Best Modern Online Bangla Galpo | Shabdodweep Story

Sharing Is Caring:

শিউলি ফুলের গাছ – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

শহরতলির ছাদে ছাদে আর গলিতে গলিতে আলোকমলা আর নানান বাজি ফাটা শুরু হয়ে গেল। এখনও দীপাবলির তিন দিন বাকি। যেদিন শ্যামা কালী পুজো সেদিনই দীপাবলি। খোকন হালদার বছর দশেক আগে গ্রাম ছেড়ে শহরতলির বাসিন্দা। সুখের আশায় গ্রাম ছেড়ে আসা তা পূরণ হল কই! পূরণ হোক আর নাই হোক, দীপাবলির রাতটা কিভাবে পার করবে সেই চিন্তা মাথার মধ্যে অনবরত পাক খাচ্ছে। গত বছরের অভিজ্ঞতা মনে পড়লে বুকের মধ্যে ধুক-পুকুনি শুরু হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে একটা সূত্র পাওয়া গেল। শ্যামা কালী পুজোর দিন যদি গ্রামের পুরোনো বাড়িতে যাওয়া যায়, কেমন হয়! গৃহিণী জানে গত বছরের আতঙ্ক আর উদ্বেগ। সেই সন্ধে থেকে শুরু হল শব্দ অসুরের দাপাদাপি। চৈনিক কারিগরের দক্ষতায় ঘরে ঘরে আলোর বন্যা। আলো আর শব্দের লাগামহীন উৎপাতে যার কিছু হোক বা না হোক খোকন বাবুর অবস্থা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। নির্ঘুম সারা রাত তার বিড়ালটি কোলে করে নিয়ে কেটেছে।

হাঁপানির রোগী, শব্দ হলেই প্রতিক্রিয়া তার ওপর ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার উপস্থিতি। হাত জোড় করে অনুরোধ করলেও কেউ কর্ণপাত করেনি। পাড়া বে পাড়ার নাবালক থেকে ধাড়ি,সবাই শব্দ বাজি আর বিচিত্র বাহারি চোখ মুখ জ্বালা করা রঙিন ধোঁয়া উদ্রেককারী বাজিতে আগুন দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ‘গাজা ভূখণ্ড’ আক্রান্ত হয়েছে শত্রু বাহিনীর হাতে। মিনিট মিনিটে চারিদিক থেকে শব্দের ঢেউ ঘরের দরজা জানালায় আছড়ে পড়ছে। শেষ রাতে ‘যুদ্ধ বিরতি’। তখন সংলগ্ন বাতাস হয়ে গেছে ভারী। ধোঁয়ার চাদর মুড়ি দিয়ে মানুষ হাঁপাচ্ছে। চেষ্টা করেও পুজোর আগের দিন খোকন তার গ্রামের বাড়িতে যেতে না পারলেও, পুজোর দিন দুপুরে বাড়িতে হাজির একা। বাড়িতে সবাই এই একাকীত্বের কারণ জানতে চাইলেও উত্তর দিতে পারেনি সে। শহর জীবনে প্রাচুর্য থাকলেও প্রশান্তি নেই, এই কথাটি সে বোঝাতে পারল না। মূল সড়ক থেকে গ্রামের সেই চেনা পথ দিয়ে সে আসছিল, ঠিক দুপুরে। পথ ঘাট, বাড়ি ঘর সব যেন নতুন নতুন। আসলে গ্রামের ভূগোল গেছে বদলে। তবুও সে গ্রাম এখনও ছায়াময়, মায়াময়, ভালোবাসার ঠিকানা। উত্তর ষাটের খোকন হালদার চেনা মুখ দেখে কথা বলে, তখন যেন সেই বাল্যের দিনগুলো এসে হাজির হয়। সেই সব প্রাণচঞ্চল মুখগুলো আজ বয়সের ভারে মলিন, তবুও হাসি মুখে কুশল বিনিময় ক্লান্ত দুপুরে বাড়তি প্রাপ্তি।

তাদের পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে, বাঁশ ঝাড় ডাইনে রেখে, কাঁঠাল গাছের নিচ দিয়ে এসে স্নানের ঘাট। ঘাটের পাশে চালতা আর বাতাবি লেবুর গাছ। কী সুন্দর হলুদ বর্ণের লেবু ঝুলছে গাছের ডালে। সে তো লেবু নয়, পৃথিবী ঝুলছে মহাকাশে। এই ক্লান্ত দুপুরে মা বারান্দায় বসে কাঁথা বুনতো। খোকনকে দেখা পেয়ে কী ব্যস্ত হত, আনন্দে যেন মায়ের দুটো ডানা গজাত। খোকনের দু চোখ তখন ব্যস্ত চারিধারে, কী ছিল কী হল এবং কী হবে। আজ তার মাতৃহীন জন্মভূমির ভিটে। শুধু মায়ের হাতে পোঁতা শিউলি গাছটা বেশ বড় হয়েছে। দেখলে দুচোখ জুড়িয়ে যায়।

শহরতলির ব্যস্ততা এখানে নেই। শরৎ পার করে হেমন্তে সেজেছে তার গ্রাম। চির কালের অভ্যাস মত বিকেলে চেনা মাঠের দিকে গিয়ে বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল, – “একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী “। সামনে আদিগন্ত শস্যবতী ধানখেত। আসন্ন গোধূলি। দিনের শেষ আলোর আভা কে যেন বিছিয়ে দিয়েছে সারা মাঠ জুড়ে। কৃষকের পরিশ্রম সফল হয়েছে আজ হেমন্তের দিনে। আসন্ন নবান্নের দিন, কৃষাণীর স্বপ্ন পূরণ হবে। ক্ষণিকেই খোকন হালদার গ্রামের জীবনে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। সমস্ত প্রকৃতি যেন তাকে আবাহন করে নিতে চায় আজিকার গোধূলি লগনে। আজ সে অভিভূত!

সাঁঝের প্রদীপ জ্বালানোর আগে সে ঘরে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু অমাবস্যার আলো আঁধারি তাকে যেন নিশ্চল করে দিয়েছে। হালকা উত্তুরে বাতাস, আকাশের বুক চিরে সীমিত সংখ্যক তারা জ্বলে উঠেছে। পাখির কলতান বন্ধ হল সবেমাত্র। ক্ষণিকের জন্য জীবন ও জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হঠাৎ দূর থেকে ভাইয়ের ডাক। ডাক শুনে তার সম্বিৎ ফেরে। অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে। সন্ধে পার করে চলত তাদের আড্ডা, ফাল্গুন মাসের জোছনায় ওই খটখটে শুকনো ধানজমির ঘাসের উপর বসে। তখন বাবা ডাকত, দূর থেকে গম্ভীর আওয়াজে। তাদের সেই বিদ্যুৎ হীন গ্রাম এখন আলো ঝলমল। ব্যস্ত সবাই বাড়ির, আজ যে পুজো অন্ধকারের কল্পিত দেবী শ্যামা কালীর। দক্ষিণ পাড়ায় গ্রামের সর্বজনীন পুজোর মাইক বাজে। সেখানেও পুজোর তোড়জোড়। কত স্মৃতি ভিড় করে আসে খোকনের মাথার ভিতর। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো তাদের গ্রামের এই পুজো। ছোটবেলায় কত উন্মাদনা এই পুজো নিয়ে। সে এক অন্য আঙ্গিকের পুজো আর অনুষ্ঠান। এখন সে সব অনুষ্ঠান হয়না। ছিল না কোন শব্দের তাণ্ডব, আলোর চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনী। অনেকদিন পর মনে হয় আজ রাত তার কাছে হবে শব্দহীন, উদ্বেগ আর আতঙ্কহীন।

ভোরের আলো ফোটার আগে ঘুম ভেঙে গেল খোকন বাবুর। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই শিউলি ফুলের সুবাস, হৃদয় গেল ভরে। হিম ছোঁয়া বাতাস সঙ্গে শিউলি ফুলের টাটকা সৌরভ, যেন এক অন্য পৃথিবী। আস্তে আস্তে সে গিয়ে দাঁড়ালো মায়ের সেই শিউলি গাছের নিচে। সেদিনের সেই ছোট চারা গাছটি আজ পল্লবে, কুঁড়িতে গেছে ভরে। শাখা প্রশাখায় সে এক উন্নত শির নিয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের তুলসী মঞ্চের ঠিক পাশে। তার মনে হল সে যেন তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মা ভোর বেলা উঠে সতেজ ফুলগুলো দূর্বা ঘাসের উপর থেকে কুড়িয়ে সাজিতে রাখত। আজও শিশির ভেজা ফুল গুলো কী সুন্দর ঝরে পড়ছে টুপ টুপ করে গাছের সমস্ত শাখা থেকে। প্রকৃতির এক অদ্ভুত দৃশ্য এই প্রথম খোকন হালদারের কাছে। হেমন্তের ভোর ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। গাছের চারিধারে শিউলির গন্ধ, মধ্য রাতে কুঁড়ি থেকে জন্মানো ফুল গুলো শেষ রাত থেকে ঝরে পড়ে মাটির পৃথিবীতে। ক্ষণ জন্ম নিয়ে যে এল, সে তো মানুষের বুক ভরে দিয়ে গেল অনেক সুবাস। হঠাৎ শ্বেত বসনা কে যেন ফুল কুড়ুচ্ছে, মায়ের মতন। তার বৌদি জিজ্ঞেস করে, – ঠাকুরপো তুমি এই ভোরবেলা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে কেন, ঠান্ডা লেগে যাবে যে!

খোকন হালদার কিছুক্ষণ নিরুত্তর, সে হয়তো অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছে। যেখানে নেই কোন শব্দের উৎপাত, অসংস্কৃত মানুষের দল, দূষণ দুষ্ট আবহাওয়া। তারপর সে উত্তর দিল, – মায়ের হাতে পোঁতা গাছ কত বড় হল দেখ। মাও তোমার মত ফুল কুড়িয়ে সাজি ভরত ভোর বেলা। মা হয়তো আজ শিউলি গাছ হয়ে গেছে। তুমি শ্বেত বসনা আমাদের মা হয়ে গেছ। তখন সাজি ভরা শিউলি ফুল হাতে বৌদি তার সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে সজল চোখে। অমাবস্যার রাত শেষ হয়ে তখন আলো ফোটার অপেক্ষায়।

কালো হরিণী চোখ – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

সুরেশ, সীমান্তকে নিয়ে যখন চণ্ডীপুর থানায় ঢুকলো, তখন বিকেল তিনটে। ভাড়াবাড়িতে থানা। কেমন আগোছালো ভাব। মানুষ গুলোও। ঠিক থানা বলে তো মনে হয় না। কিন্তু ওদের তাতে কী যায় আসে! ডিউটি সম্পাদন মূল বিষয়। এক অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখানে আসা। কজন স্কুলের ছাত্রী এক কনস্টেবল কে প্রণাম করে, কোন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ লিপি দিচ্ছিল। ওই ভদ্রলোক থানার খেলাধুলোর বিষয়টা দেখেন। সবে মাঘ মাস পড়েছে। এ বছর শীত ভালোই বিছানা মেলেছে। তাই গৃহস্থের ছাদে, রেলিঙে, উঠোনে বিকেলের রোদ পোহাচ্ছে লেপ, কাঁথা, বালাপোষ ইত্যাদি ইত্যাদি। আসার পথে হাওয়ার ঝাপটায় রীতিমত কাঁপ দিচ্ছিল।

বড়বাবু নেই, কোথাও কাজে বেরিয়েছেন। মেজ বাবু খেতে গেছেন। আমরা যতই খবর নিতে বলি, ততই কনস্টেবল ভদ্রলোক, গল্পের জাল বিস্তার করেন। পুলিশের অসহায়তার হাজার কাসুন্দি। কোনো এক শাশুড়ি বৌমার গল্প। পাড়ার পারিবারিক কোন্দলের জেরে, শাশুড়ি বৌমা যুগলে থানায় এসেছে অভিযোগ করতে। আবেদন পত্র লেখার শেষে শাশুড়ির দস্তখতের প্রশংসা করেছিলেন মেজবাবু। এই প্রশংসায় বৌমার হোল গোঁসা, তিনি শুনিয়ে দিলেন, – আমিও সই করতে পারি! একটা সাদা কাগজ দিয়ে নমুনা দেখতে চাইলেন ওই অফিসার। শেষে আবার যখন শাশুড়ির হাতের লেখার প্রশংসা, তখন উল্টো বিপত্তি। শাশুড়ির প্রশংসায় বৌমার পিত্তি জ্বলে এবং শাশুড়ির বিরুদ্ধে অন্য এক অভিযোগ জমা দিয়ে উভয়ের দ্রুত প্রস্থান। ইতোমধ্যে মেজবাবুর প্রবেশ ঘটেছে। তিনি ঝগড়া প্রিয় বৌমার চিরকুটে লেখা দস্তখত দেখিয়ে ছাড়লেন। একটা কাগজে লেখা, ‘ময়নামতি সামন্ত’ । খুব কষ্ট করে পাঠোদ্ধার করা গেল। তারপর যে ঘটনার নেপথ্য রহস্য সন্ধানে ওরা এসেছে তার কুড়টা ধরিয়ে দিলেন মেজোবাবু।

শশীকান্ত দাস, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক। বীথিকা, কণিকা আর মালবিকা, তিন মেয়ে ও স্বামী স্ত্রীর সংসারে আপাত কোন অভাব ছিল না। শিক্ষিত এবং শালীন পরিবার। প্রথম ও তৃতীয় মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন, পাড়া পড়শিদের কাছে ভদ্র পরিবার। অকস্মাৎ বাড়ির মেজো মেয়ের মৃত্যু, সংসারটা বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেল! মেয়েটি প্রাইমারি স্কুলের একজন প্রিয় শিক্ষিকা। মাস দুই আগের এক সকালে শশী বাবুর এক পরিচিত বাসিন্দা এসে বলেন, – স্যার ওই বাড়ির মেজো মেয়ে খুব সকাল থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কী করা যায় বলুন তো! – আমরা মশাই পুলিশের লোক, কোন অভিযোগ ছাড়া আগ বাড়িয়ে কিছু করতে পারি না। তবে ওনার শুভানুধ্যায়ী হিসেবে বলছেন যখন, বিকেলে একবার যেতে পারি। ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিন্তু দুপুর দুটোর পর খবর এলো, ওই মেয়েটি স্বহস্তে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তমলুক হাসপাতালে ভর্তি। আমার আর যাওয়া হল না, মনে হোল ভুল করলাম।

মেজোবাবুর পথ নির্দেশের সূত্র ধরে ওরা শশী বাবুর বাড়ির হদিস পেল। সংশ্লিষ্ট ব্লকের বিডিও অফিসের কাছাকাছি দু তলা সাজানো বাড়ি। দরজায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে এক ভদ্রমহিলা ওদের প্রবেশাধিকার দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। বোঝা গেল উনি শশী বাবুর স্ত্রী। বাড়িটি বড়ো রাস্তার খুব কাছেই। মেচেদা – দীঘার ব্যস্ততম রাস্তা। ঠিক শহরতলী নয়, গ্রামও নয়। প্রযুক্তিময় সভ্যতার এক অদ্ভুত নগরী। অতিথিদের মত করে বসার ব্যবস্থা করলেন, বারান্দায় নয় নিচের তলার একটা ঘরে। ভদ্রমহিলা অনেকটা শোক সামলে নিয়েছেন, কিন্তু শশী বাবুর আত্ম – যন্ত্রণা সীমাহীন। মেয়ের কথা বলতেই ঝর ঝর শ্রাবণের ধারায় চোখ ভাসছে। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ঘটনাটা।

‘মেয়েটা শেষ করলো নিজেকে, আমাকেও হয়তো ওই পথে বেছে নিতে হবে এই সত্তর উত্তর কালবেলায়! সরকারি আধিকারিক ছিলাম শিক্ষা দপ্তরে এবং অবসরের পরেও দপ্তরের প্রয়োজনে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছি। সুনাম ছাড়া দুর্নামের কোন ছায়া গ্রাস করেনি দীর্ঘ কর্মজীবনে। কিন্তু মেয়েটা দুর্নামের ভারী পাথর আমার বুকের উপর চাপিয়ে দিয়ে গেল।’ – একটানা বলে আবার কান্নার দমক!

তিনটি সন্তানই কন্যা। বড়োটি এম এ পাশ এবং হাই স্কুলের শিক্ষিকা ও বিবাহিতা। ওই ছিল মেজো। বিগত নয় বছর ধরে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। স্কুলে, পাড়ায়, পরিচিত পরিজনদের প্রিয়তমা। বাবা-মার আদরের স্নেহের কোন খামতি ছিল না। অসম্ভব উচ্চাশা আর প্রচণ্ড জেদ। গায়ের রংটা ছিল চাপা আর সেজন্য মানসিক একটা অস্বস্তি। এবং সেইটি শেষে কাল হোল তার বত্রিশ ছুঁই ছুঁই জীবনে। ছোট মেয়েটা বাগনানের একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। বয়স হচ্ছিল, বাবা মা চাইছিল পাত্রস্থ করতে। বড়ো মেয়ে জামাই বেশি উৎসাহী ছিল তার বিয়ের ব্যাপারে। শশী বাবু একটু পিছনের যাপন চিত্রে গেলেন। সালটা হবে ২০০২, হঠাৎ একটা মানসিক অস্থিরতা। বলা যেতে পারে মানসিক অসংলগ্নতা । প্রথমে ভাবা হয়েছিল, সেরকম কিছু নয় হয়তো। কিন্তু বাবা মায়ের মন, তখন থেকেই নামী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া শুরু। কখনও দিব্যি ভালো আবার কখনও অসংলগ্ন। বাড়িতে থাকলে বাড়ে অস্বস্তি। কর্মস্থলে প্রচণ্ড সিরিয়াস। যেন এক বিচিত্র ধাঁধা। শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়া হোল সু চিকিৎসার জন্য। কিছুদিন স্বাভাবিক মানুষের মত, মনে হোল তাদের, সুদিন বুঝি এলো। কিন্তু না!

মাকে বললো, – মা চা খাবো। চা করে কাপ হাতে দিয়ে পিছন ফিরতেই, মায়ের পিঠে গরম চা ঢেলে দিয়ে সে প্রমাণ করলো তার বাতুলতা বিদ্যমান। – তোমরা আমাকে ভালোবাসো না, কেন আমি কালো বলে! তোমরা তোও কালো, তবে আমায় দেখতে পারো না কেন? … আমি বিয়ে করবো কলকাতায়, যে সে ছেলের সঙ্গে নয়। ফর্সা। তার কলকাতায় বাড়ি, গাড়ি থাকবে। ….. বাবা তো শিক্ষা দপ্তরে কাজ করে, তবে আমি কেন এমএ পাশ করে প্রাইমারি টিচার! হাই স্কুলে চাকরি আমার দিতেই হবে। – পাগল মেয়ের অসম্ভব আবদার। এভাবেই চলছিল এক বিচিত্র সংসার যাত্রা। সঙ্গে চলছিল চিকিৎসা এবং পাত্র দেখা। দশবার কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হোল। মধ্যমানের অনেক ছেলে পাওয়া গেল, কিন্তু মেয়ের কোন পাত্রকে পছন্দ হল না। এখনও বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ের জন্য পাত্রী দেখানো, বিশেষ করে শ্যাম বা কৃষ্ণ বর্ণের, খুবই যন্ত্রণার ও বেদনাদায়ক। সব পছন্দ হল পাত্র পক্ষের। জাগল আশা, অন্ধকারের বুক ফেটে। শেষে জানায় ফোনে কথা হবে। এ বাংলায় ঘরে ঘরে আজও সেই মর্মস্পর্শী ছবি। প্রত্যেক সপ্তাহে, মেয়েকে সেজে বসতে হয়, পাত্র পক্ষের শকুন চোখের সামনে। কোনো মতে মন ভরাতে পারে না, অভাগী কালো মেয়েটা। যদিও তার গুণবতী স্বভাব – চরিত্র মরমী মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত! জগৎ ও জীবনকে সে ভালবাসে অন্য পাঁচটা মানুষের মত।

দিন দিন তার মানসিক এবং দৈহিক ভাঙন শুরু হয়। শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে, বাবা – মার হৃদয়ের অপার অতল যন্ত্রণা। বাংলার সেই আবহমান বিবর্ণ চিত্র নাট্যের শেষ হল না কোনো দিন! কলকাতার ছেলেরা এত দূর আসতে পারে না। তাই তাদের ইচ্ছে অনুসারে বার পাঁচেক মেচেদাতে লজ ভাড়া করে, পাত্রী দেখানোর ব্যবস্থা করা হোল। ধন্য আশা কুহকিনী! সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা গেল, পাত্রীকে পাত্রস্থ করা সম্ভব হল না। কলকাতার এক খ্যাতনামা চিকিৎসকের পরামর্শে কাউন্সেলিং এর জন্য একটা নামী নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হোল। কিছুদিন আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে, সেই পুরনো চিত্রের করুণ পুনরাবৃত্তি।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস। সেই বীভৎস কালো রাক্ষুসে দিনটা এলো। সেদিনের কথা মনে পড়লে শশী বাবুর বুকটা, কালবৈশাখী ঝড়ের সময় শুকনো তালপাতার কাঁপনের মত করে কাঁপে। সেদিন সম্ভবত ওর স্কুল ছিল না। সবাই বাড়িতে। বেলা যত বাড়ে, বাঁধ ভাঙা বেপরোয়া অবস্থা হল মেয়ের। সবাই যেন বুঝতে পারলো, – বিপদের অশনি সংকেত। কেরোসিন ভেজা আপদ বস্ত্রের আগুন সহ, যখন সে নিচের ঘরে নামলো, সমস্ত আকাশ যেন ভেঙে পড়লো সাজানো ওদের বাড়িটার মাথায়। বাঁচার শেষ চেষ্টায় যত দৌড়াদৌড়ি করছিল, ততই আগুনের লেলিহান শিখা তার সারা শরীরে ছোবল বসিয়ে দিচ্ছিল। ছোটো মেয়ের ধাক্কাতে, যখন সে পড়ে গেল, শরীরে পুড়ে যাওয়ার মত জায়গা আর ছিল না। ….. অ্যাম্বুলেন্স যখন ছাড়ছে তখন সে পাগল। শুধু বলছে, – বাবাই আমার মেরে ফেললো। আমি কালো বলে ঘৃণা করতো, তাই আমার এই দশা। রাস্তার পাবলিক আর ভুঁইফোঁড় সাংবাদিক হামলে পড়লো নিমেষেই। চণ্ডীপুর হাসপাতাল থেকে তমলুকের হাসপাতাল। বাবা মেয়েকে বাঁচাবে না মুমূর্ষু মেয়ের গঞ্জনা শুনবে! শশী বাবু মনে মনে প্রার্থনা করছেন, – ধরণী দ্বিধা হও। কণিকাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবাই। তমলুক থেকে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতা। সেখানেও তেমন আশার কথা শোনা গেল না। কিডনি নাকি প্রচন্ডভাবে আক্রান্ত। একদিন পর আবার ফিরিয়ে আনা হল তমলুক জেলা হাসপাতালে।

যমে মানুষে তিনদিন টানাটানির পর তাকে বিদায় জানানো ছাড়া অন্য পথ আর রইলো না! হতভাগ্য বাবার মুখ পুড়িয়ে সে এখন অনন্ত পুরের বাসিন্দা। ছবি হয়ে দেওয়ালে পিঠ রেখে বাবা মাকে দেখছে কেমন! মুখ টিপে টিপে হাসছে আর বলছে, – কেমন ফাঁকি দিলেম বলো, কাঁদো তোমরা অনন্ত কাল। মুক্তি দিলেম কালো কুচ্ছিত মেয়েটা। নিজের ঘরের দেওয়ালে কী সব লিখতো। এখনও মুছে দেওয়ার স্পষ্ট দাগ। কিন্তু বাবা মার হৃদয়ের ক্ষত তো মোছার নয়! হয়তো তার দেওয়ালের লেখার মধ্যে ফুটে উঠত, সমাজের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ। সাজানো বিছানা, বই, আলমারি। সাজাতে ও সাজতে খুব ভালোবাসতো। বাবা মাও তেমনভাবে সমস্ত সত্তা দিয়ে মেয়েকে ভালোবাসতো। যদি পরজন্ম থাকে, ও যেন আবার এই বাবা মার ঘরে টুকটুকে ফর্সা মেয়ে হয়ে আসে!

বুকভরা কান্না নিয়ে শশী বাবু করুণ এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরলেন। যতই সুরেশ আর সীমান্ত উঠতে চাইছে, বাবা কান্না দিয়ে সমস্ত যন্ত্রণা ভাসিয়ে দিতে চায়। ‘সত্যি বলছি, ওকে কালো মেয়ে বলে কোনদিন ভাবিনি, ও ছিল আমাদের হৃদয়ের ধন, সন্তান এক। এখন মনে হচ্ছে, সমস্ত আকাশে – বাতাসে – আলোতে আগুনের লেলিহান শিখা ধেয়ে আসছে আমার দিকে ! আর সেই আগুনের স্বর্ণালী আলোর মধ্যে বসে আমার হতভাগী মেয়েটা, বত্রিশটা বসন্ত কে পোড়াচ্ছে। ও! কী বীভৎস সেই মৃতদেহটা! কেবলমাত্র ওর কাজল কালো চোখ দুটোতে ফুটে উঠেছিল এক আকাশ বাঁচার আর্তি!’ ….

শশীকান্ত বাবুর বাড়ি থেকে যখন বের হোল ওরা, মাঘ মাসের বিকেল দিনের সব আলো শুষে নিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে বসে সুরেশ ভাবছে, কী ভাবে সে রিপোর্টটা লিখবে!

অবতরণ – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

অধীরবাবুর চাকরি আর দু-বছর চার মাস বাকি। এখন থেকেই বিভিন্ন অফিসে খোঁজ খবর চলছে, বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিচ্ছে। আসলে অবসরের পরে কোন একটা প্রাইভেট কনসার্ন বা সরকারি অফিসে কাজ পেলে সময় কাটবে আবার পয়সাও আসবে। এই মতলবে শুধু কী অধীরবাবু একা ঘোরে! অবসরের কাছাকাছি এমনই অনেকেই অনুসন্ধানের লাইনে। বিজ্ঞাপন দেখা আর বিভিন্ন অফিসে যাতায়াত করে একটা কাজের যোগাড় অর্থাৎ পুনর্বহাল। কিছু চাকরিজীবীর প্রয়োজন আছে সেকথা অস্বীকার করা যায় না। অওনেকে বাড়িতে বসে থাকতে পারবে না এই অজুহাতে চাকরি খোঁজে। আবার কোন কোন চাকরিজীবী অফিসে অপরিহার্য হয়ে পড়েন, অবসরের পর তাঁরা সহজেই পুরনো অফিসে থেকে যান অন্তত পাঁচটা বছর।

সুযশ মণ্ডল অধীর বাবুর সহকর্মী। তাঁরও অধীর বাবুর তিন মাস পরে বিদায় ঘণ্টা বাজবে। ব্যাপারটা নিয়ে তার কোন উদ্বিগ্নতা নেই। ছেলেটি বেকার, মেয়েটিরও পাত্রস্থ করতে পারেননি। স্ত্রীর তো ভাবনায় ভাবনায় রাতের ঘুম প্রায় উধাও। স্বামীর অবসরের দিন যতই এগিয়ে আসে ভাবনার আঁধার যেন তাঁকে ঘিরে ফেলে ক্রমশ। অফিসে কাজের লোক হিসেবে সুযশ বাবুর যথেষ্ট যশ আছে। সহকর্মীরা সব সময় তাঁর সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞও বটে। আধিকারিক বৃন্দ তাঁর ফাইল আগে ছাড়ে, কোন কিছুতে আটকে গেলে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে। সারাটা সময় ফাইলে মুখ গুঁজে কাজ করে চলেছেন। পাশের ধীরেন চাটুজ্যে মাঝে মাঝে সেই সংস্কৃত বাক্যটি শোনায়, – কর্মন্যে ব্যধিকা….. ফলেষু কদাচন। সুযশ বাবু ফাইল থেকে মুখ তুলে শুধু মিচ মিচ করে হাসে। জুনিয়র সহকর্মীরা কাজের ফাঁকে তাঁর কাছে আসে, গল্প করে। জিজ্ঞেস করে আর কতদিন দাদা ? তিনি একদম যেন মুখস্থ বলে দেন, – একবছর এক মাস। কী করবেন দাদা, অবসরের পর ? কিছুই না । সাবলীল ভাবে উত্তর দেন সুযশ। সময় কাটবে কী করে? – সময় কী আমার জন্য বসে থাকবে ভায়া ! ঠিক কাটবে। প্রতি বছর এই অফিস থেকে অনেকেই অবসর নেন। তারা দেখেছি কেমন যেন আতঙ্কে থাকেন যত অবসরের সময় এগিয়ে আসে। এই মানুষটার দেখছি কোন বিকার নেই, পুরোদমে অফিস করে যাচ্ছে। আবার বলে কী না, যেদিন কাজের বেশি চাপ থাকে আর তার বেশির ভাগ বা সম্পূর্ণ করতে পারলে মনটা ভরে যায়, যাকে বলে satisfaction । এইসব ভাবতে ভাবতে সহমর্মী চলে যায় তার টেবিলে।

তার বড়দা সুযশকে বলতো অফিসে অনেকেই বন্ধু হবে, কিন্তু কাজের সময় কেউ পাশে থাকবে না। নিজের কাজ নিজের দায়িত্বে করতে পারলেই নিরাপদ থাকা যায়। কেউ কারোর দায় নেবে না। ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। আগের কালে ছিল বিষয় ভিত্তিক ফাইল। তাতে সমস্ত সংশ্লিষ্ট গাইড লাইন, চিঠিপত্র, নোট শিট, তাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মন্তব্য নির্দেশ থাকতো। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ড্রাফট তৈরি করবে স্টাফ। এই ভাবেই উত্তর প্রত্যুত্তরও চূড়ান্ত কাজ হত। বর্তমানে সবটাই কম্পিউটার নির্ভর। একালের ছেলেপুলেরা বেশ পোক্ত প্রবীণের দল তাই আজ অকেজো।

কাজের গতি বেড়েছে কিন্তু মাঝখানে বেশ ফাঁক থেকে যাচ্ছে। অবশ্য সেই ব্যাপারটা আজকের তরুণরা বুঝবে না। অফিসের কাজের যে একটা স্বচ্ছ পদ্ধতি ছিল তা যারা করেছে তারাই বুঝতে পারে ‘ফাইল মাহাত্ম্য’। কোন কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফাইলের ‘নোট শিট’ আর ‘ট্যাগ’ দিয়ে আটকে রাখা চিঠি সব কথা বলবে। সুযশ বাবুর মনে পড়ে, চাকরি জীবনের শুরুতে তার লেখা ‘ড্রাফট’ দেখে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক নোট শিটে লিখেছিলেন বড় বড় করে, – A good draft! আজও যেন তিনি সেই লেখাটা দেখতে পান।

……. দেখতে দেখতে সুযশ বাবুর হাতে গোনা দিনগুলো কিভাবে যে শেষ হয়ে গেল, নিজেই বুঝতে পারলে না। সময়ের রেলগাড়ি এইবার তার স্টেশনে এসে থামলো। বিভিন্ন জেলায় কর্মসূত্রে কেটেছে তার। অবসরও তার সেই এক ভিন জেলায়। এক ভদ্রলোকের বাড়ির ‘দেড় তলার’ একটা ঘরে থাকতো। স্বপাকে খাওয়া দাওয়া এবং হেঁটে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অফিস। সহকর্মীরা বলতো, – কিভাবে পারেন আপনি এই অফিস সামলে রান্না বাড়ি! রাতে কী খান, ভাত না রুটি! রুটি শুনে সবাই অবাক হয়ে বলতো, – আপনি রুটি গোল করে তৈরি করতে পারেন! সুযশ বাবু বলতেন, – ভাবছেন রুটির আকার ম্যাপের মতন হয়ে যায়! একদম না, গ্রহের মত গোলাকার রুটি, পরখ করতে আমার বাসায় যেতে হবে। শুধু মাছ ভাজাটা একটু অসুবিধা হয় বটে। ভাত গলে যায় না, ঝরঝরে হবে। যখন কুচবিহারে ছিলাম পুরনো মেসে মাঝে মাঝে বন্ধুদের ভাত রেঁধে দিয়ে আসতে হত। সে বেলার খাওয়া ফ্রী। কিছুদিন পরে পরিবার নিয়ে অন্য বাড়িতে তখন থাকতাম ওদের মেসের কাছাকাছি। সেসব গল্প বলতে গেলে ফুরোবে না।

মাঝে মাঝে তার মনে হয়, কী ভাবে তেত্রিশটা বছর চলে গেল জীবন থেকে! মন থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে কী স্মৃতির ছবিগুলো! সংসার আর সংসারের মানুষগুলোকে ভালোভাবে দেখার ফুসরত পাওয়া যায়নি, শুধু অফিস আর অফিস। বেচারি স্ত্রীর ঘাড়ে সব কিছু দায়িত্ব দিয়ে তার সামাল দিতে হয়েছিল কাজের নানান ঝক্কি তথা অর্পিত দায়িত্ব। পাশের সহকর্মী সুশান্ত রায় বলতো, – যত কর ভাই, কেউ তোমার এই পরিশ্রম মনে রাখবে না। কথাটা সত্যি, কিন্তু নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে চলা তো যায় না। কেউ মনে রাখে না কী করে বলি! সুযশ বাবু একদিনের কথা ভুলতে পারে না আজও। তখন পোস্টিং কোন এক মহকুমা শহরে। সেদিন অফিসে অনেক মানুষের সঙ্গে এক নিরীহ সাধারণ মানুষ কে দেখে তাঁর অবাক লাগলো। মলিন ধুতি আর জামা গায়ে এবং মাথায় একটা আধ ময়লা গামছা। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ঘরের সামনে একবার তো অন্য ঘরের সামনে। কেউ যেন তার পাত্তা দিচ্ছে না। কী করে সে বাবু দের টেবিলের সামনে যাবে তার কুড় খুঁজে পাচ্ছে না মনে হল। শেষে সুযশ বাবু অফিসের পিয়ন সোমনাথকে দিয়ে নিজের টেবিলের সামনে হাজির করলো। সামনের চেয়ারে বসতে বলায় মানুষটা অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেল। অনেক ক্ষণ বলার পর বসে ঘরের চারদিকে তাকায় ছোটদের মত। সুযশ বাবু বলে, – আপনার এই অফিসে কী দরকার ? বলুন তো দেখি। ঝোলা থাকে এক গুচ্ছ কাগজ দিয়ে বলেন,- জমি জমার কাগজ গুলোন একটু দেখপেন ছার, ঠিক আচে কী না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বাবু বলেন, – ঠিক আছে সব, তবে দুবছরের খাজনা বাকি ওটা শোধ করে দেবেন তাড়াতাড়ি। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে চলে গেলেন হাসি মুখে। তখন বিকেল চারটা হবে, এই অফিসে এসেছিল বেলা এগারটার সময়।

সপ্তাহ খানেক পরে বেলা বারোটার দিকে সুযশ বাবু দেখেন সেই মানুষটা গামছা মাথায় আবার দরজায় উঁকি মারছে। আফিসঘরের মধ্যে ডাকলে গুটি গুটি টেবিলের সামনে হাজির। কী খবর বলুন। খাজনা পরিশোধের রশিদ দিয়ে বলেন, – কাজ হয়ে গেচে ছার। তবে কষ্ট করে এলেন যে আবার। সুযশ বাবু বলেন। আপনার সঙ্গে দেকা করতে এলুম। আসার আগে আমাদের পাড়ার থানে পোনাম করে বলি, – ঠাকুর ওই ছারের সঙ্গে যেন দেখা হয়। সুযশ বাবু মিনিট খানেক অপলক চেয়ে থাকলেন ওই নিরীহ মানুষটার দিকে। উভয় পক্ষ নির্বাক। রশিদ খানা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, – প্রত্যেক বছর খাজনা শোধ করে দেবেন না হলে অনেক টাকা একসঙ্গে পরিশোধ করতে কষ্ট হবে, বুঝলেন? মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর উত্তর দিলেন। তারপর আবার দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুযশ বাবু বেশ কিছুক্ষণ মানুষটার কথা ভাবলেন। কিছুই তো করা হয়নি মানুষটির জন্য। অথচ ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেন।

…… দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পার, তিন দশকেরও বেশি কালের ধারাবাহিকতা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন। এখন সম্পূর্ণ এক আটপৌরে জীবনের মধ্যে তাঁর অবস্থান। মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ তার ভালো লাগতো সেই ছোটবেলা থেকে। জীবনের প্রথম আড়াই দশক সে ছিল মাটির কাছাকাছি। তারপর তিন দশকের উড়ান। মানসিকতা যদিও মাটির দিকে নিবদ্ধ, তাই আপ্রাণ চেষ্টা ছিল মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন আরো বেশি করে বোঝার প্রচেষ্টা । সে কাজে সে কতটা সফল অথবা বিফল তা সে নিজেই জানে না। উড়ান থেকে ফিরে এসে তাই উড়ানের দুঃখ সুখ মান অপমান নিয়ত সংগ্রাম, তথাকথিত উচ্চ আসনে আসীন মানুষের মানসিকতা ঘৃণা অনুভূতিহীন আচরণ অবশ্য সীমিত ব্যতিক্রম ছাড়া, ভুলে গেলেন।

এখনকার যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মানসিকতার সঙ্গে নিয়ত দ্বন্দ্ব। মূল্যবোধের শূন্যতা, নীতি হীনতা, সোজা পথের অভাব, পাশবিক শক্তির বাড় বাড়ন্ত, সর্বোপরি সমাজ ব্যবস্থায় এক ঘূর্ণির মধ্যে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। এখন তাঁর মনে হয়, সে এক অচেনা গ্রহের জীব। তবু তাঁর বাঁচতে হয় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, অনিয়মের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কুকথা আর অশ্লীলতার বাতাবরণে যেন বিধি বৈপরীত্যের দয়ায়। অনাকাঙ্ক্ষিত শুকিয়ে যাওয়া সমাজ চেতনার মধ্যে সে যেন এক অচেতন জীব!

কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya

Fathers Day History | পিতৃ দিবসের ইতিহাস ও বাঙালি আবেগ | 2023

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Advantages & Disadvantages of Tattoo | ট্যাটুর উপকারিতা এবং অপকারিতা | Bengali Article 2023

ট্যাটুর ইতিহাস ও আমরা | History of Tattoo | Reasons for using tattoos | 2023

Modern Online Bangla Galpo | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Modern Online Bangla Galpo | Pdf Modern Online Bangla Galpo | Modern Online Bangla Galpo App

Full Bangla Golpo Online Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English |Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Modern Online Bangla Galpo 2024 | New Bengali Web Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Modern Online Bangla Galpo Video | Story – Modern Online Bangla Galpo | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Modern Online Bangla Galpo Netflix

Audio Story – Modern Online Bangla Galpo | Video Story – Modern Online Bangla Galpo | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Recent story Modern Online Bangla Galpo | Top Story Modern Online Bangla Galpo | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bengali Famous Story

Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2024 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bengali Story – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Story Collection – Modern Online Bangla Galpo

Leave a Comment