Salt Water | নোনা জল – জয়নাল আবেদিন | 2023

Sharing Is Caring:
Salt Water

নোনা জল | Salt Water – জয়নাল আবেদিন [পর্ব ১]

নৈনান খেয়া ঘাটে তখনও নৌকাটা বাঁধা আছে, যাত্রীরা অপেক্ষায় পাড়ে বসে। দেখলে বোঝা যায় না এটা খেয়াঘাট। একটু পাশেই মাছধরা ট্রলার খানা জাল গোছানো থেকে অন্যান্য গোছগাছ চালাচ্ছে। এখন নদীতে জোয়ার শেষ হয়েছে ভাঁটার অপেক্ষায় জহর মালোর দলবল।
চোদ্দো জনের দল নিয়ে রওনা হচ্ছে সমুদ্রে মাছ ধরতে। পাড়ে বসে মেয়ে বউ-বাচ্চা ক’জনা। ঠায় নৌকায় নজর তাদের, যেকোনো মুহূর্তে ছেড়ে যাবে মাঝ দরিয়ার দিকে। কবে ফিরবে কেউ জানে না।
শেষ শীতের এই সময়টা সমুদ্র খুব একটা উত্তাল হয় না। ঝড়ঝঞ্ঝা থাকে না প্রায়ই। কিন্তু এবছর মৌসুম বড় বেগতিক। মাঝেমধ্যেই ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে। সরকারি সর্তকতা মানতে সমুদ্র থেকে ট্রলার নিয়ে চলে আসতে হচ্ছে। কখনো বা যাওয়া স্থগিত করে দিতে হচ্ছে।
কিছুদিন আগেই আম্ফান ঝড়ে বেসামাল তামাম এলাকা। ক্ষয়ক্ষতি সেরে উঠতে এখনো মাথা তোলেনি কত ঘরবাড়ি।

ঘাটের পাশে ছোট্টো দোকান ঘরে চা- পানের দোকান মহিলার, বাড়ির লোকটা সমুদ্রে পাড়ি দেবে- চোখটা পাতা আছে তাই মাছ ধরার নৌকায়।
— আমাদের জীবন তো পদ্মপাতায় জলের মতোই বাবু। ঝড় বদলায় নদী পাগল হয়। পার উপচে জল , সব পাড়ের বাড়িঘর তছনছ করে দেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ে মহিলার।
— ভয় করে না , এখানে বাস করতে ?
— ভয় কে জয় করেই তো বেঁচে আছি গো। এইতো পুরুষ মানুষটা চলে যাচ্ছে। ফিরবে কিনা ঠাকুর জানে। মাসের পর মাস কেটে যায় তারপরে ফেরে। কখনো মাছ বোঝাই তো কখনো অর্ধেক খালি। পেটের তাগিদে জীবন নিয়ে খেলা।
ভাঁটা শুরু হয়েছে সবে। হালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে বিমল, অভিজ্ঞ হাত। কোন পথে কেমন ঢেউ কাটিয়ে যেতে হয়, নখদর্পণে গভীর জলের হাল-হকিকত। ইঞ্জিন মোটর চালু করার জন্য দাঁড়িয়ে হারুনের বড় ছেলে বাদল।
ট্রলারে একটু গুঞ্জন, যেটা যাত্রা শুরুর আগে হয়। কেমন একটা তৎপরতা সকলের মধ্যেই।

চেঁচিয়ে উঠলো জহর মালো – দরিয়ার পাঁচ পীর, বদর বদর কোরাসে সকলে বলে উঠলো।
ইঞ্জিন চলার শব্দ শোনা গেল, সচকিত পাড়ে বসা আপন চোখগুলো। ট্রলার পাড় ছেড়ে এগিয়ে চলল দক্ষিণে। ছলাৎ – ছলাৎ শব্দ ট্রলারের গায়ে আছড়ে পড়তে দেখা- চোখগুলো টলটলে জলে ভরে যায় । কারো চোখের বাঁধ উপচে ফোঁটা হয়ে ঝড়ে পড়ে।
মানুষগুলোর জীবনের বেশি সময়টাই নোনা জলের (Salt Water) ঘ্রাণে ধাতস্থ। জলের মাঝেই দিন-রাত।

জলের মাঝেই প্রাণপাত। জাল ফেলা। সময় বুঝে জাল তোলা। মাছ বেছে আলাদা করা। বরফ প্যাকিং করা। ক্রমানুসারে চলতে থাকে কাজ। প্রথম প্রথম যাওয়া মানুষগুলো নোনা জল, নোনা বাতাস সহ্য করতে পারত না। ধাতস্থ হতে গিয়ে বমি পায়খানা শরীরকে নিংড়ে নিতো। কতজনকে আবার ফিরতি কোন ট্রলারে বাড়ি ফিরে আসতেও হতো। যারা কষ্ট সহ্য করতে করতে ধাতস্থ হয়, তারা ভয় কে জয় করে নেয়। ধু ধু জলরাশি কোন কূল কিনারা নেই। দিনের আলোয় দুর কে দেখা যায়। আরো কতো কতো ট্রলার ভাসছে। জাহাজ যাচ্ছে দূর দিয়ে। রাতের অন্ধকার। নিকষ কালো। চড়াই – উতরাই ঢেউ কাটায় ট্রলার খানা। জালখানা ফেলতে ফেলতে এগিয়ে যাওয়া। ট্রলারে বেঁধে রাখা জালের রশি। প্রতি ঘন্টায় রশিতে হাত ছুঁয়ে পরখ করা। এ কাজটা জহর মালো বেশি বুঝতো, তাই তাকেই বেশি নজর রাখতে হতো। মাঝরাতের পর পর যাচাই করে ভোররাতে জাল গোটানো হতো। দিন দুই পরপর কপাল খারাপ গেলো। তেমন মাছ উঠলো না। জাল গুছিয়ে ট্রলার আরো একটু গভীরে গেলো। দুপুরের পর আবার জাল ফেলা হলো। খাওয়া-দাওয়া সেরে পাটায় বসে জলের দিকে নজর রাখছিলো জহর মালো।

— কি বুঝছো গো কাকা ? মজবুত হাতে হাল ধরা বিমল চেঁচালো।
— আজ একটু ভালো যাবে- মনে হচ্ছে। হাওয়ার দাপটে কথা গুলো ভেসে গেল। বিমলের কানে কোন শব্দ পৌঁছালো কিনা কে জানে। তবে মুখ নাড়া ভঙ্গিতে বুঝে গেছে কাকার বলা কথা।
— ঠাকুর যেন মুখ তুলে তাকায় গো কাকা। নোনা বাতাসে ভেসে গেল একটা দীর্ঘশ্বাস বিমলের।
— সবইতো তারই ইচ্ছে রে বাপ । আজ কিছু রুপো পাবো মনে হচ্ছে। মনে মনে বিড়বিড় করে জহর মালো।

নোনা জল | Salt Water – জয়নাল আবেদিন [পর্ব ২]

দিন দুই হয়ে গেলো বিমলের ছোট মেয়েটার জ্বর কমছে না। বেশ উদ্বেগের মধ্যে দিন কাটছে বিমলের স্ত্রী ঝুমার। ঘরে তেমন টাকা পয়সা নেই। স্বামী বাড়ি নেই। আশা কর্মীর দিদিটা আজ সকালে কথা ট্যাবলেট দিয়ে গেছে। ভরসা দিয়ে গেছে জ্বর কমে যাবে। বেলার দিকে শম্ভুনাথের আড়তে টাকার জন্য গিয়েছিল ঝুমা।

— আরে বাবা, কাজে বেরোনোর আগে সকলকে আগাম টাকা দিয়েছি তো। আর এখন দেবো কোথা থেকে। টাকা কড়ি বড়ো মন্দা। বড় বেজার শম্ভুনাথ টাকার কথায়।
— ছোট মেয়েটার খুব জ্বর কদিন। অসহায় গলাতে মিনতি ঝুমার।
— আরে ! জ্বর হয়েছে তো ঘরে বসে থাকলে হবে? হাসপাতালে যাও। বিনে পয়সায় ওষুধ দেয় তো। যাও গে দেখাও। কর্কশ শম্ভুনাথের গলা।
— কিছু টাকা দিলে ভালো হতো গো বাবু। করুন সুর ঝুমার।
— বলে দিয়েছি তো, এখন টাকা পয়সা হবে না। ট্রলার ফিরুক তারপর দেখা যাবে। এখন যাও ব্যস্ত আছি। বিড়বিড় করে শম্ভুনাথ।

খালি হাতে ফিরে আসতে হয় ঝুমাকে। নিয়তি বড় নিষ্ঠুর। অসহায়ের সহায় সহজে জোটে না। চাষির দোরে চাষা তেমন খেটে মরে। ফসল তুলে দিতে হয় চাষির গোলায়। কোনরকমে পেটের খোরাক টুকু জোটে। পাল- পার্বণ, অসুখ-বিসুখ ভগবানের দয়াতে কাটে। মালিকের দরজায় হাত পাততে হয়। কখনো জোটে কখনো জোটে না। গাঙ পাড়ের জেলে বস্তির পরিবারগুলো একই কাঁটায় গাঁথা। মাসের-পর-মাস ট্রলারে বাস।জাল- মাছ, কূলকিনারাহীন জলে হাতের মুঠোয় জীবন নিয়ে, মালিকের আড়ত ভরো। খোরাকির টাকা নাও। বাড়ির মানুষ গুলো বেঁচে থাক। মাছের ঠিকমতো দাম না থাকায়- হিসেবের দিনগুলোয় পাওনার অঙ্কে চোখের নোনা জলে (Salt Water) গামছার খুঁট ভেজাও।

— এবারে তো মরসুম ভালো গো বাবু। গেলোবারের থেকে অনেক অনেক বেশী তুলেছি আমরা। মাঝে তো দুবার ডেলিভারি দিছি। সঙ্গে তো কম এলো না !
— বলি , সোনা – রূপো পেলি কটা ? শুধু তো লোহা রে। ওতে কি আর টাকা আসে ?
মুখগুলো সব চুপসে যায়। বেশি জোর যার করলে ট্রলার ছুঁতেই দেবে না আর। পরিবারগুলো শুকিয়ে মরবে। অন্য কোন কাজ নেই।

শম্ভুনাথ মানুষটা বড় একরোখা। মুখের কথা বেরিয়ে গেলে আর ফেরত আসবে না। সঙ্গে দুই মুন্সি একেবারে হাড় বজ্জাত। হিসেবের দাঁড়িপাল্লা সামনে ঝুঁকে থাকবে তো পেছনে ঝুঁকবে না। টাকার যোগ-বিয়োগে ভুল করে কম হয়ে যাবে, বেশি কোনদিন হয়না। বড় ডাগর- ডাগর কথা বলে। কথায় বলে- বাবুর থেকে তো পেয়াদার দাম বেশি। চুপচাপ মেনে নিতে হয়।

দিন যায়। রাত যায়। পৃথিবীর কত পরিবর্তন হয়। প্রকৃতির কত পরিবর্তন হয়। শুধু পরিবর্তন নেই এই জেলে বস্তির। পাল্টায়নি তাদের জীবনযাত্রা পাল্টায়নি। তাদের পারিবারিক ছন্দ। নদীই তাদের রুটি-রুজির প্রধান ভরসা। নৌকা ও ট্রলার তাদের আয়ের বাহন। ভুটভুটিতে মানুষ জন পারাপার করা। সদর থেকে মাল বোঝাই করে ঘাটে ঘাটে পৌঁছে দেওয়া ।‌ দখিন বাদা থেকে খড় বোঝাই করে শহরমুখী ঘাটে পৌঁছে দেওয়া। জীবনের গতি প্রকৃতি এভাবেই চলমান থাকে।

নৌকো ছেড়ে কিছু মানুষ আজকাল ইটের ভাঁটিতে মজুরের কাজে লেগেছে। পরিশ্রম অনেক বেশি। কেউ কেউ হাঁপিয়ে ওঠে, ভীষণ কষ্ট হয়। মজা করে সেদিন ভাঁটির ম্যানেজার বাবু বলেছিলো, – তোমরা আসলে জলের কুমির গো- ডাঙ্গায় বাস করতে কষ্ট হবে তাই। দেখো কিছুদিন বাস করে, না হলে আবার জলে নেমে যাবে।

নোনা জল | Salt Water – জয়নাল আবেদিন [পর্ব ৩]

দেখতে দেখতে দুটো মাস কেটে গেলো। একবার ডেলিভারি হয়েছে ডায়মণ্ডে। প্রথম প্রথম বড্ড খরা গেছে। দিন সাতেক বলতে গেলে ছিপ ফেলে বসে থাকার মতোই অবস্থা হয়েছিলো। আস্তে আস্তে ট্রলার এগোয় গহীনে‌। নিজেদের জীবন বিপন্ন হলেও, বাকি জীবন গুলোর জন্য এগোতেই হবে। এই দুরূহ সীমানায় খুব বেশি ট্রলার আসে না। ঝুঁকিপূর্ণ বলে এড়িয়ে চলে অন্যেরা। জলের ঘনত্ব বেশি বলে, উথাল- পাথাল ঢেউ বড় কঠোর‌। হাল কাটাতে পাঁজর ব্যথা হয়ে যায়। দুজন লাগে হাল মজবুত রাখতে। বিমল একা সেঁটে ওঠেনা, সাহায্য করে লালন। বড় মজার মানুষ এই লালন। হাল-দাঁড়ে হাত দিলেই মুখে গান চলে আসে, সোঁদা মাটি- নোনা জলের (Salt Water) গান। ভাটিয়ালি সুর ঢেউয়ের পরোতে পরোতে ভেসে যায়- দূর থেকে দূরান্তরে। কূলকিনারাহীন সাগরে মাছের মতই জল ছুঁয়ে ছুটে বেড়ায় সেই সুর।

গতকাল বেশ কিছু রুপো উঠেছে। ওজন দার জাল হয়েছে। জহরের মনটা আজ বেশ উৎফুল্ল খুশি দলের সকলেই। একটা নিম্নচাপের আবহাওয়া হতে গিয়েও কেটে গেছে। এই সময়টা জাল ফেলে রাখা একটা আশঙ্কা থেকে যায়। ঢেউয়ের প্রকোপে জালের টানায় ট্রলার ডুবে যাওয়ার ভয় থাকে। জাল গুটানো ছিলো, নামানো হয়নি। সকাল থেকে আকাশ বেশ পরিষ্কার। জাল গোছ- গাছ করে ফেলা শুরু হয়েছে। একটু পরেই জোয়ার শুরু হবে, ফুলে ওঠা জলে মাছ ঢুকবে জালে তাই- সতর্ক জহর মালো। তৎপর সাথী সঙ্গীরা জোয়ার শেষ হলেই জাল তুলতে হবে।

ভরা কোটাল। জল ক্রমশ ফুলতে থাকছে। মরুভূমি কোনদিন দেখেনি জহর, তবে গল্প শুনেছে মানুষের কাছে। যতদূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি, উটের পিঠে চড়ে যেতে হয় ক্রোশ ক্রোশ রাস্তা। কূলকিনারাহীন এ পথ- কোথায় শেষ তা বলা যায় না। আজ ট্রলারে বসে জহর তাকায় দূরপানে-দৃষ্টি শক্তির বাইরে কতটা জলপথ আরও রয়েছে জানেনা সে। এমন জায়গায় বিপদ মানে পৃথিবীর কেউ জানবে না। খোঁজ পাবে না। দেশের সীমানা বোঝা দায়। কিছু দূরে কয়েকটা ট্রলার পরপর ভাসছে। মাথায় বাঁধা খুঁটিতে দেশের পতাকা। দেশের সীমানা, জলপথের সীমানা, রাজনীতির রূপরেখা-কে মন্ত্রী , কে সান্ত্রী- জিনিসপত্রের দাম কেন বাড়ছে, কিছুই জানে না বোঝে না জহর মালোরা। খাটলে খাবার জুটবে, না খাটলে খাবার জুটবে না, অনাহারে থাকতে হবে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে- এটাই বুঝে তামাম মানুষগুলো। আর তাই দিনের-পর-দিন মাসের-পর-মাস ঝড় বাদলা মাথায় নিয়েও মাঝ দরিয়ায় জীবন কাটে। প্রাণের ঝুঁকি থাকলেও বার -বার ফিরে যেতেই হয় অগাধ জলে। জলের অপর নাম জীবন, জহরদের কাছে তাই-তবে এ জীবনের বিশ্লেষণ টা একেবারেই আলাদা।

পরপর কটা দিন জালে মাছ উঠছে। বেশ খুশির ব্যস্ততা “মা মনশা” ট্রলারে, আঠাশটা হাত সদা ব্যস্ত থাকলেও কোনো ক্লান্তি নেই কারো শরীর- মনে। রশি টেনে জাল তোলা, মাছ বাছাই করে প্লাস্টিক কার্টুনে বরফ মেরে রাখা। খোলের মধ্যে আলাদা আলাদা করে রাখা অনেক কাজ। জাল ছেড়ে সাফ সাফাই করে, ছেঁড়াফাটা সঙ্গে সঙ্গে মেরামতি করে আবার নামানো। সময় টা কেমন যুদ্ধকালীন তৎপরতায়। নতুন করে জাল নামিয়ে কিছুটা সময় বিশ্রাম। রান্না, স্নান-খাওয়া মিটে যায় এই অবসরে। আজ আরও একটা ডেলিভারি হলো ডায়মন্ড হারবারের আড়তে। শম্ভুনাথের মুখটা বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে আজ। বেশ ব্যস্ততার মাঝেও জহর দের খাবার জল, চাল- ডাল ,আলু -সবজি ট্রলারের ডিজেল তুলে দিতে তৎপরতা দেখালো। কয়েক ঘণ্টার জন্য জমি ছুঁয়ে আবারও অতল জলের আহ্বানে জহররা পাড়ি দিলো নোনা জলের (Salt Water) স্বাদ নিতে। আবারো জাল ফেলা- জাল তোলা। ঝাড়াই- বাছাই। কার্টুন – বরফ।

জীবন তুমি মরুভূমির শুষ্ক বালি – জীবন তুমি মরুদ্যান। জীবন তুমি খরা ক্লান্ত চৌচির ভূমি- জীবন তুমি বৃষ্টিস্নাত বনভূমি। জীবন তুমি জোয়ার- জীবন তুমি ভাঁটা। জীবন তুমি খরস্রোতা নদী- জীবন তুমি নোনা জলের (Salt Water) সমুদ্র।

দুপুরের পরে জাল পড়েছে জলে। আপাতত আড্ডার মত বসে সকলে। কেউবা শুয়ে। হাঁক পাড়লো বিমল হালের হাতলে হাত রেখে।

— কাকা, এবার একটু ভালো দান পাবো তো ?
— ভগবান জানে, ভাবি এক আর হয় আরেক। হিসেবের দিন বোঝা যাবে। জহরের জবাব।
— এবার কিন্তু দামি মাল ভালই উঠেছে কাকা, বলো ? চেঁচিয়ে উঠলো লালন।
— আমাদের দামি মাল গুলোই – মালিকেরা কম দামে বিক্রি করে, ওরা কখনোই বেশি দাম পায় না রে। ম্লান হাসিতে স্বগতোক্তি জহর মালোর।
আমরা যদি সঠিক দাম পেতাম – তাহলে আমাদের এমন দুরবস্থা থাকতো। কপাল দোষে জেলে ঘরে জন্মে ছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জহর মালো।
— এবার একটু চাপ দিতে হবে- সব কথা মেনে নিলে হবে না। চেঁচায় লালন।
হাত তুলে লালনকে আশ্বস্ত করে জহর।

নোনা জল | Salt Water – জয়নাল আবেদিন [শেষ পর্ব]

ট্রলার ঘাটে ভিড়েছে রাত দুটোয়। আড়তে মাছ নামিয়ে, সবকিছু গোছগাছ করতে করতেই বেলা উঠে এলো। কাল হিসাব-মালিকের কথায় যে যার বাড়ি ফেরে আগে- পিছে। পরদিন সকাল- সকাল আড়তে আসে জহর মালো তার দলবল। অফিস ঘরের বাইরের দালানে বসে সকলে। হিসেব চলছে কত মাছ এসেছে, কত দামে বিক্রি হয়েছে। মালিক- ট্রলার- জাল- ডিজেল -খাবার। হিসেব মতো আয়ের ষাট শতাংশ বাদে চল্লিশ শতাংশের আয় জহর মালো আর তার দলের লোকেরা পাবে। অফিস ঘরে হিসেব চলছে, কে কত টাকা আয় করলো। অগ্রিম নেওয়া টাকা বাদ দিলে এখন হাতে কত টাকা পাবে। বাইরের দালানে বসে অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর মনের ভিতর মেঘ জমছে আস্তে আস্তে। এবার যদি হিসেব ভালো না হয়- আর ট্রলারে উঠবে না জীবনে। অন্য কাজ দেখে নেবে। শুকনো মুখগুলো মাঝেমধ্যে দরজায় উঁকি দিয়ে আর কত বাকি হিসেব শেষ হতে জরিপ করে। কেউ কেউ উদাস মনে বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ে। একসময় জহর মালোর ডাক পড়ে অফিস ঘরে।

— তোমাদের প্রত্যেকের নামে আলাদা- আলাদা করে হিসেব কষে দেওয়া আছে। যে যেমন কাজের হিসেবে পাওনা দেওয়া, একটু দেখে নাও। মুন্সির কাছ থেকে টাকা কড়ি নিয়ে যাও। শম্ভুনাথ দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বললে জহরকে। পাওনার চেহারা দেখে প্রথমে গর্জে উঠলো লালন।
— জীবন বাজী রেখে খাটবো আমরা, পাওনা শেষে মুঠো খালি। দুশো টাকা ও রোজ হয় না। কি লাভ আমাদের এতো খেটে ?

বিমলও কিছুটা বিরক্ত। মেয়ের শরীর খারাপে বউ টাকা চাইলে খালি হাতে ফিরিয়ে ছিলো মালিক‌। কোন দাম নেই আমাদের গতরের। খেটে খেতে পাবো না আমরা। এবারে কত দামি মাল উঠলো। পাওনার খাতা সেই একই। প্রকারান্তরে জহরকেই চেঁচামেচি শুনতে হলো। আর কোনদিন ডাকবে না আমাদের। চিৎকার-চেঁচামেচি। চোখের নোনা জলে (Salt Water) ঠোঁট ভিজলে অনেকের। শম্ভুনাথ শান্ত করলো সকলকে। সেই একমাত্র বোঝে জেলেদের নাড়ির স্পন্দন। কখন, কোথায় – কেমন অবস্থায় জল ঢালতে হয় ‌ এভাবেই চলছে জেলেদের জীবন। এমনটাই চালাচ্ছে শম্ভুনাথের মতো আড়তদারেরা। ট্রলার মালিকেরা।

— ওরা রুপোলি ইলিশের মতোই, নোনা জল (Salt Water) ছাড়া ওদের জীবন বাঁচবে না।

জয়নাল আবেদিন | Joynal Abedin

New Bengali Story 2023 | আশার আলো | সুভাষ নারায়ন বসু

New Bengali Story 2023 | তুতানের পৃথিবী | গল্পগুচ্ছ

New Bengali Novel 2023 | খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৯) | উপন্যাস

New Bengali Story 2023 | করিমের একদিন | তালাল উদ্দিন

Salt Water Mixture | Salt Water Benefits | Salt Water Story | Salt Water Bengali pdf | Salt Water formula | Salt Water examples | Shabdodweep Web Magazine | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment