Stories of Bhubaneswar Mondal
Bangla Galper Diary | Read Online Golper Diary
ফাঁদ
গোপনবাবু একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করেন। বয়স প্রায় বিয়াল্লিশ বছর। বাড়িতে রয়েছে স্ত্রী ও এক ছেলে। ছেলে হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছে। রোজ দশটা পাঁচটা অফিস করেন। তারপর ক্লান্ত শরীরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে টিফিন সেরে রেস্ট নেন। বছর দুয়েক হল একটা ভালো কোম্পানির অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনেছেন। আজকাল ফোন মানুষের প্রিয়সঙ্গী। ফোন ছাড়া চলেই না। কত জনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ রাখতে হয়, তাছাড়াও ব্যাংকের কাজকর্ম যেমন মানি ট্রান্সফার, অনলাইন পেমেন্ট এসব ঘরে বসেই যে কোন মুহূর্তে করা যায়। ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজনই হয় না। দোকানে মাল কিনতে গিয়েও নগদ পয়সা নিয়ে যেতে হয় না। ফোনেই পেমেন্ট করা হয়। গোপন বাবুও তাই করেন। ফোনটাকে নয়নে হারান না। whatsapp, facebook করেন। ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা আট হাজার ছাড়িয়ে গেছে। ইউটিউব দেখেন, গান শোনেন, গুগল সার্চ করে অনেক তথ্য জোগাড় করেন। আজকাল বাড়িতে খবরের কাগজ নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। ফোনে ই পেপার পড়েন। একটা নয় বেশ কয়েকটা ইংরেজি বাংলা পেপার পড়ে নেন। এতে অর্থ সাশ্রয় হয়।
সেদিন সন্ধেবেলা ফেসবুকে এক মহিলার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এল। গোপনবাবু অ্যাকসেপ্ট করবেন কিনা ভাবছেন। ক্লিক করে মেয়েটির প্রোফাইল খুললেন। বায়োডাটা দেখলেন। বায়োডাটা থেকে জানা গেল মেয়েটি মুম্বাই শহরের, বয়স ৩২ বৎসর। প্রোফাইল পিকচারের ছবি অনুযায়ী অপূর্ব সুন্দরী। ওয়ালের বিভিন্ন পোস্টগুলো সার্চ করে মেয়েটির বিভিন্ন পোজের ছবি দেখলেন। দেখা গেল বাংলার অনেক মানুষই মেয়েটির বন্ধুত্বের তালিকায় রয়েছেন। মনে হল একাউন্টটা ফেক নয়। অ্যাকসেপ্ট করা যেতেই পারে। তার উপর মেয়েটির যে ছবিগুলো রয়েছে তা বড় আকর্ষণীয়। গোপনবাবু কেন জানি না একটু মোহগ্রস্ত হলেন। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করে ফেললেন। ঘন্টাখানেক পরেই মেসেঞ্জারে ইংরেজিতে একটা মেসেজ এলো বন্ধুত্ব গ্রহণ করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। সৌজন্য বশতঃ গোপনবাবুও শুভেচ্ছা ও শুভকামনা জানালেন।
সপ্তাহখানেক কেটে গেল। গোপনবাবু রোজ অফিসে যান। সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে একটু ফেসবুক করেন। হঠাৎই দেখলেন মেসেঞ্জারে একটি মেসেজ-Hi dear, how are you? দেখলেন মেসেজটি ওই মহিলার কাছে থেকে এসেছে। তারপর দেখলেন মেয়েটি এখন অনলাইনে আছে। কি মনে হলো গোপনবাবু Hi লিখে রেসপন্স করলেন। সঙ্গে সঙ্গে ও প্রান্ত থেকে মেসেজ ভেসে এলো। মেসেঞ্জারে চ্যাটিং শুরু হল। প্রথমে হালকা পরিচয় পর্ব। পরস্পরের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, পছন্দের বিষয় এসব নিয়ে চ্যাটিং চলল। এরপর ও প্রান্ত থেকে মেয়েটি লিখলো আপনি কি রোমান্টিক চ্যাটিং পছন্দ করেন? লেখাটা পড়ে গোপন বাবুর দেহ মনে দোলা দিল। ছবিতে যা দেখা যাচ্ছে তাতে একেবারে সুন্দরী মহিলা। বলা যেতে পারে স্বর্গের ঊর্বশী। গোপনবাবু যেন ওর কথাবার্তায় মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছেন, সেই সঙ্গে মোহগ্রস্ত। সন্ধে সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে নটা পর্যন্ত দু-তলার ঘরে গোপনবাবু একাই থাকেন। স্ত্রী অনুরূপা নিচে রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকে। ছেলে অমিত ওর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত ওর রিডিং রুমে। ধারে কাছে কেউ নেই। ঘরের দরজাও বন্ধ। এই বয়সে রোমান্টিক চ্যাটিং করতে মনে একটু দ্বিধা হল গোপনবাবুর।
সংসারে স্ত্রী আছে, ছেলে আছে এসব করার বয়স আছে কি তার? না এসব করা সাজে? অল্প বয়সী ইয়াং ছেলেরা এসব করতে পারে। গোপনবাবু এসব ভাবছেন কিন্তু তবু মনটা মন্ত্রমুগ্ধের মত টানছে ওই মেয়েটির দিকে। তার কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছে। সারা শরীরে একটা উত্তেজনা খেলা করছে। মনে মনে ভাবছেন এ তো ভার্চুয়াল চ্যাটিং। ওর সঙ্গে তো জীবনেও দেখা হবে না। তা একটু করলে ক্ষতি কি? স্ত্রী অনুরূপা জেনে ফেললে অবশ্য মুশকিল হবে। কিন্তু ও তো নিচে আছে। এখন উপরে আসবেও না। ব্যাপারটার গোপন থাকবে। কাউকে তিনি জানতেও দেবেন না।বহু লোকই এরকম করেন। করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। আরে এটাও তো একটা ইনজয়মেন্ট। একঘেয়ে জীবনে একটা বৈচিত্র্য। জীবনটাকে একটু উপভোগ করা দরকার।এক ইংরেজ কবি তো বলেছেন – জীবনের তলানিটুকু পর্যন্ত পান করে যাব। আরে কয় দিনের জীবন? মরার আগেই জীবনটাকে নেড়ে-চেড়ে, ছুঁয়ে-ছেনে দেখা দরকার। বস্তুবাদীরা তো বলেন পরকাল বলে কিছু নেই, জন্মান্তরও নেই। এই পৃথিবীতে যখন এসেছি ভোগ করতে ক্ষতি কী? এটাও তো এক ধরনের উপভোগ। আর তিনি কারো ওপর জোর করে তো কিছু করছেন না। উভয়ের বোঝাপড়ায় এটা হচ্ছে। তাই নীতির দোহাই দিয়ে উপভোগকে অবহেলা করা বোধহয় যুক্তিযুক্ত নয়। তিনি যদি এটুকু করেন তার সংসার ভেসেও যাবে না। স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদও হবে না।
স্ত্রী জানলে হয়তো রেগে যাবে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত গোপনে এই কাজটা করবেন। তাহলে জানার তো কোন প্রশ্নই নেই। এটা তো কোনো সামাজিক অবৈধ পরকীয়া সম্পর্ক নয়। যে লোক জানাজানি হবে। যাস্ট ভার্চুয়াল সম্পর্ক। তাই আর কোন দ্বিধা মনে না রেখে লিখলেন হ্যাঁ আমি রোমান্টিক চ্যাটিং পছন্দ করি। ওপার থেকে মেয়েটি লিখল তাহলে আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার পাঠান। ভিডিও কলে আমাদের কথাবার্তা হবে। আর হোয়াটসঅ্যাপ অনেক সিকিওর জায়গা। কেউ কোনভাবে জানতে পারবে না। পুরো ব্যাপারটা গোপন থাকবে। তাতে দুজনেরই সুবিধা। গোপন বাবু একটু নাড়া খেলেন। মনে মনে ভাবছেন হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বার দেওয়া কি ঠিক হবে? ফোন নাম্বার নিয়ে অনেকের অ্যাকাউন্ট থেকে হ্যাকাররা মানি ট্রান্সফার করে নিচ্ছে। বহু লোক সর্বস্বান্ত হয়েছে এভাবে। তাই ফোন নাম্বারটা দিতে একটু ভয় ভয় করতে লাগলো গোপনবাবুর। যদি কিছু হয়ে যায়। এই ফোন নাম্বারটাই স্যালারি একাউন্ট ও ব্যাংকের সঙ্গে লিংক আছে। তাই রিস্ক থেকেই যাচ্ছে। তাই মিনিট দুয়েক তিনি ভাবলেন। ওপার থেকে মেসেজ এলো চিন্তার কিছু নেই। আমি ফ্রড নই। আপনার শুধু ফোন নাম্বার নিয়ে কেউ একাউন্ট থেকে টাকা চুরি করতে পারবে না। আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন। এটা একটা যাস্ট ইনজয়মেন্ট। গোপনবাবু বললেন ঠিক আছে নাম্বার পাঠাবো তার আগে মেসেঞ্জারে ভিডিও কলে আপনাকে একবার দেখতে চাই। আমি আগে দেখব এই অ্যাকাউন্টটা খাঁটি কিনা। মেয়েটি জানালো কোনভাবেই মেসেঞ্জারে কল করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। একমাত্র whatsapp এই সম্ভব। তবে সে একটা ছবি পাঠাতে পারে। গোপনবাবু একটু বিভ্রান্ত হলেন। কী করবেন ভেবে উঠতে পারছেন না। মুহূর্তেই ওই সুন্দরী মহিলার একটি অপরূপ ছবি এলো মেসেঞ্জারে। একটি নয় চার পাঁচটি বিভিন্ন পোজের অর্ধ-অনাবৃত দেহের ছবি। ছবিগুলোতে চোখ আটকে গেল গোপনবাবুর। একেবারে মোহগ্রস্ত হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন দেখাই যাক না কী হয়। নাম্বারটা দিয়েই দিই। আর সাত পাঁচ না ভেবে গোপনবাবু তার whatsapp নাম্বারটা মেসেঞ্জারে সেন্ড করে দিলেন মহিলাটিকে। মেয়েটি ধন্যবাদ জানালো এবং বলল কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে হোয়াটসঅ্যাপে তাকে কল করবে।
মিনিট পাঁচেক পরে গোপন বাবুর হোয়াটসঅ্যাপে একটা ভিডিও কল এলো। গোপনবাবু সেটা অ্যাকসেপ্ট করলেন। ফোনের স্ক্রিনে ভাসছে ওই সুন্দরী মেয়ের মুখটা। ওর পোশাক-আশাক একেবারে মডার্ন। মাথায় কোঁকড়ানো ঝাঁকড়া চুল, টিকালো নাক, টানা টানা চোখ, গায়ের রং অত্যন্ত ফরসা। পরে আছে একটা স্কিনটাইট জামা ও প্যান্ট। মুখে গোলাপ ফুলের মত হাসি। ঝকঝকে সাদা দাঁত। ঠোঁটে টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক। কানে দুটো সোনার দুল। তার সৌন্দর্য দেখে গোপন বাবু একেবারে মোহমুগ্ধ। এই বয়সে যে এমন সুন্দরী মেয়ের ভার্চুয়াল সান্নিধ্য পাবেন কোনদিন কল্পনাও করতে পারেননি। পথে ঘাটে অনেক সুন্দরী মেয়ে দেখেছেন। হয়তো কখনো কখনো মনে মনে সান্নিধ্য কামনাও করেছেন। কিন্তু বাস্তবে লোক-লজ্জা ও লোক-নিন্দার ভয়ে ও পথে পা বাড়াতে কোনদিন সাহস হয়নি। আর আজ এই অ্যান্ড্রয়েড ফোনের কৃপায় তিনি যেন হাতে স্বর্গ পাচ্ছেন। মেয়েটি হাসতে হাসতে ডিয়ার সম্বোধন করল গোপনবাবুকে। তারপর হিন্দিতে উভয়ের মধ্যে চলল মিনিট পাঁচেক রোমান্টিক কথাবার্তা।
এক সময় মেয়েটি জানালো আমরা কি আরো ঘনিষ্ঠ হতে পারি? গোপন বাবু বললেন তা কীভাবে সম্ভব? মেয়েটি বলে আমি আমার অনাবৃত দেহ আপনাকে দেখাব। কি আপনি দেখতে রাজি আছেন তো? গোপনবাবু যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। একেবারে মোহাবিষ্ট। শরীরে টানটান উত্তেজনা অনুভব করলেন। তারপর যন্ত্র চালিতের মতো বললেন আমি রাজি। আপনি দেখাতে পারেন। এরপর মেয়েটি একটু একটু করে নিজেকে অনাবৃত করতে থাকলো। লোলুপ দৃষ্টিতে গোপনবাবু সে সব দেখতে লাগলেন। এখন ইচ্ছে করছে মেয়েটির কাছে ছুটে যেতে। কিন্তু এ তো ছবি। ছবিকে কি আর স্পর্শ করা যায়। ও রক্তমাংসের মানুষ হয়েও আপাতত রক্তমাংসের মানুষ নয়। প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে গোপনবাবু এক স্বপ্নের জগতে মুগ্ধ আবেশে আবিষ্ট হলেন। মনে হলো পৃথিবীতে আর কোথাও কেউ নেই। এখন একমাত্র তারা দুটি প্রাণী। মেয়েটি এবার বললো আমার অনাবৃত দেহ তুমি দেখলে এবার তোমার অনাবৃত দেহ আমি দেখতে চাই। তুমি দেখাও। কথাটা শুনে গোপনবাবুর কেমন লজ্জাবোধ হলো। তিনি বললেন ওটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি পারবো না। মেয়েটি বলে উভয়ের এনজয়মেন্ট দরকার। আমারও তো একটা মন আছে, বাসনা আছে। প্লিজ ডিয়ার না কোরো না। লজ্জা পাবার কোন কারণ নেই। তুমি নিশ্চয়ই ঘরে একা আছো। আশেপাশে তো কেউ নেই। আমিও ঘরে একা। আমার মা-বাবা এখন বাড়িতে নেই। এই সুযোগটাকে আমি কাজে লাগিয়েছি। প্লিজ আমি দেখতে চাই, তুমি আমার দেখার খিদে মেটাও।
গোপনবাবু ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত মোবাইল স্ক্রিনের সামনে নিজেকে উন্মুক্ত করলেন। মিনিট তিনেক এই অবস্থায় তাদের মধ্যে নানা রোমান্টিক কথাবার্তা হলো। তারপর মেয়েটি বলল আজ এখানেই থাক আবার পরের দিন হবে। ঠিক এই সময়ে তুমি আমাকে কল করে নিও। আমি রেডি থাকবো। গোপনবাবু নিজেকে ধন্য মনে করলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। ওই মেয়েটির দেহসৌন্দর্য তার মনে দোলা দিতে লাগলো। এখন মনে হচ্ছে আরো কিছুক্ষণ কলে থাকলে ভালো হতো, যেন পোষালো না। নিজের মনকে নিজেই সান্ত্বনা দিলেন আগামীকাল তো আবার হবে। পরের দিন অফিস থেকে ফিরে এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। সারাদিন মনটা মেয়েটির সান্নিধ্য পাবার জন্য ছুকছুক করছিল। তিনি অপেক্ষা করতে পারছেন না। অনুরূপা এসবের বিন্দুবিসর্গ কিছুই জানে না। সে এখন নিচের তলায় রান্নাঘরে নিজের কাজে ব্যস্ত। স্বামীর প্রতি কোনদিন কোন সন্দেহ তার নেই। ছেলে অমিত টিউশনি পড়তে গেছে। দু তলা একেবারে ফাঁকা। টিফিন খেয়ে এসে ঠিক সাড়ে সাতটা বাজতেই ভয়েস কল করলো মেয়েটিকে। ফোনের ও প্রান্ত থেকে মেয়েটি উত্তর দিল তুমি এসে গেছো? আমি এখনই ভিডিও কল করছি। মিনিট খানেকের মধ্যেই আবার ভিডিও কলে সেই রোমান্টিক দৃশ্য শুরু হলো। গোপনবাবু সেই দৃশ্যের মধ্যে ডুবে গেলেন। মেয়েটির কথামতো নিজেকে আবার উন্মুক্ত করলেন। মিনিট দশেক পরে চিত্রনাট্য শেষ হলো।
পরের দিন ঠিক একই দৃশ্য অভিনীত হওয়ার পর মেয়েটি বলল তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে। খুব জরুরী কথা। গোপনবাবু বললেন – বলো। মেয়েটি বলল দুদিন ধরে তুমি যা দেখলে তার দাম দিতে হবে। গোপনবাবু হতবাক হয়ে বললেন- তার মানে? মেয়েটি বলে মানে খুব স্পষ্ট। তোমাকে সত্তর হাজার টাকা দিতে হবে। আমি আমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিচ্ছি ট্রান্সফার করে দাও। গোপন বাবুর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এরকম যে হবে তিনি কল্পনাও করেননি। গোপনবাবু বললেন আমি তো নিজে থেকে তোমাকে কোন প্রস্তাব দিইনি। বরং তুমি নিজে থেকে প্রস্তাব দিয়েছিলে। আর এই প্রস্তাবে আমি রাজি হয়েছিলাম। দুজনের সহমতেই এটা হয়েছে। তার জন্য টাকা দিতে যাব কেন? মেয়েটি এবার কড়া মেজাজে বলল- যদি সত্তর হাজার টাকা না দাও তাহলে তোমার ন্যাকেড ছবি আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেবো। তোমার ন্যাকেড ছবিগুলো আমি সব সেভ করে রেখেছি। গোপনবাবু বজ্রাহত হলেন। তিনি এ কার পাল্লায় পড়েছেন! এরকম যে হবে স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। অনেক অনুনয় বিনয়, অনুরোধ করলেন ছবি ভাইরাল না করার জন্য। কিন্তু মেয়েটি তার কোন কথাতেই রাজি হয় না। তার টাকা চাই। আর না দিলে সব কীর্তি ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দিল। শেষ পর্যন্ত দেখলেন মেয়েটি নাছোড়। তিনি কোনোভাবেই এর হাত থেকে মুক্তি পাবেন না। হাড়ে হাড়ে অনুভব করলেন তিনি ফাঁদে পড়ে গেছেন। আর রেহাই নেই। ছবি ভাইরাল হয়ে গেলে মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাবে। তাই শেষ পর্যন্ত বললেন অত টাকা তো আমার কাছে নেই। একটা প্রাইভেট ফার্মে কাজ করি। টেনেটুনে পঞ্চাশ হাজার মত দিতে পারব। তার বেশি ক্ষমতা আমার নেই। শেষ পর্যন্ত মেয়েটি তাতেই রাজি হয়ে গেল। হোয়াটসঅ্যাপে অ্যাকাউন্ট নাম্বার ও যাবতীয় তথ্য সেন্ড করলো। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে জমানো পঞ্চাশ হাজার টাকা গোপনবাবু প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ট্রান্সফার করে দিলেন মেয়েটির অ্যাকাউন্টে। অনুতাপ এবং অনুশোচনায় হাহাকার করে মেয়েটির ফাঁদে পা দেওয়ার জন্য নিজেকে ধিক্কার দিলেন।
সাত রাজার ধন
মাস কয়েক থেকে সুতপার মন মেজাজ বেশ ফুরফুরে। দুঃখ, বিষাদ ও যন্ত্রণাগুলো এখন উবে গেছে। পৃথিবীটা এখন বড় সুন্দর মনে হচ্ছে। বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে অনন্তকাল। অথচ এই সুতাপাই গত কয়েক বছর ধরে হয়ে পড়েছিল বিষাদগ্রস্ত। কোন কিছু ভালো লাগতো না। মনে হতো বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই। কী আছে এ জীবনে! মাটির যদি উর্বরতাই না থাকে, মাটি যদি ফসল ফলাতে না পারে তাহলে মাটির সার্থকতা কোথায়? তখন পাথর আর মাটিতে কোন তফাৎ থাকে না।
গত দশ বছর ধরে সুতপার জীবনটা যেন পাথর হয়ে গিয়েছিল। ওর দাম্পত্য জীবন আজ দশ বছরে পদার্পণ করল। কিন্তু ওর কোল আলো করে কোন সন্তান আসেনি। বিয়ের এক বছর পর থেকে ওর স্বামী দিব্যেন্দু সন্তান চেয়েছিল। সময় নষ্ট করতে চায়নি। দিব্যেন্দুর বয়স এখন আটত্রিশ, আর সুতপার পঁয়ত্রিশ। সুতপাও স্বামীর সঙ্গে সহমত পোষণ করেছিল। ঠিক ঠিক সময়ে সন্তানের জন্ম না দিলে পরে মানুষ করতে অনেক ঝামেলা হয়। দিব্যেন্দু চেয়েছিল ওর চাকরি থাকতে থাকতে ছেলে-মেয়ে যেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে। ভারী বয়সে সন্তানের জন্ম দিলে দুশ্চিন্তার শেষ থাকে না। মানুষের জীবন ক্ষণস্থায়ী, কখন কী হয়ে যায় কেউ জানে না। তাই যথা সময়েই যেকোনো কাজ সেরে ফেলা উচিত।
ওরা অত্যন্ত আন্তরিকভাবে সন্তান কামনা করেছিল। কিন্তু কী দুর্ভাগ্য বিয়ের পর বছর চারেক ধরে সন্তান নেওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু সুতপার গর্ভে কোন সন্তান আসেনি। এ নিয়ে ডাক্তারবাবুর কাছেও তারা বহুবার গিয়েছে। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর জানা গেছে যে সুতপার কোন সমস্যা নয় সমস্যাটা দিব্যেন্দুর। দিব্যেন্দুর স্পার্ম অত্যন্ত নিষ্ক্রিয়। সন্তানের জন্ম দানে অক্ষম। এ নিয়ে অনেক চিকিৎসাও চলেছে। কিন্তু কিছু করা যায়নি। দিব্যেন্দু হতাশ। সুতপাকে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। শারীরিক সমস্যা তারই। এ জন্মে সে আর বাবা ডাক শুনতে পাবে না। মনটা কেমন হু হু করে। কারো সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে ইদানিং আর তার ভালো লাগে না। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনদের সন্তান দেখলে ভারী কষ্ট হয়। মনে মনে ভাবে ভগবান তাকে আশ্চর্য পোড়া কপাল দিয়েছেন! সন্তান না থাকলে পরিবার, দাম্পত্য যেন মরুভূমি। একটা শিশুর আধো আধো কথা, খুনসুটি, টলমল পায়ে হেঁটে যাওয়া, হাজারো বায়না, এ জীবনে এসব কিছুই সে পাবে না। পিতৃত্বহীন দুর্ভাগা মানুষ। সুতপার জন্যও খুব খারাপ লাগে দিব্যেন্দুর। দিব্যেন্দুর জন্য সুতপাও পেল না মাতৃত্বের স্বাদ। এ দুঃখ রাখবে কোথায়! আজকাল সুতপার সামনে দাঁড়াতে দিব্যেন্দুর ভীষণ লজ্জা হয়, কেমন যেন অপরাধী মনে হয়। ওর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই সুতপার জীবনটাও অর্থহীন হয়ে গেল। এ জানলে সে বিয়েই করত না।সে জীবনে যা রোজগার করছে তা কার জন্য? এই গাড়ি বাড়ি কাকে দিয়ে যাবে সে? হৃদয় থেকে স্নেহ মমতা ভালবাসার নির্ঝর পাষাণ ভেদ করে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু বেরোতে পারছে না। সে একটা আধার চাইছে, কিন্তু পাচ্ছেনা। পৃথিবীতে এত মানুষ, এত পরিজন তবুও বিরাট একটা খাঁ খাঁ শূন্যতা গ্রাস করছে দিব্যেন্দু ও সুতপাকে। দিব্যেন্দু সুতপাকে অবশ্য বলেছিল তার সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ করতে। দোষটা যদি দিব্যেন্দুরই হয় তাহলে তার ফল সুতপা কেন ভোগ করবে? ও আবার নতুন করে সংসার করুক। মাতৃত্বের স্বাদ নিক। কথাটা শুনে সুতপা বলেছিল কী পাগলের মতো কথা বলছো। তুমি তো আর ইচ্ছে করে কিছু করছো না। সবটাই আমাদের ভাগ্য। বিয়ের আগে এই ব্যাপারটা আমরা তো কেউ জানতামই না। জানা থাকলে হয়তো বিয়েটা নাও হতে পারতো। কিন্তু হয়ে যখন গেছে তখন আর কিছু করার নেই। ভবিতব্যকে মেনে নিতে হবে। আমাদের মত এরকম কাপল পৃথিবীতে অনেক আছে। দশটা বছরের স্মৃতি, ভালবাসা, সম্পর্ক এত সহজে ভোলা যায়! স্বার্থপরের মত সেটা ভুলে যাওয়া কী মানুষের কাজ ? স্বামী-স্ত্রীকে তো জীবনের সুখ দুঃখ অনেক কিছুই ভাগ করে নিতে হয়। আমি ওরকম স্বার্থপর নই। অমন শিক্ষায় শিক্ষিতও নই। প্লিজ এ ধরনের কথা আর কোনদিন মুখে এনো না। এটা যদি আমার ক্ষেত্রে হতো তাহলে তুমি কী করতে? তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে? দিব্যেন্দু সুতপার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলে সুতপা তোমার তুলনা হয় না। তোমার মতো স্ত্রী পেয়েছি এটা আমার বহু জন্মের ভাগ্য। কথাগুলো বলার পর কয়েক মুহূর্ত দুজনেই চুপচাপ হয়ে যায়। দিব্যেন্দুর চোখের কোনায় একটা জলের রেখা, গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে দেখে সুতপা নিজের আঁচল দিয়ে সে জল মুছে দেয় ।
ওরা অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করেছে সন্তান ওরা নেবে। তাতে যত টাকা খরচ হবে হোক, শেষ চেষ্টা করে ছাড়বে। স্পার্ম ব্যাংক থেকে স্পার্ম নিয়ে সুতপার গর্ভে ডাক্তারের সাহায্যে স্পার্ম প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়। মাসখানেক পর ডাক্তার এস কে বিশ্বাস সুতপাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বলেন -আপনি সন্তানের মা হয়ে গেছেন। সত্যি সত্যিই আপনার গর্ভে সন্তান জন্ম লাভ করেছে। তবে খুব সাবধানে থাকবেন। একদম রেস্টে। কোনরকম মানসিক উত্তেজনা, মানসিক চাপ নেবেন না। আমি যে যে ডেটগুলোতে আপনাকে আসতে বলবো সেই সেই ডেটগুলোতে আমার চেম্বারে আসবেন। নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকতে হবে। তবে চিন্তার তেমন কিছু নেই। সারা পৃথিবীতে আপনার মত এরকম অনেক মহিলা এই পদ্ধতিতে মাতৃত্ব লাভ করেছেন। আমার কাছে এর আগেও পাঁচজন এভাবেই মাতৃত্ব লাভ করেছেন। তারা এখনো আমাকে মাঝেমধ্যে দেখা করতে আসেন। ওদের মুখের হাসিটা দেখলে আমার মন ভরে ওঠে আনন্দে। মনে হয় মানুষের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি। এত বড় পৃথিবীতে অন্তত কয়েকজন দম্পতিকে তো মধুর মা বাবা ডাকটি শোনাতে পেরেছি। আমার জীবনও ধন্য হয়ে গেছে। জানেন ওরা আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে বাচ্চা গুলোকেও সঙ্গে নিয়ে আসেন। ফুলের মতো সুন্দর ওই বাচ্চাগুলোকে আমি আদর করি, স্নেহ করি, ওদের হাতে উপহার তুলে দিই। সুতপাদেবী আপনি কোন চিন্তা করবেন না, দেখবেন ওদের মতো আপনাদের জীবন ও ফুলে ফলে ভরে উঠবে। নাউ ইউ আর প্রেগন্যান্ট। কয়েকটা মাস শুধু অপেক্ষা করতে হবে। তবে কিন্তু সাবধানে থাকতে হবে। আমি যে নিয়মগুলো আপনাকে লিখে দিয়েছি, এই কয়েকটা মাস নিয়মগুলো পালন করে চলবেন। যে কোন অসুবিধা বা প্রয়োজনে কোন দ্বিধা না করে আমাকে ফোন করবেন বা দেখা করতে আসবেন। বলতে পারেন আমারও এটা একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞান আজ বিজয়ীর হাসি হাসছে। হাজার হাজার বছরের কত গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের পাহাড়কে টলিয়ে দিয়েছে বিজ্ঞান। মানুষ এখন বিজ্ঞানমনস্ক হয়েছে। যুক্তি দিয়ে সবকিছু বিচার করতে শিখেছে। গড্ডলিকা প্রবাহে এনেছে এক নবচেতনা ও আলোর জোয়ার। জানেন অনেক কাপল এভাবে স্পার্ম নিয়ে সন্তান ধারণের কথা সমাজ জীবনে প্রকাশ করতে লজ্জা বোধ করেন। বিষয়টা তাঁরা গোপন করতে চান, রাখতে চান লোকচক্ষুর আড়ালে। কিন্তু বলুন তো এতে লজ্জার কী আছে? এ তো প্রকৃতির প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে বিজ্ঞানের চ্যালেঞ্জ ও জয়ের মুকুট লাভ। তাই কোন রকম সামাজিক লজ্জা বা আশঙ্কা করবেন না। এটাকে বিজ্ঞানের আশীর্বাদ রূপে গ্রহণ করবেন। ডাক্তার বিশ্বাসের কথাগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে সুতপা ও দিব্যেন্দু। ওরা যেন পায়ের নিচে শক্ত মাটি পায়। যে শূন্যতা ওদের গ্রাস করেছিল এতদিন সেটা এখন কর্পূরের মতো উবে গেল।
সুতপার মন মেজাজ সত্যিই ফুরফুরে। দিব্যেন্দুও প্রাণ ভরে বাতাস নিচ্ছে এখন। মনের উপর থেকে একটা পাষাণ ভার যেন সরে গেছে। সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে দিব্যেন্দু ভাবছিল আকাশ পাতাল। প্রথমত তার চোখের সামনে ভাসছিল একটি ফুলের মত ফুটফুটে শিশু। যে ছুটে বেড়াচ্ছে সারাটা বাড়ি। জড়িয়ে ধরছে তার গলা। তাকে চুম্বনের পর চুম্বন করছে। ওর আধো আধো কথাগুলো মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ও মধুর কথামৃত। দিব্যেন্দুর কল্পনায় বেড়ে উঠেছিল শিশুটা। স্কুল ব্যাগ কাঁধে শিশুটা স্কুলে যাচ্ছে। দিব্যেন্দু তাকে রোজ সকালে স্কুলের গাড়িতে তুলে দিচ্ছে। বিকেলে পার্কে গিয়ে তার সঙ্গে খেলা করছে। কখনো বাড়ির বারান্দায় সে ঘোড়া হচ্ছে আর শিশুটি তার পিঠে বসে ঘোড়সওয়ার হয়ে তার কান মুলে দিচ্ছে কিংবা মাথায় ঝাঁকানি দিচ্ছে। স্বপ্নের ঘোর কিছুক্ষণ পর কেটে গেলে দিব্যেন্দু দেখে সুতপা পরম তৃপ্তিতে জানলার দিকে মুখ করে শুয়ে আছে। সেদিন ছিল বুদ্ধপূর্ণিমা। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। জ্যোৎস্নার আলো জানলা দিয়ে এসে সুতপার মুখের উপর পড়ছে। সুতপার মুখে যেন এক স্বর্গীয় সৌন্দর্য ফুটে উঠছে। সুতপার এই রূপ কতদিন দিব্যেন্দু দেখেনি। মুগ্ধ অবাক দৃষ্টিতে দিব্যেন্দু বারবার দেখছে সুতপার মুখ। দেখে যেন শেষ হচ্ছে না। সুতপা এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর চোখে মুখে তৃপ্তির ছাপ। হাল ভাঙা পাল ছেঁড়া নৌকোটা এবার তীরে এসে লেগেছে। একটা ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে। এখন রাত প্রায় বারোটা। কিন্তু দিব্যেন্দুর ঘুম আসছে না। সন্তান লাভের আনন্দ উচ্ছ্বাসে, না অন্য কিছু ? যদিও বিষয়টা অন্ততঃ আজকালকার দিনে তেমন ভাবার কিছু নয়। কিন্তু ভাবনাটা অন্ততঃ তুলনাটা ঘুরপাক খাচ্ছে দিব্যেন্দুর মাথায়। তার বাপ ঠাকুরদার আমল হলে অন্যের স্পার্ম নিয়ে সন্তানের জন্মদান সামাজিক দিক দিয়ে অত সহজ ব্যাপার ছিল না। লোকে ছিঃ ছিঃ করত। এরকম কত ঘটনা ঘটে। ভুলক্রমে, অসতর্ক মুহূর্তে, বলাৎকারে বা বিভিন্ন কারণে কারো গর্ভে অন্যের সন্তান এলে সামাজিক মানুষ তা গোপনে গর্ভপাত করিয়ে দেয়। কারণ এই সন্তানের সমাজে কোন স্বীকৃতি নেই। কিন্তু এখন দিনকাল বদলে গেছে। মানুষের চিন্তা চেতনায় পরিবর্তন এসেছে। যেখানে আমি অসহায় নিরুপায় সেখানে পথ তো খুঁজে বের করতেই হবে। রক্তের সম্পর্কের চেয়ে মানবিক সম্পর্ক কম নয়। দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই রক্তের সম্পর্কও ভেঙে যায় আবার মানবিক সান্নিধ্য-সম্পর্ক চিরকাল অটুট থেকেই যায়। তাই অনেকেই অনাথ আশ্রম জাতীয় সংস্থা থেকে সরকারি নিয়মকানুন মেনে সন্তান দত্তক নিচ্ছেন। স্নেহ ভালোবাসা মমতা দিয়ে গড়ে নিচ্ছেন সোনার সংসার। সে সংসার প্রথাগত সংসারের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। এর ভিত্তি মানবতা ও মনুষ্যত্ব। হৃদয়ের কাছাকাছি যে আসে সেই তো আপন, অন্তরঙ্গ আত্মীয়। তাই দিব্যেন্দু ও সুতপার জীবনে যে দেব শিশু আসছে সে তো তাদের পরমাত্মীয়। তিল তিল করে স্নেহ ভালবাসা দিয়ে গড়ে নেবে তাকে। উজাড় করে দেবে হৃদয়ের সর্বস্ব। মরুভূমিতে বর্ষার মেঘ এসে রুক্ষ মাটিকে সবুজে সবুজ করে তুলবে। দুটি অতৃপ্ত মানবাত্মা স্নেহরসে সিক্ত হবে। বাৎসল্যের মাধুর্যের বন্যায় ভেসে যাবে বিষাদময় চরাচর। পাখি গান গাইবে, বাগানে ফুল ফুটবে, নদীস্রোতে ভেসে যাবে জীবনের নৌকো স্নেহ ভালোবাসার সমুদ্রের দিকে। ডাক্তার বিশ্বাসের সেই প্রত্যয়ী কথা যা কানের ভিতর দিয়ে দিব্যেন্দুর মরমে প্রবেশ করেছিল তা আজ এই রাতে সূর্যের আলোর মতো সত্য এবং উজ্জ্বল মনে হচ্ছে দিব্যেন্দুর। ওর দেহ মন এখন বড় প্রশান্ত। জানলা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলোটা আরো বেশি করে আসছে। ওদের বেডরুমটা জ্যোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। দিব্যেন্দু একটা নিষ্পাপ শিশুর যে ছবি টাঙিয়ে রেখেছিল বেডরুমের দেওয়ালে সেই ছবির শিশুটার হাসিতে যেন মনে হল পৃথিবীতে স্বর্গ নেমে আসছে। আর মাত্র তিন মাস অপেক্ষা। তারপর সুতপার মেদ মাংস অস্থি নিয়ে এই পৃথিবীর মাটিতে হেঁটে বেড়াবে তাদের জন্ম জন্মান্তরের স্বপ্ন সাত রাজার ধন এক মানিক।
সেই তারা
প্রিয়ব্রত তখন সবেমাত্র ফিজিক্সে এমএসসি ও বি এড পাস করেছে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এখন একটা চাকরির সন্ধান করছে। কারণ নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। বাবা একজন প্রান্তিক চাষী। অনেক কষ্ট করে পড়াশুনার খরচ জুগিয়েছেন। ওর ইচ্ছে ছিল পিএইচডি করার। কিন্তু সম্ভব হয়নি অনেক সময় চলে যাবে বলে। পিএইচডি করতে কম করে ৫-৬ বছর সময় লাগতো। এতটা সময় ব্যয় করার মত পরিস্থিতি তার ছিল না। তাই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির দিকে না গিয়ে সে স্কুলশিক্ষকের চাকরির দিকে ঝুঁকেছিল। তখন অবশ্য স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হয়নি। ম্যানেজিং কমিটির আন্ডারে স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ হতো। তবে এই নিয়োগ প্রক্রিয়া যে স্বচ্ছ ছিল তা বলা যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজিং কমিটি স্কুলে শিক্ষক নিয়োগ করতেন। সে অর্থ দেওয়ার মতো ক্ষমতা সকলের থাকতো না। মুষ্টিমেয় দু চারজন তা দিতে পারতেন। এভাবে অর্থের বিনিময়ে তারা অনেকেই চাকরি পেতেন। মেধার চেয়ে অর্থকেই গুরুত্ব দেওয়া হতো বেশি। অনেক সময় আবার স্কুলের সেক্রেটারি প্রেসিডেন্ট হেডমাস্টার মশাই ইত্যাদি গণ্যমান্যদের কোন একজনের মেয়েকে বিয়ের বিনিময়েও অনেকেই চাকরি লাভ করতেন। টাকা দিয়ে চাকরি কিনে নেওয়ার মতো পুঁজি বা মানসিকতা কোনটাই ছিল না প্রিয়ব্রতর। তাতে জীবনে যে পরিস্থিতিই আসুক না কেন সে লড়ে যাবে। প্রয়োজনে টিউশনি করে জীবিকা নির্বাহ করবে। এদিকে সুমনাও চাপ দিচ্ছে একটা চাকরি যোগাড় করার জন্য। সুমনা প্রিয়ব্রতর প্রেমিকা। তবে ওর সাবজেক্ট ফিজিক্স নয় হিস্ট্রি। দুজনে একই ইয়ারে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় পড়তো। বিশ্ববিদ্যালয়ের সোশ্যাল ফাংশনে ওদের আলাপ। তারপর ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। গোলাপবাগের পার্ক, কৃষ্ণসায়র,রেলস্টেশন, আশপাশের আরও অনেক জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে ওদের প্রেমের স্মৃতি। ওরা বোঝাপড়ায়, মানসিকতায় পরস্পরের পরিপূরক। সুমনার বাবা একজন বড় সরকারি অফিসার। সুমনা তার একমাত্র মেয়ে। বড় সরকারি চাকুরে বা প্রতিষ্ঠিত পাত্রের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিতে চান। ইতিমধ্যে একজন কলেজ অধ্যাপক পাত্রের সঙ্গে সুমনার বিয়ের ব্যাপারে এক প্রস্থ আলোচনা চালিয়েছেন। সুমনাকে ওনাদের পছন্দ। বিয়ে দিতেও রাজি। কিন্তু সুমনা না করে দিয়েছে। যেহেতু প্রিয়ব্রত এখনও কোন চাকরি পায়নি তাই ওদের সম্পর্কের ব্যাপারটা বাবা-মাকে জানাতে পারেনি সুমনা। জানালে নানা রকম বাধা-বিপত্তি আসবে। তাই ও এখন এমফিল করে দুটো বছর কাটিয়ে দিতে চায়। এই দু বছরে প্রিয়ব্রত নিশ্চয়ই একটা চাকরি যোগাড় করে নেবে। শুধু প্রিয়ব্রত নয়, সুমনা নিজেও একটা চাকরি যোগাড়ের চেষ্টা করবে। প্রিয়ব্রতর চাকরি হয়ে গেলে তখন ব্যাপারটা বাড়িতে জানাবে। তখন হয়তো ওর বাবা-মা আর না করতে পারবেন না।
প্রিয়ব্রত এখন বর্ধমানে একটা মেসে থাকে। অনার্স, এমএসসির বেশ কয়েকটা স্টুডেন্টকে টিউশনি পড়ায়। তাতে যা রোজগার হয় ওতে ওর মেস খরচ ও অন্যান্য খরচ চলে যায়। উদ্বৃত্ত কিছু অর্থ অবশ্য থাকে সেটা বাড়িতে বাবাকে পাঠায়। বিভিন্ন রকম কম্পিটিটিভ পরীক্ষার জন্য মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন রকম গাইড বই কিনে পড়াশোনা করছে। একটার পর একটা চাকরির পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছে। এমপ্লয়মেন্ট নিউজ, কর্মক্ষেত্র, কর্মসংস্থান, জীবিকা সন্ধান এরকম বহু পত্রপত্রিকা কেনে। সেখানে যে সমস্ত চাকরির বিজ্ঞাপন বেরোয় সেগুলো দেখে আবেদন করে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু সাফল্য এখনও আসেনি। তবে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাত জেগে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পড়াশোনা করে। হঠাৎই একদিন ওর এমপ্লয়মেন্ট নিউজ এর চতুর্থ পাতায় চোখ আটকে গেল। ওখানে একটা বিজ্ঞাপন ছিল। বিহারের পাটনা শহরে একটি প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে একজন ফিজিক্স টিচার নেওয়ার বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। যোগ্যতা এমএসসি, বিএড। ওরা যে স্যালারি উল্লেখ করেছেন তা খুব একটা খারাপ নয়। যতদিন না অন্য কোন চাকরি পাওয়া যাচ্ছে ততদিন ওই বেসরকারি স্কুলে কাজ করা যেতেই পারে। পড়ানোর একটা অভিজ্ঞতা হবে, সেই সঙ্গে আর্থিক সুরাহাও হবে। তাই বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করে ফেলল ওই স্কুলের জন্য। রেজিস্টারড ডাকে আবেদনপত্র পাঠিয়েও দিল। দিন দশেক পরে ওই স্কুল থেকে এল ইন্টারভিউ এর চিঠি। যেদিন ইন্টারভিউ তার আগের দিন রাতে ট্রেনে রওনা দিল পাটনার উদ্দেশ্যে। পাটনা পৌঁছালো সকাল আটটা নাগাদ। রেলস্টেশনে নেমে আশপাশের দোকানে স্কুলের খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো যে স্কুলটা স্টেশন থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। যেতে হবে রিকশ্ করে।
হালকা টিফিন করে নিল একটা দোকানে। তারপর বেরিয়ে পড়ল রিকশা চেপে স্কুলের উদ্দেশ্যে। সকাল ন’টা নাগাদ পৌঁছালো স্কুলে। তখনও স্কুল খোলেনি। বাইরের গেটে তালা লাগানো। কিছুক্ষণ পরে দেখা হল স্কুলের নাইট গার্ডের সঙ্গে। সে জানালো স্কুল খুলবে সাড়ে দশটায়। সময়টা ছিল এপ্রিল মাসের শেষ দিক। গরম যথেষ্ট পড়েছিল। পাশেই ছিল একটা বড় বটগাছ। তার ছায়ায় গিয়ে আশ্রয় নিল প্রিয়ব্রত। গাছের ছায়ায় বসে নিজের সাবজেক্ট বিষয়ে একটু পড়াশোনা করতে লাগলো। ইতিমধ্যে আরো কয়েকজন চাকরিপ্রার্থী উপস্থিত হলেন। তাঁরাও বটগাছের ছায়ায় আশ্রয় নিলেন। ওদের সঙ্গে প্রিয়ব্রতর আলাপ হল। ওদের সকলেরই বাড়ি বিহারের বিভিন্ন জায়গায়। পশ্চিমবাংলা থেকে একমাত্র প্রিয়ব্রতই এসেছে ইন্টারভিউ দিতে। সাড়ে দশটা নাগাদ স্কুলের গেট খুলে দিল। চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা ১৮ জন। প্রায় সকলেই হাজির। ওরা সকলে গিয়ে স্কুলের একটা হল ঘরে উপস্থিত হলো। ওখানেই সকলকে বসতে দেওয়া হল। এগারোটা নাগাদ ইন্টারভিউ বোর্ডের এক্সপার্ট গণ এলেন। ঠিক বারোটার সময় ডাক পড়ল প্রথম জনের। ইন্টারভিউয়ের জন্য বরাদ্দ সময় কুড়ি মিনিট। দশ মিনিট ভাইভা এবং দশ মিনিট ক্লাস টিচিং। প্রিয়ব্রতর নাম ছিল এক্কেবারে শেষে। ওকে একটা চাপা টেনশন ও উদ্বেগ নিয়ে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে হলো হলঘরে। সবশেষে ডাক পড়ল। ইন্টারভিউ ভালোই হলো। প্রায় সব প্রশ্নেরই সন্তোষজনক উত্তর সে দিতে পেরেছিল। ক্লাস টিচিং ও ভালো হয়েছিল। মনে একটা উৎসাহ, শক্তি ও তৃপ্তি এল। ইন্টারভিউ দিয়ে যখন বেরিয়ে এলো তখন প্রায় সন্ধ্যে সাতটা বেজে গেছে। স্কুল থেকে রেলস্টেশন ছয় কিলোমিটার দূরে । কিন্তু রাতের দিকে বাড়ি ফেরার কোন ট্রেন সেদিন ছিল না। বিশেষ কারণ বশতঃ রাত বারোটার দিকে যে ট্রেনটা ছিল সেটা প্রায় ৮ ঘন্টা লেটে চলছিল। অর্থাৎ পরদিন সকাল আটটায় ট্রেনটা পাওয়া যাবে। তাই রাতটা কোন একটা হোটেলেই প্রিয়ব্রতকে কাটাতে হবে। আশেপাশে সেরকম কোন হোটেল পাওয়া গেল না। এক দোকানদার বললেন দু কিলোমিটার পথ গেলে হোটেল পাওয়া যাবে । সন্ধ্যার দিকে এ অঞ্চলে লোকজনের ভিড় থাকে না । তাই রিকশওয়ালাদেরও এ সময় এ দিকে দেখা যায় না। অগত্যা প্রিয়ব্রতকে হেঁটেই যেতে হলো প্রায় দু কিলোমিটার পথ। লো ভোল্টেজের জন্য রাস্তার লাইট গুলো টিমটিম করে জ্বলছিল। ভালোভাবে পথ দেখা যাচ্ছিল না। আলো অন্ধকারে দু’একবার হোঁচট খেয়ে টলতে টলতে এসে পৌঁছলো একটা চৌমাথার মোড়ে। কয়েকটা ছোটখাট দোকানপাট সেখানে রয়েছে। আর রয়েছে দু একটা হোটেল। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে ক্লান্ত প্রিয়ব্রত একটা হোটেলের দরজায় কড়া নাড়ল। কিছুক্ষণ পরে একজন লোক এলো। প্রিয়ব্রত বললো -” দাদা আজকে রাতটা থাকার মত একটা রুম হবে?”লোকটা বলল দেখি খাতাটা চেক করে। খাতা চেক করে দেখে বলল হ্যাঁ, দু তলায় একটা সিঙ্গেল রুম খালি আছে। তবে অ্যাটাচ বাথ নেই। কমন বাথরুম ব্যবহার করতে হবে। প্রিয়ব্রত যেন হালে পানি পেল। যে কোন একটা রুম হলেই ওর চলবে। নইলে এই অজানা জায়গায় এই রাত্রিবেলায় সে কোথায় কাটাবে? কোনরকমে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই যথেষ্ট। হোটেলের ভাড়াও খুব একটা বেশি নয় বলা যেতে পারে কমই। মাত্র ১০০ টাকা।
হোটেলের একটা ছেলে ওকে রুমে নিয়ে গেল। একটা চাবি দিল। সারাদিনের ঘামে ভেজা জামাপ্যান্ট চেঞ্জ করল প্রিয়ব্রত। তারপর বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নিল। এখন খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু এ হোটেলে খাবার কোন ব্যবস্থা নেই। কেবলমাত্র থাকা যায়। রুমে তালা দিয়ে নিচে এল। একটা চায়ের দোকানে গিয়ে চা বিস্কুট খেলো। অন্য কোন খাবার পাওয়া গেল না। আবার রুমে ফিরে এলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখে নেমে এলো ঘুমের আবেশ। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে সে নিজেও জানেনা। ঘুম যখন ভাঙলো তখন রাত প্রায় এগারোটা। সেই চা বিস্কুট খেয়ে আছে। পেটে খিদের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। একটু ভাত বা রুটি খাওয়া দরকার। তাড়াতাড়ি হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো। কিন্তু ততক্ষণে বেশিরভাগ হোটেলই বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই ঝাঁপ নামিয়ে দিয়েছে। আলো-আঁধারি রাস্তায় একাই হেঁটে চলল হোটেলের খোঁজে। যেখানেই যায় হতাশ হতে হয়। সকলেই জানায় হোটেলে কোন খাবার নেই। এত রাতে আর কোন হোটেলই খাবার পাওয়া যাবে না। তখন রাত প্রায় পৌনে বারোটা বেজে গেছে। শেষ পর্যন্ত নিরাশ হয়ে ক্লান্ত বিধ্বস্ত প্রিয়ব্রত ভাড়া নেওয়া হোটেলের দিকে পা বাড়ালো।
আলো আঁধারী রাস্তায় হেঁটে চলেছে প্রিয়ব্রত। শরীরে শক্তি নেই বড় ক্লান্তি বোধ হচ্ছে। হঠাৎই সামনে থেকে কালো জন্তুর মতো একটা গাড়ি এগিয়ে আসতে লাগলো ওর দিকে। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ধাঁধিয়ে গেল প্রিয়ব্রতর দুচোখ। কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছেনা । গাড়িটা এখন ওর কাছাকাছি এসে গেছে। গাড়ির ড্রাইভার ব্রেক কষে সামনে দাঁড় করালো গাড়িটা। প্রিয়ব্রত হতভম্ব ও ভীতসন্ত্রস্ত। এত রাতে এরকম নির্জন এলাকায় এরকম একটা পরিস্থিতির সম্মুখীন সে হবে জীবনে ভাবেনি। টর্চ লাইট জ্বেলে গাড়ি থেকে পাঁচজন পুলিশ নেমে এলেন। ওদের টর্চের আলো পড়ল প্রিয়ব্রতর মুখে। পাঁচজন পুলিশের মধ্যে একজন ছিলেন ইন্সপেক্টর। কাঁধের নিচে তারকা চিহ্ন। এরা সকলেই বিহারের পুলিশ। রাতের বেলা রাস্তায় পেট্রোলিঙ করছেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর প্রিয়ব্রতকে হিন্দিতে জেরা শুরু করলেন । তার নাম, ঠিকানা এত রাতে কোথায় গিয়েছিল, এখন কোথায় যাচ্ছে, এখানে কি উদ্দেশ্যে এসেছে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করলেন। প্রিয়ব্রত একটু ভয় পেয়ে কাঁপছিল। তবুও প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর যথাযথ দিল। ওর আধার কার্ড ,ভোটার কার্ড, ইন্টারভিউ লেটার সব কাছেই ছিল, দেখালো পুলিশ ইন্সপেক্টরকে। ইন্সপেক্টর ওর পরিচয় পত্র দেখে এবং কথাবার্তা শুনে বুঝলেন লোকটি কোন ক্রিমিন্যাল নয়, কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়েও এখানে আসেনি।ও যে হোটেলে হোটেলে খাবার খুঁজে হয়রান হয়ে অভুক্ত অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে এটা অনুভব করলেন।
ইন্সপেক্টর প্রিয়ব্রতকে সাবধান করে বললেন -তাড়াতাড়ি হোটেলে ফিরে যাও। এত রাতে রাস্তায় ঘোরাফেরা করা ঠিক নয়। পথে-ঘাটে নানা বিপদ আছে। যেকোনো সময় কিছু ঘটে যেতে পারে। এত রাতে এভাবে ঝুঁকি নিয়ে বেরোনো তার উচিত হয়নি। প্রিয়ব্রত আর কোন কথা না বলে ইন্সপেক্টরকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নিল। আবছা অন্ধকারে ক্লান্ত শরীরটাকে কোনক্রমে টেনে নিয়ে চলল হোটেলের দিকে। পিঠব্যাগে একটা জলের বোতল ছিল। তা থেকে একটু জল পান করল। আর পিছন ফিরে না তাকিয়ে হোটেলের দিকে হাঁটতে থাকে। প্রায় ৩০ মিটার এগিয়ে যেতেই প্রিয়ব্রত শুনতে পেল একটা ডাক। কেউ হিন্দিতে বলছেন ” আরে ভাই, এদিকে এসো একবার।” প্রিয়ব্রত বুঝতে পেরেছে এ কন্ঠস্বর কার। এ ডাক ওই পুলিশ ইন্সপেক্টরের। সে একটু ভয় পেল। আরে ডাকছে কেন?আবার কি জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়তে হবে? না উনি এখনও কি সন্দেহ করছেন। মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করছে সে। যেন কোন বিপদে পড়তে না হয়। ভয়ে ভয়ে পিছন ফিরে তাকালো। তারপর অন্ধকার চিরে এগিয়ে চলল পুলিশের গাড়িটার দিকে। কাছাকাছি আসতেই পুলিশ ইন্সপেক্টর তার পুলিশি আভিজাত্য ত্যাগ করে সহৃদয় কন্ঠে বললেন সারাদিন প্রিয়ব্রতর খুব ধকল গেছে। তার ওপর খাবার জোটেনি। এভাবেই অভুক্ত অবস্থায় ও রাত কাটাবে কি করে! খুব কষ্ট হবে! ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক বললেন – “একটা হোটেলে খাবার আছে । তুমি যেতে পারবে? আমি খাবারের ব্যবস্থা করে দেব।” প্রিয়ব্রত অবাক।
এখানে যতগুলো হোটেল আছে, সব হোটেলেই সে খোঁজ করেছে। সকলেই জানিয়েছে কোন খাবার নেই। তাহলে খাবার কি করে পাওয়া যাবে? কিন্তু উনি যখন বলছেন তখন নিশ্চয়ই পাওয়া যেতে পারে। ইন্সপেক্টর ভদ্রলোক একজন কনস্টেবলকে বললেন “এই এক টুকরো কাগজ দাও তো।” কনস্টেবল ওর পকেট থেকে একটা সাদা কাগজ বের করে ইন্সপেক্টর হাতে দিলেন। ইন্সপেক্টর ওই কাগজে লিখে দিলেন হোটেলে যে খাবারটা আছে এই ছেলেটিকে দেবেন। ও অভুক্ত। কাগজের নিচে নিজের নাম স্বাক্ষর করে দিলেন। ঘটনাটা প্রিয়ব্রতর কাছে মনে হল যেন দৈব ঘটনা। এমন অপ্রত্যাশিত খাদ্যপ্রাপ্তি সে কল্পনাও করেনি। খিদেয় পেট জ্বলছে। ইন্সপেক্টর যে হোটেলটির ঠিকানা দিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে প্রিয়ব্রত উপস্থিত হল। হোটেলে কোন কাস্টমার নেই। ম্যানেজার একটা সোফাতে বসে তন্দ্রায় ঢুলছেন। প্রিয়ব্রতর পায়ের শব্দে তার তন্দ্রা ভেঙে গেল। তিনি বললেন “আরে ভাই আবার এসেছেন! বললাম তো হোটেলে কোন খাবার নেই।”প্রিয়ব্রত কিছু না বলে ইন্সপেক্টর এর লেখা কাগজটা হোটেল ম্যানেজারের হাতে দিল। ম্যানেজার কাগজটা পড়ে তৎপর হয়ে উঠলেন এবং -” বললেন বসুন বসুন। খাবার হয়ে যাবে। এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি।” প্রিয়ব্রত একটা চেয়ারে বসলো। তিন মিনিটের মধ্যেই খাবার চলে এলো টেবিলে। একেবারে রাজকীয় খাবার। রুটি,ডাল, সবজি, মাটন, আলুভাজা, চাটনি, পাঁপড়। এতটা সে স্বপ্নেও আশা করেনি। খেতে খেতে প্রিয়ব্রত ম্যানেজারকে বললো -“আচ্ছা দাদা, কিছুক্ষণ আগে আপনিই তো বলেছিলেন কোন খাবার নেই। অথচ ফ্রিজ থেকে বের করে আমাকে খাবার দিলেন। এটাতো প্রথমে দিলেই পারতেন। অকারণে আমাকে এতটা কষ্ট দিলেন!” হোটেল ম্যানেজার বললেন -” আরে ভাই, এই খাবারটা কার জানেন? যিনি চিঠি লিখে আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন, এটা ওনারই খাবার।
রাত সাড়ে বারোটার দিকে এসে উনি এই খাবারটা খান। হোটেল বন্ধ হয়ে গেলেও ওনার খাবারটা আমি ফ্রিজে রেখে দিই। তারপর উনি এলে সেটা ওনাকে সার্ভ করে দিই।” প্রিয়ব্রত হতবাক হয়ে বলল – “তাহলে আজকে রাতে উনি কি খাবেন? ওনার খাবার তো আমি খেয়ে ফেললাম।” ম্যানেজার ভদ্রলোক বললেন – “তা বলতে পারবো না। উনি যেহেতু বলেছেন তাই ওনার খাবারটা আপনাকে দিলাম।” কথাটা শুনে আমার চোখে জল এলো। বাংলা থেকে দূরে এই অজানা, অচেনা, স্বজনহীন জায়গায় এমন অপ্রত্যাশিত মানবতার স্পর্শে আমার আমার হৃদয় ভরে উঠলো। উনি তো আমার কেউ নন, একজন নামিদামী পুলিশ ইন্সপেক্টর। পুলিশকে সাধারণ মানুষ ভয় পায়। ওনাদের থেকে দূরত্ব রাখে।অনেকেরই বদ্ধমূল ধারণা পুলিশেরা নির্মম ও নিষ্ঠুর হন। তাদের জীবনে মানবিকতার প্রকাশ কমই দেখা যায়। কিন্তু প্রিয়ব্রত আজ একি দেখল ও অনুভব করল! ওই পুলিশ ইন্সপেক্টরকে ওর মনে হলো দেবতা। মানুষের কঠিন বর্মের আড়ালে যে কোমল হৃদয় ও মানবিকতার নির্ঝর লুকিয়ে থাকে এই ঘটনা না ঘটলে হয়তো প্রিয়ব্রত অনুভব করতে পারত না। কি দরকার ছিল ওই ভদ্রলোকের এই মহানুভবতা দেখানোর! নিজের মুখের খাবার তুলে দিলেন এক অভুক্তের মুখে। শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে এলো ওই মানুষটার কাছে। উনি আজ রাতে কী খাবেন এই চিন্তা পীড়িত করছিল প্রিয়ব্রতকে। কোন হোটেলে তো আর খাবার পাবেন না। তাহলে উনি কি অভুক্ত থাকবেন সারারাত। নিজেকে কেমন অপরাধী মনে হল প্রিয়ব্রতর। কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠল হৃদয়। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে হোটেলের বিল মিটিয়ে বেরিয়ে পড়ল হোটেলের দিকে। যে পথ ধরে এসেছিল সে পথেই চলেছে এখন। কিন্তু পুলিশের সেই গাড়ি বা পুলিশ ইন্সপেক্টর কাউকেই আর রাস্তায় দেখতে পেল না। ভেবেছিল যদি দেখা হয় ওনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাবে, প্রণাম জানাবে। কিন্তু সে সুযোগ পাওয়া গেল না। ওনারা এখন অন্যত্র চলে গেছেন। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় হোটেলে এসে পৌঁছল। হোটেলের ম্যানেজার তখনও জেগে ছিলেন। বললেন কি দাদা খাবার পাওয়া গেল? প্রিয়ব্রত মাথা নেড়ে হ্যাঁ জানালো। তারপর রুমে এসে শুয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই অবসন্ন ক্লান্ত শরীরটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হল। এক মহাতৃপ্তির ঘুমে যখন সকাল হলো তখন দেখল জানলা দিয়ে সকালের সূর্যের আলো ঘরে ঢুকছে। দু একটা পাখি কিচিরমিচির ডাকছে। সকাল ন’ টায় ফেরার ট্রেন। আটটার সময় হোটেলের বিল মিটিয়ে চেক আউট করে প্রিয়ব্রত বেরিয়ে পড়ল স্টেশনের দিকে। সারাটা রাস্তা মনে পড়তে লাগলো গত রাতের ঘটনাটা। মনে মনে ভাবছিল ওই ইন্সপেক্টরের নাম,ঠিকানা ও ফোন নাম্বার যদি পাওয়া যেত তাহলে খুব ভালো হতো। কিন্তু এত তাড়াতাড়ির মধ্যে ওই রাতে ওনার নামটাও জিজ্ঞাসা করা হয়নি, এখন তাঁকে দেখলে আর হয়তো চিনতেও পারবেনা প্রিয়ব্রত । কারণ অন্ধকারে ওনার মুখটাও ভালোভাবে দেখা হয়নি। অন্ধকার আকাশে এক ঝলক বিদ্যুতের মত দেখা দিয়ে এই বিরাট পৃথিবীতে উনি যেন কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেলেন! তারপর ট্রেন ধরে প্রিয়ব্রত বর্ধমানে তার মেসে ফিরলো। মাঝে মাঝেই মনে পড়ে ওই পুলিশ ইন্সপেক্টরের স্মৃতিটা। ভেবেছিল যদি ওখানে চাকরিটা পায় তাহলে ওনার সঙ্গে গিয়ে একবার দেখা করবে ভালো করে আলাপ করবে।দেখতে দেখতে সপ্তাহ তিনেক পেরিয়ে গেল। কিন্তু ওই প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে কোন নিয়োগপত্র এল না। পরে জানা গেল বিহারের কোন একজন ক্যান্ডিডেট সেখানে নিযুক্ত হয়েছেন। খবরটা পেয়ে মনে মনে একটু মুষড়ে পড়েছিল প্রিয়ব্রত। পড়াটাই স্বাভাবিক। ওর একটা চাকরি ভীষণ দরকার। ইতিমধ্যে স্কুল সার্ভিস কমিশন চালু হয়ে গেছে। শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপনও প্রকাশিত হয়েছে। প্রিয়ব্রত আবেদনপত্র ডাকযোগে রিজিওন্যাল অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছে। মাস খানেকের মধ্যে পরীক্ষায় বসার এডমিট কার্ড এল। তারপর একদিন পরীক্ষাও হয়ে গেল। মাস তিনেকের মধ্যে ফলাফলও প্রকাশিত হলো। প্রিয়ব্রত কোয়ালিফাই করেছিল। এরপর ইন্টারভিউ । তাতে ভালো র্যাঙ্কও হলো। একদিন ডাকযোগে মেসের ঠিকানায় এলো রেকমেন্ডেশন লেটার। বর্ধমানের নিকটবর্তী একটি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলে ফিজিক্সের টিচার হিসেবে জয়েন করলো। প্রিয়ব্রতর স্বপ্ন এখন পূরণ হয়েছে। চাকরি পাওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই ওর বিয়েও হয়েছে সুমনার সঙ্গে। এখন ওদের সুখী দাম্পত্য জীবন। সুমনাও বছর দুয়েক পরে একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। ওরা ব্যাংকে লোন নিয়ে বর্ধমানে একটা 3 BHK ফ্ল্যাট কিনেছে। প্রিয়ব্রত এখন তার বাবা ও মাকে গ্রাম থেকে নিয়ে এসেছে নিজের কাছে বর্ধমানের ফ্ল্যাটে।
প্রিয়ব্রতর স্কুলের চাকরি প্রায় বছর দশেক হয়ে গেল। কোএড স্কুলে ছাত্র-ছাত্রীদের মনোযোগ দিয়ে দায়িত্ব সহকারে পড়ায়। ওর জীবনে এখন পার্থিব কোন অভাব নেই। শান্তিপূর্ণ সংসার। তবুও মাঝে মাঝে ওর মনে হয় কোথাও যেন একটা অতৃপ্তি রয়েছে।জীবনে বিশেষ একটা কিছুর অভাব আছে। তবে সেটা যে কি ও বুঝতে পারে না। রাতের বেলা ব্যালকনিতে বসে যখন তারায় ভরা আকাশ দেখে তখন মনে হয় এই মহাকাশের তুলনায় সে কত ছোট! এই যে সংসার জীবন তাও তো একটা ছোট্ট বৃত্ত। খাওয়া, পরা, বংশবিস্তার করা এর বাইরে জীবনে কি আর কিছুই নেই ? অসীম অনন্ত সত্ত্বার সঙ্গে নিজেকে কি যুক্ত করা যায় না ? রবীন্দ্রনাথের গান যখন মন দিয়ে শোনে তখন অসীম এসে ওর বুকে খেলা করে। ইচ্ছে করে খাঁচার পাখি নয়, বনের পাখি হতে। মাঝে মাঝে ওর মনে হয় এ জীবনের উদ্দেশ্য কি? কি জন্য এসেছে এই পৃথিবীতে? জীবন তো একটা ক্ষণস্থায়ী বুদবুদ,শূন্যতার গান। কবর কিংবা চিতার আগুন তার অন্তিম পরিণতি।
এর জন্য এত কিছু, এত আয়োজন! সবই কি তবে অসার? কোথাও কোন সার বস্তু নেই? জীবনের আনন্দগুলো, তৃপ্তিগুলো কেন চিরস্থায়ী হতে পারে না?
মনে মনে এসব ভাবে প্রিয়ব্রত। আর সন্ধান করতে থাকে চিরস্থায়ী কোন সারবস্তুর, যা নশ্বর হয়েও অবিনশ্বর হতে পারে। প্রিয়ব্রত একদিন সন্ধেবেলা বেডরুমে বসে রোমন্থন করছিল ওর অতীত জীবনের নানা স্মৃতি। শৈশব, কৈশোর, স্কুলজীবন, কলেজজীবন, ইউনিভার্সিটিজীবন, সোমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার নানা মুহূর্ত, চাকরির জন্য মরণপণ লড়াই ইত্যাদি প্রসঙ্গ। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎই মনে পড়ে গেল বিহারের পাটনা শহরে প্রাইভেট ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ইন্টারভিউ দেওয়ার কথা। আর সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে শুকতারার মতো জ্বলজ্বল করে উঠলেন সেই দেবতুল্য পুলিশ ইন্সপেক্টর। তাঁর কথা অনেকদিন প্রিয়ব্রত ভুলেই গিয়েছিল। মাত্র একটা রাতের একটা বিশেষ মুহূর্তের ঘটনা। কিন্তু প্রিয়ব্রতর জীবনে তার আবির্ভাব দেবদূতের মত।ওই মানুষটির কৃতকর্মের ছাপ যে কত গভীর আজ এত বছর পরেও এই সন্ধ্যাবেলায় অনুভব করছে প্রিয়ব্রত।সে এই শহরের স্টেশন ,রাস্তাঘাট চত্বরে যখন ঘুরে বেড়ায় তখন দেখতে পায় কত অভুক্ত মানুষকে। কত লোক অভাবের তাড়নায় ভিক্ষা করছে, খাবার চাইছে, লোকের ফেলে দেওয়া এঁটো পাতা থেকে খাবার কুড়িয়ে খাচ্ছে। মানুষ আর পশুর জীবন যেন মিলেমিশে একাকার। এজন্যই হয়তো কবি সুকান্ত লিখেছিলেন -”ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।” অভুক্ত থাকার যন্ত্রণা একমাত্র ভুক্তভোগীই বোঝেন। আচ্ছা এ বিষয়ে প্রিয়ব্রতর কি কিছুই করার নেই? ওই পুলিশ ইন্সপেক্টর যে কাজটি করেছেন সে রকম কাজ সে কি করতে পারে না? দাঁড়াতে পারেনা অভুক্ত মানুষের পাশে? এ কাজ করতে গেলে অবশ্যই অর্থের দরকার। ভগবান কিছুটা অর্থ সামর্থ্য তো প্রিয়ব্রতকে দিয়েছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করে। তাদের পাঁচ বছরের একটিমাত্র পুত্র সন্তান। দুজনে যা রোজগার করবে তাতে একটি সন্তান মানুষ করার পরও অনেক উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। তার কিছুটা অংশ দিয়ে কি অভুক্ত মানুষদের পাশে দাঁড়ানো যায়না ? নিশ্চয়ই যায়। সবটাই নির্ভর করে মানসিকতার উপর, জীবন দর্শনের উপর। প্রিয়ব্রত কলেজে পড়ার সময় দেখেছিল এক ভদ্রলোককে। অতি সাদামাটা সাধারণ ছাপোষা সরকারি অফিসের করণিক। মফ:স্বল শহরেরে রাস্তায় যে সব কুকুরেরা ঘুরে বেড়াত তাদেরকে তিনি রোজ খাবার দিতেন। সাইকেল চেপে খাবার নিয়ে হাজির হতেন রাস্তার কুকুরদের কাছে। তাদের ক্ষতস্থানে ওষুধ লাগিয়ে দিতেন, ব্যান্ডেজ করে দিতেন, এমনকি শহরের পুরনো পরিত্যক্ত ভাঙাচোরা বাড়িতে তাদের থাকার ব্যবস্থাও করে দিতেন। ওনাকে দেখলেই রাস্তার কুকুরগুলো আত্মার আত্মীয় ভেবে পাগলের মতো ছুটে আসতো। দু একদিন নয় দীর্ঘদিন এই সেবাকাজ করে গেছেন উনি।ভদ্রলোককে দেখে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসতো প্রিয়ব্রতর।মনে হতো এমন মানুষও পৃথিবীতে আছে ! পাটনার পুলিশ ইন্সপেক্টরের কথা এখন খুব মনে পড়ছে প্রিয়ব্রতর। একটা প্রদীপ যেমন আর একটা প্রদীপকে জ্বালিয়ে দেয় ঠিক তেমনি করে উনি যেন এই নিভৃত সন্ধ্যায় প্রেরণা দিচ্ছেন প্রিয়ব্রতকে অন্তরের প্রদীপটি জ্বালাতে।
প্রিয়ব্রত এই শহরের অভুক্ত দীনহীন রাস্তার মানুষদের জন্য কিছু একটা করার জন্য মনে মনে উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। বড়সড়ো কিছু না হোক তার সাধ্যমত ছোটখাটো একটা প্রতিষ্ঠান সে গড়ে তুলবে। এ ব্যাপারে সুমনাকেও জানিয়েছিল। সুমনা অমত করেনি। তবে বলেছিল ব্যাপারটা অত্যন্ত কঠিন। খুব ধৈর্য চাই, নিষ্ঠা চাই,মনের জোর চাই, অদম্য উৎসাহ চাই, সেই সঙ্গে চাই অর্থ বল। এসব কাজ অনেকেই শুরু করেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত টানতে পারেন না। মাঝপথেই রণে ভঙ্গ দেন। তাই ভেবে চিন্তে কাজ করা উচিত। প্রিয়ব্রত বলেছিল দেখাই যাক না। আগে শুরু তো করি। বেশি নেগেটিভ ভাবলে কাজে এগোনো যাবে না। না মরে ভূত হয়ে কোন লাভ নেই। আমি জানি আর কাউকে না পাই তোমাকে পাশে পাব। সুমনা আর কিছু বলেনি একটু হেসেছিল। আর প্রিয়ব্রতর হাতটা শক্ত করে ধরেছিল। সেদিন সন্ধ্যাবেলা ছেলে ও সুমনাকে নিয়ে প্রিয়ব্রত একটা পার্কে বেড়াতে গেল। সুন্দর পার্কটা দেখে ওর মন আনন্দে ভরে উঠলো। ছেলে সৌম্য ছুটে বেড়াচ্ছে। সুমনা ছেলেকে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সন্ধ্যার অন্ধকার ঘন হয়ে আসছে। আকাশে একটার পর একটা তারা ফুটে উঠছে। দেখতে দেখতে লক্ষ লক্ষ তারাতে ভরে উঠল রাতের আকাশ। প্রিয়ব্রতর মনে হল আকাশটা যেন তারার মালা পরেছে। আজকের মত নক্ষত্র খচিত এত সুন্দর আকাশ আগে সে কখনো দেখেনি। সপ্তর্ষিমণ্ডল, কালপুরুষ, ধ্রুবতারা সবাই হাজির। ওদের চোখে মুখে কী উজ্জ্বলতা! ওই তারাগুলোর মাঝে হঠাৎই একটা তারায় চোখ আটকে গেল প্রিয়ব্রতর। মনে হল এ তারাটা যেন তার জন্ম জন্মান্তরের চেনা। বড় কাছের। ও যেন হাতছানি দিয়ে বারবার ডাকছে প্রিয়ব্রতকে। হয়তো কিছু বলতে চায়। ওর বুকে অনেক কথা জমে আছে। সে গুলো শেয়ার করতে চাই প্রিয়ব্রতর সঙ্গে। প্রিয়ব্রত অপলকে তাকিয়ে আছে তারাটার দিকে,অপূর্ব মুগ্ধতা ও মায়া ভরা চোখে। মনে হল তারাটির গায়ে যেন মাটির সোঁদাগন্ধ। হয়তো কোন এক সময় ও এই পৃথিবীতেই ছিল। কিন্তু আজ দূরে অনেক দূরে! প্রিয়ব্রত এখন স্মৃতির আকাশে হারানো পুরনো পৃথিবীর সুগন্ধে স্নান করছে । আর আনমনে বিড়বিড় করে বলছে -”রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।” পাটনা শহরের কবেকার সেই রাতের আকাশের সেই তারাটা আজকের এই সন্ধ্যায় খেলা করছে ওর বুকের মধ্যে। গভীর তৃপ্তি ও প্রসন্নতার আলোয় অনন্ত এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে প্রিয়ব্রতর মন।
দহন
আজ সকাল থেকেই বাড়িতে বিয়ের সানাই বাজছে। একতলা বাড়িটা সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। লোকজনের আনাগোনা ও হইচই। সকলেই যে যার মত ব্যস্ত। অতিথি আপ্যায়ন করছে সমরেশ নিজে। তার ছেলে অরণির আজ বিয়ে। অরণি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। একটা নামকরা কোম্পানিতে লোভনীয় প্যাকেজে কাজ করে। যে মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সেও সরকারি চাকুরে। ভালোবাসার বিয়ে। পাত্র-পাত্রী দুপক্ষই খুশি মনে মেনে নিয়েছেন তাদের সম্পর্ক। তারই পরিণতিতে এই আনন্দঘন বিয়ের অনুষ্ঠান। কিন্তু সানাই এর সুরে কোথাও যেন মিশে রয়েছে একটা গভীর বিষাদ। সবই ঠিক আছে কিন্তু অলক্ষ্যে তাল কেটে যাচ্ছে। আলোর ভিতরে একটা অন্ধকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। আজকের অনুষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ একজনকে দেখা যাচ্ছে না। সে হলো তমসা। মানে সমরেশের স্ত্রী, অরণির মা। নিজের ছেলের বিয়ে কিন্তু তমসা নেই, সে কি করে সম্ভব! সে কোথায় গেল? তমসা এখন পুরীতে তার কলিগদের সঙ্গে ভ্রমণে গেছে দিন দশকের জন্য। এরকম অপ্রত্যাশিত ঘটনার কারণ কি? লোকসমাজেও তো ছি: ছি: পড়ে যাবে। পাঁচজনে পাঁচ কথা বলবে। আত্মীয়-স্বজন এসে ছেলের মায়ের খোঁজ করবে। তখন সমরেশ কি বলবে? কাছাকাছি যারা থাকেন তারা হয়তো অনেকেই ব্যাপারটা জানেন। কিন্তু দূরের আত্মীয়-স্বজন যারা ব্যাপারটা জানেন না, তাদের মুখে হাত দেবে কে? ব্যাপারটা নিয়ে সমরেশও মনে মনে চিন্তিত। চক্ষু লজ্জা বলেও তো একটা জিনিস আছে। কী উত্তর দেবে সে মানুষজনকে। লোকসমাজে পরিবারের বদনাম হবে। সমরেশের মাথা হেঁট হয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার নেই। ওদিকে তমসার অবশ্য অত মাথাব্যথার কারণ নেই। তার কলিগরা সমস্ত ব্যাপারটাই জানেন। তাদের কাছে নতুনত্ব কিছু নেই। আর আত্মীয়-স্বজন থেকে তমসা এই মুহূর্তে অনেক দূরে উড়িষ্যার পুরীতে। সুতরাং তাকে কারো মুখোমুখি হতে হচ্ছে না। কী এমন ঘটেছে যে তমসাকে ছেলের বিয়ে ছেড়ে পালাতে হলো। ঘটনাটা আজ থেকে প্রায় সাতাশ বছর আগের।
সমরেশ ও তমসার বিয়ের পর প্রায় দশ বছর’বছর সম্পর্কে মাধুর্য ও রোমান্স ছিল। ছিল পারস্পরিক নির্ভরতা। সমরেশ এমএসসি পাস করেছিল। কিন্তু এমনই কপাল যে কোন চাকরি জোটেনি। তাই সংসারের ঘানি টানতে চুটিয়ে টিউশনি করছিল। টিউশনির বাজারও ভালো ছিল। বহু ছেলে মেয়ে তার কাছে পড়ে। ওর ওপর নির্ভরও করে। ওর কাছে পড়ে বহু ছেলে মেয়েই এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত। প্রাইভেট শিক্ষক হিসাবে এলাকায় সমরেশ একটা সুনাম অর্জন করেছিল। সে যা আয় করত তাতে সংসার মোটামুটি চলে যেত। সমরেশের বাবা আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে মারা যান সমরেশের যৌবনের প্রারম্ভে। তখন সে সবেমাত্র হায়ার সেকেন্ডারি পাস করেছে। বাবা একটা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন। বাবার মৃত্যুতে পরিবারটা প্রায় ভেসে যেতে বসে। বিধবা মা এবং দুই বোনকে নিয়ে সমরেশ যে কোথায় দাঁড়াবে ভেবে কুল কিনারা পায়না। পেটের খিদে বড় জ্বালা। হাওয়া খেয়ে তো আর বাঁচা যায় না। তাই এই বয়স থেকেই সমরেশকে শুরু করতে হয় টিউশনি। কোন রকমে সংসারের চাকাটা গড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। টিউশনি পড়িয়ে সমরেশ অনার্স এবং এমএসসি পাস করে। যদিও বড়দি প্রভার বিয়ে আগেই হয়েছিল। কিন্তু ছোট বোন অঞ্জনার বিয়ে সমরেশই দেয়। সে ইতিহাস বড় মর্মান্তিক এবং বেদনাদায়ক। ভুক্তভোগী ছাড়া সে যন্ত্রণা কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। চাকরির জন্য সমরেশ অনেক চেষ্টা করেছিল, অনেক কম্পিটিটিভ পরীক্ষাও দিয়েছিল কিন্তু এমনই দুর্ভাগ্য চাকরি জোটেনি। তাই টিউশনিটাকেই করতে হয় পেশা ও নেশা। এটাই তার বাঁচার একমাত্র পথ, অন্ধের লাঠি। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের যোগাযোগে গ্রাজুয়েট তমসার সঙ্গে তার সামাজিক বিয়ে হয়। তমসারা দুই বোন ও এক ভাই। বাবা সম্পন্ন চাষী। বোন থাকে কলকাতায় স্বামীর চাকরি-স্থলে। তমসা তার বোনের মত সুন্দরী নয়।গায়ের রং অনেকটা দাবা। তবে মুখশ্রী সুন্দর। মাঝারি স্বাস্থ্য। বড় আকর্ষণীয় ওর চোখ দুটো। মেয়ে দেখতে গিয়ে সমরেশ এক নজরে ওকে পছন্দ করেছিল। সমরেশও সুপুরুষ, ফর্সা উজ্জ্বল, উন্নত নাসিকা। উচ্চতাও মাঝামাঝি। ওকে দেখে তমসাও চোখ ফেরাতে পারেনি। তারপর এক ফাল্গুনের রাতে বসন্তের ছোঁয়ায় দুটি হৃদয় এক হল। বাসর রাতে, ফুলশয্যায় ওরা অনেক স্বপ্ন দেখল। সেদিন ওদের মনে হয়েছিল পৃথিবীতে বোধহয় ওরা দুজন ছাড়া আর কোন প্রাণী নেই। নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় চারটে চোখ এক হয়ে গেল। দেহের খিদে, মনের খিদে মিলেমিশে একাকার। পৃথিবীতে তখন নব বসন্তের হাওয়া বয়ে চলেছিল। ওদের মনে হয়েছিল ওরা দুজন মিলে সব সম্ভব করতে পারে। তমসা বলেছিল তুমি কোন চিন্তা করোনা। চাকরি না পেলে কী হবে, আমি ঠিক সংসার চালিয়ে নেব। সময় সুযোগ এলে আমি যদি কোন কাজ পাই তাহলে তোমাকে সাহায্য করবো।দুজন মিলে সংসারের হাল ধরবো। তখন দেখবে তোমার পরিশ্রম অনেক কমে যাবে। তমসার কথা শুনে সমরেশ তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ওকে সাহায্য করার জন্য এই বিশাল পৃথিবীতে একজন যে আছে একথা ভেবে সমরেশ মনে জোর পায়। এখন লড়াইটা শুধু তার একার নয়, তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য একজন হাত বাড়িয়েছে। এটা তার কাছে যেন ঈশ্বরের একটা বড় আশীর্বাদ। সমরেশ ও তমসার দাম্পত্য যেন ফুলে ফলে ভরে উঠতে চাইছে। তমসাকে পেয়ে সমরেশ সত্যি সত্যিই খুশি। বারবার মনে হয়েছে ওদের দাম্পত্যে কোথাও যেন ফাঁক নেই। কতবার রাতে জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলোয় তমসার সুন্দর নিষ্পাপ মুখটা দেখে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে সমরেশ। একদিন তমসার গর্ভে জন্ম নেবে দুজনের ভবিষ্যৎ ও ভাবীকাল। একটা ফুলের মত শিশু টলমল পায়ে আধো আধো কথা বলতে বলতে হেঁটে যাবে ঘরের বারান্দায়। ওরা দুজন মিলে জড়িয়ে ধরবে শিশুটিকে। ওদের রক্ত মাংস অস্থি দিয়ে গড়া এক স্বপ্নের শিশু। পৃথিবীর বোধ হয় সবচেয়ে পুরনো মধুর ডাক বাবা ও মা ওদের কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করবে। উত্তরাধিকারের চারাগাছের স্নেহ, ভালোবাসা, সৌন্দর্য, ও ছায়ায় ওদের জীবন স্বর্গ হয়ে উঠবে। ওরা অনায়াসে পেরিয়ে যাবে রোদ, বৃষ্টি, ঝড়, তুফান, পাহাড় শুধু ওই মৃতসঞ্জীবনী চারা গাছটিকে বুকে রেখে।
বছরখানেক পরে একদিন রাতের বেলা শোবার সময় তমসা সমরেশকে জড়িয়ে ধরে বলল একটা ভালো খবর আছে। শুনলে তুমি খুব খুশি হবে। সমরেশ আলতো করে তমসার ঘাড়ে হাত রেখে বলল, বলো না কি এমন খবর যা শুনলে আমি খুশি হব। বিশেষ কিছু কি হয়েছে? হ্যাঁ গো বিশেষই তো। তুমি অনেকদিন ধরে যা চাইছিলে সেটা আজ তোমার এক্কেবারে হাতের নাগালে। সমরেশ বলে, অত হেঁয়ালি না করে আসল কথাটা তাড়াতাড়ি বলে ফেলো তো। তমসা বলে আরে বাবা বলছি বলছি। মানে আমি এবার তোমার সন্তানের মা হয়েছি। সমরেশ হঠাৎই আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। আরে বলছ কী? একেবারে হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি? হ্যাঁ গো হ্যাঁ সত্যি নয় তো মিথ্যে নাকি। কয়েকদিন থেকে আমার কিছু শারীরিক অসুবিধা হচ্ছিল।। গা বমি বমি করছিল। খেতে পারছিলাম না। তাই বড়দি আজ আমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। ডাক্তার বাবু দেখে শুনে পরীক্ষা করে জানালেন, আমি প্রেগন্যান্ট। সমরেশ মহানন্দে তমসাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, এত বড় খবরটা তুমি আমার কাছে এতদিন চেপে রেখেছিলে কেন? তমসা বলে, তোমাকে সারপ্রাইজ দেবো বলে। আগে থেকে জেনে গেলে এত আনন্দ পেতে না। সমরেশ বলে, তোমার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। সত্যিই তমসা তুমি আমার হৃদয় ভরিয়ে দিলে। কী যে আনন্দ হচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না। আমাদের মধ্যে একটা অটুট বন্ধন তৈরি হয়ে গেল। যে বন্ধন দু’জনকে বেঁধে রাখবে চিরকাল। আচ্ছা তমসা আমাদের যদি ছেলে হয় তাহলে কি নাম রাখবে? তমসা বলে, দাঁড়াও একটু ভাবি। তুমিও ভাবো। যারটা ভালো লাগবে সেই নামটাই রাখবো।সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎই সমরেশ বলল, ইউরেকা। পেয়ে গেছি মনের মত একটা নাম। তমসা বলে তাড়াতাড়ি বল, দেখি আমার আবার পছন্দ হয় কিনা। সমরেশ বলে, অরণি। তমসা বলে বাহ বেশ সুন্দর নাম তো, আমার পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা যদি মেয়ে হয় তাহলে কী নাম রাখবে? সমরেশ বলে, এবার তুমি একটু ভাবো, একটা সুন্দর মিষ্টি নাম। তমসা মাথা চুলকায় আর বলে – কী নাম রাখি, কী নাম রাখি। হ্যাঁ এসে গেছে আইডিয়া ওর নাম হবে নদী। কি ঠিক আছে তো ? সমরেশ তমসার টোল পড়া গালে আঙুল ছুঁয়ে বলে খুব সুন্দর নাম। সেদিন রাতে দুজনে অনন্ত তৃপ্তির ঘুমে আচ্ছন্ন হল। অরণি আর নদী নামের দুটো ফুলের মত শিশু স্বপ্নে ওদের বুকে খেলা করতে লাগলো।
এভাবেই দিনগুলো গড়িয়ে চলল বর্তমান থেকে ভবিষ্যতের দিকে। সমরেশ প্রায় সব সময় তমসার খেয়াল রাখে। সবচেয়ে বেশি খেয়াল রাখেন সমরেশের নিঃসন্তান বিধবা বড়দি প্রভা। তিনি প্রায় চল্লিশ বছর এ সংসারে আছেন। সংসারটাকে মায়ের মতো আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। পরোক্ষে তিনিই এ সংসারের কর্ত্রী। সমরেশের ছোট বোন অঞ্জনা স্বামীর সঙ্গে থাকে হলদিয়াতে। মাঝেমধ্যে বাপের বাড়ি আসেন। সমরেশের মা গৌরীদেবী মাটির মানুষ। অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে জীবনে অনেক ঝড় ঝাপটা, দুঃখ যন্ত্রণা সহ্য করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। পরিবারে নতুন অতিথির আগমন সংবাদে আনন্দের ঢেউয়ে তাঁর হৃদয় ছাপিয়ে যাচ্ছে। দশ মাস দশ দিন পর হাসপাতালর লেবার রুমে শোনা গেল শিশুর কান্না। নার্স বেরিয়ে এসে বললেন সমরেশ বাবু আপনার একটা ফুটফুটে ছেলে হয়েছে। মিষ্টি খাওয়াতে হবে কিন্তু। সবার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক। সমরেশরা ছুটে গেল মা ও শিশুকে দেখতে। তখন অবশ্য তমসার জ্ঞান ফেরেনি। সমরেশ মুগ্ধ দৃষ্টিতে দেখেই যাচ্ছে তার স্বপ্নের অরণিকে। তবে ওর ভেতরে একটা উদ্বেগ তমসার কখন জ্ঞান ফিরবে। একসময় তমসার জ্ঞান ফিরলো। ও ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখলো ওর বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সমরেশ। সমরেশ তমসার মাথায় হাত রেখে বলল অনেক কষ্ট সহ্য করে তুমি যে উপহার আজ আমাকে দিলে তার জন্য তোমার কাছে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ। তমসা ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা এনে বলল – ” তুমি খুশি তো?” সমরেশ কোন কথা না বলে তমসার হাতে হাত রাখলো।
জীবন বহুকোষী। সব সময় সরলরেখায় চলে না। অনেক সময় বক্ররেখারও পথ ধরে। ঝড়, ঝঞ্ঝা, তুফান, সুনামি, ভূমিকম্প এসে সব ওলট-পালট করে দিয়ে যায়। তমসা ও সমরেশের সরলরৈখিক জীবন কখন যে বক্ররেখার জটিল আবর্তে ডুবে গেল তা তারাও খেয়াল করেনি। অরণির বয়স যখন দশ বছর তখন থেকেই সমস্যার সূত্রপাত। ইতিমধ্যে আকস্মিক হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন সমরেশের মা গৌরীদেবী। মাকে হারিয়ে সমরেশ খুব ভেঙে পড়েছিল। বড়দির হার্টেও মেজর প্রবলেম দেখা দিয়েছে। হার্টে বড় ধরনের ব্লকেজ আছে। উনি এখন চিকিৎসাধীন। সংসারের শক্ত ভিতটা নড়বড় করতে শুরু করেছে। বড় অসহায়তা বোধ করছে সমরেশ। বড়দির যদি কিছু হয়ে যায় সংসারটার দশা কি হবে ? কে ডানা দিয়ে আগলে রাখবে মায়ের মত ? অরণি তো পিসিমণি ছাড়া জগতে আর কাউকে চেনে না। নিঃসন্তান বড়দি তাঁর সব মাতৃত্বটুকু উজাড় করে দিয়েছেন অরণিকে। অরণিকে জন্ম দেওয়ার পর তমসাকে ছেলের বিষয়ে তেমন ভাবতে হয়নি। অরণির খাওয়া, পরা, যত্ন আত্তি, প্রাথমিক পাঠদান প্রায় সব দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন বড়দি প্রভা। বড়দির ক্ষুধার্ত মাতৃত্ব একটা স্নেহের আশ্রয় খুঁজছিল। তা তিনি পেয়েছেন অরণির মধ্যে । ইদানিং সমরেশের টিউশনিতে একটু ভাটা পড়েছে। আগে যে পরিমাণে ছেলে-মেয়ে পড়তো তার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কারণ বেকারের সংখ্যা এত বেড়েছে যে টিউশন টিচারের প্রতিযোগিতাও বেড়ে গেছে বহুগুণ। আর সংসারের খরচ আগের থেকে বেড়েছে অনেক। আয় কিছুটা কমে গেছে। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছে সমরেশ। বেশ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ অবস্থায় এগিয়ে এলো তমসা। বলল তাহলে আমি চাকরি-বাকরির চেষ্টা করি। যদি কোন কাজ জুটে যায় তাহলে সংসারে সাহায্য করতে পারব। কিন্তু সমরেশ পুরোটা সায় দিতে পারল না। কারণ বড়দি প্রভার শারীরিক অবস্থা বেশ খারাপ। আগের মতো আর সংসারের কাজ করতে পারেন না। তার ওপর অরণিকে মানুষ করা, তার দেখভাল করা এ মুহূর্তে তাঁর পক্ষে অনেকটাই অসম্ভব হয়ে উঠছে। তাই তমসা যদি সংসার ছেড়ে বাইরে কোন কাজে চলে যায় সংসার প্রায় অচল হয়ে যাবে। তার প্রভাব পড়বে অরণির ওপরেও। বড়দিরও বয়স হচ্ছে। আগের মত লোড নেওয়া আর সম্ভব নয়। কিন্তু তমসা বলে অত চিন্তা করো না আমি ঠিক ম্যানেজ করে নেব। দেখাই যাক না কী হয়। সংসারটাকে তো বাঁচাতে হবে। টাকা পয়সার পর্যাপ্ত যোগান না থাকলে সংসার চলবে কী করে? সমরেশ আর কিছু বলেনি। চুপ থেকে গেছে। তমসার কথায় যে যুক্তি নেই তা কিন্তু নয়, অবশ্যই আছে। কিন্তু শ্যাম রাখি না কুল রাখি এটাই সমস্যা। যাইহোক একটা প্রাইভেট সেক্টরে তমসা কাজ জোগাড় করল। ডিউটি সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে ছয়টা।
সকালবেলা উঠে অফিস যাবার তাড়া। সকালের কাজকর্ম তেমন আর কিছু করা হয় না। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা সাতটা। সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রমের পর শরীর ক্লান্ত হয়ে যায়। বাড়িতে কাজ করার মত শারীরিক সামর্থ্য আর থাকে না। বাড়িতে যে কাজের লোক রাখবে সে অর্থ সামর্থ্যও নেই। সংসারের পুরো চাপটা গিয়ে এখন পড়লো বড়দি প্রভার উপর। সমরেশেরও সময় নেই, সারাটা দিনই প্রায় টিউশনি। দুপুরের দিকে দু’ঘণ্টা মাত্র রেস্ট। এমনি করে প্রায় বছর দুয়েক চলল। বড়দির অবস্থা উত্তরোত্তর খারাপ। প্রায়ই শ্বাসকষ্ট হয়। শরীর দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। হাঁটা চলার শক্তি কমে যাচ্ছে। তার প্রভাব পড়ছে অরণির উপর। সারাদিন সে মাকে পায় না। রাতের বেলা মা বাড়ি ফিরলেও তাকে যত্ন নেওয়ার মতো শারীরিক সামর্থ্য মায়ের থাকে না। ছেলেটার পড়াশোনায় ক্রমশ ক্ষতি হতে লাগলো। অত্যন্ত মেধাবী ছেলে অরণি। কিন্তু এই দু বছরে রেজাল্ট আগের তুলনায় খারাপ হতে লাগলো। তাই একপ্রকার বাধ্য হয়ে সমরেশ তমসাকে বলল – তমসা তুমি কাজটা ছেড়ে দাও। না হলে ছেলেটা মানুষ হবে না। আমি যেটুকু রোজগার করছি ওতেই কোন রকমের সংসার টা চালিয়ে নেব। নুন ভাত খেয়ে থাকবো। আমাদের জীবনের লক্ষ্য শুধু ছেলেটাকে মানুষ করা। তমসা ব্যাপারটা যে বোঝে না তা নয়। কিন্তু এই দু বছর বাইরে কাজের জগতে থেকে একটা অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার যে আস্বাদ সে পেয়েছে সেটা তার পক্ষে ত্যাগ করা একটু কঠিন হয়েই দাঁড়ালো। সে মনে মনে ভাবে আমাকে কেন কাজ ছাড়তে হবে? আমিও তো কিছু রোজগার করছি। বরং সমরেশ দু একটা ব্যাচ টিউশনি কমিয়ে দিক। ওই সময়টা ও সংসারে দিক। সংসারের দায়িত্ব নিতে হলে দুজনকেই নিতে হবে। একদিন সমরেশকে কথাটা স্পষ্ট বলেই ফেলল। কথাটা শুনে সমরেশ থ হয়ে গেল। তমসা যে এভাবে বলতে পারে সে কল্পনাও করেনি। আগের তমসা আর আজকের তমসাকে সে মেলাতে পারছে না। কথাটা বড়দির কানেও গেল। তিনিও হতবাক। অনেক রকম করে বোঝালেন তমসাকে। এমনকি একথাও বললেন আমি যদি হঠাৎ মারা যাই তাহলে তোমার সংসার ও ছেলের অবস্থা কি হবে? তখন তো তোমাকে কাজ ছাড়তেই হবে। তমসা বলে যখন যেমন পরিস্থিতি হবে তখন সে রকম ভাববো। এখন তো আপনি আছেন। আমি যে রোজগার করছি তা তো সংসারের জন্যই করছি। এটাকে আপনারা এমন খারাপ ভাবে নিচ্ছেন কেন? বড়দি আর কিচ্ছু বলেন নি কোনদিন। সমরেশও চুপ হয়ে গেছে। দশ বারো বছরের দাম্পত্যে ধীরে ধীরে তৈরি হল ফাটল। দুজনে ক্রমশ চলে যাচ্ছে দুই মেরুতে। এখন আর আগের মতো স্বামী-স্ত্রীতে সহজ কথাবার্তা হয় না। একটা ইগো পরস্পরকে বিচ্ছিন্ন করে দিল। এমনি করে পেরিয়ে গেল আরও কয়েকটা বছর। বড়দি সমস্ত প্রতিবন্ধকতার আঁচ নিজে সহ্য করে রক্ষা করে চললেন অরণিকে মায়ের মত। অরণির কাছে এখন মা বলতে পিসিমণি প্রভা। জন্মদাত্রী মায়ের সঙ্গে তৈরি হয়ে গেল দূরত্ব। এভাবেই সে কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক ,উচ্চমাধ্যমিক পাস করে আজ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার। এখন তার বয়স চব্বিশ বছর। পিসিমণি ও বাবা তার জীবন সর্বস্ব। একই ঘরে আছে কিন্তু মা তার কাছে আজ দূর কোন গ্রহ। কোন টান নেই, আকর্ষণ নেই। বন্ধুরা তাদের মায়ের কথা বললে ওর কষ্ট হয়। তখন সে পিসিমণির মুখটা মনে করে। আজ তার বিয়ে। কিন্তু এ বিয়েতে মায়ের কোন ভূমিকা নেই। বিয়ের আচার সংক্রান্ত সব কাজই করছেন পিসিমণি। একটা তীব্র অভিমান থেকে তার বিয়ে সম্পর্কে কোন সংবাদই মা কে সে জানায়নি। বিয়ের কয়েক দিন আগে কেবলমাত্র সামাজিকতা রক্ষার জন্য বিয়েতে থাকার অনুরোধ করেছিল। শুধু এটুকুই মাত্র। ঘটনাগুলো যে তমসার বুকে তিরের মতো বেঁধেনি তা কিন্তু নয়। সেও তো মানুষ, রক্ত মাংসের মানুষ। ওর মনে হয়েছে এ বাড়ির কেউই ওকে ঠিকঠাক বোঝেনি। তাই সেও এক তীব্র অভিমানে ছেলের বিয়ের দুদিন আগেই কলিগদের সঙ্গে চলে এসেছে পুরি। বাড়িতে থাকলে হাজার লজ্জা, অপমান, ঘৃণা ওকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। কিন্তু এখানে এসেও সে কি শান্তিতে আছে? বুকের মধ্যে একটা আগুন হু হু করে জ্বলছে। সাতাশ বছর আগের সেই হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীটা এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। সমরেশের সঙ্গে বাসর ঘরে রাত জাগা, ফুলশয্যা, গর্ভধারণ করে ছেলের নাম ঠিক করা, গর্ভের সন্তানের মুখ কল্পনা করা, প্রসব যন্ত্রণা সহ্য করে হাসপাতালে অরণির জন্ম দেওয়া সেইসব স্মৃতিকাতর মুহূর্তগুলো এখন চোখের সামনে ভাসছে তমসার। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল। খুব ইচ্ছে করছে হাউ হাউ করে কেঁদে অরণিকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরতে।
আর এক জন্ম
আজ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে সেই মুখটাকে খুঁজছি। কিন্তু কোথাও পাচ্ছিনা। কোথায় হারালো সে মুখ!গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। চেহারা অতি সাধারণ। উচ্চতা পাঁচ ফুটের কাছাকাছি। এক চিলতে ছিটেবেড়ার ঘরে এক সন্ধ্যায়, ওকে এক আবেগঘন মুহূর্তে দেখেছিলাম। সেদিন ঘরে কেউ ছিলনা। ওর সংসারে আপন বলতে ছিল একমাত্র বিধবা মা। ও তখন মাধ্যমিকের ছাত্রী। আমি ওকে টিউশন পড়াতাম কয়েকজনের সঙ্গে একটা ব্যাচে। আমিও তখন একেবারে ছাপোষা কাঠ বেকার। একটা পুরনো ভাঙা সাইকেলে চেপে কয়েকটা বাড়িতে পড়িয়ে কলেজের পড়া ও মেসে থাকার খরচা জোগাড় করতাম। মাত্র কয়েকশো টাকার টিউশনি। ও দিত একশো টাকা। একবার মাস শেষ হয়ে গেছে এক সপ্তাহ হল। মেয়েটি কয়েকদিন থেকে পড়তে আসে না। তাই আমিও বেতন পাইনি। টাকার খুব দরকার। খুঁজে খুঁজে একদিন ওর বাড়ি গেলাম মাইনেটা আনতে। আমাকে দেখে ও খুব অপ্রস্তুত। আমি যে এ ভাবে ওর বাড়ি পর্যন্ত চলে আসতে পারি ও স্বপ্নেও ভাবেনি। আমাকে একটা মোড়াতে বসতে দিল। দেখলাম ঘরে কেউ নেই। বলল স্যার পাঁচ মিনিট বসুন আমি সন্ধ্যাটা জ্বেলে নিই। ও সন্ধ্যার প্রদীপ জ্বালল। ধুপের গন্ধে ভরে গেল ছোট্ট ঘরটা। দেখলাম ঘরের সর্বত্র দারিদ্র্যের ছাপ। দেখে একটু কষ্ট হল। ভাবলাম মাইনেটা চাইবো। চাওয়াটা কি উচিত হবে? কিন্তু না চাইলেও যে উপায় নেই। আমার মেসের খরচা পাব কোথায় ? শেষমেশ চোখ বন্ধ করে বললাম গোপা, মাইনেটা আজ দিতে পারবে? পেলে খুব ভালো হতো।টাকাটা খুব দরকার ।কেমন করুণ অসহায় মুখে ও আমার দিকে তাকালো। বুঝতে পারলাম ওর হাতে টাকা নেই। ওর অসহায়তাটুকু বুঝতে পেরে মায়া হল। তবুও নিষ্ঠুরের মতো বলে ফেললাম আজ না হোক কাল পরশুতে দিও। ও মাথা নাড়লো। বললাম তোমার মা কোথায়? বলল মা তো একটা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে, এখনও ফেরেনি। ফিরতে একটু রাত হয়। বললাম তাহলে এখন আসি। আমি বারান্দা থেকে উঠোনে পা দিতেই বলল স্যার একটু চা খেয়ে যান। অবশ্য লিকার চা। আমাদের বাড়িতে তো দুধ থাকে না। আমি বললাম পরে খাবো। এখন আসি। তাহলে পরশু সন্ধ্যাবেলা আসবো। ভাঙা সাইকেল চেপে মনে একটা চাপা বেদনা নিয়ে অন্ধকার অলিগলি পেরিয়ে যখন সদর রাস্তায় উঠলাম, তখন দেখলাম আকাশে চাঁদ উঠেছে। শহরের বড় বড় অট্টালিকা গুলো জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু যে গলি থেকে আমি বেরিয়ে এলাম সেখানে শুধু অন্ধকার। এখানে এসে যেন চোখ ঝলসে গেল। সেদিন রাতে মেসে ফিরে এসে গোপার কথা, ওর হতশ্রী বাড়ির কথা বুকে কেমন যেন মোচড় দিচ্ছিল। তবু মনে মনে একটা যুক্তি খাড়া করলাম। আমিও তো কিছু তালেবড় নই। সামান্য কয়টা টাকার টিউশনি করি। এ মুহূর্তে আমার টাকার দরকারও খুব। কি করে ছেড়ে দিই একশো টাকা ! দিন দুয়েক পরে একটা গোপন অপরাধবোধ নিয়ে আবার গেলাম গোপাদের বাড়ি ।গোপা একশো টাকার একটা নোট অতি সংকোচে আমার হাতে দিয়ে বলল – স্যার একটু দেরি হয়ে গেল দিতে, কিছু মনে করবেন না। সেদিন যখন এসেছিলেন তখন আমার মা মাইনে পায়নি। তাই সময় মত টাকাটা দিতে পারিনি। আসার সময় প্রণাম করে বলল – স্যার আশীর্বাদ করুন যেন মাধ্যমিকটা এক চান্সে পাস করে যায়। আর তো আমার পড়া হবে না ! আমার মা তো লোকের ঘরে কাজ করে। আর পড়াতে পারবে না। কথাটা শুনে চোখে জল এলো। এরকম কত গোপা আমাদের সমাজে রয়েছে তার খবর আমরা কয় জন রাখি! একটা অব্যক্ত বেদনা নিয়ে সেদিন ভাঙা সাইকেল চেপে মেসে ফিরেছিলাম।
এ ঘটনা প্রায় ত্রিশ বছর আগের। এর মধ্যে পৃথিবীতে কত কি ঘটে গেছে। কত কি বদলে গেছে। এখন আমি একটা সরকারি চাকরি করি। অনেক কষ্ট করে কম্পিটিটিভ পরীক্ষা দিয়ে এই চাকরিটা পেয়েছি। মাস গেলে মাইনে পাই। এখন আর আগের সেই অভাব নেই। সংসার করেছি। একমাত্র সন্তানকে একটা ভালো স্কুলে পড়াচ্ছি। আমার অনেক শখ ,সাধ পূরণ করতে পেরেছি। কিন্তু মাঝে মাঝে এখনো গোপার সেই অসহায় করুণ মুখটা আমার মনে পড়ে। মনে হয় একটা বড় অপরাধ করেছিলাম সেদিন ওর কাছে মাইনেটা নিয়ে। না নিলেও তো পারতাম! না হয় একটু কষ্ট করেই মাসটা চালিয়ে নিতাম। কিন্তু আমি স্বার্থপরের মতো নিজের দুঃখ কষ্টটাকেই বড় করে দেখেছি, ওই অসহায় পরিবারটার কথা ভাবিনি। তারপর এখন বেশ কয়েকবার এই শহরের ওই কানা গলিতে গেছি গোপা ও তার মায়ের খোঁজে। কিন্তু ওদের কোন সন্ধান পাইনি। আশেপাশের লোক জন বলেছিল বিশ বছর আগে ওরা এখান থেকে চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না। হতাশ হয়ে ফিরে এসেছি। মনে ইচ্ছে ছিল গোপার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব সেদিনের সেই নিরুপায় অপরাধের জন্য। কিন্তু সে সুযোগ ভগবান আমাকে দিলেন কোথায়! এখনও বহুবার রাতের স্বপ্নে গোপার অসহায় করুণ মুখটা ভেসে ওঠে।দেখি ও তুলসি তলায় সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালছে।আর আমি ওর হাতে আমার মাস মাইনের কিছু টাকা তুলে দিয়ে বলছি- গোপা আমাকে ক্ষমা করো। এই সামান্য কিছু টাকা হাতে রাখো। আমাকে প্রায়শ্চিত্ত করার একটা সুযোগ অন্তত দাও!দেখি ,গোপা আমার পায়ে হাত রেখে প্রণাম করছে। ওর চোখে জল ছল ছল করছে। আর অস্ফুট স্বরে বলছে স্যার আপনি মানুষ নন ,দেবতা! হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল।দেখি বিছানায় শুয়ে আছি। আমার পাশে ঘুমোচ্ছে নিবেদিতা, আমার স্ত্রী। আর আমার ছেলে অমিতাভর সুন্দর মুখটাতে জানলা দিয়ে আসা চাঁদের আলো পড়েছে। ওকে দেখতে দেবশিশুর মত লাগছে। স্বপ্নে দেখা গোপা এখন হারিয়ে গেছে এক অজানা অন্ধকারে। তবু ওর সেই করুণ অসহায় মুখটা আজও ভুলতে পারিনি। হয়তো এরকমই বহুবার রাতের স্বপ্নে ও আমার চেতনার দরজায় ধাক্কা মারবে। আর আমি যখন জেগে উঠবো তখন মনে পড়বে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই কবিতার লাইন “দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া / কেবল শুনি রাতের কড়া নাড়া / অবনী বাড়ি আছো ?” এ পৃথিবীতে আমরা হয়তো কম বেশি অনেকেই অবনী। হৃদয়- দুয়ার এঁটে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছি। আর রাতের অন্ধকারে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অমলকান্তির মতো গোপারা হারিয়ে যাচ্ছে। এ জন্মে ওদের আর রোদ্দুর হওয়া হলো না। হয়তো তার জন্য আর এক জন্ম অপেক্ষা করতে হবে।
বিচার
প্রায় আশি বছর আগের কথা বলছি । গ্রাম বাংলা তখন অন্ধকার কুয়াশায় ঢাকা অনেকটা প্রাগৈতিহাসিক। মেঠো পথ। বর্ষায় এক হাঁটু কাঁদা। রাতে হ্যারিকেন ও লন্ঠনের আলো। যানবাহন নেই, বিদ্যুৎ নেই। রাত আটটা বাজলেই গ্রামে নেমে আসে নিঝুম অন্ধকার। এমনই এক অজ পাড়াগাঁয়ের ভয়ংকর কৃপণ ও ধনী মানুষ রাখহরি পাল। এলাকায় যেমন তার অর্থের জন্য নাম ডাক আছে তেমনি বদনাম আছে কৃপণ হিসেবেও। রাখহরির ভাই জয়কালী। সে দাদার একান্ত ভক্ত, দাদা বলতে অজ্ঞান, দাদা যেন তার কাছে সাক্ষাৎ ভগবান। জয় কালীর হাবাগোবা বউ মেনকা। সে অক্ষর জ্ঞানহীন। রাখহরির বউ পার্বতী ওকে পরিচালনা করে। মেনকা এ বাড়ির দাসী বাঁদী। উঠতে বসতে সর্বক্ষণ তাকে লাঞ্ছিত হতে হয় পার্বতী ও রাখহরির কাছে। এ ব্যাপারে জয়কালীর কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। বরং সে জানে মেয়ে মানুষ পুরুষের সেবা দাসী। দাদা বৌদির প্ররোচনায় সেও মেনকার উপর কম অত্যাচার চালায় না। খুব কষ্ট হলে মেনকা লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে। মার খেয়েও পড়ে থাকে এদের পায়ে। কারণ তার যাবার আর কোন জায়গা নেই। বাবা মা গত হয়েছেন সেই শৈশবে। মানুষ হয়েছে দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে। ওই মামাই মাথা থেকে দায় ঝেড়ে ফেলার জন্য কালো কুৎসিত অমানুষ জয় কালীর হাতে তুলে দেন মেনকাকে। সে মামাও আজ নেই। আছে ওই মামার মেয়ে রেবতী।
হঠাৎই জানা যায় মেনকা গর্ভবতী। তার পেটে সন্তান এসেছে। মেনকার মনে খুশি খুশি ভাব। পেটের সন্তানকে ঘিরে সে অনেক কিছু ভাবে, স্বপ্ন দেখে। কিন্তু জয় কালী সন্তান ধারণের জন্য মেনকাকে কোন আলাদা সমীহ দেখায় না। কিন্তু এ বাড়িতে প্রসবের আগের দিন পর্যন্ত মেনকাকে সব কাজকর্ম করতে হয়েছে। না পারলেও কষ্ট করে করতে হয়েছে। অবশেষে মেনকার কোল আলো করে এলো এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। তবে ছেলের মুখ দেখে জয়কালীর একটু ভাবান্তর হল। একটা মায়াও জন্মালো ছেলেটার প্রতি। মাঠ থেকে কাজ করে ফিরে এসে ছেলেকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু এ দিকে রাখহরি আর পার্বতী প্রতিহিংসায় জ্বলতে লাগলো। কারণ তাদের একচ্ছত্র সম্পত্তির ভাগীদার এসে গেছে। তাদের ছেলে গোপাল আর সর্বস্ব পাবে না। যেমন করেই হোক এই ছেলেটাকে পৃথিবী থেকে সরাতে হবে। এ কাজ করতে হবে অত্যন্ত সাবধানে এবং গোপনে। তার জন্য একটা কৌশল নিতে হবে।
এখন থেকে রাখহরি ও পার্বতী নানা অছিলায় মেনকাকে প্রতি পদে পদে লাঞ্ছনা দিতে শুরু করলো। ওর প্রতি কাজের খুঁত ধরা ওদের মজ্জাগত স্বভাব হয়ে গেল। এমনকি জয় কালীর মনে ওরা ঢুকিয়ে দিল সন্দেহের বিষ। জয়কালী কে বোঝালো যে মেনকার সন্তান অবৈধ সন্তান। সে সন্তান জয়কালীর নয়। হুঁশ জ্ঞানহীন হাবাগোবা মেয়ে অন্য কারো সন্তান গর্ভে ধারণ করেছে। ওরা এমন ভাবে জয়কালীর মগজ ধোলাই করল যে জয়কালী বিশ্বাস করতে বাধ্য হলো। শেষমেশ মেনকাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল। অসহায় মেনকা গাঁয়ের দু একজন লোকের সাহায্যে কোনরকমে ঠাঁই পেল দূর সম্পর্কের সেই মামাতো দিদি রেবতীর বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও সেই একই দশা। দাসী বাঁদীর অবস্থা। দুটো খাওয়া পরা ও একটু আশ্রয়ের জন্য তাকে সহ্য করতে হলো অপমান ও লাঞ্ছনা। কিন্তু এ দিকে রাখহরির চক্রান্ত শেষ হলো না। শত্রুকে সে নির্মূল করতে চায়। ওই বেজন্মা ছেলেটা বড় হয়ে কোন দিন এসে সম্পত্তির দাবি করতে পারে। তাই মেনকার অর্থ লোলুপ জামাইবাবু রতিকান্তকে বশ করে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে ওই দুধের শিশুটাকে গলা টিপে মেরে ফেলার সুপারি দিল। হলও তাই। মেনকা একদিন বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়িয়ে পদ্ম পুকুরে স্নান করতে গেল। আর সেই সুযোগে রতিকান্ত পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিল শিশুটিকে। স্নান করে ফিরে এসে মেনকা দেখল ছেলে জাগছে না। কথা বলছে না। দিদি রেবতী স্বামীর গতিবিধি জানতো। সে ততক্ষণে সব বুঝে গেছে। এ বিষয়ে স্বামীকে বারণও করেছিল। কিন্তু কে শোনে কার কথা! মেনকা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলো। রেবতীর চোখেও জল এলো। সেও তো মানুষ! তাই সেও কাঁদে। মেনকা বলে -“হে ভগবান তুমি একি করলে!আমি এবার কি করে বাঁচবো?”মাস তিনেকের মধ্যেই রতিকান্ত বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিল মেনকাকে। সে এখন গায়ে গঞ্জে ভিক্ষে করে দিনপাত করে। যেখানে পায় সেখানে রাত কাটায়।
এদিকে রাখহরির এখন পৌষ মাস। তবে ছেলের মৃত্যুর কথা শুনে মাঝে মাঝে চোখে জল আসে জয় কালীর। মনটা কেমন হু হু করে। কেন এমন হয় সে জানে না। ও তো তার ছেলে নয়। দাদা বৌদি তো তাই বলেছে। কিন্তু তবু মনটা কেন কাঁদে তার? জয়কালী যখন চোখের জল ফেলে তখন রাখহরি তার পিঠে হাত দিয়ে বলে – “কালী কাঁদিসনে। কার জন্য কাঁদছিস? ওকি তোর নিজের ছেলে? ওতো একটা বেজন্মা।”
দেখতে দেখতে দুটো বছর পেরিয়ে যায়। এখন মাঠে ধান পেকেছে। চারিদিকে ধান কাটা চলছে। রাখহরি এবং জয়কালী ধানকাটায় ব্যস্ত। রাখহরির ছেলে গোপাল বেলা এগারোটা নাগাদ বাবা ও কাকার জন্য মাঠে জল খাবার নিয়ে এসেছে। খাবারটা আলের মাথায় রেখে দশ বছরের গোপাল জমির এক কোণে খড় দিয়ে তৈরি একটা চালা ঘরে ঢোকে। এই খড়ের চালা ঘরটা তৈরি করেছিল রাখহরি মাঠ পাহারা দেওয়ার জন্য। সেখানে ঢুকে গোপাল একটা দেশলাই দেখতে পাই। এই দেশলাই দিয়ে রাখহরি বিড়ি ধরাতো। আপন খেয়ালে গোপাল হঠাৎই একটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বেলে ফেলে। মুহূর্তের মধ্যে আগুন ধরে যায় চালা ঘরে । মিনিট পাঁচেকের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে আগুন লেলিহান শিখায়। গোপাল আর বেরোবার পথ পায় না। ওদিকে রাখহরি ও জয়কালী ধান কাটায় মগ্ন। এদিকে কি হচ্ছে খেয়াল করেনি। গোপাল আর্তস্বরে হঠাৎই চিৎকার করে ওঠে “বাঁচাও! বাঁচাও! মরে গেলাম! বাবা, কাকা তোমরা ছুটে এসো, আমাকে বাঁচাও!”
গোপালের চিৎকারে ছুটে আসে রাখহরি ও জয়কালী। কিন্তু ততক্ষণে প্রায় সব শেষ হয়ে গেছে। গোপালের সর্বাঙ্গ পুড়ে গেছে। আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ জ্বলছে। রাখহরি অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। কিন্তু আগুন ঠেলে ভিতরে যেতে পারছে না। সে এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। ইতিমধ্যে মাঠের অন্যান্য লোকেরা ছুটে এসেছে। পুকুর থেকে জল এনে তারা আগুন নেভালো। কিন্তু গোপালকে বাঁচানো গেল না। ফুটফুটে ফুলের মত গোপাল ততক্ষণে শেষ হয়ে গেছে। রাখহরি এখন মাটিতে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে পাগলের মত হাউ হাউ করে কাঁদছে। আর বলছে -“হে ভগবান! তুমি নিক্তি ধরে বিচার করো। তোমার বিচার অতি সূক্ষ্ম। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই।”
শিকড়
ফোনটা যখন এল, পরমব্রত তখন অফিসেই। ল্যাবে গবেষণার ফাঁকে কফি খাচ্ছিল। আজই ঘন্টা খানেক আগে সেরিব্রাল স্ট্রোকে মারা গেছেন বাবা। হঠাৎই শক খেয়ে পরমব্রত কিংকর্তব্য বিমূঢ়। এর জন্য সে প্রস্তুত ছিল না। কিন্তু ঘটনাটা ঘটে গেছে। একটা কান্না বুকের ভেতর থেকে দলা পাকিয়ে গলা পর্যন্ত ঠেলে ঠেলে উঠছে। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল। কফির কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখেছে। আর খেতে পারেনি। সেটা এখন ঠান্ডা হয়ে গেছে। মিনিট পনেরো পর একটু ধাতস্থ হয়ে স্ত্রী স্বপ্নাকে ফোন করে জানালো ব্যাপারটা। সেদিন আর ল্যাবের কাজে মন বসলো না। একটা অস্থিরতা ও হুহু যন্ত্রণা মোচড় দিচ্ছিল বুকে। গাইড ক্রিস্টোফার থমসন সাহেব কে সব জানিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ল্যাব থেকে। গাড়ি চলেছে দ্রুত গতিতে হাউসটনের জনবহুল পথে। পিঁপড়ের সারির মতো গাড়িগুলো নিজ নিজ গন্তব্য অভিমুখী। পরমব্রতর আর বিলম্ব সইছে না। ওর ইচ্ছে করছে স্বপ্নার কাছে গিয়ে প্রাণ খুলে কেঁদে একটু হালকা হতে। ঘন্টা দুয়েক পরে যানজট কাটিয়ে বাড়ি ফিরল। ধীর পায়ে কোনরকমে টলতে টলতে এসে সোফায় বসলো। স্বপ্নাও ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ওর চোখেও জল। দেবারতি মানে পরমব্রতর দশ বছরের একমাত্র কন্যা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল “বাবা, সত্যিই কি দাদাই মারা গেছে? ইন্ডিয়া গিয়ে আর কোনদিনই কি দাদাইকে দেখতে পাবো না?” পরমব্রত মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে “না মা আর কোনদিনই দাদাইকে দেখতে পাবে না। দাদাই যে এখন আকাশের তারা হয়ে গেছে।” বাড়ির পরিবেশ এখন থমথমে। আশপাশে যে কয়টি প্রবাসী বাঙালি পরিবার ছিলেন তাঁরাও দেখা করতে এলেন পরমব্রতর সঙ্গে। সাধ্য মতো সান্ত্বনা দিলেন। সন্ধ্যাবেলায় পরমব্রত স্বপ্নাকে বলল “বাবাকে শেষ দেখাটা তো দেখতে পেলাম না। এত দূর থেকে দেশে পৌঁছানোর অনেক আগেই ডেড বডি দাহ হয়ে যাবে। আর যাওয়াও সম্ভব নয়।জানো খুব আক্ষেপ হচ্ছে। মনে হচ্ছে এত দূর দেশে না থাকলেই পারতাম। আজ যদি দেশে থাকতাম তাহলে বাবার শেষ যাত্রার সঙ্গী হতে পারতাম। মনের খেদ মিটত।
বাবা আমাদের জন্য আজীবন কত করেছেন! স্কুল টিচারের চাকরি করে যে মাইনে পেতেন তাতে আমাদের পাঁচ ভাই বোনকে নিয়ে সংসার ভালো করে চলতো না। বাবাকে টিউশনি করতে হতো। তবুও আমার পড়াশোনার খরচা সব জুগিয়ে গেছেন বাবা। তিন বোনের বিয়ে দিয়েছেন অনেক খরচ করে। অনেক কষ্ট করে ব্যাংকের লোন শোধ করতে হয়েছে। সে সব এক ইতিহাস। বাবা পড়াতেন এক প্রাইভেট কোম্পানির স্কুলে। সেখানে কোন পেনশন ছিলনা। তাই অবসর গ্রহণের পরও টিউশনি পড়াতেন সংসারের জন্য। তারপর আমি ফেলোশিপ পেয়ে রিসার্চ করলাম। সেখান থেকে কিছু বাঁচিয়ে মাসে মাসে বাবাকে দিতাম। কিন্তু সে আর কতটুকু! পুরো সংসারটাই বাবা টানতেন। দাদাও চাকরি পায়নি সেও বেকার। ছোটখাটো একটা ব্যবসা সে করতো কিন্তু সেটাও ভালো চলত না। তারপর সৌভাগ্যক্রমে চলে এলাম আমেরিকায়, এই হাউসটনে। সায়েন্টিস্ট হিসাবে এখানকার ল্যাবে কাজ করার সুযোগ পেলাম। তারপর তুমি এলে আমার জীবনে। এলো দেবারতি। জন্মসূত্রে দেবারতি এখানকার সিটিজেন। তাই আর দেশে ফেরার ইচ্ছে হলো না। আমরাও এখানকার নাগরিকত্ব নিলাম। থেকে গেলাম এই দূর দেশে। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, ভোগবিলাসে ডুবে গেলাম। কি আশ্চর্য! কয়েক বছরের মধ্যেই শিকড়ের টানটা আলগা হতে থাকলো। প্রথম প্রথম দেশের জন্য মনটা কেমন কাঁদতো। তারপর সব সয়ে গেল।
স্মৃতিগুলোর উপর বিস্মৃতির ধুলো জমতে শুরু করল। ফেলে আসা দেশ সম্পর্কে ক্রমশ নিরাসক্ত হতে থাকলাম। একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আমার জন্মভূমিকে কেমন যেন উপেক্ষার চোখে দেখতে লাগল। আমি ভুলতে বসলাম শৈশব ও যৌবনের দিনগুলোকে। যে দেশের জল হাওয়াতে একদিন আমি পুষ্ট হয়েছি। আমার দেহ মন গড়ে দিয়েছে যে দেশ। যে দেশের খেয়ে পরে আজ আমি এতদূর এসেছি। তার প্রতি আজ যেন কোন দায়বদ্ধতা অনুভব করছি না। তবু মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের সেই কবিতার পংক্তি “এইসব মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা / এইসব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা।” কিন্তু আমি তো এখন নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। আমার কেরিয়ার, আমার স্বপ্ন, আমার ভোগ বিলাস, আমার স্বাচ্ছন্দ্য, আমার নিউক্লিয়ার সংসার আরও কত কী। জানো স্বপ্না অনেকবার ভেবেছিলাম আমার বৈভব হীন জন্মভূমিতে ফিরে যাব। ওখানেও তো আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়-স্বজন অনেক মানুষই আছেন। ঘর সংসার, চাকরি বাকরি, ব্যবসা নিয়ে বেশ সুন্দর কাটিয়ে দিচ্ছেন। ইচ্ছে করলে আমিও তো ওখানে কাজ পেতাম। কিন্তু এখানে এলাম কেন? আসলে আমি একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ চেয়েছিলাম।
ও দেশে তো এত সুযোগ, পরিকাঠামো, অর্থ নেই। হয়তো সাদামাটা আটপৌরে জীবনে আমার চেতন অবচেতন মন তৃপ্ত হতে চাইনি। তাই শিকড় সহ গাছটাকে তুলে এনে বসিয়েছি একটা টবে। মনে মনে ভাবি আমি কি তবে বনসাই? এখানে অনেক কিছুই পেয়েছি তবুও একটা শূন্যতার যন্ত্রণা এসে মাঝে মাঝে আমাকে গ্রাস করে। মনে হয় জন্মভূমির প্রতি আমার কি কোন দায় নেই! কেন আমি আমার বিদ্যা, বুদ্ধি, প্রতিভাকে বন্ধক রাখলাম অন্যের কাছে? আমি কি সত্যিই স্বার্থপর! এখানে যা কিছু দিচ্ছি সেটুকু যদি আমার দেশের জন্য দিতাম! তাহলে তো জন্মভূমির ঋণ শোধ করা হতো। তবু আত্মপক্ষ সমর্থন করে ভাবি এটা তো বিশ্বায়নের যুগ, আমরা এখন গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। দেশান্তরের সীমারেখা আজ থেকেও যেন আর নেই। তাহলে এখানে থাকলে অনুতাপ হবে কেন? আমার মতো হাজার হাজার মানুষ এ পথের পথিক। তাদের থেকে আমি আলাদা তো নই। স্বপ্না তুমি কি আমার সঙ্গে সহমত?” স্বপ্না বলে – “মানছি তোমার কথা। কিন্তু কী জানো আমিও মাঝে মাঝে নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হই। আমার শৈশব, কৈশোর, যৌবন আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তবু এখানে ঘর সংসার নিয়ে বেশ মানিয়ে নিয়েছি। মেয়েদের জীবনটা তো এরকমই। আমরা এক জায়গায় বড় হই তারপর বিয়ে হলে আর এক জায়গায় জীবন কাটাই। তা এত দিন পর তুমি এ সব নিয়ে এত বিচলিত কেন? বাবাকে শেষ দেখাটা দেখতে পেলে না বলে খুব ভেঙে পড়েছো,তাই না ?”পরমব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে -“জানো এখন মনে হয় জীবনটা যেন একটা ক্ষণস্থায়ী বুদবুদ। এই আছে, এই নেই। এই যে জীবনে এত ভোগ সুখের আয়োজন সত্যিই কি এর এতটা প্রয়োজন আছে! বাঁচতে গেলে কতটুকু লাগে? আমাদের চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার তো শেষ নেই। কোনদিন শেষও হবে না।
এক স্বপ্ন থেকে আর এক স্বপ্নে আমরা ছুটবো অনন্তকাল। এ জীবনে সবকিছুই আপেক্ষিক। যদি ভাবি জীবনের তলানিটুকু পর্যন্ত পান করে নেব, কারণ ঐহিকতার বাইরে আর কিছু নেই। তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়। এ মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকদিন আগে পড়া তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের নিতাই কবিয়ালের গাওয়া একটি গান -“ভালোবেসে সাধ মিটিলো না জীবনে / হায় জীবন এত ছোট কেনে?” শুধু দেহে বাঁচা নয়, আমরা যে মনেও বাঁচি। এই মনটাই আজ আমাকে কাঁদাচ্ছে স্বপ্না। একে আমি অস্বীকার করি কী করে! আমার রক্তস্রোতে ধ্বনিত হচ্ছে শিকড়ের গান। ফেলে আসা শৈশব,কৈশোর , যৌবনের দিনগুলো যেন বাবার মুখের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। জানো এখন শত ইচ্ছে করলেও দু মাসের আগে আমি দেশে যেতে পারবো না। আমার ল্যাবে এমন একটা গবেষণার সঙ্গে আমি যুক্ত, যেটা এখন তুঙ্গে, তাছাড়াও দেবারতির স্কুলের পরীক্ষাও আর এক সপ্তাহ পরে। তাই এই মুহূর্তে ছুটি নেবার কোন উপায় নেই।সে সব ঝামেলা মিটতে মিটতে বাবার শ্রাদ্ধ শান্তি সব পেরিয়ে যাবে। যদি দেশের মধ্যে থাকতাম এক বেলার জন্যও যে কোন মূল্যে যেতে পারতাম। কিন্তু এত দূর থেকে তো সেটা কি করে সম্ভব বলো? তাই কেমন যেন একটা অসহায়তা গ্রাস করছে আমাকে। এখন এই মুহূর্তে একটা গানই মনে পড়ছে সেই বাংলা শ্যামা সংগীত -“দোষ কারো নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।” মনে হচ্ছে নিরুপায় আমি যেন নিজের হাতেই আমার শিকড়টাকে ছিঁড়ে ফেলেছি।
ফেরা
বছর তিনেক থেকে প্রায় প্রতিটা ছুটির দিন অর্ক গঙ্গাপারের শ্মশানে যায় বিকেলের দিকে। ওখানে প্রাচীন বটগাছটার নিচে শান বাঁধানো বেদীতে বসে উদাস দৃষ্টিতে দেখে চিতার আগুন। বুকের মধ্যে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা মোচড় দেয়। মফঃস্বলের এই শ্মশানে এখনো কোনো ইলেকট্রিক চুল্লি হয়নি। শব কাঠের চিতায় পোড়ানো হয়। শহর থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে এই শ্মশান। গঙ্গানদী কুলকুল ধ্বনিতে বয়ে চলেছে শ্মশানের পাশ দিয়ে। বটগাছটার পাশেই রয়েছে শ্মশান কালীর মন্দির। যারা মৃতদেহ পোড়াতে আসে তাদের অনেকেই ওই মন্দির চত্বরে বসে চিতার আগুন দেখে। মৃতদেহ যখন পোড়ে তখন ধোঁয়ার সাথে একটা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে।পাশেই রয়েছে ঝোপ জঙ্গল। দেহ সৎকার করতে এসে যারা মদ্যপান করে তারা ওই ঝোপের আড়ালে চলে যায়।শ্মশান কালীর মন্দিরের ঠিক নিচেই রয়েছে গঙ্গার উপর একটা শান বাঁধানো ঘাট। দেহ সৎকার করে মানুষজন ওখানে স্নান করে। ওখান থেকেই মাটির কলসিতে জল তুলে চিতার আগুন নেভায়। ওই ঘাটেই মৃতের অস্থি গঙ্গাজলে বিসর্জন দেয়। ঘাটের সিঁড়িগুলোতে অনেক জায়গায় ফাটল ধরেছে । সেই ফাটলের ফাঁকে ফাঁকে জন্মেছে আগাছা। শ্মশান থেকে একটু দূরে রয়েছে বস্তি এলাকা। এখানে বাস করে কিছু গরিব মানুষ। কেউ রিকশ্ ভ্যান চালায়, কেউ ভাড়া নেওয়া টোটো চালায়, কেউ দোকানে কাজ করে। এ পাড়ায় রয়েছে একটা অঙ্গনওয়াড়ি সেন্টার। জায়গাটা খুব নির্জন। ঝোপ-জঙ্গলে রাতেরবেলা শেয়ালের ডাক শোনা যায়। সন্ধ্যে হলেই অন্ধকারের চাদর মুড়ি দেয় এলাকাটা। ছমছমে পরিবেশ। অর্ক একটি মাধ্যমিক স্কুলের প্যারা টিচার। বয়স প্রায় পঁয়ত্রিশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। গায়ের রং শ্যামলা । বাড়িতে রয়েছে স্ত্রী ও ছেলে। অর্ক বিকেল বেলাটা ফাঁকা রাখে। বিকেলের দিকে এই শ্মশানে বেড়াতে আসে। একাই আসে। বিকেলটা এখানে কাটাতে তার ভালো লাগে। বটগাছের নিচে শান বাঁধানো বেদীতে বসে একা একা কথা কয় । সূর্যাস্তের পর অন্ধকার ঘনিয়ে এলে শ্মশানকালীর মন্দির থেকে আসে ধূপের গন্ধ। বটের শাখায় ডানা ঝাপটায় ক্লান্ত কাকেরা। ক্রমশ অন্ধকার গাঢ় হলে অর্ক চুপচাপ বসে জীবনে চাওয়া পাওয়ার হিসেব মেলায়। অন্ধকারে একজন আসে অর্কর কাছে। অর্ক ওকে দেখতে পায় না কিন্তু ওর অস্তিত্ব অনুভব করে। অর্কর পাশে বসে ও শুধু কাঁদে। কোন কথা বলেনা। অর্কও কাঁদে। তিন বছর ধরে ওরা কাঁদছে । সন্ধ্যার বাতাসে সে কান্না বহুদূর পর্যন্ত ভেসে যায়।
এক রবিবার বিকেল থেকেই আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। বৃষ্টি আসতে পারে। চারপাশ থমথম করছে। দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় ঝড়ও উঠতে পারে। এ অবস্থায় কেউ ঘর থেকে বেরোতে সাহস পাবে না। কিন্তু অর্ক বিকেল হলেই ঘরে থাকতে পারে না। যে কোন মূল্যেই তাকে বেরোতে হয়।শ্মশানটা ওকে চুম্বকের মতো টানে। আশ্চর্য ওর সম্মোহন।একটা ছাতা হাতে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। বেরোবার সময় স্ত্রী অপর্ণা বলে- তুমি কি পাগল হয়েছো? ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কেন বেরোচ্ছো ঘর থেকে ? তোমার কি প্রাণের মায়া নেই? আমাদের জন্য তুমি একটুও ভাবো না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা দাঁড়াবো কোথায়? তুমি ছাড়া আমাদের আর কেইবা আছে? যত দিন যাচ্ছে তোমার পাগলামি তত বাড়ছে। কেন প্রতিদিন শ্মশানে তোমাকে যেতে হবে? কী আছে ওখানে? সবাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তোমার মত এমন পাগলামি কেউ করে না।অর্কও সেটা বোঝে, ভালোই বোঝে। কিন্তু শ্মশানে না গিয়ে থাকতে পারে না। এমনিতে কোন মানুষ শ্মশানে যেতে চায় না। ওখানে গেলে মৃত্যুর কথা মনে পড়ে। কিন্তু অর্ক কেন যায় শ্মশানে? লোকে তো তাকে পাগল ভাবে। ভাবাটাই স্বাভাবিক। যে যা ভাববে ভাবুক ওতে অর্কর কিছু যায় আসে না। ওখানে আছে বিদিশা। অর্কর প্রথমা স্ত্রী। আজ থেকে তিন বছর আগে ওই শ্মশানের চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে বিদিশার দেহ।আকস্মিক দুর্ঘটনায় বিদিশার মৃত্যু হয়। প্রায় তিন বছর হয়ে গেল তবুও সে বিদিশাকে ভুলতে পারেনি। বিদিশার মৃত্যুর জন্য অর্ক নিজেকেই দায়ী মনে করে। ওরা কলেজে একই সঙ্গে পড়তো ম্যাথ অনার্স নিয়ে। বন্ধুত্ব থেকে ওদের মধ্যে তৈরি হয় ঘনিষ্ঠ প্রেমের সম্পর্ক। তারপর বিয়ে। অর্কর বাড়ির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তাই অনার্স পাশ করার পর সে টিউশনি করত। এমএসসি করা হয়ে ওঠেনি। চাকরি-বাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু জোটেনি। টিউশনি করেই ওকে সংসারের ঘানি টানতে হয়। বিয়ের পর বিদিশাও কিছু ছেলে মেয়েকে টিউশনি পড়াতো। দুজনের আয়ে সংসারটা গড়িয়ে গড়িয়ে চলছিল। বিয়ের বছর দুয়েক পর একটা স্কুলে অর্ক প্যারা টিচারের চাকরি পায়। বেতন তেমন কিছু নয়। সেই সঙ্গে অবসর সময়ে কয়েকটা ব্যাচ টিউশনি পড়াতো। এভাবে পুষিয়ে নিত। অর্কর বোনের বয়স প্রায় চব্বিশ। বিয়ে দিতে হবে। সে অনেক খরচের ব্যাপার। ছোট দু ভাই পড়াশোনা করছে। সে পড়াশোনার খরচ অর্ককেই টানতে হয়। মা হার্টের পেসেন্ট। মাসে মাসে অনেক টাকার ওষুধ লাগে। বাবারও বয়স হয়েছে। টাকা পয়সা তেমন কিছু নেই। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে সংসারের সব দায়িত্বটাই পড়েছে অর্কর উপর। আর ওর সহযোগী হিসাবে সংসারের কিছুটা দায়িত্ব গ্রহণ করেছে বিদিশা। অর্ককে প্রতিদিন স্কুলে যেতে হয় সাইকেলে। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় চৌদ্দ কিলোমিটার। প্রতিদিন এতটা সাইকেল চালাতে বেশ কষ্ট হয় অর্কর। মাঝে মাঝে ভাবে একটা মোটর বাইক থাকলে ভালো হতো। তাতে সময়ও বাঁচতো আবার পরিশ্রমও লাঘব হতো।
কিন্তু বাইক কেনার মত আর্থিক সামর্থ্য এই মুহূর্তে তার নেই। মাসে মাসে কিছু করে সঞ্চয় করে বোনের বিয়ের জন্য। একদিন রাতে শোবার সময় বিদিশা বলল -প্রতিদিন এতটা রাস্তা সাইকেলে করে স্কুলে যেতে তোমার খুব কষ্ট হয়। তাই ভাবছিলাম তোমাকে একটা বাইক কিনে দেব। অর্ক বলে মোটর বাইকের দাম জানো? প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি। অত টাকা তুমি কোথায় পাবে? বিদিশা মৃদু হেসে আলতো করে অর্কর চিবুক ছুঁয়ে বলে আছে গো আছে। না থাকলে আমি কি এমনি বলছি। গত দুবছর থেকে আমি মাসে মাসে কিছু টাকা আলাদা করে তুলে রাখছি। সেটা এখন জমে প্রায় লাখ টাকাই হয়ে গেছে। অর্ক বিদিশার হাতটা বুকে টেনে নিয়ে বলে তুমি আমার জন্য এত ভাবো বিদিশা। আমি তোমার জন্য এতটা ভাবতে পারিনা।এই কয়েক বছরে তোমাকে তো তেমন কিছুই দিতে পারিনি। শুধু সংসারের ঘানি টেনে চলেছি। তোমাকে পেয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে। তোমার মত স্ত্রী ক’জন পায়। মা তো অসুস্থ। সংসারের সব কাজ একা হাতে সামলাচ্ছো দশভূজার মত। পান থেকে চুন খসতে দাও না। সবার দিকে তোমার খেয়াল। তোমাকে দেখে শিখি কি করে সংসারে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে হয়, দুঃখ কষ্টকে হার মানাতে হয়। বলছিলাম বোনের বিয়ে দিতে হবে তো। তাই অতগুলো টাকা খরচ করে বাইক কেনা কি ঠিক হবে? আর কয়েকটা বছর যাক। আগে বোনের বিয়েটা দিই। তারপর না হয়তো বাইক কিনব। বিদিশা বলে ও নিয়ে তুমি একদম ভেবো না। বিয়ে ঠিক হয়ে যাবে। তোমার স্কুল যেতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। একটা বাইক তোমার খুবই দরকার। ভাবছি সামনের মাসেই তোমাকে একটা বাইক কিনে দেবো। আপত্তি করোনা। এটা প্রয়োজন, কোন বিলাসিতা নয়। পরের মাসে ওরা দুজনে একটা মোটর বাইকের শোরুমে গিয়ে একটা বাইক কিনলো। তারপর নতুন বাইকে চেপে দুজনে মহানন্দে বাড়ি ফিরল। অর্ক এখন প্রতিদিন স্কুলে যায় নতুন বাইকে চেপে। স্কুল ছুটির দিনগুলোতে অর্ক ও বিদিশা মাঝে মাঝে বাইকে চেপে ঘুরতে যায়। কখনো তারাপীঠ মন্দির, ফুল্লরা মন্দির, কঙ্কালীতলা, নলাটেশ্বরী মন্দির,বক্রেশ্বর, দুবরাজপুরের মামা ভাগ্নে পাহাড়, নীল নির্জন, ম্যাসাঞ্জোর ড্যাম, এরকম কত জায়গা। মাঝে মাঝে ভাই-বোনদেরকেও ঘোরাতে নিয়ে যায় অর্ক।
মাস দুয়েক হলো বিদিশা প্রেগন্যান্ট। দুজনের মনেই আনন্দের জোয়ার। ওদের জীবনে চুপিচুপি আসছে ফুলের মত পবিত্র একটি শিশু। গর্ভের সন্তানকে ঘিরে দুজনে হাজার স্বপ্ন দেখে। তৃপ্তিতে ভরে ওঠে মন। ওদের আর প্রতীক্ষা সইছে না। কবে আসবে সেই সুন্দর দিনটা। বিদিশাকে একজন গাইনোকোলজিস্ট দেখানো হচ্ছে। ডাক্তার বাবু বলেছেন কোন চিন্তা নেই। সব ঠিকঠাক আছে। তবে সাবধানে থাকতে হবে। কোন ভারী কাজ করা চলবে না। খুশি ও আনন্দে থাকতে হবে। ডাক্তারবাবু যেভাবে বলেছেন ঠিক সেভাবেই অর্ক ও তার পরিবার বিদিশাকে রেখেছে।শাশুড়ি বউমা ও তার সন্তানের কথা ভেবে সংসারের বেশিরভাগ দায়িত্বই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বিদিশা বলেছিল মা আপনি তো অসুস্থ এতটা পারবেন না। আমি তো ভালোই আছি। একটু আধটু কাজ করলে ক্ষতি কী? কোন অসুবিধা হবে না। শাশুড়ি বলেন এটুকু আমাকে করতে দাও মা। তুমি আমাকে নাতি নাতনির মুখ দেখাবে একি কম কথা! বিদিশা আর কোন কথা বলেনি। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও ভক্তিতে শাশুড়ির প্রতি নত হয়ে এসেছিল ওর মাথা। শাশুড়ি ও বৌমায়ের সম্পর্ক অনেক ক্ষেত্রেই সাপে নেউলে হয়। কিন্তু ওদের সম্পর্ক বড়ই মধুর। প্রেগনেন্সি সবেমাত্র তিন মাস চলছে। এ অবস্থায় যেটুকু শারীরিক সমস্যা আর পাঁচজনের হয় বিদিশারও তাই। একদিন শীতকালের বিকেলবেলা স্কুল থেকে ফিরে অর্ক বিদিশাকে নিয়ে বাইকে করে ডাক্তার রায়ের কাছে গেল। দু-একটা সমস্যা ছিল। সেটার সমাধানের জন্যই যাওয়া।ডাক্তার বাবু দেখেশুনে বললেন চিন্তার কিছু নেই। আমি দু-একটা মেডিসিন যোগ করে দিচ্ছি, ওতেই ঠিক হয়ে যাবে। ডাক্তার দেখানোর পর সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ ওরা বেরিয়ে পড়ল বাড়ির উদ্দেশ্যে।
শীতের কনকনে হাওয়ায় সন্ধ্যার অন্ধকারে ওদের গাড়িটা ছুটে চলেছে। সেদিন ছিল অমাবস্যা। আকাশে চাঁদের আলো নেই। ঘুটঘুটে অন্ধকার। অর্ক একটু দ্রুত গতিতেই বাইক চালাচ্ছে। এখন ডিসেম্বরের শেষ । শীতটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। শীতে বিদিশারও বেশ কষ্ট হচ্ছে। তাই বাড়ি ফেরার তাড়া। প্রায় ছয় কিলোমিটার এসে পিচ রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে।অদূরে রয়েছে আদিবাসীদের একটা ছোট্ট গ্রাম।বাঁকের মুখে গ্রামবাসীদের নিরাপত্তার জন্য দু-তিনটে বাম্পার রয়েছে রাস্তায়। এই জায়গাটা পেরোতে হলে গাড়ির গতি কমাতে হয়। না কমালে বিপদের আশঙ্কা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়েছে অর্ক। হঠাৎই বিপরীত দিক থেকে আসা একটা লরির হেডলাইটের তীব্র আলো এসে পড়ল অর্কর চোখে । মুহূর্তেই চোখ ঝলসে গেল। প্রায় কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। সামনেই ছিল বাম্পারটা। অর্ক সেটা ঠাহর করতে পারেনি। একটা তীব্র ঝাঁকুনি দিয়ে বাইকটা লাফিয়ে উঠলো। পিছন থেকে একটা জোর শব্দ শোনা গেল আর সেই সঙ্গে আর্ত চিৎকার । একটা যে বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অর্কর আর বুঝতে বাকি রইল না। বিদিশা বাইক থেকে পড়ে গেছে। ও তখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। অর্ক ওকে ধরে তুললো। কিন্তু বিদিশা পা ফেলে হাঁটতে পারছে না। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। রাস্তায় কোন আলো নেই। তাই মোবাইলের আলো জ্বাললো। দেখল জায়গাটা রক্তে ভেসে গেছে। বিদিশার মাথায় বেশ কয়েকটা চোট লেগেছে। সেই সঙ্গে পায়ে জোর আঘাত। এ অবস্থায় কী করবে ভেবে পেল না অর্ক। কাছাকাছি কোন মানুষজনও নেই। গ্রামটাও একটু দূরে।এখনই বিদিশার চিকিৎসা করাতে হবে। অর্কর ভয় হচ্ছে বিদিশার গর্ভের বাচ্চা কোন আঘাত পেল না তো। এ নিয়ে একটা দুঃশ্চিন্তা ওর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিছুক্ষণ পরে একটা লরি এলো। অর্ক চিৎকার করে লরির ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে অনুরোধ করলো। লরি ড্রাইভার গাড়ি থামালো। গাড়িতে দুজন খালাসি ছিল। তারাও তাড়াতাড়ি নেমে এলো গাড়ি থেকে। ইতিমধ্যে গ্রামের কয়েকজন লোক শহর থেকে সাইকেল চেপে বাড়ি ফিরছিল। তারাও এসে সাহায্যের হাত বাড়ালো। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হল।ওরা যখন হাসপাতালে পৌঁছালো তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা ন’টা হবে। ইমারজেন্সিতে বিদিশাকে নিয়ে যাওয়া হল। কর্তব্যরত ডাক্তারবাবু এবং নার্সরা ছুটে এলেন। ক্ষত স্থানগুলো পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন। মাথায় চার-পাঁচটা সেলাই লাগলো। তারপর বিদিশাকে ভর্তি করে নেওয়া হল। মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা হচ্ছিল বিদিশার। সেই সঙ্গে বমি পাচ্ছিল।
ডাক্তারবাবু বললেন বিষয়টা ভয়েরই। ওর সিটি স্ক্যান করাতে হবে। ইন্টারন্যাল কোন হেমারেজ হয়েছে কিনা পরীক্ষা করা দরকার। সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। সিটি স্ক্যানে দেখা গেল ইন্টারনাল হেমারেজ হয়েছে। এবার রাতটা সকলেরই খুব উদ্বিগ্নতার সঙ্গে কাটল। অর্কর প্রায় অর্ধ পাগল অবস্থা। ডাক্তারবাবু জানিয়েছেন অবস্থা খুব সিরিয়াস। আমাদের এখানে ওকে চিকিৎসা করার মতো তেমন পরিকাঠামো নেই। আপনারা বর্ধমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সকালবেলা বিদিশাকে নিয়ে যাওয়া হলো বর্ধমান মেডিকেলে। অ্যাডমিশন করিয়ে চিকিৎসা শুরু হল। প্রথমদিকে অবস্থা স্থিতিশীল থাকলেও দিন পাঁচেক পরে বিদিশার শারীরিক অবস্থা খারাপ হতে লাগলো। মাঝে মাঝে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । অর্ক বিদিশার মাথার পাশে বসে চোখের জল ফেলছে। বিদিশার হাতটা আলতো করে ছুঁয়ে অর্ক বলে বিদিশা এই দুর্ঘটনার জন্য আমিই দায়ী। যদি সাবধানে বাইকটা চালাতাম তাহলে এমন ঘটনা ঘটত না। বিদিশা বলে তুমি কি পাগল হলে! দুর্ঘটনা বলে কয়ে আসে না। কপালে যেটা আছে সেটা হবে। একদম চিন্তা করো না। দেখবে কিছুদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাব। রাতে অর্কর ঘুম হয় না। শুধু নিজেকে অপরাধী মনে হয়। বিদিশার অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। সাত দিনের মাথায় বিদিশার শ্বাসকষ্ট আরম্ভ হল। ওকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হলো। অর্ক খুব ভেঙে পড়ল। হাসপাতালের বাইরে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ রয়েছে। অর্ক সেখানে বসে হাউ হাউ করে কাঁদে। বিদিশার সামনে কাঁদা যায় না। ও আরো ভেঙে পড়বে । অর্কর পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে। পনেরো দিনের মাথায় বিদিশার অবস্থা আশঙ্কা জনক হয়ে উঠলো। আর অক্সিজেন সাপোর্ট নিতে পারছে না। সকলেই আশা ছেড়ে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত রবিবার ভোরের দিকে বিদিশা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। অর্ক প্রায় পাগল হয়ে গেল। রাস্তার ধুলোয় গড়াগড়ি দিচ্ছে। কেউ ওকে সামলাতে পারছে না। দুপুরে মরদেহ আনা হলো শ্মশানে। জ্বলে উঠলো চিতার আগুন। ঘন্টা তিনেকের মধ্যেই শেষ হয়ে গেল একটা জলজ্যান্ত ইতিহাস। এখন কী নিয়ে বাঁচবে
অর্ক ? ওর জীবনযাত্রা কেমন যেন অস্বাভাবিক হয়ে গেল। কারো সঙ্গে কথা বলে না। খাওয়া-দাওয়া প্রায় একরকম বন্ধ। বাড়ির লোক জোর করে একটু আধটু খাওয়ায়। স্কুল যেতে পারে না। মাসখানেক পর শোক কিছুটা প্রশমিত হলে অর্ক একটু স্বাভাবিক হলো। কিন্তু প্রায়ই শ্মশানে চলে যায়। বটগাছটার নিচে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকে। আপন মনে বিড়বিড় করে কথা বলে। কোন দিকে খেয়াল নেই। বেঁচে থাকতে আর ভালো লাগে না। স্কুলে ছুটি নেওয়া অনেকদিন হয়ে গেছে। মেডিকেল ছুটি প্রায় শেষ। তাই এবার কাজে জয়েন করে। কিন্তু ক্লাসে গিয়ে ঠিকঠাক পড়াতে পারেনা। বড় অন্যমনস্ক হয়ে যায় । একটা গভীর অবসাদ ও বিষাদ ওকে গ্রাস করে । রাতে ঘুম হয় না। শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়ল। মধ্যরাতে বিদিশা বিদিশা বলে চিৎকার করে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির লোকেরা ওকে একজন মনোবিদের কাছে নিয়ে গেলেন। ডাক্তারবাবু সব দেখে শুনে বললেন মাস ছয়েক সময় লাগবে সুস্থ করে তুলতে। কিছু মেডিসিন লিখে দিয়ে বললেন চোখে চোখে রাখবেন। কারণ সুইসাইডাল টেন্ডেন্সি আছে। বছরখানেক পেরিয়ে গেল। সবার মন থেকে বিদিশার স্মৃতি আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে যাচ্ছে । কিন্তু অর্ক এখনো স্বাভাবিক হতে পারছে না। বিদিশার বাবা মাও অর্ককে বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কোন ফল হয় না। সে যেন পাথর হয়ে গেছে। অর্ককে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে গেলে ওকে আরেকটি সম্পর্কে আবদ্ধ করা দরকার। দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু বিয়ের কথা বললেই অর্ক পাগলের মতো মারতে আসে। না এ জীবনে সে আর দ্বিতীয় কোনো নারী গ্রহণ করবে না। বিদিশার স্মৃতি নিয়েই জীবনটা কাটিয়ে দেবে। শেষ পর্যন্ত বিদিশার বাবা-মাই উদ্যোগ নিয়ে অর্কর একটি বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করলেন। অর্ক কিছুতেই রাজি হয় না।
বিদিশার বাবা বলেন আমার মেয়ে তো চলে গেছে বাবা, সে তো আর ফিরে আসবেনা। ওর মৃত্যু একটা দুর্ঘটনা। এজন্য তুমি নিজেকে দায়ী মনে করো না। তুমি আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসো। তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিও না। তোমার বয়স এখন অনেক কম। সারাটা জীবন তুমি একা একা কীভাবে কাটাবে? তুমি আবার সংসার করো। বিদিশার বাবা তাদেরই দূর সম্পর্কের আত্মীয়া অপর্ণার সঙ্গে অর্কর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন। অর্ক শেষ পর্যন্ত কিছু একটা ভেবে রাজি হল। তারপর অপর্ণার সঙ্গে বিয়ে হল। বিয়ে হলেও বিদিশাকে সে ভুলতে পারেনা। মানসিক অবসাদ কাটতে চায় না। ডাক্তারবাবুর দেওয়া অ্যান্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ নিয়মিত খায়। ওষুধ না খেলে ঘুম আসে না। অপর্ণার খুব খারাপ লাগে। ওদের সম্পর্কের মাঝে বিদিশা একটা পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে। অর্ক অপর্ণার সঙ্গে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত হতে পারেনা। এজন্য ওর খারাপও লাগে। কিন্তু কী করবে, বিদিশার স্মৃতি ওকে যে তাড়া করে।অপর্ণার ভালো লাগে না এসব। একটা মৃত মানুষের অতীত স্মৃতি আঁকড়ে কেন অর্ক ওদের বর্তমান জীবনটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে ? তবু সহ্য করে অপর্ণা। ভাবে সময় সব ঠিক করে দেবে। কিন্তু সেও তো মানুষ রক্তমাংসের মানুষ। তারও তো কিছু চাওয়া পাওয়া আছে। একটা খেদ থেকে যায় মনে। দেখতে দেখতে বছর দুয়েক পেরিয়ে যায়। অপর্ণার কোলে এল এক ফুটফুটে পুত্র সন্তান। অপর্ণা ভাবে এবার হয়তো সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। সন্তানের টানে নতুন করে অর্ক জীবনটাকে শুরু করবে। ছেলে ঋতর জন্মের পর সত্যি সত্যিই অর্কর মনে একটু একটু করে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। ছেলেকে ঘিরে নতুন করে বাঁচার একটা স্বপ্ন জাগে মনে। অপর্ণার সঙ্গেও ধীরে ধীরে একটা সংযোগ সেতু তৈরি হয় অর্কর। অপর্ণা এবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কিন্তু ভুলবো বললেই কি সব ভোলা যায় ? রাতের সব তারা যেমন থাকে দিনের আলোর গভীরে, ঠিক তেমনি করে অর্কর মনের গভীরে রয়ে যায় বিদিশার স্মৃতি।
তবে অপর্ণার সামনে সে সব আর প্রকাশ করে না। কারণ অপর্ণা কষ্ট পাবে। স্বামী হিসেবে ওকে কষ্ট দেওয়া উচিত নয়। স্ত্রী ও সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে অর্ক অনেক কিছুই স্বাভাবিকভাবে মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে। তবুও মাঝে মাঝেই দমকা বাতাসের মত বিদিশা আসে। তাই প্রতিদিন বিকেল হলেই সে শ্মশানে যায়। বটগাছটার বাঁধানো বেদিতে বসে চোখ বন্ধ করে তন্ময় হয়ে বিদিশাকে অনুভব করে। এখনো নিয়মিত রাতের বেলা এন্টি ডিপ্রেশনের ওষুধ খেতে হয় অর্ককে। তা না হলে দুশ্চিন্তার স্রোতগুলো ওকে পাগল করে। ঘুম আসে না। পাশে অপর্ণা ও ঋত পরম শান্তিতে ঘুমোয়। ওদের মুখের দিকে তাকালে অর্কর কষ্ট হয়। ওরা কত সহজ, কত সরল ,কত নিষ্পাপ। অথচ এখনও ওদের পুরোপুরি আঁকড়ে ধরতে পারছে না অর্ক। মনে হয় ওদের সঙ্গে যেন ছলনা করা হচ্ছে? শ্যাম রাখি না কুল রাখির দ্বন্দ্ব সর্বদা ওর মনে। তবে স্ত্রীর কাছে বিষয়টা আড়ালে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু আড়ালে রাখবো বললেই কি রাখা যায়? অপর্ণা সবই বোঝে। লুকিয়ে কাঁদে। সব ভাগ্য বলে মেনে নিতে চেষ্টা করে। বিয়ের আগে থেকে প্রায় সব ঘটনাই সে জানতো। ভেবেছিল এমন তো কত লোকেরই হয়। পরে সব ঠিক হয়ে যায়। এক্ষেত্রেও হয়তো তাই হবে। তাই প্রতিদিন বিকেল বেলা অর্ক শ্মশানে একা একা বেড়াতে গেলে তেমন কিছু বলে না। ভাবে বেশি কিছু বলতে গেলে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। বিকেলে ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে অর্ক যখন শ্মশানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেল তখন অপর্ণা শঙ্কিত হলেও আর কিছু বলেনি । জানে ওকে আটকানো যাবে না। তাই মনে মনে বলে – ঠাকুর রক্ষে করো। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই। তুমি ওর মনটা শান্ত করে দাও ঠাকুর।
অর্ক যখন শ্মশানে পৌঁছলো তখন চারদিক কালো মেঘের অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। কোন লোকজন নেই। মিনিট পনেরোর মধ্যেই শুরু হল প্রচন্ড ঝড়। গাছের ডাল পালা ভেঙে পড়বার উপক্রম। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো বৃষ্টি। সেই সঙ্গে বজ্রপাত। এই অবস্থায় এখানে থাকা প্রাণ সংশয়ের ব্যাপার। অর্কর মনে একটু ভয় হল। ভাবলো আজকে বেরিয়ে আসাটা ভুলই হয়েছে। অপর্ণার কথা শোনা উচিত ছিল। এই ঝড় বৃষ্টি ও বজ্রপাত দেখে অপর্ণা নিশ্চয়ই খুব আতঙ্কিত হয়ে পড়বে। বজ্রপাতের শব্দে আঁতকে উঠছে মাঝে মাঝে। এ অবস্থায় গাছ তলায় থাকা ঠিক নয়। তাই দ্রুত এলো কালী মন্দিরের বারান্দায়। বারান্দায় একটা ছাদ আছে। তার নিচেই দাঁড়ালো। কিন্তু ঝড় বৃষ্টির ঝাপটায় এখানেও টেকা যাচ্ছে না। এই মুহূর্তে অর্কর মনে পড়ছে অপর্ণা আর ঋতর কথা। হঠাৎ অর্ক পিছন থেকে শুনতে পেল কোন মানুষের কন্ঠস্বর। গায়ে কাঁটা দিল। পিছন ফিরে তাকালো। দেখলো এক জটাধারী সাধু তার পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছেন। অর্ক কেমন যেন একটু ভয় পেল। সাধু বললেন বেটা তোর কি মৃত্যু ভয় নেই? এই ঝড় বৃষ্টি মাথায় করে কেন এসেছিস এই শ্মশানে? মরীচিকার পিছনে ছুটে কেন কাছের মানুষকে দূরে ঠেলে দিচ্ছিস? তুই যাকে খুঁজছিস সে এক অশরীরী মায়া। মৃত্যুর হাত থেকে কারুর রেহাই নেই বেটা। একদিন আমি মরবো তুইও মরবি। এটাই চরম সত্য। কেন জীবনটাকে নষ্ট করছিস?
অর্ক অবাক হয়ে বলল কে আপনি? কোথা থেকে এলেন? আর এত সব জানলেনই বা কী করে? সাধুবাবা হো হো করে হেসে বললেন আরে পাগলা আমি সব জানি। যা বেটা ঘরে ফিরে যা। মন দিয়ে সংসার কর। জন্ম মৃত্যু ঈশ্বরের দেওয়া। তুই আটকাতে পারবি না। ওতে মানুষের হাত নেই। এই পৃথিবীতে যার যতদিন আয়ু সে ততদিনই থাকবে। এক তিল কমও না, এক তিল বেশিও না। অর্ক সাধু বাবাকে প্রণাম করে বলল কে আপনি? আমার সম্পর্কে এত কথা আপনি কী করে জানলেন? সাধু বাবা বললেন প্রতি অমাবস্যায় আমি এই শ্মশানকালীর মন্দিরে সন্ধ্যায় আসি। সারারাত এখানে সাধনা করি। আমি আগেও তোকে দেখেছি। কিন্তু কিছু বলিনি।কিন্তু আজ তোকে জানানোর সময় হয়েছে। যা বাড়ি ফিরে যা। অতীতের জন্য বর্তমানটাকে নষ্ট করিস না। যে এখন তোর জীবনে এসেছে ওর মধ্যেই যে হারিয়ে গেছে তাকে খুঁজেনে। শান্তি পাবি। ও বড় দুঃখীরে! ওকে আর কাঁদাসনে। কাঁদালে বড় পাপ হবে। সাধুবাবা অর্কর মাথায় হাত রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে কী যে বললেন তা বোঝা গেল না। সাধুবাবার স্পর্শে অর্কর শরীর ও মন কেমন যেন প্রশান্ত হয়ে গেল। অর্ক চোখ বন্ধ করে কোন এক গভীর ভাবনার জগতে ডুবে গেল। তারপর যখন চোখ খুলল দেখল সেই সাধুবাবা আর নেই। বিদ্যুতের আলোর মত এক ঝলক দেখা দিয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছেন। তবু অর্ক চিৎকার করে ডাকল – সাধু বাবা! ও সাধু বাবা! আপনি কোথায় গেলেন? কিন্তু কেউ কোনো উত্তর দিল না। সম্বিত ফিরে পেয়ে অর্কর মনে হল সে যেন এতকাল গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিল। কিছুতেই সে ঘুম ভাঙছিল না। হঠাৎই দৈবের মতো সাধু বাবা এসে ওর ঘুম ভাঙালেন। এখন নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। মনে একটা প্রসন্নতার ভাব। ঘরে ফেরার জন্য মনটা ছটফট করছে। অপর্ণা এবং ঋতর মায়াবী মুখটা এই অন্ধকারেও সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। মনে হচ্ছে ওদেরকে ছেড়ে এতদিন সে যেন কোন এক অজানা রহস্যময় জগতে হারিয়ে গিয়েছিল। ঘরে ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছিল না।এই সাধুবাবা দৈবের মতো এসে ফেরার পথটা কত সহজে দেখিয়ে দিলেন। অন্ধকারের বুক চিরে অর্ক এখন আলোর গতিতে এগিয়ে চলেছে ঘরের দিকে যে ঘরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে জীবন-যুদ্ধে ক্লান্ত বিধ্বস্ত দুটি সরল সবুজ প্রাণ।
সুজন
আজ এক অখ্যাত ছাপোষা মানুষের কথা বলব। যে মানুষটা কোনদিন কারো নজরে পড়েনি। পড়বেই বা কেন চলনে বলনে পোশাকে চেহারায় কোন বিশেষত্বই নেই। একেবারে সাদামাটা মানুষ,এলেবেলে মানুষ। ও যে একটা গল্পের চরিত্র হতে পারে কেউ ভাবতেই পারবে না। ও আমার ৩৪ বছরের বন্ধু,খুব কাছের বন্ধু। ওর পিতৃদত্ত নাম ? না বলবো না। ওটা গোপনই রাখলাম। ধরুন গল্পের খাতিরে ওর নাম দিলাম সুজন। এ নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। নাম একটা হলেই হল। ও অনার্স গ্রাজুয়েট,একসঙ্গে কলেজে পড়েছি। খুব হাসি খুশি,আমুদে, রসিক। চাকরি পায়নি। কাঠ বেকার। এই মফঃস্বল শহরের অলি-গলিতে টিউশন পড়ায়। রোজগার সামান্য। বয়স এখন তিপান্ন পেরিয়ে গেছে। বিয়ে থা করেনি। মানে করার সামর্থ্য ছিল না। নিজের ভাতেই বেগুন পোড়া তা আবার শংকরাকে ডাক। নিজেরই চালচুলোর ঠিক নেই, বউ পুষবে কী করে? ওর একটা ঘোড়ারোগ আছে,পরোপকার করা। ও যেন অনেকটা সরকারি সম্পত্তির মত। পাড়ার যার যেখানে দরকার পড়ে ওকে ডাকে। কাউকে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়া, কেউ বাইরে গেলে তার ঘর আগলে দেওয়া, কারো হাটবাজার করে দেওয়া এইসব। এসবের জন্য কেউ কেউ যৎসামান্য টাকা পয়সা দিতে গেলে নেয় না। বলেছিলাম তোর চলবে কী করে? নিতেই পারিস, এতে কোন অপরাধ নেই। হাসতে হাসতে বলে- ধুর মানুষের উপকার করে টাকা নেব, পাগল নাকি? টাকার বিনিময়ে কিছু করলে নিজেকে বড় ছোট মনে হয় রে! বললাম শালা, তুই তো মরুভূমিতে মরূদ্যান রে!
আশপাশের মানুষের জন্যও অনেক কিছুই করে। কিন্তু কেউ জানতে পারে না। নীরবে করে, নিঃশব্দে করে, ঢাক পেটায় না। বড় বড় লোকেরা মানুষের জন্য কিছু একটা করলে (গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজাও করে) মিডিয়া ডাকে,ছবি তোলে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি, ভিডিও পোস্ট করে। কাগজে হেডলাইন হয়। সমাজ সেবার জন্য সম্মাননা পায়, সম্বর্ধনা পায়, প্রচারের আলোয় আসে। সারা দেশ পৃথিবী ওদেরকে বাহবা দেয়। কিন্তু এই অখ্যাত সুজনকে কেউ চেনে না, জানে না, ও জানাতেও চায়না। বলে কী আর করেছি এমন, রামমোহন বিদ্যাসাগর তো নই। পৃথিবীতে কত মানুষ কত বড় বড় কাজ করছেন আমার কাজ তার তুলনায় কতটুকু? মহাসমুদ্রের তীরে আমি তো একটা নুড়ি মাত্র। আমার ক’পয়সাই বা মূলধন? ভাঙাচোরা টালির ঘরে থাকি, দিন আনি দিন খাই। কত লোক বিদ্রূপ করে বলে- পেটে ভাত নেই আবার সমাজসেবা!পাগল পাগল, বদ্ধ পাগল! ময়ূরাক্ষী নদীপাড়ে একটা বস্তি আছে। ২০-২৫ টা দরিদ্র পরিবার ওখানে বাস করে। কেউ দোকানে কাজ করে, কেউ লোকের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে, কেউ রিকস ও টলি চালায়, কেউ লেবার খাটে। ওদের সঙ্গে সুজনের খুব ভাব। ওরা ওর খুব কাছের মানুষ। ওদের কারো অভাব পড়লে ৫০- ১০০ টাকা সাহায্যও করে। ওর বেশি দেওয়ার সাধ্যও নেই। কিন্তু ওই বস্তির লোকগুলো আশুতোষ শিব। অল্পেই সন্তুষ্ট। পঞ্চাশ একশ টাকাও ওদের কাছে অনেক। সেদিন রতন কাকা বলল সুজন ভাইপো ১০০ টাকা হবে? রিক্সাভ্যানটা মেরামত করাতে হবে। দুদিন থেকে জ্বর, কাজ করতে পারিনি,হাতে পয়সা নেই। দিন দশকের মধ্যেই তোমাকে শোধ করে দোব। সুজনের টিউশনির এক ছাত্র আজই ২০০ টাকা মাইনে দিয়েছে। টাকাটা সুজনের পকেটেই ছিল। পকেট থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে রতন কাকার হাতে দিয়ে বলল – না না শোধ করতে হবে না। আজকালকার দিনে ১০০ টাকার কী দাম আছে কাকা। রতন ওর মাথায় হাত রেখে বলল- বাবা ভগবান তোমার মঙ্গল করুন। মাঝে মাঝে সুজনের উপর আমার খুব রাগ হয়। এক পয়সাও সঞ্চয় করে না বলে।
কতবার বলেছি মাসে মাসে কিছু টাকা পোস্ট অফিসে রেকারিং ডিপোজিট করে রাখ। তোরও তো ভবিষ্যৎ আছে। চিরদিন শরীর তো সাথ দেবে না। এখন টিউশন করতে পারছিস, তোর শরীর খারাপ হলে তখন পয়সা কোথায় পাবি? কে দেখবে তোকে? হাতে কিছু টাকা থাকলে ভরসা পাবি। টিউশনিতেও কেমন কম্পিটিশন বুঝতেই তো পারছিস। যা বেকার ছেলে বেড়েছে তাতে স্টুডেন্টের চেয়ে টিউশন টিচারের সংখ্যা বেশি। এই কম্পিটিশনের বাজারে টিউশন জোগাড় করা যে কত কঠিন সে তো তুই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিস। টিউশন আজ আছে কাল নেই। মাসে মাসে কিছু টাকা জমা রাখ। অন্ততঃ মাসে চার পাঁচশো টাকা রাখার চেষ্টা কর। এই টাকাটা জমে এক সময় অনেক হবে। খুব কাজে লাগবে। এভাবে সব দান খয়রাত করা ঠিক নয়। দয়ার সাগর বিদ্যাসাগরও দান করতেন, কিন্তু কী জানিস ওনার নিজের খরচের টাকাটা কিন্তু পকেটে রাখতেন। আগে নিজে বাঁচবি, তবে তো অন্যকে বাঁচাবি। এভাবে কপর্দক শূন্য হয়ে জীবন কাটানো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। এটা এক ধরনের বোকামি। সুজন বলে কী আর করব বল। কপালে যা আছে তাই হবে। মাসের শেষে তেমন কিছু থাকে না। মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখলে মন কাঁদে। সুজনের বাড়িতে বাবা, মা, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী ও এক ভাইপো আছে। বেশ বড় পরিবার। সংসারে আর্থিক সচ্ছলতাও নেই। বাবা একটা মিলে কাজ করতেন। শরীর অসুস্থ হওয়ায় কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। এখন কিছু করতে পারেন না। ভাই একটা প্রাইভেটফার্মে খুব অল্প বেতনে কাজ করে। যা রোজগার হয় তাতে কোনো রকমে সংসার চলে। সুজন মাসে মাসে কিছু করে সংসারে দেয়। বাকিটা দান খয়রাত করে। ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর জন্য বাড়িতে বাবার কাছে গঞ্জনা শুনতে হয়। গঞ্জনা দেওয়াটাই স্বাভাবিক। সুজনের কাছে বাবা মায়ের অনেক প্রত্যাশা ছিল। শিক্ষিত গ্রাজুয়েট ছেলে মাস গেলে মোটা টাকা ইনকাম করবে। সংসারটাকে দাঁড় করাবে। চাকরি তো কপালে জুটলোই না। তার ওপর ঘোড়ারোগ পরোপকার। ভূতের বেগার খাটা। বাবা একদম সহ্য করতে পারতো না এসব। মাঝে মাঝে বাপ-বেটাতে কথা কাটাকাটিও হতো। পরিবারের সবাই ওর উপর খাপ্পা। বাবা বহুবার চেষ্টা করেছিলেন ওকে সংসারী করার। কিন্তু কে শোনে সে কথা ! সুজন স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ওর পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব নয়। এসব নিয়ে সম্পর্কে টানাপোড়েনও সৃষ্টি হয়। রেগে গিয়ে সুজন বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়েও গেছে। কয়েক মাস পর আবার ফিরেও এসেছে। সুজন কেমন যেন অদ্ভুত ধরনের। অত্যন্ত সাদামাটা, পোশাক আশাকে জাঁকজমক নেই। পাড়ায় পাড়ায় লুঙ্গি পড়ে ঘুরে বেড়ায়। হাঁটুর ওপরে লুঙ্গি পরে। ওর বাবা মাঝে মধ্যে এই নিয়ে খিচ খিচ করে বলে – তুই কি রাখাল-বাগাল? একটা গ্রাজুয়েট ছেলের পোশাক দ্যাখো! লোকে এমনি তোকে ক্যাবলা বলে! কেউ সম্মান দেয় না। সুজন কথাগুলো এক কানে ঢোকায় আর এক কানে বের করে দেয়। এতে বাবা আরও রেগে যান। কিন্তু রেগে কোন লাভ নেই। ওকে কিছুতেই পাল্টানো যাবে না।
কয়েক বছর আগে ফটিক মিস্ত্রির মাকে নিয়ে সে এক কাণ্ড! ফটিক মাকে দেখে না। মাকে জব্দ করবার জন্য বউকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে অন্য পাড়ায় ভাড়াবাড়িতে চলে গেছে। পুরনো ভাঙা টালির বাড়িটা সবজিওয়ালা মদনকে বিক্রি করে দিয়েছে। বুড়ি আতান্তরে পড়েছে। কোথায় থাকবে এখন? পাড়া-পড়শি হয়তো দু এক দিন থাকতে দেবে। তারপর কী হবে? বুড়ি এখন ঘোষদের বাড়ির বাইরের দিকে যে ছোট্ট বারান্দা রয়েছে ওখানেই আশ্রয় নিয়েছে। ওখানেই থাকে ও ঘুমোয়। কিন্তু খাবে কী? প্রথম প্রথম কয়েকদিন কেউ কেউ দয়া করে খাবার দিয়েছে। কিন্তু প্রতিদিন কে আর দেবে? সবাই নিজের ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত। দুই একজন বুড়ির মুখের সামনেই বলে তুমি ছেলের বউয়ের সঙ্গে যে কাণ্ড করে রেখেছো তাতে তোমার কপালে এরকমই হওয়ার কথা! বউটাকে তুমি কম জ্বালাওনি। এবার শোধ নিচ্ছে। বোঝো ঠ্যালা! কত ধানে কত চাল। বুড়ি আর কী করবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। যা হবার তা হয়ে গেছে আর তো কিছু করার নেই। সেসব তো আর ফেরানো যাবে না। দুদিন ধরে খুব বৃষ্টি। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ। রাস্তাঘাট জলে থই থই করছে। বুড়ির ছিল একটা কাঁথা, আর একটা চাদর ওগুলো সব বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে গেছে। ঠক ঠক করে কাঁপছে ঠান্ডায়। ভিজে কাঁথার ওপরেই বসে আছে। দুদিন থেকে কপালে খাবার কিছুই জোটেনি। রাস্তার কল থেকে এক বোতল জল এনে খেয়েছে। রাস্তাঘাট শুনশান। লোকজন নেই। কারো কাছে যে ভিখ মাগবে তারও উপায় নেই। তাই দুদিন থেকে অনাহারেই রয়েছে।
ও পথ দিয়েই ছাতা মাথায় সুজন যাচ্ছিল সবজি বাজারে। বুড়ি ওকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদে বলল -বাবা সুজন আমাকে দুটো মুড়ি দিতে পারিস? দুদিন থেকে কিছু খাইনি। ছেলে বউ আমাকে তাড়িয়ে দিয়ে বাড়ি বিক্রি করে দিয়েছে। তাই এখানেই মাথা গুঁজেছি। দ্যাখ বাবা কাপড় কাঁথা সব ভিজে গেছে। সুজন অনেকদিন ধরেই বুড়িকে চেনে। কিন্তু এর মধ্যে যে এতো কাণ্ড ঘটে গেছে তা সে ঘুণাক্ষরেও জানতো না। বুড়িদের পাড়া দিয়ে কিছুদিন যায়নি সে। বুড়ির এই অসহায় অবস্থা দেখে খুব মায়া হল সুজনের। খুব কষ্টও হল। মনে মনে ফটিক মিস্ত্রি ও তার বউকে গালাগাল দিল সুজন। সত্যি, ছেলে বউ বটে! মানুষ এতটা নিষ্ঠুর হয় কী করে? আরে মা যাই করুক তোকে তো দশ মাস দশ দিন পেটে ধরেছিল। লোকের ঘরে কাজ করে খাইয়ে পরিয়ে মানুষ করেছে। মায়ের নুন তো খেয়েছিস একদিন। আর আজ বউয়ের কথায় এভাবে মাকে ফেলে দিলি! বাড়িতে কুকুর বিড়াল থাকলেও লোকের মায়া হয়। আরে, এ তো তোর মা! একটুও মায়া হল না। প্রৌঢ় বয়সে হয়তো তোর বউয়ের সঙ্গে অন্যায় করেছে, কিন্তু তাই বলে এভাবে অমানুষের মতো শোধ নিবি। শালা, তুই মানুষ, না জানোয়ার! রাগে গাটা রিরি করে ওঠে সুজনের। মনে মনে বলে শালা আজব দুনিয়া। সুজন বুড়িকে বলল তুমি একটু অপেক্ষা কর মেনকা মাসিমা। আমি এক্ষুনি আসছি । এই বলে হন হন করে বাজারের দিকে চলে গেল। মিনিট পনেরো পরে ফিরে এল চপ মুড়ি নিয়ে। বুড়ির থালাতে মুড়ি ঢেলে দিয়ে বলল -খাও মাসি খাও পেট ভরে খাও। বুড়ির চোখে জল চিকচিক করছে। তু আমার সত্যিকারের ব্যাটারে বাবা। খিদেই পেট জ্বলছিল। তু আমাকে বাঁচালি । ভগবান তোর মঙ্গল করুন। সুজন বলে- কী আর করলাম মাসি। এটা এমন কিছু নয়। তোমার মত এরকম মানুষ পৃথিবীতে হাজার হাজার আছে। এ সমস্যা সমাধান করার মানুষ কোথায়? তোমার জন্য যা করলাম এ আর কতটুকু ! মানুষের পিপাসা এক সমুদ্র, এক ফোঁটা জল দিলে তেষ্টা কি মেটে? আমরা সবাই তো নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। যাকগে ওসব কথা। বৃষ্টিতে তোমার কাঁথা কাপড় সব ভিজে গেছে। তুমি থাকবে কী করে? বুড়ি বলে -জানি না বাবা, ভগবান জানে। এবেলাটা না হয় মুড়ি খেলে রাতে কী খাবে? তাও জানিনা ব্যাটা। জল খেয়ে শুয়ে পড়বো। এই বাড়ির বারান্দায় তুমি আছো কিন্তু তোমাকে তো যেকোনো সময় ওরা তাড়িয়ে দেবে। ওরা এখন বাড়িতে নেই বলে তুমি আশ্রয় পেয়েছো। বাড়ি ফিরলে কিন্তু মনে হয় এখানে তোমাকে থাকতে দেবে না। তাও ঠিক। কী করব,গাছ তলায় পড়ে থাকব। কথাটা শুনে খুব কষ্ট হল সুজনের। বুড়ির কণ্ঠস্বরে কেমন যেন একটা মা মা গন্ধ। শোনো মাসি চিন্তা করোনা, রাতের বেলা তোমাকে আমি খাবার দিয়ে যাব। দেখি কোথাও তোমার একটা থাকার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা। বুড়ি হুহু করে কেঁদে উঠে বলল-সুজন তু মানুষ না ভগবান?
কী যে বল মাসি, আমি ভগবান হতে যাব কেন? আমি একটা মানুষ, রক্ত মাংসের মানুষ। আমারও তেমন টাকাপয়সা নেই, প্রতিপত্তি নেই, পাকাবাড়ি নেই, ঘরে অভাব, টিউশনি পড়িয়ে খাই। বেশ শোনো আমি এখন আসছি। সন্ধেবেলায় টিউশনি পড়িয়ে তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসব। এই বলে সুজন চলে গেল। বুড়ি ছলছল অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল সুজনের পথের দিকে। বুড়ির মনে হল ছেলেটার সঙ্গে যেন ওর জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক।
বিকেলে সুজন ময়ূরাক্ষী নদীপাড়ের বাঁধে গেল। ওখানে পৌরসভার ওয়াটার সাপ্লাইয়ের জন্য তৈরি করা একটা পরিত্যক্ত জীর্ণ পুরনো বাড়ি পড়ে রয়েছে। কেউ থাকেনা। ওখানে যেসব গরিব মানুষেরা বাস করে তাদের পোষা ছাগলগুলো ও ঘরটাতে থাকে। এই ঘরটার কথাই হঠাৎই মনে পড়েছিল সুজনের। ভেবেছিল বুড়ির ওখানে একটা হিল্লে হয়ে যেতে পারে। তাই বিকেলের দিকে এল ঘরটা দেখতে। আদৌ ওখানে থাকার মত পরিস্থিতি আছে কিনা। নিজের বাড়িতে বুড়িকে নিয়ে গিয়ে রাখার মত পরিস্থিতি নেই। বাড়িতে পর্যাপ্ত ঘরও নেই। কোনরকমে মাথা গুঁজে ওরা থাকে। তাছাড়া বাবা ভাই এতটা বাড়াবাড়ি পছন্দও করে না। নিজের ঘরেই যার অভাবের হাজার ছিদ্র সে আবার অন্যের দায় মাথায় নিচ্ছে। ওর বাবার তো মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ছেলেটার মাথা ঠিক আছে তো ! না হলে এরকম পাগলামি কেউ করে ? সংসারের আর পাঁচজনের মত ছেলেটা যদি হতো তাহলে সংসারটা রক্ষে পেত। ভগবান কোন ধাতু দিয়ে যে ছেলেটাকে গড়েছেন কে জানে ! সুজন ভাঙা ঘরটাতে ঢুকে চারপাশ দেখে নিল। চার দেওয়ালে ছোট ছোট ফাটল। নোনা ধরে গেছে দেওয়ালে। দরজা-জানলা সব ভাঙা। উইয়ে খেয়ে ফেলেছে সব। মেঝের প্লাস্টার নষ্ট হয়ে গেছে। ছোট্ট ঘর। কোনরকমে একটা মানুষ থাকা যাবে। ঘরে ছাগল থাকার জন্য ছাগলের মলমূত্রের দুর্গন্ধ উঠছে। তবু ঘরটা দেখে কিছুটা ভরসা পেল সুজন। কাছাকাছি একটা বাড়ি থেকে একটা ঝাঁটা আনলো। জোগাড় করল বালতি মগ। ঘরটার ঝুল ঝেড়ে ভালো করে ঝাঁট দিল। নদী থেকে কয়েক বালতি জল তুলে এনে দেওয়াল ও মেঝে ধুয়ে ফেলল। একটু দূরে মধুর দোকান থেকে জোগাড় করল ফিনাইল ও ব্লিচিং। তারপর ফিনাইল ও ব্লিচিং পাউডার দিয়ে ঘরটাকে জীবাণুমুক্ত করল। কয়েকটা ধূপবাতি জ্বালালো। ঘরের দুর্গন্ধ অনেকটাই দূর হলো। কিন্তু ঘরের দরজা জানালা যে সব নষ্ট হয়ে গেছে। কুকুর, বিড়াল, ইঁদুর, সাপ কত কী সব ঘরে ঢুকে যেতে পারে। আবার বৃষ্টি হলে জলের ছাটও ঢুকে যাবে। কিছু একটা ব্যবস্থা করা দরকার। হঠাৎ রতন ভ্যানওয়ালা এসে হাজির। এসে বলল কীগো ভাইপো, এই ভাঙা ঘরটা পরিষ্কার করছ কেন? কী করবে? আর বলো না কাকা ওই যে ওপাড়ার মেনকা মাসি, ওই যে গো ফটিকের মা, ওর একটা থাকার ব্যবস্থা করতে এসেছি। অবাক রতন বলে ফটিকের মায়ের আবার কী হলো? ও এখানে থাকবে কেন? কী আর বলব কাকা, ফটিক বুড়ি মাকে ঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। ঘোষদের বাইরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছে। ঘোষরা এখন বাড়ি নেই তাই কিন্তু বাড়ি ফিরলে তো ওখানে থাকতে দেবেনা। তখন বুড়ির কী হবে? তাই ভাবলাম এই ঘরটা তো ফাঁকা পড়ে আছে,এখানেই বুড়ির একটা হিল্লে হয়ে যাবে। তাই ঘরটা পরিষ্কার করছি। কী কাকা এ ঘরে থাকা যাবে না? হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই যাবে। দাঁড়াও তোমাকে একটু সাহায্য করি। রতনও একটু হাত লাগালো। ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে দুজনে ঘরটাকে পরিষ্কার করে ফেলল। রতন বলল কিন্তু ভাইপো ঘরের দরজা-জানলা যে সব নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে তো? তাইতো ভাবছি কাকা কী করা যায়। তুমি কিছু চিন্তা করো না ভাইপো। আমার বাড়ি থেকে কয়েকটা ছোট বাঁশ আর পলিথিন চটের বস্তা নিয়ে আসছি। ওগুলো জানলায় লাগিয়ে দেব। অনেকদিন থেকে একটা ভাঙা টিনের দরজা আমার বাড়িতে পড়ে আছে।
ওটা এখানে লাগিয়ে দেব। কাকা তোমার জবাব নাই। মুশকিল আসান করে দিলে। কিছুক্ষণ পরে রতন ওর বাড়ি থেকে ছোট বাঁশ ,পলিথিন চট ও ভাঙা টিনের দরজাটা নিয়ে এল। দুজন মিলে দরজা-জানলা ঠিক করে ফেলল। মোটামুটি থাকার মত একটা ব্যবস্থা হল। সুজন যাবার সময় রতনকে বলল-কাকা, বুড়িকে তোমরাও একটু দেখো। তোমার তো কাছেই বাড়ি। আমি তো পড়াতে যাই তাই সব সময় আসতে পারব না। কোন কিছু অসুবিধা হলে ম্যানেজ করে নিও। বিশেষ কিছু হলে আমাকে খবর দিও। আজকেই সন্ধ্যায় বুড়িকে এখানে নিয়ে আসব। সুজন চলে গেল। রতন আপন মনে বলল ছেলেটা সত্যিই ভগবান! দীন দুঃখীর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। ভগবান তুমি ওর মঙ্গল করো।
একটা বাড়িতে টিউশন পড়িয়ে রতন যখন ফিরলো তখন সন্ধ্যে ছ’টা বেজে গেছে। বাড়িতে একবার দেখা করে, এল বুড়ির কাছে। বুড়ি বলল এসেছিস বাবা। হ্যাঁ মাসি এলাম। তোমার থাকার একটা ব্যবস্থা করেছি, চলো আমার সঙ্গে। কোনখানে বাবা? ওই নদী বাঁধে। বুড়ি ও তার লোটা কম্বল নিয়ে সুজন হাজির হলো নদীবাঁধে। ঘরটা দেখিয়ে বলল -মাসি এইটা তোমার থাকার ঘর। একটু কষ্ট করে থাকতে হবে। কী করবে বলো, উপায় তো নাই! বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বলল- এটাই অনেকরে বাবা! কী আর বলব কোন জন্মে তুই আমার ছেলে ছিলিস। সুজন একটা মাদুর জোগাড় করে এনে মেঝেতে পেতে দিল। তারপর বুড়ির কাঁথাটা পাতল। কল থেকে একটা ছোট বালতিতে খাবার জল এনে বলল- মাসি তেষ্টা পেলে এই জলটা খেও। রতন কাকার বাড়ি থেকে এই গ্লাসটা এনেছি। এই গ্লাসে তোমার জল খাওয়া হবে। মশা তো খুব। কালকে একটা মশারি কিনে দেবো। আজকে মশা তাড়ানো ধূপবাতিতেই রাতটা কাটাও। আর রাত আটটার দিকে হোটেল থেকে খাবারে এনে তোমাকে দিয়ে যাব। কোন ভয় নাই। রতন কাকাকে বলে দিয়েছি কোন অসুবিধা হলে ওকে ডেকো। আসি তাহলে। বুড়ি ভগবানকে স্মরণ করতে করতে বলল- আয় বাবা।
সুজন নদীবাঁধ থেকে সোজা বাড়ি এল। বুড়ি সম্পর্কে বাড়িতে কাউকে কিছু জানাল না। জানালে ঝামেলা হবে। বাবা তো রেগে খাপ্পা হয়ে যাবে। এখন থাক,পরে জানাবে সব। বাজারে একটু কাজ ছিল সে সব সারতে সারতে রাত পৌনে আটটা হয়ে গেল। ভজনদার হোটেল থেকে সস্তা দামের ডাল ভাত সবজি টিফিন ক্যারিয়ারে করে নিয়ে এল বুড়ির জন্য। এসে দেখল ঘরে একটা লন্ঠন জ্বলছে। এই ঘরে যে ইলেকট্রিক আলো নেই সেটা খেয়ালই ছিল না সুজনের। বলল মাসি কে দিল এই লন্ঠনটা? আমি তো আলোর কথা ভুলেই গেছিলাম। রতন দিয়ে গেছে বাবা। এসে বলল মাসি আঁধারে থাকবে কী করে? আমার বাড়িতে একটা পুরনো লন্ঠন ছিল তোমাকে দিয়ে গেলাম। বুড়ির থালাতে সুজন খাবারটা বেড়ে দিল। তুই খাবি না বাবা? হ্যাঁ মাসি খাব, বাড়ি গিয়েই খাব। একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে সুজনের। প্রতিদিন হোটেল থেকে ভাত এনে খাওয়ানো কি সম্ভব? টিউশন থাকে, অত সময় সে পাবে কোথায়? আচ্ছা কাছাকাছি কারো বাড়িতে খাবার ব্যবস্থা করা যায় না? একটু ডালভাত সবজি টাকার বিনিময়ে যদি কেউ দিত। ভাবতে ভাবতে রতনের কথাটা মাথায় এল। ও যদি টাকার বিনিময়ে খাবারটা দিয়ে যায়, তাহলে খুব ভালো হয়। বলে একবার দেখাই যাক না। বুড়িকে খাবার খাইয়ে সুজন এল রতনের বাড়ি। রতনের বউ তখন ভাত বাড়ছে। ওরা খেতে বসবে। সুজন বলে কাকা একটা কথা বলছিলাম। কী কথা বাবা। বলছিলাম কিছু টাকাপয়সা নিয়ে বুড়িকে যদি তুমি দুবেলা একটু ভাত দাও তাহলে খুব ভালো হয়। রতন বলে তাইতো বাবা ওর যা অবস্থা তাতে দুটো ভাত এমনিই দিতে হয়। কিন্তু আমিও তো গরিব মানুষ সে ক্ষমতা নাই। তোমার কাকী কী বলছে দেখি। রাঁধাবাড়া তো ওই করবে। রতন বউকে বলে কীগো শুনলে তো সব। পারবে তো? বউ বলে- কী আর করা যাবে,দেবো দুটো রেঁধে। আমাকে তো রাঁধতেই হয়। খুব ভালো হল কাকা। তুমি আমার মুশকিল আসান করে দিলে। তাহলে কাল থেকেই দিও। রতন বলে কোন চিন্তা নাই বাবা, দায়িত্ব যখন নিয়েছি তখন পালন করবই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সুজন বাড়ির পথে পা বাড়ায়। কিন্তু আবার একটা চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। দু এক দিনের ব্যাপার নয় বুড়ি যতদিন বাঁচবে ততদিন ওকে খাবার জোগাতে হবে। এতদিন সে খরচ টানবেই বা কী করে? রোজগার বলতে সামান্য কিছু টাকার টিউশন। বিকল্প একটা কিছু করা দরকার। রাতে শুয়ে ভাবনাটা আবার মাথায় এলো। হঠাৎই একটা উপায় খুঁজে পেল। আরে বুড়ির একটা সরকারি বার্ধক্য ভাতা বের করতে পারলেই তো সমস্যা মিটে যায়। মাসে মাসে হাজার টাকা মিলবে। যদি আর কিছু দরকার হয় সেটা না হয় সে দেবে। তাহলে আর কোন চাপ হবে না। কিছুদিনের মধ্যেই যাবতীয় কাগজপত্র জোগাড় করে বার্ধক্য ভাতার একটা ব্যবস্থা করে ফেলল।
এভাবেই বছর দুয়েক পেরিয়ে গেল। সুজন দুবেলা বুড়ির খোঁজখবর নেয়।ওর সুবিধা-অসুবিধা দেখে। কিছুদিন থেকে বুড়ির শরীর বেশ ভেঙে পড়েছে। বয়স আশি-বিরাশি। আগের মত শারীরিক সক্ষমতা নেই । ভালো চলাফেরাও করতে পারেনা। বার্ধক্য জনিত নানা রোগ শরীরে বাসা বেঁধেছে। স্মৃতিশক্তিও কমেছে। সব কথা মনে রাখতে পারেনা। মাস তিনেকের মধ্যে বুড়ি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ল। একেবারে বিছানাগতি। কে দেখবে ওকে? সুজন খুব চিন্তিত। বড় ঝুঁকি নিয়েছে সে। তেমন টাকাপয়সাও নেই যে দেখাশোনা করার জন্য একটা লোক রাখবে। যেমন করেই হোক বুড়িকে তো উদ্ধার করতে হবে। টিউশন পড়ানোর পর যেটুকু সময় থাকে সেটা বুড়ির পেছনেই ব্যয় করে। বুড়ি এখন পায়খানা পেচ্ছাপ ধরে রাখতে পারেনা। সব বিছানাতেই করে ফেলে। ঘরে দুর্গন্ধে ঢোকা যায় না। সুজন সেসব নদীর ঘাটে কেঁচে পরিষ্কার করে। বুড়ির গায়ের নোংরা আবর্জনা বালতিতে করে জল এনে ধুয়ে দেয়। এভাবে মাসখানেক চলল। একদিন সন্ধেবেলায় খুব বৃষ্টি। সুজন ছাতা মাথায় টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরছে। লোডশেডিং এর জন্য রাস্তায় আলো নেই। দেখলো অন্ধকারে একটা লোক হনহন করে ছুটে আসছে। কাছাকাছি হতেই লোকটা বলল -ভাইপো তোমাকেই খুঁজতে এসেছি। কী হয়েছে রতন কাকা? আধঘন্টা আগে আমি বুড়ির ঘরে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি বুড়ির সাড়া নাই। নড়াচড়া করছে না। কত ডাকলাম কিন্তু সাড়া দিল না। নাকে আঙুল দিয়ে দেখলাম শ্বাস বন্ধ। বুড়ি বোধহয় আর বেঁচে নাই। চলো দেখবে চলো। হন্তদন্ত হয়ে সুজন রতনের সাথে বুড়ির ঘরে এল। দেখল বুড়ির দেহটা নিঃসাড় পড়ে আছে। না ও আর বেঁচে নেই। পাড়ার কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে রতনের ভ্যানে চাপিয়ে বুড়ির নিঃসাড় দেহটা নিয়ে এল হাসপাতালে। ডাক্তারবাবু পরীক্ষা করে বললেন বেঁচে নেই ,মারা গেছে। তারপর ডেড বডি নিয়ে আসা হল নদীপাড়ের বাঁধে। আশপাশের বেশ কিছু লোকজন জড়ো হয়েছে। অনেকের চোখেই জল। কেউ কেউ বলল ভগবান মুখ তুলে তাকিয়েছেন। তাই ওকে তুলে নিয়েছেন। মরে ও শান্তি পেল। আর সুজনকেও বাঁচিয়ে দিল। মৃতদেহ দাহ করতে হবে। এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে শ্মশান। সেখানেই নিয়ে যাওয়া হবে বুড়ির দেহ। কিন্তু তার আগে যে মুখাগ্নি করতে হবে। মুখাগ্নি তো ছেলেকেই করতে হয়। কেউ কেউ বলল ওর ছেলেকে খবর দাও। কিন্তু ও কি আসবে? যদি না আসে তবে সুজনই মুখে আগুন দেবে। একবার খবর দিয়েই দেখ না। ছেলেকে খবর দেওয়া হল। ঘন্টা দেড়েক পরে ছেলে ফটিক এবং বৌমা এল। ফটিক এসে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। কেউ কেউ বলল- সব লোক দেখানো
মড়াকান্না। মা বেঁচে থাকতে একদিন দেখল না। এখন আবার কান্না দেখানো হচ্ছে। সুজন ফটিক আসার পর একপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছিল। মুখাগ্নির ব্যবস্থা করা হল। নদীর ঘাটে মায়ের মুখে আগুন দিলে ফটিক। মৃতদেহ দাহ করার তো কিছু খরচ আছে। সে খরচ কে দেবে? ফটিক না সুজন? এ নিয়ে লোকজনের মধ্যে গুঞ্জন হচ্ছে। ফটিক স্পষ্ট জানিয়ে দিল ওর কাছে কোন টাকা নেই। দাহ করার খরচ দিতে পারবে না।
সুজন তার কিছু বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নিয়ে দাহকার্য সম্পন্ন করল। ফটিক আর শ্মশান পর্যন্ত যায়নি। মুখাগ্নি সেরে বউকে নিয়ে সোজা বাড়ি চলে যায়। নিজের সংসারের অমঙ্গলের কথা ভেবে দিন দশেক পরে মায়ের শ্রাদ্ধ-শান্তি করে কিছু লোককে খাইয়েছিল।তবে সে শ্রাদ্ধ-শান্তিতে সুজনকে আমন্ত্রণ জানায়নি।
কয়েক বছরের মধ্যে সুজনের বাবা-মা গত হলেন। ভাইও ক্যান্সারে মারা গেল। বাড়িতে পড়ে রইল ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী ও এক নাবালক ভাইপো। ওদের কোন রোজগার নেই। জমানো টাকাও নেই। ওরা অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে সুজনের মুখের দিকে। সংসার না করেও সুজন এখন সংসারের ঘানি টানছে। এই মফঃস্বল শহরের অলিগলিতে একটা ভাঙা সাইকেল চেপে ও রোজ টিউশন পড়াতে যায়। সাধারণ অতি সাধারণ এক্কেবারে ছাপোষা এক তুচ্ছ মানুষ। এই শহরের নামিদামী লোকেরা ওকে কেউ চেনে না, চিনবেই বা কেন? কোন পরিচিতিই নেই । আজ পর্যন্ত কোন মিটিংয়ে যায়নি, মিছিলে যায়নি,রাঘববোয়ালদের আশেপাশে থাকেনি, স্তাবকতা করেনি, তোষামোদ করেনি। চালচুলোহীন সামান্য একটা ছাপোষা লোক। কে চিনবে ওকে?
ভুবনেশ্বর মন্ডল | Bhubaneswar Mondal
100 questions and answers about Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে প্রশ্ন ও উত্তর
Pralambasura badha besha of Jagannath | প্রলম্বাসুর বধ বেশ | অভিজিৎ পাল
Prem Sadhanar Nayika | প্রেম সাধনার নায়িকা : নানা আঙ্গিকে | New Article 2023
Ananta Bikeler Rupkathara | অনন্ত বিকেলের রূপকথারা | New Bengali Story 2023
Shabdodweep Web Magazine | Bangla Galper Diary | Bhubaneswar Mondal
Bengali literature has long been cherished for its deep storytelling, cultural richness, and emotional depth. Bangla Galper Diary is a platform where literature lovers can immerse themselves in the finest collection of Bengali stories (বাংলা গল্প). Whether you love classic tales, modern fiction, or poetry, this diary of stories opens the door to a world of imagination. Shabdodweep Web Magazine is a trusted destination for literature enthusiasts, publishing high-quality Bengali literature, including works from writer Bhubaneswar Mondal.
What is Bangla Galper Diary?
Bangla Galper Diary is an exclusive collection of Bengali stories that offers readers an unparalleled literary experience. It is a digital space where literature lovers can explore stories that reflect the essence of Bengali culture and heritage.
Why Read Bangla Galper Diary?
A Vast Collection of Bengali Stories – From timeless classics to contemporary tales, Bangla Galper Diary has something for every reader.
Access to Renowned Writers – Read works from authors like Bhubaneswar Mondal, whose stories capture the beauty of Bengali storytelling.
Seamless Online Reading Experience – Enjoy বাংলা গল্প at your convenience, anytime and anywhere.
A Hub for Bengali Literature Lovers – Engage with a community of readers who appreciate literature and storytelling.
The Role of Shabdodweep Web Magazine in Bengali Literature
Shabdodweep Web Magazine is a leading name in the world of Bengali literature. The magazine regularly publishes high-quality Golper Diary entries, poetry, and literary discussions. The magazine ensures that readers get the best of Bengali literature in an easy-to-access format.
Key Features of Shabdodweep Web Magazine
A Wide Collection of Stories – From traditional folklore to contemporary fiction.
Regularly Updated Content – New stories and poems published frequently.
Showcasing Bengali Writers – Featuring authors like Bhubaneswar Mondal, who have contributed significantly to Bangla Galper Diary.
Authenticity and Trustworthiness – Ensuring quality and literary excellence in every story.
Experience Bengali Storytelling Like Never Before
Bengali storytelling has a unique charm, blending emotion, tradition, and deep cultural insights. Bangla Galper Diary brings this storytelling magic to a digital platform, making it accessible to a global audience. Whether you are an avid reader or a casual literature lover, this diary of stories will captivate your imagination.
The Magic of Bengali Literature
Emotional Depth – Bengali stories often explore human emotions and relationships with a deep, poetic touch.
Cultural Reflection – Stories rooted in Bengali traditions and values.
Timeless Appeal – Classic stories that continue to inspire generations.
How to Start Reading Bangla Galper Diary?
Getting started with Bangla Galper Diary is simple and rewarding. Follow these easy steps:
Visit Shabdodweep Web Magazine – Find the best collection of বাংলা গল্প.
Select Your Favourite Stories – Explore a range of genres and styles.
Enjoy Seamless Reading – Read at your convenience, anytime, anywhere.
Engage with the Community – Share your thoughts and connect with other literature lovers.
FAQ on Bangla Galper Diary
What is Bangla Galper Diary?
Bangla Galper Diary is a collection of Bengali stories (বাংলা গল্প) available online, offering readers a diverse range of literary experiences.
Where can I read Bangla Galper Diary online?
You can read Bangla Galper Diary on Shabdodweep Web Magazine, a trusted platform for high-quality Bengali literature.
Are the stories in Bangla Galper Diary free to read?
Yes! Shabdodweep Web Magazine allows readers to enjoy Bangla Galper Diary for free, making Bengali literature accessible to everyone.
How often is Bangla Galper Diary updated?
New stories and literary pieces are added regularly to ensure fresh and engaging content for readers.
Can I contribute my own Bengali stories to Bangla Galper Diary?
Yes! Shabdodweep Web Magazine welcomes talented writers to share their stories and become part of the Golper Diary collection.
What genres are available in Bangla Galper Diary?
Bangla Galper Diary offers a wide range of genres, including fiction, poetry, romance, drama, and more.
Conclusion
Bangla Galper Diary is a literary treasure trove for anyone passionate about Bengali stories (বাংলা গল্প). Whether you want to read timeless classics or discover new authors like Bhubaneswar Mondal, this diary of stories will transport you into the heart of Bengali storytelling. Shabdodweep Web Magazine ensures that the magic of Bengali literature is always at your fingertips. Start your reading journey today and experience the beauty of Bangla Galper Diary!
Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio