Bangla Golper Boi Online | Best Shabdodweep Story

Sharing Is Caring:

বুমেরাং – রানা জামান

আব্দুল মুতালিব সস্ত্রীক একটি বিজনেস সেণ্টারে ল্যাপটপের সামনে বস আছেন। সময় রাত দশটা। আব্দুল মুতালিব অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। ছ’মাস হলো পুরুরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অবসরে এসেছেন। বসে আছেন ছেলের সাথে কথা বলার জন্য। দুটো সন্তান ওদের। বড় মেয়েকে বিয়ে দিতে কোনো বাড়তি খরচ না হলেও ছেলেটার জেদের কাছে ওঁদের নতি স্বীকার করতে হয়েছে। স্নাতক পাস ওবায়েদকে কানাডা পাঠাতে উপজেলা শহরের এই বাড়িটাকে এক সুদখোরের কাছে বন্ধক দিতে হয়েছে। ব্যাংক থেকে এতো টাকা ঋণ না পেয়ে বাধ্য হয়ে দাদন ব্যবসায়ী লতিফুর রহমানের কাছে উচ্চ সুদের হারে বাড়িটাকে বন্ধক দিয়ে ছেলেকে বিদেশ পাঠালেন। ওবায়েদ বলেছিলো কানাডা যাবার ছ’মাস পর হতে ঋণ পরিশোধের জন্য টাকা পাঠাতে শুরু করবে।

নির্ধারিত সময়ের দশ মিনিট পরে পর্দায় দেখা দিলো ওবায়েদ। চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। বিরক্তি নিয়েই বললো, এতো ঘন ঘন কল করো কেন আমাকে? সমস্যা কী তোমাদের?

ছেলের চেহারা ও কণ্ঠ শুনে আব্দুল মুতালিবের ছেলের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। একটু সরে আয়েশা বেগমকে কথা বলার জন্য ইঙ্গিত দিলেন। কথা বলতে গিয়ে আয়েশা বেগম ফুঁপিয়ে উঠলেন। আব্দুল মুতালিব উঠে চলে গেলেন জানালার কাছে।

ওবায়েদ বিরক্ত কণ্ঠে বললো, কথা বলার আগেই কাঁদতে শুরু করলে! কী বলতে এসেছো, বলো! আমার তাড়া আছে!
শাড়ির আঁচলে অশ্রু মুছে আয়েশা বেগম বললেন, তুই তো জানিস তোকে কানাডা পাঠানোর জন্য লতিফুর রহমানের কাছে বাড়িটা বন্ধক দিয়ে টাকা নিয়েছে তোর বাবা। ওকে মাসে মাসে সুদ দিতে হচ্ছে। তুই বলেছিলি কানাডা গিয়ে টাকা পাঠাতে থাকবি; সেই টাকা দিয়ে বাড়িটার বন্ধক ছুটাবে তোর বাবা। এক বছর হলো তুই কানাডা গেছিস। গেলো ছয় মাস থেকে তোকে প্রতিমাসে ফোন করে টাকা পাঠাতে বলছি; কিন্তু এক টাকাও পাঠালি না। ছেলে হয়ে তুই আমাদের সাথে এ কেমন আচরণ করছিস রে ওবায়েদ?

ওবায়েদ বললো, আর কয়েকটা মাস সময় দাও মা! আমি এখানে এখনো তেমন কোনো সুবিধা করতে পারি নাই।
বিস্মিত হয়ে আয়েশা বেগম বললেন, কী কইতাছস তুই ওবায়েদ! লতিফুরকে তুই চিনস না? ও সুদের কারবার করে। তোর বাবায় পেনশনের টাকাটা নিয়া বাড়ি আসতে পারে না। ব্যাংক থেকে টাকা তোলার সাথে সাথে রাস্তায় আটকে টাকাটা ছিনায়া নিতাছে। সংসার চালানোর জন্য তোর বাবায় বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানো শুরু করছেন।
বাবাকে কোচিং সেণ্টার খুলতে বলো মা। তাইলে আমার কাছে টাকা চাইতে হবে না।

ছেলের কথা সহ্য করতে না পেরে আয়েশা বেগম লাইন কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। স্বামীর কাছে এসে বললেন, চলো বাড়ি যাই। ওবায়েদ এখন আর আমাদের ছেলে নাই। আমাদের লাশ আমাদেরই কবর দিতে হবে!
আব্দুল মুতালিব একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, ওকে বিদেশ পাঠাবার আমার কুনু ইচ্ছা ছিলো না। তুমিই পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে জোর করে বাড়িটা একটা সুদখোরের কাছে বন্ধক দিতে আমাকে বাধ্য করলে।
আয়েশা বেগম স্বামীর একটা হাত ধরে বললেন, হতাশ হয়ো না গো। আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন। আপাততঃ তুমি টিউশনিতে স্টুডেণ্টের কথা বাড়াও।

আব্দুল মুতালিব বললেন, আমিও তাই ভাবতে ছিলাম। চল এবার বাড়ি যাই।

দুজন বেরিয়ে এলেন দোকান থেকে। একমাত্র ছেলের কাছ থেকে এমন ব্যবহার কখনো আশা করেন নি। বিশেষ করে আয়েশা খাতুনের বিশ্বাস ছিলো: তিনি ছেলে সম্পর্কে স্বামীর ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত করবেন। কী-না করেছেন ছেলেটার জন্য সারাটা জীবন। যা চেয়েছে, তা-ই দিয়েছেন। বহু সময় স্বামীকে লুকিয়ে দিয়েছেন- বিশেষ করে টাকা-পয়সা। ওবায়েদকে কানাডা পাঠাতে তিনিই আব্দুল মুতালিবকে বাধ্য করেছেন। ওবায়েদের প্রতি বিশ্বাস ছিলো: ছেলেটা বাবাকে অথৈ সাগরে ফেলে রাখবে না- স্বামী বিপদে থাকা মানে সাথে স্ত্রীও বিপদে থাকা। কেমন জানি দ্বিধা লাগছে আয়েশা বেগমের স্বামীর সাথে কথা বলতে। হাত বাড়িয়ে স্বামীর হাত ধরতে গিয়েও ফিরিয়ে নিলেন আয়েশা বেগম। আব্দুল মুতালিব কিছুই ভাবছেন না; বাড়ি বন্ধক রেখে ছেলেকে কানাডা পাঠানোর পক্ষে তিনি ছিলেন না; শুধু স্ত্রীর জেদের কারণে এতো বড় কাজটা করেছেন; তবে বিদেশে গিয়ে ছেলে একেবারেই টাকা দিতে চাইবে না, এটা কখনো ভাবেন নি। স্কুলের সর্বোচ্চ পদে থাকার সুবাধে অবৈধ কাজ করে টাকা কামানোর বহু সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন; কিন্তু ও ভাবনা মনে কখনো ঠাঁই দেন নি। এখন কী হবে? বাড়িটা রক্ষা করবেন কিভাবে? এতো টাকা জুগারের উপায় কী? বাড়িটা ছেড়ে দিতে হলে বৃদ্ধ বয়সে স্ত্রীকে কোথায় উঠবেন? অথৈ সাগরে পড়ে গেছেন তিনি- কোনো কূল-কিনারা পাচ্ছেন না তিনি।

গ্রামের চৌরাস্তার মোড়ে বটগাছের নিচে আসতেই লতিফুর রহমানের বখাটে ছেলে খতিবুর রহমান আড়াল থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আঁতকে উঠলেন দু’জনেই। খতিবুর রহমানকে এখনে মাতাল মনে হচ্ছে না, তবে মুখ জুড়ে দুষ্টুমি হাসিটা আছে লটকে। বললো, স্যার, বাড়ি যাচ্ছেন তো?

আব্দুল মুতালিব বললেন, জ্বি। তুমি ভালো আছে খতিবুর রহমান?

একটু পরে আমি আপনার বাড়িতে আসতাছি। একটু কাজ আছে!

আয়েশা বেগম বললেন, এ মাসের সুদের কিস্তি পরিশোধ করেছি খতিব।

আমি সুদের কিস্তি নিতে আসছি না, অন্য কাজ আছে।

ঠিক আছে। আসো।

খতিব পথ ছেড়ে দিলে দু’জন এগিয়ে গেলেন বাড়ির দিকে। লতিফুর রহমানের পুত্র কেন বাড়িতে আসতে চাচ্ছে দু’জনের কেউ ভেবে কারণ বের করতে পারেননি। খতিবুর রহমান এর আগে কখনো ওঁদের বাড়িতে আসেনি। পথে কোনো কথা না বললেও বাড়িতে ঢুকে আয়েশা বেগম বললেন, খতিব যাই বলুক, বা করুক মাথা রেখো তুমি।

শুকনো কণ্ঠে আব্দুল মুতালিব বললেন, চার পাতি বা বিস্কুট আছে ঘরে?

আছে।
তখন দরজায় টোকা পড়লে আব্দুল মুতালিব দরজা খুলে থমকে গেলেন। খতিবুর রহমানের সাথে এক যুবতী। বাঁধা বা না করার মানসিক বা দৈহিক কোনো শক্তিই নেই আব্দুল মুতালিবের।

খতিব যুবতীকে জড়িয়ে রেখে আব্দুল মুতালিবকে ঠেলে ভেতরে ঢুকে বললো, এখন দরজাটা লাগিয়ে দিতে পারেন স্যার!

হতভম্ব আব্দুল মুতালিব দরজার ছিটকিনি আটকে ঘুরে দেখতে পেলেন খতিব মেয়েটাকে নিয়ে শয্যাকক্ষের দিকে যাচ্ছে। আব্দুল মুতালিব বললেন, ওদিকে কোথায় যাচ্ছো বাবা? ড্রয়িংরুমে বসো। আমার ওয়াইফ তোমাদের জন্য চা করে আনছেন।

খতিব না ঘুরে বললো, আপনার বাসায় চা খেতে আসি নাই স্যার!

তাহলে কেন এসেছো?

একে নিয়ে কিছুটা সময় কাটাতে আসছি। সেজন্যে একটা রুম দরকার! আর কোনো প্রশ্ন না স্যার!
খতিব ভেতরে ঢুকে আটকে দিলো দরজা। হতভম্ব আব্দুল মুতালিবের বাকরুদ্ধ হলেও বাঁধা দেবার জন্য ডান হাতটা সামনে বাড়ালেন। আয়েশা বেগম রান্নাঘরের দরজায় থেমে ছিলেন খতিবের কথা শোনে। দরজা বন্ধের শব্দ শুনে এগিয়ে এলেন স্বামীর কাছে। কিছু বলতে না পারলেও তাকিয়ে থাকলেন বন্ধ দরজার দিকে। কত সময় পার হলো উভয়ের কেহই বলতে পারবেন না।

দরজা খোলার শব্দে উভয়ে সম্বিত ফিরে সামনে তাকিয়ে দেখলেন: খতিব ও মেয়েটা দাঁড়িয়ে দরজা জুড়ে। মুখমণ্ডলে হাসি ধরে খতিব বললো, সময়টা ভালোই কাটলো আণ্টি! আমি আবার আসবো!

দরজা খোলে ওরা বেরিয়ে গেলো বাইরে।

একটু পরে আয়েশা বেগম আব্দুল মুতালিবকে বললেন, এবার যাও!

বুঝতে না পেরে আব্দুল মুতালিব বললেন, কোথায়?

ইবলিশটার বাবার কাছে নালিশ দিয়ে আসো। আমার মন বলছে ইবলিশটার বাবা ওর মতো এতো ইতর হবে না!
মোবাইল ফোনে সাড়া না পেয়ে খুঁজতে খুঁজতে আব্দুল মুতালিব বাজারের এলিট সোসাইটি ক্লাবে। এখানে মূলতঃ জুয়া খেলা ও মদ্যপান করা হয়। তখন লতিফুর রহমান মদ পান করছিলেন। টেবিলে আরো দু’জন মদ পান করছিলো। ওকে দেখে লতিফুর রহমান বললেন, এডভান্স কিস্তির টাকা দিতে এসেছেন নাকি হেডমাস্টার?
আব্দুল মুতালিব বললেন, আপনার সাথে একটা জরুরি কথা ছিলো।

বলে ফেলুন ঝটপট!

সবার সামনে না, আপনাকে একা বলতে চাই।

লতিফুর রহমান বিরক্ত হয়ে বললো, সোমরস পানের সময় ঝামেলা পছন্দ না আমার! আপনি পরে আসেন হেডমাস্টার!
খুব জরুরি কথা ছিলো যে!

কিছু না বলে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে লতিফুর রহমান দাঁড়িয়ে আব্দুল মুতালিবকে ইশারা করে ব্যাল্কনির কোণায় নিয়ে গেলো। আব্দুল মুতালিবের নালিশ শুনে লতিফুর রহমানের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে গেলো। ওকে দেখে কেউ বলবে না যে মদপানের টেবিল থেকে বিরক্তি নিয়ে উঠে এসেছে। গদগদ কণ্ঠে বললো, আমার পোলাটা খনি আবিস্কার করে ফেলেছে! বাগানবাড়িতে যাওয়ার ঝামেলায় মাঝে মাঝে ইয়ে করার ইচ্ছাটাকে মাটিচাপা দিতে হয়। তাছাড়া পিয়ন-দারোয়ানরা নিশ্চয়ই মুখ টিপে হেসে মনে মনে বলে: বাপও লম্পট, পোলাও লম্পট! আপনার বাড়িতে গেলে এমন কথা বলার সুযোগ কেউ পাবে না। আমি মাঝে মধ্যে যাবো আপনার বাড়িতে। আমার পোলাটা আপনাকে কী দিয়েছে জানি না; কিন্তু আমার বেলায় প্রতিবারে এক মাসের সুদের কিস্তি মাফ! এখন বাড়ি যান প্রাক্তন হেডমাস্টার সাব!

সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল মুতালিব প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন না। ওঁর মনে হতে থাকলো: ও যেন লতিফুর রহমান পরিবারের দাস হয়ে গেছে। মাথা নিচু রেখে চলে এলেন বাড়িতে। ওখানে কী হয়েছে এর উত্তর শুনে আয়েশা বেগমও হয়ে গেলেন নির্বাক। পরদিন বিকেল তিনটায় দরজায় টোকা শোনে দরজা খুলে আব্দুল মুতালিব থ।

ছেলের মতো এক যুবতীর সাথে লতিফুর রহমান। মুখমণ্ডল হাসিত উদ্ভাসিত রেখে লতিফুর রহমান বললো, চলে আসলাম হেডমাস্টার সাহেব! এখন ভেতরে ঢুকতে দেন!

ছেলের মতোই আব্দুল মুতালিবকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো লতিফুর রহমান। যেন বহুবার এ বাড়িতে এসেছে, এমনভাবে মেয়েটাকে নিয়ে সরাসরি ঢুকে গেলো শয্যাকক্ষে। দরজা আটকে দেবার সাথে সাথে আয়েশা বেগম স্বামীর পাশে এসে স্বামীকে আঁকড়ে ধরে ভয়ে অথবা রাগে কাঁপতে লাগলেন। কতক্ষণ ওভাবে ছিলেন বলতে পারবেন না কেউ।

দরজায় টোকা পড়লে চমকে উঠলেন উভয়ই। দু’জন তাকালেন একে অপরের দিকে। ফের টোকা পড়লে দরজায় আয়েশা এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখলেন সাবেক প্রধান শিক্ষকের দুই ছাত্রছাত্রী।
উর্মী ও স্রোত। যমজ দুই ভাইবোন। বয়স চৌদ্দ। উভয়ে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। দু’মাস হলো আব্দুল মুতালিবের বাসায় এসে পড়ছে। দুটো বিষয়: অঙ্ক ও ইংরেজি।

থতমত ভাব সামলে নিয়ে আয়েশা বেগম বললেন, আজ তোমরা চলে যাও। আগামীকাল এক ঘণ্টা আগে এসো। আজকের পড়াটাও করে দেবেন তোমাদের স্যার।

স্রোত বললো, আগামীকাল আমাদের অঙ্ক পরীক্ষা। তাই আজকে কয়েকটা অঙ্ক দেখিয়ে দেবেন বলেছিলেন হেডস্যার।
আব্দুল মুতালিব এগিয়ে গিয়ে বললেন, ওদের আসতে দাও। কোনো সমস্যা হবে না। আমি সামলে নেবো।
আয়েশা বেগম কিছু না বলে ভাইবোন দু’জনকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দিলেন। আব্দুল মুতালিব দু’জনকে ড্রয়িংরুমেই পড়ান। আজও ওদের নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসলেন। পাশের সোফায় বসে আয়েশা বেগম তাকিয়ে রইলেন বন্ধ দরজার দিকে।

কখনো ভাবেন নি এ ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে ওঁদের। এসব হচ্ছে ওবায়েদের জন্য। ওবায়েদ কি ওঁর বিশ্বাসকে মাটি করে কুলাঙ্গার সন্তান হয়ে যাচ্ছে বা গেছে? আয়েশা বেগম এদিকওদিক মাথা নাড়তেই মৃদু শব্দ করে খুলে গেলো শয্যাকক্ষের দরজা।

ড্রয়িংরুমে ঢুকে উর্মীর দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো লতিফুর রহমান।
পরদিন সকাল এগারোটায় ড্রয়িংরুমে বসে চা পান করছিলেন আব্দুল মুতালিব ও আয়েশা বেগম। ইদানিং স্বামী স্ত্রীর মাঝে আগের মতো বাক্যালাপ হচ্ছে না। কী নিয়ে কথা বলবেন? বাপবেটার বিষয় নিয়ে কথা বলে কী হবে? ওরা তো দাস হয়ে গেছেন বাপবেটার। সাংসারিক প্রয়োজনীয় কথা আদান প্রদানের মাধ্যমে ওদের দিন যাচ্ছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তখন দরজায় টোকা পড়লো।

দরজা খুলে লতিফুর রহমানকে দেখে অবাক হলেন না আব্দুল মুতালিব। অবাক হলেন সাথে কোনো মেয়েমানুষ না দেখে। তাহলে এখন কেন এসেছে এই খবিশটা? ড্রয়িংরুমে তেল চিটচিটে সোফায় বসে পা দুলিয়ে লতিফুর রহমান যা বললো তা কানে গরম শিশা ঢালার মতো হলেও নীরবে হজম করে বেরিয়ে গেলেন নিজ বাড়ি থেকে। লতিফুর রহমান টোপ দিয়েছে এরকম: এই কাজটা করলে এক মাসের সুদের কিস্তি মাফের সাথে এক লাখ টাকা আসলও পরিশোধ হয়ে যাবে!

লতিফুর রহমান অপেক্ষা করছে আব্দুল মুতালিবের ফিরে আসার। আয়েশা বেগম রান্নাঘরে বসে আঁচলে মুখ চেপে কাঁদছেন। লতিফুর রহমান রান্নাঘরের দিকে গলা লম্বা করে বললো, এক কাপ চা হলে ভালো হইতো ভাবি! লাল চা! আমার এখনো ডায়াবেটিস হয় নাই। তাই চিনি দিতে হবে দুই চা চামচ।

আয়েশা বেগম সাড়া না দিলেও চা বানানোয় লেগে গেলেন। চা’র কাপটা লতিফুর রহমানের সামনে রাখতেই দরজায় টোকা পড়লো। স্বামীর টোকা বোঝেন আয়েশা বেগম। দরজা খুলে স্বামীর সাথে এক অপরিচিত কিশোরীকে দেখে কিছু বলতে চাইলে ঠোঁটে তর্জনী আঙ্গুল রেখে বলতে নিষেধ করলেন। আব্দুল মুতালিব কিশোরীর কাঁধে আলতো করে হাত রেখে ভেতরে ঢুকতেই আয়েশা বেগম লাগিয়ে দিলেন দরজা। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে ষাট বছরের লতিফুর রহমানের শরীর। বিস্ময়কর যৌনানুভূতির উত্তেজনা! কিশোরীকে পিন ফুটানো বেলুনের মতো চুপসে গেলো লতিফুর রহমানের উত্তেজনা। চিৎকার দিতে গিয়ে গিলে ফেলে হিসহিসিয়ে বললো, এ কাকে নিয়ে আসছেন হেডমাস্টার?

সাবেক প্রধান শিক্ষক আব্দুল মুতালিবের মন থেকে দাসত্বের ভয় উবে গেলো। দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, উর্মী নামের কিশোরী আর আপনার এই নাতনী জয়নবের মধ্যে পার্থক্য কী! এনজয়!

মা – রানা জামান

এখন কী করবে কিসলু? এই দোদুল্যমানতা শিশুকাল হতেই। বয়স আঠারো বছর পার হবার পরও রহস্যের উদ্ঘাটন করতে পারলো না ও।বাবার কথায় বিশ্বাস রেখে মার প্রতি অবিশ্বাস ততোটা দানা বাঁধেনি আজো। বাবার কথা অনুযায়ী সেই দুই বছর বয়সে মা ওদের ছেড়ে চলে গেছে। মা কোথায় গেছে সে সম্পর্কে বাবা যা বলে প্রতিবার তা ও মনে করতে চায় না কিসলু। বিশ্বাস করবে কিনা তা-ও বুঝতে পারছে না আজো।বাবা কি মিথ্যা বলছেন ওর সাথে? ছোটবেলা থেকেই মিথ্যে বলে আসছেন? কেন? কেন মাকে নিয়ে বাবা ছেলের সাথে মিথ্যে বলবেন?

বাবার আদর ও শাসন দুই পাল্লায় রেখে ওজনের চেষ্টা করে কিসলু। শাসনের তথা মারপিটের পাল্লাটা নিচে নামতে থাকলে কিসলু তচনচ করে দেয় কাল্পনিক দাঁড়িপাল্লা। রোবটের মতো জীবন যাপন কিসলুর। বাবার নির্দেশনা মোতাবেক কিসলু সবকিছু করে যাচ্ছে। পড়ার সময়, পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোন বইটা পড়বে, কোথায় যাবে, কার সাথে মিশবে ইত্যাদি।

কিসলু কোথাও যেতে চায় একা। কিন্তু ওর বাবা ওকে কোনো সুযোগই দিতে চান না। বাবা আঠার মতো লেগে থাকে ওর পেছনে; কোনো সময় বাবা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকলে লোক লাগিয়ে রাখেন ওর পেছনে। বালেগ হওয়া সত্ত্বেও ওর কোনো স্বাধীনতা নেই। মার অন্তর্ধানের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হলে ওকে স্বাধীন হতে হবে। কিন্তু কিভাবে স্বাধীন হবে সে? ব্রিটিশ শাসন থেকে ইন্ডিয়া স্বাধীন হয়েছে লম্বা অহিংস ও সহিংস আন্দোলনের পর এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে পাকিস্তান থেকে চব্বিশ বছরের সংগ্রাম ও ন’মাস মুক্তিযুদ্ধের পর। বাবার শাসন থেকে স্বাধীন হবার কী পদ্ধতি ওর জানা নেই। গুগলে অনুসন্ধান করে কিছুই পায়নি ও। কলেজের লাইব্রেরিতে বহু বই পড়েছে; কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। বন্ধু-বান্ধব না থাকায় কারো সাথে আলোচনাও করতে পারছে না। বাবার শাসন ওকে কোনো বন্ধু তৈরি করতে দেয়নি। নতুন কোনো ছেলে বা মেয়ে ওর কাছাকাছি হলে পরদিন আর ওর কাছে আসে না। কেন আসে না, তাও বলে না। বড্ড অসহায় লাগে ওর। বাল্যকালটাই ভালো ছিলো। এসব চিন্তা মাথায় ছিলো না। যত বয়স বাড়ছে ততো মার কথা মনে পড়ছে ওর এবং সেকারণেই ও অন্তর্ধানের রহস্য বের করতে চায়। মার দিকের অর্থাৎ মামা খালা নানা-নানি কেউ ওর আছে কিনা বাবা বলেন না। শুধু কি তাই, দাদা দাদি কাকা বা ফুপুদের কেউ আছে কিনা তাও বলেন না বাবা। এই বিশাল জনসমুদ্রে থেকেও কিসলু একা, ভীষণ একা।

কিসলু ভাবনায় থাকে। ভাবতে ভাবতে হাটতে হাটতে কোথায় কোথায় চলে যায় ও! এখন সে একটি ট্রাফিক শেডে দাঁড়িয়ে আছে।ও জানে ওর আশেপাশে বাবার লোক আছে।হারিয়ে যাবার চেষ্টা করতে গেলে ঠিক ধরে নিয়ে যাবে বাবার কাছে এবং বাবার বকুনির সাথে মারপিট। এই বয়সেও বাবার মারপিটের কমতি হচ্ছে না। কিসলু লোকগুলোকে চিনতে পেরেছে। মোট পাঁচজন।ওর আজকে ওদের নিয়ে মজা করতে ইচ্ছে করলো।ও পায়ে পায়ে একজনের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কাছে সিগ্রেট আছে মিস্টার?

লোকটা থতমত খেয়ে অন্যদের দিকে তাকালো। অন্যরা হয়তো কিছু ইশারা করেছে। লোকটা কিসলুর দিকে তাকিয়ে বললো, আমি সিগারেট খাই না!
— তাইলে একটা বিড়ি দেন! নাকি বিড়িও খান না?

লোকটা হতভম্ব থেকেই বললো, সিগারেট না খাইলে বিড়ি খাবো কেন!
— একথাও ঠিক! তাইলে ম্যাচ দেন! নাকি ম্যাচও নাই?
— না নাই!
— ওকে!

কিসলু হাসি চেপে রেখে উঠে এলো ফের ট্রাফিক শেডে। মুখ-ভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটা কথা মনে হতেই মুচকি হাসিটা আরেকটু বিস্তৃত হলো। এটা আরো মজার খেলা হবে এবং জব্দ হবে বাবাও। একটা নম্বরে ফোন করে দিলো। কিছুক্ষণ পর একটি ভ্যান ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। কিসলু ভ্যানটাকে আড়চোখে একবার দেখে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলো। চোখের পলক ফেলার আগেই ভ্যান থেকে ইউনিফর্ম পরা চারজন লোক নেমে কিসলুকে ঝাপটে ধরে ভ্যানে তুলে ছেড়ে দিলো গাড়ি।

অট্টহাসি চেপে রেখে পাশের ইউনিফর্ম পরা একজনকে জিজ্ঞেস করলো কিসলু, আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
— পাগলা গারদে।
— কোন পাগলা গারদে?
— বত্রিশ পাগলা গারদে।
— কেন?
— তুমি পাগল, তাই।
— কে বললো আমি পাগল?
— তোমার চেহারা।
— আমার চেহারা কি পাগলের মতো?
— পুরা।
— তাইলে নিয়া যান!

কিসলু আর কিছু জিজ্ঞেস না করে বসে রইলো। পাগলা গারদের একটা পাঁচ হাত বাই তিন হাত প্রকোষ্ঠে ঠাঁই হলো কিসলুর। কুকুরণ্ডলি হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়। আধাঘন্টা পর পাগলা গারদে এসে নাদির আলী ছেলের উপর চড়াও হলেন খুব। চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে পাগলের মতো আচরণ করার কোনো মানে হয়! বাবার রাগ দেখে ওর হাসি পেলো খুব। বাসায় এনে দরজায় তালা মেরে বললেন, আপাতত তোমার বাসার বাইরে যাওয়া বন্ধ! প্রয়োজন হলে আমিই তোমাকে বাইরে নিয়ে যাবো। ঘরে প্রচুর খাবার আছে; আরো বা ভিন্ন খাবার প্রয়োজন হলে ফুডপাণ্ডায় কল করে আনিয়ে নিয়ো। কিসলু বাবাকে একবার দেখে নিচু করে নিলো মাথা। বাইরে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ঘরের জিনিসপত্র দেখায় মন দিলো ও।

ফ্রীজ থেকে এটা-ওটা খায় আর খুঁজতে থাকে কী যেন কিসলু। ঘরের প্রতিটি কোণা, খাটের নিচ খোঁজাখুঁজি শেষ করে খালি হাতে এসে বসলো ব্যালকনিতে। সামনের এক চিলতে মাঠে একটা মোটা বেড়াল এক নেড়ি কুকুরকে দৌড়াতে দেখেও কিসলুর হাসি এলো না। সে ঘরে ঢুকে এদিকওদিক তাকাতে থাকলো। প্রতিটি ওয়াশরুমের উপরে একটি করে স্টোররুম আছে। স্টিলের সিঁড়ি টেনে এনে একটা স্টোরে ঢুকলো ছোট টর্চ লাইট নিয়ে। তৃতীয় স্টোরটা ঘাটাঘাটি করে একটা ছবি পেলো। ছবিটায় তিনজন-বাবা-মা আর ও। ছবিটার উপর টপটপ করে পড়তে থাকলো অশ্রু। ছবিটা নিয়ে নেমে এলো নিচে। একটা কাঁচি নিয়ে বাবার ছবিটা আলাদা করে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে পুড়িয়ে ফেললো মেঝেতে। ছাই জড়ো করে কমোডে ফেলে করে দিলো ফ্লাশ।

ছবিটাকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরে কান্না জড়িত কণ্ঠে কিসুল বললো, মা তুমি কোথায়? তুমি কি সত্যই আমাদের ছেড়ে পালিয়ে গেছো? নাকি অন্য কোনো ঘটনা? কে বলে দেবে আমাকে? কিসলু ছবিটা নির্নিমেষ চোখে আরো অনেকক্ষণ দেখে টি-শার্টের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলো। মনে মনে বললো: যেহেতু মার ছবি পাওয়া গেছে, সেহেতু পুরনো জিনিস ঘাটাঘাটি আরো কিছু পাওয়া যেতে পারে, যাতে মার গন্ধ লেগে আছে!

খোঁজাখুঁজির উৎসাহ আরও বেড়ে গেলো কিসলুর। একদিন একটা স্টোররুমে একটা শাবল দেখেছিলো ও। ওটা নামিয়ে এনে স্টিলের আলমিরার ভেঙ্গে ফেললো তালা। আলমিরা তন্নতন্ন করে কিছুই পেলো না। একটা সিন্দুক আছে আলমিরার ভেতরে। ওটার তালাও ভেঙ্গে ফেললো কিসলু। সিন্দুক ভর্তি টাকা। দুই হাজার টাকার বান্ডল সবগুলো। একটা একটা করে টাকার বান্ডল নিচে নামালো কিসলু। টাকার বান্ডলগুলোর নিচে একটা কালো বর্ণের নথি পেলো। নথিটা সিন্দুক থেকে বের করে ভাঁজ খুললো ধীরে ধীরে। ভেতরে পেলো একটিমাত্র লেমিনেটেড দলিল। দলিলটা তুলে পড়ে ওর হাত কাঁপতে লাগলো। দুই চোখ ভরে গেলো অশ্রুতে। টপটপ করে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু পড়তে লাগলো দলিলের উপর। এটা একটা নিকাহনামার রেজিস্ট্রিকৃত কপি। এতে ওর মা, নানা-নানির নাম ও ঠিকানা লেখা আছে।

কিসলু একবার গলা ছেড়ে ‘মা’ বলে চিৎকার করে নিকাহনামাটা চেপে ধরলো বুকে। তখন ভেতরে ঢুকলেন আজিজ আহমেদ। কিসলু নিকাহনামাটা দেখিয়ে বললো, বাবা, আমার মার নাম ও ঠিকানা পেয়ে গেছি।

বিষন্নানন্দ – রানা জামান

হঠাৎ নীরবতায় আশ্চর্য ওরা। কী হয়েছে পিশাচগুলোর? মরে গেলো নাকি সব কোনো বজ্রপাতে? বজ্রপাত কী হবে কখনো এই হায়েনাগুলোর উপর? এই ছয় মাসে মেঘের ডাকও শুনে নি ওরা।

এদেরও থপ থপ হাঁটাহাঁটি থেমে গেছে। এই আলো-আঁধারির ঘরে বন্দি হবার পর হতে ওরা এভাবেই হাঁটাহাঁটি করছে। ওরা সবাই একই সমতলে। একই রকম জীবন যাপন। যাপিত জীবন বিষময় হয়ে গেছে পুরোপুরি।

কেন হঠাৎ বাইরে সুনসান নীরব হয়ে গেলো, কেন হায়েনাদের কেউ ওদের কাউকে নেবার জন্য ভেতরে ঢুকছে না, এ নিয়ে কারো কোনো ভাবনা নেই। প্রথম দিকে কয়েকজন মৃত্যু বরণ করতে পারলেও পরে আর সম্ভব হয়নি। ওরা জন্মদিনের পোষাক পেয়েছে ওদের কাছ থেকে।

ফাঁক ফোঁকর দিয়ে আলো ঢুকায় কাজলি বুঝতে পারলো এখন দিন চলছে। পেট জানান দিচ্ছে সকালের নাস্তা খাবার সময় হয়েছে। এই সময় ওদের নাস্তা নিয়ে আসে সশস্ত্র রাজাকার দুটো। আহা নাস্তা! ওদের উপর ইচ্ছেমতো যৌন-নির্যাতন করা হলেও খাবারটা কখনোই ভালো দিতো না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে ক্রমাগত যৌন নির্যাতন চলতে থাকায় খাদ্য না খেয়ে থাকা যেতো না। প্রথমদিকে কয়েকজন খেতে না চাইলে জোর করে খাইয়ে দিয়েছে। সে আরেক অত্যাচার!

কাজলি এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজা বাইরের দিকে তালাবদ্ধ। ধাক্কা দেয়ায় দুই কপাটের মাঝখানে খানিকটা ফাঁক হলো। সেই ফাঁক দিয়ে বাহির দেখার চেষ্টা করছে কাজলি এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে। কেউ কোথাও নেই! দেশি কুত্তা রাজাকারগুলো যেগুলো দারোয়ানের দায়িত্ব পালন করতো, সেগুলোর একটাকেও দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে কোথাও। পাকিস্তানি হানাদারগুলোকেও দেখা যাচ্ছে না কোথাও, হায়েনাগুলোর বুটের আওয়াজও শোনা যাচ্ছে না-সেই বুটের আওয়াজ যত কাছে আসতো, ততো ওদের বুকের কাঁপুনি যেতো বেড়ে।
আরো ভালো করে সামনের আশপাশটা দেখে ফিরল ঘরের ভেতরে। সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ওরা মোট তের জন।

একজন কাজলির সামনে এসে বললো, কী দেখলা? আইতাছে? অহন কার পালা হইবো?

আরেকজন এসে বিষন্ন কণ্ঠে বললো, আমি আর পারছি না রে!

তৃতীয় আরেকজন এসে দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে দিয়ে বললো, আমাকে নিতে মানা কইরো তোমরা। আমার মাসিক হইছে।

কাজলি কে? ওর নিষেধ হায়েনাগুলো শুনবে কেন? ওকে যে নেবে না এর কী নিশ্চয়তা আছে? এখানে কে কাকে সাহায্য করবে? সবাই তো হায়েনাদের নির্মম শিকার। কাজলি কিছু বলতে পারলো না ওদের।
কাজলি কিছু না বলায় একজন এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। দরজায় ফাঁক দিয়ে বাইরে কিছু লোকের ছুটাছুটি করতে দেখে আঁতকে উঠে সরে এলো।

নিশ্চয়ই পাক হানাদার আক্রমণ করেছে গ্রামে। আর কতকাল চলবে এমন অত্যাচার? জ্বালাও-পোড়াও নিরীহ মানুষ হত্যা আর কতো চলবে? আবার কতগুলো অবলা নারীকে এখানে ঢুকানো হবে ইচ্ছেমতো যৌন-অত্যাচার করার জন্য।

কাজলি ওর সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো, কী হলো? তুমি ভয় পেয়ে সরে এলে কেন সাফিয়া? কী দেখেছো?
সাফিয়া বললো, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ফের গ্রাম আক্রমণ করেছে। গ্রামের লোকজন ছুটাছুটি করছে।

কাজলি পড়ে গেলো দ্বিধায়। ক্যাম্পের হানাদারগুলোই কী গ্রাম আক্রমণে গেছে? রাজাকারগুলোও সাথে করে নিয়ে গেছে? এভাবে ক্যাম্পকে অরক্ষিত রেখে? ব্যাপারটা দেখতে হবে ভালো করে।

কাজলি এগিয়ে গেলো ফের দরজার দিকে। বাইরে তাকিয়ে বাস্তবিকই গ্রামের লোকদের ছুটাছুটি করতে দেখছে। তবে ওরা ভয়ার্ত না-চোখে-মুখে আনন্দ। ব্যাপার কী?

কাজলি সাফিয়াকে বললো, লোকগুলোর চোখেমুখে আনন্দ খেলা করছে। পাক বাহিনী আক্রমণ করলে এমনটা হতো না। আমার মনে হয় পাক হানাদার পালিয়ে গেছে এই ক্যাম্প ছেড়ে। আশেপাশে নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনী আছে।
সাফিয়া একটু উল্লসিত স্বরে বললো, তাহলে আমরা ওদের ডাকি! তালা ভেঙ্গে আমাদের এই বদ্ধ ও অভিশপ্ত ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাক!

আরেকজন দুই কদম এগিয়ে এসে বললো, আমাদের গায়ে তো কোন কাপড় নাই। ওরা আমাদের এভাবে দেখে ফেলবে যে!

সাফিয়া চমকে বললো, তাই তো!

এতক্ষণ ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে ওদের কথাবার্তা শুনছিলো সবাই। একজন এগিয়ে এসে বললো, এটা নিয়ে দুশ্চিন্তার কী আছে! ওরা এলে বলবো আমাদের আগে পরনের কাপড় দেও। তারপর দরজার তালা খোলো।

সাফিয়া বললো, এই সহজ কথাটা আমাদের কারো মাথায় আসছিলো না কেন রোকেয়া আপা?

রোকেয়া কিছু না বলে এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। বাইরে লোকজনের ছুটাছুটি আছে; কিন্তু কেউ এদিকে তাকাচ্ছে না! রোকেয়া চিৎকার দিয়ে ডাক দিলো ওদের, এই যে ভায়েরা! এদিকে আসেন! আমরা এখানে বন্দি হয়ে আছি!

কেউ ওর চিৎকার শুনেছে বলে মনে হলো না। রোকেয়া কয়েকবার চিৎকার দিয়ে ব্যর্থ হয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো, আমার একার চিৎকারে কাজ হচ্ছে না। সবাইকে একসাথে চিৎকার করতে হবে এবং সাথে সাথে দরজায় ধাক্কা দিতে হবে।

তেরো জন এগিয়ে এলো দরজার কাছে। দরজা ধরে নাড়ানোর সাথে সাথে চিৎকার করতে থাকলো উল্লসিত লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য।এভাবে অনবরত চিৎকার করতে থাকায় একটি বালক এগিয়ে এলো এদিকওদিক তাকাতে তাকাতে।

বালকটি কাছাকাছি এলে রোকেয়া বললো, তোমরা দৌড়াদৌড়া করছো কেন? কী হয়েছে?

বালকটি বললো, হুনতাছি দ্যাশ স্বাধীন হওয়া গেছে। খুব আনন্দ!

কথাটা শুনে বিড়ম্বিতা নারীগুলোর মুখের বিষন্নতা ছাপিয়ে স্বস্তি ও ভরসার হাসি ফুটে উঠলো-বিষন্নানন্দ। ওরা একে অপরকে কোলাকোলি করতে লাগলো।

রোকেয়া ফের জিজ্ঞেস করলো, এই ক্যাম্পের হায়েনা পাক বাহিনী আর কুত্তা রাজাকারগুলা কই গেলো জানো কিছু?

ছেলেটা বললো, সকালে পালানোর সময় মুক্তিরা ওদের ধইরা ফালাইছে। অহন এদিকে লইয়া আইতাছে।

রোকেয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো, তাহলে আর চিন্তার কিছু নাই। তবু তুমি এক দৌড় দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বলো আমরা এখানে আটকা পড়ে আছি।

জ্বী আইচ্ছা।

বলে ছেলেটা দৌড়াতে লাগলো।

আর এরা খুশিতে ও মুক্তির আনন্দে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কাঁদতে লাগলো।

জয়বাংলা জয়বাংলা শ্লোগান শুনতে পেয়ে সবাই তাকালো দরজার ফাঁক দিয়ে বাইরে।

ওরা আসছে স্কুলের দিকে। সামনে সারিবদ্ধভাবে মাথার উপর দুই হাত তোলা অবস্থায় রাজাকারের পরে পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা। ওদের পেছনে স্ট্যানগান ও রাইফেল উঁচিয়ে বাংলার দামাল মুক্তিযোদ্ধাগণ। পরনে হাঁটু অব্দি গুটানো পেন্ট, কারো গায়ে গেঞ্জি, কারো গায়ে শার্ট-দুটোই ময়লা; ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল ও এলোমেলো মুখভর্তি দাড়ি।

মুক্তিযোদ্ধাগণ সামনে এসে শূয়রগুলোর দিকে অস্ত্র তাক করতেই দাঁড়িয়ে গেলো মাঠের মাঝ বরাবর। মোট পনেরো জন মুক্তিযোদ্ধা। চারজন এগিয়ে আসছে এদিকে। সরাসরি আসছে ঘরটার দিকে। ঘরটার চারিদিকে একবার দেখে দরজার সামনে দাঁড়ালো চার মুক্তিযোদ্ধা।

একজন রাইফেলের বাট দিয়ে তালা ভাংতে চাইলে ভেতর থেকে রোকেয়া বললো, তালা ভাঙবে না মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা!
মুক্তিযোদ্ধাটি রাইফেল নামিয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, কেন? আপনারা বের হতে চাচ্ছেন না?

আমাদের গায়ে কোনো কাপড় নেই। এ অবস্থায় বের হওয়া কি ঠিক হবে?

মুক্তিযোদ্ধাটি লজ্জা পেয়ে বললো, সরি! আমি এখনই হানাদারদের ক্যাম্প থেকে কিছু কাপড় নিয়ে আসছি। আপনারা কত জন?

কাজলি দ্রুত বললো, না না! এই হায়েনাদের কাপড় আমরা পরবো না! আপনারা পাশের গ্রাম থেকে শাড়ি ছায়া ব্লাউজ লুঙ্গি যা পারেন নিয়ে আসেন। আমরা তের জন।

চার জনই ছুটে চলে গেলো। ওদের মাঝে আজ বিজয়ের শক্তি ও অপার আনন্দ। গ্রামে ঢুকে কয়েকটা বাড়ি থেকে শাড়ি ছায়া ব্লাউজ লুঙ্গি যে যা দিয়েছে তাই নিয়ে ওরা চলে এলো ক্যাম্পে। দরজার ফাঁক দিয়ে একটা একটা করে কাপড় ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো, এবার আপনারা এগুলো পরে ফেলুন।

কাপড় পরা শেষ হলে আমাদের বললে তালা ভেঙ্গে ফেলবো।

রোকেয়া শান্ত কণ্ঠে বললো, একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে যে মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা।

অপর একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো, কী সমস্যা বুবু?

রোকেয়া বললো, মাঠের মাঝে মাথার উপর হাত তোলে দাঁড়িয়ে থাকা হায়েনাগুলো মাসের পর মাস আমাদের উপর যৌন নির্যাতন করেছে। ওদের সামনে আমরা যেতে চাই না।

কী করতে বলেন আমাদের বুবু? আপনাদের কথা আমরা রাখতে চেষ্টা করবো।

এবার রোকেয়া ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বললো, ঐ কুত্তাগুলোকে আপনারা মেরে ফেলুন! যদি না মারেন তাহলে এই কাপড় গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করবো! এমনিতেই এ অবস্থায় আমাদের সমাজে ঠাঁই হবে কিনা জানি না!

মুক্তিযোদ্ধাটি বললো, এ বিষয়ে আমাদের কোম্পানি কমান্ডারের সাথে কথা বলতে হবে।

তাই করুন মুক্তিযোদ্ধা ভায়েরা। আর একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের এখান থেকে জোর করে বের করতে পারবেন না! আমরা ভেতর থেকে দরজার খিল আটকে দিচ্ছি। আমাদের দাবি পূরণ না হলে আমরা সবাই একসাথে ঘরের ধন্নার সাথে ঝুলে আত্মহত্যা করতে থাকবো!

এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ভাবেনি এই চার মুক্তিযোদ্ধা। ওরা অস্ত্র উঁচিয়ে দৌড়ে চলে গেলো মাঠের মাঝখানে কোম্পানি কমান্ডারের কাছে। কোম্পানি কমান্ডারকে কথাগুলো বললে মুহূর্ত মাত্র না ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন কোম্পানি কমান্ডার।

কাঁটা – রানা জামান

কালপুরুষের জীবনে অনন্যার প্রেমলাভ আকাশের চাঁদ প্রাপ্তির চেয়েও বেশি, অনেক বেশি। নখদর্পণে হিসাবের জমানায় শতভাগ বেকারের প্রেমে অনন্যা ছাড়া পড়েনি আর কেউ। এই ভাবনায় কালপুরুষ অনন্যার সামনে হয়ে যায় আব্দুর রহমান বয়াতি অথবা লালন শাহ।

অনন্যার প্রেম আগ্রাসী ভীষণ। সপ্তাহ ফুরোবার আগেই অনন্যা ওকে নিয়ে যায় বাড়িতে। কালপুরুষ প্রথমে যেতে চায় না। এতো তাড়াতাড়ি প্রেমিকার বাড়ি গিয়ে হবু শ্বশুর-শাশুড়ির বকা খেতে সে কোন মতেই রাজি হতে চায় না। কিন্তু প্রেমিকা গো ধরলে প্রেমিককে হতেই হয় কুপোকাত। সমস্যা দেখা দেয় ওর নাম ও পোশাক নিয়ে। অনন্যার ভাষায়: এই উদ্ভট নাম ও সয়ে নিলেও মা-বাবা কখনই সইবে না; ভাইটা তো প্রথমে বিদ্রূপ হাসবে, তারপর দিয়ে দেবে একটা আবোলতাবোল নাম। একবার ঐ নাম মা-বাবার পছন্দ হয়ে গেলে পাল্টাবে এমন সাধ্য কারো নেই।

অনন্যার টাকায় কেনা পোশাক পরতে কালপুরুষ রাজি হলেও নাম পাল্টাতে রাজি হয় না কিছুতেই। সে যতবার এই নাম রাখার শানেনূযুল বলতে চায়, ততবার অনন্যা ওকে দেয় থামিয়ে। ঘটনার দিন কালপুরুষকে দেখে অনন্যা বেকুব-রাগবে না কাঁদবে, বুঝতে পারে না। কালপুরুষ ওর কেনা পোশাক না পরে নিজেরটাই পরে আসে, যা অন্যান্য গত এক সপ্তাহ ধরে ওর গায়ে দেখে আসছে: কুচকানো হাফহাতা শার্ট, নিচের দিকে বর্ডার ছেড়া জিন্সের প্যান্ট ও গোড়ালির দিকে ক্ষয়ে ফুটো হয়ে যাওয়া স্পঞ্জের চপ্পল। অনন্যা সেখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে ফুটপাতে। পথচারীদের প্রত্যেকেই যাবার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে ওকে বারবার দেখতে থাকে। নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ায় বারবার ফোন আসতে থাকে বাড়ি থেকে অনন্যার মোবাইল ফোনে। অনন্যা আরেক সেট নতুন পোশাক কালপুরুষের জন্য কিনতে পারতো;কিন্তু ওর মনেও জেদ আসে যে এভাবেই ওকে বাসায় নিয়ে যাবে, যা থাকে কপালে। অত্যন্ত কঠিন কষ্ট হবে যদি এই নির্বিকার লোকটা বিয়ের পর গাছতলায় থাকার গো ধরে!
নিঃসঙ্কোচেই কালপুরুষ অনন্যার পাশাপাশি বাসায় ঢুকে।

নাম ও সম্পর্ক জানার সাথে সাথে অনন্যার বড় ভাই ইকরাম ফরিদ তেড়ে আসে ওকে মারতে। ড্রয়িংরুমে হৈ চৈ শুনে মা-বাবা একত্রেই ছুটে আসেন ড্রয়িংরুমে।

বাবা ফরিদ আজহার ছেলের হাত ধরে টেনে রাখেন আর মা আস্রফিয়া ফরিদ মেয়ের কাছে ঘটনা শুনে হাসিতে ফেটে পড়েন। সাথে সাথে ফরিদ আজহারও হাসতে থাকে। অনন্যা ও কালপুরুষকে বসার ইঙ্গিত দিয়ে আস্রাফিয়া একটা একক সোফায় বসেন। ফরিদ আজহার ছেলেসহ একটি সোফায় বসেন।

হাসি থামিয়ে চোখের কোণের অশ্রুবিন্দু মুছে আস্রাফিয়া ফরিদ বলেন, খুশিতে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। আমি অনন্যার জন্য এমনই একটা ছেলে খুঁজছিলাম।

ইকরাম ফরিদ বিস্মিত হয়ে মার দিকে তাকিয়ে বলে, কী বলছো তুমি মা!

ছেলের মন্তব্য বিবেচনায় না এনে ফরিদ আজহার বলেন, ঠিক তাই। এই যে বাবা, তুমি কালকেই তোমার মা-বাবাকে নিয়ে এসো। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক করে ফেলবো!

আস্রাফিয়া ফরিদ বলেন, আমরা এখন হবু জামাতাকে নিয়ে হোটেল লা-মেরিডিয়ানে সেলিব্রেট করতে যাবো। ওকে?
কল্পনাতীত হলেও অনন্যা অত্যন্ত খুশি। সে বড় ভাইকে ভেংচি কেটে কালপুরুষের হাত ধরে চলে যায় নিজ শয্যাকক্ষের দিকে।

ওদিকে কালপুরুষ পড়ে যায় ঘোরের মধ্যে। রাতের ঘুম তার উধাও! আসলেও গতকাল ওরকম কোন ঘটনা ঘটেছে কিনা তা যাচাই করার জন্য অনন্যার সাথে দেখা করার সিদ্ধান্ত নেয় সে। প্রকৃতপক্ষে ওর তরফ থেকে কোন টান সৃষ্টি না হওয়ায় অনন্যার মোবাইল ফোন নম্বর নেবার কথা মনে হয়নি ওর। সে বাসে করে এবং বাকি পথটা হেটে চলে আসে অনন্যাদের এপার্টমেন্টের সামনে।

এপার্টমেন্টের সামনে অনেক লোক। সবাই অনন্যাদের ফ্লাটের দিকে তাকিয়ে। আসলে এরা ফ্লাটটায় ঢুকতে পারছে না-এপার্টমেন্টের সামনে থেকে সিঁড়িঘর হয়ে ওদের দোতলার ফ্লাট পর্যন্ত প্রচুর লোক। অনেক ঠেলাঠেলি টানাটানি গুঁতাগুঁতি করেও কালপুরুষ সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে পারে না। উপরে উঠার হাল ছেড়ে দিয়ে উপরে কী হয়েছে একজনকে জিজ্ঞেস করে।

ভদ্রলোক বলেন, ফরিদ সাহেবের ভাস্তিটা গতরাতে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

পাশের আরেকজন বলেন, মেয়েটা মরে যাওয়াতে ছেলেটার পথ পরিস্কার হয়ে গেলো।

ভালোবাসার ভিন্ন মূল্য – রানা জামান

মোবাইল ফোনে মিসড কল হতে পারে, ভুল ডিজিট টিপে দেবার কারণে অন্য নম্বরে কল চলে যেতে পারে। কিন্তু ক্রস কানেকশন? এটাও হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। গায়ে না লাগালে বিন্দাস জীবন; আর প্রলুব্ধ হলে ভালো বা খারাপের যে কোনো একটা ঘটতে পারে। অর্থাৎ ঘটে যেতে থাকবে ঘটনা।

নাদিয়ার জীবনে তেমনই ঘটনা ঘটে চলেছে। ভাবনার অতীত!

নাদিয়া কল করেছিলো মাকে। সংযোগ হবার পরে হ্যালো বলতে গিয়ে থেমে গেলো নাদিয়া। মার হ্যালোর জবাব না দিয়ে অন্য আরেকটা কথোপকথন শুনছে।
-মাস্ক সমস্যা! মাস্ক পরলে দম নিতে বা ফেলতে সমস্যা হয়! মাস্ক না পরলে করোনাভাইরাস! এখন আবার আরো শক্তিশালী ওমিক্রন ভ্যারাইটি!

অজান্তেই নাদিয়া হেসে দিলে বন্ধ হয়ে গেলো ওদিকের কথোপকথন। নাদিয়া ঠোঁট উল্টে মার সাথে সংযোগ স্থাপন করে কথা বললো। অদরকারি বাঁধা-ধরা কথাবার্তা।
— কেমন আছো মা?

— কী করছো?

— নাস্তা দেরি করে খাও কেন?

— বাবাকে বাজারে না পাঠিয়ে বেকার ভাইয়াকে পাঠালেই পারো!

— আমার লেখাপড়া চলছে!

— অনলাইনে ক্লাসের চাপ কম থাকলেও এসাইনমেন্টের চাপ বিস্তর!

— পরীক্ষা কিভাবে হবে এখনো জানায়নি।

— অটোপ্রমোশন না হলেই ভালো।

মার সাথে কথা শেষ হবার সাথে সাথে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে রিং হলো। ও অপরিচিত নম্বরের কল গ্রহণ করে না। পরপর তিনবার রিং এলেও ও ধরলো না।

ম্যাসেজ টোন এলে নাদিয়া খুলে দেখলো একটা অনুরোধ:

— একটু আগে ক্রস-কানেকসনের আমি। কলটা ধরুন। প্লিজ!

কী এক অমোঘ টানে ঐ নম্বর থেকে কলটা এলে নাদিয়া ধরে পড়ে গেলো আটকা। একেবারে জিগারের আঠায়! বাড়তে থাকলো কলের সংখ্যা এবং আলাপের সময়। ওর নাম ইস্তিয়াক। কোনো এক অজানা কারণে ইস্তিয়াকের ফোন নম্বরে ধ্যান দেয়নি নাদিয়া।

ইস্তিয়াক ভিডিও কল করলে নাদিয়া ওর পেছনের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, জায়গাটা কোথায় ইস্তি?

ইস্তিয়াক টি-শার্টের কলার নেড়ে বললো, ফুকেট।

অবাক হয়ে নাদিয়া বললো, অনেক সুন্দর ফুকেট! বাংলাদেশের কোথায় এটা? আগামী সপ্তাহে ওখানে বেড়াতে যাবো।

— ফুকেট বাংলাদেশে না, থাইল্যান্ডে।

— কী বলছো তুমি! কবে তুমি থাইল্যান্ড গেলে?

— আমি থাইল্যান্ডে থাকি।

— বাহ! আমার থাইল্যান্ডে যাবার খুব সখ।

— আমি ভিসা পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি আগামী সপ্তাহে চলে এসো।

— একা আসবো?

— সমস্যা কী! আমি হার্মফুল না!

থাইল্যান্ড প্রবাসী জামাই পাবার প্রত্যাশায় মা-বাবা নাদিয়াকে থাইল্যান্ড যাবার অনুমতি দিলেন। নাদিয়ার ভাগ্য দেখে ওর বান্ধবীরা করতে থাকলো ইস্ ইস্!

আজ নাদিয়া থাইল্যান্ড যাচ্ছে। পরিবার ও বান্ধবীরা ওকে বিদায় জানাতে এসেছে। নাদিয়া ছাগলছানার মতো ছটফট করছে। তখন ইস্তিয়াক ফোন করে একটা প্যাকেট নিয়ে আসতে বললো যা ওর এক আত্মীয় দিয়ে যাবে বিমানবন্দরে। লোকটা বিমানবন্দরেই ছিলো। সাথে সাথে এসে হাজির। প্যাকেট খুলে দেখালো:

কুমড়োবড়ি।

প্যাকেট নিয়ে নাদিয়া চলে এলো থাইল্যান্ড। থাইল্যান্ডে তিন দিন অনেক আনন্দে কাটলো নাদিয়ার। আশ্চর্য হয়েছে নাদিয়া সুযোগ পেয়েও ইস্তিয়াক ওকে স্পর্শ না করায়। বেশ কেনাকাটা করে নাদিয়া ফিরে এলো বাংলাদেশে। থাইল্যান্ড বিমানবন্দরে একটা ফলের প্যাকেট আনতে হলো নাদিয়াকে।

নাদিয়া বুঝতে পারলো ইস্তিয়াককে ও খুব ভালোবাসে। ও খুব ভালো ও পরিশীলিত। আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ভালোবাসি’ কথাটা না বললেও ভিডিও ও ননভিডিও কলে প্রেমের কথাই চলে। তিনমাস পরে ফের থাইল্যান্ড যাবার সুযোগ পেলো নাদিয়া। পূর্বের মতো এবার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চ্যাপার প্যাকেট পেলো নিয়ে যাবার জন্য। ফেরার সময় একটা ঔষধের প্যাকেট আনতে হলো ওকে।

বার্ষিক পরীক্ষার পরে লম্বা ছুটি নাদিয়ার। চলে এলো ছুটি কাটাতে থাইল্যান্ডে। মা-বাবা সাথে আসতে চাইলে আনন্দ নষ্ট হবে ভেবে নাদিয়া রাজি হলো না। উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো ইস্তিয়াক এবারও। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে গেলো পাতায়া। চারতারা হোটেলে একক কক্ষ পেলো নাদিয়া। ইস্তিয়াক পাশের কক্ষে। এবার পাঁচ দিনের ভ্রমণ। পাতায়া চষে বেড়ানোর পরে এক রাতের জন্য চলে গেলো ফুকেট। পঞ্চম দিন ওখান থেকে বিমানবন্দরে যাবার প্রস্তুতি চলছে নাদিয়ার।
লাগেজ নিয়ে কক্ষ থেকে বের হলে নাদিয়ার হাত থেকে লাগেজটা নিয়ে ইস্তিয়াক বললো, তুমি লাগেজ নিচ্ছো কেন! এটেন্ডেন্ট নিয়ে আসবে। চলো আমরা লবিতে যাই।

লাগেজ তোলার পরে ওরা বসলো জিপে। বিমানবন্দরে পৌঁছে নাদিয়াকে ইমিগ্রেশনে ঢুকিয়ে ইস্তিয়াক চলে গেলো বিদায় নিয়ে। ডিউটি-ফৃ শপ থেকে কিছু কেনাকাটা করে বিমানে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়ালে মাইকে নাদিয়ার ডাক পড়লো এবং বিমানবন্দর কাস্টমসের এক কর্মকর্তা ওকে নিতে এলো। নাদিয়া কাস্টমস অফিসে গিয়ে ওর লাগেজ দেখতে পেয়ে হতবাক। লাগেজ খোলা এবং কাপড়ের ভাঁজে ভাঁজে শাদা পলিথিনের প্যাকেট।

নাদিয়া এসব প্যাকেটের বিষয়ে কিছু জানে না বললে ও এতোদিন থাইল্যান্ডে কোথায় কার সাথে ছিলো জানতে চাইলে নাম বলে মোবাইল ফোন থেকে ইস্তিয়াকের ছবি দেখাল।

ছবি দেখে এক কাস্টমস অফিসার বললেন, এর নাম ইস্তিয়াক না, জাফর! ও কুখ্যাত বাংলাদেশি স্মাগলার হায়দার পাঠানের ভাতিজা!

হেলমেট – রানা জামান

বারবার হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছেন সার্জেন্ট প্রলয়কান্তি মজুমদার -বুকের নামফলকে যার নাম প্রলয়। প্রলয় বটে এই সার্জেন্ট-সকল প্রকার যানের চালকের জন্য। এবং এই অবস্থাটা অধিক থাকে সকাল আটটা হতে দুপুর দুইটা পর্যন্ত। এই সময়ে প্রত্যেক সার্জেন্টকে যে কোন ধরনের গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পূরণ করতে হয় লক্ষ্যমাত্রা। এই সময়ের মধ্যে পান থেকে চুন খসলেই খবর হয়ে যায়-শীর্ষ পর্যায়ের তদবিরেও হয় না কাজ! তাই ভয়ঙ্কর সময় তখন গাড়িচালকদের। গাড়িচালকরাও চেষ্টা করে নিরানব্বই দশমিক নিরান্নব্বই ভাগ ট্রাফিক নিয়ম অনুসরণ করতে। অন্য সময়ে অন্যরকম ব্যবস্থা চলে।

দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে সময়। আর একটা মামলা দায়ের করতে পারলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ঐ দিনের জন্য।সার্জেন্ট প্রলয় বারবার হাতঘড়ি ও আসা-যাওয়া গাড়িগুলোর দিকে তাকাচ্ছেন। লক্ষ্যমাত্রার একটা মামলা কম হলে ভর্ৎসনাসহ দশ হাজার টাকা জরিমানা। জরিমানা প্রদান সহ্য হলেও ভর্ৎসনা শোনার চেয়ে মৃত্যু অনেক আরামের! পুলিশের ভর্ৎসনা মানে মা-বাবা-বোনকে নিয়ে অকথ্য গালিগালাজ!

হঠাৎ আশা পূরণের আলো দেখতে পেয়ে সার্জেন্ট প্রলয়ের চোখ চকচক করে উঠলো। পাওয়া গেছে! সময় ফুরিয়ে যাবার আগেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হচ্ছে, ইনশাআল্লাহ!

মোটর বাইক কাছে আসতেই হাত ইশারায় থামতে বললেন সার্জেন্ট প্রলয়। বাইকে দুইজন যাত্রী-চালকের মাথায় হেলমেট আছে; কিন্তু পেছনের ভদ্রমহিলা হেলমেটটা রেখেছেন হাতে।

লঙ্ঘন কী হয়েছে বুঝতে না পারলেও বাইকটা ফুটপাতের কাছাকাছি নিয়ে থামালেন বাইকের চালক। সার্জেন্ট প্রলয় কিছু না বলে কোমরে ঝুলিয়ে রাখা একটা থলে থেকে ছোট মেশিনটা বের করে গটাগট টাইপ করতে লাগলেন।

মোটরবাইক চালক জিজ্ঞেস করলেন, সার্জেন্ট সাহেব, দোষ কী আমার বলবেন দয়া করে? কোনো কিছু জিজ্ঞেস না করে আপনি মামলা করতে পারেন না। আমার কাছে গাড়ির হালনাগাদ কাগজপত্র আছে; ড্রাইভিং লাইসেন্সও হালনাগাদ করা আছে। মাথায় হেলমেট আছে, কোন ট্রাফিক রুলও ভায়োলেট করি নাই।

টাইপ শেষ হলে প্রিন্ট কপি বের করে একটা স্বস্তির হাসি দিয়ে সার্জেন্ট প্রলয় বললেন, আপনার যাত্রী হেলমেট মাথায় না পরে হাতে ধরে রেখেছেন। এর জন্য মামলা হচ্ছে। দুই শত টাকা জরিমানা।

ভদ্রমহিলা বললেন, এর জন্য আপনি মামলা করতে পারেন না সার্জেন্ট সাহেব!

সার্জেন্ট প্রলয় চোখের তারা নাচিয়ে বললেন, কেন মামলা করতে পারবো না, বলবেন কী?

ভদ্রমহিলা হেলমেটটা দেখিয়ে বললেন, এই হেলমেটটা আমার মাথায় ঢুকে না।

ছোট হেলমেট গাড়িতে রেখেছেন কেন? তাহলে বাইকারের বিরুদ্ধে মামলা হবে!

ভদ্রমহিলা বাইকারের হেলমেটটা নিয়ে মাথায় পরার চেষ্টা করে বললেন, এই দেখেন, এটাও লাগে না! আপনার হেলমেটটা দেন দেখাই পরে। আমার মাথায় কোন হেলমেট লাগে না। আমার মাথাটা একটু বড় কিনা!

সার্জেন্ট প্রলয় থমকে গিয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি আপা!

বলে পাশে রাখা নিজ মোটরবাইক থেকে হেলমেটটা ভদ্রমহিলার হাতে দিলেন। ভদ্রমহিলা হেলমেটটা হাতে নিয়ে মাথায় পরার চেষ্টা করে দেখালেন-বাস্তবিকই মাথায় ঢুকছে না।

মোটরবাইক ড্রাইভার বললেন, কোন হেলমেট-ই যদি মাথায় না ঢুকে, তাহলে উনি কী করতে পারেন! মামলার ঐ কাগজটা আপনার কাছেই থাকুক সার্জেন্ট সাহেব! আমরা যাই। কেমন? আমাদের একটু তাড়া আছে! সিন্থিয়া, সার্জেন্ট সাহেবের হেলমেটটা ওনার হাতে দিয়ে দাও।

সার্জেন্ট প্রলয় হেলমেটটা হাতে নিলে ওরা মোটরবাইক স্টার্ট দিয়ে গেলো চলে। আর সার্জেন্ট প্রলয় হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন লক্ষ্যমাত্রা পূরণের সময় পেরিয়ে দশ মিনিট হয়ে গেছে। হাতে ধরা মামলা দায়েরের স্লিপটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললেন: জরিমানা ও গালিগালাজ দুটাই বরাদ্দ হয়ে গেলো আজ! কিন্তু কোন হেলমেট-ই লাগবে না এতো বড় মাথা ভদ্রমহিলার! হাউ স্ট্রেঞ্জ!

রানা জামান | Rana Zaman

Bengali Story 2022 | জয়ন্ত কুমার সরকার | গল্পগুচ্ছ ২০২২

Bengali Story | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | গল্পগুচ্ছ | 2022

Bengali Story 2023 | শুভদীপ দত্ত প্রামানিক | অণুগল্পগুচ্ছ ২০২৩

Bengali Story 2022 | বন্ধুর বিয়েতে গিয়ে | প্রবোধ কুমার মৃধা

Anandabazar Bengali Short Story | Bengali Short Story | Pratilipi Horror Stories in Bengali | Lifestyle Web Stories in Bangla | Trending online bangla golpo pdf free download | Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | Bangla Golper Boi Online pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Bangla Golper Boi Online in english | Trending online bangla golpo pdf download

suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Bangla Golper Boi Online | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Trending Bangla Golper Boi Online | Pdf Bangla Golper Boi Online | Bangla Golper Boi Online App | Full Bangla Golper Boi Online Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Trending online bangla golpo pdf

Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Bangla Golper Boi Online 2024 | New Bangla Golper Boi Online – Episode | Golpo Dot Com Series | Bangla Golper Boi Online Video | Story – Bangla Golper Boi Online | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Bangla Golper Boi Online Netflix | Audio Story – Bangla Golper Boi Online | Video Story – Bangla Golper Boi Online | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Top Bangla Golper Boi Online | Bangla Golper Boi Online Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Trending online bangla golpo book pdf

Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Bangla Golper Boi Online | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Trending online bangla golpo free download

Leave a Comment