Tahiya lagi besha | তাহিয়া লাগি বেশ | অভিজিৎ পাল

Sharing Is Caring:
Tahiya lagi besha

অভিজিৎ পাল – সূচিপত্র [Bengali Article]

তাহিয়া লাগি বেশ | Tahiya lagi besha

শ্রীক্ষেত্রেশ্বর পুরুষোত্তম জগন্নাথ তাঁর নিত্যলীলাবিলাসে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন তিথিতে বৈচিত্র্যময় হয়ে ভক্তদের হৃদয়ে অনাবিল আনন্দ প্রবাহিত করেন। তিনি কখনও সোনার অলংকারে রাজাধিরাজ রূপে প্রকাশিত হন, আবার কখনও ফুলসাজে গোপনায়ক রূপেও প্রকাশিত হন। তিনি কখনও ভাব বিমোহিত ভক্তের বয়ে আনা শুকনো ফুলকে সদ্য ফোটা ফুলে পরিণত করে সাজেন, আবার কখনও ফুলের অনুকরণে তৈরি করা শোলার ফুলের সজ্জায় সজ্জিত হয়েও সমানভাবে আনন্দ মিছিল করেন। জগন্নাথ ভাবগ্রাহী জনার্দন। তাঁর দুই চোখের দিকে তাকিয়ে তদ্ভাবরঞ্জিত হয়েই ভক্তরা উল্লসিত হয়ে পড়েন। তিনি সোনায় সাজলেন কি সাধারণ উপাচারে সাজলেন তা তুচ্ছ হয়ে যায়। জগন্নাথ স্বয়ং পরশপাথরের মতো, তাঁকে যে স্পর্শ করে বা যা তাঁর স্পর্শ লাভ করে সবই সোনার চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান হয়ে যায়।

প্রতি বছর আষাঢ় মাসে পবিত্র রথযাত্রার সময়ে পুরীর শ্রীমন্দিরে জগন্নাথ মহাপ্রভুর তাহিয়া লাগি বেশ (Tahiya lagi besha) অনুষ্ঠান পালন করা হয়। রত্নসিংহাসনের প্রধান তিন দেবতা জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্র তাহিয়া নামক একটি বিশেষ ধরনের মুকুট পরেন। তাহিয়া বেশের এই মুকুট জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের একমাত্র অলংকার বা সজ্জার উপকরণ যা নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের পর রত্নসিংহাসনের প্রধান দেবদেবীরা ভক্তদের মধ্যে দান করেন। জগন্নাথের তাহিয়া বেশে প্রতি বছর একাধিক তিথিতে অনুষ্ঠিত হয়। এই তিথিগুলি হলো স্নানপূর্ণিমা, রথযাত্রা, বহুড়া যাত্রা (পুনর্যাত্রা, প্রচলিত শব্দ উল্টোরথ) এবং নীলাদ্রী বিজয়ের তিথি। এই চারটি তিথিতে শ্রীমন্দিরের নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে জগন্নাথের যাত্রাকালে হাল্কা সাজের সুন্দর তাহিয়া বেশ শৃঙ্গারে রত্নসিংহাসনের প্রধান দেবতাদের পরিধান করানো হয়। সুদর্শন চক্র, ভূদেবী, শ্রীদেবী ও নীলমাধব বিগ্রহে এই বৈচিত্র্য সেভাবে দেখা যায় না।

জগন্নাথদেব যখন মাথায় তাহিয়া মুকুট পরে তাহিয়া বেশ শৃঙ্গারে সজ্জিত হয়ে শ্রীমন্দিরের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এসে ভক্তদের মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ান তখন জগন্নাথের ভক্তদের হৃদয়ের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাসে সমগ্র শ্রীক্ষেত্রে আনন্দের জোয়ার আসে। তাহিয়া বেশে সুসজ্জিত হয়ে প্রথমে দেখা দেন অনন্তাবতার বলভদ্রদেব, তাঁর ঠিক পরেই আসেন যোগমায়া দেবী সুভদ্রা। তাঁদের দুজনের এই সজ্জায় প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের জগন্নাথ দর্শনজনিত উন্মাদনা সপ্তমে চড়ে যায়। অবশেষে অজস্র ভক্তহৃদয়ের অধিপতি জগন্নাথ তাহিয়ায় সজ্জিত হয়ে দেখা দেন। জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের তাহিয়া বেশে একস্থান থেকে অন্য স্থানে গমন ওড়িশার জগন্নাথ-সংস্কৃতিতে অন্যতম চিত্তাকর্ষক ঘটনা। এই বেশে জগন্নাথ ভক্তদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। জগন্নাথ তাঁর প্রায় অন্য সব বেশেই রত্নসিংহাসনে বসে ভক্তদের সঙ্গে দেখা করেন। সেক্ষেত্রে ভক্তরা শ্রীমন্দিরে গিয়ে জগন্নাথকে দেখার সৌভাগ্য লাভ করেন। কিন্তু তাহিয়া বেশটি বিপরীত ঘটনা ঘটায়। তাহিয়ার সাজে সজ্জিত জগন্নাথ তাঁর ভাই-বোনের সঙ্গে শ্রীমন্দির থেকে বাইরে এসে ভক্তদের সঙ্গে মিলিত হন। তাহিয়া বেশে সুসজ্জিত জগন্নাথের অভিযাত্রার একটি অতি ছোট বর্ণনা চৈতন্যজীবনীকার কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর ‘চৈতন্যচরিতামৃত’-এর মধ্যলীলায় পাওয়া যায় :

বলিষ্ঠ দয়িতাগণ যেন মত্ত হাতী।
জগন্নাথ বিজয় করায় করি হাতাহাতি।
কতক দয়িতা করে স্কন্ধ আলম্বন।
কতক দয়িতা ধরে শ্রীপদ্মচরণ।।
কটিতটে বদ্ধ দৃঢ় স্থূল পট্টডোরী।
দুই দিকে দয়িতাগণ উঠায় তাহা ধরি।।
উচ্চ দৃঢ় তুলী সব পাতি স্থানে স্থানে।
এক তুলী হৈতে ত্বরায় আর তুলীতে আনে।।
প্রভু-পদাঘাতে তুলী হয় খণ্ড খণ্ড।
তুলা সব উড়ি যায় শব্দ হয় প্রচণ্ড।।
বিশ্বম্ভর জগন্নাথে কে চালাইতে পারে।
আপন ইচ্ছায় চলে করিতে বিহারে।।

এই অংশটি জগন্নাথের শ্রীমন্দির থেকে বাইরে এসে রথে ওঠার দৃশ্য। জগন্নাথের এই গমন অনেকখানি দুলে দুলে। জগন্নাথের মুকুটের অংশে তাহিয়াটি এই দুলকিচালে যাত্রাকালে খুব ঝাঁকুনি পায়। জগন্নাথের দুলে দুলে চলার তালে তালে তাঁর তাহিয়াটি একবার সামনে একবার পিছনে করে অতি দ্রুত দোলা খেতে থাকে। তাহিয়ায় এভাবে বহুবার ঝাঁকুনি লাগতে থাকায় তাহিয়ার বিভিন্ন অংশ আলগা হয়ে খসে পড়তে থাকে। জগন্নাথের ভক্তরা জগন্নাথের ব্যবহৃত তাহিয়ার পড়ে যাওয়া টুকরোগুলি নিজেদের বাড়ির কোনো পবিত্র স্থানে, গৃহদেবতার ঘরে, ঘরের নির্দিষ্ট পূজাস্থানে দারুব্রহ্ম ভগবানের স্পর্শধন্য স্মারকটি সংরক্ষিত করে রাখে। আবার অনেকে গৃহনির্মাণ বা মন্দির নির্মাণ করার সময় ভিত্তিতে জগন্নাথের তাহিয়ার টুকরো পরম শ্রদ্ধায় গেঁথেদেয়। সাধারণত মঙ্গলদ্রব্য ও ঈশ্বরের আশীর্বাদ রূপে সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে এই রীতির মান্যতা রয়েছে।

BENGALI ARTICLE

তাহিয়া নামে পরিচিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার এই বিশেষ গড়নের মুকুটটি মূলত বেত, বাঁশের লাঠি, রঙিন কাগজ, সোলার ফুল, টাটকা প্রাকৃতিক ফুল এবং রঙ (ন্যূনতম পক্ষে লাল রঙ এবং দস্তার রঙের ব্যবহার করা হয়) দিয়ে তৈরি। তাহিয়া মুকুটটি শ্রীবিগ্রহত্রয়ের মাথায় সুসজ্জিত হয় শ্রীমন্দিরের ভেতরেই, যখন তাঁকে শ্রীমন্দির থেকে তিনটি পৃথক রথে একে একে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রথযাত্রার যাত্রাপথের শেষ অবধি এটি শ্রীবিগ্রহত্রয়ের সঙ্গেই থাকে। চাহিয়া মুকুট ওজনে অপেক্ষাকৃত হালকা হওয়ায় বাতাসের চাপে ও জগন্নাথের গমনের ছন্দে মুকুটটি সামনে-পেছনে করে নির্দিষ্ট ছন্দে দোলা খায়। শ্রীমন্দিরের পক্ষ থেকে জগন্নাথের সেবায় নিয়োজিত দক্ষ শিল্পী কারিগরদের ওপরেই তাহিয়া বেলের উপকরণগুলি প্রস্তুত করার ভার অর্পণ করা হয়। তাহিয়া মুকুটটি অনেকখানি সুপারি গাছের পাতার মতো আকারে দেখতে। জগন্নাথ ও বলরামের তাহিয়া মুকুটটি উচ্চতায় প্রায় ছয় ফুট এবং পরিধিতে প্রায়ে সাড়ে আট ফুট। ভগবতী সুভদ্রার তাহিয়ার মাপ একটু ছোট। তাহিয়াকে নির্দিষ্ট শিল্পসম্মত আকৃতি দেওয়ার জন্য একসঙ্গে তিনটি করে কাঁচা বাঁশের কাঠি সুতির সুতো দিয়ে একসঙ্গে বেঁধে রাখা হয়। অজস্র ছোট ও বড় কাঁচা বাঁশের লাঠি এই বেশ নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। বাঁশের কাঠির পাশাপাশি একটু শক্ত ধরনের বেত কয়েকটি নির্দিষ্ট জায়গায় ব্যবহার করা হয়। এর ফলে তাহিয়াটি আরও মজবুত হয় এবং রথযাত্রার ভূয়সি হুল্লোড়েও তাহিয়া মুকুটটি ভেঙে যাওয়ার ভয় কমে যায়। টাটকা তাজা জুঁইফুল ছাড়াও সোলা দিয়ে তৈরি ফুলও ব্যবহার করা হয়। তবে সোলা দিয়ে তৈরি তাহিয়ার ঠিক শীর্ষ অংশে কদম্ব ফুলের সারি প্রতিটি তাহিয়া মুকুটের শোভা ও সৌন্দর্য অনেকগুণ বাড়িয়ে তোলে। পুরীর জগন্নাথের শ্রীবিগ্রহ ছয় ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার। প্রায় সাড়ে ছয় ফুট উচ্চতার জগন্নাথ বিগ্রহের মাথায় এত বড় ও উচ্চতা বিশিষ্ট মুকুটটি আরও মনোরঞ্জক দেখায়। জগন্নাথদেব রথে ওঠার সময় তাহিয়া ছাড়া আর কোনও মূল্যবান অলংকার পরেন না। অর্থাৎ একটা স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তিনি এই সময় শৃঙ্গার করেন। এই বেশে জগন্নাথ সহজ-সুন্দর, তিনি সাধারণ সজ্জায় সজ্জিত হয়ে জনসাধারণের প্রিয়ধন হয়ে ওঠেন।

