Pancha Byanjan Galpo | পঞ্চব্যঞ্জন পর্ব ২ | জয়ন্ত কুমার সরকার | Top New 2023

Sharing Is Caring:

পঞ্চব্যঞ্জন (পর্ব ২) – জয়ন্ত কুমার সরকার [Pancha Byanjan Galpo]

(১) পাদুকা পুরাণ

মানুষের পদযুগলের নিরাপত্তার জন্য জুতোর উদ্ভাবন হলেও বর্তমানে এটি একটি অপরিহার্য্য সামগ্রী, ফ্যাশনও বটে। বেশ কয়েক শতক আগে কাঠের তৈরি খড়ম আমাদের ভারতবর্ষে জনপ্রিয় ছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সেই জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখে কল্পনায় হবুচন্দ্র-গবুচন্দ্রের কৌতুক মিশ্রিত জুতো আবিষ্কারের গল্প শুনিয়েছেন কবিতায়। পায়ে ধূলা-কাদা লেগে পদযুগল নোংরা হওয়া বন্ধের সমাধান না পেয়ে অস্থির রাজা হবুচন্দ্র সারা রাজ্য তোলপাড় করেন, সাগরেদ মন্ত্রী গবুচন্দ্র রাজার ভালোমানুষির সুযোগ নিয়ে অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করতে থাকেন। সারা দেশের ধুলো সাফ করার জন্য কয়েক লক্ষ ঝাঁটা ক্রয়, ধুলো সাফ করার মজুরী কয়েক লক্ষ টাকা, ধুলো নাকে ঢুকে নি:শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা দূর করতে কয়েক মণ নস্য ক্রয় করা, এসব নানান আজগুবি কারণ আর তার জন্য রাজকোষের অর্থ ব্যয় করিয়ে নিজে আত্মসাৎ করার চক্রান্ত চলতে থাকে মন্ত্রী গবুচন্দ্রের সুচারু চুরিবিদ্যার দক্ষতায়। রাজা যখন সব জানতে পারেন, মন্ত্রীকে শূলে চড়াবার আদেশ দিতে উদ্যত হন। সেইসময় এক দরিদ্র বৃদ্ধ চর্মকার রাজদরবারে এসে চামড়ার তৈরি দুই পাদুকায় রাজার পা ঢাকার ব্যবস্থা করেন; চামড়ার তৈরি এই বস্তুটিই আজকের জুতো । আমাদের রামায়ণে পাদুকার ঐতিহ্য স্মরণে আসে, বনবাস আটকাতে না পেরে অগ্রজ রামচন্দ্রের পাদুকাদ্বয় অযোধ্যার সিংহাসনে বসিয়ে রাজ্য পরিচালনা করতেন ভ্রাতৃভক্ত মধ্যম ভ্রাতা ভরত। সভ্যতার বিকাশের সাথে জুতোরও আধুনিকীকরণ হয়েছে। জুতো নিয়ে হাস্যরসাত্মক মজার পর্ব চলে বিয়ে বাড়ির পরিবেশকে আপ্লুত করে; বরের জুতো লুকিয়ে কন্যাপক্ষের ছেলেমেয়েরা মজাদার রঙ্গে লিপ্ত হয়। পা-এর নিচে থাকে বলে ফ্যাশানের আভিজাত্যে এখন আর অবহেলিত নয় পাদুকা মহাশয় । জুতো পালিশ-মেরামতির সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা আমাদের কত বড় সমাজবন্ধু তা অনুভব করা যায় যখন হন্যে হয়ে একটাও জুতো সেলাইয়ের দোকান খুঁজে না পাই ! তখনকার কাঠের খড়ম, কাঠের জুতো, গাছের ছাল দিয়ে তৈরি পাদুকা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এখন লেদার,ফোম, কাঠ, পেট্রোকেমিক্যাল দ্রব্যে সজ্জিত রঙিন ও সুদৃশ্য নানান মডেলের জুতো বাজার মাত করছে অনলাইন-অফলাইনে। পাদুকা পুরাণ তাই বিবর্তিত জুতোর আধুনিক উপাখ্যানও বটে ।

