Web Story in Bengali – Shibaprasad Purakayastha
ঝাড়খণ্ডে আটদিন – শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ
২৫শে ডিসেম্বর। সকল ৬-৫এ হাতিয়া এক্সপ্রেসে, রাঁচির ষ্টেশনে পৌঁছলাম। ষ্টেশনে নেমে চারদিকটা একনজরে দেখে নিলাম। হালকা অন্ধকার ভাব। কুয়াশায় যেন ধোঁয়া আটকা পড়েছে। শরীরে ঠান্ডা টের পাচ্ছি। গায়ে গরম পোশাক চাপানো। এখানে আসার আগে যেমনটা ঠান্ডার গল্প শুনেছিলাম, তেমনটা এবারে হয়নি।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ষ্টেশন চত্তর। চলমান সিঁড়ি দিয়ে ওপারে পেরিয়ে গেলাম। পরিপাটি করে সাজানো গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমাদের নির্ধারিত গাড়ির চালক, ইমরান আনসারি। কালোসাদা বড় মাপের রুমালটি নাড়িয়ে নিশ্চিত করলেন। আমরা দুটো গাড়িতে উঠে পড়লাম। কে কোন গাড়িতে উঠবে আগেই ঠিক করা ছিলো। গাড়ি ষ্টেশন ছেড়ে সরু পথের মধ্যে দিয়ে গিয়ে হাইরোডে ছুটে চলল। তখন চারিদিকে শুনশান পরিবেশ। রাঁচি শহরে তখনও অধিকাংশ চোখের পাতা খুলবার সময় হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছুটা পথ যাওয়া পরে কারুকার্য করা অসম্পূর্ণ হনুমানজির মন্দিরের পাশ ঘেঁষে অপ্রশস্ত গলিপথে ঢুকে পড়ল। সামনে চলমান বিজ্ঞাপিত লেখায় হোটেল নটরাজ [Hotel Nataraj] আবাসিক দেখতে পেলাম। পথের পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে এই জায়গাটি কোথায় ড্রাইভার বুঝতে পাচ্ছিল না। যাক শেষ পর্যন্ত পাওয়া তো গেল।
পীযূষবাবু ফোনের পর ফোন করে হোটেলের দরজা খোলালো। দেখলাম দায়িত্বে যাকা কম বয়সি দুই ছেলে চোখ কজলাতে কজলাতে দোর খুলে দিল। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে চলেছি ঠিক তার দুহাত দূরে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমচ্ছিল এরা। যে যেখানেই ঘুমুগ্যে না, আমরা পয়সা দিয়ে ভালো পরিসেবা পেলেই হলো। পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। অবশ্যই ওদের নির্দেশে। এখানে আমার অর্ধাঙ্গিনী নেই। ঘর বাছাইয়ের প্রশ্ন ওঠে না। সবাই জানে আমি সাহিত্যমনস্ক মানুষ। যে ঘরটাই পাবো তাতেই খুশী। আমাদের কক্ষ পড়েছে চলতি রাস্তার ধারে। আমাদের বলতে, গোপালদা। আমি দাদা বলেই ডাকি। সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভীর। মিশলে বুঝবেন বাইরের খোলস দেখে মনগড়া ধারণা করা ভুল, তা প্রমাণ হবে।
আমাদের কক্ষের ঝুল বারান্দায় আছে। কাচের পাল্লা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে রাঁচি শহরের অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পুরোনো পাকা জরাজীর্ণ বাড়ির পাশাপাশি হাল আমলের ঝকঝকে বহুতল আবাসিক। বিভিন্ন নামে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যেহারে জায়গার দাম বাড়ছে। প্রোমটারের থাবা থেকে পুরোনো বাড়িগুলো বাঁচানো কতদিন যাবে। আরও কতকিছু মনে আসছিল। এমন সময় দাদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিবু, সকালের ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। দাদার কথা অন্যথা না করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। গরম জলে স্নান সারা হয়ে গেছে সবার। বাইরে থেকে চা এনে গরম জল পানের পর্ব সমাপ্ত। নেতার হাটে দশম ফলস ( Ten Water Fall ) দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। দর্শনীয় স্থানে পৌঁছিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেকটা উঁচু থেকে জলের খরধারা প্রবাহিত হচ্ছে। অমি, ডাক্তারবাবু ও ঈশানী অনেকটা নিচুতে নেমে গেলাম। ঝর্ণার জল ছুঁয়ে ছবি তুললাম।
দ্বিতীয়বার পাঁচমুখী বা পঞ্চঘাঘ জলপ্রপাত ( Panchghagh Water Fall) লক্ষ্য করার মতো। এর বৈশিষ্ট্য আবার আলাদা। এই ঝর্ণাটি যে পাথর খণ্ডগুলো মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অনেককিছু মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি পাথরখণ্ড আড়াআড়ি ভাবে আছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে তার অবস্থান। এই পাথরগুলো দেখে আমার যা মনে হয়েছিল সেটাই বলি। স্বকর্মে যুক্ত ব্যক্তিরা তার প্রিয় বস্তু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে। চকখড়ির আকার।গ্রন্থের আদল। আস্ত কাঠের গুঁড়ি। আরও কতো বিচিত্র রূপে পড়ে থাকা পাথরগুলোকে কল্পনায় ভেবে নিতে পারি। যেমন বৈকালিক অস্তগামী ভাসমান মেঘগুলো এক দৃষ্টে দেখলে প্রতিমুহূর্তে কতকিছু চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়।এই পঞ্চঘাঘের পাথরখণ্ডগুলো তেমন।
সারাদিনের পাহাড়ি ঝর্ণা দেখার আনন্দ নিয়ে রাঁচি শহরের মধ্যে দিয়ে রাঁচিতে অবস্থিত আবাসের দিকে চলেছি। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। এখন বিবেকানন্দ রকে বিপরীত দিক দিয়ে ফিরছি। বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ মর্মর মূর্তি জলাশয়ের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান। হনুমানজির মন্দিরে সকালে যেখানে ফাঁকা পড়ে ছিল এখন নেই। সেখানে চার’চাকার ঠেলা ডালায় গরম পোশাকের ঢালাও ব্যবসা চরছে। তাই আমাদের গাড়ি উলটো দিকের পথে গলির মধ্যে ঢুকেছিল। ভেবেছিলাম সকালের মতো ভুল পথে ঘুরছে নাকি। আমাদের খাবার হোটেল হনুমানির মন্দিরের পিছনে। সরু পথ পেরিয়ে এই হোটেলটি। আমরা খাওয়ার আগে ও পরে পোশাকের বাজারে ঘুরলাম। দামও করলাম। ভীষণ ভালো সোয়েটার অনেক কম দামে এখানে পাওয়া যাচ্ছে। যখন দেখছি একে একে দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে, আমরাও রাত্রি যাপনের জন্য আস্তানার দিকে পা বাড়ালাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে।
২৬শে ডিসেম্বর। দাদা, ভোর পাঁচটায় প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিয়েছে। সাহিত্যসম্মেলনে যাওয়া শান্তিনিকেতনে প্রাতঃভ্রমণের ভূত রাঁচিতে ভীষণ ভাবে মাথায় চেপে বসেছে। সেখানেও এই অধম সঙ্গী। আমি বললাম দাদা ওরা এখনো গেট খোলেনি। আমাদের সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে।
— চল, না গেলে খুলে দেবে কি? বাইরে এসে ঘুমিয়ে কাটালে, বাড়িতে থাকতে কি হয়েছে। -আমি তা বলছি না।
— কিছু বলতে হবেনে, চলো নিচে যাই।
হালকা আলোর মধ্যে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলাম। নিজেরাই গেট খোলার নিষ্ফল চেষ্টা চালালাম। ওপরে উঠে যাবো কিনা ভাবছি। রিসেপশানের ওদিকে থেকে মেঝে ফুঁড়ে কেউ যেন উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘উধার নেহি’ বলে অনেকটা দৌড়ে যাওয়ার মতো করে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। আমরা ভাবছি ‘উধার নেহি কিউ, ইধার যানা পড়ে গা’ বাংলায় কিছু বলে গেলে নিরাপদ বোধ করতাম। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কী করব এখন। যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে যাবো কি?
এমন সময় ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কোথাও নয়, প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়েছিল।এসে জানালো, সামনের দরজা খোলার এখনো সময় হয়নি। দাদা তাকে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিলেন। প্রাতঃভ্রমণের জন্য বাইরে যেতেই হবে। আমি বুঝতেই পারলাম না। দাদা তো নির্মল বাংলায় শব্দগুলো উচ্চারিত করলেন। যেখানে ছিটেফোঁটা হিন্দিভাষার টান নেই। আমাকে তো সুযোগ পেলেই বলেতে ছাড়ে না, ‘শিবু লেখালেখি করছ, বাইরে বেরুচ্ছ। একটু আধটু অন্তত হিন্দি বলতেই হবে’। দাদা ছেলেটাকে আচ্ছা করে বোঝাচ্ছিলেন। হোটেলে বিভিন্ন ভাষার মানুষজন নিয়ে তাদের কাজ করবার। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বাধ্য হয়ে বাথরুমের পাশ দিয়ে পথ দেখিয় দিল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাষার বেড়াজালে থেকে মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখন পথে বেরিয়ে হনুমানজির মন্দিরের দিকে যেতে থাকলাম। রাতের খাওয়া হোটেলের সামনে দিয়ে হনুমানজির বিপরীত দিকে মন্দিরের গা ঘেঁষে চায়ের দোকান। সেখানেও দাদা নির্মল বাংলায় শারীরিক ভাষা সহযোগে দোকানীকে বুঝিয়ে দিলেন। ‘দু’কাপ চা দিন আমরা এখানে খাবো। দশ কাপ আপনাদের কোনো জায়গায় দিন নিয়ে যাবো। আমরা পনেরো জন নটরাজ হোটেলে আছি। আরও অনেক কাপ চা লাগবে। বোঝানোর পালা প্রায় শেষ, এখন অপেক্ষায় থাকা।
এই সুযোগে দুএকটি কথা জানিয়ে রাখি। হনুমানজির মন্দির বলছি বটে। আদপে কয়েক তলা বিল্লিং। যখন বাদ্যযন্ত্র বাজে বহুতল কাঁপে। এই কাঁপন ভক্তদের কাঁপায় বলে তো প্রণামিতে কৃপণতা করার অবকাশ থাকেনা। মন্দিরের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখেছি। একভদ্রলোক শেতবস্ত্র পরিবৃত হয়ে, হাতে চামর নিয়ে মনে হয় ছোটাছুটি করছে ভিতরে। কী বলব কাশ্মীরী আপেলের মতো গায়ের রঙ। আর ভক্তদের রুক্ষ্ণ শরীর না হলে তো ভক্তি মাঠে মারা যাবে। ধর্মব্যবসায় কতকিছুর প্রয়োজন হয়। ভাবলে অবাক হতে হয়। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সকালে এখানে পাইকারি সবজির বাজার। এখন থেকে ছোট ছোট দোকানীদেরে প্রয়োজন মতো কিনে নিয়ে যায়। সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। সন্ধ্যায় মন্দিরের ওপরে গরম পোশাকের অস্থায়ী দোকান আগের দিন জেনে গেছি। আমরা চা বিস্কুট খেয়ে, ফ্লাক্সে চা নিলাম । এখন ওপরে ওঠার মুক্ত দরজা পেয়ে গেলাম। ততক্ষণে নটরাজে নটরাজের নৃত্য শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈশানী অস্থির করে তুলেছে, দাদাই দাদাই করে। দাদাকে দেখে শান্ত হলো।
কাজলদিকে দিদি’ই বলি। দুজনের দেখে জানতে চাইল, “বাবুরা সব কোথায় গেছিলে।” যখন জানল সকালে বেড়াতে। চা বিস্কুট খেয়ে অল্প চা নিয়ে এসেছি। চায়ের সঙ্গে যার যা সঙ্গে ছিল খেয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের গাড়ির চালক ইমরানদা। আমার নাম যে শিবু জেনে গেছে। রাঁচির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন। আমাকেও শিবু সোরেন নামে মজা করে ডাকতে শুরু করেছে। আমিও মুচকি হেসে উপভোগ করছি। যাইহোক দুটো গাড়ি ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। আমরা হুড্রু ওয়াটার ফলস (Hundru Water Fall) দেখার জন্য মূল জায়গায় পৌঁছে গেলাম। এখন ঝরনা দেখতে যাওয়ার জন্য যাওয়া-আসায় মোট ১৪৮৪ টা পোটে ভাঙতে হবে। শুনে প্রথমে দিদি ও পীযুষাবু না করে দিল। অনেকেই মনের জোরে নামতে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত নামতে পারেনি। অতৃপ্ত মনে উঠে আসতে হয়েছে।
আমি নেমে গিয়েছিল শেষ ধাপে। যেখানে সবাইকে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড ভাবতে হবে এবার কী করবে। ‘ওই দেখা যায় বাবার মন্দির’ বলে প্রণাম করে ফিরবে। না ঝরনা প্রপাতের তলদেশে গিয়ে দাঁড়াবে। বিপদ যদি হয়, সেই বিপদের সম্ভাবনা এবার প্রবলভাবে রয়েছে।ঈশানী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারবাবু প্রায় কাছেই আছে। মেয়ে বাবার কাছে আবদার করলো ঘূর্ণিয়মান চাকতির ওপর দাঁড়িয়ে রানিং ক্যামেরায় ছবি তুলল। ঈশানী টাইটানিকের নায়িকা যেভাবে দুদিকে হাত মেলে ছুটন্ত জাহাজে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন পোজ দিয়েছে। ছবি তোলা হয়ে গেলে মনে হবে। আমাদের বড় মেয়ের চারদিকে পুরো পাহাড় গাছপালা সমেত ঘুরছে। এই বয়সে এরাই তুলবে না তো ষাট পেরিয়ে যাওয়াদের মতো ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে। ছোটদের নিষেধের বেড়িতে আটকে রাখলে তারা তা মানবে কেন।
চাকতিতে ঘুরে ছবি তোলা তবে বিপদের ছিলো। ওই ঘূর্ণিয়মান চাকতি বসানো ছিলো ভগ্ন পাহাড়ের কানা ঘেঁষে। মেয়ের ছবি তোলা শেষ। আমি এই সময়টায় ভাবছিলাম কী উপায়ে অসংখ্য ভ্রমণার্থী গভীর খাদে ওপর থেকে ঝরে পড়া ঠান্ডা ঝর্ণার জল নিয়ে কতভাবে যে জলখেলা করছে। কঠিন হলেও সহজে নামার পথে তখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। ঈশানী যেদিকে ঘুরছিল, এদিকে টুকরো টুকরো পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে অনেকের নামতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মেয়ে বলল, ও শিবুমামা চলো ওদিকে যাই। হ্যাঁ বলে পা বাড়িয়ে দিলাম দুজনে। আর পেছনে তাকানোরও সময় নেই। দুজনের মনের ইচ্ছে ওই ঝর্ণার তলায় যাওয়ার। একের পর এক পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে দুজনে চলেছি। এক পাথরে দুজনে নেই। এগিয়ে চলেছি আমি, মেয়ে পেছনের পাথরে। মেয়ের পায়ে সু। আমার পায়ে নতুন চামড়ার জুতো। জুতার তলার খাঁজ ক্ষয়ে যায়নি। মেয়েকে বলে দিয়েছি। হঠাৎ শরীর টলে গেলে হাত ছড়িয়ে বসে পড়বে। যেন পাকা প্রশিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে ভাবছি। হঠাৎ আমি পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেলাম। এই দুর্গম পাহাড়ে অল্পতেই বেঁচে গেলাম। একটু থেমে আরও একটি পাথরখণ্ডে পা বাড়াতে যাবো সেই সাহস নিয়ে আর পারলাম না। কিন্তু থামলে চলবে না। লক্ষ্য স্থির আছে।
ওপর থেকে আমার নাম ধরে ফিরে যাওয়ার ডাক শুনতে পেলাম। কার গলা আবার, দাদার। আর দু’তিনটে পাথরের চাঁই পার হলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। দাদা তো পোটের সংখ্যা শুনে নামতে নারাজ ছিল। কখন এলো। বাৎসল্য কতটা দুর্বল করে করে দিতে পারে দাদাকে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। ওইযে দুটো মেয়ে কৌশানী ও ঈশানী বাবা মায়ের সঙ্গে গেলেও দাদাইয়ের মনে সর্বদা সংশয়।যদি কোথাও বিপদ হয়। আমি ঈশানীকে বললাম। মা তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি একা ঘুরে আসছি। পারলে ওখান থেকে ছবি তুললে তুলতে পারো। যেভাবে নেমেছিলাম সেই ভাবে ওপরে দুজনে উঠে গেলাম। কৌশানী ঝাঁকে মিশে গেল। কিছু কেনাকাটায়, খাওয়াখায়িতে সঙ্গীদের অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি কোথাও হ্যাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। ধাপে ধাপে একাই এগিয়ে চলেছি। যা ভালো লাগছে ছবি তুলছি। পথের চওড়া রেলিং-এ আশপাশের পাহাড়ি বন থেকে সংগ্রহ করা গামার কাঠ। সেই কাঁচা কাঠে তলোয়ার তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছে বেচার জন্য। সংগ্রহ করে আনা ফল, ফুল ছাড়াও স্থানীয় কতকিছু জিনিস পত্র বেচার জন্য খরিদ্দারের মুখ চেয়ে আছে। এইসব দোকান যারা দিয়েছে তাদের দেখে আমার মনে হলো অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষজন। আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন যাপন করে।
এক বাচ্চা মেয়ে হাত বাড়িয়ে কিছু চাইছে ভাবলাম। না চাইছে, তার সৃষ্টি সে বিনিময় করতে চায়। ছোট্ট কাঠের টুকরো যাকে সে তলোয়ার বলছে। কিছু শিল্পীর ছবির তলায় না লিখে দিলে কীসের ছবি বোঝা যায়না। ওই বাচ্চা মেয়টি অস্পষ্ট ভাষায় তলোয়ার না বললে সত্যি কিছুই বুঝতাম না। তলোয়ার নামক কাঠের টুকরো দশ টাকায় আমার কাছে বেচতে চায়। ইচ্ছে না থাকলেও দশ টাকা দিয়ে ওটা কিনে বাড়িতে এনেছিলাম। আমার ওই মেয়টির বয়সী নাতি খেলনা মনে করে কী খুশী না হয়েছে। কদিন ওটাই হাতছাড়া করেনি। শয়নে, স্বপনে, খেলার অঙ্গনে হাতের কাছে রাখেছে। আমি তলোয়ার ছাড়া আর কিচ্ছুটি কিনিনি। হিড্রু জলপ্রপাত দেখে বা না দেখে সবাই একত্র হলাম। ওখানকার পথের হোটেলে খেয়ে গাড়িতে বসলাম। এখন চলেছি জোহানা ওয়াটার ফলস (Jonhana Water Falls) দেখার জন্য। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে ওখানকার দোকানীদের থেকে ফলমূল কিনে খাওয়ার ব্যস্ততায় কিছুটা সময় কাটালাম। এবার ধাপে ধাপে ওপরে উঠে দেখলাম সুন্দর পার্ক বানানো। পার্কের ভিতর থেকে এগিয়ে গেলাম ঝর্ণা দেখার জন্য। বাঁদিক ঘুরে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি কতো নিষেধ নির্দেশিকা মেনে। প্রথম বুঝতেই পারিনি ঝর্ণা কোথায়। কতদূর গেলে দেখতে পাবো। আমাদের পনের জনের কে কার কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। এমটা অন্য কোথাও হয়নি। শারীরিক অক্ষমতা মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখছি সামনে দিদির সঙ্গে অনেকে বসে আছে। সামনের একটা দল এগিয়ে গেছে। আমি সামনে পেছনে না ভেবে একাই চলতে শুরু করেছি। বুঝে ফেলেছি এখানে দ্বিতীয় পথ নেই। যারা বসে আছে,আর যারা ঝর্ণা দেখতে গেছে তাদের জন্য অপেক্ষা করবেই। পৃথিবী গোলের তথ্য এখানে খাটবে।
আমি গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম খুব উচ্চ থেকে ঝর্ণার জল ঝরে পড়ছে। আমার মনে হলো হুড্রুর থেকেও অনেক উঁচু। সামনে ঝুলন্ত সাঁকো। দেখতে পাচ্ছি পিঁপড়ের সারের মতো ভ্রমণকারীরা যাতায়াত করছে। এই ঝুলন্ত পাহাড়ি পথে দুই পাহাড়ের মানুষজন যাতায়াত করতে পারে, করেও শুনছি। এক সময় মাওবাদীরা ওই পথটাই নিজেদের অসৎ কাজে লাগিয়েছে। আমি আর এগিয়ে না গিয়ে মাঝ পথে,পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ি ঢালে নিচে নেমে গেলাম। ওই তো ঝর্ণার জল বয়ে চলেছে আমার সমন দিয়ে। একদম কাছে না গেলেও স্পষ্ট ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছি। পাথরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। জলে হাত দিয়ে দেখছি বেশ ঠাণ্ডা। পা ডুবিয়ে নিলাম। কতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। কে কোথায় আছে জানিনা। এখন আমি একা, সত্যি আমার একা লাগছে না। গাছপালা ,মাথার ওপর খোলা আকাশ, পায়ের তলায় প্রবাহিত শীতল জলধারা আমার আপন হয়ে উঠেছে।
হঠাৎ ঘোর কেটে গেল। কে কোথায় অপেক্ষা করছে বুঝতে পারার কথা নয়। তাড়াতাড়ি সংকীর্ণ পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক গলে ওপরে উঠে এলাম। ফেরার পথের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম দিদিরা উদ্বিগ্ন। কী ব্যাপার জানতে চাইলাম। মানতু, মহুয়া তারা কে কোথায় কেউ বুঝতে পারছে না। সামনের ওই ঢাল পথে নামতে নামতে দেখেছে সবাই। ওভাবে দুটো মেয়ের যাওয়া উচিত হয়নি। মাওবাদী গন্ধ আছে। পণবন্দী করে দাবী পূরণ করতে পারে। অনেকক্ষণ থেকে আবার ফোন ধরছে না। কী হলো বুঝতে পারছি না। অতো গড়েনে কেউ নামতে সাহস পাচ্ছে না। আমি বললাম নেমে দেখছি কোথায় গেছে। চারদিকে নজর রেখে সাবধানে নামছি। ওইতো প্রবাহিত ঝর্ণার শীতল জলধারা পাথরের নুড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে চলেছে। আর কোথায় নেমে খুঁজবো। তবে বেশ কয়েটা বড়ো পাথরখণ্ড সামনের কিছুটা জায়গা আড়াল করে আছে। আমি তার ওপর দিয়ে খাদের জল দেখছিলাম। নিচের দিকে লক্ষ্য পড়লো, গায়ের সোয়েটার ঝাঁটি গাছের ওপর পড়ে আছে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। দিদির কাছে ফোন করেছি। কানে রিং-এর শব্দ শুনতে শুনতে চলেছি। তেমন হলে ফোন কেড়ে নেওয়ার আগে দুঃসংবাদ জানাতে পারব। পাথরের বাধা দৃষ্টি থেকে সরে যেতে দেখি মানতু জেগে থাকা পাথরে বসে আছে। ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে। দুহাতে জল ছিটুচ্ছে। কি বলব, কী সুন্দর দেখতে লাগছিল। যেন কোন রাজকন্যা সখীর সঙ্গে নিয়ে জলখেলা করছে। গুটিয়ে নেওয়া বসনে মুক্ত চরণ স্বচ্ছ জলে মুক্তর মতো মনে হচ্ছে। তবে সঙ্গীটি জল খেলছে না। সম্ভবত ঘষে পায়ের ময়লা তুলতে। দেখে মনে হলো সময়ের অপচয় করেন না। এতো দূরে এসেও হিসাব বরাবর রেখেছেন। নতমুখে উভয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মনে হলো আমাকে দেখতে পায়নি। আমি তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইলাম। মানতু আমাকে ডাকল, ও- শিবেনদা, চলে যাচ্ছো?
— তোমাদের খুঁজতে এখানে আসা। তবে এসো আমি যাই।
— কী যাই, আমাদের ছবি তুলবে না। দেখতে খারাপ বলে।
এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। দাদার কাছে বোনেরা ভালো মন্দ দেখতে হয় না। জড়তাহীন ভাবে বললাম,”বললে তুলব।” আমি নিচে নেমে ওদের কাছাকাছি গেলাম। মানতুর কতরকমের ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে হলো। মহুয়া বোনের ছবি না তোলার অর্থ একযাত্রায় পৃথক ফল। তা কি করে সম্ভব। ছবি তোলার সময় কোনপ্রকার অঙ্গভঙ্গির অবতারণা করেননি। ছবি তুলতে হয় তাই তোলা। খুব সাদাসিধে মনের। আর মানতু ভীষণ আমুদে, হাসিখুশিতে থাকতে অভ্যস্ত অন্য আর এক মেয়ে।
জোহনা জলপ্রপাতের দিক থেকে এসে বাড়ির পথে গেলাম না। বিপরীতে এগিয়ে গেলাম। সবাই খাদের পথ ধরে নিচে নামার সাহস দেখায়নি। পথের পাশে লেলিং-এর ওপর বসে আনন্দ উপভোগ করছে। আমাদের একই গোঁ নিচে নামার। ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধে মতো সরু পাথুরে পথে এগিয়ে গেলাম। এখানে রোপওয়ে সিস্টেমে আছে। অনেকে উঠছে। এখন এই সফরে বুটু থাকলে ঈশানীকে আটকানো যেতো না। পাথরের ওপর দিয়ে জলাধারের কাছে তো যেতে পারি। মেয়ের ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা। এখানে দাদার নিষেধ থেকে অনেকটা দূরে আছি। ডাক্তারবাবুর কথায় ঈশানী থামবে না। বেলা ডুবতে বসেছে দুঃসাহসিকতা দেখানো ঠিক নয়। মেয়েকে বললাম যাওয়া ঠিক হবেনা। চলো ফিরে যাই। ৪:২৪শে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটল হোটেল নটরাজে।
২৭শে ডিসেম্বর। ৯:৪২শে সূচি অনুযায়ী ভ্রমণ শুরু হলো। প্রথম রাঁচির মানসিক রুগীদের হাসপাতালে। আমাদের দুটো গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকলো তবে নামার অনুমতি ছিলনা। বিশাল এরিয়া। ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন তাঁর বাড়ি পেরিয়ে রক গার্ডেনে ঢুকলাম। একনজরে ঘুরে নিলাম। এবার পাত্রাতু লেক (Patratu Lack Resort. Patratu) ঘুরলাম। পরিপাটি করে সাজানো। আদিবাসীর যুগলমূর্তি দেখার মতো। যেন শিল্পীর তৈরি নয় বাস্তবে দেখছি। টিকিট কেটে হাইস্পিড বোটে লেকের মধ্যবর্তী পর্যন্ত পাক দিয়ে এলাম। বিশাল এরিয়া নিয়ে এই জলাধারটি। দেখলে ভয় পাওয়া মতো বটেই। ফেরার পথে কিং রেস্টুরেন্টে ওই পাত্রাতু লেকের থেকে ধরা মাছ আর ভাত খেয়ে নটরাজে ফিরলাম। রাতে অর্ডার দিয়ে খাসির মাংস ভাত খেয়ে সেই রাতটা হোটেলে কাটালাম।
২৮শে আগস্ট। সকল ৬:৩০শে চলেছি বেলতা ন্যাশনাল পার্ক (Belta National Park) অভিমুখে। এখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে। ট্রেন লাইনের আগে গাড়ি সারবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। শুনলাম মালট্রেন পার হবে। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটি মালট্রের জুড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখছি গেট খুলছে না। রাঁচির দিক থেকে আসা আরও একটি পার হলে তবেই খুলবে। ঘন জঙ্গলে হাড়হিম করা পরিবেশ। এইসব দুর্গম জঙ্গলে দুষ্কৃতির আড্ডা। তারা এমন সুযোগে নিজেদের কাজে লাগায়। যাক গেট উঠে গেল, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নানা ভাবে পথে অনেকটা সময় হয়ে গেল। এদিন আর বেলতা ফরেস্ট দেখা হলো না। তেলতা ফরেস্টর বিশাল গেটের সামনে হাইওয়ে। ওই রাস্তা পেরিয়ে হোটেলে পার্ক ভিউতে ( Hotel Park View) বতর্মানে থাকার জায়গা। দুখানা বাথরুম সহ হলঘরে (Dormitory) এগারো খানা পাশাপাশি বেডের ব্যবস্থা আছে। আমরা বারোজন একে একে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এখানে বেশ ঠান্ডা অনুভব করছি। জানালার কাচ দুটো পাল্লায় ভাঙা। আপাতত কাগজ দিয়ে আটকানো হলো। অফিসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পীযূষবাবু থাকবেন আর মজা হবে না তা কি করে হয়। কার কোথায় ত্রুটি সেই নিয়ে ঘোটপাকিয়ে মজা করার উপাদান বের করে তবে ছাড়বে। এইভাবে একঘরে থাকার এটাই সবচেয়ে আনন্দ উপভোগের মজাদার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দীপ রেস্টুরেন্টে থেকে রাতের খাবার দিয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৯ শে আগস্ট। বেলতা ফরেস্ট সাফারি, ৭:৩০ থেকে ৪:৩০ এই সময়ের মধ্যে দেখাশোনা করিয়ে গেটের বাইরে ছেড়ে দিল। জিমকরবেট জঙ্গলের থেকে বেশ খোলামেলা। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। হরিণ আমাদের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি বুনো শেয়াল রাত-দিন গুলিয়ে ফেলেছিল। আমাদের প্রথম গাড়ি যেতে দেখে ছুটে পালালো। বানরের লাফালাফি বনের থেকে সদর রাস্তায় গেটের সামনে বেশি। বানরের দৌরাত্যিতে হাতে কিছু রাখার উপায় নি। তবে দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের লুকিয় চুরিয়ে খেতে কষ্ট হয় এই যা। এবার দীপ রেস্টুরেন্ট থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সবাই নয়। ডেলটাগঞ্জের দুবিয়া খাঁড় মার্কেট এবং পরসা নদী তার ওপর দীর্ঘ ব্রিজ দেখার মতো। বালি মাড়িয়ে নদীর জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা ডুবিয়ে কিছু দূর পর্যন্ত হাঁটলাম। স্বচ্ছ জল হাতে মুখে দিলাম। যে যার মতো ছবি তুলে ডেরায় ফিরে এলাম।
দুপুরের খাওয়া সেরে পালামৌ ফোর্স দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। মূল রাস্তা ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় চলেছি। সরু ঢালাই পথ। রাস্তার ধারেই সাধারণ মানুষের বাড়ি। ধারের ক্ষেত । সবজির বাগান। ক্ষেত খামারে মেয়ে মদ্দ কাজে ব্যস্ত। গাড়ির মধ্যে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। বেশ ভালো লাগছিল দেহাতি গ্রাম্যচিত্র দেখতে। গ্রাম ছাড়িয়ে যাওয়ায় আর ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না। ঘন বনের মধ্যে ঢুকছি ক্রমশ। দুদিকের ঘন ঝাঁটি গাছ যেন ভিতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। কেন জানিনা তেমনটাই মনে হচ্ছিল। ফিরতি গাড়ি সামনে আসতেই কেউ কাউকে পথ ছাড়তে পারছিল না। সরুপথ দিয়ে গুঁতাগুঁতি করে পার হয়ে গেল। আমাদের দুটো গাড়ি এক পদ্মপুকুরের কাছে দাঁড় করালো। এই পুকুরটিতে এখানকার রানি স্নান করত। পাহাড়ের ওপর এই ঐতিহাসিক পুকুর দেখার জন্য সুন্দর ওয়াচটাওয়ার বানানো হয়েছে। আমরা অনেকে চক্কর কেটে আসলাম। এবার পালামৌ ফোর্ট দেখার পালা।
ভ্রমণার্থীরা প্রথম যেখানে এসে সবাই দাঁড়ায়। আমরা সব্বাই সেখানেই এসে দাঁড়ালাম। ছাদ খোলা বেশ চওড়া চওড়া প্রাচীর কয়েক মানুষ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভেতর যাওয়া যাবেনা গাছের জঙ্গল বসে গেছে। আমাদের ঘোরাফেরার মধ্যে চোখে পড়ল পাথুরে সিঁড়ি। দেখে বুঝলাম উপরে ওঠা যায়। আমি, ডাক্তারবাবু, কৌশানী সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম। নানা আমরা ভাঙেনি ভাঙা ছিলো। তলাতেই বোঝা যায়না। প্রাচীরগুলোর মাথা বেশ চওড়া। পথের ধারে এমনভাবে ঘেরা ওপর থেকে নিচে দেখা যাবে। নিচে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। সন্ধানী দৃষ্টিতে নিজেদের মতো ধারণা অনুভব করে নেমে এলাম। তবে মন চাইছিল না নামতে। আর কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো।
এই ধ্বংসাবশেষের বিপরীতে চলতি পথে দাঁড়ালে পাহাড়ের অতো উপরে বিশাল পাথুরে বাড়ি প্রায় অক্ষত। ওঠার তেমন ভালো পথ নেই। পূর্ব এখনকার মতো পাথরের টুকরো ছড়ানো ছিলোনা তাও কী করে বলব। তলায় কয়েকটি সুড়ঙ্গ দেখেছি। ভিতরে খানিকটা ঢুকে বেরিয়ে আসি। সম্ভবত ওখান থেকেই ওপরে ওঠার পথ আছে বলে আমার ধারণা। যাইহোক লড়াই করে ওপরে উঠে আমরা তিনজন কী দেখলাম সেটাই বলি। সামনে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা। সমান্তরাল দীর্ঘ প্রাচীর। দশ ফুট উচ্চতায়, ছয় ফুটের মতো চওড়া কপাট। দরজা নষ্ট হয়নি। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম ছমছমে,থমথমে ভাব নিয়ে। ভেতরের ঘরগুলো দেখে গৃহস্থালির বলে মনে হল না। আমরা প্রথমে যেখানে উঠেছিলাম, হলে ওটাই রাজাবাড়ি। এখন থেকে নজরদারী করার মূল ডেরা। আমরা এখানেও পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছি। বাইরে প্রাচীর ভাবছিলাম, এ যেন চীনের প্রাচীর। যেখান থেকে অনায়াসে পাহারা দেওয়া যায়। আমরা দেখলাম পতাকা দেওয়ার বেদী আছে। যেখানে পতাকার দণ্ড পোঁতর মতো ছিদ্র করা আছে। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিলাম, দ্বিতীয় সিঁড়িতে নামলাম। এই পালামৌ ফোর্স পুরোপুরি পাহাড়ের শেষ প্রান্তে। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সমতল। আরো অনেক দেখার ছিলো সম্ভব হলো না। সূর্য ডুবতে বসেছে। এবার ফিরতে হবে গভীর জঙ্গল এলাকা ছেড়ে।
৩০শে আগস্ট। বেলতা ছাড়লাম ৬:৩০শে। গভীর জঙ্গলের পথ ধরে চলেছি। অনেকটা আসার পর ৭ :০৮এ ডালটন আপডাউন করায় বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। এবার দুর্বাড্রাম দেখলাম। জলে টলমল করছে। নেতারহাট(Netarhat) দেখার জন্য টিকিট কাটতে হলো। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ি ঢালের কাছে। সূর্যাস্ত দেখার আকর্ষণীয় সুন্দর জায়গা, ( Magnotic Sun-Set Point) চোখ ফেরানো যায়না। এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার উপায় নেই। আজ সন্ধ্যায় রাঁচির ষ্টেশনে পৌছাতে হবে। ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য।
বাঘমারির জঙ্গলে – শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ [কিশোর গল্প]
প্রশান্তকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি বড়ো হয়েছে। এ বছর বড়ো ইসকুলে গেছে এইযা। তাকে কি এমন বড়টা ভাবা যায়। সেই ছেলে কোথায় আর যেতে পারে। অনেকের মুখে অনেক কথা শুনছে। সেটাই তো ভয়ের, যে জেদি ছেলে। বেলা প্রায় ডুবতে বসেছে। আবার যে কখন ফিরবে, কে জানে। তবে যেখানে থাকুক না, সন্ধ্যার আগেই ফিরবে তো! মায়ের মন কোনোভাবে প্রবোধ মানছে না।
প্রশান্তর কাকা খবরটা এনেছিল,গতরাতে পঞ্চমের হাট থেকে ফিরে। বাঘমারির জঙ্গলে বাঘ ঢুকেছে। তবে কয়েকদিন আগের ঘটনা। দমকলের ওদিকটায় সকলে ভয়ে ভয়ে রাত কাটাচ্ছে। রাতে পটকা ফাটাচ্ছে। আগুন জ্বালিয়ে ভয় দেখাচ্ছে বাঘ মামা’কে। এতো করেও নিশ্চিতে কেউ নেই। কখন কার ঘাড়ে হালুম করে পড়বে কে জানে। লোকালয় তো বাঘের নাগালের মধ্যে এখন। সুন্দরবনের বাঘ বলে কথা। পেটে খাদ্যের টান পড়লে দেখছি আজকাল প্রায় নদী ঝাঁপিয় এপারে আসে। এসেছেও এর আগে, না এলে বাঘমারি নাম হলো কি করে। যেমন বাগদিমারি। সুতি নদীতে কুমির ঢুকে এক জেলেবাগদিকে টেনে নে’যায়। এইভাবে ওখানকার নাম বাগদিমারি। এখন সেই নদী মজে গেছে। সেখানে এখন শ্মশান গড়ে উঠেছে। তেমন সুন্দরবনের লোকালয় ঘেঁষা ছোট্ট দ্বীপের নাম বাঘমারির জঙ্গল।
প্রশান্তর মনে ধরেছে কাকুর যে কথাটা। আগামীকাল বাঘমারি ঘেরাও করবে। যেভাবে হোক বাঘের বন থেকে তাড়াতেই হবে। গুলি করে মারার অনুমতি নেই। আইন বিরুদ্ধ কাজ। পশু সংরক্ষণ আইন খুব কড়া। দলবেঁধে বনের মধ্যে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায়না। তবুও বনের মধ্যে ঢুকবে। প্রশাসনকে উপেক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত কী হয় ওখানে গেলেই বোঝ যাবে। যেভাবে হোক প্রশান্ত ওখানে পৌছবে। আগু-পিছু না ভেবেচিন্তে বেরিয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে না কাউকে সঙ্গে নিয়েছে কি না।
শীতের সকল। মাঠে বর্ষার ধান কাটা হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো নাড়া মাঠময় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ বাদায় খেঁসারি কড়াই বোনা। নাড়ার গা’ধরে দাঁড়িয়ে, ফলফলে কড়াই গাছ যেন উঁকি দিয়ে আকাশ দেখছে। ফলে ফুলে ভরে আছে। কড়াই গাছ মাড়িয়ে হেঁটে চলেছে। দু’চারে কড়াই শুঁটি সমেত গাছ তুলতে ভুলবে কেন। কাঁচা কড়াই খেতে খেতে মজা করে যাওয়া। একেবারে ফাঁকা মাঠ নয়। পানের বরজ। সিমের মাচা। ঢ্যাঁড়সের বাগান।লঙ্কার বাগান। কোথায় ঘিরে রাখা নেই। ঘন গাছপালা দেখলে ভয় করে। ওখানে বাঘ গা’ঢাকা দিয়ে ওঁৎ পেতে বসে নেই তো? থাকতেও পারে। আবার নদীর ধারধরে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। গেঁওয়া বানির ঘনবন। ভয় তো হবেই। যতটা সাবধানে থাকা যায়। ভয় আছে জেনে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। যদি প্রাণের ভয়কে প্রাধান্য দিতে হয়, এখন থেকে বাড়িতে ফিরতে হয়। সে তো জঙ্গলে ঢুকবে ঠিক করেই এসেছে। ভয়কে জয় করে এগিয়ে যেতেই হবে দৃঢ় সংকল্প। বাড়ির কাউকে বলে বের হয়নি। ফিরে গিয়ে জানাবে।
প্রশান্ত লোকালয় ছাড়িয়ে গেছে। নদীর বাঁধ অনেকটা সামনেই। একটা দোচালা কুঁজি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। মাছের ঘেরি মোনার জন্য এই দোচালা কুঁজি। একটি লোক বসে জাল বুনছে। লোকটির থেকে জানতে পারল, এই ঘেরির নরম কাদায় বাঘের থাবার দাগ এখানো আছে। দেখল হুবহু বিড়ালের পায়ের ছাপ যেন। আকারে বড়ো এই যা। এই জন্য তো বাঘকে বিড়ালের মাসি বলে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে ভয় হলো। কৌতূহল আরও বেড়ে গেলো। দ্রুত পা চালিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল।গন্তব্যে পৌঁছে দেখল মেলা বসেছে নদীর এপারে। তখন একটার মতো বাজে। নদীতে ভাটা। জল তলায় নেমে গেছে। তবুও নদী পেরুতে নৌকা লাগবে। প্রশান্ত না দাঁড়িয়ে একহাঁটু গদের মধ্যে নেমে পড়ল। তার বয়সি অনেক ছেলে রয়েছে। তাদের কেউ যাওয়ায় নিষেধ করেনি। তবে তার বাধা কোথাও নেই।
প্রশান্ত মোটামুটি ভৌগলিক চিত্র বুঝে গেছে। উত্তরে মৈইপীঠ। দক্ষিণে দমকল। যেখানে দাঁড়িয়ে বাঘের গর্জন এপার থেকে শোনা যায়। এই দমকলে মেজ পিসির বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে কয়েকবার এসেছে। এখন নদী পেরিয়ে বাঘমারিতে উঠতে চলেছে। যেখানে স্থানীয় মানুষজনেরা জীবিকার সন্ধানে আসতো। মাছ, কাঁকড়া, ডাগরোল মাছ ধরতে। জ্বালানি কাঠ কাটতে। আর কিছু বিলাসী মানুষ পাখি শিকার করতে সপ্তাহে একদিন তো আসবেই। ছিটে বন্দুক নিয়ে। সেই নিরাপদ বনে হিংস্র বাঘের অনুপ্রবেশ। তাকে চরম শিক্ষা দিতে সশস্ত্র অভিযান। সশস্ত্র বলতে লাঠিসোটা ছাড়া তেমন চোখে পড়ার নেই। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও থাকতে পারে প্রশান্ত চোখে পড়েননি।
বাঘের ভয়ে জনজীবন সন্ত্রস্ত। পঞ্চায়েত উপরমহলে জানিয়েছে। তারাও উপরমহলে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। নদী নিকটবর্তী বসবাসকারীর জীবনের ততটা মূল্যবান নয়।তাই সংকট বার্তা ধীর লয়ে এখন ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। যারা লিখিত বয়ান বন-দপ্তরে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, একটি কথা শুনে এসেছে। যতই ক্ষতি করুক বাঘ মারার চেষ্টা করবেন না। অনেকটা এইরকম শুনিয়ে দিলো- দু’চারটে মানুষের চেয়ে বাঘের মূল্য অনেক। এমন কিছু করতে চেষ্টা করবেন না আইনের রোষে পড়তে পারেন। আমরা দেখছি দ্রুত কতদূর কি করতে পারি। এক সপ্তাহের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। আশ্বাসের বাণীর শীতল স্পর্শে এখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েনি। প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে নেই। হয়তো বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বোঝার মতো এখনো সময় হয়নি। তেমন করে ভাবতেন, বন-দপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না কেন।
মাঠ ভেঙে আসার পথে প্রশান্ত একটা ব্যাপারে লক্ষ্য এড়ায়নি। যতই তুলনামূলক ভাবে ছোট হোক। যাদের ঘাড়ে বাঘের থাবা প্রথম পড়বে। তাদের কোনপ্রকার যেন হেলদোল নেই। স্থানীয় বসবাসকারীদের দেখে স্বাভাবিক আচরণ মনে হয়না। কেমন নিশ্চিন্তে বাগানবড়ির কাজকর্ম করছে। দোকানে বসে পা’ঝুলিয়ে খোশমেজাজে গল্পগুজব করতে দেখা গেছে। তারা ছোটরা মরণপণ করে বাঘের বনে ঢুকতে চলেছে। স্থানীয় লোকেদের তো তেমন উৎসাহ দেওয়ার দায়টুকু নেই মনে হচ্ছে। কাদের জন্যে জীবন বাজি রেখে এসেছে কী জানি বাবা। এদের দেখে প্রচলিত প্রবাদের কথা মনে পড়-‘কাজ সেরে বসি, সত্তুর মেরে হাসি’। যেন তেমন কিছু করে নিশ্চিত হয়ে সবাই বসে আছে। প্রশান্তর এতো জটিলতা বোঝার বয়স হয়নি।
নদী পেরিয়ে অভিশপ্ত চড়ায় এখন প্রশান্ত। একগাছি বন্দুক নিয়ে যে মানুষটা প্রথম সারিতে অজিত ডাক্তারের ছোট ভাই। প্রশান্তের গ্রামের লোক। ইসকুলে যাওয়ার পথে প্রায় দেখা হয়। বিপদের মধ্যে কেউ কারো চেনা থাকেনা প্রশান্ত বুঝে গেছে। কিছুইতে বুঝতে পারছে না আগু-পিছু করে কতজন বাঘের সঙ্গে লড়তে এসেছে। সামনে থেকে কী সংকেত আসছে। পেছন থেকে কী সংবাদ পৌঁছচ্ছে। কিছুই অনুমান করতে পারছে না। সবাই যে কী শুনতে কী শুনে তালগোল পাকাচ্ছে কে জানে বাবা। ছোট বলে সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে স্পষ্ট কেউ কিছু বলছে না।
সুন্দরবন বলতে অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা বিশাল অখণ্ড বনভূমি নয়। বহু বনের সমাহার। বনের কথা বললে দ্বীপের কথা উঠবেই। মূল দ্বীপ ছাড়া অসংখ্য। অসংখ্য দ্বীপ যেমন গড়ে উঠেছে আবার জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছে,গাছগাছালি সমেত প্রাণীকুল নিয়ে। তেমন এক ছোট গড়ে ওঠা দ্বীপ এইটি। যেখানে প্রশান্তর বয়সি দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। এই যে দ্বীপ। যেখানে বাঘ থাকার কথা নয়। বরং জীবীকার সন্ধানে আসা মানুষের অভয়ারণ্য এতদিন ছিল, এখন তা নেই। চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়।
লোকালয় সংলগ্ন বন থেকে বাঘ তাড়ানোর সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি। সবটাই দুর্বল চেষ্টা চলছে বলা যায়। বিশেষ করে রাতেই তো ভয়ের ব্যাপার। সারারাত মাঝে মাঝে পটকা ফাটিয়ে। আগুন জ্বালিয়ে। মুখ দিয়ে বিকট আওয়াজ করে বাঘ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে বেশ কয়েকদিন ধরে। এইযে দিনের আলো থাকতে থাকতে বনের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে যাওয়া এ-ও একপ্রকার বাঘের ঠেকিয়ে রাখা বলা যায় । যাতে বাঘ ভয় পেয়ে নদী সাঁতরে গভীর সুন্দরবনে আবার যাতে ফিরে যায়। কাজ যে একেবারেই হয় না তা বলব না। প্রশান্তরা এসব বুঝতেই পারছেনা বাঘ কোথায় কী অবস্থায় আছে। তাদের আশপাশে ঘাপটি মেরে বসে নেই তো! সুযোগের অপেক্ষায়। ভাবলে গায়ের লোম খাড়া হয় ওঠে। এতো ঘরের পোষা বেড়াল নয়। কিছু ছুঁড়ে দিলে খুশী হবে। অথবা খিদে পেলে খাওয়া জন্য পায়ে পায়ে জড়াবে। মিউ মিউ করে বিরক্ত করবে। বাঘ জানে কী করে ঘাড় মটকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। এমন অলক্ষুণে কথা প্রশান্তর মনে যতই না ওঠে ততই ভালো।
মুহূর্তের জন্য প্রশান্ত ভাবনার মধ্যে ডুবে ছিলো। সবাই তখন ঠেলাঠেলি করে বন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। প্রশান্ত না চাইলেও মুখ ফেরাতে বাধ্য হলো। বন ছাড়ার আগে প্রকৃত সত্য তার জানা হয়ে গেছে। সামনে সবাই যেখানে থমকে গেছিল। ঠিক সেখানেই বিকৃত অবস্থায় বাঘটি পড়ে ছিলো। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া হয়েছে। তুকতাকের কাজে লাগবে বলে। বনে ঢোকার আগে দেখে এসেছিল, বিশাল শরীরের মহিষ। একটি লাঠির গায়ে বাঁধা। বাঘের শিকার হওয়া ক্ষতবিক্ষত মৃত মহিষ। খুব চাপাভাবে মুখে মুখে ফিরছে, ওই মৃত মহিষের শরীরে বিষ ঢেলে দেওেয়া হয়েছিল। বাঘটি বিষাক্ত মাংস খেয়েই মারা গেছে। এই বনে তার অন্য সঙ্গী হয়তো সেও আরও গভীর মরে পড়ে থাকতে পারে। তবে এসব কথা ধারণা মাত্র।
সুন্দরবনের বাঘ যেমন শক্তিশালী। আর নোনা পাতায় চরতে আসা মহিষ শারীরিক ক্ষমতায় কম যায়না। সেই মর্মান্তিক দিনের সূর্যাস্তের আগে বাঘ- মহিষের সে কী লড়াই। নদীর ওপর থেকে শুনেছে মহিষের ভয়ংকর আর্তনাদ। বাঘের গর্জন। বড়ই মর্মস্পর্শী যা ভোলার নয়, শরীরে কাঁপন ধরায়।সবার ধারণা একটা বাঘের পক্ষে সম্ভব নয়। বেকায়দায় পড়ে মহিষটি জীবন দিয়ে থাকতে পারে। সবার মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। সেদিনের পর থেকে আর এপারের মহিষ ওপারে পাঠতে কারুর সাহস হয়নি। তাছাড়া মহিষের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট দেখেছে।
বনের মধ্যে যারা ঢুকেছিল, অনেকের বন্যপ্রাণীর সম্পর্কে বাস্তব ধারণা আছে। বাঘেরা দিনের কোন সময় থেকে শিকারের জন্য প্রস্তুত হয় তাদের জানা আছে। সূর্য পশ্চিমে অনেকটা গড়িয়েছে। এদিকে জুয়ারের জল নদীর জেগে থাকা ঢালু চর ক্রমশ ঢেকে ফেলছে। জল যতই বনের ধার ঘেঁষবে, খোলা জায়গা কমতে থাকবে। তখন জলে কুমির ডাঙায় বাঘের নাগালে পড়ার ভয় প্রকট হয়ে উঠবে। এককথায় উভয় সংকট। প্রাণ নিয়ে ফেরা মুশকিল। যা কানে কানে ভেসে আসছে মৃত সঙ্গী যে বেঁচে নেই কে বলতে পারে? যতই তাড়াতাড়ি বন ছাড়া যায় এখন তার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। নৌকায় ওঠার জন্য প্রশান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ | Shibaprasad Purakayastha
Is Three Mile Island Still Dangerous? | Best Article 2023
Famous Places in Murshidabad | Best Travel Story 2023
Best Bangla Golpo Reading 2023 | তৃতীয় পক্ষ | Nasir Waden
Top New Story in Bangla 2023 | আষাঢ়ের অলি মনোরমা | Tanmoy Kabiraj
Web Story in Bengali 2023 | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Web Story in Bengali pdf | World’s Famous Bangla Golpo Online Reading | Pdf Web Story in Bengali | Natun Web Story in Bengali | Full Web Story in Bengali
Bangla Golpo Online Reading Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Web Story in Bengali Ebook | Full Bangla Galpo online | New Live Bengali Story | New Bengali Web Story – Episode | Golpo Dot Com Series | Horror Web Story in Bengali Video | Horror Live Web Story in Bengali | New Bengali Web Story Audio | New Web Story in Bengali Video | Bangla Golpo Online Reading Netflix | Audio Bangla Golpo Online Reading | Video Web Story in Bengali | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition
Bengali Writer | Bengali Writer 2023 | Trending Web Story in Bengali | Recent Bangla Golpo Online Reading | Top Live Bengali Story | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2023 | Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bengali Famous Story | Web Story in Bengali in pdf | Web Story in Bengali Download | Web Story in Bengali mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection
Web Story in Bengali mp4 | Bangla Golpo Online Reading Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bengali Story – audio | Web Story in Bengali – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Collection Bangla Golpo Online Reading