জগন্নাথের তাহিয়া বেশের প্রবর্তনের সঙ্গে তাঁর ভক্তপ্রবর রঘুর কাহিনী অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত রয়েছে। জগন্নাথের প্রেমধনে মত্ত ভক্ত রঘু পুরীর শ্রীমন্দিরের সিংহদ্বারের কাছে আকাশের জ্বলন্ত সূর্যের নীচে শ্রীমৎ মহাপ্রভু জগন্নাথের ধ্যান করছিলেন। পুরীর তৎকালীন গজপতি মহারাজা রাজা ছাতার আচ্ছাদনের (ওড়িশার বিশেষ ধরনের ছাতা তাতি) মাধ্যমে জগন্নাথের ভগবৎচিন্তায় মগ্ন ভক্তদের সূর্যের প্রখর উত্তাপ থেকে রক্ষা করার জন্য সেবাস্বরূপ ছায়া সরবরাহ করতেন। গজপতি মহারাজা একই ভাবে জগন্নাথের ভক্ত রঘুর জন্যও একটি ছাতা তৈরি করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় তপস্বী সাধকদের বিশ্বাস রয়েছে, পক্ষী ও সন্ত কিছুই সঞ্চয় করেন না। সন্ত রঘুও গজপতি মহারাজা প্রদত্ত সুন্দর কারুকার্যময় ছাতার কোনও ব্যবহারের প্রয়োজন অনুভব না করে সেটিকে অবহেলায় ফেলে দিলেন। গজপতি মহারাজা পরদিন সকালে আবার ভক্ত রঘুকে আগের অবস্থায় ধ্যানস্থ দেখে আবার তাঁর জন্য একই রকমের সুন্দর ছাতার ছায়া তৈরি করে দিলেন। কিন্তু এবার ঘটল অন্য ঘটনা। যখন ভক্ত রঘু আচ্ছাদনটা টেনে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলেন, তখন শ্রীনাথ জগন্নাথ ভক্ত রঘুর সামনে উপস্থিত হলেন। রঘু আনন্দে বিস্ময়ে চিৎকার করে বললেন, “হে মহাপ্রভু জগন্নাথ, হে প্রভু, আপনি আমার মাথায় আচ্ছাদন দিয়েছিলেন, এবার আমি আপনার মাথায় তাহিয়া দিয়ে আবৃত রাখব।” সেই ঘটনার পর থেকে ভক্ত রঘু রত্নসিংহাসনের দেবদেবীদের বিশেষ বিশেষ তিথিতে বিশেষ বিশেষ যাত্রার জন্য তাহিয়ার নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ করতেন। অবশ্য এই কিংবদন্তির আরেকটি রূপে পাওয়া যায়, জগন্নাথ মহাপ্রভু তাঁর অন্যতম প্রিয় সাধকের ভক্তি, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আন্তরিকতা দেখে মুগ্ধ হয়ে স্বয়ং ভক্ত রঘুর সামনে বালগোপাল রূপে উপস্থিত হন। সেখানে বালগোপাল রূপী জগন্নাথ তাঁর ভক্ত রঘুর পিছনে ছাতা ধরে অলক্ষ্য পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন। জগন্নাথের বালগোপাল সম বিগ্রহ এখনও ওড়িশার কিছু ঘরে দেখা যায়। এই ঘটনার পর থেকে ভক্ত রঘু আষাঢ়ের দিব্যরথযাত্রার সময় জগন্নাথের সজ্জা সংক্রান্ত তাহিয়া সরবরাহ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তাঁর প্রিয়ধন জগন্নাথকে।

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

Bengali Article 2023 | দুর্গা পূজার কথকতা | প্রবন্ধ ২০২৩

Advantages & Disadvantages of Tattoo | ট্যাটুর উপকারিতা এবং অপকারিতা | Bengali Article 2023

Is it possible to remove tattoo | ট্যাটু রিমুভ কি সম্ভব? | 2023

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Tahiya lagi besha | Tahiya lagi besha bengali article | Tahiya lagi besha article download | Tahiya lagi besha pdf | Tahiya lagi besha journal download | new article – Tahiya lagi besha | trending article – Tahiya lagi besha | Tahiya lagi besha viral article | Tahiya lagi besha trending pdf | news – Legend of Jagannath | read article – Tahiya lagi besha | top article – Tahiya lagi besha | Legend of Jagannath web story | Shabdodweep Founder | Shabdodweep Web Magazine

Leave a Comment