(২) অন্তরতর হে

অন্তরের প্রিয়তম মানুষটির প্রতি সুগভীর চেতনায় জাগ্রত ভালবাসার প্রকাশ কবিগুরুর গানে ছন্দে আমরা যেভাবে পাই, অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে খুঁজে পাওয়া যায় না । প্রিয়জনের প্রতি একান্ত ভালবাসার প্রকাশ কবির বিভিন্ন কবিতায় বিভিন্ন গানে, আমাদের বেদনাহত করে, বিমুগ্ধ করে, চেতনাকে নির্মল করে, জাগ্রত করে, সুন্দর করে; ‘‘অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে…নির্মল করো, উজ্জ্বল করো, সুন্দর করো হে…” কবির কবিতায় আর গানে মুগ্ধ আমরাও খুঁজে ফিরি নিজেদের মাঝে সেই আপন মানুষটিকে । সেই প্রিয় মানুষটি কখনো স্ত্রী, কখনো প্রেমিকা, কখনো মাতা, কন্যা বা ভগিনী! স্বপনে মননে আমরা পালন করি আত্মার আত্মীয়কে, নীরবে নিভৃতে আমাদের শিক্ষায়-চিন্তায়-রুচিতে–সাহিত্যে-গল্পে-গানে-কবিতায় ছড়িয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ । বাঙালী জীবনের পথ প্রদর্শক-দার্শনিক-সাহিত্যিক-কবি একজনই যিনি জীবনকে গতিময় করতে পারেন, সঠিক দিশা, নতুন প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে পারেন, আধমরাদের ঘা মেরে নতুন করে বাঁচতে শেখাতে পারেন, তিনি একম্-অদ্বিতীয়ম রবিঠাকুর, যিনি জন্মের সার্ধশতবর্ষ পরেও আজও সমান প্রাসঙ্গিক । রবীন্দ্রনাথকে চেনে না এমন বাঙালী যেমন খুঁজে পাওয়া ভার, তেমনই রবীন্দ্রসঙ্গীত ভালবাসেন না এমন বাঙালীও পাওয়া যাবে না,.শুধু বাংলা নয় দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও যাঁর স্বচ্ছন্দ আনাগোনা…এটা আমার বিশ্বাস, যাঁর অজস্র কবিতা আর গানে মুগ্ধ আসমুদ্র-হিমাচল বাঙালীর মন..প্রাণ; যিনি মানব-মানবীর প্রেমকে রঙিন আলোয় দেখতে শিখিয়েছেন, অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোকের ঝর্ণাধারায় স্নান করিয়েছেন, রাঙিয়ে দিয়েছেন মানবজমিনকে তার আপন মহিমায়। শতকোটী প্রণামও শ্রদ্ধা সেই বিশ্ববিশ্রুত কবির প্রতি….আমার…সমগ্র বাঙালীর ।

Pancha Byanjan Galpo

(৩) প্রথম দেখা নাটক, সিনেমা বা যাত্রাপালা

ও বাবুমশাই, এখন আমি কি শোনাই..। এখনও রেডিওতে শুনলে কিম্বা টিভি সিরিয়ালে অরিন্দম গাঙ্গুলীকে দেখলে একতারা হাতে নেচে নেচে বাঙলার বাউলের চিরন্তন লোকগানের মনের ক্যানভাসে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। গ্রামবাংলার একেবারে নিজস্ব সংস্কৃতির লোকগান নিয়ে বাংলা ছায়াছবি হংসরাজই আমার প্রথম দেখা সিনেমা; তখন ১৯৭৬ সাল, আমি ১১ বছর, ক্লাস ফাইভের কিশোর। আমার শহর বিষ্ণুপুরে থিয়েটার হল তো ছিল না, সিনেমা হল ছিল তিনটে । টিকিট করে যাত্রাপালা হলেও সাধ্যে কুলোত না সবার ; তাই সস্তায় বিনোদন ছিল ঐ সিনেমা । কিন্তু ঐ বয়সে সিনেমা দেখার দু:সাহস তখন ছিল না। সিনেমাটা রিলিজের পর গানগুলো মাইকে বাজলে খুব মন টানত। মিলনশ্রী সিনেমা হলে ছবিটা আসতেই হংসরাজ দেখার জন্য মায়ের কাছে বায়নাক্কা শুরু করলাম । শেষে, আমার তুতোদাদা কাম বন্ধু নিমাইদার মধ্যস্থতায় অনুমতি মিলল, সঙ্গে ৫০ পয়সা করে টিকিটের দামও। সেই প্রথম সিনেমা হলে যাওয়া ; লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট ব্ল্যাক করাও তখন প্রথম দেখলাম। টিকিটের লাইনে অন্য অনেককে গায়ের জোরে টপকে কাউন্টারে টিকিট সংগ্রহ করে বাইরে বেশি দামে বিক্রি করাই ব্লাকারদের পেশা ছিল। সেদিন ব্লাকারদের এড়িয়ে ঐ দাদার পরিচিতির সৌজন্যে সিনেমাহলেরে এক কর্মীর কাছ থেকে কোনভাবে টিকিট সংগ্রহ করে হংসরাজ সিনেমার পর্দায় দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সে কি রোমাঞ্চকর উন্মাদনা! বাউল বেশে হংসরাজ অরিন্দম গাঙ্গুলীর মনমাতানো বাউল গান! সঙ্গে নোলক পরা কিশোরী টিয়ার বাঁকা চোখের বিস্ময়ভরা চাউনি! উঃ! তখন কিশোর বয়সে কি ভালই যে লেগেছিল, যেমন গান তেমন সারল্যে ভরা সাবলীল অভিনয়। অনেক পরে জেনেছিলাম গানগুলো অরিন্দমের নিজের কণ্ঠের নয়, সঙ্গীত শিল্পী আরতি মুখোপাধ্যায়ের সুরেলা কষ্ঠের গান। বাউলগানকে এত সুন্দর ও জনপ্রিয় করে ব্যবহার করা হংসরাজই প্রথম মিউজিক্যাল ছবি, বোধহয় শেষ ছবিও।

(৪) বাড়ী থেকে পালিয়ে

বাড়ী থেকে পালানোর সময় কিশোর মানসিকতায় কি ভীষণ আবেগ কাজ করে, বুঝতে পারি; হয়তো বাড়ীতে সর্বদাই বকাঝকা খায় অথবা পড়ার চাপ কিম্বা পরীক্ষায় ফেল; বদ অভ্যাসে লিপ্ত হতে দেখলে বাবা-মা বকতেই পারেন, রাগ করে না খাওয়া, উপহারের জন্য বায়না, এসব চলতে পারে, কিন্তু তাই বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া! অনেক সময় ভালবাসা না পেয়ে অভিমান বাসা বাঁধে বুকে, কিশোর মন বড় অভিমানী, আবেগে হৃদয় পরিপূর্ণ, তাই বাড়ি থেকে পালিয়ে শাস্তি দিতে চায় আমাদের আদরের ছেলেমেয়েরা। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ যে বাবা-মায়ের আদর, বুঝতেই পারে না ধেড়ে খোকারা; আমার ছেলেবেলায় স্কুল পালিয়ে কয়েকটা ছেলে সিনেমায় চলে যেত প্রায়ই। অন্য রকম ভাবনায় কিশোর বয়সে বাড়ি থেকে পালানোর কথাও জানি আমরা। সংসার ছেড়ে সিদ্ধার্থ সন্ন্যাস নেন, নেতাজী সুভাষ, স্বামী বিবেকানন্দ, শ্রীচৈতন্যদেব, এঁরা যুগপুরুষ, গৃহত্যাগ করেছেন বৃহৎ স্বার্থে, দেশ ও দশের সেবায়। বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে, এখন হামেশাই ঘটছে। আমারই একজন মহিলা সহকর্মী, ডাইং-ইন-হারনেসে স্বামীর চাকরী করছেন। ছেলেমেয়েকে বহু কষ্টে বড় করেছেন; মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছিল, কিন্তু সে বিয়ে সুখের না হওয়ায় এখন ডিভোর্স হয়ে মায়ের আশ্রয়ে, অসুস্থ ছেলে, খরচবহুল চিকিৎসায় আপাত সুস্থ; এই ছেলেটিই হঠাৎ বাড়ি থেকে উধাও, মেয়েটি পাশের গ্রামের; এখনও আঠারো পূর্ণ হয়নি। সময়টা বয়:সন্ধির,অপরিণত বুদ্ধি, পরিণাম সম্পর্কে কোন ধারণাই তৈরি হয়নি। হাতে হাতে এখন ঘুরছে মুঠোফোন, কথা-ছবি নিমেষে এধার-ওধার হয়; মোবাইল যেমন বন্ধু তেমনই বিপথে চালিত করার জন্য এখন একটা মোবাইল ফোনই যথেষ্ট। বাড়ি পালানোর ভুল বুঝতে পেরে কেউ ফিরে আসে, কাউকে বাবা-মা ফিরিয়ে আনেন, সব দোষ ক্ষমা করে দিয়ে; স্নেহ অতি বিষম বস্তু যে !

(৫) কৃতজ্ঞতাবোধ

শৈশব পেরিয়ে কৈশোর তারপর যৌবন –মানুষের জীবনের এই ধাপগুলো পেরিয়ে আসতে গর্ভধারিণী মা, জন্মদাতা পিতা ছাড়াও দাদা-দিদি-কাকা-পিসি-দাদু-ঠাকুমা, এরকম আত্মীয়ের কিছু না কিছু অবদান থেকেই থাকে। এঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ ক্রমশ: তৈরি হয়, কাউকে শেখাতে হয় না। কিন্তু মনের গঠন সবার সমান হয় না। কেউ সামান্যতম সাহায্যও মনে রাখে সারাজীবন, কেউ পিতা-মাতার ঋণও ভুলে যায়। তাই বার্ধক্যে বৃদ্ধাশ্রম হয় তাঁদের শেষ ঠিকানা। যতই সাংসারিক চাপ থাকুক, এত কৃতঘ্ন হই কি করে আমরা। বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের শিক্ষাই শিশুর মনে কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরি হয়। যাঁদের হাত ধরে হাঁটতে শিখি, যাঁদের স্নেহের পরশে আমরা লালিত হই, যাঁরা বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ তো আসবেই, এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বাবা-মা ছাড়াও যে শিক্ষকের কাছে আমরা লিখতে-পড়তে শিখি, যিনি নিজের জ্ঞান ভাণ্ডার উজাড় করে জীবনের অভিজ্ঞতায় আমাদের জারিত করেন, তাদের প্রত্যেকের কাছেই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হয়। মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয়ে কেউ কেউ ভাবেন এটা আর এমন কি, ও তো সবাই করে। কিন্তু সত্যি কি তাই! বাবা-মা জীবনের সব কিছু নিঙড়ে দিয়ে নিজে নি:শেষ হয়ে সন্তানকে বড় করেন। এ কথা তো নতুন করে বলার নয় ; আমি আমার বাবা-মায়ের মতই আমার শিক্ষকদেরও সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, তাঁদের সামনে মাথা নত হয়ে আসে আজও। এ কৃতজ্ঞতা আমাদের রক্তে মজ্জায় লালিত হয়; আমার জীবনে প্রতিষ্ঠার পিছনে এরকম একজন টাইপ-স্টেনো শিক্ষকের অবদান আমি ভুলতে পারি না, আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে,আজীবন। এই সব নমস্য মানুষজন অবহেলিত হলে বিবেকের দংশনে নিজে ক্ষতবিক্ষত হই, এটাই কৃতজ্ঞতা বোধ। এ বোধ মানুষের মনে মূল্যবোধ জাগরিত করে,যে বোধ জীবনপ্রবাহকে সঠিক পথ দেখায়।

(৬) রসিক বাঙালি

রসিক বাঙালির রসের ফল্গুধারা বইত তখন বাঙালি আড্ডার অন্দরমহলে। পাড়ার ফাংশানে হাসির চুটকি পরিবেশন তখন বেশ জনপ্রিয় ছিল। হত কবিগানের লড়াইও। সিনেমায় কবিগানের লড়াইয়ে অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’র উত্তমকুমার, গল্প হলেও সত্যি’র রবি ঘোষ কিম্বা রসরাজ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত সংলাপের নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হন না এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া ভার। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে মাসিমা মালপো খামু কথাটা তো মিথ হয়ে আছে রসিক বাঙালি হৃদয়ে। সাহিত্যেও রসিকজন কম নেই, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা, টেনিদা আর রসিকরাজ শিবরাম চক্রবর্তী কিম্বা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের লোটাকম্বল পড়তে বসলে হাসির চোটে দম আটকে যায় আমার এখনও। সুকুমার রায়ের হ-য-ব-র-ল, আবোলতাবোল তো কিশোর সাহিত্যের মাইলস্টোন। আগের দিনে মাইকে হাসির ফুলঝুরি উড়ত মণ্ডপে মণ্ডপে। পুজোর অলস দুপুরে গোলটেবিল বসত আমাদের প্যাণ্ডেলে। তখন হাসির রাজা উত্তম দাসের চুটকি শুনতাম দলবেঁধে, নির্মল হাসির জোয়ারে ভেসে যেতাম আমরা। এখন আর সেদিন নেই। রসিক বাঙালি যেন হাসতেই ভুলে গেছেন। গ্রামে চণ্ডীমণ্ডপের ঠেক নেই, শহরে রকের আড্ডা নেই, কফিহাউস উধাও, চায়ের টেবিলে তর্কের তুফানও ওঠে না। এখন মুঠোয় ফোন নিয়ে পাঁচজন বসলেও আড্ডা আর তেমন জমে না। ফোনের নেশায় বুঁদ হওয়ার দু-একটা মজার ঘটনা শুনুন। ছেলেদের পাল্লায় পড়ে আপনভোলা গাবলুদার হাতে এখন সর্বদাই মুঠোফোন। সেদিন বিকেলে বেড়িয়ে ফিরছেন, মোবাইল হাতে ফেসবুকে আত্মহারা গাবলুদা দরজা ভুলে ঢুকে পড়লেন বিট্টুদের বাড়িতে। বাড়ির বৈঠকখানায় রাখা ফাঁকা চেয়ারে বুঁদ হয়ে সার্ফ করে চলেছেন। একটু পরেই….মোবাইল কানে বাড়ীর আধুনিকা বউ বিট্টুর মেজবৌদি এক কাপ চা নামিয়ে চলে গেলেন…যেন বাড়ীর কর্তা গাবলুদা । কানে হেডফোন পাকামাথা একজন হুট্ করে ঘরে ঢুকেই, ভুল….ভুল….সব ভুল….. বলতে বলতে বেরিয়ে গেলেন ! বিট্টু তো থ !

(৭) আমার সেই বেলাটা

এই সুন্দর পৃথিবীতে অমর কেউ নই আমরা। একদিন হঠাৎ করেই যাবার ডাক আসে। তাই বেলা শেষে মনে হয়, কি করলাম সারাজীবন, কত কি তো করা হল না। মনে হয় যদি আর একবার বাঁচি, ফিরে পাই আমার সেই বেলাটা। আরও যত্ন নিয়ে পড়াশোনা করতাম। আরও ভাল চাকরি, আরও আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার চেষ্টা করতাম। সফল হতাম কিনা জানি না। মনে পড়ে কত কি! স্মৃতিপটে উকি দেয় নানান ঘটনা। আমাদের ভাল রাখতে গিয়ে বাবা কতটা ত্যাগ করেছেন তখন বুঝতাম না, অন্য সহপাঠীদের বৈভব দেখে মনঃক্ষুন্ন হতাম, বাবার কৃচ্ছসাধন অনুভব করতে পারতাম না। মায়ের কষ্ট খারাপ লাগত, কিন্তু সবটা অনুভূতিতে আসত না। ছেলেবেলায় রুগ্ন ছিলাম বলে মা আমাকে বেশি যত্ন করতেন। মায়ের স্নেহের মূল্য তখন বুঝতাম না, সামান্য কারণে রেগে গিয়ে মাকে কষ্ট দিয়েছি। এখন সব বুঝি, কিন্তু কিছু করার নেই, মা তো নেই! সংসার বড় কঠিন ঠাঁই। পরিবারের সকলকে ভাল রাখা এক বিষম দায়। বাবা কেন নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে দিতেন এখন বুঝতে পারি। আমি চাকরি পেলাম, কিন্তু জীবন শুরুর আগেই বাবা চলে গেলেন। পরিবারকে সামলাতে গিয়ে মায়ের যত্ন যতটা নেওয়ার দরকার ছিল ততটা পারিনি। মা আমার অসহায়ত্ব বুঝতে পারতেন না। তখন মনে হত কি জন্য সংসার, কাউকেই খুশি করতে পারছি না! আর্থিক স্বচ্ছলতা জীবনের অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। দু-একজন বন্ধু, ছেলেবেলার সঙ্গী খুব কষ্ট আছে, ওদের একটু সাহায্য করতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু পারি না। তাই, আরও ভাল পড়াশোনা করে ভাল চাকরি, আর্থিক স্বচ্ছলতা অর্জন করতে পারলে খুশি হতাম। আমি সেটাই চাইব, যদি আর একবার বাঁচি, যদি ফিরে পাই আমার সেই বেলাটা, তবে বেশ হয়!

(৮) আমার সাধ না পুরিল

আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি, কেউ বাড়ির স্বপ্ন, কেউ গাড়ির, ছাত্ররা ভাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নই সফল হওয়ার পথ দেখায়, যে স্বপ্ন দেখতে জানে না সে সফলতার পথ খুঁজে পায় না। স্বপ্ন দেখা অন্যায় নয় তবে স্বপ্নের সঙ্গে বাস্তবতার তফাৎ বুঝতে পারাটা জরুরি। সাধ আকাশছোঁয়া আর সাধ্যের পরিসর ছোট হলে ব্যর্থতার গ্লানি জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে। মাসমাইনে যাঁদের ভরসা, মেপে খরচ করলে বিপাকে পড়তে হয় না। কিছু মানুষ ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ মানেন, ঋণ করেও ঘি খাওয়ার পক্ষপাতি তারা। কিছু মানুষ ভীষণ কৃপণ। আগামী দিনের চিন্তাই বেশি কৃপণ করে তোলে ওদের। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমানকে অস্বীকার করলে বোকামি হয়ে যায়। এখন ভালভাবে বাঁচলে তবেই তো ভবিষ্যৎ, নইলে কৃপণতা এমন জায়গায় পৌঁছায় যে টাকা জমানোর নেশায় ভাল খাওয়া-দাওয়া তো দুরস্ত চিকিৎসা না করিয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে দিন পার আর টাকার পাহাড় আঁকড়ে পাহারা দেওয়া, ব্যস, ওভাবেই জীবন শেষ! আগের দিনে, আমাদের সেই বেলাটায়, পুজোয় একটা নতুন জামাপ্যান্টের জন্য মুখিয়ে থাকতাম। আমরা দোকানে যেতাম না, বাবা-ই পছন্দ করে কিনে আনতেন, কারণ সাধ জাগলেই তো হবে না, সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে হবে তো! সন্তানের সাধ পূরণ করতে না পারলে মায়ের অসহায় মুখ, সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে না পারলে বাবার মানসিক বেদনা আগে বুঝতে পারতাম না, এখন বুঝি। সন্তানের আবদার মেনে নিতে গিয়ে ঋণের পরিমাণ মাত্রা না ছাড়ায় সেটাও দেখতে হয়। মনে হয় এটা অন্যায় আবদার, মেনে নেওয়া উচিত নয়, কিন্তু ঐ, স্নেহ অতি বিষয় বস্তু যে! পান্নালাল ভট্টাচার্যের সেই গান, চিরদিনের সেই সুরটা মনে আসে, আমার সাধ না পুরিল, আশা না মিটিল, সকলই ফুরায়ে যায় মা……কি আকুতি, কি বিনম্র সমর্পণ শিল্পীর কণ্ঠে! এখন হয়েছে আর এক মুশকিল, অনলাইন শপিং,পাওয়া যায় না বলে কোন কথাই হয় না। যা পছন্দ তাই পেতে মন চায়। তাই যদি কঠোর হতে না পারেন, স্নেহের দোহাই দিয়ে ছাড় পাবেন না কিন্তু, সাধ পূরণ করতে গিয়ে অসাধ্যসাধন করবেন না যেন!

(৯) আয় খুকু আয়

আমার দিদির ডাকনাম খুকু ছিল। বিয়ের মাস ছয়েকের মধ্যেই দিদিকে হারিয়েছিলাম সেই ছোট্টবেলায়। দিদির আকস্মিক চলে যাওয়ায় বাবা-মার বুকফাটা কান্না শুনে মনটা হাঁকপাঁক করত, কিন্তু কাঁদতে পারতাম না। একই দিনে বিয়ে হয়েছিল, দিদির ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল পুটুদির। সেবার পুজোর সময় পুঁটুদি বাপের বাড়ি এল, আমি তখন খুব ছোট, রাস্তায় পুটুদিকে আসতে দেখে বাড়ি এসে মাকে বলেছিলাম, মা পুটুদি এল, দিদি আসবে না? আমাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের সেই বুকফাটা কান্না আজও মন বিচলিত করে। তখনকার আদরের ডাকনাম মিঠি, বুড়ি, টুকটুকি, বুল্টি এখন আর শোনা যায় না। এখন রিমলি, ঝিমলি, ঐশী, পিউ…… যে নামেই ডাকি না কেন, আদরের তো কোন হেরফের হয় না আমাদের কন্যেদের। নামে কিবা আসে যায় বলি আমরা, কিন্তু বড় হয়ে যখন বুঝতে শেখে, যখন সহপাঠিনীর নাম যদি তার পছন্দের মনে হয়, তখনই হয় বিভ্রাট। অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে আদরের কন্যেটি তখন বলে,আমার নাম এরকম পঁচা কেন! বাবা, আমাকে একদম ঘেঁটি বলে ডাকবে না, লজ্জা করে না আমার! শৈশবে আমার কন্যে বেশ হৃষ্টপুষ্ট ফর্সা টুকটুকে ছিল, ছিঁচকাঁদুনে ছিল না মোটেই, হাত বাড়ালেই সবার কোলে চলে যেত স্বচ্ছন্দে। অন্য খাবার নয়, শৈশবের অনেকটা সময় ও শুধু দুধই খেয়েছে, ফিডিং বোতল মুখে দিব্যি শুয়ে থাকত,কোন বায়নাক্কা ছিল না আমার ছোট্ট খুকুর। আদরের ছোট্ট সোনাকে বুকে নিয়েই ওর মা’র দিন কাটত, অন্যত্র চাকরির সূত্রে আমি সময় কম পেয়েছি, কিন্তু বাৎসল্য স্নেহ অন্তঃসলিলা যে! অনেক সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছি ওকে নিয়ে, মনে হয় সোনালী সেই সব দিনগুলি যদি আবার ফিরে পেতাম। আমার খুকুর শৈশবের সময়টা সুখের ছিল না আমাদের, সাংসারিক বিপর্যয়ের কারণে। তাই, ডাকনাম আর রাখা হয় নি, কিন্তু আদরের কোন ঘাটতি হয় নি কোনদিন। এখন আমাদের খুকু, পায়েল বড় হয়েছে, বিয়ের পর ঘোর সংসারী। না, নাম নিয়ে ওর কোন অভিযোগ নেই। আমাদের সব খুকুরা যেন আদর পায় বাবা-মা’র, দীর্ঘজীবী হোক খুকুরা, প্রার্থনা জানাই।

(১০) রিমঝিম বর্ষায় একদিন

বর্ষার এক দিনান্তে সূর্য যখন অস্তাচলে, ধূসর মেঘলা আকাশ একটু একটু করে তমসার নিভৃত আভরণে ঢাকা পড়ে, একফালি বাঁকা চাঁদ মেঘের কোলে মুখ লুকিয়ে হাসে, তখন আমি ছাদের উপরে,বিশাল আকাশের নিচে অনুভব করি নিজেকে। হঠাৎ বৃষ্টির ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরে পেলাম। আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। মর্ণিংওয়াকে মাঝপথে তখন, শুরু হল রিমঝিম বৃষ্টি, শ্রাবণের অঝোর ধারায় স্নাত হয়ে দ্রুতবেগে হাঁটছি, কাছেপিঠে কিচ্ছুটি নেই। ভিজে জুলুকজুদাঁ হয়ে ফিরলাম বাড়ি। বৃষ্টি ধরবে আশা কম, রেণি-ডে’র ছুটি দিয়ে দিলাম নিজেকে। অফিসে যাচ্ছি না শুনে বাড়িতে আজ খিচুড়ি বসিয়েছে আমার শ্রীময়ী। সঙ্গে ডিমভাজা,পাঁপড় আর বেগুনী।‌ জমবে বেশ! সন্ধে ঘনায়, তখন আমি ছাদে, ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর, কালো সামিয়ানার বুকে মিট মিট হাসে অগণিত তারকা। সৌদামিনির ঝলক চোখ ঝলসায়। কবিগুরুর আষাঢ় মনে পড়ে…”নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে, ওগো তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।” নেমে আসি দোতলায়। জানালার পাশে জলের ছাঁট উপেক্ষা করে দেখি বর্ষা সুন্দরীর অনুপম রূপ, নীচে রাস্তায় বিদ্যুতের আলো ভেদ করে বৃষ্টির সোনালী রেখাগুলো তীরের বেগে নেমে আসছে ধরণীর বুকে, রাস্তার পাশে খড়ের ভাঙা চালাঘরটার নীচে ভিজে সপসপে গরুটা, পাশে বাছুরটার গা চাটে শুকনো করার নেশায়, দুটো শালিক কার্নিশে ভিজে জুবুথুবু, ঝোড়ো কাক দুটো ভিজে একশা, কাকভেজা কুকুর দুটো দোকানের নীচে কান ঝাড়ে; বকুল, নাগচম্পা আর অমলতাস’রা মাথা নুইয়ে বরণ করে নিচ্ছে শ্রাবণের ধারাবরিষণ, জানালার ঠিক নিচেই দোকানঘরের টিনের চালে একটানা ঝমাঝম শব্দ, যেন সেতারে মেঘমল্লারের সুর।

জয়ন্ত কুমার সরকার | Jayanta Kumar Sarkar

Driving Experience Canada 2023 | ড্রাইভিংয়ের যত কেচ্ছা (কানাডা পর্ব – ৯ এবং ১০)

Ananta Bikeler Rupkathara | অনন্ত বিকেলের রূপকথারা | New Bengali Story 2023

Natun Bangla Galpo 2023 | এক জীবন পিপাসা ও এক বিন্দু জল | মনসুর আলি

New Bengali Story 2023 | আঁধার পেরিয়ে (শেষ পর্ব) | গল্প

Pancha Byanjan Galpo | Bangalir Pancha Byanjan Galpo | Pancha Byanjan Galpo 2023 | Bengali story Pancha Byanjan | Pancha Byanjan Galpo pdf | Pancha Byanjan – Bangla Galpo | Pancha Byanjan Galpo – audio | Pancha Byanjan Galpo – video | New Pancha Byanjan Galpo | Shabdodweep Pancha Byanjan Galpo | Pancha Byanjan Galpo – short film | Pancha Byanjan movie download | Short film Pancha Byanjan | Pancha Byanjan in India | Pancha Byanjan Restaurant | Pancha Byanjan in USA | Pancha Byanjan in Bangladesh | Top story – Pancha Byanjan Galpo | Web series – Pancha Byanjan Galpo | Pancha Byanjan Galpo in Netflix | Shabdoweep Founder | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Writer

Leave a Comment