Godhuli | গোধূলি | রম্যরচনা | জয়ন্ত কুমার সরকার | Best 2023

Sharing Is Caring:
BENGALI STORY

গোধূলি – জয়ন্ত কুমার সরকার [Godhuli]

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার এক শেষ বিকেলের মিষ্টি আলোয় প্রথম পাত্রী দেখার সময়টা আমার ভীষণ মনে পড়ে। বন্ধু সুরেশের সঙ্গে আমিও ছিলাম কনে দেখার সেই গোধূলিবেলায়। মনে পড়ে ঠিকানায় পৌঁছেও বাড়ি না খুঁজে পাওয়ার হয়রানি। পাত্রীর বাবা অমলবাবু যদিও অপেক্ষায় ছিলেন, কিন্তু উনি সুরেশকে দেখেননি, গোলমালটা সেখানেই, তখন মোবাইল ছিল না। আসলে ঐ নামে দুজন বাসিন্দা ছিলেন এলাকায়, পদবী বলা হয়নি, তাই অন্যজনের বাড়ি দেখিয়ে দেয় একটি ছেলে। পরে ভুল ভাঙল, পদবী বলার পর। বাস আসার খবর পেয়েছিলেন, বাড়িতেই ছিলেন ভদ্রলোক, সদর দরজার সামনে একটু সামনে গলিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আমাদের দেখে এগিয়ে এসে নমস্কার করে নিজেই বলেছিলেন, আসুন আসুন, আপনারা আমার বাড়িতেই এসেছেন, নিজেই নাম বললেন। কি বিভ্রাটে পড়েছিলাম, আগের ঐ বাড়িতেও একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা ছিল, ওরা শুনে হতচকিত, পরে বুঝতে পেরে বলেছিলেন, আপনার বাড়ি ভুল করেছেন। যাঁকে খুঁজছেন, তাঁর বাড়ি পুকুরের অন্য পাড়ে। গলি রাস্তা পেরিয়ে অমলবাবু যেখানে নিয়ে গেলেন, সেটা বাড়ির অন্দরমহল নয়, বাহির মহল অর্থাৎ অতিথিদের জন্য বাইরের বসার ঘর। মাটির প্রাচীর দেওয়া এক অন্য উঠোন, দরজা ঠেলে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হল আমাদের। হাতমুখ ধোওয়ার জায়গা দেখিয়ে দিলেন এক মাঝবয়সী সুবেশী ভদ্রমহিলা। বালতিতে জল,সাবান, পাশেই পরিষ্কার টাওয়াল রাখা ছিল। উঠোন পেরিয়ে বড় ঘেরা বারান্দায় বসতে দেওয়া হয়েছে; বেশ পরিপাটি করে কয়েকটা চেয়ার সাজানো, তার উপর হাতে বোনা আসন পাতা, চেয়ারের সামনে পালিশ করা টি-টেবিল, এমব্রয়ডারির সুতোয় বোনা টেবিলক্লথ। টেবিলের উপর কাঁচের গ্লাসে জল, বেশ পরিপাটি করে সাজানো। আতিথেয়তা বেশ ভালই মনে হল। জাতিতে কায়স্থ হলেও বেশ সম্পন্ন চাষীর ঘর বোঝা যাচ্ছিল। বেশ বড় উঠান, একদিকে ধানের বড় মরাই, পাশেই পাম্পমেসিন, জলের মোটা পাইপ গোটানো, লাঙল-মই-কোদাল যত্ন করে তুলে রাখা। উঠোনে মাঝখানে সিমেন্টের বাঁধানো তুলসীমঞ্চ। কথাবার্তা চলছিল, আমাদের কোন অসুবিধা হয়েছিল কিনা জানতে চাইলেন অমলবাবু। অন্য বাড়িতে হাজির হওয়ার ঘটনাটা বললাম না, ইচ্ছে করেই। সুরেশ এমনিতেই লাজুক স্বভাবের, তার উপর আজকের নায়ক, সমস্ত নজর ওর উপরেই থাকার কথা; তাই আমিই অগ্রণী ভূমিকায়, পরিচয় অবশ্য করাইনি, আমরা জানি পাত্রকে ইতিমধ্যে কেউ দেখেননি, সুরেশের কথা অনুযায়ী ওদের বাড়িতে মেয়ের বাবা সকালে যখন গিয়েছিলেন, সেদিন সোমবার, তাই সুরেশ তখন অফিস বেরিয়ে গিয়েছিল; সুরেশ বলেছিল, ওদের পাশের পাড়ার এক পারিবারিক বন্ধু যোগাযোগ করিয়েছেন। আগের রাত্রে হঠাৎ করেই উনি ফোন করে জানিয়েছিলেন সকালে একজন ভদ্রলোক আসতে পারেন। সুরেশের জন্য পাত্রীর খোঁজ চলছিল জানতেন, সেই সূত্রেই এই দেখাশোনা।

পাত্রীর বাবা, অমলবাবু দাঁড়িয়েই কথা বলছিলেন, আমি ওনাকে বসতে বললাম। আগের ভদ্রমহিলা সরবত দিয়ে গেলেন সকলকে, একটু পরেই কাঁচের প্লেটে মিষ্টি-সন্দেশ, প্লেটভর্তি দই নিয়ে এলেন সবার জন্য। বেশ ভালই আপ্যায়ন, এখনও অবধি ঠিকঠাক চলছে, পরে কি হয় সেই ভাবনায় ভালো লাগায় রোমাঞ্চিত হচ্ছি, আমি পাত্র না হলেও একই বয়সী আমরা সকলেই, তাই মজাটা কম হচ্ছে না। সুরেশ মাঝে মধ্যেই আমার হাত টিপছে, ফিসফিস করে দু-একটা কথা বললেও মুখে বলছে না কিছুই ।আমাদের সন্ধানী চোখ খুঁজে চলেছে প্রথম থেকেই একজনকে, ফিসফাস চলছে, যদি আগেই দেখে ফেলা যায়। কয়েক জোড়া কৌতূহলী চোখ ঘুরছে আমাদের সকলের উপরে, পাত্র কোন জন বুঝতে পারছে না । বেশ মজাই লাগছে। সরাসরি জিজ্ঞেস করতেও পারছে না। ওদের চোরা চোখের ইশারা, প্রথম যৌবনের প্রাণচঞ্চল সেই ভালো লাগার রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে আপ্লুত তখন। খাওয়ার পালা শেষ, সব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হওয়ার পর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, তাঁকে আনা হল, মানে তিনি এলেন এবং জয় করলেন। নমস্কার করে নতমুখে বসলেন সামনে শ্রীময়ী। তখনও কেউ জানে না, ছেলে কে! বেশ উপভোগ করছি তারিয়ে তারিয়ে, সবার চোখেই আমরা সমান, যে কেউ পাত্র হতে পারে। এখন সেই দৃশ্যটা মনে পড়লে নিজেদের কেমন যেন ব্যাকডেটেড মনে হয়, এখন কনে দেখার প্রথা চালু থাকলেও, এরকমভাবে দেখা হয় না, দেখাশোনার কথা শুরু হলেই মোবাইল-হোয়াটস-অ্যাপের দৌলতে অনেক আগেই চেনাশোনা হয়ে যায়, বিয়ের যোগাযোগ হলে ফেসবুক-প্রোফাইল আঁতিপাঁতি ঘেঁটে পাত্র-পাত্রী উভয় পক্ষই সমস্ত কিছু দেখে বুঝে নেয়, আরও খোঁজ নেওয়া শুরু হয়ে যায়, চ্যাট চলতে থাকে, ছবির আনাগোনা চলতে থাকে, যত দিন না শুভ সংবাদ খবরে আসে। তখন সালটা ১৯৯০, এখন ‍থেকে ৩২ বছর আগের সময় সেটা, মোবাইলের যুগ শুরুই হয়নি, কাজেই সামনাসামনি না হলে বোঝা যেত না অনেক কিছুই। আমিই উদ্যোগী হয়ে কথা বললাম, শ্রীময়ীর নামধাম, খাতায় হাতের লেখা, ধাঁধার প্রশ্ন-উত্তর, অঙ্কের মারপ্যাঁচ, বোকা বানানো প্রশ্ন- এসব চলল কিছুক্ষণ। আসলে নাস্তানাবুদ করা নয়, মেয়েটি কতটা সচল সপ্রতিভ সেটা দেখার জন্য কথা বলানোর চেষ্টা হয়েছিল সেদিন। সুশ্রী চেহারা, লম্বা ফর্সা পাতলা গড়ন, উজ্জ্বল দুটি চোখের সরলতা, সলজ্জ মুচকি হাসি, এসব মিলিয়ে আমার নজরে ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল, যদিও আলাদা করে কথা বলা হয়নি সুরেশের সঙ্গে। বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায়নি গোপনীয়তা, কথাবার্তার মধ্যেই সুরেশই যে পাত্র, তা বুঝে গিয়েছিল সকলে। ফেরার সময় থামের আড়ালে দাঁড়িয়ে একজোড়া সতর্ক চোখ খুঁজেছিল অনেকক্ষণ, আমার সঙ্গেও চোখাচোখি হয়েছিল, সঙ্গে সঙ্গে আলতো হেসে সরিয়ে নিয়েছিল চোখ। আমি যেহেতু বেশী কথা বলছিলাম, তাই আমাকেও নজরে রেখেছিল মেয়েটি, বোঝা যাচ্ছিল। ফিরে এসেছিলাম সেদিন আশা-নিরাশার দোলাচল সঙ্গে করে। পরের কয়েকদিন সুরেশের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছিলাম, বেশ পছন্দই হয়েছিল সুরেশের মেয়েটিকে। মনে মনে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল ঘর বাঁধার। আমার সঙ্গে সুরেশের যোগাযোগটা কমে এসেছিল আমি চাকরী নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাওয়ায়। দেখতে দেখতে অনেকগুলো পেরিয়ে গিয়েছে।

সপরিবারে গিয়েছিলাম ভুবনেশ্বর, ওখানে মেয়ে-জামাই থাকে চাকরীর সূত্রে। সেই বিশেষ সময়টা যখন করোনা ভাইরাস চিনে ধরা পড়েছে, খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, অন্য দেশের সঙ্গে ভারতেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা এসব খবর শুনছিলাম, হঠাৎ করে লকডাউন ঘোষণা হয়ে গেল। এক সপ্তাহের মধ্যে যে যেখানে বাইরে ছিল. ছাত্র-ছাত্রী, পর্যটক, ব্যবসায়ী পড়িমরি করে ঘরে ফিরে আসতে শুরু করল, কেউ বুঝল, কেউ বুঝল না, কি করা উচিত, একটা হট্টগোল, বিশৃঙ্খল অবস্থা। এদিকে বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ পর হনিমুন থেকে ফিরেই ট্রেনিং-এ চলে যায় মুম্বাই, সেখান থেকে সরাসরি ফ্লাইটে ভুবনেশ্বর চলে যায় জামাই, তারপর থেকেই আটকে পড়ে। কয়েকদিন শ্বশুরবাড়িতে থেকে মেয়ে আমার এখানে চলে আসে, ওর শ্বশুরমশাই আমার বাড়িতে দিয়ে যান। এর পরই কোভিড লকডাউন শুরু হয়ে গেল। ছোঁয়াচে এই রোগ নি:শ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে, সকলের মুখে মাস্ক, কেউ কারও সামনে আসছে না, সকলকে বাড়িতে গৃহবন্দী থাকার পরামর্শ। এ একরকম মহামারি বিগত দুশো বছরে হয়নি বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা; অদৃশ্য শত্রু, চোখে দেখা যায় না, অথচ যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে। ফোনে ফোনে চলছে আদানপ্রদান। দোকান-ব্যবসা বন্ধ প্রায়। হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ওষুধ আর কিছু জরুরী পরিষেবা ছাড়া সব লকডাউনের আওতায়। খাবার দোকানেও সতর্ক নজর। দমকল,পুলিশ-প্রশাসন ছাড়া সরকারী দপ্তরও বন্ধ প্রায়। ভয়ে আতঙ্কে এরকম যখন সারা দেশের অবস্থা এই সময়টায় ভুবনেশ্বরে মাস দেড়েক আটক থাকার পর লকডাউন উঠলে বাড়ি আসে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর ভুবনেশ্বরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে মেয়েকে নিয়ে যায়। নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের, নতুন ফ্ল্যাটবাড়ি, জায়গাটাও খুব পরিচিত হয়, সংসার কেমন গুছিয়েছে, দু-একটা আসবাবপত্র দেওয়ারও ছিল, মূলত সেই উপলক্ষে ভুবনেশ্বরে যাওয়া আমাদের। সঙ্গে আমার পুত্র আর পূর্ণাঙ্গিনী। কয়েকদিন থাকলাম, ঘুরলাম ভুবনেশ্বর শহর। ভুবনেশ্বর থেকে মাত্র দেড়ঘন্টার পথ পুরী, সকলে মিলে পুরীর জগন্নাথ মন্দির, কোনারক, উদয়গিরি, খণ্ডগিরি ঘুরলাম, পরের দিন ভুবনেশ্বরে লিঙ্গরাজ মন্দির ঘোরা সারা হল। ওরা ওখানে রয়ে গেল, নতুন সংসার করুক, নতুন করে বুঝে নেওয়ার পালা পরস্পরের।

আমাদের এবার ফেরার পালা। অনলাইনে টিকিট বুক করেছে বিল্টু। ফিরছি পুরী-আনন্দ-বিহার এক্সপ্রেস ‍ট্রেনে। জানলার পাশের সিট বুক করে কি যে বিভ্রাট, হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলাম সেদিন। ভুবনেশ্বর থেকে বিষ্ণুপুর আসার জন্য আই.আর.সি.টি.সি অ্যাপে সিট রিজার্ভেশন করছি। সিট চয়েস অপশনে আমার পরিবারের দুজনের নামে জানালার পাশের সিট চয়েস দিয়েছিলাম। রিজার্ভেশন কমপ্লিট হতে দেখা গেল, আমার সিট এক বগিতে, ছেলে আর ওর মা অন্য বগিতে। বেশ চিন্তায় পড়লাম হয়রানির আশঙ্কায়, পরে ভাবলাম পাশাপাশি কামরা তো ম্যানেজ করা যাবে । জার্নির দিন নির্দিষ্ট সময়ের পরে “পুরী-আনন্দ বিহার” এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকলে কোচ সাজানো হয়েছে দেখলাম, আমার কোচ D-1 ইঞ্জিনের ঠিক পরেই, ওদের D-2 বগি একেবারে শেষে গার্ডরুমের আগে। । সেদিন প্লাটফর্মে এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, লাগেজ নিয়ে কি যে হয়রানির স্বীকার হতে হয়েছিল, একেবারে নাকাল অবস্থা, ভুক্তভোগীরা বুঝতে পারছেন। শেষ পর্যন্ত D-1 কোচের আমার সিট ছেড়ে ওদের D-2 কামরাতেই উঠেছিলাম, সম্পূর্ণ পৃথক বগি, পুরানো ব্যবস্থা। সিট ফাঁকাই ছিল উপরের বাঙ্কে লাগেজগুলো তুলে দিয়ে বসে পড়লাম তিনজনে। একটা স্টেশন পরেই জানালার পাশেই সিট পেয়ে গেলাম সহজেই। ট্রেন ছুটে চলেছে তীব্র গতিতে। রোদের তেজ কমে গেলেও মিঠে রোদের ঝাঁজ রয়েছে তখনো। জানালা খোলাই ছিল। সাঁই সাঁই করে গাছ-ঘরবাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে। ক্রমশ: আলো কমছে, আঁধার নামছে দূরের পাহাড়ের বুকে, গাছপালা ঝাপসা হয়ে ক্রমশ: আঁধারে মিশে যাচ্ছে। হালকা অবয়ব গাছের সারি, শহরে প্রবেশ করতেই আলোর বন্যা। বাড়ির আলো কারখানার আলোয় উদ্ভাসিত শহরের রাজপথ,লোকজন পেরিয়ে যাচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাতের আদিগন্ত ঘন কালো আকাশে একফালি চাঁদ, যেন আমারই সহযাত্রী ! আহা কি অপরূপ ! মনে পড়ে গীতা দত্তের সেই মিষ্টি সুর “নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে”! ভালো লাগায় মন ভরে উঠেছিল। প্রকৃতির এত সৌন্দর্য, এত মনোরম সন্ধ্যা, মৃদুমন্দ বাতাসে ঘুমের আবেশে ছিলাম অনেকক্ষণ। লম্বা সফর, যাত্রীর ওঠানামা নেই সেরকম, অনেক দূরে পরের স্টেশন। তাই ট্রেনের কামরায় এক অদ্ভুত নীরবতা, শুধুমাত্র ট্রেনের ঝিকঝিক একটানা শব্দ, মাঝে মাঝে হুইশিলের লম্বা টান। এক আলাদা নৈ:শব্দ, ট্রেনের দোলুনী বেশা আরামদায়ক, একটা ঘোরের মধ্যে ভাবনার রাজ্যে পাড়ি দিয়েছিলাম আনমনে, নির্জনতা উপভোগ করছিলাম। পথহীন বনে হারিয়ে যাওয়ার একটা আনন্দ আছে, নির্জনতায় নিজেকে স্বাধীন মনে হয়, নিজের উপর নির্ভরতা বাড়ে; মহাপুরুষগণ তাই নির্জনতা পছন্দ করেন, লোকালয়ের কোলাহল ওরা সহ্য করতে পারেন না । নিস্তব্ধ বিকেল, নি:স্ব হয়ে যাওয়া ভোর, নি:সঙ্গ প্রহর আমার অনুভূতিকে পুষ্ট করে, নির্জনতা অনুভব করতে শেখায় । নির্জনতার বুকে যখন আঁচড় কাটে শৈশব, গহন মনের অন্ধকারে আলোকরেখার মত পথ দেখায় নির্জনতা, বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাওয়া ঘটনার অ্যালবাম থেকে খুঁজে আনি মনি-মুক্তো, আমার হারিয়ে যাওয়া শৈশব, কৈশোর, যৌবনের সোনাঝরা দিনগুলির কথা মনে আসে, ছেলেবেলার কত টুকরো ঘটনার জলছবি ভেসে উঠছে মনের আয়নায়। স্মৃতির সরণী বেয়ে মন চলে যায় কৈশোরের সেই সোনাঝরা দিনগুলোতে। আমাদের বাড়ীর পাশের পুকুরটার জল গ্রীষ্মের দাবদাহে শুকিয়ে গেলে, পুকুরের পাড়ে সবুজ ঘাসের উপর আমরা কয়েকজন খেলতাম, ঘুড়ি ওড়াতাম; অন্ধকার নামার আগে সকলে ফিরে গেলেও আমি থেকে যেতাম। একা বড় ভাল লাগতো ঐ সময়টা। পড়ন্ত বিকেলের শেষে আঁধার ঘনিয়ে ক্রমশ: সন্ধ্যে নামে, গোধূলির মিষ্টি আলো চুঁইয়ে পড়ে গাছপালায়, ঘাসের উপর, ঝাপসা হয়ে আসে চারিধার, শহরের কোলাহল, গাড়ির আওয়াজ,পাখির কুজন ধীরে ধীরে মিলিয়ে শান্ত চুপচাপ হয়ে যেত, দূরে রামধনু রাঙা আকাশ পথে বকের সারি; আবছা আলোয় অপূর্ব মোহময় প্রকৃতির শোভায় মোহিত হয়ে যেতাম আমি, সবুজ মখমলের বিছানায় ঠাণ্ডা ফুরফুরে হাওয়ায় শ্রান্ত আমার চোখে ঘুম নেমে আসত; স্বপ্নপরীদের আনাগোনা শুরু হয়ে যেত, আর ঠিক সেসময় আচমকা মায়ের কোমল স্নেহের ছোঁয়ায় ধড়মড়িয়ে উঠে বসতাম; আজও মনে হয় এই তো সেদিন ! মনে পড়ে এই তো সেদিন, অফিসের কয়েকজন মিলে পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে গিয়েছিলাম, বাঘমুণ্ডির সাহারজোড় নদীর মরগুমা জলাধার দেখতে ; পড়ন্ত বিকেলে জলাধারের ওপারে সূর্য তখন অস্তাচলে গোধূলির মিষ্টি আলোয় নৌকায় দুই কপোত-কপোতির অস্পষ্ট ছবি; মনে পড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সেই অবিস্মরণীয় গানের লাইন, “সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশতো….গোধূলির রঙে হবে এ ধরণী স্বপ্নেরও দেশতো…বেশতো..বেশতো!” শাল-পিয়ালের জঙ্গলের পথে কলসী কাঁখে আদিবাসী রমণীর জল নিয়ে ফিরে আসে, গোধূলির শেষে সন্ধ্যে নামে পাহাড়ের বুকে, মাদোলের দুদুম-দুম শব্দ ভেসে আসে মরগুমা গ্রাম থেকে । সব মিলিয়ে প্রকৃতির সুন্দর এক নৈসর্গিক ছবি, এখনও চোখের সামনে জলছবির মত ভাসছে। আর পারছিলাম না, দুচোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। দুপুরের ভুবনেশ্বর স্টেশনের কোচ খুঁজে না পাওয়ার উৎকণ্ঠা, ভারী লাগেজ নিয়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার কষ্ট এখন আর মনে নিতে চাই না। তবে, আমার মনে হয় জানালার পাশে দু্জনের জন্যই সিট চাওয়ার অপশনটা বোধহয় ভুলই ছিল আমার। কম্পিউটারের প্রোগ্রাম ওভাবেই হয়তো সেট করা থাকে। নইলে তিনজনের সিট দুই বগিতে এভাবে পড়ত না ভাগ্যে। তাই ঠিক করেছি ভুলেও, ট্রেনে অনলাইন টিকিট বুক করার সময় দুজনের নামে জানালার পাশের সিট চয়েস, নৈব নৈব চ। ন্যাড়া আর বেল তলায় যাচ্ছে না। সেদিনই রাত্রি আটটা নাগাদ ফিরলাম বিষ্ণুপুরের বাড়িতে।

বাড়িতে ফিরে যথারীতি কাজে মন দিতে হয়েছে। হঠাৎ করে একদিন দেখা সুরেশের সঙ্গে। আমি বিষ্ণুপুরে এখন পুরানো পাড়ায় থাকি না, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় মাঝে মধ্যে, নিয়মিত না হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় সবার সঙ্গে যোগাযোগ আছে। আমি আমাদের পুরানো বাড়িতে গিয়েছিলাম, বাড়িটাতে এখন কয়েকজন ছাত্র থাকে, মেসের মত করে। একটু সময় বের করতে পারলেই যাই আমার পুরানো পাড়ায়, বাড়িটায় কিছুক্ষণ ছেলেগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলি, খবর নিই, সুবিধা-অসুবিধা জানায় ওরা। বেরিয়ে আসছি, কালী মন্দিরের সামনেটা এখন জমজমাট, নাসিংহোম হয়েছে একটা, ওখানেই রাস্তায় দেখা হয়ে গেল সুরেশের সঙ্গে। কথা বলে জানলাম চাকরী সূত্রে বাইরে থাকে এখন। পুরুলিয়ার কোন একটা স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি করে সুরেশ; বিয়ে করেছে অনেকদিন হল, দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে ভরা সংসার তার। ক্লাবের সামনে পদ্মর চা-দোকানে চা নিয়ে বসলাম। অনেকদিন পর দেখা, ব্যস্ততার মাঝে ফোনে সেরকম কথা হয় না, হোয়াটস-অ্যাপে যোগাযোগ থাকলেও কমই বলা যায়। অনেক কথা হল। গোধূলির মিষ্টি আলোয় প্রথম মেয়ে দেখার সেই সোনালী দিনটার কথাও আলোচনার মধ্যে এল। শুনে খানিকটা অবাকই হলাম, সুরেশের বিয়ের জন্য যাঁরা যোগাযোগ করিয়েছিলেন, তাঁদের ইচ্ছেতেই নাকি সুরেশের বিয়েটা হয়নি ওই মেয়েটির সঙ্গে। সুরেশ বলেছিল, মেয়েটি একজন পরিচিতের কাছে ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল, যাতে বিয়েটা না ভাঙে, অপেক্ষা করতে অনুরোধ করেছিল সুরেশকে। কিন্তু বিধাতা ইচ্ছে অন্য ছিল। শেষ বিকেলের আলোয় হারিয়ে যাওয়া সেই টুকরো টুকরো মন খারাপের জলছবির কোলাজ সামনে এল অনেকদিন পর, সুরেশ এখন আর মনে রাখতে চায় না।

জয়ন্ত কুমার সরকার | Jayanta Kumar Sarkar

New Bengali Poetry 2023 | কবিতাগুচ্ছ | শুভশ্রী রায়

New Bengali Poetry 2022 | কবিতাগুচ্ছ | কল্যাণ সুন্দর হালদার

New Bengali Poetry 2023 | কবিতাগুচ্ছ | নীলমাধব প্রামাণিক

New Bengali Poetry 2023 | কবিতাগুচ্ছ | বিকাশ চন্দ

Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | Godhuli Online Store | Godhuli Alap | godhuli meaning | godhuli in english | godhuli bela | godhuli time | godhuli app | godhuli alap cast | godhuli bela time today | godhuli bela | godhuli muhurta | godhuli bela time | godhuli alap serial cast | godhuli time today | godhuli muhurta is good or bad | godhuli gagane meghe lyrics | mohanagar godhuli | aji godhuli logone | aji godhuli logone lyrics | godhuli bengali story | godhuli story pdf | godhuli story video

Leave a Comment