Best Pdf Story Bangla | Shabdodweep Bengali Story

Sharing Is Caring:

একাকী – শওকত নূর

নগরীর শেষ গলি পেরিয়ে নগররক্ষাকারী বাঁধের ওপাশে বিস্তৃত বিল। সাদা পানি- পৃষ্ঠ ছাড়িয়ে উঁচুতে ঝুলে থাকা মাছধরা ছিপজালের ছিপশরগুলো যেন কোনও দুর্বোধ্য শূন্যতার হাহাকার ছড়িয়ে যাচ্ছিল তামাম বিল পরিসরে। সরলরৈখিক গলিমাথা বরাবর একটু ওপরে নজর ওঠালে প্রান্তিক গাছগাছালির ফাঁকা দিয়ে ভেসে আসছিল ধোঁয়াটে আকাশের উদাস খণ্ডচিত্র। ছিপশরগুলোর গায়ে, পারস্পরিক ফাঁকায়, পানি পৃষ্ঠে ও উঁচুতে তথা শূন্যে উড়ছিল শাদা বকের ঝাঁক, বালিহাঁস, পানকৌড়ি, সুঁইচোর পাখির দল। কোনও মানুষের অবয়ব দৃশ্যপটে নেই – জলাশয় জুড়ে পড়ন্ত বেলার শেষ সূর্যরশ্মির লালাভা-বিস্তৃতি, বাঁশে বাঁধা শূন্য ডিঙিনৌকা-খা খা নির্জনতা।

গলির কৌণিক বাঁকে অবস্থিত একতলা এক বাড়ি, যেটির পেছনের বাঁধ পেরিয়ে উল্লিখিত এসব দৃশ্যপট গলি-হাঁটা লোকদৃষ্টিকে দুর্নিবার ওদিকে টেনে নেয়, সে বাড়ির সম্মুখ পেছন ও পার্শ্ব পথত্রয়ের ওপর দিয়ে বেশ ক’বার পদ-চক্কর দিয়ে এসেছে মেহমুদ আবু দানিশ। অথচ বাড়িটির অবস্থান আবিষ্কারে সে সক্ষম হয়ে ওঠেনি। যে দিকভ্রান্তি বা পথভ্রান্তির বিষয় চক্রাবর্তে তাকে বারংবার একই পথের একই প্রান্তে এনে স্থির করাচ্ছে, তেমন বিষয়কে নিজ আঞ্চলিক ভাষায় সে আশৈশব কানাউল্লায় ধরা বলে জেনে এসেছে। সে বিস্ময়ে ভাবছে, শেষ পর্যন্ত তাকেও কি কথিত সে কানাউল্লাতেই পেয়ে বসেছে, নাকি ভিন্ন কিছু।

ছেলেবেলায় প্রায়ই সে শুনত, পথের মধ্যে অমুককে কানাউল্লায় ধরাতে বারবার একই পথে চক্কর দিয়ে সে বাড়ির পথ খুঁজে পায়নি, কিংবা অমুক কানাউল্লার খপ্পরে পড়ে বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে না পেয়ে মাথায় হাত দিয়ে দীর্ঘক্ষণ পথে বসে থেকেছিল, অথবা তমুক মাঝপথে কানাউল্লার বাগড়ায় পথ ভুলে নিজ গাঁ ছেড়ে ভিন গাঁয়ে গিয়ে হাজির হয়েছে প্রভৃতি। জনশ্রুতি মতে, এ যাবৎকালে যারা কথিত কানাউল্লার খপ্পরে পড়ে নাজেহাল হয়েছে মর্মে রটনা রটেছে, তার দেখায় তাদের অধিকাংশই থাকত বয়সী বা মধ্যবয়সী লোক, কিংবা বয়স ততটা না হবার ক্ষেত্রে উদাসীন চরিত্রের। কিন্তু তার মতো তরতাজা যুবককেও দিব্যি দিবালোকে ছোট্ট মফস্বল শহরের প্রান্তিক মহল্লায় কানাউল্লায় পেয়ে বসল?

গলিমাথায় অনঢ় দাঁড়িয়ে ভাবনাতেই আচ্ছন্ন রইল সে। উত্তরে মসজিদ, পুবে সুপারশপ, দক্ষিণে ওষুধের দোকান- সামনে দিয়ে পশ্চিমগামী গলিপথ ; বাসাটা তো এখানেই হবার কথা। কিন্তু কই? ডানে সরে এবারে সে প্রবেশদ্বার বরাবর দৃষ্টি খাড়া ওপরে ওঠাল। এতক্ষণ ধরে নজরে না পড়া হোল্ডিং নম্বরটি

এ মুহূর্তে তার দৃষ্টি কাড়ল। বারংবার দেখায় মুখস্থ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড বার করে মিলিয়ে নিল সে নম্বরটি। হোল্ডিং মতে এটিই উদ্দিষ্ট ভবন, যার সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় সে তথাকথিত কানাউল্লা আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘক্ষণ হন্যে হয়ে একই আবর্তে আবর্তিত হয়েছে।

অবশেষে গন্তব্য আবিষ্কারে সফল হবার সাথে সে এও আবিষ্কারে সক্ষম হলো, এতক্ষণ ধরে চলা বিভ্রান্তির মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে প্রবেশদ্বারে দৃশ্যমান ভবনের নামফলক’ একাকী’, যার কোনও উল্লেখ ভিজিটিং কার্ডে নেই। দ্বিতীয়ত কাজ করেছে হোল্ডিং নম্বরটির ফ্যাকাসে দশা ও অস্বাভাবিক, অচিন্তনীয় উচ্চাবস্থান। প্রতিবারে ভবনের নিশানা শনাক্তে তার মন ও দৃষ্টি নামফলক একাকী নাগাদ হোঁচট খেয়ে ডানে বাঁয়ে কিংবা নিচ বরাবর বিচ্যুত হয়ে তাকে উন্মুক্ত বিল-পথের দিকে টেনে নিয়ে গেছে।

নামফলক সংক্রান্ত দ্বিধা সংশয় ঝেড়ে এবারে সে কলিংবেল চেপে ওপাশে কোনও শব্দ বাক্য ধ্বনিত হবার প্রত্যাশায় উৎকর্ণ হয়ে রইল। প্রায় মিনিট পাঁচেক পার হলো, কিন্তু ভেতরে কোনও সাড়াশব্দের আভাস মিলল না। খানিক ভেবে সে আবারো বেল টিপে কান খাড়া করে রইল। এবারেও ভেতরের নৈঃশব্দ্যে কোন ব্যত্যয় নেই।

সে দাঁড়িয়েই রইল। নানা ভাবনায় আচ্ছন্ন হতে লাগল তার মন- সে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছেছে কি পৌঁছেনি, ভেতরে কেউ আছে কি নেই, যে প্রৌঢ় ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ উদ্দেশ্যে সে এসেছে, তিনি ঘুমিয়ে আছেন নাকি বাইরে আছেন, বাসায় কতজন সদস্য আছে, সবাই ঘুমিয়ে নাকি সবাই বাইরে, কতক্ষণ অপেক্ষার পর সে ফিরে যাবে প্রভৃতি। হাতের ঘড়ি দেখল সে। দ্বিতীয়বার বেলে টিপ দেবার পর পনেরো মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। নাহ, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা কোনমতেই যৌক্তিক কিংবা শোভন হয় না! আরেকবার বেল টিপে গুনে ঠিক পাঁচ মিনিট সে অপেক্ষা করবে। তারপরই নিঃসংশয়-অনিবার্য প্রস্থান। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল সে মনে মনে।

মিনিট দুই অতিক্রান্তে চমকে উঠল সে। একটা মোটরগাড়ি তার ঠিক পেছনেই হর্ন বাজিয়ে দাঁড়িয়েছে। ওদিকে দৃষ্টি ধরে নিজেকে সংহত করে নিল সে। গাড়ি থেকে তার দিকে নজর করে ঝটপট বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক। দীর্ঘদেহী, সুবেশ সুদর্শন, কালো সানগ্লাস চোখে। দুজন মুখোমুখি হতেই উচ্ছল চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, আরে, মি. দানিশ! এসেছেন তাহলে? কী সৌভাগ্য আমার! আপনি এসে গেছেন দিব্যি!

জি, স্লামালিকুম, কেমন আছেন আপনি?

যথেষ্ট ভালো। তা ভালো আছেন নিশ্চয়ই, নইলে আমার এমন সৌভাগ্য হবার কথা নয়। এখানে কেউ কখনো আসে না। চলুন ভেতরে যাওয়া যাক।

জি।

এরই মধ্যে গাড়ির চালক চাবি দিয়ে গেইট খুলে গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। প্রৌঢ় ভেতরে পা রাখলে তার সাথে হাঁটতে লাগল মেহমুদ আবু দানিশ। ভেতরের লনে পা দিয়ে বেশি একটা রোমাঞ্চিত হলো না সে। বাড়িটা যে বাগানবাড়ি হবে, সে ধারণা তার মনে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়েই বদ্ধমূল হয়েছিল। তবে ক’ কদম হেঁটে ভেতরে খানিকটা আন্দোলিত হলো সে লনে লনে দৃশ্যমান অধিকাংশ ফুলের অভিন্ন সাদারঙ দেখে।

মিনিট দুই নীরবে হাঁটছিল দু’জনই, ভাবনাচ্ছন্ন। ভদ্রলোক আকস্মিক নীরবতা ভাঙলেন, তা কেমন বোধ করছেন এখন?

বেশ ভালো, খুব সুন্দর আপনার এ বাড়ি।

ধন্যবাদ, তা অনেকটা ক্লান্ত লাগছে আপনাকে। খুঁজে পেতে কষ্ট হয়নিতো?

কিছুটা।

প্রায়শ ভাবি, নম্বরপ্লেটটা একটু নিচে নতুন করে সেঁটে দিই, ভিজিটিং কার্ডেও বাড়ির নামটা উল্লেখ করে দিই। কিন্তু ভিজিটরই যেখানে শূন্য, সেখানে- -। যাক, এসব কথা পরে হোক। এটাই বসার ঘর, বসুন এখানে কিছুক্ষণ আয়াস করে , আসছি আমি ভেতর থেকে।

ভদ্রলোক ভেতরে চলে গেলে পত্রিকার পাতা ওল্টাবার ফাঁকে চারদিকে দৃষ্টি বোলাতে লাগল মেহমুদ আবু দানিশ। ছবির মতোই ছিমছাম সুদৃশ্য ঘরটি। চারদিকের দেয়ালে ঝোলানো ছবি- অধিকাংশই প্রাকৃতিক দৃশ্যের। খানিক বিস্ময়ে সে দেখল প্রাকৃতিক দৃশ্যের ছবিগুলোর সিংহভাগই ফসলের মাঠে কৃষকের কাজে নিমগ্ন থাকার পটে আঁকা, কোনটি বা ক্যামেরায় তোলা ও বাঁধানো। গৃহপালিত জীবজন্তুর ঘাস খর খাওয়া বা কাজের দৃশ্যও নেহায়েত কম নয়। একেবারে মুখোমুখি দেয়ালে দুটি ছবি আছে – বর্ষার বিল ও তার ওপর ঘোর বর্ষণের।

একেক মানুষের একেক রকমের চিন্তা চেতনা আদর্শ ও রুচি অভিরুচি – ছবিতে দৃষ্টিপাতের ফাঁকে ভাবতে লাগল মেহমুদ আবু দানিশ। মিনিট দশের মাথায় ভেতর থেকে ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলেন ভদ্রলোক। দরজায় পা রেখেই জোরেশোরে বলে উঠলেন, তা মি. দানিশ, ছবি দেখছেন, না?

জি।

কেমন লাগছে সব দৃশ্যপট? অধিকাংশই তো গেঁয়ো কৃষককুলের জীবনঘনিষ্ট ছবি। নিন, হালকা রিফ্রেশমেন্টের ফাঁকে আলোচনা সারা যাক। বলুন কেমন লাগছে।

জি, বেশ। মনোমুগ্ধকর প্রতিটিই।

খুশি হলাম। লেখক মানুষ, প্রাকৃতিক যেকোন দৃশ্যপটই ভালো লাগবে, তা-ই স্বাভাবিক। তবে আমি ভাবতে পারিনি যে আপনি এখানে আসবেন। ফোন-টোন কিছু করেননি, ভালো লাগে না বোধকরি। এ প্রবণতাটা একসময় আমারও ছিল। ভালো লাগত না ফোনটোন করতে। সরাসরি সাক্ষাতে গিয়ে ঘুরে আসতাম অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সাক্ষাৎ না পেয়ে। তারা দাম দিতেন না বিশেষ, কিংবা ভেতরে বিরক্ত হতেন।

আমার ফোন নেই। খুব জরুরি না হলে দোকান থেকে ফোন করি না। অবশ্য বারদুই আপনার ফোনে ট্রাই করেছিলাম।

ওইযে বাইরে ছিলাম এতক্ষণ।

আপনি বলেছিলেন রবিবার আপনি পুরোদিন বাসাতেই কাটান। বাইরে বেরোবার নজির বিরল।

হাসপাতালে এক আত্মীয়ের মুমূর্ষু দশা শুনে ছুটে গেছি। যাক সেসব, ক’টায় ফিরবেন, বলুন।

যদি আগেভাগে বেরোতে পারি, রাত দশটার ট্রেন ধরে ফিরব, ঠিক করে রেখেছি।

তাহলে কথায় আসা যাক, অযথা সময়ক্ষেপণ ঠিক হবে না।

জি।

এবার বলুন এখানে আসা অবধি কী কী কৌতূহল বোধ করছেন, লেখক মানুষ। কোনও কৌতূহল আমাকে ঘিরে?

জি, নিশ্চয়ই। কিছু মনে নেবেন না, বাসায় অন্য কোন মানুষজন দেখছি না। কী বৃত্তান্ত?

নেই কেউ। বাড়ির নামফলক দেখে কিছুটা ধারণা পেয়েছেন নিশ্চয়ই?

জি, কৌতূহল জেগেছিল অবশ্য।

তাহলে নামফলক দিয়েই আলোচনার গোড়াপাত করা যাক, না কী বলুন?

