স্বামী বিবেকানন্দের যোগ ভাবনা | Top Best 4 Yoga by Swami Vivekananda

Sharing Is Caring:

স্বামী বিবেকানন্দের যোগ ভাবনা | Yoga by Swami Vivekananda

যোগ (Yoga)

যোগ কোন ধর্ম নয়। সুখের প্রবৃত্তি, দুঃখের নিবৃত্তি, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা ও ‘আত্মানং বিদ্ধি’, নিজেকে জানার কৌতূহল‌ই হলো যোগ। ‘যুজ’ ধাতু থেকে ‘যোগ’ শব্দটির উৎপত্তি। সংস্কৃতে যোগ শব্দটির একাধিক অর্থ বর্তমান। ‘যোগ’-এর আক্ষরিক অর্থ যুক্ত করা বা সংযোগ ঘটানো। বৃহৎ অর্থে, যে প্রণালী বা পদ্ধতির দ্বারা পরমাত্মার থেকে বিচ্ছিন্ন আত্মার পুনরায় পরমাত্মায় সংযোগ স্থাপন সম্ভব তাকে বলে যোগ, যোগ সাধনা। পরমাত্মার থেকে বিচ্ছিন্ন জীবাত্মা ইচ্ছা করল আর পরমাত্মায় যুক্ত হয়ে গেল, ব্যাপারটি এতটা সহজ-সরল নয়। চুম্বক এক খন্ড লৌহপিন্ড। তার সাধারণ ধর্ম হলো লৌহ জাতীয় পদার্থকে আকর্ষণ করা; তবে যে-লৌহ পদার্থ মরিচাগ্ৰস্ত, চুম্বক তাকে আকর্ষণ করে না।

পরমাত্মা বিশুদ্ধ আত্মা। জীবাত্মা বা ব্যক্তি আত্মা ইন্দ্রিয় পরবশ হয়ে তার বিশুদ্ধতা হারিয়ে ফেলে, তাই শুদ্ধ আত্মার সঙ্গে সংযুক্ত হ‌ওয়ার পথে সৃষ্টি হয় বাধার অচলায়তন। কঠোর যোগ সাধনার দ্বারা আত্মার বিশুদ্ধতা পুনঃস্থাপন করতে সক্ষম হলে তবে সেই আত্মা পরমাত্মার সাথে যুক্ত হতে পারে। যে সাধন প্রণালী দ্বারা বিশ্ব আত্মার সাথে ব্যক্তি আত্মার সংযুক্তি ঘটে তাকে বলা হয় যোগসাধনা। যোগ জ্ঞানের ইতিহাস ৫০০০ বছরের প্রাচীন ভারতীয় জ্ঞানের ইতিহাস। ভারতীয় উপমহাদেশে যোগ হলো ঐতিহ্যবাহী শারীর বৃত্তীয় মননশীল আধ্যাত্মিক সাধন প্রণালী। এই সাধন প্রণালীর অনুসারী হিন্দু বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীরাও।

Swami Vivekananda

যোগ হিন্দু দর্শনের ছয়টি প্রাচীনতম আস্তিক শাখার অন্যতম। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রমতে যোগের প্রধান শাখাগুলি হলো, রাজযোগ, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, হঠযোগ প্রভৃতি। খ্রিষ্টীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে ভারতীয় ঋষি মহর্ষি পতঞ্জলির দ্বারা যোগসূত্র গুলি সংকলিত হয়েছিল। তাই পতঞ্জলিকেই যোগসূত্রের জনক বলা হয়। বিশিষ্ট দার্শনিক ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণনের বক্তব্যের মধ্যে পতঞ্জলির যোগসূত্রের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ মেলে। পতঞ্জলির পতঞ্জলায়োগ শাস্ত্রের তারিখ প্রায় ৪০০ খ্রিষ্টাব্দ বলে মূল্যায়ন করেছিলেন ফিলিপ এ ম্যাস। ডেভিড গর্ডন হোয়াইটের ধারণায় প্রায় ৭০০ বছর ধরে পতঞ্জলির যোগসূত্রটি আপেক্ষিক অস্পষ্টতায় পড়েছিল ১৩ শতক থেকে ১৯ শতক পর্যন্ত। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে স্বামী বিবেকানন্দ, তাত্ত্বিক সমাজ ও অন্যান্যদের প্রচেষ্টার কারণে বিংশ শতাব্দীতে প্রত্যাবর্তন করে এবং বিশুদ্ধ হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করে।

যোগ অতি প্রাচীন বিষয়। তবে এই যোগশাস্ত্র বহুকাল ছিল সাধারণের নাগালের বা জ্ঞানের বাইরে। আপামর জনগণের যোগ নিয়ে কোন ধারণা না থাকার কারণে কোন কৌতূহল বা আগ্ৰহ ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দের প্রচেষ্টায় যোগ সম্পর্কে সাধারণের মনে প্রাথমিক ধারণার সূত্রপাত হয়। ভারতীয় দর্শন শাস্ত্রের সঙ্গে যোগশাস্ত্র ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণের আদর্শে অনুপ্রাণিত স্বামীজী আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১-১৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধর্ম মহা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধি জ্ঞানভিক্ষু বীর সন্ন্যাসীরূপে। সনাতন হিন্দু ধর্মের তথা দর্শনের মাহাত্ম প্রচার ছিল যার উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য সাধনে তিনি উত্তমরূপে সফল হয়েছিলেন।সে ঘটনা আজ ইতিহাস। হিন্দু ধর্ম দর্শনের সনাতনী মাহাত্মে পাশ্চাত্যের বহু মানুষ আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং ভারতীয় যোগ দর্শনকে আধ্যাত্মিক ধ্যানের শারীর বৃত্তীয় প্রক্রিয়া হিসেবে গ্ৰহণ করেছিলেন। এরপর থেকে আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন ঐতিহাসিক শহরে যোগদর্শনের এক একটা শাখার উপরে জনসভায় বক্তব্য রেখেছেন এবং নিজের চিন্তা লব্ধ গভীর জ্ঞান ও উপলব্ধির নিরিখে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতাসমূহ জনসাধারণের মধ্যে সঞ্চারিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।।

স্বামী বিবেকানন্দের সফলতার পরবর্তী সময়ে বহু ভারতীয় যোগ গুরুগণ পশ্চিমা দেশসমূহে যোগ বিদ্যার প্রচার করেন।১৯৮০ দশকে পাশ্চাত্যের অনেক দেশে এটি শরীর চর্চার ও আধ্যাত্মিক ধ্যান প্রক্রিয়ার উপায় হিসেবে জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

হঠযোগ ছাড়া ভারতীয় দর্শন মতে যোগের প্রধান শাখাগুলি, যেমন,রাজযোগ, কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ প্রভৃতির উপর স্বামী বিবেকানন্দের অভিজ্ঞতা লব্ধ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্বলিত গ্ৰন্থ আছে। যদিও সে সমস্ত রচনা তিনি ইংরেজিতে করেছিলেন এবং তার অধিকাংশই আমেরিকা ইউরোপের মতো পাশ্চাত্যের মাটিতে। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন নামী-দামী আন্তর্জাতিক শহরে ভারতীয় দর্শন তথা যোগশাস্ত্র সম্পর্কে বক্তৃতা করেছিলেন, তার মধ্য দিয়ে স্বামীজী ধ্যান, যোগ, প্রাণায়াম, ব্যায়াম প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃত ভাবে ব্যাখ্যা করে পাশ্চাত্যের জনমানসে ভারতীয় যোগ দর্শনের মাহাত্ম প্রচার মারফত সকলকে অভিভূত ও আকৃষ্ট করেছিলেন। শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনের পরে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নির্বাচিত কিছু শিষ্য-শিষ্যাদের কাছে যোগদর্শন শিক্ষা দিতে শুরু করেছিলেন। সেখানেই ‘রাজযোগ’গ্ৰন্থটি রচনা করেন। ব‌ইটি লেখার সময় শ্রুতি লিখনে সহায়তা দান করেছিলেন তাঁর‌ই এক শিষ্যা মিস এম ই ওয়াল্ডো। প্রসঙ্গক্রমে স্বামী বিবেকানন্দ রচিত যোগ গ্ৰন্থগুলি সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করব। যদিও তাঁর যোগ সম্বন্ধীয় পুস্তকগুলি যথেষ্ট বৃহদাকার এবং আধ্যাত্মিক, বেদান্তিক প্রভৃতি বহুমুখী আলোচনায় সমৃদ্ধ।

১। রাজযোগ (Raja Yoga):

রাজযোগ বা অষ্টাংঙ্গযোগ প্রথম আলোচিত হয়েছিল যোগাচার্য মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্র গ্ৰন্থে। হিন্দু যোগদর্শনের এই শাখাটিতে কীভাবে ধ্যানের মাধ্যমে মোক্ষলাভ করা যায় তার উপায় বর্ণনা করা হয়েছে। ভারতের বেদানুসারী দর্শন শাস্ত্র সমূহের সবার‌ই একটাই লক্ষ্য, পূর্ণতা লাভ করে আত্মার মুক্তি। এই মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হলো যোগ। যোগ শব্দটি বহু ভাব ব্যঞ্জক।সাংখ্য ও বেদান্ত কোন না কোন ভাবে যোগের সমর্থন করে। স্বামীজী তাঁর ‘রাজযোগ’গ্ৰন্থের পরিশিষ্ট অংশে মহর্ষি পতঞ্জলির যোগসূত্রের একটি ইংরেজি অনুবাদ ও তার নিজস্ব ব্যাখ্যা যুক্ত করে দিয়েছিলেন। রাজযোগ বা অন্তঃপ্রকৃতি জয়। স্বামীজীর মূল ইংরেজি ব‌ইটি প্রকাশিত হয় ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে এবং বাংলা অনুবাদ গ্ৰন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে, উদ্বোধন কার্যালয় থেকে।রাজযোগের এই শাখায় ধ্যান অভ্যাসের মাধ্যমে মনঃসংযম এবং শেষে মোক্ষ লাভের কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

যোগের প্রথম সোপান হলো ‘যম’। যম অর্থাৎ বর্জন। এই যমকে বশীভূত করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গেলে পাঁচটি অভ্যাস আয়ত্ত করা দরকার।যে অভ্যাস সমূহকে বাস্তব জীবনের প্রতি পদক্ষেপে চিন্তায়, কথায় ও কাজে রূপদান করা প্রয়োজন।

Yoga

প্রথমতঃ কথায়, কাজে, চিন্তায় অন্য কাউকে আঘাত না করা।
২য় – কায়-মনো-বাক্যে সত্যকে আঁকড়ে থাকা। কোন অবস্থায় সত্যকে ত্যাগ করা চলবে না।
৩য় – লোভ বা প্রলোভন সম্বরণ করা।
৪র্থ – কোন রকম শিথিলতা নয়, কঠোর ভাবে আত্ম-সংযমী হয়ে আত্ম নিয়ন্ত্রণ করা।
৫ম – সকল সময় এবং সর্বত্র পাপের স্পর্শ এড়িয়ে চলে সম্পূর্ণরূপে নিষ্পাপী থাকা।

এই যোগ পদ্ধতিতে ‘যম’ ছাড়া আরো দুটি সোপানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সোপান ব্যতীত রাজযোগের যে স্তর বিন্যাসগুলি আছে তা অনুশীলন করতে বলা হয়েছে। সর্বাগ্ৰে ইন্দ্রিয় চেতনাকে বহির্জগত থেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে মনের উপর সম্পূর্ণ ভাবে আরোপ করা। পরবর্তী স্তরে আসবে অবিচল মনোসংযোগ। ধ্যান এবং শেষে সমাধি।সমাধির যোগের সর্বোত্তম ও সর্বশেষ স্তর।পরম ব্রহ্মের সাথে একাত্ম বোধের উপলব্ধিতে চেতনার বিলুপ্তির নাম সমাধি। সমাধির এই পর্যায়ে ‘আমি এবং ব্রহ্ম এক ও অভিন্ন’, এই চিন্তা ছাড়া বাকি সব চিন্তা বর্জন করতে হবে।

২। কর্মযোগ (Karma Yoga):

‘কর্মযোগ’ স্বামীজী বিরচিত একটি গ্ৰন্থ।’কর্মযোগ’ অধিকাংশ‌ই তাঁর প্রথমবার পাশ্চাত্য ভ্রমণের সময় এবং ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পরবর্তী সময়ে বক্তৃতা আকারে প্রদত্ত হয়েছিল। পরে ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে সেগুলি ‘কর্মযোগ’নামক গ্ৰন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়। সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু জাত কর্ম শব্দটির অর্থ হলো ‘করা’। যা কিছু করা হয় তাই-ই কর্ম। বিবেকানন্দ কর্মযোগকে একটি ধর্মপথ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন যে, কর্মযোগের মাধ্যমে মানুষ যেমন জগতের প্রতি তার কর্তব্য পালন করতে পারে, তেমনি জ্ঞান অর্জন ও করতে পারে। জগতে এসে মনুষ্য জাতির পক্ষে জাগতিক কর্ম সম্পাদন করাই যে ঈশ্বর প্রাপ্তির উৎকৃষ্ট পন্থা তার উপর অগাধ আস্থা রেখে স্বামীজী বলেছেন,’যদি কেউ দর্শনের একটা সূত্র ও না পাঠ করে, যদি সে ঈশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাস না করে, তবু শুধু কর্ম সমূহের সরল ক্ষমতা তাকে সেই অবস্থায় নিয়ে যেতে পারে যেখানে পরের জন্য সে তার জীবন ও অন্য সব কিছুই উৎসর্গ করতে প্রস্তুত হবে।‌‌ এক্ষেত্রে একজন ধর্ম পরায়ণ ব্যক্তি তার আরাধনার মাধ্যমে আর একজন দার্শনিক তার জ্ঞানের জন্য যে বিন্দুতে পৌঁছবে সে ও সেই বিন্দুতে পৌঁছতে সক্ষম। সুতরাং তোমরা নিশ্চয় বুঝতে পারছ যে, দার্শনিক, কর্মী ও ভক্ত সকলে এক‌ই বিন্দুতে মিলিত হয়, আর সেই বিন্দু হচ্ছে আত্মোৎসর্গীকৃত হ‌ওয়া।’

কর্মযোগ প্রসঙ্গে স্বামীজী বলেছেন,’কর্ম রহস্য অবগত হ‌ওয়াই কর্মযোগ।’ কার্য-কারণ সম্পর্ক নিবিড় ভাবে যুক্ত। কারণ‌ই কার্যে পরিণত হয়। কার্য পরিণত হয় ফলে। কার্য ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় কারণের‌ই বাস্তব রূপ। কর্মযোগ নিরন্তর কর্ম করার নিদান দেয়, তবে উচ্চতম বা মহৎ আদর্শে কর্ম করার কথা বলে। আসক্তি ত্যাগ করে কর্মে নিয়োজিত হতে হবে, কারণ আসক্তি দুঃখের কারণ। আসক্তির টানে ‘আমি’ও ‘আমার’ ভাব‌ই হলো সকল দুঃখের আধার।এমন ভাব থেকে জন্মায় অধিকারবোধ। অধিকারবোধ স্বার্থপরতার কারণ আর স্বার্থপরতা থেকে আসে দুঃখ। স্বার্থপরতা দমন করে নিঃস্বার্থ বা অনাসক্ত হতে পারলে ভব বন্ধন মুক্ত হয়ে সংসারে অবস্থান করা সম্ভব। স্বার্থপরতা পরিত্যাগ ও অনাসক্তিই হলো যোগসমূহের মূল ভিত্তি।


প্রসঙ্গক্রমে স্বামীজী শ্রীমদ্‌ভগবদ্‌গীতার একটি শ্লোক উল্লেখ করেছেন,
”যৎ করোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদসি যৎ।
যৎ তপস্যসি কৌন্তেয় তৎ কুরুষ্ব‌ মদর্প‌ণম্‌।।”

”হে কৌন্তেয়! তুমি যা কিছু কর,যা কিছু খাও, যা হোম কর, যা দান কর আর যে তপস্যা কর,তা সমস্ত‌ই আমাকে সমর্পণ করে দাও।” অর্থাৎ আসক্তি শূন্য হয়ে মুক্তি লাভের জন্য তোমার সকল কর্মফল ঈশ্বরকে সমর্পণ করে দাও। সব কিছু কর্মের একটাই উদ্দেশ্য হোক যে, আমরা যা কিছু করি ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারেই করি। পুরস্কার বা শাস্তির সঙ্গে যার কোন সম্পর্ক থাকে না।কারণ, পুরস্কার পেতে গেলে শাস্তিটাকে এড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়।যেমন সুখ পেতে গেলে দুঃখকে পরিহার করা যায় না। অত‌এব শাস্তি এড়াবার একমাত্র উপায় হলো পুরস্কার ত্যাগ করা। ঠিক যেমন, সুখের প্রত্যাশা না করলে দুঃখের হাত থেকে পরিত্রাণ মেলে। সেভাবেই মৃত্যুকে অতিক্রম করার উপায় হলো, সর্ব প্রকার আসক্তি ত্যাগ করে অনাসক্তভাবে নিরন্তর কর্ম করা এবং সমস্ত কর্ম‌ই ঈশ্বরে সমর্প‌ন করা।

৩। জ্ঞানযোগ (Jnana Yoga):

যোগশাস্ত্র বিষয়ক গ্ৰন্থগুলির মধ্যে ‘জ্ঞানযোগ’ স্বামীজী রচিত অন্যতম একটি গ্ৰন্থ। নিউইয়র্ক ও লন্ডনের জনসভায় দেওয়া কয়েকটি ভাষণ সংকলিত করা হয়েছে এই গ্ৰন্থটিতে। জ্ঞানযোগ বা ‘শুদ্ধ জ্ঞানের মাধ্যমে যোগস্থাপন’, হিন্দু যোগদর্শনের একটি শাখা। ‘জ্ঞান’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ‘জ্ঞ’ ধাতু থেকে, যার অর্থ ‘জানা’। জ্ঞানযোগ ব‌ইটিতে স্বামীজী ঈশ্বর তত্ত্বের জ্ঞানকেই জীবনের সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যে বলে উল্লেখ করেছেন। বিবেকানন্দের মতে, মুক্ত চিন্তাই জ্ঞানযোগের মুখ্য আলোচ্য বিষয়।নাম ও রূপের বাইরে গিয়ে পরম সত্যকে চরমভাবে উপলব্ধির মধ্য দিয়ে মোক্ষলাভ সম্ভব হতে পারে।

দর্শন শাস্ত্রসমূহের মধ্যে জ্ঞানযোগ খুবই যুক্তিসঙ্গত ও কঠিন।’জ্ঞানের জন্য‌ই জ্ঞানের অনুশীলন’, ইন্দ্রিয়সুখ নিরপেক্ষ এমন ভাবটি মনের মধ্যে পরম আনন্দের সৃষ্টি করে। অদ্বৈত দর্শন অনুসারে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে একটি বস্তুই সত্য, যাকে ব্রহ্ম নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়া আর সমস্ত‌ই অসত্য। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এই ব্রহ্মের নাগাল পাওয়া। কিন্তু ব্রহ্মে পৌঁছনোর পথে বাধা হলো মায়া। সত্যের সন্ধান পেলে মায়া-মোহরূপ বাধা বা অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। একখন্ড মাটি পরীক্ষা করলে সমস্ত মাটির চরিত্র সম্বন্ধে যেমন একটা কমপ্লিট ধারণা জন্মায়, অনুরূপ ভাবে একটি মানব আত্মাকে জানতে পারলে সমগ্ৰ প্রকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা করা সম্ভব হবে।

ওঁ তৎ সৎ। আমিই সেই, আমিই সচ্চিদানন্দ। ওঁকার তত্ত্বের মহিমা জানতে পারলে জগৎ রহস্যের দ্বারোদঘাটন সম্ভব। রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ সবার‌ই লক্ষ্য এক, পার্থক্য শুধু সাধন প্রণালীতে। জ্ঞানমার্গের সাধকগণের সর্বপ্রথম আয়ত্ত করা দরকার – শম ও দম। মন বা অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযমকে বলা হয় দম। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়গুলিকে বহির্মুখী হ‌ওয়ার সুযোগ না দিয়ে তাদেরকে স্ব স্ব কেন্দ্রে স্থাপন করা।তত্ত্ব দর্শনের নিরিখে চোখ আমাদের দর্শনেন্দ্রি‌য় নয়, দেখার যন্ত্র মাত্র। দর্শনেন্দ্রিয়ের অনুপস্থিতিতে চক্ষু বর্তমান থাকলেও দেখা সম্ভব নয়। তবে দর্শনেন্দ্রিয় আছে,দর্শন যন্ত্র চক্ষু আছে, কিন্তু যতক্ষণ মন ওই দুটির সাথে সংযুক্ত না হচ্ছে ততক্ষণ দর্শনক্রিয়া সংঘটিত হতে পারছে না। অত‌এব এই সিদ্ধান্তে উপনীত হ‌ওয়া যায় যে, প্রত্যেক প্রত্যক্ষ ব্যাপারে তিনটি বস্তুর মিলন প্রয়োজন। যেমন, বাহ্য করণাবলী। অন্তরিন্দ্রিয় সকল ও মন। এই তিনটি উপাদানের কোন একটির অভাবে ‘প্রত্যক্ষ’ নামক ঘটনাটি ঘটা অসম্ভব।

অবশ‌্য এ-সবের পরেও আর একটি জিনিসের আবশ্যক, তা হলো উপরতি। আমাদের ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা অনেক। তাদের ক্রিয়াকলাপ ও ভিন্ন ভিন্ন। আমাদের বেশির ভাগ সময়টাই ব্যয়িত হয় এই সমস্ত ইন্দ্রিয়সমূহের চিন্তায়।আত্ম নিয়ন্ত্রণের দ্বারা ইন্দ্রিয়ের বিষয়গুলিকে চিন্তা না করাকেই বলে উপরতি।বেদান্তী শিক্ষার্থীগণকে ইন্দ্রিয় চিন্তার অভ্যাস পরিহার করা উচিত।

Yoga by Swami Vivekananda

৪। ভক্তিযোগ (Bhakti Yoga):

স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা। ”অকপটভাবে ঈশ্বর সন্ধান‌ই ভক্তিযোগ, প্রীতি ইহার আদি, মধ্য ও অন্ত। মুহুর্তস্থায়ী ভগবৎ প্রেমোন্মত্ততা হ‌ইতেও শাশ্বতী মুক্তি আসিয়া থাকে। ”নারদ তদীয় ‘ভক্তিসূত্র’ – এ বলেছেন,’ভগবানে পরম প্রেম‌ই ভক্তি।’ সাধুসন্ত এবং ভক্তগণের যে চরম লক্ষ্য ঈশ্বরের নাগাল পাওয়া, ভক্তিযোগ‌ই হলো তার সর্বশ্রেষ্ঠ, সহজ ও স্বাভাবিক উপায়। একনিষ্ঠ ভক্তিই হলো এর মূল মূলধন। ”ভক্তিযোগ যুগধর্ম – তার এ-মানে নয় যে ভক্ত এক জায়গায় যাবে,জ্ঞানী বা কর্মী আর এক জায়গায় যাবে। এর মানে যিনি ব্রহ্ম জ্ঞান চান, তিনি যদি ভক্তিপথ ধরে ও যান তাহলেও সেই জ্ঞান লাভ করেন।ভক্ত বৎসল মনে করলেই ব্রহ্মজ্ঞান দিতে পারেন।”

সগুণ ঈশ্বর ব্যতীত আমাদের ভক্তি আসা কঠিন। কিন্তু ভক্তের উপাস্য ঈশ্বর সগুণ ও নির্গুণ উভয়‌ই।’ভক্তিযোগ’ শব্দটির প্রকৃত অর্থ কিন্তু সগুণ ভগবানের প্রতি ভক্তি ও প্রেম নিবেদনের মাধ্যমে দেবত্বের অনুভূতি। ‘ভক্তিযোগ’, যার অন্য নাম ভক্তিমার্গ‌। হিন্দু ধর্মের তিনটি শাস্ত্রীয় মার্গের মধ্যে অন্যতম এটি একটি, যে মার্গের দ্বারা মোক্ষের পথে অগ্রসর হ‌ওয়া সম্ভব। জ্ঞান, কর্ম বা যোগ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ এই ভক্তিযোগ।ভক্তিই ভক্তির পরিণাম, উপায় এবং লক্ষ্য দুই-ই। আত্মার প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা আছে যার,আত্মা তাকেই ভালোবাসেন।এ প্রসঙ্গে স্বয়ং ভগবানের উক্তি,’যাহারা নিরন্তর আমাতে আসক্ত এবং প্রেমের সহিত আমাকে উপাসনা করে, আমি তাহাদিগের বুদ্ধি এমনভাবে চালিত করি, যাহাতে তাহারা আমাকে লাভ করে।’

জগতে প্রতিটি মানুষ তার প্রকৃতি অনুযায়ী আপন আদর্শের পথ বেছে নেয়। সেই আদর্শ‌ই হলো তার ইষ্ট। ইষ্টকে পবিত্র রাখা কর্তব্য।কারণ,প্রত্যেকে প্রত্যেকের ইষ্ট অনুসারেই ঈশ্বরের আরাধনা করে থাকে। ভক্তিমাত্র সম্বল করে অসীম শক্তির সাথে মিলনের পথ‌ই‌ ভক্তিযোগ। এই শক্তি ধারাবাহিক একটা গতিপথ পরিক্রমা করে। মানুষ যেমন অসীম ঈশ্বর থেকে আসে, তেমন সেখানেই আবার ফিরে যায়।তখন‌ই শেষ হয় পরিক্রমা। তবে ঈশ্বরের কাছে প্রত্যাবর্তন একজনের দু’ভাবে সম্পন্ন হতে পারে। সাধারণের পক্ষে প্রকৃতির নিয়মে ধীরে ধীরে দীর্ঘ পথে, আর যোগীর পক্ষে নিজের অভ্যন্তরীণ অধ্যাত্ম শক্তিবলে সংক্ষিপ্ত পথে।

জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ বা ভক্তিযোগ, এ সম্পর্কে স্বামী বিবেকানন্দের সুচিন্তিত অভিমত হলো যে, যোগের কোন একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি সবার ক্ষেত্রে উপযুক্ত হতে পারে না। সেই জন্য সকলের সম্মুখে কতকগুলি আদর্শ উপস্থাপন করা গেছে যাতে করে সবাই যার পক্ষে যেটি গ্ৰহণযোগ্য সেটি বেছে নিতে পারে। একজন যদি না পারে তো অপর জন নিশ্চয়ই পারবে। আমাদের আত্মা শরীরকে আশ্রয় করে অবস্থান করে, অত‌এব শরীরকে সুস্থ ও পবিত্র রাখা মানুষের কর্তব্য।’সদা থাকো আনন্দে,’ নিরানন্দকে বিদায় জানিয়ে আনন্দকে দোসর করার অভ্যাস গড়ে তোলার নির্দেশ দেন স্বামীজী। তাঁর আরো পরামর্শ , একজন যোগীর পক্ষে প্রচুর আহার যেমন বর্জন করা দরকার তেমনি অনশন করে থাকা ও ঠিক না। দীর্ঘ সময় নিদ্রামগ্ন যেমন থাকবে না, তেমন বিনিদ্র ও থাকবে না।সকল বিষয়ে মধ্য পন্থা অবলম্বন‌ই শ্রেয়। তাঁর মতে যোগাভ্যাসের উপযুক্ত সময় হলো ঊষার সন্ধিক্ষণ।ওই ব্রাহ্ম মুহূর্তে মন ও প্রকৃতি উভয়‌ই প্রশান্ত থাকে।কাঁধ, মাথা ও মেরুদন্ড সোজা রেখে, সামনে পিছনে না ঝুঁকে অবস্থান করাই যোগাসনের আদর্শ ভঙ্গী।মনকে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে অতি সন্তর্পণে যুক্ত করে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতির তালে তাল মিলিয়ে মনকে সংযত করার শক্তি অর্জন করতে হবে।

পরিশিষ্ট : যোগ, প্রাণায়াম, ধ্যান, ব্যায়াম, এ-সমস্ত অতি প্রাচীন কাল থেকে হিন্দুদের জীবন ধারার সাথে যুক্ত হয়ে আছে। কিন্তু তৎপরবর্তী সময়ে দীর্ঘ কাল এগুলোকে অবহেলা বশতঃ দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এরপর আধুনিক সময়ে স্বামী বিবেকানন্দ, ঋষি অরবিন্দ প্রমুখ মনীষীগণ যোগ দর্শনকে বিশ্বের সম্পদে পরিণত করেছেন। বিশেষ করে স্বামীজীর অদম্য ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বিশ্ব ব্যাপী যোগ আন্দোলনের ফল হয় সুদূরপ্রসারী।

আজ ভারতীয় যোগ দর্শন বিশ্ব স্বীকৃতি লাভ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে জাতিসংঘ যোগদর্শনের ঐতিহ্যকে সম্মান জানিয়ে ২১শে জুন তারিখটিকে আন্তর্জাতিক যোগদিবস রূপে পালনের স্বীকৃতি দিয়েছে। হিন্দু সংস্কৃতির এই ঐতিহ্যবাহী মহান দর্শনকে লালন ও পোষণ করাই হোক দিবসটি পালনের মূল মন্ত্র।

Read More Articles:-

Bengali Article 2023 | দুর্গা পূজার কথকতা | প্রবন্ধ ২০২৩

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Loukik Debota Masan Thakur | লৌকিক দেবতা মাশান ঠাকুর | 2022

New Bengali Article 2023 | প্রেমাবতার ঠাকুর হরনাথ ও সহধর্মিণী কুসুমকুমারী কথা

yoga by swami vivekananda pdf | the complete book of yoga by swami vivekananda | raja yoga by swami vivekananda in english pdf | definition of yoga by swami vivekananda | the complete book of yoga pdf | Karma yoga by swami vivekananda pdf |
bhakti yoga by by swami vivekananda | jnana yoga by swami vivekananda | pdf book of yoga by swami vivekananda | yoga by swami vivekananda bengali pdf | yoga by swami vivekananda hindi | new yoga by swami vivekananda | latest yoga by swami vivekananda | yoga by swami vivekananda 2023 | collection of yoga by swami vivekananda | complete yoga by swami vivekananda | all yoga by swami vivekananda | tutorial yoga by swami vivekananda | training yoga by swami vivekananda | full yoga by swami vivekananda | new book yoga by swami vivekananda | old book yoga by swami vivekananda | trending yoga by swami vivekananda | future yoga by swami vivekananda | past yoga by swami vivekananda

Leave a Comment