New Bengali Story 2023 | মৃত্যু অস্বাভাবিক | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

BENGALI STORY

মৃত্যু অস্বাভাবিক – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা [Bengali Story]

চক্রর ওপর দায়িত্ব বর্তাল কনক স্যারকে নিয়ে যাবার। তখন বেলা বারোটা পার হয়ে গেছে। গন গনে দুপুর বাইরের রাস্তায়। চৈত্র মাস। চক্র অর্থাৎ ড্রাইভার চক্রধর জানা। স্ট্রাইফ গেঞ্জি, ধূসর রঙের প্যান্ট, মাথায় চুল কম বলাই ভালো, হাতে তার গাড়ির লগ বুক। খুবই নিরীহ, মানুষটার গাড়ি চালানোর হাতটা খুব ভালো। অশোকবাবু পুলকারের দায়িত্বে। তিনি চক্রকে নির্দেশ দিয়েছেন, কনক স্যারকে হসপিটালের মর্গে নিয়ে যেতে। অফিসের জরুরি, আধা জরুরি ও অন্যান্য কাজ রেখে, তিনি দোতলা থেকে নিচে নামলেন। অশোক বাবুর ঘরে ঢুকতেই চা পানের জন্য পীড়াপীড়ি। অগত্যা চক্রকে খবর দিয়ে চা এর ব্যবস্থা হল।

চক্রধর জানার চার চাকার গাড়িতে হাসপাতাল চত্বরে ঢুকতেই থানার আই.ও. একটা স্যালুট ঠুকে বললেন, – স্যার অনেক দেরি হয়ে গেল, সেই সকালে এসেছি স্যার। – কী করি বলুন, আমাকে তো আধ ঘন্টা আগে জানানো হল। কথা দীর্ঘ না করে মর্গের কাছে যেতে পচনশীল মরদেহের একটা উৎকট গন্ধ বাতাস বাহিত হয়ে নাকে ঢুকলো। একটা গা বমি বমি ভাবের। এখন অবশ্য তার রপ্ত হয়ে গেছে। হাসপাতালের ডোমেরা যে ঘরে বিশ্রাম নেয়, সেখানে যেতে, একজন কালো মাঝবয়সী হ্যাফ প্যান্ট পরা মানুষ বেরিয়ে বলে, – চলুন স্যার।

মূল মর্গের কাছে যাওয়ার আগে বামদিকে একটা ছোট ঘর। তার মেঝেতে গোটা পাঁচেক মৃতদেহ। বেশির ভাগ দেহ খুব ফুলে গেছে, কোনটায় পচন ধরেছে , রাশি রাশি নীল মাছি চেয়ে গেছে । মেঝে ভিজে গেছে দেহ নিঃসৃত জলীয় পদার্থের রসে, সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের সম্ভব নয় বেশিক্ষণ। দ্রুত মূল জায়গায় যাওয়ার আগে গেটের চাবি খুলে দাঁড়িয়ে আছে দেহ দেখানো মানুষটি। ওদের সঙ্গে মৃতার পরিচিত আত্মীয় দুজনও গেল।তাদের নিজেদের মৃতদেহ শনাক্ত করতে ডাকা হয়েছে । ঘরের ভিতর থেকে ওরা বের করে আনলো একটা যুবতীর লাশ । তরতাজা সেই দেহ দেখে কনক স্যারের মনে হল, মৃতা নয় অঘোর ঘুমের মধ্যে আছে। কয়েক সেকেন্ড তার মাথাটা একটু যেন টলমলিয়ে উঠলো। মৃতার ছোট ভাই দিদির দেহ চিনিয়ে দিয়ে হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলো । তপ্ত রোদের তাপে পুড়ে যাওয়া যুবকটিকে সামলাচ্ছে তার বন্ধু। কনক বললো, – তোমরা আড়ালে যাও ভাই।

সুন্দর একটা লাল শাড়ি, ম্যাচিং ব্লাউজ কপালে উজ্জ্বল লাল টিপ আর সিঁথিতে সিঁদুর। শাঁখা আর পলা দুই হাতে। বাইরে কয়েক জন আত্মীয় অসহায় দাঁড়িয়ে। দায়িত্বে থাকা লোকটিকে বললাম দেহ নিরাবরণ করতে । লম্বা চুলের বিনুনি আছে অক্ষত। সারা দেহে কোন ক্ষত চিহ্ন নেই, শুধু গলার ঊর্ধ্ব ভাগে ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা কালসিটে দাগ ! উদ্বন্ধন ! নাকি শক্ত হাতের কারসাজি। ওই লোকটি একদম মুখস্থের মত বলে যাচ্ছে, দুই হাতে শাঁখা, পলা, নাকে কিছু নেই, পায়ের নখে নেল পালিশ, চুল লম্বা ও কালো, চোখ বোজা, …। কনক স্যার সব খুঁটিয়ে দেখে ছোট প্যাডে নোট নেয়।

মৃত্যুর আপাত কারণ সম্পর্কিত প্রতিবেদন নিমিত্ত হসপিটালের ওয়ার্ড মাস্টারের ঘরে বসে, আত্মীয়দের ডাকেন কনক স্যার। কাছাকাছি আই ও দাঁড়িয়ে, খুবই ব্যস্ততার ভাব চোখে মুখে। মৃতার বাবা, শ্বশুর ও পঞ্চায়েত সদস্য আছেন । হাসপাতালের ভিড়ের মধ্যে কোন এক আড়ালে বসে অঝোরে কাঁদছে দুঃখিনী মা, সামলাচ্ছে পাড়ার এক পরিচিত মহিলা। শ্বশুর মশাইকে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানতে চাইলে, – হাত জোড় করে যা বললেন কাঁপা গলায়, তা আজকের সমাজ ব্যবস্থার বাস্তব করুণ কাহিনী। যার খুব সামান্য শতাংশ গোচরে আসে, বাকি সব ….। ছেলে থাকে সুদূর মালয়েশিয়াতে, কাজের শ্রমিক, সেখানে বছর দুই হল। বাড়িতে গরীবের সংসারে মা, বাবা, দুই বোন, তার স্ত্রী আর ছোট তিন বছরের মেয়ে, গরিবানা মত ছেলের পারিশ্রমিকের পয়সায় চলে। বেয়াই মশাই মেয়ের জন্য শুধু দু চোখ মুছে যায়। ইতিমধ্যে মৃতার ছোট মেয়েকে পাশের গ্রামের মামাবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গত রাতে বৌমা ছেলের সঙ্গে মোবাইলে অনেকক্ষণ কথা বলছিল। সবাই রাতে শুয়ে পড়ে। ইটের দেয়াল টালির ছাউনি তিনটে ঘর রান্নাঘর, মাঝারি পরিসরে তাদের ভদ্রাসন। সকাল হলে সবাই উঠে পড়ে, কিন্তু বৌমার ঘর ছিল বন্ধ। একটু পরে নাতনির কান্নার শব্দ শুনতে পেয়ে শাশুড়ি মায়ের একটু খটকা লাগলো। দরজায় ধাক্কা দিয়েও সাড়া না দেওয়ায় বাড়ির সকলকে ডাকলো। শেষে প্রতিবেশীরা এসে দরজার কপাট ভেঙে দেখলো এক মর্মান্তিক মৃত্যু। ঝুলন্ত মৃতদেহ। শিশুটি তখন মেঝেতে পড়ে কাঁদছে অসহায় ভাবে।

আই .ও.কে ডেকে কনক স্যার জিজ্ঞেস করে, এত দেরি করে আসার কারণ। তিনি সবাইকে একটু বাইরে যেতে বললেন। ইতি মধ্যে কনক স্যারের প্রতিবেদন সম্পূর্ণ হলে, মৃতার শ্বশুর, বাবা ও জনপ্রতিনিধির স্বাক্ষর সম্পন্ন হয়েছে ওই প্রতিবেদনের নির্দিষ্ট অংশে। আই.ও. তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে জানাল, – মৃত্যু হল একটা তরতাজা যুবতী বধূর, বাবা হারাল তার প্রিয় সন্তানকে, ছোট শিশুটি মা বলে আর কাউকে ডাকতে পারবে না, ওদিকে মা কাঁদছে আর জ্ঞান হারাচ্ছে বার বার। কিন্তু জীবন তো ফিরে আর আসবে না ! তাই সদস্যের মধ্যস্থতায় যাতে মামলা মোকদ্দমা না হয়, তাই আত্মীয় ও গ্রামের মাতব্বরদের নিয়ে একটা সালিশি হয়, দেরির কারণ সেইটা।

মৃতদেহের নিখুঁত বিবরণ সহ মৃত্যুর আপাত কারণ সম্বলিত প্রতিবেদন যাবে হসপিটাল সুপার ও সংশ্লিষ্ট থানার ওসি’র কাছে। তারপর ডাক্তার বাবু পোস্ট-মর্টেম (মৃত্যুর পরবর্তী) এক্সামিনেশন তৈরি করবে তাঁর নির্ধারিত পদ্ধতি মেনে। ওই পরীক্ষার প্রতিবেদন হাতে পেলেই মৃতদেহ স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু ও পরবর্তীতে মৃতদেহের সৎকার।

কনক স্যার প্রয়োজনীয় প্রতিবেদন প্রদান করলে সবাই চলে গেল পরের প্রক্রিয়ার জন্য। এখন কনক স্যার একলা। তাঁর মনটা কিন্তু চলে গেছে ছায়াময় এক গ্রামের এক গরীব খেটে খাওয়া মানুষের সংসারে। যেখানে সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত এক গৃহবধূ। অষ্টাদশী এক যুবতী বধূ তার ছোট মেয়েকে নিয়ে থাকে, স্বামী বিদেশে শ্রমিকের কাজ করে। তার রক্ত জল করা পয়সায় দিনাতিপাত হয়, জনা পাঁচেক সদস্যের সংসার। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে এই দৃশ্য। যতই কাজের মধ্যে থাকুক না কেন, মনটা পড়ে থাকে অন্যত্র। সেই মালয়েশিয়ার কোন এক ঝুপড়ি ঘরে অথবা অন্য কোথাও কিভাবে একটা মানুষ বছরের পর বছর পড়ে থাকে! একজন কম বয়সী বধূর স্বামী বিচ্ছেদের বিরহ ব্যথা বোঝে ক’জন ! তার মানসিক যন্ত্রণা কোন স্তরে গেলে এমন ভাবে জীবন বিসর্জন দিতে পারে! বীথিকা মণ্ডলের মৃতদেহ কনক স্যারের অনুভূতিতে এক ঝড় তোলে ! কত বীথিকার মৃত্যু হচ্ছে দিন দিন কেউ তার খবর রাখে না। দু-একটা মৃত্যু সামনে এলে প্রচলিত একটা প্রতিবেদন করলেই কী দায়িত্ব শেষ ! কী করুণ জীবন নিয়ে একটা শ্রেণি বেঁচে আছে। সমাজ ব্যবস্থা, সমাজবদ্ধ পরিবার,সম্পর্কের নিবিড় বাঁধন এই নিয়ে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে কনক মণ্ডলের মনে। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপট, প্রশাসন, রাজনীতি, দারিদ্র্য, শিক্ষা, ভালোবাসা স্নেহ, সমস্ত বিষয়গুলো যেন একটা ঘূর্ণি স্রোতের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে ঘুরছে !

তাঁর ভাবনার পটভূমি মুহূর্তে বদলে যায়। অজানা সেই গ্রাম হানিগঙ্গা, পো : ঝিকারা, থানা: গাইঘাটা । সেখানে যেন মৃত বীথিকা মণ্ডল আবার হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে , মেঠো পথ বেয়ে, তার ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে এসে বলছে মিষ্টি গলায়, – মা তুমি কোথায় গেলে ! এমন সময় চক্রধর ড্রাইভার এসে বলে, – স্যার অফিসে যাবেন না !
অদ্ভুত এক জগৎ থেকে কনক স্যার ফিরে আসে। থতমত খেয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলেন, – হ্যাঁ তো, চলুন চলুন। …. গাড়িতে চক্র ধর মনে মনে ভাবে, এ কোন স্যার! চোখ মুখে অন্য এক বিপন্নতা! কী হল স্যারের! এমন তো আগে হয়নি! অফিসের টেবিলে এসে, টিফিনের বক্সে হাত দিতে ইচ্ছে করলো না। এক গাদা ফাইল থাকলেও কাজে মন দিতে পারে না। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে, – বীথিকা মণ্ডলের মৃত মুখ যেন চৈত্রের পড়ন্ত সূর্যের মধ্যে মিলিয়ে যাচ্ছে,তার কপালের টিপ আর সিঁথির সিঁদুর সূর্যের লাল আভার লালিমার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।
হঠাৎ কনক স্যারের দু চোখ ভিজে গেল। গলার কাছে খুব কাছে এলেও মুখ ফুটে বেরিয়ে আসছে না, –
“নারীর হৃদয় – প্রেম – শিশু – গৃহ – নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয় —
আরো এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে খেলা করে ;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত — ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে সেই ক্লান্তি নাই ; “…

কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya

New Bengali Story 2023 | আশার আলো | সুভাষ নারায়ন বসু

New Bengali Story 2023 | তুতানের পৃথিবী | গল্পগুচ্ছ

New Bengali Story 2023 | সন্দেহের কাঁটা | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

Bengali Story 2023 | রূপান্তরের পথে | ডরাইয়া মরে

bengali story | short bengali story analysis | short bengali story characteristics | short bengali story competition | short bengali story definition | Best Bengali Story | Top Bengali Story | World Bengali Story | International Bengali Story | short bengali story english | writing competitions ireland | bengali story writing practice | bengali story writing topics | trending topics for article writing 2022 | bengali story trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Shabdodweep bengali story | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *