Best Whatsapp Story in Bengali 2023 | Shawkat Noor

Sharing Is Caring:

সন্ধ্যা – শওকত নূর [Whatsapp Story in Bengali]

সন্ধ্যা নিয়ে যত-শত কথার জালই বোনা হোক, হয়ে থাকুক- সবই প্রায় সাধারণ লাগে। দিবা-রাত্রির সন্ধিক্ষণ সন্ধ্যা, সন্ধ্যায় গোধূলি নামে, পাখিরা নীড়ে ফেরে, ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বলে,দিগন্তে চাঁদ ওঠে, ছোট্ট নদীর বুকে ধীরে কোন মাঝি প্রাণের সুর মিলিয়ে দিয়ে ম্লান আবছায়ায় হারিয়ে যায়, এমনি যত-শত কথাই বলা চলে, তা সাধারণত্বের সংজ্ঞাতেই বাঁধা পড়ে থাকে। আমারও এই বিস্তৃত জীবনে আশৈশব কত শত সন্ধ্যাই এলো গেলো, কত ভাবেই না এলো গেল-কখনও নদী তীরে ঢি’ দিয়ে, কখনো বেলাভূমিতে একাকী বসে, কখনো দিগন্ত জোড়া মাঠের মধ্যখানে হেঁটে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্বাকাশের দিকে চেয়ে, কখনো গয়না-নৌকার ছঁই কিংবা গলুইয়ে বসে নদীপাড়ে চোখ ধরে, কখনো শহরের নির্জন একতলা বাড়ির জানালায় বসে সম্মুখ পথে স্থির দৃষ্টি মেলে, কখনো ঘন ঝোপের ধারে এক দৃষ্টে তাকিয়ে-সবই সাধারণ। সেসব কখনোই মনে অসাধারণত্বের কোন দায়ভার বইয়ে দিয়ে সন্ধ্যা বিষয়ে আমাকে কাগজ পৃষ্ঠায় কলম খাটাতে প্ররোচিত করেনি। তবে হাজার সন্ধ্যা পেরিয়ে একটি সন্ধ্যার স্মৃতি অনেকদিন ধরে প্রায়ই আমার বোধের জগতকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়ে যায়, আমাকে ভীষণ উতলা করে তোলে। আমার জীবনে হয়তো সেই সন্ধ্যাটিই একান্তভাবে অসাধারণ।

এতক্ষণে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, কী ঘটেছিল সেই বিশেষ সন্ধ্যায় তবে? সে কথাই না হয় আজ এ ঘোর সন্ধ্যায় কাগজ পৃষ্ঠায় বয়ান দিয়ে এ বিষয়ে দায়মুক্ত হওয়া যাক। হয়ে যাক সে বয়ান :

দিনগুলো আমার তখন খুবই খারাপ যেত। ছোট চাকুরী করি, বেতনাদি কম, মেসে থাকি, নাওয়া-খাওয়া খুব ভালো মত হয় না; তা না হয় বাড়ি থেকে আনা পয়সায় আপাতত ঘরের বাইরে পুষিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। কিন্তু মনের দীনতা ঘোচে কিসে? কেবলই মনে হয়, যে চাকুরী করি সত্যিকারে তা আমার কাজ নয়। অথচ এরচে’ ভালো কিছু প্রাপ্তির প্রত্যাশাও বাতুলতা মাত্র। ইন্টারভিউতে ভালোর প্রচেষ্টাও সর্বদা বিফলে যায়। মন খারাপ থাকে। অফিস বসের ফাইল নিয়ে জায়গায় জায়গায় ঢুঁ দিই। চৈত্রের কাঠফাটা দিনগুলো বড় কষ্ট বয়ে আনে। দুপুরের প্রখর রোদ কী যে অসহ্য হয়ে ওঠে! রিক্সা নিই না ইচ্ছে করেই। শুধুই হাঁটি। নগরীর সরু কিংবা প্রশস্ত পথ ধরে এলো-পায়ে হাঁটি।

হাঁটার সময় মাথার ওপরে, ঠিক খাড়া মাথার ওপরে প্রায়ই করুণ সুরে চিল ডাকে। খুব মেজাজ বিগড়ে যায়। ইদানিং কোত্থেকে এই গেঁয়ো পাখিগুলো এসে শহরে জুটেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম তামাম নগরীতে এদের একটিমাত্র জোড়াই বুঝি আমার দুইতলা মেস-বিল্ডিংয়ের ওপাশের থ্যাবড়া নারকেল গাছের মাথায় অস্থায়ী আস্তানা গেড়েছে। এখন দেখি এরা তামাম নগর জুড়েই আছে। যেখানেই উঁচু বড় গাছ আছে, সেখানেই এদের ডাক শুনি। ভীষণ মন খারাপ হয়। এ বজ্জাতগুলোর ডাক শুনলেই আমার মন এক নিমিষে নগর ছেড়ে গাঁয়ে উড়ে যায়। মনে পড়ে আমার দুঃখিনী মায়ের সেই জীর্ণ কুটির, সেই অভাব অনটন, সেই ক্ষুধা দারিদ্যের কষাঘাত, সাথে সেই নির্মম চিলের ডাক! না না, চিল নিয়ে আর এক বর্ণ নয়। মনে হচ্ছে এ চিলেরই গল্প। এবার আসল কথায় ফেরা যাক। ফিরি তবে।

চেহারা ছবি ভালো হলেও, চালচলনে সর্বত্র মানিয়ে নেবার মতো হলেও, আমার লেখাপড়ার দৌড় ততটা নয়। স্বল্প-শিক্ষিত বললে অত্যুক্তি হবে না বোধ করি। বকলমের খানিকটা ওপরে। আমার মস্তিষ্কের দৌঁড়ও উল্লেখ করার মতো নয়। অল্প বয়সে বাবা মারা যাওয়ার পর গাঁয়ের বাড়িতে দুঃখিনী মায়ের একমাত্র সন্তান হিসেবে আমি বেড়ে উঠি। পিতা বেঁচে নেই, তার ওপর একমাত্র সন্তান হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই মায়ের যত আশা ভরসা আমাকে ঘিরেই আবর্তিত। চৌদ্দ পুরুষের কেউ স্কুল কলেজের চৌকাঠ মাড়ায়নি, দেখেনি চাকরিবাকরির মুখ। তাই আমার কাছে অফিস পিওনের চাকুরীই হবার কথা পরম প্রাপ্তির এক বিষয়। কিন্তু এ চাকুরী করতে গিয়ে, বিশেষ করে প্রাপ্ত বেতনে একান্ত দায়িত্ববোধ থেকে মায়ের জন্য দু’পয়সা পাঠিয়ে নিজেকে চালাতে গিয়ে প্রতিদিন প্রতিনিয়ত যে কঠোর সংগ্রামের সম্মুখীন হই, তাতে মনে হয় এ আমার প্রাপ্য নয়। এরচে’ লেখাপড়ার চৌহদ্দিতে একেবারে পা না রাখাই, মূর্খ হয়ে গাঁয়ের মাঠে-ঘাটে, খোলা প্রান্তরে হাওয়া খেয়ে ঘুরে বেড়ানোটাই বুঝি ঢের সুখকর ছিল। ফলে সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকি।

ইদানিং লক্ষ্য করছি, বস প্রায়ই আমার দিকে বিশেষ কৌতূহল-দৃষ্টি রাখছেন। বিশেষ করে আমার মনমরা অবস্থার ওপরেই যেন তার নজরটা বেশি। আমার অলক্ষ্যে আমার আপাদ-মস্তকে দৃষ্টি দিয়ে তিনি আমার চেহারাছবিতে যে নিবিষ্ট হয়ে যান, স্বল্প-শিক্ষিত হলেও আমি তা বুঝতে পারি। বলে নেয়া ভালো, আমার বস প্রৌঢ়ত্বে পা রাখলেও এখনো বেশ সুদর্শন। প্রায় ছ’ ফুট উচ্চতা, গাঁয়ের রঙ উজ্জ্বল ফর্সা, নাক খাড়া, চুলগুলো সিল্কি স্টাইলিস্টিক। পোশাক পরিচ্ছদে তিনি সর্বদাই স্মার্ট, কেতাদুরস্ত। বাচনভঙ্গিতেও খুব চটপটে। চাকুরীতে যোগদান করা অবধি বরাবরই তাকে সদাহাস্য দেখে এসেছি। কারো প্রতি বিরক্ত কিংবা চড়াও হতে কখনোই চোখে পড়েনি। কিন্তু কিছুদিন ধরে তার সেই আগের উচ্ছ্বাস-উদ্যম ভরা মুখচ্ছবিটা যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে। প্রায়ই দেখি তিনি বিষণ্ণ- উদাস হয়ে কী ভাবেন। ভাবনার ফাঁকে তিনি যে আমার অলক্ষ্যে আমার আপাদ-মস্তকে দৃষ্টি বুলান, সেটাই আমি ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। প্রায়ই আনমনে ভাবি, আমাতে কী লক্ষ্য করেন বস? কী খোঁজেন আমার আপাদ-মস্তকে? আমি তো একটা মাক্কাল ফল। তবে কি আমার বাইরে তাকিয়ে আমার অন্তঃসারশূন্য ভেতরটাকে চিরে দেখতে চান? মনের চোখ দিয়ে হয়তো তা-ই করেন। সেদিন এমনি ভাবনার ঘোরে বসের আকস্মিক গলা-খাঁকারিতে চমকে উঠি। বরাবর তিনি কলিং-বেল টিপে আমাকে ভেতরে আহ্বান করে থাকেন। আজ কী ভেবে দরজায় এসে ধাক্কে দরজা ফাঁকা করে হাত ইশারায় ভেতরে ডাকছেন। আমি সম্মোহিতের মতো দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করি।

বস গুরুগম্ভীর রিভলভিং চেয়ারে বসে আছেন। দরজা থেকে মেঝেতে দু’ পা ফেলতেই হাতের ইশারায় পাশের সোফাতে বসতে বললেন। পিয়নদের সাধারণত বসের কক্ষের কোন আসবাবে বসার অধিকার থাকে না। কিন্তু এ কোম্পানিতে চাকরি শুরুর ক’দিনের মাথায়ই বসের বদান্যতায় আমার সে অধিকারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সোফায় বসে মাথা নিচু করতেই আবারো বসের গলা-খাঁকারি শুনতে পাই। ত্বরিত মাথা তুলতেই বস বললেন, সুনাম।

জি, স্যার। হকচকিয়ে বললাম।

সন্ধ্যায় তুমি কী কাজ করো?

জি, স্যার, কিছু না।

তাহলে তো ফ্রি?

জি, স্যার।

তবে আজ সন্ধ্যায় একটু আমার বাসায় আসতে পারবে?

জি, স্যার।

এই কার্ডে বাসার ঠিকানা আছে, নাও এটা। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে চলে এসো, কেমন?

জি, স্যার।

পথে যানজট থাকায় বসের বাসায় পৌঁছতে প্রায় সাড়ে সাতটার মতো বেজে গেল। ভয়ে ভয়ে বাসার কলিং বেল টিপি। ভাবছিলাম, দরজা খুলেই বস নিশ্চয়ই তেতো গলায় কিছু একটা বলে বসবেন। কিন্তু দরজা ফাঁকা হলে বসকে চোখে পড়ল না। যিনি দরজা খুললেন, তিনি অত্যাধুনিক বেশভূষার এক রমণী। রমণী বললে ভুল হবে; বয়সে তরুণীই হবেন তিনি। ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডলে প্রসাধনীর আধিক্য, মাথার চুল বয়কাট; পরনের পোশাকও ঝলমলে। তীব্র সুগন্ধি নাকে ঢুকল তিনি দরজা খুলতেই। পরিচয় দিতেই বললেন, আসুন, ওদিকটায় বসুন। দরজা থেকে সরে গেলেন তিনি।

আমি তরুণীর দেখিয়ে দেয়া ছোট্ট ড্রইংরুমটাতে গিয়ে বসি। বেশ ছিমছাম, বর্ণনাধিক্য অনাবশ্যক- এক কথায় বড়লোকের ড্রইংরুম যেমনটি হয়। সোফায় বসে আমি বসের উদ্দেশ্যে অনুসন্ধানী দৃষ্টি ছুঁড়ি। কোথায় বস? ওই তো সরাসরি দরজা-পথে দেখা যাচ্ছে তাকে। টেবিলে মাথা ঝুঁকে কী যেন লিখছেন। আমি পেছনের জানালায় বাইরে দৃষ্টি ছুঁড়ি। বারান্দা পেরিয়ে ওপাশটাকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। ছোট্ট এক উদ্যান গোছের স্থান। এ মুহূর্তে বাইরে আলো নেই। আবছায়ায় ওখানকার পাতাহীন মাঝারি আকৃতির গাছপালাগুলোকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে। কাকসহ অজানা কতগুলো পাখি আধো-অন্ধকারেও ডেকে ডেকে এগাছ ওগাছ করছে। তন্ময় হয়ে আমি আমার জীর্ণ, নোংরা একতলা মেস রুমটির কথা ভাবছি। কোথায় এদের জীবন, কোথায় আমার! দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে যায় অজান্তে। হঠাৎ চুড়ির টুংটাং শব্দে ঘোর কাটে। দেখলাম সেই তরুণী মৃদু পায়চারী করছেন। কে হবেন? বসের সাথে তার কী সম্পর্ক? আন্দাজ করা সমীচীন হবে না। মাথা নিচু করে থাকি। তরুণী ভেতরে চলে গেছেন। ভাবলাম, এখন নিশ্চয়ই বস উঠে আসবেন। কিন্তু না, আসছেন না তিনি। এভাবে মিনিট বিশেক পেরিয়ে গেল। আবারো চুড়ির টুংটাং শুনি। আকস্মিক কণ্ঠে চমকে উঠি, সোহান!

বলো, বসের অন্যমনস্ক কণ্ঠ।

বেরোই তবে। ফিরতে দেরি হলে খেয়ে নিও।

হুম। ফিরতে রোজ রোজ এত দেরি করো আজকাল! বস দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

বসের কথায় কোন সাড়া শব্দ না করে দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন তরুণী। এবারে ভেতরে আলমারি খোলার শব্দ পাই। খানিক পর বস এলেন। উঠে সালাম দিতেই বললেন, দেরি হয়ে গেল, সুনাম।

স্যার, সমস্যা নেই। বললাম আমি।

শোনো, তোমাকে এক কাপ চা খাওয়ানো উচিৎ ছিল, তা আর হচ্ছে না।

সমস্যা নেই, স্যার।

এ খামটা নিয়ে এক্ষুণি তোমাকে এতে লেখা ঠিকানাটায় যেতে হবে।

জি, স্যার।

যার নাম ঠিকানা লেখা আছে তার সাথে সশরীরে সাক্ষাৎ করে এটা পৌঁছে দেবে। সে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারে; একটু সময় দিও তাকে। তোমারও একটু বিশ্রাম হবে। আর এটা নাও, তোমার যাতায়াত খরচ।

স্যার, আসি।

আচ্ছা, দেখা হবে।

সিঁড়ি পেরিয়ে পথে পা রাখতেই কার্ডের ঠিকানাটা ভালোমতো দেখার উদ্দেশ্যে মনটা খচখচ করে ওঠে। খুবই সাধারণ ব্যাপার। কোনো মানুষের কাছে যাচ্ছি- যাবার আগে সে মানুষটি সম্পর্কে জানার কৌতূহল নিশ্চয়ই জাগবে। পথ-আলোয় কার্ডটি মেলে ধরি। এটি আসলে বসেরই কার্ড। কিন্তু তার নিজের নাম ঠিকানা কলমে কেটে দেয়া হয়েছে। তাহলে যার কাছে যাচ্ছি তার নাম ঠিকানা নিশ্চয়ই কার্ডের বিপরীত পিঠে থাকবে। কার্ড উল্টে দেখি ঠিক তাই। বিপরীত পিঠে কলমে লেখা :

মিসেস পিয়াসা সোহান
সোহান ম্যানশন
দক্ষিণ বনগাঁও
৪র্থ তলা, ঢাকা।

গুলশান থেকে বনগাঁও। একটা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে তাতে বসে নতুন করে কার্ডে মনোনিবেশ করি। যার কাছে যাচ্ছি, তার নামের শেষে যেহেতু বসের নামটিই যুক্ত, সেহেতু তিনি বসের পরিবারেরই একান্ত ঘনিষ্ঠ কেউ হবেন। কিন্তু কে তিনি? স্ত্রী, নাকি অন্য কেউ? স্ত্রী হবার সম্ভাবনাটাই জোরালো। কিন্তু সেক্ষেত্রে বসের গুলশানের বাসায় এইমাত্র যে তরুণী বসকে নাম ধরে ডাকলেন তিনি কে? যেটুকু কথোপকথন শোনা গেল, তাতে তারও বসের স্ত্রী হবার সম্ভাবনা প্রকট। একটা গোলক-ধাঁধায় পড়ে যাই। ভাবতে ভাবতে কখন চলে এসেছি দক্ষিণ বনগাঁও।

সোহান ম্যানশনের নীচতলায় পৌঁছতেই দারোয়ান নাম পরিচয় জেনে আমাকে সিঁড়িতে করে চার তলায় নিয়ে যায়। বস ফোনে আগেই আমার যাবার বিষয়ে বলে রেখেছেন। দারোয়ান আমাকে ড্রইং রুমে বসাতেই ভেতর রুমে স্ত্রী-কণ্ঠ ধ্বনিত হয়, নবারুণ, ওনাকে ভেতরের রুমে নিয়ে আয়। দারোয়ান বলল, ভাই চলেন। ম্যাডাম অসুস্থ। ভিতরে বইসাই কথা বলতে হবে।

ঠিক আছে চলুন, বলে দারোয়ানের সাথে ভেতরে ঢুকি।

ভেতরের রুমে খাটের অদূরে সোফা। দেখলাম খাটে যিনি শুয়ে আছেন তার আপাদ-মস্তক কম্বলে ঢাকা। ইতস্তত করছিলাম আমি। কম্বলের নিচ থেকে ম্রিয়মাণ নারী-কণ্ঠ ভেসে এলো, বসুন।

জি, ধন্যবাদ।

কোথায় বাসা আপনার?

জি, জিগাতলা।

বেশ দূর এখান থেকে।

জি।

তা সোহান কেমন আছে?

জি, ভালো।

সুন্দরীটা?

জি?

বাসায় আর কাউকে দেখলেন?

জি।

সে কেমন আছে? নাকি দেখেন নি আর কাউকে?

জি, দেখেছি।

অনেক সুন্দরী, না?

জি।

একসময় আমিও সুন্দরী ছিলাম। ওর চেয়েও সুন্দরী। ভাবছেন আমি কে? এত কথা কেন বলছি? সোহান কি আমার পরিচয় বলেছে আপনাকে?

জি না।

সুন্দরীটা ওর দ্বিতীয় স্ত্রী। নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছেন আমি কে। আমি প্রথম। জগতে এই এক প্রথম, যা বড় বেদনাদায়ক।

জি।

আপনি বিয়ে করেছেন?

জি না।

বয়স কত আপনার?

ঊনত্রিশ।

সোহান আপনার কথা অনেকবার বলেছে। ওর সাথে নাকি চেহারায় মিল আছে আপনার, খুব ভালো আপনি-এমনটিই বলেছে। অবশ্য পুরুষদের ভালো-মন্দ বোঝা দায়।

জি।

সোহানের কথাই ধরুন। ও-ও তো খুব ভালো ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠী ছিলাম আমরা। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। ভালোবাসা আসলে নিছক আবেগ। ভিত্তিহীন আবেগ।

জি।

প্রথম প্রথম আবেগে কত কথাই বলা হয়। সোহানও বলত। আমি অকালে মরে গেলে দ্বিতীয় বিয়ের কথা কল্পনায়ও আনবে না, সারা জীবন আমাকে ভেবে কাটাবে, আরো কত কী! অথচ বাস্তব কত ভিন্ন!

আপনি কি খুব বেশি অসুস্থ? তেমনই মনে হচ্ছে। বললাম আমি।

হ্যাঁ।

কী হয়েছে আপনার?

আমার এ রোগটার নাম হচ্ছে মোটোনিউ—-।

ও, ও।

এ সাধারণ কোন রোগ নয়, অতি জটিল দুরারোগ্য এক স্নায়ু-ব্যাধি। এ থেকে মুক্তি নেই, মৃত্যুই মুক্তি। যেদিন থেকে রোগটি ধরা পড়ে, সেদিন থেকেই সোহান একটু একটু করে পাল্টে যেতে থাকে। কারণ, ও জানে, এ থেকে আমার ফেরার পথ নেই। আমার অচলতায় ও-ও যেন নীরবে অচলবোধ করতে থাকে। একসময় ও ওর ব্যক্তিগত সহকারীর সাথে সম্পর্কে জড়ায়। তাকেই বিয়ে করে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, খোদা কেন যেন আমাকে নিয়ে যেতে বিলম্ব করতে থাকে। প্রস্থানের ধৈর্যটুকুও হয় না ওর। পুরুষরা এমনই বোধ করি। কী মনে হয় আপনার? নানা প্রশ্ন মনে আসে, কেউ নেই শোনার, দ্বিধায় ভুগি। আপনি প্রথম এসেছেন, অথচ একটানা কত কথা বলছি- আপনাকে। আপনি কিছু কি মনে করছেন?

জি, না।

আমি খুব নিঃসঙ্গ। বিদায়ী মানুষ-মানুষের সঙ্গ পেতে ইচ্ছে করে। অথচ এমন কেউ নেই, যার সাথে কথা বলব। প্রথম প্রথম আত্মীয়-স্বজন অনেকেই আসত। ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এখন কেউ না আসার মতোই। প্রতিনিয়ত ভাবি, এই বুঝি বিদায়। অথচ কত একা! দিনরাত খুব ছটফট করি।

আপনাদের সন্তানাদি?

এক ছেলে ছিল, প্নেন ক্রাশে মারা গেছে। তারপরই রোগটা ধরা পড়ে।

ভেরি স্যাড। আজ উঠি তবে।

মাঝেমাঝে আসলে খুশি হব। সোহানকে বলব ফোনে, যাতে আপনাকে পাঠায়।

জি, আসি।

তারপর এমনি আরো অনেক সন্ধ্যাই এসেছে গেছে। কখনো মেস থেকে ঢুঁ’ দিয়েছি বসের গুলশানের বাসায়, কখনো বনগাঁয়ের বাসায়, কখনো বা সেদিনের মতোই গুলশান থেকে বনগাঁও। এমনি অনেক কথাই হয়েছে বসের প্রথম স্ত্রীর সাথে। তা নিয়ে কথা হয়েছে বসের সাথে। বস চুপচাপ শুধু শুনেছেন সেসব। দিন দিন একটা মায়াই পড়ে যেতে থাকে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষটির প্রতি। কী নির্মম সত্যি যে তিনি জানেন, এখানে তার আর বেশিদিন নেই, অথচ নিঃসঙ্গ। এমন একটি রোগ তার যে বিছানাই একমাত্র ঠিকানা। কারো কিছু করার নেই। শরীর ক্রমশ শুকিয়ে যাচ্ছে, হারও নাকি ক্ষীণ হতে হতে একসময় পেন্সিলের আকার নেবে। ভাবি, তার আগেই হয়তো তিনি —-।

প্রথম প্রথম এই দৌঁড়ঝাঁপে খানিকটা বিরক্তিবোধ এলেও এখন তা একেবারে নেই। বরং অনেকটা আগ্রহ নিয়েই বসের ডাক পড়ার অপেক্ষায় থাকি। ভাবি, একজন ওপারের যাত্রীকে যদি শেষ বেলায় কিছুটা হলেও এপারের প্রশস্তি দিতে পারি, বিধাতা সন্তুষ্ট হবেন বৈ কি। সেদিন আবারও ডাক পড়ল গুলশানের বাসায়। গুলশানের বাসায় ডাক মানেই গুলশান থেকে বনগাঁও। যথাসময়ে যথারীতি হাজির হই আমি।

নিচতলার গেটে পা রাখতেই বসের তরুণী স্ত্রীকে চোখে পড়ে। অন্যদিনগুলির মতোই সেজেগুজে বেরিয়ে গেলেন। তবে অন্য দিনের চেয়ে মুখাবয়বটা অন্য রকম লাগছিল। অনেকটা বিধ্বস্ত বলা চলে। সিঁড়ি থেকে দু’পা এগোতেই ফ্ল্যাটের খোলা দরজা চোখে পড়ে। ওপরে উঠে কলিং বেল টিপে স্থির দাঁড়াই। কোন সাড়াশব্দ নেই। একটু সময় নিয়ে তিন চার বারের মতো বেল টিপি। তবু কোন সাড়াশব্দ নেই। কী হল বসের? আমাকে আসতে বলেছেন, তাতে তো ভুল নেই। তবে? নামাজ পড়ছেন, নাকি বাথরুমে গেলেন? থেকে থেকে বেল টিপে প্রায় মিনিট বিশেক দাঁড়াই। কোন সাড়াশব্দ নেই। খুব অস্বস্তিতে পড়ে যাই। অনিশ্চিত দাঁড়িয়ে থাকতেও ভালো লাগছে না,আবার চলেও যেতে পারি না। কী করব তবে? সাতপাঁচ ভেবে সিদ্ধান্ত নিই ভেতরে যাবার। সংকোচে পা তুলি।

ভেতরে দু’ কদম যেতেই আপাদ-মস্তকে কাটা দিয়ে ওঠে। এ কী দেখছি ভেতরে? ডাইনিং টেবিলের পা ঘেঁষে উবু হয়ে পড়ে আছেন বস। রক্তাক্ত নিস্পন্দ। পিঠে আমূল গেঁথে আছে এক ছুরি। রক্তের স্রোত বয়ে গেছে চারদিকে। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে ও দেহে প্রাণ নেই । কে করল এই নিষ্ঠুর কাজ? মাত্রই তো বেরিয়ে গেলেন বসের স্ত্রী। কী নিশ্চিন্তে গিয়ে গাড়িতে বসলেন! দুই তলা শৌখিন বাগানবাড়ি, নিচে বয়োবৃদ্ধ দারোয়ান ছাড়া অন্য মানুষজন নেই। কীভাবে, কার হাতে হল এ খুন? স্ত্রী হয়ে স্বামীকে —-। এমন নৃশংস কাজ –! কালো ওই গাড়িটিতে আরো কেউ কি আছে বা ছিল ? আজ আমি এ সময়ে আসব, হয়তো তা জানা। খুনের দায় আমার ওপর চাপাতেই যদি হয়ে থাকে এমন সময়ে খুন? এমনও তো হতে পারে খুনি এরই মধ্যে থানায় ফোন করেছে। এক্ষুণি পুলিশ এসে দেখবে আমি লাশের পাশে ছুরি হাতে দাঁড়ানো। ঠিক সিনেমার মতো। আমি নির্বোধ হলেও সিনেমার অভিজ্ঞতায় কিছু বুদ্ধি মাথায় খেলে যায়। ভাবি, না না, এ হতে পারে না। কিছুতে না। মিথ্যে খুনের দায় কাঁধে নেয়া, কিছুতে তা হবার নয়।

সাতপাঁচ ভেবে আমি তৎক্ষণাৎ বাসাটি থেকে বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। ঠিক তখনই পাশের রুমে আচমকা টেলিফোন বেজে ওঠে। হতবিহ্বল আমি ফোন রিসিভের সিদ্ধান্ত নিই। রিসিভার কানে তুলে চুপ থাকি। ওপাশ থেকে কেউ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, হুজুর, বনগাঁও থেইকা বলতেছি। বড় ম্যাডাম এইমাত্র মারা গেছেন। মিনিট পাঁচেক হল। হুজুর, –

এটুকু শুনে আমি সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করি। রিসিভারটি উল্টে রেখে বাসাটি থেকে বেরিয়ে পড়ি। নিঃশব্দে অথচ খুব দ্রুত। গেটের বাইরে এসে প্রায় দৌঁড়ের মতো করে নিকটস্থ বাস স্টেশনের পথে হাঁটি। একবার ভাবি, বনগাঁও গিয়ে বসের প্রথম স্ত্রীর জানা যায় অংশগ্রহণ করি। এতদিনের আসা-যাওয়ায় অবচেতনে আমি যেন তাকে বোনের আসনেই বসিয়ে ফেলেছি। মন খারাপ হয়েছে যারপর নাই। কিন্তু সাহস হয় না। ভীষণ দমে যাই। এদিকে এই বীভৎস দুর্ঘটনা! মন চাইলেও এ অবস্থায় ওখানে যাওয়া চলে না।

সেই সন্ধ্যায় আমি রীতিমত এক কাপুরুষের মতোই বসের বাসা থেকে পালিয়ে আসি। ক’দিন খুব সতর্কভাবে চলি। সর্বদা চারদিকে চোখ কান খোলা রাখি। বসের খুনের রহস্যময়তা নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিয়মিত নানা রকম রিপোর্ট বেরোতে থাকে। সেসব নিয়ে নানাজন নানা গুঞ্জরন তোলে। আমি নেহায়েত বাধ্য হলে হু-হাঁতে সেসব এড়িয়ে যাই। ভয়ে ভয়ে প্রতিটি মুহূর্ত পার করি। ভাগ্য ভাল যে বসের বাসা দুটিতে আমার যাতায়াতের বিষয়ে এখন পর্যন্ত অফিসের কেউই কিছু জানে না। সে বিষয়ে কোন শব্দ-বাক্য যাতে মুখ ফসকে না বেরোয় তা নিয়ে সদা সর্তক থাকি।

সপ্তাহ খানেক পর পত্রিকায় খবর বেরোয় বসের দ্বিতীয় স্ত্রী তার পুরনো প্রেমিক সহ খুনের দায়ে ধরা পড়েছে। বসের অর্থ সম্পদের লোভেই উদ্দেশ্যমূলক প্রণয়ে জড়িয়ে বসকে বিয়ে; বিয়ে করেও নানা অজুহাতে বসের সাথে বনিবনায় ঘোরতর ফারাক তৈরি করে রাখা। অবশেষে সবকিছু হাতিয়ে নেবার পর বসকে খুন করে সটকে পড়া।

তারপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। অনেক আগে খুনের দায়ে বসের দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার প্রেমিকের যথার্থ শাস্তি হয়েছে। আমারও চাকুরীকাল শেষ হয়েছে বেশ ক’বছর। তবু আমি সার্বিক বিষয়ে নিশ্চিন্ত নই। কারণ, এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই সেই সন্ধ্যার বিভীষিকাময় স্মৃতিগুলো এসে আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরে। আমি ভয়াল বিমর্ষ হই। মূক হয়ে বসে থাকি দীর্ঘক্ষণ। শাশ্বত সন্ধ্যার জাগতিক সব সৌন্দর্য পানসে অসার হয়ে আমাকে টেনে নেয় কোনও অদ্ভুত অচীনলোকে। সে এক অবাক বিস্ময়- ঘোর! জানি, ইহজগতে এ থেকে কোনও পরিত্রাণ নেই। কারণ, ইহজগৎ মানেই প্রতিটি দিন শেষে অবশ্যম্ভাবী ভাবে নামবে এক একটি সন্ধ্যা।

শওকত নূর | Shawkat Noor

New Bengali Story 2023| এসো করুণা ধারায় | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা

New Travel Story 2023 | লাচুং-নাথালু’র সীমান্ত ছুঁয়ে | জয়ন্ত কুমার সরকার

New Bengali Article 2023 | হুগলী জেল ও কাজী নজরুল ইসলাম | প্রবন্ধ ২০২৩

New Bengali Poetry 2023 | সুকান্ত মজুমদার | কবিতাগুচ্ছ

Whatsapp Story in Bengali | New Best Story Blogs | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | World’s Best Story Blogs | Best Story Blogs in Online | Online Whatsapp Story in Bengali | Full Whatsapp Story in Bengali | Whatsapp Story in Bengali Download | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – audio | Top Whatsapp Story in Bengali | Whatsapp Story in Bengali Link | Best Whatsapp Story in Bengali | Live Whatsapp Story in Bengali | short story competition | Adult Whatsapp Story in Bengali | Best Selling Whatsapp Story in Bengali | Google Whatsapp Story in Bengali | Golpo Dot Com 2023 | Top Golpo Dot Com | Whatsapp Story in Bengali 2023 | Whatsapp Story in Bengali pdf | Whatsapp Story in Bengali Boi

Leave a Comment