Traditional Seth Family Durga Puja | চন্দননগরের ঐতিহ্যবাহী হরিহর শেঠ পরিবারের দুর্গাপূজা

Sharing Is Caring:

চন্দননগরের ঐতিহ্যবাহী হরিহর শেঠ পরিবারের দুর্গাপূজা

ফরাসি উপনিবেশ চন্দননগর, জগৎজননী জগদ্ধাত্রীর শহর চন্দননগর, আলোর ঠিকানা চন্দননগর । হাওড়া-বর্ধমান রেলপথের মেইন লাইনে অবস্থিত এই চন্দননগর শহর । বিখ্যাত কবিয়াল অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির স্মৃতি বিজড়িত এই ফরাসডাঙা (চন্দননগর শহরটি এই নামেও অনেক আগে থেকেই পরিচিত ছিল) এখন বিশ্ব-মানচিত্রে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জগদ্ধাত্রী পুজোর জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত ও আলোচিত । অথচ জগদ্ধাত্রী পূজার থেকেও প্রাচীন দুর্গাপূজা রয়ে গিয়েছে এই শহরেরই বুকে । আনুমানিক ৫৫০ বছরেরও বেশি পুরানো, বাংলার অন্যতম প্রাচীন খলিসানির বসুবাড়ির দুর্গাপূজা । যা চন্দননগরের প্রথম পারিবারিক দুর্গাপূজা হিসেবে পরিচিত । চন্দননগর শহরে আরও একটি পারিবারিক দুর্গাপূজা রয়েছে যা বর্তমানেও যথেষ্ট ঐতিহ্যের দাবি রাখে । তা হল চন্দননগর শহরের পালপাড়া অঞ্চলে অবস্থিত “শেঠ বাড়ির” (Seth Family) দুর্গাপুজো ।

হুগলি জেলার মহানাদ গ্রাম থেকে হুগলির হারিট গ্রাম হয়ে প্রায় তিনশ বছর আগে চন্দননগরে আসে শেঠ পরিবার (Seth Family)। তারা তৎকালীন সময়ে ছিল প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী । শেঠ পরিবারের (Seth Family) চতুর্থ পুরুষ হলেন শম্ভুচন্দ্র শেঠ । তার পিতার নাম রাধামোহন শেঠ এবং মাতা রাধারানী দেবী । পণ্ডিত শ্রী শীবেন্দ্রনারায়ন শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা “বাংলার পারিবারিক ইতিহাস” বইটিতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মনে করা হয় কালীচরণ শেঠের (যদিও কালীচরণ শেঠ মহাশয়কে শেঠ বংশের প্রথম পুরুষ হিসেবে মনে করা হয়) কনিষ্ঠপুত্র প্রাণকৃষ্ণ শেঠ মহাশয়ের দ্বিতীয় পুত্র রাধামোহন শেঠ থেকেই বর্তমান শেঠ বংশের উৎপত্তি হয়েছে । পিতামহ কালীচরণ শেঠ মহাশয় চন্দননগরের বোড় কৃষ্ণপুরে প্রায় সাড়ে ষোলো কাঠা জমির উপর একটি ভবন প্রস্তুত করেন । বংশানুক্রমে পাওয়া চন্দননগরের বোড় কৃষ্ণপুরে তৈরি ভবনেই রাধামোহন শেঠ সপরিবারে বসবাস করতেন । রাধামোহন শেঠ ও রাধারানী দেবীর কনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন শম্ভুচন্দ্র শেঠ । তার দাদার নাম ছিল রামনারায়ণ শেঠ (মাধ্যম পুত্র) এবং দিদির নাম ছিল পদ্মমণি দেবী (জ্যেষ্ঠ কন্যা) । রাধামোহন শেঠ মহাশয় ছিলেন অত্যন্ত ধার্মিক এবং দানবীর ব্যক্তি । তিনি মুক্ত হস্তে দরিদ্র মানুষের কাছে তার সর্বস্ব বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করতেন না ।

পণ্ডিত শ্রী শীবেন্দ্রনারায়ন শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা “বাংলার পারিবারিক ইতিহাস” বইটি থেকে জানা যায় যে, জীবনের শেষলগ্নে এক ব্রাহ্মণের কাতর অনুরোধে তার নেওয়া ঋণের মৌখিক জামিনদার হন রাধামোহন শেঠ মহাশয় । আনুমানিক ১৮১৬ সালে সেই ব্রাহ্মণ ঋণ শোধে অসমর্থ হলে চন্দননগরের বোড় কৃষ্ণপুর নামক জায়গার পদ্মপুকুর পল্লীর পৈত্রিক বাসভবনটি বিক্রি করে সেই ঋণ পরিশোধ করেন তিনি । ফলস্বরূপ জীবন সায়াহ্নে এসে রাধামোহন বাবু চরম অর্থকষ্টের মধ্যে পড়েন, সাথে সাথে তার সন্তানাদিরাও এই কষ্ট ভোগ করতে থাকে । এই অত্যধিক দারিদ্রতার জ্বালা রন্ধ্রে রন্ধ্রে কষ্ট দিতে থাকে শম্ভুচন্দ্র শেঠকে । জীবন ও সংসার চালনার দায়ভার কাঁধে নিয়ে মাত্র ৬৭ টাকা মাস মাহিনার পরিবর্তে কলকাতার এক সাধারণ তুলার দোকানের কর্মচারী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন । পরবর্তী সময়ে চন্দননগরের বারাসত নিবাসী অত্যন্ত বিত্তশালী ব্যবসায়ী কার্তিক প্রসাদ শ্রীমানীর কন্যা অন্নপূর্ণা দাসীর সাথে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন । পৈত্রিক বাসভবনটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার ফলে বিয়ের ঠিক পরপরই শম্ভুচন্দ্র শেঠের শ্বশুরমশাই তৎকালীন পালপাড়া অঞ্চলে একটি দুর্গাদালান সহ ভবন প্রদান করেন (যদিও স্বর্গত হরিহর শেঠ মহাশয়ের শ্রাদ্ধবাসরে তার পুত্র-কন্যা দ্বারা প্রকাশিত “পরমপূজ্য পিতৃদেবের উদ্দেশ্যে অন্তরের গভীরতম ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন” নামক বংশ পরিচয় সম্বলিত পত্রিকায় বলা হয়েছে এই বাসভবনটি শম্ভুচন্দ্র শেঠ মহাশয় নির্মাণ করেন) । এই বাসভবনটিতে শেঠ বংশের বর্তমান প্রজন্মের মানুষের বসবাস করেন ।

এই পূজার প্রাচীনত্ব বা প্রতিষ্ঠাকাল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা যায় না । তবে প্রচলিত ধারা ও পারিবারিক মতে এই পূজাটিও আনুমানিক ৫০০-৫৫০ বছরের পুরানো বলে অনুমান করা হয় । হরিহর শেঠ মহাশয়ের প্রপৌত্র শ্রীযুক্ত গৌতম শেঠ মহাশয়ের কথায় এই পূজাটি বহুকাল আগে থেকেই শ্রীমানি পরিবারের পারিবারিক পূজা ছিল বলে জানা যায় । আর সেখান থেকেই শম্ভুচন্দ্র শেঠ মহাশয় এই দালান সহ ভবনটি বৈবাহিক সূত্রে শ্বশুরমশাইয়ের থেকে পাবার পর এই পূজাটি নির্দিষ্ট রীতিনীতি মেনে এই শেঠ পরিবারে চালু রাখেন । সেই সময় থেকেই এই দুর্গাপূজাটি “শেঠ বাড়ির পূজা” (Seth Family) বলে পরিগণিত হয় । শুধুমাত্র দুর্গাপূজায় নয়, এই ঠাকুরদালানে দক্ষিণা শ্যামা কালীর আরাধনাও আরও প্রাচীন । এই দক্ষিণা শ্যামা কালী পূজাটি দুর্গাপূজার থেকেও বেশি প্রাচীন বলে এই শেঠ পরিবারের (Seth Family) বর্তমান প্রজন্ম শ্রীযুক্ত গৌতম শেঠ মহাশয় মনে করেন । সাথে এই বাড়িতে দোল উৎসবও পালিত হতো একসময় দোল পূর্ণিমার দিন । বর্তমানে দোল উৎসবের সেই জাঁকজমক ও কৌলিন্য হারালেও, খুব ছোট পরিসরে পরিবারের মধ্যে সেই রীতি এখনো বজায় রয়েছে ।

চন্দননগর শহরের পালপাড়া অঞ্চলে অবস্থিত এই “শেঠ বাড়ি” (Seth Family) বা দেশশ্রী হরিহর শেঠের পরিবারের এই দুর্গাপূজাটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই পূজা দিতে পারেন এবং ঠাকুর দর্শন করতে পারেন । এই পরিবারের রীতি অনুযায়ী পরিবারের বরিষ্ঠ সদস্য বা সদস্যা প্রতিবছর পুরোহিতদের (এই পরিবারের প্রধান পুরোহিত হিসেবে বর্তমানে শ্রীযুক্ত নিতাই চ্যাটার্জী মহাশয় বংশানুক্রমিক ভাবে রয়েছেন । তিনি নিজেই প্রায় ২৫-৩০ বছর এই পরিবারের সাথে প্রধান পুরোহিত হিসেবে যুক্ত রয়েছেন) পূজা শুরু করার আনুষ্ঠানিক অনুমতি প্রদান করেন । বর্তমানে এই গুরুদায়িত্ব পালন করেন এই পরিবারের বর্তমান বয়:জ্যেষ্ঠা সদস্যা শ্রীমত্যা অলোকা শেঠ মহাশয়া । এই পরিবারের ঠাকুরদালানেই বা ঠাকুর-মঞ্চেই প্রতিমা তৈরীর রীতি বহু পূর্ব থেকেই চালু রয়েছে । প্রতিমা শিল্পী হিসেবে চন্দননগরের কুন্ডুঘাট নিবাসী শ্রীযুক্ত অসিত পাল মহাশয় বংশানুক্রমিকভাবে বর্তমানে নিযুক্ত রয়েছেন । এক চালচিত্রের শেঠ পরিবারের (Seth Family) দুর্গা প্রতিমার দৈর্ঘ্য প্রস্থ ও উচ্চতা হল যথাক্রমে ৫ ফুট, ৩ ফুট ও ৬ ফুট । পিছনের চালচিত্রে থাকে পটের ছবি আঁকা । আটবাংলা সোনালী সাজে চালচিত্র ও দেবী মা সেজে ওঠেন অপরূপা সাজে । তবে পুরোনো একটি ছবি থেকে জানা যায় যে, এই পরিবারের দুর্গা ঠাকুরের চালচিত্রটি পূর্বে ময়ূরের পালক দিয়ে সুসজ্জিত করা হতো ।

প্রতিবছর মহাষষ্ঠীর দিন বাড়ির সংলগ্ন পুকুরে ঘট ও কলাবউ স্নান করানোর মাধ্যমে (ঘটস্নান করানোর গুরুদায়িত্ব বর্তমানে পালন করেন শ্রীযুক্ত গৌতম শেঠ মহাশয়) এই পরিবারের দুর্গা পূজার শুভ সূচনা হয় । ঘট ও কলাবউ স্নান করিয়ে দুর্গাদালান আনার পর হয় দেবীর বোধন, শুরু হয় মহিষমর্দিনী দশভূজা আরাধনা । চারদিন মহা আড়ম্বরে দেবী মায়ের আরাধনা করা হয় । বড় বড় থালায় ফল, সবজি, চাল, ডাল, মিষ্টি ইত্যাদি সহযোগে নৈবেদ্য সাজানো হয় দেবী প্রতিমার সামনে । পূজার কার্যে প্রয়োজনীয় মিষ্টি বাইরের দোকান থেকে ক্রয় না করে, এই বাড়িতে ভিয়েন আয়োজন করার রীতি আজ অব্দি অক্ষুণ্ণ রয়েছে । পূজার সময়ে এই বাড়িতে কোনোরকম বলির রীতি কোনদিনই ছিল না, এমনকি ফল বলিও এই পূজা করা হয় না । দিনের বেলায় আরতির সময় রান্না করা খিচুড়ি ভোগ দেবার রীতি এই বাড়িতে প্রথম দিন থেকেই প্রচলিত ছিলনা এবং আজও নেই । সন্ধেবেলায় মায়ের সন্ধ্যা আরতির সময় লুচি ভোগ করা হয় ষষ্ঠী থেকে নবমী প্রতিদিনই । শুভ বিজয়ার দিন মাকে মিষ্টিমুখ ও বরণ করার পর বাড়ির সকল মহিলাদের মধ্যে সিঁদুর খেলার রীতি আজও বিদ্যমান রয়েছে স্বমহিমায় । বর্তমানে জেলে সম্প্রদায়ের অন্তত একজন প্রতিনিধি মাকে কাঁধে করে লরিতে তোলেন বিজয়ার উদ্দেশ্যে । শেঠ পরিবারের (Seth Family) দুর্গা বিগ্রহ বিসর্জিত হন চন্দননগরের বালি ঘাটে । যে ঘাটটি অবস্থিত বর্তমানে যেখানে আদি মা জগদ্ধাত্রী পূজার মন্দির রয়েছে তার পিছনে ।

এই শেঠ পরিবারের (Seth Family) বাড়িতে লক্ষ্মী-নারায়ণ অবস্থান করছেন বহু প্রাচীনকাল থেকে । হরিহর শেঠ মহাশয়ের পুত্র মনোরঞ্জন শেঠ মহাশয় স্বপ্নে প্রাপ্ত আদেশানুসারে এই নারায়ণ শিলাকে সারাবছর রাখার জন্য একটি ধাতু নির্মিত ময়ূর সিংহাসন প্রস্তুত করেন । ময়ূর সিংহাসন সহ লক্ষ্মী-নারায়ণ এই বাড়ির দোতলায় সারাবছর ঠাকুর গৃহে অবস্থান করেন । কিন্তু পুজোর সময় দোতলা থেকে ঠাকুরদালানে ময়ূর সিংহাসন সহ লক্ষ্মী-নারায়ণকে নিয়ে আসার রীতি বহুদিন থেকেই প্রচলিত রয়েছে । এই লক্ষ্মী-নারায়ণকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসার যথেষ্ট অভিনব । বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সম্মুখভাগে গঙ্গাজল ছড়ানো হয়, তার পিছনে থাকে নতুন বা সুদ্ধ বসন পরিহিতা বাড়ির কুলবধুদের কোলে লক্ষ্মী বিগ্রহ এবং তার পিছনে কুলোপুরোহিত ময়ূর সিংহাসন সহ নারায়ণকে তার কোলে করে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসেন । ঠাকুরদালানে নিয়ে আসার পর ময়ূর সিংহাসন সহ লক্ষ্মী-নারায়ণকে যথাস্থানে রাখা হয় । দেবী মায়ের আরাধনার সাথে সাথেই চারদিন ধরে লক্ষ্মী-নারায়ণকেও পুজো করা হয় । এখানে উল্লেখ্য হলো ময়ূর সিংহাসনটিও দেবতা জ্ঞানে নিত্য পূজিত হয় । শেঠ পরিবারের (Seth Family) বর্তমান প্রজন্ম শ্রীযুক্ত গৌতম শেঠ মহাশয় আরও জানান যে, দেশশ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ের পিতা নিত্যগোপাল শেঠ মহাশয়ের আমল থেকেই এই বাড়িতে ময়ূর পোষা হত, কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে তাদের পরিবারের গৃহদেবতা হলো ময়ূর (নারায়ণের প্রতিনিধি স্বরূপ) । তৎকালীন সময়ে বাড়ির সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী বাগানে ময়ূরগুলি ছাড়া থাকতে বলে তিনি জানান । তবে পরবর্তী সময়ে বিশালাকৃতি খাঁচার মধ্যে রাখা হতো । শেষে অত্যন্ত দুঃখের সাথে তিনি জানান ২০০৯ সালে বনদপ্তরের হস্তক্ষেপে বাড়িতে রাখা বন্ধ করে দেওয়া হয় । সেই সময় এই শেঠ পরিবারে (Seth Family) দশটি ময়ূর ছিল বলে গৌতম শেঠ মহাশয় জানান ।

আদি পরিবারের মধ্যে তৎকালীন সময়ে বেশকিছু রীতিনীতি চালু থাকলেও বর্তমানে অর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলস্বরুপ সেইসব রীতি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে বা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে । সেইরকমই শেঠ পরিবারে (Seth Family) চালু থাকা বেশকিছু নিয়ম-রীতিও বর্তমানে পরিবর্তিত হয়েছে । বহু ঘাত-প্রতিঘাত ও বহু কঠিন সময় মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে এই পরিবারের সময় । বহু সামাজিক নিয়মের মধ্যে থেকেও এই পরিবারের দুর্গা পূজার রীতি কখনো বন্ধ হয়নি । দেশশ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ের প্রপৌত্র গৌতম শেঠ মহাশয় জানান যে, পূজার যাবতীয় জোগাড় বাড়ির মহিলারাই প্রথম দিন থেকেই করতেন । কিন্তু তৎকালীন সময়ে সামাজিক রীতিনীতি অনুযায়ী বাড়ির মহিলারা ছিলেন পর্দানশীল । ফলস্বরূপ তারা কখনোই পর্দার আড়ালে জনসমক্ষে আসতে পারতেন না । তৎকালীন সময়ে বাড়ির মহিলারা বাড়ির অন্দরে বসে পূজার সমস্ত জোগাড় করতেন ।

মূল গৃহ থেকে ঠাকুরদালানে বাড়ির পিছনের একটি রাস্তা দিয়ে আসতেন এবং ঠাকুরদালানের দোতালায় চিক (তৎকালীন যুগে সরু-সরু করে বাঁশ কেটে, তার দিয়ে সেগুলিকে একত্রে জুড়ে, সুতো দিয়ে ঝোলানো হত পর্দার মতো করে । যার একদিক থেকে দৃশ্যমান কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরের কোন কিছুই এর মাধ্যমে দেখা যেত না) দেওয়া জানালার মধ্য দিয়ে পূজা-অর্চনা দর্শন করতেন । দেশশ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ের আমল থেকে বাড়ির মহিলাদের পর্দানশীল থাকার রীতি এই পরিবারে বন্ধ হয়ে যায় । তারা জনসমক্ষে থেকেই পূজার সমস্ত কাজে অংশগ্রহণ করতেন এবং সকলের মধ্যে থেকেই দেবী মাকে ও মায়ের আরাধনাকে স্বচক্ষে প্রাণভরে দর্শন করতে শুরু করেন ।

গৌতম বাবুর থেকে আরও জানা গেল যে, তার দাদু মনোরঞ্জন শেঠ মহাশয়ের আমলের শেষ পর্ব পর্যন্ত এই বাড়িতে দেবীর বোধন চালু হত শুভ মহালয়ার তিথিতে । উক্ত দিনে সহকারী সহ কুলপুরহিত মহাশয় দেবীর বোধন করতেন এবং চন্ডীপাঠের মাধ্যমে দেবী আরাধনার সূচনা করতেন । কিন্তু বর্তমানের বিভিন্ন অর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক পরিবর্তনের ফলস্বরুপ দেবীর বোধন ও দেবীর আরাধনা শুরু হয় মহাষষ্ঠীর দিন থেকে । এছাড়াও একসময় এই বাড়িতে বন্দুক থেকে গুলি বর্ষণ করে সন্ধিপুজোর সূচনা করার রীতি চালু ছিল । কিন্তু সেই রীতিও বিভিন্ন কারণবশত বিগত কুড়ি বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে । তৎকালীন সময়ে দেবী মা যতদিন ঠাকুরদালানে অবস্থান করতেন ততদিন পর্যন্ত ঠাকুরদালান এক মুহূর্তের জন্য জনশূন্য রাখা যেত না । রাত্রিবেলাতেও অন্তত একজন পারিবারিক সদস্যকে সেই ঠাকুরদালানে থাকতে হত দেবী মায়ের প্রহরায় । পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণে রাত্রিবেলায় পরিবারের সদস্যদের ঠাকুরদালানে থাকা সম্ভব না হওয়ায় ব্রাহ্মণ পান্ডে সম্প্রদায়ের এক পাহারাদার নিযুক্ত হন দেবী মায়ের প্রহরায় । তিনি ঢাল-তলোয়ার (জানা যায় ঢালটি গন্ডারের চামড়া দিয়ে নির্মিত ছিল) নিয়ে রাত্রিবেলায় সদাসতর্ক অবস্থায় দেবী মায়ের পাহারা দিতেন । কিন্তু কালের নিয়মে সেই রীতিও আজ বন্ধ হয়ে গেছে ।

বিজয়া দশমীর দিন শেঠ পরিবারের (Seth Family) ঠাকুর ভাসানের রীতি অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরাই মায়ের বিগ্রহ গঙ্গার ঘাট অব্দি নিয়ে যেত । ঠাকুর বিজয়ের পর প্রত্যেকে নতুন গেঞ্জি ও ধুতি পড়ে শেঠ পরিবারের (Seth Family) আসতো বিজয়া দশমীর সৌহার্দ্য বিনিময় করতে । সেই সময়ে জাতিভেদ, বর্ণভেদকে উপেক্ষা করে শুধুমাত্র নিজেদের মধ্যেই নয় শেঠ পরিবারের (Seth Family) সকল সদস্যদের সাথে তারা শুভ বিজয়ার সৌহার্দ্য বিনিময়ের সুযোগ পেত । এখন বিভিন্ন কারণবশত জেলে সম্প্রদায়ের মানুষেরা অন্যান্য জীবিকানির্বাহের মাধ্যমে জীবনযাপন করায় বর্তমানে শুধুমাত্র সেই সম্প্রদায়ের অন্তত একজন ঠাকুর বিজয়ের সময় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত থাকে । হ্যাজাকের আলোর পরিবর্তে বর্তমানে বৈদ্যুতিক এল.ই.ডি. আলোয় সুসজ্জিত হয় দুর্গা দালান ও সমগ্র বাড়ি । শেঠ পরিবারের (Seth Family) এই দুর্গাপূজায় চারদিন ধরে পারিবারিক সকল সদস্য সহ স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হতো কিন্তু বর্তমানে বেশ কিছু বছর হল এই খাওয়া-দাওয়ার অনুষ্ঠানটি শুধুমাত্র পারিবারিক সদস্য এবং যারা পূজার কার্যে নিয়োজিত থাকেন তাদের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে গেছে । কথায় কথায় গৌতম শেঠ মহাশয়ের থেকে জানা যায় যে, হরিহর শেঠ মহাশয়ের ভ্রাতা বিপ্লবী দুর্গাদাস শেঠ পন্ডিচেরি গমনের আগে পর্যন্ত পারিবারিক এই পূজায় বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন ।

দেশশ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ার বড় নাতবৌ শ্রীমত্যা অলোকা শেঠ মহাশয়ার (শ্রীযুক্ত গৌতম শেঠ মহাশয়ের মাতা) থেকে জানা গেল স্বাধীনতার পূর্বে এই বাড়ির সাথে বিপ্লবীদের গোপন যোগাযোগ ছিল । চন্দননগর শহর তৎকালীন সময়ে ফরাসিদের অধীনে থাকায় এই শহরে বিপ্লবীরা নিশ্চিন্তে আত্মগোপন করে থাকতে পারত । আর হরিহর শেঠ মহাশয়ের ভ্রাতা বিপ্লবী দুর্গাদাস শেঠ ছিলেন দেশমাতৃকার প্রতি নিবেদিত প্রাণ । ফলস্বরূপ তার সাথে যোগাযোগ ও অন্যান্য গুপ্ত বৈপ্লবিক আলোচনার জন্য এই বাড়িতে বিপ্লবীদের আনাগোনা লেগে থাকত বলে মনে করা হয় । অলোকা দেবী আরো জানান যে হরিহর শেঠ মহাশয়ের নির্দেশে এই বাড়িতে পুজোর সময় এমনকি বছরের অন্যান্য সময়েও রান্না করা খাবার রেখে দেওয়া হতো । পরদিন সকালে দেখা যেত সেই খাবার কেউ খেয়ে গেছে । খুব সহজেই অনুমেয় রাতের অন্ধকারে কারা সেই খাবার গ্রহণ করতে আসতেন বা কাদের উদ্দেশ্যে এমন রীতি এই শেঠ পরিবারের চালু ছিল ।

এই বাড়ির শুধুমাত্র দুর্গাপূজাই নয় এই বাড়ির কালী পূজাটিও যথেষ্ট প্রাচীনত্বের দাবি রাখে । পারিবারিক সদস্যদের থেকে জানা যায় যে অমাবস্যা তিথিতে দুদিন ধরে আয়োজিত এই কালীপুজোটিও একসময়ে শ্রীমানি পরিবারের পারিবারিক পূজা ছিল । মা কালীর কাঠামোতেও যথেষ্ট প্রাচীন তা দেখলেই বোঝা যায় । মা কালী এই বাড়িতে দক্ষিণা শ্যামা কালী রূপে পূজিত হন । কালী পূজার দিন আতশবাজির (শব্দবাজি ছাড়া) মাধ্যমে পূজার শুভ সূচনা করা হয় এবং সমগ্র বাড়ি আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয় । দুর্গাপুজোর মতোই কালীপূজাতেও কোনো রকম বলি উৎসর্গ করা হয় না । এই পরিবারের সকল পূজাই অনুষ্ঠিত হয় বৈষ্ণব মতাদর্শ অনুযায়ী । পূর্বে ঠাকুরদালানের মধ্যে রাখা কাঠামোর ওপর মায়ের বিগ্রহ নির্মিত হলেও বর্তমানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কুমোরবাড়ি থেকে প্রস্তুত করা দক্ষিণা শ্যামা কালীর বিগ্রহ সেই কাঠামোর উপর রেখে পুজো করা হয় । দুদিন ধরে নিয়ম-নীতি মেনে মায়ের আরাধনা সম্পন্ন করার পর জেলে সম্প্রদায়ের অন্তত একজন প্রতিনিধি উপস্থিতিতে আদি মা মন্দিরের পিছনে অবস্থিত বালি ঘাটে বিগ্রহের বিসর্জন করা হয় ।

দুর্গাপূজা ও কালীপূজার পাশাপাশি এই পরিবারের (Seth Family) দোলযাত্রা উৎসবটিও বহুদিন ধরে পালিত হয়ে আসছে । এই পরিবারে ঈশ্বর লক্ষ্মী জনার্দন জিউয়ের বিগ্রহ বহুদিন ধরেই নিত্য পূজিত হয়ে আসছেন । দোল পূর্ণিমার দিন ঠাকুরদালান থেকে ঈশ্বর লক্ষ্মী জনার্দন জিউয়ের বিগ্রহ সহ দোল মঞ্চটি নিচে নির্দিষ্ট স্থানে নামানো হত । সেখানে দোলমঞ্চটি ফুল দিয়ে সুসজ্জিত করে নির্দিষ্ট নিয়ম-রীতি সহযোগে পূজাপাঠ করা হতো এবং আবির খেলা হতো । দোলমঞ্চের পার্শ্ববর্তী নির্দিষ্ট একটি স্থানে পূজাপাঠের পরে হোম করা হতো । পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন কারণবশত দোল বহুদমঞ্চটি ঠাকুরদালানের নিচে না নামিয়ে নারকেল পাতা দিয়ে দোলমঞ্চ প্রস্তুত করে এই বিশেষ অনুষ্ঠানটি পালিত হতো বহুদিন । কিন্তু বর্তমানে অর্থ-সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন কারণবশত দোলযাত্রা উৎসব তার কৌলীন্য হারিয়েছে । উৎসবটি বন্ধ হয়নি ঠিকই কিন্তু আনুমানিক ২৫-৩০ বছর আগে থেকে এই প্রথাটি আবদ্ধ হয়ে গেছে পরিবারের ঠাকুরঘরের অন্তরালে । ঠাকুরদালানের নিচে যে স্থানে দোলমঞ্চটি নামানো ও প্রথিত হত, সেই স্থানে চারটি গর্ত ছিল । বর্তমানে সেই গর্তগুলি ভরাট করে কংক্রিটের করা হয়েছে । কিন্তু সেই গর্তগুলির অস্ফুট চিহ্ন বর্তমানেও পুরনো ঐতিহ্যের কথা নিশ্চুপে বলে যায় সকলের কানে কানে ।

এই বাড়ির প্রতিটি কোনায় রয়েছে প্রাচীনত্ব ও আভিজাত্যের ছোঁয়া । বর্তমানে এই দুয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে আধুনিকতার পরশ । বর্তমান অর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পূজার কৌলীন্য কিছুটা কমলেও, বাড়ির সদস্যদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কোনো অন্ত নেই । দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এই পরিবারের সদস্যরা এই উৎসবের দিনগুলিতে অতি-অবশ্যই এই বাড়িতে সকলে একসাথে মিলিত হন । সকলের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে চন্দননগরের “শেঠ ভবন” । পারিবারিক সদস্যদের আর্থিক সহায়তায় ও মূলত কলকাতার বড়বাজারস্থিত দেবোত্তর সম্পত্তি থেকে বার্ষিক আয়ের মাধ্যমেই আজও চন্দননগরের “শেঠ বাড়ির দুর্গাপূজা” (Seth Family) যথাসম্ভব অভিজাত্য ও কৌলীন্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে পরিচালিত হয়ে আসছে ।

তথ্যসূত্র :
  • পণ্ডিত শ্রী শীবেন্দ্রনারায়ন শাস্ত্রী মহাশয়ের লেখা “বাংলার পারিবারিক ইতিহাস” ।
  • স্বর্গত হরিহর শেঠ মহাশয়ের শ্রাদ্ধবাসরে তার পুত্র-কন্যা দ্বারা প্রকাশিত “পরমপূজ্য পিতৃদেবের উদ্দেশ্যে অন্তরের গভীরতম ভক্তি ও শ্রদ্ধা নিবেদন” নামক বংশ পরিচয় সম্বলিত পত্রিকা ।
  • সবিতা রায় চৌধুরীর ইউটিউব চ্যানেলে সম্প্রচারিত “Harihar Seth O Chandannagar Seth Barir History” নামক একটি তথ্যচিত্র ।
  • হরিহর শেঠ মহাশয়ার বড় নাতবৌ শ্রীমত্যা অলোকা শেঠ মহাশয়ার থেকে প্রাপ্ত তথ্যবলি ।
  • দেশশ্রী হরিহর শেঠ মহাশয়ের প্রপৌত্র শ্রীযুক্ত গৌতম শেঠ মহাশয়ের সাথে আলপাচারিতার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য ।

[ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে]

অনির্বাণ সাহা | Anirban Saha

Bengali Article 2023 | ভৃগুর শক্তিপীঠ ও বড়োমা :: বিল্লপত্তন থেকে বড়বেলুন

Bengali Article 2023 | সুভাষচন্দ্রের আত্মজীবনীঃ বিভিন্ন মনীষী প্রসঙ্গ

Bengali Article 2023 | কবিগুরুর মানবতার ভাবরূপ

Bengali Article 2023 | নিছক, কথার কথা নয়

হরিহর শেঠ | ইতিহাসের বিভিন্ন তথ্য | জগৎ শেঠ | চন্দননগর ইতিহাস | চন্দননগরের ইতিহাস | চন্দননগর চার্চ | চন্দননগর পৌরসভা | চন্দননগর কি জন্য বিখ্যাত | চন্দননগর পাতাল বাড়ি ইতিহাস | জমিদার বাড়ির পুজো | বাংলা প্রবন্ধ | বাংলার লেখক | প্রবন্ধ ও প্রাবন্ধিক | সেরা প্রবন্ধ ২০২২ | শব্দদ্বীপ | শব্দদ্বীপের লেখক | বাংলা ম্যাগাজিন | ম্যাগাজিন পত্রিকা | শব্দদ্বীপ ম্যাগাজিন | বনেদি বাড়ির দুর্গা পূজা | চন্দননগরের ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা | হরিহর শেঠ পরিবারের দুর্গাপূজা | ঐতিহ্যবাহী হরিহর শেঠ | চন্দননগরের দুর্গাপূজা | ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপূজা

bengali article writing competition | writing competition malaysia | writing competition london | writing competition hong kong | writing competition game | writing competition essay | writing competition australia | writing competition prizes | writing competition for students | writing competition 2022 | writing competitions nz | writing competitions ireland | writing competitions in africa 2022 | writing competitions for high school students | writing competitions for teens | writing competitions australia 2022 | writing competitions 2022 | writing competitions uk | bengali article writing | bangla news article | bengali article rewriter | article writing | bengali article writing ai | bengali article writing app | bengali article writing book | bengali article writing bot | bengali article writing description | bengali article writing example | article writing examples for students | article writing for class 8 | article writing for class 9 | bengali article writing format | article writing gcse | bengali article writing generator | article writing global warming | article writing igcse | article writing in english | bengali article writing jobs | article writing jobs for students | article writing jobs work from home | article writing lesson plan | article writing on child labour | article writing on global warming | article writing pdf | article writing practice | article writing topics | trending topics for article writing 2022 | what is article writing | content writing trends 2022 | content writing topics 2022 | Bangla Prabandha | Probondho | Definite Article | Article Writer | Short Article | Long Article | Bangla kobita | Kabitaguccha 2022 | Galpoguccha | Galpo | Bangla Galpo | Bengali Story | Bengali Article | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | Seth family Durga Puja | Harihar Seth family puja | Seth Family House | Chandannagar Seth Family Puja | Chandannagar Harihar Seth Family Durga | Chandannagar Seth Family Durga Puja | Durga Puja Seth Family | Durga Puja Seth Family Chandannagar | Seth Family traditional puja | Traditional Puja Seth Family | Traditional House Puja Seth Family

Leave a Comment