জি, তা করা যায়। ‘একাকী’ বাড়ির নাম, কী এমন তাৎপর্য?

তাৎপর্যে পরে আসা যাক। আগে বলুন একাকীত্বের সাথে প্রতিটি মানুষেরই কম বেশি সংশ্লিষ্টতা থাকে কি না।

জি, তা থাকে। কখনো কখনো মানুষকে একাকীত্বের স্বাদ তো গ্রহণ করতেই হয়। জীবনের কোনও পর্বে, পর্যায়ে।

ঠিক ধরেছেন। এই একাকীত্ব কখনো ভালো লাগে, যদি তা স্বেচ্ছা-পছন্দের কিংবা স্বল্পকালের হয়। কিন্তু আরোপিত বা বাধ্যতামুলক গৃহীত দীর্ঘকালীন একাকীত্ব প্রায়শ মানুষকে অসহায় করে তোলে। এমন মুহূর্তে অন্যের সামান্যতম হাত প্রসারণেও নিজেকে ধন্য কিংবা মূল্যবান গণ্য হয়। সেদিনের কথা মনে আছে কি না আপনার?

কোনদিন?

আগে দেখাই তো হয়েছে আপনার সাথে একদিন মাত্র। ওই সেই কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠানের দিন, সেদিনেরই কথা।

জি, বলুন।

একটা পানির গ্লাস জরুরি প্রয়োজন পড়েছিল আমার। এত লোক থাকা সত্ত্বেও কাউকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না সাহায্যটি পেতে। অচেনা হয়েও আপনি দ্রুত একটি গ্লাস নিয়ে এলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজের বোধানুভূতিতে দ্রুত একটা বিপ্লব যেন ঘটে গেল। কত সামান্য একটা ঘটনা, অথচ নিমিষে তা নিজের ভেতরে আস্থাবোধ জাগিয়ে তুলল- নিজের কাছে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলল। জনসমুদ্রের একাকীত্বে যেন কুঠারাঘাত হানলো। তুচ্ছ অথচ তাৎপর্যময়।

হুম, তুচ্ছ ঘটনাটি আমাকেও সাময়িক আন্দোলিত করেছিল। আপনার কাজে আসতে পেরে নিজেকে মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য হয়েছিল। জনসমুদ্রে অবচেতনে আমিও হয়তো একাকীত্বে ডুবেছিলাম।

দেখুন, কত তুচ্ছ একটি ঘটনা, একটি সামান্য হাত প্রসারণ আমাদেরকে পরস্পর ঘনিষ্ঠ করে তুলল।

নইলে হয়তো আজ আপনার এখানে পদার্পণ থাকত ইহজাগতিক ঘটনাবলীর বাইরের কোনও বিষয়, ঠিক কি না?

নিশ্চয়ই, তা এখন কী অবস্থা আপনার শরীরের?

বেশ। প্রসঙ্গে আসা যাক। এবার আপনার অন্য কৌতূহলগুলো একে একে প্রকাশ করুন।

হু- ম, এই যে এতসব ছবি, অধিকাংশই খেত ফসল কৃষকের, কী হেতু?

হেতুটা একান্ত সাধারণ, যদিও নিগুঢ় নেপথ্য কথাটি ব্যক্তিভেদে জটিল কিংবা বেদনা উৎসারী গণ্য হতে পারে।

খুলে বলুন দয়া করে।

সে আমার শৈশবের কথা। আমি দরিদ্র দিনমজুর কৃষক- সন্তান ছিলাম। শুধু তাই নয়, বয়স সাত থেকে বারো অবধি ধনাঢ্য এক কৃষকের বাড়িতে লাগোয়া কর্মী তথা ভৃত্য ছিলাম।

তারপর?

এই যে আমরা পরিবেশে বসবাস করি, অগণিত উদ্দীপক চারদিকে, অগণিত ঘটনাপঞ্জী আমাদের ঘিরে চারদিকে আবর্তিত হয়। সময়ে কোন কোনটি আমাদের মনোজগতে শক্তিশালী প্রভাব সৃষ্টির মাধ্যমে জীবনধারাই আমূল পাল্টে দেয়।

যেমন?

ওপাশের বিল দেখেছেন নিশ্চয়ই? মনে তা নিয়ে কোন কৌতূহলও জেগে থাকতে পারে। এ বাসার যে অবস্থান!

না, এ ধরনের প্রান্তিক বাসা অনেক শহরে অনেকেরই থাকে। বিশেষ কোনও ভাবনা তা নিয়ে জাগেনি।

এ বাসার লোকেশনটা আমার দীর্ঘ অনুসন্ধানের ফসল। শহরে হলেও অদূরে বিস্তৃত বিল থাকবে, এমনটিই লক্ষ্য ছিল আমার।

কেন?

ওই যে বললাম শৈশবের কথা।

কৃষিপ্রধান দেশ, এমনটি অনেকেরই থাকে, খুবই স্বাভাবিক সাধারণ বিষয়।

এও বলেছি, কোন কোন উদ্দীপক কিংবা ঘটনা জীবনকে আকস্মিক আমূল পাল্টে দেয়, বলেছি কি না?

জি, বলুন দয়া করে সে উদ্দীপক বিষয়ক ঘটনা, শোনা যাক তবে।

বলছি শুনুন। শৈশবের সে ঘটনার দিনটি ছিল মধ্য শ্রাবণের এক দিন। সাতসকালে গৃহস্থের বাড়িতে একপাল আত্মীয় এলো- আবালবৃদ্ধবনিতা। সবাই হাইফ্যাশনিস্ট, অত্যাধুনিক। দুপুরের খাবারদাবার গ্রহণের পর তাদের শখ হলো বর্ষার আমন বিলে নৌভ্রমণে যাবার। সময়টা এমন যে সারা আকাশ ছেয়ে ঘনকালো মেঘ ধেয়ে আসছিল নিচে। দিনের বেলাতেও যেন ঘোর অন্ধকার নেমে আসছিল।দক্ষিণ পশ্চিমের হাওয়াটা ছিল দুর্বার। স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছিল, প্রবল বর্ষণ অত্যাসন্ন ও অনিবার্য। কিন্তু গৃহস্থের নিষেধাজ্ঞায় কোনও কর্ণপাত করলেন না অতিথিদল। নৌভ্রমণে এমন আবহাওয়াই যেন তাদের কাম্য। নৌ চালনায় বেশ সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠেছিলাম আমি ওই বয়সেই। বর্ষায় হাটেবাজারে যাওয়া আসায়, আত্মীয়পরিজনের পারাপার তথা আনা নেয়াতে নৌ চালনার কাজটি বরাবর আমাকেই করতে হত। সেদিনও দায়িত্বটি আমার ওপরই বর্তাল।

তারপর?

সেই একপাল আবালবৃদ্ধবনিতা নিয়ে বিলে নৌকা ঠেলছিলাম আমি। মাঝবিলে গিয়ে শুরু হলো ঘোরতর বর্ষণ। চারদিকে ধোঁয়াটে ধারায় আচ্ছন্ন করে দেয়া বর্ষণ। আকাশ ভাঙা প্রবল সাদাধারায় প্রায়ই যেন অদৃশ্য হয়ে উঠছিল যত ভাসমান কচুরিপানা, লাল সাদা শাপলাফুল ও ঘন সবুজ আমনধানের শীর্ষ। খেতের পর খেত পেরিয়ে চলছিল নৌকাটি। থেকে থেকে বর্ষণ ফোঁটা ভারী হয়ে যেন কাঁটার মতো বিঁধছিল গায়ে। দেখলাম, ভিজে সব চোপসানো, একাকার- অথচ উচ্ছ্বাসে ন্যূনতম ঘাটতি নেই কারোরই। ঘণ্টা দুয়ের বর্ষণে ঘণ্টা দুই-ই নৌকা ঠেললাম আমি। ঠেলার ফাঁকে সারাক্ষণই আমার দৃষ্টি ছিল অতি সুশ্রী এক কিশোরীতে। বয়স যে তার খুব বেশি, তা নয়। আমার তের হলে তার আট কি’ নয়। বয়ঃসন্ধিকাল আমার তখন, আবেগ- উচ্ছ্বাস , অনুভূতি প্রাবল্য স্বাভাবিকভাবেই তাৎপর্যবহ। সে কিশোরীর বৃষ্টিস্নাত শরীর মুখমণ্ডল ভেতরে খুব রোমাঞ্চিত করল আমাকে। পাশাপাশি ভেতরে প্রচণ্ড এক দুঃখবোধ তথা শোকাফসোসেরও অভ্যুদয় ঘটাল। আমার পিতা দরিদ্র হলেও বয়স চারপাঁচে আমার পড়ালেখায় উদ্যোগী হয়েছিলেন। চালিয়ে নেয়ার ইচ্ছেও তার ছিল। কিন্তু দু’ ক্লাস অতিক্রান্তের পর আমিই ইস্তফা দিয়ে পরের বাড়িতে কাজে লেগে যেতে উন্মুখ হয়েছিলাম। সংসারে প্রকট অভাব অনটন ছিল আমাদের। আহার জুটত না ভালো। পরের বাড়িতে কাজে লেগে যাবার আগ্রহের নেপথ্যে খাদ্যাভাবই ছিল বড় চলক। কিন্তু সেদিনের সে বর্ষণ সংক্রান্ত ঘটনা আমূল পাল্টে দিল আমাকে।

কিভাবে?

নৌভ্রমণ থেকে ফিরে নিভৃতে অনেক করে ভেবেচিন্তে স্কুলে ফিরে যেতে বদ্ধপরিকর হলাম আমি। বাবাকে বলে গেলামও ফিরে শিগগিরই। শুরু হলো আমার ভিন্ন জীবন। বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গেলেও ধরতে পারছেন নিশ্চয়ই মনোভাবটা- আত্মোপলব্ধি।

জি, তারপর?

অভাব অনটন থাকলেও ভেতরের তীব্র বাসনা আমাকে নিরলস অধ্যবসায়ী করে তুলল। জীবন তথা পরিবারের খোলনলচে পাল্টে দিতে প্রবল সংগ্রামী হয়ে উঠলাম আমি। প্রতিটি ক্লাস উৎরে যেতে লাগলাম ঈর্ষণীয় সাফল্যের সাথে। একসময় গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম।

তারপর?

যে ক্ষণিক দৃশ্যপট বোধানুভূতিতে প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে স্কুলমুখী করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ নাগাদ ঠেলে এনেছে, তা অতীতের তাবৎ জরাজীর্ণতাকে ছুঁড়ে ফেলে তেমনই কোন চাকচিক্যময় অগ্রসর জীবনের পথে আমাকে টেনে নেবে, ভেতরে তেমন স্বপ্ন জাগাবে, স্বপ্নে সেদিনের সে কিশোরী প্রভাবক হয়ে থাকবে- বাস্তবে তার উপস্থিতি থাক বা না থাক, খুবই স্বাভাবিক। ভেবে দেখুন কী হতে পারত যদি সেদিনের সেই দৃশ্যপটের আবির্ভাব আমার জীবনে না ঘটত। আজীবন আমি এক গৃহভৃত্যই থেকে যেতাম, ঠিক কি না?

নিশ্চয়ই।

বিশ্ববিদ্যালয়েও আমি কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে চললাম। সেরা পাঁচ এর একজন হতাম আমি বরাবর। আচ্ছা বলুনতো আভিজাত্যের মতো কোনও কিছু আমার অবয়বে আছে কি নেই – আমাকে সন্তুষ্ট করার স্বার্থে বলার প্রয়োজন নেই। যা বাস্তব, তা-ই

বলুন।

বলার অপেক্ষা রাখে না যৌবনে নিশ্চয়ই ঢের সুদর্শন ছিলেন আপনি, এখনও উল্লেখ করার মতো।

ধন্যবাদ। বিপরীত লিঙ্গের অনেকেই আকৃষ্ট হতো আমার প্রতি। প্রথমদিকে এড়িয়ে চললেও বিশ্ববিদ্যালয় পাঠের শেষ পর্যায়ে এসে এক সুদর্শনার সাথে গভীর প্রণয়ে জড়িয়ে গেলাম আমি। একই ক্লাস এর আমরা, ক্যাম্পাস ও ক্যাম্পাসের বাইরে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ হতো আমাদের। আমরা বদ্ধপরিকর ছিলাম চিরসঙ্গী হবার। পরস্পরকে ছাড়া যেন ভাবতেই পারতাম নাা। ভবিষ্যৎ ঘিরে অনেক পরিকল্পনা এঁটেছিলাম আমরা। এই যেন রচিত হতে যাচ্ছিল আমাদের সুখনীড়।

তারপর?

এমন পর্যায়ে একদিন সে সঙ্গিনীর নিমন্ত্রণে এক বন্ধুকে নিয়ে তাদের এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে যোগ দিই আমি। সেখানেই ঘটে যত বিপত্তি। কথায় আছে, বিধিবাম- যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে রাত হয়।

কী ঘটেছিল সেখানে?

সেই অনুষ্ঠানে পরম বিস্ময়ে উপস্থিত দেখতে পাই কৈশোরের বর্ষাবিলে প্রমোদভ্রমণে যাওয়া সেই বৃষ্টিস্নাত কিশোরীকে। জানতে পারি সেও তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং তারা দুজন পরস্পর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী।

কী হলো তারপর?

বিশদ বর্ণনায় গেলে বহু শব্দবাক্যের প্রয়োজন পড়বে- এককথায় সমাপ্তি টানলে বলতে হয় ‘ব্যর্থপ্রেম’ ।

এত গভীর প্রেম ব্যর্থ হয়ে গেল?

নিশ্চয়ই।

কারণ?

ওইযে আমার অতীত!

তিনি জানতেন না আগে থেকে?

আমি বহুবার বলতে উদ্যোগী হয়েছি, কিন্তু সে একবর্ণও শুনতে চায়নি। তার মতে, সে আমাকে ভালোবেসেছিল, সময়কে বা আমার কোনও জীবন-বৃত্তান্তকে নয়। অতএব, জীবন বৃত্তান্ত পেশ নিষ্প্রয়োজন।

কিন্তু মনোভাবটা এমন ঠুনকোমত বিচূর্ণ হলো?

দুঃখবোধটা আমার সেখানেই। ব্যাপারটা এমন জটিল এবং বিশেষ তাৎপর্যময় যে যেকোনোও শিক্ষিত সচেতন পুরুষকে তা ব্যক্তিত্ববোধে আক্রান্ত করে তুলবে । সবক্ষেত্রে নিজেকে নিচু করা কিংবা বিকিয়ে দেয়া চলে না। আমিও পারিনি।

ভেরি স্যাড, ঠিকই করেছেন আপনি। আচ্ছা তারপরের ঘটনা বলুন।

বিশ্ববিদ্যালয় পাঠ শেষে স্কলারশিপ নিয়ে বাইরে চলে যাই উচ্চতর ডিগ্রি’র উদ্দেশ্যে। তা সম্পন্নে সেখানে ক’ বছর চাকরির পর দেশে ফিরি। দেশে ফিরে ইচ্ছে করলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক হতে পারতাম। কিন্তু আবারও সেই ক্লাস, শিক্ষার্থী, তরুণ তরুণী, ভিরভাট্টা -কেন যেন মনে অনিহা জাগে। তাই ইচ্ছে করেই ওদিকে যাইনি। কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হয়েছি। অনেক দেখেশুনে এখানে বাড়ি করে একাকীত্বকে ভালোবাসছি।

কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে আমিতো ভেবেছিলাম সেখানকার অনেকেই আপনার পরিবারভুক্ত- স্ত্রী, পুত্র, কন্যা প্রমুখ।

না না, তেমন ভাবনা স্বাভাবিক হলেও তা ভুল। তবে আমার ছোট ভাইবোনরা সেখানে সপরিবারে উপস্থিত ছিল। সংখ্যায় নেহায়েত কম নয় তারা।

কেমন কী তারা?

সবাই উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ – অভিজাত এলাকায় বসবাসকারী।

কিন্তু –।

ওই যে সেই ঘোর বর্ষার ক্ষণ- তারই প্রত্যক্ষ ফল। আমিই পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। বাবাকে বুঝিয়ে শেষ জমিখণ্ড পর্যন্ত বিক্রিবাট্টা করে তাদেরও পড়াশোনার ব্যবস্থা করেছিলাম। কলেজ পর্যায় থেকেই একাধিক টিউশনি করে তাদের ওপরে ওঠার পথে সহায়তা করেছি।

আপনার মা-বাবা কি জীবিত আছেন?

না, আমার দূরদেশে থাকাকালে দু’ জনই গত হয়েছেন।

অন্যদের সাথে সামাজিক সম্পর্ক বা যোগজাল কেমন কী?

চালিয়ে নেবার মতো স্বাভাবিক।

তারা কি এখানে কেউ আসেন?

বলেছি আগে। আমার পক্ষ থেকে আবশ্যকতাও ততটা নেই। কারণ, আমিতো এখানে একাকীত্বকে স্বেচ্ছা-ভালোবেসেই একাকী।

উঠি তবে আজ। আবার এলে আপত্তি থাকবে না নিশ্চয়ই?

আমি আপনাকে সাগ্রহে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। ব্যাপারটা ভেবে দেখার মতো।

দুঃখিত, বিদায়।

বিদায়।

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে অনেক আগেই। বাসার গেইট পেরিয়ে বাইরে পা রেখেই থমকে দাঁড়াল মেহমুদ আবু দানিশ। অপ্রত্যাশিত লোডশেডিং। কিছুক্ষণ এদিক সেদিক দৃষ্টিপাত করল সে। তারপর হাঁটল। ঘড়িতে সময় দেখে হাঁটা অব্যাহত রাখল- ভাবনাচ্ছন্ন, মাথা নিচু। মিনিট পনেরো হেঁটে সে উপলব্ধি করল, রহস্যময়ভাবে আবারও সেই তথাকথিত কানাউল্লার অদৃশ্য হাত তাকে বিভ্রান্তিতে টানছে। একসময় নগরবাঁধের ওপর এসে স্থির দাঁড়াল সে।

সম্মুখে বিস্তৃত বিলের দিকটা পশ্চিম, বাঁয়ে দক্ষিণ, ডানে উত্তর – অদূরে রেলস্টেশন। ডানে শরীর ঘোরাবার আগে বিলটাকে শেষবার দেখে নিল সে একনজর। ছিপজালের ছিপশরগুলো তেমনি শূন্যে ঝুলছে – মেছুয়াদের কেউ নেই – নিবিড় অন্ধকারে ডিঙিনৌকায় ছায়ামূর্তিমত কেউ বসে আছে- ‘একাকী’।

উপস্থিতি – শওকত নূর

আমার উপস্থিতিতে তাদের বিচলিত হবার কোনও লক্ষণ ফুটে উঠল না। আমিই বিচলিত হলাম উল্টো, এই ভেবে যে এ বাড়ির খোলা আঙিনায় এমন আসর একান্ত নজিরবিহীন ঘটনা। গান বাজনায় এ বাড়ির কেউ কোন কালে ছিল না তা নয়, তবে ভৃত্য সকল ব্যতিরেকে বড়সড় আসর জমানোর মতো কোন ঘটনা এই প্রথম। কারা গাইছেন এতসব মনোহর ভারি যন্ত্রপাতিতে, এমন সুরেলা কণ্ঠে? কেউ তানপুরা নিয়ে স্থির বসে, কারো মুখে বাঁশি, কারো কাঁধে বেহালা, হাতে মৃদঙ্গ সরাজ, কারো বা আঙ্গুল সেতার -তবলা ও হারমোনিয়ামে।

আমারই বাড়ি অথচ আমিই যেন অতিথি। তাদের এতটা ঘেঁষে পা চালিয়ে আঙিনা পেরিয়ে বারান্দায় উঠে এলাম, কেউ চোখ মেলে চাইলেন না পর্যন্ত। সঙ্গীতে এতটাই মত্ত তারা! অবশ্য মত্ততা না এলে এমন সুর সৃষ্টি সম্ভব নয়। শরীর কেমন শিউরে যাচ্ছে- পার্থিব জগতে অনেকের সুরই আমাকে ভীষণ টেনেছে, আজও টানে, কিন্তু এমন অপার্থিব মূর্ছনা! বারান্দায় নিস্পন্দ দাঁড়িয়ে দেয়ালে পিঠ লেপ্টে তন্ময় হয়ে রইলাম।

কোন গানটা চলছে এখন ? সুর ও কথাগুলো কি আমার চেনা ? না, চেনা নয়, তবে চেনা জানার কাছাকাছি এমন গান যে আছে দু একটি, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। হ্যাঁ হ্যাঁ, মনে পড়েছে। একে সরাসরি গান বলা চলে না। এটি মূলত একটি রাগ, সুরস্রষ্টা তানসেনের এমন একটি পরিবেশনা অডিওতে কোনও সময়ে শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সূর মূর্ছনায় কেমন ডুবে আছে গোটা পরিসর। আমি ছাড়া কোন জনমানব নেই। গাছের মাথাগুলো স্থির, ডালে ডালে সব পাখি নীরব, নিশ্চুপ। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম পরিবেশনাটি শেষের অপেক্ষায়।

যার কণ্ঠ চড়ছে তার দিকেই নিবদ্ধ আমার দৃষ্টি, আমার দু কান, সমস্ত মনোযোগ। সাদাসিধে পোশাক তার গায়ে – পাঞ্জাবির ওপর কটি, মাথায় সঙ্গীতি বিশেষ টুপি। পরিবেশনা থেমে এলে যন্ত্রগুলো এক এক করে নিভতে থাকে। সব শেষ যন্ত্রটি স্তব্ধ হলে ধীরে ধীরে চোখ খোলেন পরিবেশক, চারদিকে নজর ঘোরাতে থাকেন। ঘূর্ণায়মান দৃষ্টিটি বারান্দায় উঠে এলে আমি তাতে আমূল বন্দী হই। একি দেখছি ? এমন বিস্ফারিত কেন হল সঙ্গীতপুরুষের চোখ ? শুধু তারই নয়। একে একে সব চোখ ঘুরে এসে বিস্ফারিত নিপতিত হল আমার ওপর।

অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালেন কণ্ঠ সঞ্চালক। তাকে অনুসরণ করলেন অন্যরা। কী অনুরাগে হন হন করে হাঁটা ধরলেন সঞ্চালক। তার পেছন পেছন স্ব স্ব যন্ত্র হাতে-কাঁধে মৌন হেঁটে আঙিনা পেরিয়ে দেউরি পথে বেরিয়ে গেলেন পুরোটা দল। এবারে কী এক অচেনা অনুভব মুহূর্তে দুর্বার নাড়িয়ে দেয় আমাকে। ভেতরে প্রশ্ন তোলপাড়- আমারই কোনও অনিচ্ছাকৃত ভুলে কি ক্ষোভে দুঃখে এমন হন্তদন্ত উঠে গেলেন পুরোটা দল ? এমন অপার্থিব সম্মোহনকারী সুরলহরীটা থেমে গেল! কী একটা চিৎকার অজান্তে বেরিয়ে যায় কণ্ঠ থেকে। তখনই ঘরের ভেতরে উচ্চারিত হয় বাবার শান্ত শীতল কণ্ঠ, সুকর্ণ।

জি বাবা।

কী ভাবছিস তন্ময় হয়ে ? ওনারা কেন অমন উঠে গেলেন, তাই?

জি বাবা, কেন উঠে গেলেন ওনারা ? কী এমন —?

তোর কি সুর সাধক সুরতাজ উল্লাহ মাস্টার সাহেবের কথা মনে পড়ে ? নিভৃতচারী সেই সুরসাধক! ওই যে কাছারির দরজা জানালা বন্ধ করে একান্তে গলা সাধতেন যিনি?

না বাবা, কিছু মনে পড়ে না। নামও শুনিনি এমন।

ও তাইতো। তুই কেন তাকে চিনতে যাবি? সে তো আমার শৈশবকালের কথা।

কী সে কথা, বাবা?

ওই তো ওই সুরতাজ উল্লাহ মাস্টার সাহেব। জায়গির ছিলেন এ বাড়িতে, দূর দেশের মানুষ। পাশের গাঁয়ের স্কুলে মাস্টারি করতেন। শুধুই সুর সাধনায় মত্ত থাকতেন অবসরে। তবে নিভৃতে। ঘর ভর্তি যন্ত্রপাতি ছিল। সাধতেন সেসব। একটা সময় মাস্টারি ছেড়ে সঙ্গীতেই চলে গেলেন। বড় বড় সব জলসায় যেতেন।

বাবা, তারপর ?

জলসা করলেও সুর সাধনাটা তার নিভৃতেই হতো। শুধু যন্ত্রীরা যন্ত্র বাজাতো একান্তে। এক সময় মস্ত জনপ্রিয় হয়ে ছেড়ে গেলেন আমাদের। যাক সেসব। এতদিন পর বাড়ি এলি, বল কী খেতে মন চায় তোর। হাটে যাবো- মাছ নিয়েই যতো সংশয়ে পড়ি। কারণ, এর তো আর রকমফেরের অভাব নেই। কত যে বিচিত্র ধরণ এ প্রজাতির! বল কী মাছ তোর খেতে মন চায়।

বাবা, মাছে আর কী এমন পছন্দক্রম দেবো বলো। সব মাছই তো খাই আমি জানো।

তবু এতদিন পর আজ বাড়ি এলি। খেলেও সব মাছ তো আর সমান স্বাদের নয়। তোর কি সেই কাউনিয়া মাছের কথা মনে পড়ে ? ওই যে কাচা হলুদের মতো গাঢ় হলদে রঙ যে মাছটার। ওই যে গায়ে যার কাঁটা বিঁধে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলি তুই। কোলে করে আমি বাড়ি নিয়ে আসি।

বাবা, মনে পড়ছে না তেমন কিছু। কবে কাঁটা বিঁধল পায়ে?

আহা পাগল ছেলে, কাকে তুই কী বলছিস ? ওই মাছের কাঁটা বিঁধে অজ্ঞান তো হয়েছিলি তুই ছেলেবেলায়। তোকে কাঁধে করে বাড়ি এনেছিলাম আমি। সেই কথা তুই চাপাচ্ছিস সুকর্ণর উপর। স্মৃতি এমনই গেল যে নিজের শৈশব চাপিয়ে দিলি ছেলের ওপর। তা দাদুভাই, ওকে বলে দাও তুমি এ মাছটাই আনতে। আমিও মনে মনে ভাবি, কতদিন খাওয়া হয় না এই মাছ! দেখিই না সেই কোনকাল থেকে!

কোত্থেকে দাদা হাজির হয়ে একটানে বললেন এ কথাগুলো।

ঠিক আছে বাবা, দাদাও যখন বলছেন তবে এ মাছটাই এনো। ভালই হবে নিশ্চয়ই।আমি বললাম।

আমি যাই তবে হাটে। কই গেলিরে তোরা সব? বাবা কণ্ঠ উঁচালেন।

আহা, একটু দাঁড়া না। কতদিন পর শহর থেকে বাড়ি এল আমার প্রাণের নাতিটা। শুধু মাছ নিয়ে ফিরলেই কি চলে? তা দাদু ভাই, তোমার কি সেই মিছরির ঘোড়া, চমচম, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপি, বাতাসা, খাজা, গজা, বাদামটানা, চানাচুর, বিরেন ঘোষের খাসা দইয়ের কথা মনে পড়ে? হাটবারের কথা?

হ্যাঁ হ্যাঁ দাদাভাই, খুব মনে পড়ে। প্রতিদিন মনে পড়ে। হাটবারে কত কিছুই তো নিয়ে ফিরতে তুমি ! বারান্দায় আমরা অধির হয়ে বসে থাকতাম তোমার ফেরার অপেক্ষায়। ভৃত্যরা ঝাঁকা ভর্তি জিনিসপত্র নিয়ে ফিরত। তোমার হাতে ঝুলত একজোড়া এই বড় ইলিশ। দেউরিতে পা দিয়ে কত আদরেই না তুমি আমাদেরকে ডেকে উঠতে। ঘিরে ধরতাম আমরা তোমাকে।কারণ,আমাদের সবচে পছন্দের মহাস্বাদের সন্দেশের প্যাকেটটি থাকতো তোমার পাঞ্জাবির পকেটে। সব মনে আছে।

বল তাহলে তোর বাবাকে হাট থেকে যেন এসবেরও কতগুলো নিয়ে তবেই ও ফেরে।

শুনলে তো বাবা, দাদাভাই কতকিছুর কথা বললেন?

হ্যাঁ রে, যাই তবে জলদি। সকাল সকাল হাটে না গেলে ভাল জিনিস জুটে না। বিশেষ করে ওই কাউনিয়া মাছ।

বাবা ভৃত্যদের নিয়ে তড়িঘড়ি হাটে চলে যান। মা এসে দরজায় দাঁড়ান। এতক্ষণ গোসলে ছিলেন মা। আঁচলে কপালের ঘাম মুছে বললেন, এই গরমে পাগলের মতো দাঁড়িয়ে রইলি, বাবা। আয় বোস, শরবতটা খা। লম্বা গাছটার পাকা আমগুলো আজ সকালেই পাড়া হয়েছে, দক্ষিণের গাছের কাঁঠাল, প্রথম পেকেছে। জানিস তো এ গাছে চৈত্র শেষেই কাঁঠাল পুষ্ট হয়ে পাক ধরে। এখন তো ভর বৈশাখ।

কথার ফাঁকে মা কান পাতেন। বাড়ির পেছন দিকটা থেকে বিশেষ শব্দ ভেসে আসছে। দুবার হল শব্দটি, কুক্লিক, কুক্লিক। বললাম, মা, কানাকুয়া ডাকছে?

বাবা, পাখির ডাক ভুলে গেলি ? এতো হাঁড়িচাচা পাখি, কুটুম পাখিও বলে মানুষ। কানাকুয়ারা তো বলে পুত পুত। এখন আর শুনি না সেই ডাক। কানাকুয়া ডাকে না, ডাহুক ডাকে না, বৌড়ি, বাজ পাখির ডাক নাই, হুতোম পেঁচার ডাকও শুনি না আজকাল। মাঝে মাঝে এই হাঁড়িচাচাটা ডাকে। পেছন দিকের আতা গাছটাতে কয়টা আতা দেখেছি রাঙা হয়েছে। একটা বড় পেঁপেও পাক ধরেছে। এজন্যই এই ডাকাডাকি। যাই নিয়ে আসি তোর জন্য। আঙুরির মা’টা যে কই গেল ?

মা বেরিয়ে গেলেন। ফল পাড়াবেন কাউকে দিয়ে। ডাকাডাকি করছেন। এরই মধ্যে আবারও দাদা এলেন। লাঠি ঠুকে ঘরে ঢুকে তাঁকের ওপরকার পাতিলগুলোর ঢাকনা তুলে বলতে লাগলেন, রান্নাবাড়ার কী করল তোর জন্য ? তোর কি সেই জুম্মাবারের কথা মনে আছে ?

হ্যাঁ, দাদাভাই। খুব মনে আছে। ওই যে তুমি কদমা বাতাসা আনতে প্রতি জুম্মাবারে।

গোশত দেওয়া খিচুড়ির কথা?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাও মনে আছে। এখনও কি সেসব দেয়?

হ্যাঁ, কতজন সিন্নি বিলায় ! বড় বড় ডেচকিতে করে নিয়া আসে। এখন আর বাড়ি পর্যন্ত আনি না। পথেই গরিব মানুষদের বিলাইয়া আসি। তোরা সব বাড়িছাড়া সেই কত বছর! কার জন্য আনব ? যাই, গোসলের সময় হইল। তুই যা। বিকালে সব খেত খোলাগুলান তোরে দেখাইয়া আনব। খুব ভাল ধান হইছে খেতে খেতে। এখন অবশ্য অতো বেশি রকমের ধান নাই। সব খেতেই চিকন ধানের দুইটা মাত্র জাত।

দাদা লাঠি ঠুকে বেরিয়ে গেলে মা ঘরে ঢোকেন। সাথে গামলা ভর্তি পাকা আতা, পাকা পেঁপে। এক এক করে সব খোসা ছাড়িয়ে প্লেট ভরে দিতে থাকেন। খাওয়ার জন্য হাত বাড়াতে যাবো, এরই মধ্যে আকাশ থেকে গুড়ুব গুড়ুব ডাক ভেসে এলো। থমকে মুখ তুলে খোলা দরজা জানালায় দৃষ্টি উড়িয়ে দিলাম বাইরে।

এ বাবা, কী ঘন নীলচে মেঘে ছেয়ে গেছে আকাশ! ঝড় আসবে বুঝি। বৈশাখী ঝড়। মা বললেন, বাবা, তোর কি সেই ছেলেবেলার আকাশ মনে পড়ে ?

হ্যাঁ মা, খুব মনে পড়ে। ওই তো সেই আকাশ। বৈশাখে এমন ঘন নীল মেঘে ছেয়ে উঠলে তুমি সব সময়ই বলতে কাকের ডিমের মতো মেঘ। ওই তো সেই মেঘ।

তা বাবা, বিমান নিয়ে কত দেশ বিদেশে যাস। সহজে বাড়ি আসার ছুটি পাস না। যখন বিমান চালাস এ বাড়ির উপর দিয়ে কি কখনো চালিয়ে যাস ? ওপর থেকে কি দেখতে পাস এ বাড়ি ?

মা, হয়তো যাই এ বাড়ির ওপর দিয়ে। দেখাটা তেমন হয়ে ওঠে না।

এরপর যখন যাবি চোখ নামিয়ে একটু দেখে যাবি বাড়িটা। নিজেদের বাড়ি, বাপ দাদার ভিটা।

হ্যাঁ মা, হ্যাঁ, এরপর থেকে তাই দেখব।

আমি বিমান চালাচ্ছি। ঢাকা থেকে থিম্পু। মাত্রই ঘোষণা দিলামঃ শুভ মধ্যাহ্ন, যাত্রীগন! আমি ক্যাপ্টেন মাহতাব সুকর্ণ বলছি। … ডিগ্রী দ্রাঘিমাংশে … ডিগ্রী অক্ষাংশ, মিটার উচ্চতায় — কি.মি. বেগে চলছে আমাদের বিমান। —

আগে থেকেই টার্মিনাল থেকে বাড়ির দূরত্ব পরিমাপটা করে রেখেছি। বিমান ছেড়ে দেয়ার পূর্বাহ্ন থেকে ভাবছি, আজ নিচে উঁকি দিয়ে বাড়িটা নিশ্চয়ই দেখে নেব। সহজে যাওয়া হয়ে ওঠে না, অথচ পৈতৃক ভিটেবাড়ি। টার্মিনাল থেকে ওপরে উঠে কিছুক্ষণ পরই দেখতে পাই আকাশে ঝড়োমেঘ। সেই কাকের ডিমের মতো ঘন নীল মেঘের পাহাড়! আমাদের ঠিক বাড়িটার ওপর বরাবর দক্ষিণ পশ্চিম উত্তরে। আমি যাচ্ছি উত্তরে। মেঘগুলো এমন তাক লাগিয়ে দিচ্ছে চোখে! দেখতে দেখতে মনে হল বাড়িটা অতিক্রম করে যাচ্ছি। ঠিক নিচেই দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু সব তাল, নারিকেল, সুপারি, ইউক্যালিপটাস, দেবদারুর গাছ। দেখার জন্য গলা বাড়িয়ে দিতেই টের পেলাম যান্ত্রিক গোলোযোগে রাডারচ্যুত, পথচ্যুত হয়ে ভয়াল বিভীষিকাময় শব্দে নিচে ছিটকে পড়তে যাচ্ছে আমার বিমান! বিকট চিৎকার দিয়ে উঠি।

ঘুম ভাঙার পর চোখ বুজে ভাবছি। স্বপ্ন আর বাস্তবের ঋতু বৈপরীত্যের নির্দেশক হয়ে শিশিরের টুপটাপ শব্দ ভেসে আসছে কানে। এরপরও দুঃস্বপ্নের ঘোর পুরোটা কাটেনি। শরীর কাঁপছে মৃদু, পিঠে টের পাচ্ছি ঘামে বিছানা ভিজে গেছে। পাশ ফিরে শুতেই ঘরের বাইর থেকে ডাক ভেসে এল, সুকর্ণ। দুঃস্বপ্ন দেখছো ? প্রতিবেশী নওরোজ ভাই।

হুম। অস্ফুট বললাম আমি।

ভয় পাইয়া থাকলে উঠো। বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করো। নইলে খারাপ লাগবে। যাই, কোন সমস্যা হইলে আমারে জোরে ডাক দিও।

নওরোজ ভাই চলে গেলে ধীরে ধীরে খাট থেকে উঠে দরজা খুলে বারান্দায় আসি। মাত্রই পশ্চিমাকাশে চাঁদ ডুবেছে। চারদিকে আবছা অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘর দুয়ার, গাছপালা; আকাশের মৌনমুখ দেখতে পাচ্ছি। পাঁচ ছ’টি ঘর বড় পরিসর আঙিনা ঘিরে। সবগুলোতে তালা ঝুলানো। আমি ছাড়া এ বাড়িতে কেউ নেই।

রাতে অনেক দিন পর এসে একাই শৈশব কৈশোর কাটানো ঘরটিতে ঘুমিয়েছি। যতক্ষণ ঘুমে ছিলাম পুরোটাই নানাবিধ স্বপ্নে কেটেছে। সবটাই মধুর, শুধু শেষেরটা বাদে। এত বছর ধরে বিমান চালাই। কোনদিন তো দেখি না এমন দুর্ঘটনা দুঃস্বপ্ন। আজ কেন দেখলাম এমন বিভীষিকা দৃশ্য? ভাবতে ভাবতে আনমনে নেমে যাই বারান্দা থেকে। হেঁটে আঙিনা পেরোতে থাকি। স্বপ্নে যে জায়গাটাতে গানের আসর বসেছিল, সেখানে একটা ভাঙা পুরনো বাঁশি পড়ে আছে, একটা শিশুখেলনা প্লাস্টিক দোতারা,একটা ছেঁড়া শতরঞ্চি। আঙিনা ছাড়িয়ে চলে আসি বার গেটের তালা খুলে বাইরে।

ওই তো বড় দুটো পালান। উঁচু উঁচু কী ফসল তাতে? একেবারে কাছে চলে এসে হামাগুড়িতে একে একে দেখি- দামানো ঘন মটরকলাইর গাছ, আরেকটিতে ফুলেল সরিষা। পৌষ শীতে হালকা হালকা কুয়াশা পড়েছে। এমন শীত রাতে যখন পূর্ণিমার জোছনা থাকত, কৈশোর যৌবনে কী বিস্ময়েই না দেখতাম এমনই ঘন সবুজ কলাইর কিংবা হলুদ সরিষায় পূর্ণ এ খেত দুটিকে। মাঝে মাঝে মনে হতো যেন অপার্থিব কোনও জগৎ ! নিজেকে হারিয়ে দিতাম সে অপার্থিবতায়।

খেতের আল ধরে, আম বাগানের সারিবদ্ধ যতো গাছের গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি পারিবারিক কবরস্থানে। ওই তো সারিবদ্ধ সব কবর-দাদার, দাদীর, বাবার, মায়ের, —–।

স্থির দাঁড়িয়ে যাই। এতক্ষণ দেখা স্বপ্নদৃশ্যগুলো একে একে উঁকি দিতে থাকে মনের নিভৃতকোণে। ভাবি, হয়তো এমনটিই স্বাভাবিক যে স্বপ্ন হয়ে চোখে ধরা দেবে প্রাণপ্রিয় সব বিগত মানুষ, সাথে প্রিয় সব দৃশ্য নিয়ে, যখন এতদিন পর প্রিয় ভিটায় আজ একান্ত একেলা আমার উপস্থিতি!

শওকত নূর | Shawkat Noor

New Bengali Article 2023 | সার্বজনীনতার খোঁজে

Bishnupur Fair | ফিরে দেখা – বিষ্ণুপুর মেলা (১৯৮৮-২০২১)

Adonis | অ্যাডোনিসঃ আধুনিক আরবি কবিতার রূপকার | 2023 Article

New Bengali Story 2023 | কুত্তা | শওকত নূর

Read Online Bangla Golpo | Top Pdf Story Bangla | Top Pdf Story Bangla Blogs | Best Pdf Story Bangla | Sabuj Basinda | High Challenger | Pdf Story Bangla 2023 | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Story of 2 Kingfishers in India | World’s Bangla Golpo Read Online Blogs | Story of 2 Kingfishers in Online | Online Interesting Bangla Golpo | Full Read Online Bangla Golpo | New Bengali Web Story Blogs | Best Story Blogs in Bengali

Live Pdf Story Bangla in English | Live Bengali Story pdf | New Pdf Story Bangla | Pdf Story Bangla – Episode | Pdf Story Bangla Series | Horror Adult Story Video | Horror Pdf Story Bangla | Story of 2 Kingfishers Audio | Pdf Story Bangla Video | Pdf Story Bangla Netflix | Full Bangla Galpo Read | Read Online Bengali Story Download | Shabdodweep Competition | Bangla Golpo Read Online Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024

Trend New Bengali Web Story | Recent New Bengali Web Story | Top Live Pdf Story Bangla | Popular New Bengali Web Story | Best Read Online Bengali Story | Bangla Golpo Read Online 2024| Shabdodweep Pdf Story Bangla | Pdf Story Bangla Online | Golpo Dot Com Download | Story of 2 Kingfishers – audio | Horror Adult Story | Pdf Story Bangla Collection | Live Bengali Story – video | New Bengali Web Story APK | Pdf Story Bangla Download

Live Bengali Story mp3 | Full Live Pdf Story Bangla | Famous Pdf Story Bangla | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Live Bengali Story – audio | Top Read Online Bangla Golpo | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Pdf Story Bangla Online

Leave a Comment