Bengali Story 2023 | লুনি বা টুনী | গল্পগুচ্ছ ২০২৩

Sharing Is Caring:
BENGALI STORY

লুনি বা টুনী [Bengali Story]

আজকে ক্লাস শেষ করে বের হতে দেরী হয়ে যাওয়ায় বিকেলের বাস চলে গেছে। পরের বাসের অপেক্ষায় বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে আছে নূতন। ল্যাব ক্লাসগুলোতে প্রায় সময়ই এমন হয়। সিডনি শহরের বাসের শিডিউল বরাবরই একটু খটমটে। প্রতি এক ঘন্টা বাদে বাস আসে সকালের সময় বাদে। ওই সময় আসে প্রতি পনের থেকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে আসে। তের নাম্বার রুটের যে বাসে নূতন যাতায়াত করে এর শেষ বাস আসবে সাড়ে ছয়টায়। ব্যস! যদি কোন কারণে ওটা ছেড়ে যায় তাহলে তো হয় পনের – বিশ ডলার গচ্চা দিয়ে ট্যাক্সিতে চেপে বাসায় যাও নয় তো সটান হাঁটা লাগাও! আপাতত মাইনাস আটের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় হেঁটে যাওয়ার ঝক্কি সামলানোর বিশেষ ইচ্ছে নেই ওর। তার উপর এ মাসের বাজেট কিছুটা চাপ আছে লরিয়েলের নতুন নেইলপালিশটা কিনতে গিয়ে! গতকালই নাইজেরিয়ান বান্ধবী ওমোর দেখানো মাসকারাটাও খুব চোখে লেগেছে। ওটা আপাতত আগামী দুই মাস পরের কোন সময়ের জন্য তোলা রইলো। খন্ডকালীন চাকরি করে মাসের খরচাপাতি জোগাতে বিদেশে বিপাকে না পড়লেও খাবি খেতে হয়।

পায়ে ঠান্ডায় ওয়ালমার্টের মোজা, বরফের বুট জুতো, ভেতরে সোয়েটারের সাথে উপরে জ্যাকেট,গলায় গোলাপি মাফলার, অবশ্যই মাথায় হকারস মার্কেট থেকে কেনা কান টুপি! তারপরও হাঁটু জমে গেছে আর নাকের ডগায় মনে হচ্ছে আইসক্রিম বসিয়েছে কেউ! এতক্ষণ বাস ছাউনির ভেতরে দাঁড়িয়ে থেকে জমে থাকার চেয়ে একটু বাইরে এসে কিছুক্ষণ পায়চারি করতে শুরু করলো নূতন। এ সময়টায় এখানে কেউ থাকে না বললেই চলে! শুনশান নীরবতায় নিজেকে শহরের একমাত্র বাসিন্দা মনে হয়। মাঝে মধ্যে সামনে গিয়ে শো শো করে চলে যাচ্ছে একটা, দু’টো ফোর্ড, নিসান, হাইউনদাই, সেভরোলেট বা হোন্ডা সিভিক।

গত সপ্তাহের তুষার ঝড়ের জমে থাকা বরফের আস্তরণ রাস্তায় থাকা ইটগুলোর ফাঁকে ফাঁকে বন্দী হয়ে আছে। বেশ মনোযোগ দিয়ে নিচু হয়ে ইটের সারী দেখছিল ও। হঠাৎই পেছন থেকে ডাক এলো – “হ্যালো দেয়ার!”
পেছন ফিরে নূতন দেখলো জলপাই রঙের জ্যাকেট গায়ে একটা পাঁচ,ছয় বছরের ছেলে দাঁড়িয়ে।
– হাই! হাউ আর ইউ?
– আই এম গুড!!
– ওয়াট’স ইউর নেম?
– মাই নেম ইজ জে।

নূতন – আজকে অনেক ঠান্ডা, তোমার টুপি নেই কেন? ঠান্ডা লাগছে না ??
জে – লাগছে। বাসায় আছে। আনতে ভুলে গেলাম।
নূতন – তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?
জে – সেকেন্ড স্ট্যান্ডার্ড এ। আসলে আমি একটা চকলেট ডোনাট খেতে চাই। তোমার কাছে একটা টুনী বা লুনি হবে?? নূতন – হ্যাঁ, অবশ্যই! এই নাও।
জে – অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।
আমি চললাম। দেরী হলে দোকানটা হয়তো বন্ধ হয়ে যাবে।
নূতন – সাবধানে যেও। শুভরাত্রি।
জে – শুভরাত্রি!

কানাডিয়ান টাকার হিসেবে প্রতি পয়সার আলাদা নাম রয়েছে। এক ডলারকে বলে লুনি, দুই ডলার – টুনী, পাঁচ সেন্ট – নিকেল, দশ সেন্ট – ডাইম, পঁচিশ সেন্ট – কোয়ার্টারস। পাঁচ রকমের মুদ্রা আপাতত প্রচলিত আছে। আর নোটের টাকায় সর্বোচ্চ সংখ্যা একশো। পাঁচ থেকে শুরু হয়ে দশ, বিশ, পঞ্চাশ আর একশো।

নূতনের কাছে এমন আবদার নিয়ে কেউ এখনো পর্যন্ত আসেনি। ছোট্ট জে এর ব্যাপারটা একটু আলাদা। ঠিক বুঝতে পারলো না নূতন। ও কি অস্বচ্ছল কোন পরিবার থেকে আসা? হতে পারে! দারিদ্র্যতা পৃথিবীর সব জায়গায় আছে। অন্তর্জালে দেখতে থাকা উঁচু চাকচিক্যময় দালানের পাশের কোন গলিতেই আর বিশ্বের সেরা সামগ্রীগুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে জরাজীর্ণ একটা চেহারা, কিছু মানুষ! আমাদের রাস্তায় ভিখারিদের মত এরাও রাস্তায় ট্রাফিকে দাঁড়িয়ে কফি বা খাবারের জন্য টাকা খোঁজে! পার্থক্য এই যে এদের হাতে প্লে কার্ডে বিভিন্নরকম কথা লেখা থাকে -” হেল্প মি টু হ্যাভ এ টু ডলার কফি বা নিড এ স্ন্যাকস অর লাঞ্চ! ” এমন নানান ধরণের কথা লেখা থাকে। আদতেও যেমনটা দেখা যায় টিভিতে বা পত্রিকার পাতায়, বাস্তব ছবি ভিন্ন।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে মুঠোফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখলো এখনো পাক্কা পনের মিনিট বাকি তের নম্বর বাসের। কাউন্টারের ভেতরের একটা নির্দেশনার দিকে চোখ গেল ওর। ওতে লেখা আছে, “নো স্মোকিং। “
এর সামনে কেউ লিখে রেখেছে, হোয়াই? বোঝো অবস্থা!! হঠাৎই রাস্তার ওপাশ থেকে দেখতে পেল জে আবার ওর দিকেই ছুটে আসছে! নূতনের মনে অসংখ্য প্রশ্ন ভীড় করছে – “ও কি? ওর কি পয়সা কম পড়েছে?” এমন ভেবে পকেটে হাত দিয়ে পয়সা বের করার আগেই ওর হাতে থাকা লুনিটা দেখিয়ে যা জানতে চাইলো তাতে নূতন রীতিমতো হতবাক –

জে – হাই, ভাবছিলাম, তোমার কাছে কি বাসায় ফেরার টাকা আছে?? না থাকলে লুনিটা নাও…
নূতন – হ্যাঁ, আমার কাছে তো এটা আছে।
ওরা ইউনিভার্সিটির প্রায় সবাই মাসিক বাস পাস ব্যবহার করে। ওটাই ওর হাতে দিলো। জে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
জে- কি এটা??
নুতন – একে বলে বাস পাস। এটা থাকলে কোন পয়সা লাগে না। বাসে যেখানে খুশি যাওয়া যায়। তুমি ডোনাট খেয়েছো??
জে – ওহ! তাই। হ্যাঁ, খেয়েছি।
নূতন – তোমার তো সর্দি লেগে যাবে। নাক গড়িয়ে জল পড়ছে যে! এই টিস্যুটা নাও। টুপি আর হাতের গ্লাভস ছাড়া বের হবে না।
জে – হ্যাঁ, তোমাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তোমার নাম কি?
নূতন – আমার নাম নূতন।
জে – কি? নোটুন??
নূতন – না, না। এন ইউ টি ও এন। বুঝলে?
জে – বুঝেছি। তাহলে এই লুনিটা দিয়ে আমি কি করবো? তুমিই রেখে দাও!
নূতন – না, তুমি রাখো। এরপরে আরও পকেট মানি জমিয়ে ডোনাট খেতে পারবে।
জে – আচ্ছা। আসি। আবার দেখা হবে।
নূতন – অবশ্যই, শুভরাত্রি।
জে – তোমাকেও শুভরাত্রি।

এতটুকু ছোট্ট ছেলের মাথায় বাসায় ফিরে যাওয়ার খরচ আছে কি না এটা জিজ্ঞেস করার মতো সরলতা যদি সবার মাঝে থাকতো তাহলে পৃথিবীতে এত হানাহানি, যুদ্ধ-বিগ্রহ এসব থাকতো না! এতো সহজে ওর মাথায় ব্যাপারটা এজন্যই এসেছে কারণ ও এখনো সমাজ জীবনের জটিলতার জঞ্জালে জড়ানো জীবন দেখেনি। এত অল্প সময়ের দেখা। কে জানে হয়তো আর কখনো দেখাও হবে না। কিন্তু মিনিট বিশেকের মধ্যে ছোট্ট জে শিষ্টাচারের যে শিক্ষা নূতনকে দিয়ে গেল তা ওর হৃদয়ের মণিকোঠায় রেখে দেবে আজীবন।

“জে, যেখানেই থাকো, অনেক অনেক ভালো থেকো!!”

রোহিনির দিনকাল [Bengali Story]

আবারও রোহিনির হাত ফসকে পড়ে গেল মুঠোফোনটা। পুরোনো হয়েছে ওটা। তারপরও প্রয়াত স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন। দুই মেয়ে, এক ছেলের সবাই প্রবাসী হওয়ায় রোহিনির সাথে কেউ নেই। মেয়েরা (সুজলা, শ্যামলা) থাকে ওমানে আর ছেলে (সৌজন্য) অষ্ট্রেলিয়ায়। স্বামীর অকস্মাৎ হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পর কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবেনি এমন জলজ্যান্ত মানুষটা হঠাৎ চলে যাবেন! সন্তানেরা দেশে ফিরে পারলৌকিক কাজ শেষ করে যে যার যার জায়গায় ফেরত গেল। তখন থেকেই বড় বোনের ঠিক করে দেওয়া ভাড়া বাসায় একা একাই সময় কাটে ওনার। দুই মেয়ের মধ্যে বড় মেয়ে সুজলা নিয়মিত খোঁজ খবর নেয় বরাবরই! ব্লাড প্রেশার বেশি না কম, সুগারের জন্য ইনসুলিন চলছে না আপাতত ট্যাবলেট খেলেই চলছে। আর ডাক্তারের কাছে গিয়ে চেক আপের ব্যাপারটা বড় বোনের স্বামীসহ সবাই চলে যায়।

