Bengali Stories of Punom Mymoni
Collection Bangla Golpo | Read Bengali Story Collection
ঝড়বৃষ্টির এক রাতের গল্প
মেহের, আশিক ও রবি ওরা তিন বন্ধু। ছেলেবেলা থেকেই ওদের বন্ধুত্ব। একই স্কুল এবং কলেজে ওরা একই সাথে ছিল কিন্তু ভার্সিটি লেবেলে এসে পৃথক হতে হয়েছে কারণ ওদের তিনজনের জীবনের লক্ষ ছিল তিন রকমের। তিন বন্ধুর মধ্যে মেহের ছিল খুব প্রতিবাদী ও সাহসী প্রকৃতির। আর প্রমাণ ছাড়া সে অনেক কিছুই সহজে বিশ্বাস করতে চাইতো না। ছোটবেলা থেকেই তাঁর খুব সখ ছিল খারাপ লোকদের সে খুঁজে বের করে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিবে আর এই আশা পূরণ করতেই তাঁর সাংবাদিকতার পেশায় যাওয়া। জার্নালিস্ট বিভাগে ঢাকা ভার্সিটি থেকে পাশ করে মেহের এখন একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলের নিউজ প্রডিউসার।
বন্ধু আশিক যেন ছিল ঠিক মেহেরের পরিপূরক! কোন বিষয়ে মেহের অবিশ্বাস কিংবা সন্দেহ পোষণ করলে, আশিক গোয়েন্দাগিরী করে ঠিক সঠিক খবরটা মেহেরের সামনে এনে হাজির করতো। আশিকের স্বভাবটাই ছিল এমন। একবার মনে কোন বিষয় নিয়ে সন্দেহ ঢুকলো তো ব্যস, তার তদন্ত করে শেষটা বের করে তবেই ছাড়বে। একটু জেদি প্রকৃতির। তাই মেহের ও রবি আশিককে CNN বা BBC বলে মজা করতো। মেহেরের পরিপূরক হিসেবে সত্যিই আশিক আজ পুলিশ ডিপার্টমেন্টে চাকুরীরত এবং গোয়েন্দা বিভাগের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। আবার অন্যদিকে আরেক বন্ধু রবি ছিল বেশ সাদামাটা আর একটু ভীতু প্রকৃতিরও। কোন ঝুঁকি নিতে দশবার ভেবে-চিন্তে করে নিবে। পরপোকারিতায় সে ছিল সবার আগে। ঠাণ্ডা ও ধীরস্থির মেজাজের বলে যে কোন সমস্যায় বন্ধুরা আগে রবির কাছে পরামর্শ করে নেয়। রবির ইচ্ছানুযায়ী-ই সে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করে এবং আজ সে বেশ নামকরা একজন ডাক্তার।
ওরা তিন বন্ধু তিন দিকে মুখ করলেও ওদের বন্ধুত্বের কিন্তু কোন রকমের ফাটল ধরেনি। প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে একদিন ঠিকই ওরা একসাথে হয়ে আড্ডা দেয়। আবার পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় কাজের জন্য দিনে সময় না পেলেও তিনজন একত্রিত হওয়ার জন্য প্রায়ই রাতের খাবার তিন বন্ধুর কোন একজনের বাসায় করে নেয়। ওদের এই সুন্দর নির্মল পবিত্র সম্পর্কটা বুঝি সৃষ্টিকর্তারও পছন্দনীয় তাইতো ওদের কাজের ধারাটাও একে অন্যের সাথে সম্পৃক্ত রেখেছেন। আর সেই সূত্রে একে অন্যের সাথে যোগাযোগ রাখতেই হয়। মেহের যেহেতু সাংবাদিক তাই অনেক তথ্য জানতে পুলিশের সহযোগিতার প্রয়োজন হয় আর সেগুলো বেশিরভাগ আশিকের দ্বারাই করা হয়। আবার আশিকের অনেক কেস-এ পোষ্টমোর্টেম করার জন্য ডাক্তারের প্রয়োজন হয় আর সঠিক ও নির্ভুল তথ্যগুলো রবির মাধ্যমে করে নেয়। ওরা যেন সত্যিসত্যিই একে অন্যের পরিপূরক হিসেবেই জন্মেছে।
একবার মেহেরকে একটি সঠিক তথ্য জানার জন্য কোন এক গ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন হয়। সেটি ছিল একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা। একটি নারীর আশ্চর্যজনকভাবে মৃত্যু। তার উদঘাটন করে সত্য খবরটা প্রকাশ করতে হবে। কেউ বলছে আত্মহত্যা কেউ বলছে ভূতে মেরেছে। এ নিয়ে রাতে তিন বন্ধুর মধ্যে আলাপ আলোচনা হয়। মেহের তো হেসেই উড়িয়ে দেয় ভূত বলতে কিছু আছে নাকি! আশিক কিছুক্ষণ ভেবে বলল, হুম একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি, তার তদন্ত অবশ্যই প্রয়োজন। রবিও সাথে যোগ দিয়ে বলল, পোস্টমর্টেম করলেই সত্য বেড়িয়ে আসবে। তারপর ঠিক করে ওরা তিনজনই একসাথে যাবে।
পরেরদিন সকালে ওরা রওনা হয় সেই গ্রামের উদ্দেশ্যে। তখন বর্ষাকাল সবে শুরু। থেমে থেমে ঝড় বৃষ্টি আবার কখনো বজ্রপাত হচ্ছে কিন্তু উপায় নাই কাজের দায়িত্ব, এড়িয়ে যাওয়ারও কোন পথ নাই। সাংবাদিকদের কোন অজুহাত থাকতে নেই, কী গরম কী শীত কী বৃষ্টি। শহর থেকে বেশ ভিতরে ছিল গ্রামটা। মাঝে একটা নদী পার হতে হয়। আগে থেকে বলা ওপারে তাদের অপেক্ষায় ছাতা হাতে দু’জন লোক দাঁড়িয়ে। তারাই ওদের বাকিটা পথ পৌঁছে নিয়ে যায়। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসে গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মধ্যে ওরা একটা বাংলোতে উঠে। বাংলোটা বেশ পুরানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে। দরজা জানালাগুলো জীর্ণশীর্ণ দেয়ালের গায়ে নানানরকমের লতা-পাতায় লেপ্টে আছে। চারিদিকে অনেক গাছ-গাছালিতে ভরা। সন্ধ্যায় পাখিদের নীড়ে ফেরার কিচিরমিচির শব্দটা গ্রাম্য পরিবেশকে যেন আরও সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয়। সারাদিন জার্নি করার পর ওরা তিন বন্ধু বেশ ক্লান্ত। এই বাংলোর দারোয়ান কাদের মিয়া ওদের থাকার ঘর, ওয়াশরুম দেখিয়ে দিয়ে বলল,
— স্যার আপনাদের পছন্দ হইসে তো? আপনাদের আসার কথা শুইনা নিজ হাতে সব গুছাইয়া রাখসি। কোন অসুবিধা হইলে জানাইয়েন আমি পাশের ঘরেই থাকি।
— বেশ বড় একটা রুম, দুই দিকের জানালার ধারে সেমি ডাবল দুটো খাট। তিনজনের ভালোই হয়ে যাবে। ছিমছাম পরিপাটি চাদর বিছানো। দরজার পাশে একটা বড় টেবিল তার উপর ঝকঝকে কাচের গ্লাস ও পানি ভরা জগ।
— হ্যাঁ হ্যাঁ, খুব ভালো খুব পছন্দ হয়েছে। তিনজনেই একসাথে বলে উঠে।
দারোয়ান একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
— আপনাদের চা-নাস্তা দিয়া আমারে আবার বাজারে যাইতে হইবো রাইতের খাবারের ব্যবস্থা করতে।
রবি বলল,
— চাচা আপনি করবেন রান্না? কেন আশেপাশে কোন খাবারের হোটেল নাই?
আসে, সেই মেলা দূরে…আপনাগো কষ্ট হইবো যাইতে। অসুবিধা নাই এইখানে যারা আসে হেগোর রান্না আমার মাইয়া করে। আমার মাইয়া খুব ভালা রান্ধে বলে এক ফালি দাঁত বের করে একটা মুচকি হাসে। কাদের মিয়া রুম থেকে বেরিয়ে রওনা হয় বাজারের উদ্দেশ্যে। ওরা তিন বন্ধু ওয়াশরুম থেকে হাতমুখ ধুয়েমুছে আসতেই দেখে টেবিলের উপর একটি চায়ের ফ্লাক্স সাথে বিস্কিট। পাশে বিশ-বাইশ বছরের একটি মেয়ে, সাদা ওড়নায় বেশ লম্বা একটা ঘোমটা দিয়ে দাঁড়ানো। চেহারাটা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে না, অস্পষ্ট তবে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা বেশ রূপবতী একেবারে ধবধবে ফর্সা; হাত দুটোও তাই বলে। ওদের দেখেই মাথাটা আরও নিচু করে একটা সালাম ঠুকে বলল,
— স্যার আপনাদের চা, বলে ফ্লাক্স থেকে কাপে চা ঢালতে থাকে…
আচমকা মেয়েটাকে দেখে মেহের বলল,
— তুমি কে?
— আমি নুরী।
ভেবেই নিল এটাই সেই দারোয়ানের মেয়ে। কথা না বাড়িয়ে বলল,
— ও, আচ্ছা।
মেয়েটিও আর কোন কথা না বলে নীরবে চলে গেল। মেয়েটির হাঁটার ধরণ দেখে আশিকের বুকে কেমন একটা খোঁচা দিয়ে উঠলো! মেয়েটি যেন নিমিষেই কোথায় মিলিয়ে গেলো কিংবা তাঁর চোখেরও ভুল হতে পারে। এটা নিয়ে আর মাথা ঘামায় না আশিক।
বাইরে মৃদু হাওয়ায় ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ধোঁয়া উঠানো চায়ের কাপে চুমুক দিতে বেশ লাগে। চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে আবারো তিন বন্ধু সেই কেসটা নিয়ে আলোচনায় আসে। মেয়েটির লাশ নাকি আজই দাফন করা হয়েছে সুতরাং যদি মৃত্যুর ঘটনাটি তাঁদের কাছে সন্দেহজনক বলে মনে হয় তবে লাশটাকে অবশ্যই পোস্টমর্টেম করার জন্য কবর থেকে বের করতে হবে। আর সেজন্য এখানকার থানায় আগেই জানানো হয়েছে সে ব্যাপারে পুলিশ তাদের সহযোগিতা করবে। মেহের একটু চিন্তিত হয়ে বলল,
— ঘটনাটা যদি জটিল হয় তাহলে তো আমাদের এখানে কিছুদিন থাকতে হবে মনে হচ্ছে।
আশিক বলল,
— আমিতো দুদিনের বেশি থাকতে পারবো না। জানিস তো আরেকটা মার্ডারের কেস আছে, সেখানে উপস্থিত থাকতেই হবে।
— দেখা যাক্, আগেই চিন্তা করে তো লাভ নেই অবস্থা দেখে ব্যবস্থা করা যাবে। রবি বলল।
মেহেরও সায় দেয়,
— ঠিক তাই, তবে গ্রামটা এখান থেকে কতদূর হবে সেটাই তো জানলাম না!
ওদের কথা শেষ হতে না হতেই কাদের মিয়া এসে হাজির,
— স্যার কিসু কি লাগবো আপনাদের কারোর ?
— না, না লাগবে না বরং একটা কাজ করেন ; আপনি এখানে এসে একটু বসেন তো চাচা, কিছু জানার দরকার ছিল আমাদের। মেহের বলল।
কাদের মিয়া পাশে রাখা একটা টুলের উপর গিয়ে বসে।
— আচ্ছা চাচা নবগ্রামটা এখান থেকে কতটা দূর হবে?
— পরায় দুই মাইল তো হইবোই।
— আপনি কি ঐ গ্রামের কোন নারীর আত্মহত্যা করে মৃত্যুর খবর শুনেছেন?
— না…তো বাবারা। তারপর একটু কৌতূহল হয়ে বলল, আপনারা কি এই কেসের তদন্ত করতে আইসেন?
— হ্যাঁ, তাই আমাদের ক’টা দিন থাকতে হতে পারে, আপনাকে আরও একটু কষ্ট দিব।
— না, না কষ্ট কী, এইডাইতো আমার ডিউটি। এই বাংলোয় কেউ আইলে আমার খুব ভালা লাগে। তেমন তো কেউ আর আয় না আর আইলেও দুই দিনের বেশি থাকে না। অনেকে অর্ধেক কাজ কইরাই চইলা যায়।
আশিক বলে উঠে,
— কেন, কেন চল যায়?
ভয়ে। এক কথায় উত্তর দেয় কাদের মিয়া।
— ভয়! কীসের ভয়?
— সে অনেক কথা… কাইল শুইনেন। সবে আইসেন তো, আইজ রেস্ট নেন। বলে কাদের মিয়া টুল থেকে উঠে সামনে দু’পা এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে বলল,
— তয় আপনেরা রাইতের বেলায় বাইরে ভুলেও যাইয়েন না কিন্তু।
— আচ্ছা চাচা, এতো বড়ো বাংলোতে একা থাকতে আপনার ভয় লাগে না?
— পথম, পথম লাগতো এখন আর ভয় পাই না! সঠিক পথে চললে কেউ কারোর ক্ষতি করে না। যাই মাইয়ার রান্দা কতদূর দেইখা আসি। বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় কাদের মিয়া।
কাদের মিয়া চলে যাবার পর তাঁর কথার জের ধরে মেহের আর আশিক কিছুটা মজা করে, এই বাংলোতে তাহলে ভূত আছে তাইনা? ঠিক আছে দেখা যাক্ ভূতের দেখা মিলে কি-না!
রবি একটু নিচু স্বরে বলল,
— চাচামিয়ার কথাটা একেবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ আমার মনে হয় অশরীরী বলে কিছু আছে।
— তুই কি দেখেছিস নিজ চোখে ? আশিক বলল।
— না, তা দেখিনি তবে ময়নাতদন্তের সময় অনেক অদ্ভুত অদ্ভুত কিছু ঘটনায় আমার মনে হয়েছে ভূত বা অশরীরী যাই বলিস এর অস্তিত্ব আছে।
মেহের হো হো করে হেসে উঠে,
— আরে পাগল ডোম ঘরটা তো এমনই শুনশান নীরব থাকে তারমধ্যে তুই একটু ভীতু প্রকৃতির আবার এগুলা বিশ্বাস করিস? এগুলান সব তোর মনের ভুল। মানুষ যখন দুর্বল চিত্ত নিয়ে কিছু চিন্তা করে সেটা তাঁর মনের গভীরে চলে যায় আর দেখবি মনে হয় আমি সেটা দেখছি।
আশিকও মেহেরের কথায় সায় দিয়ে বলে,
— রাইটস।
রবি আর কথা বাড়ায় না। কারণ এগুলো যার যার বিশ্বাস ও অনুভূতির ব্যাপার। কাউকেই বলে বুঝানো সম্ভব না।
সন্ধ্যা পেরিয়ে ধীরে ধীরে রাতটা বাড়তে থাকে। অন্ধকারটাও গাঢ় হতে থাকে। পাখিদের কোলাহলের বদলে এখন ঝিঁঝিঁপোকার ডাকটাই ক্রমে বাড়ছে। আবার বৃষ্টির মাত্রাটাও বেড়ে চলছে। চারিদিকে কেমন একটা নীরব থমথমে ভাব। বাংলোর চারিদিকে ঘেরা বড়ো বড়ো অনেক গাছ। গেটের সামনে থেকে পিছন দিক পর্যন্ত একটা সরু পাকা রাস্তা চলে গেছে মাঝে মাঝে ফাটল ধরা, বুঝাই যাচ্ছে অনেক বছর ধরে এসবের কোন মেরামতই করা হয় না। রাস্তার দুপাশে ঝোপঝাড়ে ভরে আছে। প্রধান গেটের সামনে দুপাশে দুটো লাইট জ্বালানো তাও আবার টিম টিম করে জ্বলছে।
এরিমধ্যে কাদের মিয়া রাতের খাবার এনে টেবিলের উপর ঢেকে রাখে,
— আকাশটা ঘুইট ঘুইট্টা আইন্ধার হইয়া গেসে, মনে হয় জোরেশোরে একটা বৃষ্টি আইবো, আপনারা তাড়াতাড়ি খাইয়া শুইয়া পড়েন। বলে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পরই টিমটিমে আলোয় হাতে একটা হারিকেন নিয়ে আবারও আসে কাদের মিয়া,
— কারেন্টেরও ঠিকঠিকানা নাই চইলা যাইতে পারে। তাই হারিকেনটা দিয়া গেলাম।
ঘরের এক কোণায় রেখে চলে গেল নিজের ঘরে। মেহের চেয়ার ছেড়ে জানালার ধারে এসে দাড়ায় সত্যিই তো আকাশের অবস্থা তো ভালো না! বাইরে ভালোই বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটায় আশেপাশে তেমন স্পষ্ট বুঝা যায় না কিছুই শুধু কয়েকটা বাড়ির ভিতর থেকে হালকা হালকা আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে। ঘড়ির কাঁটায় তখন নয়’টা বাজে। গ্রামে নয়টা মানে অনেক রাত। আবার আষাঢ়ের রাত। ওরা খাওয়ার প্রস্তুতি নেয় এমন সময় হঠাৎই ঝড়হাওয়া আর বিদ্যুতের সাথে বিকট বজ্রপাতের শুরু হয়। তাড়াতাড়ি জানালাগুলো বন্ধ করে ওরা খেতে বসে। ঠিক তখনি কারেন্টাও চলে যায়। হারিকেনটা খুঁজতে যেয়ে দেখে সেই নুরী নামের মেয়েটা হারিকেন হাতে দাঁড়িয়ে। ঠিক তেমনি বড়ো ঘুমটাটা দেয়া। টেবিলের উপর হারিকেনটা রেখে ওদের খাবার বাড়তে থাকে।
এতো রাতে মেয়েটিকে দেখে আশিক একটু অবাক হয়ে বলল,
— তুমি এখনো যাও নাই?
— ‘না’… একটা শটকার্ট উত্তর।
— এতো ঝড়বৃষ্টির মধ্যে তোমার থাকার দরকার ছিল না।
হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে মেহেরও বলল,
— আমরা নিজেরাই বেড়ে খেতে পারবো, তুমি যেতে পার।
নুরী আবারো স্পষ্ট স্বরে উত্তর দিল,
— আপনাদের খাওয়া শেষ হইলে পরে যামু।
নুরী টেবিলের পাশেই দাড়িয়ে থাকে। হয়তোবা বাবা দারোয়ানের আদেশই মেয়েটা পালন করছে। এই ভেবে ওরা খেতে খেতে আবার আগের আলাপে মগ্ন হয়, কাল কিভাবে, কখন যাবে। আর সত্যিটা কী হতে পারে? নুরী ওদের কথাগুলো খুব মনোযোগ সহকারে শুনছিল এবং এক পর্যায়ে বলে উঠে,
— মাইয়াডা তো আত্মহত্যা করে নাই, ওরে খুন করা হইসে।
নুরীর কথা শুনে চমকে উঠল আশিক, দারোয়ান শুনেনি অথচ তাঁর মেয়ে কি করে শুনলো! বলল,
— তুমি কী করে জানলে, তুমি কি শুনেছ সেই ঘটনা?
মেহের ও রবি কিছুটা অবাক হয়ে নুরীর দিকে তাকায়।
— ‘হ’ আমি খুব ভালা কইরাই জানি আমার শ্বশুরবাড়ি যে ঐ গ্রামেই।
এবার ওরা আশ্বস্ত হলো, ভাবলো এমনটা হতেই পারে, যেহেতু মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ঘটনা, হয়তোবা বাবা জানে না আর মেয়েও জানায়নি। খাবারের পর তিন বন্ধু হাত ধুয়ে এসে ঘরে নুরীকে আর দেখতে পায় না। বাইরে এতো ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে তাই হয়তো ওদের জন্য অপেক্ষা না করে বাড়ি চলে গেছে। হারিকেনের আলোটা একটু কমিয়ে তিনজনই শুয়ে পড়ে কাল আবার ভোরবেলায় উঠতে হবে।
সকাল সকালেই ওরা তিন বন্ধু নবগ্রামে পৌঁছে যায়। প্রথমে থানায় তারপর পুলিশের সহযোগিতায় সবাই সেই বাড়িতে উপস্থিত হয়। তখনো বাড়িতে শোকের ছায়া। একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বামী বেচারা যেন একদমই ভেঙে পড়েছে। পুলিশের আগমন দেখে স্বাভাবিকভাবেই লোকের ভীড় জমতে শুরু করে। বাড়ির লোকেদের ভাষ্য ছিল মেয়েটি অর্থাৎ এ বাড়ির ছোট বৌয়ের উপর নাকি জীন আছর করেছিল আর সেই দুষ্ট জীনই পানিতে ডুবিয়ে মেরেছে। বেশ কয়েকদিন যাবৎ মেয়েটি নাকি অস্বাভাবিক আচরণ করতো কথায় কথায় রাগ হয়ে যেত, খাবারের পরিমাণও বেড়ে গিয়েছিল আর দিনে দুই তিনবার কখনো সন্ধ্যায়ও পুকুরে যেয়ে গোসল করে আসতো। পুকুরটা খুব একটা দূরে নয় বাড়ির ভিতরের পিছন দিকটায়। পুকুরের একপাশে বাঁশঝাড় আর ঝোপঝাড়ে ভরা। আশেপাশের প্রতিবেশী অনেকেই পরিবারের কথার সাথে একমত দিল, জীন মেরেছে কেউ কেউ বলছে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু আত্মহত্যা করবে কেন?
কারণ শাশুড়ির সাথে দুই বৌ এর প্রায়ই ঝগড়া হতো আর সেই জের ধরেই হয়তোবা মেয়েটি খুব বেশি অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। আরও পরিবার থেকে জানলো সেই রাতে স্বামী এবং স্বামীর বড়োভাই দুজনেই বাড়িতে ছিল না। প্রায়ই ব্যবসার কাজে একসাথেই দুজনকে শহরে যেতে হয়। আর বাড়িতে পুরুষ বলতে এই দুজনেই থাকে। বাকিরা তাদের মা আর দুই বৌ। দুই বৌয়ের মধ্যেও নাকি ছিল মধুর সম্পর্ক। কিন্তু ছোট বৌয়ের আজকের এই আকস্মিক মৃত্যু এবং সে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল। অবশেষে এখানে অনেক ঘাটাঘাটি করে তেমন কোনো সঠিক নমুনা খুঁজে পেল না তাঁরা। প্রথম মৃত্যুটা অর্থাৎ জীন দ্বারা পানিতে ডুবে মরাটা তিন বন্ধু এবং পুলিশবাহিনী একদমই মেনে নিতে পারলো না। রবির থিউরিতে ডাক্তারি মতে অন্তঃসত্ত্বার সময় মেয়েদের এমন অনেক কিছুরই পরিবর্তন দেখা যায় যা মেয়েটির বেলায়ও সেটাই হয়েছিল। যেহেতু গ্রামের এই লোকেরা অল্পশিক্ষিত তাই এ সম্বন্ধে কোন ধারণা নাই এবং জীন-ভূতে বিশ্বাসী সেই কুসংস্কার থেকেই মৃত্যুটাকে এভাবে দেখছে। সবশেষে সবার সিদ্ধান্তে আত্মহত্যাটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু পরক্ষণেই আশিকের মাথায় একটা প্রশ্ন খেলে যায়, কেউতো খুনের কথা একবারও বলেনি তবে কাল রাতে নুরী নামের ঐ মেয়েটি যার শ্বশুরবাড়ি এই গ্রামে বলে দাবী করলো সে কিভাবে জোর দিয়ে খুনের কথাটা বলল? তবে কি আরও গভীরভাবে তদন্তের প্রয়োজন আছে? না, না তাঁকে বের করতেই হবে এই মৃত্যুর আসল রহস্যটা! আশিকের মনে একবার এই সন্দেহের বীজটা ঢুকেছে তো আর ছাড়াছাড়ি নাই। তারপর পুলিশকে আগামীকাল ময়না তদন্তের জন্য লাশ তোলার ব্যবস্থা করতে বলা হয়। সবশেষে পুলিশ এবং তিন বন্ধু এই সিদ্ধান্তেই একমত হয়।
বাংলোতে ফিরতে ওদের প্রায় সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। এই মেঘবৃষ্টির মধ্যে সবারই উপর দিয়ে একটা বড়সড় ধকল গেলো আজ। বেশ ক্লান্ত সবাই তাই রাতের খাবার খেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। তখনো বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি। খাওয়ার সময় আজ নুরী আসেনি, এলে ওকে কিছু প্রশ্ন করার ছিল আশিকের। কাদের মিয়াকে মেয়ের কথা জিগ্যেস করলে জানালো আজ প্রচুর বৃষ্টি হওয়ায় মেয়ে রান্না সেরে তাড়াতাড়ি চলে গিয়েছে। গভীর রাত। ওরা তিনজনই গভীর ঘুমে অচেতন। একটা বিকট বজ্রপাতের শব্দে মেহের ও আশিকের ঘুম ভেঙে যায়। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি সাথে ঝড়হাওয়া। বাতাস আর বৃষ্টির ঝাপটায় জানালার পার্টগুলো বাড়ি খেতে থাকে। দুজনেই চটজলদি জানালটা বন্ধ করতে যায় এমন সময়ই বিদ্যুৎ চমকে উঠে আর সাথে সাথেই ওদের নজর গিয়ে পড়ে সামনের ঘন ঝোপঝাড়ের উপর… তাঁরা স্পষ্টই দেখে খুবই ছোট একটা শিশু মনে হচ্ছে মৃত, সারা গায়ে ছোপ ছোপ রক্ত গলায় লাল নতুন একটা গামছা জড়ানো। পাশে একটা নারীর অবয়ব করুণ সুরে কাঁদছে। ওরা সাতপাঁচ কিছু না ভেবেই দরজা খুলে দ্রুত হেঁটে যায়। কিছুদূর যেতেই কাদের মিয়া সামনে পড়ে যায় , ওদের উল্টো দিক থেকে আসছে। আচমকা কাদের মিয়াকে দেখে দুজনেই আঁতকে উঠে এবং ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। কাদের মিয়ার বয়স ষাট বছরের মতো হবে, বেশ মোটা উচ্চতাও বেশ কম, খাটো যাকে বলে। গায়ের রঙ কালো। কালো বলতে অনেকটাই কালো রাতের অন্ধকারে মিশে যায়। মুখভর্তি খোচাখোচা কাঁচা-পাকা দাঁড়ি। দাঁতগুলো ধবধবে সাদা। অন্ধকারে শুধু দাঁত আর চোখ দুটোই জ্বলজ্বল করে।হঠাৎ দেখলে যে কারোরই ভয় পাওয়ার কথা।
দুজনকে এভাবে তাড়াহুড়ো করে যেতে দেখে বলল,
— এতো রাইতে কই যান?
উৎকন্ঠা হয়ে ওরা বলল,
— চাচা একটা বাচ্চার লাশ…
— লা…শ, লাশ আইবো কইত্থেইকা, আমি তো এইমাত্র-ই চারিদিকে টহল দিয়া আইলাম, এমন তো কিসু দেখলাম না। আপনাগো চোখের ভুল নিশ্চয়!
কিন্তু ওরা কাদের মিয়াকে একরকম ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে সেখানে গিয়ে লাশের কোন আলামতই খু্ঁজে পেল না। তাহলে সত্যিই কি তাঁদের চোখের ভুল ছিল? কিন্তু দুজনেরই একই ভুল হয় কী করে? নানান প্রশ্নে ওদের বাকি রাতটা কেটে যায়।
পরেরদিন আবার মৃত বাড়িতে তদন্ত শুরু হয় অবশেষে পুকুরের ঝোপঝাড়ের মধ্যে একেবারে ভিতরে গুজে থাকা একটা লাল নতুন গামছা পাওয়া যায়। গামছাটা চোখে পড়তেই আশিক আর মেহেরের চোখ দুটো ছানাবড়া! কাল রাতে ঠিক যেন এই গামছাটাই ওরা দেখেছিল সেই মৃত শিশুটির গলায় পেঁচানো। তারপর তাঁদের রিপোর্ট বলে, কেউ বা কারা মেয়েটাকে এই গামছা দিয়েই গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে পুকুরে ফেলে দিয়ে এই জীন মেরেছে এই নাটকটা সাজিয়েছে। লাশটাকে উঠিয়ে ডোম ঘরে আনা হয়। ডোম ঘরের চারিদিকটা নীরব নিঝুম। বেশ ফাঁকা একটা জায়গায়। সামনে পিছনে অনেক গাছগাছালি নিচে শুকনো ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এমন শুনশান পরিবেশে দিনের বেলায়ও এখানে আসতে যে কারোরই ভয়ে গা হিম হয়ে আসবে। ওরা শুধু কয়েকজনই ডোম ঘরে যায়। হেঁটে যেতে যেতে পানিতে ভেজা শুকনো পাতার ছপছপ শব্দে মনে হচ্ছে ওদের পিছন পিছন কেউ একজন অনুসরণ করছে। ডোম ঘরে ঢুকতেই তিন বন্ধুর গা’টা ছমছম করে উঠে। নীরব নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎ হঠাৎই কিছু পাখির কর্কশ ডাকে ভয়টা যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়।
লাশের চারদিকে ওরা উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ডোম ধীরে ধীরে কাফনের কাপড়টা মুখ থেকে সরাচ্ছে আর ওরা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে। মুখটা খুলতেই তিনজনেরই মনে হলো লাশের চোখ দুটো খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে যেন একটা মুচকি হাসি দিল। তিন বন্ধুই একটা আতংকিত চিৎকার করে উঠে, নুরী… তারপর তাড়াতাড়ি ফাইলটা চেক করে মৃতের নামটা দেখে, ‘শাহানা বেগম ওরফে নুরী’। আশিক আর মেহের অমনি ঠাস করে মেঝেতে বসে পড়ে, দুজন দুজনের দিকে কৌতূহল দৃষ্টিতে তাকায়, এটা তাঁদের সাথে কী ঘটছে? তাহলে দারোয়ান অর্থাৎ কাদের মিয়ার মেয়েটা কে ছিল? অবশেষে নিজেদের সামলিয়ে নিয়ে ওরা তোড়জোড় করে ময়না তদন্ত শেষে রিপোর্ট করে। সেই রিপোর্টে বেরিয়ে আসে মেয়েটিকে সত্যিই গলায় গামছা পেঁচিয়েই হত্যা করা হয়েছে। এবং গামছায় হাতের ছাপ পরিক্ষা করে দেখা গেল আসলে নুরীর জা অর্থাৎ বড়ো বৌ এবং তাঁর আপন ভাই মিলে এই হত্যাকাণ্ড করেছে। কারণ বড়ো বৌয়ের দশ বছর সংসার জীবনে কোন সন্তান জন্মগ্রহণ করেনি। ছোট বৌয়ের গর্ভে সন্তান আসায় আবার পুত্র সন্তান হবে জেনে হিংসা ও সম্পত্তির লোভে সে এই কাজ করেছে।
সব কাজ শেষ করে রিপোর্ট নিয়ে ওরা তিন বন্ধু রওনা হয় বাংলোর দিকে। বেশ রাত হয়ে যায়। ওদিকে বৃষ্টি তো সমান তালে পড়ছেই। সকালে ঢাকার পথে রওনা দেওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তাদের বিদায় জানাতে দারোয়ানের মেয়েও এসে দাঁড়ায়, একটা সালাম ঠুকে। তিন বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করে,
— বাবার মতোই দেখতে কালো হয়েছে মেয়েটা…
গাড়িতে বসে আশিক আর মেহের নানান ভাবনায় ডুবে যায়। তবে কি রবির কথাই ঠিক, অশরীরী বলে কিছু আছে? সত্যিই কি আছে? আছে? এটা সত্যিই যার যার বিশ্বাস…
সুন্দরীদের বিড়ম্বনা
সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সবারই। সবাই সুন্দরের পূজারী। নিজেকে সবাই সুন্দর দেখতে চায়। তাই বলে সুন্দরীদের এতো বিড়ম্বনা? প্রায় সব সুন্দরীদের একই অভিযোগ, কোন পুরুষের সাথে মন খুলে হেসে একটু কথা বল্লেই ব্যাস্, হয়ে গেলাম তাঁর দৃষ্টিগোচর! পাশে তো আমার বান্ধবীটিও ছিল, দু’জনের আচরণও ছিল একই। কই তাঁকে তো তোমার দৃষ্টিতে আটকালো না? কিন্তু কেন? আমি সুন্দরী বলে? লিখে ফেললে ডায়েরির পাতাটা ভরে;
কাজল কাল ঐ ডাগর আঁখির হরিণী চাহনি,
গোলাপের মতো ঐ দু’টি ঠোঁটে বাঁকা চাঁদের হাসি,
দু’গালে পড়া টোল, আহা!
পাগল কারা এ মন
ওগো সুন্দরী, মনোহারিণী
আরো কতো কী!
এদিকে বাবা-মায়েরা আর ভরসা করতে পারছেনা তাঁর সুন্দরী মেয়েটিকে নিয়ে। কী জানি কী হয় বাবা! কখন কার পাল্লায় পড়ে যায়। না জানি কোন কেলেঙ্কারি করে বসে? বাবা-মায়ের মুখে চুনকালি না মাখে। আগেভাগে বিদায় করাই শ্রেয়। মেয়েদের সবচেয়ে নিরাপদ স্থানই হলো শ্বশুরবাড়ি।
এ্যাঁ… শ্বশুরবাড়ি সব থেকে নিরাপদ? নতুন বৌ শ্বশুরবাড়িতে পা রাখতেই জারি হয়ে গেল কড়া আদেশ-নির্দেশ। শ্বশুর-শাশুড়ির নির্দেশ; অন্দরমহল থেকে যখন তখন বাইরে যাওয়া একদম চলবে না। এমন কী বাপের বাড়িও না। এতো সাজগোজেরও কী এমন প্রয়োজন? বৌ এমনিতেই রূপবতী! এদিকে স্বামী মহাশয়েরও কড়া আদেশ; বন্ধুবান্ধব সব ছাড়তে হবে। বেগানা পুরুষের সাথে তো কথা বলাই যাবে না!
বৌ তা্ঁর মাশাল্লাহ্ সুন্দরী
কারো নজরে পড়লো বুঝি
চলাফেরায় যদি হয় ঊনিশ বিশ
মাথায় ঢোকে সন্দেহের বীজ।
সেইদিক থেকে ইলাকে সৌভাগ্যবতীই বলা যায়। কারণ দ্বিতীয়টি তাঁর ভাগ্যে জোটেনি, অর্থাৎ শ্বশুরবাড়িতে চার দেয়ালের মাঝে বন্দী হতে হয় নি তাঁকে। তাঁর স্বাধীনতায় যথেষ্ট মূল্য আছে এ পরিবারে। আর স্বামী নোমান? সেতো সোনায় সোহাগা!একেবারে বন্ধুর মতো আচরণ।
সবসময় ইলার পাশে থেকে তাঁর সুবিধে, অসুবিধেগুলো খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখে। ইলাও তাঁর মনের সমস্ত কথাগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে নোমানকে বলতে পারে। সুন্দরী মেয়েদের যে পদে পদে বিপর্যস্তে পড়তে হয় সেটা খুব ভালো করেই জানা নোমানের। নিজের ছোটবোন ছন্দার বেলায়ও এমন অনেক ঘটনার মোকাবেলা করেছে সে। আর ইলার বিয়ের পরও সমাজের এমন অনেক রুচিহীন অসভ্য লোকের কুদৃষ্টির কবল থেকে আজও তাঁর রেহাই নেই। মাঝে মাঝে এমন অনেক অপ্রত্যাশিত ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা, অকপটে নোমানকে বলে যায় ইলা। ইলার এই সরলতা সততা বিশ্বস্ততা নোমানের জীবনকে যেন আরও সুন্দর সাবলীল ও মধুময় করে তুলেছে তাঁর স্ত্রী ইলা। ইলার বেলায়ও তাই। একটি সুখী দম্পতি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যেটা সবথেকে বেশী প্রয়োজন একে অপরের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা তার পুরোটাই ছিল দু’জনের মাঝে একেবারে অষ্টেপৃষ্ঠে গাঁথা।
একদিন এক বিয়ের নিমন্ত্রণে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় ইলার কলেজ জীবনের বান্ধবী সুরমার সাথে। সুরমার স্বামী হাসিবকে দেখে তাঁদের বেশ হাসিখুশী আর প্রাণবন্ত মনে হলো। এই অল্প সময়ই ইলা আর নোমানের সাথে বেশ জমিয়ে ফেলেছে। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ি ফিরে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ইলা ফেবুটা অন করতেই চোখে পড়লো সুরমা আর হাসিবের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সাথে সাথেই এড করে নিল। এরপর থেকে মাঝেমধ্যেই হাসিবের টুকটাক কথার ম্যাসেজ আসতে থাকে। ইলাও তাঁর সরল মনে দু’এক কথায় উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু কয়েকদিন পর থেকে হাসিবের লেখার ধরণগুলো একটু একটু করে পাল্টাতে থাকে। ইলার টাইমলাইনে পোষ্ট করা ছবিগুলোতে কমেন্টস না করে ম্যাসেঞ্জারে ইলার রূপের বর্ণনা দিয়ে ছোট ছোট কবিতার ভাষায় কমেন্টস করতে শুরু করে,যা ইলার কাছে মোটেই শোভনীয় লাগছে না। অনেক কথাই এড়িয়ে সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে যায় ইলা। এরপর তাঁর সাথে কথা বলার জন্য ফোন নাম্বার চাইতে শুরু করে। সুরমার কাছে ইলার ফোন নাম্বার থাকা স্বত্বেও কেন হাসিব তাঁর কাছে চাইছে? ইলার আর বুঝতে বাকি রইলো না সুরমার স্বামীর চরিত্রে ঘাটতি আছে।
ইলা তারপর থেকে হাসিবের ম্যাসেজের আর কোন উত্তরই দেয় না। ইলার এই চুপ হয়ে যাওয়ায় হাসিব যেন আরো পাগলা কুকুরের মতো মরিয়া হয়ে উঠে! দিনরাত টুপটাপ শব্দে ইলাকে অস্থির করে ফেলছে । তাতেও ক্ষান্ত থাকেনি। এরপর শুরু করলো ম্যাসেঞ্জারে কল দেয়া। হাসিবের বিরক্তে ইলা একেবারে অতিষ্ঠ! কী করবে সে এখন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। একে তো বান্ধবীর স্বামী। নোমানের কাছে সুরমাকে ছোট করতে চাইছে না। অন্যদিকে সুরমা তাঁর এতো প্রিয় বান্ধবী। হাসিবের এই আচরণগুলোর কথা জানলে ওর সংসারে না জানি কী অশান্তি ঘটে? এই ভয়ে সুরমাকেও কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ভীষণ অস্থিরতায় দিন কাটছে ইলার।
বেশ কয়েকদিন ধরেই নোমানও খেয়াল করছে ইলা কেমন আনমনা হয়ে থাকে। নোমান ভাবে কিছুদিন আগে তাঁর হার্টে একটু প্রবলেম দেখা দিয়েছিল। এখনো ওষুধ চলছে, “হয়তো বা ইলা আমার অসুস্থতার কারণেই অমন মনখারাপ করে থাকে।“ এদিকে ইলা অসহ্য হয়ে হাসিবকে তাঁর ফ্রেন্ড লিস্ট থেকে ব্লক করে দেয়। কয়েকটাদিন কেটে যায়। সুরমাকে ইলার মাঝে মাঝে খুব মনে পড়ে আর মনে পড়ে সেই হারানো দিনগুলোর কথা। কোনো অন্যায় একদম সহ্য করতে পারতো না সুরমা খুব সাহসী ছিল। আর ইলা ছিল একটু নরম প্রকৃতির। তাঁর হয়ে অনেক কিছুরই মোকাবেলা করেছে সুরমা। খুব ভালোবাসতো সুরমা ইলাকে। তবে হাসিবের কার্যকলাপগুলোকে ইলা এখন আর তেমন কোনো গুরুত্ব দেয় না। মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে কারণ তাঁর জীবনে এমন বহু ঘটনাই সে পাড়ি দিয়ে এসেছে। কিন্তু তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছে বান্ধবী সুরমার জন্য। এমন চরিত্রের স্বামী নিয়ে সত্যিই কি ও সুখে আছে? নাকি সুখের অভিনয় করছে? সুরমাকে ঠকিয়ে না জানি হাসিব কতো মেয়ের সাথে এমন নোংরা সম্পর্ক গড়ছে। নাকি সে সুরমাকে সব খুলেই বলবে। ইলা যেন আর ভাবতে পারছে না।
এদিকে নোমানেরও অফিস থেকে ফেরার সময় হলো। ইলা কিছু নাস্তা বানানোর জন্য রান্নাঘরে ঢুকবে তখনই মোবাইলটা বেজে উঠে। রিসিভ করতেই দেখে সুরমার ফোন।
— ‘হ্যাঁ, সুরমা কেমন আছিস? অনেকদিন পর তোর কথাই ভাবছিলাম রে!’
একটু ভারী গলায়,
— ‘চাকরী করে আর সময় পাই না রে…, আমি তো আর তোর মতো অতো সুখী মানুষ না যে প্রচুর অবসর! আর অবসরে ফেবুকে বসে সবার সাথে আনন্দ করি চ্যাটিং করি!’
সুরমার কথাগুলো ইলার বুকে এসে একটা ধাক্কা লাগে,
— ‘কই আমিতো ফেবুকে কারোর সাথে চ্যাট করি না?’
— ‘ও শুধু হাসিবের সাথে করিস এইতো? তো মাঝেমধ্যে আমাকেও তো করলে পারতিস?’
ইলার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না,
— ‘তুই কী বলছিস এসব, আ…
— ‘থাক আর ভণিতা করিস না হাসিব আমায় সব বলেছে। রোজই তোদের চ্যাটিং হয়। একদিনের পরিচয়ে ভালোইতো ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলি তোরা? নোমান ভাই কী জানে সে কথা? নিশ্চয় না। জানলে অবশ্যই মেনে নিবে না যেমন আমি নেই নি।’ এক নাগার বলেই গেল সুরমা।
সুরমাকে একটু থামিয়ে, ‘প্লিজ আমার কথাটা একটু শোন্? আমাকে ভুল বুঝিস…
— ‘থাক আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাস না। আমার কথা আমি বলে দিয়েছি। কথাটা মাথায় রাখিস। আর নোমান ভাইকেও জানাবো সে কথা’ বলেই টুপ করে ফোনটা কেটে দেয় সুরমা।
সুরমার বরাবরই অমন কাটখোট্টারর মতো চটাং চটাং করে কথা বলার অভ্যাস এটা ইলার ভালো করেই জানা। তবে সুরমার আজকের ব্যবহারটা তাঁকে অসম্ভব কষ্ট দিয়েছে। ‘যার জন্য করি চুরি সে বলে চোর। আমাকে তো ও ভালো করেই জানে আমি কেমন স্বভাবের’।
সুরমার এই আচরণগুলো ইলা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। এই গুমটটা কি করে ভাঙবে সে। এই ভুলের অবসানটা নিয়ে ভাবতে থাকে ইলা। নোমান অফিস থেকে ফিরে এলে প্রতিদিনের মতো ইলা উৎফুল্ল না হয়ে চা-নাস্তা সব টেবিলের উপর রেখে ছোট ছোট পা ফেলে বারান্দার গ্রিলে মাথাটা ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ভিতরটা কেমন ছটফট করছে। ভাবছে সুরমার সাথে তাঁর দেখা না হলেই বরং ভালো হতো? নোমানও লক্ষ্য করলো ইলার এই অস্থির অস্থির ভাবটা । নিশ্চয়ই ইলার বড়ো একটা কিছু সমস্যা হয়েছে। ওর ঐ বিষণ্ণ মুখখানাই বলে দিচ্ছে। ইলার কী এমন হয়েছে যে আমাকেও বলতে পারছে না?
তোয়ালে মুখ মুছতে মুছতে ইলার পাশে এসে দাঁড়ায় নোমান,
— ইলা তোমাকে আমার চেয়ে বেশী বোধহয় আর কেউ ভালো করে জানে না! আমি নিশ্চিত, কেউ তোমাকে কোনো বিষয় নিয়ে আঘাত করেছে শুনলে কষ্ট পাবো বলে আমায় বলছ না? প্লিজ বল, আমিও খুব কষ্ট পাচ্ছি কয়দিন ধরে তোমার এই মলিন মুখটা দেখে!
ইলা যেন নিজেকে আর সংবরণ করতে পারছিল না। যে মিথ্যা সন্দেহের মধ্যে সে আটকে গেছে তা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না । তাঁকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। ইলা এটাও খুব ভালো করেই জানে সে নোমানের কতোটা বিশ্বাসী স্ত্রী! পৃথিবী উল্টে গেলেও নোমান কোনদিনই বিশ্বাস বা সন্দেহ করবে না ইলার চরিত্র নিয়ে। বরং সুরমা তাঁকে এই ভুল বুঝার জন্য নোমানই কষ্ট পাবে বেশি, এটা একশত ভাগ সত্য। কোনো সন্দেহ নেই তাতে।
— ‘আমি তোমাকে অনেকবার বলতে চেয়েছি কিন্তু বিশ্বাস করো, শুনে যদি তোমার শরীর খারাপ হয় সেই ভয়েই বলতে চাই নি।’
নোমান অভয় দেয়, ‘চিন্তা করোনা আমি সহ্য করতে পারবো।তবু তোমার এই মলিন চেহারাটা আর সহ্য করতে পারছি না প্লিজ!’
তারপর ইলার মুখে সবকিছু শুনে নোমান হো হো করে হেসে উঠে,
— ‘ওহ্, এই কথা? আমি ভেবেছি বিরাট কিছু হয়েছে তোমার। তাহলে এটাই ছিল একমাত্র তোমার চিন্তার কারণ?
— তোমার বান্ধবীর স্বামীকে প্রথম থেকেই আমার সুবিধের মনে হয়নি। তোমার মন খারাপ হতে পারে তাই কিছু বলিনি। এখন দেখছি আমার ভাবনাটাই মিলে গেল । দাও দাও সুরমার ফোন নাম্বারটা দাওতো আমায়। সুরমার সাথে কথা বলবো’।
কিন্তু ইলা একটু ইতস্তত করতে থাকে,
— ‘থাক্ না নোমান? আর ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই! সুরমা খুব জেদি মেয়ে। হয়তোবা সংসারে আগুন জ্বালিয়ে দিবে। আমার সাথে তো সম্পর্ক ভেঙেছেই। ওদের মধ্যেও সম্পর্কের ঘুণ ধরতে পারে। আমি চাই না এই তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে সুরমার সংসারের কোনো ক্ষতি হোক’।
নোমান ইলাকে বোঝায়,
— ‘তোমার সাথে সম্পর্ক ভাঙুক! কিন্তু হাসিবের প্রকৃত রূপটা সুরমাকে জানানো একান্ত প্রয়োজন। ভালো করে দেখুক ওর মুখোশধারী স্বামীকে। দোষীকে অবশ্যই এভাবে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া উচিত। দেখিয়ে দিতে হয়। অন্যকে সন্দেহ করার আগে নিজেকে আগে প্রশ্ন করা উচিৎ দোষী কে?’।
ইলা চুপ করে থাকে। নোমান ইলার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। ইলার ফেবু ম্যাসেঞ্জারটা খুলে। হাসিবের পাঠানো ম্যাসেজগুলো সব পড়ে । তারপর একে একে সবগুলো ফরওয়ার্ড করে দেয় সুরমার ম্যাসেঞ্জারে। আর নীচে লিখে দেয়; আগে নিজের ঘরের দুর্গন্ধ দূর করো তারপর অন্যের ঘরে টোকা দাও।
বাবার বিচার
— কুহি, ও কুহি, তুই কই গেলিরে মা..?
কুসুম সারা বাড়িময় খুঁজে বেড়াতে থাকে তাঁর বার বছরের মেয়ে কোহিনূরকে। অবশেষে বাড়ির পিছনের আমগাছের তলায় বসে, হাঁটুর উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মেয়েকে । কুসুম এক দৌড়ে যেয়ে একটু অবাক স্বরে বলল,
— কি রে মা… কি অইসে তোর ? কান্দস ক্যান?
তারপর মেয়ের মুখের উপর পড়েথাকা বালির মতো খসখসে খটা চুলগুলো সরিয়ে, মুখটা তুলে দু’গালে চুমু খায় ।মায়ের সাথে চোখাচোখি হতেই আরো জোরে জোরে কেঁদে উঠে কোহিনূর,
— পেত্যেকদিন বাবা তোরে এতো মারে ক্যান মা..? হেইদিন নানাবাই আইসিলো আমারে দেকতে…. কথাটা কেড়ে নিয়ে কুসুম বলল,
— হ’রে, মা… একটা ডিম ভাইজা তোর নানারে ভাত দিসিলাম বইলা,আমারে কি মারনডাই না মারলো তোর বাবায়! কতো কৈফিয়ত চাইলো, তুই টেকা পাইছস কই? আমার টেকা চুরি কইরা তোর ফইন্নি বাপেরে গিলাস।
মায়ের কথা শুনে একটু ক্ষুদ্ধ হয়ে কোহিনূর বলে উঠে,
— আমার মুরগী ডিম পাড়সিলো, হেই ডিমই তো নানাভাইরে খাইতে দিসিলাম । কতো কইরা কইলাম তবুও বাবা ক্যান হুনলোনা, মা?
মেয়ের কথা শুনে কুসুমের চোখ দু’টো ছলছল করে উঠে, মেয়েকে জড়িয়ে ধরে –
— তুই কান্দিস না, আল্লায় হেই বিচার করবো রে মা… আল্লায় সব দেখতাসে।
— খালি রোজই কস্ আল্লায় বিচার করবো, কই করে? কাইল রাইতেও রান্দনের একটু দেরী হইসিলো, হেইলিগ্গা বাবা তোর চুলের মুডি ধইরা সারা উডান গুরাইয়া মারসে, কতোগুলান চুল টাইন্না ছিরল। আমারেও লাত্থি দিয়া ফিক্কা মাইরা ফালাইয়া দিলো।
কুসুম শাড়ীর আঁচলে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠে। কোহিনুর মায়ের মুখের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়,
— দাদী ফুফু হগ্গলে আমগো চিক্কর পাইরা কান্দন দেখলো, কে–উ তো বাবারে ইকটু ঠেকাইলো না মা?
ক্রন্দনরত গলায় কুসুম,
— মানুষ কি আর মানুষ আসেরে মা.., হগ্গলে মজা লুটে, তামশা দেখবার আহে, সিনামা দেখবার আহে।
তারপর আঁচল দিয়ে নিজের, মেয়ের চোখের জল মুছতে থাকে । আবারও বলে উঠে ,
— যার কেউ নাই তাঁর আসে আল্লায়, হে ঠিকই একদিন সবার বিচার করবো দেহিস মা!
কোহিনূর মায়ের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে। টপটপ করে গাল বেয়ে চোখের জল ঝরতে থাকে,
— মাগো, আমারে ইশকুলে ভর্তি করাইয়া দিবি? সবাই কি সুন্দর ইশকুলে যায়! আমিও পড়ালেখা করুম।
কুসুম মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে থাকে । মায়ের উষ্ণ অশ্রুর ফোঁটা কহিনুরের পিঠে পড়ে, ওমনি উঠে বসে কহিনূর। ছোট্ট তুলতুলে আঙুলগুলো দিয়ে মা’য়ের চোখ দু’টো মুছতে থাকে। কুসুম মেয়ের হাতে চুমু খায়,
— থাক্ মা ,দুঃখ করিস না। তুই আরেকটু বড়ো হইলে হেরপর দুইজনে শহরে যামু, তোর ঐ ফুলি বুবুর মতো গাম্মেনসে (গার্মেন্টস) কাম নিমু, মেলা টেকা পামু, তহন আর দুক্কু থাকবো না আমগো। আমি তোরে ইশকুলে ভর্তি করাইয়া দিমু গো মা…।
মায়ের কথায় কোহিনূরের বুকের ভিতর একটা শীতল হাওয়া স্পর্শ করে যায়, আনন্দে দু’চোখে একটা আবছ রঙিন স্বপ্ন ভেসে উঠে। তুহিন , সাথী, লিলি ওদের মতো বগলের নিচে বই-খাতা নিয়ে সেও একদিন স্কুলে যাবে; ক্লাসরুমে বসে জোরে জোরে সুর মিলিয়ে সবার সাথে অ আ ক খ পড়বে । ছড়া কেটে কেটে পড়বে । কহিনূর প্রায়ই স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের পড়াগুলো শুনতো আর তাঁর বুকের ভিতর ভীষণ একটা কষ্ট অনুভূত হতো স্কুলে না পড়ার কারণে। আজ মা’য়ের মুখে সেই আশার বাণী শুনে একটা অজানা খুশীতে মাকে জড়িয়ে ধরে,
— সত্যই মা, আমারে ইশকুলে পড়াইবি?
কুসুম স্নেহভরা মুখে হেসে বলে – সত্য, সত্য , সত্য । তিন সত্য । তারপর মা-মেয়ে দু’জনেই খিলখিল করে হেসে উঠে।
ভোর থেকেই কর্কশ স্বরে কাকগুলো কা, কা করে ডেকেই চলেছে এডালে ওডালে। বুকের ভিতর অজানা আতঙ্ক ভর করে বসে কুসুমের। ইটের টুকরো ছুঁড়ে তাড়াবার চেষ্টা করে,
— মরার কাওয়া, বিয়ান থিকা কি শুরু করলো, না জানি কার কি সর্বনাশ অইলো! বলে পিছনদিকে মুখ ঘুরাতেই চোখে পড়ে ছোটভাই বাদলকে। বিবর্ণ মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে।
আচমকা বাদলকে দেখে কিছু বলার আগেই বাদল চিৎকার করে কেঁদে উঠে,
— বুবু…রে, বাজান আর নাই..! তোরে লইতে আইসি রে বুবু.। শুনে কুসুমও আর্ত চিৎকার করে উঠে।
ভাইবোনের কান্নার আওয়াজে কোহিনূর দৌড়ে আসে। কোহিনূরকে বাদল বুকে টেনে নেয় ,
— তোর নানাবাই আমগো ছাইড়া চইলা গেসে, মইরা গেসে রে কুহি..। আর কোনদিনও আইবো না।
মৃত্যুর রহস্যটা কহিনূরের তখন অজানা । তার কচিমনে যেন একটা ধাক্কা খায় । তীব্র আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,
— মইরা গেলে মানুষ কই চইলা যায় মামু?
— আল্লাহর কাসে যায় রে কুহি।
ওদের কান্না দেখে কোহিনূরও কাঁদতে থাকে।
পাশের গ্রামেই কুসুমের বাবার বাড়ি। স্বামী সিরাজ কাজ শেষে ফিরে আসে সেই সন্ধ্যা নাগাদ। তাই অপেক্ষা না করে কোহিনূরকে নিয়ে ভাইয়ের সাথেই চলে যায় কুসম। বাবার চিরবিদায়ের শেষ মুখখানা একবার দর্শন করার আশায়। বাবার কবরে মাটি দিয়ে, শেষ বিদায়ের পর কুসুম নিজ বাড়ীতে যখন ফিরে আসে, তখন সন্ধ্যা পার হয়ে চারিদিক অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বাবার মৃত্যু শোকের কান্নাটি তখনো কুসুমের বুকের ভিতর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছিল। উঠোনে পা ফেলতেই রক্তচক্ষু নিয়ে সিরাজ তেড়ে আসে, লাথি মেরে কুসুমকে মাটিত ফেলে দেয়, তাল সামলাতে না পেরে কোহিনুরও ছিটকে পড়ে অপরদিকে। কুসুমকে আবারো চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে তুলে সিরাজ। তারপর কিল, চড়, ঘুষি দিয়ে ইচ্ছেমত মারতে থাকে।
— মাগি! তোর এত্তবড় সাহস আমারে না কইয়া বাড়ীত্থন বাইর হইসস? আবার ফিরা আইলি ক্যান , এতো সখ যহন বাপরে দেহনের, ফইন্নি বাবার লগে মরতে পারলি না? বাইর হ আমার বাড়ীত্থন!
রাতে ঘরের দরজা বন্ধ করে একাই শুয়ে পড়ে সিরাজ। সারারাত বারান্দায় ছোট্ট চৌকিতে মা, মেয়ে দুজনে কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে। ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে মেয়েকে পাশে না দেখে অনেক খুঁজাখুঁজির পর, বাড়ীর বাইরে বের হয় কুসুম। কিছুদূর যেতেই কোহিনূরের খেলার সাথী জরিনাকে চোখে পড়ে।
— আমার কুহিরে দেখছস জরি?
— ‘হ’, ঐ নদীর দিক্ দৌঁড়াইয়া যাইতে দেখছি! জিগাইলে কুহি কইলো, বাবার বিচার চাইতে যাইতাছি..।
কুসুম বিলম্ব না করে দ্রুত নদীর তীরে যেতেই, অনেক লোকের ভীড় চোখে পড়লো। প্রাণপণে ভীড় ঠেলে কাছে গিয়ে দেখে, তাঁর প্রাণের কুহি। নিথর, অসার ছোট্ট দেহটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। পানিতে ডুবে আরো সাদা ধবধবে একেবারে ফুলে টইটুম্বুর হয়ে গেছে। অমনই মেয়ের উপর আছড়ে পড়ে কুসুম।
— কুহিরে..তুইও আমারে ছাইড়া চইলা গেলি, আমার বুক খালি কইরা! আল্লাহর কাছে বাপের বিচার চাইতে গেছস? মানিক আমার, এইডা তুই কি করলি, ক্যান করলি?
আমি অহন কারে নিয়া থাকুমরে কুহি…
কুসুমের বাঁধভাঙ্গা আর্তনাদে বাতাস ক্রমশ ভাড়ী হয়ে উঠেতে থাকে।
কিন্তু তখনো চারিদিকের সব লোকজন নীরব দর্শকের মতো দাঁড়িয়ে ।
সন্তান হারানোর এক অভাগী মায়ের সেই কষ্টের বিলাপের দৃশ্য উপভোগ করতে থাকে।
কোন ভুলেই যেন কোন ফুলের জন্ম না হয়
বাবা মায়ের অত্যন্ত আদরে বেড়ে উঠা মেয়ে, টুম্পা। তাঁর ইচ্ছা অনিচ্ছা সাধ আহ্লাদ পূরণে বাবা-মা কখনোই এতোটুকু কার্পণ্য করেনি । অবশ্য সব পিতামাতারাই চায় নিজ সন্তানদের চাওয়া পাওয়া তাঁদের সাধ্যমতো পূরণ করতে। আর এতেই পিতামাতার আত্মতৃপ্তি \। কিন্তু সন্তানের এই চাওয়া পাওয়ার ব্যবধানটা যদি অসামঞ্জস্য হয় তাহলে কখনো কখনো কাউকে সঠিক পথটি হারিয়ে অতল গহ্বর তলিয়ে যেতে হয়। টুম্পাকে তাঁর জীবন চলাচলে পিতামাতার দিক থেকে কোনদিনই কোন বাঁধার সম্মুখীন হতে হয় নি। ধনীর আদুরে দুলালী মেয়ে টুম্পা। ইচ্ছামত বাবার টাকা উড়িয়েছে। ক্লাস শেষে দেরী করে বাড়ি ফিরেছে। এজন্য বাবা,মায়ের কাছে কোনোদিনও তাঁর কোন কৈফিয়ত বা কারণ দর্শাতে হয়নি। কখনো বা বন্ধুবান্ধবদের জন্মদিন, বিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সারারাত কাটিয়ে এসেছে, শুধু তাই নয়; মাঝে মাঝে পিকনিক এর নাম করে কক্সবাজার, বান্দরবন বেড়িয়ে এসেছে হৈ হুল্লোড় করে। সেখানেও নীরব থেকেছে বাবা-মা, মেয়ে যা বুঝিয়েছে, বিশ্বাস করে সেটাকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়েছে। মেয়ের এই উশৃঙ্খল চলাচল নিয়ে অনেকেই বাবা-মাকে টুম্পার প্রতি নজর দিতে বলেছে। কেউ আবার যুগের পরিস্থিতি, পরিবেশ নিয়েও কিছু উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু মেয়ের প্রতি এতো অন্ধ বিশ্বাসের কারণে টুম্পার বাবা-মা কারোর কথাই গ্রাহ্য করেনি। বরং উল্টিয়ে সবার মুখের উপর জোর দিয়েই বলেছে তাঁদের একমাত্র মেয়ে কখনো এমন কাজ করতে পারেনা যা বাবা-মাকে লজ্জায় পড়তে হবে। কি আর করা ! সন্তানের ভালো-মন্দের ব্যপারে বাবা-মা’ই যদি উপেক্ষা করে চলে তবে তাঁদের আর কিছু বলার নাই। ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেছে সবাই।
বেশ কয়েকদিন ধরেই টুম্পার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে । খাওয়াদাওয়ার প্রতি খুব অনীহা। বাবা-মা দু’জনেই অস্থির। মেয়ের পছন্দের সব খাবার সামনে এনে হাজির। কিন্তু মেয়ের কোন রুচি নেই খাবারের প্রতি। একদিন টুম্পা কলেজ থেকে ফিরে ঘরে ঢুকতেই হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে, ধরাম করে মাটিতে পড়ে যায়। ব্যতিব্যস্ত হয়ে বাবা তৎক্ষণাৎ ডাক্তার ডাকলেন। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার স্পষ্টভাবে জবাব দিলেন– আপনার মেয়ে তো অন্তঃসত্ত্বা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো বাবা-মা’য়ের, ‘এ কী শুনছে তাঁরা!’’ অন্ধের মতো বিশ্বাস করে এত আদর, মমতা, ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করে তুলল যে মেয়েকে, সে কি না এতো বড় একটা ঘৃণিত কাজ করতে পারলো? আমরাতো কখনো ওর কোন অভাব বা কোন আবদারই অপূরণ রাখিনি? একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে তখন ডাক্তার বললেন, “আপনারা শুধু ওর অভাব আর আবদারই পূরণ করেছেন কিন্তু মেয়ে সেটি কোনখাতে ব্যয় করছে, কার সাথে মিশছে তার তদারকি কি কখনো করেছেন? আধুনিকতার নামে, অপসংস্কৃতির ছোঁয়ায় কতো যে এমন, লাল, নীল রঙিন প্রজাপতিগুলো পথহারা পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে; শুধুমাত্র সঠিক শিক্ষা ও সঠিক গন্তব্যস্থলটি না জানার কারণে। সেদিন যদি, লাগাম ধরে ভুল আর ঠিক পথের নিশানাটি আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেন, তাহলে হয়তো আজ আপনার মেয়ে এই পরিস্থিতির শিকার হতো না।” তারপর খানিকক্ষণ নীরব থেকে, ডাক্তার সাহেব দুঃখের সাথে আবারো বললেন, “অভিভাবকদের এমন অসচেতনতার কারণে, হরহামেশাই আমাদের ডাক্তারদের দেখতে হচ্ছে এই নির্মম লজ্জাকর ঘটনাগুলো”
অবশেষে টুম্পাকে একটি নামীদামী ক্লিনিকে নেওয়া হলো। কিন্তু কোন ডাক্তার এতো বড় রিক্স নিতে রাজি হলেন না। কারণ টুম্পা তখন পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এরপর আরও কয়েকটা ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েও ব্যর্থ হলো। সব ডাক্তারদের ঐ একই কথা একেতো কিশোরী বয়স, তার উপর মেয়ের শরীরের যে কন্ডিশন, কিছুতেই সম্ভব না বাচ্চা নষ্ট করার। এতে রোগীর জীবনাবসানও ঘটতে পারে। তাঁর এই সর্বনাশের পিছনে কে দায়ী? মেয়ের কাছে জানতে চাইলে আরও আশ্চর্যের কথা, টুম্পা নির্দিষ্ট কারোর নাম বলতে পারলো না। এই অবস্থায় ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করতে হলো টুম্পাকে। হুটহাট করে প্রায়ই টুম্পা বাবা-মায়ের সাথে বিদেশে ঘুরতে যেত । তাই সহপাঠীরা কেউ যোগাযোগ করতে চাইলে তাঁদের জানানো হয়, কয়েকদিনের জন্য টুম্পা দেশের বাইরে বেড়াতে গেছে। কয়েক মাস পর নির্দিষ্ট সময়ে এক প্রকার চোরের মতো লুকিয়ে, রাতের অন্ধকারে টুম্পাকে নিয়ে যাওয়া হলো কোন একটা ক্লিনিকে।
পরেরদিন কাকডাকা ভোরে মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কিছুদূর এগুতেই কয়েকজন লোকের ভীড়। টুম্পার মা গাড়ির গ্লাসটা নামিয়ে মাথাটা বের করতেই, একটা ফিসফিস আওয়াজ কানে এলো “জারজ, জারজ বাচ্চা”। সামনে আরও একটু ভালো করে তাকাতেই নজরে আসে , ডাস্টবিনে পড়ে থাকা সদ্য ভূমিষ্ঠ একটা ফুটফুটে শিশু । চারিদিক বাতাস ভারী করে হাত পা ছুঁড়ে কেঁদেই চলেছে নবজাতক শিশুটি। তড়িঘড়ি করে গ্লাসটা উপরে উঠিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে বলল টুম্পার মা। কিন্তু যত দূরেই যাক্, টুম্পার মায়ের কানে সেই শিশুর কান্নার আওয়াজ স্পষ্ট থেকে আরও স্পষ্ট হয়ে বাজতে থাকে। শিশুটির কান্নার ভাষা যেন চিৎকার করে বলে দিচ্ছে, “আমি মানুষ আমি পবিত্র। দোষী যদি হও সে তুমি, তোমরা। আমার কোন কালিমা নেই এ পৃথিবী সাক্ষী। তবে কেন হবে আমার পরিচয় জারজ সন্তান? জন্মের পর আমার স্থান এই নোংরা ডাস্টবিনে নয়। আমার স্থান স্নেহময়ী মায়ের কোল। আমিও তোমাদের মতো আদর, যত্নে মায়ের ভালোবাসা চাই। মানুষ নামে বাঁচতে চাই। বাঁচার অধিকার চাই!” লোকলজ্জার ভয়ে নিজেদের কুকীর্তি ঢেকে সমাজের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই টুম্পার মায়েরা অপরাধগুলো অন্ধকারের মতো, হয়তো আড়াল করতে পেরেছে ঠিকই । কিন্তু দিনের আলোর মতো পরিষ্কার,যে ভুলের মাশুল লেপ্টে আছে মেয়ের অস্থি, মজ্জায়, সারা দেহে। তাকে অস্বীকার করবে কোন দৃষ্টি দিয়ে? এ পৃথিবী আর কতকাল… এভাবে নীরব সাক্ষী হয়ে বহন করে চলবে কে জানে?
১০ টাকার আংটি
কয়েকদিনের ছুটিতে বেড়াতে গিয়েছিলাম কলকাতায়।
এক আত্মীয়ার বাসায়, সম্পর্কে আমার দেবর হয়। ওর ফুটফুটে একটি বাচ্চা মেয়ে নাম রিয়া, বয়স আট কী নয় বছরের হবে। এর আগে ওকে আমি দুই, আড়াই বছর বয়সের দেখে এসেছিলাম।
ধবধবে সাদ ফর্সা, গোলগাল গড়নের। তুলতুলে শরীরটা তাই আমি রিয়ার নাম দিয়েছিলাম তুলতুল।
আমাদের দেখে, প্রথম প্রথম ও খুব লজ্জা পাচ্ছিল । অন্য রুম থেকে পর্দাটা একটু ফাঁক করে করে দেখে নিতো। আমি কাছে ডেকে এনে, একটু আধটু কথা বলে, চকলেট দিয়ে দিয়ে ওর লজ্জাটা ভাঙালাম।
তারপর থেকেই লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে আমার সাথে গল্প করা ছিল ওর খুব আনন্দের! আমি বাচ্চাদের সাথে থাকলে, নিজেও যেন বাচ্চা হয়ে যাই। এখনকার বাচ্চারা পাঠ্য বই আর কোচিং নিয়েই ব্যস্ত সারাদিন।
রূপকথার তেমন কোন গল্পের বইয়ের নামই জানে না ওরা। রিয়ার মা দীপার কথা হলো, গল্পের বই পড়লে লেখাপড়ার ক্ষতি ভীষণ! মনে আছে ছেলেবেলায় রূপকথার গল্প ঠাকুমার ঝুলি, আরব্যোপন্যাস, নীলপদ্ম, সাতভাই চম্পা বিভিন্ন রকমের গল্পের বই কতো যে পড়েছি! কই লেখাপড়ার ক্ষতি তো বুঝিনি।
অথচ ক্লাসে ভালো ছাত্রী হিসাবেও পরিচিতির কমতি ছিলনা। মনে পড়ে ছোটবেলায় টিফিন পিরিয়ডে আমরা বান্ধবীরা একে অন্যকে রূপকথার গল্প শুনাতাম। রিয়াকে সেই পান্তাবুড়ী, শুয়োরাণী-দুয়োরাণী, ডালিম কুমার, সোনারকাঠি-রূপোরকাঠি এমন অনেক রূপকথার গল্পগুলো বলতাম।
ও এতো আগ্রহ আর মনোযোগ দিয়ে শুনতো, মনে হতো রিয়া যেন এক কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যেতো। দুঃখের কাহিনীগুলো শুনে চোখ দু’টো ছলছল করে উঠেছে, টপ্ টপ্ করে গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়েছে । আমি হাসতে হাসতে জড়িয়ে ধরে, তুলতুল গালে চুমু খেয়ে বলেছি, এগুলতো রূপকথার গল্প মামণি ।
আমার বুকেই মাথা গুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকতো। বলতাম, থাক্ তাহলে আর গল্প বলে কাজ নেই। ফোলা ফোলা ছোট্ট আঙুলগুলো দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলতো না, চাচী-আম্মি আর কাঁদবো না দেখো, তুমি বলো প্লিজ!
আবারো শুরু করতাম, ভাবতাম সত্যিই এই বা্চ্চাদের শিশু বয়স থেকেই যদি এমন সুখ,দুখের অনুভূতিগুলো ওদের ভিতর জাগ্রত করা যায়, তবে অবশ্যই এই শিশুটি একজন ভাল মানুষ হয়ে গড়ে উঠবেই, এটা আমার সবসময়ই মনে হতো। দীপাকেও বলেছি, বাচ্চাদের রূপকথার গল্প শুনাবে, ওরা কল্পনা করতে শিখবে, দেখবে। জীবনের আরেকটা নামও কল্পনা করা আর স্বপ দেখা।
প্রতিটি মানুষের অন্তরে একটি কল্পনার রাজ্য আছেই। রূপকথার গল্পগুলো থেকেই শুরু হয় সেই স্বপ্নগুলো সাজাবার। যতোই স্বপ্ন দেখবে ততোই কল্পনাশক্তি বাড়বে। সুন্দর স্বপ্ন দেখে আশায় থাকা, এটাও জীবনের একটি অঙ্গ। সময় কারোর জন্য থেমে থাকে না। আমাদেরও বিদায় নেওয়ার দিন ঘনিয়ে এলো। রিয়ার মনটাও খুব খারাপ। এ কয়দিনে আমার সাথে ওর খুব ভাব জমে গিয়েছিল। আমরা চলে যাব ও আর গল্প শুনতে পারবেনা।
এটাও ছিল রিয়ার মন খারাপের আরেকটি দিক । ওর ছোট্ট মায়া ভরা বিষন্ন মুখখানা আমাকেও খুব পীড়া দিচ্ছিল! আমার গা ঘেঁষে বসে থাকা ওর তুলতুলে শরীরটা যেন মায়ায় জড়িয়ে লেপ্টে আছে আমার সারা শরীর জুড়ে। এটাই বুঝি ভালোবাসায় মায়ার বন্ধন!
আমাদের সব গোছগাছ করা শেষ। কাল ভোরেই রওয়ানা দিব। রিয়া স্কুল থেকে এসে ড্রেস না খুলেই আমার হাতে একটা চকচকে আংটি দিয়ে, নিজের হাতের আংটিটা দেখিয়ে বলল
— চাচী-আম্মি তুমি আমার এই আংটিটা খুব পছন্দ করেছিলে না?
সেজন্য আমি, তোমার জন্য ও একটা এনেছি। আমাদের স্কুলের সামনের দোকানেই পাওয়া যায়। তোমাকে এটা আমি উপহার দিলাম।
আমি তো অবাক! ওর সুন্দর ছোট্ট আঙুলে, লাল চকচকে পাথরের আংটিটা দেখে একবার বলেছিলাম,
— তোমার এ আংটিটা তো ভারি সুন্দর !
ব্যাস, ওটাই সে মনে রেখেছে। আমি ওকে কি বলবো, সত্যি বুঝতে পারছিলাম না। অতটুকুন একটা বাচ্চা মেয়ের ভালোবাসার প্রতিদান কি দিব? তবুও বললাম —
— কেন আমার জন্য খরচ করে এটা কিনতে গেলে সোনা?
থতমত খেয়ে, একটু লজ্জা,লজ্জা মুখে ঠোঁটটা বাঁকিয়ে বলল — বেশি দাম না চাচী, মাত্র ১০ টাকা।
— সত্যি, মাত্র ১০ টাকা?
সাথে সাথেই রিয়ার মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেল,
– — খুব সস্তা, কম দাম তাই তোমার পছন্দ হয়নি বুঝি?
আমি ওকে বুকে চেপে, আদর করে বললাম,
— এত সুন্দর আংটি! আমার পছন্দ হবেনা, খু-উ-ব পছন্দ হয়েছে মা… ।তখনই আঙুলে পড়ে নিলাম।
কম দামী তাঁর এই উপহারটি এতো খুশি হয়ে গ্রহণ করায়, রিয়ার চোখে মুখে কি-যে আনন্দের তৃপ্তি ও প্রশান্তির ছোঁয়া আমি দেখেছি ; তা এ দুনিয়ার কোনকিছুর বিনিময়েও পূরণ করতে পারবোনা!
আমার কাছে এখনো অমূল্যই হয়ে রইলো, এই ১০ টাকার আংটিটা। ছোট্ট এই বাচ্চা মেয়েটির ভালোবাসায় মাখা এ উপহারটি হলো, আমার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ উপহার! ভালোবাসার কাছে টাকা…সত্যি অনেক অনেক বেশী মূল্যহীন। আর তাইতো “ভালোবাসাই” হলো অমূল্য ধন।
বৃষ্টিজল
মেঘলা দুপুর। শ্রাবণের আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘগুলো জমতে থাকে। চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে, সাথে দমকা হাওয়া বইছে। বুঝি প্রচণ্ড একটা ঝড়োবৃষ্টি হবে!
ভীষণ ভাল লাগে পূর্ণিমার এই বর্ষা ঋতুটা ; কেন যে বর্ষাকালটা ঋতুরাজ হলো না?
বর্ষার জলে স্নান করে আরও শ্যামল ,সতেজ, পবিত্র হয় এই বসুন্ধরা। ডালে ডালে সবুজের সমাহার, তারি ফাঁকে গুচ্ছ গুচ্ছ বাহারি ফুল, ব্যাকুল কারা মন।
আকাশে সাদাকালো মেঘের লুকোচুরি খেলা, মাঝে মাঝে সোনালী দড়ির বিদ্যুৎ এর ঝলকানি ! দৈত্যের মতো আকাশ ফাটা মেঘেদের গর্জন, এটাই যেন আকাশের কলরব।
কখনোবা আকাশ জুড়ে রংধনুর সাত রঙ ছড়িয়ে বসেছে রংয়ের মেলা। কি অপরূপ রূপে সেজেছে আকাশ আর প্রকৃতি। মিলেমিশে একাকার। পূর্ণিমা তাঁর মনের ক্যানভাসে কল্পনার তুলি দিয়ে এঁকে যায় আকাশ ও পাতালের এই মিলনমেলা। এমন মেঘলা দিনে কেন যেন পূর্ণিমার হৃদয়ে এক অদ্ভুত পাগলপারা প্রেমের দোলা দিয়ে যায়! ইচ্ছে করে কারো হাতটি ধরে ময়ূরের মতো পেখম খুলে বৃষ্টিজলে ভিজতে!
মনে পড়ে যায়, ফেলে আসা পিছনের অধ্যায়। সে আর চন্দন। কতো যে বর্ষার জলে ভিজে ভিজে পিচঢালা পথে হেঁটেছে। কখন যে মনের অজান্তেই দু’জনার দু’টি হাত একমুঠো হয়ে গেছে। পাশাপাশি বসে ঝিলের জলে পদ্মপাতায় বৃষ্টির ছিটা দেখেছে.আর সুরে সুর মিলিয়ে কবিতা গেঁথেছে।
পূর্ণিমার ঘুম থেকে উঠেই চলে একটানা সংসারের সব কাজ করা, একদণ্ড বসার সময় যেন নেই তাঁর।কিন্তু মধ্য দুপুরবেলাটা সে তাঁর একান্ত নিজের করে সময় কাটায়। কিছু স্মৃতি , কিছু কথা, কিছু মনের কথা; হয়তোবা আজকের এই অনুভূতিটুকুও লিখে রাখা তাঁর ডায়েরির পাতায়। তখনো বৃষ্টি শুরু হয়নি, বাতাসের দমকা হাওয়া এসে পূর্ণিমার খোলাচুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যায়। পূর্ণিমা আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়, কাজল পড়া দু’টি চোখ। শাড়ির সাথে মিলিয়ে কমলা রং এর একটা টিপ এঁকে নেয় কপালে; ঠিক যেন সদ্য ফোটা টকটকে কৃষ্ণচূড়ার ফুল! এই বাদল দিনে সাজতে বড্ড ভাল লাগে পূর্ণিমার! ততক্ষণে বেশ জোরেশোরে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। পূর্ণিমা এক দৌড়ে বেরিয়ে যায় ঝুলবারান্দায়।
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নীল রেশমি চুড়ি পড়া হাত দু’টো বার করে বৃষ্টি ছোঁয়। বৃষ্টির রিমঝিম সুর আর চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে জলের ফোঁটা এলোপাথাড়ি ছুঁড়তে থাকে! আর আনমনেই সুরেলা কন্ঠে গেয়ে উঠে,
— আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না —
– – —
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা
মন চায়… মন চায়….
এমন সময় কলিংবেলটা বেজে উঠে । ভেজা হাতে দরজা খুলে পূর্ণিমা। অবাক হয়ে, — চন্দন তুমি এ সময়!
— হুম, অফিসে কিছুতেই মন বসছিল না, তোমায় নিয়ে বৃষ্টিজলে ভিজবো তাই চলে এলাম। কতদিন ঝিলের জলে পদ্মপাতায় বৃষ্টির ছিটা দেখিনি বলতো ? চল চল এখনই চল
পূর্ণিমা খুশিতে আটখানা হয়ে বলল,
— সত্যি যাবে ?
— সত্যি সত্যি সত্যি । তিন সত্যি।
রাজাধিরাজ
ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে! কেউ হয়তো পারিবারিক কোনো অসুবিধের কারণে, কেউবা অর্থনৈতিক কারণে আবার কারোর সখ-ই নেই বেড়াবার। তবে এ শ্রেণীর মানুষ মনে হয় খুব কমই আছে। ছোটবেলা থেকে ভ্রমণের খুব আকর্ষণ ছিল সেই থেকেই যেখানেই যাই দর্শনীয় স্থানগুলো এখনো সুযোগ পেলে সেগুলো দেখতে চেষ্টা করি।আর মনে হয় সৃষ্টিকর্তা তাঁর বান্দার আশা কখনই অপূরণ রাখেন না।
২০১৮ সালে গিয়েছিলাম পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদে “হাজার দুয়ারী”। যেখানে মুঘল সম্রাটদের রাজত্ব ছিল। আলিবর্দি খা, সিরাজুদৌল্লার কথা আমরা প্রায় সকলেই ইতিহাসে পড়েছি আর সিরাজদৌল্লা বলতেই যেন আনোয়ার হোসেন, লুতফুন্নেসা-রোজি সামাদ, আলেয়া-আনোয়ারা এদেরই মুখয়ব ভেসে উঠে। ছাত্র জীবনে আমার আব্বাও সিরাজদৌল্লার পাঠ করেছিল সে গল্প আমাদের বলতো। এ প্রজন্মের সন্তানেরাও সেই নবাবের পাঠ করে যাচ্ছে। ইতিহাস ইতিহাস-ই সেটা পরিবর্তনের নয়,যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে। যাক্ বাংলার প্রাচীন কীর্তি কথা না জানলে এবং দর্শনীয় স্থানগুলো না দেখলে বাংলার গৌরবময় অধ্যায় অজানা থেকে যায়। দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার মুর্শিদাবাদ সেই সম্রাটদের বাসস্থানে যেখানে নবাবদের রাজত্ব ছিল। তাঁদের খাট, পালঙ্ক ব্যবহারিক আসবাবপত্র , নবাবদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর অনেক কিছুই যা এখনও ইতিহাস বহন করে চলেছে। একদিনে তাঁদের সেই রাজত্ব দেখা সম্ভব নয়। যেখানে ছিল পরিবারের বসবাস সেখান থেকে তাঁদের জলসাঘর বা শাসন ব্যবস্থার কোথায় যে কী হচ্ছে স্ত্রীদের জানার কোনোই সম্ভাবনা নেই, এটাই আমার মাথায় খেলেছিল সেদিন! অনেক দূরত্ব রেখে রেখে ছিল সেই জায়গাগুলো। ভিতরের অনেক কিছুই ছবি নেওয়া নিষেধ তাই অনেক কিছুই তোলা হয়নি।
অনেক কিছুই লেখার ছিল কিন্তু স্বল্প পরিসরে তা সংক্ষেপে জেনে নেই ইতিহাস ও নবাবদের কিছু কথা। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ২০৪ কিলোমিটার। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লোকাল, লালগোলা প্যাসেঞ্জার এবং এক্সপ্রেস ট্রেন করে মুর্শিদাবাদ যাওয়া যায়।তবে বাই ইয়ারে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই। আমরা গিয়েছিলাম বীরভূম থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে । বীরভূম থেকে মুর্শিদাবাদ কাছেরই পথ।
(ক) মুর্শিদাবাদ এবং নবাব আলিবর্দি খাঁ
মুর্শিদাবাদ নবাবী আমলে বাংলার বর্তমানে বিহার ঝাড়খণ্ড ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এই জেলার উত্তরে মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, দক্ষিণে নদীয়া জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা অবস্থিত ৷জেলার বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বাংলাভাষায় কথা বলে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ ন্যূনাধিক অর্ধশতাব্দী অর্ধ যাবৎ এক বৃহৎ জনবহুল সমৃদ্ধ নগরীরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এর পূর্বনাম মুকসুদাবাদ।
১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার প্রথম নবাব রূপে পরিগণিত হন এবং তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। প্রাদেশিক দেওয়ান, বাংলা এবং উড়িষ্যার তখন থেকেই মুর্শিদাবাদে এর সমৃদ্ধির সূত্রপাত। ১৭৫৭ খ্রীঃ পলাশী যুদ্ধের পর হতেই এর গৌরব ম্লান হতে থাকে। কথিত আছে আনুমানিক ১৬৬০ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ দাক্ষিণাত্য মালভূমির এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র দশ বছর বয়সে ইস্পাহান শহরের হাজী শফি নামক একজন পদস্থ মুগল কর্মকর্তা তাঁকে ইরানে নিয়ে পিতৃস্নেহে লালন-পালন ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান করেন।
হাজী শফির মৃত্যুর পর তিনি ভারতে এসে গোলকুন্ডার দীউয়ান ও ফৌজদার হিসেবে মুগল সরকারের চাকরিতে যোগদান করেন এবং মনসবদারি লাভ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার প্রদেশের জন্য একজন সৎ ও দক্ষ দীউয়ান খুঁজছিলেন। তিনি তরুণ মুর্শিদকুলী খানকে এ পদের যোগ্য মনে করেন এবং ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সম্মানসূচক করতলব খান উপাধি দিয়ে দীউয়ান হিসেবে বাংলায় নিয়োগ প্রদান করেন।
নতুন নিয়োগ পেয়ে করতলব খান ঢাকায় পৌঁছেন। তিনি রাজস্ব ও অর্থনৈতিক প্রশাসনে স্বীয় যোগ্যতার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন সৎ এবং সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। কিন্তু রাজকীয় স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলার নাজিম ও সম্রাটের দৌহিত্র আজিমুদ্দীনের (পরবর্তী সময়ে আজিম-উস-শান) সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাঁধে। ফলে করতলব খানের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়।ফলে ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তাঁকে গঙ্গার তীরবর্তী (ভাগীরথী শাখা) মকসুদাবাদে দফতর স্থানান্তরের অনুমতি দেন। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দাক্ষিণাত্য যান এবং এ সাক্ষাতে তিনি ‘মুর্শিদকুলী খান’ উপাধি লাভ করেন। এভাবে তাঁর পদমর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়।সম্রাট মকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নতুন উপাধি অনুসারে মুর্শিদাবাদ রাখার অনুমতি দেন।
বাংলায় নওয়াবী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলী খানের কর্মজীবন শুরু হয় প্রাদেশিক দীউয়ান হিসেবে। একে একে বাংলা ও উড়িষ্যার নাজিম বা গভর্নর, বিহারের দীউয়ান এবং কয়েকটি জেলার ফৌজদারের পদ অলঙ্কৃত করার পর আঠারো শতকের প্রথম দিকে তাঁর কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটে। মুর্শিদকুলী খান মসজিদ নির্মাণে যত্নবান ছিলেন। তিনিই ঢাকার করতলব খান মসজিদ (বেগম বাজার মসজিদ ) নির্মাণ করেন।
(খ) কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর পূর্ব দিকে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি বিখ্যাত কাটরা মসজিদে অবস্থিত। নবাবের ইচ্ছানুসারে এখানে একটি বাজার স্থাপন করা হয়। কাটরা শব্দের অর্থ গঞ্জ বা বাজার। এই কারণে কাটরা মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজ ভগ্নদশায় পড়ে আছে। এই গম্বুজের উপর থেকে মুর্শিদাবাদ নগরীর অনেকাংশ দেখা যায়। ভিতর চত্বরে এক সঙ্গে প্রায় দুই হাজার লোকের নামাজ পড়বার ব্যবস্থা ছিল।
ঐতিহাসিকগনের লিখিত অনুযায়ী জানা যায়, মুর্শিদকুলি খাঁ বার্দ্ধক্যে উপনীত হলে মসজিদ সংলগ্ন নিজের একটি সমাধি ভবন নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৭২৫ খৃীঃ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দুষ্কর্মের জন্য শেষদিকে তিনি খুবই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং সাধুজনের পদধূলি তাঁর পাপ দূর করবে মনে করে সোপান শ্রেণির নীচে সমাধি প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। মসজিদে কষ্টিপাথরের নির্মিত একখণ্ড ফলকে লেখা আছে; আরবের মুহাম্মদ উভয় জগতের গৌরব, যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারের ধূলি লয়,তাঁর মাথায় ধূলি বৃষ্টি হউক।
মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর পালিত এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। মৃত্যুর পর তাঁর পালিত কন্যার জামাতা (আজিমুন্নেসার স্বামী) সুজাউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত। তিনি দিল্লীর অনুকরণে শাহী মঞ্জিল, শাহী দরওয়াজা, দহপাড়া মসজিদ, ফরহাবাগ ও রোশনীবাগ নির্মাণ করেছিলেন। এই রোশনীবাগ বর্তমান হাজারদুয়ারী প্যালেসের সামনের দিকে ভাগীরথী নদীর পশ্চিমধারে অবস্থিত এবং এখানেই তিনি সমাহিত হন। নবাব সুজাউদ্দৌলার মৃত্যুর পর পুত্র সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অত্যন্ত অলস, অকর্মণ্য ও ভোগবিলাসী নবাব ছিলেন।
১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে নবাব আলীবর্দি খাঁ গিরিয়ার যুদ্ধে নবাব সরফরাজ খাঁ ও মারাঠা দূত ভাস্কর পণ্ডিতকে বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা পারস্য দেশের খোরাসান নামক স্থানের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর বেগম সরফুন্নেসা অত্যন্ত জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শীনি মহিলা ছিলেন। তিনি সব ব্যাপারে তাঁর বেগমের পরামর্শ গ্রহণ করে চলতেন। আলিবর্দি খাঁ নিষ্কলুষ চরিত্রের একজন মানুষ ছিলেন ।তাঁর আঠারো বৎসর রাজত্বকালে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করত। খোসবাগে আলিবর্দি খাঁ’র সমাধি বিদ্যমান আছে ।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খান-এর নাতি। আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না ছিল তিন কন্যা।আলীবর্দী খাঁ যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন, তখন তার তৃতীয়া কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে সিরাজ-উদ-দৌলা’র- জন্ম হয়। এ কারণে তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে আনন্দের আতিশয্যে নবজাতককে নাতি হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের।
নবাব আলিবর্দি খাঁ’র মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে সিরাজদ্দৌলা নবাব হন । তাঁর দুই বেগম–লুতফুন্নেসা এবং ওমাতুন্নেসা। লুতফুন্নেসা প্রথমে নবাব আলিবর্দি খাঁ”র হারেমে ক্রীতদাসী ছিলেন। সিরাজ তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বেগমরূপে গ্রহণ করেন। সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব। বাংলা ইতিহাসের এক প্রতিমূর্তি। পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়।
(গ) হাজারদুয়ারী প্রাসাদ
হাজারদুয়ারী প্রাসাদ, যা আগে বার কোঠি নামে পরিচিত ছিল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে কিলা নিজামতের ক্যাম্পাসে এটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এই প্রাসাদ শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
দুপুরে এক হোটেল থেকে লাঞ্চ সেরে আমরা গঙ্গা নদীর ধার ঘেঁষে চওড়া রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে নদীর পাশে বসার জন্য পাকা করা পুস্তা আবার সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর জলে। অনেকে গোসল করছে হয়তো স্থানীয়রা হবে আবার হিন্দুশাস্ত্র মতে গঙ্গার জলে স্নান করে তাঁরা পবিত্র হয়। তাই নারী পুরুষ সবাই পবিত্র হওয়ায় ব্যস্ত। কিনার ঘেঁষে বড় বড় গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা । এতো মনোরম দৃশ্য দেখে গাড়িতে কিছুতেই বসে থাকতে পারলাম না। অনেক লোকের সমাগম। আমরা নেমে কিছুটা হালকা জায়গায় বসলাম । চারিদিক পাখির কলকাকলি আবার খাবারেরও ছড়াছড়ি! আর বাঙালিতো ভোজনরসিক। পানিপুরি মানে আমাদের ফুচকার মত যা লোভ সামলানো যায় না । আর আরেকটা খাবার আছে আমার ভীষণ প্রিয় পাপড়িচাট আর কিছু টুকটাক নাস্তা কফি খেয়ে আবার রওয়ানা হলাম হাজার দুয়ারীর উদ্দেশ্যে ।
সাধারণভাবে এরূপ নামকরণের অর্থ এক হাজার দরজার জন্য উক্ত প্যালেসকে “হাজার দুয়ারী”আখ্যা দেওয়া হয়েছে। হাজার দুয়ার সমন্বিত, তাই নাম হাজার দুয়ারি, যদিও এই হাজার দুয়ারের কিছু দুয়ার নকল, দেয়ালের গায়ে দরজার অনুকরণে ছবি আঁকা। বর্তমানে এই প্রাসাদটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। টিকিট কেটে ভিতরে যেতে হয় ।আমরাও টিকেট কেটে ভিতরে গেলাম বিরাট এরিয়া । অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। পাকা রাস্তার দু’পাশে সবুজ মাঠ । নানান গাছের সুশোভিত । হাতের ডানদিকে বিরাট মাঠের উপর ইমামবাড়া । পরের পর্বে ইমামবাড়ার কথা লিখব। প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার আগে নিচেই সবার পার্স, মোবাইল সব রেখে খালি হাতে যেতে হয় । আর ছবি তোলা তো একেবারেই নিষেধ। প্রাসাদের উপরতলায় আশ্চর্যের একটা বিরাট আয়না আছে আপনি সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কিছুতেই দেখতে পারবেন না কিন্তু পাশেরজন ঠিকই আপনাকে দিব্যি দেখতে পারবে।
প্রাসাদের পিছনদিকে বেশ কিছু দূরে একটি গেট আছে তার পিছন দিয়েই অনেক ছোট ছোট দোকানের মার্কেট সেখানে ঐতিহ্যবাহী এবং রাজকীয় কারুকার্য খচিত অনেক জিনিষপত্র বিক্রয় হয়। আমার তো কেনাকাটা আর উপহার দেওয়া আরেকটা ভীষণ পছন্দের বিষয়। একেতো চোখ ধাঁধানো সব জিনিষগুলো ছিল। নিজের জন্য, শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি সবার জন্যই পছন্দ করে কিনলাম। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিল ।ফেরার পথে রাস্তার পাশে সব খাবারের স্টলগুলো ,গাড়িতে বসেই গরম গরম লুচি ঘূর্ণি মজাদার দু’তিন রকমের মিষ্টি চা খেয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। ভারতে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি হয় সবাই জানি। নামগুলাও তেমন, লেংচা, বৈকুন্ডভোগ, খীরকদম্বো, চিত্তরঞ্জন, কালাকান্দ, দানাদার লড অরেঞ্জ, সিতাভোগ, রাজভোগ ক্ষীরভোগ অনেক নামের সমাহার, খেতেও দারুণ! স্নেক খাবারগুলাও ভীষণ সুস্বাদু খেতে। আমি বহুবার গিয়েছি ভারতে ঘুরাঘুরির সাথে সাথে সেখানকার খাবারগুলাও আমাকে খুব আকর্ষণ করে।
একদিনে এই নবাবদের রাজ্য দেখা সম্ভব না । তাই আমরা মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের কাছাকাছিই আমার শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়র হোটেলে গিয়ে উঠি অবশ্য আগে থেকেই বলা ছিল। এবার প্রাসাদের আরও কিছু জেনে নেই। এই প্রাসাদ ইতালির স্থাপত্যকলার এক জীবন্ত নিদর্শন।১৮২৯ খ্রীঃ ২৯ শে আগস্ট তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিস ও বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিগনের উপস্থিতিতে নবাব নাজিম হুমায়ুন-জা এই প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। গাঁথুনির কাজে বহু পরিমাণ ডিমের কুসুম ব্যবহার করা হয়েছিল বলে শোনা যায়।
এই প্রাসাদটি তিনতলা, প্রতিটি কক্ষের কারুকার্য অত্যন্ত মনোরম। একতলায় অস্ত্রাগার, অফিস-কাছারি, রেকর্ড রুম ইত্যাদি আছে। অস্ত্রাগারে মোট ২৬০০ টি অস্ত্র সজ্জিত আছে। এই অস্ত্রগুলির মধ্যে কতকগুলি বিখ্যাত অস্ত্র এবং যে ছোরার সাহায্যে মোহাম্মদীবেগ সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে হত্যা করেছিল সেটিও সযত্নে রক্ষিত আছে। ২য় ও ৩য় তলায় আর্টগ্যালারী ও লাইব্রেরী আছে। আর্টগ্যালারীতে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা স্থান লাভ করেছে। এদের মধ্যে “The buril of sir John More, Adom & Eve, Black Bent” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
লাইব্রেরী ঘরে ছোটবড় আকারেরর বহু বিষয়ের এবং বিদেশী ভাষায় লিখিত নানান গ্রন্থ সংগৃহীত আছে। আবুল ফজল রচিত আইন- ই-আকবরির পাণ্ডুলিপিও এখানে দৃষ্ট হয়। একটি বিরাট আকৃতি বিশিষ্ট সুবিশাল এলবাম আছে যা দৈর্ঘ্যে তিন হাত, প্রস্থে দুই হাত আর ওজন প্রায় বিশ কেজি। তাছাড়া বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন-অর্-রশিদের হস্ত লিখিত কোরআন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই হাজার দুয়ারী প্যালেসের সম্মুখভাগে দু’পাশে মনোরম বাগান শোভা পায়। একতলা প্যালেসের সম্মুখভাগে বিশাল সিঁড়ি “দরবার কক্ষ” পর্যন্ত উঠেছে। সম্মুখে লম্বা গোলাকার স্তম্ভরাজি যাতে সুন্দর নক্সার কাজ রয়েছে। সিঁড়ির দু’পাশের সম্মুখভাগে অবস্থিত দুইটি সিংহ মূর্তি এর সৌন্দর্যকে আরও অপরূপ করেছে।
নবাবদের অনেক কিছু দেখার আছে, লিখার আছে যেমন জাফরাগঞ্জ সমাধি ক্ষেত্র মীরজাফর ও ফ্যামিলি, ওয়াসেফ মঞ্জিল, পলাশি মনুমেন্ট, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, জগৎশেঠের বাড়ি, সিরাজের প্রাসাদ– হীরাঝিল ইত্যাদি। সল্প পরিসরে যেগুলো না লিখলেই না সেগুলোর সম্বন্ধে কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি…
(ঘ) ইমাম বাড়া
হাজার দুয়ারী প্যালেসের পর ইমাম বাড়ার কথা না বললেই নয়, প্যালেসের ঠিক বিপরীত দিকে ইমাম বাড়া অবস্থিত। নবাব হুমায়ুন-জার পুত্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ নবাব নাজিম মনসুর আলী খাঁ ফেরাদুন-জা ১৮৪৭ খ্রীঃ প্রায় সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করে বর্তমান ইমাম বাড়াটি নির্মাণ করেন। “মহরম উৎসব” প্রতি বছর মহরম মাসের প্রথম দশদিন ইমাম বাড়ার সম্মুখস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে জাঁকজমক সহকারে এক মেলার আয়োজন করা হয়।
মহরমের পঞ্চম ও শেষদিন গুলিতে তাজিয়াসহ বিরাট জৌলুস বেড় হয়।শেষদিন সকাল বেলা ইমাম বাড়া হতে হাসান হোসেনের নকল মৃতদেহ শবাধার ও তাজিয়াসহ প্রকাণ্ড জৌলুস কেল্লা ও শহরের রাস্তা অতিক্রম করে কারবালা অভিমুখে যাত্রা করে। ঐ শোভাযাত্রায় যুবকেরা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নিজেদের বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করে ;হায় হোসেন হায় হোসেন বলে মাতন করে থাকেন। এই দৃশ্য খুবই মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক।
(ঙ) আজিমুন্নেসা
হাজারদুয়ারীর পাশের রাস্তা দিয়ে, আজিমুন্নেসা বেগমের জীবন্ত সমাধি। নশীপুর যাওয়ার পথে মহিমাপুর ফাঁড়ির বিপরীত দিকে মুর্শিদকুলির খাঁর কন্যা ও সুজার খাঁর স্ত্রী আজিমুন্নেসার সমাধি অবস্থিত। শোনা যায় একবার তিনি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পরায় হেকিম সাহেবের নির্দেশমতো গাছের শিকড়ের সাথে রোজ একটি জীবন্ত মানুষের কলিজা থেকে ঔষধ তৈরি করে খাওয়ানো হতো। ফলে রোগ মুক্তি হলো কিন্তু তিনি নেশাগ্রস্থের মতো মানুষের কলিজা খাওয়ার প্রচণ্ড নেশায় মেতে উঠলেন! তারপর গোপনে নিজের ঘনিষ্ঠ লোক দিয়ে মানুষ মেরে তাঁদের কলিজা খাওয়া শুরু করে।
তাই তাঁকে “কলিজা খাকী বেগম” বলে অভিহিত করা হতো। এই সংবাদ স্বামী সুজা খাঁ এর কানে পৌঁছলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে নরহত্যার অপরাধের জন্য বেগমকে জীবন্ত অবস্থায় সমাধিস্থ করার আদেশ দেন এবং অপরাধ মুক্তির জন্য ঐ সমাধির উপর একটি মসজিদ তৈরি করেন।
(চ) নশীপুর রাজবাড়ী
ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখ্যাত দেবী সিংহ এই রাজবাড়ী তৈরি করেন। দেবী সিংহের আদিবাড়ী ছিল পানিপথে। মুর্শিদাবাদ যখন চরম উন্নতির শিখরে দেবী সিংহ তখন সুদূর পানিপথ হতে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদে আগমন করেন । পরে তিনি দেওয়ান রেজা খাঁ’র অধীনে চাকরী গ্রহণ করেন এবং পরে ইংরেজ কোম্পানির অধীনে রেভিনিউ কালেক্টর পদে ভূষিত হন। ৭৬-এর মন্বন্তরের পরে রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি প্রজাদের উপর যেরূপ অত্যাচার উৎপীড়ন করেন তাঁর তুলনা হয় না। কৃতকর্মের ফল স্বরূপ তাঁর দুই পত্নী থাকা সত্ত্বেও তাঁর বংশরক্ষা হয় নি । তিনি বিভিন্ন উপায়ে প্রচুর ধনসম্পত্তির অধিকারী হন এবং বসতবাড়ির জন্য “হাজারদুয়ারীর” অনুরূপ প্রাসাদ তৈরি করেন। দেবী সিংহ ১৮০৫ খ্রীস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। নশীপুর ‘ঝুলনযাত্রার” জন্য বিখ্যাত। ঐ উপলক্ষে এখানে জাঁকজমকপূর্ণ মালা বসত। তখন পুরাণ অবলম্বনে ‘পুতুলনাচ’ দেখানো হত।
(ছ) কাঠগোলা বাগান
নশীপুর রাজবাড়ি হতে উত্তর পূর্ব দিকে ১ কিমি পথ গেলেই অত্যন্ত সুন্দর মনোরম পরিবেশে একটি প্যালেস, বাগান ও পরেশনাথের মন্দির চোখে পরে, এটাই কাঠগোলা বাগান নামে বিখ্যাত। বিশাল এই বাগানটিতে মূল্যবান গাছ ও ফুলের বাগানে সুশোভিত।
১৭৮০ সালে কাঠগোলা বাগানের প্রতিষ্ঠিত করেন লক্ষীপৎ সিং দুগর। প্রায় ২৫০বিঘা জায়গা নিয়ে বিশাল বাগানের মধ্যে দোতালা অট্টালিকার সামনে বড় পুকুর। সেই পুকুরে থাকত নানা ধরনের রঙ্গীন মাছ। এখানে জৈন মন্দির ও প্রাসাদ ছাড়াও রয়েছে চিড়িয়াখানা, হেরেম ও শ্বেত পাথরে বাঁধানো পুকুর। এই বাগানের মধ্যস্থিত প্রাসাদে বহু মূল্যবান আসবাবপত্র, তৈজসপত্র ও মর্মরমূর্তি রক্ষিত আছে। সেকালে কাঠগোলা বাগানে জলসা হতো এবং অনেক লোকের সমাগম হতো। বর্তমানে কাঠগোলা বাগান একটি দর্শনীয় স্থান। যেই দু’জনের কথা না লিখলেই না। (অতি সংক্ষেপে)
১) মীরজাফর
নাবাব মীরজাফর ছিলেন আলীবর্দি খাঁর ভগ্নীপতি তার পিতার নাম আহম্মদ নাজাফি। পিতামহ হুসেন নাজাফি আরব দেশের অধিবাসী ছিলেন। হুসেন নাজাফি, ইব্রাহিম তাবাতাবাই-এর ২২তম বংশধর। মীরজাফর আহম্মদ নাজাফির দ্বিতীয় পুত্র। তিনি অত্যন্ত কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন এবং ছলে বলে কৌশলে দু’বার নবাব নিযুক্ত হয়েছিলান।
সিরাজ-উ-দ্দৌলার অধঃপতনের মূলে ছিল মীরজাফর। মীরজাফর অত্যন্ত বিলাস ও আড়ম্বর প্রিয় ছিলেন । তিনি বহু মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদ ও হীরা জহরত খচিত গলার হার পড়তেন। তিনি অদূরদর্শী ছিলেন । পলাশী যুদ্ধের পর তিনি বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হয়ে ইংরেজদিগের অবিরত অর্থের দাবী মিটাতে অপারগ হন এবং এর ফলে অবলম্বে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত হতে হয়।
মীরজাফর ৭৪ বৎসর বয়সে ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ১৭ই জানুয়ারি পরলোক গমন করেন।
২) ঘসেটি বেগম
নবাব আলিবর্দি খাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা । ঢাকার শাসনকর্তা নবাব নোয়াজিস মহম্মদ খাঁ ছিলেন তাঁহার স্বামী। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন । এজন্য সিরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা একরাউদ্দৌলাকে পুত্র রূপে গ্রহণ করেন । বেগমের অনু্রোধে নওয়াজিস মহম্মদ মোতিঝিল প্রাসাদ তৈরি করেন। এই প্রাসাদের সামনে একটি বিরাট ঝিল তৈরি করেন একসময় এই ঝিলে মুক্তার চাষ হতো। ঘসেটি বেগম ছিলেন ঐশ্বর্যশালিনী। তার ইচ্ছা ছিল তাঁর পালিত পুত্রকে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা । সিরাজকে ঘসেটি বেগম কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না । সিরাজের ধ্বংসই ছিল তাঁর কাম্য। সেজন্য তিনি ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লব, উমিচাঁদ এবং ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন ।
পলাশির রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে মিরণের আদেশে বন্দী অবস্থায় সিরাজ নিহত হন এবং মীরজাফর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মসনদে বসেন। এই সময় থেকে নবাব আলিবর্দি খাঁর পরিবারবর্গের প্রতি অত্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ হয়। আলিবর্দির বেগম ও তাঁর কন্যাদ্বয় ঘসেটি ও আমেনা এবং সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে অযথা কষ্ট প্রদান করে বন্দীভাবে রাখা হয়।
বন্দী অবস্থায় তাঁর চূড়ান্ত যন্ত্রণা ভোগ করলে তাঁদের মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় নির্বাসিত করা হয়। মিরণ তাঁদের জীবিত থাকা অসহ্য মনে করে তাঁদের বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত হন। আলিবর্দি খাঁর বেগম এবং সিরাজের বেগম ও কন্যা কোনরূপে অব্যাহতি পান। কিন্তু ঘসেটি ও আমেনা বেগমকে নৌকা থেকে নদীগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়।
মুর্শিদাবাদ ঘুরে আমরা আসার পথে… মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত কয়টা সিল্ক শাড়ি ও বিখ্যাত ছানাবড়া কিনে নিলাম…
সাগরদাঁড়ি যশোর
ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে! কেউ হয়তো পারিবারিক কোনো অসুবিধের কারণে, কেউবা অর্থনৈতিক কারণে আবার কারোর সখ-ই নেই বেড়াবার, তবে এ শ্রেণীর মানুষ মনে হয় খুব কমই আছে। আমার আব্বা ছিলেন ভীষণ ভ্রমন পাগল একজন মানুষ। বিশেষ করে দর্শনীয় স্থান, শিক্ষামূলক স্থানগুলোতে যেতে বেশি পছন্দ করতেন। আমারও তাই, অসম্ভব পছন্দ ভ্রমণের। আগে ছুটির দিন ছিল রবিবার। পেশায় আব্বা সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন পাউবো প্রকৌশলী । বদলীর চাকরি। চাকরির সূত্রে বাংলাদেশের জেলা, উপজেলা অনেক জায়গায় আমরা থেকেছি। কোথাও দুই বছর কোথাও বা তিন বছর । প্রায় ছুটির দিনে আব্বা আমাদের পরিবারের সবাইকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতেন। কিছু কিছু স্মৃতি আজও মনে দোলা দেয়, মনে দাগ কেঁটে থাকে আব্বার চাকরিসূত্রে আমরা তখন ছিলাম যশোহরে। মনে পড়ে, যশোরের সাগরদাঁড়ির কথা, যেখানে ছিল একদিন কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের পদচারণ। কেটেছিল শিশুকাল। কবির লেখা কবিতা, সেই কপোতাক্ষ নদীর কথা… রূপালি জলে সোনালি সূর্যের আলোয় ঝিকিমিকি ছোট ছোট ঢেউয়ের উপর ঢেউগুলো কলকলধ্বনিতে বয়ে যাওয়া আজও আমায় টানে। ওয়ালে লেখা কবির সেই কবিতা আব্বা ভরাট গলায় জোড়ে জোড়ে পড়ে শুনিয়েছিলেন আমাদের। তখন আমার বয়স হবে নয় কী দশ বছর, আগামাথা তো কিছুই বুঝিনি তবু শুনতে বেশ লাগছিল।
আমরা সবাই সারাদিন ওখানে ঘুরে ঘুরে কাটিয়েছিলাম। বিশাল জমিদার বাড়ি, চারিদিক বড়ো বড়ো নানান ধরণের সেই পুরানো গাছ, নিচে অনেক ঝরা পাতা। গাছগাছালিতে বিভিন্ন পাখির কলকাকলিতে মুখরিত। আউলা বাতাস বইছে। খুব একটা লোকের আনাগোনা ছিল না , ক্যামন যেন নিস্তব্দ নিস্তব্দ ভাব! ভীষণ ভালো লাগছিল, ছোট বেলা থেকেই আমাকে পাখি, গাছ, নদী, পাহাড়, মুক্ত হাওয়া, নির্জন এমন পরিবেশ খুবই আকর্ষণ করতো। তখন এত মানুষের যাতায়াত ছিল না শুধু আশেপাশের এলাকা থেকেই কেবল মানুষেরা দেখতে আসতো। এখন পর্যটকদের কারণে অনেক ভীর হয়। নদীর ধারে বসে কুলুকু্লু ধ্বনি শুনেছিলাম তখন নদী ভরা পানি ছিল যেন পূর্ণ যৌবনা । ছোট বড়ো অনেক পালতুলা নৌকা, ডিঙ্গি নৌকা সাঁই সাঁই করে বয়ে যাচ্ছে । একটা বিরাট বটগাছে নিচে চারদিক পাকা করা সেখানে বসে আম্মা (আম্মা ছিলেন শিক্ষিকা) বড়ো ভাইবোনদের কবি মধুসূদন জীবন সম্বন্ধে বলছিলেন আর শুধুমাত্র ধর্মান্তরিত হওয়ার জন্য কবির নিজ দেশে ঠাঁই হয়নি ,পিতার এত ঐশ্বর্য থাকা সত্ত্বেও অর্থের অভাবে কী অসহায়ের মত মৃত্যুবরণ করেছিল । বলে রাখা ভালো সেদিন ঐ আম্মার মুখেই আমি কবি মাইকেল মধুসূদন এবং তাঁর জীবনের গল্প প্রথম শুনেছিলাম। কচি মনে তেমন কিছু অনুভূতি হওয়ারও কথা নয় সেসময়, গল্পের মতো মনে হয়েছিলো।
সাগরদাঁড়ি কবি মধুসূদনের বাড়িতে একদিন–
মাইকেল মধুসূদনের পিতা রাজনারায়ণ দত্ত ছিলেন কলকাতার সদর দেওয়ানি আদালতের এক খ্যাতনামা উকিল। রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতায় উকালতি করে প্রচুর অর্থশালী হয়েছিলেন। তিনি সাগরদাড়িতেঁ জমিদারি ক্রয় করেন ও বাড়িতে কিছু অট্টালিকা ও দেবালয়টি স্থাপন করেন। অপূর্ব নির্মাণশৈলীর দেবালয়টিতে প্রতিবছর দুর্গাপূজা হয়। এ বাড়ির পূর্ব-পশ্চিম পার্শ্বে তার আত্নীয়দের বাড়ি ও জমিদারির কাছারি রয়েছে। মধুসূদনকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো, সাগরদাঁড়ি পর্যটন কেন্দ্র, মধুসূদন মিউজিয়াম। কপোতাক্ষের পাড়ে কবির স্মৃতি বিজড়িত কাঠবাদাম গাছ ও বিদায় ঘাট পর্যটকদের আকর্ষণ করে। কথিত আছে ১৮৬২ সালে কবি যখন সপরিবারে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন তখন ধর্মান্তরিত হওয়ার কারণে আত্নীয়রা তাঁকে বাড়িতে উঠতে দেয় নি। তিনি কাঠবাদাম গাছের তলায় তাঁবু খাটিয়ে চৌদ্দ দিন অবস্থান করেন , বিফল মনে কপোতাক্ষের তীর ধরে হেঁটে বিদায়ঘাট হতে কলকতার উদ্দেশে বজরায় উঠেছিলেন। ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে থাকাকালীন মধুসূদন তাঁর মাতৃভূমি সাগরদাঁড়িতে বয়ে যাওয়া নদী কপোতাক্ষকে নিয়ে সুগভীর ভালোবাসার টানে মাতৃভাষায় সনেট লিখেছিলেন–
কপোতাক্ষ নদ-
সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে।
সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে;
বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে,
কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?
দুগ্ধ-স্রোতোরূপি তুমি মাতৃভূমি স্তনে।
আমরা যারা মধুসূদনের জীবনী পড়েছি তা থেকে জেনেছি শেষ জীবন তিনি চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন । ঋণের দায়, অর্থাভাব, অসুস্থতা, চিকিৎসাহীনতা ইত্যাদি কারণে তাঁর জীবন হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। শেষজীবনে তিনি উত্তরপাড়ার জমিদারদের লাইব্রেরি ঘরে বসবাস করতেন। জীবনের এই টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েও মধুসূদন কাব্যচর্চা অব্যাহত রাখেন। ভ্রমণের সাথে সংক্ষেপে জেনে নেই মাইকেল মধুসূদনের জীবনের কিছু কথা —
বাংলা সাহিত্যে তিনি ‘মধুকবি’ নামে পরিচিত। মধুসূদন ছিলেন বাংলা সাহিত্যের যুগপ্রবর্তক কবি। তিনি তাঁর কাব্যের বিষয় সংগ্রহ করেছিলেন প্রধানত সংস্কৃত কাব্য থেকে।
উনিশ শতকের বাঙালি নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ মধুসূদন তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভার দ্বারা বাংলা ভাষার অন্তর্নিহিত শক্তি আবিষ্কার করে এই ভাষা ও সাহিত্যের যে উৎকর্ষ সাধন করেন, এর ফলেই তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু কায়স্থ পরিবারে মধুসূদন দত্তের জন্ম হয়। পিতার নাম রাজনারায়ণ দত্ত ও মাতা জাহ্নবী দেবী। মধুসূদনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় তার মা জাহ্নবী দেবীর কাছে। জাহ্নবী দেবীই তাকে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ প্রভৃতির সঙ্গে সুপরিচিত করে তোলেন। সাগরদাঁড়ির পাশের গ্রামের শেখপুরা মসজিদের ইমাম মুফতি লুৎফুল হকের কাছে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। বিদ্বান ইমামের কাছে তিনি বাংলা, ফারসি ও আরবি পড়েছেন। সাগরদাঁড়িতেই মধুসূদনের বাল্যকাল অতিবাহিত হয়।
তের বছর বয়সে মধুসূদন কলকাতায় আসেন। স্থানীয় একটি স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি তদনীন্তন হিন্দু কলেজে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। মধুসূদন খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন।আঠারো বছর বয়সেই মহাকবি হওয়ার ও বিলাতে যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা তার মনে বদ্ধমূল হয়ে যায়। তাঁর ধারণা ছিল বিলেতে যেতে পারলেই বড় কবি হওয়া যাবে।১৮৪৩ সালে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন। তাকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী তিনিই তার “মাইকেল” নামকরণ করেন। মধুসূদন পরিচিত হন “মাইকেল মধুসূদন দত্ত” নামে। তার এই ধর্মান্তর সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পিতা তার বিধর্মী পুত্রকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করেন কিন্তু পুত্রকে পরিত্যাগ করলেও, বিশপস কলেজে পড়াশোনার ব্যয়ভার বহন করছিলেন। চার বছর পর তিনি টাকা পাঠানো বন্ধ করেন। বিশপস কলেজে অধ্যয়ন শেষ করে মধুসূদন যখন কলকাতায় চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন তখন তার মাদ্রাজি বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ্যান্বেষণে মাদ্রাজে (চেন্নাই) চলে যান। মধুসূদন মাদ্রাজেও বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেন নিয়ে। কলেজের পরীক্ষায় তিনি বরাবর বৃত্তি পেতেন। নারীশিক্ষা বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করে তিনি স্বর্ণপদক লাভ করেন। সেই সময় থেকেই মধুসূদন ইংরেজিতে কবিতা লিখতেন । সে সময়কার ইংরেজি পত্রিকায় এসব কবিতা প্রকাশিত হত ।
ছেলেবেলায় মধুসূদন মায়ের মুখে রামায়ণ পাঠ শুনতেন । তখন থেকেই কবিতার সুর ও ছন্দের প্রতি মধুসূদনের বড় আকর্ষণ ছিল। পঁচিশ বছর বয়সে নিদারুণ দারিদ্র্যের মধ্যেই তিনি “দ্য ক্যাপটিভ লেডি” তার প্রথম কাব্যটির রচনা করেন। কবি ও দক্ষ ইংরেজি লেখক হিসেবে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। মাদ্রাজে আসার কিছুকাল পরেই মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। উভয়ের দাম্পত্যজীবন আট বছর স্থায়ী হয়েছিল। পরে মধুসূদন এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিবাহ করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন। তিনি ১৮৬০ সালে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে চলে যান। কিন্তু তার আর্থিক অবস্থা ছিল খুব খারাপ। একমাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এর জন্য তিনি তার আইন বিষয়ে পড়া শেষ করে ভারতে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই কলকাতায় তার এই লেখাপড়াকে কাজে লাগাননি।
মাইকেল মধুসূদন ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি এবং নাট্যকার ও প্রহসন রচয়িতা। তিনি ইংরেজি ছাড়াও ল্যাটিন, গ্রিক, ফারসি, হিব্রু, তেলুগু, তামিল ইত্যাদি ভাষায় অনায়াসে কথা বলতে পারতেন। এমনকি ফারসি ও ইতালীয় ভাষায় কবিতাও লিখতে পারতেন। কবি মধুসূদন ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে অবস্থানকালেই ইতালির কবি পেত্রার্কের সনেট থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রথম বাংলা সনেটের দিগন্ত উন্মোচন করেন এবং তার সনেটকে বাংলায় “চতুর্দশপদী” নাম মহাকবি মধুসূদনই দিয়েছিলেন। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে কবির চতুর্দশপদী কবিতাগুলি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলিতে কবি চিত্তের ব্যকুলতা, স্বদেশ প্রেম ও আবেগ ধ্বনিত হয়েছে। তাঁর কাব্যের নায়িকাদের মধ্য দিয়ে যেন যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত, অবহেলিত, আত্ম সুখ-দুঃখ প্রকাশে অনভ্যস্ত ও ভীত ভারতীয় নারীরা হঠাৎ আত্মসচেতন হয়ে জেগে ওঠে। নারীচরিত্রে এরূপ বিদ্রোহের প্রকাশ বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের আগে আর কারও রচনায় প্রত্যক্ষ করা যায় না। তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অমিত্রাক্ষর ছন্দে রামায়ণের উপাখ্যান অবলম্বনে রচিত মেঘনাদবধ কাব্য নামক মহাকাব্য। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাবলি হল দ্য ক্যাপটিভ লেডি, শর্মিষ্ঠা, কৃষ্ণকুমারী (নাটক) , পদ্মাবতী (নাটক),বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ , একেই কি বলে সভ্যতা, তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য, বীরাঙ্গনা কাব্য, ব্রজাঙ্গনা কাব্য, চতুর্দশপদী কবিতাবলী, হেকটর বধ ইত্যাদি।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে অর্থাভাবে তিনি মৃত্যুবরণ করেন এবং তাকে কলকাতার সার্কুলার রোডে সমাধি দেওয়া হয় স্ত্রী হেনরিয়েটার পাশেই। মহাকবি জীবনের অন্তিম পর্যায়ে জন্মভূমির প্রতি তার ভালোবাসার চিহৃ রেখে গেছেন অবিস্মরণীয় পংক্তিমালায়। তার সমাধিক্ষেত্রে কবির নিজেরই লেখা একটি কবিতা স্মৃতিফলকে খোদিত করে দেওয়া —
দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব
বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে
(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমত
বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত
দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!
যশোরে সাগরদাঁড়ি কপোতাক্ষ-তীরে
জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি
রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী
পুনম মায়মুনী | Punom Mymoni
Sunglass and our friendship | সানগ্লাসেই সৃষ্টি আমাদের বন্ধুত্ব | Bangla Galpo 2023
Shree Jagannath Bijay Kabya | ‘শ্রীজগন্নাথবিজয়’ কাব্য প্রসঙ্গে | 2023
2023 New Bengali Story | গল্পগুচ্ছ | রানা জামান
Anabasarakalina besha of Jagannath | অনবসরকালীন বেশ | অভিজিৎ পাল
Shabdodweep Web Magazine | Collection Bangla Golpo | Punom Mymoni
In the world of Bengali literature, nothing captures the imagination quite like a well-written golpo. A strong Collection Bangla Golpo allows readers to experience the depth of Bengali culture, tradition, and emotion through stories. Today, with the rise of online platforms, accessing a diverse Collection Bangla Golpo has become easier than ever. Platforms like Shabdodweep Web Magazine are leading the way by providing a rich selection of Bengali Stories Collection that speaks to both young and mature audiences.
The Digital Transformation of Collection Bangla Golpo
Gone are the days when readers had to search through libraries or local bookstores for a good Golpo Samagra. Now, a simple internet connection opens the door to an entire Collection Bangla Golpo that spans classic tales, contemporary fiction, and experimental narratives. This transformation is not just about convenience – it’s about preserving the beauty of Bengali literature while adapting to modern reader preferences.
Shabdodweep Web Magazine has been instrumental in this shift, regularly publishing new stories, poems, and Golpo Samagra written by both emerging and seasoned writers. One notable contributor is Punom Mynoni, a Bengali writer whose thoughtful and emotionally rich stories have become a staple in the magazine’s Collection Bangla Golpo section.
Why Collection Bangla Golpo Is Important
A curated Collection Bangla Golpo does more than entertain – it educates, inspires, and connects generations. These stories act as cultural markers, preserving dialects, traditions, and values that define Bengali identity. Whether it is a nostalgic story from a remote village or a modern urban tale, each golpo adds value to the Bengali literary canon.
For readers who want to Read Bengali Books online, an online Bengali Stories Collection serves as an ideal entry point. It provides access to short stories, serialized fiction, and thought-provoking pieces that offer both enjoyment and insight.
Shabdodweep Web Magazine: A Hub for Bengali Literature
When it comes to finding an authentic Collection Bangla Golpo, Shabdodweep Web Magazine stands out as a trusted source. It is home to hundreds of original bangla golpo, Golpo Samagra, and poems. The platform not only highlights established Bengali writers but also nurtures fresh talent.
Punom Mynoni, for example, has contributed many heartfelt and vivid stories to the magazine. Her storytelling reflects a deep understanding of human emotions and Bengali culture. These stories, published on Shabdodweep, form a vital part of the magazine’s Bengali Stories Collection, enriching the platform’s literary credibility and trustworthiness.
Moreover, Shabdodweep doesn’t limit itself to prose. It embraces poetry, essays, and literary criticism, creating a holistic environment for Bengali literature lovers. This breadth of content ensures that readers can find something meaningful in every visit.
The Benefits of Reading Collection Bangla Golpo Online
Online access to Collection Bangla Golpo provides numerous benefits for both casual and serious readers:
Accessibility: Whether you live in Kolkata or California, you can Read Bengali Books online without geographical limitations.
Diverse Voices: Digital platforms include stories from various regions, social backgrounds, and perspectives.
Regular Updates: Platforms like Shabdodweep Web Magazine frequently update their Bengali Stories Collection.
User Engagement: Readers can comment, share, and interact with content, creating a literary community.
Eco-friendly: Digital reading reduces the need for paper, making it an environmentally friendly option.
Writing and Sharing Your Own Bangla Golpo
Aspiring writers can also benefit from this digital trend. If you have a story to tell, platforms like Shabdodweep invite you to contribute. Your golpo could become part of a growing Collection Bangla Golpo that reaches thousands of readers.
Writing for a trusted site like Shabdodweep also helps build your reputation as a Bengali writer. With clear submission guidelines and editorial support, it’s easier than ever to join the literary movement and make your mark.
Future of Collection Bangla Golpo
The future of Bengali literature lies in platforms that can merge tradition with technology. A digital Collection Bangla Golpo is more than a trend – it’s a sustainable model for literary preservation and growth. With increased smartphone usage and better internet access, more people are turning to online platforms to satisfy their literary cravings.
Platforms like Shabdodweep will continue to play a crucial role, offering diverse content, discovering new talent, and promoting Bengali stories globally. As more writers like Punom Mynoni contribute their unique voices, the richness of the Collection Bangla Golpo will only deepen.
Frequently Asked Questions (FAQs)
What is Collection Bangla Golpo?
Collection Bangla Golpo refers to a curated set of Bengali short stories, often available online through platforms like Shabdodweep Web Magazine.
How can I access Bengali Stories Collection online?
You can visit literary websites such as Shabdodweep Web Magazine to explore and Read Bengali Books online for free or by subscription.
What is Golpo Samagra?
Golpo Samagra typically refers to a complete or comprehensive collection of stories by a particular writer or compiled on a specific theme.
Why should I read Collection Bangla Golpo online?
Reading stories online is convenient, accessible, and environmentally friendly. It also exposes you to a broader range of Bengali literature.
A well-curated Collection Bangla Golpo connects us to our roots while embracing the future. Whether you’re a reader or a writer, now is the best time to explore the vast world of Bengali Stories Collection available online. Dive into Shabdodweep Web Magazine today and experience Bengali literature like never before!
Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio