Mangal Kabya Katha | Best Bengali Puran Katha

Sharing Is Caring:

বাঙালির নিজের পুরাণ : মঙ্গলকাব্যকথা – অভিজিৎ পাল

সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী থেকে স্বতন্ত্র বাঙালি জাতির বিকাশ ঘটেছিল। বঙ্গে হিন্দু-বৌদ্ধ রাজশক্তির সময়কালে বাংলা সাহিত্যের উন্মেষ ঘটেছিল। তুর্কিরা মগধ জয় ও বিধ্বস্ত করে বঙ্গ অধিকার করে বঙ্গে ধ্বংসলীলা চালাতে শুরু করলে স্ব-সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে বাঙালি জাতি সচেষ্ট হয়েছিল। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হতে সময় লেগেছিল প্রায় দেড় শতাব্দী। সময়ের দাবিতে বাহ্য-বিভেদ মুছিয়ে অখণ্ড বাঙালি জাতির ঐক্য পুনর্গঠনের ক্ষণ উপস্থিত হয়েছিল। এই ধর্ম-সাংস্কৃতিক মিলনের সময়ে অনার্য তথা লৌকিক দেবদেবীরা রক্ষিত হয়েছিলেন নতুন পরিচয় ও পূজাবিধিতে। যেমন—মনসা হয়ে উঠেছিলেন শিবকন্যা, চণ্ডী মিশে গিয়েছিলেন দুর্গাতে। এভাবেই পরিবর্তন লাভ করেছিলেন ধর্ম, দক্ষিণরায়, শীতলা, ষষ্ঠী, পঞ্চানন প্রমুখ দেবদেবী। এই মেলবন্ধনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল মঙ্গলকাব্যগুলি। এর আগে লৌকিক দেবদেবীদের মঙ্গলকথাগুলি মূলত নারীমহলে ক্ষুদ্রাকারে ব্রতকথা ও ছড়ার পর্যায়ে সীমাবদ্ধ ছিল। কালক্রমে বিভিন্ন কবির প্রতিভা-গুণে লোকমুখে প্রচলিত মঙ্গলকথাই বর্দ্ধিতায়তন হয়ে মঙ্গলকাব্যের রূপ পেয়েছিল।১ আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে মঙ্গলকাব্যের নিজস্ব গঠন-বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছিল। মঙ্গলকাব্যের রচনারীতিতে দেবতার বন্দনা, গ্ৰন্থোৎপত্তির কারণ বর্ণনা, দেবখণ্ড ও নরখণ্ড—এই চারটি অংশ আবশ্যিকভাবে ধরা পড়তে শুরু করেছিল। প্রথমদিকে মঙ্গলকাব্য রচিত হয়েছিল লৌকিক দেবদেবীর আর্যীকরণের আকাঙ্ক্ষায়, পরবর্তীতে সাহিত্যরস আস্বাদনের জন্য নতুনতর মঙ্গলকাব্য রচনা শুরু হলে অনেক বাঙালি কবিই পৌরাণিক দেবকাহিনীকে মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিকে লিখেছিলেন। অবশ্য ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে মঙ্গলকাব্যের লৌকিক ধারা ও পৌরাণিক ধারা—প্রধান দুই ধারা একটি মিশ্রিত রূপও অর্জন করেছিল।২

