেছিলাম। প্রাপ্ত মূল পুথির লিপি দেখি মনে হয় না তা খুব বেশি দিনের প্রাচীন। প্রাপ্ত পুথি ও মাতাজীর খাতার পাঠে স্বদেশ মাতার বন্দনা ও ইংরেজ শাসনের অবসানের প্রার্থনা রয়েছে। এর থেকে এটুকু নিশ্চিত করা যায় যে, এই নাতিদীর্ঘ লোককাব্যটি কমপক্ষে পঁচাত্তর বছরের প্রাচীন তো বটেই। আমি পুথিপণ্ডিত নই। ফলে প্রাপ্ত পুথির প্রাচীনত্ব নির্ণয় আমার কর্মও নয়। ফরেনসিক পদ্ধতিতে পুথির অনুলিপিকাল স্পষ্ট করে নির্ণয় সম্ভব হলেও সেসব জটিল আয়োজন আমার মতো সাধারণ মানুষের কাছে অসাধ্য। আমরা প্রাপ্ত পুথির কাব্যমাধুর্যেই তৃপ্ত। আমরা এমন অনন্য ফলের আস্বাদনে আগ্রহী। বৃক্ষ গুণে সঠিক পরিসংখ্যান তৈরি করার প্রাথমিক জ্ঞান আমাদের নেই। প্রাপ্ত সম্পূর্ণ কাব্যই ক্ষেমঙ্করী মাতাজীর কণ্ঠস্থ। এই কাব্য শ্রুতি ও স্মৃতির মাধ্যমে পরবর্তী শিষ্য প্রজন্মের কাছে এসে পৌঁছেছিল। তাই সম্পূর্ণ ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ [Shree Jagannath Bijay] কাব্য মাতাজীর কণ্ঠস্থ থাকা অস্বাভাবিক নয়। এই পরম্পরার একজন পূজ্যপাদ গোঁসাই-এর সৃষ্টি হিসেবেই ক্ষেমঙ্করী মাতাজী আসল পুথিটি নিজের কাছে রাখেন। তিনি চান না তাঁদের পরম্পরার বাইরে সম্পূর্ণ খাতার সব পাতার ছবি তোলা হোক বা মূল পুথিটি অপরের হাতে আসুক। আমরা তাঁর ভাবনায় আঘাত করতে চাইনি। বস্তুত এই সম্পদের যথার্থ রক্ষণের ক্ষেত্রে তিনি সমর্থ। আমি প্রাগাধুনিক সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে জানি লিখিত পুথি জাতীয় সম্পদ। এও জানি অজস্র অধ্যাপক ব্যক্তিগত সংগ্রহে যথেষ্ট যত্নে বিভিন্ন পুথি রাখেন। মাতাজী যদি এমন একটি পুথি নিজের প্রাণসম যত্নে রক্ষা করতে পারেন, তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি না আপত্তির কিছু আছে। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে পুথি থাকলেও পুথিটি যত্নেই সংরক্ষিত হয়ে চলেছে। ক্ষেমঙ্করী মাতাজী তাঁর পুথিকে বিশেষভাবে রক্ষা করলেও তিনি চান ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ [Shree Jagannath Bijay] কাব্য বাংলার জনে জনে প্রচারিত হোক। তাই খাতার সম্পূর্ণ পাঠ তুলতে তিনি আমাকে খুব সাহায্য করেছিলেন। এই বিষয়টি লোকচক্ষুর আড়াল থেকে বের করে আনতে চাই তা তখনই তাঁকে বলেছিলাম। আমিও এতদিন ধরে জগন্নাথচর্চায় রয়েছি। তাই বাংলার জগন্নাথ সাহিত্যের একটি পদও অবলুপ্ত হোক বা অন্ধকারময় আড়ালে পড়ে থাকুক তা আমি চাই না। ক্ষেমঙ্করী মাতাজী এত বছর ধরে মুখে মুখে এই কাব্য গেয়ে এসেছেন বাংলার গ্রামে গঞ্জে, শহরতলী ও শহরে। তাঁর কাছেই শুনেছি তাঁর অনুমতি নিয়ে ২০১৮র আগে আমি ছাড়া আর কেউ তা নথিবদ্ধ করার আগ্রহ দেখাননি। তাঁর অনুমতি ব্যতিরেকে কেউ কাব্যটি লোকগীতি বা পালাগীতি হিসেবে কোনো অডিও বা ভিডিও রেকর্ড করেছেন কিনা তা মাতাজীর জানা নেই। ২০১৮ নাগাদ যে সময় আমরা এই বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করি সেই সময় ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে দীর্ঘ অডিও রেকর্ড রাখার কোনো মাধ্যম ছিল না। বাধ্য হয়েই ক্ষেমঙ্করী মাতাজীর পূজিত পুথি ও খাতা থেকে কাব্যের মূল পাঠ আমাকে কপি করে নিতে হয়েছিল। ক্ষেমঙ্করী মাতাজী শিষ্য রাখেন না। সাধনার পথে কাউকে দীক্ষাদান করেন না। তাঁর মতে গুরু হওয়ার মতো আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্য তাঁর নেই। এ তাঁর বিনয়। আসলে পরিণত গাছ ফলভারে নত হয়ে আসে। মাতাজীও আধ্যাত্মিক ঐশ্বর্যপূর্ণ, তাই তিনি বিনয়ী। তিনি স্বল্পভাষী, বেশিরভাগ সময়ই নীরব থাকেন। নিরন্তর অজপা জপ করে চলেন। তাঁর সান্নিধ্যে এলে বোঝা যায় জপের একটা চাপা স্রোত বইছে। তাঁর কথা অনুযায়ী, তিনি নিজে একজন আদর্শ শিষ্য হতে চান, গুরু হতে চান না। ভবিষ্যতে মাতাজীর নিজের বাঁধা গীতগুলি সংগ্রহের বড় ইচ্ছা রয়েছে। ওড়িশায় তিনি বেশ কিছুদিন সাধনা করেছিলেন। ফলে জগন্নাথ সংস্কৃতির বহু বিষয়ই তাঁর জ্ঞাত। তাঁর গানে সেই গূঢ় তত্ত্ব সহজে উদ্ভাসিত হয়। তাঁর নিজের লেখা নাতিদীর্ঘ ‘পোহাণ্ডিবিজয়’ ও ‘নীলাদ্রিবিজয়’ আমি শুনেছি। এই দুই কাব্যের লেখ্যরূপ এখনও সংগ্রহ করা হয়নি। হয়তো ক্রমে হবে। এই ভক্তিময়ী বৈষ্ণবী মাতাজীর গুরু পরম্পরার ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ [Shree Jagannath Bijay] আসুন আস্বাদন করি সবাই।

মূল কাব্য

শ্রীজগন্নাথবিজয় — গোপালচন্দ্র গোঁসাই [Shree Jagannath Bijay]

ওঁ নমঃ পরমব্রহ্মায় শ্রীজগন্নাথায়।।
জয় গুরুদেব ব্রহ্ম পরমপুরুষ।
জয় জয় গণপতি আদি পূজ্য ঈশ১।।
জয় হর মহাদেব জয়দুর্গা জয়।
জয় হরি নারায়ণ গগনেন্দ্র২ জয়।।
জয় জয় জগন্নাথ বলরাম সাথ।
জয় সুভদ্রা বন্দিনু রাখি শিরে হাত।।
জয় শ্রীদেবী ভূদেবী জয় সুদর্শন।
জয় নীলমাধব দাও মোরে দর্শন।।
স্বদেশ মায়ে বন্দি মুঁই৩ দিনে রাতে।
মুক্তিকামে ব্রতী হও সকল শ্রোতাতে।।
গুরুয় বন্দি শিষ্যেরে বন্দি বন্দি গণে।
সবার হাসি হেরিয়া৪ প্রীতি লাগে মনে।।
স্কন্দপুরাণের কথা অতি সুমধুর।
শুন সবে পালাগানে লীলা শ্রীপ্রভুর।।
শুন কিসে হৈল৫ নীলাচলে নিয়োজন।
কারা কৈল৬ জগন্নাথে প্রথম পূজন।।
দেখি জগন্নাথে ফল কিবা পায় তাতে।
ইথে৭ বসি ধৈর্য্য ধরি শুন নাট্যেগীতে।।
ইংরাজ শাসন প্রভু দেশে কর ক্ষয়।
কালপাহাড়ের সম সবে পায় ভয়।।
অসুরনাশক তুমি আস যুগে যুগে।
দূরন্ত শাসনে ভূমে রয়েছি অভাগে।।
অত্যাচারী দূরাচারে দূর কর ত্বরা।
পুনঃ অবতারী ওগো শুচিশুদ্ধ ধরা।।
মমনাথ জগন্নাথ পামর পাবন।
শুন শুন কব সবি হৈয়ে৮ এক মন।।
নিশ্চয় করিবে ত্রাণ প্রভু জগন্নাথ।
যারে সেবে বিধি ইন্দ্র আর উমানাথ।।
জয় জয় দাও সবে করি গীত পালা।
হুলু৯ দাও হেথা আছ যত এয়োবালা।।

স্কন্দমুখে জৈমিনী শুনিছিল কৈলাসে।
জগন্নাথলীলা নিত্য হৃদয়ে বিলাসে।।
হরির সে আদিলীলা বড় দিব্যলীলা।
দারুতনুময় রূপে প্রভু প্রকাশিলা।।
বাঞ্ছিতে দর্শন মাত্রে মুক্তি দেন প্রভু।
ব্রহ্মদর্শনের পরে জন্ম নাহি কভু।।
জন্মান্তর দোষ সবে কাটি হাতে ধরি।
নিত্যলীলাময় প্রভু জগন্নাথ হরি।। ‌
নৈমিষ অরণ্যে যত ঋষিমুনি সব।
তপোবনে তারে দেখি করে কলরব।।
অর্ঘ্য পাদ্য স্বাগতাদি করি নিবেদন।
জিজ্ঞাসে সযত্নে হেথা আসার কারণ।।
শ্রীপতির কথা শুন তপোধন সবে।
মনুষ্যলীলায় মাতে দারুরূপে এবে।।
ভাইবোন সঙ্গে করি পুরীক্ষেত্রেবাস।
চারযুগে দশরূপে হয়েন প্রকাশ।।
সর্ব অবতার সার জগতের নাথ।
চিন্ময় বাঙ্ময় রাম১০ ভদ্রা১১ চক্র১২ সাথ।।
সদা আলিঙ্গন দিতে বাহু প্রসারিয়া।
ভক্তে মিলিতে আসেন বাহনে চাপিয়া।।
রথযাত্রা স্নানযাত্রা যাত্রা কত কত।
বিস্তরি বলি শুন মাহাত্ম্য যত যত।।
পতিত যবন যত আছয়ে এদেশে।
রথে চড়ি মুক্তি সবে বিলান প্রকাশে।।
ব্রহ্ম হতে কীট যত আছে ধরাতলে।
সম মান পাহে তারা দিব্য নীলাচলে।।
ধরার বৈকুণ্ঠ নীলাচল মহাধাম।
নিত্য প্রাপ্তি সেথা ধর্ম অর্থ মোক্ষ কাম।।
মুনি সব আনন্দিত বসে করজোড়ে।
জৈমিনী পুরুষোত্তম কথা পাঠ করে।।

পুরাকালে ইন্দ্রদ্যুম্ন ভকত বিষ্ণুর।
শান্ত বীর ভক্তিবান সূর্যের কুমার।।
অবন্তীনগরে বাস করে বীর্যবান।
মহিমণ্ডলে নাহি রাজা তার সমান।।
দেবর্ষি নারদ আসি তার সভাস্থলে।
কহে নীলমাধব কথন কুতুহলে১৩।।
নিরাকার মহাবিষ্ণু আছেন লুকায়।
বিশ্বাবসু শবরের নিত্য সেবা পায়।।
শবররাজন বিশ্বাবসু ভাগ্যবান।
প্রভুসেবারত নিত্য দরশন পান।।
পুরাকালে সেহ ছিল অঙ্গদ বানর।
পরজনমেতে হইল জরা শবর।।
শবরের অগ্রগণ্য হৈয়ে এইবার।
করিছে প্রভুর পূজা একান্তে সবার।।
পূর্বে উৎকল দেশ সুমধুর স্থান।
সাকার বিগ্রহতে প্রভুর অবস্থান।।
শতজন্ম তপস্যায় যিনি দেন ধরা।
আছেন তিনি তথায় সহজ হইয়া।।
যত আছে দেব দেবী স্বর্গমর্ত্য মাঝে।
সবাকার প্রভু তিঁহো১৪ শাস্ত্রে লিখা আছে।।
প্রলয়সলিলে যবে সব ডুবি গেলা।
তবু না ডুবে সে ভূমি হেন বিষ্ণুলীলা।।
ভূলোকের স্তনসম শোভে সেই স্থান।
কোটি কোটি সৃষ্টি লয়ে নিত্য অধিষ্ঠান।।
ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রের সেথা তোমার ব্রাহ্মণ।
খুঁজি তাঁর লাগি কর মন্দির নির্মাণ।।
সেহ দেব তোমা পূজা পেতে ইচ্ছা ধরে।
যাও শীঘ্র ত্বরা কর আন তারে ঘরে।।
ভূতলে অতুল কীর্তি রাখহ রাজন।
মন্দির গড়িয়া কর সেবন পূজন।।
কোটি জন্ম মাথাকাটা তপে যারে পায়।
সেথায় সহজে সেহ নিত্যি ধরা দেয়।।
যাও যাও যাও রাজা অতি ত্বরা করি।
ত্বরা গিয়া তুমি দেখ সেথায় শ্রীহরি।।
নারদের আজ্ঞা শুনি হরষিত মন।
প্রভুতে অতি ত্বরা আনিতে করে পণ।।
জগন্নাথ জগন্নাথ নিত্য স্মরে রাজা।
জগতের সার তিনি জগতের রাজা।।
তুমি রাজা মোরা প্রজা তুমি সর্বগতি‌।
তোমারে আনিতে হেথা দাও গো শকতি।।
স্মরে রাজা জগন্নাথে নিত্য মনে মনে।
উতলা আবেগ ভরে চলনে গমনে।।
অতি প্রীত মনে রাজা স্মরেণ শ্রীপতি।
রাজা নির্দেশে আসেন দ্বিজ বিদ্যাপতি।।
রাজা কহে বন্ধু মোর শুন মোর কথা।
নীলমাধব শ্রীবিষ্ণু নারদের কথা।।
তিনি চান পূজা পেতে সবাকার হাতে।
লুকায় আছেন তবু বনের মাঝেতে।।
একে একে কন রাজা নারদের ভাষে১৫।
ত্বরা১৬ যাও মিত্ররাজ মনদুঃখ নাশে।।
শুনি সব দেবকথা দ্বিজ বিদ্যাপতি।
যাইবারে চায় সেথা একা ত্বরাগতি।।
বিদ্যাপতি ভক্তিমান রাজ আজ্ঞাবহ।
পথ মাঝে তার সনে কি হৈল শুনহ।।

পূর্ব দিশা ধরি চলে বিপ্র১৭ বিদ্যাপতি।
ক্ষেপে পদ মনে হয় যেন মৃগ গতি।।
উৎকল দিশায় পথ অতি দুরগম১৮।
মরুতে প্রান্তরে তাঁর জাগে বড় ভ্রম।।
পথি মাঝে বিদ্যাপতি গঙ্গাস্নান করে।
পথক্লান্তি মত তার নিমেষেতে হরে।।
নমো নমো গঙ্গাদেবী বারিময়ী ব্রহ্ম।
নিত্য শুদ্ধ রাখ মাতা জগতের গম্য।।
তিন দিন তিন রাত্র পদব্রজে ফিরি।
আসিলা ব্রাহ্মণ শেষে নতুন নগরী।।
বিদ্যাপতি পদব্রজে যান নীলগিরি।
দেবে বনে বনান্তরে বৃথা খুঁজে ফিরি।।
আশাহত হয় তাঁর পুনঃ জাগে আশা।
প্রভুলাগি মহাপ্রেমে ত্যাজে নাহি আশা।।
বনমাঝে উচ্চ এক টিলায় বসিয়া।
তিন দিন তিন রাত্র ধ্যানেতে মাতিয়া।।
কলিতে তপস্যা সম তীব্র আকুলতা।
সদয় হও গো প্রভু জগতের ত্রাতা।।
কোটি ব্রহ্মা কোটি শিব যার পদ চিন্তে।
সেই বিষ্ণু রহিছেন পর্বতে একান্তে।।
সুনাদ মহানামের ওঠে গিরি মাঝে।
মুশকিল সমাধা হয় বেলান্তে সাঁঝে।
পাইলেন বিশ্বাবসু শবরের দেখা।
শবরনন্দন ভালে তিলকের রেখা।।
গলে দোলে পুষ্পমাল শ্রীপতির যথা।
বসু কহে দ্বিজবর বসি কেন হেথা।।
ক্লান্ত দেহ শান্ত কর প্রসাদ খাইয়া।
প্রভুর মহাপ্রসাদ বনেতে পাইয়া।।
সন্দেহ করেন দ্বিজ শবরের ’পর।
সাকার বিষ্ণুপূজক ধরণী ওপর।।
এই সেই দ্বিজসম শবরনন্দন।
যার খোঁজে এত ক্লেশে তার আগমন।।
ব্রাহ্মণ শবর ঘরে মিলে একসাথে।
মহাপ্রসাদ ভক্ষেন ধরি দুই হাথে।।
সেবে শবরের কন্যা ষোড়শী ললিতা।
ব্রাহ্মণে শবরে প্রভু করিলেন মিতা।।

বিশ্বাবসু কাছে ললিতার চাহে পাণি১৯।
পীরিতি করি ভাঙেন দ্বিজেন আপনি।।
শুনে বিশ্বাবসু পায় সমাজের ভয়।
নীলমাধব আজ্ঞায় তার মত হয়।।
নীলমাধব কহেন দোহে দাও বিয়া।
বিপ্ররে আদর করি সম্ভাষিহ গিয়া।।
মোর সৃষ্টি পৃথিবীতে দুই মাত্র জাতি।
ভালো আর মন্দ বিনা নাহি কোন জাতি।।
শূদ্র বিপ্র ক্ষাত্র বৈশ্য হয় নিজ গুণে।
বংশজ বরণ সব নাহি গুণে মানে।।
ভক্তের এমাত্র পরিচয় ভক্ত সেহ।
হেন পরিচয় সদা নাহি পায়ে কেহ।।
নিশ্চিন্ত থাকহ সদা শবরাগণ্য তুমি।
নিমিত্ত তুমি সমস্ত করতেছি আমি।।
ভরসা রাখহ রাজা শবরনন্দন।
কিছুমাত্র বন্দোবস্ত করহ এখন।।
প্রয়োজনে ডাকিবে মধুসূদন বলি।
ভক্তিঋণ শোধিব হইয়া কৃতাঞ্জলি।।
আনন্দে কান্দেন বিশ্বাবসু একা মনে।
কি ভাগ্য এহেন প্রভু রছিছেন সনে।।
বিশ্বাবসু বিহা দেয় সমারোহ করি।
কন্যা সম্প্রদান করে দ্বিজ হাতে ধরি।।
কণামাত্র আয়োজন হয়ে উঠি মস্ত।
গ্রামজনে ভোজ খায় সুখাদ্য সমস্ত।।
ধন্য ধন্য করে সবে সুখাদ্য খাইয়া।
বিশ্বাবসু কান্দে প্রভুর লীলা দেখিয়া।।
সামান্য দরিদ্র সে যে শবর কুমার।
তার তরে এত কৃপা করে মনোহর।।
আনন্দে অধীর বিশ্বাবসু তপোধন।
এতদিনে চিন্তামুক্ত হয়েন তখন।।
শবরনন্দন ভাবে কন্যাদায় শেষ।
দেখিব নীলমাধব নিত্যি অনিমেষ।।
নীলমাধব বিনা কেহ নাহি আপন।
জগতের সার তিনি স্মরি প্রাণমন।।

দিনে দিনে সুখ বাড়ে মাতে বিদ্যাপতি।
ঘটিছে ভোগেতে মূল উদ্দেশ্য বিচ্যুতি।।
পুনঃ স্মরি নারায়ণে পুনঃ চিন্তা করে।
স্বামীরে অন্যমনা দেখি ললিতা ডরে।।
স্বামীরে জিজ্ঞাসী জানে ললিতা শবরী।
কিভাবে পাইবে নীলমাধব শ্রীহরি।।
শুনি চমকিয়া উঠে সুন্দরী ললিতা।
হেন কাঙ্ক্ষা২০ শুনি বুঝি ক্ষমে নাহি পিতা।।
একদিকে পিতা আর অন্যদিকে স্বামী।
দুহি মোর প্রিয়জন কি করিব আমি।।
নীলমাধব নীলমাধব স্মরে মনে।
স্মরিয়া ললিতা চলিল পিতার সনে।।
পিতার নিকটে আসি বিনয় বচনে।
কহে ললিতাবালা ভয় ত্রাস মনে।‌।
ইচ্ছা ধরে স্বামী নীলমাধব দেখিতে।
সেহ মিনতি পিতা হেথা এচি করিতে।।
পুত্রী দিব্য রাখি দেবে দেখাও আপনি।
পতি কাঙ্ক্ষা ভিন্ন সতী কিছু নাহি জানি।।
পিতা মোর শেষবারে রাখহ মিনতি।
তোমারে বিরুদ্ধে যাই নাই মোর শক্তি।।

কন্যাদিব্য২১ শুনি যেন মাথে পড়ে বাজ।
ক্ষুণ্ন মনে রাজি হন শবরের রাজ।।
শর্ত দেন পথে রবে বাঁধা চক্ষু দুই।
এই শর্ত পালিলে তবে মো রাজি হই।।
ললিতা প্রণাম দেয় গলবস্ত্র করি।
ভবিতব্য ভাবি রাজা স্মরেণ শ্রীহরি।।
পিতার পাইয়া মত ললিতা শবরী।
কথা স্বামীরে কহিল আলিঙ্গন করি।।
আনন্দে অধীর দ্বিজ সমস্ত ভাবিয়া।
কি হতে কি হলো সব পায় না চিন্তিয়া।।
অবশেষে ব্রহ্মলগ্নে বাঁধি চক্ষুদ্বয়।
দানা ফেলি চলিলেন দ্বিজ পথময়।।
শ্বেত সরিষার দানা ফুল ধরে দ্রুত।
পুনঃ পথে আসিবার স্মারক অক্ষত।।
গুহায় পৌঁছেন দ্বিজ দেখেন শ্রীপতি।
নীলমাধব ঈশ্বর জগতের গতি।।
নীলমণি সমবর্ণ চারবাহু ধরি।
নারায়ণ দাঁড়িয়াছে গরুড়ের পরি।।
শঙ্খচক্রগদাপদ্ম ধরিয়া হাতেতে।
পীতাম্বরী বনমালী কৌস্তুভ মাথেতে।।
চৌত্রিশায়২২ বন্দে দ্বিজ প্রভু নারায়ণ।
তিনি প্রভু আদিদেব জগৎকারণ।।
ধনরত্ন বিদ্যাবিত্তি নাহি আর চাহে।
মুক্তির বাসনা স্মরণে কর্তব্যে বাঁধে।।
ফিরি যেতে হবে তাঁরে অবন্তী নগরে।
যাত্রা করে ‌স্ত্রীর সাথে প্রথম প্রহরে।।
বৃদ্ধ বিশ্বাবসু কাঁন্দে বলি হায় হায়।
চক্ষের নিমিষে নীলমাধব লুকায়।।
কন্যা গেল প্রভু গেল বিশ্বাবসু দেখে।
গুহা স্থানে বালু দেখি সারা অঙ্গে মাখে।।

বিদ্যাপতি ফিরি আসে অবন্তীনগরে।
ইন্দ্রদ্যুম্নে প্রভুকথা কহে সবিস্তারে।।
কেমনে দেখিতে সেই প্রভু নীলমণি।
শুনিতে শুনিতে মত্ত হয়েন আপনি।।
বিদ্যাপতি সবিস্তারে করেন বর্ণন।
অনিন্দ্য সুন্দর বিরাট মধুসূদন।।
আজীবন দেখিলেও নাহি ভরে মন।
ইন্দু কোটি তুচ্ছ নীলমাধব এমন।।
ঈশ্বর পরমতত্ত্ব দেবতার রাজা।
কেহ না বর্ণিতে পারে দিব্য মনোহরে।
শ্রীরূপ দর্শনে আর চক্ষু নাহি ফিরে।।
তুচ্ছ সব ধনরত্ন হয় দিকে দিকে।
কিবা রূপ কিবা বিভা শোভে চারিদিকে।।
এমন মনোহারী নীলমাধব হরি।
নীলগিরি যাও রাজা যাও ত্বরা করি।।
ইন্দ্রদ্যুম্ন মনে ভাবি শ্রেষ্ঠ আমি হব।
ধরায় বিখ্যাত ভব্য মন্দির গড়িব।।
নীলমাধব দেবের বেদী গড়ি দেব।
জগতে অক্ষয় কীর্তি এহেন রাখিব।।
কালে কালে জনে জনে দেখিবে মন্দির।
মুখে ধন্য ধন্য করিবে মোর কীর্তির।।
পাত্র মিত্র লোকজন পাইক লস্কর।
বাদ্য নৃত্য ঘোড়া হাতি বিরাট বহড়।।
চলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলগিরি মুখে।
পথশ্রমে ক্লান্তি নাই রাজা চলে সুখে।।
চলে সকল সুহৃদ২৩ ধন্য ধন্য করি।
অহংকার বাড়ে তার অল্প অল্প করি।।
বুঝিতে নারে গো রাজা মোহ বড় দোষ।
যথাস্থানে গিয়া দেখে নাহি অবশেষ।।
কোথায় নীলমাধব কোথা আছে বন।
পড়ি আছে ধূ ধূ বালু এমন কুক্ষণ২৪।।
শূন্য ডান শূন্য বাম শূন্য সর্বদিক।
পাত্র মিত্র মনে ভাবে এ সবি অলীক।।
রাজা ভাবে সবি ব্রাহ্মণের পরিহাস।
ক্ষণে কান্দে ক্ষণে পুনঃ করে অট্টহাস।।
মাথা নাহি স্থির থাকে আসে অবসাদ।
নীলমাধবেরে দেখিবার ছিল সাধ।।
অভাগা দুর্ভাগা রাজা হেন আর নাহি।
এমন স্মরিতে থাকে দেবে নাহি পাহি।।
বহু খুঁজি ফিরি না পাইলে চক্রপাণি।
গঞ্জরিতে থাকে মনে আপনে আপনি।।
পাত্র মিত্র প্রজা সবে মনে মনে হাসে।
অতি দর্পে হতা লঙ্কা শাস্ত্রের প্রকাশে।।
দেবপ্রতিষ্ঠার অহং না সয় মাধব।
সে হেতু অদর্শন কৈল নীলমাধব।।
সবে বুঝে সবে যুঝে থাকে চুপ করি।
রাজরোষে পড়িয়া হারাবে ঘরবাড়ি।।

উৎকলে আসি রাজা না পায় প্রভুরে।
রাগে ক্ষোভে টানি আনে বান্ধিয়া শবরে।।
নীলমাধব হারিয়া বিমর্ষ শবর।
প্রভুর ভাবে আত্মস্থ নাহি ভয় ডর।।
রাজা ছুঁলি নিন্দা রটে সমাজ ভিতরে।
মনে নিত্য স্মরি যায় দেব শুভঙ্করে।।
তবু রাজা মহাতেজা নাহি দেয় ছারি।
বিশ্বাবসু একমনে জপে হরি হরি।।
গগনেতে দৈববাণী শুনায় শ্রীপতি।
বিশ্বাবসু মোরগণ করহ প্রণতি।।
ক্ষমা চাহে রাজা ধরি বিশ্বাবসু পায়।
ক্ষম মোর দ্বিজোত্তীর্ণ বিশ্বাবসু রায়।।
রাজারে ক্ষমেন২৫ ধীর শবর সুমতি।
ছাড়হ পদ ধরহ বিষ্ণু জীবগতি।।
সব আয়োজন বৃথা বিমর্ষ বদন।
ফিরিতে ফিরিতে রাজা করেন ক্রন্দন।।
পদাতিক আগে চলে পিছে চলে হয়।
হাতি পীঠে চলে রাজা কাঁন্দে পথময়।।
এত আয়োজন সব জলেতে যাইল।
দৈবের অপূর্ব লীলা দেবে হারাইল।।
অবন্তীতে ফিরি আসি ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা।
গুণ্ডিচা রাণীরে কহে অহংকারের সাজা।।
বিমর্ষ বদনে দোঁহে যাঁচে ক্ষমা যত।
গ্লানিভার কমি আসি শুদ্ধ হয় তত।।
বৈকুণ্ঠে হাসেন বিষ্ণু উভয়েরে দেখি।
গ্লানি হরিয়া লন নারায়ণ একাকী।।
গ্লানিহারী হরি হরিলেন সর্বগ্লানি।
ব্রহ্মার আজ্ঞায় চলেন নারদ মুনি।।
ঢেঁকিবাহনে আসেন অবন্তীনগরী।
নারদমুনি রাজন সম্বোধন করি।।
বিস্তারি কহেন উত্তরণের বিধান।
করহ রাজন অশ্বমেধ সহস্রান।।
অশ্বমেধে তুষ্ট হয়ে দেব‌ নারায়ণ।
পূরিবেন তব কাঙ্ক্ষা ব্রহ্মার বচন।।

নারদের পরামর্শে ইন্দ্রদ্যুম্ন রাজা।
অতি ত্বরা আয়োজনে নিয়োজিছে প্রজা।।
যজ্ঞ লাগি বিদ্যাপতি তীর্থে তীর্থে যায়।
উপকরণ লইয়া ফিরেন সেথায়।।
দশশত অশ্বমেধ যজ্ঞ রাজা করে।
আকাশে দেবতাগণ ধন্য ধন্য করে।।
যজ্ঞ শেষে গগনেতে হয় দৈববাণী।
সাগরে ভাসিছে দারু শঙ্খচক্রপাণি।।
ত্বয়া যাও তুলি লও সেই দারুখানি।
জগন্নাথ রাম ভদ্রা মূর্তি তিনখানি।।
যজ্ঞ অন্তে নৃসিংহদেবে প্রণমিয়া।
সমুদ্র ধারেতে উপনীত হয় গিয়া।।
মহাদারু দেখি রাজা আনন্দে অধীর।
দারু গড়াইতে সবে হয়েন অস্থির।।
রাজার প্রার্থনে আসি শবরনন্দন।
প্রণাম করিয়া ঠেলে দারু অনুক্ষণ।।
গড়গড় গড়ে মহাদারু অতি গতি।
দারুর বিগ্রহ রূপ কে দিবে আকৃতি।।
কত আইল কত যাইল সূত্রধর।
দারুর ওপর নাহি কাটিল আঁচড়।।
বিশ্বকর্মা বুড়া মহারাণা সাজ ধরি।
আসেন সভাতে শেষে হাতে যন্ত্র ধরি।।
লোলচর্মসার বৃদ্ধ দেখি সূত্রধরে।
আশাহীনে করাঘাত করে নিজ শিরে।।
সূত্রধর কহে রাজা না হয় কাতর।
এ হাতে গড়েছি সব জঙ্গম স্থাবর।।
রাজা কহে বেশ বাপু করহ নির্মাণ।
দিলাম তোমা মাত্র কয়েক দিনমান।।
জগন্নাথ বলভদ্র সুভদ্রার মূর্তি।
অখিলের নাথ তিহোঁ২৬ জগতের গতি।।
সূত্রধর কহে আছে শর্ত এক মোর।
বিগ্রহ গড়ার কালে বন্ধ রবে দোর।।
মোর বাক্য অন্যথায় হব অদর্শন।
অসমাপ্ত মূরতিত্রয় রবে রাজন।।
কেহ যেন কোন পায় নাহি দেখে ঘরে।
কহে যেন সন্দেহেতে নাহি খোলে দ্বারে।।
রাজা কহে তোমা আজ্ঞা শিরোধার্য করি।
আরম্ভ করহ শিল্পকার্য ত্বরা করি।।

দিনে দিনে মূর্তি গড়ে বৃদ্ধ শিল্পকার।
দিন যায় রাত যায় শিল্পী নির্বিকার।।
কক্ষের ভিতর হতে বহু শব্দ আসে।
ঠকা ঠক ঠাঁই ঠাঁই সদা কানে ভাসে।।
একদিন সব শব্দ গেল থামি দিনে।
শঙ্কিত হইল রাণী যন্ত্রশব্দ বিনে।।
কি হ’লো কি হ’লো বলি করে কানাকানি।
গুণ্ডিচার পরামর্শে ভুল করি রাজা।
গুপ্ত নির্মাণ ঘরের খুলিল দরজা।।
কোথা বৃদ্ধ সূত্রধর কোথা যন্ত্রসব।
পড়ি আছে অসমাপ্ত দেবমূর্তি সব।।
রাজা নিজ মতিভ্রমে করে হায় হায়।
তীরেতে আসিয়া নৌকা ডুবিল তলায়।।
অসমাপ্ত মূর্তি তিন কোন কাজে লাগে।
সাকার বিষ্ণু প্রতিষ্ঠা নাহি বুঝি ভাগে।।
নারদ আসি ইন্দ্রদ্যুম্নে প্রবোধ করে।
মূর্তিতে প্রতিষ্ঠা হোক হরি ইচ্ছা ধরে।।
অখণ্ড ব্রহ্মের কভু খণ্ড নাহি হয়।
অসমাপ্ত কিছু ভবে নাহি সমুচয়।।
পূর্ণ থেকে পূর্ণ লও পূর্ণ পড়ি রবে।
পূর্ণ থেকে যাহা কিছু দেখিছ এ ভবে।।
অপূর্ণ বলি ভবে কিছু নাই রাজন।
অখণ্ড পুরুষোত্তম সর্বত্র চিন্তন।।
এই তত্ত্ব যেই মানে সেই ব্রহ্মজ্ঞানী।
সংশয় ত্যজ রাজা কহে দেবমুনি।।
কৃষ্ণবর্ণে জগন্নাথে করে অঙ্গরাগ।
শ্বেতবর্ণে বলভদ্রে সেবে অঙ্গরাগ।।
অতসীবর্ণে সুভদ্রা অঙ্গরাগে সাজে।
তিন বিগ্রহ রত্নসিংহাসনে বিরাজে।।
ব্রহ্মা আসি প্রতিষ্ঠা করেন দেবগণে।
ধন্য রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কহে জনে জনে।।
পুরীতে জগন্নাথের মঙ্গলবাণী কথন।
কলিযুগে সবাকার কলুষহরণ।।
দারুতনুধর মহাবাহু জগন্নাথ।
ত্বরাও কলির জীবে মাথে রাখ হাত।।
তুমি মাতা তুমি পিতা বন্ধুসখা তুমি।
তুমি বিদ্যা তুমি নিত্যা সর্বস্ব হে তুমি।।
তুমি বিনু কেহ নাহি জগত মাঝারে।
ভবঘোরে দয়া করি তড়াহ আমারে।।
মহাপ্রসাদ ভক্ষণে জাগে যেন প্রীতি।
মানুষে মানুষে মিলে হোক এক রীতি।।
জগন্নাথ মহাবিষ্ণু সকলের নাথ।
ঘুচাও সকল‌ গ্লানি ঘুচাও তফাত।।
মানুষে মানুষে জাগে নিত্য দয়াময়।
মানুষে মানুষে ভেদে দেব দূর হয়।।
জয় জয় ব্রহ্মাশিবে জয় জগন্নাথ।
সশক্তিক শ্রী ভূঃ ভদ্র ভদ্রা চক্র সাথ।।
মোর গুরু জগদ্গুরু জানি সবে মনে।
মোর নাথ জগন্নাথ মানি সবে প্রাণে।।
ভক্ত অনুকম্পা জগন্নাথ পাহিমাম।
হৃদি বিহারক জগন্নাথ রক্ষোমাম।।
জগন্নাথের মহিমা কহনে না যায়।
কোটি বেদ কোটি শাস্ত্র ভূমিতে লুটায়।।
আদিতে বাল্মীকি ব্যাস বর্ণিবারে নারে।
আমি অধম মানব কি আর পারে।।
শত মুখে শত বার গাইব মণিমা।
জয় জয় জগন্নাথ জাতির প্রতিমা।।
মানুষে মিলাও মহাপ্রভু জগন্নাথ।
অবলের বল তুমি অনাথের নাথ।।
অধম গোপালচন্দ্র স্মরি হে তোমায়।
দীনহীনে আসি দেখা দাও দয়াময়।।
শ্রীজগন্নাথবিজয় দিলাম তোমায়।
কৃপা করি গ্রহণ করহ দয়াময়।।
কাব্যখানি এই খানে হলি সমাপন।
জগন্নাথ পাদপদ্মে রাখ প্রাণমন।।
কবি হারায় যাবে মহাকালের জলে।
কাব্যখানি রহি যাক বঙ্গ ধরাতলে।।
দেশমাতা মুক্ত হবে জেনে রেখো স্থির।
ঘরে ঘরে জন্ম দাও শত শত বীর।।
জননী ও জন্মভূমি নিত্য স্বর্গতর।
দেবতার কৃপাবশে বহু বীর গড়।।
মায়ের শৃঙ্খল সবে ভাঙি দিও সবে।
বীরগতি লভি স্বার্থক জনম হবে।।
সর্বতীর্থ সার ভারত মোদের দেশ।
বুদ্ধ শঙ্কর নিমাইদের মহাদেশ।।
সর্বজন পদতীর্থে করি গো প্রণাম।
ভক্তের পদধূলি মোর বৈকুণ্ঠধাম।।
কাব্যখানি এইবার সমাপন হল।
মহা আনন্দে সবাই হরি হরি বল।।

ইতি তারিখঃ আষাঢ়স্য অষ্টি২৭
দিবস বৃহস্পতিবার
সাঃ একচক্রা জিলা বর্দ্ধমান
শ্রীশ্রীজগন্নাথবিজয়কাব্যসমাপ্তম্।
যথা দৃষ্টং তথা লিখিতং
লিক্ষকো২৮ দোষ নাস্তি
শিষ্য প্রশিষ্যকুলের পাপ নাস্তি।।
জয় গুরু গোঁসাই।
জয় শ্রীজগন্নাথ মহাপ্রভু জীউ।।
হরি ওঁ তৎসৎ।।

বিশেষ কয়েকটি শব্দের প্রতিশব্দ ও শব্দার্থ

১. ঈশ্বর, ২. সূর্যদেব, ৩. আমি, ৪. দেখে, ৫. হইল, ৬. করিল, ৭. এখানে, ৮. হয়ে, ৯. উলুধ্বনি, ১০. বলরাম, ১১. সুভদ্রা, ১২. সুদর্শন চক্র, ১৩. কৌতুহলে, ১৪. তিনি, ১৫. কথায়, ১৬. দ্রুত, ১৭. ব্রাহ্মণ, ১৮. দুর্গম, ১৯. হাত, ২০. আকাঙ্ক্ষা, ২১. কন্যার দিব্যি, ২২. অ থেকে ক্ষ পর্যন্ত চৌত্রিশ বর্ণযুক্ত স্তব, ২৩. বন্ধু, ২৪. অসময়, ২৫. ক্ষমা করেন, ২৬. তিনি, ২৭. আট, ২৮. লেখকের (অনুলেখকের)।

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

স্বামী বিবেকানন্দের যোগ ভাবনা | Top Best 4 Yoga by Swami Vivekananda

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Best Tattoo Machine 2023 | ট্যাটু মেশিনের ক্রমবিকাশ | প্রবন্ধ ২০২৩

32 Beshas of Jagannath Mahaprabhu | পুরীর জগন্নাথ মহাপ্রভুর বত্রিশ প্রকার সাজ-শৃঙ্গার

Shree Jagannath Bijay Kabya 2023 | Shree Jagannath Bijay Kabya pdf 2023 | Shree Jagannath Bijay Kabya reader | Journal review – Shree Jagannath Bijay Kabya | Shree Jagannath Bijay Kabya review | Shree Jagannath Bijay Kabya book | Shree Jagannath Bijay Kabya download | New article – Shree Jagannath Bijay Kabya | Shree Jagannath Bijay Kabya video series | Shree Jagannath Bijay Kabya – trend topic | Shree Jagannath Bijay Kabya – best seller | New book – Shree Jagannath Bijay Kabya | Shree Jagannath Bijay Kabya in USA | Shree Jagannath Bijay Kabya sankalan | Shabdodweep – Shree Jagannath Bijay Kabya | Full book – Shree Jagannath Bijay Kabya | Web series – Shree Jagannath Bijay Kabya | Full details – Shree Jagannath Bijay Kabya | New cd – Shree Jagannath Bijay Kabya | Shree Jagannath Bijay Kabya CD series | Shree Jagannath Bijay Kabya – Avijit Pal | Shree Jagannath Bijay Kabya – Shabdodweep | Shree Jagannath Bijay Kabya in India | Shree Jagannath Bijay Kabya in Bengali | Shree Jagannath Bijay Kabya in English | Translation of Shree Jagannath Bijay Kabya | Trending topic – Shree Jagannath Bijay Kabya | Top Shree Jagannath Bijay Kabya | Shabdodweep Founder | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Article | Shabdodweep Writer

Leave a Comment