Bangla Novel Online – সুদীপ ঘোষাল – সূচিপত্র
আনবাড়ির আঙিনা – সুদীপ ঘোষাল
এক [Bangla Novel Online]
একদল বলাকার দল উড়ে এল রিমির মন মেঘে। তখন সে সাদা শাড়িতে সতের। দেহের সাগর ঘিরে উথাল-পাথাল ঢেউ। ঠিক সেই সময়ে নোঙর করে তার মনের তীরে পূর্ব প্রেমিক সমীরণের ছোঁয়ায় তার শিরশিরে পানসি নৌকার অনুভব। ধীরে ধীরে পালতোলা জাহাজের মত দুজনের প্রেম তরতরিয়ে এগিয়ে চলে। শত ঝিনুকের মুক্তোর সোহাগে দুজনেই রঙিন হয়ে উঠত।
চিন্তার রেশ কাটতেই বিপিন বলে উঠল, রিমি তুমি এত কী চিন্তা করছ?
— কিছু না।এমনি করেই কাটুক সময়।
— আমাদের বিয়ের পাঁচ বছরে একটা অনুষ্ঠান করলে হয় না?
— থাক ওসবে আর কী হবে? এই বেশ বসে আছি নদীর তীরে।
— তোমার অতীতের কথা বলো। আমি শুনব।
— কেন তোমার অতীত নেই
— আমার অতীত বর্তমান হয়ে রাজুর বউ হয়ে বসে আছে।
— ও, রাজুর বউ তোমার পূর্ব প্রেমিকা ছিল?
— হ্যাঁ ছিল একদিন। গ্রামের মন্ডপতলায় গেলেই মনে পড়ে বাল্যপ্রেম। কাঁসর ঘন্টা বাজত আরতির সময়। আমি ভালো কাঁসর বাজাতাম। আর তাছাড়া ওর মুখ দেখার লোভে ছুটে চলে যেতাম পুজোমন্ডপে। আরতির ফাঁকে দেখে নিত ওর চোখ আমাকে। তার চোখের নজর আমার দিকেই থাকত। সারাদিন তাকিয়ে থাকতাম ওদের বাড়ির দিকে। যদি একবারও দেখা যায় ওর মুখ। অসীম খিদে চোখে কেটে গেছে আমার।
— আমারও অতীতের ভালোবাসা সমীরণ, ভেসে গেছে অজানা স্রোতে।এসো আজ আমরা আবার নতুন মনে এক হই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথ চেয়ে।
— হ্যাঁ ঠিক বলেছো তুমি। পুরোনো ব্যথায় মলম লাগাব দুজনে দুজনকে।চলো আজ নৌকাবিহারে আমাদের বিবাহবার্ষিকী পালন করি।
— চলো। নব উদ্যমে এগিয়ে যাই আমরা নব সূর্যের আহ্বানে।
রিমি লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর ভক্ত।বিপিন পুণ্যদাস বাউলের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। কিন্তু দুজনে দুজনের পছন্দকে শ্রদ্ধা করে। রিমি বিপিনকে বলে তার প্রিয় লেখিকার কর্মজীবনের কথা,সাহিত্যের কথা। রিমি বলে, পুরুলিয়া,বাঁকুড়া,পশ্চিম মেদিনীপুরের শবর জনজাতির সঙ্গে মহাশ্বেতা জড়িয়ে ছিলেন আজীবন। তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছিল শবরাও। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ব্লকে লোধা শবর, বাঁকুড়া জেলার রানিবাঁধ, রাইপুর এবং পুরুলিয়ার তেরোটি ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী খেড়িয়া শবরদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষে কাজ করেছেন তিনি। এদের উন্নয়নে মহাশ্বেতার কর্মসূচি ছিল শিশুশিক্ষা, বয়স্কশিক্ষা, নারীশিক্ষা, শবরদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, তাদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করা এবং ব্রিটিশ যুগ থেকে শবরদের গায়ে লেগে থাকা ‘অপরাধপ্রবণ জনজাতি’র তকমা থেকে তাদের মুক্ত করা। বিপিন বলে, আমি পড়েছি, এজন্য আইনি লড়াইয়েও পিছপা হননি তিনি। ২০০৩ সালে এই শবরমাতা ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কারের ভূষিত হন। পুরস্কার মূল্যের দশ লক্ষ টাকা পুরোটাই তিনি দিয়েছেন এদের উন্নয়নার্থে। গ্রামে কোন সমস্যা হলেই তিনি সেইসব গ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে গেছেন।
রিমি আবার বলে, মহাশ্বেতার সাহিত্যিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল আরো অনেক বছর আগে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় পদ্মিনী ও যশোবন্তি গল্প দুটি লেখেন মহাশ্বেতা দেবী। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় মহাশ্বেতা দেবী গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ঝাঁসির রাণী, এই মধ্যপ্রদেশের লোককথা ও ইতিহাসের মিশেলে তৈরি। ষাট দশকের গোড়ায় অবিভক্ত বিহারে পালামৌ, হাজারিবাগ, সিংভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সেখানকার বেগার শ্রমিক প্রথা এবং জনজাতিদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে লেখেন ‘অপারেশন বসাই টুডু, অরণ্যের অধিকার এবং ‘চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর‘। ১৯৭৪ সালে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘হাজার চুরাশির মা‘ বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীতে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিভিন্ন বাংলা পাঠ্যপুস্তকও সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা। ১৯৭৯ সালে বাবা মণীশ ঘটকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা ‘ বর্তিকা’র দায়িত্ব নেন। ১৯৮৩ সালে পুরুলিয়ার অবহেলিত জনজাতিদের উন্নতির জন্য গড়ে তোলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি। তিনি তার বহু পুরস্কারের অর্থ দান করেন এই সমিতিকে।
দুই [Bangla Novel Online]
রিমির পাশের বাড়িতে রাজু আর রাজুর বউ প্রজ্ঞা থাকে। রিমি না থাকলেই বিপিন প্রজ্ঞার কাছে যায়, কথা বলে। বিপিন গান করে,”গোলেমালে, গোলেমালে পিরীত কোরো না”। প্রজ্ঞা বলে, খুব তো সাহস দেখাও।বিয়ের আগে তো কিছু বলতে পারোনি। এখন তো আমি পরের বউ গো। বিপিন বলে, অপরজনা এখন আমার আপনজন হয়ে বসে আছে। বিপিন অতীতের কথা বলে প্রজ্ঞাকে, যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ, ডিম, মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া, সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল, ডাল, মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল, ডাল, গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা, মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। ১৯৮০ সালের কথা এগুলি।এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর, গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিস্টার্ব হতো।
বিপিন বলে,এবার আসি কবিতার কথায়। নব্বই দশকের বাংলা কবিতার যে প্রধান বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ ছান্দিক কাঠামোর মধ্যে থেকে বিষয় ভিত্তিক কবিতা লেখা, বা বলা যায় ভাবপ্রধান বাংলা কবিতার এক প্রবর্ধন, তা শূন্য দশকে এসে বেশ খানিকটা বদলে যায়। আমরা লক্ষ্য করি লিরিক প্রধান বাংলা কবিতার শরীরে কোথাও একটা অস্বস্তি সূচিত হয়েছে। হয়ত নব্বই দশকের লেখা থেকে নিজেদের আলাদা করার তাগিদ থেকেই এই উত্তর। হয়ত সত্তর দশকের ছায়ায় লালিত বাংলা কবিতার পাঠাভ্যাস থেকে নিজেদের আলাদা করার এক সচেতন প্রচেষ্টা। যেখানে নব্বই দশকের সংকলন করতে গিয়ে সম্পাদক সে দশকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখেন প্রেম এর সঙ্গে এটিএম এর অন্ত্যমিল, সেখানে শূন্য দশকের সম্পাদককে ঘাঁটতে হবে নির্মাণের ইতিহাস। যেখানে নব্বই দশকের কবি খুঁজে বেড়িয়েছেন গল্প বলার ছান্দিক দক্ষতা, সেখানে শূন্য দশকের কবি খুঁজেছেন ভাষা প্রকরণ। হয়ত এর পিছনে কাজ করেছে এক গভীর সত্য যে কবিতা আর জনপ্রিয় হয় না। কবি আর চটুল মনোরঞ্জন করবেন না। আর এই কাজে শূন্য দশক অনেকাংশই তাদের শিকড় পেয়েছে আশির দশকের নতুন কবিতা আন্দোলনে। এছাড়া বাঙালীর দুর্গাপুজো এক ভালোলাগার দলিল। ঘুরে ঘুরে সারারাত কলকাতার ঠাকুর দেখা আর খাওয়াদাওয়া, ধুনুচি নাচের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে থাকুক অমলিন স্মৃতি।কুমোরপাড়ার খ্যাতি ছিল হাঁড়ি কলসি ও অন্যান্য নিত্যব্যবহার্য বাসনপত্র তৈরির জন্যই। এখানকার পুরনো অধিবাসীদের কথায় জানা যায়, বিশ শতকের গোড়ার দিকেও নাকি এখানে কিছু মাটির হাঁড়ি-কলসি নির্মাতার দেখা পাওয়া যেত। প্রথমে হাঁড়ি-কলসি, তার পরে ঘর সাজাবার পুতুল এবং একটা সময়ের পরে, যখন দুর্গাপুজো ক্রমে আমজনতার উৎসবে পরিণত হল, তখন থেকে ছোট্ট সেই কুমোর পাড়া রূপান্তরিত হয়ে উঠতে লাগল প্রতিমা নির্মাণের প্রধানতম কেন্দ্র, কুমোরটুলিতে।
তিন [Bangla Novel Online]
বাসস্টপেজেই অতনুর বাড়ি। সে বলে, রাত বাড়লে বাসস্ট্যান্ড একটা আমোদের জায়গা হয়ে যায়। অন্ধকারে শুয়ে থাকা কিশোরী থেকে বুড়ি ভিখারির পাশে শুয়ে পড়ে মাতালের দল। তারা তো জন্মনিয়ন্ত্রণের বড়ি খায় না। শুধু একগ্রাস ভাত জোগাড় করতেই তাদের দিন কেটে যায়। তারপর রাতচড়াদের বাজার। কেউ ওদের মালিক নয়। বাজারি মাল দরিয়া মে ঢাল। ঠিক এই পদ্ধতিতে পৃথিবীর আলো দেখেছিল অতনু। কে তার বাপ সে জানে না। আর জন্মদাত্রী ফেলে দিয়েছিল বাসের ছাদে। সেখানে শকুনের মত ওৎ পেতে থাকে হায়েনার মত ভয়ংকর অমানুষের দল। তারা অনাথ ছেলেমেয়েদের নিয়ে বড় করে। বড় হলে চুরি বা ভিক্ষা করে তারা যে টাকা আয় করে তার বৃহৎ অংশ নিয়ে নেয় হায়েনার দল। না খেতে পাওয়ার প্রবাহ চলতেই থাকে। এর থেকে মুক্তি পায় না অনাথ শিশুরা।
অতনু এখন বেশ স্মার্ট, বুদ্ধিমান। সে নিজের চেষ্টায় মেকানিকের কাজ শিখে নিয়েছে। মাথা উঁচু করে চলা ছেলেদের সকলেই সমীহ করে।
অতনু চুরি করে না, ভিক্ষাও করে না। সে বলে, হাত পা আছে। খেটে খাব। আর তোদের যা পাওনা মিটিয়ে দেব। সে বলে হায়েনার দলকে, বেশি ঘাঁটালে আমাকে, দেব শালা খালাস করে। আমার বাঁধন শক্ত বে। ওসব মাস্তানি তোর পকেটে রেখে দে।
যতই হোক শয়তানদের সাহস কিন্তু বেশি হয় না। অতনু একটা দল করেছে ছেলে মেয়েদের। সে বলে, শালা, কোন শালা রাতে খারাপ কাজ করতে এলে একসঙ্গে আ্যটাক করব। ওদের দৌড় বেশিদূর নয়। অতনু থাকতে আর অনাথের দল বাড়াতে দেব না বাসস্টপে। এই এলাকা এখন নতুন প্রজন্মের। ওরা আমাদের বড় করেছে তাই ওদের পাওনাটুকু দেব।
হায়েনার দল সাবধান হয়ে গেছে। এখন আর অনাথ বাচ্চা কম পায় এই স্থানে। অতনুর বিরুদ্ধে কাজ করে ওরা অনেকবার ঠকেছে।অতনুর দলবল দেখে ওরা অন্য জায়গায় ডেরা বাঁধে। অতনু সকলকে নিজের পরিবারের সদস্যের মত দেখে। এই পরিবারের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সুনীতা। সে পাশের পাড়ায় থাকে। অতনু তার আদর্শ। কিন্তু অতনুর বংশ পরিচয় নেই। তা না থাক তবু সে সমাজসেবী। অতনু দেখেছে মারামারি বা লড়াই করে জেতার থেকে ভালবাসার জোর বেশি। ভালোবেসে কথা বললে শয়তানও বশ হয়ে যায়। এখন সে একদম আনন্দে থাকে। এলাকার লোকজন তাকে ভালবাসে। সুনীতা ভাবে, অতনুদা এত বড় মন পেল কোথা থেকে। সকলের উপকারে ছুটে যায় অতনু। হাসপাতাল,শ্মশান যেখানে যার প্রয়োজন প্রথমেই ডাকে তাকে। সুনীতা ভাবে, সে কি অতনুর প্রেমে পড়েছে। সবসময় অতনুকে দেখতে পায় খাতায়, জলে, দেওয়ালে, আয়নায়। তবু অতনুকে বলতে সাহস হয় না। যদি রেগে যায়। যা ব্যক্তিত্ব ছেলেটার, শ্রদ্ধা হয়। সুনীতা সবসময় এখন এইসব ভাবে।
অতনু বলে তার বন্ধুকে, আমি তো অনাথ, বেজন্মা। ভদ্র সমাজে আমার স্থান হবে না। আমি কি চিরদিন এই বাসস্টপেজেই থেকে যাব?
আজ সুনীতা গ্রামের বাড়ি যাবে। সে পরিবারের সঙ্গে বাসস্টপে এসেছে ব্যাগ-পত্তর নিয়ে। সুনীতাকে দেখে অতনু কাছে এল। অতনুর মা বললেন, সুনীতার মুখে তোমার কথা শুনেছি। আজকে তোমাকে ছাড়ছি না। আমাদের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি পুজো দেখতে চল। অতনু বলল,আমি অনাথ পুজোবাড়িতে আমার স্থান হবে? সুনীতার মা বললেন, কে বললো তুমি অনাথ। তুমি আমাদের পরিবারের একজন হলে। আমরা আছি, চল। অতনু তার সঙ্গীদের বললো, আমি পুজোয় গ্রামে যাচ্ছি। তোরা সাবধানে থাকিস।
গ্রামের পুজোবাড়িতে আরতির বাজনা বাজছে। ধুনোর গন্ধে পুজোবাড়ি মাতোয়ারা। আর একটু পরেই ধুনুচি নাচ শুরু হবে। সুনীতা ধুনুচি নাচ নাচছে। ধুনোর গন্ধে অতনু খুশি। একটা শিহরণ তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। সুনীতার চোখ তার দিকে। সুনীতার মা অতনুকে হাত নেড়ে হাসিমুখে ডাকছেন। সুনীতার মায়ের মুখটা ঠিক দুর্গা প্রতিমার মত। তার চোখের দিকে তাকিয়ে অতনু এই প্রথম বলে উঠলো, মা, মা গো…।
চার [Bangla Novel Online]
রাজুকে বিপিন তার বাড়ি নিয়ে আসে,গল্পগুজব করে।সে বলে,তোমার যখন ইচ্ছে হবে আমার বাড়ি আসবে। এবার পুজোয় আমরা আবাডাঙা যাব।বিপিন বলে,শুনেছি ওখানে পটের ঠাকুর পূজিত হন।রাজু বলে,হ্যাঁ।দেখতে দেখতে পুজো এসে গেল।রাজু বিপিনকে নিয়ে এল আবাডাঙা।সে বলল,বীরভূমের আবাডাঙা গ্রামে বাড়ুজ্জে পরিবারের পটের পুজো বিখ্যাত। পটের দুর্গা, পটের লক্ষ্মী, পটের কার্তিক নানা জায়গায় পূজিত হন। পাটের থিম “পট ও পুতুল এর মাঝে এস-ই-ও” মূলত প্রতিটি জেলার হস্তশিল্পের তাদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। থিমটি প্রথমবারের মতো বাংলার ২৩টি জেলার প্রতিটি হস্তশিল্পের সারমর্ম। সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক এই ঐতিহ্যকেই মূলত তুলে ধরতেই চেয়েছে এসইও। এসইও র এই উদযাপন শুধু বাসিন্দাদের জন্যই নয়। ঘরের মেয়ের এই আগমন উৎসব সমস্ত দর্শকদের উপভোগের জন্যও সমান খোলা থাকে। ভাস্করশিল্পী প্রদীপ রুদ্র পালের হাতে এবার তৈরি হচ্ছে তাদের মাতৃমূর্তি। দূরদূরান্ত থেকে লোক ছুটে আসে সিলভার ওকের এমন নির্মল ও কল্যাণময় মাতৃমূর্তি দেখতে। সারল্যই এই মূর্তির বৈশিষ্ট্য। মা পরে থাকেন সুতির শাড়ী। সহজ সরল গ্রাম্য মেয়ের সাজে সেজে ওঠেন ওখানে মা। সঞ্জায় দাসের সৃজনশীল নির্দেশনায় এবার সেজে উঠছে সিলভার ওকের মন্ডল। আলোকসজ্জা করছেন এবারে বিশ্বজিৎ সরকার। প্যান্ডেল ডিজাইনের দায়িত্বে আছেন সুরজিৎ সেন।
পূজার সময় একাধিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে এবার। তাদের মধ্যে প্রথম হলো আনন্দমেলা উৎসব এই উৎসবে বাড়ির শেফরা তাদের রান্নার দক্ষতা প্রদর্শন করবেন। দ্বিতীয়ত আবাসিকদের জন্য থাকছে ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন, যেখানে নাটক, আবৃত্তি, নাচ, গান প্রভৃতি পরিবেশন করতে পারবেন ৮ থেকে ৮০ সকলে তৃতীয়ত স্বনামধন্য গায়ক অনীক ধর ও উর্মি চৌধুরী আসছেন এই পুজোয় গান গাইতে। চতুর্থত থাকছে মহাভোজ। এই চারদিন আবাসিকরা মণ্ডপেই পুজোর ভোগ খাবেন। আর খাওয়া দেওয়ার সাথেই চলতে থাকবে আড্ডা।
পাঁচ [Bangla Novel Online]
ভগ্নপ্রায় মন্দিরেই পুজো পান দেবী পটেশ্বরী। বর্ধমান রাজবাড়িতে যখন রাজা রাজত্ব করতেন তখন সাড়ম্বরে পূজা পেতেন দেবেন পটেশ্বরী। কিন্তু এখন সেই পুজোর জৌলুস খানিকটা মলিন হয়েছে। অতীতে বহু মানুষ এই পুজো দেখতে ভিড় জমাতেন। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ আসত এই বাড়ির পুজো দেখতে। বর্ধমান রাজার তৈরি লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ ঠাকুরের বাড়িতে পুজো হতো। এই পুজোতে বাড়ির মহিলারা কখনই সবার সামনে আসতেন না। গোপন রাস্তা দিতে তাঁরা মন্দিরে আসতেন এবং সেখানকার দ্বিতলে বসে পুজো দেখতে। পুজোটা আজও হয়। কিন্তু যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মন্দির প্রায় ভেঙে গিয়েছে। গত দুই বছর করোনার কারণে জনসাধারণ এই বাড়িতে প্রবেশ করতে পারেনি।
রাজবাড়ি তার জৌলুস হারালেও পুজোর রীতি নীতি, জৌলুস কোনওটাই কমেনি আজও। অতীতের নিয়ম মেনেই পূজিত হন দেবী পটেশ্বরী। প্রতিপদ থেকে এই পুজো শুরু হয়ে যায়। এই পুজো নাকি বর্ধমানের রাজা মহাতাব চাঁদ শুরু করেছিলেন। কাঠের পটের উপর নানান রঙ দিয়ে আঁকা হতো দশভূজাকে। এখানে কেবল গণেশের দুটি চোখ দেখা যায়। বাকি সকলেরই দেখা যায় একটি করে চোখ। এমন ভাবেই আঁকা হয় এই পট। এই বাড়িতে আজও আছে বলি প্রথা। তবে পাঁঠা নয়, বলি হয় মিষ্টির। আগে অবশ্য কুমড়ো বলি হতো। নবকুমারীর পুজোও হয় এই বাড়িতে অষ্টমীর দিন।সমীরণ বলে,বীরভূমের পট নিয়ে প্রচুর কিছু লেখা না হলেও কিছু মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। যাদু পটুয়াদের কথা লিখেছেনও ’ম্যালি, গৌরীহর মিত্র প্রমুখ। এই পটুয়াদের সঙ্গে হাট সেরান্দির পটশিল্পীদের পার্থক্য রয়েছে।এখানকার পটশিল্পীরা সূত্রধর সম্প্রদায়ের। পটের সঙ্গে গান এঁরা করেন না। কেবলমাত্র দুর্গার পট আঁকা/লেখা ছাড়া অন্য পটও করেন না। সে দিক থেকে অন্যান্য পটুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই পটশিল্পীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু শোনা যায়, হাট সেরান্দির সূত্রধর শিল্পীদের পূর্বপুরুষ রাজারাম এসেছিলেন অজয়পাড়ের ভেদিয়া থেকে। তিনিও পটের শিল্পী ছিলেন। ভেদিয়া নামটির উৎস কেউ কেউ‘বেদিয়া’ বলে গণ্য করা হয়। বেদিয়াদের মধ্যে পটশিল্পীদের গোষ্ঠী রয়েছে। আসলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি একটি অন্যটির সঙ্গে কোথাও না কোথাও জুড়ে রয়েছে। এই যোগসূত্রগুলি খুঁজে দেখা দরকার। যাই হোক, বর্তমানে আমরা সূত্রধর শিল্পীদের মধ্যে পট আঁকার প্রায় দুশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস পাচ্ছি। রামকৃষ্ণ সূত্রধরের পিতা আদরগোপাল, তাঁর পিতা কালীপদ, কালীপদের পিতা শিবরাম, শিবরামের পূর্বে দ্বারিকানাথ, তদূর্ধ্ব রাজারাম। এ ভাবেই পারিবারিক ইতিহাস বাহিত হয়েছে। সূত্রধরদের মধ্যে প্রবীণ মানিকচাঁদ গুণী শিল্পী। এই সম্প্রদায়ের বাইরে রয়েছেন রত্নাকর মেটে। পটশিল্পের ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলা।
ছয় [Bangla Novel Online]
গ্রামের অত্যন্ত গুণী, প্রায় কিংবদন্তীপ্রতীম শিল্পী ছিলেন কালীপদ সূত্রধর। তিনি চোখে ভাল দেখতে পেতেন না। কিন্তু অল্প সময়ে নিপুণ দক্ষতায় একের পর এক পট আঁকতেন। এই কালীপদ একদিন লোক সংস্কৃতি গবেষক সুধীর চক্রবর্তীকে তাঁর আক্ষেপের কথা শুনিয়েছিলেন। দুঃখ করেছিলেন শিল্প এবং শিল্পীর ক্রম ক্ষয়িষ্ণু অবস্থানের কারণে। তাঁর সেই আক্ষেপ এখনও হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি। তা অনুভব করা যায় তাঁর নাতি বর্তমান প্রজন্মের শিল্পী রামকৃষ্ণ সূত্রধরের আক্ষেপের মধ্য দিয়ে। চল্লিশ ছুঁই ছুঁই রামকৃষ্ণ এগারো ক্লাসের পর ইলেক্ট্রনিক্সের কাজ করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু শিল্পের টান ভুলতে পারেননি। বাবার সঙ্গে থেকে থেকে তাঁর পটশিল্প শিক্ষা। বর্তমানে সংসার চালানোর জন্য টোটো চালাতে হয় তাঁকে।পটশিল্প ও পটের পুজো ফিরে এলে মানুষ ও পরিবেশ বাঁচবে।
বিপিন বলে,ছোটবেলা থেকেই আমার লেখালেখির অভ্যাস। কিন্তু লেখাগুলি লুকোনো থাকত পড়ার বইয়ের দেরাজে । মা যে সব লক্ষ্য করেন, আমার জানা ছিল না। একদিন বিকেলবেলায় ছাদে মা আর আমি বসে আছি। মাইকে ভেসে আসছে রবীন্দ্র সংগীতের সুর। তারপর ঘোষণা করলেন ঘোষক, এবার স্বরচিত কবিতা পাঠ করবেন স্বনামধন্য কবি অলোকরঞ্জন। নাম শুনে আমার আনন্দ আর ধরে না। তবু লজ্জা আগলে রেখেছে আমাকে। মা বললেন, যা বড় কবিরা এসেছেন। দেখে আয়, এ সুযোগে একটা কবিতা পাঠের সুযোগ পেতে পারিস তো বেশ হয়। যা ওঠ, বসে থাকিস না, কবিতা পাঠের চেষ্টা না করলে লেখাগুলো লুকোনোই থেকে যাবে।
মায়ের কথা শুনে আমি বললাম,আমি পারব তো, সুযোগ পাব তো?
মা বললেন, আমার আশীর্বাদ তোর সঙ্গে রইলো, যা আর দেরী করিস না।
আমি মায়ের কথা শুনে একটা কবিতার খাতা নিয়ে দৌড় দিলাম চুম্বকের আকর্ষণে।
মায়ের আশীর্বাদ সত্য হয়েছিলো সেদিন। আমার প্রথম কবিতাপাঠের সুযোগ সেদিন হয়েছিলো। তারপর থেকে বই পড়া আর লেখার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল মহান কবি আর মায়ের করুণাময় পরশে।
সাত [Bangla Novel Online]
রিমি ও বিপিন কাটোয়ার গৌরাঙ্গপাড়ায় থাকে। রিমি বলে, ভক্তিসাগরের শিরোমণি, মহাপ্রাণ ও আপামর বাঙালীর প্রিয়গুরু ও সমাজসংস্কারক শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন প্রাজ্ঞ পন্ডিত। আমি সৌভাগ্যবান যে, তৎকালীন কন্টকনগরী বা অধুনা কাটোয়ায় বাস করি, যে শহরটি, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান-নদিয়া জেলার নবদ্বীপধামের কাছাকাছি। কাটোয়ায় মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস নেওয়ার পূর্বে মস্তকমুন্ডন করেন। বিপিন বলে,সন্ন্যাস নেওয়ার সময় যে পাকুড় গাছের তলায় তিনি ক্ষৌর কর্ম বলেছিলেন তা আজও দেখা যায় কাটোয়া গৌরাঙ্গ মন্দিরে৷ দেখা যায় মহাপ্রভুর কেশ – সমাধিও৷ জগাই-মাধাই খ্যাত মাধাইয়ের সাধনাক্ষেত্রও চোখে পড়ে কাটোয়া শহরে৷
রিমি ও বিপিন আজ কাটোয়ায় ঘুরল নতুন করে। রিমি বলে, এখানে আছে, শ্রীগৌরাঙ্গ মন্দির, মাধাই তলা আশ্রম, শ্রী রাধাকান্তদেব মন্দির, নিচুবাজারে, গৌরাঙ্গমন্দির, কাঙাল গৌরমন্দির, মহাপ্রভু বা গৌরাঙ্গ মন্দির, একলা নিতাই মন্দির, রাধাকান্ত মন্দির, তমাল তলা রাধাগোবিন্দ মন্দির, ষড়ভূজা মন্দির। গৌরাঙ্গ মন্দিরের পাশে আছে বিশাল পাকুড় গাছ, যার তলায় বসে মহাপ্রভুর মস্তকমুন্ডন হয়েছিল। এই স্থানটি অত্যন্ত পবিত্র, গদাধর দাসের সমাধির জন্য । ভিতরে ঢুকে পশ্চিম দিকে সৌদামিনী তীর্থ নিবাস ডান দিকে তুলসী মঞ্চ। মন্দিরের সন্নিকটে রয়েছে মহাপ্রভু ও কেশব ভারতীর পদচ্ছাপ। কাটোয়া শহরের মূল আকর্ষণ বলা যায় গৌরাঙ্গ মন্দির৷ কাটোয়া নিচু বাজারের কাছে গৌরাঙ্গপাড়ার শেষ প্রান্তে অবস্থান করছে এই গৌরাঙ্গ মন্দির৷ ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করা হয় এই মন্দির৷ মন্দির নির্মাণ করেন গদাধর দাস৷ গদাধর দাস ছিলেন গৌরাঙ্গের ভজন -সঙ্গী ও অনুচর৷ ৯১৫ বঙ্গাব্দে যখন গঙ্গা পেরিয়ে এই কাটোয়া বা কণ্টকনগরীতে এসে পণ্ডিত কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস নিয়েছিলেন গৌরাঙ্গ মহাপ্রভু। মহাপ্রভুর সঙ্গে জীবনের বেশ কিছুটা সময় কাটান গদাধর৷ তিনি ছিলেন মহাপ্রভুর লীলা – সঙ্গী ও অভিন্ন হৃদয় বন্ধু৷ সন্ন্যাস গ্রহণের পর মহাপ্রভু পুরীধামে গমন করলে তাঁর সঙ্গী হন গদাধরও৷ শ্রীচৈতন্য নীলাচলে লীন হবার পরে তিনি ফিরে আসেন নবদ্বীপে৷বিপিন বলে,মহাপ্রভু সংসার ছেড়ে কত কষ্ট সহ্য করে আমাদের মুক্তির উপায় বলেছেন।বিপিন রিমিকে শোনায় মহাপ্রাজ্ঞ গৌরাঙ্গলীলর কাহিনী।সে বলে,চৈতন্যদেবের পিতৃদত্ত নাম ছিল বিশ্বম্ভর মিশ্র। প্রথম যৌবনে তিনি ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত। তর্কশাস্ত্রে নবদ্বীপের নিমাই পণ্ডিতের খ্যাতি ছিল অবিসংবাদিত। জপ ও কৃষ্ণের নাম কীর্তনের প্রতি তাঁর আকর্ষণ যে ছেলেবেলা থেকেই বজায় ছিল, তা জানা যায় তাঁর জীবনের নানা কাহিনী থেকে। কিন্তু তাঁর প্রধান আগ্রহের বিষয় ছিল সংস্কৃত গ্রন্থাদি পাঠ ও জ্ঞানার্জন। পিতার মৃত্যুর পর গয়ায় পিণ্ডদান করতে গিয়ে নিমাই তাঁর গুরু ঈশ্বরপুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বরপুরীর নিকট তিনি গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এই ঘটনা নিমাইয়ের পরবর্তী জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। বাংলায় প্রত্যাবর্তন করার পর পণ্ডিত থেকে ভক্ত রূপে তাঁর অপ্রত্যাশিত মন পরিবর্তন দেখে অদ্বৈত আচার্যের নেতৃত্বাধীন স্থানীয় বৈষ্ণব সমাজ আশ্চর্য হয়ে যান। অনতিবিলম্বে নিমাই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন।নীলাম্বর চক্রবর্তী শচীদেবীর পিতা। মস্ত পণ্ডিত তো বটেই জ্যোতিষ শাস্ত্রেও তাঁর খ্যাতি কম নয় । দৌহিত্রের জন্ম – সংবাদ পেয়েই তিনি নবজাতকের ভাগ্য গণনায় বসে গেলেন। গণনা শেষে বললেন, এ জাতকের কোষ্ঠী অপূর্ব। এ শুধু অসামান্য মনীষী ও বিদ্যার অধিকারী হবে না, ধর্মজগতের এক মস্তবড় নেতা হবে। বহু লোক দেবতা জ্ঞানে তাঁকে পুজো করবে।
দাদামহাশয়ের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছিল । নিমাই শুধু অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হননি, ধর্মজগতে এনেছিলেন এক বিরাট বিপ্লব। সমাজের ও ধর্মজীবনের কলুষ দূর করবার জন্যে দেশে ভক্তির বন্যা বইয়ে দেবার জন্যে তাঁর আবির্ভাব ঘটেছিল। এই জন্যে তাকে বলা হয় যুগাবতার। জগন্নাথ মিশ্রের প্রথম ছেলের নাম বিশ্বরূপ । পরপর কয়েকটি ছেলে – মেয়ের মৃত্যুর পর এই ছেলের জন্ম। মা শচীদেবী তাই নবজাতকের নাম রাখলেন নিমাই। কোষ্ঠীর নাম ‘বিশ্বম্ভর’। ভুবন ভোলানো রূপ নিমাইয়ের। একবার দেখলে চোখ ফেরানো কঠিন। বাপ–মায়ের তো বটেই, পাড়া–পড়শীদেরও সে নয়নের মণি। দিনে দিনে বাড়ে চাঁদের কলার মত। শচীমার বুকের ধন, চোখের মণি আঙিনায় খেলা করে। মা যশোদা যেমন তাঁর নয়নমণি শ্রীকৃষ্ণকে সাজাতেন তেমনি ক’রে শচীমাতাও সাজিয়ে দেন নিমাইকে । চঞ্চল অস্থির শিশু কারও কথা শোনে না। লেখাপড়ায় তার এতটুকুও মন নেই। সারাদিন, শুধু খেলা করে আর নেচে বেড়ায়।
পাঁচ বছরে নিমাইয়ের হাতে খড়ি হলো। হাতে খড়ির দিন দেখা গেল, বালকের মেধা ও প্রতিভা দুই–ই বিস্ময়কর। বিদ্যালয়ের পাঠ অনায়াসেই সে আয়ত্ত করে। পুত্র গৌরবে মায়ের মন খুশিতে ভরে ওঠে। নিমাইয়ের বয়স যখন প্রায় সাত বছর, তখন তার বড় ভাই বিশ্বরূপ ষোল বছর বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে সংসার ছেড়ে চলে যান। জগন্নাথ মিশ্র ভেঙ্গে পড়েন। চোখের জলে বুক ভাসাতে থাকেন শচীমা। নিমাই বলেনঃ “কেঁদো না মা। দাদা সন্ন্যাসী হয়েছেন কিন্তু আমি তো আছি। আমি তোমাদের দেখব।” পাছে বড় ছেলের মত নিমাইও লেখাপড়া শিখে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসী হয়ে চলে যায় এই ভয়ে জগন্নাথ মিশ্র নিমাইয়ের লেখাপড়া বন্ধ ক’রে দিলেন। কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ করে দেওয়াতে বালক নিমাই এক দুরন্ত বালকে পরিণত হলেন। তাঁর অত্যাচারে ও দুরন্তপনায় নবদ্বীপের সকলেই অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। সাত বছরের ছেলে নিমাই কখনও কলাবাগান থেকে পাকা কলা চুরি করে খান, কখনও বা গঙ্গার জল তোলপাড় করে সাঁতার কাটেন।
১৬ বৎসর বয়সে তিনি অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময় তিনি লক্ষ্মীপ্রিয়াকে বিবাহ করেন। এরপর তিনি তাঁর পিতৃভূমি সিলেটে গিয়ে কিছুদিন কাটিয়ে আবার নদীয়ায় ফিরে আসেন। নদীয়ায় ফিরে এসে তিনি দেখেন যে, তাঁর স্ত্রী লক্ষ্মীপ্রিয়া সর্প-দংশনে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই সময় তিনি কিছুটা উদাসী জীবনযাপন করা শুরু করেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে, তিনি বিষ্ণুপ্রিয়া নামক একটি সুন্দরী কন্যার সাথে তাঁর বিবাহ দেন। এরপর তাঁর পিতার মৃত্যু হলে, তিনি গয়ায় পিণ্ডদান করতে যান। এই সময় তিনি পণ্ডিত ঈশ্বর পুরীর সাক্ষাৎ পান। ঈশ্বরপুরীর জ্ঞানে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁর কাছে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্রে দীক্ষিত হন। এরপর তিনি ধ্যানের দ্বারা কৃষ্ণকে পাওয়ার সাধনা করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি এক নতুন মানুষ হয়ে নদীয়ায় ফিরে আসেন। তাঁর দর্শন, জ্ঞান এবং আচরণের দ্বারা অচিরেই নদিয়ার বৈষ্ণব সমাজের এক অগ্রণী নেতায় পরিণত হন। তিনি অবতার ছিলেন। তখন শাসক ছিলেন হুসেন শাহ্। তাঁর কাছে শ্রীচৈতন্যের নামে অনেক অভিযোগ জমা পড়লো। হুসেন শাহ্ শ্রীচৈতন্যদেবকে ডেকে পাঠালেন। তাঁর আচার আচরণ ব্যবহারে হুসেন শাহ্ চমৎকৃত হলেন। কি এক অদ্ভুত ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হলেন হুসেন শাহ্। এমন এক সময়ে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব যে সময়ে হিন্দুরা তাদের নিজস্ব ধর্ম ছেড়ে মুসলিম ধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়েছিলো। সেই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব। তাঁর কাছে দলে দলে মানুষ ভালোবাসার আকর্ষণে আসতে শুরু করলো। সমসাময়িক আগমবাগীশ একদিন ভোরবেলা উঠে মা-কালীর রূপ প্রত্যক্ষ করলেন। তাঁর কল্পিত রূপেই আজও কালীপূজা হয়ে থাকে। তখন দক্ষিণ ভারতে রামানুজ ছিলেন মহাপ্রাণ পন্ডিত ও সমাজসংস্কারক।
শ্রীচৈতন্যদেব প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে মিশতেন। তাঁর প্রবর্তিত ধর্মে মানুষ দলে দলে যোগদান করতে শুরু করলেন।যবন হরিদাস তাঁর অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন। বেশ কিছু আগে থেকেই অদ্বৈতাচার্য, যবন হরিদাস এবং শ্রীবাস পণ্ডিত প্রমুখের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় একটি বৈষ্ণব গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল। চৈতন্যদেব দেশে ফিরে এই বৈষ্ণব গোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ অনুরক্ত হয়ে ওঠেন এবং ধীরে ধীরে তিনি এই গোষ্ঠীর একজন অন্যতম সদস্য হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি প্রখ্যাত বৈষ্ণব সাধক গোস্বামী’র কাছে দীক্ষা নেন।কেশব ভারতীর নিকট সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হওয়ার পর নিমাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নাম গ্রহণ করেন। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মভূমি বাংলা ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করেন। এই সময় তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করতেন। জীবনের শেষ চব্বিশ বছর তিনি অতিবাহিত করেন জগন্নাথধাম পুরীতে। ওড়িশার সূর্যবংশীয় হিন্দু সম্রাট গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেব চৈতন্য মহাপ্রভুকে কৃষ্ণের সাক্ষাৎ অবতার মনে করতেন। মহারাজা প্রতাপরুদ্র চৈতন্যদেব ও তাঁর সংকীর্তন দলের পৃষ্ঠপোষকে পরিণত হয়েছিলেন। ভক্তদের মতে, জীবনের শেষ পর্বে চৈতন্যদেব ভক্তিরসে আপ্লুত হয়ে হরিনাম সংকীর্তন করতেন এবং অধিকাংশ সময়েই ভাবসমাধিস্থ থাকতেন।ষোড়শ শতাব্দীর বিশিষ্ট বৈষ্ণব ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক। তিনি অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাকে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য ছিলেন ভাগবত পুরাণ ও ভগবদগীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের একজন বিশিষ্ট প্রবক্তা। তিনি বিশেষত রাধা ও কৃষ্ণ রূপে পরম সত্ত্বার পূজা প্রচার করেন এবং জাতিবর্ণ নির্বিশেষে আচণ্ডাল-ব্রাহ্মণের কাছে হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রটি জনপ্রিয় করে তোলেন। এটি হল,
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
এরপর তিনি ২৪ বৎসর বয়সে কেশব ভারতী নামক অপর এক সাধকের কাছে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। দীক্ষিত হওয়ার পর তাঁর নাম হয় নিমাই শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য। সন্ন্যাস গ্রহণের পর তিনি জন্মস্থান ত্যাগ করে কয়েক বছর ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান পর্যটন করে পুরীতে আসেন। এখানে তিনি অবিরত কৃষ্ণনাম জপ করে কাটাতেন। এখানে তিনি দুই বৎসর বাস করার পর নদীয়া ফিরে আসেন। এরপর তিনি মায়ের কাছে অনুমতি নিয়ে, তিনি বারাণসী, প্রয়াগ, মথুরা ও বৃন্দাবন দর্শন করেন। অবশেষ তিনি পুনরায় পুরীতে চলে যান এবং সেখানেই অবশিষ্ট জীবন কাটিয়ে দেন।
রিমি কাহিনী শুনতে শুনতে বিহ্বল হয়ে পড়ল।চোখের জল মুছে তারা আশ্রমে খেল।তারপর আবার পাখির নীড়ে ফেরার মত ঘরে ফিরল।
আট [Bangla Novel Online]
রিমি ও বিপিন সকালে উঠে ঠিক করল অবধূতের জন্মদিনে উদ্ধারণপুর ঘুরে আসবে। বিপিনও রাজী।বিপিন ও রিমি শাঁখাই ঘাটে এলো নৌকা করে।তারপর টোটো ধরে চলে এলো উদ্ধারণপুর। সেখানে পৌঁছে শুনল এক কবির কথা। তিনি বললেন, অবধূতের প্রকৃত নাম দুলালচন্দ্র মুখার্জি। একাধারে, বিপ্লবী, সাহিত্যিক ও সাধক।
রিমি বলল, কাটোয়া থেকে নৌকায় পার হয়ে শাঁখাইঘাট ,সেখান থেকে উদ্ধারণপুর এলাম টোটো ভাড়া করে।অবধূতের মূর্তিতে মালা পরানো হয় তাঁর জন্মদিনে।আমি উপস্থিত থেকেছি তাঁর জন্মদিনে আরও অনেক গুণী মানুষের সঙ্গে।কবি বললেন,আসবেন নিশ্চয়ই আসবেন।শুনবেন তাঁর কাহিনী। রিমি ও বিপিন, শুনব আমরা, আপনি বলুন। মহাশ্মশানের পাশে গঙ্গার ঘাটে সকলে বসলেন।তারপর কবি শুরু করলেন অবধূতের জীবনের গল্প। তিনি বললেন, অবধূত বিপ্লবী ছিলেন। বর্ষার পদ্মা, সে ভয়ানক উত্তাল। ওই সময়ে নদী পেরোনো মানে নিশ্চিত মৃত্যুকে ছুঁয়ে আসা। এ দিকে অন্য পথও নেই, পিছনে পুলিশ। তাদের হাতে ধরা পড়া মৃত্যুর চেয়েও খারাপ। অগত্যা জলে ঝাঁপ দিলেন দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। পাড় থেকে ক্রমাগত ফায়ার করতে থাকল ব্রিটিশ পুলিশ। কিন্তু নাগাল পাওয়া গেল না। কিছু দিন তল্লাশি চালিয়ে পুলিশও রণে ভঙ্গ দিল। ধরে নেওয়া হল, তিনি মৃত। অথচ কোনও দেহ পাওয়া যায়নি। সে সময়ে বাংলাদেশে যে বন্ধুর আশ্রয়ে তিনি ছিলেন, সেই বৃন্দাবনচন্দ্র দাস রটিয়ে দিলেন দুলালচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পরিবারের সকলেও ধরে নেন, তিনি মৃত। এর পর ফাস্ট ফরওয়ার্ডে ঘটনা প্রায় ২২ বছর এগিয়ে যাচ্ছে। যখন পরিবারের লোকেরা লালচন্দ্রের খোঁজ পেলেন, তখন তিনি কালিকানন্দ অবধূত। মাঝের দু’দশকে ঘটে গিয়েছে। অবধূত ছদ্মনামে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে মরুতীর্থ হিংলাজ নামক উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন। এই উপন্যাসটি অবলম্বনে একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়।
হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য তার সম্পর্কে লিখেছেন, “উদ্ভট কাহিনী-কল্পনা, বীভৎস রস, তান্ত্রিক ধর্মসাধনার গুহ্য রহস্য ও উৎকট যৌনাচার অবধূতের রচনার বৈশিষ্ট্য, – শক্তিমত্তা সত্ত্বেও শিথিল বিন্যাস ও যৌনতার আধিক্য ত্রুটিরূপে গণ্য।” শিশিরকুমার দাশের মতে, “তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য ভয়াবহ ও বীভৎস রসের আধিক্য। প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোনো কোনো সমালোচক তাঁর বিষয় নির্বাচন ও প্রয়োগরীতির প্রতি সংশয়ী ছিলেন।
অবধূত রচিত উপন্যাসগুলি হল মরুতীর্থ হিংলাজ (জুলাই, ১৯৫৪), হিংলাজের পরে, বশীকরণ, তাহার দুই তারা (১৯৫৯), ক্রীম (১৯৬০) পিয়ারী (জুলাই, ১৯৬১)বহুব্রীহি ভোরের গোধূলি টপ্পা ঠুংরী (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ) ভূমিকা লিপি পূর্ববৎ, কান পেতে রই, তুমি ভুল করেছিলে, অনাহত আহুতি, স্বামীঘাতিনী, ফক্করতন্ত্রম্ (১ম, ২য় ও ৩য় পর্ব) দুর্গম পন্থা (১৩৬৮ বঙ্গাব্দ), নীলকণ্ঠ হিমালয়, মন মানে না, সাচ্চা দরবার, উত্তর রাম চরিত, সুমেরু কুমেরু, একটি মেয়ের আত্মকাহিনী।বাবা অনাথনাথ মুখোপাধ্যায় অবিভক্ত বাংলাদেশের বরিশাল থেকে কলকাতা আসেন প্রথম মহাযুদ্ধের আগে। চাকুরি সূত্রে ছিলেন রেলি ব্রাদার্সের বড়বাবু। বিয়ে হলো কলকাতা বাগবাজারের প্রভাবতী দেবীর সঙ্গে। থাকতেন কলকাতার হাতিবাগানে। এই হাতিবাগানেই ১৯১০-এর ২ রা নভেম্বর কালীপুজোর পরের দিন দুলালের জন্ম। তাঁরা ছিলেন ৬ বোন, ২ ভাই। ছোট ভাই মৃণালকান্তি।
দুলালের শিক্ষাজীবন অজানা। তবে পারিবারিক সূত্রে শোনা যায়, তিনি গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। ১৯৩০-এ কলকাতা পোর্ট কমিশনের অফিসে স্টোর কিপার হোন দুলাল মুখোপাধ্যায়। হুগলির রিষড়ার সুখময়ী বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়। একমাত্র সন্তান অমলের জন্মের ৬ মাস পরেই সূতিকায় আক্রান্ত হোন সুখময়ী। আরও ৬ মাস রোগভোগের পর মারা গেলেন সুখময়ী। স্ত্রীর মৃত্যুতে প্রচণ্ড আঘাত পান দুলাল। ওদিকে পোর্ট কমিশনে “রেবতীমোহন মুখোপাধ্যায়” নাম নিয়ে পিস্তল খালাস করে বিপ্লবীদের দিতেন তিনি। জানাজানি হতেই ছেলেকে ফেলেই পালালেন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুরে বন্ধু বৃন্দাবনচন্দ্র দাসের কাছে। সেখানেও একদিন পিছু ধাওয়া করলো ব্রিটিশ পুলিশ। পুলিশের তাড়ায় এক বর্ষায় উত্তাল পদ্মায় ঝাঁপ দিলেন নিশ্চিত মৃত্যুকে উপেক্ষা করেই। পাড়ে দাঁড়িয়ে গুলি ছুঁড়তে লাগলো পুলিশ। কিন্তু কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না দুলালকে। আশ্রয়দাতা বন্ধু বৃন্দাবনচন্দ্র জানিয়ে দিলেন, দুলাল মারা গেছে। আর সত্যিই তো, বর্ষার দুরন্ত পদ্মায় ঝাঁপ দিয়ে কি আদৌও বাঁচা সম্ভব!
এর প্রায় ২২ বছর পর যখন “মরুতীর্থ হিংলাজ” প্রকাশিত হলো, কাগজে ছবি ছাপা হলো, তখন লোকজন জানলো, দুলাল বেঁচে। তবে তিনি তখন “কালিকানন্দ অবধূত।” উপন্যাসটি তিনি উৎসর্গ করেছেন আশ্রয়দাতা বন্ধু বৃন্দাবনচন্দ্রকে। দ্বিতীয় বিখ্যাত উপন্যাস বের হয় ১৯৬০-এ কাটোয়ার উদ্ধারণপুর মহাশ্মশানের পটভূমিকায় “উদ্ধারণপুরের ঘাট।” এটি তিনি পিতা অনাথনাথ মুখোপাধ্যায় ও প্রথমা স্ত্রী সুখময়ী দেবীকে উৎসর্গ করেছেন। পদ্মায় ঝাঁপ দেওয়ার পর ঘুরতে ঘুরতে দুলাল একসময় পৌঁছান উজ্জ্বয়িনী। সেখানে মহাকাল মন্দিরে সন্ন্যাস নেন। নাম হয় — “কালিকানন্দ অবধূত।” সমস্ত রকম সংস্কার থেকে ধৌত যিনি, তন্ত্রে তিনিই “অবধূত” নামে পরিচিত। এছাড়াও শরীরের ভেতরে যে অবধূতিকা নাড়ি, তার সম্পর্কে যিনি জ্ঞানী, তিনিও “অবধূত।” অবধূত কালিকানন্দ এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় তীর্থে তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। একসময় আসেন কাশীর কালীমন্দিরে এবং সেখানকার পূজারী হোন। এই পর্বের বিবরণ রয়েছে তাঁর “নীলকণ্ঠ হিমালয়”-এ। এই কাশীতেই দেখা হয় সাধিকা আনন্দময়ী মায়ের সঙ্গে। আনন্দময়ী মা অবধূতের জিভ ঘুরিয়ে দিয়ে তাঁকে তিন বছর মৌনী রেখেছিলেন। এ বিষয়ে অবধূতের নিজের লেখাতেই পাওয়া যাচ্ছে, “মা বললেন, হাঁ কর, আগে কাজটুকু সেরেনি, তারপর যা বলার বলব।
হাঁ করলাম। সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম, কি হল।”
কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র, তারপর আমার মুখের ভেতর থেকে আঙুল টেনে নিলেন মা। অবধূত (১৯১০ – ১৩ এপ্রিল, ১৯৭৮) বা কালিকানন্দ অবধূত ছিলেন একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি ঔপন্যাসিক ও তন্ত্রসাধক। তাঁর প্রকৃতনাম দুলালচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে। পুত্র অমল মুখোপাধ্যায়ের জন্মের পর প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু হলে উজ্জয়িনীর মহাকাল মন্দিরে[৩] সন্ন্যাস (অবধূত) গ্রহণ করেন। সন্ন্যাসজীবনে তাঁর নাম হয় কালিকানন্দ অবধূত। সন্ন্যাসজীবনে তাঁর ভৈরবী স্ত্রীও ছিল। হুগলি জেলার চুঁচুড়ায় স্বপ্রতিষ্ঠিত রুদ্রচণ্ডী মঠে তাঁর মৃত্যু হয়।
অবধূত ছদ্মনামে তিনি একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে মরুতীর্থ হিংলাজ নামক উপন্যাস রচনা করে খ্যাতি অর্জন করেন।এই উপন্যাসটি অবলম্বনে একটি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন বিকাশ রায় ও উত্তমকুমার। তাঁর অপর বিখ্যাত গ্রন্থ উদ্ধারণপুরের ঘাট (১৯৬০)। হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, “উদ্ভট কাহিনী-কল্পনা, বীভৎস রস, তান্ত্রিক ধর্মসাধনার গুহ্য রহস্য ও উৎকট যৌনাচার অবধূতের রচনার বৈশিষ্ট্য, – শক্তিমত্তা সত্ত্বেও শিথিল বিন্যাস ও যৌনতার আধিক্য ত্রুটিরূপে গণ্য।” শিশিরকুমার দাশের মতে, “তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য ভয়াবহ ও বীভৎস রসের আধিক্য। প্রবল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও কোনো কোনো সমালোচক তাঁর বিষয়নির্বাচন ও প্রয়োগরীতির প্রতি সংশয়ী ছিলেন।”
উদ্ধারণপুরের ঘাট, উপন্যাসটি পড়লে তাঁকে জানা যায় সম্যকরূপে।
গল্প শেষ হলে সকলে খাওয়া দাওয়া সেরে কাটোয়ায় ফিরলেন।
নয় [Bangla Novel Online]
বিপিন ও রিমি ঘুরতে ঘুরতে দেখা পেলো সমীরণের। রিমি না দেখার ভান করে ঘুরে দাঁড়ালো। পূর্ব প্রেমিক সমীরণ বলল, কি গো রিমি, একা এসেছো না সঙ্গে তিনি আছেন? রিমি বলল, ও পুজো দিতে মন্দিরে ঢুকেছে।আর তোমার বউ?
সমীরণ বলে, আমার আর বিয়ে করা হয়ে উঠল না। কথাটা শুনে রিমির বুকটা মুচড়ে উঠল। তবু চাপা স্বরে বলল, কেমন আছো?
সমীরন বলে, বেশ আছি।তীর্থে ঘুরে বেড়ায় আর তাঁকে খুঁজে মরি।
রিমি বলে, আমরা সকলেই তাকে খুঁজি কিন্তু তিনিতো আমাদের মনের গভীরে আছেন।
এর মধ্যে বিপিন চলে আসে।বিপিন বলে, এই নাও প্রসাদ খাও। রিমি বলে, এই হলো আমাদের গ্রামের সমীরণদা, সাধক লোক। বিপিন বলে, আপনার কথা শুনেছি রিমির কাছে। আপনি ভালো আছেন। সমীরণ বলে,আপনাদের ছেলে মেয়ে কই? বিপিন বলে, নেই। হবেও না গো।
সমীরণ কথা ঘোরায়, বলে, চলুন আমার আশ্রমে। সেখানে থাকবেন আমার কাছে। সব দায়িত্ব আমার। বিপিন বলে, স্কুলে একমাস ছুটি। চলুন যাওয়া যাক।
এই একমাসে তারা ঘুরে বেড়াবে ঠিক হলো।
দশ [Bangla Novel Online]
সমীরণ নিজের আশ্রমে বেশিদিন তাকে না।এবার রিমি ও বিপিনকে নিয়ে চলে এলো কালনা ঘুরতে। সমীরণ বলে,পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য শহর অম্বিকা কালনা। ছোট থেকেই শুনে আসছি কালনা শহরের ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের কথা।দেখার সৌভাগ্য হল ডি এল এড পড়ার সুবাদে। কালনা নবকৈলাস মন্দিরের ১০৯টি মন্দিরের মধ্যে ১০৮টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত। দুটি বৃত্তে বিন্যস্ত এই মন্দিরগুলির বাইরের বৃত্তে ৭৮টি এবং ভেতরের বৃত্তে মোট ৩৪টি অবস্থিত। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি অবস্থিত। বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত ১০৮টি মন্দির আটচালার আকৃতিতে নির্মিত। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট এবং বাইরের বৃত্তের পরিধি ৭১০ ফুট। এই মন্দিরগুলি স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এবং মন্দিরগুলি পরস্পর সংলগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৯.৫ ফুট। এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের পর্ব এবং শিকারের বহু দৃশ্যও চিত্রিত রয়েছে। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি আটটি সিঁড়িবিশিষ্ট বারান্দার উপর অবস্থিত । এর মন্দিরটি ৬ ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত, যার আয়তন ১৩ ফুট X ১৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৫ ফুট। এই মন্দিরটির বর্তমান নাম জলেশ্বর। বৃত্ত দুটির কেন্দ্রে একটি বাধানো ইঁদারা আছে যা মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটায়। তবে অনেকে মনে করেন এটি শূণ্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ শিবের প্রতীক।
বর্ধমান রাজপরিবারে বৈষ্ণব ভাবধারা প্রচলিত ছিল। গঙ্গার অবস্থিতি এবং বৈষ্ণব পাট হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বর্ধমান রাজপরিবার কালনাতেও আবাসস্থল এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দির স্থাপন করে। রাজপরিবারের সদস্যরা কালনায় গঙ্গাস্নানে যেতেন। এই উদ্দেশ্যে বর্ধমান এবং কালনার মধ্যে ১৮৩১ সাধারণাব্দে রাজপথ নির্মাণ করান তেজচন্দ্। এই সঙ্গে নির্মিত হয় প্রতি আট মাইল অন্তর জলাশয়, বাংলো, আস্তাবল ইত্যাদি। ভোলানাথ চন্দ্র প্রণীত ‘ট্রাভেলস অব আ হিন্দু’ (লন্ডন, ১৮৬৯) এবং ডব্লু ডব্লু হান্টারের ‘আ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল’ (১৮৭৬) উদ্ধৃত করে বলা যায় যে, গঙ্গার ধারে ছিমছাম সুন্দর শহরের রূপকার বর্ধমান রাজপরিবার। কালনা ছিল বর্ধমান জেলার একমাত্র বন্দর এবং মূল বাণিজ্যকেন্দ্র। জেলার বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানি হত কালনা বন্দরের মাধ্যমে। কালনা পুরসভার অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১৮৭১ সাধারণাব্দে। ১৮৭২-য় কালনার জনসংখ্যা ছিল ২৭,৩৩৬। ‘ক্যালকাটা রিভিউ’ পত্রিকায় রেভারেন্ড জেমস্ লং-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, কালনা বাজারে ইটের তৈরি এক হাজার দোকান ছিল। রংপুর, দেওয়ানগঞ্জ এবং জাফরগঞ্জ থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল কিনে মজুত করা হত কালনায়। খাদ্যশস্য, সিল্ক, তুলো ইত্যাদি ছিল প্রধান পণ্যদ্রব্য।
এ হেন কালনা রাজবাড়ি চত্বরের সবচেয়ে পুরোনো পঁচিশচূড়া মন্দিরটি হল লালজি মন্দির। ১৭৩৯ সাধারণাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করান বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচন্দ্-জননী ব্রজকিশোরী দেবী। মন্দিরের প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। ‘লালজি’-র নামকরণের পিছনে তেমনই একটি কিংবদন্তি আছে।
এগারো [Bangla Novel Online]
লালজি মন্দির চত্বরটি প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লম্বা-চওড়ায় ৫৪ ফুট বর্গাকার মন্দিরটি প্রায় চার ফুট বেদির ওপর অবস্থিত। মন্দিরের সামনে আছে চারচালা নাটমন্দির। চত্বরে প্রবেশপথের উপরে আছে নহবতখানা। বাঁ-দিকে রয়েছে পর্বত আকৃতির গিরিগোবর্ধন। মূল মন্দিরের চারদিকে চারচালা ছাদযুক্ত দীর্ঘ এবং ত্রিখিলান বারান্দা আছে। প্রথম তলের ছাদের চার কোণে সৃষ্ট খাঁজে তিনটি করে—দুটি চূড়া সমউচ্চতায় এবং মাঝেরটি একটু পেছোনো অবস্থায় সমতল করে বসানো আছে। দক্ষিণমুখী মন্দিরের সম্মুখভাগে আছে ত্রিখিলান প্রবেশদ্বার। মন্দিরের সম্মুখভাগ টেরাকোটা অলংকরণ সমৃদ্ধ। রামায়ণ, নানা পৌরাণিক কাহিনীর ফলকের পাশাপাশি নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখে মন্দিরের টেরাকোটা অলংকরণের অনেকটা অংশ জুড়েই আছে কৃষ্ণলীলার নানা কাহিনীর প্রতিফলন।
লালজি মন্দিরের বর্তমান বয়স ২৮০ বছর। ১৯৫৪ সালে জমিদারি উচ্ছেদের পর রাজবাড়িচত্বর প্রায় ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তার অন্তত ৪৫ বছর পর সমগ্র চত্বরটি ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের কলকাতা মণ্ডল অধিগ্রহণ করে। চত্বরের সৌন্দর্যায়নের কাজটি চমৎকারভাবে হলেও স্থাপত্য রক্ষণাবেক্ষণের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ।
বারো [Bangla Novel Online]
রিমির মনটা আনবাড়ির আঙিনার ধুলোয় বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছে মনটা। সকালে উঠে সমীরণের উঠোন ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে। তুলসীতলায় প্রদীপ দেয়। বিপিন ও সমীরণ হরিনাম করে। রিমি খোল বাজায়।
পূর্ব বর্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্ভুক্ত এই সতীপীঠ আমার জন্মস্থান বড়পুরুলিয়া গ্রামের কাছাকাছি। তাই বারবার যাওয়ার সুযোগ হয়েছে সতীপীঠে। সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবের নিন্দা সহ্য করতে না পেরে আত্মাহুতি দেন। এর পর মহাদেব কালভৈরবকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে। সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে মন্দির তৈরি হয়েছে। এগুলোকে সতীপীঠ বা শক্তিপীঠ বলে। এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। পীঠনির্ণয়তন্ত্র তন্ত্র মতে দেবীর বাম বাহু পড়েছিল বহুলায়। পরে রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে এই গ্রামের নাম হয় কেতুগ্রাম।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন।সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব এই দেহ কাঁধে নিয়ে তান্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তান্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খন্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহ খন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। সেই রকমই একটি সতীপীঠ হলো “বেহুলা” বা “বহুলা” সতীপীঠ। অন্নদামঙ্গল গ্রন্থে এটিকে আবার “বাহুলা” পীঠ বলে উল্লেখ করা আছে এবং এখানের অধিষ্ঠিত দেবীকে “বাহুলা চন্ডিকা” বলা হয়েছে। আবার “শিবচরিত গ্রন্থ” অনুযায়ী কেতুগ্রামেরই ‘রণখন্ড’ নামে একটি জায়গায় সতীর ‘ডান কনুই’ পড়েছে। এখানে অধিষ্ঠিত দেবীর নাম বহুলাক্ষী ও ভৈরব মহাকাল।
বর্ধমানের কাটোয়া থেকে সতেরো কিলোমিটার দূরে কেতুগ্রামে বহুলা সতীপীঠ অবস্থিত। অনেক বছর আগে এই গ্রামে তিলি বংশজাত ভূপাল নামক এক রাজা বাস করতেন। সেই রাজার একটি ছেলে ছিল, তার নাম চন্দ্রকেতু। মনে করা হয় চন্দ্রকেতুর নামেই এই গ্রামের নাম হয়েছে কেতুগ্রাম। প্রাচীনত্ত্বের বিচারে এই কেতুগ্রামের বয়স অনেক। অনেকের মতে এই কেতুগ্রামেই জন্মেছিলেন নানুরের বিশালাক্ষী-বাশুলি দেবীর উপাসক চন্ডীদাস। এই গ্রামে ছিল তার আদি বাসস্থান। এই কেতুগ্রামের উত্তরদিকের একটি জায়গাকে স্থানীয় মানুষজন চন্ডীভিটা বলে সম্বোধন করে থাকে। গ্রামেই অবস্থান বহুলা মায়ের মন্দিরের। রাও পদবিধারী জমিদারেরা বহুলা দেবীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। বর্তমানে মন্দিরের যে সেবাইতরা রয়েছেন তারা এই রাও জমিদারদের বংশধর। এই কেতুগ্রামে “মরাঘাট মহাতীর্থ” বলে একটি জায়গা রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিকদের মতে শিবচরিত গ্রন্থে রণখন্ড বলে যে জায়গার উল্লেখ করা আছে সেটি আসলে কেতুগ্রামের মরাঘাট মহাতীর্থ নামক জায়গাটি। এখানেই দেবীর দেহখন্ড পড়েছিল। এই মরাঘাটের পাশ দিয়ে ছোট নদী বয়ে গেছে। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে মরাঘাট মহাতীর্থ অনেক বছর আগে শশ্মান ছিল। শশ্মানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর তীরে মৃত শিশুদের দেহ পোঁতা হতো। এখানে অনেক সাধক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন। এখানেই রয়েছে দেবীর ভৈরব ভীরুক। তবে এটা নিয়ে মতান্তর আছে। অনেকের মতে কেতুগ্রামে বহুলা দেবীর সাথেই ভৈরব ভীরুকের অবস্থান। আবার অনেকের মতে কেতুগ্রাম থেকে একটু দূর “শ্রীখন্ডে” আছে মায়ের আসল ভৈরব ভীরুকের লিঙ্গ ও মন্দির।
সমীরণ বলে,গ্রামে মায়ের যে মন্দির আছে, সেটিকে নতুন ভাবে সংস্কার করা হয়েছে। মন্দিরে দেবীর মূর্তিটিকে একটি কালো পাথরের উপর স্থাপন করা হয়েছে। দেবীর মুখ বাদে সারা শরীর সুন্দর বস্ত্র দ্বারা আবরণ করা থাকে। মায়ের মূর্তির চারটি হাত। মায়ের পাশেই রয়েছে অষ্টভুজ গণেশের মূর্তি। গণেশের এই মূর্তিটি অনেক পুরানো। মা এখানে স্বামী পুত্র নিয়ে একসাথে বাস করেন। এখানে দেবীর নিত্য পুজো করা হয়। মাকে রোজ অন্নভোগ দেওয়া হয়। মন্দিরের পাশে একটি পুকুর আছে, অনেকের বিশ্বাস এই পুকুরে অবগাহন করলে রোগ ভালো হয়ে যায়।
তেরো [Bangla Novel Online]
আজ সমীরণ সকালে বলল,আজ আমরা অট্টহাসতলা যাব। তৈরি হয়ে সকলে বেরিয়ে পড়ল। সমীরন বলে, কলকাতা থেকে ধর্মতলা থেকে নিরোলের সরকারি বাস (SBSTC) পাবেন। তবে বাসে সময়টা একটু বেশিই লাগে। বাস ছাড়ার সময় হল বিকেলে তিনটে। ওই বাস বাসটি নিরোল পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিরোলে নেমেই টোটো রিক্সা করে পৌঁছে যান অট্টহাস সতীপীঠে। আপনি চাইলে মন্দিরে আগে থেকে ফোন করেও আসতে পারেন। তাতে আপনারই সুবিধা। অতিথিদের থাকার জন্য জায়গা আছে। ভক্তদের থাকা, খাওয়া মন্দির থেকেই পরিচালিত হয়।
এছাড়াও কাটোয়ার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান। যেমন, চৈতন্য চরিতামৃতের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজের বাড়ি ঝামতপুর নামের এক গ্রামে। বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশীরাম দাসের বাড়ি কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে। ফলে অট্টহাসে এলে আপনি এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মস্থানেও আসতে পারবেন ঘুরতে। অন্যদিকে কাটোয়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরেই জগদানন্দপুর গ্রাম। সেখানেই রয়েছে রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। যদি আপনার পুরাতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ থাকে, তাহলে এই মন্দিরের গঠনশৈলি আপনাকে অবাক করবেই।মন্দিরের পূর্বপাশে সাধক ভোলাবাবার মন্দির ৷ পঞ্চমুন্ডির আসন ৷ রটন্তী কালিকা মন্দির ৷এই কালীর কাছে ডাকাতরা পুজো করত ৷ আগে অট্টহাসে পূজার পর শিবাভোগের (শিয়ালকে খাওয়ানো) ব্যবস্থা ছিল৷ ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় শৃগালকুল ধ্বংস হওয়ায়৷ এখন ওই প্রথা উঠে গেছে ৷ শাক্তদেবী হলেও এখানে বাৎসরিক পুজো হয় বৈষ্ণবীয় উৎসবের সময় দোল বা ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ৷ এখানে ধূমধাম সহকারে ওই উৎসবের প্রচলন করেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা কাটোয়ার বিখ্যাত দুলাল সাধু৷
যদিও বীরভূমেও অট্টহাস সতীপীঠ আছে ৷ যা লাভপুরের কাছে৷ সেখানেও গিয়েছি৷ আগে বলেছি সেই সাধনপীঠ তথা সতীপীঠের কাহিনী৷ এই সতীপীঠে দেবীর পাথরের প্রতিমা উপর মহিষমর্দ্দিনীর পাথর মূর্তি রেখে নিত্যসেবা করা হয় ৷মহাভোগ যোগে কালীমন্ত্রে দেবী পূজিতা হন ৷এখানে মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী দন্তরা চামুন্ডা৷ ভূগর্ভের কয়েক হাত নিচে রয়েছে সতীর মূল শিলা বা পাথর ৷হাজারেরও বেশি বছর আগের একটা নথি পাওয়া গেছে একটা স্কেচ তাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ “অট্টহাসে চ চামুন্ডা তন্ত্রে শ্রী গৌতমেশ্বরী “৷ তাই অনেকে বলেন এখানে প্রাচীন বৌদ্ধ দেবীর হিন্দুআয়ন হয়েছে৷ তাই মনে হয় হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক, বজ্রযানী ও সিদ্ধাচার্যগণ এখানে সাধনা করেছেন৷ মায়ের কাছেই ছোট মন্দিরে বিল্লেশ থাকলেও মূল বিল্লেশ মন্দির বিল্লেশ্বর গ্রামে৷ সেখানে শিব লিঙ্গ মাটিতে বসা ৷ কষ্ঠি পাথরের শিববাহন ষাঁড়ের মূর্তি৷ মহাপীঠ নিরূপম গ্রন্থে এই পীঠের কথা বলা হয়েছে৷ এই পীঠে একসময় ভয়ানক রঘু ডাকাত পুজো করে ডাকাতি করতে যেত৷ সে নরবলি দিত বলে জনশ্রুতি আছে৷ আবার যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত “বাংলার ডাকাত ” বইয়ে বলেছেন এখানে বেহারী বাগদী নামে এক ডাকাত পুজো করে নরবলি দিত৷ ত্রিশ একর জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরে আজও গা ছমছমে পরিবেশ৷ মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঈশাণী নদী। কাছেই রয়েছে শ্মশান। এই এলাকাটি আগে এত বেশি জঙ্গলে ভরা ছিল যে, দিনের বেলায়ও যেতে সাহস পেতেন না অনেকে। তবে এখন খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে মন্দিরটিকে। রাতে ঘুমানোর সময় কানে আসবে শিয়ালের ও প্যাঁচার ডাক, সকালে উঠবেন পাখির ডাকে। শান্ত পরিবেশে ভক্তি ভরে পুজো দিতে পারবেন আপনি। কথিত আছে একমনে মাকে ডাকলে সতীমায়ের উপস্থিতি অনুভব করা যায় আজও।
সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত্যাগ করেন। এর পর মহাদেব বীরভদ্রকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে।সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য। ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে শক্তিপীঠ স্থাপিত হয়েছে ।এগুলোকে সতীপীঠ বলে। এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। এখানে দেবীর অধর / নিচের ঠোঁট, পতিত হয়।
এরপর অনেক বছর কেটে যায়।এই স্থান জঙ্গল হয়ে ওঠে।তখন এ স্থানের নাম ছিল খুলারামপুর বা তুলারামপুর।পরবর্তীতে এই গ্রামের নাম দক্ষিণ ডিহি হয়।এই গ্রামে কিছু কৃষক বাস করত। তারা মাঠে চাষবাদ করত। ঈশাণী নদীর ধারে অবস্থিত এ স্থান ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দিনের বেলাতেও ওখানে কেউ যেত না। একদিন কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে এক সাধুবাবাকে জঙ্গলে ধ্যানমগ্ন দেখতে পায়।তাড়া কৌতূহলী হয়ে দলবদ্ধভাবে তার কাছে যায় ও তাকে প্রণাম করেন।সাধুবাবা এখানে যজ্ঞ করেন।যজ্ঞ শেষে তিনি যজ্ঞস্থানে একটি ত্রিশূল পুঁতে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।চলে যাবার আগে বলেন, এটি একটি সতীপীঠ। এখানে দেবী ফুল্লরা ও ভৈরব বিশ্বেশ। এখানে দেবীর দন্তুরা চামুণ্ডা মূর্তি ।এখানে দেবীকে অধরেশ্বরী নামে পূজা করা হয়। এখানে আছে এক প্রাচীন শিলামূর্তি। মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে। সারা বছর এখানে ভক্তরা আসে।তবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস এ পাঁচ মাস এখানে বহু ভক্তের সমাগম হয়।বহু ভক্তের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে এখানে পূজা দিয়ে ।দোলের সময় এখানে বিশাল মেলা বসে। এখানে থাকার জন্য অতিথি নিবাস আছে।মন্দির থেকে ভক্তদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
চোদ্দ [Bangla Novel Online]
আজ সমীরণ ক্ষীরগ্রাম যাওয়া ঠিক করল।সমীরণ বলল, জনশ্রুতি অনুসারে এই জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে দেবী সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছে। দেবী যোগাদ্যা মায়ের স্থায়ী বাসস্থান এই জলাশয়ের নীচে। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তিতে দেবীকে জল থেকে তুলে মূল মন্দিরে ভক্তদের সামনে রাখা হয়। এই দিন সবার অধিকার থাকে দেবীকে স্পর্শ করার পুজো দেবার। এই সংক্রান্তিতে সারাদিন ধরে মায়ের পুজো হয় ও গ্রামে মেলা বসে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই দীঘির ঘাটে মা যুবতীর বেশ ধরে শাঁখা পড়েছিলেন। সেই উপলক্ষে বৈশাখ মাসের উৎসবে মাকে শাঁখা পড়ানো হয় এবং গ্রামের বধূরাও ওই দিন শাঁখা পরে। পুজো শেষ হলে ভোরবেলা দেবীকে আবার ক্ষীরদীঘিতে রেখে আসা হয়। এছাড়াও বছরের অন্যান্য বিশেষ সময়ে দেবীকে জল থেকে তুলে মন্দিরে এনে পুজো করা হলেও ভক্তরা দেবীর দর্শন পান না। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তির দিনই দেবীর দর্শন করা যায়।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী যোগাদ্যাকে ক্ষীরগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বয়ং রাম। লংকায় রাম রাবণের যুদ্ধ চলাকালীন রাবণের ছেলে মহীরাবণ রাম ও লক্ষণকে মায়াজালে আবদ্ধ করে পাতালে নিয়ে আসে বলি দেবার জন্য।এই পাতালে মহীরাবণের আরাধ্যা দেবী ছিলেন ভদ্রকালি তথা দেবী যোগাদ্যা ।প্রতিদিন দেবীর সামনে নরবলি দেওয়া হতো। কিন্তু মহীরাবণের সেই উদ্দশ্য সফল হয়নি। হনুমান মহীরাবণকে পরাজিত করে রাম ও লক্ষণ কে উদ্ধার করেন। মা যোগাদ্যা রামের কাছে থাকতে এবং তার হাতে পুজো নেবার ইচ্ছে জানালে রাম দেবীকে পাতালপুরী থেকে পৃথিবীতে এনে এই ক্ষীর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব বর্ণনা কবি কৃত্তিবাসের রচনায় পাওয়া গেছে। যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মতে এই ক্ষীরগ্রাম থেকে বহু প্রাচীন পুঁথি উদ্ধার হয়েছে যেখানে যোগাদ্যা বন্দনার প্রায় ৪০টি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে।
দেবী মূর্তিটি কালো কষ্টি পাথরের। দেবীর রূপ দশভূজা ও দেবী মহিষমর্দিনী। বলা হয় প্রাচীন মূর্তি চুরি যাওয়ায় বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ দাইহাটের নবীনচন্দ্র ভাস্করকে দিয়ে দশভূজা মহিষমর্দিনীর একটি প্রস্তর প্রতিমা তৈরি করিয়েছিলেন। এই প্রতিমাটিই ক্ষীরদীঘির জলের নীচে রাখা থাকে। তবে মূল মন্দিরে কোনো প্রতিমা নেই। গর্ভগৃহে বেদী রাখা আছে এই বেদীতেই মায়ের নিত্য পুজো করা হয়। মাকে আমিষ ভোগ প্রদান করা হয়। এই মন্দিরের একটু দূরে রয়েছে ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠের শিব মন্দির। একসময় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটি নিয়ে। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সাথে খোঁজ মেলে হারিয়ে যাওয়া মূর্তির। পুরনো মূর্তি ফিরে পাবার আনন্দে গ্রামবাসীরা আরও একটি মন্দির গড়ে তোলেন। এই মন্দিরেই রাখা থাকে পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। ফলত এখন গ্রামে গেলে সারাবছরই মায়ের দর্শন পাওয়া যায়। এবং বৈশাখ সংক্রান্তির সময় গ্রামের দুই মন্দিরেই সমান আরাধনা চলে।
ক্ষীরগ্রাম দেবী সতীর ৫১ পীঠের এক পীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর আঙুলসহ ডান পায়ের পাতা পড়েছিল। দেবীকে এখানে যোগাদ্যা রূপে পূজা করা হয়। জানা যায়, বর্ধমানের মহারাজা কীর্তি চন্দ এই গ্রামে যোগাদ্যার একটি মন্দির তৈরি করান। কিন্তু এরপর কোনও ভাবে হারিয়ে যায় প্রাচীন যোগাদ্যা মূর্তিটি। এরপরই সম্ভবত মহারাজার আদেশেই হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটির অনুকরণে একটি দশভূজা মহিষমর্দিনীর মূর্তি তৈরি করা হয়। তবে, পরবর্তী সময়েও নতুন তৈরি হওয়া মূর্তিটিও কিন্তু অবশ্য বছরের অন্যান্য সময়ে ডুবিয়ে রাখা হত ক্ষীরদীঘির জলেই বলে জানা যায়। কেবল ৩১ বৈশাখ দেবীকে জল থেকে তুলে এনে সর্বসমক্ষে রাখা হত।
এর মধ্যে হঠাৎই ঘটে যায় এক অলৌকিক কাণ্ড। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় হঠাৎই নতুন মূর্তির সঙ্গেই উঠে আসে ‘হারিয়ে যাওয়া’ পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটিও। এরপর, মূর্তি ফেরত পাওয়ার আনন্দে আশপাশের গ্রামের বাসিন্দাদের সাহায্যে সম্পূর্ণ আলাদা একটি মন্দির গড়ে তোলেন গ্রামের মানুষরা। সেই নতুন মন্দিরেই প্রতিষ্ঠিত হন ফিরে পাওয়া দেবী মূর্তিটি। তাই এখন গ্রামে গেলেই দেবীরদর্শন পান বহিরাগতরা। পাশাপশি সংক্রান্তিতে দুই মন্দিরেই চলে দেবীর আরাধনা। জানা যায়, এই ক্ষীরগ্রামে একটা সময় বেশ কিছু চতুষ্পাঠী ছিল। সেই সময়ের সাক্ষী বহু প্রাচীন পুঁথি। স্থানীয় ইতিহাস নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন, তাঁদের দাবি, বেশ কয়েক জন পণ্ডিত এই গ্রামে বিদ্যাচর্চা করতেন। অন্তত ৪০টি যোগাদ্যা বন্দনা পুঁথি পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়। তবে জানা যায়, সবথেকে আগে যোগাদ্যা বন্দনা লিখেছিলেন কবি কৃত্তিবাস। কবির মতে, রামায়ণের কালে মহীরাবণ বধের পরে তাঁরই পূজিতা ভদ্রকালী বা যোগাদ্যাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা করেন রামচন্দ্র।
মন্দির থেকে অদূরে একটি টিলার উপর দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। তাই এই গাঁয়ের নাম ক্ষীরগ্রাম, আদরের ক্ষীরগাঁ। মন্দির আর ক্ষীরদীঘি থেকে খানিকটা দূরে গ্রামের এক প্রান্তে ধামাসদীঘি। কথিত আছে, মহীরাবণকে কৌশলে বধ করে লক্ষ্মণ যখন পাতাল ত্যাগ করতে উদ্যাত হন, তখন রাবণের আরাধ্যা দেবী মহাকাল প্রভু রামচন্দ্রের সঙ্গে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। হনুমানের কাঁধে চেপে মহাকাল এসে ওঠেন মঙ্গলকোটের ক্ষীরগ্রামে। পুরাণ মতে, সেই সময় থেকেই দেবী মহামায়া বা মহাকালী কিংবা ভদ্রকালী যোগাদ্যা হয়ে রাঢ় বঙ্গে অন্ত্যজ শ্রেণির হাতে পূজিতা হতে শুরু করেন। শাক্ত মতে এটি সতীপীঠ। দেবীর ডান পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছিল এখানে। এখানে আলাদা কোনও কালী মূর্তি নেই। দেবীর রত্নবেদীতে কালীমন্ত্রে পুজো করা হয় দেবী যোগাদ্যাকে।
পনেরো [Bangla Novel Online]
সমীরণ, বিপিন ও রিমি আজ ঠিক করল,উজানি হয়ে কাটোয়ার বাসায় ফিরবে ওরা।সমীরণ বলল,তুমি তো জানো বিপিন,অজয় নদের পাড়ে এই মন্দির অবস্থিত। মূল মন্দিরটিতে প্রথমে একটি বারান্দা আছে। তার ভিতরে আয়তাকার গর্ভগৃহ। এই গর্ভগৃহের মধ্যে মা মঙ্গলচণ্ডীর ছোটো কালো পাথরের দশভূজা মূর্তি রয়েছে। প্রাচীন মূর্তিটি নব্বইয়ের দশকে চুরি হয়ে যায়। ১৯৯৪ সালে মল্লিক উপাধিধারী গ্রামের এক ধনী পরিবার বর্তমানের কষ্টিপাথরের দশভুজা মূর্তিটি নির্মাণ করে দেন। সেই থেকে এই কষ্টিপাথরের মূর্তিটির পূজা হচ্ছে। ২০০৬ সালে মন্দিরটি সারানো এবং বাড়ানো হয়েছে। মূল মন্দিরের সামনে একটি ছোট নাটমন্দির যোগ করা হয়েছে।
প্রত্যেকটি সতীপীঠ বা শক্তিপীঠে দেবী এবং ভৈরব অধিষ্ঠিত থাকে। দেবী হলেন সতীর রূপ। ভৈরব হলেন দেবীর স্বামী। উজানি সতীপীঠে দেবীর নাম মঙ্গলচন্ডী। উঁচু কালো রঙের পাথরের একটি শিবলিঙ্গ হল দেবীর ভৈরব । ভৈরবের নাম কপিলাম্বর। অনেকে কপিলেশ্বর বলেও উল্লেখ করেন। শিবলিঙ্গের সামনে নন্দীর কালো পাথরের একটি ছোট মূর্তি আছে। শুধু তাই নয়, ভৈরবের বাঁদিকে একটি বজ্রাসন বুদ্ধমূর্তিও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এই মূর্তিটি পাল যুগের। কবিকঙ্কণ চণ্ডীতে বর্ণিত ভ্রমরার দহ, মাড়গড়া, শ্রীমন্তের ডাঙা প্রভৃতি স্থানগুলি উজানিতেই। বর্তমানে সেই স্থানগুলির হদিশ পাওয়া যায় না। কথিত আছে সপত্নীপীড়িতা খুল্লনা উজানির কাছে ছাগল চরাতেন। যে স্থানে ভাত রান্না করে মাড় গালতেন সেই স্থানটি মাড়গড়া নামে পরিচিত ছিল। চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি দত্ত এই ভ্রমরার দহ থেকেই ডিঙায় চেপে সিংহলে বাণিজ্যে গিয়েছিলেন। আবার তাঁর পুত্র শ্রীমন্তও মঙ্গলচণ্ডীর চরণে পুজো দিয়ে সিংহলে পিতার অনুসন্ধানে যেতে ভ্রমরার দহ থেকেই সাত খানি ডিঙা ভাসিয়েছিলেন। যে স্থানে দাঁড়িয়ে সাতখানি ডিঙা দেখেছিলেন সেই স্থানটি শ্রীমন্তর ডাঙা নামে পরিচিত ছিল। সেগুলির সন্ধান বর্তমানে না পাওয়া গেলেও উজানির সতীপীঠ-কপিলাম্বর রয়েছেন স্বমহিমায়। দেবীর মূল পুজো হয় শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময়। পুজো চলে ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত। এটি সতীপীঠ হওয়ার কারণে পুজোয় আলাদা করে মূর্তি আসে না এবং নবপত্রিকা আনা হয় না। শুধু ঘট বারি আনা হয়। বছরে তিনবার ঘট বদল হয়। প্রথম ঘট আসে বৈশাখের শেষ মঙ্গলবার এবং বাৎসরিক পুজো হয়। এরপর ঘট আসে জিতাষ্টমীর পরদিন, যাকে বোধনের ঘট বলা হয়। তারপর ঘট আসে দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর দিন। এছাড়াও বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসের মঙ্গলবারে মঙ্গলচণ্ডীর পুজো হয়। এখানে বলিপ্রথা চালু আছে। দুর্গাপুজোর সপ্তমী এবং অষ্টমীতে চালকুমড়ো, নবমীতে চালকুমড়ো, কলা, আখ এবং ছাগ বলি হয়। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীরা লৌকিক ও পৌরাণিক দেবদেবীর মিশ্রণ। লৌকিক দেবদেবীদের সঙ্গে কালে কালে যুক্ত থাকে পরিপুষ্ট গভীর আবেগ, ভক্তির উচ্ছ্বাস, অন্ধবিশ্বাসের ঐকান্তিকতা। শ্রীমন্ত এই স্থান থেকে সিংহলে যাত্রা করে সিদ্ধকাম হয়েছিলেন এই বিশ্বাসের ওপর ভর করেই উজানি শক্তিপীঠের প্রতি সাধারণ মানুষের ভক্তি ও বিশ্বাস আজও অমলিন।
পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এখানে সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে অধিষ্ঠিত দেবী মঙ্গলচন্ডী এবং ভৈরব হলেন কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর। পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরার কাছে কোগ্রামে অবস্থিত এই সতীপীঠ। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে মাতা সতী নিজের বাপের বাড়িতে বাবার কাছে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেরে সেখানেই দেহত্যাগ করেছিলেন। মাতা সতীর দেহত্যাগের খবর মহাদেবের কাছে পৌঁছতেই মহাদেব সেখানে উপস্থিত হন। সতীর মৃতদেহ দেখে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব সেই দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য চালু করেন। মহাদেবের তাণ্ডব নৃত্যে পৃথিবী ধ্বংসের আশঙ্কায় শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ একান্নটি খণ্ডে খণ্ডিত করেন। সেই দেহখন্ডগুলোই যে যে স্থানে পড়েছিল সেখানে একটি করে সতীপীঠ প্রতিষ্ঠা হয়। বলা হয় কোগ্রামের সতীপীঠ উজানিতে মাতা সতীর বাঁ হাতের কনুই পড়েছিল।যার সাধনায় অনেক অসাধ্যকে সাধ্য হতে দেখেছেন ভারতবাসী। এদেশের প্রতিটি ঘরে রয়েছে ঈশ্বর আরাধনার বাতাবরণ। রয়েছে সেই মহাশক্তির ছায়া। বাকি ভারতের সঙ্গে তুলনা টানলে দেখা যাবে যে এই বাংলাও তার ব্যতিক্রম নয়। এমনকী এখানে নাস্তিকতার আড়ালেও চলে দৈব সাধনা, পুজো-অর্চনা, জপ-তপ। চলে তন্ত্রচর্চাও। যার সাহায্যে জীবনের অনেক কঠিন পরিস্থিতিকে সহজে সামলে নেন ভক্তরা।
এই বাংলার আরও বড় সুবিধা যে এখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি শক্তিপীঠ। বেশ কয়েকটি সিদ্ধপীঠ। এই বাংলায় জন্ম নিয়েছেন একের পর এক মহাপুরুষ। এমনই এক শক্তিপীঠ হল পূর্ব বর্ধমান জেলার কোগ্রামের উজানি। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী যেখানে দেবী সতীর বাম হাতের কনুই পড়েছিল। এখানে দেবী মণ্ডলচণ্ডী। আর ভৈরব কপিলাম্বর বা কপিলেশ্বর।
রিমি বলল, এছাড়া পূর্ব বর্ধমান জেলায়, ক্ষীরগ্রামের যোগাদ্যা মা, কেতুগ্রামের বাহুলক্ষীতলা ও অট্টহাস সতীপীঠ উল্লেখযোগ্য সতীপীঠ বলে পরিচিত। সমীরণদা আজকের রাতটা আমাদের বাসায় থাক।সমীরণ বলল, নিশ্চয়ই।
তারপর রাত হলে বিপিন সমীরণকে পাঁচ লাখ টাকার চেক দিয়ে বলল, তুমি তোমার আশ্রমের উন্নতি করো।আমি ও রিমি বয়স হলে তোমার সঙ্গী হব।
সমীরণ বলল, টাকায় আমার কাজ নেই। তবু আশ্রমের সেবার কাজে লাগে ভক্তদের সাহায্য। আমার আশ্রমের প্রবেশদুয়ার তোমাদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে চিরকাল। সমীরণ সকাল হলেই বেরিয়ে পড়ল অজানার টানে।
সুদীপ ঘোষাল | Sudip Ghoshal
Tahiya lagi besha | তাহিয়া লাগি বেশ | অভিজিৎ পাল
Women’s role in Christian society | খ্রীষ্টীয় সমাজে নারীর অবস্থান
New Bengali Story 2023 | আঁধার পেরিয়ে (পর্ব ২) | গল্প
Briddhashram Story | বৃদ্ধাশ্রম – বিপাশা চক্রবর্তী | 2023
Bangla Novel Online Reading | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Bangla Novel Online Reading | Pdf Bangla Novel Online Reading | Bangla Novel Online Reading App | Full Bangla Golpo Online Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English |Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Bangla Novel Online Reading 2023 | New Bengali Web Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Bangla Novel Online Reading Video | Horror – Bangla Novel Online Reading | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Bangla Novel Online Reading Netflix | Audio Bangla Golpo Online Reading | Video Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2023 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Recent Bangla Novel Online Reading | Top Bangla Novel Online Reading | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2023 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bangla Novel Online Reading Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Bangla Novel Online Reading mp4 | Bangla Novel Online Reading Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bengali Story – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Collection – Bangla Novel Online Reading