অঙ্গনদীপ চ্যাটার্জী – সূচিপত্র [Bengali Story]
পরিবর্তন – অঙ্গনদীপ চ্যাটার্জী [Paribartan Bengali Story]
‘এক প্যাকেট মেট্রোজিল, চারটে প্যারাসিটামল, আর দু প্যাকেট ডাইপার দিন।’
পাড়ার হরি মেডিক্যালসের দীপুদা চশমাটা চোখে ভালো করে লাগিয়ে পর পর সবকটা ওষুধ এনে রেখে অভিষেকের দিকে তাকালেন।
‘আর কিছু লাগবে?’
‘আর…আর..’ একটু থমকে বললো অভিষেক। ‘ওই ইয়ে এক প্যাকেট আর একটা ওই ইয়ের প্যাকেট আরকি।’ হাসিটা মুখে কেমন যেন মেকিভাবে লাগিয়ে কথা শেষ করল সে।
হরিদা কিছু না বুঝে প্রশ্নবোধক চোখেই তাকিয়ে রইলেন তার দিকে, চশমার ফাঁক দিয়ে। এই ‘ইয়ে’ দুটোর কি মানে বার করবেন তা ভাবছেন বোধহয়।
‘আ….আ….মানে ওই….’
‘কন্ডোম না প্যাড?’ হরিদার মুখে খেলে গেলো হাসি, অভিষেকের মনের কথাটা শেষ অবধি বুঝতে পেরে।
‘আ…আজ্ঞে দুটোই।’ অপ্রস্তুত উত্তর পঁয়ত্রিশ পার হওয়া যুবকটির।
আসলে অভিষেকের দোষ নেই, দোষটা আমাদের মধ্যবিত্ত সমাজ আর তার চিন্তাধারার। এখনো আমরা খোলাখুলি মেয়েদের পিরিয়েডের জন্য প্যাড বা সঙ্গমের জন্য কন্ডোম চাইতে পারি না, কিংবা সেগুলো নিয়ে কথা বলি না । ‘পাছে লোকে কিছু ভাবে’ বা ‘কে আবার কি বলে দেবে’ এই চিন্তাটা মাথায় যেন গেঁথে গেছে। আর তা থেকে বেরোবার কোনো পথ নেই। নিজের এক বছরের মেয়ের ডাইপার নিতে অস্বস্তি হয় না, কিন্তু বৌয়ের প্যাড বা দরকারের কন্ডোম নিতেই যেন সমস্ত অপ্রস্তুতা ছড়িয়ে পরে।
বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে সেই কথাই ভাবছিলো অভিষেক। সত্যি, সমাজের ভয়ে কত কিছু করা হয়না, কত কিছু বলা যায়না। কিন্তু সে একা কি পরিবর্তন করবে? ওষুধের দোকান পর্যন্ত সেই প্যাড আর কন্ডোম কালো প্লাস্টিকের প্যাকেটে বেঁধে ভরে দেয়, যেন বাইরে থেকে দেখলে কেউ না বোঝে যে ভেতরে এইসব কিছু আছে।
হেসে ফেলে সে মনে মনে। বাড়িতে মায়ের ওষুধগুলো তাঁর কাছে দিতে যাবার সময় যদি উনি দেখেন এইসব কিছু, তাহলে না জানি উনিও কি মনে করবেন। অথচ এমন তো নয় যে বৌ অধৃতার সাথে বিনা সঙ্গমে তার মেয়ে হয়েছে। দুষ্টু মেয়েকে সামলানো, বাচ্চার কম ঘুমের জন্য নিজেদের কম ঘুম আর বেসরকারি অফিসের কাজের চাপ সামলে যদি সময় পাওয়া যায় নিজেদের একটু সময় কাটাবার, একটু আদর করার, তখন অধৃতাকে বলতে হয় – ‘আস্তে সোনা, আস্তে। বেশি আওয়াজ করো না, মা নিচের ঘর থেকে শুনতে পাবে।’
ওই যে, সেই মধ্যবিত্ত মনোভাব ! তার বাইরে আর যায় কি করে। দীর্ঘশ্বাসটা যেন না চাইতেও বেরিয়ে গেলো অভিষেকের বুক থেকে, বাড়ি ঢোকার মুহূর্তে।
‘কি গো? সব এনেছো?’ অধৃতার কথায় হঠাৎ সংবিৎ ফিরলো তার।
ঘাড় কাত করে হ্যাঁ জানিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোয় সে। চোখের ইঙ্গিতে বৌয়ের প্রশ্নের উত্তর সে দিয়ে দিয়েছে। হ্যাঁ সে নিয়ে এসেছে প্যাড আর কন্ডোম, দুটোই। বৌ যদিও আই-পিল আনতেও বলেছিলো, কিন্তু ওটা আর মনে হয়না লাগবে বলে।
‘তো আজ আর নতুন কিছু লিখলে? আমাকে দেখালে না?’
বৌয়ের প্রশ্নে ঘুরে তাকালো অভিষেক। একটু হেসে কোল থেকে ল্যাপটপটা নামিয়ে উঠে পড়লো সে।
‘নাঃ, এখনো কিছু লিখিনি গো। একটা আইডিয়া এসেছে, সেটাই লিখছিলাম।’
‘কি আইডি-‘
‘অভি…..অভি…’
বৌয়ের কথা শেষ হবার আগেই মায়ের চিৎকার শোনা গেলো নিচে থেকে।
‘ওই।’ অধৃতা চুল মুছতে মুছতে বললো। ‘নিশ্চয়ই তোমার মেয়ে উঠে গেছে।’
‘একটু অধৃতাকে তাড়াতাড়ি করতে বল তো।’ মায়ের পরবর্তী চিৎকার। ‘সুলু উঠে পড়েছে, ওকে চান করাতে হবে, তোদের বাবা আবার বেড়িয়েছেন ।’
পলকে অধৃতার চোখের সেই আনন্দ উজ্জ্বল দৃষ্টি যেন পাল্টে গেলো। চোখ না এড়ালেও সেটা বিশেষ পাত্তা দিলো না অভিষেক। সে জানে কি ভাবছে তার বৌ, সে নিজেও সেটা ভেবেছে অনেকবার।
সুলু, অর্থাৎ তার মেয়ে সুলগ্না, সবে আগের মাসে এক বছর হয়েছে। তাকে একটু মা চান করিয়ে তো দিতে পারেন, কিন্তু কেন করছেন না ? বর আর বৌ একটুখানি তো শুধু সময় পায়, তখন মা ডাকলে কেমন যেন লাগে।
আবার সেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো অভিষেকের। অধৃতা তার ভেজা চুল আর সুডোল গঠনের শরীরটা নিয়ে তখন অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির পাশ দিয়ে।
কি আর করা যাবে। মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন এইভাবেই চলে আসছে, হয়তো এইভাবেই চলে যাবে। মা আর বৌয়ের মাঝে সেই মধ্যবিত্ত পুরুষকে পিষতে হয়, আর নারীকে সেই একইভাবে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য একটা বাড়িতে এসে সবাইকে নিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে নিয়ে চলতে হয়। নতুন বাড়িতে সবার সব কথা পছন্দ না হলেও বাড়ির বৌমাকে মানিয়ে নিতে হবে, চুপটি করে, কিছু বলা যাবেনা। এটাই তো চিরন্তন সত্য।
‘আজ তো শনিবার।’ মা বলে উঠলেন। ‘আজ এতো কাজ কিসের তোর? সবার তো ছুটি আজ।’
‘মা, তোমাকে তো বলেছি, নতুন চাকরি, কাজের চাপটা প্রথম মাসে একটু বেশি।’ একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে অভিষেক। ‘জানো তো একটা নতুন পদ পেয়েছি, এই কাজ করিনি আগে, তাই একটু বেশি খাটতে হচ্ছে।’
‘অন্যান্য দিন রাত সাড়ে এগারোটা অবধি কাজ করিস, তখন কিছু বলি না, কিন্তু তাই বলে কি শনিবারেও? সেদিন তো বাড়ির সবার সাথে গল্প করবি, কথা বলবি।’
‘আমি বলছি তো মা, সবার সাথেই কথা বলছি।’
‘এটা বলা হয়না। তোর মন আর মাথা দুটোই ওই ল্যাপটপে।’
এই এক কথা শোনা বিশেষ কিছু নতুন না অভিষেকের কাছে শেষ দেড় বছরে, মানে যবে থেকে মুম্বাইয়ের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে অন্তঃসত্ত্বা বৌকে নিয়ে। মায়ের ইচ্ছা তাঁর ছেলে আর বৌ যেন সারাক্ষন তাঁর আশেপাশেই থাকে।
আবার কাজ না করলেও অসুবিধা। অধৃতার চাকরি ছেড়ে দেবার ব্যাপারটা কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছেন না, আবার নিজের ছেলের সারাক্ষণ কাজও পছন্দ হচ্ছে না। অথচ মাসের শেষে ছেলের মাইনে, আর অন্যের কাছে ছেলের কাজের প্রশংসা শোনা, এই দুটোতেই আনন্দ না পেলেও যেন তাঁর হয় না।
অভিষেক মা কে ঠিক বুঝতে পারেনা। কি যে আজকাল ভাবেন, কি যে করেন, তার কোনো ঠিক নেই। সন্ধে হলেই শুধু খবর, আর সকালে পেপারের আদ্যোপান্ত পড়া, এই দুটো যেন মায়ের রোজকার কাজের সবথেকে বড়ো অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই মা একসময় কত সিনেমা দেখতেন, মেগা সিরিয়াল দেখা চলতো কত।
আর এখন? শুধুই খবর।
অধৃতা যখন ওকে বলতে গেছিলো এগুলো নিয়ে, অভিষেকের সাথে ভালোই ঝগড়া হয়ে গেছিলো। সে বেচারি আর কতদিন এরমভাবে থাকবে, চুপ করে, সবকিছু সহ্য করে? আবার অভিষেকই বা কি করে তার মায়ের ব্যাপারে কুকথা শুনতে পারে? নিত্যদিন যেন কিছু না কিছু লেগেই আছে।
মধ্যবিত্ত জীবন আর কি !
‘ওরে বাবা। আজ সুলগ্নার পাঁচ বছর বয়েস হয়ে গেলো। কত্ত বড়ো হয়ে গেছে আমার সোনা নাতনীটা।’
মাকে নিজের নাতনিকে জড়িয়ে ধরে থাকতে দেখে কি ভালো লাগলো অভিষেক আর অধৃতার, তা তারা যেন বলেও বোঝাতে পারবে না।সুলগ্নার বড়ো হওয়াটা যেন বর হয়েছে তাদের সংসারে। মায়ের খবর দেখা পাল্টে গেছে এখন ছোটা ভীম আর পোকেমন দেখাতে। সারাদিন তাঁর যে কি ভাবে কাটছে তা যেন তিনিও টের পাননা।
শেষ চারটে বছর যেন তাঁদের জীবন সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। বাবার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার জন্য যেই শূন্যতা ছড়িয়ে ছিল মায়ের জীবনে, তা যেন একটানে কেড়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে শিশু সুলগ্না। জন্মের থেকেই সেটা সে করতে শুরু করেছিল, শুধু বদলটা বুঝতে বুঝতে ছেলে আর বৌয়ের একটু সময় লেগেছে।
‘ঠাম্মা আমাকে ইকোপার্ক নিয়ে যাবে কাল?’ সুলগ্নার মিষ্টি গলার আওয়াজ যেন গানের মতো শোনালো অভিষেকের কানে। ‘আমি ওখানে যাবো।’
‘নিশ্চয়ই যাবে সোনামা। আমি নিয়ে যাবো।’
মাকে দেখতেও যেন ভালো হয়ে গেছে দিন দিন। কে বলবে মায়ের বয়েস এখন পঁয়ষট্টি ছুঁই ছুঁই ?
‘মা, তুমি সবার আগে কেকটা খাবে।’ অধৃতার গলার আওয়াজ শোনা গেলো রান্নাঘর থেকে। ‘সুলু সোনা, ঠাম্মাকে খায়িয়ে তারপর দাদাই আর দিদুকে কেক খাওয়াবে, তারপর মাম্মা আর পাপাকে, ওকে?’
অভিষেকের মুখে ফুটে ওঠে হাসি। আজ আর সেই দীর্ঘশ্বাসটা নেই, এটা খুশির হাসি। সে আজ তার পরিবারকে যেন নতুন চোখে দেখছে। অধৃতারও এখন সেরম কোনো কমপ্লেইন নেই আজকাল, বরং শাশুড়ি আর বৌমা বন্ধুদের মতোই কথাবার্তা বলে, গল্পগুজব করে। মাঝে মাঝে তো একসাথে সুলগ্নাকে নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পরে, তারপর সারাদিন ঘুরে, বাইরে খেয়ে ফেরত আসা।
বৌমার অফিসেও ঘুরে আসা হয়ে গেছে মায়ের। হ্যাঁ, অধৃতার স্বপ্ন পূর্ণ হয়েছে। সে নিজের একটা কোম্পানি শেষ অবধি খুলতে পেরেছে। চাকরি ছাড়া যেই কারণে, যেই কারণে মুম্বাই থেকে ফেরত আসা, তা সফল হয়েছে শেষ অবধি। যদিও কোম্পানি খুবই ছোট, কিন্তু তবু স্বপ্ন তো সফলের পথে এগিয়েছে।
এখনো অনেক কাজ বাকি কোম্পানিকে দাঁড় করাতে, আর সেটার জন্য সুলগ্নার সমস্ত দায়িত্ব মা নিয়ে নিয়েছেন, যাতে বৌমাকে চিন্তা না করতে হয়। অধৃতা এখন অফিসের দিকে বেশি খেয়াল করছে, বাড়ির সমস্ত দায় দায়িত্ব মা নিয়ে রেখেছেন যে।
অভিষেকের জীবনও অনেকটা পাল্টেছে। তার ইংরেজি উপন্যাসগুলো কয়েকটা ভালো লেগেছে একটা বিদেশী পাবলিশারের, বিক্রিও হয়েছে ভালোই। সে এখন চাকরি ছেড়ে নিজের বই এর দিকেই বেশি নজর দিয়েছে। তার লেখার হাত আগেও খারাপ ছিল না, কিন্তু আগে অফিসের কাজ, বাড়ির কাজকর্ম আর মা আর বৌয়ের ঝামেলার থেকে রেহাই পেলে তবেই বসতে পারতো নিজের লেখা নিয়ে। আজকাল আর তা নয়।
‘আর আজ বিকেলে তুমি আমার প্যাড কিনে আনবে গো, শেষ হয়ে গেছে। আগেরটাতে দুটোই মাত্র ছিল, আজ স্নানের পরে ব্যবহার করলে শেষ হয়ে যাবে। তুমি মনে করে নিয়ে আসবে সুলুর কেক আনার সময়ে।’
ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে অভিষেক। মধ্যবিত্ত পুরুষ সে এখনো, কিন্তু বাড়ির আর সমাজের নিয়ম এখন আর এই বাড়িতে নেই। এখন তারা বর বৌ সময় পায় একটু আধটু, তাদের মেয়ে ঠাম্মার সাথে রাতে শুয়ে পড়লে। আর এখন কন্ডোমের কথা বা আই-পিলের কথা না বলতে পারলেও, প্যাডের কথাটা সামনাসামনি বলা যায়।
মা তো চাইছেন এবার আর একটা নাতি বা নাতনি।আবার হাসি এসে যায় অভিষেকের মনে মনে।
সবকিছু সমাজের ওপর দোষ দিয়ে লাভ আছে ? নিজেরা পাল্টালে তবেই তো পাল্টায় সমাজ। সেটাই তো আসল পরিবর্তন।
অঙ্গনদীপ চ্যাটার্জী | Angandeep Chatterjee
Teachers day in honor of teachers | শিক্ষকদের সম্মানে শিক্ষক দিবস
Tebhaga Movement | বাংলায় “তেভাগা আন্দোলন” এবং সলিল চৌধুরীর গণসঙ্গী
History of Bengali Poetry | কবিতা কি ও কেন এবং তার ইতিহাস
New Bengali Story | গল্পগুচ্ছ | বিপাশা চক্রবর্তী
Paribartan Bengali Story | Paribartan Bengali Story 2023 | Paribartan Bengali Story in pdf | Paribartan Bengali Story in video | Paribartan Bengali Story in audio | Sabuj Basinda | High Challenger | Paribartan Bengali Story images | Paribartan Bengali Story – Angandeep Chatterjee | Paribartan Bengali Story New | Paribartan Bengali Story – Shabdodweep | Shabdodweep – Paribartan Bengali Story | Best Paribartan Bengali Story | Top Paribartan Bengali Story | Best selling Paribartan Bengali Story |