Read Online Story Books – Shawkat Noor
মাঝরাত – শওকত নূর [Maajh Raat]
আজকাল প্রায় রাতেই এমনটি ঘটে। লাঠি ঠুকে নবারুণ যখন আসে, তখন কর্তার কুটিরের বাতি নিভে যায়। শীতরাত হলে কর্তার নাক ডাকার শব্দ একটু দূর থেকেও নবারুণের কানে ওঠে। কর্তার বয়স ঢের হয়েছে। শরীর আজকাল আর ভালো যায় না। বাইরে চলাচল প্রায় না থাকার পর্যায়ে। বলতে গেলে প্রায় গোটা দিন ঘরের দাওয়ায় বসে আকাশের দিকে চেয়ে কী শুধু ভাবেন। দিনের বেলা নবারুণের সময় হয় না। সে দূর দূরান্তে ভিক্ষায় যায়। ফিরতে প্রায়ই এমন রাত ঘনায়। রাত হলেও কর্তার দর্শন না নিয়ে নিজ ঘরে ফিরতে তার মন টানে না। সে ভাবে, কর্তাকে অন্তত দুটো প্রশ্ন ছুঁড়ে তার উত্তর নিয়ে ঘরে ফিরলেও বুঝি তার মন পরিপূর্ণ হবে, দিন সার্থক হবে, জীবনের যাবতীয় ব্যর্থতার গ্লানি যেন গুটিয়ে যাবে।
শীতরাতে কর্তার কুটিরের বাইরে দাঁড়িয়ে অন্তত কর্তার নাক ডাকার শব্দ শুনতেও তার মন্দ লাগে না। ব্যর্থতার, একাকীত্বের গ্লানি এতে কিছুটা হলেও যেন লাঘবে যায়। আর কুয়াশাচ্ছন্ন হিমেল রাতে খানিকটা দূর থেকেও যদি সে কুয়াশা ভেদে কর্তার ঘরের ক্ষীণ আলোর উপস্থিতি টের পেলো তো কী হেতু তার মন পূজার আরতি দেখার মতোই বিষণ্ণতা কাটিয়ে নেচে ওঠে। এগিয়ে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে সে।
সে রাতে কর্তা বাইরে তার উপস্থিতি টের পেয়ে গতানুগতিকের মতো ভেতর থেকে গলা খাঁকড়ান। অভয় পেয়ে মুখ খোলে সে, কর্তা, সালাম।
— সালাম, আয় নবারুণ, ভিতরে আয়।
— কর্তা, এতো রাইত, আপনের ঘুম ধরে নাই?
— না, জানোসইতো মাঝেমধ্যে আজকাল ঘুমে বড় দেরি হয়। তা কই যাস ভিক্ষায়? আজকাল ফিরতে এত বিলম্ব হয়?
— কর্তা, ওই ইস্টিশানের পরের চাড়ান গাঁও; বড় বড় যত মাথা মুণ্ডুর বাস। খাঁটি ভদ্রলোক বিনে কোন বাসিন্দা নাই। কেউ পাঁচ টেকার নিচে ভিক্ষা দেয় না। দশ বিশ পঞ্চাশ একশ টেকা পর্যন্তও হাসিমুখে ছাইড়া দেয়। কয়দিন ধইরা সেইহানেই যাই।
— তাইলে তো তর আর অভাব থাকব না, শীঘ্রই বড়লোক হবি তুই।
— কর্তা, কী যে কন!
— তা এইবার আসল কথা বইলা ফেল। পুরান কথা যেন আর না হয়।
— কর্তা, নতুন আর কী কথা বলব? কথাতো ওই একটাই।
— হু-ম, কবে এমন পৃথিবী আসব, যেইখানে সব মানুষ সমান থাকব, ধনী গরিব থাকব না, মানুষ মানুষের ক্ষতি করব না, সবাই সম্মান লইয়া থাকব, নাকি ভুল বললাম?
— না কর্তা, ঠিকই বলছেন। কথা সেইগুলানই।
— কিন্তু সেই পৃথিবী কি আর বাস্তবে হয়? মানুষ সারাজীবন সেইরকম পৃথিবীর স্বপ্নই শুধু দেখে। এই যে দেখতে দেখতে এখন বিছানায় পইড়া গেছি। এরপর কবরে যাব, সেইতো শেষ।
— কর্তা ক্যান এমন হয়? স্বপ্ন স্বপ্নই থাইকা যায় খালি?
— সেই কথা খোদারে জিগা, তুই তর ভগবানরে জিগা।
— কর্তা, ভগবানরে কতই তো জিগাই, কত কিছু জিগাই। ভগবান নিশ্চুপ। রা চা কিচ্ছু করে না। মাঝেমাঝে বড় রাগ হয়। ইচ্ছা হয়, পাও ধইরা জোরছে টানতে থাকি। কিন্তুক সাহসে কুলায় না। যদি হঠাৎ অন্যরকমের কিছু ঘইটা যায়, ভোরবেলা মন্দির পরিদর্শনে গিয়াই রামচরণ কাহা চিৎকার দিব, রাম রাম ধ্বনিতে কইব – কে করল এমন মহা সর্বনাশ? কোন কুলাঙ্গার রাইক্ষস ভাঙল আমার মন্দিরঘরের মূর্তি? কোন হারামজাদা বদমায়েশের এত বড় সাহস? দুনিয়াত এত লোক থাকতে একবাক্যে সন্দেহ গড়াব এই নবারুণ ভিক্ষুকের উপর। শেষে এই ভিক্ষার ঝুলিটাও কাইড়া লইব। দশ দিগন্তে আমারে নিষিদ্ধ কইরা দিব। তহন না খাইয়া মরণ লাগব। কর্তা, ও কর্তা, ঘুমাইলেন?
— না, বইলা যা। তবে এখন অন্য কথায় যা। আর শুন, এইসব কথা ভুলেও মানুষ সমাজে মুখে নিস না। তদের ধর্মমতে এইসব পাপও গণ্য হইতে পারে। সব মানুষ তো তরে চিনে জানে না। অনেকে বুঝব না, তর ভগবানের উপর তর বড় অভিমান। তর যে মাথার ঠিক থাকে না, তা-ও অনেকে চিন্তা করব না। তরে অবিশ্বাসীও গণ্য করতে পারে। কাজেই তর ভালোর জন্য বলতেছি।
— না কর্তা, বিশ্বাস আমার ঠিকই থাকে। কিন্তু লাভ তো কিছু হয় না। খালি ক্ষতি আর ক্ষতি। জীবনডা ভর ক্ষতি।
— এখন অন্য কথা বল।
— কর্তা, ওইযে ওইপাড়ার মসজিদঘরের পিছের জমিটা। কী ভালো ফসলই ফলত। এই পৌষের শীতে হলুদ সরিষায় ভইরা যাইত। তার পুরা ইতিহাস কি সব জানেন? কতদিন তো ঘরে বসা। একাবারে চলতে ফিরতে পারেনই না!
— তারপরও কিছুতো শুনছিই। তর মন চাইলে খুইলা সব বইলা যা। আমি ইচ্ছা কইরাই তরে এতদিন কিছু জিজ্ঞাসা করি নাই।
— মাত্র আধাহাত জমি বেশি পাওয়ার দাবি ছিল রামচরণ কাহার। কিন্তু দলিলে তার সত্যতা ছিল না। রামচরণ কাহা তবু জোর করল। বাবা রাজি হইল না। দুইদিন তর্কবিতর্ক হইল। বাবা প্রতিবাদী মানুষ, একটু বেশি বইলা ফেলছিল। প্রায় হাতাহাতি। বাবা নতুন আইল বাঁনছিল। রামচরণ কাহা ভয়ানক ক্ষেপল। গোপনে বাবারে দুনিয়া থেইকাই সরাইয়া দিল। শেষে জমিটাও বেদখল দিল। আমি তো পাগল। তাছাড়া, আমার লাঠি নাই। থাকলেও লাঠি খাটাইতাম না। খাটাইলে জমির সাথে ফাঁসিতে প্রাণটাও যাইত। তার চাইতে ভিক্ষাও ভালো। দুনিয়ার মানুষ ক্যান এই সত্যটা বুঝে না? সবলে ক্যান দুর্বলের উপর এমন জোর করে? অত্যাচার করে?
— নবারুণ!
— জি, কর্তা।
— দুঃখ করিস না, বাড়ি গিয়া ঘুমা। দিনের বেলা একদিন সময় কইরা আয়, জরুরি কাজ আছে। এবার বাড়ি চইলা যা।
— কর্তা, বাড়ি আর কই? একটা খরের গাদা, যাওয়া না যাওয়া সমান। কর্তা!
— বল।
— আপনের ছেলেরা কি কোন চিঠিপত্র দিছে? আইজকাইলের মধ্যে?
— কিসের চিঠিপত্র? তাদের চিঠিপত্র পাইলে যদি আমার আয়ু বাড়ে? সেই ভয়ে তারা লেখে না।
— আয়ু বাড়লে কী হইব?
— কী আর হইব? এই বাড়ি বিক্রি পিছাইয়া যাব। শহরে তাদের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়ব না। শহরের বাড়ির ফ্যাশনও বাড়ব না।
— কর্তা, ক্যান এমন হয়? আপনের খোদায় কী কয়?
— খোদারে তো আমি সেই বিষয়ে কোনদিন কিছু জিগাই নাই। সব বিষয়ে খোদারে জিগান চলে না।
— তাইলে দিনে তারে এতবার কইরা কী এত কন?
— সে তুই বুঝবি না, এবার ঘুমাইতে যা।
— কর্তা!
— বল।
— দরজা কি খোলা থাকব?
— থাক, খোলাই থাক।
— যদি চোর আসে?
— আসলে আসুক, চোর আসুক, ডাকাত আসুক। সব লইয়া যাক।
— কর্তা, যাই।
— যা। ওউফ্ফু! ওউফ! খ- অ- –
— কর্তা!
— আহা, তুই চইলা যা। শীত আইজ খুব বেশি পড়ছে। শরীর কেমন জানি লাগতেছে। একটু ঘুম যদি-
— যা-ই-তাছি।
মাঝরাতে কর্তা তন্দ্রাচ্ছন্নতা থেকে সচকিত হন। ঘরের দাওয়ায় কার নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পান, মৃদু খুচখাচও। কর্তা মুখ খোলেন, নবারুণ!
— ক-র্তা! নবারুণের ঘুমজড়ানো কণ্ঠ।
— ক্যান ফিরা আসছোস আবার? বারান্দায় শীতের মধ্যে কষ্ট করতাছোস!
— কষ্ট নাই, কর্তা!
— এই ভর শীতে গায়ে কী তোর?
— কর্তা, আপনের গোলাঘরের পুরানা বস্তাগুলানে অনেক বেশি ওম। খরের গাদা থেইকা খর খুইলা আইনা এইখানে বিছানা পাতছি।
— ক্যান খামাখা এত কষ্ট করতাছোস? ভাবছস, চোরে আমারে নিঃস্ব কইরা দিব?
— না, কর্তা।
— তয় আর কী ভাবছস? ভাবছস, আমি যদি মইরা যাই। মরণ কি আর তুই ফিরাইতে পারবি? মরণ ফিরায় সাধ্য কার?
— কর্তা, আকাশে তাঁরা খসলে কী হয়?
— কোন তাঁরা কি খসলো? দেখলি তেমন কিছু?
— না কর্তা, না, এমনি জিগাই।
— নবারুণ!
— জি, কর্তা?
— তর কি ওয়াযীর শিকদারের কথা মনে আছে?
— আছে, কর্তা।
— তার ছেলে দুইটার কথা?
— তাও মনে আছে।
— কী মনে আছে?
— ছেলে দুইটারে সে গুলি কইরা মারছিল।
— ক্যান মারছিল?
— তা আমি জানি না, কর্তা।
— না মারলে সে নিজেই তাদের হাতে মরত। এই হইল কারণ।
— কিন্তু সেতো মইরাই আছে। ফাঁসি হইলে আর মরার কী বাকি থাকে? তার তো ফাঁসি হইছে!
— ছেলেরা তারে মারলে ছেলেদের ফাঁসি হইত। এখনও দুই পক্ষ গেছে, তখনও দুই পক্ষই যাইত। বুদ্ধিমান মানুষ, বুইঝা শুইনাই কাজ করছে। ভিতরের তাৎপর্য-দর্শন তর মাথায় খেলবে না। এ বড় গোলকধাঁধারে বড় গোলকধাঁধা।
— কর্তা, দুনিয়ায় ক্যান এইসব বিভ্রাট হয়?
— তাও তুই তর ভগবানরে জিগা। উত্তর পাবি না জানি, তবু আমারে না জিগাইয়া তারে জিগা। তুই হিন্দু, আমি মুসলমান। যার যার সীমায় থাকি দুইজন।
— কর্তা!
— বল।
— দূরে কাছে সবখানেই তো খালি হানাহানি কাড়াকাড়ি। এই নিয়া যত কুসাল। কুসালের অন্ত নাই।
— আবার কোন কথায় যাইতাছস?
— আপনের কি আদিমগো কথা মনে আছে?
— কোন আদিম?
— ওই যে পশু মাইরা লোক বেশি হইলে হানাহানি কইরা খাওয়ার আগে নিজেগই মাইরা যে ফালাইত, তাগোর কথা?
— এইসব পুরানা কথা এইবার রাখ। শরীর আমার বিশেষ সুবিধার ঠেকতেছে না। হঠাৎ কেমন জানি লাগতাছে। তুই জলদি ঘরে উইঠা আয়।
— জি, কর্তা।
— মোমবাতিটা দিয়াশলাই দিয়া জ্বালা। জলদি কর।
— কর্তা জ্বালাইছি, আপনে চোখ খুলেন।
— শুন, আমি বুঝতে পারতেছি – আমার আর চোখ খুলা না খুলা সমান। যা বলি তাই শু-ন মন দিয়া।
— কর্তা!
— এই কাগজপত্রগু-লা হা-তে নে।
— কর্তা, কী এইগুলান?
— ধর, আগে হা-তে নে। কলমও নে।
— কর্তা, কিসের কাগজ?
— শোন, ভেন্ডার আর উকিল দিয়া মাস ভই-রা এইসব আমি তৈরি করছি। এখন পইড়া দেখস -না দেখ-স, স্বাক্ষর দে। আর কাইল থেইকা এই বাড়িতে, এই ঘ-রে তুই থাকবি। এখন থেইকা এই ঘরবাড়ি তর নিজের। তুই ভিক্ষুক হইলেও – – -।
— না কর্তা, না, এ হয় না৷ কিছুতে হয় না। এ আমি পারব না, কর্তা।
— নবারু-ণ, তুই আমার অবাধ্য হই-স না। যা বলি তা শুন। নে, কাগজে স-ই দে। আর কাইল থেইকা ভিক্ষা ছাইড়া স্বাভাবিক জীবনে ফিরবি, আমারে কথা দে। নে, জল-দি সই দে-। কথা বেশি কইতে পারব না, কষ্ট অনেক – –
— না কর্তা, না। এ ভার আমি কিছুতে সইতে পারব না।
— আপনে আমারে ক্ষমা করেন।
— নবারুণ, এমন অসময়ে – – তু-ই – কথা শুন আ- মা-র
— না কর্তা, না। আমি ভিক্ষুক আছি, ভিক্ষুকই থাকব জীবন ভর। আপনে আমারে ক্ষমা করেন।
— নবা-রু-ণ- তুই কাছেই- – সময় -আর-
— কর্তা, আমি যাই।
— ন- বা-র-, ডাক্তা-র কবি-রাজ লাভ না- ই – -তুই ঘরে থা-ক-
— কর্তা, আপনের চোখেমুখে খোদার কালাম পইড়া ফু দেওয়ার লোক ডাকা জরুরি। সেইটাই বড়কাজ। এর চাইয়া বড় কাজ নাই।
— নবা-রুণ- – তুই – –
— কর্তা, ইমাম সাহেবের বাড়ি তো দশ মিনিটের পথ। ওই টিলাডার পিছেই। মেয়েলোক দিয়া তো আর সে কাজ ভালো হইব না। নইলে ওই দাসিটারে ডাকতে পারতাম, আপনার রান্না করে যে ভিখারিণীডা!
— ন-বা -রু- নবা-র-
— বিদায় কর্তা, আমি যাব আর আসব। আমারে মাফ দিয়েন। উ -হু-হু, হে উপরলোকের উপরকর্তা, মহাকর্তা, ক্যান এমন হয়?
নবারুণ মাঝ-উঠানে পা রাখতেই ঘরের চাল থেকে একটা পাখি কী এক অচেনা শব্দে উর্ধ্বাকাশে উড়ে যায়। আকাশের রূপ দেখে তার মনে হয়, এই বুঝি যথার্থ মাঝরাত, যেমনটি আগে কখনো সে দেখেনি। ঠিক পুব আকাশ থেকে একটা তাঁরা খসে সোজা পশ্চিমে চলে যায়। নবারুণ অনুভব করে, তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে। হাঁটার তালে সে অস্ফুট বলে, হে মহাজগতের মহাপ্রভু, হে মহাজ্ঞানী মহাজন, এ জগতে ক্যান এমন হয়? তোমার রহস্য ঠাউরান ক্যান মহা দায়?
মৌলভীকে নিয়ে নবারুণ যখন ফিরে আসে, কুটিরে তখন পরিপূর্ণ নৈঃশব্দ্য- সময় যথার্থ মাঝরাত।
গাই – শওকত নূর [Gaai]
হেঁটে দু পাশের দু বাড়ির সীমান্ত প্রাচীর অতিক্রম করে যেতে যে পথটি মাড়াতে হয়, তা উল্লেখ করার মতো সরু। একাকী কোনও মানুষকে বিশেষ সতর্কতায় পা আগপিছ করে কোনমতে পাড় হয়ে যেতে হয়, দু ব্যক্তির যুগপৎ হাঁটার সম্ভাব্যতা প্রশ্নাতীত । নিত্য এখানে পা ফেলতে যুবক পানু মিয়ার মনটাও যেন নিভৃতে সরু হয়ে যায়। কোনও প্রকারে জায়গা টুকু অতিক্রম করে যেতে পারলেই যেন সংকীর্ণ প্রণালী থেকে উপসাগরে গিয়ে উপচে পড়া। উল্লেখ সমীচীন, ভৌগলিক ও জনমানুষের সূক্ষ্ম হিসেব নিকেশ ঘটিত ভাগ বন্টনের দেয়াল তোলাতোলির দায়ে পানু মিয়াদের গাঁ থেকে বহির্মুখী হতে হলে এ পথ মাড়ানো
অত্যাবশ্যক।
যাক সে কথা। সরল, সাদাসিধে ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডল, হ্যাংলা পাতলা, কোঁকড়া-চুল, কিঞ্চিৎ উঁচু- দাঁত কলেজ পড়ুয়া পানু মিয়া যখনই দু ঘরের ফাঁকা দিয়ে দু পায়ে তার শীর্ণ দেহটি ধাক্কে কিংবা টেনে নিয়ে চলতে থাকে, তখনই সে বাঁ পাশের ঘরটিতে নারীপুরুষের সমবেত হৈ হুল্লোড় অথবা উৎকট গান বাজনার শব্দপাত শুনতে পায়। ঠিক ডানের ঘরটি থেকে ভেসে আসতে থাকে অনুরূপ দ্বৈত-লিঙ্গ- কণ্ঠের শ্রাব্যাশ্রব্য চাপা গালাগাল কিংবা ফিসফাস।
ঘর দুটি পেরিয়ে দু আঙিনার গা ঘেঁষে দুদিক থেকে উঁচানো কাঁটা ঝোপের বেড়া দুটি অতিক্রম কালে ডান বাম দু আঙিনা থেকেই তাগড়া ষাঁড় গরুর ভয়াল হোক্কা ডাক, ঘোরতর দড়ি-টান ছটফটানি, মাটিতে খুরের সজোর আঘাত, বাঁশের খুঁটিতে শিঙের ঠকঠকানি প্রভৃতি শুনে পানু মিয়ার ভীত শিহরিত না হবার ঘটনা থাকে নেহায়েতই বিরল। বুক-উঁচু বেড়া ডিঙিয়ে দুদিক থেকেই দুই বেপরোয়া প্রাণীর দ্বারা শিঙের ঘা খেয়ে ধরাশায়ী হওয়াা অসম্ভব কিছু নয়। দ্রুত চলার ফাঁকে দুদিকে তাকিমাকি করতে থাকে পানু মিয়া।
ঠিক তখনই বাঁয়ের ঘরটি থেকে অবধারিতভাবে ভেসে আসে তাচ্ছিল্য কণ্ঠটি, ও ভায়ে, চিপায় ক্যাঠায় যান? বেবাক প্রাণীহে ভয়-ডর পায়বার দরকার নাই। ডাইন বাড়ির ওইহান কিন্তুক আদতে ষাঁড় গরু না। ওডো হইতাছে বলদা, খাঁটি বলদা। আমার খানা আচাবুক ষাঁড় আছে। এই দুনিয়াত বুজ্জেননি ভায়ে, ষাঁড়ে ষাঁড় পালে, বলদায় পালে বলদা। ডাইনের ওই বাড়িহান বাড়ি ঠিকোই, তয় মাইনষের না, বলদার। কথা শেষে বাঁয়ের ঘরটি থেকে একক কিংবা সমবেত উচ্চস্বর নারী হাস্যরসের আবহ ভেসে আসে।
বাঁয়ের ঘরটিতে থাকে হান্নান মিয়া। বয়স ষাট এর কাছাকাছি। খুব সম্ভবত বয়স পঞ্চাশের পর অতিরিক্ত দুজন স্ত্রী গ্রহণ করেছে। এতে করে তার স্ত্রীর সংখ্যা তিন। তিন স্ত্রী নিয়েই তার সুখের সংসার। বাড়িতে ঘরের সংখ্যা তিন – দিনের বেলা স্ত্রীরা সম্ভবত পথের পাশের ঘরটিতে তার সাথে সমবেত হয়। পথচারী মাত্রই তাই হই হুল্লোড় ও হান্নান মিয়ার হাঁকডাক শুনতে বাধ্য হয়ে থাকে।
ডানের ঘরটিতে থাকে আফনান মিয়া; তারও বয়স ষাট এর কাছাকাছি। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাট এর মধ্যে সে দু দুজন স্ত্রী ছেড়ে তৃতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেছে। দৃশ্যত এটিই চূড়ান্ত, একক এবং সর্বশেষ জীবন সঙ্গী। আফনান মিয়াও দৃশ্যত সুখী, যদিও জনশ্রুতি মতে তার আগের নিরীহ স্ত্রীদ্বয় তাকে গলগামছা অভিসম্পাতের ভেতর দিয়েই স্ব স্ব বাপের বাড়িতে বিদগ্ধ দিনাতিপাত করে। আফনান মিয়া ও তার স্ত্রী চাপাস্বরে যেসব গালাগাল বর্ষণ করে তা পথচারীদের উদ্দেশ্যে নয়, হান্নান মিয়া ও তার স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে। গালাগালের মধ্যে যেসব শব্দপাত থাকে তার মধ্যে, শালার চড়ুই, বাঐ, পাতিহাঁস, গাধা, ভেড়া, ভেড়ী প্রভৃতি।
পানু মিয়া ছাত্র মানুষ, পড়াশোনা ও শখের কাজবাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এই দুই বয়সী ব্যক্তির দৃশ্যমান জীবনের বাইরে গভীরে কোন কিছুতে ঢুঁ দেয়ার খেয়াল খুশি কখনোই তার জাগে না। যেতে হয় তাই দু বাড়ির ফাঁক গলিয়ে যায়, চোখ খোলা রাখতে হয় তাই যা নজরে পড়ে তা দেখে। কান বন্ধ রাখা চলে না তাই চলতি পথে তার কুহরে যা প্রবেশ করে তা শোনে, ব্যস। আঙিনা পেরিয়ে সদর পথের সদর হাওয়া, খোলা আসমান, খোলা মাঠ ঘাট তাকে শীঘ্রই সেসব থেকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। মনের ভেতরে নিত্য একটাই ভাব জাগে, অতীতে দেখা চলচ্চিত্রের গানের ভাব: নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা — একা –
রাস্তা একাকী চললেও তার নিজের বেশি দূর একাকী চলা চলে না। কিছু দূর যেতেই কেউ না কেউ সঙ্গী জোটে। বিশেষ করে স্টেশন মোড়ে পৌঁছতেই অবধারিতভাবে গাঁয়ের অন্যতম মাতবর ব্যক্তিত্ব জাফলং মিয়া চোখ মিটমিটিয়ে এসে গা ঘেসে হেঁটে বলবে, আরে, পানু মিয়া যে, তা কোন পথ মাড়ায়া আসলা, ভায়া?
পথতো একটাই।
জানি, তবুও কথার কথা জিগাই। তা ওই মশকরা বাড়ির চিপায় আসতে কী কী মশকরা শুনলা?
কই, নাতো কিছু শুনিনি।
আরে ভায়া, শুনছাও, শুনছাও, খামাখা সত্য গোপন করতাছ। হেঃ হেঃ হেঃ।
কী সত্য গোপন করব? শুনিইনি আমি কিছু।
আইচ্ছা হইল, শুইনাও না শুইনা থাকলে না শুনছ। কিন্তু গরু দুইটাক তো দুই ধারে দেখছ। নাকি দেইখাও দেখোনাই?
নাহ, গরুটরু কিছু চোখে পড়েনি। পানু মিয়া সান্নিধ্য ও ঝঞ্জাট এড়াতে ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে।
শালার দুইটাই আসলে মস্ত ধাউর, বুঝলা? গরুগুলানের লাহানই ধাউর।
স্পষ্ট বুঝতে পারছি না, কী বলছেন।
হাঃ হাঃ হাঃ, বুঝছো শতভাগই, কিন্তু স্বীকার করবা না। ঠি-ই-ক আছে, যাও গিয়া! তুমি স্বীকার না কর-লেও সত্য বলার লোকের অভাব নাই। ওই যে লাডু মিয়া আসতাছে। তার কাছেই সব শুনবার পারব, হেঃ হেঃ হেঃ!
শোনার এত আগ্রহ, তা নিজে গিয়ে দুই বাড়ির চিপায় দাঁড়িয়ে শুনলেই তো পারেন।
যাই না ক্যান, সেইখানেই তো একপালা গানরে ভাই। তা তুমি যাও গিয়া। কলেজে কেলাস শুরু হয়া যাব।
হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, চলি।
আর-রে, লাডু মিয়া যে।
হ ভাই, আইসা গেছি।
হাঃ হাঃ হাঃ , আয়া ভলো করছ। ওই যে পানু মিয়া যায়। হালার মদন পোলাপাইন একটা।
হাঃ হাঃ হাঃ, ঠিক কথা কইছেন।
তা কও দেহি আইজ কী কী শুনলা।
কী-ই আর শুনব? রোজ রোজ যা শুনি, তাই। ভাই, ক্যাঠায় যাও, ষাঁড়ে ষাঁড় পালে এইসব।
তা ওই হান্নান হারামজাদার ঘরে কি একক মাইয়ালোকের কণ্ঠ শুনলা, নাকি হারামজাদিগুলান সব একত্র হইছে?
সবগুলানই একত্র হইছে কি না তা বুঝা গেল না। তবে একক কণ্ঠ যে না, সেইটা ইস্পষ্ট।
ময়ূরীর কণ্ঠ কি ঠাউর করবার পারলা? কিংবা কার কি কথা হইতেছে ময়ূরীর লগে?
না, তা পারি নাই।
তয় আর কী পারলা? আহারে আমার পরান পাখি,পরানের ময়ূরী। কী ফাঁকিই আমারে দিছে!
ময়ূরীর লাইগা আপনের এত পরান পুড়ে , তা ওই হান্নাইনায় তারে লওয়ার আগেই তারে লইয়া লইতেন।
চেষ্টা তো কম করি নাই, তা দৌড়ে পাইরা উঠবার পারিনাই।
ক্যানে?
বড় পোলায় বিদেশ থেইকা হঠাৎ চিঠি পাঠাইল বিপদে আছে। ম্যালা ট্যাকার ফ্যাঁকরা। ট্যাকার সন্ধানে যারপর নাই ব্যস্ত হইয়া পড়লাম। এই ফাঁকে ওই শালা হান্নাইনায়–। আরে শালার খাচরাডায় দেহি কলেজে না যাইয়া দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া আমগোর বেবাক কথা শুনতাছে। আইজ কলেজে যাব না নাকি?
ও শুনলে আর কী হইব?
যদি হান্নান মিয়ার কাছে কথা লাগাইয়া দেয়?
না, আপনেই না কইলেন হ্যায় মদন পোলাপাইন।
তা অবশ্যি ঠিক। কিন্তু ইস্টুপিডটায় কলেজে যাইতাছে না ক্যান?
যাইব কি, কলেজ তো হুনছি আইজ বন্ধ। কী চাহার সোমবার না কী একটা নাহি আছে, আমগো গ্যাদা কইল।
হইতে পারে, লও ওইদিকটায় গিয়া ব-ই।
জাফলং মিয়া লাডু মিয়াকে নিয়ে অদূরের গাছতলায় গিয়ে বসে। এদিকে এক্ষুণি বাড়ি ফিরবে নাকি আরো কিছুক্ষণ এদিকটায় ঘোরাফেরা করবে, সে বিষয়ে ভাবছিল পানু মিয়া। ভাবছিল, কলেজ বন্ধের বিষয়টি আগে জানা থাকলে কিছুতেই সে আজ বাড়ি থেকে বেরোত না। এদিক সেদিক পায়চারি করতে লাগল সে। এরই মধ্যে তার বড় বোনজামাই কোত্থেকে মোটরসাইকেল যোগে এসে তার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, কী রে, এখানে ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে আছিস, কী ব্যাপার? আজতো কলেজই নেই।
হ্যাঁ। গতকাল কলেজে না যাওয়াতে জানতে পারি নাই।
তো চল আজ আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবি। তোদের বাড়িতে এক্ষুণি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। ওঠ পেছনে।
পানু মিয়া কোন উচ্চবাচ্য না করে মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে তার বোনের বাড়িতে চলে যায়। বিকাল নাগাদ সে সেখানেই কাটায়। সেখান থেকে ফিরতি পথে সে যখন হান্নান মিয়া ও আফনান মিয়াদের বাড়ির সীমানায় পা রাখে, তখন রীতিমত সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। পানু মিয়া এর আগেও মাঝেমধ্যে ঠিক এমন সময়ে এ পরিসরটুকু অতিক্রম করতে গিয়ে খেয়াল করেছে জায়গাটা প্রচুর পাখপাখালিতে ভরপুর। দু পাশের দু বাড়ির গাছপালা, ঘরের চাল, উঠান, এমনকি গরুদুটির পিঠ ভর্তি হয়ে থাকে পাখিতে। আর যে তাদের কোলাহল!
এ গাঁয়ে পাখির সংখ্যা এমনিতে বেশি। কিন্তু এ বাড়ি দুটির মতো অতি মাত্রার পাখি তৃতীয় কোন বাড়িতে নেই। দুদিক থেকে প্রকট ক্যাচক্যাচানিতে তারা কানে তালা লাগিয়ে দেবে যেন। পানু মিয়া চলার ফাঁকে ভাবে, পাখিদের ঠিক এ দুটি বাড়ি এভাবে বেছে নেয়ার কী হেতু। কী বিশেষত্ব এ দুই বাড়ির? প্রাকৃতিক কোনও বিষয়, নাকি তারা নিজেরা কোলাহলে বলে এ দুই বাড়ির কোলাহল পছন্দ বশত নিকট সাহচর্য প্রদর্শন করে থাকে? ভাবনা ও হাঁটার ফাঁকে ঠিক দু আঙিনার মাঝামাঝি এসে থমকে দাঁড়ায় পানু মিয়া। হান্নান মিয়া আচমকা ডেকে উঠেছে ঘরের ভেতর থেকে,ও পানু ভায়া! পানু ভায়া যাইতাছোনি,ভায়া-হ?
জি ভাই।
এটুক্কা খাঁড়াও দেহি। জরুলি কথা আছে তোমার লগে।এই এক সেকেন্ড।
নিদারুণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানু মিয়া দু আঙিনার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে যায়। পিঠে পাখির ঝাঁক নিয়ে দু’দিকে দুটি ষাঁড় বিকট হোক্কা ডাকতে থাকে। বুক সমান উঁচু কাঁটা ঝোপের বেড়ার ওপর দিয়ে পর্যায়ক্রমে দু’দিকে তাকায় পানু মিয়া। হান্নান মিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আঙিনা পেরোয়। বেড়ার গা ঘেষে দাঁড়ায়। পানু মিয়ার দিকে খাটো গলা বাড়িয়ে চাপাস্বরে বলে, ভায়া, কওছে হুনি আউজগা রাস্তার মোড়ে খাঁড়ায়া ওই জাফলং বদমাইশটায় কী কইছে তোমারে। হুয়ারে আমার সম্পর্কে কীসব নাকি কইছে তোমারে?
কই নাতো, কেউ কিছু বলেনিতো। কে বলল আপনাকে এসব?
ভায়া, কইছে কইছে, আমার সম্পর্কে নানান কথাই হারামজাদায় তোমারে কইছে। তুমি চাইপা যাইতাছ।
না না, আপনি মিছেই ভাবতেছেন। আপনার সম্পর্কে কেউ কিছুই বলেনি আমাকে।
লাডুয়ে কি তাইলে মিছা কথা কইল আমারে?
নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেছে।
লাডু মিছা কয় আমারে! সে কইল তোমারে নাকি জায়জিলিমান দেখছে হারামজাদার লগে খাঁড়ায়া মেলাহন কথা কইতে। সুযোগ পায়া নাকি হারামজাদায় আমার আর ময়ূরীর সম্পর্কে যা তা কইতাছিল।
একদম মিথ্যা কথা।
অয় তালি সত্যি তোমারে কয়নাই কিছু?
হ্যাঁ হ্যাঁ, কিচ্ছু বলেনি।
মিছামিছি আমি তালি একশটা টাহা দিলাম লাডুরে।অয় আমার লগে—।
আমি যাই এখন।
না না, খাঁড়াও। ওই ময়ূরী, ময়ূরী–।
কী কন? ঘরের ভেতর থেকে হান্নান মিয়ার তৃতীয় স্ত্রীর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ভেসে আসে।
পানের বাটা লইয়া এইদিকে আয় দেহি। মিঠা জর্দা আন। ভালো সুপারি আনিস।
আনতাছি।
ময়ূরী ঘর থেকে বের হয়ে পানের বাটা হাতে পরম ঢংয়ে হাঁটতে হাঁটতে হান্নান মিয়ার অদূরে এসে দাঁড়াল। মাথায় এলো কোঁকড়া চুল, কপালে লাল টীপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। বাঁকা হাসি, চোখের চাউনিতে যেন ঝড়ো হাওয়া। হালকা এক নজর দেখে মাথা নিচু করল পানু মিয়া। ময়ূরী বেড়ার ওপর দিয়ে পানের বাটা বাড়িয়ে বাঁকা হাসি হেসে বলল, ভায়া, ভালো?
হ্যাঁ।
এই যে পান নেন, মিষ্টি পান। জর্দা সুপারি দুইটাই মিষ্টি, সুগন্ধি।
পান আমি খাই না।
একদিন খাইলে কিছু হইত না ভায়া, নেন। এই যে -হ!
আরে লও ভায়া, পানে কোন ক্ষতি নাই। মিষ্টি জর্দা পান, বড় সুস্বাদু। গিন্নি তোমারে সম্মান কইরা দিছে। নারীর সন্মানে অমর্যাদা করতে নাই। লও একখান খিলি-পান। হান্নান মিয়া আহলাদে বলে।
ভায়ার কি খিদা লাগছে? পেট খালি? পানি বিস্কুট আনি? ময়ূরী হেসে বলে।
না না, কিচ্ছু আনতে হবে না। একটা পানই নিচ্ছি, শুধু পান।
ভায়া, একখণ্ড সুপারিও নেন। খালি পান খাইতে নাই। ময়ূরী ডালা উঁচায়।
ঠিক আছে, চলি।
ভায়া, দিনের বেলা একদিন আসলে খুশি হমু। আসেন একদিন। যুগপৎ দুজন বলে।
সে দেখা যাবে, চলি।
ভালা থাইকেন।
আঙিনা পেরিয়ে পানু মিয়া যখন ঠিক দু ঘরের চিপায়, তখন বাঁ পাশের অর্থাৎ আফনান মিয়ার ঘর থেকে চাপা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে, দ্যাখলেন তো দুই বদমাইশ ক্যামনে ভাও করতাছে সহজ সরল পোলাডারে! জাফলং মিয়ায় তো আস্তা দুইমুখা সাপ। সেও ভাবতাছে এই পোলাডারে হাত কইরা এই বাড়ির কথা লইব। কিন্তুক এই পোলায় কি সত্য কথা কইব তারে? হান্নাইনায় যা তা কইলেও এ কইব হ্যায় তারে কয়নাই কুনু কথা। জাফলইংয়ার কথাও চাইপা যাব এই বদগুলানের কাছে।
ময়ূরী, বাদ দে এইসব আজাইরা কথাবাত্রা। চুপ কইরা থাক। বদেগোর কাম বদেরা করতে থাউক।
পানু মিয়া যখন হেঁটে ওপাশের পথ ধরেছে, তখন পেছনের দু ঘর থেকেই আহলাদে গানের সুর ভেসে আসে :
ডানে : কী সুখ দিলারে খোদা
সুখের সীমা নাই। হান্নান মিয়ার কণ্ঠ।
বাঁয়ে: সুখের সংসারে আমার
আইজ নাই দুখের ঠাঁই। আফনান মিয়া গাইছিল।
অদূরের মসজিদ-মাইক্রোফোনে আচমকা আযান বেজে উঠলে পেছনের দুটি কণ্ঠই ধুপ করে থেমে যায়। পানু মিয়ার চলার গতি দ্রুততর হয়।
ক’ দিন পর সাতসকালে আবারো কলেজের উদ্দেশ্যে হাঁটছিল পানু মিয়া। ফসলের মাঠ পেরিয়ে হান্নান মিয়া আফনান মিয়াদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই এদিক থেকে বাড়ির ভেতরে প্রচণ্ড রকমের চিৎকার চেঁচামেচি ও ঠকঠক জাতীয় শব্দ শুনতে পায় সে। চেঁচামেচি করছে ময়ূরী, কিন্তু ঠকঠক শব্দটা কিসের? শক্ত কোন কিছুতে আঘাতজনিত শব্দ বলে মনে হচ্ছে। ইতঃস্তত দাঁড়ায় পানু মিয়া। এর মধ্যেও পথপ্রান্তের ঘর থেকে হান্নান মিয়ার গানের সুর ভেসে আসছে। সেই সুখ সংসারের গান।
এবারে ইতস্তত ঝেড়ে হাঁটা ধরে পানু মিয়া। দু আঙিনার বেড়ার ফাঁকায় পা দিয়ে বাঁয়ে নজর যেতে দেখে ময়ূরী কোমরে কাপড় পেচিয়ে এলোচুল রুদ্র মূর্তিতে কাঠের লাকড়ি দিয়ে আঙিনার অপর দুই ঘরের বন্ধ দরজায় মুহূর্মুহু তুমুল আঘাত করছে। মুখে অশ্লীল অশ্রাব্য যা আসছে তা-ই বলছেঃ ওই মাগী, ওই —-, বাইর ঘর থিকা, আইজ তগোর—– তর ভাতার–
ঘরের ভেতর থেকে ন্যূনতম সাড়াশব্দ ভেসে আসছিল না। অর্থাৎ ময়ূরীর দুই সতীন ভীত সন্ত্রস্ত স্ব স্ব ঘরের দরজা বন্ধ করে আছে। একবার শুধু এক ঘর থেকে অস্ফুট এক বাক্য ভেসে এলোঃ হো মা-ঃ আইজ মাগীর ইয়া উঠছে গো- ও-!
ক্রমাগত দরজায় আঘাতের সাথে একইরূপ বাক-বর্ষণ করেই চলেছে ময়ূরী। পানু মিয়া প্রায় দৌড় পর্যায়ের হাঁটা আরম্ভ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। হান্নান মিয়া গান থামিয়ে চেঁচাচ্ছেঃ ক্যাঠায়? ও পানু ভায়া, চইলা যাইতাছ?৷ এক সেকেন্ড খাঁড়াও। তোমার কোন ভয় নাইক্কা! এই আইতাছি!
হান্নান মিয়া বেড়ার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে ভালোমত দেখে নিল। তার দৃষ্টি বিশেষভাবে ঘুরছিল আফনান মিয়ার আঙিনা ও ঘরের দরজায়। ঘরের দরজা খোলা কিন্তু কেউ নেই দৃশ্যপটে। এবারে হান্নান মিয়া হাসিমুখে নজর দিল ময়ূরীর কর্মকাণ্ডে। পানু মিয়ার দিকে গলা বাড়িয়ে বলল, দেখলা তো পানু ভায়া, কী তাগোদের তাগোদ!
কার?
আহা- কার আবার? আমার ময়ূরীর। তুমি কি ভাবছ আমি ওই আফনাইনারে তাগোদের পুরুষ কইতাছি?
আফনান মিয়া হইল একটা বলদা, বলদা। অর উঠানে যে পেরাণীডারে তুমি তাগোদের ষাঁড় ভাবতেছ, সেইডাও আদতে ষাঁড় না, একখান খাঁটি বলদা। বলদায় বলদা পালে সেইটাই তো স্বাভাবিক। হেঃ হেঃ হেঃ!
আচ্ছা, এবার যাই আমি, তাড়া আছে।
আহা ভায়া, আসল কথাটাই তো বলা হইল না।
বলুন জলদি।
ওই যে দেহেন, কী চোটপাট! অর ওই রহম চোটপাট আছে বইলাই তো অরে পরাণ দিয়া ভালোবাসি। চোটপাট যদি না থাকত, ওই বড় দুইটায় অরেই চুলের মুঠা ধইরা লাইত্থাইয়া খেদাইত। ইয়ার পর একোইভাবে একটায় আরেকটারে খেদাইত। বিবি থাকত কয়জন?একজন। কথা খেয়াল করতাছ না, ভায়া?
করছি, বলুন।
সেই মত অবস্থায় আমার আর তিন বিবির হাউশ পুরাপুরি মিটত না। নিজের তাগোদেরও একটা বিষয় আছে। আমি হইলাম গিয়া ষাঁড়। ষাঁড় বইলাই তিনডারে লইয়া থাকবার পারতাছি।
ঠিক আছে, আমি যাই এবার।
আহা ভায়া, এতো ছটফট করলি কি আর হয়? মোদ্দ কথাটাই তো বলা হয় নাই।
আচ্ছা বলুন।
ওই আফনাইনায়, বুঝলা কি না, ভায়া? ওই আফনাইনায় হইতাছে একটা উক্কিষ্টো বলদা। বলদা বইলাই আগের দুইহানরে পর পর খেদাইয়া একটারে লইয়া ঘর করতাছে। বলদার কাম বলদায় করতাছে। শালার বলদা!
ঠিক আছে, আমি এবার যাই।
ভায়া, আরেক দিন ঘরের মইধ্যে আইও, নিরিবিলি কথা কমু। আউজগা এই তরিই থাউক। চইলা যাও।
আচ্ছা।
পানু মিয়া দ্রুত আঙিনা পেরিয়ে এপাশের খোলা পথে পা রাখে। অন্য দিনের মতো আজ আর ‘নীল আকাশের নিচে’ গানের ভাব মনে জাগছে না। ময়ূরীর তীব্র হাঁকডাক, দরজায় তুমুল বাড়ির শব্দ এখনো কানে উঠছে। যুগপৎ একটা হিসাবও মনের মধ্যে মিলে যাচ্ছে। হান্নান মিয়া কেন নিজেকে ষাঁড় আর আফনান মিয়াকে বলদা আখ্যা দেয় – সেই রহস্যের কুল কিনারার হিসাব। পৈতৃক ভিটাবাড়ি, সহায় সম্পত্তি, মোটা ভাত মোটা কাপড় আছে; হয়তো এ-ই বৈরিতা বিরোধিতা, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা, নিত্য ফ্যাসাদ, হাসি রসিকতাই তাদের জীবন। চলতি পথে পানু মিয়ার তাতে অন্তর্ভুক্তিও তাদের জন্য সে অর্থবহ জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পানু মিয়া ভাবনাঘোরে কখন স্টেশন মোড়ে পৌঁছে যায়।
সেখানে পৌঁছা মাত্র ওপাশের শিরিষ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জাফলং মিয়া খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। কাতর স্বরে বলল, কী খবর, পানু ভায়া? শুনলাম তুমি আমার সম্পর্কে নানান ষড়যন্ত্রেরই সাক্ষীগোপালের ভূমিকা পালন কইরা চলছ। কথা ঠিক কইলাম কি না কও।
কী ষড়যন্ত্র?
ওই শালা হান্নাইনায় নাকি নানান গালিগালাজই আমারে নিত্য পারে, তোমারে নানান কথা শুনানবশত।
কী কথা?
ওই আমি নাহি একখান আবাল বাঁছুড়, নিত্যি রাস্তায় দাঁড়ায়া নাদাই, চোনাই। পাঁতিহাসও নাহি বলছে আমারে।খালি নাহি প্যাকপ্যাক করি আর পথেঘাটে আণ্ডা ঝাড়ি। কী কমু দুঃখের কথা?
আমি বলতে পারব না। জানি না এসব।
মাইনে? এতসব বদকথা তোমারে বলল, আর তুমিই বলতেছ বলতে পারবা না–।
বললাম তো আমি কিছু জানি না এসবের, আমাকে যেতে দিন।
আইচ্ছা যাও। ওই যে আফনান মিয়ায় চইলা আসছে। হারামজাদা লাডু কি মিছা কথা কইল? নগদ একশ টাহা লইয়া গেল। শেষ বাক্যটি বিড়বিড়িয়ে বলল জাফলং মিয়া।
স্টেশন সীমার শেষ প্রান্তের এক দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াল পানু মিয়া। ওদিকে তাকিয়ে দেখল, জাফলং মিয়া আফনান মিয়ার হাত ধরে তার সাথে নিবিড়ভাবে কী যেন বলাবলি করছে। দুজন মাথা ঝুঁকেও যেন কী বলল কতক্ষণ। ভাবে মনে হলো জাফলং মিয়া আফনান মিয়াকে কোনও বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছে। তার পকেটে গুঁজেও দিল একটা কিছু। ওদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে চলে গেল পানু মিয়া।
কলেজ থেকে ফেরার পথে বাড়ি দুটির চিপায় এসে প্রথমত অভিভুত হলো পানু মিয়া। আফনান মিয়ার ঘরের ভেতর থেকে পোলাও কোরমা জাতীয় খাবারের তীব্র সুগন্ধি ভেসে আসছে। আরো ভেসে আসছে চাপা কথোপকথনের শব্দ। লাডু মিয়াকে আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছে আফনান মিয়া ও তার স্ত্রী। সাথে হান্নান মিয়ার বিরুদ্ধে নানান ছবক দিচ্ছে। জায়গাটা দ্রুত অতিক্রম করে এলো পানু মিয়া।
বাড়ির উঁচু ভিটা থেকে নিচুতে নেমে দু কদম এগোতেই পাশের আমগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে খপ করে তার হাত ধরে ফেলল হান্নান মিয়া। ফিসফিস করে বলল, দেখলাতো ভায়া, আমার বিরুদ্ধে কেমন ষড়যন্ত্র হইতাছে। ওই লাডু হারামজাদা হইল তিন মুখা সাপ। হারামজাদা সবদিক তাল দিয়া টাহা খাইতাছে। আর দুই বলদা তা ট্যার পাইতাছে না। —
আচ্ছা যাই আমি।
যাও গিয়া। তয় আমি যে ঘরের পিছনে খাড়ায়া বদেগো কথা শুনছি, বদেরা জিগাইলে তুমি তা কোনদিন বইলা দিও না।
জি বলব না।
পরদিন কলেজে যাওয়ার পথে বাড়ি দুটির কাছাকাছি গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল পানু মিয়া। দু ঘরের চিপায় তুমুল লড়াই চলছে দু বাড়ির দু মালিকের মধ্যে। নিঃশব্দ লড়াই। একবার হান্নান মিয়া ধাক্কে আফনান মিয়াকে ক হাত পিছিয়ে নিয়ে যায়, পরক্ষণেই উল্টো কাজটি করে আফনান মিয়া। কলেজে জরুরি ক্লাস, অথচ পথ অবরুদ্ধ। ইতঃস্তত করতে থাকে পানু মিয়া। মিনিট কয়েকের মাথায় হান্নান মিয়ার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ওইঃ ভায়েক যাইতে দে! ডাইনে সর!
যাও ভায়া, যাও!
পানু মিয়া বিবদমানদের একপাশ দিয়ে কোনমতে দুকদম এগোতেই দু বাড়ির ভেতর থেকে তুমুল জোরে নারী কণ্ঠের গালাগাল শুরু হলো। কাহিল অবস্থায় প্রথমে বাম পাশ থেকে হান্নান মিয়া কাতর কণ্ঠে বলল,ময়ূ-রী চিল্লাইয়া কী হইব? চিল্লইশ না, ষাড় ছাইড়া দে, ষাঁড়!
হাজেরাহ! আমাগোরডাও ছাইড়া ধে-হ! আফনান মিয়ার কাহিল কণ্ঠ।
চোখের নিমিষে দু পাশ থেকে দুই ষাঁড় ছুটে গিয়ে ওপাশের পালানে নেমে তুমুল লড়াইতে লিপ্ত হলো। পানু মিয়া এরই মধ্যে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখল একদিকে দুই পক্ষের নারী পুরুষে তুমুল লাফালাফি-গালাগাল, অন্যদিকে দুই ষাঁড়ের লড়াই।
ষাঁড় লড়াই ঘিরে বেশ লোক জড়ো হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হান্নান মিয়ার লাল ষাঁড়টি দৌড়ে পালালে হান্নান মিয়া মাটি থেকে ইটার খণ্ড তুলে আফনান মিয়ার মাথায় আঘাত করে। আহত আফনান মিয়া প্রবল আক্রোশে পাশ থেকে গাছের ডাল তুলে হান্নান মিয়ার ঘাড়ে আঘাত করে। দুজনই মুহূর্তে মাটিতে লুকিয়ে পড়লে ময়ূরী আর আফনান মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম প্রবল বেগে দুপাশ থেকে দৌড়ে গিয়ে দুজনের চুল টেনে ধরে। একটু দেখার পর পানু মিয়া অতি দ্রুত কলেজের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করে। এরই মধ্যে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তার।
কলেজ থেকে ফেরার পথে খানিকটা দূর থেকে পানু মিয়া লক্ষ্য করল বাড়ি দুটির পরিসরে পিন পতন নিরবতা। নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেল সে জায়গাটা। নিজ বাড়ির ভেতর আঙিনায় পা দিতেই তার বাবা প্রশ্ন করে বসলেন, বয়সী হান্নান মিয়া ও আফনান মিয়ার সাথে তার কী এমন খায়খাতির যে সদ্য ঝগড়াহত দু’জনই তাকে পালাক্রমে বাড়িতে খুঁজতে আসছে। পানু মিয়া যে জবাব করল তা তার বাবার কাছে খুব বেশি বোধগম্য হল না।
তিনি অনুমান করলেন ওই দুই ব্যক্তির একজনও তার প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট কিছু না বললেও ভেতরে হয়তো পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। আর কাউকে না পেয়ে দুজনই সাক্ষী মানতে চাইছে সহজ সরল পানু মিয়াকে। অতএব, খাওয়া দাওয়া সেরে বিকল্প পথে এক্ষুনি যেন সে বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যে কেটে পড়ে, প্রয়োজনে দু একদিন যেন আত্মগোপন করে থাকে। তার বাবার কথামত পানাহার শেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় পানু মিয়া।
পরদিন ভোরবেলা। বোনের বাড়ি থেকেই কলেজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছল পানু মিয়া। আশ্চর্যজনকভাবে উদ্ভ্রান্ত দর্শন হান্নান মিয়া সেখানে গিয়ে হাজির। পানু মিয়া কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে পথে কথা ওঠাল হান্নান মিয়া। পানু মিয়া দেখল তার বাবার অনুমান শতভাগই সত্যি। হান্নান মিয়া তাকে মামলার সাক্ষী হবার অনুরোধ জানাতেই সাতসকালে এতদূর হেঁটে
এসেছে। তাকে টাকা পয়সার প্রলোভনও দেখাচ্ছে সে।
পানু মিয়া তাকে বুঝিয়ে বলল মামলা মোকদ্দমায় না গিয়ে উভয়ে মিলেঝিলে চলতে। এও বোঝাল, সে যদি মামলা করে তবে আফনান মিয়াও তার বিরুদ্ধে মামলা করবে। ফলে তাকে জেল হাজতে থাকতে হবে। এ সময় জাফলং মিয়া তার ফেলে যাওয়া পরিবারের ওপর সুযোগ নিতে পারে। ব্যাপারটা তার জন্য মোটেও ভালো বা সুখকর হবে না। শুনে হান্নান মিয়া প্রথমে চোখ বড়বড় করল। তারপর চিন্তিত মনে দ্রুত পা বাড়িয়ে ভিন্ন পথে চলে গেল।
সেদিন কলেজ ছুটির পর পানু মিয়া বাড়িতে ফিরে যাবে নাকি বোনের ওখানেই গিয়ে উঠবে তা নিয়ে ইতঃস্তত করছিল। কিছুক্ষণ এলোবিক্ষিপ্ত ভাবার পর শেষ পর্যন্ত সে বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওয়ানা হয়ে গেল। বাড়ির বার আঙিনার কাছাকাছি পৌঁছতেই তার চোখ রীতিমত চড়কগাছ হলো। সে কলেজ ছুটির পর মনে মনে যা ভেবেছিল, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। আফনান মিয়া দিব্যি ওখানকার বার আঙিনার জামগাছে হেলানে বসে আছে উদাস। তাকে দেখে নিমিষে অনেকটা চাঙা হয়ে উঠল যেন। ক্লান্ত অবসন্ন পানু মিয়ার জিজ্ঞাসাবাদে যা বেরিয়ে এলো তা হুবহু হান্নান মিয়ার আগমন হেতুর অনুরূপ।
পানু মিয়া সংক্ষেপে আফনান মিয়াকেও একরূপ পরামর্শে বিদায় জানাল। আফনান মিয়া গভীর ভাবনাচ্ছন্ন প্রস্থান করল।
পানু মিয়া এখন বাড়ি দুটির ফাঁকা দিয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। কান পেতে থাকে। দুপাশ নিস্তব্ধ, মাঝেমধ্যে বড়জোর চুড়ির টুংটাং কিংবা অলস হাই তোলার শব্দ ভেসে আসে। ওদিকে কাঁটাঝোপের বেড়াদুটির ওপর দিয়ে গলা উঁচিয়ে প্রতিদিন যে ভয়ংকর প্রাণী দুটির উদ্দেশ্যে সে দৃষ্টি ছোঁড়ে, তাদের কাউকেই আর চোখে পড়ে না। নিয়মিত দৃষ্টিতে আটকে যায় ঠায় বসা দুই গৃহকর্তার ভাজ করা দু হাঁটুর ফাঁকে চেপে ধরা সীসার পাত্রে চুৃঁইচাঁই সাদা তরলধারা বর্ষণকারী অতি নিরীহ দণ্ডায়মান দুটি গাই।
ইন্সপেক্টর – শওকত নূর [Inspector]
পরিদর্শনে যাবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই পরিদর্শক সাহেব স্কুলটি সম্পর্কে নানা কথা শুনে আসছিলেন। বিশেষ করে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের উশৃঙ্খল আচরণের কথা। বিষয়টি তাকে কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছিল। অবশেষে তিনি স্কুলটিতে সংবাদ পাঠালেন যে তিনি পরবর্তী বৃহস্পতিবার সেটি পরিদর্শনে যাচ্ছেন।
একেবারে প্রত্যন্ত গাঁয়ের স্কুল। ছাত্রছাত্রীরা পিছিয়ে পড়া ধরনের হবে, তা-ই স্বাভাবিক। স্কুলে লেখাপড়া করলেও গাঁয়ের নিরক্ষর মানুষদের জীবন যাত্রার নানাবিধ পশ্চাৎমুখী বিষয়াদিই সিংহভাগ ছাত্রছাত্রীর ওপর প্রভাব বিস্তার করে আছে। অবশ্য বাংলা ‘পরিদর্শক’ শব্দটির চেয়ে ইংরেজি ইন্সপেক্টর শব্দটি তাদের মধ্যে বিশেষ প্রচলিত, কৌতূহলোদ্দীপক ও উৎসাহব্যঞ্জক। বলা বাহুল্য, শহরাঞ্চলেও উল্লিখিত শব্দঘটিত বিষয়টি প্রায় অনুরূপ। বাংলার তুলনায় ইংরেজি শব্দটিই যেন সহজ, প্রাঞ্জল ।
অথচ আলোচ্য স্কুলে ইন্সপেক্টর সাহেবের আগমন উপলক্ষে গয়রহ সেই সহজ-প্রাঞ্জল গণ্য হওয়া শব্দটিরই নানা বেহাল দশা দাঁড়াল। অপারগতা ও তাচ্ছিল্য, উভয়ের সংমিশ্রণে ছাত্রছাত্রী ও স্বাক্ষর -নিরক্ষর উভয় প্রকার অভিভাবক মহলে ইন্সপেক্টর শব্দটি বহুল বিকৃত উচ্চারণের ঝড় তুলে বসল। কেউ বলতে লাগল, ইস্কুলে মেসপেট্টার সাপ আসতাছে, কেউ বলছিল, নেসপেট্টার সাফ আসতাছে, বয়স্ক রসিক গোছের কেউবা ছাত্রছাত্রীদের ডেকে বলতে লাগল, এই পোলাপান, লেইজ আলা মাস্টার বলে আইতাছে তগোর ইস্কুলেহ, ইয়া বড় ল্যাঞ্জারে, মাস্টারের কী ল্যাঞ্জার ল্যাঞ্জা প্রভৃতি।
লোক-মারফত ইন্সপেক্টর সাহেব এসব খবরও নিয়মিত পাচ্ছিলেন। যাই হোক, তিনি নির্ধারিত দিনে পরিদর্শনে যাবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করতে লাগলেন। পরিদর্শনের দুদিন আগে স্কুলের প্রধান-শিক্ষক সাহেব তার সাথে দেখা করতে গেলে তাকে দিয়ে তিনি স্কুলের প্রধান সমস্যাগুলো কাগজে কলমে লিখিয়ে নিলেন। প্রধান-শিক্ষক সাহেবের লিখিত ভাষ্য অনুসারে সমস্যাগুলো হলো : ছাত্রছাত্রীর তুলনায় স্কুলঘরের পরিসর ছোট, আশেপাশের পরিবেশ নোংরা, খেলাধুলার সাজসরঞ্জাম অপ্রতুল, ছাত্রছাত্রীরা বেয়াদব – শিক্ষকদের গণ্যমান্য করে না প্রভৃতি। মুখে আমতা আমতা করে শিক্ষকদের ভালো যোগ্যতা না থাকাকেও ছাত্রছাত্রীদের গোলমালের কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেন। জবাবে পরিদর্শক সাহেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ছাত্রছাত্রীরা আপনাকে ভয় পায় তো? গণ্যমান্য করে?
জি স্যার, জি স্যার, তা খুবই করে।
আপনাকে গণ্যমান্য করে, অথচ শিক্ষকদের গণ্যমান্য করে না, কেমন দাঁড়ায় ব্যাপারটা?
স্যার, ওই যে বললাম, শিক্ষকরা যোগ্যতায় খুব একটা চৌকশ না, তাই–
আচ্ছা, ঠিক আছে, দেখা যাবে। দাঁতে দাঁত চাপলেন পরিদর্শক সাহেব।
পরের বৃহস্পতিবার যথারীতি স্কুল পরিদর্শনে এলেন পরিদর্শক সাহেব। প্রধান-শিক্ষক সাহেবকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখলেন সব। গোটা স্কুলটি যেন এখন সীমাহীন নীরবতায় ডুবে আছে। প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর মাথা নিচু। কেউ টু শব্দটি পর্যন্ত করছে না। এমন শান্ত ভদ্র ছাত্রছাত্রী যেন জগতে আর নেই। পরিদর্শক সাহেব প্রধান-শিক্ষক সাহেবের কক্ষে যতক্ষণ বসলেন, তিনি খেয়াল করলেন, শিক্ষকরা কী চমৎকারভাবে ক্লাস নিচ্ছেন। সর্বত্র পিনপতন নীরবতা। বিন্দুমাত্র হৈ-হুল্লোড়ের আভাস এলো না কোনও শ্রেণীকক্ষ থেকে। পাঠদান, পাঠ গ্রহণের অনুপম এক পরিবেশ বিরাজ করছে।
পরিদর্শন কাজ শেষে মোটরসাইকেলে চেপে বিদায় নিলেন পরিদর্শক সাহেব। মনে বেশ কিছু খটকা তার রয়েই গেল। চিন্তিত মনে মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন তিনি। কিছুদূর পথ অতিক্রম করে এসে তিনি মোটর সাইকেল এর বাঁক ঘুরিয়ে তার এক পুরনো ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। সেখানে হালকা আপ্যায়ন ও খানিক বিশ্রামের ফাঁকে বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ আলাপচারিতায় লিপ্ত হলেন।
আধো ঘন্টা পর বন্ধুর বাড়ি থেকে ছদ্মবেশে বেরিয়ে স্কুলটির পাশ দিয়ে হাঁটতে লাগলেন পরিদর্শক সাহেব। পরনে পুরনো জীর্ণ লুঙ্গি, গায়ে হাফহাতা ময়লা গেঞ্জি, গলায় গামছা ঝোলানো, হাতে কাস্তে। এরই মধ্যে স্কুল ছুটি হয়ে গেছে। ছাত্রছাত্রীরা এলোপাথাড়ি ছুটছে। তিনি লক্ষ্য করলেন কী একটা বিশেষ হই-হট্টগোল লেগেছে স্কুল ও তার আশপাশের পরিসর জুড়ে! চেঁচামেচিতে যেন কান ফেটে যাবে। স্কুল ছুটিতে হই-হট্টগোল, চেঁচামেচি থাকেই, কিন্তু এ চেঁচামেচিতে ভিন্ন কিছু আছে। সবার মুখে মুখে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে একই তাচ্ছিল্য সুর: আইছিল মেসপেট্টার সাপ ! লেইজআলা মাস্টার! ইয়া বড় ল্যাঞ্জা গো! কী ল্যাঞ্জার ল্যাঞ্জা!
ছোটরা কণ্ঠগুলোকে এমন করছিল যেন তারা ছাত্রজীবনের বয়সটা বহুদূর পেছনে ফেলে এসেছে। অনেকে সম্মিলিত কণ্ঠে শ্লোক হাঁকছিল –
লেইজআলা মাস্টার
ছুঁইড়া মারো ডাস্টার।
ও-ই লেইজআলা মাস-টার
মারো ছুঁইড়া ডাস্টার!
চারপাশের পথগুলোতে ছাত্ররা যেমন শব্দগুলো উচ্চারণ করছিল, তেমনি করছিল অভিভাবকরা, পান খাওয়া মুখে হেসে হেসে তাদের সাথে তাল মেলাচ্ছিলেন দু-একজন শিক্ষকও। পরিদর্শক সাহেবের চেহারাছবি নিয়েও হচ্ছিল নানা ব্যঙ্গ-কথন। পরিদর্শক সাহেব অচেনা অজ্ঞাত ব্যক্তির ন্যায় মাথা নিচু হেঁটে ছেড়ে গেলেন জায়গাটি।
সপ্তাহ খানেক পর পরিদর্শক সাহেব প্রধান-শিক্ষক সাহেবকে এক চিঠি পাঠালেন এই মর্মে যে তিনি একজন নতুন শিক্ষকের দক্ষতা যাচাইয়ের জন্য তাকে তার স্কুলে ক্লাস গ্রহণের জন্য পাঠাচ্ছেন। তাকে যেন ক্লাস নেয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। উল্লিখিত শিক্ষক তার নিজের চেনাজানা কেউ নয়, ওপরের চাপে বাধ্য হয়ে দু তিন দিনের জন্য তাকে ক্লাস নিতে পাঠাচ্ছেন। তিনি বা ওপর মহল যে তাকে ক্লাস নেয়ার উদ্দেশ্যে সেখানে পাঠাচ্ছেন, প্রধান-শিক্ষক সাহেব যেন সে বিষয়টি শিক্ষক শিক্ষার্থী সহ সকল মহলে সম্পূর্ণ গোপন রাখেন।
পরের সপ্তাহে স্কুলটিতে যথারীতি আধুনিক বেশভূষার নবাগত এক নবীন শিক্ষকের আবির্ভাব হলো। শিক্ষক প্রথমেই প্রধান-শিক্ষক সাহেবের সাথে দেখা করে নিজের পরিচয় দিলেন। প্রধান-শিক্ষক সাহেব তাকে শীতল অভ্যর্থনায় গ্রহণ করে খানিক বাদে ক্লাসে ক্লাসে নিয়ে গিয়ে দায়সারা গোছের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
নতুন শিক্ষক পড়ানোর উদ্দেশ্যে একে একে বেশ কটি ক্লাসে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, সেগুলো এত বেশি গোলমেলে যে গ্রাম্য হাটবাজারও বুঝি সে গোলমালের কাছে হেরে যাবে। তার উপস্থিতি সেই নজিরবিহীন গণ্ডগোলে সামান্যতম প্রভাবও ফেলছিল না। তিনি এক ক্লাস থেকে বেরিয়ে আরেক ক্লাসে যেতেই পেছন পেছন প্রধান শিক্ষক সাহেব সেই ক্লাসে হুড়মুড় ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের কৌতুকপূর্ণ মুখাবয়বে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কেমন পড়িয়ে গেলেন। প্রধান-শিক্ষক সাহেবের মুখাবয়বের দিকে লক্ষ্যপাত করে অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী এক বাক্যে চেঁচিয়ে বলে যাচ্ছিল, ভালো না স্যার! ভালো পড়ায় না মোটেও।
ওনাকে কেমন শিক্ষক মনে হলো?
উনি ভালো শিক্ষক না, স্যার! কী পড়ায় বুঝা যায় না!
সত্যি বলছো সকলে?
জি-ই, ছ্যা-ড়! তিন সত্যি!
অকে, অকে, বসো সকলে, বসো।
জি-ই ছ্যা-ড়!
প্রধান-শিক্ষক সাহেব ছাত্রছাত্রীদের মন্তব্যের সাথে রহস্যময় মাথা নেড়ে নেড়ে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছিলেন, শিক্ষকতায় যোগ্যতা একটা ব্যা-পা-র! থাকা চা-ই তা –!
নবাগত শিক্ষক এবার সর্বশেষ ক্লাসটিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। স্কুলের সবচেয়ে বড় ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস এটি। এটিতে এসেই তিনি খেয়াল করলেন ছাত্রছাত্রীরা যেমন খুশি তেমন আচরণ করছে। তিনি ঐকান্তিক উপস্থাপনায় অনেক করে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন। কিন্তু নিষ্ফল। কে শোনে কার কথা? তার প্রতি ন্যুনতম মনোযোগও তারা কেউ দিচ্ছে না। কেউ হাত পা নাড়াচ্ছে, কেউ গা মাথা চুলকাচ্ছে, কেউ হাত ধরাধরি করছে, একে অপরকে ঠেলা দিচ্ছে, কেউ বা কাগজ দিয়ে উড়োজাহাজ বানিয়ে ওড়াবার চেষ্টা করছে ।
কিছুক্ষণ চুপচাপ লক্ষ্য করার পর শিক্ষক জোরেশোরে বলে উঠলেন, প্রিয় শিক্ষার্থীরা, আমি তোমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, প্লিজ, এদিকে মনোযোগ দাও, সবাই শোনো আমার কথা। আমি গুরুত্বপূর্ণ কিছু পড়াতে এসেছি তোমাদের,নিশ্চয়ই আমি ভালো পড়াব। আগে আমার পরিচয়টা দিই।
শোনো–
কেউ কোন ভ্রুক্ষেপ করল না। শিক্ষক নিজের নাম পরিচয় নিয়মতান্ত্রিক ঘোষণা করলেন। তারা তেমনই রইল। এবার শিক্ষক ব্যাগ হাতড়ে কতগুলো রঙিন ছবি বার করলেন। নানা প্রকারের ফুলের ছবি। ছবিগুলোসহ বোর্ড বরাবর উঁচিয়ে বললেন, এই যে দেখো সবাই। আর তখনই একদল ছাত্রছাত্রী পেছন থেকে হো হো করে হেসে উঠল। তারা বলল, ফুল! হাঃ হাঃ হাঃ! ফয় রস্যুকারে ফু, ল, ফুল! এ আবার পড়ানোর কী হলো?
এবার শিক্ষক ব্যাগ থেকে একটা নরকঙ্কালের ছবি বার করে বোর্ডে আটকালেন। আর সাথে সাথে সারা ক্লাস জুড়ে প্রচণ্ড অট্টহাসির রোল পড়ে গেল। শিক্ষকের মনে হতে লাগল তিনি যেন কোন ভূতের আস্তানায় এসে পড়েছেন। আরও কিছুক্ষণ তিনি তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালালেন। কিন্তু নিষ্ফল। তার মনে হতে লাগল নিজ হাতে আঁকা নরকঙ্কালের ছবিটা যেন কার্যকারিতায় লাফিং গ্যাসকে অতিক্রম করে গেছে।
শিক্ষক এবার শান্ত ধীর চিত্তে বোর্ড পেছনে রেখে টেবিল সামনে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন। পুরো ক্লাসটি নজর করে দেখলেন। মাথা নিচু করলেন তিনি। মাথা থেকে হ্যাটটি নামিয়ে সন্তর্পণে টেবিলের ওপর রাখলেন। ওপরে তাকালেন। অট্টহাসিগুলো যেন দ্বিগুণ হলো। এবারে তিনি নাকের নিচ থেকে আলগা গোঁফটি একটানে খুলে ফেললেন। হাসি একইভাবে চলল। এরপর তিনি থুতনিতে টান দিয়ে ফ্রেঞ্চকাট আলগা দাড়িটি খুলে ফেললেন। পকেট থেকে চশমাটি নিয়ে দ্রুত পরে ফেললেন চোখে।
এখন নিস্তব্ধতা। তামাম ক্লাসটি যেন সিনেমা পর্দায় হঠাৎ আটকে যাওয়া নির্বাক স্থিরচিত্র হয়ে গেছে। শিক্ষক পুরো ক্লাসে দৃষ্টি ঘোরালেন। প্রতিটি মাথা নিচু। এক দুজন যারা সাহস করে মাথা তোলার চেষ্টা করল, তাদের চোখে ভয়ার্ত চাউনি। তারা পরম বিস্ময় ভয়ে দেখছে তাদের সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আর কেউ নন, সেদিনের পরিদর্শনে আসা সেই পরিদর্শক। সেই বিশেষ চেহারা ছবি, থুতনির গোল কালো দাগ, গলায় ঝোলানো আইডিতে নাম পদবী লেখা। ত্বরিত মাথা নামিয়ে তারা ফিসফিস করে ইন্সপেক্টর শব্দটি উচ্চারণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। পরিদর্শক সাহেব লক্ষ্য করলেন ভয়ে সবাই কাঁপছে। তিনি গলাখাঁকারিতে বললেন, প্রিয় শিক্ষার্থীবৃন্দ,কী হলো তোমাদের? হঠাৎ এভাবে নীরব হয়ে গেলে সবাই! মাথা তোলো তোমরা।
কেউ কেউ মাথা তুলে তাকালেও তাৎক্ষণিক দৃষ্টি নামিয়ে ফেলল।পরিদর্শক সাহেব একটু জোরেশোরে বললেন, এত ভয়ের কী আছে? সেই একই তো মানুষ আমি, যে একটু আগে তোমাদের চুপ রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা করে আসছিলাম। তোমরা ভ্রুক্ষেপ করোনি। সেই মানুষ, সেই হাত পা মন মস্তিষ্ক। এখন কী এমন ঘটল এমন ভয় করছো আমাকে? ভয় পাচ্ছ, নাকি অন্য কোনও হেতু?
স্যার, ভয়! একজন ছাত্র সাহস করে দাঁড়িয়ে বলল।
অন্যদের কী? সবার কি একই কারণ?
জি স্যার। সমবেত কাঁপা কণ্ঠে কজন বলল।
না না,ভয়ের কিছু নেই। এই আমি আর কিছুক্ষণ আগের আমিতে মৌলিক কোন পার্থক্যই নেই। যা কিছু পার্থক্য তা গৌণ মামুলি বেশভূষায়। কিন্তু একই উদ্দেশ্য দুই আমিতে। তা হচ্ছে তোমাদের পড়াতে চাওয়া। নাকি তোমাদের কাছে বিশেষ কোন পার্থক্য আছে বলে তোমরা গণ্য কর?
জি স্যার, আছে। একজন বলল।
কী তা?
স্যার, আপনি ইন্সপেক্টর!
তার মানে আমি যখন ইন্সপেক্টর, তখন তোমরা আমাকে ভয় ও সম্মান করো, আর যখন আমি সাধারণ শিক্ষক, তখন ভয় সম্মান কোনটিই তোমাদের তরফ থেকে নেই । ঠিক বলেছি কি না?
জি স্যার, না স্যার –। আমতাআমতা করল কজন।
আসলে কিসে ভয় পাও তোমরা ? মানুষের শক্তি, ক্ষমতা,পদ পদবীকে- নাকি তার নীতি, নৈতিকতা, জ্ঞানগরিমা ,আদর্শ- যোগ্যতাকেও?
কেউ কোন কথা বলল না। পরিদর্শক সাহেব বলে চললেন, যিনি জ্ঞান দেবেন তার শক্তি, ক্ষমতা কতদূর কী, তারচে’ তার জ্ঞানগরিমা কতদূর কী সেটির বিবেচনাই কি মুখ্য নয়? আর সেই জ্ঞান গ্রহণের জন্য যে সুষ্ঠু স্বাভাবিক পরিবেশ প্রয়োজন তা তৈরিতে ন্যূনতম আগ্রহ, সদিচ্ছা তোমাদের নেই। সত্যিকার অর্থে মানুষকে বশের জন্য জ্ঞানই প্রধান হাতিয়ার। কারণ, জ্ঞানগরিমা বলেই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীব। অন্য জীবের ওপর জ্ঞান-হিতোপদেশ কার্যকর হয় না বলেই তাদের বশে প্রয়োজন পড়ে শক্তি, কৌশল, ক্ষমতার। আর মানুষের শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যই হচ্ছে অন্য জীব থেকে নিজেদের পৃথক করা। এক্ষেত্রে ঐকান্তিক ইচ্ছা প্রচেষ্টাই মুল চাবিকাঠি। যেকোনো মূল্যে অস্তিত্বে তা জাগাতে হবে।
এটুকু বলে ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। পেছনে তখন পিনপতন নীরবতা। হেঁটে মাঠ পেরোবার ফাঁকে তিনি ভাবলেন, স্কুলটিতে খুব শীঘ্রই তিনি আবার পরিদর্শনে আসবেন। কারণ, তিনি পরিদর্শক।
বিবর্ণ – শওকত নূর [Bibarna]
দৌড়ে ভেজা বাংলোর পেছনে অদৃশ্য হলো লোকটা। দু’পাশে অনুচ্চ গাছের সারির লন ধরে যেভাবে দৌঁড়াচ্ছিল সে তাতে আদিবের মনে হয়েছিল বৃষ্টির তাড়া খেয়ে বন্ধ বাংলোর দরজায় নিজেকে সঁপে দেয়াই বুঝি হবে তার একমাত্র অভীষ্ট। কিন্তু বাংলোর দিকে সে ন্যূনতম ভ্রুক্ষেপ করেছে বলে মনে হয় না। দৌড়ালেও তার মাথা ছিল রীতিমত মাটির দিকে। বাংলোর নিশানাটা যেন তার চোখের তারায় গাঁথা। আদিব পা বাড়াতে গিয়ে থামল। বৃষ্টির বেগ কমার পর্যায়ে এসে এখন এমন বেড়েছে যে এ পাহারা ছাউনি ত্যাগ করার প্রশ্ন জাগে না। পাহারাদারের ক্লান্ত, ক্লীষ্ট, জীর্ণ-আধো ঘুমন্ত মুখমণ্ডলে দৃষ্টি নামছে তার থেকে থেকে। আবার মুহূমূর্হু বজ্রের বিকট শব্দে উঠে যাচ্ছে আকাশে। আকাশ তো নয় যেন পাগলাটে রাজবন্দীর ফ্যাকাশে দীর্ঘ এলো-জটা চুল।
সূর্য পশ্চিমাকাশ ধরেছে খুব বেশি সময় হয়নি, তবু কোনও জ্যোতির্লৌকিক মারপ্যাচে মেঘগুলো কালো রঙ-বিবর্তন থেকে এমন উন্মত্ত হতশ্রী ভাব নিয়েছে। আদিব কাঁধের ব্যাগ হাতড়ে পানির বোতল বের করে ছিপি খুলে গলা ভেজালো। তীব্র ক্ষুধায়, আহারহীনতায় এই অগত্যা ও একমাত্র দাওয়াই। পানির বোতল ব্যাগে পুরতে গিয়ে রীতিমত লাফিয়ে উঠলো সে। ভয়াল শব্দে আগুন খণ্ড ছিটকে যেতে দেখল সে বাংলোর পেছনের বনভূমির সবচে’ লম্বা গাছটার মাথায়। খানিকটা চিন্তিত হল আদিব।
বাংলোর পেছনে কিছুটা জায়গা জুড়ে অচেনা ফসলের খেত, কোন ঘরবাড়ি নেই। তারপরই বন। লোকটা ওদিকে গেল কোথায়? গত চারদিনে এ পথে তিনবার মুখোমুখি দেখেছে সে লোকটাকে। বেটেখাটো গড়ন, নাক বোচা, রং তামাটে, নাকের নিচের গোঁফ জোড়া আটখানা। মুখোমুখি হলে হঠাৎ মুখ তুলে প্রতিবার বিবর্ণ রহস্য চোখে তাকিয়েছে সে। এই প্রবল দুর্যোগে ওদিকে গেল কোথায় সে, তার স্থায়ী নিবাসই বা কোথায়? এ মুহূর্তে সে কী অবস্থায় আছে?
হঠাৎ নাসারন্ধ্রে তরকারীর গন্ধ ঢোকায় চমকে নিচে তাকালো আদিব। দেখলো ঝিমভাব কাটিয়ে দিব্যি মুখে খাবার তুলছে পাহারাদার। কী খাচ্ছে সে ? মোটা ভাত, এক লকমা ভর্তা, খানিকটা শাক ও অচেনা কোনও মাছের তরকারী। তরকারীর গন্ধটা যেন চিরচেনা। একই দেশে এমনই হয় বুঝি। জিভে জল এসে গেল তার। পেটুকতায় নয়, একান্তই ক্ষুধায়। খাওয়ার ফাঁকে পাহারাদার ঢি’ ঢি’ করে তাকাতে লাগল তার দিকে। ভেতরের বিরক্তির কিছুটা যেন মিশে বেরোচ্ছিল তার দৃষ্টির সাথে। আদিব এবার ভাবনায় ডুবে গেল। আজ নগরের যে অচেনা পথ ধরে সে ঘণ্টা দুই আগে ঘণ্টা খানেক ধরে হেঁটেছে, তা ছিল এক বিবর্ণ পথ। বিবর্ণ এই অর্থে যে প্রায় এক কিলোমিটারের সরল পথটির কোথাও সে ন্যূনতম প্রাণোচ্ছলতা দেখতে পায়নি।
পিচ খসা, ইট বের হওয়া তামাম পথটি ধুলি-ধূসর। দুপাশে সারি সারি ঠেলা ভ্যান দাঁড়ানো। কোনটি খালি, কোনটিতে আছে আখের ছোবড়া, কিংবা ইট খোয়া অথবা সিমেন্টের বস্তা। পথের দুধারে বসে থাকা প্রতিটি মুখ বিবর্ণ, ক্লান্ত- অবসন্ন। কেউ ঝিমাচ্ছে, কেউ ঘুমঘোরে, দলবদ্ধ অনেকে খাবার গিলছে। একই দৃশ্য দীর্ঘপথ জুড়ে। দুপাশে কৌতূহলী নজর রেখে চলছিল আদিব। নিজে ক্ষুধার্ত বলেই হয়তো বেশি বেশি দৃষ্টি আটকাচ্ছিল খাবার দৃশ্যে। প্রতি প্রেক্ষিত অতিক্রমে একই তরকারীর গন্ধ তার নাসারন্ধ্রে ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিক্ষেত্রে পরিবেশক বয়োঃবৃদ্ধা জীর্ণবেশ কোনও নারী।
একটি জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ালো আদিব। এখানকার জটলায় খাদ্য পরিবেশকের মুখমণ্ডল তাকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। পরিবেশকের মুখমণ্ডল এত বেশি ভাজ খাওয়া আর এতটা জীর্ণ ক্লিষ্ট ও বয়সের ছাপের সাথে দুর্বলতার চিহ্নধারী যে ভীষণ মায়া হল তার। খানিকটা নস্টালজিক হয়ে উঠল সে। নিজের দাদীকে সে শৈশবে হারিয়েছে। ক্লাস টু থ্রিতে পড়ে এমন বয়সে। বয়স শ এর কাছাকাছি গেছিল। পা বিছিয়ে বসে পায়ের ওপর নিয়ে থাকত সে তাকে। নানা গল্প করত। নাওয়া খাওয়া ভুলে যেত সে। তার দাদী যেই বলত, এত যে মায়া করস, আমি মরলে কেমন করবি? আর হয়েছে, এ কথার প্রভাব মুহূর্তে তাকে এমন নাড়া দিত যে হাউমাউ শব্দে তার ঘণ্টা কয়েক চলে যেত অপ্রতিরোধ্য। অশ্রুসিক্ত অবাধ্য টানা এক প্রশ্ন ঝরত -দাদী মরবে কেন?
অতিক্রমান্তে হাত দুই এগিয়েও থমকে দাঁড়াল আদিব। দৃষ্টি তার স্বতঃস্ফূর্ত ঘুরে গেল খাদ্য পরিবেশন দৃশ্যে। খাদ্য গ্রহণকারীগণও যে সতেজ-সবল তা আদৌ নয়। প্রত্যেকে শ্রমিক, নির্জীব নির্লিপ্ত খাদ্য গিলছে- সম্ভবত প্রায় বিনা বিশ্রামে। শীঘ্র কাজে হাত লাগাতে হবে বিষয়ক দুশ্চিন্তা ঠাঁই করে আছে মাথায়। পাশের খালি ঠেলা ও ভ্যানের ওপর দু একজনার সটান চোখবন্ধ শুয়ে থাকার দৃশ্যপটও তার নজর কাড়ল। কিন্তু মুহূর্তে তা ফিরে এসে স্থায়ী হল বৃদ্ধার আপদমস্তকে। এই ছাত্রজীবনে এ নগরীর নানা পথে সময় সময় সে অতিক্রম করেছে। কিন্তু আজকের মতো এভাবে একই অচেনা পথে দীর্ঘক্ষণ হাঁটেনি। এমন দৃশ্যপটও এভাবে আগে নজরে আটকায়নি। ব্যথাতুর বিস্ময়বোধ আচ্ছন্ন করতে লাগল তাকে। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো অসুস্থতা আক্রমণ করে তাকে। শরীর স্বাভাবিকের চেয়ে দুর্বল করে দেয়। তা দিয়ে সে বৃদ্ধার অসহায় অবস্থাটার প্রকৃত স্বরূপ স্বতঃস্ফুর্ত জাগা বোধের সাথে অনুভব করল। যার কিনা নিজেকে সচল রাখার সক্ষমতাই লুপ্তপ্রায়, তাকে পেটের দায়ে জীবিকায় নামতে হয়েছে। তাও আবার নগরের রাজপথে, অচেনা সব মানুষদের খাদ্য পরিবেশনে।
পরিবেশনের কাজটি যেহেতু তাকে করতে হচ্ছে, রান্না, কেনাকাটার কাজ তথা বাসস্থান, যা কিনা ধারেকাছে হবার ন্যূনতম সম্ভাবনা নেই, তা থেকে নিজেকে বের করে হেঁটে কিংবা কোনও সরল যানে করে এ পর্যন্ত পৌঁছার কাজটি তার স্বনির্ভরতায়ই করে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। কোনও সহযোগী কি আদৌ থেকে থাকবে ? আশেপাশে দেখা তো যাচ্ছে না তেমন কাউকেই। যদি তার তেমন কেউ থেকেই থাকে তবে তাকে কেন জীবিকায় নামতে হয়েছে? কম্পমান হাতে থালায় থালায় ভাত তরকারী তুলনা দেয়ার দৃশ্যটি এমন সব প্রশ্নপাতের উদ্রেক ঘটায় যা থেকে সক্ষম সমাজ কোনমতে কোনও যৌক্তিকতায় নিজেদেরকে দায়মুক্ত ভাবতে পারেন না। এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন আদিবের মনে ঘন ঘন আঘাত করে চলেছে- কেন তাকে এ বয়সে এ হেন ন্যূনতম অর্থে বেঁচে থাকার দশায় জীবিকায় নামতে হয়েছে, রান্নার কাজটি তার নিজেকেই সারতে হয় কিনা, কেনাকাটা কে করে, এ কাজে তার দৈনন্দিন কত উপার্জন, কোথায় নিবাস, জগৎ-সংসারে নৈতিক অর্থে দেখভালের কেউ সত্যিকারে আছে কি নেই প্রভৃতি।
সে ভাবল তার হাতে একটা মাউথ পিস ধরণের কিছু কিংবা কাগজ-কলম কিছু থাকলে কিছুটা ভালো হত। ফুটপাতে এ ধরণের দৃশ্যপটে এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে নগরীতে কিছু নেতিবাচক জন-ধারণা থাকে। কারণ, চাঁদাবাজদের চাঁদাহরণ তালিকায় নিরীহ সবল বলতে কোনও কথা আদৌ থাকে না। এ প্রেক্ষিতে নিরীহরাই সম্ভবত বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। সাতপাঁচ ভেবেও নিজেকে সংবরণে সমর্থ্য হল না সে। মনে উত্থিত প্রশ্ন ঝড়ের নিবারণটা আবশ্যক গণ্যে এগিয়ে গেল চেহারা বেশে নিজেকে ভালোমানুষের মতো দেখাবার আত্মবিশ্বাস নিয়ে। কাঁধের ঝোলা ব্যাগটি তাতে সমর্থন যোগালো। দাঁড়িয়ে মাথা ঝুঁকল সে, এখানে কাজ করছেন?
হ বাবা! ভাত খাবা ?
না, আমার ক্ষুধা নেই।
কিছু জিগাবা ?
হ্যাঁ, আগে কেউ কি কিছু জিগিয়েছে ?
হ বাবা। একজন জিগাইছে একদিন।
কী?
এই বয়সে কাজ কইরা খাই কেন ? কষ্ট হয় নাকি?
কী বললেন ?
কী কমু, বাবা ? কাজ না করলে খামু কী ? খোদায় মরণ তো দেয় না।
তা আর কেউ নেই আয় রোজগারের ?
না বাবা, থাকলে কি আর আধা যাওয়া দশায় কাজ করতাম ?
কতদিন হল এখানে খাবার পরিবেশন করেন?
দুই বৎসর।
তার আগে কী করতেন ?
ঘরের কাজকর্ম করতাম।
তখন কে উপার্জন করতেন ?
আমার স্বোয়ামী।
উনি বেঁচে আছেন ?
না থাকার মতোন।
কী হয়েছে ? অসুস্থ ?
হ বাবা, মরার মতন বাঁইচা আছে।
কোনো অসুখ ?
হ বাবা, ঠ্যালাগাড়ি চালাইত। এই পথেই ইস্টোক হইছিল দুই বৎসর আগে। জবান বন্ধ। হাতপাও অবোশ। খালি কান্দে আর কবার চায়, মরণ নাই ক্যান ?
আপনার কোন ছেলেমেয়ে ?
এক মাইয়া, এক ছাওয়াল।
তারা কী করেন ? দেখেন না আপনাকে ?
মাইয়ার জামাই জামা কাপড় ফেরি করে। তাগোর নিজেগোই চলে না।
ছেলে ?
বস্তিত থাকে। ইস্টিশনের মাল টানে। একদিন কাম করলে তিনদিন বইয়া কাটায়। খালি গানবাজনা হুনে। আজেবাজে জিনিস খায়। দুইবার পুলিশে ধরছে।
এখানে আসেন কীভাবে ? বাজারঘাট কে করে?
এক খালাত ভাইয়ের ছাওয়াল আছে। ওই যে ওই মাথাত দারোয়ানের চাকরি করে। হেই আনা নেওয়া করে। বাজারঘাট বেশির ভাগ নিজেই করি।
থাকেন কোথায় ?
শহরের ওই মাথাত।
এখানে ক’টা পর্যন্ত থাকতে হয়?
বেইল ডুবার আগে ভাইয়ের ছাওয়াল ডিউটি শেষে ভ্যানে তুইলা নিয়া যায়। আইজ আছর ওক্তে যাওয়ার কথা কইছে।
তা দিনে যা উপার্জন হয়, তাতে ভালোমত চলে?
কোনোমতে দিন যায়। ওষুধে ম্যালা ট্যাকা যায়। মাঝেমধ্যে ট্যাকার অভাবে ওষুধে ঠ্যাক পড়ে।
আচ্ছা, আপনার কাজের ক্ষতি করলাম। কিছু মনে করবেন না।
না বাবা, কী মনে করমু?
ভালো থাকবেন, চলি। এ পথে যদি আবার আসি, কথা বলব।
আইসেন, বাবা।
ভাবনাঘোর কেটে আকাশে মুখ তুলল আদিব। বৃষ্টি নেই, মেঘ সরে রোদের ভাব ফুটে উঠেছে। সামনের গাছ সমেত বাংলোটাকে জল রঙে আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছিল তার চোখে। দ্রুত পা বাড়াল সে। লন পেরিয়ে চলে এলো বাংলোর সামনে।
শুকনো খাবারে আজ মুখ ফিরে আসছিল আদিবের। দুদিন ধরে এমনই সে খাচ্ছে। পড়াশোনার একটা পর্যায় তার এ শহরেরই অন্য এক প্রান্তে থেকে কেটেছে। এখনও পড়াশোনাই চলছে অন্য শহরে। এখানে সে এসেছে চাকরির খোঁজে। পড়াশোনার ফাঁকে সময় সময় চাকরির খোঁজ। এ বাংলোর অধিবাসী তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়। সপরিবারে বেড়াতে গেছেন তিনি সে এখানে এসে ওঠার দিন রাতেই। কাল তাদের ফিরে আসার কথা। তারা ফিরবেন, আদিব ছেড়ে যাবে। রান্নাভাবে এখন শুকনো খাবারেই সে ভরসা করছে। খেতে গিয়ে বার বার মনে পড়ছে রান্না করা তরকারীর সে ঘ্রাণের কথা। এখান থেকে চলে গেলেই যেন এ অবস্থা থেকে পরিত্রান।
হোটেলের খাবারে সে অভ্যস্ত নয়, তবু দিন দুই দুপুরের খাবার হোটেলে সেরেছে। এখন চলছে শুধু পাউরুটি, কলা বিস্কুট চিড়া মুড়িতে। চিড়া চিবানোর ফাঁকে জানালা থেকে হঠাৎ রোদ বিদায় নেবার দৃশ্যে দৃষ্টি গেল তার। আবারো বুঝি আকাশে মেঘ জমছে। ভাবতে ভাবতেই ঝমঝম করে শুরু হল বৃষ্টি। আবারো সেই বজ্রপাত। খাওয়া সেরে দ্রুত হাত ধুয়ে দৃষ্টি দিল সে পুবের জানালায়। ফসল মাঠটি মুরগী ভেজার মতো মৌন হয়ে গেছে। ভেজা বন নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে গা খালি পিশাচের মতো। তার মনে পড়ল সেই লোকটির কথা। এ চত্বরের দারোয়ানের সাথে যোগসাজশে সে লন পেরিয়ে ওপাশের কেচি গেইট দিয়ে বেরিয়ে যায়। ডুপ্লিকেট চাবিও তার আছে। কিন্তু ওদিকে থাকে সে কোথায়? বনের মধ্যে কোনও নিবাস? ভাবতে ভাবতে তদ্রাচ্ছন্নতা বোধ করে সে। জানালা চাপিয়ে বিছানায় শুয়ে চোখ বোজে সে।
ঘুম ভাঙার পর বারান্দায় মৃদু কথোপকথনের শব্দ পেল সে। ঘরের লাইট বন্ধ থাকায় টের পেল, হয় বেলা ডুবেছে, নয়তো আকাশ খুব বেশি মেঘাচ্ছন্ন হয়েছে। বাইরে সূর্যালোক থাকলে ভেতরে এতটা অন্ধকার হয় না- এ ক’দিনে সে তা লক্ষ্য করেছে। কারা চাপা কথোপকথন চালাচ্ছে, খানিকটা ফিসফিসানোর মতো? উঠে পুবের জানালা খুলল সে। সূর্যাস্ত যায়নি- আকাশের ওপাশটা ফ্যাকাশে ও বাষ্পাকারে গুড়িগুড়ি অতি মিহি বৃষ্টি হচ্ছে। বনাংশ কুয়াশাবৎ। সে একবার ভাবলো আবারো বিছানায় গা এলিয়ে দেবে। কিন্তু সিদ্ধান্ত পাল্টে দরজা খুলে দিল। হকচকিয়ে যাবার অবস্থা তৈরি হলেও নিজেকে সামলাল সে। নাটক সিনেমায় প্রায়শ এমন কাকতালীয় ঘটনা নির্মাতাদের দ্বারা ঘটানো হয়, যার বাস্তবতায় সর্বদাই তার নিজস্ব অবস্থান দোটানা থাকে। সেই বৃদ্ধা বারান্দা-কোনার প্লাস্টিক চেয়ারে বসা। কাছেই বেটেখাটো ওই লোকটা, যাকে দিয়ে এ গল্প শুরু, সে দাঁড়ানো। বৃদ্ধা বোধ করি ভুলে গেছে তার চেহারাছবি। এখন তো তার বেশভূষা একেবারে ভিন্ন। গায়ে শার্টের পরিবর্তে স্যান্ড্রো গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি।
আজ কি আপনার সাথে দুপুরে কথা হলো? বলল সে।
আপনে ক্যাঠায় ? বৃদ্ধা জবাব করল।
ওই যে দুপুরে যে পথের ধারে নানা কথা জিজ্ঞাসা করলাম, আজ দুপুরেই!
ও বাবা, আপনে সে-ই ছাওয়াল।
হ্যাঁ, আপনি এখানে কোত্থেকে এলেন ?
এনার বাসা, বাসা ওই ধারে। সাথের লোকটা বলল।
ওদিকে কোথায়?
ওই যে পুবে কেচিগেট। পরের ফসলের খেত। তারপরে বন ঘেইষা আরেক কেচিগেট। তার বাইরের ফুটপাতের পর টিনের বস্তিঘর আছে, চিনেন ?
না, ওদিকটায় যাওয়া হয়নি।
এনার লগে বুঝি কথা হইছে?
হ্যাঁ, আজ দুপুরেই, রাজপথে।
বৃষ্টি খুব না। কিন্তুক হাঁফাইয়া উঠছে। ম্যালা বয়স হইছে তো। ভাবলাম একটু জিরাইয়া লই। অহন দেহি মোক্ষম জায়গাত আশ্রয় লইছি। মনে মনে ভয় করতাছিলাম। আপনেরে দেখছি দুইদিন, তারপরেও।
সমস্যা নেই, বসুন। জিরিয়ে বৃষ্টি থামলে যান।
কথা সেইটাই। তা এ বাংলার মালিকে আপনার কী লাগে?
আমার বাবার ফুঁপাতো ভাই।
হ্যায় কবে আসতাছে বেড়াইয়া?
কালই, দুপুরে।
আপনে ওনাদের সাথে…।
না, থাকব না আমি , কালই চলে যাবো। ওনারা দুপুরে আসবেন, আমি বিকালে চলে যাবো।
বাড়ি কই?
পঞ্চগড়।
ও…। ফুবু কি ঘুম গেলা নাকি? ও ফুবু।
না। শরীল দুর্বল। চোখ বুনছি।
উনি কাইল চইলা যাইতাছে, দূরে।
বাবা, কাইলই যাবা ? আরেক দিন না কথা কবা কইছিলা।
হ্যাঁ, আবার এ শহরে আসলে বলব।
মাফ কইরো বাবা, আমি তোমারে তখন বুঝবার পারি নাই। কত রকম মানুষ পথে ঘুরে ফিরে।
কেন, কী হয়েছে ?
তোমারে ভাত খাবার কইছি।
ও হো…। তাতে কী হয়েছে ? আপনি মুরুব্বী মানুষ। আমার যে ক্ষুধা তখন লেগেছিল! মনে হচ্ছিল আপনার খাবারগুলো খুব স্বাদের হবে।
আর বাবা স্বাদ, গরিবের খাবার! যাও বাবা, ঘরে যাও। আযান পড়ব বুঝি।
হু ফুবু, লও যাই অহন। ফুবায় বোধ করি কান্নাকাটি করতাছে।
লও যাই।
তারা হাঁটা ধরলে আদিব দরজা চাপিয়ে দিল। কেচি গেটটা শব্দ করে বন্ধ হল। আযান আর পাখির শব্দে কান বন্ধ হবার উপক্রম হল। পুবের জানালায় সে তাকিয়ে দেখল লোকটা বৃদ্ধাকে নিয়ে অতি ধীরে সন্তর্পণে আবছায়ায় ফসল মাঠের পার্শ্বপথ ধরে অতিক্রম করে যাচ্ছে। তীর ধনুকের মতো অবয়বে ধীরে ধীরে ওদিকে অদৃশ্য হল তারা।
সন্ধ্যাকাশে স্থানে স্থানে ধোয়াটে মেঘ, স্থানে স্থানে নীল ঘেরে তারা জাগছিল। রেলস্টেশনে গিয়ে টিকেট কেটে আনে আদিব। পরদিন বিকালে সোয়া পাঁচটায় তার ট্রেন। দূরাত্মীয়দের আসার কথা আছে দুপুরে। কিন্তু স্টেশন থেকে বাংলোয় ফিরতেই ফোনে সে জানলো তারা আসছেন পরদিন বিকাল পাঁচটায়। পথে বিলম্ব না হলে ঠিক বিকাল পাঁচটাতেই ট্রেন এসে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াবে। অতএব, আলোচনা হল আদিব বাংলোয় তালা দিয়ে চাবি নিয়ে পাঁচটার খানিকটা আগে স্টেশনে পৌঁছবে। তারা স্টেশনে নামার পর চাবি হস্তান্তর করে সে যথারীতি চলে যাবে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। স্টেশন রেস্তোরায় রাতের খাবার খেয়ে সে চলে এলো বাংলোয়।
ভোরে ঘুম ভাঙলেও আবশ্যক না হওয়ায় খানিকটা দেরিতে বিছানা থেকে উঠলো আদিব। চোখ খুলে টের পেল বৃষ্টি কেটে বাইরে রোদ উঠেছে। খাট থেকে নেমে সদর দরজা খুলে কিছুটা বিস্মিত হল সে। প্লাস্টিকের যে চেয়ারটি বারান্দার দূর কোণায় ছিল সেটি ঠিক দরজা বরাবর দাঁড়ানো। একটা সীসার টিফিন ক্যারিয়ার তার ওপর বসানো। বিবর্ণ! এখানে কে রাখল এটা? কী উদ্দেশ্য? বুঝে উঠতে পারল না সে। দরজা চাপাতে যাবে এরই মধ্যে দেখল, এ চত্বরের ছাউনি পাহারাদার দৌড়ে আসছে। একটু দূর থেকে সে হাঁপিয়ে বলল, ভাইসাব, বাটি নাদেল মিয়ায় রাইখা গেছে।
কেন ?
কইছে ভিতরে নাকি আপনের খাইদ্য আছে।
আমার খাদ্য!
জি। নাদেল মিয়ার ফুবু নাকি আপনের লাইগা দিছে। ভিতরে নিয়া রাখেন। বড় মুখ কইরা দিছে।
পাহারাদার দৌড়ে চলে যায়। ক সেকেণ্ডের মাথায় ছাউনিতে পৌঁছে এদিকে তাকিয়ে রইল সে। আদিব ইতঃস্তত বাটিটা ভেতের নিয়ে আসে। ডাইনিংএ রেখে দেয়।
সকালের নাস্তা সে পাউরুটি কলায় সেরেছে। দুপুরের জন্য চিড়াগুড় ঠিক করে রেখেছে। বার কয়েক বাটিতে হাত দিতে গিয়ে সে ইতঃস্তত করেছে। মানুষে মানুষে ভেদাভেদে সে বিশ্বাসী নয়। কিন্তু পারিবারিক ভাবেই খাওয়াদাওয়ার বিষয়ে খুঁতখুঁতে ভাবটা আছে, যা দূর করার প্রয়াস যেমন এতকাল চলেনি, দূরও হয়নি। অনুমানে সে বুঝে নিয়েছে বাটিতে কী আছে খাবার। গত সন্ধ্যায় নেহায়েত সৌজন্য বশে বৃদ্ধার খাবারের সম্ভাব্য স্বাদের প্রসঙ্গ টেনেছে সে। এ যে তারই ফলশ্রুতি সন্দেহ নেই। কিন্তু খাবে সে ? তৃপ্তির ব্যাপারটা, যা কি না স্বতঃস্ফূর্ত বাসা বেধে আছে তার অস্তিত্বে, তা? ইতঃস্তত বাটি খুলে দেখল সে। তার অনুমান শতভাগই ঠিক। সেই ভাত, মাছের তরকারি, একটু শাক, ডাল।
বিকাল তিনটা নাগাদ না খাওয়া রইল আদিব। সিদ্ধান্তহীনতা, কী খাবে- ভাত, নাকি চিড়াগুড়? তিনটায় সে অগ্রিম গোছগাছ ধরল। আধঘণ্টা পেরিয়ে গেল। বারবার খাটে উঠবোস ও মেঝেতে পায়চারি করতে লাগল সে। ভাবতে লাগল খাবারটি খাওয়া না খাওয়ার নৈতিক দায় নিয়ে। না খেলে কী হবে ? যিনি দিয়েছেন তিনি তো আর জানবেন না সে খায়নি। অতএব,–। পরক্ষণে আবার বিবেকের দায় মাথায় চাপে। ওপরওয়ালা তো জানবে গরীব বলে এক মাতৃস্থানীয়া বয়োঃবৃদ্ধার সম্মান সে গোপনে ভূলুণ্ঠিত করেছে। এরই মধ্যে ভেতরে ক্ষুধার অনুভূতিটা প্রবল হয়ে উঠেছে। সে টের পেল তৃপ্তি-অতৃপ্তি বিষয়গুলো তার অন্তরতম সত্ত্বায় এরই মধ্যে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। চাঙা হয়ে উঠেছে ক্ষুধার ধূসর রঙ। আচমকা বাটি টেনে আরম্ভ করে দিল সে। দ্রুত শেষ করে দিল যা কিছু ছিল তামাম টিফিন ক্যারিয়ারে। খাওয়া শেষে বাটিটা বারান্দার প্লাস্টিক চেয়ারে স্থাপন করল সে।
যথাসময়ে বাংলো থেকে বেরিয়ে পড়ল আদিব। দরজায় তালা দেয়ার পর প্রথমেই দৃষ্টি পড়ল তার ওই বাটিটির ওপর। বিবর্ণ! তার মনে ভেসে উঠল বৃদ্ধার খাবার পরিবেশন করা সে রাজপথটি, পথের সে তামাম দৃশ্যপট। বিবর্ণ! চেষ্টা করে বৃদ্ধার মুখটি ভালোমত চোখে ভাসাতে পারল না সে। ঝাপসা দেখাল। সে দৃষ্টি ছুঁড়ল সামনের গাছে, লনে। বিবর্ণ! লনে বেরিয়ে আকাশে তাকাল সে। আবারো ধোঁয়াটে মেঘের উপস্থিতিতে বিবর্ণ হয়ে উঠেছে তামাম আকাশ। সে বিস্ময়ে লক্ষ্য করল, সে আকাশের এখানে ওখানে নগরের ফুটপাত আর খাদ্য গ্রহণে ঠায় বসা জীর্ণ -বেশ, শ্রমক্লিষ্ট যত মনুষ্য মূর্তি এঁকে দিয়েছে কোন্ অদৃশ্য চিত্রকর। ওসব দৃশ্য আঁকতে গিয়ে তুলির রঙ নিঃশেষিত হয়ে এসেছিল বুঝি তাঁর। তাই ওসব চিত্রপট অমন রঙ-বিবর্জিত, বিবর্ণ!
কুত্তা – শওকত নূর [Kutta]
মাংসের পুটলি পাশে নিয়ে বসেছিল নফর মিয়া। ধনুক বাঁকা শরীরে মাথাটা নিচু করে বিড়িতে কষে টানের ফাঁকে খুকখুক করে কাশছিল, আর হাঁপ ধরা কণ্ঠে কথা বলছিল বস্তিবাসী তেজারত মিয়ার সাথে। দুজনের বয়সের পার্থক্য দশের কাছাকাছি হবে। নফর মিয়ার উনষাট হলে তেজারত মিয়ার উনসত্তর। তেজারত মিয়া বস্তির অদূরের সীসার তৈজস তৈরির কারখানায় শ্রমিকের কাজ করে। নফর মিয়া পার্শ্ববর্তী বাড়ির দারোয়ান। থাকে বাড়ির চৌহদ্দির এক গোডাউন ঘরে। বদলি দারোয়ান থাকায় সময়ের ফাঁক ফোঁকরে সে এসে সীসা কারখানার নিকটস্থ এক পরিত্যক্ত পথে পড়ে থাকা ভাঙ্গা বেঞ্চির ওপর বসে। দুজন মিলে সময় নিয়ে গল্প গুজব করে, পান বিড়িতে মত্ত হয়ে ওঠে।
আজ তেজারত মিয়ার কারখানায় ছুটি। অতএব, নিশ্চিন্তে আয়াস করে বসে নফর মিয়ার কথায় কান ধরে রাখছে সে। হিজিবিজি কথার ফাঁকে বিড়িতে সুখ টান দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ উবু হয়ে কাশল নফর মিয়া। প্রায় বেহুশ অবস্থা। তেজারত মিয়া তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে আছে তার কাশি-বিধ্বস্ত মুখমণ্ডলের দিকে। সে ঘন ঘন বলতে লাগল, ফাল্গুন মাসতো, কাশিমাশির সিজন এইডা। একবার এই মাসে আমারও মারোত্মক কাশি হইছিল। কাশতে কাশতে গলার ভিতরদেশ ফাইটা রক্ত বাইর হইয়া পড়ছিল। তহন আবার কলকি খাইতাম। এই সিজনে এমনতর হয়। এইবার নাহি আবার কোন ভাইরস পোকার উপদ্রব বাড়ছে।
হঠাৎই নিস্তেজ হয়ে গেল নফর মিয়া। কাশি খানিকটা দম নিলেও মাথা নিচু করে রইল সে। কিন্তু পাশেই উচ্চারিত এক মেয়েলি কণ্ঠ নাড়িয়ে দিল তাকে, বাইজান, আপনের মাংসর পোটলা কিন্তুক কুত্তায় খাবো। জরুলি সামলাইন। এইভাবে মাংস লইয়া বহন লাগে না। কুত্তায় খাবলা মারছিল বইলা। ওই মরার কুত্তা, যা, যা কইতাছি!
নফর মিয়া কোনমতে প্রথমে ঘাড় ও পরে শরীর ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখল অচেনা এক মহিলা তার পাশে দাঁড়ানো। বেশভুশায় ধরা যায় আশপাশের কোনও বাড়ির গৃহকর্মী হবে সে। এখনও সে কুকুর সামলাতে ব্যস্ত। কুকুরও একটা! যেমন নাদুসনুদুস, তেমনই নাছোড়। যেন মাংসের পুটলি খাবলে নিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে সে। মহিলা চেঁচাল, ভাইজান, জলদি পোটলা সামলাইন। বেঞ্চিত্থোন হাতে লইন। নইলি এইহান থিকা উইঠা যান গিয়া। একবার আমার হাতেত্থোন মাংসর পলিথিন লইয়া দৌড় ফালাইছিল এক কুত্তায়। যেই বাড়িত কাম করতাম, হেই দোষে হেই বাড়ির কামডা আমার চইলা গেছিল। গরিবের কথা, কেউ কি আর বিশ্বাস করে?
আইচ্ছা বুঝছি, তুমি অহন যাও গিয়া। আমি দেখতাছি।
নফর মিয়া গিট দেয়া মাংসের পলিথিন ব্যাগটা দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নিয়ে হুংকার দেয়, হালার হারামজাদা বদ কুত্তা, ভাইগা যা কইতাছি। টাহা দিয়া মাংস লইছি কি তরে খাওয়াবার লাই? এক কেজি মাংসর দাম আটশ টাহা। লোভ ছাইড়া যা কইতাছি, চাইয়া থাহিস না। ওই যাহঃ! ছ্যাবলামি করলি তর চোফার মইধ্যে কয়ডা উষ্ঠা ফালামু। ওই, যা! যা! যা!
নফর মিয়া কনুই বাগাতে থাকলে কুকুরটা নিরাশ হয়ে দৌড়ে চলে যায়। নফর মিয়া হাঁপ ছেড়ে বলে, বুঝলাইন মিয়াভাই, কুত্তার পরিমাণডা এই এলাকায় খুবোই বেশি। এই পরিমাণের কুত্তা দ্যাশের আর কুনুহানে আমি এই জীবনে দেহিনাই। রাস্তায় বাইর হইলিই খালি কুত্তা আর কুত্তা, দলে দলে কু্ত্তা। হুনলাম হইটালে বলে ইদানীং কুত্তার মাংস দিয়া বিরানি পাকায়। হ্যাতেরা কী করে? এই হালাগো কয়ডারে ধইরা ছালাত ভইরা নিয়া গেলিই তো পারে।
কুত্তার সমখা এই এলাকাত বেশি হেইডা ঠিক আছে।কিন্তু এইডা কী কইতাছেন? এইডা ভালো কতা না। হইটালে মাইনষ খাসির মাংস জাইনা কুত্তা খাইলে ক্যামতে হইব? খুবোই খারাপ হইব ব্যাপার।
খাউকগা হালার বড়লোকেরা। আমরা তো আর খামু না। এক প্যাক বিরানির দাম হুনি পাঁচ ছয়শ টাহা। হইব না ক্যান? এক কেজি খাসির মাংসর দাম এগার বারোশ টাহা। চাইড্ডিখানি কতা!
আমরা খাই না খাই, মাইনষর পক্ষে কুত্তার মাংস খাওন ভালো ব্যাপার হয় না। আপনে ভুল ভাবতাছেন। অহন বাসায় চইলা যাইন গিয়া। অতিরোক্ত কাশতি কাশতি মাথাত গণ্ডোগোল হইতাছে বোধ করি।
হইবার ফারেহ! ঝা-হা-ই, আউ-ঝ-ঘা! যাইয়া আবার খানা ফাকান লাখব! খাউচ্চু খক ফুখ! ফা-ই-ছা-ন, ঝা-ই! অফ্ ফুক! ফুউক!
নফর মিয়া চাপা কাশতে কাশতে বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরল। তেজারত মিয়া তাকিয়ে আছে তার পেছন দিক থেকে। শহরের এদিকটা অতি প্রাচীন। দালানকোঠার অধিকাংশই রঙ ও ইট পলেস্ত খসা, জরাজীর্ণ। চিপাচাপা প্রতিটি অলিগলি। এখানে ওখানে রঙ- প্লাস্টিক- সীসা কারখানা, গোডাউন, সবজি- চাল ডালের আড়ত, মুদি দোকান, মুরগির আড়ত, মাংস পট্টি – সবে মিলে রীতিমত ঘিঞ্জি।
নফর মিয়া কিছুদূর এগিয়ে যাবার পর পেছন ফিরে তাকাল তেজারত মিয়ার উদ্দেশ্যে। বেঞ্চির আশপাশটা তখন কারখানা থেকে আসা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। তেজারত মিয়াকে দেখতে পেল না সে। তার সামনেই খোলা দুর্গন্ধময় নর্দমা। যে বাড়িতে সে চাকরি করে সেটা নর্দমার এপারেই। কিন্তু নর্দমার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় তার পানের কথা মনে পড়ল। ঘরে পান ফুরিয়ে গেছে তার। আজ অনেক দিন পর মাংস রান্না করে খাবে সে। খাওয়ার পর একটা সুদৃশ্য বাড়ৈ পান মিষ্টি জর্দায় আয়াস করে চিবিয়ে খাওয়া চাই। কিন্তু সুদৃশ্য বাড়ৈ পানের জন্য তাকে যেতে হবে নর্দমা পেরিয়ে ওপারে। ওপাশে ছোট্ট মাঠের পর পান বিক্রির পাইকারি বাজার আছে। সস্তায় কদিনের পান একযোগে কিনে আনবে সে।
মনের স্ফূর্তিতে এক লাফে নর্দমা পেরোল নফর মিয়া । ছোট্ট মাঠ ধরে দ্রুত হাঁটতে লাগল। সে মাঠের শেষ সীমায় যেতেই পেছনের পুরনো শিরিশ গাছের ওদিক থেকে কেউ চিৎকারে ডেকে উঠল, বাইজান, ওইধারে যাইয়েন না! ওইধারে কুত্তার আড়ত, কুত্তার দ্যাশ। মাঠের ওইধারের দাগে পা দিলি কিন্তুক আপনেও লগে লগে কুত্তা হয়া যাবেন। সাবধান, ফিরা আয়েন। বর্ডারে যায়েন না।
নফর মিয়া বিস্মিত হয়ে ফিরে তাকাল। দেখল পেছনে কেউ নেই। গাছের নিচ নাগাদ ধূ ধূ ফাঁকা। অতএব, কেউ ফাজলামো করে সটকে পড়েছে ভেবে সে দ্বিগুন বেগে পা চালাল। কিন্তু আবারও পেছনে সে চিৎকার শুনতে পেল, বাইজান, ভুল করলেন আপনে, ভুল।দেহেন, অহনি কুত্তা হয়া যাবেন। নফর মিয়া অবিশ্বাস বশত মুচকি হেসে একবার হাতের মাংস- পুটলির দিকে, আরেকবার পানের আড়তের দিকে তাকাল। তারপর হেলেদুলে হাঁটতে লাগল।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর রীতিমত বিস্মিত হলো নফর মিয়া। কই, এদিকে সেই পানের আড়তটি কই? একটা বড় মাঠ ; চারদিকে বস্তি শ্রেণির পাকা, আধা পাকা যত খুপরি। প্রতি খুপরির সামনে জোড়ায় জোড়ায় নানা আকৃতি ও রঙের কুকুর শুয়ে বসে ও দাঁড়ানো আছে। এবারে মুখ ঘুরিয়ে বরাবর মাঠের দিকে তাকাল নফর মিয়া । দেখল মাঠের মাঝামাঝি থেকে দৃষ্টির শেষ সীমা নাগাদ শুধু কুকুর আর কুকুর। কেউ শুয়ে বসে, কেউ দাঁড়িয়ে, অনেকে দৌড়াদৌড়ি, জড়াজড়ি ঘাউঘাউ খাউখাউ করছে।
অনেকটা তাল হারানোর মতো অবস্থা হলো নফর মিয়ার। এ কোথায় এসে পড়ল সে? এখন কোন দিকে যাবে সে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। যেদিকে তাকায়, রীতিমত অচেনা লাগে। কোন পথও তার চোখে পড়ে না যে তা ধরে পা চালাবে। শুধু একটি দৃশ্যই চোখে বেঁধে যায়, তা হচ্ছে কুকুর আর কুকুর। ভীষণ বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে। ভয় ঢুকতে শুরু করেছে ভেতরে। ভাবছে, একটা উদ্ভট কথায় কান না দিয়ে তবে কি সত্যিই সে ভুল করে বসেছে। পেছন থেকে যারা তাকে সতর্ক করেছিল, তারা কি ভালো চেয়েছিল তার, সে না বুঝে ত্যাড়ামো করেছে? সে মানুষের পৃথিবী ছেড়ে কুকুর জগত নামের আলাদা কোন জগতে চলে এসেছে! বিষয়বস্তু যাই হোক, এখন উপায়? কী করবে সে এখন? দুর্ভাবনায় কাঁদোকাঁদো হয়ে উঠল সে।
হঠাৎ সে মুখ তুলে দেখল বেশ নাদুসনুদুস উঁচু লম্বা এক কুকুর লেজ তুলে এগিয়ে আসছে তার দিকে। ভয়ে দু’পা পিছিয়ে এলো সে। কুকুরটা দ্রুত তার সামনে এসে গলা উঁচিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় বলল, ভাইজান, কুত্তার দেশে আইলেন তালি? তা কুনহান থোন আয়লেন? ভুকভুক!
ওই যে সীসারিপাড়া, ওইহান থিকা।
ডরাইতেছেন? ডরের কিছু নাই, আয়েন আমার লগে। ভুকভুক।
আপনের লগে–?
আরে ভায়া, পাইছাইয়েন না, আয়েন আমার লগে, আয়েন।
কোথাই?
আমার বাড়িত, ডরায়েন না। ডরের কিছু নাই, আয়েন জলদি ।
আপনের বাড়িত যামু?
হ, আয়েন। এইহানে খাড়ায়া থাকলি জাত ভায়েরা শত্রু ভাইবা আপনেক ধাওয়া করবার পারে, আয়েন, আয়েন।
আচ্ছা চলো।
আমি কিন্তুক আপনের চায়া বয়সে বড়। সম্মান কইরা কতা কন, ভুকভুক!
আইচ্ছা, চলেন।
ককুরটার পেছনে হেঁটে একটা একচালা আধাপাকা ঘরে এসে উঠল নফর মিয়া। ঘরের মেঝেতে চোখ যেতেই দেখল সেখানে আট দশটা ছোট বড় কুকুর। ওই কুকুরটা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, আমার পরিবার।
পরিবার!
হ, পরিবার। আমার বাপ, মাও, ইস্তিরি ও পোলা মাইয়া।
বলেন কী? কুকুরগো আবার পরিবার! বিড়বিড় করল নফর মিয়া।
সে খুব মনোযোগ সহকারে প্রতিটি কুকুরের দিকে তাকাতে লাগল। পরিবার কথাটি শুনে তার কী হলো- কেন যেন মনে হতে লাগল কোথায় কোথায় যেন কীসব মিল রয়েছে কুকুরগুলোর চেহারা-হাবভাবের সাথে মনুষ্য সমাজের নানা সদস্যের । মনশ্চক্ষে সে তার আশপাশের ও গাঁয়ের পাড়া-মহল্লায় চলে গেল। এখানকার সেখানকার নানাজনের চেহারা ছবি, হাবভাব, ব্যক্তিত্ব তার মনে ভাসতে লাগল। সে ভাবল, হতেই পারে। এটা কুকুর জগত। তাই এখানে এসে ধরা যাচ্ছে, কুকুরদের মধ্যেও নানা ব্যক্তিত্বের, চেহারা বৈশিষ্ট্যের বিশেষত্ব রয়েছে – যেমন থাকে নানা বয়সী মানুষের মধ্যে। কেউ দেখতে নিরীহ, কেউ রাগী- রাশভারী , কেউ হাবাগোবা, কেউ চঞ্চল, কেউবা ধীরস্থির, কেউ দুর্বল-দর্শন, কেউবা শক্তিশালী। হঠাৎ ওই কুকুরটা বলে উঠল, এতসব কী ভাবতাছেন আপনে?
ভাবতাছি, আপনেগো মধ্যেও আমগর লাহান নানাবেধ রকমফের বিদ্যমান আছে দেখবার পারতাছি।
ভুকভুক! আপনে কি নিজেরে আমগ চাইয়া ভিন্নতর ভাবতাছেন নাকি? আপনে মিয়া — আপনে–
মাইনে?
মাইনে আবার কী? আপনে নিজে কুত্তা হয়া আমগ লগে আপনের পার্থক্য খুঁজতাছেন! এইডা কি ঠিক? ভুকভুক!
আ- মি কুত্তা- আ-? কী কইতাছেন আপনে? আ-মি কু-উ-ত্তা?৷ আ-মি-ই- ই—।
আপনে কুত্তা না তয় কী?
মানুষ! আ-মি মা- নু- উ -ষ! কুত্তা হমু ক্যান?
ধূর মিয়া! আপনে আর মানুষ আছেন নাহি? আগে থাকলেও এইধারে পাও দেওন মাত্রক কুত্তা হয়া গেছেন। ওই মাঠের বর্ডার ক্রস করন মাত্রক। নিজের গাওগতরের দিক চায়া দেহেন নাই বোধ করি। এই যে লন আয়না দিতাছি। নিজের ধারে খেয়াল কইরা দেহেন ভালামতন। আপনে নিজেরে—-, ধূর!
কুকুরটা লাফিয়ে তার ঘরের দেয়ালে ঝোলানো আয়নাটা এক টানে নিচে নামিয়ে নফর মিয়ার সামনে খাড়া করে ধরে কেউ কেউ শব্দ করতে লাগল। আয়নায় নিজের কুকুর প্রতিকৃতি দেখে ভয়াল চিৎকার করে উঠল নফর মিয়া। এক লাফে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল সে। প্রবল দৌড় শুরু করল মাঠ বরাবর। দৌড়াতে দৌড়াতে সেই শিরিশ গাছটার নিচে এসে থামল সে। জিহ্বাটা রীতিমত বেরিয়ে গেছে প্রচণ্ড ভীতি-হাঁপে। শ্রান্ত অবসন্ন শুতে গিয়ে থামল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে একবার তাকিয়ে দেখল কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না। নাহ, কেউ নেই ওদিকে।
হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল সে। শ্রান্তিতে খানিকটা ভাটা নেমেছে। কী মনে করে চোখ দুটো ভীষণ করুণ হয়ে উঠল তার। শশব্যস্ত নিজের গায়ের পায়ের দিকে লক্ষ্য করতে লাগল সে। নিমিষে চোখ দুটো আরো বেশি করুণ হয়ে উঠল তার। এ কী দেখছে সে? সত্যিই তো সে কুকুর হয়ে গেছে। এতক্ষণ পোড়া চোখে অবিশ্বাস ভর করে ছিল বলেই হয়তো সে নিজের এ পরিবর্তন লক্ষ্য করেনি। এ কি কোন কথা হলো? গেল সে পানের আড়তে পান আনতে, কী দিয়ে কী ভুয়া কারসাজি হলো, আর তাতে করে তাকে কিনা কুকুর হতে হলো। পরম দুঃখে ভীষণ ঘেউ ঘেউ করতে লাগল সে। ভাবল, ভুল দেখছে না তো? এ কী করে সম্ভব? মানুষের কুকুরান্তর!
দীর্ঘশ্বাস ঝরাল সে। আহা, সবই যদি মিথ্যে হত, দুঃস্বপ্ন হতো! আবারও মুখমণ্ডল পরখ করতে ইচ্ছে হলো তার। হাঁপাতে হাঁপাতে এগিয়ে গেল সে পাশের নর্দমার দিকে। পানির স্রোত বইছে নর্দমায়। যদি ওই পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখা যায়, মনুষ্য-প্রতিবিম্ব? নর্দমার পারে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে চোখ নামাতেই পেছন থেকে তার কানে ভেসে এলো, এইতো পাইছি একটারে। জলদি জাল দিয়া আটকায়া ফালাও এ্যাক। কুইক! অনেক সাধনায় পাইছি। বাকি হারামজাদারা শহর ছাইড়া কই যে ভাগছে! হারামজাদা কুত্তার দল! এ্যাক ছাড়া যাইব না, কুইক!
নফর মিয়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুজন লোক তড়াক করে তার ওপর বিশেষ জাল ছুঁড়ে দিয়ে আটকে ফেলল তাকে। দুজনে মিলে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো শিরিশ গাছটার নিচে। ওখানে একটি কাঠের বেঞ্চি ফেলা আছে। দুজনে তাকে বেঞ্চির নিচে ফেলে আলোচনা শুরু করল: ধরলাম তো! মালও খাসা। হইটালের জন্য পারফেক্ট। দেখছ, হাড্ডিগুলান হইব একদম নিখুঁত। পাবলিক টেরই পাইব না যে এই হাড্ডি খাসির না, কুত্তার।
কিন্তু সমেস্যা হইল–
কী? অন্যজন জিজ্ঞাসা করল।
এ্যাক নিয়া যাব কেমনে? জ্যাতা নিয়া যাওয়া তো রিস্কি। ধরা খাওয়ার আশংকা আছে। চাইরদিক খবর রইটা গেছে।
এক কাজ করি তালিপর।
কী?
জবো কইরা ফালাই। রক্ত ড্রেনে ফালাইয়া পলিথিনে প্যাঁচাইয়া ছালাত ভইরা সি এন জিত তুলমু, কী কও?
ঠিক, ঠিক কতা কইছো। তুমি শক্ত কইরা পাছার দিক ধরো , আমি মাথাত পাড়া দিয়া গলাত ছুরি চালাই। রেডি!
কাঁধের ব্যাগ থেকে ধারালো ছুরি বের করল লোকটা। নফর মিয়ার মাথাটা জোরছে পায়ে চেপে ছুরিটা তার গলার দিকে নিয়ে গেল সে। প্রাণভয়ে প্রচণ্ড চিৎকার করে উঠল নফর মিয়া।
ঘুম ভেঙেছে নফর মিয়ার। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। কাঁপছে সে আপাদমস্তক। ধীরে ধীরে চোখ খুলল সে। ঘরের মধ্যে আবছা অন্ধকার। বাইরে ফজরের আযান বাজছে চারদিকে। আযানের সাথে এদিকসেদিক কুকুর চেঁচাচ্ছে। গায়েপায়ে হাত বুলাল নফর মিয়া। সে উপলব্ধি করল, এতক্ষণ সে যা দেখছিল, তা বাস্তব নয়, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন মাত্র। ভয় কাটতে থাকে তার। ভাবনাচ্ছন্ন হলো সে।
দিনের বেলাকার নানা দৃশ্য তার মনে ভাসতে লাগল। দুপুরে এক পোয়া গরুর মাংস কিনে রাস্তায় হেঁটে এসেছে সে। হাঁটার সময় একটা কুকুর হাঁটছিল তার পাশাপাশি। একজন মহিলাকে সে দেখেছে তার হাতের মাংসের পুটলি ও কুকুরের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকাতে। কিছুক্ষণ কথিত, অর্থাৎ স্বপ্নে দেখা বেঞ্চিতে বসে কথিত তেজারত মিয়ার সাথে কথাও বলেছে সে। একসময় উঠে গোডাউনে ফিরে মাংস রান্না করে আচ্ছামত খেয়েছে। একপেট – এক পোয়া তথা আড়াই শ গ্রাম মাংস, রাতেও ভালোমত খেয়েছে সে। গরুর মাংস গুরুপাক খাবার। গুরুপাক খাবারে রাতে ঘুমের ঘোরে নানা দুঃস্বপ্ন হয়- বহুবার শুনেছে সে। প্রত্যক্ষও করেছে। এটাও দুঃস্বপ্ন , তবে খুব অদ্ভুত এবং ভয়াবহতম। এতটা বিভীষিকাময় স্বপ্ন আগে সে দেখেনি। কেন দেখল সে এমন ভয়াবহ স্বপ্ন?
তার মনে পড়ল, কদিন ধরে মহল্লায় কুকুর নিয়ে নানা আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। হোটেলে কুকুরের মাংসের কাচ্চির সমালোচনা। তাছাড়া এ এলাকায় ইদানিং কুকুরের সংখ্যাও মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে। এ দুঃস্বপ্ন হয়তো সেসবেরই গড়ফল। তবু তার খুব মন খারাপ হলো। ঘুম হলো না আর। ঘাপটি মেরে শুয়ে রইল সে।
দিনের আলো ফুটতেই সীসা কারখানার অদূরের সেই বেঞ্চিটার ওপরে গিয়ে বসল নফর মিয়া। অপেক্ষা করতে লাগল তেজারত মিয়ার জন্য। তেজারত মিয়া প্রতিদিন সাতসকালেই কারখানায় আসে। সে এলে তাকে সে বিস্তারিত খুলে বলবে স্বপ্নের যত কথা। বলে হালকা হয়ে নেবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তেজারত মিয়া এলো। তাকে দেখেেই বলে উঠল, কী ব্যাপার? এই সাতসকালেই আইসা বইসা আছেন আইজ! মন খুব খারাপ মনে হইতাছে! কী ব্যাপার? কী হইছে? কুনু ঘটনা?
ব্যাপার কিছু না। রাইতে খারাপ হপোন দেখছি, এই যা। চাইরোধারে এত কুত্তা, তার উফারে আবার কুত্তা লইয়া হইটাল আলাগো কুকামের খবর-বাতরা -হেইসবোই কারণ।
কিন্তু খারাপ হপোন, কেমন কী হপোন?
ওই দেহি, আমি হইল গিয়া, আমি হইল- ইয়া হইয়া গেছি আর কি।
কী? হফোনে কী হইছেন?
ওই হইল গিয়া ইয়া আর কি, ইয়া?
কী হেইডা? কী হইছেন হফোনে?
ওই হইল গিয়া, কুত্তা!
দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী (পর্ব ১) – শওকত নূর [Dukkhito O Khomaprarthi]
গুড়ি বৃষ্টি এঁদো কাদায় দশ বারোটার মতো ঘুপচি গলি পেরিয়ে যখন বাসাটার নিশানা খুঁজে পেল মাশফিক, তখন বেলা প্রায় ডুবে গেছে। লোডশেডিং, চারদিকে আযানের শব্দ নিভে খানিকটা নৈঃশব্দ্য ভর করেছে। দরজায় কড়া নাড়তে যাচ্ছিল মাশফিক, কিন্তু নাড়তে হলো না। খোলা জানালাপথে ভেতরের দৃশ্য ভেসে এলো। মোমবাতি জ্বলা টেবিল সামনে নিয়ে বসে আছেন তার জয়তুন মামা। মাথায় লম্বা চুল, রোগা পাতলা মুখ ভর্তি সাদা-কালো দাড়ি, চোখ মুখ বিষণ্ণ। সামনে গোটা দুই পেটমোটা মাঝারি আকৃতির কাঁচ-বোতল। মাশফিকের বুক ধড়ফড়িয়ে উঠলেও ক’ সেকেন্ডে তা থেমে গেল। সে জানে, তার জয়তুন মামা অতি খাঁটি প্রকৃতির মানুষ- পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, শুধু কপাল দোষে পড়ালেখা খুব বেশি দূর করতে না পাড়ায় ছোট চাকরি করেন। তবে সৎ সরল জীবন যাপনে অভ্যস্ত।
চিন্তিত মনে সে দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে খট করে খুলে গেল দরজা। জয়তুন মামা এমন ভঙ্গিমায় ‘আয়’ শব্দটি উচ্চারণ করলেন যেন মাশফিক এর সাথে তার আগে থেকে কথা পাকা হয়ে আছে সে আসবে এবং ঠিক এ সময়েই। অথচ প্রায় তিন বছর তারা পরস্পর যোগাযোগ-বিচ্ছিন্ন।
হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে বিছানার কোনা ঝেড়ে মাশফিককে বসতে দিলেন জয়তুন সাহেব । গা হাতড়ে বললেন, গেদা (গ্যাদা, মানে বাবুসোনা), তা আকস্মিক কী মনে করে আসলি?
মামা, এমনি।
এসে ভালো করলি, কিন্তু কারেন্ট মারেন্ট আজকাল আসে না, বুঝলি?
মামা, আসে না, নাকি থাকে না?
কদাচিৎ আসে। অনুপস্থিতিই বেশি। এইজন্য বলি আসে না।
হুম, তা তুমি আছো কেমন?
ভালো না বিশেষ, খালি ওষুধ খাই। ওই দ্যাখ সালসার বোতল।
সাল-সা!
হ্যাঁ, সালসাটাই আজকাল ভালো। বাকি সব ওষুধে ভেজাল, বুঝলি? নজরদারি নাই।
তা কী সব অসুখ হয়েছে তোমার?
অসুখ তেমন কিছু না। এই ধর গ্যাস্ট্রিক, কোষ্ঠকাঠিন্য; মাঝেমধ্যে ঠান্ডাঠুন্ডা লাগে।
খাওয়াদাওয়া ঠিকমত করো? রান্নার ব্যবস্থা আছে?
বিয়েশাদী তো আর করলে না। এখনও সময় আছে, করলে বলো।
খাওয়া দাওয়ার জন্য কি আর বিয়ে করব এই বয়সে?
তা কত হলো এ বছর বয়স?
উনপঞ্চাশ।
ইচ্ছে করলে এখনও করতে পারো বিয়ে। মেয়ের সন্ধান আছে আমার কাছে।
কই মেয়ে? তোর ঝোলার ভেতরে? থাক আপাতত ঝোলাতেই, আয় কিছু খাইদাই, নাকি?
এই ভরসন্ধ্যায় কী খাব-খাওয়াবে?
ভাত, মুশুরের ডাল আছে, বেগুন ভর্তা, উস্তা ভাজা।
নাহ, তোমার খুধা লেগে থাকলে খাও, আমি হোটেল থেকে নাস্তা সেরে এসেছি।
তাইলে থাক,পরে একত্রে খাওয়া যাবে। তা বল বাড়িতে বুবু কেমন আছে, দুলাভাই?
ভালো।
তা এবার বল, এমনি এসেছিস যে বললি, তা এমনি কী মনে করে এলি?
আহা, বললাম তো এমনি! আপন মামা নও বলে কি বেড়াতে আসতে পারি না?
তা পারিস, তবে কোন দিন তো আসিসটাসিস না। সেই বছর তিনেক আগে রাস্তা থেকে ধরে এনেছিলাম। তা কী করে বুঝলি আমি এখানটাতেই রয়ে গেছি? অন্য কোথাও সরিনি?
এ এলাকাতেই এসেছিলাম, বেলাও পড়ে এলো কাজের মধ্যে ; ভাবলাম দেখি তুমি যদি থাকো তো দেখা করে যাই। না থাকলে এসে ঘুরে যেতাম। কী আর হতো তাতে?
এই যে বললি কাজে এসেছিলি, অথচ বলছিস এমনি এসেছিস। তা এবার বল যে কাজে এসেছিস, সে কাজটা কী।
একটা ইন্টারভিউ ছিল ওই বাণিজ্যিক পাড়ায়।
লিখিত, না মৌখিক?
মৌখিক।
সরকারি না বেসরকারি?
বেসরকারি ফার্ম।
তা চাকরি কি হবে মনে করছিস?
নাহ।
কী করে বুঝলি? ভাইবা অনুকূল হয়নি?
হুম।
কী প্রশ্ন করেছিল? কটা প্রশ্ন?
একটা।
কী প্রশ্ন?
হোয়াট উইল ইউ ডু টু কিপ দ্য অফিস ডিসিপ্লিনড?
টু কিপ দ্য অফিস ডিসিপ্লিনড! মুখস্থ প্রশ্ন! তা তুই কী জবাব করলি?
বললাম, টু মেইনটেইন অফিস ডিসিপ্লিন, সারটেন স্টেপস উইল হ্যাভ টু বি টেকেন।
নাইস! দেন?
নাইস বলছো?
হুম, অব কোর্স , নাইস!
কিন্তু এটুকু বলতেই তো চাকরির সম্ভাব্যতা নট হয়ে গেল।
কেন?
তরুণ প্রশ্নকারী রাগত স্বরে বললেন, ডিসিপ্লিন কি আবার ভরণপোষণ করা যায় নাকি? ডিসিপ্লিন মেইনটেইন করার কী আছে? এ ফ্যামিলি ক্যান বি– হ্যাচ্চু!
বুঝেছি, তারপর?
আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম ‘মেইনটেইন’ শব্দটি আমি ভরণপোষণ অর্থে ব্যবহার করিনি, বজায় রাখা অর্থে ব্যবহার করেছি। কিন্তু সে সুযোগই দেয়া হলো না।
কী করল?
বলল, পুওর নলেজ ইন ইংলিশ, ইউ মে রিমুভ ।
রিমুভ বলল?
হুম।
রাবিশ! আচ্ছা দাঁড়া, দেখি তো তোর বেশভূষা। হুম-সাদা শার্ট, অ্যাশ প্যান্ট, চুল ছোট, স্বাস্থ্য মোটামুটি মানানসই, মুখমণ্ডলে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও অভদ্র লাগছে না।
মামা।
ও ব্যাটা একটা অকাট মূর্খ। ডিসিপ্লিন ভরণপোষণ করা যায় না! জ্ঞানের সীমাবদ্ধতারও একটা সীমা থাকে। তা থাক, ওসব বাদ দে। মন খারাপ করিস না। ওদের যা বোধ, ওরা সে মোতাবেকই করেছে। তাছাড়া, চাকরিবাকরিতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে লোক ঠিক করাই থাকে। লোক দেখানো ভাইবাতে অনেকেই বেহুদা নাস্তানাবুদ হয়। ওসব মাথা থেকে ঝেড়ে এবার শুয়ে বিশ্রাম নে। আমি কিছু কাজ করি।
জয়তুন সাহেব এবার দেয়ালে ঝোলানো ঝোলা-ব্যাগ টেবিলে নামিয়ে হাতড়ানো শুরু করলেন। মাশফিক বিছানায় গা এলিয়ে চারদিকে লক্ষ্য করতে লাগল। আধাবস্তি এলাকার একতলা নিম্নমানের দালানের এক কক্ষ। পুরনো, জরাজীর্ণ, দেয়ালের রঙ উঠে কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। এখানে ওখানে মাকড়সার ঝুল, কক্ষের কোনায় একটা স্টিলের তাক ভর্তি পুরনো বই-পুস্তক, কাঠের আলনাটা তেমনই আছে, যেমনটি সে দেখেছিল তিন বছর আগে এসে। বাইরে হঠাৎ বাতাসের গর্জন ও বৃষ্টির সমসম শব্দ শুরু হলে সেদিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো মাশফিকের। অন্ধকারে বৃষ্টির সাদাটে ধারায় বিজলির চমক পড়লে ওদিকের ঘরবাড়ি, বিদ্যুৎ-থাম্বা, রাস্তা, দোকানপাট, ছাতা-মানুষ, ছায়ার মতো এক নজর স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পরক্ষণেই বৃষ্টির অস্পষ্ট ধারার সাবেক দৃশ্যপট ফিরে আসে। কতক্ষণ বিহ্বল বাইরে তাকিয়ে থাকার পর দৃষ্টি গুটিয়ে জয়তুন সাহেবের দিকে স্থির করল মাশফিক।
কী করছেন তিনি? টেবিলের ওপর ওসব কিসের মূর্তি? হারিকেনের আলোয় সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে একটা বাঘ, একটা সিংহ, মহিষ, হরিণ ও একটা বানর মূর্তি। কিন্তু এসব হাতিপাতি করে কী শখ মেটাচ্ছেন জয়তুন মামা এ বয়সে? বিড়বিড় করে বলছেনই বা কী? যাদুকর হয়ে গেছেন নাকি? পার্টটাইম যাদুটাদু দেখিয়ে টু পাইস করেন?
মামা, কী করছ ওসব? মাশফিক মধ্যম কণ্ঠে চেঁচাল।
খেলছি।
খেলছো? এ বয়সে বাচ্চাকাচ্চাদের খেলা? এ কী কথা হলো?
ঠিক কথা হলো। জগৎটাই খেলার। খেলার আবার বয়স অবয়স কী?
অবশ্য ভেবে দেখার মতো কথা। একদিক থেকে ভাবলে জগৎটা খেলারই।
ঠিক বুচ্ছিস। খেলাহীন জগৎ অচল।
তা মামা, কী মর্মার্থ তোমার এই খেলার?
তোর মাথায় কি আজ ধরবে? মাথাটা তো ভরণপোষণ অপব্যাখ্যায় নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে আছে।
না, আমি ঠিক আছি। তোমার এ খেলাটা কি প্রাণীজগতের চেইন সংক্রান্ত?
কিছুটা প্রতীকী ধরনের।
যেমন?
এই ধর, এই প্রতাপশালী এই বাঘটা একসময় বনের নিরীহ প্রাণী বানরদের ধরে খেত। পাশের বনের সিংহ প্রতিবাদ করে বলল, এই যে মিয়া বাঘা, তুমি কিন্তু নিরীহ প্রাণীদের ওপর থাবা বসাচ্ছ। বড়তে ছোটতে
ব্যবধান কাম্য নয়।
বাঘ হুংকার দিয়ে বলল,আরে মিয়া সিংহ, তুমি যে নিরীহ হরিণদের সাবড়ে দিচ্ছ, এটা কী হে? এটা কী? এটা কি বড়তে ছোটতে সাম্য নাকি হে? বলো দেখি সত্যি কথাটা।
কী বললি ব্যাটা, বাঘু? এত্তব ড় সাহস! ত্যাড়া বাক্য ঝাড়ছিস!
কী বললি ব্যাটা ছিঙ্গো, অমন লাফাসনে। অফ যা কচ্চি!
তবেরে!
তবেরে!
লাগল বাঘে সিংহে ভয়াল লড়াই। বানর আর হরিণ একযোগে পালাল ভিন্ন বনে। সেই থেকে দুজন বন্ধু। আর বানর যেহেতু গাছে উঠতে জানে, বাঘ সিংহ দেখলেই সে হরিণকে সতর্ক করতে গাছের মগডাল থেকে এক প্রকার শব্দ করতে থাকে।
প্রতীকী গল্প, রূপক, তার মানে এটা দিয়ে মানুষকেও বোঝাতে চাইছ, নাকি?
শোন গেদা, এই মনুষ্য জীবটা নিয়ে আমি কোন গবেষণায় নামি না। বানর আর হরিণের গল্পটা সুন্দরবন ভ্রমণ নামক গল্পে পড়েছি। তা থেকে ধারণাটা এসেছে। গোবর মাথায় যা হয়।
তা এসব মূর্তি কোত্থেকে কিনলে?
সেদিন বৈশাখী মেলা গেল না? এদের দেখে শৈশবটা মাথাচাড়া দিল। তাই শখ প্রশমনে কিনে ঝোলায় ভরে নিয়ে এলাম। টেবিলে নামিয়ে ছোটবেলার মতো খেলতে খেলতে গল্পটা মাথায় ভর করল, বুঝলি?
বেশ। তা ঝড়বৃষ্টি তো বেশ শুরু হয়ে গেল। রাতের খাবার কি দেরিতে খাবে, নাকি আগেভাগেই খাবে?
কারেন্ট তো আসছে না।
তোর কি ঘুম পাচ্ছে? ঘুম পেলে খেয়ে নে। আমি দেরিতে হলেও কারেন্ট এলেই খাই।
আচ্ছা।
জয়তুন সাহেব উঠতে যাবেন, এরই মধ্যে দরজায় খটখট শব্দের সাথে জোর ধাক্কায় খুলে গেল দরজা। ছাতা হাতে হুড়মুড় একটা লোক ঢুকল। মাঝবয়সী, গায়ে জীর্ণ চাপা শার্ট, শরীর কৃশকায়, মুখমণ্ডল তামাটে-শুকনো কটমটে, আধাপাকা খোঁচাদাড়ি, চোখদুটো কোটরগত।
সালাম স্যার । বিনীত বলল আগন্তুক।
তা অখিল বাবু, হঠাৎ অসময়ে? এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে!
আইসলাম, স্যার।
বসেন।
না স্যার, আইসছি বিশেষ উদ্দেশ্যে।
বলুন।
স্যার, আপনে আমারে ক্ষমা কইরা দেন। আমার মস্ত ভুল হইয়া গেছে।
তা দুঃখ প্রকাশ কালও করতে পারতেন, যদিও জরুরি বা আবশ্যক নয়। এতোটা কষ্ট করে –।
স্যার, বাসায় খুব বকাবকি কইরতেছে। নিজেরও মনটা খুব অনুতইপ্ত। কোনদিন আপনের লগে অসৎ আচরণ করিনাই। ছেলে আর ছেলের মা হাতে ছাতি দিয়া বইলল, যাও, ঘুপ ধইরা না খাইয়া বইসা না থাইকা অহনি সাবের কাছে গিয়া ক্ষমা চাইয়া আইসো। মন মাইনতেছিল না। তাই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই চইলা আইসলাম। স্যার, ক্ষমা কইরা দেন, কিছু মনে রাইখবেন না।
মনে রাখিনি তো। সেই কখনই ভুলে গেছি। কিচ্ছু মনে রাখিনি আমি।
যাই স্যার, সালাম। ভগবান আইপনের মঙ্গল করুক।
আচ্ছা যান।
অখিল বাবু চলে যায়। জয়তুন সাহেব দরজায় খিল এঁটে দিতেই মাশফিক বলল, মামা, লোকটা কে?
লোকটা একজন চর্মকার, মানে মুচি।
ক্ষমা চাইতে এলো, কী ব্যাপার?
সে ছোট এক কাহিনী।
কী?
আজ সকালে অফিসে যাওয়ার পথে একজোড়া জুতা সেলাই করতে দিয়ে গেছি। কথা ছিল ফেরার সময় সেলাই- জুতো ফেরত দেবে।
তারপর?
ফেরার পথে জুতো ফেরত চাইতেই ভীষণ রেগে গেল। সেলাই থেকে মাথা না তুলে বলল, জুতামুতা সেলাই কইরতে পারিনাই। পরে নেওয়া লাইগব। কাইলকে নিয়েন। আউজগা যানগিয়া।
মানে, কথাতো ছিল–।
কথা থাইকলে কী? বইল্লাম তো জুতামুতা সেলাই হয় নাই। দেরি না সইলে ফেরত নেন। এই আপনের জুতা। নিয়া যান গিয়া। জু-তা সেলাই—! বিড়বিড় করছিল সে।
আচ্ছা নিয়ে যাচ্ছি। আজই সেলাই করতে হবে জুতা, জরুরি। কাল আর এ স্যান্ডেলে অফিসে যাওয়া চলবে না।
নেন গিয়া, যেইধারে পারেন সেলাই করেন গিয়া! জু-তা—!
এমন আচরণ করল কেন? বরাবর কি এমন করত?
না,আজই প্রথম। যখন অফিস থেকে ফিরি, তখন গ্রাম থেকে তার স্ত্রী ও ছেলে এসে কাছে বসেছে। বেশ হাসিখুশি, নিবিড় গল্প করছিল তিনজন।
কিন্তু অমন করল যে?
অমন করে স্ত্রী ও ছেলেকে দেখাল শহরে কত প্রভাব প্রতিপত্তি নিয়ে থাকে, এই আর কি।
আপনি কি কিছু মনে করেছিলেন?
নাহ।
কেন?
ব্যাপারটা আমি বুঝেছিলাম এবং স্বাভাবিক ধরে নিয়েছিলাম। কারণ, সব পুরুষই চায় নিজ পরিবারের কাছে নিজেকে বড় করে তুলে ধরতে। আমাকে নিরাপদ ভেবে সেও চেয়েছে। এমন কতজনই তো করে। অস্বাভাবিক কিছু নয়।
ও।
দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী (পর্ব ২) – শওকত নূর [Dukkhito O Khomaprarthi]
রাতে বৃষ্টি কমার লক্ষণ দেখা গেল না। ঝড়ো বাতাসও ক্রমশ বেগবান হতে লাগল। বৃষ্টিস্নাত ঝড়োহাওয়া শীত শীত ভাব বয়ে এনেছে। এতক্ষণ সাধারণ লোডশেডিং এর যে ধারণাটা দুজনের মাথায় স্থিতিশীল ছিল তা আর অপরিবর্তিত রাখা গেল না তাদের পক্ষে – তারা আঁচ করে নিল কোনও বড় বিপর্যয় নিশ্চয়ই ঘটে গেছে কোথাও। অতএব, দুজন মৃদু আলাপচারিতায় রাতের খাবার খেয়ে নিল। মাশফিক শুতে যাবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমে তলিয়ে গেলেও জেগে উঠল ঘণ্টা খানেকের মাথায়। তার ঘুম বজ্রপাতের বিকট শব্দে ভাঙলেও পুনর্বার না ঘুমানোর নেপথ্যে কাজ করতে লাগল জয়তুন সাহেবের নানাবিধ খুটমুটানো টাইপ কর্মকাণ্ড। বেশ ক’বার বাথরুমেও গেলেন তিনি। নিজে থেকেই জানালেন, মুত্রজনিত কোনও অসুখ তার নেই। ঘন ঘন বাথরুমে যাওয়া পানি বেশি পান করার ফল হয়ে থাকতে পারে। সর্বোপরি, রাতে যেটুকু সময় তার ঘুমে কিংবা বিছানায় কাটল, তা সুস্বাস্থ্যের পরিপন্থী। অথচ মাশফিক ঘুম থেকে জেগে ওঠার আগেই জেগে উঠেছেন তিনি।
সকালে নাস্তার পর মাশফিকের চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু নিম্নমানের জায়গাটা রাতে তাকে যেভাবে যথা-শীঘ্র চলে যাওয়ার বিষয়ে সংকল্পবদ্ধ করেছিল, সকালে তাতে ভাটা পড়ে। শান্ত মেজাজে সে জয়তুন সাহেবকে বলল, মামা, দুপুর নাগাদ চলে যাই, কী বলো?
চলে যেতে চাস? আজই দুপুরে?
হ্যাঁ, ভেবেছিলাম ভোরেই চলে যাব।
তা কী ভেবে দুপুর নাগাদ থাকার সিদ্ধান্ত নিলি?
সকালে তুমিও অফিসে চলে যাবে, আমিও তড়িঘড়ি বেরিয়ে যাব; মন খারাপ হচ্ছে এভাবে সমান ও সমান্তরালে যেতে হবে ভেবে। গত তারিখেও তা-ই গেছিলাম।
শোন।
জি মামা।
আজ আর তোর যাওয়া হচ্ছে না।
কেন?
গত তারিখে এসেছিলি, কিছু দিতে পারিনি। পরে খারাপ লেগেছিল। এবার আর তা হতে দিচ্ছি না। দুপুর নাগাদ অফিসে আয়। কিছু কেনাকাটা করি। আজকে থেকে কাল ভোরে যাবি – দেখিস খারাপ লাগবে না।
জয়তুন সাহেব মাশফিকের কাছে ঘরের তালাচাবি রেখে অফিসে চলে যান। মাশফিককে বলে যান সে যেন বেলা একটার মধ্যে তার অফিসে পৌঁছে যায়। দুপুরে হোটেলে কিছু মেরে দুজন বেরিয়ে পড়বে কেনাকাটার উদ্দেশ্যে। মাশফিক কেনাকাটার বিষয়ে আপত্তি জানালেও জয়তুন সাহেব তা কানে না তুলে বেরিয়ে গেছেন। মাশফিক সকালের নাস্তা সেরে টেবিলে বসে একটা বইয়ের পৃষ্ঠা ওল্টাতে থাকে। এখন মেঘ বৃষ্টি সরে রোদ হাসছে বাইরে। জানালা পথে শহরের ঘুপচি গলি ক্ষুদ্রাংশের নানা খণ্ডচিত্র ও শব্দপাত অবাধে প্রবেশ করছে। দলবদ্ধ ভিক্ষুকগান, হকারহাঁক, রিক্সা টুংটাং, রাস্তার বাচ্চাকাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় নানাবিধ দৃশ্য- শব্দ বইয়ের পৃষ্ঠা থেকে ঘন ঘন তার দৃষ্টি উঠিয়ে দিচ্ছে। প্রায় দুপুর বারোটা নাগাদ সে বেরিয়ে পড়ে জয়তুন সাহেবের অফিসের উদ্দেশ্যে।
বেলা বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিটে সে পৌঁছে যায় জয়তুন সাহেবের অফিসে। দরজায় চোখ রেখেই সে দেখতে পায় তার জয়তুন মামা খাটো এক টেবিলে উপবিষ্ট, চারদিকের বড় বড় ধুলোট ফাইল স্তূপের মাঝে ডুবন্তপ্রায়। ক’ জন লোক বসে আছে তার আশেপাশে, জনাদুই পিয়ন গোছের লোকও দাঁড়ানো। অফিসের করণিকদের মধ্যে জয়তুন সাহেব সেরা। এক অর্থে সে অফিস সেরা। মাশফিককে দেখা মাত্রই তিনি বলে উঠলেন, আয় গেদা। তোর কথাই মনে করতেছিলাম। ভাবতেছিলাম আবার দেরিটেরি করে বসিস কি না। দেখছি তোর সময় জ্ঞান মন্দ না। কোম্পানির চাকরি, বুঝলি? কাজের অন্ত নাই। একটু সময় বার করা মানে–। দেখিসইতো রাত আটটার আগে বাসায় ফেরা যায় না। শুরু করা কাজটার এখনই একটা গতি করতে চাচ্ছি। বোস এই চেয়ারটাতে।
জি মামা।
আমার ভাগ্নে, ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল। চাকরি বাকরি খুঁজতেছে। তা বাজারের যে অবস্থা! ও আবার কারো কাছে ধর্ণাটর্ণা দিবে না। ঘুষও পছন্দ করে না। জয়তুন সাহেব মাশফিককে অন্যদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন।
ছাড়, আপনের ভাইগ্না আপনের মতোনই হইছে। পিয়নদের একজন বলল।
তা গেদা, চা খাও এক কাপ। কেট মিয়া, চা আনো দুই কাপ।
মামা, আমি এখন চা খাব না। আপনি খান।
ঠিক আছে, চা আনার দরকার নাই। রকেট মিয়া, থামো।
ছাড়, আনবো না?
না, আমরা একটু পরে ভাতই খাব।
জি ছাড়।
ছাড়, বছে আপনেক ছালাম দিছে। সদ্য আগন্তুক এক পিয়ন বলল।
আরে রাখো তোমার সালাম, স্যারকে বলো ব্যস্ত আছি।
জি ছাড়, বলতেআছি।
কী বলল জয়তুন সাহেব? বস বললেন।
ছাড়, বল-ছে আরে রাখো তোমার ছালাম। বলো ব্যস্ত আছি।
বলো কী? আবার গিয়ে ভালো করে বলো আমি সালাম দিয়েছি।
জি ছাড়, বলতেআছি।
কী মাসদার মিয়া, আবার কী কাজে?
ছাড়, বছে আপনেক ছালাম দিছে খুব জরুলি। ক্লায়েন্টে মনে কয় ফোন ক-রছে, আপনের ধারে জরুলি তথ্য।
আহা, বললাম তো বসকে গিয়ে বলো কাজেই ব্যস্ত আছি। আবার ভাগ্নে আসছে, তাকেও একটু আপ্যায়ন করছি। তথ্য রেডি আছে আমার কাছে। আসছি একটু পরেই। (গিয়ে দেখা যাবে বাহুল্য ক্লায়েন্ট, জরুরি কিছুই না। অযথা বিরক্ত করতেছে।) বিড়বিড় করলেন জয়তুন সাহেব।
ছাড়!
হুম, কী বলল এবার?
ছাড়,ওই একোই কথা।
কে কে আছে ওখানে?
ওনার ভাইগ্না আসছে। আরো লোকজন আছে।
হুম, বুঝতে পেরেছি, যাও। পরে এলেও চলবে। পরেই আসতে বলো।
জি ছাড়!
স্যার, আসব একটু?
হ্যাঁ, লিয়ন সাহেব, আসুন।
জি স্যার, আসসালামু আলাইকুম।
ওয়াকাইকুম সালাম, বসুন।
জি স্যার।
বলুন, একটু ব্যস্ত আছি। এখনই বেরোতে হবে।
স্যার, একটা জরুরি কথা ছিল। বেশ কয়েকদিন যাবতই বলব ভাবতেছিলাম।
এখন জরুরি কথা! ঘুরে আসি তারপর বলুন। পাশেই আরেফিন প্লাজায় একটু যাব। আসব এখনই। এসে লাঞ্চ এর ফাঁকে কথা হবে।
জি স্যার, আসুন, যাই।
জি !
বস বাইরে চলে যান। জয়তুন সাহেব তাকে না পেয়ে লিয়ন সাহেবকে বলে এক ঘণ্টার জন্য বেরিয়ে যান। বস ফিরে এলে লিয়ন সাহেব আবারও তার কক্ষে ঢুকে কথা পাড়েন, স্যার, বলছিলাম যা তখন।
জি, শুরু ক-রুন। বস পাশ ফিরে খাওয়া শুরু করেছেন।
স্যার, বলছিলাম আমাদের হেড ক্লার্ক ওই জয়তুন সাহেবের কথা।
জি, জয়-থুন ছাহেভ, খুব ভালো লোখ। কী হয়ে-ছে থার?
লোক সে ভালোই, তবে স্যার।
খী ত-বে?
স্যার, মানুষের ভালো মন্দ, ভালো মানুষের খারাপ হতে খুব সময়ও আবার লাগে না।
কী বলতে ছা-ইছেন জথুন ছাহেভের খথা?
স্যার, ইদানিং ওনার দৃষ্টিভঙ্গিটা বেশ পাল্টে গেছে। আপনার আমার সম্পর্কে –।
কী বিষয়?
খবর পাই, আমাদের বিষয়ে নাক গলানো ধরেছে। নানা কথাই কানে আসে।
অনেকের কথাই শুনি, শেষ পর্যন্ত উনিও–। অবশ্য কেউ কখ-নো ওনার বিষয়ে কিছু ইনফর্ম করেনি। যতদূর জানি দেখি, নিখাদ ভালো লোখ। একটু ভাবুক টাইপ। তবে কাজে কর্মে যথেষ্ট সিন-সিয়ার।
কিন্তু উনিও আমাদের বিষয়ে–হুম–
স্যার, উনি আজকাল আমাদের এ্যান্টি কোম্পানির লোকদের সাথে বেশ দহরম মহরম–। আমাদের শত্রুদের সাথে —
আপনি দেখেছেন?
জি স্যার, আজও সেই কোম্পানির সাথে যোগাযোগ রাখা এক লোক এসেছিল ওনার কাছে। আমি গতকালই তাকে দেখেছি ফাইল নিয়ে ওই কোম্পানির গেট দিয়ে ঢুকতে।
এখন আমাকে কী করতে বলেন? যেসব চাপে আছি দেখতেই তো পাচ্ছেন। কিন্তু ওনাকে দিয়ে এমন কিছু কল্পনা করিনি। এ্যাজ এ ম্যান, ভালো জানি।
স্যার, সময়মত ব্যবস্থা না নিলে নানা সমস্যাই হতে পারে।
আচ্ছা, ডেকে আনছি ওনাকে। শুনে দেখি বিস্তারিত।
স্যার, পাবেন না তো ওনাকে।
কেন?
উনি আমাকে বলে বাইরে চলে গেলেন তখন। সাথে সেই লোক। যে অবস্থা তাতে কার মাধ্যমে কোথায় কোন ঘোরপ্যাঁচ লাগে তা কে জানে?
স্ট্রেঞ্জ! বিশ্বস্ত লোক এমন হয়ে উঠলে তো ঝুঁকির বিষয়।
জি স্যার!
এখন কী করব বলুন। এতসব ঝুট ঝামেলা, তার ওপর–!
স্যার, আজতো আপনি ডেকেছিলেন, আসেনি।
হুম, অবশ্য এমনটি কখনো করেন না। মাঝেমধ্যে ডাকি, পার্টনারদের বিরতিহীন কল, ফরেন বা ট্রাংক কল থাকে ; দরজায় দাঁড়িয়ে একাধিকবার ফিরে যান। পরে আবার আপনা থেকে এসে দেখা করে যান। আজ এমন করলেন!
স্যার, এটাতো এক প্রকার ভায়োলেশন! রীতিমত এক–
তো!
স্যার, ওনাকে একটা শোকজ দিয়া দেন।
শোকজ দেব জয়তুন সাহেবকে?
জি স্যার।
ওনার ওই পদে থেকে অনেকে বাড়িটাড়ি-ঢের পয়সাকড়ি করেছে, উনি আধাবস্তিতে –।
স্যার, সব আপনার বিবেচনা। মনে হয় আমাদের বিষয়ে ওনারও –। তাছাড়া, আমি কোম্পানির স্বার্থে যা বলা কর্তব্য, ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে আপনাকে বললাম। এখন–
হুম, ঠিক আছে, লিখছি শোকজ।
জি স্যার, উঠি।
জি।
ব্যাটা জয়তুন, মাছিমারা কেরানি। মাছিমারা হইয়া তুই আমার সাথে ইংরাজির পাল্লা লাগিস! তাও আবার পিয়নদের সামনে! আমার টেনস জ্ঞানে ভুল ধরিস! সে বাইরে গেছে, ডাহা পাস্ট টেনস। কারণ, তার বাইরে যাওয়া অতীত হয়ে গেছে। আর তুই বলিস প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেনস। এবার বোঝ পারফেক্ট কারে বলে। বোঝ কেরানি আর অফিসারের পার্থক্য। অবসরে বিড়বিড় কইরা কী বলস, কারে ফোন করস, সব বুঝা যাবে। আমি ক্লায়েন্টদের সাথে ঘন ঘন বাইরে গেলে তোর কী? তোর দৌড় কদ্দূর তারও পরীক্ষা হইয়া যাবে, প্রোমোশান! হাঃ হাঃ হা-আ- লিফটের শব্দ আবার বাইরেটাইরে যায় নাকি? ধৌ-উ-র, গেলে গেছে!
বিড়বিড় আর আনন্দ মিশ্রিত চাপা অট্টহাসিতে লিফট দিয়ে নিচে নেমে যান পাবলিক রিলেশনস কর্মকর্তা লিয়ন সাহেব। ঢের পয়সাবাজ লোক। জীবনকে আচ্ছামত ভোগ উপভোগ করেন। উপভোগ করেন কুটকাজের সাফল্যানন্দ। ন্যায় হোক, অন্যায় হোক, নিজের শত ভুল হোক, শুদ্ধ হোক, যেকোন তর্কে বিতর্কে প্রতিযোগিতায় নিজের ইগোকে, ব্যক্তিসত্তাকে তার ওপরে রাখা চাই, বিজিত হওয়া চাই। অন্যকে শায়েস্তা করতে পারার আনন্দ তার কাছে অন্য রকম। স্ফূর্তিতে তা উদযাপনে হোটেলে গিয়ে এক কাপ চায়ের সাথে ডানহিল ফোঁকেন। এখন সে উদ্দেশ্যেই নিচে যাচ্ছেন, যদিও নানা কারণে ঢের ঝুট ঝামেলায় আছেন।
মাশফিক চলে গেছে আজ সকালে। গতরাত সাড়ে আটটার দিকে বাসায় ফেরা ক্লান্ত অবসন্ন জয়তুন সাহেবের সাথে তার বিশেষ কোন কথা হয়নি আর। কাল দুপুরে কেনাকাটা করে অফিসে ফিরেই জয়তুন সাহেব বসের কাছ থেকে এক কারণ দর্শাণো চিঠি পেয়েছেন। সেটির জবাব দিতে বলা হয়েছে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে। তিনি জানেন, প্রত্যুত্তর তিনি চব্বিশ ঘণ্টার আগেই দেবেন। কারণ, সহজবোধ্য বিষয়ে কালক্ষেপণের কোনও যৌক্তিক প্রেক্ষিত থাকে না। অনেক রাত জেগে অফিসের সাম্প্রতিক হালহকিকত, নানা ফিসফাস-গুঞ্জরন অদৃশ্য ঘাত অভিঘাত প্রভৃতি মাথায় এনে ভেবে চিন্তে বসের উদ্দেশ্যে দুটি চিঠি প্রস্তুত করেছেন তিনি। একটি পদত্যাগের, অপরটির ভাবার্থ দাঁড়ায় দু লাইন: আচরণ অনিচ্ছাকৃত ও অন্যায় বিবর্জিত। আমি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
রাতভর কল্পনায় জীবনের নানা আগাম দৃশ্যপট দেখেছেন তিনি : যৌক্তিক পদত্যাগ, একাকী বিচ্ছিন্ন বেকার জীবন, বাড়িতে বিধবা বয়োঃবৃদ্ধা মা, পড়াশোনারত ছোট ভাইবোনের মুখ প্রভৃতি। অফিসের প্রথম ঘণ্টায় বসের কক্ষে হাজির হলেন বিমর্ষ উদভ্রান্ত দর্শন জয়তুন সাহেব। হাতের খামে রাতে প্রস্তুত করা দ্বিতীয় পত্রটি, যার ভাবার্থ উল্লিখিত ওই দু লাইন: আচরণ অনিচ্ছাকৃত ও অন্যায় বিবর্জিত। আমি দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
শওকত নূর | Shawkat Noor
New Bengali Article 2023 | কৃষিভিত্তিক সমাজ ও মুঠ উৎসব
Best Bengali Story 2020 | কিছু নই | শওকত নূর
New Bengali Story 2023 | তুতানের পৃথিবী | গল্পগুচ্ছ
Godhuli | গোধূলি | রম্যরচনা | জয়ন্ত কুমার সরকার | Best 2023
Shabdodweep Web Magazine | Read Online Story Books | Shawkat Noor
In the modern world of digital convenience, the way we enjoy books has changed significantly. Gone are the days of needing to carry heavy novels or hunt down rare books in physical stores. Now, you can read online story books with just a few clicks. Whether you’re into thrilling mysteries, heartwarming tales, or online classic storybooks, the world of online literature offers endless opportunities to discover new stories.
One platform that stands out in this digital age is Shabdodweep Web Magazine. A place where readers can enjoy a vast collection of free online books, Shabdodweep Web Magazine hosts stories, novels, and narratives from a range of genres. Here, readers can read online story books for free and dive into compelling stories written by notable authors like Shawkat Noor.
The Appeal of Reading Online Story Books
Today, more and more people prefer to read online story books due to the convenience and variety they offer. The benefits of reading online go beyond simple accessibility—it’s about the freedom and flexibility that come with it.
- Instant Access to Free Online Books
One of the key advantages of reading books online is that it’s incredibly convenient. You don’t have to wait for a book to be shipped or visit a bookstore. With online platforms like Shabdodweep Web Magazine, you can read online story books anytime you want. From online classic storybooks to fresh contemporary pieces, you can access a variety of genres with just a few clicks—at no cost!
- A Vast Selection of Stories
When you read online story books, you’re not restricted to a single genre. Whether you’re looking for classic novels, heartwarming short stories, or gripping mysteries, online platforms offer an expansive selection. On Shabdodweep Web Magazine, readers can explore everything from online classic storybooks to the latest literary works in multiple genres, ensuring there’s always something new to discover.
- Flexibility and Portability
With the digital format, you can enjoy reading books from any device—smartphones, tablets, or laptops. This portability makes it easy to read online story books whether you’re commuting, traveling, or relaxing at home. Shabdodweep Web Magazine optimizes its platform so you can read online story books wherever you are, without worrying about carrying physical books.
- Engaging Content from Acclaimed Authors
Reading online story books also gives you the opportunity to discover incredible works from renowned authors. One such author featured prominently on Shabdodweep Web Magazine is Shawkat Noor, whose stories have captivated a wide audience. His narratives, such as Maajh Raat, Gaai, Inspector, and Dukkhito O Khomaprarthi, reflect deep human emotions, societal challenges, and timeless themes. On Shabdodweep Web Magazine, readers can enjoy reading books like these for free, gaining access to some of the finest literature available online.
Why Shabdodweep Web Magazine is your ideal destination to read online story books?
Shabdodweep Web Magazine is committed to offering the best literary content to its readers. With a focus on providing free online books, we ensure that high-quality stories and novels are accessible to everyone, regardless of their budget.
Here are a few reasons why you should read online story books on Shabdodweep Web Magazine:
A Diverse Collection of Storybooks
At Shabdodweep Web Magazine, we offer a variety of genres. From online classic storybooks to modern fiction, there’s something for every reader. Whether you’re a fan of mystery, romance, drama, or satire, you’ll find plenty to engage with.
Free and Accessible to All
One of the most attractive aspects of our platform is that all stories, including online classic storybooks and contemporary works, are available for free. We believe in making literature accessible to everyone, no matter their financial circumstances.
Interactive Community
On Shabdodweep Web Magazine, reading books is not just a solo activity. We invite readers to engage with the stories by leaving comments, participating in discussions, and sharing their thoughts with fellow readers. This creates a sense of community and fosters a deeper connection to the content.
FAQ: Read Online Story Books on Shabdodweep Web Magazine
- Where can I read free online books?
Shabdodweep Web Magazine offers a wide range of free online books for all readers. You can access various online classic storybooks and modern tales for free on our platform.
- Do I need to sign up to read online story books?
No, you don’t need to sign up to read online story books on Shabdodweep Web Magazine. All our stories, including those by Shawkat Noor, are available for immediate reading without any registration.
- What types of storybooks can I read on Shabdodweep Web Magazine?
Shabdodweep Web Magazine offers a vast collection of genres, including mystery, romance, drama, and more. We feature both online classic storybooks and contemporary pieces, catering to a wide range of interests.
- Can I read Shawkat Noor’s stories online?
Yes! You can read Shawkat Noor’s popular works, such as Maajh Raat, Gaai, and Inspector, on Shabdodweep Web Magazine. All of his stories are available for free on our website.
- Are there any interactive features on Shabdodweep Web Magazine?
Yes, we encourage readers to interact with the content by leaving comments, sharing their thoughts, and engaging with other readers and authors. It’s a great way to deepen your connection with the stories.
Sabuj Basinda | High Challenger | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio