Bangla Galpo Online Reading | Best Bengali Story

Sharing Is Caring:

Bangla Galpo Online Reading | Read Bengali Books online free

গোবিন্দ গুনিন ও কাল সাপ

এক

গভীর জঙ্গলের মাঝখান দিয়ে এক চিলতে পথ। রাতের জঙ্গল বড়ই রহস্যময়। চারপাশের ঝোপে-ঝাড়ে, মনে হচ্ছে অশুভ কিছু ঘাপটি মেরে আছে। গাছে গাছে ঝিঁঝিঁরা কোরাস গাইছে। চারপাশের গাছের আড়ালে কীসের যেন হুটোপুটি। রহস্যময় বুনো পথে গোবিন্দ গুনিন একা। গোবিন্দ গুনিনের কাজ অন্য জগতের, অপ্রাকৃত আর অশুভ আত্মাদের নিয়ে। সারা জীবন বিপন্ন মানুষদের এসবের হাত থেকে বাঁচিয়ে এসেছেন। আজও নিশিন্দাপুরের পঞ্চায়েত প্রধানের মেয়েকে অশুভ শক্তির হাত থেকে রক্ষা করতেই তার ঐ গাঁয়ে যাওয়া। গুনিনের বাবা ছিলেন একজন তান্ত্রিক। তারও কাজ ছিলো অশুভ শক্তি নিয়ে। তার বাবার নীতি ছিল বিপদ গ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করা আর দুষ্টাত্মাদের বিনাাশ করা। পিতার পথকেই পাথেয় করে নিয়েছেন গোবিন্দ গুনিন।

মেয়েটার ওপর কাল সাপের নজর পড়েছে। মেয়েটা যেখানেই যায়, সেখানেই সাপ। ঘরে সাপ, বাইরে সাপ, বিছানায় সাপ অর্থাৎ যেখানে সাপ প্রবেশ করা সম্ভব নয়, সেখানেও সাপ! হয়তো খেতে বসেছে, কথা নেই, বার্তা নেই, ধুপ্ করে ওপর থেকে একটা সাপ এসে পড়লো তার খাবার পাতে। বিছানায় শুয়েছে কেবল, হঠাৎ, গায়ের চাদরের তলায় পিচ্ছিল আর ঠান্ডা কী যেন হাতে ঠেকলো। চিৎকার দিয়ে ওঠে চাদর সরিয়ে দেখে, কুচকুচে কালো একটা বড় সাপ। নির্বিষ সাপ নয়। রীতিমতো বিষাক্ত। মেয়েটা এখন দুঃস্বপ্নেও সাপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে জেগে ওঠে।

সারা দিনরাত মেয়েটা ভয়ে সিটিয়ে থাকে। এমনিতেই মেয়েটা তার আদরের কুকুর চিনিকে হারিয়ে কেঁদে চোখ ফুলিয়েছে। তার ওপর এই উপদ্রব। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়ে মরার উপক্রম হয়েছে তার। গোবিন্দ গুনিন, মেয়েটার হাতে একটা মন্ত্র পড়া গাছের শেকড় বেঁধে দিয়ে এসেছেন। তিনি জানেন, মেয়েটি যার পাল্লায় পড়েছে, সে কোন সাধারণ সাপ নয়। কোন অশুভ দুষ্ট আত্মা। মেয়েটি ওটার পাকা ধানে মই দিয়েছে ফেলেছে। যার ফলে, ওটা মেয়েটার জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। কিন্তু, গুনিন এমন ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে, মেয়েটি এখন নিরাপদ। গুনিন মেয়েটির বাড়িটাও বেঁধে দিয়ে এসেছে। আর কোন অপদেবতা বা পিশাচ, মেয়েটাকে কিংবা তার বাড়ির কাউকে কিছু করতে পারবে না।

দুই

গত কালই পূর্ণিমা গেছে। আকাশে ভরাট চাঁদ, নব যৌবনার মতো। চারপাশে থৈথৈ জোছনা। গাছের পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে চাঁদের আলো এসে বন ভূমিতে ঝালর কাটছে। অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ। কিন্তু গুনিন স্বস্তি পাচ্ছেন না। হাঁটতে হাঁটতে গোবিন্দ গুনিন উপলব্ধি করলেন, এই নিশিতে, এই গভীর জঙ্গলে, তিনি একা নন। তার পেছন পেছন, কেউ বা কিছু একটা আসছে। যে আসছে সে কোন একটা মতলবেই আসছে। ভালো কোন কিছু নয় ওটা। তিনি সাধারণত সাইকেলে যাতায়াত করেন।

কিন্তু বুনো পথ বিদায়, আজ পায়ে হেঁটেই এসেছেন। দ্রুত পা চালালেন তিনি। ভয়ে নয়, উটকো ঝামেলা এড়ানোর জন্য। যেটা ওর পিছু নিয়েছে, ওটা যে রক্ত মাংসের কোন মানুষ নয়, তিনি বেশ বুঝতে পারছেন। আর ওটা তার ক্ষতি করার জন্যই পিছু নিয়েছে। অশুভ আত্মাদের চরম শত্রু, এই গুনিন। আর তাই সুযোগ পেলেই ওরা তার ক্ষতি করার জন্য মুখিয়ে থাকে। হয়তো স্বাভাবিক মৃত্যু তার কপালে নেই। হয় তো কোন একদিন কোন এক অসাবধান মুহূর্তে, কোন অপশক্তির হাতেই মৃত্যু হবে তার।

পেছনে সড়সড় শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কোন সরীসৃপ বুকে হেঁটে আসছে। মনে হচ্ছে কোন সাপ। সহসা তিনি থমকে, ঝটিকা গতিতে ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন চোখের পলকে একটা সাপের মতো কিছু, ঝিলিক তুলে, পাশের একটা ঝোপে ঢুকে গেলো। গুনিন দুই হাত কোমরে রেখে, দুই পা ফাঁক করে দাঁড়ালেন। ফিসফিস করে মন্ত্র জপ করলেন কতক্ষণ। তারপর নিজের বুকে একটা ফুঁ দিলেন। তারপর চিৎকার করে হাঁক দিলেন, ‘ঝোপ থেকে বেরিয়ে আয়। আমি জানি আমার ক্ষতি করার জন্যই তুই আমার পিছু নিয়েছিস।’ বলেই, কোমরে বাঁধা, বাবার দেয়া, মন্ত্রপূত গামছাটা আরো কষে বেঁধে নিলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, ঝোপে যে সাপটা ঢুকেছে, ওটা আদৌ কোন সাপ নয়। অন্য কিছু!

তিন

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। হামাগুড়ি দিয়ে, ঝোপের ভেতর থেকে, একটা কুচকুচে কালো মনুষ্য নারী দেহ বেরিয়ে এলো। ঠিক মানুষ নয় যেন। চাঁদের আলো দেহে পরে, কালো কষ্টিপাথরের মতো চকচক করছে। চোখ দুটো জ্বলছে অঙ্গারের মতো। রাগে, তীক্ষ্ণ দুটো দাঁত বের করে চাপা গর্জন করে ওঠলো পিশাচী।

‘আমার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছিস তুই গুনিন। আমাকে মেয়েটার কাছ থেকে দূর করে দিয়েছিস। মেয়েটা আমার বাসস্থান তছনছ করে দিয়েছে। ওদের বাঁধানো পুকুর পাড়ের কাছে যে তেঁতুল গাছটা ছিলো, সেটা কাটিয়ে দিয়েছে মেয়েটা। আমার তিনটে বাচ্চাকে মেরেছে সে। ওকে আমি শেষ করে দিতাম। তুই এসে সব শেষ করে দিলি।’

ভয়ঙ্কর চাপা স্বরে বললো পিশাচী। গোবিন্দ গুনিন বললেন, ‘এই জন্যই এতো আক্রোশ মেয়েটার ওপর? আর তুই যে সাপের রূপ ধরে, মেয়েটার প্রিয় পোষা কুকুরটা খেয়েছিস, ওদের পোষা প্রাণী গুলোকে শেষ করে দিয়েছিস। এরপর নজর দিতি মানুষ গুলোর ওপর। মেয়েটার প্রিয় কুকুরটা খেয়েই তুই ভুল করেছিস। এখন এসেছিস আমার ক্ষতি করতে? কিন্তু সে সুযোগ তো আর তুই পাবি না। ভেবেছিলাম, তুই এই তল্লাট ছেড়ে চলে যাবি। কিন্তু এখন দেখছি তুই ভালো কথার মানুষ না। তবে এবার সামলা।’ বলেই, গুনিন জোর গলায় মন্ত্র পাঠ করে, কাউকে আহ্বান করতে লাগলেন।

হঠাৎ গুনিনের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো বিশাল দেহি এক কালো পুরুষ। তার চোখ দুটো আক্রোশে জ্বলছে। গুনিনের অনুগত অপদেবতা ওটা। ওকে দেখেই মুহূর্তে সাপে রূপান্তরিত হলো পিশাচী। দেখে বোঝা গেলো, পিশাচী ভয় পেয়েছে। গুনিনের পেছন থেকে বেরিয়ে আসার সাথে সাথে, গুনিনের আহ্বান করা অপদেবতা, একটা বড়সড় বেজিতে রূপান্তরিত হলো আর প্রচন্ড আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়লো সাপটার ওপর!

প্রচন্ড লড়াই বেঁধে গেলো দুই অপশক্তির। লড়াই করতে করতে একবার ঝোপের ভেতর ঢুকছে আর বেরিয়ে আসছে ওরা। ওরা যখন লড়াই করতে করতে ফাঁকা জায়গায় বেরিয়ে আসছিলো, তখন চাঁদের আলোতে ভয়ঙ্কর লাগছিলো দেখতে। সমস্ত বন তছনছ করে ফেলছে দুটোতে। অপদেবতার সাথে প্রাণপণ লড়ছে সর্প-পিশাচী। গোবিন্দ গুনিন অলস আর নিরাসক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে লড়াই দেখলেন কতক্ষণ। তারপর আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। এই অসম লড়াইয়ের ফলাফল কী হবে তিনি জানেন।

তারপর, গোবিন্দ গুনিন, গাছের ফাঁক দিয়ে, ওপরে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে, একবার মুচকি হেসে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, বাড়ির পথ ধরলেন। তিনি জানেন, সর্প পিশাচী, তার ডেকে আনা অপদেবতা কর্তৃক বিনাশ হয়ে যাবে।

বন মানবী

এক

আকাশে মেঘ করেছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। বন-পাহাড়ের বৃষ্টি মানে, অন্য রকম আমেজ। বর্ষাকালে, বন-জঙ্গলে, সাপের উপদ্রব বাড়ে। সে সব জেনেও, জঙ্গলে ঢুকেছি, শিকারের আশায়। এই বনে তিতির পাখি পাওয়া যায়। তিতিরের মাংস আমার প্রিয়। আমার সাথে আছে, বাংলোর কেয়ারটেকার ভজলে রাম। তার কাঁধেও বন্দুক। শিকারের পারমিট আছে তারও। তবে খাবারের জন্য যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকু।

সহসা, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলো। আমি আর ভজলে রাম, একটা নাম না জানা ঝাঁকড়া গাছের তলায় আশ্রয় নিলাম। যদিও জঙ্গলে, ঘন গাছপালার কারণে, বৃষ্টি তেমন একটা ভেজাতে পারছে না বনভূমি। একটা সজারু গুড়গুড়িয়ে দৌড়ে গিয়ে একটা ঝোপে গা ঢাকা দিলো। একটা কাঠবেড়ালি গাছের ওপর, কাঠবাদাম আঁকড়ে ধরে, একটা খোড়লে ঢুকে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, এ সবই দেখছিলাম। ভজলে রাম বিড়ি ফুঁকছিলো।

আর ঠিক তখনি, একটা খিল খিল, নারী কন্ঠের হাসির আওয়াজে চমকিত হলাম। অনেকক্ষণ থেকেই একটা কুলকুল ধ্বনি কানে এসে, সুর তুলছিলো। ভজলে রামকে জিজ্ঞেস করায়, সে বলেছিলো, একটা পাহাড়ি ঝর্ণা ধারা বয়ে যাচ্ছে, বনভূমির ওপর দিয়ে। কুলকুল ধ্বনিটা তারই। এখন মনে হচ্ছে, হাসির সুর লহরি, সেই ঝর্ণার কাছ থেকেই এসেছে।

দুই

বেলা পড়ে এসেছে, তার ওপর, মেঘ-বৃষ্টির কারণে, বনভূমিতে নেমে এসেছে, রাতের আঁধার। এই সময়, ঝর্ণা ধারার পাশে কে থাকতে পারে? আমার বেশ কৌতূহল জাগছিলো। না, একবার দেখতে হবে। ভজলে রামকে বললাম সেই কথা। সব শুনে, ভজলে রাম বললো, ‘বাংলোয় ফিরে চলো দাদা বাবু। এই সময়ে জঙ্গলে, কতো ধরনের অপদেবতার আনাগোনা থাকে। বিপদ ডেকে আনার দরকার নেই।’
আমি বললাম, ‘ধ্যাৎ, ছাড়ো তো ওসব গালগল্প। আমি দেখতে যাচ্ছি। মেয়েটাকে আমি দেখবো।’

বলতে না বলতেই, আবার খিলখিল হাসি শোনা গেলো। এবার বেশ জোরে। সেই হসি শোনে, ভজলে রাম, কেঁপে ওঠলো। আর বললো, ‘রাম রাম রাম!’

বৃষ্টিটা ধরে এসেছিলো। আমি ঝর্ণার কুলকুল ধ্বনি অনুসরণ করে পা বাড়ালাম, সেই দিকে। কেয়ারটেকার বাঁধা দিতে চাইলো। তাকে উপেক্ষা করে, আমি দ্রুত হারিয়ে গেলাম বুনো পথের বাঁকে। বুনো পথ ধরে কিছুদূর যেতেই, ঝর্ণা বয়ে যাবার আওয়াজটা বেড়ে গেলো। আর একটা বাঁক ঘুরেই, দেখতে পেলাম ঝর্ণা ধারাটা।

জঙ্গল এখানে একটু ফাঁকা। অনেকটা জায়গা নিয়ে বয়ে চলেছে ঝর্ণা। মেঘ কেটে গেছে। আকাশ পরিষ্কার হয়ে গেছে। ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলো এসে পড়েছে ঝর্ণার জলে। দেখে মনে হচ্ছে, তরল সোনা। সেই জলধারার মাঝখানে একটা,বড় আর কালো পাথর খন্ড। এই পাথর খন্ডটা এখানে কী করে এলো, সে এক রহস্য।

সেই পাথর খন্ডের ওপরে বসে আছে সিক্ত বসনা, রহস্যময়ী সেই নারী। যার হাসির শব্দ শুনে আমি এখানে ছুটে এসেছি। সেই রহস্যময়ী, তার কোমল দুই পা দিয়ে, ছুটন্ত ঝর্ণার জলকে, আঘাত করছে। আর তাতে, সেই জল, মিছরির গুড়ো হয়ে ছিটকে পড়ছে।

তিন

ডুবন্ত সূর্যের কমলা আভা, সেই নারীর মুখেও পড়েছে। তাতে তাকে অপূর্ব লাগছে।

রহস্যময়ী’র চেহারা অসাধারণ। নাকটা একটু চাপা বটে। তবে এক মাথা কালো চুল। ফর্সা গায়ের রং। গলায় একটা সুন্দর লকেট যুক্ত হার।

মেয়েটার রূপে আমি মোহিত হয়ে গেলাম। হঠাৎ আমার পেছন থেকে ভজলে রামের ডাক ভেসে এলো, ‘দাদা বাবু, ও দাদা বাবু, কোথায় তুমি?’

আমি ডাক শুনে ফিরে তাকালাম। তারপর আবার দ্রুত চোখ ফেরালাম, ঝর্ণার দিকে।

নেই! বন মানবী নেই! শুধু কালো পাথরটা, নিঃসঙ্গ পড়ে আছে, ঝর্ণাধারা ”র বুকে। এদিকে সন্ধ্যেও নেমে এসেছে।
আমি ভজলে রামের সাথে বাংলোর দিকে ফিরে চললাম।

সেই রাতে, মেঘ মুক্ত আকাশে চাঁদ উঠেছে। কাল পূর্ণিমা তো, তাই। যদিও আকাশ সম্পূর্ণ মেঘ মুক্ত নয়। ছেড়া খোঁড়া মেঘ আছে। আমি বাংলোর বারান্দায় বসে রহস্যময়ীর নারীর কথা ভাবছিলাম। ঠিক তখনই, চা, বিস্কুট আর পকোড়া নিয়ে এলো, বাংলোর রাঁধুনি রামলাল। আমি চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে, রহ্যময়ীর বর্ণনা দিয়ে, রামলালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রামু দা, তুমি, এমন কোন মেয়েকে চেনো?’

রামলাল বললো, ‘দাদাবাবু, তুমি যে মেয়েটার কথা বলছো, তেমনই এক মেয়ের কথা আমি জানি। তবে সেটা অনেক দিন আগের ঘটনা। তবে তোমাকে বলি, এমন ভাবে, কোন অস্বাভাবিক কিছু দেখে বা শুনে থাকলে, কখনো দেখতে যেয়ো না। তোমার কিছু হলে, বড়বাবুর কাছে কী জবাব দেবো আমি? ‘

রামলাল ঠিকই বলেছে, এই বাংলোটা আমার বাবার। এখান থেকে পনেরো কিমি মতো দূরে, আমাদের একটা চা বাগান আছে। আরেকটা চা বাগান তৈরি করা হচ্ছে, পাশের পাহাড়ি ঢালে। আমি এখানে একদম নতুন। লেখাপড়া করেছি লন্ডনে। ক’দিনের জন্য দেশে এসেছি। এখন সময় কাটাচ্ছি এই মহুয়া গড়ে। সময় আনন্দেই কাটছে। কিন্তু আমার জীবনটা বোধয় উলট পালট করে দিলো ঐ বন মানবী। রাতে তো আর ঘুম আসে না।

চার

পরদিন, সকাল হতেই, পাগলের মতো ছুটে গেলাম, সেই ঝর্ণাধারার কাছে। সারাদিন, বন মানবীর দেখা পাবার আশায় কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু দেখা পেলাম না। শেষে, সন্ধ্যার একটু আগে, ভজলে রাম, আমাকে ওখান থেকে, বাংলোতে ফিরিয়ে এনেছে।

ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে গেলো। কোন কারণ ছাড়া তো আর ঘুম ভাঙবে না। কিন্তু কারণটা কী ছিলো, তা মনে করতে পারছিনা। হাত ঘড়ি পরে ঘুমানো আমার একটা অভ্যাস। রেডিয়াম লাগানো হাত ঘড়িটা দেখলাম। রাত দুটো বেজে দশ।

আমি দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম। জোছনায় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। চাঁদের আলোয়, অপরূপ সৌন্দর্যের মায়াময় রূপে সেজেছে প্রকৃতি।

বাংলোর হাতায় যে কনক চাঁপা ফুল গাছটা, তাতে এখনো ফুল ফুটে। সেই ফুলের গন্ধে চারদিক ম ম করছে। আমি বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারটায় বসে, জোছনা সাগরে বন-পাহাড়ের অবগাহন উপভোগ করছিলাম। আর ঠিক তখনই দেখলাম ওকে! বন মানবীর কথা বলছি।

আমাদের বাংলোটা একটা ছোট্ট টিলার ওপর। টিলা বেয়ে নেমে যাবার জন্য, টিলার ঢালে, সিঁড়ির মতো খাজ কেটে কেটে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। একদম শেষ ধাপটা মিশেছে, বনে যাবার পথের সাথে। সেখানে, একটা ছাতিম গাছ আছে। তার তলায় দাঁড়িয়ে আছে সে। সাদা শাড়ি পরনে। খোলা চুল হাওয়ায় উড়ছে। আমি, সময়, পারিপার্শ্বিকতা সব কিছু ভুলে গেলাম।
বেরিয়ে এলাম বাংলো থেকে।

আমি যখন ছাতিম গাছটার তলায়, প্রায় চলে এসেছি, ঠিক তখনই বন মানবী, আমার দিকে তীর্যক দৃষ্টি হেনে, ঘুরে দাঁড়িয়ে, বনের দিকে হাঁটা দিলো। আমি বিহ্বলের মতো তার পিছু নিলাম। কী করছি কোথায় যাচ্ছি, সে বিষয়ে আমার কোন হিতাহিত জ্ঞান নেই। আমার মাথায় শুধু একটাই চিন্তা, বন মানবীকে চোখের আড়াল করা যাবেনা।

তার পিছু পিছু আমি গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। আশেপাশে, রাত জাগা শ্বাপদের আনাগোনা উপেক্ষা করে, আমি এগিয়ে গেলাম।

কতক্ষণ হেঁটেছি, কিংবা কোন পথে, এই জায়গায় এসেছি, বলতে পারবোনা। শুধু দেখলাম, আমি আর রহস্যময়ী, একটা মহলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মনে হচ্ছে কোন রাজবাড়ি। একটা, বড় সিংহ দ্বার। তাতে কোন দ্বাররক্ষক নেই। ফটক, হা করে খোলা। বন মানবীর পেছন পেছন, রাজবাড়ীতে প্রবেশ করলাম। বাড়িটা অন্ধকারে নিমজ্জিত। রাজবাড়ির মাথায়, পূর্ণিমার চাঁদটাকে মনে হলো ভুতুড়ে চাঁদ।

পাঁচ

রহস্যময়ী নারী, আমার দিকে আবারো কটাক্ষ হেনে, একদম মহলের ভেতর ঢুকে গেলো। সদর দরজা খোলা ছিলো। একটুখানি দ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। তারপর সেই দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আমিও প্রবেশ করলাম বিশাল এক হল ঘরে। মস্ত বড় হল ঘর। মাঝখানে, স্কয়ার করে, ব্রিটিশ আমলের এক সেট সোফা সাজানো আছে, একটা বড় টি টেবিলকে ঘিরে। দেয়ালে কতগুলো অয়েল পেইন্টিং। দেয়ালের প্রতি কোণায় কোণায় মোমদানি ফিট্ করা। তাতে বড়বড় মোম জ্বলছে। সেই মোমের আলোতে, হলঘরটা রহস্যময় আর ভৌতিক লাগছে।

রহস্যময়ীকে কোথাও দেখতে পেলাম না। কেমন যেন ক্লান্তি এসে ভর করলো আমার দেহে। ধপ্ করে একটা সোফায় বসে পড়লাম আমি। সরাসরি আমার চোখ চলে গেলো, একটা পেইন্টিং-এর দিকে। সাথে সাথে আমার শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গেলো। সেই বন মানবী! ছবিতে তাকে আরো মোহনীয় লাগছে। হাসছে সে। যে শিল্পী ছবিটা এঁকেছে, তার প্রতি শ্রদ্ধা এসে গেলো আমার। কী নিখুঁত। যেন জীবন্ত!

সহসা একটা খিলখিল হাসি শুনতে পেলাম। মনে হলো, ছবির রহস্যময়ী হেসে ওঠলো। আর ঠিক তখনই, সব ক’টা মোমবাতি নিভে গেলো। মাথাটা ঝিমঝিম করে ওঠলো আমার। ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। তারপর আর কিছু মনে নেই।

যখন ঘুম ভাঙলো, দেখলাম, আমি একটা ধুলোয় ভরা মেঝেতে শুয়ে আছি। যেখানে শুয়ে আছি, সেটা একটা ধ্বংস প্রাপ্ত হল রুম। চারপাশের দেয়াল ভাঙাচোরা। দেয়ালে, ভেঙে যাওয়া, মলিন পেইন্টিংসগুলোর অবস্থা দেখার মতো নয়। দেয়ালগুলোর ফাটলে ফাটলে অশ্বত্থ গাছ জন্মে আছে। সহসা, আমার গত রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। কোথায়, বন মানবী, কোথায় সাজানো গোছানো হল রুম, কোথায় দেয়ালের সেই নজর কাড়া পেইন্টিংস?

বিস্মিত আমি, টলতে টলতে, সেই ভাঙাচোরা মহল থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরতে লাগলাম।

‘কারণ আমি বাংলোয় যাবার রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি!

হঠাৎ একটা চিৎকার শুনতে পেলাম, ‘দাদবাবু! এই তো দাদাবাবু?’ চিৎকারটা ভজলে রামের। আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সে। আবার বললো, ‘কোথায় ছিলে তুমি? সে যাকগে পরে শুনবো। এখন বাংলোয় ফিরে চলো।’

আমি ভজলে রামের সাথ বাংলোয় ফিরে এলাম। এসেই বাথরুমে ঢুকে গেলাম। স্নান করে ফ্রেস হতে হবে।

ছয়

দুপুরে, খাবারের বেশ ভালো আয়োজন করেছে রামলাল। তিতিরের মাংসের ঝোল, ঝুরঝুরে আলু ভাজা, টমেটো দিয়ে মসুরের ডাল, আচার। আমি, রামলাল আর ভজলে রাম, একই টেবিলে বসেছি।
আমি খেতে খেতে কাল রাতের ঘটনা বলছিলাম। তারপর রামলালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাখ্যা এর রামুদা? সেদিন যেন, এই মেয়ে সম্পর্কে কী একটা বলছিলে। আমার মনে হয়, তুমি কিছু জানো।’

রামলাল বললো, ‘তুমি যে মেয়েকে দেখেছো সে হচ্ছে আদিবাসী রাজা, মুরোংমুরো’র একমাত্র মেয়ে নিনিতা। সে ভালোবেসে ছিলো, অতি সাধারণ এক আদিবাসী যুবক, মিকোকে। যুবক মিকো ছিলো, বলিষ্ঠ আর রূপবান। সে সময়ের আদিবাসীদের মধ্যে সেরা শিকারি।
কিন্তু রাজা মুরোংমুরো যখন এই খবর জানতে পারলো, সে রেগে লাল হয়ে গেলো। তার মেয়ে এক সাধারণ, ছোট লোককে বিয়ে করবে, এটা মেনে নিতে পারলো না সে।
সে লোক পাঠিয়ে, খুন করালো, আদিবাসী বীর মিকোকে। খুন করালো, জঙ্গলের মধ্যের এক ঝর্ণা ধারার কাছে। সেই খবর পেয়ে রাজকুমারী নিনিতা দৌড়ে চলে আসে, সেই ঝর্না ধারার কাছে। মিকোর লাশটা তখনো সেখানে পড়েছিলো। সেই লাশের ওপর পড়ে, অনেক কাঁদে সে। তারপর সে আত্মহত্যা করে। সেটা ছিলো, উনিশ শো চল্লিশ সালের ঘটনা। যাক, সেই রাজকুমারীকেই তুমি দেখেছো, দাদাবাবু।’

আমি, অবাক হয়ে গল্পটা শুনলাম। তারপর, রামলালকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে তো, ব্রিটিশ আমলের ঘটনা। সে সময়ের আত্মহত্যা করা রাজকুমারী এখন, আমার সামনে আসবে কেমন করে?’
রামলাল বললো, ‘সেই সময় থেকেই, আজ পর্যন্ত, প্রত্যেক পূর্ণিমায় সে জঙ্গলে আসে। পূর্ণিমা শুরুর একদিন আগে থেকে, পূর্ণিমা পর্যন্ত তাকে, জঙ্গলে ঘুরতে দেখা যায়। সে সময় সে, মিকোর বয়সী কোন যুবক দেখলে তাকে আকর্ষণ করে। কেন এমন হয়, তা আমি জানি না। বিধাতার রহস্য বোঝা বড় ভার।’

রামলালের কথা শুনে, আমি থ মেরে বসে রইলাম।

তারপর থেকেই আমি কেমন যেন পাগলের মতো হয়ে গেলাম। বাবা-মা এসে, আমাকে কোলকাতা নিয়ে এলো। বললো আবার যেন আমি লন্ডন চলে যাই, লেখাপড়াটা শেষ করি। কিন্তু আমার আর লন্ডন যাওয়া হয়নি।

পূর্ণিমা আসার দু’দিন আগেই আমি, আমাদের সেই মহুয়া গড়ের বাংলোতে চলে যাই। চলে যাই, সেই ঝর্না ধারার কাছে, যেখানে বন মানবীকে প্রথম দেখেছি। সেই একই সময়, সে আসে। প্রতি বারই সেই একই ঘটনা ঘটে। আমি জানি নিকিতাকে আমি পাবো না। তবু আমি আসি।

আমার জীবন ও ভাগ্য, সেই অপার্থিব রাজকুমারী’র পরলৌকিক জীবনের সাথে এক সূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে!

রতন চক্রবর্তী | Ratan Chakraborty

Travel Story 2022 | আমার বেড়ানো | পণ্ডিচেরী | মহাবলীপূরম | তিরুপতিধাম | কন্যাকুমারী

Rabindranath Tagore’s love for art and literature

New Bengali Article 2023 | অযোধ্যা গ্রামে প্রাচীন জমিদারদের আশ্চর্য স্থাপত্য নিদর্শন

New Bengali Article 2023 | হুগলী জেল ও কাজী নজরুল ইসলাম | প্রবন্ধ ২০২৩

Shabdodweep Web Magazine | Bangla Galpo Online Reading | Ratan Chakraborty

Bengali literature has always been a treasure trove of storytelling, inspiring generations of readers with its depth and diversity. In today’s digital world, Bangla Galpo Online Reading has become an essential way for literature lovers to explore the richness of Bengali stories anytime and anywhere. Shabdodweep Web Magazine is a leading platform that brings readers a vast collection of Bengali stories, poetry, and literature by writers like Ratan Chakraborty.

Why Choose Bangla Galpo Online Reading?

With the increasing shift towards digital reading, many literature lovers prefer to read Bengali books online for free. Here’s why online reading is a game-changer:

  1. Access to a Rich Collection of Stories

Bangla Galpo Online Reading offers an extensive collection of Bengali storybooks, classic novels, and contemporary literature. Whether you love short stories, poetry, or novels, digital platforms ensure you can enjoy them all.

  1. Convenience of Reading Anytime, Anywhere

Gone are the days of carrying bulky books. With Bengali অনলাইন Stories, you can read from your smartphone, tablet, or laptop anytime you want.

  1. Discovering Writers Like Ratan Chakraborty

Shabdodweep Web Magazine features the works of talented Bengali writers, including Ratan Chakraborty, who has captivated readers with his storytelling. His stories offer a unique blend of tradition and modernity, making them a must-read for literature enthusiasts.

  1. Engagement with the Bengali Literary Community

Online reading platforms allow readers to discuss, review, and share their favorite Bangla ebooks with others, fostering a vibrant literary community.

Shabdodweep Web Magazine – Your Destination for Bengali Stories

Shabdodweep Web Magazine is a trusted platform where literature lovers can read Bengali books online free. The magazine publishes high-quality Bangla golpo, poetry, and essays that reflect the richness of Bengali culture and traditions. With a user-friendly interface, readers can easily find and enjoy their favorite stories.

How to Get Started with Bangla Galpo Online Reading?

Starting your journey with Bangla Galpo Online Reading is easy. Follow these simple steps:

Visit Shabdodweep Web Magazine: Go to the website and browse through the latest stories.

Choose a Story: Pick from a wide variety of genres – from mystery to romance.

Start Reading: Enjoy immersive storytelling from the best Bengali writers.

Engage with the Community: Share your favorite stories and discuss them with fellow readers.

FAQ on Bangla Galpo Online Reading

What is the best platform for Bangla Galpo Online Reading?
Shabdodweep Web Magazine is one of the best platforms for Bangla Galpo Online Reading, offering a diverse collection of Bengali অনলাইন Stories for free.

Can I read Bengali storybooks for free online?
Yes! Many platforms, including Shabdodweep Web Magazine, allow readers to read Bengali books online free and explore various genres of literature.

Who is Ratan Chakraborty, and why should I read his stories?
Ratan Chakraborty is a renowned writer featured on Shabdodweep Web Magazine. His engaging storytelling and deep understanding of Bengali culture make his works a must-read.

How often does Shabdodweep Web Magazine publish new stories?
A4: Shabdodweep Web Magazine regularly updates its collection with new Bangla ebooks, ensuring readers always have fresh content to enjoy.

Are there different genres of Bengali stories available online?
Yes, online platforms offer a wide variety of genres, including fiction, historical novels, poetry, and contemporary short stories.

How can I stay updated with the latest Bengali books and stories?
A6: Subscribe to Shabdodweep Web Magazine to receive updates on the latest Bengali অনলাইন Stories and enjoy a continuous stream of fresh content.

Conclusion

Bangla Galpo Online Reading is the future of Bengali literature, providing accessibility, variety, and a seamless reading experience. Platforms like Shabdodweep Web Magazine ensure that literature lovers can explore the best of Bengali storytelling from anywhere in the world. If you are passionate about Bangla ebooks, Bengali storybooks, and বাংলা গল্প, start your literary journey today and immerse yourself in the beauty of Bengali literature.


Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio

Leave a Comment