Best Collection Bangla Golpo | Bengali Online Story

Sharing Is Caring:

ঝড়বৃষ্টির এক রাতের গল্প – পুনম মায়মুনী

মেহের, আশিক ও রবি ওরা তিন বন্ধু। ছেলেবেলা থেকেই ওদের বন্ধুত্ব। একই স্কুল এবং কলেজে ওরা একই সাথে ছিল কিন্তু ভার্সিটি লেবেলে এসে পৃথক হতে হয়েছে কারণ ওদের তিনজনের জীবনের লক্ষ ছিল তিন রকমের। তিন বন্ধুর মধ্যে মেহের ছিল খুব প্রতিবাদী ও সাহসী প্রকৃতির। আর প্রমাণ ছাড়া সে অনেক কিছুই সহজে বিশ্বাস করতে চাইতো না। ছোটবেলা থেকেই তাঁর খুব সখ ছিল খারাপ লোকদের সে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিবে আর এই আশা পূরণ করতেই তাঁর সাংবাদিকতার পেশায় যাওয়া। জার্নালিস্ট বিভাগে ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করে মেহের এখন একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের নিউজ প্রডিউসার।

বন্ধু আশিক যেন ছিল ঠিক মেহেরের পরিপূরক! কোন বিষয়ে মেহের অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহ পোষণ করলে, আশিক গোয়েন্দাগিরী করে ঠিক সঠিক খবরটা মেহেরের সামনে এনে হাজির করতো। আশিকের স্বভাবটাই ছিল এমন। একবার মনে কোন বিষয় নিয়ে সন্দেহ ঢুকলো তো ব্যস, তার তদন্ত করে শেষটা বের করে তবেই ছাড়বে। একটু জেদি প্রকৃতির। তাই মেহের ও রবি আশিককে CNN বা BBC বলে মজা করতো। মেহেরের পরিপূরক হিসেবে সত্যিই আশিক আজ পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকুরীরত এবং গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আবার অন্যদিকে আরেক বন্ধু রবি ছিল বেশ সাদামাটা আর একটু ভীতু প্রকৃতিরও। কোন ঝুঁকি নিতে দশবার ভেবে-চিন্তে করে নিবে। পরপোকারিতায় সে ছিল সবার আগে। ঠাণ্ডা ও ধীরস্থির মেজাজের বলে যে কোন সমস্যায় বন্ধুরা আগে রবির কাছে পরামর্শ করে নেয়। রবির ইচ্ছানুযায়ী-ই সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করে এবং আজ সে বেশ নামকরা একজন ডাক্তার।

ওরা তিন বন্ধু তিন দিকে মুখ করলেও ওদের বন্ধুত্বের কিন্তু কোন রকমের ফাটল ধরেনি। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একদিন ঠিকই ওরা একসাথে হয়ে আড্ডা দেয়। আবার পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় কাজের জন্য দিনে সময় না পেলেও তিনজন একত্রিত হওয়ার জন্য প্রায়ই রাতের খাবার তিন বন্ধুর কোন একজনের বাসায় করে নেয়। ওদের এই সুন্দর নির্মল পবিত্র সম্পর্কটা বুঝি সৃষ্টিকর্তারও পছন্দনীয় তাইতো ওদের কাজের ধারাটাও একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন। আর সেই সূত্রে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখতেই হয়। মেহের যেহেতু সাংবাদিক তাই অনেক তথ্য জানতে পুলিশের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় আর সেগুলো বেশিরভাগ আশিকের দ্বারাই করা হয়। আবার আশিকের অনেক কেস-এ পোষ্টমোর্টেম করার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন হয় আর সঠিক ও নির্ভুল তথ্যগুলো রবির মাধ্যমে করে নেয়। ওরা যেন সত্যিসত্যিই একে অন্যের পরিপূরক হিসেবেই জন্মেছে।

একবার মেহেরকে একটি সঠিক তথ্য জানার জন্য কোন এক গ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। সেটি ছিল একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একটি নারীর আশ্চর্যজনকভাবে মৃত্যু। তার উদঘাটন করে সত্য খবরটা প্রকাশ করতে হবে। কেউ বলছে আত্মহত্যা কেউ বলছে ভূতে মেরেছে। এ নিয়ে রাতে তিন বন্ধুর মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়। মেহের তো হেসেই উড়িয়ে দেয় ভূত বলতে কিছু আছে নাকি! আশিক কিছুক্ষণ ভেবে বলল, হুম একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, তার তদন্ত অবশ্যই প্রয়োজন। রবিও সাথে যোগ দিয়ে বলল, পোস্টমর্টেম করলেই সত্য বেড়িয়ে আসবে। তারপর ঠিক করে ওরা তিনজনই একসাথে যাবে।

পরেরদিন সকালে ওরা রওনা হয় সেই গ্রামের উদ্দেশ্যে। তখন বর্ষাকাল সবে শুরু। থেমে থেমে ঝড় বৃষ্টি আবার কখনো বজ্রপাত হচ্ছে কিন্তু উপায় নাই কাজের দায়িত্ব, এড়িয়ে যাওয়ারও কোন পথ নাই। সাংবাদিকদের কোন অজুহাত থাকতে নেই, কী গরম কী শীত কী বৃষ্টি। শহর থেকে বেশ ভিতরে ছিল গ্রামটা। মাঝে একটা নদী পার হতে হয়। আগে থেকে বলা ওপারে তাদের অপেক্ষায় ছাতা হাতে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে। তারাই ওদের বাকিটা পথ পৌঁছে নিয়ে যায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে ওরা একটা বাংলোতে উঠে। বাংলোটা বেশ পুরানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। দরজা জানালাগুলো জীর্ণশীর্ণ দেয়ালের গায়ে নানানরকমের লতা-পাতায় লেপ্টে আছে। চারিদিকে অনেক গাছ-গাছালিতে ভরা। সন্ধ্যায় পাখিদের নীড়ে ফেরার কিচিরমিচির শব্দটা গ্রাম্য পরিবেশকে যেন আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। সারাদিন জার্নি করার পর ওরা তিন বন্ধু বেশ ক্লান্ত। এই বাংলোর দারোয়ান কাদের মিয়া ওদের থাকার ঘর, ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়ে বলল,

— স্যার আপনাদের পছন্দ হইসে তো? আপনাদের আসার কথা শুইনা নিজ হাতে সব গুছাইয়া রাখসি। কোন অসুবিধা হইলে জানাইয়েন আমি পাশের ঘরেই থাকি।
— বেশ বড় একটা রুম, দুই দিকের জানালার ধারে সেমি ডাবল দুটো খাট। তিনজনের ভালোই হয়ে যাবে। ছিমছাম পরিপাটি চাদর বিছানো। দরজার পাশে একটা বড় টেবিল তার উপর ঝকঝকে কাচের গ্লাস ও পানি ভরা জগ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো খুব পছন্দ হয়েছে। তিনজনেই একসাথে বলে উঠে।

দারোয়ান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— আপনাদের চা-নাস্তা দিয়া আমারে আবার বাজারে যাইতে হইবো রাইতের খাবারের ব্যবস্থা করতে।

রবি বলল,
— চাচা আপনি করবেন রান্না? কেন আশেপাশে কোন খাবারের হোটেল নাই?

আসে, সেই মেলা দূরে…আপনাগো কষ্ট হইবো যাইতে। অসুবিধা নাই এইখানে যারা আসে হেগোর রান্না আমার মাইয়া করে। আমার মাইয়া খুব ভালা রান্ধে বলে এক ফালি দাঁত বের করে একটা মুচকি হাসে। কাদের মিয়া রুম থেকে বেরিয়ে রওনা হয় বাজারের উদ্দেশ্যে। ওরা তিন বন্ধু ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়েমুছে আসতেই দেখে টেবিলের উপর একটি চায়ের ফ্লাক্স সাথে বিস্কিট। পাশে বিশ-বাইশ বছরের একটি মেয়ে, সাদা ওড়নায় বেশ লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ানো। চেহারাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, অস্পষ্ট তবে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা বেশ রূপবতী একেবারে ধবধবে ফর্সা; হাত দুটোও তাই বলে। ওদের দেখেই মাথাটা আরও নিচু করে একটা সালাম ঠুকে বলল,
— স্যার আপনাদের চা, বলে ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢালতে থাকে…

আচমকা মেয়েটাকে দেখে মেহের বলল,
— তুমি কে?
— আমি নুরী।

ভেবেই নিল এটাই সেই দারোয়ানের মেয়ে। কথা না বাড়িয়ে বলল,
— ও, আচ্ছা।

মেয়েটিও আর কোন কথা না বলে নীরবে চলে গেল। মেয়েটির হাঁটার ধরণ দেখে আশিকের বুকে কেমন একটা খোঁচা দিয়ে উঠলো! মেয়েটি যেন নিমিষেই কোথায় মিলিয়ে গেলো কিংবা তাঁর চোখেরও ভুল হতে পারে। এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না আশিক।

বাইরে মৃদু হাওয়ায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপে চুমুক দিতে বেশ লাগে। চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে আবারো তিন বন্ধু সেই কেসটা নিয়ে আলোচনায় আসে। মেয়েটির লাশ নাকি আজই দাফন করা হয়েছে সুতরাং যদি মৃত্যুর ঘটনাটি তাঁদের কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হয় তবে লাশটাকে অবশ্যই পোস্টমর্টেম করার জন্য কবর থেকে বের করতে হবে। আর সেজন্য এখানকার থানায় আগেই জানানো হয়েছে সে ব্যাপারে পুলিশ তাদের সহযোগিতা করবে। মেহের একটু চিন্তিত হয়ে বলল,
— ঘটনাটা যদি জটিল হয় তাহলে তো আমাদের এখানে কিছুদিন থাকতে হবে মনে হচ্ছে।

আশিক বলল,
— আমিতো দুদিনের বেশি থাকতে পারবো না। জানিস তো আরেকটা মার্ডারের কেস আছে, সেখানে উপস্থিত থাকতেই হবে।
— দেখা যাক্, আগেই চিন্তা করে তো লাভ নেই অবস্থা দেখে ব্যবস্থা করা যাবে। রবি বলল।

মেহেরও সায় দেয়,
— ঠিক তাই, তবে গ্রামটা এখান থেকে কতদূর হবে সেটাই তো জানলাম না!
ওদের কথা শেষ হতে না হতেই কাদের মিয়া এসে হাজির,
— স্যার কিসু কি লাগবো আপনাদের কারোর ?
— না, না লাগবে না বরং একটা কাজ করেন ; আপনি এখানে এসে একটু বসেন তো চাচা, কিছু জানার দরকার ছিল আমাদের। মেহের বলল।
কাদের মিয়া পাশে রাখা একটা টুলের উপর গিয়ে বসে।

— আচ্ছা চাচা নবগ্রামটা এখান থেকে কতটা দূর হবে?
— পরায় দুই মাইল তো হইবোই।
— আপনি কি ঐ গ্রামের কোন নারীর আত্মহত্যা করে মৃত্যুর খবর শুনেছেন?
— না…তো বাবারা। তারপর একটু কৌতূহল হয়ে বলল, আপনারা কি এই কেসের তদন্ত করতে আইসেন?
— হ্যাঁ, তাই আমাদের ক’টা দিন থাকতে হতে পারে, আপনাকে আরও একটু কষ্ট দিব।
— না, না কষ্ট কী, এইডাইতো আমার ডিউটি। এই বাংলোয় কেউ আইলে আমার খুব ভালা লাগে। তেমন তো কেউ আর আয় না আর আইলেও দুই দিনের বেশি থাকে না। অনেকে অর্ধেক কাজ কইরাই চইলা যায়।

আশিক বলে উঠে,
— কেন, কেন চল যায়?

ভয়ে। এক কথায় উত্তর দেয় কাদের মিয়া।
— ভয়! কীসের ভয়?
— সে অনেক কথা… কাইল শুইনেন। সবে আইসেন তো, আইজ রেস্ট নেন। বলে কাদের মিয়া টুল থেকে উঠে সামনে দু’পা এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে বলল,
— তয় আপনেরা রাইতের বেলায় বাইরে ভুলেও যাইয়েন না কিন্তু।
— আচ্ছা চাচা, এতো বড়ো বাংলোতে একা থাকতে আপনার ভয় লাগে না?
— পথম, পথম লাগতো এখন আর ভয় পাই না! সঠিক পথে চললে কেউ কারোর ক্ষতি করে না। যাই মাইয়ার রান্দা কতদূর দেইখা আসি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কাদের মিয়া।

কাদের মিয়া চলে যাবার পর তাঁর কথার জের ধরে মেহের আর আশিক কিছুটা মজা করে, এই বাংলোতে তাহলে ভূত আছে তাইনা? ঠিক আছে দেখা যাক্ ভূতের দেখা মিলে কি-না!

রবি একটু নিচু স্বরে বলল,
— চাচামিয়ার কথাটা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ আমার মনে হয় অশরীরী বলে কিছু আছে।
— তুই কি দেখেছিস নিজ চোখে ? আশিক বলল।
— না, তা দেখিনি তবে ময়নাতদন্তের সময় অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু ঘটনায় আমার মনে হয়েছে ভূত বা অশরীরী যাই বলিস এর অস্তিত্ব আছে।

মেহের হো হো করে হেসে উঠে,
— আরে পাগল ডোম ঘরটা তো এমনই শুনশান নীরব থাকে তারমধ্যে তুই একটু ভীতু প্রকৃতির আবার এগুলা বিশ্বাস করিস? এগুলান সব তোর মনের ভুল। মানুষ যখন দুর্বল চিত্ত নিয়ে কিছু চিন্তা করে সেটা তাঁর মনের গভীরে চলে যায় আর দেখবি মনে হয় আমি সেটা দেখছি।
আশিকও মেহেরের কথায় সায় দিয়ে বলে,
— রাইটস।
রবি আর কথা বাড়ায় না। কারণ এগুলো যার যার বিশ্বাস ও অনুভূতির ব্যাপার। কাউকেই বলে বুঝানো সম্ভব না।

সন্ধ্যা পেরিয়ে ধীরে ধীরে রাতটা বাড়তে থাকে। অন্ধকারটাও গাঢ় হতে থাকে। পাখিদের কোলাহলের বদলে এখন ঝিঁঝিঁপোকার ডাকটাই ক্রমে বাড়ছে। আবার বৃষ্টির মাত্রাটাও বেড়ে চলছে। চারিদিকে কেমন একটা নীরব থমথমে ভাব। বাংলোর চারিদিকে ঘেরা বড়ো বড়ো অনেক গাছ। গেটের সামনে থেকে পিছন দিক পর্যন্ত একটা সরু পাকা রাস্তা চলে গেছে মাঝে মাঝে ফাটল ধরা, বুঝাই যাচ্ছে অনেক বছর ধরে এসবের কোন মেরামতই করা হয় না। রাস্তার দুপাশে ঝোপঝাড়ে ভরে আছে। প্রধান গেটের সামনে দুপাশে দুটো লাইট জ্বালানো তাও আবার টিম টিম করে জ্বলছে।
এরিমধ্যে কাদের মিয়া রাতের খাবার এনে টেবিলের উপর ঢেকে রাখে,
— আকাশটা ঘুইট ঘুইট্টা আইন্ধার হইয়া গেসে, মনে হয় জোরেশোরে একটা বৃষ্টি আইবো, আপনারা তাড়াতাড়ি খাইয়া শুইয়া পড়েন। বলে চলে যায়।

কিছুক্ষণ পরই টিমটিমে আলোয় হাতে একটা হারিকেন নিয়ে আবারও আসে কাদের মিয়া,
— কারেন্টেরও ঠিকঠিকানা নাই চইলা যাইতে পারে। তাই হারিকেনটা দিয়া গেলাম।

ঘরের এক কোণায় রেখে চলে গেল নিজের ঘরে। মেহের চেয়ার ছেড়ে জানালার ধারে এসে দাড়ায় সত্যিই তো আকাশের অবস্থা তো ভালো না! বাইরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটায় আশেপাশে তেমন স্পষ্ট বুঝা যায় না কিছুই শুধু কয়েকটা বাড়ির ভিতর থেকে হালকা হালকা আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন নয়’টা বাজে। গ্রামে নয়টা মানে অনেক রাত। আবার আষাঢ়ের রাত। ওরা খাওয়ার প্রস্তুতি নেয় এমন সময় হঠাৎই ঝড়হাওয়া আর বিদ্যুতের সাথে বিকট বজ্রপাতের শুরু হয়। তাড়াতাড়ি জানালাগুলো বন্ধ করে ওরা খেতে বসে। ঠিক তখনি কারেন্টাও চলে যায়। হারিকেনটা খুঁজতে যেয়ে দেখে সেই নুরী নামের মেয়েটা হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে। ঠিক তেমনি বড়ো ঘুমটাটা দেয়া। টেবিলের উপর হারিকেনটা রেখে ওদের খাবার বাড়তে থাকে।

এতো রাতে মেয়েটিকে দেখে আশিক একটু অবাক হয়ে বলল,
— তুমি এখনো যাও নাই?
— ‘না’… একটা শটকার্ট উত্তর।
— এতো ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তোমার থাকার দরকার ছিল না।

হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে মেহেরও বলল,
— আমরা নিজেরাই বেড়ে খেতে পারবো, তুমি যেতে পার।
নুরী আবারো স্পষ্ট স্বরে উত্তর দিল,
— আপনাদের খাওয়া শেষ হইলে পরে যামু।

নুরী টেবিলের পাশেই দাড়িয়ে থাকে। হয়তোবা বাবা দারোয়ানের আদেশই মেয়েটা পালন করছে। এই ভেবে ওরা খেতে খেতে আবার আগের আলাপে মগ্ন হয়, কাল কিভাবে, কখন যাবে। আর সত্যিটা কী হতে পারে? নুরী ওদের কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিল এবং এক পর্যায়ে বলে উঠে,
— মাইয়াডা তো আত্মহত্যা করে নাই, ওরে খুন করা হইসে।
নুরীর কথা শুনে চমকে উঠল আশিক, দারোয়ান শুনেনি অথচ তাঁর মেয়ে কি করে শুনলো! বলল,
— তুমি কী করে জানলে, তুমি কি শুনেছ সেই ঘটনা?

মেহের ও রবি কিছুটা অবাক হয়ে নুরীর দিকে তাকায়।
— ‘হ’ আমি খুব ভালা কইরাই জানি আমার শ্বশুরবাড়ি যে ঐ গ্রামেই।

এবার ওরা আশ্বস্ত হলো, ভাবলো এমনটা হতেই পারে, যেহেতু মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ঘটনা, হয়তোবা বাবা জানে না আর মেয়েও জানায়নি। খাবারের পর তিন বন্ধু হাত ধুয়ে এসে ঘরে নুরীকে আর দেখতে পায় না। বাইরে এতো ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তাই হয়তো ওদের জন্য অপেক্ষা না করে বাড়ি চলে গেছে। হারিকেনের আলোটা একটু কমিয়ে তিনজনই শুয়ে পড়ে কাল আবার ভোরবেলায় উঠতে হবে।

সকাল সকালেই ওরা তিন বন্ধু নবগ্রামে পৌঁছে যায়। প্রথমে থানায় তারপর পুলিশের সহযোগিতায় সবাই সেই বাড়িতে উপস্থিত হয়। তখনো বাড়িতে শোকের ছায়া। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বামী বেচারা যেন একদমই ভেঙে পড়েছে। পুলিশের আগমন দেখে স্বাভাবিকভাবেই লোকের ভীড় জমতে শুরু করে। বাড়ির লোকেদের ভাষ্য ছিল মেয়েটি অর্থাৎ এ বাড়ির ছোট বৌয়ের উপর নাকি জীন আছর করেছিল আর সেই দুষ্ট জীনই পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ মেয়েটি নাকি অস্বাভাবিক আচরণ করতো কথায় কথায় রাগ হয়ে যেত, খাবারের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল আর দিনে দুই তিনবার কখনো সন্ধ্যায়ও পুকুরে যেয়ে গোসল করে আসতো। পুকুরটা খুব একটা দূরে নয় বাড়ির ভিতরের পিছন দিকটায়। পুকুরের একপাশে বাঁশঝাড় আর ঝোপঝাড়ে ভরা। আশেপাশের প্রতিবেশী অনেকেই পরিবারের কথার সাথে একমত দিল, জীন মেরেছে কেউ কেউ বলছে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আত্মহত্যা করবে কেন?

কারণ শাশুড়ির সাথে দুই বৌ এর প্রায়ই ঝগড়া হতো আর সেই জের ধরেই হয়তোবা মেয়েটি খুব বেশি অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। আরও পরিবার থেকে জানলো সেই রাতে স্বামী এবং স্বামীর বড়োভাই দুজনেই বাড়িতে ছিল না। প্রায়ই ব্যবসার কাজে একসাথেই দুজনকে শহরে যেতে হয়। আর বাড়িতে পুরুষ বলতে এই দুজনেই থাকে। বাকিরা তাদের মা আর দুই বৌ। দুই বৌয়ের মধ্যেও নাকি ছিল মধুর সম্পর্ক। কিন্তু ছোট বৌয়ের আজকের এই আকস্মিক মৃত্যু এবং সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। অবশেষে এখানে অনেক ঘাটাঘাটি করে তেমন কোনো সঠিক নমুনা খুঁজে পেল না তাঁরা। প্রথম মৃত্যুটা অর্থাৎ জীন দ্বারা পানিতে ডুবে মরাটা তিন বন্ধু এবং পুলিশবাহিনী একদমই মেনে নিতে পারলো না। রবির থিউরিতে ডাক্তারি মতে অন্তঃসত্ত্বার সময় মেয়েদের এমন অনেক কিছুরই পরিবর্তন দেখা যায় যা মেয়েটির বেলায়ও সেটাই হয়েছিল। যেহেতু গ্রামের এই লোকেরা অল্পশিক্ষিত তাই এ সম্বন্ধে কোন ধারণা নাই এবং জীন-ভূতে বিশ্বাসী সেই কুসংস্কার থেকেই মৃত্যুটাকে এভাবে দেখছে। সবশেষে সবার সিদ্ধান্তে আত্মহত্যাটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু পরক্ষণেই আশিকের মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে যায়, কেউতো খুনের কথা একবারও বলেনি তবে কাল রাতে নুরী নামের ঐ মেয়েটি যার শ্বশুরবাড়ি এই গ্রামে বলে দাবী করলো সে কিভাবে জোর দিয়ে খুনের কথাটা বলল? তবে কি আরও গভীরভাবে তদন্তের প্রয়োজন আছে? না, না তাঁকে বের করতেই হবে এই মৃত্যুর আসল রহস্যটা! আশিকের মনে একবার এই সন্দেহের বীজটা ঢুকেছে তো আর ছাড়াছাড়ি নাই। তারপর পুলিশকে আগামীকাল ময়না তদন্তের জন্য লাশ তোলার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। সবশেষে পুলিশ এবং তিন বন্ধু এই সিদ্ধান্তেই একমত হয়।

বাংলোতে ফিরতে ওদের প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। এই মেঘবৃষ্টির মধ্যে সবারই উপর দিয়ে একটা বড়সড় ধকল গেলো আজ। বেশ ক্লান্ত সবাই তাই রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। তখনো বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। খাওয়ার সময় আজ নুরী আসেনি, এলে ওকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল আশিকের। কাদের মিয়াকে মেয়ের কথা জিগ্যেস করলে জানালো আজ প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় মেয়ে রান্না সেরে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে। গভীর রাত। ওরা তিনজনই গভীর ঘুমে অচেতন। একটা বিকট বজ্রপাতের শব্দে মেহের ও আশিকের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি সাথে ঝড়হাওয়া। বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটায় জানালার পার্টগুলো বাড়ি খেতে থাকে। দুজনেই চটজলদি জানালটা বন্ধ করতে যায় এমন সময়ই বিদ্যুৎ চমকে উঠে আর সাথে সাথেই ওদের নজর গিয়ে পড়ে সামনের ঘন ঝোপঝাড়ের উপর… তাঁরা স্পষ্টই দেখে খুবই ছোট একটা শিশু মনে হচ্ছে মৃত, সারা গায়ে ছোপ ছোপ রক্ত গলায় লাল নতুন একটা গামছা জড়ানো। পাশে একটা নারীর অবয়ব করুণ সুরে কাঁদছে। ওরা সাতপাঁচ কিছু না ভেবেই দরজা খুলে দ্রুত হেঁটে যায়। কিছুদূর যেতেই কাদের মিয়া সামনে পড়ে যায় , ওদের উল্টো দিক থেকে আসছে। আচমকা কাদের মিয়াকে দেখে দুজনেই আঁতকে উঠে এবং ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। কাদের মিয়ার বয়স ষাট বছরের মতো হবে, বেশ মোটা উচ্চতাও বেশ কম, খাটো যাকে বলে। গায়ের রঙ কালো। কালো বলতে অনেকটাই কালো রাতের অন্ধকারে মিশে যায়। মুখভর্তি খোচাখোচা কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। অন্ধকারে শুধু দাঁত আর চোখ দুটোই জ্বলজ্বল করে।হঠাৎ দেখলে যে কারোরই ভয় পাওয়ার কথা।

দুজনকে এভাবে তাড়াহুড়ো করে যেতে দেখে বলল,
— এতো রাইতে কই যান?
উৎকন্ঠা হয়ে ওরা বলল,
— চাচা একটা বাচ্চার লাশ…
— লা…শ, লাশ আইবো কইত্থেইকা, আমি তো এইমাত্র-ই চারিদিকে টহল দিয়া আইলাম, এমন তো কিসু দেখলাম না। আপনাগো চোখের ভুল নিশ্চয়!

কিন্তু ওরা কাদের মিয়াকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে সেখানে গিয়ে লাশের কোন আলামতই খু্ঁজে পেল না। তাহলে সত্যিই কি তাঁদের চোখের ভুল ছিল? কিন্তু দুজনেরই একই ভুল হয় কী করে? নানান প্রশ্নে ওদের বাকি রাতটা কেটে যায়।

পরেরদিন আবার মৃত বাড়িতে তদন্ত শুরু হয় অবশেষে পুকুরের ঝোপঝাড়ের মধ্যে একেবারে ভিতরে গুজে থাকা একটা লাল নতুন গামছা পাওয়া যায়। গামছাটা চোখে পড়তেই আশিক আর মেহেরের চোখ দুটো ছানাবড়া! কাল রাতে ঠিক যেন এই গামছাটাই ওরা দেখেছিল সেই মৃত শিশুটির গলায় পেঁচানো। তারপর তাঁদের রিপোর্ট বলে, কেউ বা কারা মেয়েটাকে এই গামছা দিয়েই গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে পুকুরে ফেলে দিয়ে এই জীন মেরেছে এই নাটকটা সাজিয়েছে। লাশটাকে উঠিয়ে ডোম ঘরে আনা হয়। ডোম ঘরের চারিদিকটা নীরব নিঝুম। বেশ ফাঁকা একটা জায়গায়। সামনে পিছনে অনেক গাছগাছালি নিচে শুকনো ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এমন শুনশান পরিবেশে দিনের বেলায়ও এখানে আসতে যে কারোরই ভয়ে গা হিম হয়ে আসবে। ওরা শুধু কয়েকজনই ডোম ঘরে যায়। হেঁটে যেতে যেতে পানিতে ভেজা শুকনো পাতার ছপছপ শব্দে মনে হচ্ছে ওদের পিছন পিছন কেউ একজন অনুসরণ করছে। ডোম ঘরে ঢুকতেই তিন বন্ধুর গা’টা ছমছম করে উঠে। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ হঠাৎই কিছু পাখির কর্কশ ডাকে ভয়টা যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।

লাশের চারদিকে ওরা উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডোম ধীরে ধীরে কাফনের কাপড়টা মুখ থেকে সরাচ্ছে আর ওরা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। মুখটা খুলতেই তিনজনেরই মনে হলো লাশের চোখ দুটো খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে যেন একটা মুচকি হাসি দিল। তিন বন্ধুই একটা আতংকিত চিৎকার করে উঠে, নুরী… তারপর তাড়াতাড়ি ফাইলটা চেক করে মৃতের নামটা দেখে, ‘শাহানা বেগম ওরফে নুরী’। আশিক আর মেহের অমনি ঠাস করে মেঝেতে বসে পড়ে, দুজন দুজনের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকায়, এটা তাঁদের সাথে কী ঘটছে? তাহলে দারোয়ান অর্থাৎ কাদের মিয়ার মেয়েটা কে ছিল? অবশেষে নিজেদের সামলিয়ে নিয়ে ওরা তোড়জোড় করে ময়না তদন্ত শেষে রিপোর্ট করে। সেই রিপোর্টে বেরিয়ে আসে মেয়েটিকে সত্যিই গলায় গামছা পেঁচিয়েই হত্যা করা হয়েছে। এবং গামছায় হাতের ছাপ পরিক্ষা করে দেখা গেল আসলে নুরীর জা অর্থাৎ বড়ো বৌ এবং তাঁর আপন ভাই মিলে এই হত্যাকাণ্ড করেছে। কারণ বড়ো বৌয়ের দশ বছর সংসার জীবনে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। ছোট বৌয়ের গর্ভে সন্তান আসায় আবার পুত্র সন্তান হবে জেনে হিংসা ও সম্পত্তির লোভে সে এই কাজ করেছে।

সব কাজ শেষ করে রিপোর্ট নিয়ে ওরা তিন বন্ধু রওনা হয় বাংলোর দিকে। বেশ রাত হয়ে যায়। ওদিকে বৃষ্টি তো সমান তালে পড়ছেই। সকালে ঢাকার পথে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তাদের বিদায় জানাতে দারোয়ানের মেয়েও এসে দাঁড়ায়, একটা সালাম ঠুকে। তিন বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে,
— বাবার মতোই দেখতে কালো হয়েছে মেয়েটা…
গাড়িতে বসে আশিক আর মেহের নানান ভাবনায় ডুবে যায়। তবে কি রবির কথাই ঠিক, অশরীরী বলে কিছু আছে? সত্যিই কি আছে? আছে? এটা সত্যিই যার যার বিশ্বাস…

সুন্দরীদের বিড়ম্বনা – পুনম মায়মুনী

সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সবারই। সবাই সুন্দরের পূজারী। নিজেকে সবাই সুন্দর দেখতে চায়। তাই বলে সুন্দরীদের এতো বিড়ম্বনা? প্রায় সব সুন্দরীদের একই অভিযোগ, কোন পুরুষের সাথে মন খুলে হেসে একটু কথা বল্লেই ব্যাস্, হয়ে গেলাম তাঁর দৃষ্টিগোচর! পাশে তো আমার বান্ধবীটিও ছিল, দু’জনের আচরণও ছিল একই। কই তাঁকে তো তোমার দৃষ্টিতে আটকালো না? কিন্তু কেন? আমি সুন্দরী বলে? লিখে ফেললে ডায়েরির পাতাটা ভরে;
কাজল কাল ঐ ডাগর আঁখির হরিণী চাহনি,
গোলাপের মতো ঐ দু’টি ঠোঁটে বাঁকা চাঁদের হাসি,
দু’গালে পড়া টোল, আহা!
পাগল কারা এ মন
ওগো সুন্দরী, মনোহারিণী
আরো কতো কী!

এদিকে বাবা-মায়েরা আর ভরসা করতে পারছেনা তাঁর সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে। কী জানি কী হয় বাবা! কখন কার পাল্লায় পড়ে যায়। না জানি কোন কেলেঙ্কারি করে বসে? বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি না মাখে। আগেভাগে বিদায় করাই শ্রেয়। মেয়েদের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানই হলো শ্বশুরবাড়ি।
এ্যাঁ… শ্বশুরবাড়ি সব থেকে নিরাপদ? নতুন বৌ শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতেই জারি হয়ে গেল কড়া আদেশ-নির্দেশ। শ্বশুর-শাশুড়ির নির্দেশ; অন্দরমহল থেকে যখন তখন বাইরে যাওয়া একদম চলবে না। এমন কী বাপের বাড়িও না। এতো সাজগোজেরও কী এমন প্রয়োজন? বৌ এমনিতেই রূপবতী! এদিকে স্বামী মহাশয়েরও কড়া আদেশ; বন্ধুবান্ধব সব ছাড়তে হবে। বেগানা পুরুষের সাথে তো কথা বলাই যাবে না!

বৌ তা্ঁর মাশাল্লাহ্ সুন্দরী
কারো নজরে পড়লো বুঝি
চলাফেরায় যদি হয় ঊনিশ বিশ
মাথায় ঢোকে সন্দেহের বীজ।

সেইদিক থেকে ইলাকে সৌভাগ্যবতীই বলা যায়। কারণ দ্বিতীয়টি তাঁর ভাগ্যে জোটেনি, অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হতে হয় নি তাঁকে। তাঁর স্বাধীনতায় যথেষ্ট মূল্য আছে এ পরিবারে। আর স্বামী নোমান? সেতো সোনায় সোহাগা!একেবারে বন্ধুর মতো আচরণ।
সবসময় ইলার পাশে থেকে তাঁর সুবিধে, অসুবিধেগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে। ইলাও তাঁর মনের সমস্ত কথাগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে নোমানকে বলতে পারে। সুন্দরী মেয়েদের যে পদে পদে বিপর্যস্তে পড়তে হয় সেটা খুব ভালো করেই জানা নোমানের। নিজের ছোটবোন ছন্দার বেলায়ও এমন অনেক ঘটনার মোকাবেলা করেছে সে। আর ইলার বিয়ের পরও সমাজের এমন অনেক রুচিহীন অসভ্য লোকের কুদৃষ্টির কবল থেকে আজও তাঁর রেহাই নেই। মাঝে মাঝে এমন অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা, অকপটে নোমানকে বলে যায় ইলা। ইলার এই সরলতা সততা বিশ্বস্ততা নোমানের জীবনকে যেন আরও সুন্দর সাবলীল ও মধুময় করে তুলেছে তাঁর স্ত্রী ইলা। ইলার বেলায়ও তাই। একটি সুখী দম্পতি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেটা সবথেকে বেশী প্রয়োজন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা তার পুরোটাই ছিল দু’জনের মাঝে একেবারে অষ্টেপৃষ্ঠে গাঁথা।

একদিন এক বিয়ের নিমন্ত্রণে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ইলার কলেজ জীবনের বান্ধবী সুরমার সাথে। সুরমার স্বামী হাসিবকে দেখে তাঁদের বেশ হাসিখুশী আর প্রাণবন্ত মনে হলো। এই অল্প সময়ই ইলা আর নোমানের সাথে বেশ জমিয়ে ফেলেছে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইলা ফেবুটা অন করতেই চোখে পড়লো সুরমা আর হাসিবের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সাথে সাথেই এড করে নিল। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই হাসিবের টুকটাক কথার ম্যাসেজ আসতে থাকে। ইলাও তাঁর সরল মনে দু’এক কথায় উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু কয়েকদিন পর থেকে হাসিবের লেখার ধরণগুলো একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে। ইলার টাইমলাইনে পোষ্ট করা ছবিগুলোতে কমেন্টস না করে ম্যাসেঞ্জারে ইলার রূপের বর্ণনা দিয়ে ছোট ছোট কবিতার ভাষায় কমেন্টস করতে শুরু করে,যা ইলার কাছে মোটেই শোভনীয় লাগছে না। অনেক কথাই এড়িয়ে সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে যায় ইলা। এরপর তাঁর সাথে কথা বলার জন্য ফোন নাম্বার চাইতে শুরু করে। সুরমার কাছে ইলার ফোন নাম্বার থাকা স্বত্বেও কেন হাসিব তাঁর কাছে চাইছে? ইলার আর বুঝতে বাকি রইলো না সুরমার স্বামীর চরিত্রে ঘাটতি আছে।

ইলা তারপর থেকে হাসিবের ম্যাসেজের আর কোন উত্তরই দেয় না। ইলার এই চুপ হয়ে যাওয়ায় হাসিব যেন আরো পাগলা কুকুরের মতো মরিয়া হয়ে উঠে! দিনরাত টুপটাপ শব্দে ইলাকে অস্থির করে ফেলছে । তাতেও ক্ষান্ত থাকেনি। এরপর শুরু করলো ম্যাসেঞ্জারে কল দেয়া। হাসিবের বিরক্তে ইলা একেবারে অতিষ্ঠ! কী করবে সে এখন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একে তো বান্ধবীর স্বামী। নোমানের কাছে সুরমাকে ছোট করতে চাইছে না। অন্যদিকে সুরমা তাঁর এতো প্রিয় বান্ধবী। হাসিবের এই আচরণগুলোর কথা জানলে ওর সংসারে না জানি কী অশান্তি ঘটে? এই ভয়ে সুরমাকেও কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ অস্থিরতায় দিন কাটছে ইলার।

বেশ কয়েকদিন ধরেই নোমানও খেয়াল করছে ইলা কেমন আনমনা হয়ে থাকে। নোমান ভাবে কিছুদিন আগে তাঁর হার্টে একটু প্রবলেম দেখা দিয়েছিল। এখনো ওষুধ চলছে, “হয়তো বা ইলা আমার অসুস্থতার কারণেই অমন মনখারাপ করে থাকে।“ এদিকে ইলা অসহ্য হয়ে হাসিবকে তাঁর ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে ব্লক করে দেয়। কয়েকটাদিন কেটে যায়। সুরমাকে ইলার মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে আর মনে পড়ে সেই হারানো দিনগুলোর কথা। কোনো অন্যায় একদম সহ্য করতে পারতো না সুরমা খুব সাহসী ছিল। আর ইলা ছিল একটু নরম প্রকৃতির। তাঁর হয়ে অনেক কিছুরই মোকাবেলা করেছে সুরমা। খুব ভালোবাসতো সুরমা ইলাকে। তবে হাসিবের কার্যকলাপগুলোকে ইলা এখন আর তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে কারণ তাঁর জীবনে এমন বহু ঘটনাই সে পাড়ি দিয়ে এসেছে। কিন্তু তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে বান্ধবী সুরমার জন্য। এমন চরিত্রের স্বামী নিয়ে সত্যিই কি ও সুখে আছে? নাকি সুখের অভিনয় করছে? সুরমাকে ঠকিয়ে না জানি হাসিব কতো মেয়ের সাথে এমন নোংরা সম্পর্ক গড়ছে। নাকি সে সুরমাকে সব খুলেই বলবে। ইলা যেন আর ভাবতে পারছে না।

এদিকে নোমানেরও অফিস থেকে ফেরার সময় হলো। ইলা কিছু নাস্তা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকবে তখনই মোবাইলটা বেজে উঠে। রিসিভ করতেই দেখে সুরমার ফোন।
— ‘হ্যাঁ, সুরমা কেমন আছিস? অনেকদিন পর তোর কথাই ভাবছিলাম রে!’
একটু ভারী গলায়,
— ‘চাকরী করে আর সময় পাই না রে…, আমি তো আর তোর মতো অতো সুখী মানুষ না যে প্রচুর অবসর! আর অবসরে ফেবুকে বসে সবার সাথে আনন্দ করি চ্যাটিং করি!’
সুরমার কথাগুলো ইলার বুকে এসে একটা ধাক্কা লাগে,
— ‘কই আমিতো ফেবুকে কারোর সাথে চ্যাট করি না?’
— ‘ও শুধু হাসিবের সাথে করিস এইতো? তো মাঝেমধ্যে আমাকেও তো করলে পারতিস?’
ইলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না,
— ‘তুই কী বলছিস এসব, আ…
— ‘থাক আর ভণিতা করিস না হাসিব আমায় সব বলেছে। রোজই তোদের চ্যাটিং হয়। একদিনের পরিচয়ে ভালোইতো ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলি তোরা? নোমান ভাই কী জানে সে কথা? নিশ্চয় না। জানলে অবশ্যই মেনে নিবে না যেমন আমি নেই নি।’ এক নাগার বলেই গেল সুরমা।
সুরমাকে একটু থামিয়ে, ‘প্লিজ আমার কথাটা একটু শোন্? আমাকে ভুল বুঝিস…
— ‘থাক আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাস না। আমার কথা আমি বলে দিয়েছি। কথাটা মাথায় রাখিস। আর নোমান ভাইকেও জানাবো সে কথা’ বলেই টুপ করে ফোনটা কেটে দেয় সুরমা।

সুরমার বরাবরই অমন কাটখোট্টারর মতো চটাং চটাং করে কথা বলার অভ্যাস এটা ইলার ভালো করেই জানা। তবে সুরমার আজকের ব্যবহারটা তাঁকে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছে। ‘যার জন্য করি চুরি সে বলে চোর। আমাকে তো ও ভালো করেই জানে আমি কেমন স্বভাবের’।
সুরমার এই আচরণগুলো ইলা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এই গুমটটা কি করে ভাঙবে সে। এই ভুলের অবসানটা নিয়ে ভাবতে থাকে ইলা। নোমান অফিস থেকে ফিরে এলে প্রতিদিনের মতো ইলা উৎফুল্ল না হয়ে চা-নাস্তা সব টেবিলের উপর রেখে ছোট ছোট পা ফেলে বারান্দার গ্রিলে মাথাটা ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরটা কেমন ছটফট করছে। ভাবছে সুরমার সাথে তাঁর দেখা না হলেই বরং ভালো হতো? নোমানও লক্ষ্য করলো ইলার এই অস্থির অস্থির ভাবটা । নিশ্চয়ই ইলার বড়ো একটা কিছু সমস্যা হয়েছে। ওর ঐ বিষণ্ণ মুখখানাই বলে দিচ্ছে। ইলার কী এমন হয়েছে যে আমাকেও বলতে পারছে না?

তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে ইলার পাশে এসে দাঁড়ায় নোমান,
— ইলা তোমাকে আমার চেয়ে বেশী বোধহয় আর কেউ ভালো করে জানে না! আমি নিশ্চিত, কেউ তোমাকে কোনো বিষয় নিয়ে আঘাত করেছে শুনলে কষ্ট পাবো বলে আমায় বলছ না? প্লিজ বল, আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি কয়দিন ধরে তোমার এই মলিন মুখটা দেখে!

ইলা যেন নিজেকে আর সংবরণ করতে পারছিল না। যে মিথ্যা সন্দেহের মধ্যে সে আটকে গেছে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ইলা এটাও খুব ভালো করেই জানে সে নোমানের কতোটা বিশ্বাসী স্ত্রী! পৃথিবী উল্টে গেলেও নোমান কোনদিনই বিশ্বাস বা সন্দেহ করবে না ইলার চরিত্র নিয়ে। বরং সুরমা তাঁকে এই ভুল বুঝার জন্য নোমানই কষ্ট পাবে বেশি, এটা একশত ভাগ সত্য। কোনো সন্দেহ নেই তাতে।
— ‘আমি তোমাকে অনেকবার বলতে চেয়েছি কিন্তু বিশ্বাস করো, শুনে যদি তোমার শরীর খারাপ হয় সেই ভয়েই বলতে চাই নি।’
নোমান অভয় দেয়, ‘চিন্তা করোনা আমি সহ্য করতে পারবো।তবু তোমার এই মলিন চেহারাটা আর সহ্য করতে পারছি না প্লিজ!’
তারপর ইলার মুখে সবকিছু শুনে নোমান হো হো করে হেসে উঠে,
— ‘ওহ্, এই কথা? আমি ভেবেছি বিরাট কিছু হয়েছে তোমার। তাহলে এটাই ছিল একমাত্র তোমার চিন্তার কারণ?
— তোমার বান্ধবীর স্বামীকে প্রথম থেকেই আমার সুবিধের মনে হয়নি। তোমার মন খারাপ হতে পারে তাই কিছু বলিনি। এখন দেখছি আমার ভাবনাটাই মিলে গেল । দাও দাও সুরমার ফোন নাম্বারটা দাওতো আমায়। সুরমার সাথে কথা বলবো’।

কিন্তু ইলা একটু ইতস্তত করতে থাকে,
— ‘থাক্ না নোমান? আর ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই! সুরমা খুব জেদি মেয়ে। হয়তোবা সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিবে। আমার সাথে তো সম্পর্ক ভেঙেছেই। ওদের মধ্যেও সম্পর্কের ঘুণ ধরতে পারে। আমি চাই না এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে সুরমার সংসারের কোনো ক্ষতি হোক’।
নোমান ইলাকে বোঝায়,
— ‘তোমার সাথে সম্পর্ক ভাঙুক! কিন্তু হাসিবের প্রকৃত রূপটা সুরমাকে জানানো একান্ত প্রয়োজন। ভালো করে দেখুক ওর মুখোশধারী স্বামীকে। দোষীকে অবশ্যই এভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া উচিত। দেখিয়ে দিতে হয়। অন্যকে সন্দেহ করার আগে নিজেকে আগে প্রশ্ন করা উচিৎ দোষী কে?’।

ইলা চুপ করে থাকে। নোমান ইলার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। ইলার ফেবু ম্যাসেঞ্জারটা খুলে। হাসিবের পাঠানো ম্যাসেজগুলো সব পড়ে । তারপর একে একে সবগুলো ফরওয়ার্ড করে দেয় সুরমার ম্যাসেঞ্জারে। আর নীচে লিখে দেয়; আগে নিজের ঘরের দুর্গন্ধ দূর করো তারপর অন্যের ঘরে টোকা দাও।

বাবার বিচার – পুনম মায়মুনী

— কুহি, ও কুহি, তুই কই গেলিরে মা..?

কুসুম সারা বাড়িময় খুঁজে বেড়াতে থাকে তাঁর বার বছরের মেয়ে কোহিনূরকে। অবশেষে বাড়ির পিছনের আমগাছের তলায় বসে, হাঁটুর উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মেয়েকে । কুসুম এক দৌড়ে যেয়ে একটু অবাক স্বরে বলল,
— কি রে মা… কি অইসে তোর ? কান্দস ক্যান?

তারপর মেয়ের মুখের উপর পড়েথাকা বালির মতো খসখসে খটা চুলগুলো সরিয়ে, মুখটা তুলে দু’গালে চুমু খায় ।মায়ের সাথে চোখাচোখি হতেই আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠে কোহিনূর,
— পেত্যেকদিন বাবা তোরে এতো মারে ক্যান মা..? হেইদিন নানাবাই আইসিলো আমারে দেকতে…. কথাটা কেড়ে নিয়ে কুসুম বলল,

— হ’রে, মা… একটা ডিম ভাইজা তোর নানারে ভাত দিসিলাম বইলা,আমারে কি মারনডাই না মারলো তোর বাবায়! কতো কৈফিয়ত চাইলো, তুই টেকা পাইছস কই? আমার টেকা চুরি কইরা তোর ফইন্নি বাপেরে গিলাস।

মায়ের কথা শুনে একটু ক্ষুদ্ধ হয়ে কোহিনূর বলে উঠে,
— আমার মুরগী ডিম পাড়সিলো, হেই ডিমই তো নানাভাইরে খাইতে দিসিলাম । কতো কইরা কইলাম তবুও বাবা ক্যান হুনলোনা, মা?

মেয়ের কথা শুনে কুসুমের চোখ দু’টো ছলছল করে উঠে, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে –
— তুই কান্দিস না, আল্লায় হেই বিচার করবো রে মা… আল্লায় সব দেখতাসে।

— খালি রোজই কস্ আল্লায় বিচার করবো, কই করে? কাইল রাইতেও রান্দনের একটু দেরী হইসিলো, হেইলিগ্গা বাবা তোর চুলের মুডি ধইরা সারা উডান গুরাইয়া মারসে, কতোগুলান চুল টাইন্না ছিরল। আমারেও লাত্থি দিয়া ফিক্কা মাইরা ফালাইয়া দিলো।

কুসুম শাড়ীর আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে। কোহিনুর মায়ের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়,
— দাদী ফুফু হগ্গলে আমগো চিক্কর পাইরা কান্দন দেখলো, কে–উ তো বাবারে ইকটু ঠেকাইলো না মা?

ক্রন্দনরত গলায় কুসুম,
— মানুষ কি আর মানুষ আসেরে মা.., হগ্গলে মজা লুটে, তামশা দেখবার আহে, সিনামা দেখবার আহে।

তারপর আঁচল দিয়ে নিজের, মেয়ের চোখের জল মুছতে থাকে । আবারও বলে উঠে ,
— যার কেউ নাই তাঁর আসে আল্লায়, হে ঠিকই একদিন সবার বিচার করবো দেহিস মা!

কোহিনূর মায়ের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। টপটপ করে গাল বেয়ে চোখের জল ঝরতে থাকে,
— মাগো, আমারে ইশকুলে ভর্তি করাইয়া দিবি? সবাই কি সুন্দর ইশকুলে যায়! আমিও পড়ালেখা করুম।

কুসুম মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে । মায়ের উষ্ণ অশ্রুর ফোঁটা কহিনুরের পিঠে পড়ে, ওমনি উঠে বসে কহিনূর। ছোট্ট তুলতুলে আঙুলগুলো দিয়ে মা’য়ের চোখ দু’টো মুছতে থাকে। কুসুম মেয়ের হাতে চুমু খায়,
— থাক্ মা ,দুঃখ করিস না। তুই আরেকটু বড়ো হইলে হেরপর দুইজনে শহরে যামু, তোর ঐ ফুলি বুবুর মতো গাম্মেনসে (গার্মেন্টস) কাম নিমু, মেলা টেকা পামু, তহন আর দুক্কু থাকবো না আমগো। আমি তোরে ইশকুলে ভর্তি করাইয়া দিমু গো মা…।

মায়ের কথায় কোহিনূরের বুকের ভিতর একটা শীতল হাওয়া স্পর্শ করে যায়, আনন্দে দু’চোখে একটা আবছ রঙিন স্বপ্ন ভেসে উঠে। তুহিন , সাথী, লিলি ওদের মতো বগলের নিচে বই-খাতা নিয়ে সেও একদিন স্কুলে যাবে; ক্লাসরুমে বসে জোরে জোরে সুর মিলিয়ে সবার সাথে অ আ ক খ পড়বে । ছড়া কেটে কেটে পড়বে । কহিনূর প্রায়ই স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াগুলো শুনতো আর তাঁর বুকের ভিতর ভীষণ একটা কষ্ট অনুভূত হতো স্কুলে না পড়ার কারণে। আজ মা’য়ের মুখে সেই আশার বাণী শুনে একটা অজানা খুশীতে মাকে জড়িয়ে ধরে,
— সত্যই মা, আমারে ইশকুলে পড়াইবি?
কুসুম স্নেহভরা মুখে হেসে বলে – সত্য, সত্য , সত্য । তিন সত্য । তারপর মা-মেয়ে দু’জনেই খিলখিল করে হেসে উঠে।

ভোর থেকেই কর্কশ স্বরে কাকগুলো কা, কা করে ডেকেই চলেছে এডালে ওডালে। বুকের ভিতর অজানা আতঙ্ক ভর করে বসে কুসুমের। ইটের টুকরো ছুঁড়ে তাড়াবার চেষ্টা করে,
— মরার কাওয়া, বিয়ান থিকা কি শুরু করলো, না জানি কার কি সর্বনাশ অইলো! বলে পিছনদিকে মুখ ঘুরাতেই চোখে পড়ে ছোটভাই বাদলকে। বিবর্ণ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে।

আচমকা বাদলকে দেখে কিছু বলার আগেই বাদল চিৎকার করে কেঁদে উঠে,
— বুবু…রে, বাজান আর নাই..! তোরে লইতে আইসি রে বুবু.। শুনে কুসুমও আর্ত চিৎকার করে উঠে।

ভাইবোনের কান্নার আওয়াজে কোহিনূর দৌড়ে আসে। কোহিনূরকে বাদল বুকে টেনে নেয় ,
— তোর নানাবাই আমগো ছাইড়া চইলা গেসে, মইরা গেসে রে কুহি..। আর কোনদিনও আইবো না।

মৃত্যুর রহস্যটা কহিনূরের তখন অজানা । তার কচিমনে যেন একটা ধাক্কা খায় । তীব্র আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
— মইরা গেলে মানুষ কই চইলা যায় মামু?
— আল্লাহর কাসে যায় রে কুহি।
ওদের কান্না দেখে কোহিনূরও কাঁদতে থাকে।

পাশের গ্রামেই কুসুমের বাবার বাড়ি। স্বামী সিরাজ কাজ শেষে ফিরে আসে সেই সন্ধ্যা নাগাদ। তাই অপেক্ষা না করে কোহিনূরকে নিয়ে ভাইয়ের সাথেই চলে যায় কুসম। বাবার চিরবিদায়ের শেষ মুখখানা একবার দর্শন করার আশায়। বাবার কবরে মাটি দিয়ে, শেষ বিদায়ের পর কুসুম নিজ বাড়ীতে যখন ফিরে আসে, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে চারিদিক অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাবার মৃত্যু শোকের কান্নাটি তখনো কুসুমের বুকের ভিতর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছিল। উঠোনে পা ফেলতেই রক্তচক্ষু নিয়ে সিরাজ তেড়ে আসে, লাথি মেরে কুসুমকে মাটিত ফেলে দেয়, তাল সামলাতে না পেরে কোহিনুরও ছিটকে পড়ে অপরদিকে। কুসুমকে আবারো চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে তুলে সিরাজ। তারপর কিল, চড়, ঘুষি দিয়ে ইচ্ছেমত মারতে থাকে।

— মাগি! তোর এত্তবড় সাহস আমারে না কইয়া বাড়ীত্থন বাইর হইসস? আবার ফিরা আইলি ক্যান , এতো সখ যহন বাপরে দেহনের, ফইন্নি বাবার লগে মরতে পারলি না? বাইর হ আমার বাড়ীত্থন!

রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে একাই শুয়ে পড়ে সিরাজ। সারারাত বারান্দায় ছোট্ট চৌকিতে মা, মেয়ে দুজনে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে মেয়েকে পাশে না দেখে অনেক খুঁজাখুঁজির পর, বাড়ীর বাইরে বের হয় কুসুম। কিছুদূর যেতেই কোহিনূরের খেলার সাথী জরিনাকে চোখে পড়ে।
— আমার কুহিরে দেখছস জরি?
— ‘হ’, ঐ নদীর দিক্ দৌঁড়াইয়া যাইতে দেখছি! জিগাইলে কুহি কইলো, বাবার বিচার চাইতে যাইতাছি..।

কুসুম বিলম্ব না করে দ্রুত নদীর তীরে যেতেই, অনেক লোকের ভীড় চোখে পড়লো। প্রাণপণে ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখে, তাঁর প্রাণের কুহি। নিথর, অসার ছোট্ট দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। পানিতে ডুবে আরো সাদা ধবধবে একেবারে ফুলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। অমনই মেয়ের উপর আছড়ে পড়ে কুসুম।

— কুহিরে..তুইও আমারে ছাইড়া চইলা গেলি, আমার বুক খালি কইরা! আল্লাহর কাছে বাপের বিচার চাইতে গেছস? মানিক আমার, এইডা তুই কি করলি, ক্যান করলি?
আমি অহন কারে নিয়া থাকুমরে কুহি…

কুসুমের বাঁধভাঙ্গা আর্তনাদে বাতাস ক্রমশ ভাড়ী হয়ে উঠেতে থাকে।
কিন্তু তখনো চারিদিকের সব লোকজন নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ।
সন্তান হারানোর এক অভাগী মায়ের সেই কষ্টের বিলাপের দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে।

কোন ভুলেই যেন কোন ফুলের জন্ম না হয় – পুনম মায়মুনী

বাবা মায়ের অত্যন্ত আদরে বেড়ে উঠা মেয়ে, টুম্পা। তাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছা সাধ আহ্লাদ পূরণে বাবা-মা কখনোই এতোটুকু কার্পণ্য করেনি । অবশ্য সব পিতামাতারাই চায় নিজ সন্তানদের চাওয়া পাওয়া তাঁদের সাধ্যমতো পূরণ করতে। আর এতেই পিতামাতার আত্মতৃপ্তি \। কিন্তু সন্তানের এই চাওয়া পাওয়ার ব্যবধানটা যদি অসামঞ্জস্য হয় তাহলে কখনো কখনো কাউকে সঠিক পথটি হারিয়ে অতল গহ্বর তলিয়ে যেতে হয়। টুম্পাকে তাঁর জীবন চলাচলে পিতামাতার দিক থেকে কোনদিনই কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় নি। ধনীর আদুরে দুলালী মেয়ে টুম্পা। ইচ্ছামত বাবার টাকা উড়িয়েছে। ক্লাস শেষে দেরী করে বাড়ি ফিরেছে। এজন্য বাবা,মায়ের কাছে কোনোদিনও তাঁর কোন কৈফিয়ত বা কারণ দর্শাতে হয়নি । কখনো বা বন্ধুবান্ধবদের জন্মদিন, বিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সারারাত কাটিয়ে এসেছে, শুধু তাই নয় ; মাঝে মাঝে পিকনিক এর নাম করে কক্সবাজার, বান্দরবন বেড়িয়ে এসেছে হৈ হুল্লোড় করে। সেখানেও নীরব থেকেছে বাবা-মা, মেয়ে যা বুঝিয়েছে, বিশ্বাস করে সেটাকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে। মেয়ের এই উশৃঙ্খল চলাচল নিয়ে অনেকেই বাবা-মাকে টুম্পার প্রতি নজর দিতে বলেছে। কেউ আবার যুগের পরিস্থিতি, পরিবেশ নিয়েও কিছু উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু মেয়ের প্রতি এতো অন্ধ বিশ্বাসের কারণে টুম্পার বাবা-মা কারোর কথাই গ্রাহ্য করেনি। বরং উল্টিয়ে সবার মুখের উপর জোর দিয়েই বলেছে তাঁদের একমাত্র মেয়ে কখনো এমন কাজ করতে পারেনা যা বাবা-মাকে লজ্জায় পড়তে হবে। কি আর করা ! সন্তানের ভালো-মন্দের ব্যপারে বাবা-মা’ই যদি উপেক্ষা করে চলে তবে তাঁদের আর কিছু বলার নাই। ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে সবাই।

বেশ কয়েকদিন ধরেই টুম্পার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে । খাওয়াদাওয়ার প্রতি খুব অনীহা। বাবা-মা দু’জনেই অস্থির। মেয়ের পছন্দের সব খাবার সামনে এনে হাজির। কিন্তু মেয়ের কোন রুচি নেই খাবারের প্রতি। একদিন টুম্পা কলেজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে, ধরাম করে মাটিতে পড়ে যায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাবা তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডাকলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার স্পষ্টভাবে জবাব দিলেন– আপনার মেয়ে তো অন্তঃসত্ত্বা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো বাবা-মা’য়ের, ‘এ কী শুনছে তাঁরা!’’ অন্ধের মতো বিশ্বাস করে এত আদর, মমতা, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে তুলল যে মেয়েকে, সে কি না এতো বড় একটা ঘৃণিত কাজ করতে পারলো? আমরাতো কখনো ওর কোন অভাব বা কোন আবদারই অপূরণ রাখিনি? একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে তখন ডাক্তার বললেন, “আপনারা শুধু ওর অভাব আর আবদারই পূরণ করেছেন কিন্তু মেয়ে সেটি কোনখাতে ব্যয় করছে, কার সাথে মিশছে তার তদারকি কি কখনো করেছেন? আধুনিকতার নামে, অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় কতো যে এমন, লাল, নীল রঙিন প্রজাপতিগুলো পথহারা পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে; শুধুমাত্র সঠিক শিক্ষা ও সঠিক গন্তব্যস্থলটি না জানার কারণে। সেদিন যদি, লাগাম ধরে ভুল আর ঠিক পথের নিশানাটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন, তাহলে হয়তো আজ আপনার মেয়ে এই পরিস্থিতির শিকার হতো না।” তারপর খানিকক্ষণ নীরব থেকে, ডাক্তার সাহেব দুঃখের সাথে আবারো বললেন, “অভিভাবকদের এমন অসচেতনতার কারণে, হরহামেশাই আমাদের ডাক্তারদের দেখতে হচ্ছে এই নির্মম লজ্জাকর ঘটনাগুলো”

অবশেষে টুম্পাকে একটি নামীদামী ক্লিনিকে নেওয়া হলো। কিন্তু কোন ডাক্তার এতো বড় রিক্স নিতে রাজি হলেন না। কারণ টুম্পা তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এরপর আরও কয়েকটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েও ব্যর্থ হলো। সব ডাক্তারদের ঐ একই কথা একেতো কিশোরী বয়স, তার উপর মেয়ের শরীরের যে কন্ডিশন, কিছুতেই সম্ভব না বাচ্চা নষ্ট করার। এতে রোগীর জীবনাবসানও ঘটতে পারে। তাঁর এই সর্বনাশের পিছনে কে দায়ী? মেয়ের কাছে জানতে চাইলে আরও আশ্চর্যের কথা, টুম্পা নির্দিষ্ট কারোর নাম বলতে পারলো না। এই অবস্থায় ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করতে হলো টুম্পাকে। হুটহাট করে প্রায়ই টুম্পা বাবা-মায়ের সাথে বিদেশে ঘুরতে যেত । তাই সহপাঠীরা কেউ যোগাযোগ করতে চাইলে তাঁদের জানানো হয়, কয়েকদিনের জন্য টুম্পা দেশের বাইরে বেড়াতে গেছে। কয়েক মাস পর নির্দিষ্ট সময়ে এক প্রকার চোরের মতো লুকিয়ে, রাতের অন্ধকারে টুম্পাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোন একটা ক্লিনিকে।

পরেরদিন কাকডাকা ভোরে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কিছুদূর এগুতেই কয়েকজন লোকের ভীড়। টুম্পার মা গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে মাথাটা বের করতেই, একটা ফিসফিস আওয়াজ কানে এলো “জারজ, জারজ বাচ্চা”। সামনে আরও একটু ভালো করে তাকাতেই নজরে আসে , ডাস্টবিনে পড়ে থাকা সদ্য ভূমিষ্ঠ একটা ফুটফুটে শিশু । চারিদিক বাতাস ভারী করে হাত পা ছুঁড়ে কেঁদেই চলেছে নবজাতক শিশুটি। তড়িঘড়ি করে গ্লাসটা উপরে উঠিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে বলল টুম্পার মা। কিন্তু যত দূরেই যাক্, টুম্পার মায়ের কানে সেই শিশুর কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে বাজতে থাকে। শিশুটির কান্নার ভাষা যেন চিৎকার করে বলে দিচ্ছে, “আমি মানুষ আমি পবিত্র। দোষী যদি হও সে তুমি, তোমরা। আমার কোন কালিমা নেই এ পৃথিবী সাক্ষী। তবে কেন হবে আমার পরিচয় জারজ সন্তান? জন্মের পর আমার স্থান এই নোংরা ডাস্টবিনে নয়। আমার স্থান স্নেহময়ী মায়ের কোল। আমিও তোমাদের মতো আদর, যত্নে মায়ের ভালোবাসা চাই। মানুষ নামে বাঁচতে চাই। বাঁচার অধিকার চাই!” লোকলজ্জার ভয়ে নিজেদের কুকীর্তি ঢেকে সমাজের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই টুম্পার মায়েরা অপরাধগুলো অন্ধকারের মতো, হয়তো আড়াল করতে পেরেছে ঠিকই । কিন্তু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার,যে ভুলের মাশুল লেপ্টে আছে মেয়ের অস্থি, মজ্জায়, সারা দেহে। তাকে অস্বীকার করবে কোন দৃষ্টি দিয়ে? এ পৃথিবী আর কতকাল… এভাবে নীরব সাক্ষী হয়ে বহন করে চলবে কে জানে?

১০ টাকার আংটি – পুনম মায়মুনী

কয়েকদিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম কলকাতায়।

এক আত্মীয়ার বাসায়, সম্পর্কে আমার দেবর হয়। ওর ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়ে নাম রিয়া, বয়স আট কী নয় বছরের হবে। এর আগে ওকে আমি দুই, আড়াই বছর বয়সের দেখে এসেছিলাম।

ধবধবে সাদ ফর্সা, গোলগাল গড়নের। তুলতুলে শরীরটা তাই আমি রিয়ার নাম দিয়েছিলাম তুলতুল।

আমাদের দেখে, প্রথম প্রথম ও খুব লজ্জা পাচ্ছিল । অন্য রুম থেকে পর্দাটা একটু ফাঁক করে করে দেখে নিতো। আমি কাছে ডেকে এনে, একটু আধটু কথা বলে, চকলেট দিয়ে দিয়ে ওর লজ্জাটা ভাঙালাম।

তারপর থেকেই লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে গল্প করা ছিল ওর খুব আনন্দের! আমি বাচ্চাদের সাথে থাকলে, নিজেও যেন বাচ্চা হয়ে যাই। এখনকার বাচ্চারা পাঠ্য বই আর কোচিং নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন।

রূপকথার তেমন কোন গল্পের বইয়ের নামই জানে না ওরা। রিয়ার মা দীপার কথা হলো, গল্পের বই পড়লে লেখাপড়ার ক্ষতি ভীষণ! মনে আছে ছেলেবেলায় রূপকথার গল্প ঠাকুমার ঝুলি, আরব্যোপন্যাস, নীলপদ্ম, সাতভাই চম্পা বিভিন্ন রকমের গল্পের বই কতো যে পড়েছি! কই লেখাপড়ার ক্ষতি তো বুঝিনি।

অথচ ক্লাসে ভালো ছাত্রী হিসাবেও পরিচিতির কমতি ছিলনা। মনে পড়ে ছোটবেলায় টিফিন পিরিয়ডে আমরা বান্ধবীরা একে অন্যকে রূপকথার গল্প শুনাতাম। রিয়াকে সেই পান্তাবুড়ী, শুয়োরাণী-দুয়োরাণী, ডালিম কুমার, সোনারকাঠি-রূপোরকাঠি এমন অনেক রূপকথার গল্পগুলো বলতাম।

ও এতো আগ্রহ আর মনোযোগ দিয়ে শুনতো, মনে হতো রিয়া যেন এক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতো। দুঃখের কাহিনীগুলো শুনে চোখ দু’টো ছলছল করে উঠেছে, টপ্ টপ্ করে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে । আমি হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে, তুলতুল গালে চুমু খেয়ে বলেছি, এগুলতো রূপকথার গল্প মামণি ।

আমার বুকেই মাথা গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকতো। বলতাম, থাক্ তাহলে আর গল্প বলে কাজ নেই। ফোলা ফোলা ছোট্ট আঙুলগুলো দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলতো না, চাচী-আম্মি আর কাঁদবো না দেখো, তুমি বলো প্লিজ!

আবারো শুরু করতাম, ভাবতাম সত্যিই এই বা্চ্চাদের শিশু বয়স থেকেই যদি এমন সুখ,দুখের অনুভূতিগুলো ওদের ভিতর জাগ্রত করা যায়, তবে অবশ্যই এই শিশুটি একজন ভাল মানুষ হয়ে গড়ে উঠবেই, এটা আমার সবসময়ই মনে হতো। দীপাকেও বলেছি, বাচ্চাদের রূপকথার গল্প শুনাবে, ওরা কল্পনা করতে শিখবে, দেখবে। জীবনের আরেকটা নামও কল্পনা করা আর স্বপ দেখা।

প্রতিটি মানুষের অন্তরে একটি কল্পনার রাজ্য আছেই। রূপকথার গল্পগুলো থেকেই শুরু হয় সেই স্বপ্নগুলো সাজাবার। যতোই স্বপ্ন দেখবে ততোই কল্পনাশক্তি বাড়বে। সুন্দর স্বপ্ন দেখে আশায় থাকা, এটাও জীবনের একটি অঙ্গ। সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। আমাদেরও বিদায় নেওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। রিয়ার মনটাও খুব খারাপ। এ কয়দিনে আমার সাথে ওর খুব ভাব জমে গিয়েছিল। আমরা চলে যাব ও আর গল্প শুনতে পারবেনা।

এটাও ছিল রিয়ার মন খারাপের আরেকটি দিক । ওর ছোট্ট মায়া ভরা বিষন্ন মুখখানা আমাকেও খুব পীড়া দিচ্ছিল! আমার গা ঘেঁষে বসে থাকা ওর তুলতুলে শরীরটা যেন মায়ায় জড়িয়ে লেপ্টে আছে আমার সারা শরীর জুড়ে। এটাই বুঝি ভালোবাসায় মায়ার বন্ধন!

আমাদের সব গোছগাছ করা শেষ। কাল ভোরেই রওয়ানা দিব। রিয়া স্কুল থেকে এসে ড্রেস না খুলেই আমার হাতে একটা চকচকে আংটি দিয়ে, নিজের হাতের আংটিটা দেখিয়ে বলল

— চাচী-আম্মি তুমি আমার এই আংটিটা খুব পছন্দ করেছিলে না?

সেজন্য আমি, তোমার জন্য ও একটা এনেছি। আমাদের স্কুলের সামনের দোকানেই পাওয়া যায়। তোমাকে এটা আমি উপহার দিলাম।

আমি তো অবাক! ওর সুন্দর ছোট্ট আঙুলে, লাল চকচকে পাথরের আংটিটা দেখে একবার বলেছিলাম,
— তোমার এ আংটিটা তো ভারি সুন্দর !

ব্যাস, ওটাই সে মনে রেখেছে। আমি ওকে কি বলবো, সত্যি বুঝতে পারছিলাম না। অতটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ের ভালোবাসার প্রতিদান কি দিব? তবুও বললাম —
— কেন আমার জন্য খরচ করে এটা কিনতে গেলে সোনা?

থতমত খেয়ে, একটু লজ্জা,লজ্জা মুখে ঠোঁটটা বাঁকিয়ে বলল — বেশি দাম না চাচী, মাত্র ১০ টাকা।
— সত্যি, মাত্র ১০ টাকা?

সাথে সাথেই রিয়ার মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল,
– — খুব সস্তা, কম দাম তাই তোমার পছন্দ হয়নি বুঝি?

আমি ওকে বুকে চেপে, আদর করে বললাম,
— এত সুন্দর আংটি! আমার পছন্দ হবেনা, খু-উ-ব পছন্দ হয়েছে মা… ।তখনই আঙুলে পড়ে নিলাম।

কম দামী তাঁর এই উপহারটি এতো খুশি হয়ে গ্রহণ করায়, রিয়ার চোখে মুখে কি-যে আনন্দের তৃপ্তি ও প্রশান্তির ছোঁয়া আমি দেখেছি ; তা এ দুনিয়ার কোনকিছুর বিনিময়েও পূরণ করতে পারবোনা!

আমার কাছে এখনো অমূল্যই হয়ে রইলো, এই ১০ টাকার আংটিটা। ছোট্ট এই বাচ্চা মেয়েটির ভালোবাসায় মাখা এ উপহারটি হলো, আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার! ভালোবাসার কাছে টাকা…সত্যি অনেক অনেক বেশী মূল্যহীন। আর তাইতো “ভালোবাসাই” হলো অমূল্য ধন।

বৃষ্টিজল – পুনম মায়মুনী

মেঘলা দুপুর। শ্রাবণের আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘগুলো জমতে থাকে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, সাথে দমকা হাওয়া বইছে। বুঝি প্রচণ্ড একটা ঝড়োবৃষ্টি হবে!

ভীষণ ভাল লাগে পূর্ণিমার এই বর্ষা ঋতুটা ; কেন যে বর্ষাকালটা ঋতুরাজ হলো না?

বর্ষার জলে স্নান করে আরও শ্যামল ,সতেজ, পবিত্র হয় এই বসুন্ধরা। ডালে ডালে সবুজের সমাহার, তারি ফাঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ বাহারি ফুল, ব্যাকুল কারা মন।

আকাশে সাদাকালো মেঘের লুকোচুরি খেলা, মাঝে মাঝে সোনালী দড়ির বিদ্যুৎ এর ঝলকানি ! দৈত্যের মতো আকাশ ফাটা মেঘেদের গর্জন, এটাই যেন আকাশের কলরব।

কখনোবা আকাশ জুড়ে রংধনুর সাত রঙ ছড়িয়ে বসেছে রংয়ের মেলা। কি অপরূপ রূপে সেজেছে আকাশ আর প্রকৃতি। মিলেমিশে একাকার। পূর্ণিমা তাঁর মনের ক্যানভাসে কল্পনার তুলি দিয়ে এঁকে যায় আকাশ ও পাতালের এই মিলনমেলা। এমন মেঘলা দিনে কেন যেন পূর্ণিমার হৃদয়ে এক অদ্ভুত পাগলপারা প্রেমের দোলা দিয়ে যায়! ইচ্ছে করে কারো হাতটি ধরে ময়ূরের মতো পেখম খুলে বৃষ্টিজলে ভিজতে! 

মনে পড়ে যায়, ফেলে আসা পিছনের অধ্যায়। সে আর চন্দন। কতো যে বর্ষার জলে ভিজে ভিজে পিচঢালা পথে হেঁটেছে। কখন যে মনের অজান্তেই দু’জনার দু’টি হাত একমুঠো হয়ে গেছে। পাশাপাশি বসে ঝিলের জলে পদ্মপাতায় বৃষ্টির ছিটা দেখেছে.আর সুরে সুর মিলিয়ে কবিতা গেঁথেছে।

পূর্ণিমার ঘুম থেকে উঠেই চলে একটানা সংসারের সব কাজ করা, একদণ্ড বসার সময় যেন নেই তাঁর।কিন্তু মধ্য দুপুরবেলাটা সে তাঁর একান্ত নিজের করে সময় কাটায়। কিছু স্মৃতি , কিছু কথা, কিছু মনের কথা; হয়তোবা আজকের এই অনুভূতিটুকুও লিখে রাখা তাঁর ডায়েরির পাতায়। তখনো বৃষ্টি শুরু হয়নি, বাতাসের দমকা হাওয়া এসে পূর্ণিমার খোলাচুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যায়। পূর্ণিমা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, কাজল পড়া দু’টি চোখ। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কমলা রং এর একটা টিপ এঁকে নেয় কপালে; ঠিক যেন সদ্য ফোটা টকটকে কৃষ্ণচূড়ার ফুল! এই বাদল দিনে সাজতে বড্ড ভাল লাগে পূর্ণিমার! ততক্ষণে বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। পূর্ণিমা এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঝুলবারান্দায়।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীল রেশমি চুড়ি পড়া হাত দু’টো বার করে বৃষ্টি ছোঁয়। বৃষ্টির রিমঝিম সুর আর চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে জলের ফোঁটা এলোপাথাড়ি ছুঁড়তে থাকে! আর আনমনেই সুরেলা কন্ঠে গেয়ে উঠে,

— আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না —
– – —
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা
মন চায়… মন চায়….

এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠে । ভেজা হাতে দরজা খুলে পূর্ণিমা। অবাক হয়ে, — চন্দন তুমি এ সময়!

— হুম, অফিসে কিছুতেই মন বসছিল না, তোমায় নিয়ে বৃষ্টিজলে ভিজবো তাই চলে এলাম। কতদিন ঝিলের জলে পদ্মপাতায় বৃষ্টির ছিটা দেখিনি বলতো ? চল চল এখনই চল

পূর্ণিমা খুশিতে আটখানা হয়ে বলল,
— সত্যি যাবে ?
— সত্যি সত্যি সত্যি । তিন সত্যি।

পুনম মায়মুনী | Punom Mymoni

Sunglass and our friendship | সানগ্লাসেই সৃষ্টি আমাদের বন্ধুত্ব | Bangla Galpo 2023

Shree Jagannath Bijay Kabya | ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ কাব্য প্রসঙ্গে | 2023

2023 New Bengali Story | গল্পগুচ্ছ | রানা জামান

Anabasarakalina besha of Jagannath | অনবসরকালীন বেশ | অভিজিৎ পাল

Read Online Bangla Golpo | Famous Collection Bangla Golpo | Top Collection Bangla Golpo Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Collection Bangla Golpo 2023 | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | New Collection Bangla Golpo | Collection Bangla Golpo in pdf | Live Collection Bangla Golpo – audio | Top Collection Bangla Golpo | Collection Bangla Golpo – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Collection Bangla Golpo Online | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bangla Golpo Read Online

বাবা হত্যার বিচার | বাবার খুনের বিচার | ১০ টাকার আংটি | বৃষ্টিজল | পুনম মায়মুনী | শব্দদ্বীপের লেখক | শব্দদ্বীপ | সেরা বাংলা গল্প | গল্প ও গল্পকার | সেরা সাহিত্যিক | ১০ টি মেয়েদের আংটি ছবি ও দাম | মেয়েদের হাতের রিং | সোনার আংটি কিনুন | ছেলেদের আংটি | ৩ আনা সোনার আংটি | লেডিস আংটি | ছেলেদের সোনার আংটি ডিজাইন | সোনার আংটি নতুন ডিজাইন | হাতের আংটি | ১ আনা সোনার আংটি | সোনার আংটি নতুন ডিজাইন মেয়েদের | আঙুলে সোনার আংটি | বৃষ্টির জল সংরক্ষণ কী ও কেন | কী করে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করবেন | বৃষ্টির জল ধরে রাখুন | বৃষ্টির জল সংরক্ষণ | বৃষ্টির জলে রান্না | বৃষ্টির জল সংরক্ষণের পদ্ধতি লেখ | বৃষ্টির জল সংরক্ষণের গুরুত্ব লেখ | বৃষ্টির জল সংরক্ষণের পদ্ধতি | বৃষ্টির জল সংরক্ষণে তামিলনাড়ুর ভূমিকা | জল সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা | বৃষ্টির জল সংরক্ষণের সমস্যা | জল সংরক্ষণের কারণ | জল সংরক্ষণের ছবি

Collection Bangla Golpo Video | Audio Collection Bangla Golpo | Live Collection Bangla Golpo | Bengali Story Archive | Short Story | Collection Bangla Golpo pdf | Collection Bangla Golpo in English

Leave a Comment