অঞ্জনের সাথে রোহিনির বিশ বছরের সংসার। বেশ সাজানো গোছানো ছিমছাম একটা পরিবারে প্রধান কর্তার মৃত্যুতে সবকিছু তাসের ঘরে রূপ নিলো। এক্ষেত্রে রোহিনিকে প্রথমে লড়তে হলো শ্বশুর পক্ষের লোকজনের বিপরীতে। জায়গা জমির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে সবাই হইহট্টগোল করতে লাগলো! গ্রামের বাড়িতে মামলা মোকদ্দমা শুরু হয়ে গেল। এর ওই জায়গার ভাগ চাই তো, ওর কচুরিপানার পাশের জমিটার বিক্রির টাকা চাই। অঞ্জন প্রথম থেকেই নির্ঝঞ্ঝাট গোছের মানুষ হওয়ায় শহরতলীর দিকে চলে আসেন। কর্মসূত্রে ওনাকে এমনিতেই বিভিন্ন জায়গায় বদলি হয়ে কাজ করে যেতে হয়েছে। পরবর্তীতে সরকারি থেকে অবসরে গেলেও অন্য চাকরি নিয়ে ঝামেলামুক্ত জীবন কাটাতে কদমতলীর পাশ্ববর্তী শহরকেই বেছে নেন। এখন ওনার অবর্তমানে জায়গা জমির হিসাব নিয়ে কখনো মাথা না ঘামানো রোহিনির উপর সবাই জেঁকে বসলো। বড় বোন রুপানের বর পেশায় উকিল হওয়ায় বেশ কিছু দিক সামলে নেন। নিন্দুকের অভিযোগ এতেও থেমে যায় না। অনেক কটুবাক্য শুনতে হয় রোহিনিকে। কখনো মা-বাবার সেবা না করার জন্যই বেশ দূরে চলে গিয়েছিল অঞ্জন! শেষ সময়ে সেভাবে ওনাদের দেখা শোনা করেনি। একা একা নিজের একান্তে সুখ লাভের আশায় আত্মীয় স্বজন সবার অলক্ষ্যে গেলেও আদতেও কি কোন লাভ হল? এখন তো সবই হারাতে হলো। অনেকের মুখে এটাও শোনা গেল একা একা সব গিলতে গিয়েছিল তাই এই দশা! যিনি বলেছেন তার ছোট মেয়ের সিজারিয়ান অপারেশনের সময় অঞ্জনের লক্ষীপুরের সরকারী বাড়িতে ছিলেন। ওখানকার পরিচিত ডাক্তারের কাছে দেখিয়ে, রোহিনির সেবা যত্নে সুস্থ হয়েছিলেন। প্রথম বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তিনি আর কোন ঝুঁকি নিতে চাননি। আর আজকে কার মুখে কি কথা??

এখন রোহিনির বেশিরভাগ সময় দিন কাটে পূজো-আর্চা, উপোস, ধর্মীয় বই আর টিভি সিরিয়াল দেখে। ছোট্ট এ ঘরে দুটো রুম, একটা রান্নাঘর আর বাথরুম – শুরুতে গেস্টরুম, কয়েকটা সোফা রেখেছেন, সামনে একটা ছোট সাইজের সো-কেজ, পাশে অঞ্জনের বইয়ের সেলফ, দেয়ালে টাঙানো ঠাকুরের ছবি, পরের ঘরে ঠাকুর ঘর আর বিছানার পাশে টেবিল -চেয়ার, একটা আলনা। অতিথি অাপ্যায়ন করতে হলে প্রথম ঘরেই ভরসা। নেই রোহিনির পছন্দের বেলকনি। আগের বাসায় বেলকনিতে লাগানো আট রকমের গোলাপ গাছগুলোকে খুব মনে পড়ে ওনার। প্রায় প্রতিদিন বিকেলে বেলকনিতে আরাম কেদারায় বসে সুজলার দেওয়া ট্যাবে গান শোনা বা গাছগুলোতে সময় করে দু’বেলা জল দেওয়া। এসব কাজই এখন অঞ্জনের স্মৃতি মাত্র। শখ করে পাশ্ববর্তী নার্সারি থেকে কিনে আনতেন উনি। সময় পেলে প্রয়োজনীয় সার, কীটনাশক দেওয়া, আগাছা পরিষ্কারের কাজ – এসব কাজ আপনমনে সেরে ফেলতেন। দুটো তুলসী গাছও লাগিয়েছিল ওরা। পূজোয় দিতে হয়। এখন পুজোর ফুলটা বর্তমান বাড়ির কর্তাদের কাজের লোক নিয়মিত দিয়ে যায়। তাই কোনদিন তুলসী নেই, আবার কোনদিন দূর্বাঘাস উধাও! এসব নিত্যদিনের ঘটনা আর রোহিনিও সয়ে গেছেন অনেকটা। তবে এখনোও অঞ্জনকে হারানোর প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন বলে মনে হয় না! প্রতি রাতেই ঘুম ঠিকমতো হয় না। আপাতত ঘুমের বড়ি খেয়ে সামাল দিচ্ছেন। এভাবে বেশিদিন চলতে থাকলে পরে প্রতিরাতে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার নেশা হয়ে যাবে – সর্তক করে দিলো ছোট জায়া শ্যামলা! জায়গাজমির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মনোমালিন্যের জেরে দুই দেবরের সাথে কোন যোগাযোগ নেই ওনার। অনেক নাটকীয় মোড় নিয়েছে পরিস্থিতি। প্রথমে দুই দেবরেরা রোহিনিকে নিজেদের কাছে রাখার কথা বললেও পরে গ্রামের বাড়ি থেকে জমি জমার ভাগ বাটোয়ারার কথা শোনার পর বেঁকে বসেন। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে জমির কাড়াকাড়ির কাছে এত বছরের সাংসারিক সম্পর্কের সবরকম সম্পর্কে ফাটল দেখা দিল। এখন কেউ কারও নয়। ওইরকম অবস্থায় রূপানের পাশে এসে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না! ছোট বোনকে, মাথা গোছার ঠাঁই পেতে সাহায্য করার পাশাপাশি অঞ্জনের প্রতি বিভিন্ন সময়ের কাজ, এই যেমন – রুপানের বড় মেয়ের জন্মের সময় ভীষণ রকমের জটিলতা দেখা দেয়। প্রাণসংকট বলা চলে। ডাক্তারদের পরামর্শ মতো বেশ দামী একটা ইনজেকশন সুদূর চীন থেকে আনিয়ে নিয়েছিল এক বন্ধুর মারফতে। ওদিকে রূপানের স্বামী আদিত্য তখন বিলেতে ট্রেনিংয়ের কাজে ছিল। কাজেই অঞ্জনের কাছে রূপানের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। আমরা প্রায় সময়ই একটা কথা মুখে আনি- “তোমার ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো?”

তবে বাস্তব জীবনে আমরা এ কাজ আর করতে পারি কই??

অঞ্জনের চলে যাওয়া অনেকের মুখোশ উন্মোচন করেছে। প্রথমে দুই দেবরের পরম শ্রদ্ধেয়া বৌদিকে নিয়ে নাটকীয়তা প্রদর্শন। দুই জনই রোহিনিকে নিজেদের কাছে রাখতে চায়! পরে দেখা গেল এর ওই অসুবিধা, ওর সেই অসুবিধা, আসল কাজে কারও কোন আগ্রহ নেই – নানান কথায় সময় অপচয় হচ্ছে দেখে রূপানের স্বামী আদিত্যের পরিচিত এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাসায় থাকার ব্যবস্হা করে দেয় ও।

সৌজন্য হেলথ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে মাস্টার্স করছে কুইন্স ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটিতে। একটা পার্ট টাইম জবও করে। আর কাজের ব্রেকে সময় করে রোহিনির সাথে কথা বলে। সন্তানদের সাথে রোহিনির সম্পর্ক প্রায় বলা চলে ফোন কলের উপর দাঁড়িয়ে! মাঝে মাঝে সুজলা, শ্যামলা দুই বোন মিলে ভিডিও কলে আসে। এসব ক্ষেত্রে রোহিনির শত চেষ্টা সত্ত্বেও চোখের পানি আটকে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে! সুজলার স্বামী রাহুল ব্যাংকে কাজ করে, এক ছেলে ওদের – মৈত্র। আর ওদিকে শ্যামলার বিয়ে হবে হবে করেও এখনো হয়নি। ওমানের এক ভারতীয় স্কুলের শিক্ষিকা। ওর স্কুলে ভারতীয় বাচ্চাদের পাশাপাশি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, মিশর, ফিলিপাইন প্রভৃতি দেশের ছেলেমেয়েরাও পড়ে। পেশায় ডাক্তার এক পাঞ্জাবি ছেলের সাথে সম্পর্ক আছে ওর। আগামী বছর হয়তো ওরা বিয়েটাও সেরে ফেলবে সুযোগ বুঝে। আপাত দৃষ্টিতে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে মনে হলেও দিনের পর দিন একাকিনী রোহিনির সন্তানদের কাছে যাওয়া হয়ে উঠে না। ওদের সাথে একসাথে থাকা, ছোট্ট নাতি মৈত্রর সঙ্গে মিষ্টি খুনসুটিতে পরম আনন্দে সময় কাটানো – এসব বাসনা মনে মনেই রয়ে যায় আর বাস্তবতার মুখ দেখে না! উনি নিজেও ভাবেন আর আশেপাশের লোকজনের মুখে মুখে তো আছেই এক কথা- মা-কে মেয়েরা নিজেদের কাছে নিয়ে রাখলেই তো পারে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা কুটনৈতিক বাঁধা, অভিবাসন আইনের যত মারপ্যাচ! বাইরে থেকে বিষয়গুলোকে যত সহজ দেখায়, প্রকৃতপক্ষে বিষয়গুলো ততটাই প্যাচালো। অষ্ট্রেলিয়ার অভিবাসন প্রক্রিয়া আর ওমানের আাইনি জটিলতার ফাঁদে পড়ে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মতো নিজেরা আছে। কেউ চেষ্টা করছে না, মোটেও এমনটা নয়! সবাই যার যার মতো চেষ্টা করেছে আর অতিমারীর পাল্লায় পড়ে এখন অভিবাসনের নিয়ম কানুন পালটে যাচ্ছে প্রতিমাসে, কখনো পরিস্থিতির বিচারে সপ্তাহেও নিয়ম পালটাতে বাধ্য হচ্ছে কতৃপক্ষ! রোহিনির রাতে ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্নগুলো অনেক মিষ্টি। মৈত্রকে নিয়ে বিকেলে পার্কে বেড়াতে যাওয়ার পথে ওই অজানা থেকে উড়ে আসা এক ঝাঁক কবুতরকে দানা খাওয়ানোর ইচ্ছে। ওই কোণঠাসা সিটে বসে নাতিকে বিস্কুট খেতে দিয়েছে আর নিজের হাতে এর এক কাপ গরমাগরম দুধ- চা! এসব হয়তো আর বাস্তবতার মুখ দেখবে না!

গতকালই সুজলার সাথে কথা হয়েছে, ওদের অ্যাপ্লিকেশন আবার বাতিল হয়ে গেছে। যতটা বোঝা যায় তাতে এমন মনে হয় যে এখানকার সরকার কর্মীদের সুযোগ দিতে আগ্রহ বেশি অথবা কেউ যদি ওমানে স্হানীয় ব্যবসায়ে আগ্রহ দেখায়, তাদের ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ওমাম সরকার বেশ উদার। যত সমস্যা বয়স্ক ব্যক্তিদের বেলায়। ওদের দেখভালের দায়িত্ব কার থাকছে? সেই সমপরিমাণ অর্থের হিসাবে চাকরি থাকা চাই। যাতে বিপদ আপদে সরকারের ঘাড়ের উপর কোন বাড়তি চাপ না পড়ে, তার থেকে উত্তরণের উত্তম পন্থা। এর মধ্যে কোনটাতে সরকারের আপত্তি তা মোটা দাগে কাগজে উল্লেখ থাকে না। সবসময় গঁদ বাধা কিছু একটা কারণ দেখিয়ে দিয়েই দায়িত্ব সারে কতৃপক্ষ। আর ওদিকে রোহিনি প্রায় প্রতিদিন রাতেই নাতি- নাতনীদের নিয়ে মিষ্টি স্বপ্ন দেখে!

সুলতানের রোজনামচা [Bengali Story]

পর্ব – ১ [Bengali Story]

“আসেন, আসেন… হাউসবিল্ডিং, হাউসবিল্ডিং, ওই আসেন,
আসেন… অহন ই যামুগা, অহন ই যামুগা,
ভাই আসেন, এই গেল হাউসবিল্ডিং, এই গেল
হাউসবিল্ডিং, এই আপু, যাইবেন ??
…আসেন !! “
সুনামগঞ্জের এক ছোট্ট গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে দেশের কেন্দ্রস্থলে ছুটে আসা কাসেম আলীর ছেলে সুলতান। কাসেম আলি পরিবহন শ্রমিক ছিল। এক সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে প্রাণ হারানোর পর দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া সুলতানের লেখাপড়ার স্বপ্নও হারিয়ে যায়। অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় সরাসরি বাসে হেলপার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া সম্ভব না দেখে আপাতত লেগুনার সহকারী হিসেবে কাজ দিল মোহর সাহেব, কাসেমের মালিক। জন্মের সময়েই মাকে হারানো সুলতান এখন এতিম। তাই মালিকের গ্যারেজে অন্যান্য সবার সাথে তারও ঠিকানা ওটাই।

প্রতিদিন সকালটা একইভাবে আরম্ভ হয় সুলতানের। চোখ কচলাতে কচলাতে শার্টটা গায়ে দিয়ে লেগুনার পেছনের পাদানিতে উঠে পড়ে ডাকতে থাকে যাত্রীদের। বসার সীটের নিচে বালটিতে রাখা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক গিলে নেয়। পেটের বাঁপাশে অল্প অল্প ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়ার কোন বালাই নেই। প্রথম প্রথম খিদে পেলে আধ একটু চ্যাঁচামেচি করতো, পরে একদিন ওস্তাদের এক সজোর চপেটাঘাত বেমালুম সব ভুলিয়ে দেয়। এরপর থেকে আর কোন শব্দ করে না খিদে পেলেও। এখানে সোহেল, রাসেল, মাহবুব, মাইল্লা, রসুল, আরও অনেকে সবাই ওর মত লেগুনার হেলপার। রাসেল বয়সে কিছুটা বড়। ওর দাপটও কিছুটা বেশি।

সুলতান যাত্রীদের ডেকে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে লেগুনাতে যাত্রীরা উঠছে। দিয়াবাড়ি লেগুনা স্ট্যান্ড থেকে খালপাড় আসতে আসতে কিছু যাত্রী থাকলেও প্রায় সময়ই এখান থেকেই গাড়িতে আর বসার জায়গা থাকে না। পেছনে দুপাশে পাঁচজন করে দশজন বসার জায়গা থাকলেও চাপাচাপি করে বারজন উঠানো হয়। সামনে ড্রাইভারের পাশে একজনের জায়গায় দুইজন আঁটসাঁটভাবে বসান হয়। সকালবেলা খালপাড়ে যাত্রীদের ভিড় থাকে আর বিকেলে একই দৃশ্য দেখা যায় হাউসবিল্ডিংয়ে। এই দুই সময়েই তীব্র চাপ নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। গাড়িগুলোও এলোমেলোভাবে চলতে থাকে। সুলতান চেয়ে টাকা নিচ্ছে যাত্রীদের কাছ থেকে। আকারে ছোট হওয়ায় অতি সহজেই বাইরের পাদানি থেকে লেগুনার ভেতরে ঢুকে যাত্রীদের মাঝের জায়গা দিয়ে দিব্যি হেঁটে ভাড়া উসুল করে নেয় সে। কিছু যাত্রী আছে যারা সবসময়ই দুএক টাকার জন্য তর্কাতর্কি করে।

ভাংতি টাকা যাত্রীদের না দেওয়ার চক্করে মাইল্লা, রাসেল, সোহেলরা বেশ টাকা জমিয়ে নিয়েছে। পাঁচ টাকা না দিয়ে দুটো দুই টাকার নোট দিয়ে পকেটভর্তি ভাংতি টাকা থাকলেও সবসময়ই বলে, “ভাংতি নাই”। আর যে যাত্রীকে প্রথম থেকেই সুবিধাজনক মনে হয় না, তার সাথে কোন চালাকি না। আপু, আন্টিদের কাছ থেকে মাঝে সাজে দু চার টাকা মেরেও দেয়। আবার কিছু ভদ্রলোক বেশধারী লোক লেগুনাতে উঠে চুপটি মেরে বসে থেকে বেমালুম ভাড়া না দিয়ে নেমে যায়! এক লোককে সুলতান তাড়াও করেছিল, ড্রাইভার ওকে ফেলে রেখেই চলে গেল। না পেল ভাড়া, না পেল ওই ধোঁকাবাজের নাগাল। পরের লেগুনায় সোহেলের সাথে ঝুলতে ঝুলতে ফিরলো সে। ড্রাইভারকেও বললো না। উলটো যদি বলে বসে, “উঠার সাথে সাথে ভাড়া নেস নাই ক্যান?” সোহেল বলছিলো, একদিন এরকম এক ভদ্রলোক থাপ্পড় মেরে তাড়িয়ে দিয়েছিল। গাড়ি থেকে নেমে গেলে কোথায় ভাড়া ? কোথায় কি ? তাই যাত্রীরা এভাবে সটকে পড়লেও সুলতানের আর দুঃসাহস হয় না পিছু ছোটার।

সকালে খালপাড় থেকে যাত্রীর ভিড় লেগেই থাকে। গাড়ি হাউসবিল্ডিংয়ে পৌঁছার পর সকাল বেলা যাত্রীর ভিড় না থাকায় চৌদ্দজন না হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়ে না ড্রাইভাররা। এভাবে খালপাড় থেকে গাড়ি তো ভর্তি হয়েই এদিকে আসে আর সব গাড়ি এদিকে চলে আসে, খালপাড় গাড়ি শূন্য হয়ে দেখা দেয় যানবাহন সংকট। প্রতিদিন দেখে সুলতানের এসব চোখ সওয়া হয়ে গেছে। ও ভাবে, “কি রে? ওস্তাদ এরকম করে ক্যান? হগলের আগে পৌঁছাইলে তো আগেই এহানে আসতে পারবো। আরেক টিপ মারতে পারবো, দাঁড়াইয়া থাহে ক্যান।” সকালে ১০-১১ টার দিকে যাত্রীর চাপ কমে যায়। তখন লেগুনা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে পাঁচ – দশ টাকার মুড়ি/ চানাচুর খেয়ে নেয় সুলতানরা। এটাই সকালের নাস্তা। মাঝে মাঝে এর ব্যত্যয় ঘটে।

দুপুর ১২- ১ টার দিকে দিয়াবাড়ি থেকে যাত্রীর চাপ বাড়ে। ওইদিকে একটা কলেজ আছে। ছুটি হওয়ার পর ছাত্রছাত্রীরা সব দল বেঁধে বের হয়। অবশ্য এ গ্রুপের কাছ থেকে সুলতান কখনও ঠকেনি। এরা ভাইয়া বা আপু – যে ই হোক না কেন, ভাড়া যা চাওয়া হয়, তা-ই দেয়। এ সময় থেকে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত বেশ ভাল রোজগার হয়। গলা শুকিয়ে আসছে ওর। দিয়াবাড়ি গোলচক্করের লেগুনা স্ট্যান্ডের পাশেই এক হোটেলে খেতে বসে ওর ওস্তাদ ড্রাইভার শওকত। প্রায় সময়ই ভাত – ডিম বা ভাত – আলুভর্তা, ডাল, সবজি এসব দিয়েই হয় ভুরিভোজ। শওকত মাছ/ মাংস সবসময় না খেলেও প্রায়ই খায়। সুলতানের ভাগ্য ভাল থাকলে মাঝে মধ্যে ওর ভাগ্যেও জুটে যায় এক টুকরা মাছ। আজকেও ডিমের ঝোল আর ভাত। গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছিল ও। পানি খেতে ভুলে যাওয়ায় হঠাৎ হেঁচকি উঠলো। পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে হিক্কা সামলে নিল। খাওয়া শেষ হলে খুব ইচ্ছে হয় ড্রাইভারের সিটের পেছনে একটা নরম গদি আছে, ওটাতে যদি একটু মাথা রেখে কিছুক্ষণ ভাত ঘুম দেওয়া যেত! যা হোক, সে অবসর কখনই পাওয়া যায় না। কি রোদ, কি বৃষ্টি, কি শীত, সব দিনই ওর কাছে একই রঙের। বিকেল ৩-৪ টার এ সময়ে যাত্রীর তেমন একটা চাপ না থাকলেও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আর বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত যাত্রীদের ভিড় লেগেই থাকে। পেছনের দাঁড়ানোর ছোট্ট পাদানিতেও দুই তিনজন উঠে পড়ে, সুলতান ওখান থেকে সরে গাড়ির ভেতরেই দাঁড়িয়ে থাকে। ওর অবশ্য সুবিধাই হয়, গাড়ি ছাড়ার পর চৌরাস্তা পর্যন্ত আসতেই ওইটুকু পথের ভাড়া খুব তাড়াতাড়িই উসুল হয়ে যায়। এ সময়ে অনেক ঝুলন্ত যাত্রীই ভাড়া না দিয়ে ভেগে পড়ে। ছোট্ট সুলতানের গলার আওয়াজ অতদূর পৌছায় না! “ভাড়া দিয়া যান … ভাড়া দিয়া যান” কয়েকবার বলার পর ও আপনাআপনিই থেমে যায়। দৈহিক গড়ন ছোট হওয়ায় কোন যাত্রীই খুব একটা পাত্তা দেয় না ওকে। ভেতরে বসা যাত্রীরা অবশ্য মাঝে মাঝে টাকার হিসাব জিজ্ঞেস করে, টাকা সঠিকভাবে গুনে হিসাব করতে পারে কিনা সেটা দেখে। কেউ বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে। এটা সেটা করতে করতে দশটা বেজে যায়। এরপর ১১ টা। রাতের খাবার খেয়ে আজকের মত ছুটি। দুপুরে ডিম খেলে রাতে ভর্তা আর ডাল। কোনদিন রাতে চলে যায় কারেন্ট। কয়েল জ্বালিয়ে না নিলে মশার কামড়ে টেকা দায়। তবে কয়েকবার মশার কামড় খাওয়ার পর একবার ঘুমিয়ে পড়লেই হল। এসবের মাঝে ক্লাস থ্রি তে উঠবে এমন স্বপ্ন দেখার কি কোন সময় পাবে ও কখনো ?? হয়তো ওই স্বপ্ন দেখাও বারণ!

পর্ব – ২ [Bengali Story]

একদিন লেগুনায় এক তরুণীর চোখ পড়ে সুলতানের উপর। ওর চেহারাটা খুব পরিচিত ঠেকে ওর কাছে।
জিজ্ঞেস করে বসে, “এই পিচ্ছি! কি যেন নাম তোমার?”
ও গোমড়া মুখে বলে, “সুলতান”
“চিনতে পেরেছ? আমি তোমাদের অংক করাতাম। তন্দ্রা ম্যাডাম!”
মুখে কোন কথা নেই, শুধু মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে সে। ম্যাম জিজ্ঞেস করলেন, কেন সে আর স্কুলে আসে না? উনার চেহারা বেমালুম ভুলে গেলেও কারণ বললো। তরুণী সুলতানের লেখাপড়ার খবর জানতে চাইল। সুলতান কোন জবাব দেয় না। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে তন্দ্রা নেমে গেল।
আজকের মত ডিউটি শেষ করে বের হয় তন্দ্রা। ভাবছে, ছোট্ট সুলতানের কথা। আজ কি ওর দেখা পাবে? তাহলে কি করবে? আচ্ছা! ওকে বলার দরকার কি? সরাসরি ওর মালিকের সাথে কথা বললেই তো হয়। কিন্তু বলবে কি ? “ওকে স্কুলে পড়তে দিন। না, ও লেখাপড়া আরও করুক এটা চাই। না ! আপনি কি চান না ওর একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ হোক? না! না! বেশি ন্যাকামি হয়ে যাচ্ছে !! আমি চাই ও আরও পড়ালেখা করুক। একজনের কথা বলবো কি করে? হ্যাঁ ! সবার কথাই বলবো। তাহলে প্রস্তাবটা আরও যুক্তিসঙ্গত হবে। আর খরচের অজুহাতে পড়ানো সম্ভব নয় এটা বলে পার পাওয়ার কোন উপায় নেই। খরচের সকল প্রকার ব্যবস্থা আমি এন.জি.ও থেকে পেতে পারি।।” ওখানকার শিক্ষিকা হওয়ার সুবাধে এটা সহজেই সম্ভব। এখন শুধু মিসেস ফালকন কে রাজি করাতে পারলেই হল। তবে হয়ত আরও অনেক নিয়মকানুন আছে যা নিয়ে তার সাথে বিস্তারিত আলাপেরও দরকার আছে। কালই উনার সাথে কথা বলবে এমনটাই মনস্থির করলো।

পরের সপ্তাহে রবিবারের দুপুর। আকাশে মেঘের আনাগোনা। সকাল থেকেই আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। নিশ্চয়ই কোথাও ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যায় হয়তো এক পশলা ঝড়বে, তারই পূর্ব প্রস্তুতি এটা। তন্দ্রা লেগুনা স্ট্যান্ডে সুলতানদের দেখতে পেল।
মুড়িভাজা খাচ্ছে সবাই ভাগাভাগি করে। তন্দ্রা সুলতানকে ডেকে দেয়। জানতে চায় ওর মালিক কোথায়? সোজা ড্রাইভারের কাছে নিয়ে যায় ও। তন্দ্রা মালিকের সাথে দেখা করতে চাইলে ড্রাইভার জানায়, যা ব্যাপার সব তাকেই খুলে বলতে। সে-ই সুলতানের সবকিছু দেখাশোনা করে। মালিক শুধু টাকা জমা নেয়। তন্দ্রা জানাল, সুলতানসহ বাকিরা যদি একবেলা করে পড়ালেখা করার সুযোগ পেত তাহলে ওদের জন্য ভাল হত। ড্রাইভার বললো, এটা কখনই সম্ভব না। ওরা পড়তে গেলে লেগুনার হেলপারগিরি কারা করবে? “তখন স্কুলে পড়াতে যাবেন কেমনে আপা?”
তন্দ্রা বলে, সবাই একসাথে না গেলেও হয়, কেউ সকালে যাবে, কেউ বিকেলে। ড্রাইভার ওকে আরও হেলপার জোগাড় করে দিতে বললো। ও শেষবারের মত মালিকের সাথে দেখা করিয়ে দেওয়ার অনুরোধ করে ফিরে এল।

সকাল হতেই সাদা রঙের লেগুনাতে উঠে পড়লো সুলতান। আকাশী রঙের জামাটা বগলের নিচে ফাটা আর প্যান্টটা সাইজে অনেকটাই বড়। নাক দিয়ে পানি পড়ছে। সকালের গোসলের পানি একটু বেশিই ঠাণ্ডা ছিল মনে হয়। ওর ওস্তাদ প্রতিদিনের মত আজও সিগারেট ফুঁকছে। ওদিকে রাসেলরা সব একদিকে জটলা করেছে। গতকালের মুড়িভাজাটা বেশ মজাই ছিল। রাসেল তো এক মুঠো মুড়ি আর এক হাতে সিগারেট ফুঁকে দেখাচ্ছিল ওর ওস্তাদ কিভাবে চা – সিগারেট খায়। সুলতানের লেগুনা দিয়াবাড়ি থেকে খালপাড় এসে পৌঁছল। ওখান থেকে তিনজন যাত্রী উঠেছে মাত্র। তবে এখনই গাড়িতে হুড়মুড় করে যাত্রীরা উঠবে। খালপাড়ের ব্রিজে আসার আগেই যাত্রীরা উঠতে থাকে। খালপাড় লেগুনা স্ট্যান্ডে পৌঁছে আর জায়গা খালি থাকে না গাড়িতে। এরপর ময়লার মোড়, বাজার পার হয়ে চৌরাস্তা; সব জায়গায় যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু সীট খালি নেই। ঘড়িতে সময় ৮ টা। সুলতানের পেটের বা পাশের নিচের দিকটায় ব্যথা করছে। একটা বনরুটি আর কলা জুটলো। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিল। আজকে ওস্তাদ চা-ও খাওয়াচ্ছে। চা খেতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল। কার আগে কে খাবে? কিছুক্ষণ চ্যাঁচ্যাঁমিচির পর সবাই বেশ মজা করেই খেল। চা, বনরুটি খেয়ে বেশ চাঙ্গা লাগছে ওর। প্রতিদিনের মত আজও যাত্রীদের সাথে কখনো কথা কাটাকাটি, কখনো হাসি ঠাট্টা, কখনো ভাংতি নিয়ে দর কষাকষিতে সকাল, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হল।

হাউসবিল্ডিংয়ে মাস্কট প্লাজার সামনের রাস্তা থেকে বাঁ পাশে লেগুনাগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো আছে। একটার পর একটা লেগুনা ছেড়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই রাস্তার লাইটগুলো জ্বলে উঠবে। কিছুক্ষণ হল তন্দ্রা ওখানটায় এসেছে। সুলতানকে খুঁজে ফিরছে ওর সন্ধানী দুই চোখ। আজকে কাজে অনেক জায়গায় ঘুরে বেরিয়েছে। ব্যাগ থেকে পানির বোতল নিয়ে কয়েক ঢোক খেয়ে নিল। সুলতানের লেগুনা এসে পৌঁছল। তন্দ্রা উঠে বসলো।
“এই পিচ্চি, কি যেন নামটা তোমার? কিছু খেয়েছ? চলো, খালপাড় গিয়ে মুড়ি ভাজা খাই !!”
“আইচ্ছা আপু, আপনে ওস্তাদরে বইলেন!” – বলে সুলতান।

বিকাল ৫.৩০। খালপাড় জামে মসজিদ। কিছুটা দুরে রাস্তার পাশের একটা দোকানে বসেছে তন্দ্রা আর সুলতান। চায়ের অর্ডার দেওয়া হয়েছে। ওরা মুড়ি ভাজা খাচ্ছে।

তন্দ্রা – আচ্ছা, সুলতান, তুমি জানো ‘সুলতান’ মানে কি?
সুলতান – না!
ত – মানে রাজা ! তোমার সুলতান হতে ইচ্ছে করে না?
সু – আগে করত না, তয়, অখন করবো !
ত – বেশ, এর জন্য তোমাকে অনেক পড়ালেখা করতে হবে। স্কুলে যেতে হবে। তুমি যাবে??
সু – হ, যামু ! আপনে ওস্তাদরে রাজি করান। আপনের কতা হুনবো ?
দুজনের চা তৈরি। চায়ে হালকা একটা চুমুক দিয়ে সুলতান দেখে নিল কতটা গরম।
ত – জানি না রে, তবে খুব চেষ্টা করবো। তোমার জন্য নতুন জামা কাপড়, বই খাতা, কলম সব কিনতে হবে। এরপর তোমার বন্ধুদের জন্যও কিনতে হবে।
সু – আইচ্ছা আপা ! সবাই স্কুলে গেলে লেগুনা চলবো কি কইরা ?
ত – সবাই যাবে না। রুটিন করবো। যাতে সবাই যেতে পারে।
চায়ের কাপ এক হাতে রেখে আরেক হাতে থাকা বিস্কুটে কামড় বসালো । নোনতা বিস্কুট। মিষ্টি চায়ের সাথে খেতে বেশ লাগে।
সু – লুটিন ? এইডা কি আপা ??
ত – রোজনামচা । আগে তৈরি করে নিই। তারপর তোমাকে দেখাবো। জানো সুলতান, আমার ঠিক তোমার মত দেখতে একটা ছোট্ট ভাই ছিল, ‘তপু’
সু – হে অখন কই, আপা?
ত – হারিয়ে গেছে!!

চা মুড়ি শেষ করে তন্দ্রা ফিরে যাওয়ার পথে আবার ড্রাইভারের সাথে দেখা করলো। উপস্থিত হলেন মোহর আলি। তাকেও অনুনয় বিনয় করে বোঝনোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। বুঝলো শুধুই সময় নষ্ট করছে সে। এরা কোন কথাই শুনবে না। অন্য কোন উপায়ে চেষ্টা করতে হবে। এরপর মিসেস এনাকে নিয়েই হাজির হবে সে। ছোট্ট সুলতানের ক্লান্ত দু-চোখে তন্দ্রা তার ছোট তপুকে খুঁজে ফেরে প্রতিদিন।

আবার সুলতানের লেগুনা ছেড়ে দিল। হাউসবিল্ডিং থেকে আবার রওয়ানা হয়ে গাড়ি যতই খালপাড়ের দিকে এগুচ্ছে, সেখানকার সুউচ্চ অট্টালিকাগুলোও আকারে ছোট হয়ে আসছে। সেই সাথে কি স্তিমিত হয়ে আসছে সুলতানকে নিয়ে দেখা তন্দ্রার স্বপ্ন?
কাল থেকে আবার সুলতানের লেগুনা ছেড়ে যাবে। সময়ের কাটাও এগিয়ে চলবে নিজের গতিতে। আর হয়তো একদিন সুলতানের রোজনামচায় আমূল পরিবর্তন আসবে!

অতনু দাশ গুপ্ত | Atonu Das Gupta

Bengali Article 2023 | চিরায়ত ধর্মমঙ্গলের স্বাতন্ত্র্য | প্রবন্ধ ২০২৩

Bengali Article 2023 | আশা নিরাশার দোলাচলে বাঁকুড়া জেলার কাঁসা শিল্প

Bengali Novel 2023 | ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৭) | উপন্যাস

Bengali Article 2023 | শ্রমিক আন্দোলনে সুভাষচন্দ্র বসু | প্রবন্ধ ২০২৩

গল্পগুচ্ছ | গল্পগুচ্ছ বিশ্বভারতী | গল্পগুচ্ছ কাকে বলে | গল্পগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ | রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ বই | ত্যাগ গল্পগুচ্ছ | রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প | হালদার গোষ্ঠী গল্পগুচ্ছ | শব্দদ্বীপের লেখক | শব্দদ্বীপ | সেরা বাংলা গল্প | গল্প ও গল্পকার | সেরা সাহিত্যিক | সেরা গল্পকার ২০২২ | বাংলা বিশ্ব গল্প | বাংলা গল্প ২০২২ | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন

Golpo Guccho | world bengali story | new poems in hindi | new poems rilke | new poems in urdu | bangla poets | indian poetry | indian poetry in english | indian poetry in urdu | indian poems | indian poems about life | indian poems about love | bengali story new | indian poems about death | bengali story | bengali story books for child pdf | bengali story books for adults | bengali story books | bengali story books for child | bengali story books pdf | bengali story for kids | bengali story reading | short story | short bengali story analysis | short bengali story characteristics | short bengali story competition | short bengali story definition | short bengali story english | short bengali story for kids | short bengali story generator | bengali story 2023 | short bengali story ideas | short bengali story length | long bengali story short | long bengali story short meaning | long bengali story | long bengali story | long bengali story instagram | bengali story writing competition | story writing competition topics | story writing competition for students | story writing competition malayalam | bengali story writing competition india | bengali story competition | poetry competition | poetry competitions australia 2022 | poetry competitions uk | poetry competitions for students | poetry competitions ireland | poetry competition crossword | writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | bengali story writing | bengali story dictation | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bengali story news| article writing on global warming | article writing pdf | article writing practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Short Article | Long Article | Bangla kobita | Kabitaguccha 2022 | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment