Most Wonderful Bangla Galpo | Best Bengali Story

Sharing Is Caring:

যদি এমন হত – জয়ন্ত কুমার সরকার [রম্যরচনা]

যদি এমন হত, নতুন বৌ শ্বশুরবাড়ি এসে যেমন সংকোচে থাকে, তেমন কিছুই নেই; শ্বশুর-শাশুড়ি কেমন মানুষ, ননদ দেওর পছন্দ করবে কিনা, মিশুকে যদি না হয়,পতিদেবতাটি আদতে কেমন, গোঁয়ার রগচটা নয়তো, এসব প্রশ্ন ঘুরপাক খায় নতুন বৌয়ের কুসুম হৃদয়ে। যদি এমন হতো, কারো মনে কোন দ্বিধা নেই, প্রশ্ন নেই, বাড়ির সবাই নববধূকে বরণ করার জন্য স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রস্তুত আছেন। শ্বশুরবাড়ির সকলে যদি সহনশীল হতেন, নতুন বউকে শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ লোকজনকে বুঝে উঠতে একটু সময় দিতে হয়, বুঝতেন যদি সবাই। বাড়ির বৌ-ঝিরা প্রথম থেকেই যেন প্রতিদ্বন্দ্বী না ভাবেন, যদি বড় দিদির মত, বন্ধু সুলভ আচরণ করেন। নতুন বৌ-সুন্দরী, ধনীর দুলালী হলেই অহংকারী হবেই, এরকম তো নাও হতে পারে, সবাই যদি একটু বুঝতেন, কিম্বা গরীব ঘরের মেয়ে বলে আদব কায়দা জানে না, এরকম আগে থেকেই না ধরে নেওয়া; রান্নায় কতটা পটু, হেঁসেল সামলাতে পারবে কিনা জানা দরকার, লেখাপড়ার দৌড় কতদূর তো জেনেই যান সকলে শিক্ষিতা হলেই অহংকারী হবে, এমনটা নাও হতে পারে, সকলকে মানিয়ে চলতে পারবে তো! এসব প্রশ্নের সমাধান নিজেরাই করে নিতে পারেন। মূলকথা দৃষ্টিভঙ্গির বদল দরকার, সর্বদাই নাকতোলা মনোভাব নয়, ইতিবাচক ভাবনা মাথায় থাকলে ওভাবেও ভাবা যায়। রান্না না জানলে শিখিয়ে নিতে হবে, আদব-কায়দা বাড়ির রীতি অনুযায়ী তৈরি করে নিতে হবে, লেখাপড়ায় পারদর্শী না হলে বৌমাকে সময় দিতে হবে। বৌমাকে বাড়ির মেয়ে ভাবতে হবে, তাকে আপন করে নেওয়ার প্রথম দায় শাশুড়িমার। ভাল ব্যবহার করলে তবেই ভাল ব্যবহার ফিরে পাওয়া যায় মনে রাখতে হবে।

“গল্প হলেও সত্যি” ছায়াছবির স্বনামধন্য অভিনেতা রবি ঘোষের মত কেউ পরিবারে যদি থাকতেন। শুধু, বাপের বাড়ি কিছু শেখায়নি, ঠেস দেওয়া এসব কথা কেন শুনতে হবে নতুন বৌমাটিকে, এখনকার সব মেয়েই, আমাদের কন্যেরা, লেখাপড়া শিখে স্বনির্ভর হতে চায়, হয়তো বাবা-মায়ের একটিই সন্তান সে, শিশু বয়স থেকে বাবা-মা যেরকম আদর-যত্নে মেয়েকে মানুষ করেছেন, বাড়ীর কাজ শিখবে কখন, সময় কোথায় তার, লেখাপড়া ছাড়া তার অন্য ভাবনা ছিলই না।‌ মেয়ের খুঁটিনাটি সবকিছু দেখেশুনে জেনে বুঝে তবেই পাত্রী নির্বাচন করেছেন ছেলের বাবা-মা। তাহলে সব দায় মেয়ের বাবা-মার, এরকম সংকীর্ণ ভাবনা, পুরনো ধ্যানধারণা থেকে সরে আসতে হবে শ্বশুরবাড়ির সকলকে। পরিবারের বনেদিয়ানা,আধুনিকতার প্রকাশ শুধু চমক দেখিয়ে হয় না, মন উদার না হলে আধুনিকতার ভড়ং দেখিয়ে কি লাভ। নতুনকে নিয়ে নানান কৌতূহল মেয়েদের অন্দরমহলে ঘোরাফেরা করে, তাই দ্বিধায় থাকেন ওঁরা। বিয়ের পর দ্বিরাগমনে আসা জামাইকে নিয়েও দ্বিধায় থাকেন শ্বশুর-শাশুড়ি। জামাতা বাবাজীবন অহংকারী নয়তো, আপ্যায়ন পছন্দ হবে তো! যদি জামাতা বাবাজীবন ছুতমার্গ না করে খোলা মনে ছোট ছোট অসুবিধাগুলি মানিয়ে নিয়ে শ্বশুরবাড়ির গুরুজনদের অভয় দিতে পারতেন।‌ নতুন জায়গায় রাত কাটাতে হলে ঘুম ধরে না অনেকের। দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়ে আচমকা ধড়মড় করে উঠে বসা, ভয় পেয়ে ঘেমেনেয়ে একশা হন অনেকে।

