
জয়নাল আবেদিন – সূচিপত্র [New Bengali Novel 2023]
খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ১৩) – জয়নাল আবেদিন [Sera Bangla Uponnash]
পাল-পার্বণ ছাড়া আরশাদের রিক্সা কোনদিন চুপচাপ বসে থাকে না। সে নিজে অলস সময় কাটানো নিজের চরিত্রে রাখেনি কখনো। পরিশ্রমই তার জীবনের ধারা অথচ আজ তার ঘরের রিকশা টা চুপচাপ দাঁড়িয়ে। সে নিজেও চুপচাপ ঘরের মধ্যে। তবে একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে তার চোখে মুখে। চনমনে রিজিয়াও কিছুটা যেন ম্লান। এমন একটা সকাল আরশাদ- রিজিয়ার সংসার জীবনে কখনো এসেছে বলে কারো স্মরণে নেই। থাকার কথাও নয়। অথচ আজকের সকাল- একটা স্মরণীয় সকাল হবে তাদের জীবনে, সে ভাবনা ভাবার অবকাশও তাদের নেই।
জীবন বোধ। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। জীবনধারণের অতীত- বর্তমান কোন কিছুই ওদের প্রভাবিত করেনি কখনো। পরিশ্রমের বিনিময়ে রোজগার। রোজগারের বিনিময়ে খেয়ে পরে বেঁচে থাকো। বেঁচে থাকা ছাড়া আর উৎসুখ্য কি থাকতে পারে। রিজিয়ার সাদামাটা জীবনে চাওয়ার কোন বস্তু পৃথিবীতে নেই। পাওয়ার জন্য কিছু চাইতে হয় এটুকু রঙিন বোধ মনের কোনায় কোনদিন ফুটে ওঠেনি। আরশাদ পরিশ্রমী জীবনে চাহিদা এবং যোগানের সমন্বয় পেয়েছি বলেই, বেঁচে থাকার রসদে টান পড়েনি কখনো। অথচ আজ তার মসৃণ জীবনে কেমন একটা টাল খাওয়া সময় তাকে বিব্রত করে রেখেছে। সঠিক পথ বাছতেই হবে তাকে।
চা রুটিতে সকালের নাস্তা সেরেছে। দিদিমণির সঙ্গে আজ কথা বলার প্রয়োজনেই নিজেকে প্রস্তুত রেখেছে। কারণ একটু বেলা হলেই মাতব্বর কজন আসবে, ফলাফল জানতে।
— দিদিমণি আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল। আরশাদের কথাগুলো বলতে বেশ অস্বস্তি বোধ হচ্ছিল।
— আরে, বসুন বসুন। ছেলেমেয়েকে পড়ার বই হাতে পাশের ঘরে পাঠালো স্বাতী। রিজিয়া পাশাপাশি বিছানায় বসলো।
— আসলে কি দিদিমণি। অনেকদিন তো হয়ে গেল আপনি আছেন। বস্তির লোকেরা কথা তুলেছে। আপনার এভাবে থাকা এখানে অন্যায়। হাজার হোক আপনি হিন্দু ঘরের বউ। আমরা মু মোসলমান।
— আপনার কথা আমি বুঝি। এতগুলো দিন আপনাদের দয়ায় পড়ে রয়েছি। অনেক আগেই চলে যাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কোথায় যাব ? আমার জীবনে সব রাস্তাই বন্ধ। কোনখানেই ফিরে যাবার জায়গা আমার নেই। মৃত্যুই আমার একমাত্র সঠিক জায়গা।
— বালাই ষাট! একি কথা গো দিদি? রিজিয়া ককিয়ে উঠলো। সকালবেলা ওরকম কথা কেউ মুখে আনে!
ম্নান হাসে স্বাতী। আমার উপকার করার জন্য আপনাদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। আমি অনেক ক্ষতি করেছি। জীবনের বিনিময়েও তা শোধ হবে না।
— কিন্তু এখন কি করবেন ? কোথায় যাবেন ?জিজ্ঞাসা আরশাদের।
— কিছুই জানি না। কিন্তু যেতে হবে। উদাশ স্বাতী।
— আপনি কলকাতায় ফিরে যান। নিজের ঘরে। বাচ্চাগুলো মুখ চেয়ে আছে। আমরা আপনারে গে দিয়ে আসবো। ভুল বুঝলেও হাতে পায়ে ধরে মিটিয়ে নেব।
চোখের কোনে জমে থাকা টলটলে জল বাঁধ ভেঙে উপচে পড়তে লাগলো। তা আর হবার নয়। আমি যেমন সংসার ত্যাগ করে চলে এসেছি। সংসারও আমাকে ত্যাগ করেছে। কেউ কাউকে আর ফিরিয়ে নেবে না। শাঁখা- সিঁদুর আমার থেকে সরিয়ে রেখেছি। কাছে আসার আর সময় নেই।
রিজিয়া আবেগে নিজেকে সামলাতে পারে না। আনপড় মানুষটার মন পেঁজা তুলোর মতো নরম। চোখের জল মুছে নিজের আঁচলে, – বলে এভাবে কি নিজেকে কষ্ট দেবে না গো দিদি। মানুষের জীবনে কত ভুলভ্রান্তি হয়। আবার শুধরেও নিতে হয়।
— আমার আর কোন জায়গা নেই। ঠিক না ভুল শোধরানোর ভাবনা আসবে কোথা থেকে? একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে স্বাতীর।
— দিদিমণি, আমরা মুখ্য সুখ্য মানুষ। অনেক কথার মানে বুঝি না। কি বলতে হয় তা সময় মতো বলতে পারি না। কোথায় যাবেন সেটা বলে দিলে পৌঁছে দিয়ে আসবো।
— আমার উপকার করে আপনার জীবনে অন্ধকার নামতে এসেছিল। তার প্রতিবাদ করতে সব ছেড়ে ছুটে এসেছিলাম। তখন কিন্তু কারো সাহায্য নিই নি। এবার এখান থেকে আপনাদের ছেড়ে চলে যাব। কাউকে লাগবে না।
— অমন কথা বললে তো খটকা লাগে গো দিদিমণি। কিছুটা যেন ভীত আরশাদ।
— সেটা আপনার সততা। আপনাদের সরলতা। অভাবের সংসারে আমার মতো একজন অভাগী মানুষকে তো বেশ কটা দিন পুষলেন। আবার তার জন্য নতুন করে প্রতিবেশীর কাছে হেনস্তাও হতে চলেছেন।
— সেটা যেমন ঠিক কথা। আবার মানুষ বাড়িতে গরু- ছাগল পুষলেও বাড়ি থেকে ইচ্ছে করে কেউ তাড়িয়ে দিতে পারে? পারে না। তাহলে একটা মানুষকে কি করে জেনেশুনে তাড়িয়ে দেবো বলুন।
চোখের জল মোছে আঁচলে স্বাতী। সারা শরীরে একটা অস্থির, চঞ্চলতা দেখা দেয়। মানবতা বোধ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় মুহূর্তে। কেন এভাবে এদের বিব্রত করে- অসহায় মানুষ দুটোকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছি। আমার তো কোন অধিকার নেই এখানে। যে কাজের জন্য আমি এসেছিলাম। তা তো অনেকদিন আগেই সমাপ্ত করে ফেলেছি। অতএব যেখানে যাবার সেখানে চলে যাওয়া উচিত ছিল আমার। কেন স্বার্থপরের মতো পড়ে রয়েছি এখানে। কেন অসহায় মানুষ দুটোকে এভাবে বিপদে ফেলছি আমি। বিবেকের তাড়না অদৃশ্য চাবুক হাতে বারবার চাবকাতে থাকে স্বাতীকে। দমকা কান্নায় দুহাতে মুখ ঢেকে সে। ঘটনার আকস্মিকতায় রিজিয়া হতভম্ব। বুকে টেনে নেয় স্বাতীকে। কেঁদো না দিদি। এভাবে কাঁদলে শরীর খারাপ করবে। আমি বুঝি গো দিদি। মেয়ে মানুষের সোয়ামী সব। তোমার জীবনে সেটারই অভাব থেকে গেছে। তোমার মরদ ভালো মানুষ নয় গো, মেয়ে মানুষের খোঁজ টাই করল না। কেমন মরদ ভাব পায়নি গো।
চোখের জল মুছে স্বাতী যেন কিছুটা স্বাভাবিক হতে চায়। সুখ শব্দটা সকলের জন্য নয়। সুখী হওয়ার জন্য ভাগ্যের দরকার হয়। আমার ভাগ্য সুখের নয়- দুঃখের। আমাকে তা পেতেই হবে। এ আমার ললাটের লিখন। একে খন্ডন করে কার সাধ্য।
— দিদিমণি, আমি এক কথা বলি শোনেন। কলকাতা যাবেন না চাইছেন যখন। তখন আপনার বাপ বাড়িতে চলেন। আমি আমার পরিবার দুজনে গিয়ে সব বলবো। আপনার বরং তাতে ভালো হবে।
উদাস স্বাতী। বেশ কিছুক্ষণ কোন শব্দ করে না। তারপর বলে, – আমার বাবা- মার কাছে যাওয়া মানেই মৃত্যুর মুখোমুখি যাওয়া। আমাকে নানা অপবাদ শুনতে হবে। নানা প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। অথচ সত্য জবাব আমার থেকে পেলেও তা ওরা মেনে নেবেন না। উল্টে আমাকে শত দোষে জর্জরিত করবেন। স্বামীর বাড়ি যতই অত্যাচারিত হই না কেন। বলবেন ধৈর্য ধরো, আস্তে- আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। দিনের পর দিন আমি স্বামীর কাছে মার খেয়েছি। স্বামীর চাহিদা মেটাতে ছুটে এসেছি বাবা-মার কাছে। সেখানেও তিরস্কার পেয়েছি। আবারও ঝর ঝরিয়ে কেঁদে ফেলে স্বাতী। আমার এই পৃথিবীতে কোথাও জায়গা নেই। তাই আমার বাঁচার অধিকার নেই। আমাকে মরতেই হবে। কেমন যেন হাঁপিয়ে ওঠে স্বাতী।
হতভম্ব আরশাদ। হতভম্ব রিজিয়া। এমন কঠিন পরিস্থিতি তারা জীবনে দেখেনি। এমন অবস্থায় কি করতে হবে, তেমন ভাবনা তাদের ভাবার অবকাশ মেনে নি কোনদিন। খাওয়া- পরা ছাড়া যারা কোন কিছু কোনদিন চাইতে শেখেনি। শখ, আহ্লাদ বলে কোন বস্তু নেই। সাজ-পোষাক, গহনা- মনের কোনে উঁকিও দেয়নি কখনো। পাল পার্বণে শুধু একটু সাফসুতরো এটাই অনেক। আসলে চাওয়াটা যাদের জীবনে নিতান্তই কম, পাওয়াটা তাদের হিসাবেই থাকে না। লোভ লালসার জন্মই হয় না তাদের মনের কোণে। আর তার থেকেই হিংসা বলে কোন কিছু ছুঁতে পারেনি এদের।
আরশাদ ভাবে, দিদিমণি কোথায় আত্মহত্যা করবে। রেলে জান দেবে। শেষে আমাকেই তো দোষী হতে হবে। আমি বাড়ি থেকে তাড়িয়েছি বলেই না মরতে হলো মেয়েটাকে। আবারো থানা পুলিশ। হাত-পা কেমন হিম হয়ে আসে তার ।বুকটা আবারো সেই অজানা আতঙ্কে দুরু দুরু করে ওঠে।
রিজিয়া ভাবে- এ কেমন মুসিবত দিলে গো আল্লাহ। যে মানুষটার জন্ম দিলে, এত বড় দুনিয়ায় তার একটু ঠাঁই হবে না। ভালো মানুষটার সংসার থেকেও নেই। বাল- বাচ্চা থেকেও নেই। স্বামীই যে মেয়েদের সুখ। সেই স্বামী এতো বদ মানুষ। মানুষটাকে একটু সুখ দিলে না। মেয়ে মানুষটার একটু খোঁজ নিল না। মেয়ে মানুষের জীবনের কোন দাম নেই ?
দীর্ঘ সময় মাথা নিচু করে বসেছিল স্বাতী। আরশাদ- রিজিয়া উভয়ই মর্মাহত। কি করনীয় বোঝে না কিছুই। দিদিমণির থেকে যাওয়াতে আপত্তি নেই। চলে যাওয়াতেও আপত্তি নেই। তবে চলে যাওয়া মানে যদি প্রাণ দেয়, তাহলে তো বিপদ তাদেরই। সকালের গুমোট আবহাওয়ায় ঝুপড়ি ঘরটায় তিনটে প্রাণীই ঘামতে থাকে। বাইরের কোলাহল বস্তিবাসীদের রোজনামতা শুরু হতে থাকে। বাইরের চাপা কলটার সামনে নারী পুরুষের জটলা। মুখ ধোয়া, জল নেওয়া, হাঁড়ি-বালতির ঠোকাঠুকির শব্দ। ব্যস্ত জীবন- জীবিকার মানুষগুলো একটু একটু করে ছড়িয়ে পড়বে দিক বিদিক। কর্মই যাদের জীবন। সেই অনির্দিষ্ট কর্মই তাদের রুজি। আর রুজির টানে বস্তির দরমা ঘেরা ঘরটাকে, একলা রেখে নারী পুরুষ বেরিয়ে পড়ে।
— আমি কাল সকালে চলে যাব। নিস্তব্ধতা ভাঙে স্বাতী।
আরশাদ বলল, কোথায় যাবেন তা বলুন দিদিমণি। আমি আপনারে দিয়ে আসবো।
— না, না। আপনাকে যেতে হবে না। এবার আমি একাই যাবো। আর আপনাদের কষ্ট দেবো না। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে স্বাতীর।
আরশাদ বলে, কষ্ট বলছেন কেন দিদিমণি।
রিজিয়া বলল, না গো দিদি, দিয়ে এলি পারে একটু নিশ্চিন্তি হবো আমরা। তুমি ঠিক ঠিক পৌঁছলে আমাদেরও ভালো লাগবে।
ম্লান হাসে স্বাতী। আমি আগেই বলেছি, কোথায় যাবো ঠিক জানি না। তবে আমাকে যেতেই হবে। এটুকুই বলছি।
আরশাদ অসহায় ভাবে বলে, – এভাবে বললে চলে না দিদিমণি। যদি কোন বিপদে পড়েন। আবার একটা ঝঞ্ঝাট হবে। থানা পুলিশ আমাদের বড় ডর লাগে গো। মুখ্যু মানুষ তো ।একবার নামটা পুলিশের খাতায় উঠেছে। বুঝলেন তো দিদিমণি। তারপর ভালো-মন্দ কিছু একটা হলেই- সেই বলে না, বাঘের ছুলে আঠারো ঘা।
স্বাতী বলে, ওভাবে ভাবছেন কেন ? আমার চলে যাওয়াটাই আপনাকে বিপদ মুক্ত করবে। নতুন কোন বিপদ আসবে না। এই সময় আমার থেকে বড় বিপদ আর কি? আমি আপনাদের কাছ থেকে সরে যাওয়া মানেই বিপদ সরে যাওয়া।
অথৈ জলে আরশাদ। বর্ণহীন ফ্যাকাশে মুখ রিজিয়ার। এ সমস্যা যে কি- এর সমাধানটাই বা কি, কূলকিনারা পায় না আনপড় এই দম্পতি। সাদামাটা তাদের জীবনে এমন জটিলতা কেন এলো। মানুষের উপকারের বিনিময়ে এতো পেরেশানি হতে হবে ভাবেনি তো তারা।
জয়নাল আবেদিন | Joynal Abedin
100 questions and answers about Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে প্রশ্ন ও উত্তর
Natun Bangla Kabita 2023 | নীলমাধব প্রামাণিক | Top New Poetry
Prem Sadhanar Nayika | প্রেম সাধনার নায়িকা : নানা আঙ্গিকে | New Article 2023
Shikhar Chera Jiban | শিকড় ছেঁড়া জীবন | New Article 2023
Sera Bangla Uponnash 2023 | Sera Bangla Uponnash in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Sera Bangla Uponnash book | New book – Sera Bangla Uponnash | Novel – Sera Bangla Uponnash | Pdf – Sera Bangla Uponnash | Shabdodweep – Sera Bangla Uponnash | Joynal Abedin – Sera Bangla Uponnash | Top Novel – Sera Bangla Uponnash | Sera Bangla Uponnash in English | Sera Bangla Uponnash in bengali | Sera Bangla Uponnash – Full | Sera Bangla Uponnash download