বাংলার মঙ্গলকাব্যের মধ্যে সর্বাধিক প্রচারিত হয়েছিল মনসামঙ্গল কাব্য। মনসামঙ্গলের আদি কবি হরিদত্ত। তাঁর ভণিতাযুক্ত বহু পদ পাওয়া গেলেও সম্পূর্ণ কাব্য পাওয়া যায়নি। পরবর্তী কবিদের রচনায় তাঁর নামোল্লেখ পাওয়া গেছে। হরিদত্তের পর নারায়ণদেব মনসামঙ্গল রচনা করেছিলেন। তিনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ মনসামঙ্গল লিখেছিলেন। নারায়ণদেবের কাব্যে মনসার জন্মের কথা পাওয়া যায়। মনসামঙ্গলের প্রথমপর্বের প্রথম শ্রেণির কবি বিজয়গুপ্ত। তাঁর কাব্য সমগ্র পূর্ববঙ্গে দীর্ঘদিন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। বিজয়গুপ্তের সমসাময়িক মনসামঙ্গলের কবিদের মধ্যে বিপ্রদাস পিপিলাই দক্ষিণবঙ্গে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। চৈতন্য-পূর্ব সময়ের মনসামঙ্গলে মনসা ক্রূরমতি। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীর মনসামঙ্গলের কবিদের মধ্যে দ্বিজ বংশীদাস, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ উল্লেখযোগ্য। প্রায় সমস্ত মনসামঙ্গল কাব্যেই চাঁদ বণিক ধর্মপরিচয়ে শৈব, একমাত্র বংশীদাসের কাব্যে তিনি শাক্ত। মনসামঙ্গলের কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ। তাঁর কাব্যে সমসাময়িক বৈষ্ণবীয় ভাবনা, রামায়ণের প্রচ্ছন্ন প্রভাব ও সমকালীন কবিদের মধ্যে চণ্ডীমঙ্গলের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর প্রভাব রয়েছে। তাঁর কাব্যে দেবী মনসা মঙ্গলময়ী মূর্তি। চৈতন্য-বিধৌত বঙ্গের দেবভাবনায় দেবতার উগ্ৰতাপ প্রশমিত হয়েছিল। কেতকাদাসের কাব্যেও তা দেখা গেছে। নিখুঁত চরিত্রচিত্রণ, ঘটনাবিন্যাস ও কাব্যকৌশলের চমৎকারিত্ব সমগ্র মনসামঙ্গলের ধারায় কেতকাদাসের কাব্যকে অনন্য করে রেখেছে।

সমগ্র বঙ্গদেশে মনসামঙ্গলের পরে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চণ্ডীমঙ্গল। মানিকদত্ত চণ্ডীমঙ্গলের আদিকবি। মানিকদত্ত চণ্ডীকে আদ্যাশক্তি রূপে দেখিয়েছেন। তাঁর কাব্যে চণ্ডীমঙ্গলের ব্যাধকাহিনী ও বণিককাহিনী উভয়ই রয়েছে। মানিকদত্তের কাব্য বঙ্গের গণ্ডি পেরিয়ে ত্রিপুরাতেও প্রসারিত হয়েছিল। মানিকদত্তের পরে কবি মদনদত্ত, দেবীদাস সেন, শিবনারায়ণ দেব, কীর্তিদাস, বলরাম ও দ্বিজ হরিরাম চণ্ডীমঙ্গলের ধারাকে পরিপুষ্টি দিয়েছিলেন। চৈতন্য-পূর্ব যুগের চণ্ডীমঙ্গলের কবিদের মধ্যে মানিকদত্তই ছিলেন শ্রেষ্ঠ কবি। চৈতন্যদেবের সমসাময়িক কবি দ্বিজ মাধবও চণ্ডীমঙ্গলের ধারায় সাফল্য পেয়েছিলেন। দ্বিজ মাধবের কাব্যে বাঙালি নারীচরিত্রগুলি স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। চণ্ডীমঙ্গলের শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দ চক্রবর্তী। মুকুন্দ চক্রবর্তী সপ্তদশ শতাব্দীতে চণ্ডীমঙ্গল লিখেছিলেন। তাঁর কাব্যে সমকালের বঙ্গের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও প্রজানিগ্ৰহের জীবন্ত দলিল রয়েছে। মুকুন্দ চক্রবর্তী চৈতন্য-প্রভাবিত কবি ছিলেন। ব্যাধজীবনের আখ্যান রূপায়ন, চরিত্র নির্মাণ ও কাহিনী বিন্যাসে তাঁর দক্ষতা সমগ্র চণ্ডীমঙ্গলের ধারায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সুকুমার সেনের মতে, “বাঙ্গালা দেশের এবং বাঙ্গালী মানুষের এমন পরিপূর্ণ চিত্র বাঙ্গালা সাহিত্যের আর কোথাও মিলে না।”৩ এছাড়াও দ্বিজ রামদেব, রামানন্দ যতি, মুক্তারাম সেন, ভবানীশঙ্কর দাস, জয়নারায়ণ সেন প্রমুখ কবি চণ্ডীমঙ্গল লিখেছিলেন।

সমগ্র বঙ্গদেশে মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গলের প্রসার ঘটলেও রাঢ়বঙ্গে সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়েছিল ধর্মমঙ্গল কাব্য। ধর্মদেবতার উপাসনা রাঢ়ের স্ব-ধর্ম। ধর্মমঙ্গলের আদিকবি ময়ূর ভট্ট। তাঁর কাব্য পাওয়া যায়নি। কিন্তু ধর্মমঙ্গলের প্রথম শ্রেণির কবিদের রচনায় তাঁকে ধর্মমঙ্গলের আদিকবির মর্যাদা পেতে দেখা গেছে। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে যথাক্রমে গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায় ও খেলারাম ধর্মমঙ্গল লিখেছিলেন। তাঁদের সম্পূর্ণ কাব্য পাওয়া যায়নি। তাঁরা উভয়েই ময়ূরভট্টের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ধর্মমঙ্গলে হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী ও লাউসেনের কাহিনীই সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রাচীন। ষোড়শ শতাব্দীতে মাণিকরাম গাঙ্গুলির হাত ধরে ধর্মমঙ্গলের সমৃদ্ধিকাল শুরু হয়েছিল। তিনিই প্রথম ধর্মমঙ্গলের কাহিনীর পালারূপ দিয়েছিলেন। মাণিকরাম গাঙ্গুলির পরে সীতারাম দাস, রামদাস আদক, রূপরাম চক্রবর্তী, শ্যাম পণ্ডিত, রামচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও রাজারাম দাস প্রমুখ কবি ধর্মমঙ্গল লিখেছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই মাণিকরামের দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। এই ধারার সমৃদ্ধিকাল তৈরি হয়েছিল কবি ঘনরাম চক্রবর্তীর সময়ে। ঘনরাম চক্রবর্তী চব্বিশ পালায় ধর্মদেবের দ্বাদশ উপাসকের আখ্যান লিখেছিলেন। ঘনরাম চক্রবর্তীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আরও একদল কবি ধর্মমঙ্গল রচনা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কবি প্রভুরাম, সহদেব চক্রবর্তী, হৃদয়রাম সাউ, রামকান্ত রায়, গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়, ধর্মদাস বৈদ্য প্রমুখ।

সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে লৌকিক শিবকে কেন্দ্র করে কবি শঙ্কর কবিচন্দ্র, রামকৃষ্ণ রায়, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, দ্বিজ কালীদাস, দ্বিজ মনিরাম, জীবন মৈত্রেয়, প্রাণচন্দ্র, দ্বিজ রামচন্দ্র প্রমুখ শিবমঙ্গল বা শিবসঙ্কীর্তন লিখেছিলেন। মঙ্গলকাব্যের রচনারীতির সঙ্গে এই সাহিত্যধারার আংশিক মিল রয়েছে। এই ধারায় জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য। কাব্যে পুরাণের ছকে জৈমিনি মুনি নৈমিষারণ্যে এসে শৌনকাদি মুনিদের কাছে শিবের মাহাত্ম্য বলেছেন। পরবর্তীতে মূলত পৌরাণিক দেবতার মাহাত্ম্যজ্ঞাপক মঙ্গলকাব্যে এই রীতির বহুল ব্যবহার দেখা গেছে। দেবীমাহাত্ম্যবাহী চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারার কবিদের উত্তরসূরী হিসেবে অষ্টাদশ শতাব্দীতে কবি ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর অন্নদামঙ্গল লিখেছিলেন। অন্নদামঙ্গলের আরাধ্য দেবী কাশীশ্বরী অন্নপূর্ণা। সমগ্র মধ্যযুগে ভারতচন্দ্রের মতো প্রতিভাবান কবি বিরল। তবে মঙ্গলকাব্য রচনার ক্ষেত্রে ভারতচন্দ্র পূর্ববর্তী কবিদের মধ্যে মুকুন্দ চক্রবর্তী ও ঘনরাম চক্রবর্তীর দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন। বাংলায় অন্নদামঙ্গল মাত্র একটিই লেখা হয়েছে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলের বিদ্যাসুন্দরের আখ্যানে কালিকামঙ্গল নামেও পরিচিত। দেবীর মাহাত্ম্যবাহী চণ্ডীমঙ্গলের উত্তরসূরী হিসেবে সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীতে কালিকামঙ্গল ও দুর্গামঙ্গলের ধারার প্রসার ঘটেছিল। কালিকামঙ্গলের আদিকবি কঙ্ক। তিনি চৈতন্যদেবের সমসাময়িক ছিলেন। বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী জনপ্রিয় হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীর শেষদিকে। কবি কঙ্কের পরে শ্রীধর কবিরাজ, শা’বারিদ খান, গোবিন্দদাস, কৃষ্ণরাম দাস, প্রাণরাম চক্রবর্তী, বলরাম চক্রবর্তী, নিধিরাম আচার্য, কবীন্দ্র, দ্বিজ রাধাকান্ত, মদনদত্ত, বিশ্বেশ্বর, রামপ্রসাদ সেন প্রমুখ কালিকামঙ্গলে সাফল্য পেয়েছিলেন। অনেক কবিই আদিরসের পরিমিত ব্যবহারে কালিকামঙ্গলের কাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। একই সময়ে মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’র কাহিনী অনুসরণে রচিত হয়েছিল দুর্গামঙ্গল। এই ধারায় সাফল্য পেয়েছিলেন কবি রাধাচরণ রক্ষিত, দ্বিজ কমললোচন, ভবানীশঙ্কর দাস ও দ্বিজ রামচন্দ্র। বঙ্গদেশের শক্তিসাধনার বলয়ে দেবী কালী ও দেবী দুর্গার উপাসনার ভাবধারা প্রসারিত রয়েছে। এই দুই শক্তি দেবীর মাহাত্ম্যজ্ঞাপক মঙ্গলকাব্য অনায়াসে লোকপ্রিয় হয়েছিল। এই ধারাতেই সংযুক্ত হয়েছিল কবি দ্বিজ মুকুন্দ মিশ্রের বাসুলীমঙ্গল। লৌকিক দেবী বাসুলী কালক্রমে চণ্ডীদেবীতে পরিণতি পেয়েছিলেন।৪ বস্তুত বাংলার অধিকাংশ লৌকিক দেবীই সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে কালী বা অন্য শক্তি দেবীর সঙ্গে অদ্বয় অর্জন করেছিলেন। এভাবেই উত্তরবঙ্গের লৌকিক দেবী গোসানীও শাক্তদের আরাধ্য হয়ে উঠেছিলেন। রাধাকৃষ্ণদাস বৈরাগী দেবী গোসানীকে কেন্দ্র করে গোসানীমঙ্গল লিখেছিলেন। ত্রিপুরার বরদেশ্বরী দেবীর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। বাংলায় দেবী বরদা দেবীর মাহাত্ম্যবাহী মঙ্গলকাব্য রচনা করেছিলেন কবি নন্দকিশোর।

পৌরাণিক দেবতাদের মাহাত্ম্যকথা মঙ্গলকাব্যিক রূপ লাভ করতে শুরু করলে জলব্রহ্ম গঙ্গাদেবীকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছিল গঙ্গামঙ্গল। ষোড়শ শতাব্দীতে মাধবাচার্য প্রথম গঙ্গামঙ্গল লিখেছিলেন। কবি দ্বিজ কমলাকান্ত ও জয়রাম দাস গঙ্গামঙ্গলের ধারায় সাফল্য অর্জন করলেও দ্বিজ দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের গঙ্গামঙ্গলের জনপ্রিয়তা প্রসারিত হয়েছিল সবচেয়ে বেশি। গঙ্গামঙ্গলের কবিদের মধ্যে দ্বিজ দুর্গাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য গঙ্গাদশহরার তিথিতে এখনও দক্ষিণবঙ্গে পঠিত হয়। আর্য দেবতাদের মধ্যে সূর্যদেবও মঙ্গলকাব্যের বলয়ে নিজস্ব মাহাত্ম্য বজায় রেখেছিলেন। কবি রামজীবন বিদ্যাভূষণ, মালাধর বসু ও দ্বিজ কালিদাসের সূর্যমঙ্গলের সন্ধান পাওয়া যায়। পূর্ববঙ্গে প্রচলিত সূর্যের করমাদি ব্রত থেকে সূর্যমঙ্গলের কাহিনীর জন্ম হয়েছে।

মধ্যযুগে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার অভাবে রোগ-ব্যাধিতে প্রায় বিনা চিকিৎসায় বহু মানুষের মৃত্যু হতো‌। লৌকিক শীতলা ও পঞ্চানন দেবতার পূজা রোগমুক্তিকল্পে বঙ্গে প্রচলিত হয়েছিল। এই দুই দেবতার পূজামাহাত্ম্য প্রসারের জন্য লিখিত হয়েছিল শীতলামঙ্গল ও পঞ্চাননমঙ্গল। শীতলামঙ্গলে মূলত মনসামঙ্গলের চাঁদ বণিকের আখ্যানের আংশিক পরিবর্তন করে চন্দ্রকেতুর আখ্যান তৈরি হয়েছে। কবি নিত্যানন্দ চক্রবর্তী শীতলামঙ্গলের আদিকবি। এই ধারাকে সমৃদ্ধি দিয়েছিলেন কবি বল্লভ, কৃষ্ণকিঙ্কর ও হরিদেব। পঞ্চাননমঙ্গলে লৌকিক শিব উপাসিত হয়েছেন ব্যাধিনিরাময়ের দেবতারূপে। একমাত্র দ্বিজ রঘুনন্দনের পঞ্চাননমঙ্গলই বঙ্গময় প্রসার লাভ করেছিল। দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবন অঞ্চলে বাঘের উপদ্রব থেকে নিষ্কৃতি পেতে দক্ষিণরায় দেবতার পূজা প্রসারিত হয়েছিল। রায়মঙ্গল কাব্যের মাধ্যমে দক্ষিণরায়ের পূজা প্রসারে ব্রতী হয়েছিলেন কবি মাধবাচার্য, কৃষ্ণরাম দাস, দ্বিজ হরিদেব ও বলরাম।

বঙ্গে ষষ্ঠী দেবীর উপাসনা প্রচলিত রয়েছে মূলত নারী সমাজে। ষষ্ঠী দেবীকে কেন্দ্র করে ষষ্ঠীর ছড়াগুলি নারীরাই তৈরি করেছিলেন। ষষ্ঠী দেবীর পূজার জনপ্রিয়তাকে অবলম্বন করে ষষ্ঠীমঙ্গল লিখেছিলেন কৃষ্ণরাম দাস, রুদ্ররাম চক্রবর্তী ও রামধন চক্রবর্তী। ষষ্ঠী ছাড়াও বঙ্গের ঘরে ঘরে উপাসিত হতেন লক্ষ্মী ও সরস্বতী দেবী। বঙ্গদেশে ধানই ধন। বঙ্গে লক্ষ্মী মূলত ধানের দেবী। লক্ষ্মীর উপাসনায় ধানের সমৃদ্ধি থেকে ধনের সমৃদ্ধি আসে। বঙ্গে লক্ষ্মীমঙ্গলের ধারাকে সমৃদ্ধি দিয়েছিলেন কবি শিবানন্দ কর, দ্বিজ পঞ্চানন, ভরত পণ্ডিত, দ্বিজ শঙ্কর, দ্বিজ বসন্ত, জগমোহন মিত্র ও বৈকুণ্ঠনাথ মাঝি প্রমুখ। লক্ষ্মীমঙ্গলের ধারাটি নাতিদীর্ঘ। বঙ্গে লক্ষ্মীর পাঁচালী যতটা জনপ্রিয় হয়েছে ততটা লক্ষ্মীমঙ্গল জনপ্রিয় হয়নি। বঙ্গে সরস্বতীর পূজা হয় প্রধানত বিদ্যাকাঙ্ক্ষায়। মহাকবি কালিদাসের বিদ্যালাভের আখ্যানকে কেন্দ্র করে বঙ্গে সারদামঙ্গল বা সরস্বতীকথা তৈরি হয়েছিল। এই ধারার সমৃদ্ধি দিয়েছিলেন কবি দয়ারাম, রাজসিংহ ও মুনিরাম মিশ্র। সারদামঙ্গলে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন কবি দয়ারাম।

অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে জগন্নাথকে কেন্দ্র করে মঙ্গলকাব্য লিখেছিলেন কবি বিশ্বম্ভর দাস। পুরী জগন্নাথের সঙ্গে বাঙালির আধ্যাত্মিকজীবনের যোগ সুপ্রাচীন। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে বাংলা ভাষায় প্রথম জগন্নাথকাহিনী লেখা হয়েছিল। মঙ্গলকাব্যের আঙ্গিক ব্যবহার করে জগন্নাথের পৌরাণিক কাহিনীকে নবরূপে সজ্জিত করেছিলেন বিশ্বম্ভর দাস। সমগ্র মধ্যযুগে একমাত্র তিনিই জগন্নাথ বিষয়ক মঙ্গলকাব্য লিখেছিলেন। বাংলার নারীসমাজ থেকে জন্ম নিয়েছিল সুবচনীমঙ্গল ও কপিলামঙ্গল। সুবচনী বাংলার নারীব্রত। সুবচনীমঙ্গলের কবিদের মধ্যে দ্বিজ মাধব ও রামজীবন জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। কপিলামঙ্গলের ধারায় সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিলেন দ্বিজ কবিচন্দ্র। সুবচনীমঙ্গল ও কপিলামঙ্গল যথাক্রমে বাংলার হাঁস-সম্পদ ও গোধনের উপাসনার ভাবধারার পোষণ করে।

তথ্যসূত্র [Mangal Kabya Katha]

১. দাশ গুপ্ত, তমোনাশ চন্দ্র, ‘প্রাচীন বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, প্রথম সংস্করণ, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৮৮
২. হালদার, গোপাল, ‘বাঙ্‌লা সাহিত্যের ইতিহাস’ (প্রথম খণ্ড), দ্বিতীয় সংস্করণ, এ মুখার্জি অ্যাণ্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ, পৃ. ১০৯
৩. সেন, সুকুমার, ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ (দ্বিতীয় খণ্ড), প্রথম আনন্দ সংস্করণ, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৪১৮ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৪৪৫
৪. ভট্টাচার্য, আশুতোষ, ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’, অষ্টম সংস্করণ, এ. মুখার্জি অ্যাণ্ড কোং প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৮, পৃ. ৫৯২

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

Lifetime Poetry Achievement | Best Article Forever

Companions or Threats of AI | Best Artificial Intelligence

1st Meeting of Rabindranath and Ramkinkar | Best 2023

A Train to Israel via Purulia | Best Article 2023

Mangal Kabya Katha | Mangal kabya wikipedia | Mangal kabya summary | Mangal kabya pdf | Mangal kabya book pdf | Mangal kabya pdf download | mangalkavya written by | manasa mangal kabya | What is the meaning of Mangalkavya? | How many Mangal Kavyas are there? | In which part of India is Mangal kavya popular? | What is Mangal Kavyas Class 7? | Who wrote Manasa Mangal? | Where is Mangala Kavya? | Which is the longest mahakavya in the world? | Who wrote Chandi Mangal kavya?

Bengali Mangal Kabya Katha | Mangal Kabya Katha PDF | Mangal Kabya Katha Essay | Mangal Kabya Katha in Hindi | Bengali Article | Bengali Written Article | International Article | Mangal Kabya Katha wikipedia | Article Writing Course | Academic Article Writing | Professional Article Writer | Mangal Kabya Katha Video | Mangal Kabya Katha Audio | Mangal Kabya Katha Ebook | Mangal Kabya Katha in English | Shabdodweep Writer | Mangal Kabya Katha MP4 | Article Factory | Freelance Article Writer | New Mangal Kabya Katha | Indian Mangal Kabya Katha | Full details – Mangal Kabya Katha

Leave a Comment