বাড়িতে নতুন অতিথি এলে বাজিয়ে দেখতে হয় অনেক সময়। রাত্রিবাস করলে আরও সন্দেহ, স্বভাবচরিত্র ভালতো, কদিন থাকবে ইত্যাদি…..। কলেজের নবীনবরণ অবশ্য আলাদা, সিনিয়র দাদা-দিদিদের নতুনদের বরণ করার রীতি চালু আছে সর্বত্র। ফাংশন জলসা তো হবেই, কপালে চন্দনের টিকা, মিষ্টিমুখ করিয়ে গোলাপের পাপড়ি উপহার দিয়ে যাদের বরণ করা হয়, দাদাদের দলে সামিল করার অছিলায় তাদের কখনো বা অন্য মূল্য চোকাতে হয়, সবার চোখের আড়ালে। তখন নবীন বরণের গালভরা কথাগুলো বড় কৃশে হয়ে যায়। যদি এমন হতো, সিনিয়র দাদারা নতুনদের মনে ভরসা যোগাতে পারতেন।‌ নতুনরা সিনিয়রদের বন্ধু মনে করতে পারত‌, তবেই তো নবীন বরণের সার্থকতা খুঁজে পেতাম আমরা অভিভাবকরা। যদি এমন হতো, আত্মজদের বাইরে পড়তে পাঠিয়ে বিপদের আশংকায় অহরহ দিন গুণতে না হত। পরিবারের নতুন অতিথি যদি সদ্যজাত হয়, তাকে নিয়ে সকলে অস্থির হই আমরা। কোথায় কিভাবে রাখা যাবে,কত সুরক্ষিত হবে, সেই চিন্তায় রাতদিন এক করে ফেলেন বাড়ির কর্ত্রী। একটু বর্ধিষ্ণু পরিবার হলে নাতি-নাতনীর আগমনে সারা বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়, এ নবীনবরণ অন্যরকম।‌ না, এখানে নতুন অতিথিকে নিয়ে কোন দ্বিধা থাকে না,থাকে সাবধানতা,খারাপ কিছু না হয় সেই আশংকায় চঞ্চল হয় ঠাকুমা-দিদাদের অন্দরমহল।

তুমি কথার কথা বোঝ না, আরে ঠাট্টা করে ছিলাম, আজ রবিবার, আর তুমি কিনা সত্যি সত্যি এক কিলোমিটার দূরে পার্লারে তোমার স্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলে। ওরা বলেছিল, রবিবার খোলা হয় সময় বিশেষে, তুমি ভাল করে না শুনে না বুঝে পাঠিয়ে দিলে, কনফার্ম হলে না! তোমার স্ত্রী কি ভাবলেন বল তো! কথার কথা এভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদি এমন হতো, বন্ধু আর বন্ধুপত্নী কোনটা লঘু আর কোনটা গুরু, কোনটা ইয়ার্কি,কোনটা সিরিয়াস, কথার ভঙ্গিমায় বুঝে নিতে পারতেন।

সেদিন বাড়িতে কি যেন একটা বিষয় নিয়ে মন কষাকষি হয়েছিল, হ্যাঁ, আমি বলেছিলাম যাও না বাপের বাড়ি, বড় জোর একদিন, তার বেশি নয়।‌ কথা শুনে বেশ চুপ মেরে গেলেন তিনি, মুখভার থমথমে আবহাওয়া, ভাবছি এই বুঝি বর্ষা নামল ধরাতলে। কয়েক সেকেন্ড পর বেশ চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন শ্রীময়ী আমার,”তাই….না, তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাই না তো, তাই একথা শোনালে তো! বুঝবে আমি না থাকলে কি হয়।” তখনকার মত চুপ মেরে গেলেন পূর্ণাঙ্গিনী শ্রীময়ী। আমিও ভুলে গেলাম। স্নান খাওয়া যথারীতি অফিস চলে গেলাম।‌ ওমা, বাড়ি ফিরে দেখি সদর দরজায় তালা।‌ গ্রীলের শব্দ শুনে পাশের বাড়ীর বৌদি বেরিয়ে এসে চাবিকাঠির গোছা তুলে ‌দিয়ে বললেন নাও ভাই, সংসার সামাল দাও। প্রমাদ গুনলাম,যাঃ! এ তো ভারি বিপদ, কথার কথা বললাম, এত সিরিয়াস হয়ে গেল। বন্ধুরা পরামর্শ দিল, নিজে চলে যাও‌।‌

আমি ভাবছিলাম, এমন কেন হয়, আমাকে বুঝল না, ওপরের দুটো কথায় এত সিরিয়াস হয়ে গেল! যদি এমন হতো শ্রীময়ী আমার, হালকা কথা ভারি কথা সব কিছু মানিয় নিতে পারতেন, তাহলে এত কাণ্ড কি ঘটত, ঘটত না। বন্ধু বলল, সবটাই নিজের মত করে ভাবছো তো, সবাই তাই করে। কিন্তু ওনার মানসিক অবস্থাটা তুমি বুঝেছ কি, কোন কথায় কোমল হৃদয়ে ব্যথা লাগলো, কোন কথায় মুখ আধার হলো, হৃদয় প্রকৃতির নানান চড়াই উৎরাই না বুঝলে প্রকৃত বন্ধু হবে কি করে ভায়া। বুঝতে হয়, বাবা-মা আত্মীয় প্রিয়জন ছেড়ে তোমার শ্রীময়ী তোমার উপর ভরসা করে তোমার ঘরে এসেছেন, তুমি ওনার ঘরে যাওনি। তাই তাঁকে মানিয়ে নিতে হবে তোমাকেই, কর্তব্য দায় সেটা ওনার যতটা তার থেকেও কয়েক গুণ বেশী দায়িত্ব তোমার, তোমার পরিবারের। উভয় পক্ষ সমঝদার হলে তবেই সংসার সুখের হতে পারে।‌ আমি বললাম, যাই বল ভাই, অতশত ভেবে তো বলিনি, কথার কথা বলে ফেলেছিলাম, মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কথাটা হালকা হল না, গুরুতর হয়ে গেল, তিনি আঘাত পেলেন, পিত্রালয়ে গোসাঘরে খিল তুললেন। মানভঞ্জনের দায় আমার। বুঝিয়ে ভালবেসে মানিয়ে নিয়ে ঘরে ফিরিয়ে আনতেই হবে। মিশন শুরু হল। ফোন করলাম, অপর প্রান্তে পুরো সময় ধরে রিং হয়ে কেটে গেল। পরের বার শালাবাবুর বউ ফোনটা ধরলেন, চাপা গলায় সাবধানবানী, সাবধান জামাইবাবু, বেশ রেগে আছেন দিদি, ধীরে এগোবেন। বুঝলাম কেস গোলমাল, ঘোরতর বিপদ।‌ তারপর যা হবার হোল। সাতসকালে হত্যে দিয়ে পড়লাম। না! ও বাড়ি গিয়েও কিছু হল না। টোটকা কয়েকটা টিপস্ প্রয়োগ করলাম,শালার বৌ খুব হেল্প করছিলেন। বড় হোটেলে বেশ জম্পেশ করে খাওয়াব বলেছি, তাই খুব তৎপর শালা-শালার বৌ, তাছাড়া বোনকে ঘাড় থেকে নামাতে পারলে বাঁচেন কৃপণ শিরোমণি শ্রীমান শালাবাবু। এরপর তোষামোদ অনুনয়-বিনয়, মানভঞ্জনের নানান প্রক্রিয়া চলল টানা সাতদিন। প্রচুর ক্যাশ ঝরল, গয়না এক সেট অর্ডার দিতে হল, একাধিক আপাত প্রতিশ্রুতি দিতে হল। তারপর, বরফ গলল, আরও দিন তিনেক পর তিনি এলেন। উঃ! যা শিক্ষা হয়ে গিয়েছে, কথার কথা হালকা কথা আর নয়, যদি এমন হত, আকাশকুসুম ভেবেও লাভ নেই কিছু!

যদি এমন হত, যদি ফিরে পেতাম আমার ফেলে আসা দিনগুলো, আমার সেই ছেলেবেলাটা। যদি সত্যি ফিরে যেতে পারতাম তখনকার সময়ে, তাহলে আরও যত্ন নিয়ে পড়াশোনা করতাম, পড়ার বইয়ের আড়ালে লুকিয়ে গল্পের বই পড়তাম না। অনার্সটা পেয়ে যেতাম নির্ঘাত, মাস্টার ডিগ্রীটাও হয়ে যেত। জান লড়িয়ে চাকরির পরীক্ষাগুলো দিতাম। স্কুলের চাকরি কিম্বা আরও ভাল চাকরি যদি পেয়ে যেতাম। আর্থিক স্বচ্ছলতা বাড়ত। আমাদের ভাল রাখতে গিয়ে বাবা কতটা ত্যাগ করেছেন তখন বুঝতাম না, সহপাঠীদের বৈভব দেখে মনঃক্ষুন্ন হতাম, বাবার কৃচ্ছসাধন অনুভব করতে পারতাম না। মায়ের কষ্ট খারাপ লাগত,কিন্তু সবটা অনুভূতিতে আসত না। ছেলেবেলায় রুগ্ন ছিলাম বলে মা আমাকে বেশি যত্ন করতেন। মায়ের স্নেহের মূল্য তখন বুঝতাম না, সামান্য কারণে রেগে গিয়ে মাকে কষ্ট দিয়েছি। এখন সব বুঝি, কিন্তু কিছু করার নেই, মা নেই যে! সংসার বড় কঠিন ঠাঁই। পরিবারের সকলকে ভাল রাখার দায় বড় বিষম দায়। বাবা কেন নিজের স্বাচ্ছন্দ্য ছেড়ে দিতেন এখন বুঝতে পারি। আর্থিক স্বচ্ছলতা জীবনের অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। দু-একজন বন্ধু, ছেলেবেলার সঙ্গী খুব কষ্ট আছে, ওদের একটু সাহায্য করতে খুব ইচ্ছে করে, কিন্তু পারি না। সত্যিই যদি এমন হত! স্মৃতির সরণী বেয়ে পিছিয়ে যেতে পারতাম কয়েকটা দশক, আগের সেই ছোট্টবেলায়। আমি তখন ক্লাস ফাইভ-সিক্স। ভাই টু-থ্রি। বাবা ছিলেন পাড়ার মাস্টার। রোজ সকালে বসত মাটির বারান্দায় অ-আ-ক-খ, নামতা পাঠের আসর। শিশুশ্রেণী থেকে ক্লাস ফোর তখন বাবার পাঠশালায়। শ্রুতিলিখনে আমিও বসতাম। লাইনে দাঁড় করিয়ে সুর করে নামতা ঘুষাতেন বাবা দুই থেকে উনিশ। কচিকাঁচাদের হাসি কান্না কলকাকলিতে ভরে উঠত গোটা পাড়া। মনের ক্যানভাসে ভীড় করছে অজস্র ছবি। কি আনন্দেই না কাটাতাম সেই সব দিন। শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিসুধায় ভরা সেইসব সোনাঝরা দিনগুলি ফিরে পেতাম, যদি এমন হতো।

[Read More – Most Wonderful Bangla Galpo | Most Wonderful Bangla Galpo Ever | Most Wonderful Bangla Galpo Rare Collection]

ইচ্ছে – জয়ন্ত কুমার সরকার [রম্যরচনা]

কলেজে বাংলা অনার্সের ফর্ম তোলার লাইনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েও ফিরে এসেছিলাম । ফর্ম তোলা হয়নি । সায়েন্স থেকে আর্টসে না যাওয়ার ইচ্ছেটাই শিক্ষক হওয়ার দৌড় থেকে বের করে দিল আমাকে । প্রকৃতপক্ষে সায়েন্স গ্রাজুয়েট হয়ে শিক্ষক হওয়ার দৌড়ে আমি সফল হব না, আমি জানতাম। বাংলায় হলে সেটা সম্ভব হতে পারে, কারণ বাংলা আমার ভালোলাগা বিষয়, বাংলায় লেখার দক্ষতা ছিল, ছাত্র-ছাত্রীদের বোঝাতে পারব, বিশ্বাস দৃ্ঢ় ছিল । কিন্তু হল না! আমার মাসীর বাড়ি ভেদুয়াশোলের কাছে একটা গ্রামে, আমি প্রায়ই যেতাম সেখানে। ওদের পাশের বাড়িতে জয়ন্তরা থাকত, ওর তখন সেকেণ্ড ইয়ার পিওর সায়েন্স সম্মেলনী কলেজ। ভীষণ কষ্টে লেখাপড়া করে ওখানকার ছেলেমেয়েরা। নদী পেরিয়ে কলেজ, টিউশনি যেতে হত। বর্ষায় সাইকেল বই মাথার উপর তুলে নদী পেরিয়ে বাড়ি ফিরত জয়ন্ত। আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল ওর। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে কয়েকদিন জয়ন্ত আমাকে কেমিষ্ট্রির কয়েকটা চ্যাপ্টার খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, খুব উপকৃত হয়েছিলাম; পড়া বোঝানোর অসাধারণ দক্ষতা ছিল ওর; আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। ‘‘তুমি শিক্ষক হলে অনেক ছেলেমেয়ে উপকৃত হবে”, আমি বললে ও হাসত শুধু। বন্ধুটি শিক্ষক হয়নি, মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরী পেয়েছিল। বাড়িতে বাবার সঙ্গে টোলে বাচ্চাদের পড়ানোর অভ্যাসটা ছিলই আমার । ক্লাস ইলেভেন থেকেই টিউশনি পড়ানো শুরু; সঙ্গে চলত টাইপ-স্টেনো প্র্যাকটিস । এভাবেই ইন্সট্রাকটর হয়ে টাইপ শেখানো, কলেজে পড়া, টিউশনি, বিকেলে বাচ্চাদের মাঠে খেলানো । সারাদিন ব্যস্ততা, প্রচুর পরিশ্রম করেছি । ফলও পেয়েছিলাম। সরকারী অফিসে চাকরী পেলাম। সবাই খুশী, কিন্তু আমার মন তৃপ্ত হয়নি, ভালোলাগার কাজটাই তো পেলাম না । তখন এস.এস.সি. ছিল না । যোগ্যতার চেয়ে ডোনেশন, সুপারিশ জরুরী ছিল, তাই হল না আমার শিক্ষক হওয়া ।

কৈশোরে অনেক কৌতূহল মনে ভীড় করে, আবেগ তখন ষোলআনা। স্বপ্ন দেখা শুরু তখন থেকেই। অনেক ইচ্ছে, কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে যায় মনে। অনেক অবাস্তব প্রশ্নও মনে উঁকি দেয়, মানুষ অসৎ হয় কেন, এই অসৎ মানুষগুলোর শাস্তি হয় না কেন, কেউ দেখেও দেখছে না কেন, সবাই জানে না এমন তো হতে পারে না, তাহলে কেন কেন, এরকম হাজার প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খেত তখন। পরে বুঝতাম, দায়িত্ব, কৃতজ্ঞতাবোধ, সংসার সামলানোর বাধ্য-বাধকতা মানুষকে বেশি সাহসী হতে বাধা দেয়। জীবনে কত কিছুর দায়, নানান জটিল সম্পর্ক থেকে যায়, কত মানুষের কাছে ঋণী থেকে যাই আমরা। বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পিছনে কত মানুষের ঋণ থেকে যায়, সব ঋণ কি পরিশোধ হয়। মা-বাবার ঋণ, শিক্ষকের ঋণ কি কখনো শোধ করা যায়, যায় না। শৈশব পেরিয়ে কৈশোর তারপর যৌবন –মানুষের জীবনের এই ধাপগুলো পেরিয়ে আসতে গর্ভধারিণী মা, জন্মদাতা পিতা, তারপর দাদা-দিদি-কাকা-পিসি-দাদু-ঠাকুমা …এরকম আত্মীয়ের কিছু না কিছু অবদান থেকেই থাকে । এঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ ক্রমশ: তৈরী হয়, কাউকে শেখাতে হয় না। কিন্তু মনের গঠন সবার সমান হয় না । কেউ সামান্যতম সাহায্যও মনে রাখে সারাজীবন, কেউ পিতা-মাতার ঋণও ভুলে যায় । তাই বার্ধক্যে বৃদ্ধাশ্রম হয় তাঁদের শেষ ঠিকানা । যতই সাংসারিক চাপ থাকুক, এত কৃতঘ্ন হই কি করে আমরা । বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজনের শিক্ষাই শিশুর মনে কৃতজ্ঞতাবোধ তৈরী করে। যাঁদের হাত ধরে হাঁটতে শিখি, যাঁদের স্নেহের পরশে আমরা লালিত হই, যাঁরা বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ তো আসবেই। বাবা-মা ছাড়াও যে শিক্ষকের কাছে আমরা লিখতে-পড়তে শিখি, যিনি নিজের জ্ঞান ভাণ্ডার উজাড় করে জীবনের অভিজ্ঞতায় আমাদের জারিত করেন, তাদের প্রত্যেকের কাছেই আমাদের কৃতজ্ঞ থাকতে হয় । মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয়ে কেউ কেউ ভাবেন এটা আর এমন কি, ও তো সবাই করে। কিন্তু সত্যি কি তাই! বাবা-মা জীবনের সব কিছু নিঙড়ে দিয়ে নিজে নি:শেষ হয়ে সন্তানকে বড় করেন। এ কথা তো নতুন করে বলার নয় ; আমি আমার বাবা-মায়ের মতই আমার শিক্ষকদেরও সম্মান করি, শ্রদ্ধা করি, তাঁদের সামনে মাথা নত হয়ে আসে আজও। এ কৃতজ্ঞতা আমাদের রক্তে মজ্জায় লালিত হয় ; আমার জীবনে প্রতিষ্ঠার পিছনে এরকম একজন টাইপ-স্টেনো শিক্ষকের অবদান আমি ভুলতে পারি না, আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে, আজীবন । এই সব নমস্য মানুষজন অবহেলিত হলে বিবেকের দংশনে নিজে ক্ষতবিক্ষত হই, এটাই কৃতজ্ঞতা বোধ । এ বোধ মানুষের মনে মূল্যবোধ জাগরিত করে,যে বোধ জীবনপ্রবাহকে সঠিক পথ দেখায় । অনেক সময় কোন ইচ্ছে পূরণ না হলে বাবা-মাকে দোষ দিতাম, কান্নায় বুক ভরে যেত। কিন্তু বাবা-মায়ের উপর ভরসা হারাতাম না, ভাবতাম বাবা-মা ই সব । আমাকে ওঁদের কথামতই চলতে হবে। তখন ছোট তো, অত বড় করে ভাবার কথাও নয়। বড় হয়ে বুঝেছি, ওঁদের দোষ দিতে নেই। ছেলেমেয়েদের সব কিছু দিতে মন চায় বাবা-মায়ের। কিন্তু, সামর্থ্যে কুলায় না, কখনও বা কার্পণ্য করেন, যাতে কষ্টের মর্মটা বোঝে। খুব সহজে কিছু পেয়ে গেলে জিনিষটার কদর কমে যায়,আবার নতুন বায়না এসে পড়ে। যাতে উপহার পেয়ে নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট না করি, সেই জন্য কার্পণ্য করতেন। কখনো বা সন্তানকে না দিতে পারার কষ্ট ওঁরা অনুভব করেছেন, আমরা তখন বুঝিনি।

ছোটবেলায় ইচ্ছে করত অনেক কিছুই … ভাল পোষাক .. ভাল খাবার … ভাল ভাল উপহার পেতে আমার বয়সী বড়লোক বাড়ীর ছেলেগুলোর মত। আকাশ কুসুম কল্পনার ভীড়ে আবার হারিয়েও যেত চাওয়া-পাওয়ার ইচ্ছেগুলো । প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় থেকেই নিজের চাওয়া-পাওয়া আর নিজের ইচ্ছের অনুভূতিটা আসতে শুরু করে । অন্যের মত আমাকেও পেতে হবে এরকম ভাবনা কাজ করতো, যদিও পেতাম সামান্যই; আর্থিক অনটনের কারণে যে আমার ইচ্ছেগুলো পূরণ হচ্ছে না তা বুঝতে পেরে চুপ থাকতাম আর বুকের মধ্যে কান্না দলা পাকিয়ে গুমরে মরতো । কিছুদিন পর পুরনো ইচ্ছেগুলো মরে যেত আর নতুন ইচ্ছের জন্ম হত আর একই রকমভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটতো । স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজে ঢোকার সময় থেকে মনের ইচ্ছেগুলো পাল্টাতে লাগলো আর শুরু হোল রঙীন স্বপ্নের আনাগোনা ; তখন সহপাঠীদের দেখাদেখি নতুন ফ্যাশনের বাহারী পোষাক, দামী উপহার পেতে মন চাইত । নিজেকে একটু ঝকঝকে-চকচকে দেখানোর ইচ্ছে জাগত ; একটু আধটু মিটত না যে তা নয় । কিন্তু বেশীর ভাগই অধরা থেকে যেত । ছা-পোষা বাঙালীর পাঁচ-পাঁচিক সংসারে পড়াশুনা শেষে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চাপের কাছে রঙীন ইচ্ছের স্বপ্নের হাতছানি ম্লান হয়ে যেত । তা বলে ভাবনার রাজ্যে মনে মনে ইচ্ছে করতে তো মানা নেই- ইচ্ছে তো করে নীল আকাশের বুকে মেঘের মত ভাসতে, ইচ্ছে করে পাখির মত উড়তে, ইচ্ছে করে আগের মত শৈশবে ফিরত আসতে, ইচ্ছে করে সারাটা সময় মায়ের কাছে কাছে ঘুরতে, ইচ্ছে করে ভর দুপুরে ঘুড়ি নিয়ে ছুটতে, সবুজ পাতায় বৃষ্টি হয়ে ঝরতে…..এসব নানান ইচ্ছের জাল বুনেই চলি চুপিসারে…মনের রাজ্যে কোথাও তো আমার হারিয়ে যেতে মানা নেই; কিন্তু বাস্তবের মাটিতে সংসারের যাঁতাকলে ঐ ইচ্ছেগুলোর কোন দাম আছে কি ! তবু আমরা স্বপ্ন দেখি । সময়ের সাথে সাথে ইচ্ছেগুলো অনেক পাল্টে যায়, এখন ইচ্ছেগুলো আর আবেগে চলে না, ঠকে শেখার অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়েছে অনেক তো । ছেলেবেলায় অনেক ইচ্ছে পূরণ হত অনেক হত না। ভাবতাম বড় হয়ে সব পূরণ হবে। কষ্টের মধ্যেও বাবা আমার শখ-আহ্লাদ একেবারে নস্যাৎ করে দিতেন না। আমার বাবা সাইকেল চড়তে জানতেন না। না মানুষ বন্ধুদের কথা মনে আসতেই মনে পড়ছে অনেক কথা, অনেক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা।

আমাদের বাড়ি ময়রাপুকুর মানে বিষ্ণুপুর শহরের শেষ পাড়া। বাড়ি থেকে বাবা রোজ হেঁটে অফিসে যেতেন শিবদাস গার্লসের পাশে, প্রায় তিন কিলোমিটার রাস্তা। শুধু অফিস নয়, সব কাজই বাবা পায়ে হেঁটে করতেন। বাড়িতে সাইকেল নেই, অথচ আমার ভীষণ শখ সাইকেল চালানোর। পাড়ার এক সহপাঠী, ষষ্ঠীর বাবার ভ্যান-রিকশা ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা ছিল। ওদেরই পুরানো একটা সাইকেল পেতাম মাঝে মধ্যে। প্রথমে হাফ-প্যাটেল, ভারি লাগত সাইকেলটা, ব্যালান্স রাখতে পারতাম না, পড়ে গিয়ে হাত-পা ছড়ে যেত, তবুও চালাতে ছাড়তাম না। মাস তিনেক পর ফুল প্যাটেল তারপর সিটে উঠলাম, থড়বড় করে গলিতে চালাতাম। প্রাকটিসের জন্য ষষ্ঠীদের ভাড়া আদায় করতে যেতাম, ওকে সাইকেলে চাপিয়ে, কষ্ট হত, কিন্তু চালাতাম, যাতে হাত বস হয়। এরপর ক্লাস টেনে উঠলাম। নতুন সাইকেল কেনার ইচ্ছেটা প্রবল হল। আবদার শুরু হল আমার। আমি বড় ছেলে, বাবা আমাকে খুব ভালবাসতেন, আমার ইচ্ছেটা পূরণ করার জন্য বাবা আপ্রাণ চেষ্টা করতেন, বলতেন টাকা জমাই, ঠিক কিনে দেব, তুই মন দিয়ে পড়াশুনা কর। ইচ্ছেটা পূরণ হল, খুব খুশি, আনন্দে আত্মহারা আমি। কিন্তু সাইকেল কেনার কয়েকদিন পরেই দুর্ঘটনায়। মায়ের ভর্ৎসনার শেষ নেই, শুধু আমাকে নয়, বাবাকেও ছাড়লেন না। ভাঙা সাইকেল ঠেলে খুড়িয়ে ঢুকছি বাড়িতে, মায়ের সে কি রাগ! আমি ভয়ে জড়সড়।

‘‘বলেছিলাম না, এখনই ওকে সাইকেল কিনে দিও না, আগে শিখুক ভাল করে। শুনলে না, এই সবে হাফ-প্যাটেল থেকে সিটে উঠেছে, হ্যাণ্ডেল বশ হয়নি, পাকা রাস্তায় চালাতে এখনও দেরী আছে। শরীরে ঐ কটা হাড় ভেঙে যাবে যে, পাকা-পোক্ত হোক আগে, শুনলে না তো, দেখ ফল যা হবার তাই হয়েছে। ঠেলা সামলাও এবার। বাবা বললেন, আমিও বুঝি সেটা, কিন্তু ছেলে তো, কঠোর হতে পারি না, না বলতেও মনটা খচখচ করে, ভাবি বোধহয় দু:খ পেল। সেদিন কি এমন ঘটেছিল, যার জন্য মায়ের এত রাগ। স্মৃতির সরণী বেয়ে পিছনে চললাম, আমার ছাত্রজীবনে। মনে পড়ছে অনেক কথা। জলছবির মত ভেসে আসছে এক এক ঘটনা । সাইকেল নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করতাম প্রায়ই। বাবাও স্তোকবাক্য দিতেন। লোনের দরখাস্ত এই জমা দিয়েছি, তুই একটু ভাল করে হাত পাকা, ইত্যাদি। মাধ্যমিক পরীক্ষার মাস তিনেক আগে বাবা আমর স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন। পেয়েছিলাম একটা নতুন ঝকঝকে সাইকেল। ‘অ্যাভন’ সাইকেলটা কমদামী হলেও,তখন ওটাই ঢের । খুব সাধারণ একটা চাকরী বাবার, টানাটানির সংসার। সাইকেলটা কিনতে লোন করতে হয়েছিল বাবাকে । মনে আছে, আগের রাতে আনন্দে উত্তেজনায় ঘুম হয়নি আমার। নতুন সাইকেল,হাত কাঁচা, তাই খুব ভয়ে আর সাবধানে চালাতাম, আর খুব যত্নে রাখতাম আমার বাহন বন্ধুকে, একটু ধুলো জমতে দিতাম না । তখন সাইকেলে টিউশনি যেতাম শুধু। অঙ্ক স্যরের বাড়ীতে যেতাম, উনি খুব ভালবাসতেন আমাকে,আমার সাইকেল যত্নের বহর শুনেছেন, মুচকি হেসে প্রায়ই বলতেন, “সরকার ! সাইকেলটা তুই, ভিতরে রাখ ! “অন্য সহপাঠীরা বাইরেই রাখত, আমি লজ্জায় পড়ে যেতাম! নতুন চালাচ্ছি, তাই ভীড় এড়াতাম। কিন্তু সেদিন এড়ানো গেল না, খাতা কিনতে বেরিয়ে বাজারে চৌমাথার মোড়ে একটা বড় হাইড্রেনে সাইকেল সহ পড়ে গেলাম, আমার সেরকম না লাগলেও বন্ধুর চোট সাংঘাতিক হল, সামনের ফগটা বেঁকে গেল,ঘষা লেগে রঙ চটে গেল কয়েক জায়গায়। অব্যক্ত কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল, মায়ের বকুনির জন্য নয়,মন খারাপ ছিল আমার প্রাণপ্রিয় সাইকেলটার জন্য। এর পর অনেকদিন, মুছতে মুছতে সাইকেলটার ক্ষতস্থানে হাত বোলাতাম নিজের অজান্তেই। কত বছর, মাস, দিন, ঘন্টা আমার সঙ্গে জড়িয়ে থেকেছে বাহন বন্ধু আমার, আমাকে গন্তব্যে পৌঁছে রোদ জল ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করে বাইরে পড়ে থেকেছে, আমি থেকেছি ভিতরে । কত স্মৃতি ভীড় করে । কলেজ শেষ করার পর অন্য সাইকেল কিনেছি, অবহেলায় নষ্ট হওয়ার আগে ওকে এক পড়ুয়াকে দিয়ে দিই। চাকরীতে আসার পর অনেকদিন পর্যন্ত সাইকেলই আমার সঙ্গী ছিল। সাইকেলটা খুব যত্নে থাকত আমার কাছে।

একই রকম আমার কাছে যত্নে থাকে হাতঘড়ি’, রেডিওসেট, মোবাইল, চশমা, ছাতা, ‘অফিস ব্যাগ’ সহ আরও অনেকে, আমার ‘না মানুষ বন্ধুরা’ । আমাদের বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে রাখা আমার ‘না মানুষ বন্ধু’ আমার প্রথম পাওয়া সাইকেলটির কথা প্রথমেই বলেছি। মায়ের বকুনি বাবা চুপ করে শুনে মৃদু ধমক দিয়ে চুপ করালেন, আমাকে বললেন, তোর কোথায় লেগেছে, ওরকম বাঁকে নেমে গেলেই ঠিক ছিল, হাত বস নেই বাজারে যাওয়ার কি দরকার ছিল। চুপচাপ শুনলাম মাথা নামিয়ে। পরের দিন সাইকেল মেরামতের দোকানে নিয়ে গেলাম। আরেকটি না মানুষ বন্ধু আমাকে চালিত করত তখন। প্রথম রেডিও যখন বাড়িতে এল তখন থেকে আমার বন্ধুত্ব সন্তোষ কোম্পানির ছোট্ট রেডিও সেটটির সঙ্গে। শুধুমাত্র মিডিয়াম ওয়েভে কোলকাতা ‘ক’, ‘খ’ আর বেতার বাংলাদেশ ঢাকার অনুষ্ঠান শোনা যেত ঐ সেটে। আকাশবাণী কোলকাতার ‘ক’ তে বুধবারের যাত্রা, শুক্রবার রাত্রি আটটার নাটক, রবিবারের গল্পদাদুর আসর নিয়মিত টানত আমায়। পড়ার ফাঁকেই শুনতাম ঐ সব অনুষ্ঠান। সেই সেটটি এখন আর চালু নেই, কিন্তু রেডিও শোনার সেই অভ্যাস আজও আমার সঙ্গী। চিলে কোঠার ঘরে একপাশে অযত্নেই ঘুমিয়ে আছে আমার সেই না-মানুষ বন্ধুটি। চিলেকোঠার ঐ ঘরেই দেখলাম একপাশে অযত্নেই ঘুমিয়ে আছে আমার প্রথম পাওয়া হাত ঘড়িটি; নীল ডায়াল স্টীলব্যাণ্ডের অ্যাংলো-সুইস কোম্পানির ঘড়ি। ধুলো মুছে হাতে নিয়ে দেখলাম অনেক বছর পর। টিকটিক শব্দে আমার সঙ্গে পেরিয়ে এসেছে কত ঘন্টা, কত দিন, কত মাস, কত বছর। এরকম কত ‘না-মানুষ বন্ধু’র সাহচর্যে আমরা বেড়ে উঠি, দিন যাপন করি, ওদের উপর ভর করেই আমরা নিজে পৌঁছে যাই গন্তব্যে, নিজেকে উপযোগী করি কত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে। ঐ সব না মানুষ বন্ধুদের সহযোগিতায় আমরা থাকি আরামে, ওরা থাকে উপেক্ষিত, অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে কিম্বা মরচে পড়ে নষ্ট হয়ে পুরানো হিসেবে চালান করি অন্যত্র, আমাদের জ্ঞাতসারে কখনও বা অজ্ঞাতসারে। মানুষ না হয়েও কত বিশ্বাসী এই ‘না-মানুষ বন্ধুরা‘। মানুষ অবিশ্বাসী হয়, কিন্তু যন্ত্র কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না, নি:শব্দে পাশে থেকে কাজ করে যায় আমৃত্যু। বিশ্বাসভাজন হওয়াটা অনেক বড় কাজ জীবনে। বিশ্বাসী মানুষ সর্বদা ভরসা যোগায়, নি:শব্দে কাজ করে যান। ওঁরা সর্বদা যোগ্য সম্মান হয়ত পান না, কিন্তু তাই বলে অবিশ্বাসী হন না। ‘বিশ্বাস’, এই ছোট্ট শব্দটাই মানব সভ্যতার ভরকেন্দ্র, মানব চরিত্রের বিশেষ একটি স্তম্ভ এই বিশ্বাস । বিশ্বাসের উপর ভর করেই মানুষ মানুষকে সাহস যোগায়, মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে, সংসার সমাজ এগিয়ে চলে, দেশে প্রগতি আসে। বিশ্বাসের ভীত যত গভীর হয়, বন্ধুত্বের সম্পর্ক মজবুত হয়, স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তত সুদৃঢ় হয় । সব নারী-পুরুষই চান তাদের জীবনসঙ্গী যেন বিশ্বস্ত হন ; পরস্পরের ভালবাসা গভীর হয় এই বিশ্বাস থেকেই ; বিশ্বাস একটা মানসিক জোর, সময় বিশেষে এই মানসিক জোর এতই প্রবল থাকে যে অসাধ্যসাধন সম্ভব হয় । শুধুমাত্র আইনের ভয়ে সমাজ-সংসার চলে না, চলে বিশ্বাসে ভর করে ; মানুষকে বিশ্বাস করে ঠকলেও ক্ষতি নেই, অবিশ্বাসী মন মানুষকে ছোট ভাবতে শেখায়, তাই মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, অন্যায় ; আবার বিশ্বাসভাজন হয়ে সেই সুযোগে বিশ্বাসঘাতকতা চরম অন্যায় । সরল মানুষ এটা করেন না, দুর্বোধ্য চরিত্রের কিছু জটিল মানুষ বিশ্বাসঘাতক হয়, এরা মানবতার হন্তারক । বিশ্বাস ভঙ্গকারী মানুষ কখনই সমাজে সমাদৃত হয় না । ইতিহাস মীরজাফরকে কখনোই ক্ষমা করে নি । সভ্য সমাজের চলার পথের দিশা রচনার উদ্দেশ্যে রচিত হয়েছে সংবিধান, আইন । কিন্তু আইনের জুজু দেখিয়ে মানুষের অপরাধ প্রবণতা রোধ করা যায় না । মানুষের মধ্যেকার পশু প্রবৃত্তি বিনষ্ট করে বিশ্বাস-ভালবাসা-দয়া-ক্ষমা এসব মানবিক গুণাবলীর উন্মেষ ঘটাতে হবে। সকলের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করে সমাজের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করার বানীই প্রচার করে গেছেন আমাদের দেশের মনীষীগণ; সেই সনাতন ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক আমরাই ।

জয়ন্ত কুমার সরকার | Jayanta Kumar Sarkar

Travel Story 2022 | আমার বেড়ানো | পণ্ডিচেরী | মহাবলীপূরম | তিরুপতিধাম | কন্যাকুমারী

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Advantages & Disadvantages of Tattoo | ট্যাটুর উপকারিতা এবং অপকারিতা | Bengali Article 2023

ট্যাটুর ইতিহাস ও আমরা | History of Tattoo | Reasons for using tattoos | 2023

Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | bangla golpo pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Suspense story in english | suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Most Wonderful Bangla Galpo | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Most Wonderful Bangla Galpo | Pdf Most Wonderful Bangla Galpo | Most Wonderful Bangla Galpo App | Full Bangla Golpo Online Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English |Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Most Wonderful Bangla Galpo 2024 | New Bengali Web Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Most Wonderful Bangla Galpo Video | Story – Most Wonderful Bangla Galpo | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Most Wonderful Bangla Galpo Netflix | Audio Story – Most Wonderful Bangla Galpo | Video Story – Most Wonderful Bangla Galpo | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2023 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Recent story Most Wonderful Bangla Galpo | Most Wonderful Bangla Galpo book | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2023 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bengali Story – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Story Collection – Modern Online Bangla Galpo | Most Wonderful Bangla Galpo – Vlog

Leave a Comment