Best Bangla Story Archive | Shabdodweep Bangla Galpo

Sharing Is Caring:

জীবন তরঙ্গ – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

জাগ্রত সেই শ্মশান কালী মন্দির। মাসের প্রতি শনি আর মঙ্গলবার , দেবীর কৃপা পেতে মানুষের ভিড় হয়। সারাবছর। পুজো শুরু সেই সকাল থেকে। আসলে পরিবারের নবজাতক সন্তানের সুস্বাস্থ্য আর দুরারোগ্য রোগীর রোগমুক্তি বা আরোগ্য হেতু এই মন্দিরের দেবতার কাছে ‘মুদো’ মানে বা ‘মানত’ মানে আশপাশের ও দূরদূরান্তের গরীব থেকে ধনী মানুষেরা। সেই মানত বা মানসিক অঙ্গীকার পূরণের জন্য প্রতিমা বা ছলন সহ পুজোর ব্যবস্থা।

মন্দিরের পাশের গ্রাম ‘একতারা’র সুমিত্রার মা একদিন তার নাতি গোলকের মানসিক পরিশোধ করতে মন্দিরে এসেছিল। ছাপোষা বীরেন সরদারের বউ ভানুমতী, কিন্তু পাড়ায় বা গ্রামে সে সুমিত্রার মা নামে বিশেষ পরিচিত। তার নামডাক আছে প্রশিক্ষণ নেওয়া ধাত্রী হিসেবে। তো নাতির মাথা ন্যাড়া করে মা কালীর মন্দিরে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা করতে এসে অনেককিছু দেখে নিল। বেশির ভাগ পরিবার থেকে মহিলারা আসে এই থানে।যার জন্য প্রার্থনা হয় দেবীর কাছে, তার করতে হবে মস্তক মুন্ডন। বাচ্চাদের কী কান্না এই ক্রিয়ার কালে। সকল মহিলাদের মধ্যে ভক্তির প্রাবল্য দেখে সুমিত্রার মায়ের মাথায় অনেক বুদ্ধি গেল খেলে। ভাবলো ছোট বড়ো সকলের কপালে যদি ‘ তিলক মাটি ‘র তিলক দেওয়া যায় মন্দ হয় না।অল্প পয়সার বিনিময়ে তা করা সহজ। সে তো জানে হাটে, বাজারে, স্টেশনে ধুতি পরে এক শ্রেণীর মানুষ কপালে তিলক এঁকে দিয়ে কেমন পয়সা চায়! আর যতই দিন যাচ্ছে শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাই যেন দেবতা নির্ভর হয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার বদ্যি হাসপাতাল নার্সিং হোম দিন দিন বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মন্দির আর ঠাকুরের থান। আর সেই থানের দৌলতে চলে ভক্তির বান, পয়সা দিয়ে মাপা হয় ভক্তি আর পুজোর বহর।

মন্দিরের কাছাকাছি গ্রাম হওয়ায় ভানুমতীর সুবিধাই হল। গরীবের সংসারে এখন একটু উন্নতির মুখ দেখেছে , দুই ছেলের পারিশ্রমিকের ওপর ভর করে। তাই বলে সে তো আর বসে থাকতে পারে না। সংসারে বেশি নজর দিতে হয় না, বৌমাদের উপর দায়িত্ব বন্টন হয়েছে।তবে তার সময় বা কোথায়, পাড়া ছেড়ে গ্রাম, গ্রাম ছেড়ে ভিন্ন গ্রামে তার ডাক আসে। যদিও এখন বেশির ভাগ মহিলার প্রসব হয় নার্সিং হোম বা হসপিটালে। কোন কোন বাড়ির অভিভাবক চায় ‘নরমাল ডেলিভারি’। আর তখন ভানুমতীর ‘কল’ আসে।

সেদিন শনিবার। সকালের সাংসারিক কাজ মিটিয়ে স্নান সেরে অভুক্ত ভানুমতী বেরিয়ে পড়ে মা কালীর থানের উদ্দেশে। থানের ব্যাপার, শুচি আর অন্ন গ্রহণ চলে না। হাতের ছোট ব্যাগে করে কপালে ‘তিলোক’ আঁকার সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে দ্রুত বের হয়। বউমাদের কাছে সংসারের সাময়িক দায়িত্ব। ডিসেম্বরের শেষের দিকে এবছর শীত তেমন নেই। বাড়ি থেকে থানে আসতে তার মিনিট পনেরো সময় লাগে। এসে দেখে ভিড় ভালোই জমেছে। পাঁচ থেকে সাতটা ছোট বড়ো গাড়ি রাস্তার ধারে, তাছাড়া বেশ কিছু অটো টোটো হাজির। প্রত্যেক দল গাড়ি নিয়ে আসে। প্রত্যেক দল নিয়ে আসে ঢাকি বা ব্যাঞ্জো পার্টি। গাড়িতে বাজিয়ে এসে থানের সামনেও চলে তাদের বাজনা। ভানুমতী প্রত্যেক দলের ছোট বড়ো সকলের কপালে এঁকে দিচ্ছে তিলক, আর নিচ্ছে মাথা পিছু পঞ্চাশ পয়সা করে। একটা দলের যত সংখ্যক সদস্য তার হিসেব করে পয়সা পাওনা হয়। মোটামুটি কেউ তিলকের ছাপ নিয়ে অস্বীকার করে না। তবে কিছু ছাড় দিতে তো হবে, সকল ক্ষেত্রে যা হয়। এই কাজে ভানুমতীর কী যে ভালো লাগে, তা সে বোঝাতেই পারে না। ভক্তি মনে আর মুখে হাসি নিয়ে তার এই কাজ যেন সকলের পুজো আর প্রার্থনার সঙ্গে দিব্যি মানিয়ে যায়।

সকলের হয়ে যেন ভানুমতী দেবীর কাছে প্রার্থনা করে, তাদের সুস্বাস্থ্য আর সু দিনের জন্য। এরপর কখনও দেখা পাওয়া গেল সে সুন্দর ভক্তি রসের ভঙ্গিমায় ব্যাঞ্জো পার্টির বাজিয়েদের সঙ্গে নৃত্যরত! সবাই হাততালি দিয়ে সংবর্ধিত করে আর অবাক হয়ে দেখে এক উত্তর পঞ্চাশের আটপৌরে মহিলার জীবন তরঙ্গ। বাড়ির কর্তা নাকি মাঝে মাঝে রসিকতা করে বৌমাদের বলে, – মা জননীরা একটু খেয়াল রেখো, পাছে আমি একলা না হয়ে যাই! শুনে সবাই হেসে কুটি কুটি। তবে যাদের হয়ে নৃত্য প্রদর্শন, তারা খুশি করে একশো দুশো দিয়ে দেয় ভানুমতীকে। সব মিলিয়ে মন্দ হয় না সপ্তাহের দুটো দিন। ওইদিন দুপুর গড়িয়ে পড়ন্ত বেলায় ‘মানত’ মানতে যাওয়া এক দলের আমন্ত্রণে তাদের নিয়ে আসা মুড়ি আর ঘুগনি পেট ভরে খেয়ে ঘরে ফিরে দেখে, বাইক নিয়ে দুই যুবক তার অপেক্ষায়। কর্তার হাতে পাওয়া টাকাগুলো দিয়ে বাইক আরোহীদের আগমনের কারণ জানতে পারলো সে।

পাশের গ্রামের আসন্ন প্রসবা এক তরুণী বধূর বাড়ি থেকে ওরা এসেছে। গরীব ঘরের প্রথম সন্তান হতে যাওয়া বধূকে কাছাকাছি দুটো নার্সিং হোম থেকে ফিরে আসতে হয়েছে তাদের নির্ধারিত পরিমাণ টাকা না দিতে পারার জন্য। ভানুমতী আসন্নপ্রসবার পরিস্থিতি শুনে বেশ চিন্তিত। কিন্তু আর কাল বিলম্ব না করে তাদের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। টালির ছাউনি দেওয়া এক ছোট অপরিসর ঘরের তক্তপোষে শুয়ে প্রসব যন্ত্রণায় ছট ফট করছে সেই তরুণী বধূ। চেহারায় দারিদ্রের ছাপ। কীভাবে এগোবে ভানুমতী! তার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় গরম জল, তেল, পরিষ্কার পুরনো কাপড়ের টুকরো ইত্যাদি চেয়ে নিল। বধূকে মেঝেতে নামিয়ে মাদুরের উপর শুইয়ে দিয়ে নিজের কোলে তার মাথাটা নিয়ে সান্ত্বনা দিতে থাকে। সঙ্গে বধূর শাশুড়িকে রেখে দরজা বন্ধ করে দিল। বিকেল নেমে আসছে, ঘরের মধ্যে জ্বলছে একটা বাল্ব। মাঝে মাঝে যন্ত্রণার অভিঘাতে কুঁকড়ে ওঠে বধূ। ভানুমতী বুঝে গেছে এখনও প্রসবের সময় হয়নি। তবে যন্ত্রণা কেন যে এতো আগে শুরু হল সেইটাই বুঝতে পারছে না।

বাড়ির অন্য সব সদস্যরা উদ্বিগ্নতা নিয়ে সেকেন্ড, মিনিট আর ঘণ্টা কাটাচ্ছে। যত সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের প্রহর আসে উদ্বিগ্নতা আতঙ্কের চেহারা নিয়ে হাজির হয়! রাতের রান্না আর খাওয়া আজ বড়ই বেমানান নিত্য দিনের তুলনায়। সেটাই স্বাভাবিক মানুষের সংসারে। সবাই একটা কান্নার শব্দ শোনার জন্য যেন বুকের ধুক পুকুনি বন্ধ করে রাখে। মনে মনে তারা যে কত দেব দেবীর কাছে চলে গিয়ে প্রার্থনা জানায়! কেউ কেউ ভাবে, ডাক্তারের কাছ থেকে ফিরিয়ে এনে কী ভুল হল! ভানু মতির ওপর ভরসা রাখাটা কী ঠিক হচ্ছে। ইতিমধ্যে বধূর বাপের বাড়িতে খবর চলে গেলে প্রায় মাঝ রাতে, বধূর মাকে নিয়ে এলো এক দাদা।

তখন ভোরের আলো প্রায় ফোটে ফোটে। পুব আকাশে শুকতারা আলো ছড়াচ্ছে শেষ শীতের হালকা অন্ধকারে। বন্ধ ঘরের অন্ধকার থেকে তরুণী বধূর প্রসব যন্ত্রণার শব্দ হঠাৎ যেন স্তিমিত। ঘরের বাইরে উৎকর্ণ মানুষেরা নিদ্রাহীন বসে আছে। ভানুমতীর বুঝতে বাকি থাকে না নবজাতকের আসার সময় হয়ে গেছে। তারও যেন বুক বন্ধ শ্বাস অজান্তে বেরিয়ে আসে। পাশে বসে থাকা শাশুড়ি বৌমার যন্ত্রণাবিদ্ধ মুখের দিকে চেয়ে আছে বালবের স্তিমিত আলোতে। ….. তারপর সে এলো, পৃথিবীর মাটি ছুঁয়ে কঁকিয়ে কেঁদে উঠে জানান দিল – আমি এসে গেছি। এই পৃথিবীর আলো বাতাস জলের আমিও এক ভাগীদার। যন্ত্রণাকাতর সদ্য মা, ভূমিষ্ঠ শিশুর মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকে। ঘরের অন্য দুই মহিলার চোখ চিক চিক করে ওঠে। বাইরে ‘ দমবন্ধ ‘ করা মানুষ গুলো স্বস্তি পেল আটচল্লিশ ঘণ্টার স্নায়ু যুদ্ধের পর। তখন পুবের আকাশ আলো ছড়াতে শুরু করেছে।

এসো করুণা ধারায় [Bengali Story]

পৌষ মাসের ভোর বেলা। পাখ পাখালির ডানায় তখনও পুব আকাশের আলোর ছোঁয়া না লাগলেও তারা ভোরের খবর পেয়েছে। মানুষের গেরস্থালীর নীরবতা না ভাঙলে কী! মঙ্গলার মা ঠিক উঠে পড়ে। সে জানে তার সঙ্গী, ও পাড়ার হাঁসার বউ এতক্ষণে ভুলো মোড়লের চা দোকানের বাঁশের মাচায় এসে তার জন্য অপেক্ষা করছে। আজকের রাতে ছিল গভীর কুয়াশা। শীত একটু কম হলেও পথে একটু দূরের মানুষ দেখা যায় না। যদিও মানুষের সমাগম এই মুহূর্তে নেই। মঙ্গলার মা তার সংসারে সকালের জল ছড়া, এক চিলতে উঠোন ঝাট দিয়ে এক বালতি হালকা গরম জলে চান সারে । ছোট মেয়ে মিনতি গরম জলের ব্যবস্থা করে দেয়, শীতের দাপট একটু বেশি বলে। তার বর মন্মথ আজকাল আর কাজে যেতে পারে না। সেই ভোরে উঠে যোগাড়ের কাজে যেত, মঙ্গলার মা কেটলিতে পান্তা এবং প্রয়োজনীয় সব হাতের কাছে গুছিয়ে দিত। কিন্তু দীর্ঘ পাঁচ মাস সে আর বেরোতে অপারগ। সেদিনের সেই দুর্ঘটনার কথা মনে হলে চোখ দিয়ে জল এসে যায় । অন্য সকলের সঙ্গে বেশ উদ্যম নিয়ে সে কাজ করছিল। দু তলা বাড়ির ছাদ দিতে গিয়ে বাঁশের সিঁড়ি বেয়ে, মাথায় সিমেন্ট বালির মিশ্রণ নিয়ে উঠতে গিয়ে পা ফস্কে পড়ে গিয়ে একটা পা পঙ্গু করে ফেলেছে।


সেদিনের হঠাৎ বিপদের কথা কল্পনা করলেও মঙ্গলার মা আঁতকে ওঠে। বড় মেয়ে মঙ্গলার বিয়ে দেওয়ার পর, সংসারটা একটু থিতু অবস্থায় আসার মুখে এই বিপদ। নিজের কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে, গায়ের চাদর জড়িয়ে মিনতিকে সব বুঝিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। তখন মঙ্গলার বাপ মন্মথ অঘোরে ঘুমুচ্ছে, তাদের উঠোনের পেয়ারা গাছে গোটা চারেক বুলবুলি পাখি জানান দেয়, আর একটা সকাল ভোরের কুসুম ফুটে বেরিয়ে আসছে। তাদের এই মশামারী গ্রাম থেকে কুলপি রেল স্টেশন হেঁটে যেতে প্রায় আধা ঘন্টা। হাঁসার বউ মাঝের পাড়া থেকে এসে, ঝুঁজকো অন্ধকারে গুটি সুটি হয়ে নিত্যদিনের মত বসে ছিল, সঙ্গীর ডাক শুনে পথে নামে। ফাঁকা ফাঁকা রাস্তায় বাতি স্তম্ভের আলো জ্বলে। গ্রামে এখন শহুরে ছোঁয়া। বিকেল চারটে থেকে আলো জ্বালা, নেভে সেই পরদিন সকাল সাতটা। মহার্ঘ্য কয়লা পুড়িয়ে অন্ধকার মুছে ফেলার অদ্ভুত এক বদ অভ্যাস।

শীতের সকালে সূর্যের মুখ একটু দেরীতে দেখা যায়। নামখানা শিয়ালদা আপ ট্রেন কুলপী স্টেশনে পৌঁছনোর পাঁচ ছয় মিনিট আগে ওদের পরিচিত মুখগুলো হাজির হয়। মহিলা কামরার একটা নির্দিষ্ট খোপে এক একটা দল। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে পুরুষ, মহিলা, যুবক যুবতী, নাবালক নাবালিকা – সবাই কাজের তাগিদে শহরের বুকে ছড়িয়ে পড়ে রোজ। দিনান্তে ফেরে নিজের কুটিরে। তবে যন্ত্রণাদায়ক রেল যাত্রা, খরচ আর সময়ের সাশ্রয়ের জন্য অনেকে সংসার নিয়ে শহরতলির ভাড়া ঘরে যে কোন উপায়ে মাথা গুঁজে থাকে। তবে মঙ্গলার মায়েদের দল এখনও গ্রামের মায়া কাটাতে পারেনি, নিজেদের অক্ষমতার বা মায়ালু কারণে।

নিয়মিত যেতে যেতে বাঁধাধরা কামরায় উঠেও পরিচয় অপরিচয়ের সব বাধা যায় ঘুচে। সতেজ, মলিন, নিদ্রাহীন সব মুখ সাময়িক প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে। গল্পের চুবড়ি যেমন উল্টে ঢেলে দেওয়া হয়, ঝগড়ার থলিও মুখ বন্ধ থাকে না। রেলের কামরা গুলো এমনভাবে দখল হয়ে যায়, নতুন কোন যাত্রী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে সহযাত্রীদের আচারে, আচরণে, রসিকতায়, খোলাখুলি যাপনের আলোচনায়। তারপর বারুইপুর এলে যাত্রীদের নামা হয়ে যায় শুরু। গ্রামের নিরীহ গোবেচারা পরিশ্রমী মহিলারা, আস্তে আস্তে এই নিত্যযাত্রার সঙ্গে গা সওয়া হয়ে ক্রমশ ‘স্মার্ট’ হয়ে যায় শহরের ঝকঝকে জীবনকে সামনাসামনি দেখে দেখে, ঠকে ঠকে। কিন্তু মঙ্গলার মা, হাঁসার বউ, মলিনা বৌদি, চৈতালি কাকিমা আর করুণা ঠাকুরমা চেষ্টা করেও এই তিনঘন্টা সময়ের চলতি হাওয়ার পন্থী হতে পারে না। নিজেদের সংসার, সুখ দুঃখ, ভাবনা ভালোবাসা নিয়ে তাদের সময় কাটে। কিন্তু কামরার চেঁচামেচি, হকারের চিৎকার, সব কিছু মিলিয়ে এমন এক শব্দদূষণ, যা সহ্য করার মত অসীম ধৈর্য খুব কম মানুষের আছে।

করুণা ঠাকুরমা যাদবপুরের এক চাকুরে দম্পতির বাড়িতে ডিউটি করে।তাঁদের বাড়ির বয়স্ক কর্তা গিন্নির দেখাশোনা করে সকাল আটটা থেকে বিকেল পাঁচটা । খুব একটা পরিশ্রমের না হলেও নানান কূটকচালি । ওদের বাকি চারজনের প্রত্যেকের চার থেকে পাঁচ বাড়িতে, বাসন মাজা থেকে ঘর মোছা কাপড় কাচা ইত্যাদি ইত্যাদি। মানুষ হলেও যন্ত্রের দক্ষতায় চলে পরিশ্রমী দুটো হাত, না হলে খাটুনি পোষায় না। কাজের সময় একদম ঘড়ি ধরে বাঁধা, না হলে সব বাড়ি সামলানো যাবে না। তাই বিশ্রাম বলতে ওই যাওয়া আর আসা, রেলের কামরার কয়েক ঘন্টা । সেই সময়টুকু একটু মানসিক স্থিরতা যেন খুব জরুরি হয়ে পড়লো ওদের। করুণা ঠাকুরমার স্বামী পাঁচ বছর হল গত হয়েছেন। ছেলে – বউয়ের মোটামুটি সচ্ছল সংসার । নাতিপুতি খুব একটা পছন্দ করে না কপালে তিলক কাটা ঠাকুরমাকে। একসময় করুণা পাড়ার কার্তিক মাসের সংকীর্তনের দলে মন্দিরা বাজিয়ে গান করতো, সে অভ্যেস আজও আছে। তাই তার মনে এলো, এই যাওয়া আসার সময়টা কজনে মিলে গান গাইলে তো সময় কাটে! একদিন দলের বাকিদের কাছে কথাটা পাড়ে। ওরা হাসাহাসি করে, তাই হয় নাকি! সকলের সামনে গান গাইতে তো লজ্জা করবে, আর সেই সুর তো নেই, গানও জানা নেই। ‘কেন লজ্জা করবে ! দেখছিস না , ছোট থেকে বড় কী নোংরা কথা বার্তা বলে, গাড়ি ভর্তি লোকের সামনে, ওদের তো লজ্জা করে না !’ – করুণা ঠাকুরমার কথা । যুক্তি আছে বটে, নিত্য যাত্রার যাত্রীরা দু কান ভরে কত কথা শোনে, কত কথা বলে । শ্লীল অশ্লীল কথার শতকরা হিসেবে করা যাবে না !

একদিন যায়, দু দিন যায় ওরা পাঁচজন গান গাওয়ার বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করে। নিজেদের সংসারের অভাব ঢাকতে তারা বাবুদের সংসারে কাজের দায়িত্ব নিয়েছে। আবার নিজেদের ঘরে ফিরে যে একটু বিশ্রাম পাবে তার উপায় নেই। অন্ধকার নামলে তারা নিজেদের কুলায় ফেরে, রাতের অন্ধকার থাকতে আবার কলকাতায় পাড়ি। করুণা ঠাকুরমার কথাটা আস্তে আস্তে গভীরতা পায়। সেদিন ওরা পাঁচজন রেলকামরার জানালার কাছে, উভয় পারের সিটে বসলো। যথাসময়ে ট্রেন ছাড়লে, করুণা ঠাকুরমা ব্যাগ থেকে করতাল দুটো বের করে, দু চোখ বন্ধ করে ধরলো গান, – ‘মা গো আনন্দময়ী নিরানন্দ কোরো না… ‘। মঙ্গলার মা, হাঁসার বউ, মলিনা বৌদি আর চৈতালি কাকিমা লজ্জায় মর মর। অতি কষ্টে দু হাতে তালি বাজিয়ে মিনমিনে গলায় কোরাসে দোয়ারকির ভূমিকা পালন করে। প্রথম দিন মহিলা কামরার সবাই তো হতবাক। মুখচোরা মেয়েগুলো গান গাইছে! কেউ হাসে কেউ রসিকতা করে, কিন্তু করুণা ঠাকুরমার গলায় যেন একটা করুণা ধারার আঁচ পায়। জড়তা না কাটলেও প্রথম গান শেষ হলে ,সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে। একরাশ জড়তা, লজ্জার পাহাড় পার হয়ে, দুরু দুরু বক্ষে শুরু হল এক অভিনব চলমান গানের আসর। করুণা ঠাকুরমার গানে উৎসাহিত হয়ে দলের অন্য চার মহিলা বাড়িতে যেটুকু সময় পায়, গুনগুনিয়ে আড়ালে আবডালে অনুশীলন করে। আর মূল গায়িকা করুণাময়ী, পুরনো দিনের গাওয়া গানগুলো নতুন করে স্মৃতির কোষে ধরার চেষ্টা করে। এখন শ্রোতার সংখ্যা আর চাহিদা ঊর্ধ্বগামী।

সেদিন ওদের প্রথম গান ছিল, ‘আমার চেতনা চৈতন্য করে, দে মা চৈতন্যময়ী…।’ মূল গায়িকার চোখে জল, দলের অন্যদেরও। সারা কামরায় সেই গানের সুরে সুরে এক চেতনার স্রোত যেন বয়ে যাচ্ছে। শব্দ হীন যাত্রীর দল। হঠাৎ কামরার শেষ প্রান্ত থেকে জনা পাঁচেক নিত্যযাত্রী যুবতী ওদের কাছে এসে গায়িকাদের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ইচ্ছে প্রকাশ করে, – ‘ আমরা তোমাদের দলে গান গাইবো।’ – কন্যা – সমা যুবতীদের বুকে জড়িয়ে করুণাময়ীদের চোখে আনন্দাশ্রু, বাকি যাত্রীদের আবেগ তাড়িত করে দেয়।

মঙ্গলার মা, মলিনা বউদিদের বিস্ময়ের ঘোর কেটে গেলে ভাবে, – মানুষ এই সামান্য গানের সুরে যদি এত আনন্দ পায়,তাহলে জীবন নিয়ে এত বিবাদ কেন করে ! যাত্রাপথের বাকি সময়ের জন্য ওদের মিলিত কণ্ঠে আবার সুর ঝরে পড়ে – ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের …’। এক স্টেশন থেকে ভোঁ …. শব্দ তুলে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে ট্রেন ছেড়ে দেয়।

কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya

Bengali Story 2023 | রূপশঙ্কর আচার্য্য | গল্পগুচ্ছ ২০২৩

Bengali Story 2023 | ইচ্ছাপূরণ | গল্পগুচ্ছ ২০২৩

Bengali Story 2022 | জয়ন্ত কুমার সরকার | গল্পগুচ্ছ ২০২২

Bengali Story | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | গল্পগুচ্ছ | 2022

Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | bangla golpo pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Suspense story in english | suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Bangla Story Archive | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Bangla Story Archive | Pdf Bangla Story Archive | Bangla Story Archive App | Full Bangla Story Archive Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Bangla Story Archive 2024 | New Bangla Story Archive – Episode | Golpo Dot Com Series | Bangla Story Archive Video | Story – Bangla Story Archive | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Bangla Story Archive Netflix | Audio Story – Bangla Story Archive | Video Story – Bangla Story Archive | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Recent Bangla Story Archive | Top Bangla Story Archive | Bangla Story Archive Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bangla Story Archive | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bangla Story Archive – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Story Collection – Modern Bangla Story Archive

Leave a Comment