Alochanai Fera | আলোচনায় ফেরা | শওকত নূর

Sharing Is Caring:
Alochanai Fera

আলোচনায় ফেরা – শওকত নূর [Alochanai Fera]

নগর কলোনির এ জায়গাটুকুতে কলোনিবাসীদের ভ্রূক্ষেপ না থাকার মতোই। বর্গাকার কলোনি জুড়ে সম আকৃতি সমশ্রীর শতাব্দী প্রাচীন দালানগুলো পরস্পর সমদূরত্ব নিয়ে দণ্ডায়মান। প্রায় ঠিক মাঝবিন্দুতে ক’টা বিচ্ছিন্ন রাবার মেহগিনি গাছকে নিকট প্রতিবেশী করে এখানে একাকী অস্তিত্বমান এক বৃত্তাকার বেষ্টনী ; উচ্চতায় কোমর-ছুঁই, সাদা চুনকামে দৃষ্টি আকর্ষক। অদূরের পথ ধরে সকাল বিকাল রোজকার আসা যাওয়ায় এখানে কোন মনুষ্য উপস্থিতি কখনো চোখে পড়ে না। বিরান বেষ্টনী, নিঃসঙ্গ গাছ, এই আবর্তে ক্ষণিক দৃষ্টি চেলে আনমনে নিয়মিত গন্তব্যে ছুটি। বসার স্থান, অথচ নির্জনতায় অনন্য;কলোনির ওই স্যাঁতসেঁতে প্রায়ান্ধকার নর্দমা ঘেঁষা আগাছাঘন অবস্থিতি-অনুপযুক্ত কোনাগুলোর চেয়েও। কী তার হেতু- এই নিভৃত প্রশ্নে নিয়মিত ভাবনা গুটাই।

বলা সঙ্গত, আমি এ কলোনিরই এক দলছুট বাসিন্দা। বয়সে তরুণ, পেশায় সরকারি কর্মকর্তা, অবিবাহিত বিধায় কলোনির ব্যাচেলর’স কোয়ার্টারে এক কক্ষে একা থাকি৷ ছ’ মাসের জীবনযাত্রায় এখানে কোনও বন্ধু জোটেনি বিধায় একাকীত্বের নিভৃত অস্বাচ্ছন্দ্য ঘোচাতে সময় কাটাতে জায়গাটিতে মাঝেমধ্যে গিয়ে বসার ইচ্ছা জাগে।তবে ওখানে দৃশ্যমান ওই অসঙ্গত নির্জনতা পাশাপাশি মনে দ্বিধা সংকোচেরও উদ্রেক ঘটায়। আদৌ যদি জায়গাটি বসার উপযুক্ত হয়ে থাকে তো কেউ কোনদিন বসছে না কেন? এ হিসেব নিকেশের গড়ফলে শেষ অবধি আর ওদিকে পা চালানো হয়ে ওঠে না।

নগর-কলোনি মানেই নিত্য বিচিত্র মানুষের বিচিত্র দৃশ্যপটে, বিচিত্র শব্দপাতে মুখরিত। বলতে দ্বিধা নেই শৈশব থেকেই শুনে আসছি আমি দেখতে সুদর্শন। সে শ্রুতিতে দ্বিমত পোষণকারী কারোর প্রত্যক্ষ দর্শন অদ্যাবধি মেলেনি। তাই বোধ করি কলোনিতে কুমারী তরুণী গোছের যাদেরই দৃষ্টিগোচর হই তাদের নানা ভঙ্গিমার চাউনি ও কানাকানি ফিসফিসানিতে সংকুচিত হই। কিন্তু কারোরই খুব কাছাকাছি হওয়া কিংবা কথোপকথনে লিপ্ত হওয়ার মতো কোনও পরিপ্রেক্ষিত কখনো তৈরি হয় না। নিত্য সময়সূচী মেনে অফিসে যাই, ফেরত আসি। বিকালগুলো প্রায়ই নিজ কক্ষেই শুয়ে বসে, বই পড়ে অথবা অফিসের কোনও কাজে ডুবে কাটে। কালেভদ্রে একাকী এক আধো ঘণ্টা কলোনির কোনও পথ ধরে উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটি। এভাবে চলে গেছে ছ’ মাস।

কলোনির যেসব সাধারণ দৃশ্য দৃষ্টিবিদ্ধ হবার মতো, তন্মধ্যে স্থানে স্থানে তরুণদের আড্ডাবাজি সর্বাধিক উল্লেখিত হবার মতো এবং তা নিত্যনৈমিত্তিক। তরুণ আড্ডা মানেই তাতে বখাটের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। যখন হাঁটি, তাদেরও কানাকানি, ফিসফিসানো অথবা কোনও ব্যঙ্গবিদ্রূপ, যা ঈর্ষার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ বহিঃপ্রকাশ, তা নিয়মিত ঘটে। এক তরুণ আছে, ভাবটি এমন যেন আমাকে দূর থেকে লক্ষ্যপাত ও ব্যঙ্গবিদ্রূপ তার পবিত্র কর্তব্য, এবং তার সুচারু সম্পাদনে তার কোনও বিশেষ প্রাপ্তি অবধারিত । আমি নজরবিদ্ধ হওয়া মাত্রই আমার নজর কাড়তে দাঁড়িয়ে যাবে সে। শরীর আঁকা বাঁকা করে হাত দিয়ে আমার চুলের স্টাইলটি ব্যঙ্গ করবে, মাথা সংকুচিত করে দু কাঁধে হাত তুলে তাতে সজোরে ঝাঁকুনি দিতে থাকবে। কোনও দিন দূর থেকে সে উল্লিখিত ভঙ্গিমায় আমাকে চুল ও ঢিলে শার্ট এর কাঁধের ভাজ পড়া ঠিক করতে দেখে থাকবে। দুটি ভঙ্গিমাতেই আমার তুলনায় সে দ্রুতগতিসম্পন্ন। বেশ ক’ দিন এসব প্রত্যক্ষ করার পর কলোনিতে হাঁটা বন্ধ করি।

ভরগ্রীষ্ম, প্রায় বিকেলেই টানা লোডশেডিং থাকে। বাতাসহীন গুমট নিত্য হাফ ধরিয়ে দেয়। এক বিকেলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি একা হলেও বেষ্টনী দেয়া ওই জায়গাটিতে গিয়ে সময় অতিবাহিত করব।যথা সিদ্ধান্ত তথা কাজ। কিছু বইপুস্তক সাথে নিয়ে বিনা সংকোচে সে বিকেলে গিয়ে বসে পড়ি জায়গাটিতে। বইয়ের পৃষ্ঠায় ডুবে পার করে দিই সন্ধ্যা নাগাদ।

প্রথম দিন জায়গাটার ধারেকাছে কেউ ঘেঁষেনি। দূর থেকে কেউ লক্ষ্যপাত করেছে কি না তা অবশ্য অজ্ঞাত। কিন্তু দ্বিতীয় দিন বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে হঠাৎ মুখ তুলে দেখলাম অদূরে হাঁটারত মধ্যবয়সী এক লোক এদিকে নজরপাত করছেন। আমি তার দিকে দৃষ্টি ধরে রাখাতেই বোধ করি তিনি এদিকে ঢুঁ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসলেন। এগিয়ে এলেন তিনি যথাসম্ভব দ্রুত হেঁটে। কাছাকাছি এসে পাশ কাটিয়ে যাবার উপক্রম করে আবার থামলেন। ঘাড় বাঁকিয়ে প্রথমে জায়গাটার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেন। তারপর মৃদু গলা খাঁকারিতে বললেন, এখানে বসেছেন, না?

জি হ্যাঁ।

আপনার বাসাটা?

ওই যে ওই কোনার চারতলায়।

ব্যাচেলর, না ফ্যামিলি?

জি, ব্যাচেলর।

হু- উ-ম, বেশ বসে কাটান।

আপনি –।

আমিও ওদিকটাতেই থাকি। আপনার বাসা থেকে তিন ভবন পর।বছর দুই আগে এ জায়গাটাতে আমিই উদ্যোগ নিয়ে এ বেষ্টনীটা করি। ভেবেছিলাম লোকজন বুঝি ঘটা করে নিয়মিত বসবে। তা দেখলাম কেউই এদিকে আসে না। প্রথম প্রথম একা একাই এসে বসতাম। পরে ব্যস্ত হয় পড়ায় আর আসা হয়ে ওঠে না।

আসুন আজ, বসুন।

হু-উ-ম, বসি কিছুক্ষণ। তা কী করছেন আপনি?

জি, আমি আছি শুল্ক ও গোয়েন্দা বিভাগে।

পদ?

কর্মকর্তা। আপনি?

আমি ছোটখাটো পদে চাকরি করি। নাম ফয়সল চৌধুরী।

তা আসুন রোজ, একত্রে বসে গল্প করা যাবে।

হু-ম, ব্যস্ততা আছেই। আমার তো আসা হবে না।

ভাবছি কাল থেকে বাবাকে এনে রেখে যাব।

যান, বেশ ভালো লাগবে।

খুবই ভালো মনের মানুষ, দেখতেও একসময় সম্ভবত আপনার মতোই ছিল। এখন বয়স হয়েছে ঢের। শরীর বিশেষ ভালো থাকে না। বাসায় সারাক্ষণ শুধু হাসফাস করেন। আমার স্ত্রী জীবিত নেই, ছেলেপুলেরা বাইরে বাইরে থাকে। এখানে রেখে গেলে বিকালটা আপনার সাথে ভালো কাটাতে পারবে। অবশ্য যদি আপনি সদয় হন। অনেকেই আবার বয়স্কদের ঝামেলা মনে করে।

না না, কী বলছেন! ঝামেলার কী আছে? আপনি অবশ্যই ওনাকে এনে রেখে যাবেন। খুশি হব আমি।

ঠিক আছে, আজ চলি।

জি, দেখা হবে।

ভদ্রলোক খানিকটা ভাবনাগ্রস্ত মুখাবয়বে হাঁটা ধরলেন। এতক্ষণ তাকে সামনের দিক থেকে লক্ষ্য করছিলাম। মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল, এ বয়সে অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে যা বিরল, ছোট চাকুরে হিসেবে চেহারার জৌলুশটা যেন বেমানান। তবে হয়, হয়ে থাকে, হতে পারে এমন। কেউ ছোট চাকরি করলেই চেহারায় জৌলুশ থাকবে না তা বলা চলে না। পেছন থেকে লক্ষ্য করলাম তার শারীরিক গড়ন বা হাঁটার স্টাইলে বয়সের কোনও প্রভাব প্রতিফলিত হয়নি। উচ্চতা বোধ করি তার ছ’ফুটের কাছাকাছি হবে। পরনের পোশাক অত্যাধুনিক ও ফ্যাশনেবল। হাঁটতে হাঁটতে গাছগুলোর ওপাশে অদৃশ্য হয়ে গেলেন তিনি।

এরপর জায়গাটিতে প্রায় সপ্তাহ খানেকের মতো পার হয়ে গেল একা একাই। ভদ্রলোক কথা মোতাবেক তার বাবাকে নিয়ে আসেননি। অবশ্য আমি এখানে নিয়মিত বসার পর থেকে স্কুল কলেজ পড়ুয়া একদল মেয়ের অদূরে দাঁড়িয়ে গল্প গুজব হই হুল্লোড় বা উচ্চ-শব্দ হাসাহাসির দৃশ্যপট নিত্যনৈমিত্তিক হয়েছে। বেশভূষা, ফ্যাশন ও আচরণে প্রভূত বৈচিত্র্য তাদের। আচরণে বাক্যালাপে দৃষ্টি আকর্ষণ প্রয়াস সহজ-লক্ষণীয়। সঙ্গত কারণে আমি তাদের দিকে তেমন ভ্রুক্ষেপ করি না। সূর্যাস্ত নাগাদ তারা নিয়মিত আড্ডাবাজি করে বিভিন্ন দিকে অদৃশ্য হয়ে যায়। বখাটেরা দূর থেকে ঢি ঢি করলেও কী কারণ এদিকে পা মাড়ায় না।

সপ্তাহ খানেক পরের এক বিকেলে ভদ্রলোক আকস্মিক জায়গাটিতে ঢুঁ দিলেন। সঙ্গে তার বাবাকে নিয়ে এসেছেন। পরিচয় পর্বের পর কিছুক্ষণ একত্রে বসে কাটালেন তিনি। এরপর তার বাবাকে রেখে হাঁটা ধরলেন। মিনিট দশেকের মতো তার বাবার সাথে টানা কথা বলি আমি। কথার ফাঁকে লক্ষ্য করেছি তার আপাদমস্তকে। চেহারা বেশভূষায় আভিজাত্যে তিনি তার ছেলের চেয়েও যেন কয়েক ধাপ এগিয়ে। কথাবার্তায় বেশ বিনয়ী ও আন্তরিক। আন্তরিকতায় আমারও কমতি ছিল না। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘন ঘন আমার মনোযোগ আকৃষ্ট হচ্ছিল অদূরে আড্ডারত মেয়ের দলে। আমার পাশে ভদ্রলোকের উপবিষ্ট হওয়া, তথা আমার একাকীত্বের আকস্মিক অবসান কোনও মনস্তাত্ত্বিকতায় মেয়েগুলোকে যেন আজ সাহস যুগিয়েছে অনেকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে। খানিকক্ষণ আমার মনোযোগ সরে যাবার বিষয়টি লক্ষ্য করার পর ভদ্রলোক গলাখাঁকারিতে বললেন, ফয়সাল কি আপনার পুরনো বন্ধু, নাকি নতুন পরিচয়?

জি, নতুন। ঈষৎ চিন্তিত বললাম আমি।

ও আপনাকে আমাদের কথা কী বলেছে?

জি, তেমন কিছু না। উনি বলেছেন, উনি ছোটখাটো চাকুরীতে আছেন, আপনি বাসায় একা থাকেন, বিকালে আমার কাছে রেখে যাবেন, এইসব।

আমরা সেতাবনগরের জমিদার ছিলাম। মূলত আমার বাবা ছিলেন জমিদার। ছেলে হিসেবে আমি সাহায্য করেছি পরিচালনায়। ফয়সলের শিশু অবস্থায় আমাদের জমিদারী চলে যায়।

জি, খুব ভালো কথা। শুনে আনন্দিত হলাম খুব। ইস এ মেয়েগুলো খুব ডিস্টার্ব করছে আজ!

ধমক দিচ্ছেন না কেন? ধমক দিন।

জি, আমার ধমকে কি কাজ হবে? শুনবে এরা? আমি তরুণ,এখানে প্রায় নতুন। এরা এখানে সম্ভবত দীর্ঘদিনের বাসিন্দা।

ও ভয় পেয়েছেন!

ঠিক তা নয়।

বুঝেছি, সৌজন্য। আচ্ছা, আমিই বলছি তবে। এই মেয়েরা! চেঁচালেন তিনি।

জি আংকেল/ জি চাচা/ জি দাদু।

যাও তোমরা এখান থেকে। ওই দূরে গিয়ে দাঁড়াও। দেখছো না আমাদের কথায় ডিস্টার্ব হয়?

এই চল সবাই, চল। মেয়ের দল নিঃশব্দে চলে যায়।

এরপর থেকে ভদ্রলোকের সাথে আমি নিয়মিত জায়গাটিতে বসি। অধিকাংশ দিন আমাদের আড্ডা চলে পড়ন্ত বিকাল থেকে রাত আটটা নটা নাগাদ। পরস্পরের মধ্যে নানা বাক্যালাপ হয় – ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, জাতীয়, আন্তর্জাতিক প্রভৃতি। এরই মধ্যে তাদের জমিদারী জীবনের নানা উত্থান পতন তথা উল্লেখযোগ্য ঘটনাপঞ্জিরই বিশদ বিবরণ তিনি সাবলীল ব্যক্ত করেছেন। পরস্পরের সম্পর্কটা অল্প কিছু দিনের মধ্যে এমন গাঢ়তর পর্যায়ে পৌঁছেছে যে তিনি দাদা-নানা ধরনের মুরুব্বিয়ানায় স্নেহে আমাকে নাম ধরে ডাকেন, এমনকি সময় সনয় জোরগলা তুই তুকারিও করেন। আমিও তার প্রতি তদনুরূপ ভক্তি শ্রদ্ধার নিদর্শন রাখি। আলোচনার খোলামেলা দিকটি বিবেচনায় আনলে সম্পর্কটি নিখাদ বন্ধুত্বের।

দীর্ঘক্ষণ ঠায় বসে থাকা থেকে নিয়মিত পায়ে ক্লান্তি আসে ভদ্রলোকের। আর তা দূর করতে সময় সময় দাঁড়িয়ে বেষ্টনীর বাইরে গিয়ে পাঁচ দশ মিনিটের মতো এদিক ওদিক হেঁটে আসেন তিনি। আর সেই মেয়ের দল ওইদিনের পর থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিলেও এখন ভদ্রলোকের উঠে যাওয়ার সুযোগে তড়াক করে বেষ্টনীর একেবারে কাছাকাছি চলে আসে। তাদের হৈ-হুল্লোড়ের মাত্রাও আকস্মিক বেগবান হয়ে ওঠে। এদের মধ্যে সবচে চটপটে ভাব যে মেয়েটির, গায়েপায়ে, বয়সেও বোধ করি বড়, সে একদিন বিস্ময়করভাবে হুট করে বেষ্টনীর ভেতরে চলে এলো। সশব্দ শ্বাস ফেলে বলল, ভাইয়া, চলে এলাম ভেতরে আ–জ! একটা ক-থা বলব।

কী কথা?

তেমন কিছু না, ভাইয়া, আপনার নাম কী?

শাহজাদা।

মানে? শা-হ–। বিড়বিড় করল সে।

মানে শাহজাদা আমার নাম।

শাহ-জাদা!

হুম শাহজাদা, মোঃ শাহজাদা।

ভাইয়া, মিথ্যা বলছেন না তো? রসি-কতা!

নাহ, আর কিছু বলবে?

না, ভাইয়া।

মেয়েটি চলে যেতে উদ্যত হয়ে ভদ্রলোকের দূরবর্তী অবস্থানের দিকে লক্ষ্যপাত করে থামে। ঘুরে দাঁড়িয়ে জোর শ্বাস ফেলে বলে, ভাই-য়া, আরেকটা কথা।

ব-লো।

ওই দাদুটা কি আপনার নিজ লোক?

মানে?

মানে উনি কি আপনার আত্মীয়?

না।

ভাইয়া, আরেকটা কঁ-থা?

কী?

ভাইয়া, আপনি কি ম্যারিড পার্সন? ওউফ! দাদুটা আসতেছে!

নাহ।

ভাইয়া, আমিও না!

হুম।

ভাইয়া, যাই।

যা-ও।

মেয়েটি দ্রুত হেঁটে গিয়ে ওর সঙ্গীদের সাথে যুক্ত হয়। ভদ্রলোকও যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে ফিরে আসেন। বসতে বসতে হাঁপিয়ে ওঠা কণ্ঠে বলেন, এরা -এখানে ঢুঁ দেয়া ধরল বুঝি? তা কী কথা নিয়ে এসেছিল?

বিশেষ কোন বিষয় নাকি?

না, তেমন কিছু না।

এদের থেকে সতর্ক থাকবি, বুঝলি?

হুম।

ওই বড়সড়টা এসেছিল, না? দেখতে বেশ মেয়েটা।

হুম।

দেখতে যা-চ্ছে তাই সুন্দরী হলে কী হবে? মানুষ হিসেবে এদের গ্যারান্টি তোকে কে দেবে? জায়গাটা আমার কাছে বড় সুবিধার ঠেকে না,বুঝলি? থাকতে বাধ্য হলে কী হবে?

চিন্তা করবেন না। আলোচনায় ফেরা যাক।

হুম।

আমরা আলোচনায় ফিরি। সেদিন ভদ্রলোকের শৈশব কৈশোর যৌবনের নানা কথাই আলোকপাতে উঠল। রাত ন’টা বাজল টানা কথোপকথনে। এরই মধ্যে সাদা ধোঁয়ার মতো জোছনা ছড়িয়ে চাঁদ উঠেছে। যতদূর দৃষ্টি পৌঁছে, নির্মল আকাশে জোছনা প্লাবন চোখে পড়ে। ভদ্রলোক ইতিমধ্যে আমার শখের যাবতীয় বিষয়াদি জেনেছেন। তিনি খুব জোর দিয়ে বললেন পরদিন বাসা থেকে বাঁশি নিয়ে যেতে। আমার অভ্যাস অনুশীলনে থাকা এ বিশেষ সুর যন্ত্রে তার বড় বেশি ভালো লাগার কথা তিনি বেশ কদিন বলেছেন। আজকের এ জোছনা প্লাবন বোধ করি তার সুপ্ত ইচ্ছেটাকে রীতিমত জাগিয়ে তুলেছে। অতএব, পরদিন বাসায় থাকা বাঁশিগুলোর সবচে ভালোটি নিয়ে গেলাম। রাত আটটার পর জায়গাটা নির্জন হয়ে উঠলে আমার ভালো আয়ত্তে থাকা বেশ কতগুলো সুর বিশেষ মনোযোগে বাজালাম। তন্ময় হয়ে শুনলেন তিনি সব সুর। ভূয়সী প্রশংসা করলেন। এভাবে টানা ক বিকেল ও সন্ধ্যা রাত কাটল।

এ ক’দিনে ওই মেয়েটি ভদ্রলোকের হাঁটতে যাবার ফোকরে বার দুই বেষ্টনীতে প্রবেশ করে আমাকে এটাসেটা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। দ্বিতীয় দিন আমি তার নাম জেনেছি। তার নাম উল্কা আখন্দ। বি এ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। পড়ে ধারেকাছেরই এক কলেজে। দেখতে অনিন্দ্য সুন্দরী, খুব ভালোমত খেয়াল করলে বাঁ চোখটা সামান্য ছোট মনে হতে পারে। অবশ্য তা কোনও সাময়িক অসুস্থতার ফলও হতে পারে।

মাঝে ক’দিন অফিস কাজের অতি চাপে ফিরতে দেরি বশত জায়গাটিতে ঢুঁ মারা হয়ে ওঠেনি। অফিস কাজ বাসায় এনে সারতে হয়েছে। অধিকন্তু, সামনে ক’ দিনের ছুটি নিয়ে বাড়িতে যাবার কথা রয়েছে বিধায় অগ্রিম কিছু কাজও বাসায় এনে সারতে হয়েছে। বলতে গেলে রীতিমত এক ঘোরের ভেতরে কেটেছে ক’দিন। যেদিন ওসব থেকে মুক্ত হওয়া গেল,অফিস থেকে ফেরার পথে পড়ন্ত বেলায় জায়গাটিতে ঢুঁ দেয়ার কথা ভাবছিলাম। পথ হাঁটছিলাম ভাবনা ঘোরে। বাসার নিচে পৌঁছে কিছুটা উদ্বিগ্ন হতে হলো। দেখি সেই মেয়ের দল প্রবেশ দ্বারের পাশে দাঁড়িয়ে কিছু বলাবলি করছে। ওদের মাঝে উল্কা মেয়েটি শুধু অনুপস্থিত। আমাকে অল্প দূরে দেখেই সরে দাঁড়ায় দলটি।

আমি চিন্তিত মনে ওপরে উঠতে থাকি। ভাবছিলাম, আজ হঠাৎ দল বেঁধে এদের এখানে কী কাজ। সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে বারান্দায় দৃষ্টি ছুঁড়তেই চোখ রীতিমত চড়কগাছ হলো। বারান্দার চেয়ারে দিব্যি বসে আছে উল্কা। আমাকে দেখেই তড়াক করে দাঁড়িয়ে গেল সে। অনুচ্চ স্বরে বলে উঠল, ভাইয়া, এসে গেলাম কিছু না বলে কয়ে। রাগ করবেন না তো?

না, কী ব্যাপার, হঠাৎ ?

ভাইয়া, ব্যাপার কিছুই না।

কিছু না অথচ এসে গেলে, নিচে দলবল দাঁড়ানো, কিছু তো একটা বটেই। বলো কী বিষয়।

ভাইয়া, আপনি অনেক সুন্দর।

আসল কথাটা বলে ফেলো। ক্লান্ত, ঘরে ঢুকব।

ঢুকেন, আমি এখান থেকে কথা বলি? সমস্যা হবে?

না, বলো জলদি।

ভাইয়া, বলব?

বলো।

আমার না, বিয়ের কথা হচ্ছে।

বেশ ভালো। খুশির সংবাদ।

সত্যি বলছেন? সিরিয়াস ভাইয়া, প্রায় ঠিকের পথে।

আমারও একই অবস্থা।

মানে?

মানে দেখছো তো, কদিন ধরে বিকালে ওখানে বসছি না। সামনে ছুটি নিতে হবে।

ভাইয়া,আমার কথা শুনে আপনি মিথ্যা বলছেন। একদম মিথ্যা।

মিথ্যা হবে কেন? তোমার কথা কি মিথ্যা?

না ভাইয়া, একদম না। বাবা মা বারবার আমার মত চাইতেছে।

আমার মতোই অবস্থা। আমি অবশ্য বেশ আগেই মত দিয়েছি। এখন শুধু —

ভাই-য়া, আপনি সত্যি – মজা করছেন নাতো?

না, তোমার বান্ধবীরা নিচে সম্ভবত অপেক্ষা করছে। কেউ মনে হচ্ছে চাপা স্বরে ডাকছে। ওই শোনো।

জি ভাইয়া, চলি।

যাও, শুভ কামনা থাকছে।

জি ভা-ই-য়া ! কণ্ঠটা ভারী শোনালো।

সিঁড়িতে দ্রুত ও জোর শব্দে উল্কা চলে গেল। কিছুক্ষণ থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুনতে পাচ্ছিলাম, নিচে ওর সঙ্গীরা চাপাস্বরে বারবার ওকে বলছে, কী খবররে? কী বলল শুনে? কিরে, চুপ কেন, বল না জলদি!

চাপাস্বর হলেও কথাগুলো শোনার মতো স্পষ্ট হয়ে ওপরে উঠে আসছিল। উল্কার কোন কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল না। ধীরে ধীরে অন্য কণ্ঠগুলো অস্পষ্ট হয়ে এলে তালা খুলে ঘরে প্রবেশ করি।

সপ্তাহ খানেক পরের কথা। সন্ধ্যার পর জায়গাটিতে বসে আছি আমি ও জমিদার ভদ্রলোক । অদূরে আলোকসজ্জা চোখে পড়ছে। আগেই জেনেছি আজ উল্কার বিয়ে। এ তারই আলোকসজ্জা। এ সন্ধ্যায় মনের চোখে আরও একটি আলোকসজ্জা আমি দেখতে পাচ্ছি। অথচ মনের চোখে নয়, বাস্তব চোখেই আমার তা দেখার কথা ছিল। নিয়তি আর কোনও অদৃশ্য কূটচালে বাস্তবটিই অবাস্তব হয়ে গেছে। তন্ময় হয়ে আমি তা ভাবছিলাম। হঠাৎ চমকে উঠি ভদ্রলোকের কথায়,গাঁয়ে কেন তাহলে ভেঙে গেল তোমার বিয়ে?

কারা যেন মেয়ের বাবার কাছে চিঠি পাঠিয়েছে।

কী চিঠি?

চিঠি আমারই জবানিতে, আমারই হাতের লেখায়।

মানে? তুমি তো লেখনি চিঠি?

নাহ, প্রশ্ন আসে না।

কিভাবে হলো তবে? অবশ্য মফস্বলে অনেক কিছুই হয়। বাজে সব জায়গা।

কাজটা সম্ভবত এখান থেকেই হয়েছে।

কী কাজ?

ওই যে কাগজে মাঝেমধ্যে আপনার জমিদারী কাহিনী টুকে নিয়েছি। সেসবের কোনও টুকরো হয়তো অলক্ষ্যে এখানে পড়ে থাকবে কোনদিন। কেউ সময়ে তার সদ্ব্যবহার করেছে।

কী লিখেছে মেয়ের বাবাকে?

আমি এখানে উল্কা নামের একটি মেয়ের সাথে প্রীতি আসক্ত । সে সূত্রে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চলেছি। অতএব, দুঃখিত, অভিভাবকদের দেয়া কথা রক্ষা করতে না পারার জন্য -এমন বৃত্তান্ত।

ওরা তার সত্যমিথ্যা যাচাই না করেই সব ঠিকঠাক করে ফেলল?

আমি নির্দিষ্ট প্যাডে সবসময় বাড়িতে চিঠিপত্র লিখি। ও চিঠিও নাকি তেমন প্যাডেই লিখা। নকলের বিষয়টা ওদের মাথায় আসেনি।

তুমি ফেরাতে পারলে না ওদের?

ততটা সময় হাতে ছিল না। চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা তখন অপারগ- সময়ও ওদের জন্য অনুকূল ছিল না। একই সময়ে বিকল্প ভালো ছেলের অফার পেয়েছে। ছেলে পক্ষও হয়তো তড়িঘড়ি করেছে। সর্বোপরি, এখানকার বিষয়বস্তুতে বিশ্বাস অবিশ্বাসের একটা দোলাচল তো ছিলই। নেহাতই পূর্বপরিচয়হীন আলোচনা প্রসূত সম্পর্কের উদ্যোগ, অল্পতেই ভেস্তে গেছে।

হুম। তা তুই আবার এসব নিয়ে ভেঙ্গেটেঙ্গে পড়লি নাকি? ঘটনা বিয়োগান্তক। একই দিন ক্ষণে দুই জায়গায় দু দুটি বিয়ে! তাই বলে–

না না, ঠিক আছি।

টেক কেয়ার, মাই ডিয়ার ইয়াংম্যান। নেভার ব্রেক ডাউন। টেক ইট ইজি।

চলুন এবার আলোচনায় ফেরা যাক।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাই ব্রাদা(র), আলোচনায় ফেরা!

শওকত নূর | Shawkat Noor

Bengali Article 2023 | ভৃগুর শক্তিপীঠ ও বড়োমা :: বিল্লপত্তন থেকে বড়বেলুন

Bengali Article 2023 | কবিগুরুর মানবতার ভাবরূপ

History of Bengali Poetry | কবিতা কি ও কেন এবং তার ইতিহাস

Tebhaga Movement | বাংলায় “তেভাগা আন্দোলন” এবং সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গী

আলোচনায় ফেরা | আলোচনা | আলোচনা করা | আলোচনা অর্থ | আলোচনা সভা | আলোচনা সমার্থক শব্দ | আলোচনা চক্ৰ | আলোচনা পদ্ধতি কাকে বলে | বাধ্যতামূলক অবসর নানা আলোচনা | চলচ্চিত্র আলোচনা | আলোচনা-প্রসঙ্গে | শব্দদ্বীপের লেখক | শব্দদ্বীপ | সেরা বাংলা গল্প | গল্প ও গল্পকার | সেরা সাহিত্যিক | সেরা গল্পকার | বাংলা বিশ্ব গল্প | বাংলা গল্প | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন

Alochanai Fera | Alochanai Fera Bengali Story | Alochanai Fera 2023 | New Story Alochanai Fera | Top Story Alochanai Fera | Story in pdf – Alochanai Fera | pdf story – Alochanai Fera | Trending story – Alochanai Fera | Trend Story 2023 – Alochanai Fera | Story download – Alochanai Fera | Shawkat Noor – Alochanai Fera | Alochanai Fera – Writer Shawkat Noor | Alochanai Fera 2023 Story | Alochanai Fera Story pdf 2023 | Alochanai Fera – Story Book | Alochanai Fera – Audio Story | Alochanai Fera – Audio story book | Alochanai Fera – Video Story | Alochanai Fera – Reading Story | Read story – Alochanai Fera | Top story book – Alochanai Fera | Best selling story – Alochanai Fera | Free story – Alochanai Fera | Bengali Story – Alochanai Fera | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment