Best Bangla Uponnash Online Reading 2023 | গঙ্গাপাড়ের গাথা

Sharing Is Caring:

গঙ্গাপাড়ের গাথা – সুদীপ ঘোষাল

এক – নেপালের সংসারের কথা [Bangla Uponnash Online Reading]

নেপালের পরিবার গঙ্গানদীর ধারে বাস করে ১৯৭২ সাল থেকে।নদী যেন এদের কাছে মায়ের মত।তার বুকে আশ্রয় করে বাস করে মানুষ। নেপাল জানে,গঙ্গা হিন্দুদের কাছে পবিত্র নদী। তারা এই নদীকে গঙ্গা দেবীজ্ঞানে পূজা করেন। গঙ্গার ঐতিহাসিক গুরুত্বও অপরিসীম। একাধিক পূর্বতন প্রাদেশিক ও সামাজিক রাজধানী যেমন পাটলিপুত্র কনৌজ,কাশী, এলাহাবাদ, মুর্শিদাবাদ, মুঙ্গের, নবদ্বীপ ও কলকাতা,এই নদীর তীরেই অবস্থিত। গঙ্গা বিশ্বের পাঁচটি সবচেয়ে দূষিত নদীর একটি। বারাণসীর কাছে এই নদীতে ফেসাল কলিফর্মের পরিমাণ ভারত সরকারের নির্ধারিত সীমার চেয়ে একশো গুণ বেশি। গঙ্গাদূষণ শুধুমাত্র গঙ্গাতীরে বসবাসকারী কয়েক কোটি ভারতীয়েরই ক্ষতি করছে না, ১৪০টি মাছের প্রজাতি, ৯০টি উভচর প্রাণীর প্রজাতি ও ভারতের জাতীয় জলচর প্রাণী গাঙ্গেয় শুশুক-এরও ক্ষতি করছে। গঙ্গাদূষণ রোধে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান নামে একটি পরিকল্পনা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু দুর্নীতি, প্রযুক্তিগত অদক্ষতা, সুষ্ঠু পরিবেশ পরিকল্পনার অভাব,ভারতীয় ধর্মীয় ঐতিহ্য ও বিশ্বাস এবং ধর্মীয় সংগঠনগুলির অসহযোগিতার কারণে এই প্রকল্প ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। কিন্তু বর্তমানে সরকারের তৎপরতায় গঙ্গা নদী অনেকটাই দূষণমুক্ত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে পুরো নদী দূষণ মুক্ত হবে, সেই আশা রাখা যায়।নেপালের বাড়ি গঙ্গার ধারে কাটোয়ার নয়াচরে। গঙ্গার ধারে একটা বকুলগাছ ছিল। একটা ভালোবাসার গল্প ছিল নেপালের মনে।সেই ভালোবাসা মনে করে আজও গেঁথে যায় বকুল ফুলের মালা।কত স্বপ্ন, কত আশা বাস্তবের মাটিতে মিশে যায় সহজে মনে দাগ রেখে।

কাটোয়া মহকুমার একটি সুন্দর জায়গার নাম নয়াচর। কাটোয়া চরপাতাইহাট, নয়াচর গঙ্গার ধারে ছায়াছবির মত দেখতে লাগে।হাওড়া থেকে কাটোয়ার প্রায় দূরত্ব ১৫৪ কিমি। কাটোয়া এসে চর পাতাইহাট আসতে হবে। স্টেশন থেকে ৫ কিমি পথ। ট্রেনে এলে দাঁইহাট নামলে সুবিধা হবে। সবুজ পরিবেশে চোখজুড়িয়ে যাবে আরামে। রিসর্ট আছে। এখানে এন-জি-ও’র সংস্থা পাখিশিকারিদের নিষেধ করে এই এলাকায় আসতে। বনদপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, কাটোয়ার ভাগীরথীর মোট তিনটি চরে পরিযায়ী পাখিরা আসছে। নয়াচর চরে বিভিন্ন প্রজাতির সাইবেরিয়ান বার্ড, স্মল পেটিন কোল্ড থেকে শুরু করে কিংফিশারের দেখা মিলছে। এমন কী অস্ট্রেলিয়ান বার্ডও আসছে বলে দাবি বন-দপ্তরের। কাটোয়ায় এবার গাঙ্গেয় ডলফিন রক্ষায় কড়া নজরদারি শুরু করেছে বন-দপ্তর। এর জন্য রাজ্য বন-দপ্তর থেকে দু’টি স্পিড বোটও পেয়েছে কাটোয়া বনবিভাগ। তাতে যেমন ভাগীরথীতে তারা টহল দিচ্ছে, তেমনই ওই বোটে চরগুলিতে পরিযায়ী পাখিদের উপর নজরদারিও চলছে। পরিযায়ী পাখিদের আসার জন্য যে পরিবেশ দরকার, তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করতে তৎপর তারা। এখানে কাটোডলফিন, ভোঁদড়, ব্রাহ্মণী হাঁস, পারাডাইস ফ্ল্যাই ক্যাচার, অনেক রকম সাপ আরও অনেক রকমের পাখি।

নয়াচর গ্রামটি কালীগঞ্জ থানার গোবরা পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে। ওই গ্রাম থেকে অনেক পড়ুয়াই প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে কাটোয়ার পানুহাট রাজমহিষী উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তে আসে। গঙ্গার তীরে অপূর্ব সুন্দর পরিবেশে মন ভাল হয়ে যাবে। জঙ্গল আর বিভিন্ন পশুপাখি এই নয়াচরকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। কাটোয়াতেই মীর কাসিমের সাথে লর্ড ক্লাইভের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধই ছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীনতার যুদ্ধ। তার আগে ঘেরিয়া আর উদয়নালার যুদ্ধে মীর কাসিম পরাজিত হন।অনেকেই মনে করেন, এখন নয়াচরের কাছে এর অবস্থান। কাটোয়ায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেওয়ার পূর্বে মস্তক মুন্ডন করেন। বিভিন্ন রাজ্য থেকে এমনকি বিদেশের পর্যটকরাও কাটোয়ায় আসেন বিভিন্ন মন্দির দর্শন করতে। কাটোয়ায় আছে, শ্রীগৌরাঙ্গ মন্দির, মাধাই তলা আশ্রম, শ্রী রাধাকান্তদেব মন্দির, ঘোষ শিব মন্দির গুরুদুয়ার শাহী মসজিদ, রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ মন্দির, কেরি দ্য জুনিয়রের সমাধিস্থল।এছাড়াও অজয় ভাগীরথী সঙ্গমস্থলে মা কালী মন্দির হরগৌরী মন্দির, হাড়ি বাড়ি, দুর্গা মন্দির, ক্ষ্যেপিমায়ের মন্দির, যুব কালীমন্দির, নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের আশ্রম প্রভৃতি। নিচু বাজারে, গৌরাঙ্গমন্দির, কাঙাল গৌর মন্দির, মহাপ্রভু বা গৌরাঙ্গ মন্দির, একলা নিতাই মন্দির, রাধাকান্ত মন্দির, তমাল তলা রাধাগোবিন্দ মন্দির, ষড়ভুজা মন্দির, বিপদতারিণী মন্দির, গ্রহরাজ মন্দির এবং সন্নিকটে বিখ্যাত ক্ষেপাকালী মন্দির। এছাড়া নীলবাবার কালী মন্দির ঢুকতেই সামনে উঁচু প্রবেশ তোরণ। গৌরাঙ্গ মন্দিরের পাশে আছে বিশাল অশ্বত্থ গাছ, যার তলায় বসে মহাপ্রভুর মস্তক মুন্ডন হয়েছিল। এই স্থানটি অত্যন্ত পবিত্র, গদাধর দাসের সমাধির জন্য । ভিতরে ঢুকে পশ্চিম দিকে সৌদামিনী তীর্থ নিবাস ডান দিকে তুলসী মঞ্চ। মন্দিরের সন্নিকটে রয়েছে মহাপ্রভু ও কেশব ভারতীর পদচ্ছাপ।

পূর্ব বর্ধমান জেলায় অসংখ্য মেলা বসে। মঙ্গলকোট থানার দধিয়ায় মকর সংক্রান্তির সময় এক মাসব্যাপী মেলা বসে। বাবলাদিহিতে মহা শিবরাত্রির সময় একটি নাঙ্গতেশ্বর শিব মেলা রয়েছে। আউসগ্রাম থানার কৈরাপুরে রাম নবমীর সময় এক সপ্তাহব্যাপী মেলা বসে। বাংলা চৈত্র মাসের শেষ দিনে শিবের গাজন উদযাপনের জন্য করুইতে একটি মেলার আয়োজন করা হয়। কাইগ্রাম কুসুমগ্রামে, নেরোদিঘি এবং সুটাতে, পীরের একটি উর্স বাংলার ফাল্গুন মাসে মেলার সাথে উদযাপিত হয়।সাঁওতালরা আশ্বিন নবমীর সময়ে বৈদ্যপুরে মেলার আয়োজন করে। কেতুগ্রাম থানার সিতাহাটিতে বাংলার ভাদ্র মাসে ভাদু উৎসব চলাকালীন একটি মেলার আয়োজন করা হয়। জেলায় আরও অনেক মেলা রয়েছে।

মন্দিরের ঘরে মহাপ্রভুর বিগ্রহ বাম দিকে জগন্নাথ ও ডান দিকে বলরামের আবেগে নিতাই বিগ্রহ। উহার সন্নিকটে ক্ষেপাকালীতলায় চোদ্দ ফুট বিশাল মা কালীর জাগ্রত মূর্তি যা সকলকেই বিস্মিত করে তোলে। মহাপ্রভু কাটোয়ায় কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাস দীক্ষা গ্রহণ করেন। এছাড়া কাটোয়ায় আছে মাধাই তলা আশ্রম ও কাটোয়ার সন্নিকটে আছে কালাকৃষ্ণ পাট মন্দির।। মাধাইতলা আশ্রম হল, বৈষ্ণবদের অন্যতম তীর্থস্থান। দীর্ঘ প্রায় একশো বছর ধরে এখানে দিন রাত হরিনাম সংকীর্তন হয়। এছাড়া কাটোয়ায় আছে সখী আখড়া আশ্রম, এখানেও বিভিন্ন ঠাকুরের মূর্তি আছে। এছাড়া আছে ঘোষেশ্বর তলার বিখ্যাত শিব মন্দির। এখানকার হাড়ি বাড়ির দুর্গা বিখ্যাত।

কাটোয়া মহকুমার অধীনে কেতুগ্রামে, বিভিন্ন প্রজাতির গাছ সহ বনের মাঝে অবস্থিত। এটি কেবল স্বর্গীয় বাসস্থান নয়, বহু সংখ্যক সুন্দর পরিযায়ী পাখির আবাসস্থল হিসাবেও বিখ্যাত, মন্দিরের আধ্যাত্মিক পরিবেশটি ভক্তদের হৃদয় এবং মনকে শান্তি দেয়।নেপালের সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। নেপালের চাকরি নেই, ব্যবসা নেই, টাকা নেই। সে কি করে সংসার চালাবে।নেপাল স্ত্রী কুসুমকে বলল, তুমি যেমন করে হোক ছেলেমেয়েদের বাঁচিয়ে রেখ। আমি চললাম কাজের সন্ধানে। এই বলে নেপাল চলে এল ভবঘুরের মত বর্ধমানের খানা তে।সেখানে চায়ের দোকানে কাজ পেল খুঁজে। কয়েকমাস পরে এক ব্যবসাদারের নজরে পড়ে গেল নেপাল। নেপাল বলল, বাবু, আমার ঘরবাড়ি কিছুই নেই।ছেলেমেয়ে, বউ কোথায় আমি জানি না। আমাকে দয়া করুন।মালিক বলল, ঠিক আছে আমার জমির দুকাঠা তোকে দান করলাম। তার বদলে তুই আমার বাড়ির দেখাশোনা করবি আর আমার শিবমন্দিরে নিত্যপূজা করবি। নেপাল রাজী হয়ে গেল।

এদিকে নেপালের স্ত্রী কুসুম কোন উপায় না দেখে দিদির বাড়ি চলে এল। দিদি খুব খুশি।তিনি বললেন,তুই আমার কাছেই থাকবি, যতদিন খুশি। ছেলেমেয়ে নিয়ে কুসুম কোনরকমে কষ্টকরে দিদির বাড়িতে থাকতে লাগল। আসলে নেপালবাবু শৌখিন মানুষ ছিলেন। কিন্তু চাকরি বা অন্য কোন কাজ করতেন না। ধার করে চলত তার সংসার। সৎ লোকের সুখ দেরীতে হয়। গ্রামের সকলের কাছে উপহাসের লোক হয়ে গেছেন নেপাল। তিনি ঠিক করলেন অন্যত্র গিয়ে ব্যবসা শুরু করবেন। চলে গেলেন আহমদপুর থেকে খানা জংশন। একটা গ্রামে গিয়ে পৌঁছলেন। সেখানে লোকজনের সহায়তায় এক ধনী বাড়িতে পুরোহিতের কাজ পেলেন। নেপালবাবুর দুই ছেলে ও স্ত্রী খেতে না পেয়ে ট্রেনে চাপলো ভিক্ষা করতে। স্ত্রী কুসুম ছেলেদের খাওয়ালো দানের পয়সায়। তারপর ভাবলো, এই স্টেশনে নেমেই তো দিদির বাড়ি যেতে হয়। ভাবাও যা আর হাঁটতে শুরু করে কুসুম দুই ছেলেকে নিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় দিদির বাড়ি। সেখানে গিয়ে প্রথমে স্নান করে দুই ছেলেকে নিয়ে খেয়ে নেয়। তারপর শুরু করে এক নতুন জীবন। সকালে উঠে কুসুম দিদিকে সাহায্য করে রান্নায়। দিদি বলেন, তুই শুধু দুই ছেলেকে নিয়ে সুস্থ হয়ে থাক। তোর জামাইবাবু খুব ভালো লোক। সে অতিথিকে কাজ করতে দেয় না। দিদির তিন ছেলে। সকলে একসাথে আনন্দে দুবছর পার করে ফেলে। এদিকে খানায় কুসুমের স্বামী জায়গা কিনে মাটির বাড়ি তৈরি করে। ছেলেদের আর কুসুমকে সংবাদ পাঠায় আসার জন্য।

দুই – অনিমেষের কথা [Bangla Uponnash Online Reading]

অনিমেষ নেপালের বাড়ির পাশেই থাকে। সে প্যারা-টিচার। এখন চাইল্ড রেজিস্টারের কাজে বাড়ি বাড়ি ঘুরে স্কুলছুট ছাত্রছাত্রীদের নাম সংগ্রহ করছে। পুরো দুটো বুথের ভার তার উপরে পড়েছে।একটা টোটো ভাড়া করে অনিমেষ প্রথমে হাজরাপাড়ায় গেল। টোটো থেকে নেমে সে দিবাকরকে জিজ্ঞেস করল, তোমার ছেলেমেয়ে কটা?
দিবাকর বলল, এক ছেলে আর এক মেয়ে।
— আচ্ছা, ওদের জন্ম-সার্টিফিকেট বের করো তো।
— ঠিক আছে

কিছুক্ষণের মধ্যেই দিবাকর জন্ম-সার্টিফিকেট বের করে অনিমেষের হাতে দিলো। অনিমেষ জন্মের তারিখ লিখে নিল, মোবাইল নাম্বার, পিতামাতার নাম, জন্মস্থান ও আরও অনেক তথ্য সংগ্রহ করে আবার অন্য বাড়িতে ঢুকল।এইভাবে একটা একটা করে প্রায় কুড়িটা বাড়ি ঘোরার পরে বারোটা বেজে গেল। অনিমেষ টোটোভাড়া মিটিয়ে নিজের বাড়িতে গিয়ে স্নান, খাওয়া সারলো। এদিকে অসুস্থ মা বিছানায় পড়ে আছেন। ছেলেটা এম, এ পড়ছে।স্ত্রী বিকেলে টিউশানি পড়ান।সবমিলিয়ে অনিমেষের সংসারে একটা শান্তির পরিবেশ বিরাজমান।

পরেরদিন সকালে উঠেই স্ত্রীর কান্না শুনে অনিমেষ মায়ের ঘরে যায়।মা মারা গেছেন রাতে। সকালে অনিমেষের স্ত্রী উঠে প্রথমে দেখে। অনিমেষ কান্না ভেজা গলায় বলে,মা ছিলেন বলে অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলাম। এবার মাছাড়া কি করে চলবে সংসার জানি না।মা ছিলেন একটা বটগাছের মত।তার আশ্রয়ে বড় হয়েছি।যাইহোক তারপর সব কর্তব্য সারা হলো। শ্রাদ্ধশান্তি মিটে গেলে চাইল্ড রেজিস্টারের কাজ শেষ করে এস, আই অফিসে জমা দিল অনিমেষ। এখন স্কুল ছুটি।অবসরে বাড়ির কাজগুলো সেরে ফেলে অনিমেষ। অনিমেষের ছেলে সুবীর পড়াশোনায় ভালো।তবে ছোট থেকে একা একা মানুষ হওয়ায়, অন্য লোকের সঙ্গে কথা বলতে তার অসুবিধা হয়।একান্নবর্তী পরিবারে কিন্তু এই অসুবিধা ছিল না।সকলে মিলেমিশে থাকার ফলে ছেলেমেয়েদের মনের স্বাস্থ্য ভালো থাকত।এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি।নিজেরটা গুছিয়ে নেওয়ার দিন। তার ফলে দাদু-দিদা বা কাকা-পিসির আদর, স্নেহ তারা উপলব্ধি করতে পারে না। অনিমেষ আংশিক সময়ের শিক্ষকতার কাজ করে।কাজের নিশ্চয়তা নেই। লকডাউনের সময় নিয়মিত বেতনও পায় না।তাই এখন সে বাড়ি বাড়ি পুরোহিতের কাজটা করে সামান্য আয় করে।এছাড়া গৃহশিক্ষকতাও করে। ছেলে ও স্ত্রীও ছাত্র ছাত্রী পড়ায়।কোনরকমে সংসার চলে যায়, পরিবারের সকলের মিলিত প্রচেষ্টায়।

এবার বর্ষাকাল এল। অজয়নদের ধারে বাড়ি। শ্রাবণ মাসের একটা টানা বৃষ্টি ও ডিভিসির জল ছাড়ার কারণে বন্যা দেখা দিল। বন্যায় অনেকের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে পড়ছে। অনিমেষের বুক কাঁপছে।কারণ তার বাড়িতেও জল ঢুকছে।অনিমেষ ও তার পরিবার অতি দ্রুত মালপত্তর নিয়ে স্কুলবাড়িতে আশ্রয় নিল। একতলা সমান উঁচু জল, আরও বাড়ছে। স্কুলবাড়ি তিনতলা হওয়ায় প্রাণ শেষ হওয়ার আশঙ্কা কমলেও অনিমেষের বাড়ি ভেঙ্গে নদীর গহ্বরে চলে গেলো। অনিমেষের স্ত্রী ও ছেলে কান্নাকাটি শুরু করল। কিন্তু অনিমেষের তো কাঁদলে হবে না। কয়েকদিনের মধ্যেই বন্যা কমে গেলে অনিমেষ পঞ্চায়েতে আবেদন করে এক কাঠা জমির উপর বাড়ি করার জন্য তিন লাখ টাকা পেল। অনিমেষ ও আরও অনেকে যাদের বাড়ি নদীর গর্ভে চলে গেছে তারা বাড়ি তৈরি শুরু করল। আবার নতুন পাড়া গজিয়ে উঠল। অনিমেষ পুরোনো বাড়ির পথে পা বাড়ালো। ভিটে বলতে এটুকুই ছিল, তবু সেটাও কেড়ে নিল ভয়ঙ্কর বন্যা। এখন সে কি করে সংসার চালাবে চিন্তা করে ব্যাকুল হল।

তিন – সন্তুর কথা [Bangla Uponnash Online Reading]

নেপালের দুই ছেলে ও এক মেয়ে। নেপালের বড়ছেলের নাম সন্তু আর ছোটছেলে নন্তু। নেপাল কষ্টকরে মেয়ে সুমনাকে পাত্রস্থ করতে চায়। সন্তু ছোটো থেকেই মায়ের নেওটা। মা ছাড়া সে কিছু বোঝে না,চেনে না। ফলে মায়ের স্নেহছায়া একটু বেশি পেতো সে। মা জানতেন এই ছেলে আমার অবর্তমানে অন্য ছেলেমেয়েদের দেখবে। সন্তুর বাবা ছিলেন সরকারী কর্মচারী। তিন ছেলে আর দুই মেয়েকে পড়াশোনা শেখাতে সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়া পরার কোনো অসুবিধা নেই। বেশ চলছিলো বটগাছের ছায়ায় সাতটি জীবন। কিন্তু মহাকালের বিচার মানতেই হবে। হঠাৎ মারা গেলেন সন্তুর বাবা।

তখন সন্তুর বয়স একুশ। মেট্রিক পাশ করে আই,টি,আই এ ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু অর্ধপথে পড়া থেমে গেলো। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলো সন্তু। বাবার চাকরীটা সরকার বাহাদুর দিলেন সন্তুকে। এবার ভাই, বোনদের পড়াশোনা, মাকে যত্ন করা সব অই সন্তুর সামান্য মাইনের টাকায়। নতুন চাকরী তাই মাইনে কম। ট্রান্সফারেবল্ জব। আজ হাওড়া তো কাল শিলিগুড়ি। শিলিগুড়ি থাকাকালীন ছুটির দিনে ঘুরতো সন্তু একা। একবার দার্জিলিং গিয়েছিলো। পাহাড় তাকে ডাকতো। ভালোবাসা ধরে রাখতো সবুজ প্রকৃতি। সে সমতলের ছেলে। আর পাহাড়ি ছবি তার মনে শান্তি আনতো। মন খারাপ হলেই পাহাড়ের ডাকে বেরিয়ে পড়তো বারে বারে।

একরাতে বাসা বাড়িতে খাবার নেই। মাইনের টাকা গ্রামে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কটা টাকা আছে। সন্তু জানে মাস চালাতে হবে। রাত বেশি হওয়ায় দোকানগুলো বন্ধ। এক গ্লাস জল ঢকঢক করে পান করলো। অমৃতের স্বাদ। কিন্তু পোড়া পেট মানে না বারণ। চুঁই চুঁই করছে। তবু লেপ মুরি দিয়ে শুয়ে পড়লো। গুরুর জপ শেষ করে ঘুমোয় সন্তু। জপ করার সময় শুনতে পেলো ঠক ঠক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি জপ শেষ করে বললো, কে?
— আমি, দরজাটা খুলুন।
— জগতে সবাই তো আমি। নাম বলুন।
— আমি পাপিয়া
— এত রাতে
— আরে খুলুন না ছাই।

দরজা খুলে দেখলো বাড়িওয়ালার সুন্দরী অষ্টাদশী মেয়েটা। হাতে একটা থালা। বললো,আজকে আমাদের সত্যনারায়ণ পুজো ছিলো মা তাই প্রসাদ পাঠালেন। খেয়ে জল খাবেন। প্রসাদ খেয়ে জল খেতে হয়। সেই প্রসাদ খেয়ে সন্তু ঘুমিয়েছিলো।

বাড়িওয়ালার মেয়ে পাপিয়া দেখতো, সন্তু সকালে বেরিয়ে যায় আর রাতে ঢোকে। তার মানে হোটেলে খায়। কোনোদিন বেশি কথা বলে না। শুধু বলে,ভালো আছেন। আর ভাড়া দিতে এলে বলে,বাবা আছে। পাপিয়া মা আর বাবাকে বললো, আমি সন্তুদার কাছে ইংরাজীটা দেখিয়ে নেবো। বাবা খুব কিপটে। বিনা পয়সায় পড়ানোতে আপত্তি নেই। মা বললেন, ছেলেটা ভালো। যাবি প্রয়োজন হলে। রাতে সন্তু এলে পাপিয়া বই নিয়ে ওর ঘরে গেলো। লুঙ্গি পরে তক্তায় সন্তু বসেছিলো। সন্তু বললো, কিছু বলবে।

— হুঁ,একটু ইংরাজীটা দেখিয়ে দেবেন?
— কই দেখি, আমি পড়তে ভালোবাসি।
— আর পড়াতে
— দুজনে আলোচনা করবো। ইংলিশ আ মার বেস্ট সাবজেক্ট ছিলো।
— তাই, তাহলে ভালোই হলো।

সন্তু দেখছে পাপিয়ার পড়াশোনায় মন নাই। শুধু কথা বলছে। বলছে,আপনি এত অগোছালো কেন? তারপর সন্তু দেখলো পাপিয়া সব কিছু গোছাতে শুরু করেছে। সন্তু বললো, তুমি বড়লোকের একমাত্র কন্যা আমার কাজ করবে কেন?
— আমি এসব দেখতে পারি না। আপনি চুপ করে বসুন। আর আমি একবার করে আপনার কাছে গল্প করতে আসবো। তাড়িয়ে দেবেন না তো?
— না, না আমিও তো একাই থাকি। কথা বলার সঙ্গী পাবো।
— বাবাকে বলবেন, আমি খুব পড়ি।
— মিথ্যা বলতে নেই। যা বলার তুমি বলবে। আমি কিছু বলবো না।
— ঠিক আছে, আপনি ক্যাবলার মতো এসব বলবেন না।
— আমি এসব ভালোবাসি না।

সন্তু ভাবে মেয়েটা কি চায়? আমার মাথার ওপর বড়ো সংসারের দায়িত্ব। আমাকে সাবধানে চলতে হবে। পুজোর ছুটিতে সন্তু বাড়ি এসেছে। মায়ের জন্য সাদা তাঁতের শাড়ি। দুই ভায়ের জন্য জামা,প্যান্ট একই কালারের। বোনেদের চুড়িদার এনেছে। বাড়িতে দুর্গাপুজোর পালা। আগের দিন রাত থেকে সব্জি বনানো,কুটনো কাটা শুরু হলো। অনেক লোকজন বাড়িতে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা। বড়ো বড়ো গামলায় রেখে সব্জি সব উঠোনে নামানো হলো। কাল সকালবেলা রান্না হবে। সন্তু কে ওর মা বলে,এবার বিয়ে করে নিবি। আমি দোনাগ্রামে মেয়ে দেখে রেখেছি। কথাও বলেছি। মায়ের কথা ফেলতে পারে না সন্তু। সে সম্মতি দিলো। তা না হলে মা দুঃখ পাবেন।

পুজোর ছুটি ফুরিয়ে গেলে সন্তু ফিরে এলো শিলিগুড়ি। এসেই দেখলো, পাপিয়া হাতে একটা চিঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু বললো, কি এটা।
— পুজোতে তোমার জন্য লিখেছি।
— থাক, তোমার কাছে থাক। আমার আবার ট্রান্সফারের অর্ডার এসেছে। কাল মোবাইলে মেসেজ পেয়েছি। আজকে নোটিশ পাবো অফিসে।
— কিন্তু আমি যে অনেক কিছু দিয়েছি তোমাকে। আমার মন, প্রাণ সব কিছু।

সন্তু দরজা খোলামাত্র পাপিয়া জড়িয়ে ধরলো তাকে। চোখের জলে তার জামা ভিজিয়ে দিলো। আর সন্তু তো কাঁদতে পারছে না। পাপিয়ার জন্য তার মন পাপিয়া কতবার যে ডাক দিয়ে গেছে তার ইয়ত্তা নাই। সন্তুর বাসা বাড়ির টালির চাল। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো, চাঁদ আজ ঢেকে গেছে অন্ধকারে।

সংসারে কর্তব্য করে যায় এক জাতীয় মানুষ। তারা নিজের আবেগ, ভালোবাসা বিসর্জন দেয় সকলের জন্য। আর এক জাতীয় মানুষ তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার ক’রে দূরে ছুঁড়ে ফেলে। সন্তু এবার বাড়ির কাছে চলে এলো। খেয়ে বাড়ি থেকে বেরোয় সকাল দশটায়। মা খুব খুশি সন্তুর। বিয়েতে ভালো পাওনা। চাকরী পাওয়া ছেলে। কুড়ি ভরি সোনা। সন্তুর বিয়েতে কলিগরা সবাই এসেছে। মোবাইল ফোন বেজে উঠলো। ফোনে পাপিয়ার গলা। বলছে, বজ আমার বিয়ে সন্তুদা। তুমি ভালো থেকো। সন্তু ফোনটা কেটে দিলো। কেউ শুনতে পেলে অসুবিধা হবে। মনকে শক্ত বেড়ি পরিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসলো। বিয়ে হয়ে গেলো। শেষ রাতে অর্ধেক চাঁদের আলোয় সন্তু পাপিয়াকে দেখলো বাগানের মধ্যে। স্বপ্নটা ভেঙ্গে গেলো। আজ বিয়ের পরদিন। কালরাত্রি। বৌয়ের মুখ দেখতে নেই।

ফুলের শয্যায় কাঁটা। বৌ জয়ার শরীর খারাপ। সন্তুর বন্ধুরা পরের দিন বললো,নতুন অভিজ্ঞতা কেমন হলো? সন্তু বললো, ভাগ্য প্রসন্ন নয়। অপেক্ষায় আছি। বন্ধুরা হতাশ। তারপর খাড়া বড়ি থোর, থোর বড়ি খাড়া। মামূলী জীবন। চাকরী। দিন কাবার। রাত। রান্না। চান। জপ। খাওয়া। সাইকেল। অফিস।

মা বললেন, বোনের বিয়ের ব্যবস্থা করেছি।বোনের বৈশাখমাসে বিয়ের ঠিক করেছি। তুমি লোন নাও।বৌমার গহনাগুলো দাও। মায়ের কথা অনুযায়ী সব কিছু হলো। জয়া সব সোনা দিয়ে দিলো। দুটো ননদের বিয়ে হলো। বড় ভাই লন্ডন চলে গেলো সবাইকে ফেলে। ভালো চাকরী পেয়েছে। ছোটোভাই গ্রামেই একটি মেয়েকে প্রেম করে বিয়ে করলো। ভালো চাকরী পেয়ে কলকাতায় চলে গেলো। সন্তু খুশি। মাও খুশি। মা বললেন, সবাই ভালো থাকলেই ভালো। মা কিন্তু সন্তুর কাছেই থাকলেন। স্বামীর ভিটে তার কাছে স্বর্গ। আর কোথাও তার ভালো লাগে না। নেপাল ও কুসুম তাদের মেয়ে সুমনার ভাল ঘরে বিয়ে দিয়েছে।

সন্তুর এখন দুই ছেলে। মাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ সুখেই আছে। কিন্তু সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। নেপালের বড়ছেলে নন্তুর, রুমকি ও ঝুমকি দুই মেয়ে। রুমকি এখন ক্লাস টেনে পড়ে আর ঝুমকি সেভেনে। দুজনেই এক গৃহশিক্ষকের কাছে পড়তো। রুমকি সেন্ট আপ হলো। কিন্তু ঝুমকি আ্যনুয়াল পরীক্ষায় ফেল করলো। সন্তু আর জয়া খুব বকাবকি করলো। বললো,সারা বছর পড়বি না, তাহলে ফেল করবি না তো কি? গৃহশিক্ষক বললো, যা গলায় দড়ি দেগা। ফেল করে বসে আছে। ঝুমকির মন খুব খারাপ হয়ে গেলো। সে ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থাকলো। বাড়ির সবাই জানে কিন্তু কেউ একবারও তাকে ডাকলো না। ঝুমকি ভাবলো, কেউ আমাকে চায় না। ভালোবাসে না। সে শুনতে পেলো কে যেন বলছে গলায় দড়ি দিয়ে মর। সব ঠিক হয়ে যাবে। কে বলছে? সে ভাবলো ঠিকই বলেছে। আমি খারাপ মেয়ে। গৃহশিক্ষক অজয় আমার যৌনাঙ্গে আঙুল দিয়ে রক্তাক্ত করে বলেছিলো। পড়াশোনা তোর হবে না। এইসবই হবে। গলায় দড়ি দেগা। অজয়ের মুখ থেকে মদের গন্ধ পেয়েছিলো। কাউকে বললে, প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছিলো। সেদিন তার দিদি ছিলো না। দিদিকেও হয়তো ভয় দেখিয়েছে।আবার ভাবছে, আমি মরে গেলে ওই মাতালটা আরও অনেক মেয়েকে মারবে। কিন্তু ওর বেঁচে থেকে কোনো লাভ নেই। বাবা, মা পর্যন্ত আমাকে ডাকলো না। আমার খিদে পেয়েছে। একবারও ডাকলো না। ভাবতে ভাবতে তার ওড়নাটা গলায় গিঁট দিলো। খুব লাগছে। তারপর মাটির ঘরের কড়িকাঠে, ওড়নাটা, পেঁচিয়ে নিলো চেয়ারের ওপর উঠে।তারপর চেয়ারটা লাথি দিয়ে সরিয়ে ঝুলে পড়লো। তারপর ভাবছে। কেন করলো এই কাজ। খুব ভুল করলো। মা বাবার মুখ মনে পড়লো তার।

সন্ধেবেলায় সন্তু এসে জয়াকে বললো, দাদার মেয়েটা খেয়েছে?ঘর খুলেছে?জয়া বললো ,জানি না, যাও তুমি দেখো। ঘরের ফাঁক দিয়ে দেখলো দাদর মেয়েটা ঝুলছে। সন্তু ভাবে, এই সময় মা থাকলে ভালো হতো। মা বোনের বাড়ি কেন গেলো? সন্তুর শরীর কাঁপছে থর থর করে। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না। জয়া দেখতে এলো স্বামীকে, ধপ করে একটা আওয়াজ শুনে। এসে দেখলো,সন্তু অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। জয়া দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলো মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে, ঝুলছে। বাড়ির আশেপাশে যারা ছিলো তাদের চিৎকার করে ডাকলো জয়া। লোকজন এলো।দরজা ভাঙলো। মৃতদেহ নিয়ে চলে গেলো দাহকাজে।

সন্তু আর জয়া দুবছর রাতে ঘুমোতে পারে নি। একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো। হয়তো তাদের ভুলে মেয়েটা অভিমানে চলে গেলো অকালে। বড়ো মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলো সন্তু। জয়া ভাবে তার জন্মকালের কথা। মায়ের মুখে শুনেছে,জন্মমাত্রই তাকে মৃত মনে করে বাড়ির লোকজন ফেলে দিয়েছিলো বাঁশতলায়। আঁতুড় ফেলার জায়গায়। বাগ্দীবুড়ি দেখতে পেয়েছিলো জ্যান্ত মেয়েটাকে।হাত, পা নড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে তুলে নিলো কোলে। খবর ছড়িয়ে পড়লো গ্রামে। তখন বাড়ির লোক এসে নিয়ে যায় মেয়ে। বাগ্দীবুড়ি নাম রেখেছিলো জয়া। ও তাদের বাড়ি এসে বলেছিলো, ও জীবন জয় করেছে। তাই ওর নাম জয়া। তারপর জয়া বড়ো হলো। কালো মেয়ে আলো রূপ নিয়ে ভরতি হলো স্কুলে। পড়াশোনায় খুব ভালো। অন্যদের থেকে আলাদা। নীরব শিল্পীর মতো তার স্বভাব। সবাই ভালো বলতো তাকে। তারপর কলেজে ভরতি হলো। কিন্তু কলেজে পড়তে পড়তেই তার বিয়ে হলো। তিন সন্তানের জননী হলো। কাজ হলো হাঁড়ি ঠেলা। আত্মীয়স্বজনের কাছে ভালো হবার ব্যর্থ চেষ্টা। কম বয়সে শিখলো অনেক। শক্তি জাগ্রত হলো শরীরে, মনে। সহজ পথে চলা শুরু হলো। তেল মাখানো কথাও বন্ধ হলো। শত্রু বাড়লো। তবু সে বললো, কুছ পরোয়া নেহি।

একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না, ছেলে মেয়েদের স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা, কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে বসে ঘুমে ঢুলে পরতো জয়া। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পড়তো কিশোরীবেলার স্কুলের পথে আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রং বেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতো বায়েনবুড়ো কত মাছ। বায়েন বুড়োর কাছে চেয়ে একটা বোতলে ভরে রাখতো জল। আর তাতে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতো বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারে নি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা পড়াতে আসতো। আমরা মেয়েরা সুর করে পড়তাম একসাথে। তারপর খাওয়ার পরে শোওয়ার পালা। ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পরতাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। জয়া এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী, ছেলে, মেয়েরা চলে আসতো জয়ার স্বপ্ন নীড়ে। আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ,সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে।

১৮৫৮ সালের ১৫ নভেম্বর প্রকাশিত হয় সোমপ্রকাশ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা। এই পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনার নেপথ্যে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যথেষ্ট অবদান ছিল। দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত এটিই প্রথম পত্রিকা যাতে রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৫৯ সালের ১ এপ্রিল পাইকপাড়ার রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় [লা স্কুল। কিছুকাল এই প্রতিষ্ঠানের অবৈতনিক তত্ত্বাবধায়কও ছিলেন তিনি। ২০ এপ্রিল মেট্রোপলিটান থিয়েটারে উমেশচন্দ্র মিত্র রচিত নাটক বিধবা বিবাহ প্রথম অভিনীত হয়। ২৩ এপ্রিল রামগোপাল মল্লিকের সিঁদুরিয়াপট্টির বাসভবনে সেই নাটকের অভিনয় দেখেন বিদ্যাসাগর মহাশয়। মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গে মিশে গেলে উক্ত সভার সভাপতির পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২৯ সেপ্টেম্বর গণশিক্ষার প্রসারে সরকারি অনুদানের জন্য বাংলার গভর্নরের নিকট আবেদন করেন। ১৮৬০ সালে বোর্ড অফ একজামিনার্সের পদ থেকেও ইস্তফা দেন তিনি। এই বছরই ১২ এপ্রিল ভবভূতির উত্তর রামচরিত অবলম্বনে তার রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সীতার বনবাস প্রকাশিত হয়। কথিত আছে বইখানি তিনি রচনা করেছিলেন মাত্র চারদিনে।

১৮৬১ সালের এপ্রিল মাসে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের সেক্রেটারি মনোনীত হন বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছর ডিসেম্বর মাসে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকালপ্রয়াণে গ্রহণ করেন তার সম্পদিত হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকার পরিচালনভার। ১৮৬২ সালে কৃষ্ণদাস পালকে এই পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেন তিনি। এই বছর তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাণভট্টের কাদম্বরী। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাকে উৎসর্গ করেন স্বরচিত বীরাঙ্গনা কাব্য। ১৮৬৩ সালে সরকার তাকে ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক নিযুক্ত করেন। উল্লেখ্য, ৮ থেকে ১৪ বছর বয়সী নাবালক জমিদারদের শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে ১৮৫৬ সালে এই ইনস্টিটিউশন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম মৌলিক গদ্যরচনা ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ এ বছর রচিত হয়। ১৮৬৪ সালে কলিকাতা ট্রেনিং স্কুলের নাম পরিবর্তন করে কলিকাতা মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন রাখা হয়। ৪ জুলাই ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাকে সাম্মানিক সদস্য নির্বাচিত করে। খুব কম ভারতীয়ই এই বিরল সম্মানের অধিকারী হতে পেরেছিলেন। ২ আগস্ট ফ্রান্সে ঋণগ্রস্ত মাইকেল মধুসূদনের সাহায্যার্থে ১৫০০ টাকা প্রেরণ করেন তিনি। ১৮৬৫ সালের ১১ জানুয়ারি ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনের পরিদর্শক হিসেবে বিদ্যাসাগর মহাশয় তার প্রথম রিপোর্টটি পেশ করেন।

১৮৬৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বহুবিবাহ রদের জন্য দ্বিতীয়বার ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার নিকট আবেদনপত্র পাঠান বিদ্যাসাগর মহাশয়। এই বছরই প্রকাশিত হয় তার পরিমার্জিত আখ্যান মঞ্জরী পুস্তকের প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। ১৮৬৭ সালের জুলাই মাসে জ্যেষ্ঠা কন্যা হেমলতার সঙ্গে গোপালচন্দ্র সমাজপতির বিবাহ হয়। এবছর অনাসৃষ্টির কারণে বাংলায় তীব্র অন্নসংকট দেখা দিলে তিনি বীরসিংহ গ্রামে নিজ ব্যয়ে একটি অন্নসত্র স্থাপন করেন। ছয় মাস দৈনিক চার-পাঁচশো নরনারী ও শিশু এই অন্নসত্র থেকে অন্ন, বস্ত্র ও চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছিল। ১৮৬৮ সালে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু রামগোপাল ঘোষ প্রয়াত হন। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের সেক্রেটারির পদ ত্যাগ করেন। এপ্রিল মাসে তার সম্পাদনায় কালিদাসের মেঘদূতম্ প্রকাশিত হয়। ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয় উইলিয়াম শেক্সপিয়র রচিত কমেডি অফ এররস্ অবলম্বনে রচিত বাংলা গ্রন্থ ভ্রান্তিবিলাস। উল্লেখ্য, শোভাবাজার রাজবাড়িতে আনন্দকৃষ্ণ বসুর কাছে তিনি শেকসপিয়রের পাঠ নেন। কথিত আছে, মাত্র পনেরো দিনে তিনি কমেডি অফ এবর-এর এই ভাবানুবাদটি রচনা করেছিলেন। এবছরই বীরসিংহ গ্রামে তার পৈতৃক বাসভবনটি ভস্মীভূত হয়। চিরতরে জন্মগ্রাম বীরসিংহ ত্যাগ করেন ‘বীরসিংহের সিংহশিশু বিদ্যাসাগর বীর।

জন্মগ্রহণ কালে তার পিতামহ তার বংশানু্যায়ী নাম রেখেছিলেন “ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়”। ১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও যথারীতি কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি পান, তাতেই প্রথম তার নামের সঙ্গে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে ‘বিদ্যাসাগর’ নামে অভিহিত করেন।

১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। তাদের সঙ্গে কলকাতায় এসেছিলেন কালীকান্ত ও চাকর আনন্দরাম গুটিও। কথিত আছে, পদব্রজে মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি সেগুলি অল্প আয়াসেই আয়ত্ত করেছিলেন। কলকাতার বড়বাজার অঞ্চলের বিখ্যাত সিংহ পরিবারে তারা আশ্রয় নেন। এই পরিবারের কর্তা তখন জগদ্দুর্লভ সিংহ। ১৮২৯ সালের ১ জুন সোমবার কলকাতা গভর্নমেন্ট সংস্কৃত কলেজে ( যা বর্তমানে সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল নামে পরিচিত) ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই সংস্কৃত কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৮২৪ সালে; অর্থাৎ, ঈশ্বরচন্দ্রের এই কলেজে ভর্তি হওয়ার মাত্র পাঁচ বছর আগে। তার বয়স তখন নয় বছর। এই কলেজে তার সহপাঠী ছিলেন মদনমোহন তর্কালঙ্কার। বিদ্যাসাগরের আত্মকথা থেকে জানা যায়, মোট সাড়ে তিন বছর তিনি ওই শ্রেণিতে অধ্যয়ন করেন।

ব্যাকরণ পড়ার সময় ১৮৩০ সালে সংস্কৃত কলেজের ইংরেজি শ্রেণিতেও ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। ১৮৩১ সালের মার্চ মাসে বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। সংস্কৃত কলেজে মাসিক বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের ‘পে স্টুডেন্ট’ ও অন্য ছাত্রদের ‘আউট স্টুডেন্ট’ বলা হত। অন্যদিকে তিন বছর ব্যাকরণ শ্রেণিতে পঠনপাঠনের পর বারো বছর বয়সে প্রবেশ করেন কাব্য শ্রেণিতে। সে যুগে এই শ্রেণির শিক্ষক ছিলেন বিশিষ্ট পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কার। ১৮৩৩ সালে ‘পে স্টুডেন্ট’ হিসেবেও ঈশ্বরচন্দ্র ২ টাকা পেয়েছিলেন। ১৮৩৪ সালে ইংরেজি ষষ্ঠশ্রেণির ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য ৫ টাকা মূল্যের পুস্তক পারিতোষিক হিসেবে পান। এই বছরই ক্ষীরপাই নিবাসী এই ছেলেই একদিন সকলের থেকে বড় হলেন।ইনি হলেন বাঙালির গর্বের সন্তান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। পাঁচ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্রকে গ্রামের পাঠশালায় পাঠানো হয়। ১৮২৮ সালের ডিসেম্বর মাসে তাঁকে কলকাতার একটি পাঠশালায় এবং ১৮২৯ সালের জুন মাসে সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করানো হয়। তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছাত্র এবং ১৮৩৯ সালের মধ্যেই বিদ্যাসাগর উপাধি লাভ করেন। পরে তিনি দু-বছর ওই কলেজে ব্যাকরণ, সাহিত্য, অলঙ্কার, বেদান্ত, ন্যায়, তর্ক, জ্যোতির্বিজ্ঞান, হিন্দু আইন এবং ইংরেজি বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া প্রতি বছরই তিনি বৃত্তি এবং গ্রন্থ ও আর্থিক পুরস্কার পান।

১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে সংস্কৃত কলেজ ত্যাগ করার অল্প পরেই তিনি ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের বাংলা ভাষার প্রধান পন্ডিতের পদ লাভ করেন। ১৮৪৬ সালের এপ্রিল মাসে সংস্কৃত কলেজে সহকারী সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উক্ত কলেজের শিক্ষকগণের রক্ষণশীল মনোভাবের কারণে ১৮৪৭ সালের জুলাই মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের কাজে ইস্তফা দেন এবং ১৮৪৯ সালের জানুয়ারি মাসে, ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ১৮৫০ সালের ডিসেম্বর মাসে তিনি সংস্কৃত কলেজের সাহিত্যের অধ্যাপক পদ লাভ করেন এবং পরের মাসে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন।

প্রাতিষ্ঠানিক উপাধি কী ভাবে একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতে পারে, তার উদাহরণ ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। অবশ্য তিনি ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর জায়গায় ‘শর্ম্মা’ বা ‘শর্ম্মণঃ’ লিখতেন। তাঁর ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি শুধু তাঁর কৌলিক উপাধিই শুধু নয়, নামটিকে পর্যন্ত অপ্রয়োজনীয় করে তুলেছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর গুণমুগ্ধবন্ধুকে নিয়ে যে সকল চিঠি লিখেছিলেন তা শুধু মুগ্ধতাই বয়ে আনে না, বহুরূপী ঈশ্বরচন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া যায় সেখানে। সেখানেই ঈশ্বরচন্দ্রের বিদ্যাসাগর হওয়ার পাশাপাশি ‘করুণাসাগর’ হওয়ার হদিস মেলে। তবে আম বাঙালির ‘দয়ার সাগর’ বিশেষণে সুবাসিত হলেও তা বিদ্যাসাগরের মতো তা বিশেষ্য হতে পারেনি।

তিনি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার আনেন কলেজের পাঠ্যক্রমে। পূর্বে ব্যাকরণ এবং বীজগণিত ও গণিত শেখানো হতো সংস্কৃতে, কিন্তু তিনি সংস্কৃতের বদলে ব্যাকরণ বাংলার মাধ্যমে এবং গণিত ইংরেজির মাধ্যমে পড়ানোর নিয়ম চালু করেন। ইংরেজি ভাষা শেখাকে তিনি বাধ্যতামূলক করেন এবং ইংরেজি বিভাগকে উন্নত করেন। বাংলা শিক্ষার ওপরও তিনি জোর দেন। তবে তারচেয়ে ব্যাপক পরিবর্তন করেন দর্শন পাঠ্যক্রমে। তিনি সাংখ্য এবং বেদান্ত দর্শনকে ভ্রান্ত এবং প্রাচীনপন্থী বলে বিবেচনা করতেন। সে জন্যে, তিনি বার্কলের দর্শন এবং অনুরূপ পাশ্চাত্য দর্শন শিক্ষাদানের বিরোধিতা করেন এবং তার পরিবর্তে বেকনের দর্শন এবং জন স্টুয়ার্ট মিলের তর্কশাস্ত্র পড়ানোর সুপারিশ করেন। অনেকে তাঁর সমালোচনা করলেও, তাঁর এ সংস্কার ছিল সুদূরপ্রসারী এবং শিক্ষা পরিষদ তাঁর এ সংস্কারের প্রশংসা করে এবং পুরস্কারস্বরূপ ১৮৫৪ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁর বেতন বৃদ্ধি করে।

১৮৫৪ সালে চার্লস উডের শিক্ষা সনদ গৃহীত হওয়ার পর সরকার গ্রামীণ এলাকায় শিক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেয়। এ উদ্দেশে ১৮৫৫ সালের মে মাসে বিদ্যাসাগরকে সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদের অতিরিক্ত সহকারী স্কুল পরিদর্শকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে তিনি নদিয়া, বর্ধমান, হুগলি এবং মেদিনীপুর জেলায় স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। দুবছরের মধ্যে তিনি এ রকমের বিশটি স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া তিনি এসব স্কুলে পড়ানোর জন্যে, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি নর্মাল স্কুল স্থাপন করেন। তিনি নিজ গ্রামে নিজ খরচে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।

এসব বাংলা মডেল স্কুল ছাড়া, সরকার বালিকা বিদ্যালয় স্থাপনেরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তখন রক্ষণশীল সমাজ মনে করতো যে, স্ত্রীশিক্ষা দেওয়া নিষিদ্ধ। সমাজের তীব্র বিরোধিতার মুখে এ ধরনের স্কুল প্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে কিনা—সরকার সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিল না। অন্যদিকে, বিদ্যাসাগর ছিলেন স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ সমর্থক। সরকার সেজন্যে এ কাজের দায়িত্ব দেয় তাঁর ওপর। তিনি বালিকা বিদ্যালয় খোলার বিষয়ে স্থানীয় লোকদের সমর্থনে বর্ধমানে একটি স্কুল স্থাপন করেন। পরে ১৮৫৭ সালের নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাসের মধ্যে আরও পঁয়ত্রিশটি স্কুল স্থাপন করতে সমর্থ হন।

কিন্তু শিক্ষা কর্তৃপক্ষের পরিচালকের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার কারণে তিনি এ কাজ বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। তাই তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদ এবং স্কুল পরিদর্শকের পদ-উভয় ত্যাগ করেন। এ রকমের উচ্চপদে বাঙালিদের মধ্যে সম্ভবত তিনিই অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরে শিক্ষা সম্প্রসারণের কাজে, বিশেষ করে মেয়েদের শিক্ষা দেওয়ার কাজ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করেন। এ সময়ে তিনি বেথুন সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হন। এই সোসাইটির কাজ ছিল স্ত্রীশিক্ষা বিস্তার এবং পরিবার ও সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধির। তিনি স্কুল স্থাপনের জন্যে ধনী জমিদারদেরও উৎসাহ প্রদান করেন।

বিদ্যাসাগর একাধারে সমাজসেবী, সমাজসংস্কারক, পন্ডিত ও মহামানব।তাঁর গুণবর্ণনা করা আমার মত সাধারণ লোকের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু তাঁর স্মরণে আমার এই শ্রদ্ধার্ঘ, কিছুটা হলেও আমার মনে আনন্দ উদ্রেক করে। সন্তু মেয়ের বিয়ে দিলো। তারপর গ্রাম ছেড়ে চলে এলো কোয়ার্টারে। গ্রামের বাড়িতে সবখানে ভেসে উঠতো মৃত মেয়ের মুখ। তাই এই সিদ্ধান্ত। কোয়ার্টারে সন্তুর মন হাঁপিয়ে উঠতো। অফিসে ছুটি পেলেই চলে যেতো মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। সেখানে বড়ো মেয়ের মুখ দেখে ভুলে যেতো মৃত মেয়ের মুখ। আর দুই মেয়ের মুখের আদলে দুবছর পরে ঘর আলো করে এলো নাতি। মেয়ের পুত্রসন্তানের মুখ দেখে সন্তু ও জয়া ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে লাগলো। নাতি ও মেয়ে এসে দুমাস, তিনমাস করে থাকতো কোয়ার্টারে। এবার মন শক্ত করে সন্তু ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে। কোয়ার্টারে তার মন ভারী হয়ে যেতো। নিজেকে হারিয়ে ফেলতো বারে বারে। এবার গ্রামে এসে পুরোনো বন্ধুদের মাঝে সন্তু জীবন খুঁজে পেলো। সব কিছু স্বাভাবিক হলো।

পুরাণে দেখা যায় নারীশক্তির জয়জয়কার। নারী হলেন শক্তির আধার।বৈদিক যুগের আদি পর্বে নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রেই পুরুষের সঙ্গে সমানাধিকার ভোগ করেছে। পতঞ্জলি বা কাত্যায়ণের মতো প্রাচীন ভারতীয় বৈয়াকরণের লেখা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে আদি বৈদিক যুগে নারীরা শিক্ষিত ছিলেন। ঋক বেদের শ্লোক থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে নারীরা পরিণত বয়সে বিবাহ করতেন এবং সম্ভবত স্বয়ম্বরা নামক প্রথায় নিজের স্বামী নির্বাচনের বা গান্ধর্ব বিবাহ নামক প্রথায় সহবাসের স্বাধীনতা তাদের ছিল। ঋক বেদ, উপনিষদের মতো আদি গ্রন্থে বহু প্রাজ্ঞ ও ভবিষ্যতদ্রষ্টা নারীর উল্লেখ আছে, গার্গী ও মৈত্রেয়ী যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।মধ্যযুগে তা এই যুক্তিতে খারিজ হয়ে যায় যে তা পূর্বযুগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ শতকে নারীর অবস্থার অবনতি শুরু হয় যদিও জৈনধর্মের ন্যায় সংস্কার আন্দোলনগুলি।

চার [Bangla Uponnash Online Reading]

নারীদেরকে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের অনুমতি দেয়, তবুও ভারতে অধিকাংশ নারী বিধিনিষেধের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। বাল্যবিবাহের প্রথা খুব সম্ভবত ছয় শতকের কাছাকাছি সময় থেকে প্রচলন লাভ করে। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে নারীদের উপর আরোপিত বিধিনিষেধের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেমন, মনু স্মৃতি অনুযায়ী: নারী শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী বার্ধক্যে পুত্রের অভিভাবকত্বে থাকবে, একজন মহিলা স্বয়ংশাসিত থাকার উপযুক্ত নয়। তবে এটি আদর্শিক গ্রন্থ, এবং নারীর স্বাধীন ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করার, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস গ্রহণের বর্ণনামূলক বিবৃতিও পাওয়া যায়। প্রাচীন ভারতে কিছু রাজ্যে নগরবধূর মতো প্রথা প্রচলিত ছিল। নারীরা নগরবধূর ঈপ্সিত শিরোপা জয় করতে প্রতিযোগিতা করতো। আম্রপালি এরকমই একজন জনপ্রিয় নগরবধূ।

মধ্যযুগী ভারতীয় সমাজে নারীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটে এবং বাল্যবিবাহের প্রচলন এবং বিধবাদের পুনর্বিবাহের নিষেধাজ্ঞা ভারতে কিছু সম্প্রদায়ের সামাজিক জীবনের অংশ হয়ে ওঠে। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গেই ভারতীয় সমাজে পর্দা প্রথার প্রচলন ঘটে। রাজস্থানের রাজপুতদের মধ্যে জওহর প্রথার প্রচলন ছিল। ভারতে কিছু অংশে, দেবদাসীরা কখনো কখনো যৌন নির্যাতনের শিকার হন। রাজনৈতিক কারণে হিন্দু ক্ষত্রিয় শাসকদের মধ্যে বহুবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। অনেক মুসলিম পরিবারে, নারীর গতিবিধি বাড়ির অন্দরমহলেই সীমাবদ্ধ ছিল। খুব অল্প সংখ্যক গ্রন্থেই স্ত্রী আচার ও মহিলাদের ক্রিয়াকলাপ মূল উপজীব্য বিষয়, তবে, ১৭৩০ সালে তাঞ্জৌরের জনৈক রাজকর্মচারী ত্রম্বকোয়জ্যন রচিত স্ত্রী ধর্ম পদ্ধতি একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। প্রথম শ্লোকটি হল:

এই পরিস্থিতিতেও, রাজনীতি, সাহিত্য, শিক্ষা ও ধর্ম সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু বিশিষ্ট নারীর সন্ধান পাওয়া যায়। রাজিয়া (১২০৫-১২২০) একমাত্র মহিলা সুলতান যিনি দিল্লি শাসন করেছেন। ১৫৬৪ খ্রিষ্টাব্দে মুগল সম্রাট আকবরের সেনাপতি আসাফ খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রাণ হারানোর আগে গোন্দ রানী দুর্গাবতী ১৫ বছর(১৫২৪-১৫৬৪) রাজ্যশাসন করেছিলেন। চাঁদ বিবি ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে আকবরের শক্তিশালী মুগল বাহিনীর বিরুদ্ধে আহমদনগরকে রক্ষা করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের স্ত্রী নূরজাহানের রাজ্যশাসনে কার্যকরী ভূমিকা ছিল এবং তিনি মুঘল সিংহাসনের পিছনে প্রকৃত ক্ষমতা হিসেবে পরিগণিত হতেন। মুঘল রাজকুমারী জাহানারা ও জিবন্নুসিসা ছিলেন বিখ্যাত কবি এবং তারা ক্ষমতাসীন শাসকদেরও প্রভাবিত করেছিলেন। যোদ্ধা এবং প্রশাসক হিসেবে তার দক্ষতার শিবাজীর মা জিজাবাইকে শাসক বা রাজপ্রতিনিধির মর্যাদা দিয়েছিল। তারাবাই ছিলেন আরেকজন মহিলা মারাঠা শাসক। দক্ষিণ ভারতে অনেক নারী গ্রাম, শহর ও বিভাগ পরিচালনা করেন এবং নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন।

ভক্তি আন্দোলন নারীর অবস্থা পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করে এবং তাদের উপর হওয়া বিভিন্ন নিপীড়নের বিষয়ে প্রশ্ন তোলে। কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা সতী, জওহর এবং দেবদাসীর মতো প্রথা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং আধুনিক ভারতে এই প্রথাগুলি প্রায় অবলুপ্ত। যদিও ভারতেবর্ষের কিছু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও এইসব প্রথা মাঝেমাঝে পালিত হয়। কিছু সম্প্রদায়ের মহিলারা আজও পর্দা প্রথা মেনে চলেন। বাল্যবিবাহ গ্রামাঞ্চলে আজও সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি, যদিও এটি বর্তমান ভারতীয় আইন অনুযায়ী অবৈধ।

সতী বা সতীদাহ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত থাকা একটি পুরানো, প্রায় পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া প্রথা, যেখানে বিধবা মহিলারা স্বামীর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় স্বামীর চিতায় ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। যদিও বিধবাদের এই প্রথায় অংশগ্রহণ স্বেচ্ছায় বলে ধরা হত, তবে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী বর্তমান যুগে অর্থাৎ কলি যুগে এটি নিষিদ্ধ। ভারতীয় উপমহাদেশের বৈদেশিক আগ্রাসনের পর থেকেই, এই প্রথাটি তার উপস্থিতি জানান দিতে শুরু করে, কারণ, নারীরা প্রায়ই বৈদেশিক বাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত বা অপহৃত হত। ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক এই প্রথাটির বিলোপ ঘটানো হয়। স্বাধীনতার পর থেকে প্রায় ৪০টি সতীদাহর ঘটনা ঘটেছে বলে খবরে প্রকাশ। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের রূপ কানোয়ার মামলায় সতীদাহ(প্রতিরোধ) আইন বলবত্ হয়। কোনো যুদ্ধে পরাজিত বাহিনীর স্ত্রী ও কন্যারা শত্রুপক্ষের হাতে বন্দী হওয়া বা যৌন নিপীড়ন এড়াতে স্বেচ্ছায় অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহুতি দিতেন। এই প্রথাটি জওহর প্রথা নামে পরিচিত এবং এটি মূলত রাজপুত সমাজে প্রচলিত ছিল, যেখানে জওহর ব্রতে শহীদ রমণীরা সম্মানের উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হন। এই প্রথার চর্চা মূলত ভারতে ইসলামী আক্রমণের সময় ঘটেছিল।

দেবদাসী প্রথাকে বহুক্ষেত্রেই ধর্মীয় অনুশাসন বলে ভুল করা হয়। এটি মূলত দক্ষিণ ভারতে প্রচলিত একটি প্রথা। এই প্রথা অনুযায়ী, মহিলারা কোনো দেবতা বা মন্দিরের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতেন এবং এরপর তাদের সামাজিক বিবাহ থেকে বিরত থাকতে হত। এরপর, তারা দেবীকে সেবা করার জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করতেন। প্রথাটি ১০ম শতাব্দী থেকেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।১৯৮৮ সালে এই প্রথাটি দেশে বেআইনি ঘোষণা করা হয়, কিন্তু দেশের কিছু অঞ্চলে এখনো, মূলত নিম্নতম বর্ণের মেয়েরা দেবদাসী হিসেবে কাজ করে।
তারপর ব্রিটিশযুগে তাদের অত্যাচার মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেলে মহিলারা সোচ্চার হয়ে ওঠেন।তাদের মধ্যে বীরাঙ্গনা প্রীতিলতার অবদান অনস্বীকার্য।

প্রীতিলতার দাদুর মৃত্যুর পর তাঁর পিতা জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তাঁর পৈত্রিক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন। তিনি পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে বড় হয়েছেন। এই বাড়িতেই প্রীতিলতার জন্ম হয়। আদর করে মা প্রতিভাদেবী তাঁকে “রাণী” ডাকতেন। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম শহরের আসকার খানের দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেয়া মাটির একটা দোতলা বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকতেন ওয়াদ্দেদার পরিবার। প্রীতিলতার দেশপ্রেম জাগ্রত হয়েছিলো তাঁর অসীম মনবলের জন্য। পাড়ার দাদু প্রীতিলতাকে খুব স্নেহ করতেন। কাছে বসিয়ে তিনি নানারকম গল্প বলতেন তার সাধের নাতনিকে।

প্রীতিলতা গ্রামের বুড়ো দাদুর বয়স একশ দুই বছর। দাদু এখনও বাড়ির সামনে খোলা বারান্দায় লাঠি হাতে বসেন বিকেলবেলা। সকলে নিজের নিজের কাজ করে। আজকালকার ছেলেরা দাদুর বীরত্ব সম্বন্ধে বা দাদুর প্রচুর অভিজ্ঞতার ঝুলি কত তা জানতে চায় না। এখনকার ছেলেরা অনেকে চেনেই না দাদুকে দাদুর খুব দুঃখ হয়। তবে দাদুর থেকে ছোট কিন্তু পঞ্চাশ থেকে ষাট বছরের প্রৌঢ় যারা তারা মাঝে মাঝে দাদুর কাছে বসে গল্প করে। প্রীতি বলেন, দাদু তোমার কাছে বসলে অনেককিছু জানতে পারি।

পাঁচ [Bangla Uponnash Online Reading]

আজ শরতের সুন্দর বিকেলে দাদু দু তিনজনের সঙ্গে গল্প করছে। দাদু বলছে, জানিস যদু, তখন আমি পোরো বোলানের লাঠিয়াল দলের একজন। গাজনে গান গেয়ে বেড়াতাম পাড়ায় পাড়ায়। আগেকার জমিদার বাড়িতে একদিন ডাকাত এসেছিল রাতে। আমি রিহার্সাল সেরে বাড়ির পাশ দিয়ে আসছিলাম গান গাইতে গাইতে। ডাকাতের একজন বাইরে পাহারায় ছিল। ভেতরে চলছে ডাকাতের অত্যাচার। পাহারাদার ডাকাতটি বলল, কে যাস ওদিকে। ফিরে আয়, তোকে বাঁধি। আমি বললাম, আমি ওপাড়ায় ছিলাম। রাত হয়ে গেছে। বাড়ি চললাম। ডাকাত বলল, সাবধান এখন দেওয়াল বাগু মুখ করে দাঁড়া। নড়লেই মাথা ফাটিয়ে দোব। আমি ডাকাতের লাঠিটা কেড়ে তাকে বেঁধে ঘরের ভেতরে এলাম। বন বন করে লাঠি ঘোরাতে থাকলাম। ডাকাতরা একে একে সরে পড়ল অন্ধকারের আড়ালে। প্রাক্তন জমিদার বলল, তুমি আজ বাঁচালে আমাদের। গল্প শুনে অনেকে বিশ্বাস করে আবার অনেকে হাসে। বলে, বুড়ো দাদুর বাতেলা কে শুনবে বল? চল পালাই।

দাদু ভাবে, মানুষ বুড়ো হয়ে গেলেও তার অভিজ্ঞতার দাম আছে। তার কাছে শুনতে হয় জীবনের কাহিনী। তাতে শিক্ষা পাওয়া যায় অনেক। দাদু চুপ করে থাকে। কোনদিন পাশে কেউ বসলে গল্প বলে। তবু দাদু দেখে পৃথিবী রঙীন ফিতে জড়িয়ে নাচে বিভিন্ন ঋতু জুড়ে। বাড়িতেও বুড়ো দাদুর সম্মান নেই। মাঝে মাঝে বিছানায় পায়খানা হয়ে যায়। দাদুর টাকা নেই। কোনো পেনশনও পায় না। তাহলে দাদুর আছে কি? তার আছে জ্ঞানের ঝুলি, ওস্তাদের কায়দা তার জানা। কেউ নেই যে এই অমূল্য সম্পদ নেবে।

দাদু কয়েকদিন হল একটা পঁচিশ বছরের ছেলেকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছে। তার নাম বীরবাহাদুর। সে কার কাছে শুনেছে দাদু নাকি তন্ত্র মন্ত্রও অনেক জানে। বীরবাহাদুর লাঠি খেলা শিখতে চায়। দাদু বলে দেয় প্যাঁচ পয়জার। বীরবাহাদুর দেখে দাদুর কথায় যাদু আছে। কত কঠিন কাজ সহজেই হয়ে যায়। দাদু হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও জানেন। বীরবাহাদুর বলে,দাদু হোমিও মেডিসিনে ক্যান্সার রোগ কি গাল হয়? দাদু বলে, শুধু ক্যান্সার নয় এর চেয়ে মত মরণ রোগের চিকিৎসক হচ্ছে হোমিওপ্যাথিতে এখন অন্নপ্রাশনের ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন রকমের ওষুধের গবেষণা হয় এ রোগের চিকিৎসায় তারা দেখতে পেয়েছেন হয়তো অনেক রোগী সুস্থ আছেন ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা কাজ করবেন। বীরবাহাদুর জানে, এছাড়া অন্যান্য রোগ নিয়ে কাজ করছেন প্রতিনিয়ত বর্তমানে তাদের ওয়েবসাইটে চিকিৎসা সম্পর্কে তথ্য সাহায্য চেয়ে আবেদন আসে। ভারত সরকার এক্সপার্ট কমিটি গঠন করেছে। সেই এক্সপার্ট কমিটি সুপারিশ করবে আমাদের চিকিৎসা প্রথাগত উপকারের কথা।

ছয় [Bangla Uponnash Online Reading]

প্রয়োজন মুছে দেয় রাজনৈতিক সীমারেখা। এখানে বিন্দু নদী জলঢাকায় মিশেছে। নদীর গা থেকে খাড়াই উঠে গেছে ভুটান পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে বিন্দু থেকে হিমালয়ের বরফশৃঙ্গ দেখা যায়। বুধবারে ঝালং-এ আর বৃহস্পতিবারে বিন্দুতে হাট বসে। শিলিগুড়ি থেকে বিন্দুর দূরত্ব ১০৪ কিমি। ঝালং থেকে বিন্দু ১৩ কিমি। ঝালং থেকে দলগাঁও হয়ে রঙ্গো বেরিয়ে নেওয়া যায়। প্যারেন থেকে ঘুরে আসা যায় তোদে। কুসুম ভাবে, কয়েকদিন ওখানে কাটিয়ে আমরা ফিরে আসি। কিন্তু ঝালং এর প্রকৃতির শোভা মানসপটে ভেসে ওঠে বারেবারে। আর ভেসে ওঠে অসিমের কাতর মুখের ছবি।

কুসুম জানে, অসিম এই পাঁচবছর পরেও বিয়ে করেনি। কুসুম ভাবে, এবার বাবার বাড়ি গেলেই অসিমদাকে বিয়ের কথাটা বলব। অসিম এম এ পাশ করে কম্পিউটার কোর্স শেষ করে।চাকরি পেয়ে যায় টিসিএস কোম্পানিতে। টিসিএস কোম্পানি তাকে কাজের জন্য টরেন্টো পাঠিয়েছে। কুসুমের বিয়ে হয়েছে। তাই ভালো লাগছে তার। অসিম ভাবে, যদি হঠাৎ করে কোনোদিন কুসুমের সঙ্গে দেখা হয় তাহলে খুব ভালো হয়। কুসুম এদিকে বরের সঙ্গে সুখে আছে।সে ভাবে, অসিম আর যোগাযোগ রাখে না।মোবাইলে সিম পাল্টে দিয়েছে বর। যদি কোনোদিন অসিমের দেখা পাই, কথা বলব অনেকক্ষণ। কিন্তু বর কি পারমিশন দেবে।নিশ্চয় দেবে না।এক্স বয়ফ্রেন্ডকে স্বামীরা ভয় পায়।যতই আড়াল করে রাখা থাক, চোকাচুখি রোখা যাবে না।যে গরু গু খায় সে তার স্বাদ ভুলতে পারে না। কুসুম ভবিষ্যৎ ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়।

সাত [Bangla Uponnash Online Reading]

মা বলতেন, কি করে যে একটা একটা করে রাত, দিন পার হয়ে যায়, বোঝাই যায় না। তবু বুঝতে হয়, মেনে নিতে হয়। অসিম বলে, একটা ঘুঘু পাখি তার স্বামী মরে যাওয়ার পর থেকেই এবাড়িতে আসে। আম গাছের ডালে বসে আপন মনে কত কথা বলে। ঘুঘুর ঘু, ঘুঘুর ঘু। সবিতাদেবীর সঙ্গে পাখিটার খুব ভাব।তার মনে হয় স্বামী, ঘুঘুর রূপ ধরে আসেন। তিনি আম গাছের তলায় খুদকুড়ো ছিটিয়ে দেন। ঘুঘু পাখিটা খায় আর গলা তুলে কবিতাকে দেখে। কিছু বলতে চায়। তিনি বোঝেন। আর আপনমনেই পাখিটার সঙ্গে বকবক করেন। পুরোনো দিনের কথা বলেন। ছেলের বৌ বলে,বুড়িটা পাগলী হয়ে গেছে। প্রতিবেশীরা অতশত বোঝে না। হাসাহাসি করে। শুধু তার ছেলে বোঝে মায়ের অন্তরের কথা, ব্যথা। ঘুঘু পাখিটা সারাদিন ডেকে চলে। এবার আয়, এবার আয়। কবিতার বয়স হল আশি।

একদিন সবাই দেখলো, বুড়ি ফুলশয্যার রথে শ্মশানে গেলো বোধহয় স্বামীর কাছে। ঘুঘু পাখিটা ডেকে চলেছে তখনও, ঘুঘুর ঘু…। কুসুম বলে, তোর মা বাবা দুজনে এখনও একসাথেই আছেন।আমরাও মরার পর একসাথেই থাকব দেখিস।অসিম কুসুমের মুখ চেপে ধরে।সে বলে,ওকথা বলতে নেই।তোর বিয়ে হবে বিদেশে। তুই রাজরানী হবি, দেখিস। অসিম বলে চলে, কিশোরবেলায় একটা রঙিন বাক্স ছিলো জানিস পড়ার ঘরে। তার ভিতরে দুটি রবীন্দ্রনাথ একটা জীবনানন্দ আর কয়েকটা বাল্যকালের খেলনা ছিল। মন খারাপ হলেই পুরী থেকে আনা, নকশা কাটা পেন ও হলুদ কাশীরাম দাস বের করতাম বাক্স থেকে। তখনই প্রভাতী সূর্যের ভালবাসা দখল করত আমার মন। তারপর বন্যা এলো, মাটির বাড়ি ভেঙ্গে পড়ল। জীবনের তোয়াক্কা না করে আমি ভেসে যাওয়া বাক্স ধরার চেষ্টায় বিফল হলাম। ভেসে চলে গেলে আমার স্বপ্ন। বাবা আমার কান্না দেখে নতুন বাক্স কিনে দিলেন। তারপর বড় হলাম। চাকরি পেলাম। আরও নতুন বাক্স কিনলাম। কিন্তু হায় সেই প্রভাতী সূর্যের ভালোবাসা আর পেলাম না। কুসুম জড়িয়ে ধরে অসিমকে। সে বলে, কবি আমি তোকে ভালোবাসি রে।

আট [Bangla Uponnash Online Reading]

একদল বলাকার দল উড়ে এল রিমির মনমেঘে।তখন সে সাদাশাড়িতে সতের। দেহের সাগর ঘিরে উথালপাথাল ঢেউ। ঠিক সেই সময়ে নোঙর করে তার মনের তীরে পূর্ব প্রেমিক সমীরণের ছোঁয়ায় তার শিরশিরে পানসি নৌকার অনুভব। ধীরে ধীরে পালতোলা জাহাজের মত দুজনের প্রেম তরতরিয়ে এগিয়ে চলে।শত ঝিনুকের মুক্তোর সোহাগে দুজনেই রঙিন হয়ে উঠত। চিন্তার রেশ কাটতেই বিপিন বলে উঠল, রিমি তুমি এত কী চিন্তা করছ?

— কিছু না।এমনি করেই কাটুক সময়।
— আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরে একটা অনুষ্ঠান করলে হয় না?
— থাক ওসবে আর কী হবে? এই বেশ বসে আছি নদীর তীরে।
— তোমার অতীতের কথা বলো। আমি শুনব।
— কেন তোমার অতীত নেই
— আমার অতীত বর্তমান হয়ে রাজুর বউ হয়ে বসে আছে।
— ও, রাজুর বউ তোমার পূর্ব প্রেমিকা ছিল?
— হ্যাঁ ছিল একদিন। গ্রামের মন্ডপতলায় গেলেই মনে পড়ে বাল্যপ্রেম। কাঁসর ঘন্টা বাজত আরতির সময়। আমি ভালো কাঁসর বাজাতাম।আর তাছাড়া ওর মুখ দেখার লোভে ছুটে চলে যেতাম পুজোমন্ডপে। আরতির ফাঁকে দেখে নিত ওর চোখ আমাকে।তার চোখের নজর আমার দিকেই থাকত। সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম ওদের বাড়ির দিকে। যদি একবারও দেখা যায় ওর মুখ। অসীম খিদে চোখে কেটে গেছে আমার রোদবেলা।
— আমারও অতীতের ভালোবাসা সমীরণ, ভেসে গেছে অজানা স্রোতে। এসো আজ আমরা আবার নতুন মনে এক হই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ চেয়ে।
— হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি। পুরোনো ব্যথায় মলম লাগাব দুজনে দুজনকে। চলো আজ নৌকাবিহারে আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করি।
— চলো। নব উদ্যমে এগিয়ে যাই আমরা নব সূর্যের আহ্বানে।

রিমি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ভক্ত। বিপিন পুণ্যদাস বাউলের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। কিন্তু দুজনে দুজনের পছন্দকে শ্রদ্ধা করে। রিমি বিপিনকে বলে তার প্রিয় লেখিকার কর্মজীবনের কথা, সাহিত্যের কথা। রিমি বলে, পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুরের শবর জনজাতির সঙ্গে মহাশ্বেতা জড়িয়ে ছিলেন আজীবন। তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছিল শবরাও। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ব্লকে লোধা শবর, বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ, রাইপুর এবং পুরুলিয়ার তেরোটি ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী খেড়িয়া শবরদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ করেছেন তিনি । এদের উন্নয়নে মহাশ্বেতারকর্মসূচি ছিল শিশুশিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা, নারীশিক্ষা, শবরদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, তাদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করা এবং ব্রিটিশ যুগ থেকে শবরদের গায়ে লেগে থাকা ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’র তকমা থেকে তাদের মুক্ত করা। বিপিন বলে,আমি পড়েছি,এজন্য আইনি লড়াইয়েও পিছপা হননি তিনি। ২০০৩ সালে এই শবরমাতা ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কারের ভূষিত হন। পুরস্কার মূল্যের দশ লক্ষ টাকা পুরোটাই তিনি দিয়েছেন এদের উন্নয়নার্থে। গ্রামে কোন সমস্যা হলেই তিনি সেইসব গ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে গেছেন।

নয় [Bangla Uponnash Online Reading]

রিমি আবার বলে, মহাশ্বেতার সাহিত্যিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল আরো অনেক বছর আগে । ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় পদ্মিনী ও যশোবন্তি গল্প দুটি লেখেন মহাশ্বেতা দেবী। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় মহাশ্বেতা দেবী গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রাণী, এই মধ্যপ্রদেশের লোককথা ও ইতিহাসের মিশেলে তৈরি। ষাট দশকের গোড়ায় অবিভক্ত বিহারে পালামৌ, হাজারিবাগ, সিংভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সেখানকার বেগার শ্রমিক প্রথা এবং জনজাতিদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে লেখেন ‘অপারেশন বসাই টুডু, অরণ্যের অধিকার এবং ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর‘। ১৯৭৪ সালে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘হাজার চুরাশির মা ‘ বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীতে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিভিন্ন বাংলা পাঠ্যপুস্তকও সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা। ১৯৭৯ সালে বাবা মণীশ ঘটকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘বর্তিকা’র দায়িত্ব নেন। ১৯৮৩ সালে পুরুলিয়ার অবহেলিত জনজাতিদের উন্নতির জন্য গড়ে তোলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি। তিনি তার বহু পুরস্কারের অর্থ দান করেন এই সমিতিকে।

দশ [Bangla Uponnash Online Reading]

— বলো কি বলছো ?
— তোদের থলিতে কি আছে দেখা।
— কিছু নেই।
— তবে রে, আমি তো মাছের গন্ধ পাচ্ছি।
— ঠিক বলেছো। পিসিকে দোবো।
— আমাকে দে বলছি

এই বলে মেছে ভূতটা থলিটা উড়িয়ে নিয়ে বট গাছের ডালে ঝুলিয়ে কাঁচা মাছ চিবিয়ে খেতে লাগলো। জ্যোৎস্না শুনে ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করতো, সত্যি, বাবারে আমি আর শুনবো না। বলেই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরতো। আমি বলতাম, তারপর থেকে বাবার সঙ্গ ছাড়া আমরা পিসির বাড়ি যেতাম না। পরে বাবা বুঝিয়ে বলতেন, অই গাছের ডালপালা অন্ধকারে দেখতে ভয় লাগে। ভূত বলে কিছু হয় না। তবু আমার এই বিশ্বাস ধরে বেঁচে থাকতে ভালো লাগে। আর একবার জ্যোৎস্নাকে গল্প শুনিয়ে ছিলাম। সে অবাক হয়ে শুনেছিলো। অনিমেষ বলল, অন্ধ কুসংস্কার কত জনের প্রাণ কেড়ে নেয় আমার মামার বাড়িতে দেখেছিলাম। বীরভূম জেলার আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রামে আমার মামার বাড়ি। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বক্রেশ্বর নদী। গাছে গাছে সাজানো গ্রাম। তখন আমার বয়স চোদ্দ কি পনেরো। আমি মামার বাড়িতে এলে একমাস থাকতাম। আসার দুই দিনের মধ্যেই জানতে পারলাম বুড়ো বটগাছতলায় একটি লোক একমুখ দাড়ি নিয়ে নানা রকমের বিস্ময়কর কাজ করে দেখাচ্ছে। হাত থেকে আগুন বের করে দেখাচ্ছে। প্রচুর লোক তাকে দেখতে আসছে। আমি একটা লোককে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি আশায় ওখানে যাচ্ছেন।

— আরে দাদা, উনি মহাপুরুষ, উনি যা বলেন তাই হয়।
— কি রকম, একটু ভেঙ্গে বলুন ।
— একটো ঘটি আছে। ঘটিটো থেকে জল ছিটিং দিছে আর তারপর যা বঁলছে তাঁই হচে।

বীরভূম জেলার ভাষা এইরকমই। শুনতে বেশ ভালো লাগে। আমি পিছনে পিছনে কথা বলতে বলতে মহাপুরুষের কাছে গেলাম। দেখলাম অনেক লোক লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন এগিয়ে গিয়ে বললেন, আমার ভবিষ্যৎ একটু বঁলে দেন কেনে। মহাপুরুষ তার সঙ্গীকে বললেন, এর সঙ্গে কথা বলে ওর অসুবিধা আমাকে লিখে পাঠা। মহাপুরুষের প্রায় দশজন সঙ্গী । গ্রামের আদিবাসী পাড়ার কয়েকজনকে বশ মানিয়ে নিয়েছে। বেশ ভালো রকম আয় হচ্ছে তার। একটি তরুণ এগিয়ে এসে বললো, এই ফোর জি র যুগে চিটিং বাজি। বেটা দেবো তোমার ব্যবসা গুটিয়ে। মহাপুরুষ রেগে বলে উঠলেন, তোর ফোর জি তে ঝুল জমবে। আমার অভিশাপ বারো ঘন্টার মধ্যে তোর বিপদ হবে। তরুণটি বলে উঠলো, শোনো নি ফাইভ জি চালু হয়েছে অনেক দেশে। তোমার চিটিং বাজি চলবে না।

পাঁচ ঘন্টার মধ্যে শোনা গেলো তরুণটি মোটর সাইকেলের ধাক্কায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেলো। সরল মানুষ গুলিকে এরা ঠকিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। ক্লান্ত হয়ে বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম। অনেক ঘটনা জীবনে জলছবি হয়ে আছে । ঠিকমতো সাজাতে গেলে সুন্দর মুখও অসুন্দর হয়ে যায়। এই পাগলের প্রলাপ শুনতে জ্যোৎস্না বড়ো ভালোবাসতো। সেই ঘটনাগুলো একটু শেয়ার করলাম। বলুন এর মধ্যে ভালোবাসার গল্প কোথায়। তবু সে আমাকে আমি তাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম কোনো এক ক্ষণে, মাহেন্দ্র ক্ষণে। সে ভালোবাসা টিকে আছে আজও। শরীর পেরিয়ে এক অনুভবের জগৎ এই ভালোবাসা। সব নিয়ম অমান্য করে জীবনের এই গল্প, এই কবিতা আমার জীবনে চলার পাথেয়।

অনিমা আজ ডায়েরি লিখলেন। আজ নববর্ষের পুণ্য লগ্নে সবার আনন্দে অংশীদারি হয়ে নিজের আনন্দ খুঁজে নেবো । সকলের সুখ দুঃখেই আমার অংশগ্রহণে মনের ময়লা সাফ হয়ে গড়ে উঠবে নতুন পৃথিবী। নববর্ষে শপথ নেবো কেউ কারো নিন্দা করবো না। ভালোবাসা স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে পারস্পরিক বোঝা পড়ার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবো। সকলের সুখেই সমাজের মঙ্গল। ভারতবর্ষের এই সনাতন ঐতিহ্য অটুট রেখে, জাত পাতের বালাই দূরে রেখে এগিয়ে যাবো সবাই এক সুন্দরের আহ্বানে। আপন আপন কর্মে সবাই স্থির থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবো। একজন আদর্শ মানুষ হবার চেষ্টায় রত থাকলে হিংসা, ঘৃণা, পরশ্রীকাতরতা দূরে সরে যাবে ।মনে রাখতে হবে কবির বাণী, সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে। আর মনে রাখতে হবে কিছুই আমি সাথে আনিনি, কিছু আমরা নিয়েও যাবো না। একমাত্র ত্যাগের এই সনাতন বাণী আমাদের প্রকৃত মানুষের মর্যাদা দিতে পারে।

সুদীপ ঘোষাল | Sudip Ghoshal

Sea expedition of fisherman | মৎস্যজীবীর সমুদ্র অভিযান | Article 2023

New Bengali Story 2023 | খুনসুটি | প্রসেনজিৎ মজুমদার

New Bengali Story 2023 | মৃত্যু অস্বাভাবিক | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

Living next to tiger | বাঘের পাশে বাস করা | 2023

Bangla Uponnash Online Reading | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Bangla Uponnash Online Reading | Pdf Bangla Uponnash Online Reading | Bangla Uponnash Online Reading App | Full Bangla Golpo Online Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English |Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Bangla Uponnash Online Reading 2023 | New Bengali Web Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Bangla Uponnash Online Reading Video | Horror – Bangla Uponnash Online Reading | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Bangla Uponnash Online Reading Netflix | Audio Bangla Golpo Online Reading | Video Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2023 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Recent Bangla Uponnash Online Reading | Top Bangla Uponnash Online Reading | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2023 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bangla Uponnash Online Reading Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Bangla Uponnash Online Reading mp4 | Bangla Uponnash Online Reading Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bengali Story – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Collection – Bangla Uponnash Online Reading

Leave a Comment