কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা – সূচিপত্র [Bengali Story]
এসো করুণা ধারায় [Bengali Story]
পৌষ মাসের ভোর বেলা। পাখ পাখালির ডানায় তখনও পুব আকাশের আলোর ছোঁয়া না লাগলেও তারা ভোরের খবর পেয়েছে। মানুষের গেরস্থালীর নীরবতা না ভাঙলে কী! মঙ্গলার মা ঠিক উঠে পড়ে। সে জানে তার সঙ্গী, ও পাড়ার হাঁসার বউ এতক্ষণে ভুলো মোড়লের চা দোকানের বাঁশের মাচায় এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। আজকের রাতে ছিল গভীর কুয়াশা। শীত একটু কম হলেও পথে একটু দূরের মানুষ দেখা যায় না। যদিও মানুষের সমাগম এই মুহূর্তে নেই। মঙ্গলার মা তার সংসারে সকালের জল ছড়া, এক চিলতে উঠোন ঝাট দিয়ে এক বালতি হালকা গরম জলে চান সারে । ছোট মেয়ে মিনতি গরম জলের ব্যবস্থা করে দেয়, শীতের দাপট একটু বেশি বলে। তার বর মন্মথ আজকাল আর কাজে যেতে পারে না। সেই ভোরে উঠে যোগাড়ের কাজে যেত, মঙ্গলার মা কেটলিতে পান্তা এবং প্রয়োজনীয় সব হাতের কাছে গুছিয়ে দিত। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ মাস সে আর বেরোতে অপারগ। সেদিনের সেই দুর্ঘটনার কথা মনে হলে চোখ দিয়ে জল এসে যায় । অন্য সকলের সঙ্গে বেশ উদ্যম নিয়ে সে কাজ করছিল। দু তলা বাড়ির ছাদ দিতে গিয়ে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে, মাথায় সিমেন্ট বালির মিশ্রণ নিয়ে উঠতে গিয়ে পা ফস্কে পড়ে গিয়ে একটা পা পঙ্গু করে ফেলেছে।
সেদিনের হঠাৎ বিপদের কথা কল্পনা করলেও মঙ্গলার মা আঁতকে ওঠে। বড় মেয়ে মঙ্গলার বিয়ে দেওয়ার পর, সংসারটা একটু থিতু অবস্থায় আসার মুখে এই বিপদ। নিজের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, গায়ের চাদর জড়িয়ে মিনতিকে সব বুঝিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। তখন মঙ্গলার বাপ মন্মথ অঘোরে ঘুমুচ্ছে, তাদের উঠোনের পেয়ারা গাছে গোটা চারেক বুলবুলি পাখি জানান দেয়, আর একটা সকাল ভোরের কুসুম ফুটে বেরিয়ে আসছে। তাদের এই মশামারী গ্রাম থেকে কুলপি রেল স্টেশন হেঁটে যেতে প্রায় আধা ঘন্টা। হাঁসার বউ মাঝের পাড়া থেকে এসে, ঝুঁজকো অন্ধকারে গুটি সুটি হয়ে নিত্যদিনের মত বসে ছিল, সঙ্গীর ডাক শুনে পথে নামে। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তায় বাতি স্তম্ভের আলো জ্বলে। গ্রামে এখন শহুরে ছোঁয়া। বিকেল চারটে থেকে আলো জ্বালা, নেভে সেই পরদিন সকাল সাতটা। মহার্ঘ্য কয়লা পুড়িয়ে অন্ধকার মুছে ফেলার অদ্ভুত এক বদ অভ্যাস।
শীতের সকালে সূর্যের মুখ একটু দেরীতে দেখা যায়। নামখানা শিয়ালদা আপ ট্রেন কুলপী স্টেশনে পৌঁছনোর পাঁচ ছয় মিনিট আগে ওদের পরিচিত মুখগুলো হাজির হয়। মহিলা কামরার একটা নির্দিষ্ট খোপে এক একটা দল। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পুরুষ, মহিলা, যুবক যুবতী, নাবালক নাবালিকা – সবাই কাজের তাগিদে শহরের বুকে ছড়িয়ে পড়ে রোজ। দিনান্তে ফেরে নিজের কুটিরে। তবে যন্ত্রণাদায়ক রেল যাত্রা, খরচ আর সময়ের সাশ্রয়ের জন্য অনেকে সংসার নিয়ে শহরতলির ভাড়া ঘরে যে কোন উপায়ে মাথা গুঁজে থাকে। তবে মঙ্গলার মায়েদের দল এখনও গ্রামের মায়া কাটাতে পারেনি, নিজেদের অক্ষমতার বা মায়ালু কারণে।
নিয়মিত যেতে যেতে বাঁধাধরা কামরায় উঠেও পরিচয় অপরিচয়ের সব বাধা যায় ঘুচে। সতেজ, মলিন, নিদ্রাহীন সব মুখ সাময়িক প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। গল্পের চুবড়ি যেমন উল্টে ঢেলে দেওয়া হয়, ঝগড়ার থলিও মুখ বন্ধ থাকে না। রেলের কামরা গুলো এমনভাবে দখল হয়ে যায়, নতুন কোন যাত্রী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সহযাত্রীদের আচারে, আচরণে, রসিকতায়, খোলাখুলি যাপনের আলোচনায়। তারপর বারুইপুর এলে যাত্রীদের নামা হয়ে যায় শুরু। গ্রামের নিরীহ গোবেচারা পরিশ্রমী মহিলারা, আস্তে আস্তে এই নিত্যযাত্রার সঙ্গে গা সওয়া হয়ে ক্রমশ ‘স্মার্ট’ হয়ে যায় শহরের ঝকঝকে জীবনকে সামনাসামনি দেখে দেখে, ঠকে ঠকে। কিন্তু মঙ্গলার মা, হাঁসার বউ, মলিনা বৌদি, চৈতালি কাকিমা আর করুণা ঠাকুরমা চেষ্টা করেও এই তিনঘন্টা সময়ের চলতি হাওয়ার পন্থী হতে পারে না। নিজেদের সংসার, সুখ দুঃখ, ভাবনা ভালোবাসা নিয়ে তাদের সময় কাটে। কিন্তু কামরার চেঁচামেচি, হকারের চিৎকার, সব কিছু মিলিয়ে এমন এক শব্দদূষণ, যা সহ্য করার মত অসীম ধৈর্য খুব কম মানুষের আছে।
করুণা ঠাকুরমা যাদবপুরের এক চাকুরে দম্পতির বাড়িতে ডিউটি করে।তাঁদের বাড়ির বয়স্ক কর্তা গিন্নির দেখাশোনা করে সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা । খুব একটা পরিশ্রমের না হলেও নানান কূটকচালি । ওদের বাকি চারজনের প্রত্যেকের চার থেকে পাঁচ বাড়িতে, বাসন মাজা থেকে ঘর মোছা কাপড় কাচা ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ হলেও যন্ত্রের দক্ষতায় চলে পরিশ্রমী দুটো হাত, না হলে খাটুনি পোষায় না। কাজের সময় একদম ঘড়ি ধরে বাঁধা, না হলে সব বাড়ি সামলানো যাবে না। তাই বিশ্রাম বলতে ওই যাওয়া আর আসা, রেলের কামরার কয়েক ঘন্টা । সেই সময়টুকু একটু মানসিক স্থিরতা যেন খুব জরুরি হয়ে পড়লো ওদের। করুণা ঠাকুরমার স্বামী পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন। ছেলে – বউয়ের মোটামুটি সচ্ছল সংসার । নাতিপুতি খুব একটা পছন্দ করে না কপালে তিলক কাটা ঠাকুরমাকে। একসময় করুণা পাড়ার কার্তিক মাসের সংকীর্তনের দলে মন্দিরা বাজিয়ে গান করতো, সে অভ্যেস আজও আছে। তাই তার মনে এলো, এই যাওয়া আসার সময়টা কজনে মিলে গান গাইলে তো সময় কাটে! একদিন দলের বাকিদের কাছে কথাটা পাড়ে। ওরা হাসাহাসি করে, তাই হয় নাকি! সকলের সামনে গান গাইতে তো লজ্জা করবে, আর সেই সুর তো নেই, গানও জানা নেই। ‘কেন লজ্জা করবে ! দেখছিস না , ছোট থেকে বড় কী নোংরা কথা বার্তা বলে, গাড়ি ভর্তি লোকের সামনে, ওদের তো লজ্জা করে না !’ – করুণা ঠাকুরমার কথা । যুক্তি আছে বটে, নিত্য যাত্রার যাত্রীরা দু কান ভরে কত কথা শোনে, কত কথা বলে । শ্লীল অশ্লীল কথার শতকরা হিসেবে করা যাবে না !
একদিন যায়, দু দিন যায় ওরা পাঁচজন গান গাওয়ার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। নিজেদের সংসারের অভাব ঢাকতে তারা বাবুদের সংসারে কাজের দায়িত্ব নিয়েছে। আবার নিজেদের ঘরে ফিরে যে একটু বিশ্রাম পাবে তার উপায় নেই। অন্ধকার নামলে তারা নিজেদের কুলায় ফেরে, রাতের অন্ধকার থাকতে আবার কলকাতায় পাড়ি। করুণা ঠাকুরমার কথাটা আস্তে আস্তে গভীরতা পায়। সেদিন ওরা পাঁচজন রেলকামরার জানালার কাছে, উভয় পারের সিটে বসলো। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়লে, করুণা ঠাকুরমা ব্যাগ থেকে করতাল দুটো বের করে, দু চোখ বন্ধ করে ধরলো গান, – ‘মা গো আনন্দময়ী নিরানন্দ কোরো না… ‘। মঙ্গলার মা, হাঁসার বউ, মলিনা বৌদি আর চৈতালি কাকিমা লজ্জায় মর মর। অতি কষ্টে দু হাতে তালি বাজিয়ে মিনমিনে গলায় কোরাসে দোয়ারকির ভূমিকা পালন করে। প্রথম দিন মহিলা কামরার সবাই তো হতবাক। মুখচোরা মেয়েগুলো গান গাইছে! কেউ হাসে কেউ রসিকতা করে, কিন্তু করুণা ঠাকুরমার গলায় যেন একটা করুণা ধারার আঁচ পায়। জড়তা না কাটলেও প্রথম গান শেষ হলে ,সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। একরাশ জড়তা, লজ্জার পাহাড় পার হয়ে, দুরু দুরু বক্ষে শুরু হল এক অভিনব চলমান গানের আসর। করুণা ঠাকুরমার গানে উৎসাহিত হয়ে দলের অন্য চার মহিলা বাড়িতে যেটুকু সময় পায়, গুনগুনিয়ে আড়ালে আবডালে অনুশীলন করে। আর মূল গায়িকা করুণাময়ী, পুরনো দিনের গাওয়া গানগুলো নতুন করে স্মৃতির কোষে ধরার চেষ্টা করে। এখন শ্রোতার সংখ্যা আর চাহিদা ঊর্ধ্বগামী।
সেদিন ওদের প্রথম গান ছিল, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে, দে মা চৈতন্যময়ী…।’ মূল গায়িকার চোখে জল, দলের অন্যদেরও। সারা কামরায় সেই গানের সুরে সুরে এক চেতনার স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে। শব্দ হীন যাত্রীর দল। হঠাৎ কামরার শেষ প্রান্ত থেকে জনা পাঁচেক নিত্যযাত্রী যুবতী ওদের কাছে এসে গায়িকাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ইচ্ছে প্রকাশ করে, – ‘ আমরা তোমাদের দলে গান গাইবো।’ – কন্যা – সমা যুবতীদের বুকে জড়িয়ে করুণাময়ীদের চোখে আনন্দাশ্রু, বাকি যাত্রীদের আবেগ তাড়িত করে দেয়।
মঙ্গলার মা, মলিনা বউদিদের বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে ভাবে, – মানুষ এই সামান্য গানের সুরে যদি এত আনন্দ পায়,তাহলে জীবন নিয়ে এত বিবাদ কেন করে ! যাত্রাপথের বাকি সময়ের জন্য ওদের মিলিত কণ্ঠে আবার সুর ঝরে পড়ে – ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের …’। এক স্টেশন থেকে ভোঁ …. শব্দ তুলে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ট্রেন ছেড়ে দেয়।
কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya
Bengali Story 2023 | রূপশঙ্কর আচার্য্য | গল্পগুচ্ছ ২০২৩
Bengali Story 2023 | ইচ্ছাপূরণ | গল্পগুচ্ছ ২০২৩
Bengali Story 2022 | জয়ন্ত কুমার সরকার | গল্পগুচ্ছ ২০২২
Bengali Story | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | গল্পগুচ্ছ | 2022
bengali story | short bengali story analysis | short bengali story characteristics | short bengali story competition | short bengali story definition | Best Bengali Story | Top Bengali Story | World Bengali Story | International Bengali Story | short bengali story english | writing competitions ireland | bengali story writing practice | bengali story writing topics | trending topics for article writing 2022 | bengali story trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Shabdodweep bengali story | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder