Web Story in Bengali | Read Best Bangla Golpo

Sharing Is Caring:

Web Story in Bengali | Bengali Stories | Bengali Literature

ঝাড়খণ্ডে আটদিন [8 Days in Jharkhand]

২৫শে ডিসেম্বর। সকল ৬-৫এ হাতিয়া এক্সপ্রেসে, রাঁচির ষ্টেশনে পৌঁছলাম। ষ্টেশনে নেমে চারদিকটা একনজরে দেখে নিলাম। হালকা অন্ধকার ভাব। কুয়াশায় যেন ধোঁয়া আটকা পড়েছে। শরীরে ঠান্ডা টের পাচ্ছি। গায়ে গরম পোশাক চাপানো। এখানে আসার আগে যেমনটা ঠান্ডার গল্প শুনেছিলাম, তেমনটা এবারে হয়নি।

পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ষ্টেশন চত্তর। চলমান সিঁড়ি দিয়ে ওপারে পেরিয়ে গেলাম। পরিপাটি করে সাজানো গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। আমাদের নির্ধারিত গাড়ির চালক, ইমরান আনসারি। কালোসাদা বড় মাপের রুমালটি নাড়িয়ে নিশ্চিত করলেন। আমরা দুটো গাড়িতে উঠে পড়লাম। কে কোন গাড়িতে উঠবে আগেই ঠিক করা ছিলো। গাড়ি ষ্টেশন ছেড়ে সরু পথের মধ্যে দিয়ে গিয়ে হাইরোডে ছুটে চলল। তখন চারিদিকে শুনশান পরিবেশ। রাঁচি শহরে তখনও অধিকাংশ চোখের পাতা খুলবার সময় হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছুটা পথ যাওয়া পরে কারুকার্য করা অসম্পূর্ণ হনুমানজির মন্দিরের পাশ ঘেঁষে অপ্রশস্ত গলিপথে ঢুকে পড়ল। সামনে চলমান বিজ্ঞাপিত লেখায় হোটেল নটরাজ [Hotel Nataraj] আবাসিক দেখতে পেলাম। পথের পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। প্রথমে এই জায়গাটি কোথায় ড্রাইভার বুঝতে পাচ্ছিল না। যাক শেষ পর্যন্ত পাওয়া তো গেল।

পীযূষবাবু ফোনের পর ফোন করে হোটেলের দরজা খোলালো। দেখলাম দায়িত্বে যাকা কম বয়সি দুই ছেলে চোখ কজলাতে কজলাতে দোর খুলে দিল। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে চলেছি ঠিক তার দুহাত দূরে মেঝেতে বিছানা করে ঘুমচ্ছিল এরা। যে যেখানেই ঘুমুগ্যে না, আমরা পয়সা দিয়ে ভালো পরিসেবা পেলেই হলো। পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠে গেলাম। অবশ্যই ওদের নির্দেশে। এখানে আমার অর্ধাঙ্গিনী নেই। ঘর বাছাইয়ের প্রশ্ন ওঠে না। সবাই জানে আমি সাহিত্যমনস্ক মানুষ। যে ঘরটাই পাবো তাতেই খুশী। আমাদের কক্ষ পড়েছে চলতি রাস্তার ধারে। আমাদের বলতে, গোপালদা। আমি দাদা বলেই ডাকি। সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে গুরুগম্ভীর। মিশলে বুঝবেন বাইরের খোলস দেখে মনগড়া ধারণা করা ভুল, তা প্রমাণ হবে।

আমাদের কক্ষের ঝুল বারান্দায় আছে। কাচের পাল্লা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেখান থেকে রাঁচি শহরের অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পুরোনো পাকা জরাজীর্ণ বাড়ির পাশাপাশি হাল আমলের ঝকঝকে বহুতল আবাসিক। বিভিন্ন নামে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। যেহারে জায়গার দাম বাড়ছে। প্রোমটারের থাবা থেকে পুরোনো বাড়িগুলো বাঁচানো কতদিন যাবে। আরও কতকিছু মনে আসছিল। এমন সময় দাদা পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শিবু, সকালের ঠাণ্ডায় বেশিক্ষণ থাকা ঠিক না। দাদার কথা অন্যথা না করে ভিতরে ঢুকে গেলাম। গরম জলে স্নান সারা হয়ে গেছে সবার। বাইরে থেকে চা এনে গরম জল পানের পর্ব সমাপ্ত। নেতার হাটে দশম ফলস ( Ten Water Fall ) দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। দর্শনীয় স্থানে পৌঁছিয়ে গেলাম। দেখলাম অনেকটা উঁচু থেকে জলের খরধারা প্রবাহিত হচ্ছে। অমি, ডাক্তারবাবু ও ঈশানী অনেকটা নিচুতে নেমে গেলাম। ঝর্ণার জল ছুঁয়ে ছবি তুললাম।

দ্বিতীয়বার পাঁচমুখী বা পঞ্চঘাঘ জলপ্রপাত ( Panchghagh Water Fall) লক্ষ্য করার মতো। এর বৈশিষ্ট্য আবার আলাদা। এই ঝর্ণাটি যে পাথর খণ্ডগুলো মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে অনেককিছু মনে করিয়ে দেয়। প্রতিটি পাথরখণ্ড আড়াআড়ি ভাবে আছে। বিভিন্ন আঙ্গিকে তার অবস্থান। এই পাথরগুলো দেখে আমার যা মনে হয়েছিল সেটাই বলি। স্বকর্মে যুক্ত ব্যক্তিরা তার প্রিয় বস্তু লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে। চকখড়ির আকার।গ্রন্থের আদল। আস্ত কাঠের গুঁড়ি। আরও কতো বিচিত্র রূপে পড়ে থাকা পাথরগুলোকে কল্পনায় ভেবে নিতে পারি। যেমন বৈকালিক অস্তগামী ভাসমান মেঘগুলো এক দৃষ্টে দেখলে প্রতিমুহূর্তে কতকিছু চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়।এই পঞ্চঘাঘের পাথরখণ্ডগুলো তেমন।

সারাদিনের পাহাড়ি ঝর্ণা দেখার আনন্দ নিয়ে রাঁচি শহরের মধ্যে দিয়ে রাঁচিতে অবস্থিত আবাসের দিকে চলেছি। চারিদিকে আলো ঝলমল করছে। এখন বিবেকানন্দ রকে বিপরীত দিক দিয়ে ফিরছি। বিবেকানন্দের পূর্ণাঙ্গ মর্মর মূর্তি জলাশয়ের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান। হনুমানজির মন্দিরে সকালে যেখানে ফাঁকা পড়ে ছিল এখন নেই। সেখানে চার’চাকার ঠেলা ডালায় গরম পোশাকের ঢালাও ব্যবসা চরছে। তাই আমাদের গাড়ি উলটো দিকের পথে গলির মধ্যে ঢুকেছিল। ভেবেছিলাম সকালের মতো ভুল পথে ঘুরছে নাকি। আমাদের খাবার হোটেল হনুমানির মন্দিরের পিছনে। সরু পথ পেরিয়ে এই হোটেলটি। আমরা খাওয়ার আগে ও পরে পোশাকের বাজারে ঘুরলাম। দামও করলাম। ভীষণ ভালো সোয়েটার অনেক কম দামে এখানে পাওয়া যাচ্ছে। যখন দেখছি একে একে দোকান গুটিয়ে নিচ্ছে, আমরাও রাত্রি যাপনের জন্য আস্তানার দিকে পা বাড়ালাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছে।

২৬শে ডিসেম্বর। দাদা, ভোর পাঁচটায় প্রাতঃভ্রমণে যাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করে দিয়েছে। সাহিত্যসম্মেলনে যাওয়া শান্তিনিকেতনে প্রাতঃভ্রমণের ভূত রাঁচিতে ভীষণ ভাবে মাথায় চেপে বসেছে। সেখানেও এই অধম সঙ্গী। আমি বললাম দাদা ওরা এখনো গেট খোলেনি। আমাদের সবাই এখনো ঘুমিয়ে আছে।
— চল, না গেলে খুলে দেবে কি? বাইরে এসে ঘুমিয়ে কাটালে, বাড়িতে থাকতে কি হয়েছে। -আমি তা বলছি না।
— কিছু বলতে হবেনে, চলো নিচে যাই।
হালকা আলোর মধ্যে সাবধানে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেলাম। নিজেরাই গেট খোলার নিষ্ফল চেষ্টা চালালাম। ওপরে উঠে যাবো কিনা ভাবছি। রিসেপশানের ওদিকে থেকে মেঝে ফুঁড়ে কেউ যেন উঠে দাঁড়িয়েছে। ‘উধার নেহি’ বলে অনেকটা দৌড়ে যাওয়ার মতো করে অন্ধকারের দিকে চলে গেল। আমরা ভাবছি ‘উধার নেহি কিউ, ইধার যানা পড়ে গা’ বাংলায় কিছু বলে গেলে নিরাপদ বোধ করতাম। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কী করব এখন। যে পথে এসেছি, সেই পথে ফিরে যাবো কি?

এমন সময় ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। আর কোথাও নয়, প্রাতঃকৃত্য সারতে গিয়েছিল।এসে জানালো, সামনের দরজা খোলার এখনো সময় হয়নি। দাদা তাকে হিন্দিতে বুঝিয়ে দিলেন। প্রাতঃভ্রমণের জন্য বাইরে যেতেই হবে। আমি বুঝতেই পারলাম না। দাদা তো নির্মল বাংলায় শব্দগুলো উচ্চারিত করলেন। যেখানে ছিটেফোঁটা হিন্দিভাষার টান নেই। আমাকে তো সুযোগ পেলেই বলেতে ছাড়ে না, ‘শিবু লেখালেখি করছ, বাইরে বেরুচ্ছ। একটু আধটু অন্তত হিন্দি বলতেই হবে’। দাদা ছেলেটাকে আচ্ছা করে বোঝাচ্ছিলেন। হোটেলে বিভিন্ন ভাষার মানুষজন নিয়ে তাদের কাজ করবার। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। বাধ্য হয়ে বাথরুমের পাশ দিয়ে পথ দেখিয় দিল। হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ভাষার বেড়াজালে থেকে মুক্তির স্বাদ পেলাম। এখন পথে বেরিয়ে হনুমানজির মন্দিরের দিকে যেতে থাকলাম। রাতের খাওয়া হোটেলের সামনে দিয়ে হনুমানজির বিপরীত দিকে মন্দিরের গা ঘেঁষে চায়ের দোকান। সেখানেও দাদা নির্মল বাংলায় শারীরিক ভাষা সহযোগে দোকানীকে বুঝিয়ে দিলেন। ‘দু’কাপ চা দিন আমরা এখানে খাবো। দশ কাপ আপনাদের কোনো জায়গায় দিন নিয়ে যাবো। আমরা পনেরো জন নটরাজ হোটেলে আছি। আরও অনেক কাপ চা লাগবে। বোঝানোর পালা প্রায় শেষ, এখন অপেক্ষায় থাকা।

এই সুযোগে দুএকটি কথা জানিয়ে রাখি। হনুমানজির মন্দির বলছি বটে। আদপে কয়েক তলা বিল্লিং। যখন বাদ্যযন্ত্র বাজে বহুতল কাঁপে। এই কাঁপন ভক্তদের কাঁপায় বলে তো প্রণামিতে কৃপণতা করার অবকাশ থাকেনা। মন্দিরের সামনে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখেছি। একভদ্রলোক শেতবস্ত্র পরিবৃত হয়ে, হাতে চামর নিয়ে মনে হয় ছোটাছুটি করছে ভিতরে। কী বলব কাশ্মীরী আপেলের মতো গায়ের রঙ। আর ভক্তদের রুক্ষ্ণ শরীর না হলে তো ভক্তি মাঠে মারা যাবে। ধর্মব্যবসায় কতকিছুর প্রয়োজন হয়। ভাবলে অবাক হতে হয়। এখন যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সকালে এখানে পাইকারি সবজির বাজার। এখন থেকে ছোট ছোট দোকানীদেরে প্রয়োজন মতো কিনে নিয়ে যায়। সারাদিন ফাঁকা পড়ে থাকে। সন্ধ্যায় মন্দিরের ওপরে গরম পোশাকের অস্থায়ী দোকান আগের দিন জেনে গেছি। আমরা চা বিস্কুট খেয়ে, ফ্লাক্সে চা নিলাম । এখন ওপরে ওঠার মুক্ত দরজা পেয়ে গেলাম। ততক্ষণে নটরাজে নটরাজের নৃত্য শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈশানী অস্থির করে তুলেছে, দাদাই দাদাই করে। দাদাকে দেখে শান্ত হলো।

কাজলদিকে দিদি’ই বলি। দুজনের দেখে জানতে চাইল, “বাবুরা সব কোথায় গেছিলে।” যখন জানল সকালে বেড়াতে। চা বিস্কুট খেয়ে অল্প চা নিয়ে এসেছি। চায়ের সঙ্গে যার যা সঙ্গে ছিল খেয়ে নিচে নেমে এলাম। আমাদের গাড়ির চালক ইমরানদা। আমার নাম যে শিবু জেনে গেছে। রাঁচির প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন। আমাকেও শিবু সোরেন নামে মজা করে ডাকতে শুরু করেছে। আমিও মুচকি হেসে উপভোগ করছি। যাইহোক দুটো গাড়ি ভ্রমণের জন্য বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। আমরা হুড্রু ওয়াটার ফলস (Hundru Water Fall) দেখার জন্য মূল জায়গায় পৌঁছে গেলাম। এখন ঝরনা দেখতে যাওয়ার জন্য যাওয়া-আসায় মোট ১৪৮৪ টা পোটে ভাঙতে হবে। শুনে প্রথমে দিদি ও পীযুষাবু না করে দিল। অনেকেই মনের জোরে নামতে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত নামতে পারেনি। অতৃপ্ত মনে উঠে আসতে হয়েছে।

আমি নেমে গিয়েছিল শেষ ধাপে। যেখানে সবাইকে দাঁড়িয়ে দু’দণ্ড ভাবতে হবে এবার কী করবে। ‘ওই দেখা যায় বাবার মন্দির’ বলে প্রণাম করে ফিরবে। না ঝরনা প্রপাতের তলদেশে গিয়ে দাঁড়াবে। বিপদ যদি হয়, সেই বিপদের সম্ভাবনা এবার প্রবলভাবে রয়েছে।ঈশানী পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারবাবু প্রায় কাছেই আছে। মেয়ে বাবার কাছে আবদার করলো ঘূর্ণিয়মান চাকতির ওপর দাঁড়িয়ে রানিং ক্যামেরায় ছবি তুলল। ঈশানী টাইটানিকের নায়িকা যেভাবে দুদিকে হাত মেলে ছুটন্ত জাহাজে দাঁড়িয়ে ছিল তেমন পোজ দিয়েছে। ছবি তোলা হয়ে গেলে মনে হবে। আমাদের বড় মেয়ের চারদিকে পুরো পাহাড় গাছপালা সমেত ঘুরছে। এই বয়সে এরাই তুলবে না তো ষাট পেরিয়ে যাওয়াদের মতো ভয়ে কুঁকড়ে থাকবে। ছোটদের নিষেধের বেড়িতে আটকে রাখলে তারা তা মানবে কেন।

চাকতিতে ঘুরে ছবি তোলা তবে বিপদের ছিলো। ওই ঘূর্ণিয়মান চাকতি বসানো ছিলো ভগ্ন পাহাড়ের কানা ঘেঁষে। মেয়ের ছবি তোলা শেষ। আমি এই সময়টায় ভাবছিলাম কী উপায়ে অসংখ্য ভ্রমণার্থী গভীর খাদে ওপর থেকে ঝরে পড়া ঠান্ডা ঝর্ণার জল নিয়ে কতভাবে যে জলখেলা করছে। কঠিন হলেও সহজে নামার পথে তখনও আবিষ্কার করে উঠতে পারিনি। ঈশানী যেদিকে ঘুরছিল, এদিকে টুকরো টুকরো পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে অনেকের নামতে দেখে আমিও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। মেয়ে বলল, ও শিবুমামা চলো ওদিকে যাই। হ্যাঁ বলে পা বাড়িয়ে দিলাম দুজনে। আর পেছনে তাকানোরও সময় নেই। দুজনের মনের ইচ্ছে ওই ঝর্ণার তলায় যাওয়ার। একের পর এক পাথরখণ্ডের ওপর দিয়ে দুজনে চলেছি। এক পাথরে দুজনে নেই। এগিয়ে চলেছি আমি, মেয়ে পেছনের পাথরে। মেয়ের পায়ে সু। আমার পায়ে নতুন চামড়ার জুতো। জুতার তলার খাঁজ ক্ষয়ে যায়নি। মেয়েকে বলে দিয়েছি। হঠাৎ শরীর টলে গেলে হাত ছড়িয়ে বসে পড়বে। যেন পাকা প্রশিক্ষকের ভূমিকায় নিজেকে ভাবছি। হঠাৎ আমি পড়ে যেতে যেতে বেঁচে গেলাম। এই দুর্গম পাহাড়ে অল্পতেই বেঁচে গেলাম। একটু থেমে আরও একটি পাথরখণ্ডে পা বাড়াতে যাবো সেই সাহস নিয়ে আর পারলাম না। কিন্তু থামলে চলবে না। লক্ষ্য স্থির আছে।

ওপর থেকে আমার নাম ধরে ফিরে যাওয়ার ডাক শুনতে পেলাম। কার গলা আবার, দাদার। আর দু’তিনটে পাথরের চাঁই পার হলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হয়। দাদা তো পোটের সংখ্যা শুনে নামতে নারাজ ছিল। কখন এলো। বাৎসল্য কতটা দুর্বল করে করে দিতে পারে দাদাকে না দেখলে বুঝতে পারবেন না। ওইযে দুটো মেয়ে কৌশানী ও ঈশানী বাবা মায়ের সঙ্গে গেলেও দাদাইয়ের মনে সর্বদা সংশয়।যদি কোথাও বিপদ হয়। আমি ঈশানীকে বললাম। মা তুমি ওখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি একা ঘুরে আসছি। পারলে ওখান থেকে ছবি তুললে তুলতে পারো। যেভাবে নেমেছিলাম সেই ভাবে ওপরে দুজনে উঠে গেলাম। কৌশানী ঝাঁকে মিশে গেল। কিছু কেনাকাটায়, খাওয়াখায়িতে সঙ্গীদের অনেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমি কোথাও হ্যাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনা। ধাপে ধাপে একাই এগিয়ে চলেছি। যা ভালো লাগছে ছবি তুলছি। পথের চওড়া রেলিং-এ আশপাশের পাহাড়ি বন থেকে সংগ্রহ করা গামার কাঠ। সেই কাঁচা কাঠে তলোয়ার তৈরি করে সাজিয়ে রেখেছে বেচার জন্য। সংগ্রহ করে আনা ফল, ফুল ছাড়াও স্থানীয় কতকিছু জিনিস পত্র বেচার জন্য খরিদ্দারের মুখ চেয়ে আছে। এইসব দোকান যারা দিয়েছে তাদের দেখে আমার মনে হলো অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া শ্রেণির মানুষজন। আর্থিক অনটনের মধ্যে জীবন যাপন করে।

এক বাচ্চা মেয়ে হাত বাড়িয়ে কিছু চাইছে ভাবলাম। না চাইছে, তার সৃষ্টি সে বিনিময় করতে চায়। ছোট্ট কাঠের টুকরো যাকে সে তলোয়ার বলছে। কিছু শিল্পীর ছবির তলায় না লিখে দিলে কীসের ছবি বোঝা যায়না। ওই বাচ্চা মেয়টি অস্পষ্ট ভাষায় তলোয়ার না বললে সত্যি কিছুই বুঝতাম না। তলোয়ার নামক কাঠের টুকরো দশ টাকায় আমার কাছে বেচতে চায়। ইচ্ছে না থাকলেও দশ টাকা দিয়ে ওটা কিনে বাড়িতে এনেছিলাম। আমার ওই মেয়টির বয়সী নাতি খেলনা মনে করে কী খুশী না হয়েছে। কদিন ওটাই হাতছাড়া করেনি। শয়নে, স্বপনে, খেলার অঙ্গনে হাতের কাছে রাখেছে। আমি তলোয়ার ছাড়া আর কিচ্ছুটি কিনিনি। হিড্রু জলপ্রপাত দেখে বা না দেখে সবাই একত্র হলাম। ওখানকার পথের হোটেলে খেয়ে গাড়িতে বসলাম। এখন চলেছি জোহানা ওয়াটার ফলস (Jonhana Water Falls) দেখার জন্য। আমরা গন্তব্যে পৌঁছে ওখানকার দোকানীদের থেকে ফলমূল কিনে খাওয়ার ব্যস্ততায় কিছুটা সময় কাটালাম। এবার ধাপে ধাপে ওপরে উঠে দেখলাম সুন্দর পার্ক বানানো। পার্কের ভিতর থেকে এগিয়ে গেলাম ঝর্ণা দেখার জন্য। বাঁদিক ঘুরে পাহাড়ের গা কেটে তৈরি পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি কতো নিষেধ নির্দেশিকা মেনে। প্রথম বুঝতেই পারিনি ঝর্ণা কোথায়। কতদূর গেলে দেখতে পাবো। আমাদের পনের জনের কে কার কোথায় ছড়িয়ে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে না। এমটা অন্য কোথাও হয়নি। শারীরিক অক্ষমতা মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখছি সামনে দিদির সঙ্গে অনেকে বসে আছে। সামনের একটা দল এগিয়ে গেছে। আমি সামনে পেছনে না ভেবে একাই চলতে শুরু করেছি। বুঝে ফেলেছি এখানে দ্বিতীয় পথ নেই। যারা বসে আছে,আর যারা ঝর্ণা দেখতে গেছে তাদের জন্য অপেক্ষা করবেই। পৃথিবী গোলের তথ্য এখানে খাটবে।

আমি গাছপালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম খুব উচ্চ থেকে ঝর্ণার জল ঝরে পড়ছে। আমার মনে হলো হুড্রুর থেকেও অনেক উঁচু। সামনে ঝুলন্ত সাঁকো। দেখতে পাচ্ছি পিঁপড়ের সারের মতো ভ্রমণকারীরা যাতায়াত করছে। এই ঝুলন্ত পাহাড়ি পথে দুই পাহাড়ের মানুষজন যাতায়াত করতে পারে, করেও শুনছি। এক সময় মাওবাদীরা ওই পথটাই নিজেদের অসৎ কাজে লাগিয়েছে। আমি আর এগিয়ে না গিয়ে মাঝ পথে,পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ি ঢালে নিচে নেমে গেলাম। ওই তো ঝর্ণার জল বয়ে চলেছে আমার সমন দিয়ে। একদম কাছে না গেলেও স্পষ্ট ঝর্ণা দেখতে পাচ্ছি। পাথরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছি। জলে হাত দিয়ে দেখছি বেশ ঠাণ্ডা। পা ডুবিয়ে নিলাম। কতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। কে কোথায় আছে জানিনা। এখন আমি একা, সত্যি আমার একা লাগছে না। গাছপালা ,মাথার ওপর খোলা আকাশ, পায়ের তলায় প্রবাহিত শীতল জলধারা আমার আপন হয়ে উঠেছে।

হঠাৎ ঘোর কেটে গেল। কে কোথায় অপেক্ষা করছে বুঝতে পারার কথা নয়। তাড়াতাড়ি সংকীর্ণ পাথরের চাঁইয়ের ফাঁক গলে ওপরে উঠে এলাম। ফেরার পথের দিকে এগিয়ে যেতে দেখলাম দিদিরা উদ্বিগ্ন। কী ব্যাপার জানতে চাইলাম। মানতু, মহুয়া তারা কে কোথায় কেউ বুঝতে পারছে না। সামনের ওই ঢাল পথে নামতে নামতে দেখেছে সবাই। ওভাবে দুটো মেয়ের যাওয়া উচিত হয়নি। মাওবাদী গন্ধ আছে। পণবন্দী করে দাবী পূরণ করতে পারে। অনেকক্ষণ থেকে আবার ফোন ধরছে না। কী হলো বুঝতে পারছি না। অতো গড়েনে কেউ নামতে সাহস পাচ্ছে না। আমি বললাম নেমে দেখছি কোথায় গেছে। চারদিকে নজর রেখে সাবধানে নামছি। ওইতো প্রবাহিত ঝর্ণার শীতল জলধারা পাথরের নুড়িতে ধাক্কা খেতে খেতে বয়ে চলেছে। আর কোথায় নেমে খুঁজবো। তবে বেশ কয়েটা বড়ো পাথরখণ্ড সামনের কিছুটা জায়গা আড়াল করে আছে। আমি তার ওপর দিয়ে খাদের জল দেখছিলাম। নিচের দিকে লক্ষ্য পড়লো, গায়ের সোয়েটার ঝাঁটি গাছের ওপর পড়ে আছে। বুকের মধ্যে ছ্যাঁৎ করে উঠলো। কাউকে তো দেখতে পাচ্ছি না। দিদির কাছে ফোন করেছি। কানে রিং-এর শব্দ শুনতে শুনতে চলেছি। তেমন হলে ফোন কেড়ে নেওয়ার আগে দুঃসংবাদ জানাতে পারব। পাথরের বাধা দৃষ্টি থেকে সরে যেতে দেখি মানতু জেগে থাকা পাথরে বসে আছে। ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে। দুহাতে জল ছিটুচ্ছে। কি বলব, কী সুন্দর দেখতে লাগছিল। যেন কোন রাজকন্যা সখীর সঙ্গে নিয়ে জলখেলা করছে। গুটিয়ে নেওয়া বসনে মুক্ত চরণ স্বচ্ছ জলে মুক্তর মতো মনে হচ্ছে। তবে সঙ্গীটি জল খেলছে না। সম্ভবত ঘষে পায়ের ময়লা তুলতে। দেখে মনে হলো সময়ের অপচয় করেন না। এতো দূরে এসেও হিসাব বরাবর রেখেছেন। নতমুখে উভয়ে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল। মনে হলো আমাকে দেখতে পায়নি। আমি তৎক্ষণাৎ মুখ ঘুরিয়ে ওপরে উঠে আসতে চাইলাম। মানতু আমাকে ডাকল, ও- শিবেনদা, চলে যাচ্ছো?
— তোমাদের খুঁজতে এখানে আসা। তবে এসো আমি যাই।
— কী যাই, আমাদের ছবি তুলবে না। দেখতে খারাপ বলে।

এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। দাদার কাছে বোনেরা ভালো মন্দ দেখতে হয় না। জড়তাহীন ভাবে বললাম,”বললে তুলব।” আমি নিচে নেমে ওদের কাছাকাছি গেলাম। মানতুর কতরকমের ভঙ্গিমায় ছবি তুলতে হলো। মহুয়া বোনের ছবি না তোলার অর্থ একযাত্রায় পৃথক ফল। তা কি করে সম্ভব। ছবি তোলার সময় কোনপ্রকার অঙ্গভঙ্গির অবতারণা করেননি। ছবি তুলতে হয় তাই তোলা। খুব সাদাসিধে মনের। আর মানতু ভীষণ আমুদে, হাসিখুশিতে থাকতে অভ্যস্ত অন্য আর এক মেয়ে।

জোহনা জলপ্রপাতের দিক থেকে এসে বাড়ির পথে গেলাম না। বিপরীতে এগিয়ে গেলাম। সবাই খাদের পথ ধরে নিচে নামার সাহস দেখায়নি। পথের পাশে লেলিং-এর ওপর বসে আনন্দ উপভোগ করছে। আমাদের একই গোঁ নিচে নামার। ডাক্তারবাবুকে সঙ্গে নিয়ে বাঁধে মতো সরু পাথুরে পথে এগিয়ে গেলাম। এখানে রোপওয়ে সিস্টেমে আছে। অনেকে উঠছে। এখন এই সফরে বুটু থাকলে ঈশানীকে আটকানো যেতো না। পাথরের ওপর দিয়ে জলাধারের কাছে তো যেতে পারি। মেয়ের ওখানে যাওয়ার ইচ্ছা। এখানে দাদার নিষেধ থেকে অনেকটা দূরে আছি। ডাক্তারবাবুর কথায় ঈশানী থামবে না। বেলা ডুবতে বসেছে দুঃসাহসিকতা দেখানো ঠিক নয়। মেয়েকে বললাম যাওয়া ঠিক হবেনা। চলো ফিরে যাই। ৪:২৪শে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি ছুটল হোটেল নটরাজে।

২৭শে ডিসেম্বর। ৯:৪২শে সূচি অনুযায়ী ভ্রমণ শুরু হলো। প্রথম রাঁচির মানসিক রুগীদের হাসপাতালে। আমাদের দুটো গাড়ি গেট দিয়ে ঢুকলো তবে নামার অনুমতি ছিলনা। বিশাল এরিয়া। ওখান থেকে বেরিয়ে গেলাম। ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবু সোরেন তাঁর বাড়ি পেরিয়ে রক গার্ডেনে ঢুকলাম। একনজরে ঘুরে নিলাম। এবার পাত্রাতু লেক (Patratu Lack Resort. Patratu) ঘুরলাম। পরিপাটি করে সাজানো। আদিবাসীর যুগলমূর্তি দেখার মতো। যেন শিল্পীর তৈরি নয় বাস্তবে দেখছি। টিকিট কেটে হাইস্পিড বোটে লেকের মধ্যবর্তী পর্যন্ত পাক দিয়ে এলাম। বিশাল এরিয়া নিয়ে এই জলাধারটি। দেখলে ভয় পাওয়া মতো বটেই। ফেরার পথে কিং রেস্টুরেন্টে ওই পাত্রাতু লেকের থেকে ধরা মাছ আর ভাত খেয়ে নটরাজে ফিরলাম। রাতে অর্ডার দিয়ে খাসির মাংস ভাত খেয়ে সেই রাতটা হোটেলে কাটালাম।

২৮শে আগস্ট। সকল ৬:৩০শে চলেছি বেলতা ন্যাশনাল পার্ক (Belta National Park) অভিমুখে। এখন গভীর জঙ্গলের মধ্যে। ট্রেন লাইনের আগে গাড়ি সারবেঁধে দাঁড়িয়ে গেল। শুনলাম মালট্রেন পার হবে। দীর্ঘ সময় নিয়ে একটি মালট্রের জুড়ি পেরিয়ে যাওয়ার পরেও দেখছি গেট খুলছে না। রাঁচির দিক থেকে আসা আরও একটি পার হলে তবেই খুলবে। ঘন জঙ্গলে হাড়হিম করা পরিবেশ। এইসব দুর্গম জঙ্গলে দুষ্কৃতির আড্ডা। তারা এমন সুযোগে নিজেদের কাজে লাগায়। যাক গেট উঠে গেল, গাড়ি চলতে শুরু করেছে। নানা ভাবে পথে অনেকটা সময় হয়ে গেল। এদিন আর বেলতা ফরেস্ট দেখা হলো না। তেলতা ফরেস্টর বিশাল গেটের সামনে হাইওয়ে। ওই রাস্তা পেরিয়ে হোটেলে পার্ক ভিউতে ( Hotel Park View) বতর্মানে থাকার জায়গা। দুখানা বাথরুম সহ হলঘরে (Dormitory) এগারো খানা পাশাপাশি বেডের ব্যবস্থা আছে। আমরা বারোজন একে একে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলাম। এখানে বেশ ঠান্ডা অনুভব করছি। জানালার কাচ দুটো পাল্লায় ভাঙা। আপাতত কাগজ দিয়ে আটকানো হলো। অফিসে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পীযূষবাবু থাকবেন আর মজা হবে না তা কি করে হয়। কার কোথায় ত্রুটি সেই নিয়ে ঘোটপাকিয়ে মজা করার উপাদান বের করে তবে ছাড়বে। এইভাবে একঘরে থাকার এটাই সবচেয়ে আনন্দ উপভোগের মজাদার ক্ষেত্র হয়ে ওঠে। দীপ রেস্টুরেন্টে থেকে রাতের খাবার দিয়ে গেল। খেয়ে দেয়ে যে যার নির্দিষ্ট জায়গায় ঘুমিয়ে পড়লাম।

২৯ শে আগস্ট। বেলতা ফরেস্ট সাফারি, ৭:৩০ থেকে ৪:৩০ এই সময়ের মধ্যে দেখাশোনা করিয়ে গেটের বাইরে ছেড়ে দিল। জিমকরবেট জঙ্গলের থেকে বেশ খোলামেলা। অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। হরিণ আমাদের কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কয়েকটি বুনো শেয়াল রাত-দিন গুলিয়ে ফেলেছিল। আমাদের প্রথম গাড়ি যেতে দেখে ছুটে পালালো। বানরের লাফালাফি বনের থেকে সদর রাস্তায় গেটের সামনে বেশি। বানরের দৌরাত্যিতে হাতে কিছু রাখার উপায় নি। তবে দিয়ে খাওয়ার অভ্যাস যাদের নেই, তাদের লুকিয় চুরিয়ে খেতে কষ্ট হয় এই যা। এবার দীপ রেস্টুরেন্ট থেকে টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সবাই নয়। ডেলটাগঞ্জের দুবিয়া খাঁড় মার্কেট এবং পরসা নদী তার ওপর দীর্ঘ ব্রিজ দেখার মতো। বালি মাড়িয়ে নদীর জলের ধারে গিয়ে দাঁড়ালাম। পা ডুবিয়ে কিছু দূর পর্যন্ত হাঁটলাম। স্বচ্ছ জল হাতে মুখে দিলাম। যে যার মতো ছবি তুলে ডেরায় ফিরে এলাম।

দুপুরের খাওয়া সেরে পালামৌ ফোর্স দেখার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। মূল রাস্তা ছাড়িয়ে প্রত্যন্ত গ্রামের রাস্তায় চলেছি। সরু ঢালাই পথ। রাস্তার ধারেই সাধারণ মানুষের বাড়ি। ধারের ক্ষেত । সবজির বাগান। ক্ষেত খামারে মেয়ে মদ্দ কাজে ব্যস্ত। গাড়ির মধ্যে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি। বেশ ভালো লাগছিল দেহাতি গ্রাম্যচিত্র দেখতে। গ্রাম ছাড়িয়ে যাওয়ায় আর ঘরবাড়ি চোখে পড়ছে না। ঘন বনের মধ্যে ঢুকছি ক্রমশ। দুদিকের ঘন ঝাঁটি গাছ যেন ভিতরে ঢুকতে বাধা দিচ্ছে। কেন জানিনা তেমনটাই মনে হচ্ছিল। ফিরতি গাড়ি সামনে আসতেই কেউ কাউকে পথ ছাড়তে পারছিল না। সরুপথ দিয়ে গুঁতাগুঁতি করে পার হয়ে গেল। আমাদের দুটো গাড়ি এক পদ্মপুকুরের কাছে দাঁড় করালো। এই পুকুরটিতে এখানকার রানি স্নান করত। পাহাড়ের ওপর এই ঐতিহাসিক পুকুর দেখার জন্য সুন্দর ওয়াচটাওয়ার বানানো হয়েছে। আমরা অনেকে চক্কর কেটে আসলাম। এবার পালামৌ ফোর্ট দেখার পালা।

ভ্রমণার্থীরা প্রথম যেখানে এসে সবাই দাঁড়ায়। আমরা সব্বাই সেখানেই এসে দাঁড়ালাম। ছাদ খোলা বেশ চওড়া চওড়া প্রাচীর কয়েক মানুষ উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর ভেতর যাওয়া যাবেনা গাছের জঙ্গল বসে গেছে। আমাদের ঘোরাফেরার মধ্যে চোখে পড়ল পাথুরে সিঁড়ি। দেখে বুঝলাম উপরে ওঠা যায়। আমি, ডাক্তারবাবু, কৌশানী সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠলাম। নানা আমরা ভাঙেনি ভাঙা ছিলো। তলাতেই বোঝা যায়না। প্রাচীরগুলোর মাথা বেশ চওড়া। পথের ধারে এমনভাবে ঘেরা ওপর থেকে নিচে দেখা যাবে। নিচে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। সন্ধানী দৃষ্টিতে নিজেদের মতো ধারণা অনুভব করে নেমে এলাম। তবে মন চাইছিল না নামতে। আর কিছুক্ষণ থাকার ইচ্ছে ছিলো।

এই ধ্বংসাবশেষের বিপরীতে চলতি পথে দাঁড়ালে পাহাড়ের অতো উপরে বিশাল পাথুরে বাড়ি প্রায় অক্ষত। ওঠার তেমন ভালো পথ নেই। পূর্ব এখনকার মতো পাথরের টুকরো ছড়ানো ছিলোনা তাও কী করে বলব। তলায় কয়েকটি সুড়ঙ্গ দেখেছি। ভিতরে খানিকটা ঢুকে বেরিয়ে আসি। সম্ভবত ওখান থেকেই ওপরে ওঠার পথ আছে বলে আমার ধারণা। যাইহোক লড়াই করে ওপরে উঠে আমরা তিনজন কী দেখলাম সেটাই বলি। সামনে অনেকটা প্রশস্ত জায়গা। সমান্তরাল দীর্ঘ প্রাচীর। দশ ফুট উচ্চতায়, ছয় ফুটের মতো চওড়া কপাট। দরজা নষ্ট হয়নি। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকলাম ছমছমে,থমথমে ভাব নিয়ে। ভেতরের ঘরগুলো দেখে গৃহস্থালির বলে মনে হল না। আমরা প্রথমে যেখানে উঠেছিলাম, হলে ওটাই রাজাবাড়ি। এখন থেকে নজরদারী করার মূল ডেরা। আমরা এখানেও পাথুরে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছি। বাইরে প্রাচীর ভাবছিলাম, এ যেন চীনের প্রাচীর। যেখান থেকে অনায়াসে পাহারা দেওয়া যায়। আমরা দেখলাম পতাকা দেওয়ার বেদী আছে। যেখানে পতাকার দণ্ড পোঁতর মতো ছিদ্র করা আছে। আমরা যে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছিলাম, দ্বিতীয় সিঁড়িতে নামলাম। এই পালামৌ ফোর্স পুরোপুরি পাহাড়ের শেষ প্রান্তে। আমরা যেদিক থেকে এসেছি সমতল। আরো অনেক দেখার ছিলো সম্ভব হলো না। সূর্য ডুবতে বসেছে। এবার ফিরতে হবে গভীর জঙ্গল এলাকা ছেড়ে।

৩০শে আগস্ট। বেলতা ছাড়লাম ৬:৩০শে। গভীর জঙ্গলের পথ ধরে চলেছি। অনেকটা আসার পর ৭ :০৮এ ডালটন আপডাউন করায় বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেল। এবার দুর্বাড্রাম দেখলাম। জলে টলমল করছে। নেতারহাট(Netarhat) দেখার জন্য টিকিট কাটতে হলো। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে আছি পাহাড়ি ঢালের কাছে। সূর্যাস্ত দেখার আকর্ষণীয় সুন্দর জায়গা, ( Magnotic Sun-Set Point) চোখ ফেরানো যায়না। এখানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার উপায় নেই। আজ সন্ধ্যায় রাঁচির ষ্টেশনে পৌছাতে হবে। ফিরতি ট্রেন ধরার জন্য।

গ্যাংটক ভ্রমণ : আনন্দে ও বিড়ম্বনায় [Gangtok Travel Attraction]

কাঁটামাছে যেমন বাড়তি স্বাদ থাকে। তেমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে, পাহাড়ের গা ঘেঁষা পথের প্রতি বাঁকে বাঁকে বিপদের ইঙ্গিত উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হয়। তা না হলে সবকিছুই কল্পনায় থেকে যায়। এবার বলি এতো কিছুর ভূমিকার প্রয়োজন কেন হলো বা কীসের জন্য এই গৌরচন্দ্রিকা। আসলে আমরা সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছিলাম। অনেক ভ্রমণপিপাসুর অভিজ্ঞতায়, এমন পাহাড়ে ভ্রমণে যাওয়া তাদের কাছে নস্যি। আমরা আমাদের প্রথম পাহাড় ভ্রমণ এতটা হালকা করে ভাবতে পারিনি। পরে কী হয়েছিল আর বোঝতে হবেনা। এখন সেই ভূমিকায় থেকে গেলাম,কোথায় চলেছি বলে ফেলি। ভ্রমণের মূল কেন্দ্রবিন্দু গ্যাংটক থেকে বাবা পাহাড়। সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক। ওখান থেকে দার্জিলিং ঘুরে বাড়িতে ফেরা। ওই সময় ওখানকার রাজনৈতিক হিংসাক্তক অস্থিরতার জন্য দার্জিলিং ভ্রমণ সূচি থেকে বাদ পড়ে। তার পরিবর্তে নমো নমো করে জলদা পড়ার জঙ্গল ঘুরিয়ে আনার কথা দিয়ে বাস ছাড়েন।

মাধবপুর থেকে নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছু পরে বাসটি ছেড়েছিল। বাসের চালক ভীষণ সাবধানী। ভিড় ভাট্টায় গা বাঁচিয়ে, ভ্রমণার্থীদের ধৈর্যচ্যুতিতে ভ্রুক্ষেপ করেননি। যেখানে দুপুর দুটোর সময় পৌঁছানোর কথা সন্ধ্যা সাতটায় পৌঁছালো। শিলিগুড়িতে বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারীর আশ্রমের ঘেরার মধ্যে। এই বাস তিন-চারদিন আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে। যে কদিন না গ্যাংটক থেকে ফিরছি। অসুবিধায় পড়েছি আমরা। দুটোর সময় যে দুটি ছোট বাস আমাদের প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট ছিলো। তারা বলছে আমাদের সময় পার হয়ে গেছে, ভাড়া দাও চলে যাই। পরিচারক মণ্ডলীর কাছে উভয় সংকট। দুপুর থেকে কারো পেটে ভাত নেই। রাঁধুনিরা সঙ্গে আছে সময় পেলে দুটো ডাল ভাত খাইয়ে গাড়িতে তুলতে পারে। কিন্তু, দুপুর থেকে অপেক্ষমাণ ভিনদেশী দুই চালক সহ সঙ্গীরা অতশত বুঝবে না। পথে দেরি হয়েছে এখন তো এসেছি। আমার লোকজন গাড়িতে উঠছে। গাড়ি ছেড়ে দাও, বাড়তি ভাড়ার কথা উঠছে কেন? অগত্যা আমরা গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি সমতল ছেড়ে ক্রমশ পাহাড়ি পথে আপন গতিতে চলতে শুর করল।

মিনিট পনেরো পথের দুদিকে ঘরের সারি দেখতে পেলাম । হালকা বৃষ্টির আচ পেতে অসুবিধা হল না। হঠাৎ গাড়ি থেকে গেল। সামনে বিভিন্ন গাড়ি পিঁপড়ের মতো সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়েছে। জানতে পারলাম লোকজনের মুখে মুখে পাহাড়ের কোথাও ধস নেমেছে। কখন রাস্তা পরিষ্কার হয়ে আবার গাড়ি চলবে কেউ সঠিক করে বলতে পারছে না। হয়তো এক দেড় ঘন্টার মাধ্যমে সমস্যা মিটতে পারে, তা না হলে রাত কাবার। চালকের জিজ্ঞেস করে কিছুই বুঝতে পারছি না। তারা বাংলা ভাষা বোঝে না, তাদের মুখে হিন্দির টান আমরাও বুঝি না। তাদের নির্দিষ্ট মাতৃভাষা আছে, তাদের মধ্যে কথাবার্তায় কোনো অসুবিধা নেই। খান পিনা ঠিক ফাঁক ফোকর বুঝ চালিয়ে নিচ্ছে। পাহাড়ের মানুষেরা এসবে অভ্যস্ত। যখন যানজট ছাড়বে যাবে। অসুবিধা আমাদের মতো যাত্রীদের। সামনে যা দেখতে পাচ্ছি। সরলবর্গীয় গাছের মধ্যে থেকে ঘনঘোর অন্ধকারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সম্ভবত মেঘের প্রাদুর্ভাব। পরে জানতে পারলাম ওটাই পাহাড়। ওই ভিতর দিয়ে আঁকাবাঁকা সংকীর্ণ পথ দিয়ে আমাদের বাস যাবে। এই কথা শুনে আমাদের মধ্যে থেকে আটজনের মতো বাস থেকে নেমে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার বিপদ সংকুল পথে তারা পা বাড়াবে না। বুঝতে দেরি হয়নি, ওরা নাকি দেখে ফেলেছিল। চালকদের সুরাযোগের আমোদ পর্বটি। তৎক্ষণাৎ আমাদের অনেকেই ভেবেছিলাম। পাহাড়ে বেড়াতে আসাটাই তো বিপদ। গলা যখন ঢুকিয়ে দিয়েছি যূপকাষ্ঠে,কপালে যা হওয়া হবে।

পাহাড়ে চলা গড়ির গতি নির্দিষ্ট থাকে। আমাদের গাড়ি সিকিমের আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চললো। শুরুর পথ এতটা বাঁকা ও সরু এবং পাশে গভীর খাড়াই খাদ ভীষণ ভাবে ভাবিয়ে তুলল। রাতে পাড়ি না দিলেই ভালো হতো। এসব আমাদের মনের কথা। মন আর চোখ একই দিকে বইছে না। দুপাশে লক্ষ্য করলাম, পথের দুপাশে অসংখ্য আলোক বর্তিকা আমাদের চলার পথ নির্দেশিকার কাজ করছে। ক্ষণিকের জন্য মুগ্ধ না হয়ে পারছিলাম না। এই আলোগুলো আমাদের মনে এগিয়ে যাওয়ার ভরসা যোগালো। এই আলোগুলোর রহস্য এমন কিছু নয় গাড়ির আলো পড়লে জ্বলছে মনে হয়। দীর্ঘ পাহাড়ি পথে মাঝে নামার পরে লক্ষ্য করলাম। যেতে যেতে বুঝলাম দুএকটি ছাড়া পথে আর কোনো গাড়ি নেই। আমাদের চালক সুকৌশলে অনেক মালবাহী শকট পেরিয়ে এসেছে। এতে শঙ্কিত হওয়ার তেমন কিছু ছিলনা কারণ প্রথমের তুলনায় প্রশস্ত পথ। হালকা বৃষ্টিতে পথ ভিজে। ঝুলন্ত গাছের পাতা থেকে জল ঝরছে। হঠাৎ এক জায়গা থেকে গাড়ি যাওয়ার সময় ভয় ও আনন্দ দুটোই অনুভব করলাম। পাশে খাদ চোখ বুজিয়ে নিতে পারতাম। কিন্তু উলটো দিকের পাহাড় লাগোয়া আবাসিক ঘরগুলোতে টিমটিমে আলোতে মনে হচ্ছিল, তারা ভরা যে ভাবে আকাশ দেখি তারই প্রতিচ্ছবি। সত্যি দুচোখ ভরে দেখার মতো দৃশ্য। যা জীবনে প্রথম দেখলাম।

একসময় রাত সাড়ে তিনটার সময় গ্যাংটকে পৌঁছলাম। যেখানে বাস দাঁড়াল সামনে সিনেমা হল। আমাদের মালপত্র নিয়ে বিরাট বিল্ডিং-এর সামনে দাঁড়ালাম। আমাদের আরো একটি বাস আদা ঘণ্টা আগেই পৌঁছে গিয়েছে। স্বাভাবিক কারণে ভাবতে পারি। তারা হোটেলে বিশ্রাম নিচ্ছে এটিই নিশ্চিত। আমাদের গাড়ি বিলম্বে ছাড়ার কারণ ওই যে আটজন জীবনের ঝুঁকি নিতে চাননি। শিলিগুড়িতে থেকে যাবে না আমাদের বাসে আসবেন সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বিলম্বের কারণে। আমাদের বাসের চালকগোষ্ঠির একজন ফোন কলে জানতে চাইলেন ওই বাসটি কোথায়। যেখানেই থাক সিনেমা হলের কাছে চলে আসতে বলল। আমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছি। প্রথম আমরা বুঝতেই পারিনি দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটি সিনেমা হল। আর ভালো করে দেখে বোঝার কথাও নয়। পেটে ভাত নেই কোথায় তুলবি তোল বাবা। অন্তত চোখের পাতা দুটো এক করি।

দুটি মিনি বাসের সহযাত্রীরা একত্রিত হলে পরিচালকদের থেকে নির্দেশ এলো। সামনের পাথুরে পোটে ভেঙে ওপরে ওঠার। ওঠা শুরু করে আর শেষ হয়না। উঠছি তো উঠছি। দেখতে দেখতে গেলাম, দুই ধারে নানা বিদেশি নামের সাটার ফেলা দোকান। পেছনে দশ বারো তলার মতো উপরে উঠে এসেছি। আরো উঠতে হবে। মনে হলো রাবণের অসম্পূর্ণ স্বর্গে যাওয়ার সিঁড়ি। যখন শেষ ধাপে পৌঁছলাম এবং একটু ঘুরে তাকালাম ওরে বাব্বা এতো স্বর্গোদ্যান। আলোক মালায় ঝলমল করছে। বড়ো বড়ো টবে বাহারি গাছ সাজিয়ে রাখা। দৃষ্টিনন্দন অট্টালিকা সারি। মুহূর্তের মধ্যে যেন সবরকম কষ্ট ভুলিয়ে দিল। ভেবেছিলাম এরই মধ্যে কোথাও ঠাঁই হবে। এমন বদ্ধমূল ধারণা মনের মধ্যে জাঁকিয়ে বসে ছিলো। এমন সময় কানে এলো পাশের সরু পথ দিয়ে উপরে এগিয়ে যাওয়া নির্দেশ। অপরিচ্ছন্ন সংকীর্ণ খাড়াই পথ। শ্যাওলা তো আছেই কিছু গাছগাছালি চোখে পড়ল। বৃষ্টি হয়েছিল পথ ভিজে আছে।আমারা হাতেপায়ে বেয় আরো চারতলা উপরে উঠে এসেছি। এখন দাঁড়িয়ে আছি একটি আড়াই ফুল চওড়া অলিন্দে। কোনো গেট খোলার লক্ষণ নেই। ফোনে কথোপকথন শুনছি। এতো রাতে ঘর দেওয়া যাবেনা। সকালে যা কথাবার্তা হবে। আমাদের কর্মকর্তারা জানালেন, আমরা তো ফোনে জানিয়ে রেখেছিলাম, নানা কারণে আমাদের পৌছাতে বিলম্ব হবে। এতগুলো লোক নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছি। গেট খুলুন আমাদের সঙ্গে কথা বলুন।

অধৈর্য হয়ে পেছন থেকে কাউকে উচ্চ গলায় বলতে শোনা গেল, আমাদের নে কি ফাজলামি করা হচ্ছে, আমরা মানুষ নয় নাকি? হঠাৎ হাট করে গেট খুলে গেল। ফর্সা ছিপছিপে একটি ছেলে হুড়মুড়িয়ে আমাদের জটলা ভেতর থেকে বাইরে যেতে গিয়ে প্রায় মাটি ছুঁয়ে পড়ল। আবার সেই ভাবেই উঠে অদৃশ্য হয়ে গেল। ভাবলাম চিৎকার চেঁচামেচিতে ওরা কি আতঙ্কিত। ওই ছেলেটাই কি প্রশাসনিক সাহায্য নিতে ছুটল। সে হলে তো ফোনে কাজ মিটে যেতো। তবে কি স্থানীয় ঠ্যাঙাড়ে বাহিনীর দ্বারস্থ হতে চাইছে। এখনকার নিয়ম কানুন কিছুই জানা নেই। ভাবলাম এই আড়াই ফুট জালঘেরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় জালিয়ান ওয়ালাবাগের শিকার না হই, বাইরে দাঁড়ানো অনেক নিরাপদ। আবার বাইরে মানে কয়েক তলা পাহাড়ের ধাপ মাড়িয়ে সেই স্বর্গোদ্যানে গিয়ে দাঁড়ানো। আর সত্যি সত্যি যদি ওই ভিনদেশী ছেলেটা ঠ্যাঙাড়ে বাহিনী আনে প্রথম শহীদ তো আমরাই হবো। তার চেয়ে যেখানে আছি সেখানেই থাকি।

সাতপাঁচ ভাবছি। সেই ছেলেটার আর দেখতে পেলাম না, তবে ফর্সা গোলগাল চেহারায় এক ভদ্রলোক আমাদের সামনের ঘরটি খুলে দিলেন। আমাদের দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা ভিতরে বসতে বললেন। আশ্বাস দিলেন, খাওয়ার কিছু একটা ব্যবস্থা এখুনি করছি। ভিতরে গিয়ে দেখলাম ছোট বোর্ডে লেখা ‘রিশেপসান রুম’। ভদ্রলোক রেজিষ্টার বুকে কিছু নথিভুক্ত করতে চাইছিলেন। আমাদের অশোকদা বললেন, আগে ঘরগুলো দেখিয়ে দিন পরে যা লেখার লিখবেন। কেউ পালিয়ে যাচ্ছি না। দুদিন তো থাকছি। সামান্য কিছু না লিখলে নয় লিখে নিলেন। সবার হাতে চাবি তুলে দিতে থাকলেন। আমরা ফোর বেডের ঘর নিলাম। কারণ আমরা সস্ত্রীক এবং মেজ মামা ও মামাতোভাই। এক রুমে থাকলাম।

আমাদের ঘরের চাবির নম্বর একশ-তিন। ঘর খুঁজে পেলাম কিছুতেই দোর খুলতে পারলাম না। বার দুই ওপর নিচ করলাম সন্তর্পণে। শেষে আনাড়ি ভাবে টানাহেঁচড়া করেও একই ফল পেলাম। আমাদের সবাই তখন যে যার ঘরে ঢুকে পড়েছে। অফিসে গিয়ে অভিযোগ জানালাম। ভদ্রলোক বললেন ও যাচ্ছে চলে যান। ও মানে সেই প্রথম সাক্ষাতের ছেলেটি। ওর মুখে ভাষা কিছু বুঝলাম না। শারীরিক ভাষায় ধরা পড়ল, চাবি খোলা কোনই ব্যাপারই নয়। এক্ষুণি খুলে দিচ্ছি। আমাদের হাত থেকে চাবি নিয়ে তালায় ঢুকিয়ে জোরে জোরে চাপ দিতে লাগল। চাবি বেঁকে গেল তবু তালা খুলল না। ছেলেটি হালকা হাসিতে হাত নেড়ে, আমরা যেদিন থেকে এসেছি তার বিপরীতে দ্রুত চলে গেল। এটাই বুঝিয়ে গেল চিন্তার কি আছে একটু দাঁড়ান খুলে দিচ্ছি। ছেলেটি শিবলিঙ্গ হাতে করে ফিরছে। আমাদের খুব পরিচিত বস্তু। গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে চেনে। শিলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে বাঁধা “নোড়া”। নোড়া দিয়ে দু’তিন ঘা মারতে কাজ হলো। আমরা তালা মুক্ত ঘরে বাস করতে আপাতত আপত্তি নেই, সেই পথে ঠান্ডা যুক্ত কষ্টের শেষ নেই। হাড় কাঁপানো বাতাস মানিয়ে নিতে পারবেন না। সমাধান হয়ে ছিলো তা অনেক পরে। ভেতরে খাটের সঙ্গে লেপ ছিল। বাথরুমে বরফের মতো ঠান্ডা জল। যতটুকু না ছুঁইলে নয় সেইটুকুই। আমাদের নিজেদের আনা শুকনো খাবার তাই খেয়ে রাতের কয়েক ঘণ্টা কাটানো। আমাদের শীতঘুমের মধ্যে ভেসে উঠলো ফেলে যাওয়া গ্রামবাংলায় এই সময়ে দাবদাহ বইছে। মানুষ গরমে অস্থির হয়ে পড়েছে। মঙ্গলময়ীর কৃপায়,মঙ্গলবার সকাল ছটায় মধ্যে প্রতিটি ঘরে চা বিস্কিট ও টিফিন পৌঁছে গেছে। মামাতো ভাই শঙ্কর দিয়ে যাওয়া খাবার কিছুতেই খেলনা। কর্মকর্তাদের ব্যবস্থাপনায় অসঙ্গতিতে ক্ষুব্ধ। যে কদিন থাকবে বাইরে থেকে কিনে খাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা। যদিও শেষ পর্যন্ত প্রতিজ্ঞা ধরে রাখতে পারেনি। একমাত্র মামাই আমাদের সঙ্গে বাধ্য হয়েই খেল মনে হয়। আমরা বেড়াতে এসেছি এটাই মাথায় রেখেছি। খাওয়া যাই হোক দেখার উপভোগ করাটাই মূল বিষয়।

অতো সকালে সবাই হোটেলে। আমি ও শঙ্কর নেমে এসেছি রাতের সেই স্বর্গোদ্যানে। নজর এড়ায়নি একটা ‘ক্লিনিক মারুতি ভ্যান’ গড়গড় করে কোথায় থেকে উঠে এসেছে এতটা উপরে। চমকে যাওয়ার মতো। সিঁড়ি দিয়ে তো আসেনি উঠল কী করে। তবে রাবণের সিঁড়ি আসেনি একদম নিশ্চিত। কোন পথ দিয়ে এতটা উপরে আসতে পারে আমাদের কাছে অজানা। অজানার উৎস জানার চেষ্টায় দুজনে হাঁটা শুরু করলাম উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথ ধরে। আমরা পায়ে পায়ে ক্রমশ উপরে উঠছি। পিছলে পড়ার উপক্রম। প্রায় চার তলার মতো উপরে গিয়ে থামলাম। এরপর এগিয়ে গেলে আবার নামতে হবে ঢালুতে। ওখানে গিয়ে দেখলাম আরো একটি পথ উপরের দিকে গেছে। ভৌগোলিক পরিস্থিতি বুঝতে চেষ্টা করলাম। ধাপে ধাপে সারিবদ্ধ আবাসিক ঘরগুলো ক্রমশ উপরে নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি বাড়ির সমনে দিয়ে পাথুরে পথ এঁকেবেঁকে উপরে নিচে যেন সাপ-লুডো খেলা করছে। আমরা তলা থেকে মনে করেছিলাম মাথার উপরের ঘরগুলো বিপদজনক ভাবে তৈরি হয়েছে। আবার উপরে গিয়ে দেখি নানা এগুলো নয় আরো উপরের ঘরগুলো সম্ভবত ভীষণ বিপদগ্রস্ত অবস্থায়। আপাতদৃষ্টিতে এমন মনে হবে। এইভাবে চলে আসছে কয়েক পুরুষ। পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগের কারণে ভ্রমণ পিপাসুদের দৈনন্দিন আগমন। নজর কাড়া প্রাসাদগুলো আসলে আবাসিক হোটেল। কখনো মাঝে মাঝে চোখে পড়বে পুরোনো কাঠের তৈরি বাড়ি। কারুকার্য মণ্ডিত। আমাদের সামনে তেমন পুরোনো আমলের কাঠের বাড়ি দেখতে পেলাম। এই বাড়ির মালিকেরা বাস করে। প্রাচুর্যের স্রোতে এই বাড়িগুলো প্রমোটারের কাছে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। উপরে না উঠলে অনেক কিছুই অজানা থাকত। আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম রাজপথের এক ঝুল বারান্দার মতো এক জায়গায়। তলায় পথ বেশ চওড়া। কোন দিকে গেছে জানিনা। কিছু ঠিকে শ্রমিক মোটা দড়ির পাঁচে পঁচিশটা করে ইট সাজিয়ে,দড়ির একটা অংশ মাথায় রেখে, ধীরে ধীরে পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আমরা দেখছি উপর থেকে, আঁকাবাঁকা পথে, ছোট ছোট সাঁকো পেরিয়ে ছোট হতে হতে বিন্দুতে মিলিয়ে যাচ্ছে। যেখানে এখনো প্রশস্ত পথ গড়ে ওঠেনি। জীবন সংগ্রামে লড়াই করা ওই দূরের মানুষগুলো খুব সাধারণ ভাবে ওখানে থাকে। আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্য থেকে এখানেও ওরা বঞ্চিত। আর এই ইটগুলো যেখানে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে যারা স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখা কিছু সাধারণ মানুষজন।

এখন আমরা হোটেলে যাওয়ার জন্য পিছু ফিরতে হলো। বাঁকের এক কোণে দোকান দেখলাম। কয়েকটি ভাষায় কয়েকখানা পত্রিকা সাজানো। আমি দেখলাম আমার প্রিয় হকার ভাই প্রতি সকালে যে পত্রিকাটি আমার বাড়িতে রোজ দিয়ে আসে সেটি পেয়ে আনন্দ পেলাম। কিন্তু গোঁ ধরেছে মামাতো ভাই। তার যুক্তি বিদেশে এসে বাংলা ভাষার সংবাদ পত্র কেনা উচিৎ হয়নি। এখন লোক কী ভাববে। কি জানি বাবা, পড়াটা বড়ো কথা নয়। ইংরেজি পত্রিকা হাতে থাকলে রাজভবন থেকে লোক পাঠিয়ে ডেকে নিয়ে যাতো বিশেষ অতিথি করে। ইংরেজি সংবাদপত্র কিনে অন্তত আউড়ে কিছুই বুঝতাম না তা কিন্তু নয়। অসুবিধা হতো আমাদের অন্য সঙ্গীদের নিয়ে। সবাই তো এখনো গোঁ ধরে বসে আছে দার্জিলিং ভ্রমণ সূচিতে আছে কেন নিয়ে যাবেনা। এখনো ওখানে রাজনৈতিক হিংসাক্তক গণ্ডগোল চলছে কাগজে তার খবর সমানে দিচ্ছে।

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে, বৈকালে কেনাকাটার জন্য বেরিয়ে পড়ল সবাই। আমাদের কেনার ছিলনা দেখার কৌতূহল ছিল প্রবল। মামাতো ভাই খোঁজ নিয়েছে এখনকার সবজি বাজার দেখার মতো। কয়েক তলা বিল্ডিং এথরে বিথরে সাজানো। রেডিমেড জামা কাপড়ের দোকান আছে। আমরা চা খেতে বেরিয়েছিলাম মামা, মামাতো ভাই, আমি ও আমার গিন্নি। আমরা হাঁ করে দেখছিলাম। কোথাও গ্রিল দিয়ে ঘেরা নেই। বাঁধা দোকানগুলো সাটার বসানো। আমরা যে পথ দিয়ে হেঁটে চলেছি ঠিক মাথার উপরে মোটা সরু লোহার পাইপের জাল বিস্তার করা হয়েছে। সবচেয়ে সরু পাইপ প্রতিটি দোকানের এসে শেষ হয়েছে। আমরা নিজেদের মধ্যে নানারূপ মন্তব্য সরিয়ে রাখলাম। ওখানকার দোকানীদের থেকে জানতে পারলাম, ওই পাইপের মধ্যে দিয়ে এই বিরাট বিল্ডিং-এর প্রাণ প্রবাহিত হয়। অর্থাৎ অগ্নি নির্বাহকের জন্য জল সরবরাহ পাইপ এবং উপরে জল সঞ্চয় করা আছে। মেইন পাইপ জলাধারের সঙ্গে যুক্ত। এমন সুরক্ষিত ব্যবস্থা আমি এই প্রথম দেখলাম। বেশ ভালো লাগল।

রাতে খাওয়া শেষের পরে কর্মকর্তারা জানিয়ে দিলেন। সকলে সাড়ে ছটার সময় এখনকার গাড়িতে ছেঙ্গুলেক ও বাবাপাহাড় দেখতে যাওয়া হবে। আমরা চা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়ব। আমরা সেই মতো গাড়ি স্ট্যান্ডে আগু পিছু করে পৌঁছে গেলাম। বহু গাড়ির মধ্যে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট গাড়ি কোনগুলো বুঝতেই পারলাম না। দুটো গাড়িতে দুবার বসলাম আবার কার কথায় যেন নেমেও এলাম। দিশাহীনভাবে ঘুরতে গিয়ে চোখে পড়ল, আমার স্ত্রী ও মামাতো ভাই একটি মারুতি ভ্যানে বসে আছে। আর জায়গা নেই। ভালোই হলো গিন্নি একলা থাকলে চিন্তা হতো। বিদেশ বিভূঁই বলে কথা। আমি ও মেজমামা একটি গড়ির পেছন উঠলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ি গড়াল দিনের আলোয়, পাহাড়ি পথে। তবে এতো খাড়াই ঢালে গাড়ি ওঠা নামা করছে, পাশে খাদ রাতে হলে বুঝতেই পারতাম না। অতটা ভয়ের ছিলনা। ক্রমে লোকালয় ছাড়িয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে বিপদজনক সীমানা পেরিয়ে গাড়ি চলেছে তার আপনার গতিতে দুলকি চালে।

আমাদের গাড়িতে এক সুখী পরিবারটি ছিলো। পরে হাবভাবে বুঝলাম ওরা দম্পতি নয়। পুরুষি আগেই এসেছিল। তাই স্বেচ্ছায় গাইডের কাজটি নিরলস ভাবে করে যাচ্ছেন। আমরা যে তাদেরই সহযাত্রী তা তাদের ভাবার কথা নয়। মনে হলো ভদ্রলোক হাতে ধরে ওই ভদ্রমহিলাকে দেখাচ্ছেন বলে, পাহাড়ের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে বা বুঝতে পারছেন। আমরা বাড়তি যারা একই গাড়িতে আছি কিছুই দেখতে বা বুঝতে পারছি না। ঈর্ষার কিছুই নেই। ওই ভদ্রলোকের একক সিদ্ধান্তে ও অসামাজিক আচরণের সম্বিৎ ফিরেছিল আমাদের। আমাদের কী হয়েছিল পরে বলছি। এইটুকু বলে রাখি, এরা হলো শিলিগুড়িতে থেকে যাওয়ার গোঁ ধরেছিল। থাক এসব কথা যে যেভাবে আনন্দ উপভোগ করে করুক। গাড়ি পাহাড়ের গা কেটে তৈরি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে ছেঙ্গুলেকে পৌঁছল। গাড়িতে নামতে দেখি বেশ শীত শীত করছে। এরই মধ্যে হালকা তুষার বৃষ্টি হয়েছে। অবাক দৃষ্টি নিয়ে এদিক ওদিক দেখছি। ভ্রমনার্থীর অনেকে ওখানকার স্থানীয় পোষাকে চামরি গরুর পিঠে চড়ে মজা করছে ছবি তুলছে। অত উঁচু পাহাড়ের উপরে বিশাল জলাধারকে ছেঙ্গুলেক বলে। সারা লেকের জলে বৃষ্টির ফোঁটায় বুটিক বসানো কাপড়ের মতো দেখাচ্ছে। কোনো কারণে ওই সময় প্যাটেল ভেলা ছিলনা। লেকটির উপরই ভাগে প্রশস্ত করার কাজ চলছিল। এখনে কিছুক্ষণের জন্য গাড়ি থামিয়ে উপভোগ করে আবার উপরের দিকে উঠতে চাইবে বাবাপাহাড়ের ডেরায় যেতে।

একনজরে দেখতে পেলাম, একজন কলার ফেনি ও পাউরুটি পলিপ্যাকে ঝুলিয়ে বেশ গল্প করতে করতে এদিকে আসছে। আমাদের অন্য সঙ্গীদের হাতে ওইরূপ খাদ্যবস্তু দেখছি। ভেবেছি কিনেই আনছে। সুদৃশ্য দোকান ঘর থেকে। পরে বুঝলাম ওটি ঘর নয় বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা গৃহ। প্রসাদ সরূপ এমনিতেই দান করছে ভ্রমণার্থীদের। আমার না জানার কথা। সবার কথা শুনে কৌতূহলী হয়ে গেলাম। আমাদের কপালে বিশেষ করে আমার কপালে ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট ছিলনা। তবে অনেকে অনেক কিছু ফাউ পাওয়ার কপাল নিয়ে জন্মেছে, এই অধম নয়। সামান্য ওই খাদ্যবস্তু নাইবা হলো। যেহেতু ওটি প্রসাদ, তাই অসামান্য বলতেই হবে। এবার মনে পড়ল, আমার গিন্নিদের গাড়ি তো এখনো পৌঁছালো না। তবে কি অনেকটা পেছনে আছে। আমাদের গাড়ি আগে ছেড়েছিল তাই বলা। হঠাৎ হঠাৎ পাহাড়ে ধস নামে। পাহাড়ের এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। এমন যেন না হয়।

ওইযে অযাচিত নাগর তার সঙ্গীদের বুঝিয়েছেন গাড়ি চালকের সুপরামর্শের কথা। এক গ্লাসে কথাবার্তা জমিয়ে ফেলা পথের বন্ধু। আবহাওয়া ভালো নয় এখন থেকেই ফিরে যাওয়া নিরাপদের। ওপরে এমন কিছু দেখার নেই। আমার মতামত জানতে চাওয়া হলো। বললাম, ‘বাবার মন্দির’ যাবো বলে বেরিয়েছি। ওখান থেকেই ফিরব, যা হয় হবে। বাধ্য হয়ে গাড়ি গড়িয়ে চলল সামনের পথ ধরে আরো উপরের দিকে। বেশ অনেকটা যাওয়ার পরে খাড়াই পাহাড়ের পাশে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। খাড়াইয়ে আগে অনেকটা ঢাল হয়ে উপরের দিকে গেছে। হঠাৎ ধোঁয়াশায় ভরে যায়। পরে শিলাবৃষ্টি পড়তে থাকে। এমনটা সবসময় হয়না। অপ্রত্যাশিত পাওনা। গাড়ি থেকে নেমে ছেলে মানুষের মতো ছোঁড়াছুড়ি করলাম। আবার গাড়িতে উঠলাম, বাবা পাহাড়ের দিকে গাড়ি চলল। গাড়ির মধ্যে সবাই একবাক্যে স্বীকার করল ছেঙ্গুলেক থেকে ফিরে গেলে পাহাড়ের দেশে শিলাবৃষ্টির অপূর্ব নান্দনিক চোখে হারাতাম।

পাহাড়ের শীর্ষদেশে বাবামন্দিরের অনতিদূরে গাড়ি পার্কিং করল। আমরা বেরিয় পড়লাম। বাইরে বৃষ্টি পড়েছে, বেশ ঠান্ডা লাগছে। কাছে ছাতা ছিল মাথায় দিয়ে বেরির পড়লাম বাবা সাহেব দর্শনে। বিরাট লাইন। দাঁড়িয়ে আছি। আর পেছনে দেখছি ওদের গাড়ি কত দূরে বা কি অবস্থায় আছে। বলতে গেলে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছি। যেমন তেমন সাতপাকে বাঁধা অগ্নিসাক্ষী করা বউ। হঠাৎ দেখি এক মহিলা আমার হাত থেকে ছাতা কেড়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। পরে বুঝলাম আমার অর্ধাঙ্গিনী। আমাদের আগেই নেমেছে। আমারা যখন ছেঙ্গুলেকে নেমে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন পেরিয়ে এসেছে। আমাদের ডেকে ছিলো বুঝতে পারিনি, ভেবেছি পেছনে আছে। মিলিটারি ফোর্স দর্শণার্থীদর কন্ট্রোল করছিল। দীর্ঘক্ষণের পরে যখন মন্দিরটির সামনে পৌছুলাম দেখলাম বাঁধান ছবি। যেটি দেখার জন্য অধীর আগ্রহে এই পাহাড় চুড়ায় আসা। সবার কৌতূহলের বা আকাঙ্ক্ষিত “বাবা সাহেব”। ইনি একজন মিলিটারি ম্যান ছিলেন। কী অবিশ্বাস্য কারণে তাঁর এতো জন পরিচিতি সে ইতিহাস পরে জেনেছি। যা অতি বিশ্বাসের ফল।

বাবা পাহাড় থেকে এক সঙ্গে আমাদের চারখানা গাড়ি ছাড়ল। নিরাপদে ছেঙ্গুলেক পেরিয়ে গেলাম। গ্যাংটক পৌছানোর আনেক আগেই ধসের কবলে পড়লাম। গাড়ি পিপড়ের সারের মতো দাঁড়িয়ে গেল। অনেকেই নেমে বাইরে দাঁড়ালাম। ইতিমধ্যে হয়ে যাওয়া শীলাবৃষ্টি গালিচার মতো বিছানো আছে। প্রথমের মত আর মন ভালো নেই কেউ বরফ নিয়ে খেলবে। কখন পথ পরিস্কার হবে এই চিন্তায় সবাই বিভোর। তবে আমাদের সামনে ধসে পড়েনি। কোথায় পড়েছে, কত দ্রুত কাজ হচ্ছে জানিনা। একসময় আটকে থাকা গড়ি চলতে শুরু করেছে। একে একে আমাদের গড়ি পাহাড় সংলগ্ন লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। লোকালয় বলতে ঘিঞ্জি ঘরবাড়িতে ভরা। ওইটুকু পেরিয়ে গেলে শৈলসহরে ঢুকে পড়া। প্রশস্ত পথে আমাদের গাড়ি এলো পাশে থেকে তিনখানা গাড়ি পেরিয়ে গেল। আমাদের গাড়িটি সামান্য ঘুরে একটি কংক্রিটের সেটে এসে ড্রাইভার বলল, এখানে সবার নামতে হবে। আমি লক্ষ্য করলাম এটা নতুন জায়গা। এখন থেকে আমাদের গাড়িতে তোলা হয়নি। সামনে যারা বসে ছিল তাদের ভাবের ভাবিকে নিয়ে ব্যস্ত। ষণ্ডামার্কা লোকটির সঙ্গে আমাদের সেভাবে পরিচয় গড়ে ওঠেনি তিনিও রাখতে চাননি। আমাদের কথা না ভেবে প্রিয়সঙ্গীদের নিয়ে রাস্তার রানিং বাস ধরে হুস করে বেরিয়ে গেল। আমরা কিছু বলার সুযোগ পেলাম না। আমি আর মামা পড়ে রইলাম অজানা জায়গার, আলো আঁধারিতে।

পরে ফোনে পথ নির্দেশ জেনে নিলাম। আরো এক ভোগান্তি শুরু হলো চলতি গাড়িতে ওঠা নিয়ে। ওখানে নির্দিষ্ট সংখ্যাক প্যাসেঞ্জার নেবে। কোনো গাড়ি দুজনের নেবে না। কে আগে যাবে, কেউ কাউকে ছাড়তে পারছি না। এক বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের অবস্থা বুঝলেন। তিনিও কাছাকাছি কোনো হোটেলে উঠেছেন। তিনি এর আগেও এসেছেন। আমাদের সমস্যা মেটালেন। একটা কথা মনে রাখতে হবে। একান্ত পরিচিত সঙ্গী ছাড়া ভ্রমণের আনন্দ মাটি হয়ে যেতে পারে। সব মানুষ তো দায়িত্বশীল হয় না। আর যারা নারীসঙ্গ পেতে বেশি আগ্রহী, পুরুষ বন্ধুর কথা ভাববেই কেন। যাইহোক ভালোয় মন্দে গ্যাংটক ভ্রমণ খুব ভালোই উপভোগ করেছিলাম। যা কখনো ভোলার নয়।

বাঘমারির জঙ্গলে [কিশোর গল্প]

প্রশান্তকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন কি বড়ো হয়েছে। এ বছর বড়ো ইসকুলে গেছে এইযা। তাকে কি এমন বড়টা ভাবা যায়। সেই ছেলে কোথায় আর যেতে পারে। অনেকের মুখে অনেক কথা শুনছে। সেটাই তো ভয়ের, যে জেদি ছেলে। বেলা প্রায় ডুবতে বসেছে। আবার যে কখন ফিরবে, কে জানে। তবে যেখানে থাকুক না, সন্ধ্যার আগেই ফিরবে তো! মায়ের মন কোনোভাবে প্রবোধ মানছে না।

প্রশান্তর কাকা খবরটা এনেছিল,গতরাতে পঞ্চমের হাট থেকে ফিরে। বাঘমারির জঙ্গলে বাঘ ঢুকেছে। তবে কয়েকদিন আগের ঘটনা। দমকলের ওদিকটায় সকলে ভয়ে ভয়ে রাত কাটাচ্ছে। রাতে পটকা ফাটাচ্ছে। আগুন জ্বালিয়ে ভয় দেখাচ্ছে বাঘ মামা’কে। এতো করেও নিশ্চিতে কেউ নেই। কখন কার ঘাড়ে হালুম করে পড়বে কে জানে। লোকালয় তো বাঘের নাগালের মধ্যে এখন। সুন্দরবনের বাঘ বলে কথা। পেটে খাদ্যের টান পড়লে দেখছি আজকাল প্রায় নদী ঝাঁপিয় এপারে আসে। এসেছেও এর আগে, না এলে বাঘমারি নাম হলো কি করে। যেমন বাগদিমারি। সুতি নদীতে কুমির ঢুকে এক জেলেবাগদিকে টেনে নে’যায়। এইভাবে ওখানকার নাম বাগদিমারি। এখন সেই নদী মজে গেছে। সেখানে এখন শ্মশান গড়ে উঠেছে। তেমন সুন্দরবনের লোকালয় ঘেঁষা ছোট্ট দ্বীপের নাম বাঘমারির জঙ্গল।

প্রশান্তর মনে ধরেছে কাকুর যে কথাটা। আগামীকাল বাঘমারি ঘেরাও করবে। যেভাবে হোক বাঘের বন থেকে তাড়াতেই হবে। গুলি করে মারার অনুমতি নেই। আইন বিরুদ্ধ কাজ। পশু সংরক্ষণ আইন খুব কড়া। দলবেঁধে বনের মধ্যে ঢোকার অনুমতি পাওয়া যায়না। তবুও বনের মধ্যে ঢুকবে। প্রশাসনকে উপেক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত কী হয় ওখানে গেলেই বোঝ যাবে। যেভাবে হোক প্রশান্ত ওখানে পৌছবে। আগু-পিছু না ভেবেচিন্তে বেরিয়ে গেছে। বোঝা যাচ্ছে না কাউকে সঙ্গে নিয়েছে কি না।

শীতের সকল। মাঠে বর্ষার ধান কাটা হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো নাড়া মাঠময় খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বেশিরভাগ বাদায় খেঁসারি কড়াই বোনা। নাড়ার গা’ধরে দাঁড়িয়ে, ফলফলে কড়াই গাছ যেন উঁকি দিয়ে আকাশ দেখছে। ফলে ফুলে ভরে আছে। কড়াই গাছ মাড়িয়ে হেঁটে চলেছে। দু’চারে কড়াই শুঁটি সমেত গাছ তুলতে ভুলবে কেন। কাঁচা কড়াই খেতে খেতে মজা করে যাওয়া। একেবারে ফাঁকা মাঠ নয়। পানের বরজ। সিমের মাচা। ঢ্যাঁড়সের বাগান।লঙ্কার বাগান। কোথায় ঘিরে রাখা নেই। ঘন গাছপালা দেখলে ভয় করে। ওখানে বাঘ গা’ঢাকা দিয়ে ওঁৎ পেতে বসে নেই তো? থাকতেও পারে। আবার নদীর ধারধরে যাওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। গেঁওয়া বানির ঘনবন। ভয় তো হবেই। যতটা সাবধানে থাকা যায়। ভয় আছে জেনে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। যদি প্রাণের ভয়কে প্রাধান্য দিতে হয়, এখন থেকে বাড়িতে ফিরতে হয়। সে তো জঙ্গলে ঢুকবে ঠিক করেই এসেছে। ভয়কে জয় করে এগিয়ে যেতেই হবে দৃঢ় সংকল্প। বাড়ির কাউকে বলে বের হয়নি। ফিরে গিয়ে জানাবে।

প্রশান্ত লোকালয় ছাড়িয়ে গেছে। নদীর বাঁধ অনেকটা সামনেই। একটা দোচালা কুঁজি ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। মাছের ঘেরি মোনার জন্য এই দোচালা কুঁজি। একটি লোক বসে জাল বুনছে। লোকটির থেকে জানতে পারল, এই ঘেরির নরম কাদায় বাঘের থাবার দাগ এখানো আছে। দেখল হুবহু বিড়ালের পায়ের ছাপ যেন। আকারে বড়ো এই যা। এই জন্য তো বাঘকে বিড়ালের মাসি বলে। বাঘের পায়ের ছাপ দেখে ভয় হলো। কৌতূহল আরও বেড়ে গেলো। দ্রুত পা চালিয়ে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলল।গন্তব্যে পৌঁছে দেখল মেলা বসেছে নদীর এপারে। তখন একটার মতো বাজে। নদীতে ভাটা। জল তলায় নেমে গেছে। তবুও নদী পেরুতে নৌকা লাগবে। প্রশান্ত না দাঁড়িয়ে একহাঁটু গদের মধ্যে নেমে পড়ল। তার বয়সি অনেক ছেলে রয়েছে। তাদের কেউ যাওয়ায় নিষেধ করেনি। তবে তার বাধা কোথাও নেই।

প্রশান্ত মোটামুটি ভৌগলিক চিত্র বুঝে গেছে। উত্তরে মৈইপীঠ। দক্ষিণে দমকল। যেখানে দাঁড়িয়ে বাঘের গর্জন এপার থেকে শোনা যায়। এই দমকলে মেজ পিসির বাড়িতে বাবা মায়ের সঙ্গে কয়েকবার এসেছে। এখন নদী পেরিয়ে বাঘমারিতে উঠতে চলেছে। যেখানে স্থানীয় মানুষজনেরা জীবিকার সন্ধানে আসতো। মাছ, কাঁকড়া, ডাগরোল মাছ ধরতে। জ্বালানি কাঠ কাটতে। আর কিছু বিলাসী মানুষ পাখি শিকার করতে সপ্তাহে একদিন তো আসবেই। ছিটে বন্দুক নিয়ে। সেই নিরাপদ বনে হিংস্র বাঘের অনুপ্রবেশ। তাকে চরম শিক্ষা দিতে সশস্ত্র অভিযান। সশস্ত্র বলতে লাঠিসোটা ছাড়া তেমন চোখে পড়ার নেই। প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে গোপনে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেও থাকতে পারে প্রশান্ত চোখে পড়েননি।

বাঘের ভয়ে জনজীবন সন্ত্রস্ত। পঞ্চায়েত উপরমহলে জানিয়েছে। তারাও উপরমহলে জরুরি বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছে। নদী নিকটবর্তী বসবাসকারীর জীবনের ততটা মূল্যবান নয়।তাই সংকট বার্তা ধীর লয়ে এখন ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। যারা লিখিত বয়ান বন-দপ্তরে পৌঁছে দিতে গিয়েছিল, একটি কথা শুনে এসেছে। যতই ক্ষতি করুক বাঘ মারার চেষ্টা করবেন না। অনেকটা এইরকম শুনিয়ে দিলো- দু’চারটে মানুষের চেয়ে বাঘের মূল্য অনেক। এমন কিছু করতে চেষ্টা করবেন না আইনের রোষে পড়তে পারেন। আমরা দেখছি দ্রুত কতদূর কি করতে পারি। এক সপ্তাহের অধিক সময় পেরিয়ে গেছে। আশ্বাসের বাণীর শীতল স্পর্শে এখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়েনি। প্রশাসন হাত গুটিয়ে বসে নেই। হয়তো বিষয়টা গুরুত্ব সহকারে বোঝার মতো এখনো সময় হয়নি। তেমন করে ভাবতেন, বন-দপ্তরের কর্মকর্তাদের দেখা মিলছে না কেন।

মাঠ ভেঙে আসার পথে প্রশান্ত একটা ব্যাপারে লক্ষ্য এড়ায়নি। যতই তুলনামূলক ভাবে ছোট হোক। যাদের ঘাড়ে বাঘের থাবা প্রথম পড়বে। তাদের কোনপ্রকার যেন হেলদোল নেই। স্থানীয় বসবাসকারীদের দেখে স্বাভাবিক আচরণ মনে হয়না। কেমন নিশ্চিন্তে বাগানবড়ির কাজকর্ম করছে। দোকানে বসে পা’ঝুলিয়ে খোশমেজাজে গল্পগুজব করতে দেখা গেছে। তারা ছোটরা মরণপণ করে বাঘের বনে ঢুকতে চলেছে। স্থানীয় লোকেদের তো তেমন উৎসাহ দেওয়ার দায়টুকু নেই মনে হচ্ছে। কাদের জন্যে জীবন বাজি রেখে এসেছে কী জানি বাবা। এদের দেখে প্রচলিত প্রবাদের কথা মনে পড়-‘কাজ সেরে বসি, সত্তুর মেরে হাসি’। যেন তেমন কিছু করে নিশ্চিত হয়ে সবাই বসে আছে। প্রশান্তর এতো জটিলতা বোঝার বয়স হয়নি।

নদী পেরিয়ে অভিশপ্ত চড়ায় এখন প্রশান্ত। একগাছি বন্দুক নিয়ে যে মানুষটা প্রথম সারিতে অজিত ডাক্তারের ছোট ভাই। প্রশান্তের গ্রামের লোক। ইসকুলে যাওয়ার পথে প্রায় দেখা হয়। বিপদের মধ্যে কেউ কারো চেনা থাকেনা প্রশান্ত বুঝে গেছে। কিছুইতে বুঝতে পারছে না আগু-পিছু করে কতজন বাঘের সঙ্গে লড়তে এসেছে। সামনে থেকে কী সংকেত আসছে। পেছন থেকে কী সংবাদ পৌঁছচ্ছে। কিছুই অনুমান করতে পারছে না। সবাই যে কী শুনতে কী শুনে তালগোল পাকাচ্ছে কে জানে বাবা। ছোট বলে সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে স্পষ্ট কেউ কিছু বলছে না।

সুন্দরবন বলতে অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে ওঠা বিশাল অখণ্ড বনভূমি নয়। বহু বনের সমাহার। বনের কথা বললে দ্বীপের কথা উঠবেই। মূল দ্বীপ ছাড়া অসংখ্য। অসংখ্য দ্বীপ যেমন গড়ে উঠেছে আবার জলের তলায় তলিয়ে গিয়েছে,গাছগাছালি সমেত প্রাণীকুল নিয়ে। তেমন এক ছোট গড়ে ওঠা দ্বীপ এইটি। যেখানে প্রশান্তর বয়সি দাঁড়িয়ে আছে অনেকে। এই যে দ্বীপ। যেখানে বাঘ থাকার কথা নয়। বরং জীবীকার সন্ধানে আসা মানুষের অভয়ারণ্য এতদিন ছিল, এখন তা নেই। চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়।

লোকালয় সংলগ্ন বন থেকে বাঘ তাড়ানোর সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি। সবটাই দুর্বল চেষ্টা চলছে বলা যায়। বিশেষ করে রাতেই তো ভয়ের ব্যাপার। সারারাত মাঝে মাঝে পটকা ফাটিয়ে। আগুন জ্বালিয়ে। মুখ দিয়ে বিকট আওয়াজ করে বাঘ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলেছে বেশ কয়েকদিন ধরে। এইযে দিনের আলো থাকতে থাকতে বনের মধ্যে তেড়েফুঁড়ে যাওয়া এ-ও একপ্রকার বাঘের ঠেকিয়ে রাখা বলা যায় । যাতে বাঘ ভয় পেয়ে নদী সাঁতরে গভীর সুন্দরবনে আবার যাতে ফিরে যায়। কাজ যে একেবারেই হয় না তা বলব না। প্রশান্তরা এসব বুঝতেই পারছেনা বাঘ কোথায় কী অবস্থায় আছে। তাদের আশপাশে ঘাপটি মেরে বসে নেই তো! সুযোগের অপেক্ষায়। ভাবলে গায়ের লোম খাড়া হয় ওঠে। এতো ঘরের পোষা বেড়াল নয়। কিছু ছুঁড়ে দিলে খুশী হবে। অথবা খিদে পেলে খাওয়া জন্য পায়ে পায়ে জড়াবে। মিউ মিউ করে বিরক্ত করবে। বাঘ জানে কী করে ঘাড় মটকে খাদ্য সংগ্রহ করতে হয়। এমন অলক্ষুণে কথা প্রশান্তর মনে যতই না ওঠে ততই ভালো।

মুহূর্তের জন্য প্রশান্ত ভাবনার মধ্যে ডুবে ছিলো। সবাই তখন ঠেলাঠেলি করে বন থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। প্রশান্ত না চাইলেও মুখ ফেরাতে বাধ্য হলো। বন ছাড়ার আগে প্রকৃত সত্য তার জানা হয়ে গেছে। সামনে সবাই যেখানে থমকে গেছিল। ঠিক সেখানেই বিকৃত অবস্থায় বাঘটি পড়ে ছিলো। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া হয়েছে। তুকতাকের কাজে লাগবে বলে। বনে ঢোকার আগে দেখে এসেছিল, বিশাল শরীরের মহিষ। একটি লাঠির গায়ে বাঁধা। বাঘের শিকার হওয়া ক্ষতবিক্ষত মৃত মহিষ। খুব চাপাভাবে মুখে মুখে ফিরছে, ওই মৃত মহিষের শরীরে বিষ ঢেলে দেওেয়া হয়েছিল। বাঘটি বিষাক্ত মাংস খেয়েই মারা গেছে। এই বনে তার অন্য সঙ্গী হয়তো সেও আরও গভীর মরে পড়ে থাকতে পারে। তবে এসব কথা ধারণা মাত্র।

সুন্দরবনের বাঘ যেমন শক্তিশালী। আর নোনা পাতায় চরতে আসা মহিষ শারীরিক ক্ষমতায় কম যায়না। সেই মর্মান্তিক দিনের সূর্যাস্তের আগে বাঘ- মহিষের সে কী লড়াই। নদীর ওপর থেকে শুনেছে মহিষের ভয়ংকর আর্তনাদ। বাঘের গর্জন। বড়ই মর্মস্পর্শী যা ভোলার নয়, শরীরে কাঁপন ধরায়।সবার ধারণা একটা বাঘের পক্ষে সম্ভব নয়। বেকায়দায় পড়ে মহিষটি জীবন দিয়ে থাকতে পারে। সবার মনে সন্দেহ দানা বেঁধেছে। সেদিনের পর থেকে আর এপারের মহিষ ওপারে পাঠতে কারুর সাহস হয়নি। তাছাড়া মহিষের চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট দেখেছে।

বনের মধ্যে যারা ঢুকেছিল, অনেকের বন্যপ্রাণীর সম্পর্কে বাস্তব ধারণা আছে। বাঘেরা দিনের কোন সময় থেকে শিকারের জন্য প্রস্তুত হয় তাদের জানা আছে। সূর্য পশ্চিমে অনেকটা গড়িয়েছে। এদিকে জুয়ারের জল নদীর জেগে থাকা ঢালু চর ক্রমশ ঢেকে ফেলছে। জল যতই বনের ধার ঘেঁষবে, খোলা জায়গা কমতে থাকবে। তখন জলে কুমির ডাঙায় বাঘের নাগালে পড়ার ভয় প্রকট হয়ে উঠবে। এককথায় উভয় সংকট। প্রাণ নিয়ে ফেরা মুশকিল। যা কানে কানে ভেসে আসছে মৃত সঙ্গী যে বেঁচে নেই কে বলতে পারে? যতই তাড়াতাড়ি বন ছাড়া যায় এখন তার লড়াই শুরু হয়ে গেছে। নৌকায় ওঠার জন্য প্রশান্ত ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

উত্তরাখণ্ডের নৈসর্গিক পাহাড়ি পথে [On the hilly roads of Uttarakhand]

খণ্ড ১

[খাসির মাংস এবং জাগ্রত বিচুটি]

ভ্রমণ স্থলে পৌঁছানোর আগের কিছুটা সময়, শূন্য সময় ধরে নিতে পারি। অভিযানের শুরুতে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে, অনেকে ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। আবার যেখানে বেড়াতে চলেছি, অনেককিছু দর্শনীয় বস্তু বা স্থানের মধ্যে একটাকেই নামে বা ক্ষেত্রের প্রাধান্য দিয়ে থাকি। যেমন, হাজারদুয়ারি, পুরীর মন্দির, সুন্দরবন। অথচ সেখানে হাজারো দেখার জিনিস থাকে। যদি সুন্দরবন একমাত্র দেখাই উদ্দেশ্য হয়। বাঘ, কুমির, হরিণ দেখার জন্য উৎসুক হই কেন? না দেখতে পেলে মন খারাপের গল্প করি কীসের দুঃখে। অরণ্য কেন্দ্রিক সামগ্রিক উপভোগ করাই হলো সুন্দরবন ভ্রমণের বিশেষত্ব।

আমাদের আজকের ভ্রমণের যে নামটি মুখে মুখে ঘুরছে ফিরছে এবং এখনো একই ভাবে অনড় আছি, তা হলো কৌশানী। আমাদের ভ্রমণের শেষ রাত্রিবাসের জায়গা। মজার হলো, ওই নামের ফুটফুটে দুরন্ত ছোট্ট মেয়েটি আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। তার নামটাও কৌশানী। আমাদের কৌতূহলের বিষয় এটাই, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পাহাড়ি স্থানটি কতটা সুন্দর, আমাদের ছোট্ট মেয়ে কৌশানীর থেকেও। নিছক কৌতুক করে বললাম। পাঠক বন্ধুরা আমাকে প্রশংসা করে বলতেই পারে, একদম পাকা ঘোল ব্যবসায়ী। তাহলে মারাত্মক ভাবে ভুল করবেন। মেয়েটির চোখে দেখলে, রূপে মুগ্ধ হবেন। ওর সঙ্গে আমার কোথায় মিল সেটাই বরং বলে রাখি জেনে রাখুন। তাহলে ওদের সঙ্গে আমাকে আলাদা ভাবে চিনতে সুবিধা হবে।

কৌশানীকে নিয়ে উত্তরাখণ্ডের ভ্রমণ সূচিতে মোট পনের জন। রাত নটা-পঁয়তাল্লিশে হাওড়া থেকে বাগ-এক্সপ্রেস ছাড়ল। রায়বেরেলি পৌঁছাল সকাল দশটায়। যেখান থেক ভারতের একসময়ের কয়েকবারে জয়ী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গন্ধী দাঁড়াতেন। ওখান থেকে গন্তব্যের শেষ ষ্টেশন কাঠ-গুদাম। সবাই লাগেজপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম। এইযে দুই রাত্রি, একদিন ট্রেনের মধ্যে কাটিয়ে চতুর্থ দিবসের প্রায় মধ্যভাগে এখন। এই দীর্ঘসময়ে কৌশানী ও আমি রেলকোম্পানির খাতায় দু’জনের নাম নেই। অথচ আমরা সশরীরে বিরাজ করেছি। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ডিব্বাতে।

তিন জায়গায় আমাদের সিট পড়ে। কৌশানী তিন জায়গায় ছোট্ট পায়ে দাপিয়ে ফেরে। আমি আপার ও লোয়ারের মধ্যে ওঠা নামার সময় পেরিয়ে যায়। একমাত্র আমরা দু’জন টিটি’র ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পড়লাম না কেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয় হতে পারে। ছোট্ট কৌশানীর বয়সের ছাড় আছে কিন্তু আমার বেলায় তা তো খাটে না। ফুটফুটে সুন্দর মুখের মামা বলে। ওর মা তো আমাকে সেই ছোট থেকে শিবেনদা বলে সেই অর্থে মামাই। তাই বলে ষাটোর্ধকে রেল কোম্পানি ভাড়া মুকুপ করবে কোন সুখে। আমি বিনা টিকিটের যাত্রী নই, সেই রহস্য প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারবেন। আমাদের ভ্রমণ গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাক্তন শিক্ষকের ছড়াছড়ি। আছে সরকারি ডাক্তার, সরকারি চাকুরে, রামকৃষ্ণ মিশনের নবীন মহারাজ, কাজলদি। একমাত্র আমি অতি সাধারণ, এগারো দিনের সফরসঙ্গী।

অললাইনে ট্যাভেরা ও ইনোভা দুটো গাড়ি কদিনের জন্য ভাড়া করে রেখেছিল। গাড়ি ষ্ট্যাণ্ডে ছিলো। ফোনের মাধ্যমে উভয়ের সাক্ষাৎ হয়ে গেল। আমরা দুটি দলে ওখান থেকে ভাগ হয়ে গেলাম। এই ভ্রমণের যিনি পূর্ণ পরিচালক পিযুষবাবু। আমাকে শিবুদা বলে ডাকে। আমিও মেজবাবু বলি। বেশ লম্বা চওড়া। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ঘন ঘন ওষুধ খায়। পা টেনে টেনে হাঁটে। এমনটা আগে ছিলো না। ,

সর্বাঙ্গ সুন্দর বলতে গেলে। এখনোও দেখতে সুন্দর তবে অতিরিক্ত মেদ শরীরে বাসা বেঁধেছে। শরীর আর নিজের বশে নেই। ওনার কি দোষ, এই সময়ের ব্যাধির প্রভাব যা সর্বত্র লক্ষ্যনীয়। অপ্রাসঙ্গিক কথার ফাঁকে সবাই গাড়িতে উঠে গেছি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমাদের গাইড ম্যানের নির্দেশ যে যেই গাড়িতে উঠেছে, ভ্রমণের কটাদিন গাড়ির সে সেই সিটে, সেই গাড়িতে বসবে। একদিক দিয়ে ভালোই হলো আমার মানসিকতা অনুযায়ী।

ষ্টেশনের বাঁক ছাড়িয়ে বের হতেই, চোখে পড়ল পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে পাথর কাটা পথ বেয়ে আমাদের পথ চলা শুরু হলো। দৃষ্টি আর গাড়ির ভেতরে আবদ্ধ রইল না। কান কানপেতে পড়ে রইল গাড়ির কোণে, কুঁনো ব্যাঙের মতো। তবে গাড়ি থামলে দুটো গাড়ির মধ্যে কানে হেঁটে খবরাখবর ঘুরে বেড়াতে লাগল। পিযুষবাবু চালকের পাশে। ওখান থেকে জানিয়ে দিলো, ‘আমার হিসাবের মধ্যে খাসির মাংস খাওয়াবো। পরে যে যার খরচে খেতে হবে, খাওয়াটা একসঙ্গেই হবে’।

সামনের এক পাহাড়ের ঢালে দীর্ঘদিনের পুরোনো পদ্ধতিতে খাসির মাংস রান্না হয়। যতটুকু তেল মশলা না দিলে নয়, ঠিক ততটুকুই দেওয়া। প্রতিদিন একটা আস্ত খাসি আনে। ওখানেই কেটে রান্না করে। আবার ওখান থেকে রাতে বাড়িতে চলে যায়। এইভাবে দীর্ঘদিন চলে আসছে। নামেই হোটেল রাত্রিবাসের যায়গা নেই। গাড়ি সেখানেই এসে পথের পাশে দাঁড় করালো। হিন্দি বাংলায় মিশিয়ে শারীরিক ভাষায় বুঝিয়ে দিলো, ‘চৌদ্দা থালি চাওল আউর হাফ প্লেট করকে মাটন জলদি বানা দিজিয়ে’। ‘ঠিক হ্যায়’ বলে তারা তাদের কাজ শুরু করে দিলো।

ট্রেনের মধ্যে কদিন আটকে থেকে দম প্রায় বন্ধের জোগাড় হয়েছিল। হাতে পায়ে খিল ধরে যাওয়ার অবস্থায় ছিলাম। পাহাড়ের ঢালে মুক্ত প্রকৃতির কোলে যে কি আরাম। কী ভালোই না লাগছে। এখন মোবাইল মানে ক্যামেরা। সেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেখানে মাংস ক্রমাগত কাঠের জ্বালে ফুটছে। তার পাশে একটা বড়ো পাথরের চাঁই। তার ওপারে রক্তের ছোপ। যে খাসির মাংস রান্না চলছে, এখানেই কাটা হয়েছে। গভীর খাদের পাশে বেড়ে ওঠা পাইনের ঝাঁঙড়া মাথা আমাদের উঁকি মেরে দেখছে। যেন অনায়াসে তাকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। বাস্তবে অসম্ভব ব্যাপার।

এই রাজ্যেই অসংখ্য পাইন গাছের সমাহার। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। সেখান থেকে বেশ কয়েকতলা নিচে গাছের গোড়া। জানলাম উত্তরাখণ্ড জুড়ে পাইন গাছের আধিক্য। এই গাছের কাঠে ট্রেন লাইনের স্লিপার করা হতো। এখন তো ঢালাইয়ের স্লিপার। এখান থেকে তখন সারা ভারতে লাইন পাতার কাঠ পাঠানো হতো। মাপ মতো গাছগুলো কেটে গুদামজাত করে রাখতো। তাই এই ষ্টেশনের নাম ‘কাঠগুদাম’। আমরা ধাপা থেকে মাংস ভাত খেয়ে, যে যার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো।

এগিয়ে চলেছি পাহাড়ি পথ দিয়ে। এই সুযোগে সদস্যের আংশিক পরিচয় দিয়ে রাখি। আমি বসে ছিলাম চালকের বরাবর গাড়ির পেছনের আসনে। আমাদের মাঝের সিট উলটিয়ে ঢুকতে হয়। তা চালক প্রতিবার ওই কাজটি করে থাকে। আমার বাঁ পাশে পিনাকীবাবুর পুত্র বুটু, পোষাকি নাম দীপাঞ্জন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।ওর পাশে পিনাকীবাবুর ছোটদা অর্থাৎ পিযুষবাবু। প্রকৃত তিন ভায়ের মধ্যে ছোট পিনাকী। মেজদাকে ওইভাবে ডেকে অভ্যস্ত। ভাইদের থেকে বড়ো কাজলদি, তিনি সবার কাছে দিদি। অন্য গাড়িতে আছে। জামাইবাবু গোলামচন্দ্র। সবাই তাঁকে মাষ্টারদা বলে ডাকে।নানা বিপ্লবী মাষ্টারদা নয়। আমার সামনের সিটে অর্থাৎ মাঝখানের সিটে তিনজন। কাজলদির ছোটি মাসি দুইদিকে পিনাকীবাবুর শ্বশুর ও শাশুড়ি। এক মাসি ও মাসতুতো বোন অন্য গাড়িতে। সামনের সিটে মহারাজ।

পাঠকবন্ধুরা একটা নামের শব্দ একাধিক বার ব্যবহার করেছি ইচ্ছে করেই, পিনাকী। শ্বশুর, শাশুড়ি ও ছেলে এসেছে কিন্তু স্ত্রীর কথা একবারও ওঠেনি। আসলে পত্নীকে অর্ধাঙ্গিনী বলে, তাঁর অর্ধ অঙ্গ না এলে সতী কী করে আসে। এবার মন খারাপ করে বলি, হঠাৎ অসুস্থতায় অপারেশন করতে হয়। বিশ্রামের জন্য বাড়িতে আছেন স্বামীর সেবার ভার নিজের কাঁধে নিয়ে। আমি, পিনাকী নামে এক সচ্ছল পারিবারিক ভ্রমণমণ্ডলীর অংশ হয়ে বিরাজ করছি। পিনাকী ও শিবেন, দুটোই মহাদেবের নাম এই যা মিল।

নীরবে গোমরা মুখে ভ্রমণ উপভোগ করা যায় না। কান যেমন সজাগ চাই , চোখ খোলা রাখতে হয়। রঙ্গ রসিকতার ছাঁকনিতে অপ্রয়োজনীয় খাদ যা আনন্দময় জীবনের বাধার কারণ, তা ছেঁকে ফেলতে হবে। নির্মল আনন্দ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়। তাই আমার দৃষ্টির বাইরের দৃশ্যাবলীতে আর কান পরিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে শব্দ সচেতন। নিছক কথোপকথনে রসদ খুঁজে ফেরে। সবাই সরবে মজা করলেও আমি নীরবে বেশি আনন্দ উপভোগ করেছি। বাইরে থেকে সহজে বোঝার কথা নয়।

মাকে হারিয়েছে। ছোটি মাসিকে নিয়ে টুকিটাকি কথায় প্যাচে ফেলে মজা করে মাকে অনুভব করার একটা প্রয়াস পিযুষবাবুর মধ্যে লক্ষ্য করছিলাম। ‘দ্যাখো আবার মেসো ফোন করছে। বাইরে ছাড়া তো উচিত হয়নি। কতটা ভালো বাসে সবাই দেখলে। সঙ্গে আনতে পারতো’। মাসিকে রসিকতা করে বলল।
— পিযুষ তুইতো জানিস, মেসোর শারীরিক অবস্থার কথা। ঘর থেকে ফোঁটা কেটে কেটে পায়খানায় যায়। আমার কম জ্বালায়। কাজের মেয়ে আছে। সব বুঝিয়ে এসেচি। তবু যদি ফোন করে কী করব, শুনতে পাবেনে তবু আঁ আঁ করবে।
— ছেড়ে দাও তো ঝরঝলে মাল। আমার সঙ্গে চলে এসো, যা মালকড়ি আছে নিয়ে।একটা আশ্রয় বানিয়ে দুজনে থাকবো। মহাজের কথায় সবার সে কী হাসির ফোয়ারা গাড়ির মধ্যে।

হাসি ঠাট্টার মধ্যে ছোটি মাসির জীবনের অনেক দুঃখ যন্ত্রণায় কথা জানতে পারলাম। তাঁর উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা কাকে না দিয়েছেন। সবাই ভুলে গেছে, তাকে ভুল বুঝেছে। মনে পড়লে ভীষণ কষ্ট পান। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি। ছোটি মাসির থেকে বুঝলাম মানুষ সংসারের চাপ সরিয়ে একবার যদি মুক্ত পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়তে পারে। জীবনের অনেক কিছু থেকে হালকা হতে পারে। যে প্রিয় মানুষটা আর কোনদিন বাইরে বেরুতে পারবেনা। জীবনসঙ্গিনীকে ভ্রমণে যেতে বাধা দেয়নি। হাসি ঠাট্টা গল্প গুজবের মধ্যে পাহাড়ের গা’ঘেঁষা খাড়াই উৎরাই পথে হাওয়ার গতিতে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি।

পিযুষবাবু বললেন হোটেলে উঠলে আজকে আর বের হতে পারবনা। যতটা পারি বাইরে ঘুরে নেব। ভ্রমণ সূচিতে ছিলনা। ড্রাইভারের কথায় একটা ঝর্ণা দেখতে চলেছি। সরু পথ দিয়ে বিপদজনক ভাবে এঁকেবেঁকে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে প্রায় ঝর্ণার কাছে পৌঁছলাম। পেছনের গাড়ি সেও পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। যে গাড়িতে ছিল ডাক্তারবাবু, মৌমিতা ডাক নাম মানতু। দুই মেয়ে, ঈশানী এবং কৌশানী। মাষ্টার, দিদির খুড়ততো বোন মহুয়া, টকাই মাসি ও মাসতুত বোন ঝুম্পা। সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম।

আমরা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তার তলা দিয়ে ক্রমাগত ঠান্ডা জল প্রবাহিত হচ্ছে। এই ঝরনার উৎস ঘন গাছের জন্য দেখতে পাচ্ছি না। সামনে পাথুরে খাঁজ কাটা পথ দিয়ে উঠতে হয়। খাড়াই ধাপ দেখে কে কে উঠবে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ছোটিমাসি কোমরে বিশেষ বেল্ট পরা অবস্থায় পা বাড়িয়ে আছে। আমি, ডাক্তার, বড়মেয়ে, বুটু তো যাবোই। দিদির বুকে বিশেষ যন্ত্র বসানো আছে, একদম যাবেই না। মাষ্টার চুপচাপ থেকে সবার ওপরে চালটা দেন। তিনি অনেকটা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বললেন ‘যেতে পারি, তবু কেন যাবো’। আমরা টিকিট কেটে ঝর্ণা দেখলাম বটে মন ভরলো না সেভাবে।

নিচে নেমে এক বিরাট শোরুমে একে একে সবাই ঢুকলাম। আমাদের মধ্যে বয়স্কদের বেশিরভাগ হাতে পায়ে গাঁটের ব্যথায় ভুগছে। দোকানিরা এই সময়টা বোঝে। অবাঙালি কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিলেন তার হাতে ধরা একগুচ্ছ কাঁটা গাছের গুণাগুণ। শরীরের যেখানে ব্যথা, কয়েক ঘা সেই জায়গায় মারলে মুহূর্তে ব্যথা উধাও। এই গাছ পেস্ট করে চটি বানানো হয়েছে। পরলে পায়ের তলায় ব্যথা থাকবে না। ছোটিমাসি পায়ের সঙ্গে কোমরের অবস্থা ভীষণ খারাপ। ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা বেল্ট প্রায় সময় খোলেন না।যখন শুনলেন বিনামূল্যে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ছোটিমাসি বেল্ট খুলে প্রস্তুত।

পায়ের কামিজ হাঁটু পর্যন্ত তুলে ছোট্ট টুলে বসে পড়লেন। লম্বা চওড়া দোকানের ছেলেটি ঝাঁটা পেটার মতো ঝপাঝপ কষিয়ে দিয়ে, এখন কেমন লাগছে জানতে চাইলেন। ছোটিমাসির কোমন তো রাঙা ফোড়ার মতো অবস্থায় ছিলো। গুচ্ছ গাছের ঠিক গুণগত ক্রিয়া আপাতত বোঝা গেলনা বটে। বোধহয় ‘বিষে বিষ ক্ষয়ে’ নির্বিষ বোধ করে বললেন, আগের চেয়ে ভালো বোধ করছি। পাশে বুটুর দিদিমা দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল। বিনা পয়সায় এই সুযোগ কে হাত ছাড়া করে। ভদ্রমহিলা বোকামি করলেন না। ব্লাউজের আস্তিন গুটিয়ে ষ্টুলে বসে পড়লেন। ছেলেটি গুচ্ছ কাঁটাগাছের বাড়তি কয়েক ঘা খোলা হাতে মারলেন। হাতে ব্যথা ছিলনা। ফাউ পরিসেবা পেতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে চিড়বিড় করছে। ক্রমশ বাড়বাড়ন্তের দিকে এগোচ্ছে বুঝতে পারছেন। মুখের বিরক্তি ভাব দেখে বুঝতে পারছি।

মধ্যম শালক পিযুষবাবু ওই ঝাঁটিগাছের পেষ্ট করা একজোড়া চটি কিনেছে। মাষ্টার চটি কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যখন দেখলেন বুটুর দিদিমা চিড়বিড়ুনিতে অস্থির হয়ে উঠছে। বুদ্ধিমান মানুষ বুঝে নিলেন কোথাও গড়বড় আছে। যে কথা দোকানী বলেছে নিজে শুনেছে। তবুও পিযুষবাবুর কাছে জানতে চাইলেন। ‘হ্যারে এরা তো হোম ডেলিভারি দেয় তাই না। ঠিকানা আছে অর্ডার করিয়ে নেবো’। এই বিষাক্ত চটির কথা আর মুখে এনেছিলেন কি না আমার জানা নেই। ওনার বাড়িতে যাতায়াত আছে চোখে পড়েনি। যাক অনেকটা সময় কাটিয়ে গাড়িতে উঠলাম।

ট্রেন দেরিতে কাঠগোলায় পৌঁছেছে। পথে খেতে আরও অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। শেষ ঝর্না দেখার উপলক্ষে, দোকানে কিছুটা সময় ব্যয় হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।গাড়ি ক্রমশ আরও উপরের দিকে উঠছে। পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে এখন নৈনিতালের নয়না লেকের পাশ দিয়ে গাড়ি ধীর গতিতে আমাদের আবাসিকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল এখানে বেড়াতে আসব। আমরা কততলা উপর থেকে নয়না লেক দেখছি মাথায় ঢুকছে না। এই লেক অনেকটা ডিম্বাকৃতির। যার আয়তন কত একর হবে, না জানলেও হবে। লেকের গায়ে অসংখ্য ভ্রমণার্থীদের জন্য আবাসিক গড়ে উঠেছে। পুরো লেকের চারিদিকে জোনাকির আলোয় যেন ছিলমিল করছে। লেকের জলতরঙ্গে আলো খেলে বেড়াচ্ছে। নৈসর্গিক অপরূপ সেই দৃশ্য দেখার মতই।

গাড়ি অল্পের জন্য থামিয়ে, আবার চলতে শুরু করল আঁকাবাঁকা পাহাড়ি ঘুর পথে। অনেকটা যাওয়ার পর, বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে প্রায় খাড়াই ওঠার মতো উঠে দোতলা বাংলো বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আগু পিছু করে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। বোর্ডে লেখা দেখলাম, ইউথ হোষ্টেল নৈনিতাল (Youth Hostel.Nainital) সংরক্ষিত এরিয়া। পাহাড়ের বিশেষ জায়গায় এটি। এখানে বেশিরভাগ ভিআইপি মানুষের বাস। আমরা যেখানে উঠেছি সেই অর্থে হোটেল নয়, হোষ্টেল। যারা ক’দিন নিরিবিলি থাকতে চায় তারাই এখানে আসে।

তলায় মহিলাদের জন্য সুসজ্জিত দুটি এটাচ কক্ষ। ছেলেদের দ্বিতলে বড়ো ঘর (Dormitory)। আমরা ছেলেরা সাতজন। মহারাজের জন্য কোণায় সিঙ্গেল বেড ছাড়া হলো। পিযুষবাবু একা একটা খাট নিলেন। পায়ের গণ্ডগোল আছে,খাটটা নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করতে পারবে। রানিং খাটে আমার কোথাও অসুবিধা নেই। তবে মাস্টারদার কাছাকাছি থাকলে স্বস্তিবোধ করি। ডাক্তারবাবুর দেয়ালের ধারে সবাই উপযুক্ত মনে করলাম। মানুষটা নার্সিংহোম ছেড়ে এসেছেন। মুহূর্তে মুহূর্তে ফোন। কয়েকটা ফোন এবং ল্যাপটপ রয়েছে। ফোনের মধ্যে প্রায় সময় মুখ গুঁজে রয়েছে মনে হলো। জানতে পারলাম না উত্তরাখণ্ডে এসে কী কী দর্শন করলেন। তবে পা ছাড়িয়ে গেলেন নিশ্চিত। অর্ডার দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে, পিযুষবাবু সবাইকে তেমন জানিয়ে দিয়েছে।

[লাভ-ভিউ থেকে নয়নালেকের সৌন্দর্য]

ট্রেনে দু’রাত, হোষ্টেল একরাত কাটালাম। উনিশে মে দু’হাজার-তেইশের সকাল। চা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়া হবে নয়না লেক সহ দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখতে। সময় বেঁধে দেওয়া। তাতে কি? গাড়ির কাছে সবাই এলে তো যাত্রা শুরু হবে। এদিকে আমি, বুটু, কৌশানী পথে পায়ে উঁচু নিচু পথে সাপলুডো খেলতে খেলতে সর্বোচ্চ কোর এরিয়ায় পৌঁছে গেছি। আমার মনে হলো ওইতো পাহাড়ের শিখর দেখা যাচ্ছে ওর গোড়ায় যেতে আর কতটুকু সময় নেবে।

বিশাল বিশাল পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে যে উচ্চতায় চুড়ো দেখছি। তলদেশ তো ফাঁকা দেখছি না, আবাসনে ভরে আছে। সেইসব ঘরবাড়ির মধ্যবর্তী অলিগলি পথে কৌতূহলী চোখে এগিয়ে চলেছি তো চলেছি। পাহাড়ের গোড়া আর ছুঁতে পারছি না। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফিরে যাওয়ার নির্দেশ। ডাক্তারবাবু আমাদের খুঁজে এগিয়ে আসছে। পথের এতটাই ঢাল, ওপর থেকে দেখছি ডাক্তারবাবু যেন তেনজিং নোরগে। পর্বতশিখর জয় করতে উঠছেন। পেছনে সর্বক্ষণের ল্যাপটপের ব্যাগ। সামনে ঝুঁকে লড়াই করে উঠে আসছে। আমরা একই পথে এসেছি তখন বুঝতে পারিনি।

ডাক্তার দীপাঞ্জনের থেকে মেয়েকে কাঁধে নিয়ে আগে আগে চললেন। নামার সময় তুলনামূলক ভাবে কষ্ট কম। এবার আমরা দু’জন পাশাপাশি এগিয়ে চলেছি। আমি রাস্তার বাঁদিক চেপে। বিভিন্ন পাহাড়ি ফুলের গাছ দুদিকে ভরে আছে। আমি গল্প করতে করতে দরদি হাতে ছুঁয়ে চলেছি ফুল গাছের পাতা। হঠাৎ হাত চিড়বিড়িয়ে উঠল। হাত ঝাড়তে লাগলাম। তাতে কী সুরাহা হলো বুঝতে পারলাম না। গাছটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম।

আরে এতো সেই দোকানের ঝাঁটিগাছ। সম্ভবত বিচুটি, তবে পাতা বেশ চওড়া চকচকে। আমি চিড়বিড়ুনির জ্বালায় দু’কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়িনি। আমরা সুন্দরবনের নিচু জলাভূমিতে পাতালে বাস করি। আর তুমি পাহাড়ের শীর্ষদেশে স্বর্গে বসবাস করছ তাতে কি? বনবিলাল হলে কি হবে স্বভাব বদলায় না। তুমি পাহাড়ের গায়ে থাকো আর আমাদের বাঁশবাগানে থাকো, স্বভাব তো বদলালো না। আচ্ছা করে শুনিয়ে, আর পেছনে তাকালাম না।

হোষ্টেলের কাছাকাছি এসে উপরে দিকে তাকালাম। গতকাল সন্ধ্যায় অতটা নজর করিনি। আমরা যে বাংলো টাইপের আবাসনে আছি। তার পাশে ঘন গাছের বন ভেবেছিলাম। সেটাই একটা পাহাড়। পাহাড়ের তলদেশ কেটে সমতলে পরিণত করে এই বাংলো। আমরা লক্ষ্য করলাম পাহাড়ের অনেক উঁচুতে গাড়ি চলছে। নিশ্চিত পথ আছে ওখানে।

পরে জানলাম আমাদের ওই পথে নয়না লেকে যাবো। চা টিফিন খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আমাদের দুটো গাড়ি নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে চলল। নয়না লেকের বরাবর রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি।প্রথমে ‘লাভভিউ’ দেখার জন্য। খাড়াই পাহাড়ের পাশে অপ্রশস্ত পথ। পথের গা ঘেঁষে নেমে গেছে গভীর মরণ খাদ। খাদের ধারে সুসজ্জিত ফ্রেমের মধ্যে ভালোবাসার প্রতীক। ওই ফাঁকা জায়গায় মুখায়ব অক্ষয় করে রাখতে চায়। বলতে গেলে খাদের ধারে যেভাবে একটু ছোঁয়া পেতে প্রেমিক-প্রেমিকা চঞ্চল হয়ে ওঠে। অসতর্ক মুহূর্তে জীবন্ত প্রেমের সমাধি না ঘটুক চাইব।

আমরা লাভভিউ-তে চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে বেশকিছু দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে নিলাম। নয়না লেকের পেছনের দিকে নেমে পড়লাম। গাড়ি নির্দিষ্ট সময়ে সামনের দিকে থাকার কথা বলে অন্যত্রে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বেরিয়ে গেল। লেকের কাছাকাছি গাড়ি রাখলে খরচ অনেক বেশি। আমরা মূল রাস্তা ছেড়ে, লেকের ভিতরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের দিকে চলে গেলাম। জুতো বাইরে রেখে নয়নাদেবীর মন্দির দেখলাম। দেবীকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। যেখানে ভোগ বিতরণ হচ্ছে শালপাতার খুপিতে সংগ্রহ করলাম। মহারাজের উত্তরাখণ্ডে আসার মূল কারণ, এখনকার দেব-দেবী, প্রাচীন মন্দিরগুলো দেখার জন্য আসা। নিজের মতো করে, একা একাই ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটালেন।

একটা সময় সবাই নয়না লেকের বোটিং এর ঘাটে উপস্থিত হলাম। পিড়াপিড়িতে মহারাজ বোটিং বিহার করলেন। আমি না না করে দিদির কথায় বোটিং-এ যেতে রাজি হলাম। পিযুষবাবু ও দিদি, সামনে বসলো। আমি মাঝে। পেছনে ডাঁড়ি দু’হাতে ডাঁড় টেনে মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি ছবি তুলছি। চারিদিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছি। গতকালের সন্ধ্যায় ওপর থেকে সারা নয়না লেকটা মনে হয়েছিল অসংখ্য জোনাকির আলোয় ভরে আছে। এখন লেকের জলের ওপর থেকে মনে হচ্ছে তিন দিকের ঢাল যেল রঙিন টালি দিয়ে বাঁধানো। একদিকের পাহাড়ের ঢালে গাছে ভরে আছে। বোটিং দু’দিক থেকে চলছে, মাঝ বরাবর সীমানা। লম্বায় মেপে দেখিনি যতদূর দেখা যায় ততটা, প্রত্যেকের দেখার চোখের ওপর নির্ভর করছে।

মাঝখানে কল্পিত রেখা ছোঁয়ার আগে, সবকিছু উপভোগ করার আনন্দ উবে গেল। বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি শুরু। কার কী হয়েছিল ওই সময়ে বলতে পারবনা। ঠিক নয়নালেকের মাঝখানে যেখানে জল বুদবুদ করে উঠছিল। জল স্বচ্ছ কিন্তু যেদিকে আবাসিক নেই। পাহাড়ের গায় গজিয়ে ওঠা বৃক্ষরাজি। গাছগাছালি বৈকালিক ছায়া জলে পড়েছে। জল বেশ কালো দেখাচ্ছে আর ওই বুদবুদ।যেকেউ ভাবতেই পারে, তিনি মাছের মতো দৈত্যাকার কোনো জলদৈত্য যদি জলের ওপর মাথা তোলে।

মোচার খোলের মতো ছোট্ট বোটের কী অবস্থা হবে কল্পনা করুন। একসময় বোটটি আপাতত নিরাপদ মনে হলো। চালকের কাছে জানতে চাইলাম, ‘বুদবুদ কিসকা হ্যায়’? যা বলল এইরূপ। উঁচু পাহাড়ের ঝর্ণা বাহিত জল। এক পাহাড় থেকে আর এক নিচু পাহাড়ে বয়ে চলে। তেমন একটা ধারার জল পাইপের মাধ্যমে লেকের মাঝখানে ঢুকছে। বাড়তি জল, নয়না লেক থেকে নিচের পাহাড়ে ঝর্না হয়ে কোথাও ঝরে পড়ছে। লেকের জল বরাবরই এক থাকছে। ফলে নয়নালেকের জল দুষিত হচ্ছে না। এভাবে নতুন অনুভূতি বোটিং-এর মজা উপভোগ করলাম।

এবার হোটেলে খেয়ে দুই চালকের কথা মতো বড়ো রাস্তার মোড়ে রেলিং-এর ধারে সবাই গাড়ির অপেক্ষায় আছি। গুঞ্জন শুনে কাছে এসে দেখলাম। বুটুর দিদিমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বাচ্চা মেয়ের মতো। যেমন তেমন হোক এক্স শিক্ষিকা। কান্নার হেতু কি জানতে পারলাম। গাড়িতে যে ব্যাগটি ভুলে ফেলে গেছে, তাতেই তো সব টাকাপয়সা। গাড়িতে নামার পরে মনে পড়ে। ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অন্য কোথাও গ্যারেজ করার জন্য। পিযুষবাবুর আশ্বাসবাণীতে ছিল ব্যাগ কিছুই হবেনা। দীর্ঘক্ষণ হয়ে গেল গাড়ির দেখা নাই রে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।, ডাক্তারবাবুর গাড়ি এসেছে। আমাদের গাড়ি আসেনি। যে গাড়িতে বুটুর দিদিমা উঠবে।

তেমাথার চলতি পথে গাড়ি দাঁড়াতে, ট্রাফিক পুলিশ তাড়া দিচ্ছে। ডাক্তারবাবু বড়মেয়ের জন্য কী কিনতে গেছে এখনো ফেরেনি। ঈশানী যদিও এলো তো ওর বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না। আবার কিছুইতে ফোন ধরছে না। ওই এক আপনার ভালো মানুষ। বুটুর দাদাইকে ওই গাড়িতে একরকম জোর করে তুলে দেওয়া হলো। আমি অন্য গাড়িতে উঠতে রাজি হইনি। প্রথম গাড়ি ছেড়ে চলে গেল। বুটুর দিদিমার একান্ত কাছের মানুষ, ঘোর বিপদের সময় তাকে ছেড়ে অন্য গাড়িতে চলে গেল। এদিকে সেই অভিশপ্ত গাড়িটি এখনো টিকিটিও দেখা মিলছে না। মেজবাবু অর্থাৎ পিযুষবাবু সরল মনে জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কদিনের জন্য বুকিং করা গাড়ি। ও অন্য কোথায়ও বাইরে ভাড়া খাটতে পারবে না। আমাদের যা লাগেজ ওর মধ্যে আছে নিরাপদে থাকবে।

কথায় বলে ‘ঘর শত্রু বিভীষণ’। বুটু দিদিমার সঙ্গে রসিকতা করতে ছাড়ল না। ‘মেজজেঠু, এই দীর্ঘসময়ে বাইরে ভাড়া খাটে তো পার? আমরা তো আর দেখতে পাচ্ছি না। জেঠু ভাইপোর দুষ্টুমি বুঝে তৎক্ষণাৎ বলল, ‘তা পারে, ব্যাগ যখন ড্রাইভারের জিম্মায় রেখে আসেনি। প্যাসেঞ্জার নামিয়ে নিলে, ভাববে ওদের। এই কথা শোনা মাত্র বীভৎসভাবে দুই চোখের জল বাঁধ ভাঙা অবস্থায় বইতে লাগল।

এমন সময় ভিড় ঠেলে গাড়ি চলে এসেছে। ড্রাইভার পাল্লা খুলেতেই যেন রিং-এর মধ্যে গলে ভেতরে পড়লেন। প্রথমে ব্যাগ দু’হাতে থাবা মেরে তুলে নিলেন। পরে ভেতরে হাতড়িয়ে নিশ্চিত হলেন তাঁর সম্পদ সুরক্ষিত আছে। মুখে হাসির রেখা মেঘের আড়ালে স্পষ্ট উজ্জ্বল। ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবু পৌঁছে গেছে। ফোন-পে মেরেছে। নেটের বিড়ম্বনায় ক্লিয়ার না হলে আসতে পারছিল না। আর কালবিলম্ব না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। পাহাড়ি পথ ঘুরে বাসায় ফিরলাম। উইথ হোষ্টেলে সেই রাত্রি বেশ মজা হলো। এখানে দু’রাত কাটালাম।

[জিমকরবেট জঙ্গল ও আলমোড়া]

সকালে চা টিফিন খেয়ে গাড়ি চড়লাম। বেশ অনেকটা পথ যাওয়ার পরে ‘হনুমান মন্দির’ চোখে পড়ল। তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। যা কারুকার্য দেখলাম দুচোখ ভরে গেল। গর্ভগৃহের ওপর মন্দির। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ভিতর বাহির ঘুরে ফিরে দেখলাম সবাই। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। এখন পাহাড়ি পথ থেকে সমতলে নেমে এসেছি। গ্রামের মধ্য দিয়ে, ঘন গাছপালা পেরিয়ে চলেছি।

এখন খাঁ খাঁ দুপুর, রমনগরের পথে। উদ্দেশ্য ‘রুদ্রাক্ষ হোটেলে আজ রাত্রিবাস করতে চাই। এখানে চারখানা ঘর ভাড়া করা ছিলো। ঘরগুলিতে আধুনিক চিন্তাভাবনার ছাপ লক্ষণীয়। একটি ঘরে আমি ছাড়া আরো দুজন পিযুষবাবু ও মহারাজ। হোটেল বয়কে দিয়ে ডিম ভাতের ব্যবস্থা করা হলো। ফ্রেস হয়ে নিলো সবাই। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকু নেই। ‘জিমকরবেট জঙ্গল সাফারি’তে বেরিয়ে পড়তে হবে। অললাইনে বুক করতে বলা হয়েছিল হোটেল কর্তৃপক্ষকে। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করেছেন।

হুটখোলা জিপগাড়ি তারাও হর্ন বাজিয়ে তাড়া দিচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না গেলে, আজকের মতো সাফারি বন্ধ হয়ে যাবে। আবার আজের না দেখলে, আগামীকাল এখানে থাকছি না। সেইভাবে দর্শনীয় সময়সূচি ঠিক করা। দুটো গাড়িতে ভাগ হয়ে উঠে পড়লাম। অলিগলি বেড় দিয়ে প্রধান সড়কে উঠল গাড়ি। গাড়ি তীর বেগে ছুটতে লাগল। সোজা গেট পেরিয়ে অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

কাগজপত্র চেকিং-এর ব্যাপার। আমি পিনাকী নামে ছিলাম। নতুন করে পাঁচশ টাকায় আমার নামে অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হলো। মূলকথা চেকিং-এর নামে বাঁহাতি টাকার লুট চলছে, নতুন করে বলার নেই। আমাদের একটি গাড়ি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে,বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি, প্রকাণ্ড এক হস্তী দাঁড়িয়ে আছে। যেন হাতি অপেক্ষায় আছে, কখন ওর সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি পেরিয়ে যেতে চাইবে। অমনি ও ঠেলা মেরে উলটিয়ে দেবে।

খণ্ড ২

ড্রাইভারেরা বন্য জীবজন্তুর চলাফেরা তার মতিগতি ভালো ভাবে বোঝে। আমরা টু শব্দটি করছি না নিষেধ ছিলো। হাতির পথ পেরিয়ে যাওয়া,ওর মর্জির ওপর নির্ভর করছে। আমাদের ধৈর্য বিষিয়ে দিয়ে গজেন্দ্রগমনে পথ পেরিয়ে গেল। পথের ওপরে কলা গাছের মতো গাছ শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে মাথা ভেঙে আয়েশ করে খেতে লাগল। এমন প্রচলিত ধারণা ‘ভূত ছেড়ে গেলে চিহ্ন সরূপ গাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায়। এখন হাতির থেকে যে নিরাপদ ভাবতে পারি। যাক আপাতত বিড়ম্বনা মিটল। গাড়ি চলতে শুরু করল। কিছুটা গিয়ে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে লাগল। যে পাহাড়ি প্রশস্ত খাদ দিয়ে বর্ষায় পাহাড় বাহিত ঝর্ণার জল দুই কূল ছুঁয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়। এখন ক্ষীণ জলধারা তলা দিয়ে বইছে। সেই জলের টান নেহাত কম নয়। আমাদের গাড়ি হাঁটু জলে হুড়মুড়িয়ে পেরিয়ে গেল। আবার খাড়াই পথে উপরে উঠে এলো। তখন নজর পড়ল দূরে অনেক হরিণ চরছে। দেখতে দেখতে বনের পথে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো। যেখানে আমাদের মতো অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে গভীর জঙ্গলে ঢোকার সময় ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় দু’বার যোগাযোগ করতে হয়। আমাদের গাড়ির কাগজ দেখিয়ে গভীর জঙ্গলের পথে ঢুকতে চলেছি। গা ছমছমে পরিবেশ। কোথায় কী ঘাড়ের ওপর এসে লাফিয়ে পড়ে কে বলতে পারে। গভীর জঙ্গল পেরিয়ে আরও এক অফিসে পৌঁছলাম। সেখানে ওয়াচ টাওয়ার আছে। তবে সাধারণের জন্য নয়। গাড়ি থেকে নামার অনুমতি নেই। অদূরে হরিণেরা জল খাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের শেষ গাড়ি। চারটের আগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। গাড়ি ছেড়ে দিল। হরিণ, বুনোহাতি, কিছু পাখি ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনি। বনদপ্তরের সমস্তটাই আঁটোসাঁটো আয়োজন। তবে জব্বর আঁটুনি,ফোসকা গেরো মনে হয়েছে। ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে একমুখ ধুলো মেখে সন্ধ্যার দিকে রুদ্রাক্ষ আবাসিক হোটেলে ফিরলাম।

মোড়ের ওপর দোকান থেকে যে যা খাবে, যেমন পরিমাণে সেইভাবে রাতের খাবার এসেছিল। আরও তিনটি ঘরে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের সুসজ্জিত ঘরে আমি, পিযুষবাবু, মহারাজ। রুটি টাইপের খাবার ভাগ করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়লেন। আমার দুটো দিলে, পিযুষদার একটা থাকে। আবার একটায় ওনার হবেনা এটাই স্বাভাবিক আমার চিন্তায়। এখন কী করবেন। আনতে যাওয়া তো এ মুল্লুকে নয়। তৎক্ষণাৎ বললাম, আমার একটা দিলেই হবে। একসঙ্গে বেড়াতে গেলে অনেককিছু মানিয়ে নিতে হয়। সামান্যতম উষ্মা প্রকাশ করে ভ্রমণের পুরো আনন্দটাই মাঠে মারা যেতে পারে। হিসাবে ছিলো কেউ একটা বেশি নিয়ে, একপিস কমে গেছে। হাসিমুখে নীরব থাকাটাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। তুচ্ছ বিষয় মানিয়ে নেওয়াটাই আনন্দে থাকার প্রাথমিক ব্যবহারিক ধর্ম মনে করি।

এই প্রবাদটি বাউণ্ডুলের ক্ষেত্র খাটে ‘ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’। যে পারিবারিক ভ্রমণার্থীদের সঙ্গী হয়ে এসেছি, তাদের ক্ষেত্রে ওই শ্লোক অচল। আমার ক্ষেত্রে হুবহু না হলেও কিঞ্চিৎ খাটে। এমন রাজকীয় আবাসিকে আছি তা কি হট্টমন্দির। খোলা বাজার আদৌ নয়। যাইহোক পাঠকের গ্রুপটির সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে রাখলাম। এখন ওইসব কথা থাক। আবার সকালে উঠতে হবে শুয়ে পড়লাম। এসি চলছে আমার ঠাণ্ডা লাগছে। হালকা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি। একসময় ঘুমের মধ্যে মনে হলো গরম লাগছে। পিযুষবাবু উসপাশ করছে। মহারাজ চিন্তায় আছেন বুঝতে পারছি। হালকা আলোয় তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছি। দেখলাম গেরুরা কাপড় কোমরে আঁটোসাটৌ করে জড়িয়ে নিলেন। আড় চোখে দেখলাম,বেশ লম্বা দেখাচ্ছিল। সোজা দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আবার এসে শুয়ে পড়লেন। ইতিমধ্যে এসি চলতে শুরু করেছে। ভাবলাম কী অলৌকিক শক্তি রে বাবা। তবে সারা জীবনে এতো সাধনভজন সে কি বন্ধ এসি চালু করার জন্য। নিশ্চিত সে জন্য নয়।মহারাজ বললেন, এসি’র কন্টোলরুম জানা ছিলো। সবগুলো এসি চালিয়েছি। ভাড়া সেই ভাবে নিয়েছে এসি চালাবে না মানে।

রাতে ভালো ঘুম হলো। সকালে সবাই হাত মুখ ধুয়ে, পোষাক পরে প্রস্তুত। আমি এবং মাষ্টারদা স্থানীয় দোকান থেকে চা কিনে আনলাম। দুটো গাড়ি আমাদের সঙ্গেই ছিলো। সবাই গাড়িতে উঠতে ছেড়ে দিল। ক্রমশ সমতল ছেড়ে আবার উঁচুতে উঠতে শুরু করেছি। আবার ধীরে ধীরে ঠান্ডা অনুভব করছি। এখনো রামনগর ছাড়িয়ে যাইনি। আমরা এখন ‘গলুদেবে’র মন্দিরে। ব্রতীদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে বিভিন্ন মাপের ঘণ্টা ঝুলিয়ে মানত চুকিয়ে যায়। এতটুকু জায়গা ফাঁকফোকর নেই যেখানে মাথা গলিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ানো যায়। যে ঘন্টাগুলো এক-দু’মণ করে ওজন তলায় বসানো থাকে। আমার মনে হয়েছিল গুলদেব না হয়ে যদি “ঘণ্টাদেব” হতো মন্দ হতো না। মানুষের বিশ্বাসের কাছে কোনো যুক্তি খাটে না। যাইহোক আমাদের মানা না মানায় কিছু ওখানকার মানুষজনের কোনো যায় আসে না। প্রণাম করে এখন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার পথে ‘বিবেকানন্দ ধ্যানাশ্রম’ সুন্দর জায়গাটি দেখে নিলাম।

এখন পথের এক হোটেলে খাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নেমেছি। প্রতিবারে যেমন হয় খাবার মেনু নিয়ে তুমুল গবেষণা চলে।পুরোটা জুড়ে থাকে মাংস নিয়ে। তা চলতে থাকে পিযুষবাবু ও ঈশানীর মধ্যে। মামা ভাগ্নির ব্যাপার। যাইহোক তারা কী মেনুতে ভোজন সেরেছে উৎসাহ বোধ করিনি। আমার মুখে লাগার মত হলেই হলো। আমি ঠান্ডা স্প্রাইট নিয়ে গাড়িতে বসলাম। বুটুর দিদিমাও খেয়েদেয়ে গাড়িতে বসেছে। কাচের ভেতর থেকে ছেখছে কৌশানী ও বুটু দু’জনার হাতে দুটো স্প্রাইটের বোতল। পাশে রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে কীসব আলোচনা করছে ভাই বোনে।কৌশানীর চলনে বলনে হাবভাবে দেখে গা যেন জ্বলে যাচ্ছে বটুর দিদিমার। কেন হচ্ছে সত্যি বলছি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার তো ভালোই লাগছে। ওই বয়সের সঙ্গে আর্থিক সচ্ছলতা থাকলে বরং একধাপ এগিয়ে থাকতাম। বুটুর দিদিমা ভাবলেন ও মেয়ে গোল্লায় যাক, আমার নাতির মতো ছেলে হয় না। ওই মেয়েটার কাছে কুটিটিও চাইলে পাওয়া যাবেনা। যদিও বাস্তবে তেমনটি নয়। কথায় বলে না ‘যার দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’। ভাত খেয়েছে হজমের জন্য ঠান্ডা পানীয় চেয়ে খেতেই পারে। আবার পয়সা খরচের কি আছে। নাতির থেকে একঢোক খেলেই হলো। গাড়ির ভেতর থেকে আকারে মনের ইচ্ছা জানালো। নাতি ভাষা বুঝতে পারেনি। ইঙ্গিতের উত্তর, ইঙ্গিতে দিলেন নাত নেড়ে। যার অর্থ কী জানি না। রাগে গরগর করতে থাকে দিদিমা। অদূরে নিজের মানুষটি দাঁড়িয়ে ছিলো হাত দিয়ে ডাকলেন। একবোতল স্প্রাইট ভাগাভাগি করে খেয়ে, নতির ওপর রাগ তখনকার মতো কমলো

(রাতের আলমোড়া এবং নৈসর্গিক কৌশানী)

এখন রাতের আশ্রয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ি চলেছেই তো চলেছে। কতটা উঁচুতে আমাদের গাড়ি কিছুই বুঝতে পারছি না। অনুমান কানে আসছে না তা নয়। দুইদিকে ফুলে ভরে থাকা বড়ো ছোট গাছ। মুহূর্তে মুহূর্তে বিপদজনক বাঁক কাটিয়ে চলতে হচ্ছে। তবে ড্রাইভার এসবের ভ্রুক্ষেপ করেনা। আমি কৌতূহলী চোখে দেখছি আর ভাবছি ‘আলমোড়া’ শব্দগত অর্থ কী হতে পারে। প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আমার মনে এইরকম একটা অর্থ খাড়া হয়েছে। নিজের মতো করে বুঝেছি। “আল” অর্থে ভেড়ি। চাষাবাদের জমিতে জল ধরে রাখার মতো অনুচ্চ ভেড়ি। “মোড়া” কথাটার আমি যে অর্থে এখানে বোঝাতে চাইছি, তা হোলো আবৃত করে রাখা বা মুড়ে রাখা। আল কী দিয়ে মুড়ে রাখা আছে সমগ্র পাহাড়ি অঞ্চলকে সেটাই জ্ঞাতব্য বিষয়। চলন্ত গাড়ি থেকে আমরা দেখছি দুইদিক থেকে যে পাড়ের ঢাল নিচের দিকে নেমে গেছে। তার গায়ে বাড়িঘর যেন গিজগিজ করছে। অসংখ্য আবাসিক দিয়ে মুড়ে রাখা বলেই জায়গার নাম কি রাখা হয়েছে “আলমোড়া’। নামকরণের অন্য তথ্য থাকলে পাঠকের থেকে জানার অপেক্ষায় রইলাম।

পাহাড়ের গা বেয়ে চলার পথে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ওপারে ঘরগুলোতে কাচের পাল্লা থেকে অসংখ্য আলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করেছ। পিযুষবাবুর কথায় বুঝলাম, আমরা ওপারের কোনো এক হোটেলে আজকের রাতটা কাটাবো। আমরা যে পাহাড়ি পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সে পথ আরো কতো দূরে গেছে জানিনা। মাঝে খাদ। তলা দিয়ে জল প্রবাহিত হচ্ছে। বিপরীত দিকের পথ ক্রমশ গা ঘেঁষছে। একটা সময় ছোট একটা ব্রিজ দিয়ে পেরিয়ে গেলাম। বেশ কিছুটা ঘুরপথে এসে দাঁড়ালাম ‘রুদ্রনাথ’ অফিসের সামনে। লাগেজ নিয়ে অফিসে মধ্যে গিয়ে সবাই বসলাম। যখন শুনলাম এটাই নাকি আবাসিক হোটেল। অবাক না হয়ে পারলাম না। ঢালা জায়গায় শুয়ে বসে রাত কাটাতে হবে নাকি। আমি একা আছি আমার অসুবিধা কীসের। অপেক্ষা করছি। কী হয় দেখি।

পিযুষবাবু কাগজপত্র ঠিক করে এসে বলল, আমাদের আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে হবে। আমার বুঝতে বিলম্ব হয়নি, অন্ধকার পুঁতিগন্ধময় কোনো গোডাউনে রাত কাটাতে হবে। নতুন করে ব্যাখ্যার কী বা আছে। পরমান্ন মানে আমার মায়ের হাতের খুঁদের জাউ। মনে পড়ে সারা দেশ জুড়ে ঘাসের দানা, খুঁদের জাউ প্রায় বাড়িতে হতো। আমার অভ্যাস আছে ঠিক মানিয়ে নেবো। সবাই কী করবে জানিনা, বড়োমেয়ে ওইতো একাই যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। যা রুচিশীল মেয়ে। দুইবোনকে আমি মেয়ে বলি। ওদের মা তো সেই ছোট থেকে আমাকে শিবেনদা বলে আগেই বলেছি। পরিচয় পর্ব চুলোয় যাক, শেষমেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় দেখি। আমাদের মালপত্রে হাত দিতে হলো না। হোটেল বয়েরা নিয়েই যাবে। আমরা একটা ছোট ঘরে ঢুকলাম,লিফট জানাই ছিলো। যখন সুইচ টিপে দিল, নিচে নামতে শুরু করেছে। সেটাই কপালে লেখা ছিলো। শেষে গিয়ে লিফট থেমে গেল। আর ভাবছি না যেখানে বলবে ঢুকে যাবো। লম্বা দাবায় হেঁটে চলেছি। আমাদের সঙ্গীসাথীরা চাবির নম্বর অনুযায়ী রুমে ঢুকে গেল একে একে। এখানে আমার সঙ্গী দীপাঞ্জন যাকে সবাই বুটু বলে চেনে। আমরা দাবার শেষপ্রান্তে গিয়ে ডানদিকে বেঁকে শেষের আগেরটিতে ঢুকে গেলাম চাবি মিলিয়ে। ঘরের মধ্যে ঢুকে অবাক। সাজানো গোছানো আসবাবপত্র। ঘর যেমন লম্বা, তেমন চওড়া। উচ্চতা অবশ্যই দশ ফুট। জোড়া বিছানা। মাথার দিকে কাচসেটিং করা এ্যালুমিনিয়ামের পার্টিশান। একদিকে কাচের পাল্লা। ভারী পর্দা সরিয়ে দেখলাম ঝুল বারান্দা। ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এখন সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। সামনে তাকিয়ে কী দেখছি সেটাই বুঝতে পারছি না। ভাষায় কী প্রকাশ করব। গায়ে গায়ে গড়ে ওঠা আবাসিক থেকে অসংখ্য জোনাকির মতো আলো ঠান্ডা বাতাসে খুশিতে দোলা খাচ্ছে। নৈসর্গিক পরিবেশ ভীষণ ভাবে উপভোগ করছি। শুধু আমরাই না বহুতল আবাসিকের প্রতিটি ব্যক্তি একই ভাবে দেখতে পাচ্ছে। আলমোড়া’য় এমন আবাসিক হাতে গোনা। আমরা প্রথম যেখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম হোটেলের ছাদে। সহজে কাউকে এপ্রিলফুল না করা গেলেও,আমি হয়েছিলাম। সেটাই আমার জীবনে চরমপ্রাপ্তি।

ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের এক সারিতে থাকা প্রতিটি সদস্য-সদস্যাদের দেখতে পাচ্ছিলাম। ঠান্ডায় বাইরে না দাঁড়িয়ে ভেতরে এলাম। সামনের পর্দা আপাতত সরিয়ে দিলে বাইরের সৌন্দর্য দেখতে কোনো বাধা থাকছে না। সোফায় বসে সারাদিনের প্রয়োজনীয় কিছু লিখে রাখছিলাম। এমন সময় কপাটে নক করল কেউ। খুলে দেখি আমার একজন বয় রাতের খাবার দিয়ে গেল। দীপাঞ্জন দিদা-দাদুর কাছে পাশের ঘরে গিয়েছে। নিশ্চিত ওঁদের সাথে খেয়ে আসবে। দেখলাম না ওর খাবার এই ঘরে নিয়ে এসেছে। ভালোই হলো একসাথে খাওয়ার আনন্দ আছে। আমি খাতাপত্র গুছিয়ে রাখছি। দিপাঞ্জন খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। লক্ষ্য করলাম ভাতের সঙ্গে আলুটাইপের কিছু একটা ঘাঁট। আমার কী আছে আগে দেখে নিয়েছি। আমি জানতে চাইলাম, তুমি মাংস খাও না?
— হ্যাঁ।
— কিছু না মনে করলে বলি। আমার দুটো মাংসের পিস আছে। সত্যি বলছি আমি খেতে পারব না। তোমার একপিস দেবো? যদি বলো তাহলে দি। লেগ পিসের সঙ্গে কারি অনেকটা নিয়ে নিতে বললাম। আমি তখনও খেতে বসিনি। কপাটে কেউ নক করল। খুলে দেখি দিদি। ভাইপোর জন্য একপিস মাংস এনেছে। নিজের শরীর ভালো নয় দুটো খাবে না।

বুটুর অবস্থা দেখে,মহাভারতের পৌরাণিক চরিত্র যযাতি’র কথা মনে হলো। অভিশাপে জরাগ্রস্ত হয়ে যৌবন সুখ থেকে বঞ্চিত হয়।পুত্র নহুশ পিতার জরা নিজের শরীরে নিয়ে,পিতার যৌবন ভোগের সুযোগ করে দেয়। এখানে দিপাঞ্জন নহুশ হয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছে। দাদু-দিদিমা’রা শারীরিক অসুস্থতার কারণে খাওয়ার ব্যপারে ভীষণ হিসেবি। নিজেরা যা খেতে পারবেনা মেয়ের নাতিকে খাইয়ে নিজেরা কষ্ট পেতে চান না। শরীর মন চাঙ্গা রাখার বিকল্প পথ আর নেই। আর গভীরে যাওয়ার কী দরকার আছে থাক। রাতের ঘুম ভালো হলো। সকালে ওখানকার বাজার ঘুরে দেখলাম। বিলিতি কুকুর আমরা বাড়িতে পুষি। ওখানে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানকার কুকুরেরা ঝগড়ুটে মনে হলো না। তবে ক্ষণেকের দেখা বলে এমন ধারণা হতে পারে। তবে পাশে অন্য কুকুর ছিলনা। গাড়ি ছাড়বে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।

আলমোড়া থেকে গাড়ি ছাড়লো। আমাদের শেষ আবাসিক গন্তব্য কৌশানী। মাঝপথে পথের পাশে হোটেলে খেয়ে নিলাম। ড্রাইভার সমেত পনের জন। আমাদের সঙ্গে চালক খাবে সেইভাবে কথা ছিলো। দীর্ঘ পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে বৈকালে কৌশানীতে পৌঁছলাম। এক বিধবা মহিলার বাড়িতে উঠলাম। ঘরোয়া ভাবে থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত। অললাইনে ঠিক করা ছিলো। গ্রাম্য পরিবেশে নির্জন পাহাড়ের ঢালে পুরোনো আমলের ছাদফেলা দোতলা বাড়ি। রাস্তার লাগোয়া ঢালাই সিঁড়ি সরাসরি দোতলায় আসা যায়। মালকিনের বাড়ির বারান্দা দিয়ে। ওই সিঁড়ির নিচে দিয়ে পাথর কাটা পথে নিচের ঘরে প্রথমে আমরা এসেছি। ওখানের ঢালাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায়। সরু পথে সাবধানে ওঠা নামা করতে হয়। এমনিতে পাহাড়ি অঞ্চলে সাপ লুডোর বোর্ড পাতা যেন। সাপের মুখে পড়লেই একেবারে খাদে পৌঁছে যাবে। বেড়াতে এসে স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় চললে বিপদের ঝুঁকি কম থাকে। ধীরে সুস্থে সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম। যাদের শারীরিক অসুবিধা নিচের ঘরে থেকে গেল। ওপরের তিনটে ঘরের শেষ ঘরে গিয়ে উঠলাম আমি ও দিপাঞ্জন। ওই আমাদের কাছে গাইড। আমি অনেক কিছু ইচ্ছে করে ওর ওপর নির্ভর করে ভালোই আছি। যে যার ঘরে ঢুকে পড়লাম। গরম গরম চা বিস্কুট অল্প সময়ের মধ্যে হাতে পেলাম। বড়ো বড়ো গাছের ঘন বলয়ের মধ্যে থাকলেও বুঝতে পারছি সূর্য এখনো ডোবেনি। বারান্দায় বসে দেখতে পাচ্ছি সামনের বহু দূরে, অথচ মনে হচ্ছে ওইতো দেখা যাচ্ছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। সোনালি আভায় ঝলমল করছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে। নজর ফেরাতে কেউ পারছি না। প্রতিটি জায়গা এতো সুন্দর ভাবে যে উপভোগ করছি পুরো কৃতিত্ব একটি মানুষের তিনি আর কেউ নয় পিযুষবাবু। কাজলদির মেজভাই। লোকেশান নিয়ে নেটে ভীষণ খেটেছে। সেই সুফল আমরা এখন ভোগ করছি।

আমরা চা খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম, ধাপে ধাপে সারিবদ্ধ ঘরগুলো ক্রমশ নিচের দিকে নেমে গেছে। সর্বত্রে পাহাড়কে কেন্দ্র করে লোকালয় গড়েছে। কোথাও ব্যতিক্রম নেই। অভিজ্ঞতায় ভৌগোলিক গঠনশৈলী জেনেও বারংবার ভুল একই বিষয়ে হবেই হবে। মনে হবে ওইতো পাহাড়ের চুড়ো। দু’পা গেলেই ওর পাদদেশে পৌঁছে যাবেন। কিছুটা সময় ধ্যানস্থ অবস্থায় কাটিয়ে ফিরবেন। যতই যাবেন কতো পাহাড়ের মাথা মুণ্ডু আপনার চোখের সামনে যেন গজিয়ে উঠবে। আপনার আকাঙ্ক্ষিত পাহাড় ছোঁয়া কয়েক ঘণ্টায় সম্ভব হবে না। নিচের দিকে নামার ক্ষেত্রে একই অবস্থার শিকার হবেন। একসময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। আমাদের বেলায় সেটাই হলো। ওপর থেকে দেখলাম, কয়েকটা বাড়িতে পরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। নকল পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা বা রোপওয়েতে সাইকেল রেসিং-এর মজা পাওয়া। ছোটদের বড়োদের সবার উপযোগী বিনোদনের ব্যবস্তা আছে। বড়ো মেয়ে জেদ ধরলো ওখানেই যাবে। ভাবলাম ঘুরে আসা যাক। স্থানীয় লোকজনের জীবন যাপনের কিছুটা আঁচ করা যাবে। বেরিয়ে পড়লাম। দুইমেয়ে, ডাক্তারবাবু, দিপাঞ্জন এবং আমি। যে পথ দিয়ে আমরা এদিকে এসেছি, ওই পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। পাশে তাকিয়ে দেখছি নামার পথ চোখে পড়ছে না। আরো কিছুটা গিয়ে বাঁহাতি ঢাল পথে ঘুরে গেলাম। সুরু পথে ঘিঞ্জি বাড়ি ঘরের ভিতর দিয়ে নেমে গেলাম। এখন চলেছি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দিকে। পথের দু’দিকে পাহাড়ি ফুলে ভরে আছে। হালকা ঠান্ডা বইছে। কুয়াশার আস্তরণ চোখে পড়ার মতো। চারিদিকে ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই। প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আলতো গোছের কিছু কথাবার্তা হলো। চারদিকটা ঘুরে বেড়িয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ওপর থেকে দেখতে পেলাম আমাদের রাত্রি যাপনের বাসা। আবার আমাদের মাড়িয়ে আসা পথ দিয়ে ওপরে উঠতে হবে। মনে পড়ল চিরুনি খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যাগের মধ্যে আছে কি নেই বুঝতে পারছি না। একটা কিনে নিলে হয়। লক্ষ্য করে হাঁটছি তেমন দোকান চোখে পড়ে কি না দেখে। ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে ষ্টেশনারি দোকান দেখতে পেলাম। ভাবলাম হয়তো বাংলা ভাষা বুঝবে না। সামান্য নিরুনি কিনতে গিয়ে মানইজ্জৎ খোয়াবো ভাষার কারণে। আমি ছাড়া, আমাদের গ্যাঙে রীতিমতো হিন্দি ভাষার প্রয়োগ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বলতে গেলে কার্গিল যুদ্ধ বাধিয়ে চলেছে। বড়ো মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। যেখানে হিন্দি’র গুরুত্ব আছে বাংলার থেকে। আমি বললাম ‘হ্যাঁ রে মা, একটা চিরুনি কিনে এনে দাও তো’?

— তুমি কিনে নাও না।
দেখলাম মামাতো দাদার সঙ্গে মুচকি হাসছে। ডাক্তারবাবু হাসার অবস্থায় নেই। ছোট মেয়ে কৌশানীর কাঁধে নিয়ে। আমি সোজা দোকান গিয়ে বললাম- ‘বাল ছানলে কে লিয়ে কোম্ব হ্যায়?
দোকানী ‘বাল আর কোম্ব'(comb)দুটি শব্দের মধ্যে বিক্রয়ের বস্তুটি খুঁজে পেয়েছেন। ছানাছানি ক্রেতার ব্যাপার। বড়ো চিরুনি একটা আমার সামনে বাড়িয়ে দিলেন। দেখে বললাম, ছোটাবালা?
— নেহি।
— ঠিক হ্যায়, কেতনা রুপিয়া?
— বিশ।
আমি আর কথা না বলে কুড়ি টাকার নোট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এতো কম সময়ে চিরুনি খরিদ করে চলে এলাম ওদের খুশী হবার কথা নয়। কী বলে কিনলাম জানতে চায়। আমি বলতে চাইলাম না। পিড়াপিড়ি করত লাগল। শেষে থার্ডডিগ্রি সহ্য করতে না পেরে বলে দিলাম। ওরা একটা বাক্য তথ্য সরূপ সংগ্রহে নিল “বাল ছানলেকে লিয়ে কোম্ব “। এই শব্দবন্ধ পিযুষবাবুর হাতে পড়ে কতভাবে যে প্রয়োগ করে ভ্রমণের শেষ কটাদিন আমাকে তিতিবিরক্ত করেছে। সবাই ভারি মজা করেছে। আমিও চাপা ভাবে উপভোগ করেছি।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে রাতের সৌন্দর্য একনজরে দেখে নিলাম। নয়ানালেকের মতো নয়। অনেকটা খোলা জায়গা দেখতে পাচ্ছি। কাঞ্চনজঙ্ঘা শুভ্র মেঘের আকারে দেখতে পাচ্ছি। আকাশ ভরা তারা। পাহাড়ের যেন ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। আমরাও ঢুলুঢুলু চোখে রাতের মতো ঘরের কপাট আটকে দিলাম। সকালেও চোখ ছাড়তে চাইছে না। কী যেন তাড়ানোর গুঞ্জনে পাশ ফিরি। আড় চোখে দেখি কেউ দোর ঠেলে ভিতরে ঢুকতে চাইছে। বুটু বিছানায় নেই। নিশ্চিত ওই হবে বাইরে গেছিল। সকালের সূর্যোদয় দেখতে। দোর মুক্ত হচ্ছে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তলায় দেখি একটা বানর ঘরের ভিতরে কেউ জেগে আছে কি না পরখ করে নিচ্ছে। সুযোগ মতো ঘরে ঢুকে খাবারদাবার যা হাতের কাছে পাবে নিয়ে পালাবে। আমি আর অপেক্ষা না করে জানতে চাইলাম, “এ্যই কে রে?” অমনি দে ছুট। পরে জানতে পারলাম, আমার পাশের ঘরে থেকে মুড়ি,চানাচুর, বিস্কুট ইচ্ছা মতো নিয়েছে নষ্ট করেছে। সকালে কোলাহলের বিষয় বানরকুল নিয়ে। এদের আচরণ দেখে বাঁদরামি বলবেন কি করে। এরা যাকিছু করে পেটে খাওয়ার জন্য। দয়া করে কে কতটুকু দিয়ে থাকি। খাদ্যের ভাণ্ডার মানুষ নামক প্রাণীর হাতে। এমনকি বনের ফলমূল মানুষ সংগ্রহ করে মুনাফার সার্থে। প্রাপ্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয় বানরেরাও জানে।

কৌশানীতে আরও একটা রাত কাটাতে হবে। ২রা জুন, ভ্রমণ সূচিতে থাকা স্থানগুলো শেষ বারের মতো দেখে নিতে হবে। সকালে হালকা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। পুরোটাই পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা পথ। আমার এখন সর্বোচ্চে ঘোরাফেরা করছি। দু’তিনটে বাঁক কাটিয়ে গান্ধি আশ্রমে পৌঁছলাম। ওখান থেকে মাষ্টারদা নিজের জন্য এবং আমার জন্য দুটো বই কিনলেন। যার লেখক স্বয়ং গান্ধীজী-“আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ”। ওখান থেকে আমরা এখন চলেছি, শ্রী বৈজুনাথধাম মন্দির এবং শ্রী বাগেশ্বরনাথ মন্দির দর্শনে। এবার আমরা লক্ষ্য করলাম যতই পাহাড় হোক, পাহাড়ের তলদেশে সমতলে পুরোদমে চাষাবাদ চলছে। বিশেষ করে ধানচাষ নজরে পড়ছে। আমরা অনেক খাড়াই -উতরাই, আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এক পথের কোণে এসে দাঁড়ালাম। সামনে আরো উঁচু পাহাড়। দু-একটা ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে। সরু পথ কোথায় যে এঁকেবেকেঁ দূরে মিশে গিয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ফুলগাছ দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো ফুলের বাগান। তার মধ্যে ঝুপড়ি দোকান ঘর সহ এক পরিবার বাস করে। চায়ের অর্ডার দিয়ে, ততক্ষণে চারপাশের খুঁটিয়ে দেখছিলাম। আমরা খাড়াই খাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন থেকে চাষাবাদে যুক্ত থাকা মানুষগুলো পুতুলের মতো দেখাচ্ছিল। দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দৃষ্টি এড়ায়নি কারো।

চা বিস্কুট খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে শুরু করেছ। পথের ধারে ঝাঁকড়া গাছে নানা রঙের ফুল থোকা থোকা ভরে আছে। গাড়িটি সামনে থেকে বাঁক নিয়ে ঘুরে ওপরের দিকে কয়েকতলা উঠে গেল। পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাড়ি চলেছে। রাস্তার অপর দিকে অনেকটা করে সমতল। ঘরবাড়ি যেমন গায়ে গায়ে আছে। চাষাবাদের জমি চোখে পড়ার মতো। সময়ের শাকসবজি দেখতে পাচ্ছি। বেশ ঢলঢলে চেহারায়। ভালো লাগছে দেখে দেখে যেতে।

আমাদের গন্তব্যস্থল মন্দির চত্তরে পৌঁছে গেছি। ড্রাইভার পথের ইঙ্গিত দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সরযু নদীর ওপরে ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে গেল। স্থানীয় লোকের দ্বারা পথের জটিলতা কাটিয়ে মন্দির গেলাম। প্রথমে শ্রী বাগেশ্বরনাথ মন্দির, পরে শ্রী বৈজুনাথ ধাম মন্দিরে ডালা দিলাম ও প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। প্রাচীন মন্দির কারুকার্য দেখার মতো। এখন গাড়িতে উঠতে হবে। কিছুতেই লোকেশান বুঝতে পারছিলাম না। সরযু ব্রিজ পেরিয়ে অনেক কষ্টে পার্কিং ষ্ট্যাণ্ডে গেলাম। এই সব দেবদেবীর স্থানে সবকিছুই যেন অলৌকিক। কোথায় থেকে যে গড়িয়ে আসছে জল। চলতি রাস্তার ওপর দিয়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে গাড়ি রাখার জায়গা গড়িয়ে চলেছে। তবে এই জল সরযু নদীর জল নয়। প্রস্রাবের গন্ধ তেমন মালুম হলো। এরাও পবিত্র স্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে বুঝতে বিলম্ব হল না। ভক্তিতে বেশিক্ষণ ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কোনমতে সেখান থেকে গাড়ি চেপে কেটে পড়লাম।

পিযুষবাবুর ড্রাইভার তাদের জানা হোটেলে সতের জনের জন্য দুপুরে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে গেছে। পাহাড়ের গায়ে হোটেল। কোথায় থেকে ঝর্ণার জল পাইপের দ্বারায় এমন ভাবে রাখা আছে অনবরত জল পড়ে চলেছে। গাড়ি নিয়ে এদিকে এলে ওই জলে পরিষ্কার করে নেয় তাদের গাড়ি। আমাদের খাওয়ার মেনুতে তিন রকম ডালের আইটেম। কালো ডালের সাথে ঘি দিয়ে রান্না হয়েছিল। সবার মতো আমিও খিদের সময় বাদবিচার করিনি। পরে গা যেন কেমন হতে লাগল। ঠিক কোনটা খেয়ে যে কী হলো সঠিক বলতে পারব না। ওইযে শারীরিক অসুস্থতা শুরু হলো আর সস্তি পেলাম না। টি-গার্ডেনে এলাম। যখন শুনলাম প্রকৃত চায়ের বাগান পাহাড়ের ওপারে। শুনে আমার হয়ে গেছে। এর আগে আসামের চা বাগান দেখেছি। জলদা পড়ার আশেপাশের চা বাগান দেখেছি। দার্জিলিং দু-দুবার যাওয়া বাতিল হয়েছে থাক ওকথা। কিছুটা ধাপ পর্যন্ত উঠে শারীরিক দুর্বলতায় নেমে এলাম।

পিযুষবাবুর কথায় জানলাম। ড্রাইভারদের একটা সংস্কার আছে। ভ্রমণের শেষ দিনে তারাই মাংস রান্না করে, তাদের মেহমানদের পরিবেশন করার রীতি দীর্ঘদিন মেনে আসছে। ভালো লাগার কথা বাড়তি একসাজ মাংস খাওয়া যাবে। যখন জানলাম মাংসের সঙ্গে যাবতীয় তেল মশলার পুরো খরচ আমাদের বহন করতে হবে। মনে মনে না হেসে পারলাম না। মুখে কিছু বললাম না বটে, একটা গুরুভক্তির গল্প মনে পড়ল। কুলগুরু গরিব যজমানের বাড়িতে এসেছে। তাও সন্ধ্যার সময়। কী করবে মাথায় হাত। গুরুদেবের ঝোলাটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে। পাঁচ বাড়ি তো ঘুরে এসেছে। গোপনে দেখলো চাল ডাল তেল নুন কিচ্ছুটি বাদ নেই। ওতেই রান্নার কাজ সেরে ফেলল। গুরুদেবের ভাত বেড়ে দিয়ে কর্তা সমানে পাখার বাতাস দিয়ে চলেছে। গুরু এতটা আশা করেনি। খুশিতে বলল,’বেশ ভালো আয়োজন করেছ। এতো কম সময়ে কী করে পারলে’। যজমান বলল, ‘গুরুদেব, সব তো আপনার। আমাদের শুধু পাখার বাতাস’। ড্রাইভার আমাদের খরচে মেহমানদের সেবা দেবার আনন্দ অর্জন করল, পুণ্যি নয়। তবে কটাদিন আমাদের সঙ্গে ভীষণ ভালো আচরণ করেছ। ভিন্ন ধর্মের মানুষ বলে বুঝতে পারিনি। উভয়ের মধ্যে দূরত্ব যা কিছু ছিলো ভাষাতে, আর কিছুতেই নয়।

শারীরিক অসুস্থতার জন্য সেই রাতে মাংস খাইনি। সকালে দিপাঞ্জনের সঙ্গে নিয়ে, বহু অনুসন্ধান করে দূরের দোকান থেকে এককেজি মুড়ি সংগ্রহ করে নিয়েছি। গ্রুপ ছবি তুলে আমরা গাড়িত উঠে পড়ি। এবার হাইরোড ধরে গাড়ি ছুটতে শুরু করল। মাঝে খাড়াই পাহাড়ের তলায় গাড়ি রেখে ছোট হোটেল থেকে সবাই খেয়ে নিল। একমাত্র আমি ছাড়া। গাড়ির আড়ালে বমি করে একটু স্বস্তি বোধ করলাম। গাড়ি আর কোথাও থামল না। ট্রেনের সময় ড্রাইভারদের জানা। চারটের সময় ষ্টেশনে পৌছে গেলাম কাঠগোলার আগের ষ্টেশনে। ছটায় আমাদের গাড়ি ছাড়ার কথা। দুজন গাড়ির চালক আমাদের বিদায় জানিয়ে, নিজেরা বিদায় নিলো হাত নাড়িয়ে।

এখন বাড়ি ফেরার টান। দেখার কৌতূহল নেই। আপারে জমাট করে বিছানা করে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিলাম। দিন কেটে গেল দেখতে দেখতে। ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা। বিলম্বে গাড়ি ঢুকল হাওড়ায়। ডাক্তারবাবুর নিজের দুটো গাড়ি আগের মতো হাওড়ায় ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে। আমরাও গাড়িতে উঠে পড়লাম।

নুরো, জাতভাই হতেই পারে না [বাংলা গল্প]

জায়গাটা অনেকের চেনা। চলার পথে পড়ে। জরাজীর্ণ দোলমঞ্চ ছাড়িয়ে, ঝকঝকে মসজিদ টপকে যেতে হয়। পাশে খাল, একসময়ে ডোঙা চলাচল করত। এখন মজে গেছে। এই সেদিন পর্যন্ত বাঁশের সাঁকো ছিলো, এখন ঢালায়ের। দুদিকে বসার জায়গা। জলপথ পেরিয়ে রাস্তার কোণে উঠতে হয়। ওপারের রাস্তার দুমাথা দুদিকে গেছে। একদিক ইনায়েৎ মুখী অন্যটা বৈদ্যপুর। পশ্চিম দিকে যে পথটি গেছে, তার পাশে অল্প দিনের গজিয়ে ওঠা সংগ্রামী সংঘ। যাহোক করে রাতারাতি দাঁড় করাতে হয়েছে। সরকারি অনুদান হাত ছাড়া না করার জন্য। প্রথম কিস্তি পেয়েছে। পরা পাওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। সেটা বড়ো কথা নয়। বখাটে ছেলেগুলোকে সরকারি কাজে উদ্যোগী করে তোলাই মূল উদ্দেশ্য। আবার সর্ব-সাধারণের কাছে সেটাও তেমন বড়ো কথার মধ্যে পড়েনা। ভাবছ সে আবার কেমন কথা। সেটাই তো আসল কথা। তবে কথার কথা নয়। লাখ কথার এক কথা। এখন সেই কথাই বলতে চলেছি, তেমন দাবীও করছি না।

সংগ্রামী সংঘের নূরজাহান ছাড়া, কম বয়সী সদস্য বেশি। তাদের সঙ্গে তেমন প্রবীণদের মিস খায়না। নবীনরা যে বিষয়ে হাত দেয়, বয়স্করা ধারে কাছে ঘেঁষে না। সদস্যদের পোষাক আষাক। চুল কাটার অভিনব ছাঁট। পথ চলতি মানুষজনের সমঝে চলতে শেখায়। গ্রামের বিচার আচার নিয়ে তারা যা সিদ্ধান্ত করে মেনে নেয়, না বলে বলবো নিতে বাধ্য হয়। কারণ নবীন বিচারকদের কথার চেয়ে হাত বেশি চলে।

সংগ্রামী সংঘের জানালা দিয়ে খালের ওপরটা দেখা যায়। বটগাছের মোটা ডাল, খালের ঢালাই পথের অনেকটা ছায়া করে আছে। সেখানে সকাল বিকাল দুপারের লোক জটলা করে থাকে। বেশ কিছুদিন ইমনকে দেখা যাচ্ছে। পড়ন্ত বয়সী যুবক। ভাঙা শরীরের অবস্থা। আগে এমন অবস্থা ছিল না। এখন দেখলে যে কেউ মনে করবে।

সংগ্রামী সংঘের ছেলেরা, ইমনের অতীত জানবে কোথা থেকে। এই সময়ের সঙ্গে তেমন যোগ নেই। ইমনের পেটে সামান্য হলেও বিদ্যে আছে। সরকার মাথাপিছু এককালীন টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। যুবকরা যাতে কিছু একটা করেকম্মে খায়। ইমন সেই সুযোগে পঁচিশ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছিল। তার উদ্দেশ্য ব্যবসা ছিল, সে নিজেই সেই দাবী করতে পারবে না।

বকখালি থেকে শুটকি মাছ আনতে গিয়ে নৌকা মাঝ নদীতে ডুবে যায়। তেমন গল্পতো ঋণদাতাদর বিশ্বাস করাতে হয়। তাই বুদ্ধি করে হালকলমি পুঁতে আসে মাঝ নদীতে। পরিদর্শকের টিম দেখতে চেয়ে ছিল। ছোট নৌকা অস্বাভাবিক দোল খাওয়ার ফলে, কোথায়ও দুষ্টুমি খেলছে বুঝতে পারে। আর কেউ প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে এগোয়নি। ব্যাঙ্ক আবার ঋণ দেবে কোন যুক্তিতে।

ইমন আবার বেকার হয়ে পড়ে। টৌঁ-টৌঁ করে ঘোরে। নতুন সুযোগ হাতে আসে। ই-রিক্সা বাজারে চলছে। কিছু টাকা জমা দিয়ে টোটো গাড়ি নেয়। তেলের খরচ নেই। খোলা ইলেকট্রিক তারে, হুকিং করে চার্জ দেয়। একসময় খোলা তার আর নেই, কেবল তার হয়ে যায়। মিটার থেকে চার্জ দেওয়া মানে, হাতির খোরাক। গোপন গাড়ি বিক্রি। গাড়ি নেই, গাড়ির কিস্তির টাকা কে দেবে। যার গাড়ি সেই দিক।ততদিনে হাত ঝেড়ে সরে পড়েছে ইমন। কাজের ছেলে কতদিন আর বসে থাকবে। ষ্টেশন চত্বরে জুয়ার কারবার ফাঁদে। সাট্টায় হাত পাকায়। থানা পুলিশের ফাঁকি দিয়ে আর কতদিন চলবে। কোমরে দড়ি দিয়ে লকআপে ভরে। পুলিশেরও সততা আছে বৈকি।

ইমনের একটা লাভ হয়েছে। জেলের ভেতর থেকে শেখা, সিঁদকাটা হস্তশিল্পটি। চুরির কাজে সহযোগী এক ফেরি করা মহিলা। দিনের বেলা ফেরি করে। গলা চড়িয়ে সুর করে হাঁকে, ‘ভাঙা চোরা আচে’ বলে। গৃহস্থের কাছে সততার কথা বলে,’আমি ওগার পেনা, তিন কেজি মাল এক কেজিরও কম করিনা’। হাতেকলমে প্রমাণ দিতে হয়নি বলে মুখের জোরে টিকে আছে। কিন্তু সততা এইখানেই, হাঁকার মধ্যে “চোরা” কথাটা বলতে ছাড়েনি। দিনের বেলা পথঘাটে দেখে যায়। রাতে ইমনের সঙ্গী হয়ে সিঁদ কাটে দুজনে মিলে। এই বিদ্যেও এক সময় লাটে উঠলো। ইমনের কপাল এমন।

কারণ আর কিছুই নয়। সময় পালটাচ্ছে। বেড়া বা মাটির দেওয়াল আর নেই বললেই চলে। শহরে অনেক আগেই পাট চুকিয়েছে। যে বেড়া দিতে ইচ্ছুক, সে তিন ইঞ্চি ইট গাঁথবে। যে মাটির আঠারো ইঞ্চির দেওয়াল দিতে চায়, সে দশ ইঞ্চির ইটের গাঁথলে অনেক মজবুত বাড়ি বাঁধতে পারবে। এই তাথ্যিক কথা ইমনের পক্ষে গরিবের পেটে লাথি মারার সামিল। সুতরাং ইমনের কাছে ফালতু কথা।

কাজ নেই। ইমন অনেক দিন আর বাড়িতে যায় না। কোথায় খায়, কোথায় থাকে ঠিক নেই। ঘরের লোক বাড়িতে না এলে তো তাদের চিন্তা হবেই। প্রকৃত কাদের চিন্তা হয়? প্রশ্নের সাধারণ উত্তর, বাড়ির আপন জনের। ইমনের বাড়ি বলতে তিনটি। বলাটা স্বাভাবিক যে নিজের পেটের অন্ন আগামীকাল কোথায় থেকে আসবে জানেনা। যার অনিশ্চিত জীবন। তার ক্ষেত্রে তিনটি বাড়ি মানেই তো বাড়াবাড়ি। বাড়িতে বউ নামক তরর পদার্থ থাকবে না, সে কেমন কথা।

এই যে ইমনের তিন তিনটি বউ বা নিকা করেছ কিংবা করেনি। তার বৈধতা নিয়ে কৌতূহল নেই। সেই তিন বৌয়ের অবস্থান তিন জায়গায়। তারা কেউ কাউকে চেনে না। তারা কেউ ইমনের উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল নয়। একজন তো ফেরি করে। দ্বিতীয় জন মহিলা সমিতির মাধ্যমে স্কুলের রান্নার কাজ জুটিয়েছে। প্রথম জন এণ্ডি গেণ্ডি চার পাঁচটা বালবাচ্চা। বৌমার কাজে পাঠাবে কোথায়। শ্বশুর নাতি নাতনিদের সঙ্গে সময় কাটায়। অযোগ্য সন্তানের পিতা হলে সমাজের কাছে তো মাথা হেঁট হবেই। দায়িত্ব নিতেই হবে।

বুড়ো বাবার কি হলো, বউ বাচ্চাদের কী না হলো, ইমনের চিন্তাভাবনার মধ্যে পড়েনা। সে ভোগী মানুষ, যোগী মানুষ তো নয়। সে বউ বাচ্চাদের ‘কেদারা’ মনে করে। আর একটু খোলসা করে বললে আরাম কেদারা বা আরামদায়ক চেয়ার। যেখানে যখন যাবে হাত পা ছড়িয়ে, গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করবে। বউয়ের আদর খাবে। ক্ষণিকের জীবনে কে কার বউ! কে কার ‘দারা’। এককথায় কেদারা। এই সুক্ষ্মতত্ত্ব মাথায় থাকলে সংসার সম্পর্কে উদাসীন থাকা যায়।

ইমনের জীবনে কেদারা মিলেমিশে সংগীতময় হয়ে উঠেছে। বৈচিত্র্যময় বিবর্ণ জীবনে রাগ অনুরাগের অপূর্ব মিশ্রণ। তাও রাতের প্রথম প্রহরে যদি হয়। তখন ঘুমকাতুরে বেরসিক পাড়া প্রতিবেশীদের খারাপ লাগতেই পারে। কিন্তু ইমন সময় করে তিন জায়গায়, বেসুরো জীবনের রেওয়াজ চালিয়ে যাচ্ছিল বটে, তবে অনিয়মিত হয়ে গেছে। ফলে সন্দেহের বাতাবরণ এভাবেই তৈরি হয়েছে তিন অবলার মনে। তাদের গলায় ধ্বনিত হলে হরবোলা মনে হয়। যে আতঙ্ক তাদের মনে পাষাণের মতো চেপে বসেছে।

তিন বউ খোঁজখবর রাখছিল। কোথায় যায়। কোথায় খায় থাকে। জেনেছে ভিখিরির দশা। একরকম গাছ তলায় কাটানোর মতো অবস্থায় দিন কাটছে। পুরুষ মানুষের হাতে টাকাপয়সা না থাকলে যা হয়। তবুও এতো ভেঙে পড়ার কি আছে। আজ নেই কাল হবে। ইমন ভাবে মেয়েলোকের বোঝার কথা নয় তাকে। তার জীবনে লালকালির দাগ পড়েছে। আর ঘুরে দাঁড়ানো এ জীবনে সম্ভব নয়। নিজের কপাল নিজেই ভেঙেছে। পায়ে কুড়ুল তো অনেক আগেই মেরে বসে আছে। তা না হলে এঁদো পুকুরে ডুব দেয়। একসময় যার ল্যাজের ছটায় কতো সুন্দরী ললনা ছিটকে গেছে। অতীত থাকা। ও সব মন খারাপের কথা।

ইমনের তিন বিবি, এক রোসুনের পুঁটকি। তাদের মধ্যে অনুভূতির মিল কাকতালীয় ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। তিন বউ ভালো রান্নাবান্না করে পোলের ওপর হাজির।

বড়ো বউ গামলি ভরে ভাত, তিনকাটা মাছের রসা গামছার চারমুড় বেঁধে এনেছে। মেজো এনেছে, টিফিন ক্যারিতে মুরগির মাংস। ছোট এনেছে, হটপটের মধ্যে গোস্ত। বেশি করে এনেছে, একসঙ্গে দুজনে খেয়ে নেবে। তিনজনের উদ্দেশ্য ইমনকে খাওয়ানো। ইমনের সঙ্গে তাদের কার কী সম্পর্ক আলাপচারিতায় বোঝা গেল। একঘাটের জল তারা খেয়েছে। তারা পরস্পরের সতীন। আলাদা সঙ্গসুখ সেভাবেই তারা কেউ পায়নি। তাদের মধ্যে আর ক্ষোভের সঞ্চার হলো না। তারা আগে থেকে অনুমান করত এ বর নয় বরবর। সুবিধের বস্তু নয়। পেটের কথা মুখে আনে না।

যাইহোক মানিয়ে নিতে হবে। দুপুর গড়িয়ে যাওয়ার আগে, বুঝিয়ে সুজিয়ে খাওয়াতে হবে। কতদিন তাদের হাতে রাঁধা ভাত খায়নে। তিনজনে তিনজনের মতো সাধাসাধি করতে লাগল। আশপাশের কৌতূহলী লোকজন ভরে গেল। খাওয়ানোর জন্য কঠিন সাধনা। এতো পিড়াপিড়ি। যে দেশে দুটো ক্ষিধের ভাতের জন্য লোকের দোরে মুখ রগড়ায় ভিখিরি। দূরছ্যা করে তাড়িয়ে দেয়। তেমন হতভাগা দেশে এতো অতীব ভাগ্যবান বলে মনে হয়।

ইমন ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে আছে। এভাবে তিনজনে স্বামীর সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষায়। কেউ তো আসামী ভাবছে না। তার মুখোশ তো খুলে গেছে। কই ওদের মধ্যে তো ঝগড়ার লক্ষণ দেখছে না। তবে কি ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ। এই শান্ত আসলে প্রলয়ের ইঙ্গিত।

একটা প্রচলিত কথা গ্রামবাংলায় মুখে মুখে ফেরে। মেয়েরা সব কিছুর ভাগ দিতে পারে, স্বামীর নয়। এখানের রসায়ন কী? বিষয় জলের মতো সহজ। তিনজনে কেউ ইমনকে নিজের করে পায়নি। এখন তিনজনে মিলে যদি নিজেদের মতো ঘরছাড়া মানুষটাকে পায় কম কিসের। উভয়ের ভালো লাগার কথা।

এছাড়া অন্য উপায় আর নেই। ইমন কথায় কথায় ‘তালাক’ দেওয়ার কথা শুনিয়েছে। সেই ভয়ে বৌয়েরা কাঁটা হয়ে থাকত। মুখ বুজে মেনে নিত স্বামীর অন্যায় আবদার। এখন তো আরো বিপদের সম্মুখীন। একবার তিন তালাক বললে তিনজনের লাগবে। যেভাবে গায়ে গায়ে লেগে আছে। তালাক তো কম বেশি দোষ বিচার করবে না। তার তো বোধ বুদ্ধি বলে কিছু নেই। যতটা ইমনের আছে।

তিন বিবি পিড়াপিড়ি করছে। কৌতূহলী মানুষজন ঠেলাঠেলি শুরু করেছে। ইমন ভাবছে যে কোন মুহূর্তে দুর্ঘটনা তার দিকে ধেয়ে আসত পারে। বিপদ এড়ানোর শেষ ভোঁতা অস্ত্র ‘তালাক’। হাতের কাছে আর বিকল্প কিছু নেই। স্বমূর্তি ধারণ করে আঙুল তুলে, সর্বাঙ্গ দুলিয়ে জানিয়ে দিল, তোরা এখেনতে না গেলে তিন তালাক দোব বলে দিচ্ছি। কোন শালা বাঁচতে পারবেনে।

আর কোথায় যায়। বউরা যে যার মতো ক্রোধ সম্বরণ করতে লেগে পড়ে। বড়ো বউ পা জড়িয়ে ধরে। মেজো হাত কজলাতে থাকে। ছোট বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হাউমাউ করে কাঁদত থাকে। যেন স্বামী ছাড়া হলে কী করে খাবে। এই মুহূর্তে তারা ভুলে গেছে, তাদের পেটের ভাত তারাই সংগ্রহ করে। দুষ্টু এঁড়ে দেয়না।

এই যে মান অভিমানের পালা চলছে। সংগ্রামী সংঘের ভেতর চলে গেল। নুরজাহান ভাবল ব্যাপারটা নিজের গিয়ে থামাতে হবে। সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়ল। মোটামুটি সারাংশ দূতের মুখে শুনেছে। তবুও জানতে চাইল, ‘হ্যাঁ, ভাবিরা।কি হয়েছে তোমাদের মধ্যে কেউ বলুন তো শুনি’।

তিনজনে কিছুই বলছেনা। যা বলবে তো স্বামীর বিরুদ্ধে যাবে। কোথায় মারধোর করবে কে জানে বাবা। মুখে কেউ কিছু বলে না।
— তা, খুড়ো আপনি বলুন ঘটনাটা কি?
— দ্যাখো আমাদের স্বামীস্তিরির বেপার। তোমার একেনে নাক গোলাতে হবেনে।
— তা ভালো কথা। তোমাদের ঘরের মধ্যে থাকলে ইস্তিরি কতটা গরম হয়েছে জানতে চাইতাম না। ঘরের কেচ্চা বাইরে এনে আভিজাত্য দেখানো। মেরে কান লাল করে দেবো। এই ধরতো যা মনে করেছে তাই। বলে কিনা নাক গলাতে হবেনে।

তিন বউ কাঁদো কাঁদো। নূরজাহানকে বুঝিয়ে বলল, ভাই আমরা তোমার কেউ ভাবি, কেউ দিদি, কেউবা বোনের মতো। ওদের বলে দাও যেন না মারে। দেখতে পাচ্চ ওই তো শরিলের ছিরি। না খেয়ে খেয়ে।
— দেখ ভাবি, আমার যা মনে হয় তোমরা ওকে ভয় পাও। তোমাদের প্রতি ওর তো দেখছি কোনো দায়িত্ব বোধ নেই। অথচ মদ্দের রাশ আছে। দেখছি ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই। সত্যি কথাটা বলত কি?
— দেখ ভাই রাগ না চণ্ডাল। যদি মাথা গরম হলে তালাক দেই দেয়। আমরা তাই ভয়ে ভয়ে থাকি।
— সে কি ভাবি? তিন তালাকের ভয়। তালাক তো কবে এদেশ থেকে উঠে গেছে। বরং কেউ তালাকের কথা মুখে আনলে, আর তা যদি কোনোভাবে থানা জানতে পারে, আড়ং ধোলাই করবে।
— সে কি ভাই, তালাক নেই। সত্যিাতভ বলছ?
— মিথ্যে বলে কি হবে। তালাকবাবুর জিজ্ঞেস করনা।
— ভাই কি করে তালাক উঠল জানি না। যেই তুলুক আল্লাহর কাচে দোয়া মাঙি। তার ভালো হোক। তোমার আর আমাদের বিচার করতে হবেনে ভাই। একটা কাজ করো। যদি এই ভাবিদের রান্না খাও তবে আমরা খুব খুশী হবো। তিনজনের আনা ভাত, মাছ, গোস্ত তোমাদের কেলাবে নে যাও। আমরা ওর মাথা থেকে পা অব্দি তালাক নামিয়ে তবে ছাড়ব।

নূরজাহান কিছুই বুঝতে পারল না তিন ভাবি কী করতে চাইছে। বটগাছের ওধারে খালপাড় ঘেঁষে হালকলমির গাছ বাতাসে দুলছিল। তিন বউ হালকলমি ভেঙে এগিয়ে চলল ইমনের দিকে। ইমন বুঝেছে ভয় দেখিয়ে আর কোনো কাজ হবেনে। ইমন পালিয়ে যাওয়ার আগে, নূরজাহান সম্পর্কে মন্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করে গেল। তালাক উঠে যাওয়ার কথা বলে নারীদের যেভাবে ক্ষেপিয়ে তুলল, তা বেদীনের কাজ। ওই নুরো, জাতভাই হতেই পারে না।

গুরুতর সন্দেহ [হাসির গল্প]

ভয়ে এমন হিঁচড়ে টেনেছে সুতির মশারির একটা কোণ ছিঁড়ে ফালা। সন্ন্যাসীদের ওপর থেকে ঝাঁপ কাটার মত, তক্তপোষের থেকে মেঝেতে পড়েছে। তারপরে অন্ধকার ঘরের কোথায় যে গা ঢাকা দিল, বোঝার উপায় নেই। ভাগ্যিস ছেলেটা জেগে ওঠেনি। ভয়ে চিৎকার করলে অন্য বিপদ। ওর থামাবে না, না নিজের প্রাণ বাঁচাবে।

রমনীরমণ বুঝতেই পারছে না ব্যাপারটা কী। বউয়ের একী উদ্ভট আচরণ। নিজের বউ যেন নিজের নয়। কেমন পরের মতই। ওর শরীরে অন্য কেউ ভর করেনি তো। হতেও পারে। অত রাতে ফাঁকা মাঠ দিয়ে একা ফেরা উচিত হয়নি। তাও ঘোড়া মারা পুকুরের পাশ দিয়ে। ভাবলে গা শিউরে ওঠে। তখন সন্দেহ হয়েছিল, গুরুত্ব দেয়নি।

মাঘের শীত। গা-হাত-পা ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। কাউকে কিছু না বলে দোর খুলে ছেলে বউয়ের পাশে শুয়ে পড়েছে। ঘরে জোনাকির মতো টিমটিমের আলো ছিল। তবে, ওই আলোর উৎস খুঁজতে অন্য একটা আলোর দরকার হতো। সেই বিড়ম্বনায় আর যায়নি। একবার ঘরের মধ্যে যখন ঢুকেছে, শোবার যায়গা ঠিক পেয়ে যাবে। বেশি হাতড়াতে হবেনা। তাই হয়েছিল রমনীরমণের ক্ষেত্রে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া থাকে। একটু আধটু শোয়া খারাপ হতেই পারে। উভয়কেই মানিয়ে নিতে হয়। যেমন ধরো, শীত কুঁকড়ে যাওয়া শরীরে তাপের দরকার। আমরা ছোটবেলায় মা ঠাকুমার গায়ে পা তুলে দিতাম না। তাপ নিতাম না। সেদিন তো কারো কিছু মনে হত না। আজ কেন নয়। অন্তত আজকের বাইরের কনকনে শীত থেকে আসা রাতটুকুর জন্য। সেই দাবী করার অধিকার তাতের মধ্যে থাকতে পারেনা।

বন্ধুর বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। গুরুপাক খাওয়াদাওয়া হয়েছে। এতো রাতে বাড়িতে ফিরে শরীর আইঢাই করছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। গভীর ঘুমের মধ্যে ছিল রমনীরমণ। কিছু বিশেষ স্বপ্ন দেখেছিল কি না মনে করতে পারছে না। তবে হ্যাঁ, ঘুমের আগে যে নতুন অনুভূতি অনুভব করেছিল। বউয়ের গা ঘেঁষে শুয়ে মনে হয়েছে। বউয়ের শরীর এতটা পালটে গেল কী করে। সংসারে দিনরাত খেটে খেটে হাড় কখানা সার। এযে দেখছি সেই ছিটে বেড়ার গায়ে খড়ে কাদায় ছোপ দেওয়া। রাতারাতি নরম কদার মতো তুলতুলে শরীর হল কী করে? তবে কি শীতের রাতে অনুভূতিগুলো ভোঁতা হয়ে গেছে। তাই এমন মনে হচ্ছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল। বিশেষ পরীক্ষা নিরীক্ষা করেনি। বউ নিশ্চিতে ঘুমুচ্ছিল। বউয়ের দিব্যি করে বলতে পারে, কোন প্রকার বিরক্ত করেনি। তা হলে অমন ছেঁচড়ে উঠল কেন? অজানা প্রশ্ন মনের মধ্যে ঘুরপাক খেয়েই চলেছে।

রমনীরমণ কিছুতেই তক্তপোষের থেকে মাটিতে পা নামাতে চায়ছে না। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ভয়। যেন হাই-ভোল্টের তার ছিঁড়ে ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে। যে মানুষটা একা ফাঁকা মাঠে নিকষ অন্ধকার উপেক্ষা করে, বীরদর্পে বাড়ি ফিরেছে। সেই মানুষটা চার দেয়ালের আবদ্ধ আঁধারে এত ভয়। কপাটের খিল যে খুলবে, সেই সাহসটুকু হারিয়ে ফেলেছ। বাইরে ঘরের দাবায় রমনীরমণের মা শুয়ে। ভয়ের মধ্যে কখন মাকে ডেকেছে হুস নেই। ডাক শুনে মা জেনে গেছে বড়খোকা রাতে বাড়িতে ফিরেছে। মায়ের কোনরূপ সাড়াশব্দ রমনীরমণ ভেতর থেকে শুনতে পায়নি। আর নিজেও টু শব্দ টি করেনি। অবস্থা খুব ভালো বুঝছে না। তার পিছু পিছু পেতনি টেতনি ঘরের মধ্যে ঢোকেনি তো! বউয়ের দেহের মধ্যে ঘিপটি মেরে নেই তো? কী জ্বালায় পড়া গেল। ঘরের মধ্যে তেমন বাড়াবাড়ি করলে যদি ঘাড় মটকে দেয়। নিজের ঘাড় নিয়ে যাখানে সন্দেহ, দুধের পোনার ঘাড়ের আর নিশ্চয়তা কীসের। তুলে আছাড় মারবে না কে বলতে পারে। পেতনির বুক কাঁপবে বলে মনে হয় না। রাত এখন কত হল বোঝার উপায়নি। অশুভ আত্মার একমাত্র ভয় আলো। একবার ভোরের আলো ফুটতে দাও না কোথায় যায় দেখব। তখন এই পুরুষ মানুষের হাতের মুঠোয় থাকতে হবে। যত বড়ই পেতনি হও না কেন। তোমাদের যতো শক্তির প্রকাশ আঁধারে। পুরুষের পরাজয় তো ওখানেই।

রমনীরমণের বন্ধুর বিয়ে ছিল আজ। আর আজকেই ছিলো খুড়তুতো ভাইয়ের বউভাতের অনুষ্ঠান। বাড়ি সুনসান। এখন জেগে আছে ‘এয়েরা’। প্রত্যেক মহিলা সংসার ধর্মে পোড়খেকো। নবদম্পতিকে হাতেকলমে কিছু শিখিয়ে দেওয়ার দায় তাদের থাকে। তারাই হাসি ঠাট্টায় হই-হুল্লোড়ের দিয়ে ফুলসজ্জার ঘর ভরিয়ে রেখেছে। ঘরের পাল্লা ভেজানো থাকলে কি হবে। ফুটো ফাটা দিয়ে আলো আটকানো যায় নাকি। অনেকটা ফুটো নৌকায় কাদা বুজো দেওয়ার মত। এখানেও তেমন অনেক কিছু বাইরে বেরিয়ে আসে বইকি। কানের দোষ দেওয়া যায় না। ফুলসজ্জার রাতে ঘরের মধ্যে যা কিছু হয়, অনেকটা এইরকম। ধরুন দোকান ঘরে নতুন ‘সাটার’ বসালে মিস্ত্রিরা কি করে। লাইনে ভালো করে গিরিস দেয়। হাতল ধরে বেশ কয়েকবার ওঠাতে নামাতে থাকে। যখন খুব সহজে যাতায়াত করছে মনে করে, মালিকের হাতে চাবির গোছা ধরিয়ে দেয়। তালা চিনিয়ে কাজ শেষ করে।

এক্ষেত্রে তেমন বিদ্যে খাটে না। ভিন্ন মেরুর দুটি ছেলে মেয়ে। তাদের দেহ মন যান্ত্রিক বস্তু নয়। তাড়াহুড়ো করলে চলেনা। জোড়াতালি দেওয়ার কাজ নয়। শিব্রাম চক্কোত্তির গল্পের মত “আস্তে ভাঙো” পথ ধরতে হয়। তাতে কাজ হবার হলে হবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্দেশ্য সফল হয়। এয়োতীরা একটা জিনিস বুঝতে পারে, এই জুড়ি কেমন হবে। ধরুন বাবা শিবের মাথায় ফুল বেলপাতা দিলেন। যত তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে, মানে তার মনস্কামনা পূর্ণ হল। এক্ষেত্রে ঠিক তার উলটো। উভয়ের অক্ষ প্রত্যঙ্গ একে অন্যর ওপর চাপিয়ে দেয়। যত তাড়াতাড়ি পড়ে যাবে, সোজা কথায় সরিয়ে নেবে। বুঝতে হবে উভয়কে বাগে আনতে কালঘাম ছুটে যাবে। যদি ফুল না পড়ে তবে বিলকুল সবাইকে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়া হচ্ছে ধরে নিতে হবে। এখন তেমন অবস্থায় আসেনি। নবদম্পতি ও এয়োতীদের মধ্যে আসর জমে উঠেছে।

রমনীরমণের মা আর চোখ বুজিয়ে থাকতে পারে। ঘরের মধ্যে বড়ছেলে আর সদ্য নতুন বৌমার খুড়তুতো যুবতী বোন। এক বিছানায়। এক ঘরের মধ্যে। ভেতরে কী করতেছে কে জানে বাবা। মায়ের মনে এই ভাবনা চলছে। রমণটা তো একবার মা বলে চেঁচালো। মেয়েটা মুখে রা কাড়েনি। বড়বৌমা এয়ে হয়ে ফুলসজ্জার রাতে হাসিঠাট্টায় মসগুল। সে বেচারা কি করে জানবে, তার ঘরে কী কেল্লা না হচ্ছে। যাই আগে ডেকে আনি গে। উঠোনে দাঁড়িয়ে রমনীরমণের মা। ঘরের ভেতরে ছাপিয়ে যাওয়া গলাটি বড়বৌমার। ভীষণ আমুদে মেয়ে। রমনীরমণের সহধর্মিণী। রমণের মা হাসিঠাট্টা শোনার জন্য আড়ি পাততে ঘুম ভেঙে আসেনি। এসেছে সর্বনাশের খবরটি দিতে। দাবায় উঠে দরজায় ধাক্কা মেরে বলল, বড়বৌমা বেইরে এসো তো।

— কেন মা? দোর একটু ফাঁক করে জানতে চাইল।
— কেন বলতে হবেনে, আগে এসো।
বিমলা বাইরে আসার আগে দলের সবাইকে বলে এলো, আসর চালিয়ে যা। এখুনি ঘুরে আসছি।

বউমা উঠোনে নামতে শাশুড়ি বলল, ওদের ঘর তোমাকে বেঁধে দিতে হবে নে। এখনকার মেয়েরা ঘর বেঁধে আসে। ওদিকে যে তোমার ঘর ভাঙতে বসেছে। আগে নিজেরটা সামলাও। বিমলা বুঝতে পারল না। শাশুড়ি বলল, হ্যাঁ করে আছো কি? তারপরে যেযে যেতে মোটামুটি মূল কথা বুঝিয়ে দিল। বিমলা দম দেওয়া পুতুলের মতো ওইযে চলতে শুরু করল, একেবারে ঘরের ভেজানো কপালের গায়ে ধাক্কা খেয়ে উলটে পড়ার উপক্রম। বালা ধরে নাড়া দেওয়ার আগে ধড়াস করে ভেতর থেকে কেউ খিল খুলে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল। কোথায় গেল পরে জানলে চলবে।বিমলা ঘরের মেঝেতে হুড়মুড় করে পড়ে যাচ্ছিল সামলে নিল কোনভাবেই।

বিমলা ঘরের ভিতর ঢুকে দেখল স্বামী যেন মহারাজ। খাটের ওপর ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে। মুখের অভিব্যক্তি দেখার জন্য টিমটিমেটার পলতে বাড়িয়ে দিল, রাগের বশে অনেকটা। কালি উঠে কাচ কালিতে ঢেকে গেল। বিমলার মনে হল, টিমটিমেটার লজ্জা বোধ আছে। মুখে কালো কাপড় বেঁধে ধিক্কার জানাচ্ছে। কেন অসহায় মেয়ের পক্ষ নিয়ে। হলে ওই রাজসাক্ষী হবে। যাইহোক, মেয়েটা এভাবে গা বাঁচিয় পালাল কেন সেটাই প্রশ্নের। পুরুষ মানুষের দিয়ে বিশ্বাস নেই। বিড়ালের মত এরা ছোঁক ছোঁক করে। জানতে আর বাকিনি। সরাসরি স্বামীর কাছে জানতে চাইল, তুমি মেয়েটার কী করেচো?

— আমি কি করেছি।

— তুমি ছাড়া আর কে ? কী সোন্দর কথা শোনো, আমি কি করিচি।

— তুমি কি যা তা বলছ।

— যা তাই বলচি। ঘরের মধ্যে কুস্তি করেচ দেখতে পাইনি ভেবেচ। পোথমেই দেখেচি। মশারির দড়ি ছেঁড়া কেন? ছাবালটার মশা কেমড়েচে সেদিকে হুসনি। একেবারে পাগল হয়ে গেচো মেয়েটার পাওয়ার জন্যে।

— তোমার কি হয়েছে বলত?

— আর কী বাকি রেখেচ যে হবে। সোকালে কলে মুখ দেখাতে পারব।

— মুখের কী হয়েছে?

— আমার মুখের আবার কি হবে। তোমার জন্যে তো মুখ দেখাতে পারবুনি।

— আমার জন্য তুমি মুখ দেখাতে যাবেই বা কেন। আমার মুখ থাকতে।

— আর মুখ নেড়ে কথা বলুনি। কলতলার মেয়েরা জানতে চাইলে বলব, আমার মদ্দ কী না ভালো কাজটি করেচে।

— তুমি না বললে ওরা জানবে কি করে?

— আমি একজন মেয়ে হয়ে , একটা মেয়ের এতো বড় ক্ষতি কি করে মুখ বুজে চেপে থাকি বলো। জানাজানি হলে আর বাইরে বে হবে মেয়েটার।

— তাহলে তো তোমার কপাল ভাঙবে।

— কি বললে?

— আমি বলছি কি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করো। শীতের সময় এসে ঘরে ঢুকে তোমার আর ডাকিনি। হালকা আলোয় মনে হয়েছে মায় পোয় শুয়ে আছো। আমি কাপড় জামা ছেড়ে তোমাদের লেপের মধ্যে ঢুকে পড়ি। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি হুস নেই।

— এদিকে হুস থাকবে কেন। পাশে যে একটা মানুষ পোড়া কাঠের মতো পড়ে আছে খেয়াল ছিলনা। একবারের জন্য গায়ে হাতটি দেবার নাম করোনি। তোমার সোঁসারে ঘানি টানতে টানতে গা হাতের কি দেখার হাল আচে। আমার দিকে আর টান থাকবে কেন!

— কে বলেছে তোমার এখনো আগের মত দেখতে নেই।তোমার মধ্যে আলগা চটক আছে। চোখ ফেরাতে পারি না।

— থাক থাক তোমার আর পিরিত দেখাতে হবে নে। ভেতরটা খুলে দেখাতে পারলে দেখাতুম।

— যাই থাক, খোলার নয় যখন খুলতে চেষ্টা কোর না। তোমার ভিতর বাহির বিলক্ষণ আমার জানা আছে। বিয়ের থেকে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। শেষ কথাটি অবশ্যই মনে মনে আউড়েছে।

— দ্যাখো মন ভোলানোর চেষ্টা করুনি বলে দিচ্ছি। পাশে শুয়ে তফাৎ কিছু মনে হয়নি?

— না বলছি তো। শুইছি আর ঘুইমে পড়িছি।

— একবারটি গায়ে হাত দাওনি?

— দিলে ভালো হতো। দীর্ঘ এই সংসার জীবনের প্রথম ঐতিহাসিক ভুল করতুম। হায়রে কপাল পরশপাথর ছুঁয়ে দেখলুম না কেন। একই অমৃত ভেবেছিলুম।

— যতই কথা ঘোরাও হেস্তনেস্ত একটা করবই। সকলটা হোক।একটা মেয়ে হয়ে আর একটা মেয়ের সব্বানাশ হতে দুবুনি।

— বরং সেই ভালো। যখন প্রতিদ্বন্দ্বী করবে ঠিক করে নিয়েছ।আমার একটু অসুবিধা হবে এই যা। কাঁধ তো খালি রাখোনি। মাথায় তুলে রাখতে হবে এই আর কি।

— তাই বলি। জল তলে তলে অনেক দূর গড়িয়েচে। কোথায় রাখবে সে জায়গা আগাম ঠিক করে রেখেচ।

— সে তুমি যাই বলো। তোমার বিচারে ফাঁসিতে ঝুলতে রাজি। আসামীর শেষ ইচ্ছা এই কাল রাতটুকু তোমার সঙ্গে কাটাতে দাও। এতদিনের মধুর সম্পর্ক ভুল বোঝাবুঝিতে চিরদিনের মতো চূরমার হয়ে যেতে বসেছে। আমার কাছে তো মৃত্যুর সমান।

— না না। চরিত্তিরহীনের পাশে রাত কাটানোর হীনপবিত্তি মরে গেলেও হবেনে। আমার এক বাপে জন্ম দেচে জেনে রেকো।

— আচ্চা চরিত্রনামক বস্তুটা আজকের হারিয়েছি তোমার মনে হয়? তোমার দিকে তো আঙুল তুলতে পারব না। আসামীর কথা কেউ বিশ্বাস করবেই না।

— অতশত বুঝি না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এখেনে দম বন্ধ হয়ে আসতেচে।

— আমারও।

— কি বললে?

— বলছি একটা রাত বরং প্রাণ ভরে মুক্ত বাতাস নিতে পারব। মনটা শক্ত করতে হবে তো গীতার সেই বাণী আউড়ে। তারপর – – – সব শেষ।

বিমলা এক মুহূর্ত আর দাঁড়াল না। ও যা বলে বলুক। বাইরে এসে কপাটে শিকল তুলে দিল। যাতে পালাতে না পারে। দাবায় বসে রাত কাটালো। ফুলসজ্জার আসরে আর যায়নি। এয়েরা আসর শেষ করে নবদম্পতির নিশ্চিতে থাকার ব্যবস্থা করে যে যার মতো চলে গেছে।

সকালে যাবতীয় বাড়ির কাজ সেরেছে বিমলা। মাথার মধ্যে দুশ্চিন্তা। রাতে কতটা বিপদসীমা ছাপিয়ে নদীর জল বয়ে গেছে। গাঙধারিতে জলের দাগ দেখলে বোঝা যাবে। সেটাই লক্ষ্য রাখতে হবে। আগে নতুন বউয়ের খুড়তুতো বোনকে খুঁজে বের করি। কোথাও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সন্দেহ আরো ঘোরতর হয়ে উঠল। রাতে কিছু একটা ঘটেছে, মন বলছে।
অনেক রাখঢাক করে নতুন বৌকে কথাটা বলতে বাধ্য হলো। ওরা কী ভাববে। নতুন কুটুমবাড়ির কারো চরিত্রের ঠিক নি। লম্পট প্রকৃতির সবাই। অনেক শান্ত গলায় বলল, বউমা তোমার বোন কোতায়, দেখতে পাচ্চি না তো?

— সে তো বাড়ি গেছে, কেন?

— কিচু বলে যায়নে?

— হ্যাঁ বলে যাবে না কেন।

বিপলার সন্দেহের আর কিছুই নেই। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ছিঃ ছিঃ, কী করবে এখন। মনে হচ্ছে যেন পুরুষ মানুষটার গলা টিপে সাবাড় করে দিই। এসব তো মনের কথা। আগ্রহ ভরে জানতে চাইল, তা কিছু বলে গেচে?

— ও-ই তো, কলেজের কী কাগজ জমা দেওয়ার দিন ছিলো। তাই ভোর ভোর চলে গেছে।

— না বৌমা ও ঠিক কথা বলেনি। বড়ো মেয়ে। তাও আবার কলেজে পড়ে। অনেক বোঝে। তাই ব্যাপারটা চেপে গেছে। ওকে বল না রাতে কী হয়েছিল। আমার নাম করে বলো, ভয়ের কিচ্চুটি নেই।

নতুন বউ আবার ফোন করল, ওদিক থেকে উত্তর এলো, কি বলবি বল দিদি।

— দেখ ফোন কাটবি না। রাতে কী হয়েছিল খুলে বলত। বিমলাদিকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। বেশ ভেঙে পড়েছে মনে হচ্ছে।

— ও সব যা ভাবছে কিছুই নয়। দাদাবাবু অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে। কখন ফিরেছে আমিও জানি না।ভেবেছিলাম বিমলাদি শুয়ে আছে ছেলের পাশে। এক লেপের মধ্যে আমার গা ঘেঁষে দাদাবাবুও ঘুমিয়ে পড়েছে। কী মনে করে আমার ঘুম ভেঙে যায়। মুখে হাত দিয়ে আমার সন্দেহ হয়। কানে হাত দিয়ে দেখি কিছু নেই। এয়োতী মেয়েদের নাকে কানে একটু তো সোনা রুপো থাকবে। বুকে হাত দিয়ে দেখি লোভে ভরা। ভীষণ ভয় পেয়ে যাই। মশারি টান মেরে ছিঁড়ে নিচে লাফিয়ে পড়ি। বাপ বেটার মাঝে পড়ে বলির পাঁঠার হাড়িকাঠে আটকে পড়ার অবস্থা। উদ্ধারেল পথ খুঁজে ঘরের কোণে কাঁপতে থাকি।

তখন কি জানি মনে হয়েছে দাদাবাবুও ভীষণ ভাবে ভয়ের মধ্যে আছে। একবার মা বলে আর সাড়াশব্দ নেই। খাট থেকে সশব্দে লাফিয়ে পড়ি। মশারির দড়ি ছিঁড়ে সন্দেহর পরিস্থিতি তৈরি করার দায় অস্বীকার করতে পারব না। কেন ওখানে ঘুমুতে গেলুম তাই ভাবি। বিমলাদিকে বলে দিও, সতীন হওয়ার ভয় নেই। দাদাবাবু কোন প্রকার চরিত্র নাশের চেষ্টা করেনি। বলে দিও দাদাবাবু ভালো মানুষ। সুযোগ বুঝে একসময় ঘুরে আসব।

বাঘের পাশে বাস করা [Living next to tiger]

— ও বারিনদা, কোতায় এয়েচো?

— জমি দেখতে এসেছি। তুমিই তো দাদার নাম বারবার করো। এইতো সেই দাদা।

একটু কাছে এসে, একনজরে দেখে। তোমরা শহরের মানুষ। আর চেনার উপায় আচে। ভায়ের সাতে দেকা হলে বলি, বড়ভাই কেমন আচে। এলে, এদিকে এনো। বলি সোবাই ভালো আচো?

— হ্যাঁ,তা মোটামুটি আছি। আসলে শিবেন চিনতে পারেনি। সেই কবে ফোরে পড়ার সময় দেখেছে। এখন সেই চেনাটুকু স্মৃতিতে ফিকে হয়ে আছে। সৌজন্যের প্রয়োজনে শারীরিক ভাষায় একটা কিছু মিলিয়ে সম্পর্ক ধরে কথা চালিয়ে যাওয়া।

কথা হচ্ছিল নদীবাঁধে। ঢালাই করা রাস্তা। নদীর খোল পিটে আবাস যোজনায় পাওয়া ইটের তৈরি ঘর। পাশে বুনো কাঠের নড়বড়ে হেলে পড়া ঘরটি এখনো আছে। ওটাই এখন বৈঠকখানা। প্রাকৃতিক ক্ষয়ক্ষতি দেখাতে ধরে রাখা। সরকারি অনুদানের আশায়।

রাস্তা লাগোয়া ভাঙাচোরা বৈঠকে দুভাই গিয়ে বসে। নানা রকম কথা চলে। ইতিমধ্যে চা পানের কথা উঠলো। শিবেন না বলার পাত্র নয়। বারোটা বাজে তো কী হয়েছে। ভাই নাক কুঁচকে না বলল।
— আঁমাদের বাড়িতে খেলে বুজি জাত যাবে? মমিন গাজি বলেই ফেলল।

দাদা যদিও ভায়ের কথায় সায় দিয়েছিল। জাতের কথা শুনে শুধু চা কেন, টা’তেও আপত্তি নেই হাসতে হাসতে জানিয়ে দিল।

বাড়ির ভেতর থেকে গৃহকর্ত্রী ক্ষীণ গলায় জানালো চা নেই। বিস্কুট আনতে হবে।
শিবেন বলল, না না আর তা হলে আনতে হবেনা। ভাত খাবার বেলা হয়ে গেছে। গাড়িতে যেতে জোর দুমিনিট। বরং বসো দুটো গল্প করি। অনেক দিন পরে দেখা।

— না না তুমি থামো তো। এখুনি আনতিচি।এই তো পাশের বাড়িতে দোকান।
এই সুযোগে চারদিকে নজর বুলিয়ে নিল। বিশেষ করে নদীর বাঁধ বরাবর খোলপিটে ঘরবাড়ি বেঁধে বসবাস করছে। ঘরের পুবদিকে প্রবাহিত ঠাকুরান নদী। সেই নদীর জেগে ওঠা চরে ঘনবন, উত্তর থেকে দক্ষিণে।

এই শান্ত বনে দু’দুটো বাঘ ঘাপটি মরে আছে। দুটো কি একটি এমনটি লোকমুখে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যে আছে তার প্রমাণ মিলেছে নানা ভাবে। কোথাও পায়ের ছাপ। বুনো শোরের হাড়গোড়। মোহিষ শিকার করতে গিয়ে বিপত্তি ঘটে। লোক জানাজানি হয়। জখম মোষটি জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে।
এই লোকালয় ঘেঁষা শান্ত জঙ্গলে বাঘ ঢুকেছে। প্রথম বুঝতে পারে যারা প্রতিদিন জীবিকার টানে বনে আসে। মাছ,কাঁকড়া, জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ করা গরিব লোকেদে রুজি রোজগার। । মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে ভয়ংকর দুঃসংবাদ। যা আড্ডির জঙ্গল লাগোয়া গ্রামবাসীর পক্ষে জীবন মরণ সমস্যা।


শিবেন এখানে না থাকলেও এই দ্বীপের ভৌগোলিক অবস্থানের বিশেষ পরিবর্তন হয়নি বুঝতে অসুবিধা হয় না। রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে যেমন। জীবন জীবিকা অনেকাংশে বদলে গেছে। তবে একটা শ্রেণি জল জঙ্গলের সঙ্গে ছেদ ঘটায়নি হয়তো বাধ্য হয়ে এখনো থেকে গেছে। যেমন মমিনরা এখনো জলে জঙ্গলে পড়ে আছে।

ইতিমধ্যে চা নিয়ে এসেছে মমিনভাই। চায়ে চুমুক দিয়ে জানতে চাইল, তোমার এইযে নায়লন জালের এপার ছেলেপিলে নিয়ে বাস করছ ভয় করে না?

— ভয়ের কী আচে। বাঘ কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে তো বেঁচে আচি। কী একটা বাঘ ঘরের পাশে ঘোরাফেরা করতেচে তা কি হয়েচে। বরভাই এই নিয়ে আর ভাবিনা। তবে হ্যাঁ সাবদান থাকতে হয়। যে কোনো মুহুত্তে বিপদ ঝেঁইপে পড়তে পারে। যম থেকে বাঁচা যায়, বাগের থেকে নয়।

— সরকারি লোকজন তো নদীঘাটে নোঙর ফেলেছে। বড় লঞ্চ তো দেখলুম।
সে তো আমরাও কদিন থেকে দেখে আসচি। আমাদের বাঁচাতে এসেচে বলে তো মনে হয় না। কী ভাবে বাগ মানুষ শিকার করে, মজা দেখতে এয়চে।

— কেন এমন কথা বলছ?

— কেন বলবুনি, তুমি আমার বুইজে বলো। বাগ ধরতে এয়চে না সরকারি লোকেরা নদীতে বেড়াতে এয়েচে। ওরা তো নঞ্চের ওপর থেকে নামেনে বলতে গেলে। যেন পিকনিক করচে। শুনতে পাচ্চি কোতায় নাকি খাঁচা পাতা আচে। ভেতরে আস্ত ছাগল বাঁদা। ছাগল আচে নাকি নিজেরা খেয়ে ফেলেচে কে জানে বাবা। কতো দেখলুম।

— না না এটা ঠিক বলছ না। সবকিছুই তো একটা সময় লাগে। বাঘেরা নানাভাবে প্রশিক্ষিত হচ্ছে। দৈনন্দিন শিকারের অভিজ্ঞতা থেকে। বাঘেরা বিপদ ভেবে কেন খাঁচায় ঢুকবে যাবে।

— তা যা বলেচ। তবে আমার কী মনে হয় জানো। আমাদের জেগে ওঠা চড়ায় কোন গাছপালা ছিলনা। নতুন গাছ পোঁতার জন্য এই ঘনবন গজিয়ে উঠেছে। বন না থাকলে তো বাগ আসতো না। বন ছিলো দূরে। আসপাশের গ্রামের গরিব লোক দুটো পয়সার লোভে গাছ কাটাতে কাটাতে প্রায় ফাঁকা গেচিল মানচি। অনেক দূর পয্যন্ত দেখা যেতো। ভালোই ছিলো বলতে গেলে। সরকার থেকে গাছ বসিয়ে এই বিপদ ডেকে আনলো।

— তুমি বলছ এই বনসৃজন সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত।

— তাই নাতো কি?

— তা ঠিক বলেছ। জঙ্গল গড়ে না উঠলে আরো ঘরবাড়ি নদীর জেগে ওঠা চরে গড়ে উঠতো।

— আমি তো তাই বলচি। যে ভাবে মানুষ বাড়চে।

— যাক ওসব কথা। আচ্ছা, ষাঁড়া-ষাঁড়ির কোটালের সময় জল নদীবাঁধের কানায় কানায় উঠে আসে কি? আগের খারাপ অবস্থার কথা তো আমরা সবাই জানি। প্রতি বন্যায় ভেসে যেতো।

— আসে মানে। তখন যদি সামান্য ঝোড়ো বাতাস বয়তো পানি উপছে পড়বে। বাঁধে দাঁড়ানো যাবেনা। ভেঙে পয্যন্ত যেতে পারে।

— এইযে তোমার বাড়ি নদীর খোলপিঠে গড়ে উঠেছে।ঢেউয়ের উত্তালে তোমাদের জীবন যাত্রা দুর্বিসহ হয়ে ওঠে না?

— তবে জুয়ার বাড়লে কাছাকাছি আসে বটে, প্রবল ঢেউ খুব একটা কাবু করতে পারেনা। ঘন জঙ্গল গড়ে ওঠার জন্য। ঢেউ ভেঙে দেয়।

— তা হলে স্বীকার করছ তো মমিনদা। মাটির ক্ষয় রোধ করা। ঢেউয়ের গতি ভেঙে নদীবাঁধ বাঁচানো জন্য বনসৃজনের দরকার আছে। তুমি কি বলো?

— তা কিন্তু ঠিক।

— না, কিন্তুর কিছুই নেই। এবার বাঘ কেন লোকালয়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তার প্রকৃত কারণ খুঁজছে হবে। গ্রামে যদি খাদ্যের সংকট হয়। সারাবছর দিনখাটা মানুষের কাজ না থাকে। মানুষ না খেয়ে ভিটে কামড়ে পড়ে থাকবে। তাইতো শহরাঞ্চলে কাজের খোঁজে পাড়ি জমায়। বাঘের ক্ষেত্রেই তেমন ঘটেছে।

— কিচু বুজতে পারিনি। বাগ কি খাটতে যাবে।

— দেখো মমিনদা, জঙ্গল সম্পর্কে তোমরাই বেশি করে বোঝার কথা। আমরা তো খবরের কাগজে,পত্র পত্রিকায় পড়ে এসব জেনেছি। চোরাই কাঠ ব্যাবসায়ীরা লোভের বশে বনজঙ্গল কেটে দিনকে দিন ফাঁকা করে দিচ্ছে। হোটেল ব্যাবসায়ীরা জঙ্গল কেটে ইন্দ্রপুরী বানাচ্ছে। ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য। ফলে বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র ছোট হয়ে যাচ্ছে। আগেই তো আমরা বন সাফ করে লোকালয় গড়েছি। এখনো থামতে চাইছি না। একুশ শতকে এসেও।

বাঘের খাদ্য হরিণ। হরিণের পাশ রাজ্য সরকার থেকে দেয়না। চোরাই ভাবে হরিণে মাংস শহরে গ্রামে ঢোকে। অনেকটা ঘুষের মতো নিঃশব্দ ব্যাবসা চলে আসছে। চায়ের দোকান হরিণ মাংসে গুনাগুন নিয়ে কথা ওঠে। কেউ চোখে দেখিনা। সেই সৌভাগ্য আমার হয়নি বলবনা। বন ছোট হচ্ছে, হরিণ কমে যাচ্ছে। মাংসাসি বাঘ কি ঘাস খেতে বাঁচবে? লোকালয়ে ঢুকে, তাড়া খেয়ে, খেঁজুর গাছে তালগাছে প্রাণ ভয়ে উঠে বাঁচতে চেষ্টা করবে নাতো কি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মৃত্যু বরণ করবে। জালের ওপাশে তোমাদের আশপাশের দৃষ্টির আড়ালে যে অদৃশ্য বাঘটি ঘোরাফেরা করছে। মূল্য সুন্দরবন থেকে তো এসেছে। নদীতে ভেসে। খাদ্যের সন্ধানে!

— তা মন্দ বলুনি।

— এবার তা হলে যাই, অনেক কথা হলো। দেখি বৈকেলে আসতে পারি কি না। ভয়ংকর সুন্দর ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’টি খাঁচা বন্দি হলে কেমন অবস্থা হয়। এমন দুর্লভ দৃশ্য দেখার লোভ ছাড়ি কি করে। মমিনভাই আসি তা হলে?

— থেকে গেলে হ’তো। ওবলা আবার আসবে যখন কষ্ট করে গেলে কি নয়।

— হ্যাঁ হ্যাঁ থাকি আর কি। তোমরা তো বাঘের সাথে একপ্রকার এক সাথে বাস করছ। সখ্যতা গড়ে উঠেছে। দেখা হলে নিশ্চিত বলে বসবে। দু’ভাইকে ছাড়লে কেন। আমাদেরও দুটো দুঃখের কথা বলে হালকা হতুম। কাউকেই ওনাদের মতো এতো সুন্দর করে বুঝিয়ে বলতে শুনিনি। থাকলে আমাদের ভালো লাগত।

— শিবেনদা কী যে বলো না। এমন হয় নাকি।

— তা হয়তো হয় না। ভাবতে তো পারি।

— শুনিচি তুমি নাকি লেখালেখিতেই নাম করেছ। এখোন তাই মনে হয়।

– তুমিই তো বললে। ছাগল বাঘধরা খাঁচায় দিয়েছে,এই নিয়ে তোমার সন্দেহ। বাঘ আমাদের দেখলে কি ছেড়ে দেবে?

উভয়ের কথোপকথনের মধ্যে বাস্তবের সুন্দর মুহূর্ত ধরা রইল। বৈকালিক সাক্ষাৎ আর উভয়ের মধ্যে হয়নি। বাঘ নিয়ে অধিক কৌতূহল সাহস দেখানো আদৌ নিরাপদ নয়। বরদানগর গ্রাম থেকে পুবে মুসলমান পাড়া। নদীর পাড়ে যারা বাস করছে এই পাড়া থেকে উঠে যাওয়া মানুষজন। আড্ডাির জঙ্গলে ওদেরই রাজ চলছে।

সন্ধ্যা পার হতেই ভীষণ চেঁচামেচি ভেসে আসছে। বাঘটি কি ধরা পড়ল। না কি লোকালয়ের দিকে ঢুকে পড়েছে। বাইরে বের হওয়া কিছুতেই নিরাপদ নয়। কোথায় ঘাপটি মেরে আছে। আচ্ছা মমিনভাইদের কোনো বিপদ হয়নি তো। এইতো সামান্য জালের এপার-ওপার যেম মানুষের দূরত্ব। বুঝিনে এর কী নিশ্চয়তা আছে। যাই হোক সকালে দেখা যাবে। সেই অপেক্ষায় রইলাম।

রুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় এবং জীবনযাপন [ভ্রমণ কাহিনী]

২৮শে, ডিসেম্বর। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে বেড়াতে চলেছি। প্রথমের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের বছরের তফাৎ প্রায় দশ বছর। প্রথমবারে গিয়েছি লাক্সারি বাসে। এবারে চলেছি ডাক্তারবাবুর দুটো ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে। হঠাৎ ডাক্তারবাবুর শারীরিক অসুস্থতার কারণে আমাদের সঙ্গে আর যাওয়া হলো না। দুই চালক নিয়ে এগারো জনের দল। ডাক্তারবাবুর স্ত্রী, দুই মেয়ে। বড়দি। মাষ্টারদা, দুই শ্যালক। আমাকে না ধরলে হিসেবে মিলবে না।

সকাল সাতটায় বিজয়গঞ্জ থেকে গাড়ি ছাড়ল। বিদ্যাসাগর সেতু পেরিয়ে, বর্ধমানের মধ্যে দিয়, বাঁকুড়া পার হয়ে পুরুলিয়ায় প্রবেশ করলাম। সাড়ে ছটায়, অযোধ্যা পাহাড়ের অনতি দূরে আমাদের আবাসিক দিশা হোম স্টে (Disha Home Stay)। চারটি কক্ষ নির্ধারিত ছিলো, পাঁচ দিনের জন্য। আগামী সকাল থেকে দর্শনীয় স্থান দেখতে বেরিয়ে পড়ব। রাতটুকু যা কাটানোর অপেক্ষায়।

২৯শে, ডিসেম্বর। হালকা কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। সবাই উঠে ঘরবার করছি। আবাসিকের মালিক প্রাক্তন শিক্ষক। অমায়িক মানুষ। আমরা কেউ মাহাতবাবু বলছি না। দিদি মাষ্টামশাই বলছে। কারণ এই ঘর পাওয়ার জন্য কথা বলেছ বিধুভূষণ লোহার। দিদির স্কুলে দেড় বছর শিক্ষকতা করেছে এখন পুলিশের চাকরি করে। বিধুভূষণের শিক্ষক, সেইসুত্রে দিদিরও মাষ্টার। যেন আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছে কদিনের জন্য বেড়িয়ে যেতে। গরম গরম টিফিন, চা হাতে হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। খেয়ে বেরিয়ে পড়ব।

মাষ্টামশাই আজকের দিনের মতো ভ্রমণসূচি হাতে ধরিয়ে দিলো। তবে আমাদের মধ্যে বিকল্প চিন্তাভাবনা করার মতো মাথার ঘাটতি ছিলনা। প্রথম বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ড্যামে যাওয়ার চিন্তা স্থির হলো। আমি আগে এসেছি তবে স্মৃতিতে ধোঁয়াশা লাগছে। চেনা পথ অচেনা হয়ে উঠেছে। পাহাড়ি পথ দস্তুর মতো সংস্কার করা হয়েছে চোখে পড়ছে। ভালো লাগছে মানতেই হবে। গাড়ি ক্রমাগত অযোধ্যা পাহাড়ের ঢালের পথ বেয়ে, উপরের দিকে নানা বাঁক নিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমাদের গাড়ি আকারে বড়ো। চালক চিন্তায় পরিণত। অসুবিধা হলে চলভাষে কথা বলে নিচ্ছে। গুগল ম্যাপে পথনির্দেশ লক্ষ্য করছে। নতুন জায়গায় অতি বোদ্ধা হওয়ার কোনো মানে নেই। অথচ আমাদের সামনের ছোট গাড়িটি, পেছনের তোয়াক্কা করছে না। ওখানে একাধিক মাথা কাজ করছে কিন্তু মোড়ের তিনমাথার গুরুত্ব দিতে হবে তো। একটাতেই গেলে যাওয়া যাবে। আমরা কোথায় যেতে চাই? আমাদের প্রথম এগিয়ে যাওয়া গাড়ির সেটাই জানের কথা।

চালক যখন স্থানীয় মানুষজনের কাছে জানতে চাইছে, সন্দেহ দূর করার জন্য। তখন ভুল পথে অনেকটা এগিয়ে গেছে। আবার আমাদের পিছিয়ে আসার তাড়া পড়ে যায়। অনেকটা সরু পথে গাড়ি ঘোরাতে হয়। তবে নির্ভুল পথে ভ্রমণের মজা থাকেনা ভালোই লাগছে এক কথায়। আমাদের প্রথম এগিয়ে যাওয়া গাড়ি ড্যাম বা বাঁধে উঠেই দাঁড়িয়ে গেছে। সৌর-বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টাওয়ারের মতো দুটি ঘর। পাশাপাশি জলের ওপর একপায়ে দাঁড়িয়ে। আর জলের ওর পদ্মপাতার মতো ভাসছে সোলার সিস্টেম। আমাদের গাড়ি দুটি মাঝ বরাবর আবার গিয়ে দাঁড়ালো। চতুর্দিকে পাহাড় সংলগ্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। বাঁধের শেষপ্রান্তে খাড়াই পাহাড় বাঁয়ে রেখে পাহাড়ি পথ ধরে এগিয়ে চললাম। কিছু দূর যাওয়ার পরে ডানদিকের পথে না গিয়ে,বাঁহাতি ধরে এগিয়ে চলেছি।

আমাদের গাড়ি থেমে গেল। সামনের গাড়ি থেমে থাকার জন্য। বুঝতে পারছিলাম না, এখন কী বা দেখার আছে। গাড়ি থেকে নেমে যতই এগিয়ে চলেছি, প্রশস্ত রাস্তা ক্রমশ একগলি পথে বদলে যাচ্ছে। দুদিকে সাজানো দোকানপাট। হাতের সৌখিন কাজ দিয়ে ভরিয়ে তুলেছে। কাঠপালা দিয়ে অস্থায়ী দোকানঘর। দুইদিকের দোকানের মধ্যবর্তী জায়গা ছোট ছোট পাতা সমেত ডাল এমন ভাবে সাজিয়েছে যেন ঝালরের মতো ঝুলছে। ওই পাতা ফুঁড়ে রোদের তাপ বা কুয়াশা নিচে নামছে না। বেশ আরামদায়ক পরিবেশ। এই আলো আঁধারিতে আমাদের মোট সদস্যের আংশিক এগিয়ে চলেছি। বাকিরা গাড়ির আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে। শারীরিক সমস্যার জন্য পাহাড়ি পাথুরে খাঁজ ভেঙে ওঠানামার ঝুঁকি নিতে চাইছে না। আমি তো বয়স ভুলে গেছি। বড়মেয়ের উৎসাহকে উৎসাহিত করতে পিছপা নই। প্রতিবারের মতো আমি ও বড়মেয়ে এগিয়ে গেলেও তৃতীয় কাউকে সর্বদা সফরসঙ্গী করি। যেমন ঝাড়খণ্ডে ডাক্তার বাবুকে সঙ্গে নিয়েছি। এবার বর্মন বাবুকে দোষর করেছি। তার একটাই কারণ যেমন পাহাড়ি পথে বিপদের ঝুঁকি আছে তেমন অচেনা মানুষের দ্বারা ভয় আছে। তৃতীয়ব্যক্তি বাড়তি সাহস।

যখন দোকানপাঠ ছাড়িয়ে অনেকটা নিচে নেমে এলাম। এখনে তো এসেছিলাম। নামটা এবার মুখস্থ করে নিলাম, ‘মার্বেলার লেক’ (Marbelar lack)। মেয়েকে বললাম এই খাড়াই পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে আমরা কয়েকজন ছবি তুলে ছিলাম। চারিদিকে ঘেরা পাহাড়ের মাঝে স্বচ্ছ জলে ভরে আছে। এসেছিলাম গরমের সময়। জল তলায় পড়ে ছিল। মাঝখানে বেশ কিছু পাথরখণ্ড মাথা তুলে, এখন তারা ডুবে আছে। বড়মেয়ে অর্থাৎ ডাক্তারবাবুর জ্যৈষ্ঠকন্যা ঈশানী। বয়স বড়জোর দশ-বারো হবে। তার তো দেখার কৌতূহল হবেই। সে তো এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী খুঁজবে। আবার বয়সের তুলনায় আমার মন,যে অচেনা অজানার আনন্দে এগিয়ে। মেয়ে তা বুঝে গেছে। আমরা ত্রয়ীতে বিপদজনক জেনেও মার্বেলার লেকের,খাড়াই পাহাড়ের ১গাঁঘেঁষা মসৃণ পথে ধীর গতিতে এগিয়ে চললাম। লেকের অর্ধেক গোলার্ধে গিয়ে কিছুটা প্রশস্ত জায়গা পেলাম। এখানে যে দাঁড়ানো যায়,ওপার থেকে বোঝর উপায় ছিল না।

মার্বেলার লেক পেছনে রেখে সামনে তাকালাম। দেখলাম ঢাল বেয়ে ওপরে ওঠা যায়। কৌতূহল বেড়ে গেল, ওখানে কী আছে দেখার। মেয়েকে এখানে রেখে আমি ও বর্মনবাবু ওপরে উঠে গেলাম। আরে এখানে সবুজ গাছগাছালি ভরে আছে। পাতার ফাঁক দিয়ে সামনে দূরের পাহাড় দেখা যাচ্ছে। বেশ মজা লাগছে। এখন আমাদের মতো খুব যে দর্শনার্থীরা আসে মনে হলো না। মিনিট দশেক কাটিয়ে মেয়ের কাছে চলে এলাম। আবার তিনজনে লেকের অর্ধগোলার্ধ অতিক্রমের সাহস নিয়ে এগিয়ে চললাম। একজায়গায় এতটাই মসৃণ ও সরু পথ মনে হলো এই বুঝি পড়ে যাবো। মেয়েকে হাত ধরে পার করে নিলাম। আমাদের মার্বেলার লেক প্রদক্ষিণের মনস্কামনা পরিপূর্ণ হলো। কিছু কেনার জন্য সময় বাঁচাতে পারিনি, পাছে মাস্টারদার রোষের স্বীকার হওয়ার ভয়ে। মাষ্টারদা মেয়ের ছায়াসঙ্গী হয়ে যেতে চেয়েছিল। পথের অবস্থা দেখে পা বাড়াতে সাহস দেখায়নি।

যাওয়ার পথে বামনী ঝর্ণা (Bamni Falls) ভিড়ের জন্য এড়িয়ে গেছি। একই পথে ফেরার সময় সবাই দেখে যাবো ভেবেছি। সরু পথে সারবদ্ধ এতো গাড়ি, কোথায় রাখি কোথায় রাখি করতে করতে আমাদের দুটো গাড়ি অনেকটা দূর এগিয়ে গেছে। ঝর্ণা দেখার ইচ্ছা ত্যাগ করে সমতলে নেমে এলাম। বাইরের হোটেলে খেয়ে, আবসিকে দুপুরের ঘুম সারলাম। ঘুম ভাঙার পরে মুখে মুখে শুনতে পেলাম আজ সন্ধ্যায় আমাদের আবাসিকের সামনের প্রশস্ত খোলা জায়গায় “ছৌনৃত্য” হবে। পুরুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী নাচ। এই নৃত্যের খরচ বহন করবে কোন এক স্কুল থেকে আসা ভ্রমণপিপাষুর দল। ছৌনাচের জন্য অনেকটা জায়গা লাগে। এনেছে ম্যাটাডোর ভরে মুখোশ। কারুকার্য খোচিয় পোষাক। বিরাট আকারের চালচিত্র। দলে কোনো মহিলা নেই। বলতে গেলে মহিলার কোনো প্রয়োজন নেই। সারা শরীর পোষাক আর মুখোশে আবৃত থাকে। দেখলাম যে ভাবে লম্ফঝম্ফ দিয়ে পড়ে মহিলার পক্ষে কষ্টদায়ক।

আবাসিকের দিক থেকে দেখতে পাচ্ছি। ওদিকে ছৌদলের সাজা শেষ। বাদ্যকারেরা গুছিয়ে বসেছে। ধামসা মাদল, ক্যাসিও নিয়ে বসে গেছে। মাইকে ঘোষিত হলো, আজ পালাগান হবে “আদ্যাশক্তি মহামায়া”। এতো বড়ো ফাঁকা জায়গা লড়াইয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠলো। বিকট আওয়াজে যুদ্ধের দামামা বেজে চলেছে। ভাষ্যকার বা পালা যিনি বসে বসে পরিচালনা করছে, তার গলা দিয়ে প্রতিটি শব্দ যেন হুঙ্কার দিয়ে বেরিয়ে আসছে। সবটা না বুঝলেও নৃত্যের মাধ্যমে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। বড়ো বড়ো মুখোশ পরে প্রশিক্ষিত কৌশলে মাটিতে পড়ে, পাক খেয়ে অবলীলায় উঠে পড়ছে। চোখে না দেখলে বুঝিয়ে বলা কঠিন।বেশ উপভোগ করলাম। একঘণ্টার মতো ছৌনৃত্য চলল। শুনলাম আরো কয়েক জায়গায় পালাগান করতে হবে। আমরাও রাতের খাবার খেয়ে, যে যার ঘরে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে শুশুখাস গ্রামে যেতে হবে। দিদির সহ শিক্ষক, এক স্কুলে বেশ কিছুদিন শিক্ষকতা করে গেছেন। কথা দিয়েছিল, বেড়াতে এলে ঘুরে যাবে।

৩০শে ডিসেম্বর। সকালে উঠে তো কোনো গৃহস্থের বাড়িতে যাওয়া যায় না। ঠিক হলো খয়রাবেরা ড্যাম (Khairabera Dam) দেখে ওখান থেকে শুশুখাস গ্রামের দিকে রওনা দেবো। আমরা অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে ছিলাম। এই পাহাড়ে ওঠার প্রধান পথ। ওপথে গেলাম না। আমরা সামনের তেমাথা দিয়ে আমাদের লজে এসেছি। আরেকটি পথ মাঘমুণ্ডির দিকে গেছে। ওই পথে গাড়ি ছুটে চলল। একই পথে মুখোশ পাড়া পড়বে। ছৌনাচের মুখোশ ওখানেই কিনতে পাওয়া যায়। প্রচুর দোকান। ভ্রমণার্থীরে বাড়ি সাজানোর বিভিন্ন মাপের মুখোশ কিনে নিয়ে যায়। আমাদের চলার পথে পড়বে।

দেখতে পেলাম সামনের গাড়ি ডানদিকে বেঁকে সরু রাস্তার মধ্যে ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছে। দুইপাশে বাগান সংলগ্ন বাড়ি। কেঁটকি মুরগি ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামের মধ্যে ঢুকতে চলেছি নিশ্চিত হলাম। বেশ কিছুটা যাওয়া পরে মনে হলো ভূগর্ভস্থ পথে ঢুকে পড়েছি। দুদিকে অনেকটা করে উঁচু রাঙা মাটির দেয়াল। সম্ভবত ঢিপি কেটে গ্রামের মানুষের চলাচলের জন্য সোজাসুজি পথ বের করেছে। মাথার ওপর বিভিন্ন গাছের ঘন আচ্ছাদন। দিনের আলো যেন চেলুনির মধ্য দিয়ে তালেব নোদের মতো গলে পড়ছে। আলো আঁধারি পথ ধরে দেখতে দেখতে বেশ যাচ্ছিলাম। গ্রামের উদম জলে এই গলিপথে জমে না যায় তার জন্য পাশে পাকা ড্রেন দেখতে পেলাম। নিশ্চিত পঞ্চায়েতের অবদান। বেশ ভালো ব্যবস্থা।

দেখলাম আগের গাড়ি অদূরে দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের ড্রাইভার বিপ্রবাবু চলতি এক গ্রামের বয়সী মহিলার থেকে জেনেছে, ভুল পথে ঢুকে পড়েছি। শুশুখাস গ্রাম ওই নামে এদিকে কোনো গ্রাম নেই। সামনের গাড়ি সহজে ঘুরিয়ে নেছে। আমাদের গাড়ি বেশ লম্বা। পেছনে অনেকটা পিছিয়ে,এক গৃহস্থের নিকানো উঠানে গাড়ি ঘোরাতে হলো। এখন মূল রাস্তায় উঠে আগের মতো গাড়ি এগিয়ে চলল। কিছু দূর যাওয়ার পরে ডানদিক ঘুরে, সরু রাস্তা ধরে খয়রাবেরা ড্যামের দিকে চললাম। পথের ধারে বরাবর জলনিকাসিতে বহমান জল। জানিনা কোথায় থেকে আসছে। জলে হাত দিয়ে দেখলাম ভীষণ ঠান্ডা। এই সামান্য জলে চড়ুই পাখির মতো গ্রামের গৃহবধূরা স্নান করছে চোখে পড়ল। দুইপাশে গাছপালা আর ফসলের মাঠ দেখতে দেখতে খয়রাবেরা ড্যামে পৌঁছলাম। প্রথমের দিকে আমরা গিয়েছি। আমাদের মতো গুটিকয়েক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখন সারাদিন পড়ে আছে। কতো গাড়ি, লোকজন আসবে যাবে তার হিসাব নেই।

খয়রাবেরা ড্যাম বিশাল আকারের। চারিদিকে পাহাড় ঘিরে আছে। কাকচক্ষুর মতো জল। যেন কোনো পাত্রে টলমল করছে। আমাদের ছোট মেয়ে কৌশানী তলোয়ার কিনে, সে বিড়বিড় করতে করত সমানে ঘুরিয়ে চলেছে। তলোয়ারের প্রতিটি কোপ খয়রাবেরার দিকে তাক করে। তবে কী খয়রাবেরার জলাধিপতিকে জয় করে ফিরতে চায়। আমরা তাকে সেই সময়টুকু না দিয়ে, তাকে গাড়িতে তুলে নিলাম। কিছুক্ষণ কাটিয়ে, টুকিটাকি খেয়ে গন্তব্যে এগিয়ে চললাম। যাবো আদিবাসী শুশুখাস গ্রামে। আদিবাসী শব্দ কানে এলে তুলনামূলক ভাবে নিজেদের নিয় গর্ববোধ করি। সভ্য আধুনিক প্রাণী হিসাবে। যদি শব্দগত অর্থ ব্যাখ্যা করি আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াই। আদিবাসী মানে মূল এখানকার বসবাসকারী। আমরা তবে কোথায় থেকে ভেসে এসেছি কিংবা উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। এসব কথা থাক এখন, কোন দিকে চলেছি সেটাই দেখি।

এবার প্রশস্ত পিচের ঢালাই রাস্তা থেকে বাঁহাতি পথে ঘুরে গেল। সরু রাস্তা ধরে জিজ্ঞেস করতে করতে, অনেকগুলো বাঁক ঘুরে বিধুভূষণ লোহার ভবনে পৌঁছালাম। নতুন পাকা বাড়ি। যাবতীয় আধুনিক চিন্তাভাবনায় সাজানো গোছানো। সামনের সদর কপাট দিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকলাম।দিদির কলিগ বিধুভূষণ লোহার। পরিবারের সবার সঙ্গে যতই আন্তরিকতা দেখালেও বিধুপত্নীর সঙ্গে একাত্মা হওয়ার মানে বিধুবাবুর খুশী করা। বাধুভূষণ বাড়িতে নেই। পুলিশের চাকরির সুবাদে অনেকটা দূরে আছে। বেশ কয়েকবার ফোনালাপ সেরেছে। আতিথেয়তায় কোনো প্রকার ঘাটতি হচ্ছে না আন্তরিকতার সঙ্গে জানিয়েছেন।

বিশেষ করে বিধুবাবুর বড়দা চিত্তরঞ্জন লোহার, তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক বেশ জমে উঠেছিল। ভীষণ সাদাসিধে মানুষ, সহজে তাঁর সঙ্গে মিশে যাওয়া যায়, কার্যত গেলামও। পরস্পরের আপনজন হয়ে উঠলাম। একান্নবর্তী পরিবারের আমরাও সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে তুললাম। বাড়ির প্রতিটি সদস্যদের শারীরিক ভাষায় বুঝলাম, আমাদের বাড়তি ভার ষাঁড়ের সিং-এ মশা বসার মতই তাঁদের কাছে মনে হলো।

কথাবার্তায় উঠে এলো বাবা মায়ের কথা। মা বাড়িতে। বাবা বাগান বাড়িতে। চিত্তরঞ্জনবাবুর আগ্রহে বিশাল বাগান দেখতে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। একটু দূরে বলে গাড়ি নিয়ে গেলাম। কারণ খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়তে হবে। দুদিকে সবজির বাগান দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। বড়ো বড়ো গাছে জঙ্গলে পরিণত হয়ে। বাঁশ কাঠ দিয়ে ঘেরা। বাগানে ঢুকেই পাথুরে শরীরের যে মানুষটিকে দেখলাম তিনি হলেন চিত্তবাবুর বাবা। আমি পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলাম। তিনিও আবেগ আপ্লুত। কী বলবেন বুঝেই উঠতে পারছেন না। বাগানে লালমাটির চালহীন ভগ্ন দেওয়াল দেখলাম। আগে এই বাগান বাড়িতে থাকতেন। এখন আর কেউ থাকেনা। এই বাগানবাড়ি কেউ অনিষ্ট করতে পারবেনা। কারণ এখানে দুই দেবতা আছে। আমি কৌতূহলবশত জানতে চাইলাম, দেবতাকে আমরা দেখতে পারি। চিত্তবাবু দুটি পাথরখণ্ড মাটিতে পোঁতা অবস্থায় দেখালেন।প্রথমটি “বজ্ঞাবুরু”, সম্ভবত বনদেবতা। দ্বিতীয়টি “বাহুতঠাকুর”, বাস্তদেবতা হবেন। বেশ কিছুক্ষণ বাগানে কাটিয়ে চিত্তরঞ্জনদার বাড়িতে ফিরলাম।

বিরল যে বস্তুটিতে পরিচিতি ঘটল তা হলো “একান্নবর্তী পরিবার। বিধুভূষণ একাই সরকারি চাকুরে। মা বাবা দাদা বৌদি তাদের প্রত্যন্ত গ্রামে ফেলে চলে যায়নি। পতিব্রতা স্ত্রী দায়িত্ব এড়িয়ে স্বামীর কাছে থাকার বায়না করেনি। নিজের ছেলে মেয়ে একসঙ্গে খোলা মনে বেড়ে উঠছে। এমন পরিবার দেখার বস্তুই বটে। দিদির থেকে জানলাম বিধুভূষণের স্ত্রী আমাদের জেলার মেয়ে। এতো উদার, কর্তব্যবোধ নিজের মধ্যে কী করে লালন করছে। তবে কি পুরুলিয়ার মাটির গুণে এমন সম্ভব হয়েছে! একান্নবর্তী পরিবারের কথা তো আমরা ভুলেই গেছি।

আমরা লোহার পরিবারে ভূরিভোজ সেরে, বড়দার (চিত্তরঞ্জন) বাগানের শাকসবজি একগাদা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। নিস্পলক চোখে সবাই অনিচ্ছায় বিদায় জানালো। আমরাও আর,কাচের মধ্যে থেকে অলক্ষ্যে হাত নাড়ালাম না। মনের কষ্ট নিয়ে শুশুখাস গ্রাম ছাড়লাম। ফিরতি মাঘমুণ্ডি ব্লকের চরিদা গ্রামের পথে “মুখোশ গ্রাম” পড়ে। চলতি পথে ছৌনাচের মুখোশর সারিবদ্ধ দোকান। সরাসরি মুখোশ তৈরি করছে দেখতে পাচ্ছি। ঘর সাজানোর মতো মুখোশ অসংখ্য সাজিয়ে রাখা আছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনি মনে হবে। তবে আমি মুখোশ কিনতে পারিনি দামের জন্য। তবে আমার যা মনে হয়েছে, তৈরি খরচ খরিদার দেয় বলে মন হয়না। শিল্পীরা চিরকাল বঞ্চিত হয়,নতুন কথা কি। আমাদের মধ্যে কেনার চেয়ে দেখার আনন্দে বিভোর ছিলো। এখন যাইহোক সন্ধ্যার আগে আবাসিকে ফিরতে হবে। বেরিয়ে পড়লাম পথে। অদূরে অযোধ্যা পাহাড়ের গায়ে বিজলিবাতি আলোয় ঝলমল করছে। যেন স্বর্গরাজ্যের কোনো এক জায়গায় ক্ষণিকের অতিথি হয়ে বাস করছি।

৩১শে ডিসেম্বর। ভ্রমণের শেষ দিন।পয়লা জানুয়ারিতে ফিরতে হবে। গাড়িতে উঠে গেলাম। কয়েকটি পথের বাঁক ঘুরিয়ে অযোধ্যা পাহাড়ের প্রধান খাড়াই ঢুলু পথ দিয়ে গাড়ি উঠতে লাগল। প্রথমে কিছুটা পথ পাহাড়ের পাদদেশের কাছাকাছি। পায়ের অবস্থা আর কেমন হবে। ছড়িয়ে থাকা পাথরখণ্ড ধুলোয় মাখামাখি। ওইটুকু উঠে গেলে ঝকঝকে সুন্দর পথ দেখে চোখ জুড়িয়ে যাবে। আগের তুলনায় অনেক পথঘাটের কাজ হয়েছে। ইতিমধ্যে গাড়ি বেশ কিছুটা ওপরে ওঠার পর বাঁদিকে সরু পথে ঘুরে গেল। এখন আমরা চলেছি শিব মন্দির দর্শনে। প্রাচীন মন্দির। যা আগে দেখা হয়নি। দেবতার স্থান ঘুরে ঘুরে দেখলাম। প্রচুর গাছে আচ্ছাদিত ধর্মীয় স্থানটি। দেখলাম দুটি “যুপকাষ্ঠ” কালশিটে রক্তের দাগ বোঝা যাচ্ছে। আমি দেখলাম বটে, মাস্টারদার মনে হলো এখানে কী মতে ‘বলি’ দেওয়া হয়? শিব তো বৈষ্ণব। দোকানিদের থেকে জানলাম বিষয়টা। যারা মানসিক করে তারাই দেয়। এমনিতে বলির নিয়ম এখানে নেই। গোলমেলে উত্তর, তবে দোকানিদের এ ব্যাপারে কোনো হাত নেই। তবে কি বলতে চাইছে ভোলানাথ খায়না তো কি হয়েছে। নন্দী-ভৃঙ্গীদের তো খেতে বাধা নেই। ধর্মের নামে নির্মম প্রথা, এখনো যটুকু আছে না থাকলেই ভালো। মন খারাপ নিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম।

এই নিয়ে দ্বিতীয়বার বামনী ফলস না দেখে ( Bamni Falls) পেরিয়ে গেলাম। তবে আমি ঝর্ণাটি দিব্যচক্ষুতে দেখতে পাচ্ছি। জানিনা দুর্গম পথের কতটা সংস্কার হয়েছে। অনেকের শারীরিক অসুস্থতার জন্য পাহাড়ের ঢালে ঝর্ণা দেখতে যেতে রাজি নয়। আমি জানি বিপদজনক পথ। এগিয়ে চললাম মুরগুমা ড্যাম (Murguma Dam) বা বাঁধ দেখার জন্য। অযোধ্যা পাহাড়ে ওঠার আগে, ওপরে তাকিয়ে মনে হবেই ওখানে কোনো বসবাসকারী মানুষজন নেই। যে মানুষকে দেখব তা আমরাই। তা নয়, বাগান-বাড়ি, হাটবাজার, বাসস্থান, দেবালয় কোনকিছুর অভাববোধ হবে না। তবে উপরিভাগ সমতল হবেই বা কেন। লালমাটির, নানান রঙ করা ঘরের দেওয়াল বেশ ভালো লাগছে। দেখতে দেখতে লোকালয় ছাড়িয়ে গেলাম। ঘন ঘাসে অবরুদ্ধ পথের মধ্যে চলেছি। মনে হলো এখানে কেউ মেরে গুম করে দেয় বুঝতে পারা যাবে না। যা ভাবছি সেটাই বুঝি ঘটতে চলেছে। আমাদের সামনের গাড়ি কয়েকজন কালো লোক ঘিরে ধরেছে। আবার ছেড়েও দিলো দেখলুম। নিরাপদ বুঝে অত লোকের মাঝখান দিয়ে বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে গেলাম। পরে জানলাম ঘাসের দাম কেটে পরিষ্কারক করছে, আবদার করে কিছু পয়সাকড়ি চাইছিল। জুলুমের কিছু ছিলো না।

জঙ্গল পার হয়ে আবার লোকালয়ে ঢুকলাম। যত্রতত্র বাঁশ ফেলে পথ আটকে, সরস্বতী পূজার চাঁদা তুলছে ছোট ছোট ছেলেরা। স্কুল চোখে পড়ল চলার পথে। শিক্ষার আলো সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে চায়, ভালো লাগল। এখন আমাদের দুটো গাড়ি উঁচু বাঁধের ওপর দিয়ে চলেছে। কিছু দূরে গিয়ে গাড়ি দাঁড়ালো। এই বাঁধ হলো ‘মুরগুমা’। দেখতে লাগলাম দূরে দূরে পাহাড় বেষ্টিত বিশাল আকারের জলাধার। বাঁধের নিচে গাড়ি যাওয়ার পথ। পাশে ঘন ঘরবাড়ি। বসবাসের লাগোয়া শাকসবজি চাষ চোখে পড়ার মতো। আমাদের গাড়ি আরও এগিয়ে গিয়ে বাঁক নিয়ে নিচে নামতে হলো। গাড়ি এগিয়ে চলেছে। পথের পাশে বৈদ্যুতিক পাখা চালিয়ে ধান সারাই করছে। আমাদের গাড়ি এখন আবাসিকে ফেরার পথে।

আর গভীর গাছপালা, ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে গেলাম না। স্থানীয়দের থেকে জেনে মাঝামাঝি পথ ধরে নিচে নামতে চাইলাম। এখনকার পরিভাষায়’বাইপাস’। তাড়াতাড়ি ফেরার তাড়া। প্রশস্ত ঢালাই পথে শুরুটা বেশ হলো। পরে এই পথ পূর্বের অবস্থায় পেলাম না। আমাদের অযোধ্যা পাহাড় ভ্রমণের বাঁধাছক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি। পাহাড়ের উপরিভাগ সমতল ভাবাটাই হবে ভুল। ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘরবাড়ি দেখতে পাচ্ছি। ঢেউ খেলানো সরু পথ এঁকেবেঁকে কোথা থেকে কোথায় চলে গেছে।

দেখা আর ভাবার মধ্যে ডুবে ছিলাম। ইতিমধ্যে আমাদের গাড়ি দীর্ঘ এক ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেছে। দুদিকে যতদূর দৃষ্টি যায় তাকিয়ে দেখলাম। অনেক নিচ দিয়ে জল বইছে। বড় বড় পাথরখণ্ড ছড়িয়ে আছে। গ্রামের কোনো এক গূহবধূকে কিছু কাচতে দেখা যাচ্ছে। কেউ স্নান করছে। মরা নদীর ওপরে যতটা না, তার চেয়ে বেশি দূর সামনে। সবকিছু ছবির মতই দেখাচ্ছে। গাড়ি চলতে শুরু করল। ব্রিজ থেকে অনেকটা ঢালে ধীরে ধীরে নেমে গেল। পাহাড়ি বন্ধুর পথে, গাছগাছালি মধ্যে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল। এখন মানুষ ঘন ভাবে বসবাস করছে। গাড়ি এখন অযোধ্যা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামছে। বিপরীত পথে এসে মূল পথে মিশে গেছে। আমরা শেষবারের মতো পাহাড় থেকে নেমে এলাম।

বাইরের হোটেলে খেয়ে, দিশা হোম স্টে-তে দিবানিদ্রা আচ্ছা করে দিলাম। সন্ধ্যায় আর বের হওয়ার তাড়া নেই। সকালে বাড়িতে ফেরার পালা। চুপচাপ আছি পাহাড়ের দিক থেকে যুদ্ধের দামামা বাজার শব্দ। নিশ্চিত ছৌনৃত্যের আসর বসেছে। বড় মেয়ে নাচ শেখে, তার আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। আমার কৌতূহল যারা এখানে ছৌনৃত্য করেছিল তারাই কি। বড়মেয়ে প্রথম ইচ্ছা প্রকাশ করল, দুজনে বেরিয়ে পড়লাম শুনশান পথে। আসরের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লাম। লক্ষ্য করলাম, এক বাদ্যকারের গেঞ্জিতে লেখা ‘আদিবাসী ছৌনৃত্য পার্টি’। আমাদের দেখা সেই দল নয়। এদের চালচিত্র নেই। দুর্গা অনেক ছোট। এদের পালাগানের নাম ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। দুর্গাদেবীকে ভিত্তি করে পালাগান তৈরি হয়।

আমি অনেককিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার ও বোঝার চেষ্টা করছিলাম। এদিকে নৃত্য শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। পথে ভিড় হতে পারে। আমরা দু’জনে আবাসিকের দিকে এগিয়ে চললাম। শেষবারের মতো পিছনের দিকে তাকিয়ে, রাতের আলোকোজ্জ্বল অযোধ্যা পাহাড় দেখতে ভুললাম না।

শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ | Shibaprasad Purakayastha

Is Three Mile Island Still Dangerous? | Best Article 2023

Famous Places in Murshidabad | Best Travel Story 2023

Best Bangla Golpo Reading 2023 | তৃতীয় পক্ষ | Nasir Waden

Top New Story in Bangla 2023 | আষাঢ়ের অলি মনোরমা | Tanmoy Kabiraj

Shabdodweep Web Magazine | Web Story in Bengali | Shibaprasad Purakayastha

Bengali literature is one of the richest and most diverse literary traditions in the world. With a vast collection of poetry, short stories, and novels, it has captivated readers for centuries. In today’s digital era, Web Story in Bengali has emerged as a popular medium for storytelling. Online platforms like Shabdodweep Web Magazine have played a crucial role in bringing Bengali Stories (বাংলা গল্প) to a global audience.

The Importance of Bengali Stories in Digital Media

The evolution of storytelling has transitioned from traditional books to digital formats. Web Stories in Bangla allow readers to enjoy immersive storytelling through visually engaging and easy-to-read formats. These stories keep the essence of classic Bengali literature alive while adapting to modern readers’ preferences. Shabdodweep Web Magazine is a leading platform where literature enthusiasts can explore various forms of Bangla golpo (বাংলা গল্প), including poetry, short stories, and thought-provoking articles.

Why Read Web Stories in Bangla on Shabdodweep Web Magazine?

Authentic Bengali Literature: The magazine features original Bengali Stories (বাংলা গল্প) written by seasoned writers, maintaining the true spirit of Bengali culture.

Diverse Collection: Whether you love romantic tales, mystery stories, or inspirational poetry, Shabdodweep Web Magazine offers a variety of Web Stories in Bangla.

User-Friendly Interface: The magazine’s easy navigation and readability enhance the experience of reading Bengali Stories online.

Global Reach: Readers from across the world can access Bangla golpo anytime, making it easier to stay connected with their roots.

Regular Updates: New Web Stories in Bengali are added frequently, keeping readers engaged with fresh content.

The Growing Popularity of Bengali Literature in Web Story Format

The advent of digital storytelling has increased the reach of Bengali literature beyond geographical boundaries. Online Bengali Stories (বাংলা গল্প) are gaining popularity among young readers who prefer short, engaging content over lengthy books. This shift has made Web Stories in Bangla a preferred choice for modern literature lovers.

How Shabdodweep Web Magazine Enhances the Bengali Reading Experience

Interactive and Engaging Content: Web Stories are designed to provide an immersive experience through multimedia elements.

Mobile-Friendly Reading: With mobile-optimized formats, readers can enjoy Bengali Stories on the go.

Community Engagement: The platform allows readers to interact, share thoughts, and contribute to discussions on Bangla golpo.

Future of Web Story in Bengali

With increasing demand for digital content, Web Stories in Bangla are expected to flourish further. The efforts of platforms like Shabdodweep Web Magazine and writers like Shibaprasad Purakayastha will continue to shape the future of Bengali literature. By blending traditional storytelling with modern digital formats, Bengali literature is poised for global recognition.

Frequently Asked Questions (FAQ) about Web Story in Bengali

What is Web Story in Bengali?

Web Story in Bengali is a digital storytelling format that presents engaging Bengali Stories (বাংলা গল্প) in an interactive and visually appealing way. Shabdodweep Web Magazine publishes high-quality Web Stories in Bangla for literature enthusiasts.

Why should I read Web Stories in Bangla on Shabdodweep Web Magazine?

Shabdodweep Web Magazine features authentic and engaging Bengali Stories by talented writers like Shibaprasad Purakayastha, ensuring a rich literary experience for readers.

Are Web Stories in Bengali suitable for all age groups?

Yes, Bengali literature on Shabdodweep Web Magazine includes stories suitable for all age groups, from children’s tales to thought-provoking adult fiction.

How frequently are new Web Stories published on Shabdodweep Web Magazine?

New Web Stories in Bangla are published regularly, offering fresh and diverse content to keep readers engaged.

Can I contribute my Bengali Stories to Shabdodweep Web Magazine?

Yes, aspiring writers can submit their Bangla golpo (বাংলা গল্প) for consideration. The magazine welcomes creative and original submissions.

Is Shabdodweep Web Magazine free to access?

A: Yes, most of the Bengali Stories on Shabdodweep Web Magazine are free to read, making quality Bengali literature accessible to all.

What genres of Bengali Stories are available on Shabdodweep Web Magazine?

The magazine features a wide range of genres, including romance, thriller, mystery, drama, and poetry, ensuring something for every reader.

Conclusion

Web Story in Bengali has revolutionized the way we consume Bengali literature. Platforms like Shabdodweep Web Magazine have successfully brought Bengali Stories (বাংলা গল্প) to a global audience, preserving the beauty of Bangla golpo while embracing modern digital trends. Whether you are a passionate reader or an aspiring writer, this magazine is your gateway to a world of rich literary heritage. Start exploring today!


Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio

Leave a Comment