Sekaler Pishimonira – Krishna Kishore Middya
সেকালের পিসিমনিরা – কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা
রমেনবাবু কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান। প্রাক বৃদ্ধ বয়সে এসে বড়ো ছেলের সংসারের সদস্য। এবং শহর না হলেও আধা শহর অঞ্চলে আস্তানা। পুত্র এবং পুত্রবধূ উভয়েই যথাক্রমে সরকারি ও বেসরকারি অফিসের কর্মে নিযুক্ত। একমাত্র ছোট নাতনির দেখভালের জন্য, তারা মাথা খুঁড়ছে এক দক্ষ পরিচারিকার সন্ধান পেতে। কত বিজ্ঞাপন যে রোজ দেখে, সহকর্মী, আত্মীয় পরিজন আর পরিচিত সকলের কাছে অনুরোধ আছে একজন ভালো পরিচারিকার খোঁজ দেওয়ার জন্য। কিন্তু কোন বিদ্যে ফুরছে না। বছর চারেক বয়সের শিশুর জন্য ইতিমধ্যে জনা চারেক বাতিল হয়ে গেছে। আপাতত ঠাকুরদাদা রমেনের তত্বাবধানে দিন অতিবাহিত হচ্ছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। রমেনবাবুর স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকে। সেখানে ছোট ছেলের সংসার চলে ওই ভদ্র মহিলার হাড়ভাঙা পরিশ্রমে।
ছেলে বৌমা অফিসে বেরিয়ে গেলে, গুরু দায়িত্ব এসে পড়ে রমেনবাবুর ঘাড়ে। তার কী ছাই ছেলেমেয়ে ‘মানুষ’ করার অভিজ্ঞতা আছে! কিন্তু এখন সেই ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’, ঠাকুরদা। ছুটির দিনগুলোতে তবু একটু স্বস্তি। যুগলে অফিস চলে গেলে, স্কুলে নিয়ে যাওয়া – আনা, এবং …. বেশ মাথা ব্যথার বিষয়। তারপর ঘুম পাড়ানো, বড়ো জটিল ব্যাপার। এতো আর মাটির ঘরের বারান্দায় টাঙানো ‘দোলা’ নেই যে, বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ দোল দিলেই ঘুমিয়ে ‘কাদা’। এখন অনেক কায়দা কৌশল করে, মোবাইলে গেম দেখিয়ে নাতনির দুটো চোখ বুজে এলেই তবে ঠাকুরদার একটু স্বস্তি। এই রকম পরিস্থিতি যে কোনো কালে হবে, রমেনবাবু কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। মনে পড়ে তার, তারা পাঁচ ভাইবোন বাবা মা আর পিসিমার স্নেহে কীভাবে বড়ো হয়েছিল।
পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে বাবা মা প্রায় সারাদিন ব্যস্ত থাকে নানান কাজে। বলতে গেলে তাদের ভাইবোনদের বড়ো করেছে তাদের পিসিমা। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখে আসছে, কী অসম্ভব কৌশলে তাদের হাজার বায়না, অসুখ বিসুখ, স্কুল যাওয়ার ব্যবস্থা ইত্যাদি সামলাতো পাঁচু পিসিমা। বড়ো হয়ে সে জানতে পারে, পিসিমা হলেন তখনকার দিনের বাল্য বিধবা। স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর পর শ্বশুর বাড়ি থেকে চলে আসে চিরদিনের মত। বাবা মা সবাই স্নেহ প্রবণ, কোনো দিন পরের বাড়ির বউ বলে ভাবেনি। আপন সন্তানকে হৃদয় ভরা সহানুভূতি দিয়ে কাছে টেনে নেয়। কালক্রমে সেই পিসিমা হয়ে গেল তাদের সংসারের মূল চালিকাশক্তি। মা বাবাকে ছেড়ে, সব ভাইবোন হয়ে গেল পিসিমার ‘ন্যাওড়’।
পিসিমা তো কোনো দিন স্বামী, সংসার সন্তানের সুখ দুঃখ বুঝলো না, ভাগ্যের পরিহাসে! তার সেই মনোকষ্ট কোনো দিন কাউকে বুঝতে দেয়নি। ভাইপো ভাইঝিরা তার স্নেহের সন্তানসম। তাদের সুখ দুঃখ বেদনায় যেন এক গভীর টান অনুভব করে। বাড়িতে কারোর অসুখ হলে ভাবনার অন্ত থাকে না পিসিমার। ভেষজ লতাপাতা থেকে ওষুধ তৈরি, ডাক্তার কবিরাজের কাছে যাওয়া,রোগীর পরিচর্যা সব কিছুই একার দায়িত্বে। নাওয়া খাওয়া ভুলে রোগীর সেবা, যতদিন না সুস্থ হয়। রমেনের খুব মনে পড়ে, কোন ভাই বোনের জ্বর হলে, পিসিমা মাটির বারান্দায় মাদুর পেতে তার মাথার নিচে কলাপাতা রেখে মাথায় জল দিত ঘটি ভরে। প্রয়োজনে পুকুর থেকে বড়ো শাপলা তুলে, তা দিয়ে একরকম নল তৈরি করে মাথায় ধীরে ধীরে জল দেওয়া হত অনেকক্ষণ ধরে। আস্তে আস্তে দেহের তাপমাত্রা নামলেই পিসিমার শান্তি।
পাড়া পড়শিরা বলতো, – নিজের ছেলে মেয়ের অধিক যত্ন করছো, বয়সকালে দেখবে তো? – ওসব কথা ভাবলে কি চলে গো, সেটা তো কপাল! এই যে আমার অল্প বয়সে কেমন কপাল পুড়লো ! এক অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তি পিসিমার সারা দেহ মনে ছড়িয়ে যায়, কেউ বুঝতে পারে না। তখন হয়তো পিসিমা বলে কেউ ডেকে ওঠে, পাঁচুর সম্বিত ফেরে ।
ভাইয়ের স্ত্রী বাপের বাড়ি গেলে, পাঁচুই তখন সংসারের ‘হাল’ ধরে। রান্না থেকে সংসারের সমস্ত কাজে পিসিমা দারুণ পটু। এমনকি মাঠে চাষের সময় ভাইকে সাহায্য করে। আর পিসিমার হাতের রান্না সকলের খুব প্রিয়। ভাইয়ের স্ত্রী ও ভাই তাকে খুব শ্রদ্ধা ও ভক্তি করে। ভাইয়ের স্ত্রী জানে ননদ ছাড়া এই সংসার সামলানো কী কঠিন! ছোটরা ধরতো পিসিকে, গঙ্গা স্নানের মেলা, যাত্রা পুতুল নাচের আসরে নিয়ে যেতে। পিসিমার সে বায়না উপেক্ষা করার উপায় কী!
তখন শীতের কী দাঁত ফোটানো রূপ। সন্ধ্যা সকালে সকলের মাথা ঢেকে চাদর পরিয়ে গলায় বেঁধে দিত চাদরের দুই কোণা। সহজে খুলতো না চাদর শীতের দিনে। গঙ্গাসাগর মেলা থেকে সবার জন্য চাদর কিনে আনতো। ওই চাদর কে বলা হত ‘সাগুরে চাদর’। বেশ দেখতে এবং টেকসই। পিসিমা সব কাজ সামলে হাঁস মুরগি পোষে। আর ডিম বিক্রির পয়সায় সকলের বায়না মেটায়। মেলায় খালি হাতে তো যাওয়া যায় না, পয়সা লাগে তো।
মেলায় পিসির সঙ্গে হেঁটে হেঁটে চলে ভাইপো ভাইঝির দল। পিঠোপিঠি ভাই-বোন সব। কত দিন পর বাড়ির ঘেরাটোপ থেকে বের হয়েছে সব। কী প্রাণখোলা আনন্দ সবার। কত মানুষ আর ছোটরা চলেছে মেলায়। পথের দুপাশে ওদের অপু চোখের চাহনি। হাজার প্রশ্নে জেরবার। ঠাণ্ডা মাথায় সুন্দর করে প্রশ্নের উত্তর দেয়।
পথের দু পাশের চিত্রমালা ওদের এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছে যেন। মেলায় পৌঁছে চিত্রপট পাল্টায়। কী কিনবে, দিশেহারা সব। ভিড়ে ঠাসা মেলায় হারিয়ে যাওয়ার ভয়, শিশু মনে। মেলার নানা ধরনের খেলনা, খাবার, রকমারি জিনিসের বিকিকিনি, সব কিছু মিলে এক প্রবল উত্তেজনা, সবার দেহ মনে। ….. পিসিমার নিপুণ অভিভাবকত্বে সব কিছু পছন্দের খাওয়া আর পাওয়া হয়ে গেলে বেলা ফুরিয়ে আসে। ঘরে ফেরার পালা। দীর্ঘ পথের ক্লান্তি ওদের কষ্ট দেয় না কোনো, ফেরার আনন্দে। পিসিমার সঙ্গে পুতুল নাচের আসরে যাওয়ার দিনগুলো কত যে স্বপ্নের মত ছিল, ভাবলে অবাক হওয়ার কথা।
সেকালের পিসিমনি, ঠাকুরদাদা, ঠাকুরমা, জেঠিমা, কাকীমাদের স্নেহ জড়ানো ভূমিকা ভিত্তি করে যারা যৌবন পার করে সমাজের বিভিন্ন স্রোতে মিশে গেল, তাদের মানসিকতায় একটা সংবেদনশীলতা ছিল। সহজ, সাবলীল, ভাবনাহীন শিশু থেকে কৈশোর এবং পরবর্তী জীবন, আর এই চরিত্র গঠনের কারিগর যারা, সেই সব মানুষের কথা আজ যেন কোনো বিষয় নয়। রমেনবাবুর ভাবনার ডালপালা বর্তমানের হাওয়া লেগে দোল খায়। আজকের শিশুরা বন্ধুহীন পরিবারের ছোটো খাঁচায় বন্দী। বাবা মায়ের নিরবচ্ছিন্ন ভালোবাসা পায় না, আদর নেই, যখন প্রয়োজন। রক্তের সম্পর্কহীন পরিচারিকার কাছে দিনের বেশি সময় কাটে। স্নেহ হীন এক যান্ত্রিকতায় কাটে শৈশব থেকে কৈশোর । বাবা মায়ের পরিপূরক পিসিমা আজ আর নেই। সম্পর্কের আর স্নেহ আদরের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে শিশুরা মুক্ত জীবনের স্বাদ পেত এককালে সে আর নেই।
শুধু স্বামী হারা বিধবা পিসিমা নয়, বিয়ে হওয়ার আগে পর্যন্ত বাড়ির মেয়ে অর্থাৎ ছোটদের পিসিমার ভূমিকাও কয়েক দশক আগে পর্যন্ত ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভাইপো ভাইঝিদের জন্য তারা অনেকটা সময় দিত, যা শিশু মনের পক্ষে পরবর্তীতে ফল দায়ক হয়েছে। ক্রমশ মানব মনের মানসিকতা বদল ও সময়ের বদল বৃত্তান্ত, দুইয়ের ফাঁকে পিসি – মনিরা হারিয়ে গেল। নিজেদের সব কিছু বিসর্জন দিয়ে যারা বাপের বা ভায়ের ঘরে ভরে দিয়েছিল করুণা ধারায়, তাদের কথা আজ বিস্মৃত বিষয়। শিশু মনের অলি গলিতে ছিল তাদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। আর সকলের অজান্তে শিশু মনের পরিচর্যায় তা ছিল ক্রিয়াশীল।
রমেনবাবু নাতনিকে ঘুম পাড়িয়ে, জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করেও পারলেন না। হঠাৎ ‘দাদা, দাদা’ চিৎকারে জেগে দেখেন প্রিয় নাতনি তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে। অসহায় এক শিশুকে দেখে, রমেনবাবুর চোখে জল এসে গেল।
কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya
Teachers day in honor of teachers | শিক্ষকদের সম্মানে শিক্ষক দিবস
Tebhaga Movement | বাংলায় “তেভাগা আন্দোলন” এবং সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গী
Traditional Seth Family Durga Puja | চন্দননগরের ঐতিহ্যবাহী হরিহর শেঠ পরিবারের দুর্গাপূজা
English Literature | The Relationship between Literature and Society | Literature and Society | What is the relationship between literature and society? | Sekaler Pishimonira – Journal | The Relationship of Literature and Society | Sekaler Pishimonira pdf | relationship between literature and society pdf | relationship between literature and society essay | Sekaler Pishimonira notes | literature and society notes | literature and society summary | society and literature subject | literature and society definition | Sekaler Pishimonira – Video
Essay – Sekaler Pishimonira | Society Lover | Literature Lover | Sekaler Pishimonira – images | Literature and Society: A Reflection | (PDF) Literature and Society | literature is the mirror of society | Bengali Essay – Sekaler Pishimonira | Short Article | Best Article | Bengali Article | Definite Article | Article Submission | Trending Article – Sekaler Pishimonira | New Subject Article | Article Collection | Article Writer | Creative Writer | Sekaler Pishimonira in English