Sea expedition of fisherman | মৎস্যজীবীর সমুদ্র অভিযান | New Article 2023

Sharing Is Caring:
Fisherman

মৎস্যজীবীর সমুদ্র অভিযান – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা [Sea expedition of fisherman]

ফাগুন মাসের শেষ। মাছের বাজারে এখনও মেলে দু-এক পিস ইলিশ মাছ। ‘খোকা’ ইলিশ এর চেয়ে একটু বড়, বলা যেতে পারে ‘বড় খোকা ইলিশ’। দাম কত বাপু? সাড়ে সাতশ। একদম ডিম নেই, সলিড মাছ বাবু। ভাবি, বর্ষাতে যে ইলিশের আকাল, সে এই ফাগুন মাসে এলো কী করে! এ পোড়া বাংলা থেকে ইলিশ যে বিলুপ্তির পথে, সে সম্ভাবনা উজ্জ্বল (?) হচ্ছে – মাছ ধরার কৌশল, সময় ও বিধি না মানার কারণে। বিধি আছে কাগজে কলমে, কিন্তু ব্যবসায়ী মুনাফা, মাছ ভাতে বাঙালির রসনা তৃপ্তির জন্য সব নিয়ম কানুন ওলট পালট। ফলশ্রুতি, প্রতিবেশী বাংলাদেশের কাছে হাত পাতা। শুধু ইলিশ নয়, সমস্ত সামুদ্রিক মাছ আমরা পাই মৎস্য জীবীদের কঠোর পরিশ্রমে আর দুরন্ত সাহসিকতায়। আমরা সুখে খাই মাছ। নজরসই পছন্দ, আকার, স্বাদ ইত্যাদি অনুযায়ী। কিন্তু কোনদিন ভেবে দেখি না, ট্রলারের মাছ শিকারিদের কষ্টকর জীবন সংগ্রাম।

দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা আর পূর্ব মেদিনীপুরের বিভিন্ন সমুদ্র উপকূলবর্তী বন্দর থেকে হাজার হাজার ট্রলার যায় গভীর সমুদ্রে মাছের সন্ধানে। ট্রলারের মালিক প্রথমে সন্ধান করে দক্ষ মাঝির। মাঝি ঠিক হলে , সেই মাঝির উপর দায়িত্ব পড়ে মাছ ধরার লোক অর্থাৎ মৎস্যজীবী (Fisherman) । একটা ট্রলারে কমপক্ষে বারো থেকে পনের জন মৎস্যশিকারি প্রয়োজন। অগ্রিম মজুরি দিয়ে এদের বন্দোবস্ত করা হয়। দলের সবচেয়ে গুরুত্ব পূর্ণ ব্যক্তি হল মাঝি। একজন রাঁধুনি থাকে। আর সব জাল পাতা, টানা তোলা ইত্যাদি কাজের দক্ষ শ্রমিক। মালিকের কথা অনুযায়ী এক ট্রিপ গেলে ষাট সত্তর হাজার টাকা ব্যয়। এক ট্রিপে কতদিন থাকতে হবে সমুদ্রে তার নির্দিষ্ট কোন সময় নেই। হতে পারে সাত দিন, নয় দিন বা দশ দিন । মাছের সংগ্রহের উপর সময় নির্ধারণ। হয়তো বা তারও আগে চলে আসা যায় ভাগ্য ভালো হলে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ , সাইক্লোন ,নিম্নচাপ ইত্যাদির কারণে মাছ ধরা বাদ দিয়ে কখন যে চলে আসতে হবে তার কোন ঠিক নেই। আবহাওয়া দপ্তরের খবর দ্রুত পেয়ে যায় ওরা রেডিও ইত্যাদির মাধ্যমে।

ট্রলারে নিয়ে যেতে হয়, পরিমাণ মত ডিজেল,পানীয় জল, চাল, ডাল, সবজি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী। আর নিয়ে যেতে হয় বরফ, মাছ সংরক্ষণের জন্য। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত প্রধানত ইলিশ মাছ ধরা । আর এই রুপোলি ফসল তোলার জন্য ট্রলারের সমুদ্রযাত্রা। ট্রলার ঘণ্টায় আট থেকে দশ কিলোমিটার যেতে পারে, তবে ঝড় ও সমুদ্রের ঢেউয়ের ওপর নির্ভর করে তার গতি। এই গতিবেগে প্রায় এক দিন ধরে চলে নৌযান গভীর সমুদ্র পানে। তারপর মাছের সন্ধান মেলে।

ট্রলারের মাঝি, সেই হল মূল গায়েন। সে মাঝির নেই কোন লেখাপড়া, নেই কোন পুঁথিগত জ্ঞান। কিন্তু সেই গেঁয়ো মাঝির অভিজ্ঞতা, সাহস, উপস্থিত বুদ্ধি, আর সমুদ্রের নাড়ি নক্ষত্র কিছুই অজানা নয়। এ তার দীর্ঘ অনুশীলন এবং ব্যবহারিক পর্যবেক্ষণ থেকে প্রাপ্ত। তার ভক্তি, বিশ্বাস ও অগাধ আস্থা মা গঙ্গার প্রতি। কারণ লোকবিশ্বাস জলের দেবী হলেন গঙ্গা । তাঁকে তুষ্ট রাখাই মূল বিষয়। ট্রলারে থাকা কালীন সেই মাঝি যেন অন্য জগতের মানুষ। তার হাতে অনেক গুলো মানুষ তাদের সংসার, সন্তান সন্ততির জীবন নির্ভর করে। মাঝির নিয়ন্ত্রণে ট্রলারের সমস্ত গতি বিধি, মাছ সংগ্রহ ও নিরাপদে ফেরা নির্ভর করে। অন্য সবাই তার কথার ও নির্দেশের অমান্য করলেই বিপদ। বর্তমানে জি পি এস পদ্ধতিতে দিক নির্ণয়, অত্যাধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে খবর আদান প্রদান অনেক সহজ হলেও মাঝির তাৎক্ষণিক বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। আসলে উত্তাল ও রহস্যময় সমুদ্রে সেই কাণ্ডারি। সেই মাঝির কথা অমান্য করার সাহস কারোর নেই। আসলে সবাই এক অজানা বিপদের মধ্যে আশঙ্কার মধ্যে এই মৎস্য অভিযানে ব্যস্ত থাকে। তাই ভক্তি এবং বিশ্বাস মনোবল বাড়াতে সাহায্য করে। ঘন ঘন তাই রব ওঠে, – ‘ জয় মা গঙ্গা’।

ট্রলারে অনেক বাধা নিষেধ কঠোরভাবে পালনীয়। রান্নার জন্য পেঁয়াজ, রসুন, মাংস নিষেধ। কেবলমাত্র আদা ব্যবহার করা যাবে। ট্রলারের সামনের দিকের শীর্ষ বিন্দু হল – “আহ্নিক”, নৌকোর ক্ষেত্রে যাকে বলা হয়, ‘চণ্ডী ‘ বা গলুই। এই স্থানে মাঝির নিয়মিত পূজা। এই আহ্নিক এর দিকে পা করে কেউ শয়ন করতে পারবে না। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ, বিশেষ করে বর্ষাকালে কতটা ভয়ঙ্কর , তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না ।সবসময় আট দশ ফুট ঢেউয়ের মুখে পড়তে হয়। সেই ভয়াল ঢেউ সামাল দিয়ে মাঝি চলে মাছের সন্ধানে। দোদুল্যমান ট্রলারে দাঁড়িয়ে থাকা যেন কষ্টকর। তবু সেই অবস্থার মধ্যে চলে জাল পাতা, তোলা ইত্যাদি কাজ। এক ধাক্কায় ভাতের হাঁড়ি উল্টে গেলে রাঁধুনির কপালে দুঃখের শেষ নেই। খাবার সময়ও সাবধানে বসে খেতে হবে, ঢেউ এর বেগ সামলে। বঙ্গোপসাগরের গভীরতা সব জায়গায় সমান নয়। আর পৃথিবীর সব চেয়ে বিপজ্জনক সমুদ্রের নাম বঙ্গোপসাগর। বিচিত্র তার জলের রঙ। ঢেউয়ের ঊর্ধ্বগতির জন্য মাঝে মাঝে ট্রলারের তলদেশ নিচের মাটিতে আছড়ে পড়ে, তখন ট্রলার ভেঙে যেতেও পারে। ঘুম হয় পালা করে। রাতে যেন সমুদ্রের উপর সহর নেমে আসে। হাজার হাজার ট্রলারের আলোতে ভরে যায় সমুদ্রপৃষ্ঠ। সে এক অনুপম দৃশ্য।

এক কঠিন আর অতি সতর্কতার মধ্যে চলে মাছ ধরার পালা। একটু অসাবধান হলেই পদে পদে বিপদ। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে এক দিনের ধরা মাছে ভর্তি হয়ে যেতে পারে ট্রলার। মন-ফিলামেন্ট আর কট জাল দিয়ে মাছ ধরা।এমনও ঘটনা ঘটতে পারে যে, একদিনের ধরা মাছের পরিমাণ আট দশটা ট্রলারে ধরবে না। তখন জাল কেটে মাছ নষ্ট করা ছাড়া উপায় থাকে না। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাছ ইলিশ হলেও অন্য প্রজাতির ছোট বড় মাছ ধরা পড়ে পাতা জালে। ঢেলা, ফ্যাসা, ভোলা, আট ট্যাংরা, পমফ্রেট ইত্যাদি প্রজাতির মাছের সঙ্গে কামোট ও বোম মাছ ধরা পড়ে। কামোটের ধারালো দাঁতের কামড় ভয়ঙ্কর, তবে তার মাংস নাকি খুব সুস্বাদু । এর মাংস খেলে শরীর প্রচন্ড গরম হয়ে যায়। বোম মাছের আকার গাছের গুঁড়ির মত। ট্রলারের সব চেয়ে বিপদ তার পাখায় জাল জড়িয়ে গেলে। তখন দক্ষ কোন মৎস্যজীবী (Fisherman) কোমরে দড়ি জড়িয়ে ডুব দিয়ে সেই জাল ছাড়ায়। কাজটা খুব বিপজ্জনক। যে কোন মুহূর্তে বিপদ। আসলে এই মৎস্য শিকারের প্রতিটি মুহূর্ত বিপদের। আমরা কত ট্রলার ডুবি, মৎস্যজীবীর (Fisherman) প্রাণহানির খবর পাই, কিন্তু তাদের জীবন নিয়ে সাময়িক দুঃখ প্রকাশ ছাড়া কিছুই কী করতে পারি !

বর্তমান দূষণের যুগে মাছেদের অনেক প্রজাতি শেষ হয়ে যাচ্ছে। কমে গেছে মাছের উৎপাদন। জলের দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, এ দেশে এবং বিদেশেও। বিশেষ করে ইলিশ মাছের ক্ষেত্রে আমাদের বঙ্গভূমি বিপদের কিনারায়। ইলিশ মাছ প্রজননের ক্ষেত্র চন্দ্রনির্ভর আবর্তন অনুসরণ করে। তাই ভরা পূর্ণিমায় বা অমাবস্যায় হয় প্রজনন। অবশ্য অন্যান্য দেশে এই সময় সীমার বাইরেও প্রজনন হয়। বঙ্গোপসাগরে ইলিশের প্রজনন ভাদ্র মাস থেকে মধ্য কার্তিক, আবার মধ্য পৌষ থেকে মধ্য ফাল্গুন মাস। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রজনন হার প্রথমের থেকে কম। এই সময়কালে ইলিশ ধরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু তা কী হয় ! খাতায় কলমে নির্দেশ রয়ে যায়। একটা মা ইলিশ ২০ থেকে ২২ লাখ ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার কালে সমুদ্র তীরের কাছে মিষ্টি জলের সন্ধানে আসে। তারপর খোকা ইলিশের দল গভীর সমুদ্রে গিয়ে বড় হয়। তবে দূষণের কবলে পড়ে মা ইলিশের ডিম ধারণ ক্ষমতা কমে গিয়ে ১৮ লাখের কাছাকাছি। সহজেই অনুমেয় আমরা কত ইলিশের জীবন নষ্ট করছি ! শুধু মাত্র প্রাচীন প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে লোভের বশবর্তী হয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতি কে না মানার জন্য আজকের এই ইলিশ বিলুপ্তির পূর্বাভাস। আর আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ কিভাবে ইলিশ উৎপাদনে এগিয়ে গেল ! ওদেশে একসময় এই প্রিয় মাছের উৎপাদন কমে যায়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ওদেশের খোকা ইলিশ ধরা বন্ধ করা হয় এবং সরকারি নির্দেশ পালনে কার্যকরী ভূমিকা নেয় জনগণ। মানুষের আন্তরিক প্রচেষ্টায় সেই কর্মসূচি সফল হয়। 

গোটা দেশে বিজ্ঞান ভিত্তিকভাবে ইলিশের উৎপাদন আজ এক বিপ্লব এনেছে ওই বাংলাদেশ। যে কাজটা আমদের পশ্চিমবঙ্গ পারলো না। এ রাজ্যের মানুষ রাজনীতি নিয়ে এত ব্যস্ত যে কিভাবে এগোলে পাতে রুপোলি ফসল পড়বে তা ভুলে গেছে। খোকা ইলিশ খেলে যে সুস্বাদু বড় ইলিশ পাওয়া যায় না, এই সহজ কথাটা আমরা ভুলে গেছি। বীজ ধান খেয়ে নিলে বীজ বোনা যাবেনা আর ধান চাষও হবে না। বিজ্ঞানে অনেক এগিয়েও বিজ্ঞান ভিত্তিক মৎস্য উৎপাদনে আমরা কতটা পিছিয়ে, পড়শী দেশ তা বুঝিয়ে দিল।
জীবনকে বাজি রেখে ট্রলারের মৎস্যজীবীরা (Fisherman) হাড় ভাঙা পরিশ্রম করেও আমাদের সুস্বাদু মাছ কোথা থেকে জোগাড় করবে, যদি না মাছ জন্মায় সমুদ্রের জলে !

কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya

The legend of Jagannath | জগন্নাথের কিংবদন্তি

Odisha Goddess Durga | ওড়িশার পটচিত্রে দেবী দুর্গা | 2023

New Bengali Article 2023 | আধুনিক কবিতা ও অনুবাদ কবিতা

Chandannagar Jagadhatri | চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রবক্তা কে ??

মৎস্যজীবীর সমুদ্র অভিযান | বানৌজা সমুদ্র অভিযান | সমুদ্র অভিযান | মৎস্যজীবীর সমুদ্র | অভিযান (চলচ্চিত্র) | অভিযান গল্প | সামুদ্রিক মৎস্যজীবী | মৎস্যজীবী লীগ | বাংলা প্রবন্ধ | বাংলার স্মৃতি | বাংলার লেখক | প্রবন্ধ ও প্রাবন্ধিক

fisherman in hindi | fisherman or fishermen | fisherman movie | fisherman registration | fisherman friend | fisherman drawing | fisherman fishing | fisherman article | fisherman bengali article | article fisherman | fisherman wallpaper | fisherman photo | fisherman image | fisherman motivation | fisherman image download | fisherman journal download | fisherman journal pdf | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment