Online Bengali Story Writing – Shawkat Noor
জীবন – শওকত নূর
তারা একে একে হাজির হচ্ছিল পড়োভিটার ঝাঁকড়া জামগাছটির তলায়। অদূরে এক ছাতিমকাণ্ডের পেছনে দাঁড়িয়ে প্রতিটি আবির্ভাব লক্ষ্য করছিল গল্পকার ইনতিসার এমু। নদীপাড়স্থ পড়োভিটাটি নদীগর্ভে যাবার সমূহ সম্ভাব্যতায় কোনমতে জেগে আছে। অর্ধপাটে যাওয়া সূর্যের তীর্যক রশ্মি এসে তখনও রঙখেলায় মগ্ন জাম-মাথাটির সাথে। এখানে তাদের হাজির হবার কথা যদিও সূর্যাস্তপর, এরই মধ্যে তাদের প্রতিজনই এসে জমে গেছে। ইনতিসার এমু তাদের এ আগাম হাজিরা বিষয়েই ভাবনাচ্ছন্ন হচ্ছিল – এখানে তাদের পড়ন্ত বেলায় হাজিরার প্রস্তাবনাটি প্রত্যেকে প্রত্যাখ্যান করেছিল নিজ নিজ কর্মব্যস্ততার অজুহাতে; অথচ তারা প্রত্যেকে সে স্ব-প্রত্যাখ্যাত সময়েই এসে হাজির হলো।
এমু দোটানায় পড়ে যায় তার নিজ হাজিরার বিষয়ে- সেও কি নিজের প্রস্তাবিত, তাদের প্রত্যাখ্যাত সময়েই হাজির হবে, নাকি তাদের বেঁধে দেয়া সময় ‘সূর্যাস্তপর’ তাদের সাথে যুক্ত হবে। সিদ্ধান্তহীনতা খানিকটা বিচলিত দশায় ঠেলে দেয় এমুকে। হঠাৎ দৈব এসে উপস্থিত। আচমকা একটা মৃদু হাওয়া বয়ে গেল তার মাথার ওপর দিয়ে। আন্দোলিত হলো আষাঢ়ি ছাতিম ফুলের ছাতিম মাথাটি। আর দুর্নিবার এক নাক-সুড়সুড়িতে রীতিমত হাঁচি খেলে গেল তার নাসারন্ধ্র-বাকযন্ত্রে। তখনই রীতিমত সরব হয়ে উঠল পড়োভিটায় সমবেতগন: কে ওইখানে দাঁড়াইয়া, হাঁচি হাঁচল কে, হাঁচি আটকাইয়া রাখতে ব্যর্থ বুঝি, আড়ালে দাঁড়াইয়া কে আমাদের কথাবার্তায় কান রাখে, কী উদ্দেশ্য, কী বিধেয় প্রভৃতি।
তাদের জিজ্ঞাসু সরবতা মুহূর্তে কোলাহলে রূপ নেবার পথ ধরলে ইনতিসার এমু সচকিত হলো। তাদের ক্রমাগত কে কে শব্দ প্রাবল্যে পা চালাবার অবসরে সে গলা উঁচিয়ে বলে উঠল, আমি এখানে, আমি ইনতিসার এমু।
কোলাহলটি নিমিষে প্রশমনের পথ ধরে সমবেত শব্দ বাক্যে রূপ নিল, ও- -, খোদ ইনতিসার এমু এসে উপস্থিত। কিন্তু ক’টা বাজে? সূর্য তো এখনো ডোবেনি। এত আগে কেন এমু এসে জুটল?
আহা, এত বেহুদা প্যাঁচাল পেরো না তো! আমরা কখন এসেছি? নিজেরা কি সূর্যাস্তে এসে জুটেছি? আমরাও তো ঢের আগে এসে জমেছি!
ঠিক ঠিক, কিন্তু চুপ মারলেন কেন এমু সাহেব? হাঁটছেন না কেন এদিকে? ও এমু সাহেব, কী হলো আপনার? আসছেন না যে এদিকে! সূর্য তো অস্ত গেল বলে! আসুন এবার!
এইতো আসছি, পায়ে জুতাটা পরে নিতে যা দেরি হচ্ছে।
ও- – সময়ের দাম আর কথা রাখতে বোধ করি জুতা খুলে ওখানটায় দাঁড়িয়েছে। আর আমরা আহাম্মুকের মতো কীসব ভেবে বসছি!
আহা, চুপ করো এবার। ওইতো আসছে!
দেখো, কথা বলতে বলতে সময় গড়িয়েই গেল। ঠিক সময়েই উনি এসে হাজির। সূর্য নিচে পড়ে গেল ওই!
তা আসুন এমু সাহেব, ভিটাবৃত্তের ভেতরে পা চেলে দিন।
জি দিচ্ছি, তা কেমন আছেন আপনারা সবাই? ভালইতো, নাকি?
জি জি, বেশ আছি সকলে।
বসেছেন তো প্রত্যেকে একেবারে ভাঙনপাড়ে! ওইতো মাটিচাপা দুমড়ে পড়ল নদীগর্ভে। আরেকটু হলেই জামটা চলে যাবে নিচে। ব্যাপারটা তাহলে- –
এ আমাদের ব্যাপার। আপনি এ নিয়ে বিচলিত হবেন না দয়া করে। স্থির হয়ে বসুন ওপাশের ওই টুলে।
টুলে? আপনারা সবাই বসে আছেন মাটিপাতা মাদুরে, একেবারে ভাঙনপাড় ঘেঁষে। আমি এদিকে টুলে বসব, ব্যাপারটা- –
এটাই স্বাভাবিক। আপনি শান্ত হোন। এবারে কথা পাড়া যাক।
হ্যাঁ হ্যাঁ, আলতুফালতু কথা রেখে একেবারে মুল কথা উঠুক । সমবেত কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হলো।
জি, ঠিক আছে, তা-ই হোক। শুরু করুন আপনাদের কথা, যে কথার জন্য আমাকে এখানে আহবান করেছেন।
আমাদের মধ্যে কে আগে শুরু করব, ঠিক হোক আগে। একযোগে কথা পাড়া যুতসই হয় না।
আহা, তুমিই আগে শুরু করো না। আমাদের মধ্যে তুমিই তো কথাবার্তায় অন্যদের চেয়ে পটু। তোমার বুদ্ধিমত্তাও ঢের ভালো।
এ তোমাদের বদান্যতা মাত্র। তারপরও বলছি আমিই, গোড়াপত্তনটা দিচ্ছি।
দাও দাও, কালবিলম্ব না করে গোড়াপত্তনটা দাও।
একে একে প্রত্যেকেই তো অল্পবিস্তর বলব। সময় যাবে ঢের। এমু সাহেবের জন্য রাত খুব বেশি হওয়া বৈধ হবে না, ভেবে দেখো।
তো শুরু করি, নাকি? সবাই যখন আমাকেই গোড়াপত্তনে ঠেলে দিচ্ছে!
জি, করুন।
আমার নাম হচ্ছে গিয়ে তানজিল উদ্দিন মিয়া। সর্বাগ্রে আমাদের কথার বিষয়বস্তু সম্পর্কে আপনাকে জানাবার তাগিদ অনুভব করছি, যেহেতু সবার বক্তব্যের মুল বিষয়বস্তু এক এবং অভিন্ন- অতি সংক্ষিপ্ত শব্দে তা বলা যাবে।
জি, বলে ফেলুন বিষয়বস্তুটি।
জীবন!
জীবন?
হ্যাঁ, জীবনই আমাদের প্রত্যেকের বক্তব্যের সারকথা, যদিও মৃত্যু নিয়েও দু’চার কথা স্বতঃস্ফূর্ত চালান হয়ে আসবে, যেহেতু জীবনের অপর পৃষ্ঠেই তার অবস্থান।
ঠিক আছে, বলা শুরু করুন। তবে তার আগে জানতে কৌতূহল জাগছে, হঠাৎ কেন এমনতর বিষয়ে আমার সাথে আলোকপাতে ঘটা করে আমাকে আহবান। সে বিষয়ে কিঞ্চিৎ ইঙ্গিত দিলে আমি ভেতরে নিজেকে আলোকপাত উদ্দেশ্যে খানিকটা গুছিয়ে নিতে সক্ষম হতাম।
শুনুন জনাব, জীবন সম্পর্কে আমরা ইতিপূর্বে আপনার অল্প বিস্তর লেখায় কিছু ব্যাখ্যা পেয়েছি। কিন্তু আমাদের মনে হয়েছে, ওইসব ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের অনেকই আপনার নিজস্ব ভাবনা প্রসূত, যেটুকুও বা চরিত্র-মুখ বর্ষিত, হয়তো তা চরিত্রের সাথে নিবিড় আলোচনা সাপেক্ষ নয়, বরং নিকট কিংবা অদূর থেকে শ্রুত মতাভিমতের গড়ফল মাত্র। কাজেই আমরা ভাবলাম, কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চরিত্র ঘনিষ্ঠ প্রত্যক্ষ আলোকপাতের ভিত্তিতে আপনার সকাশে হোক। সেমতে, এ আয়োজনে আদৌ মন্দ করেছি কি? কী মনে হয় আপনার?
না না, ঠিক আছে, যথার্থই করেছেন আপনারা। এবারে আপনার মুল বক্তব্যে প্রবেশ করুন।
জি, বলছি,শুনুন।
জি।
জীবনই এ ধরায় আমাদের প্রত্যেকের মুল বিষয়বস্তু
তথা সার্বিকতা। অস্তিত্ব থেকে জীবন বাদ করে দিলে কী থাকে, কিছুই না – শূন্য। কাজেই জীবন নিয়ে আমরা চেতনে অবচেতনে প্রত্যেকেই কম বেশি ভাবনাগ্রস্ত হই। আর জীবন নিয়ে ভাবতে গেলে আপনা থেকে মৃত্যু ভাবনাটাও চলে আসে, আসে কি না?
জি, তা আসে।
মৃত্যু ভাবনা এলেই জীবনের বিস্তৃতিকাল নিয়ে ভাবনা দুর্ভাবনা জাগে। ভাবনাঘোরে সিংহভাগ মানুষেরই আকাঙ্ক্ষায় থাকে জীবনের দীর্ঘ বিস্তৃতিকাল। অথচ সেই বিস্তৃতিকাল বিষয়ে আমরা একেবারে অনিশ্চিত। কথায় আছে, মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। এই ধরুন, আমার নিজেরই কথা। আমার বাবা দীর্ঘজীবী ছিলেন। শতাধিক বছর তিনি সুস্থভাবে বেঁচেছিলেন। সেই দৃষ্টান্তে আমি অবচেতনে ধরেই নিয়েছিলাম, আমিও বুঝি বাবার মতো ঠিক ততদূরই যাব। কিন্তু হলো কী বাস্তবে? হ্যাঁচ্চু, হ্যাঁচ্চু, বাতাসটা প্রবল হচ্ছে আবারও।
কী হলো পরে?
একাত্তরে আমার যবনিকা ঘটল। বলা নেই, কওয়া নেই, ঘটল। কোথায় শতোর্ধ্ব, কোথায় বা একাত্তর!
কিভাবে ঘটল?
দিব্যি সুস্থ সবল মানুষ। পড়ন্ত বেলায় বাড়ির বার সীমানায় হাঁটছিলাম। হঠাৎ বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হলে ধপাস করে মাটিতে পড়ে গেলাম। অনেকে ধরাধরি করে বাড়িতে তথা শোবার ঘরে নিয়ে এলো। ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই দূর শহরে। ছোট মেয়েটা সার্বক্ষণিক কাছে থাকত। ও-ই বাড়িতে ছিল। কিছুক্ষণ পর ছোট ছেলেটাও বাইরে থেকে ফিরল। ওরা ছোট, ভরসা হলো না খুব। মুহূর্তে শত মানুষ জুটেছে – পরম অসহায়ত্বে নির্বাক ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকি। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার ফাঁকে অনেকে ডাক্তার, কবিরাজ ডাকা তথা শহরে নিয়ে যাওয়ার যানবাহনের উদ্দেশ্যে দিগ্বিদিক ছুটে গেছে। কেবলই মনে হচ্ছিল, সবই নিষ্ফল হতে চলেছে। তবু ক্ষীণ আশা জাগছিল- একমাত্র বড় ছেলেটা এলে বুঝি একটা পরিত্রাণ ঘটতেও পারে। হাত ইশারার প্রচেষ্টায় সমবেতদের বোঝাতে চাইলাম তার কথা। ও তক্ষুনি আসছে মর্মে অনেকে মিথ্যা আশ্বাস দিল। বুঝতে সক্ষম হলাম তা আমি- দু’চোখ জোরছে বুজে এলো- সেই থেকে চিরস্থায়ী ওপারে।
তা ওপারে কেমন আছেন আপনি?
জীবনের এটাই বড় এক রহস্য, বড় এক মাহাত্ম্য – ওপারে চলে গেলে এপারের মানুষদের জানাবার উপায় থাকে না কিছুই। এপারের কেউ জানতে সক্ষমও নয় কিছু। এখান থেকে ওখানে কোনও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে না।
তানজিল উদ্দিন সাহেব, কী সর্বনাশ! ওই বড় মাটিচাপটাতো আপনাকে নিয়ে দিব্যি পড়ে যাচ্ছে দেখছি নদীগর্ভে, জলদি এদিকে সরে আসুন আপনি, প্লিজ, আসুন! আসুন বলছি এদিকে! ইনতিসার এমু প্রাণান্তকর চেঁচাল।
না না, ওকে ডাকবেন না ওভাবে! ওইতো গেল শব্দ করে নিচে!
ওহ, চলে গেল!
আপনি শান্ত হোন। ওতো অনেক আগেই ওপারে চলে গেছে। ওপারের মানুষ, ওপারে থাকবে, তা-ই স্বাভাবিক। আপনি নিশ্চুপ থাকুন। সমবেতদের একজন গুরুগম্ভীর বললেন।
জি! হাঁটুতে মুখ গুঁজল ইনতিসার এমু।
কিছুটা বিরাম নেয়া যাক। আপনাকে ক্লান্ত ও বিচলিত ঠেকছে। স্বাভাবিক হয়ে নিন আগে।
জি-ই।
এমু সাহেব, আপনি স্বাভাবিক আছেন কি? হাঁটুতে মুখ গুঁজে আছেন এতক্ষণ! রাত বাড়ছে ক্রমশ। আবার শুরু করা যাক, না কি?
জি, শুরু করুন। কে বলবেন এখন? দয়া করে বলতে থাকুন।
আমিই বলি, না কি?
হ্যাঁ হ্যাঁ, বলো। এখন তোমারই পালা হবার কথা। ধারাবাহিক কথা চালিয়েও যাচ্ছো তুমি।
হ্যাঁ, তা-ই। এই যে তানজিল উদ্দিন সাহেবের জীবন ও ইতিবৃত্ত – আমি তো মনে করি তিনি সৌভাগ্যবান। অবশ্য তা একান্তই আমার ব্যক্তিগত ভাবনা।
সবিস্তারে কেমন কী তা? ইনতিসার এমু নিস্তেজ বলল।
খুব স্বল্প কষ্টে তিনি আকস্মিক জীবন ছাড়লেন। আর দেখুন আমার দিকটা!
কী সেটা?
শুনতে অনেকের ভালো নাও লাগতে পারে তা। তবুও বলতে হচ্ছে, যেহেতু তা-ই বাস্তবতা। মনস্তাত্ত্বিক কষ্টাঘাতের কারণ হলে তা ক্ষমা করবেন নিজ গুনে।
আচ্ছা, বলুন।
জীবনের বিস্তৃতি বাড়তে বাড়তে ক্রমশ জীবনটাই বোঝা পরিগণিত হতে লাগল। প্রায়ই মনে হতে লাগল, কেন শেষ হয় না তা। দারিদ্র্যে একাকীত্বে শতক তো পেরিয়েছে সেই কবে! কী একটা অচেনা কষ্ট, দুঃসহতা ভয়ানক অস্থির করে তোলে। প্রায়ই মনে হত, যদি স্ব-নিঃশেষ হওয়া যেত! অথচ আমার তা ধর্মাচার বিরুদ্ধ – কাপুরুষোচিত। দুঃসহতায় শুধু বিধাতাকে ডাকতাম, আর নিজ অবসান চাইতাম। একরাতে ঘুমঘোরে কী একটা বিশাল দীর্ঘ কালোছায়া বুকে এসে চেপে বসল, আর চিৎকারে স্তব্ধ হলাম। তারপর থেকেই ওপারে।
তা ওপারে কেমন আছেন আপনি?
এমু সাহেব, ভুলে গেলেন, ওই যে তানজিল উদ্দিন সাহেব যে এপার ওপারের শব্দ দুর্ভেদ্য দেয়ালের কথা যে বলে গেলেন?
আচ্ছা ঠিক আছে, আর জানতে চাইব না ও বিষয়ে।
এবার অন্য কেউ কথা বলুন। অন্ধকারটা বেশ ঘনিয়ে উঠেছে। ভাঙনটাও প্রবলতর হচ্ছে। ভয়ই হচ্ছে অবশিষ্টদের নিয়ে, এতটা পাড় ঘেঁষে বসে আছেন আপনারা!
আপনি আবারও অযথা বিচলিত হচ্ছেন অর্থহীন বিষয়ে। নিশ্চিন্তে থাকুন আমাদের ব্যাপারে। আচ্ছা, এবার কে কথা বলবে?
কে আর বলবে? হুম, ওইতো হামানুল হামান সাহেব এসে গেছেন। কী হামান সাহেব, দেরিতে হলেও এলেন তাহলে! ভালোই হলো।
হুম এলাম দেরিতে, তবে যাবও আগেভাগে। কথার পালা চলছে, না?
হ্যাঁ, বলবেন নাকি আসা মাত্রই?
আগে সুযোগ পেলে তো বেশ হয়। সময় যেহেতু একেবারে কম!
ঠিক আছে, তো আপনিই শুরু করুন । তোমরা কী বলো?
স্বাগত, স্বাগত, আমরা উচ্ছ্বসিত। তিনি নিঃসংকোচে বলুন।
জি, শুভসন্ধ্যা। বলতে গেলে কথা আমার হাজারটি। অতো তো আর বলা সম্ভব হবে না। অতি সংক্ষেপেই বলি।
জি।
জীবনকালের বিস্তৃতি আমার মধ্যমের ঊর্ধ্বে। জীবনটা যেমন আড়ম্বরপূর্ণ ছিল, সে তুলনায় বেশ করুণই হলো শেষটা। আর সেটাই যেন স্বাভাবিক। আমি সারা জীবন প্রচুর পরোপকার সাধন করেছিলাম । বিনিময়ে সেইসব উপকারভোগী মানুষগুলোরই সম্মিলিত নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হয়ে মনো-দৈহিক কষ্টে ধুঁকে ধুঁকে আমার যবনিকা হলো। বেশ ক’দিন হাসপাতাল, সিসিইউ, আইসিইউ – সংজ্ঞাহীন দশা- উপকারভোগীদের লাপাত্তা দশা, উপকারের দীর্ঘ ফিরিস্তি অবচেতনে মানস দৃশ্যপটে আসা- ঠোঁটের কোনে মৃদু তাচ্ছিল্য হাসি নিয়ে ওপার-যাত্রা। যাক, সর্বোপরি এ নিয়ে আমার শোকাফসোস শূন্যের কোঠায়। আমার বার্তা হচ্ছে, মানুষের উপকার যেন হয় বিনিময় প্রত্যাশাহীন। হাতে সময় একেবারে কম, সংক্ষেপে এর অধিক কী আর বলব? পরে কোনদিন না হয় সুযোগ হলে- –
হামানুল সাহেব ভূতপূর্বদের মতো আপনিও তো দেখছি- -কখন আপনি ভাঙন রেখার ওপারে – –
এমু সাহেব, শান্ত হোন। জানেনই তো সব। নতুন করে কী বলব? এবার অন্য কেউ শুরু করুক। ও পর্ব চুকে গেছে।
আচ্ছা, ভাঙন শব্দটা আগে যাক।
হুম, যাক।
গেছে শব্দটা এখন পুরোপুরিই। তো শুরু হোক আবার, নাকি? শুরু হলে কে বলবে এখন?
কে আর বলবে? তুমিই কথা চালিয়ে যাও।এখন তুমিই তো আছো ধারাবাহিকতায়। তুমিই তো,নাকি?
আমি- – ও হ্যাঁ, আমারই পালা হবার কথা। মাঝপথে হামানুল হামান সাহেব এসে বলে গেলেন। তো শুরু করি আমি। ওনার মতো আমিও সংক্ষেপেই শেষ করে দেব।
জি, তা-ই করুন। আমার আবার শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। অনেকক্ষণ ধরে এভাবে টুলে বসা হয় না সচরাচর!
আচ্ছা এমু সাহেব, আপনি একবার দাঁড়িয়ে তারপর বসুন। আমি শুরু করছি।
করুন, কিছুক্ষণ না হয় দাঁড়িয়েই শুনি আমি।
জি, শুনুন। আমার নাম হচ্ছে গিয়ে সৈয়দ কাছিরুল কাছির। পেশায় চিকিৎসক।
ভেরি নাইস!
সে আপনার বদান্যতা, এমু সাহেব । সবটুকু শুনুন আগে ভালো করে।
জি, বলুন।
এইযে আমার কণ্ঠস্বরটি শুনছেন!
জি, শুনছি।
একটু ব্যতিক্রমী কী না?
হুম, কী ধরনের?
খানিকটা মেয়েলি?
জি, মানুষের কণ্ঠ নানা ধরনেরই থাকে। একান্তই বিধাতার দান বললে অত্যুক্তি হয় না। ও কিছু নয়।
কিন্তু এ নিয়ে বিপত্তির সীমা ছিল না আমার। সমাজের মানুষগুলোকে তো চেনেন?
জি।
আমার যৌবনে এ কণ্ঠ ঘিরে তারা আমার নামের পূর্বে একটি দুঃখজনক ও আপত্তিকর শব্দ জুড়ে দেয়।
কেমন?
গাঁয়ে তথা পাড়ায় একই নামের দু’জন মানুষ ছিলাম আমরা। আরেকজন থেকে আমাকে পৃথক করে বোঝাতে আমার নামের পূর্বে অবলীলায় ওই শব্দটি চালু করে দিল অনেকে।
কোন শব্দ?
মাইগা।
মানে?
মানে হচ্ছে মেয়ে বা নারী। তাদের ভাষায় আমি হচ্ছি মাইগা কাছিরুল। কতটা দুঃখজনক ভেবে দেখুন।
দুষ্টরা দুষ্টামি করল, আর তা-ই বহাল হয়ে গেল?
সমাজটা এমনই। ভালো লোকের সংখ্যা নেহাৎই কম।
ভীষণ দুঃখজনক। তবে আমরা জীবন নিয়ে আলোকপাত করছিলাম।
এ জীবনেরই অংশ, এমু সাহেব । কারণ, তা জীবনকে প্রবল প্রভাবিত করে ছেড়েছে আমাকে।
মানে?
মানে কিছু রটনা রটে গেল আমাকে নিয়ে, ঠিক এ নাম ঘিরেই বলা চলে।
খুলে বলুন, প্লিজ।
গুজব রটে গেল আমার পৌরুষ থাকা না থাকা বিষয়ে।
গুজব তো গুজবই। তাতে কী আসে যায়?
অনেক কিছুই। ওইযে বললাম, জীবনকে তা প্রভাবিত করল।
কিভাবে?
আমাকে এভার ব্যাচেলর থাকতে হয়েছে, বুঝলেন কি না?
দুঃখজনক।
তবে পেশাগত ক্ষেত্রে কঠোর সংগ্রামে হলেও আমি ভালো করতে থাকি। জীবনে প্রচুর রোগীর চিকিৎসা করেছি আমি। বিনা ফি’তে করেছি নজিরবিহীন। কিন্তু একটা বয়সে এসে ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এক পর্যায়ে আমার স্ট্রোক হয় দু’দু’ বার। সর্বশেষ হার্ট এ্যাটাক!
হাসপাতালে লাইফ সাপোর্ট এ থাকি। আমি নির্বাক।
প্রায় সপ্তাহ যায়। চিকিৎসক সহ অনেকের আনাগোনা উপলব্ধিতে আসে – তাদের মৃদু কথোপকথন শুনতে পাই । অনেকে বলেন, আমি আজীবন নিষ্পাপ জীবন যাপন করেছি, মানুষের ভালো করেছি- ইহজগতে কষ্ট দিয়ে বোধকরি বিধাতা আমার পরজগতের সব কষ্ট ক্ষমা করে রেখেছেন। আমি অবচেতনে আদিঅন্ত পুরো কষ্টময় জগৎ জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখতে থাকি- এক পর্যায়ে মৃদু তাচ্ছিল্য হাসি ঠোঁটে জগৎ ত্যাগ করি।
তারপর? তারপর কী বলুন। ও জগতের কথা – -। ও হো, না না, ও জগতের কথা তো জানা যায় না- কেন বারবার ভুলে যাচ্ছি? ওহ, ভীষণ ক্লান্ত লাগছে! আর কি কেউ নেই? হুম, ওখানে আপনাকে দেখছি বেশ কিছুক্ষণ একেবারে পার ঘেষে দাঁড়িয়ে গলা ঝাড়ছেন। কিছু কি বলবেন?
জি- ই, তবে এখনি কি আমার- -?
হ্যাঁ হ্যাঁ, এখনই বলবে তুমি। হিসেবে তোমারই পালা হবার কথা। সমস্বর ধ্বনিত হলো।
আচ্ছা ঠিক আছে, আপনিই বলুন। পারলে খানিকটা এগিয়ে এসে বলুন। ইনতিসার এমু নিজের দিকে হাত ইশারায় বলল।
সমস্যা নাই, এখানেই থাকি। শুনা যাবে আমার কথা। আর পার ঘেঁষা কোন ব্যাপার না। আপনাকে একটা প্রশ্ন করি আগে।
জি, করুন।
আমার কণ্ঠস্বর শুনে কিছু কি আন্দাজ করতে পারতেছেন?
কী অনুমান? ঠান্ডা লেগেছে কি না আপনার? সেই কখন থেকে দেখছি মাথা মুখ ঢেকে রেখেছেন!
না না, আমি ঠিক আছি। আমি বলছি আমার কণ্ঠস্বর শুনে আমার লিঙ্গ পরিচয় সম্পর্কে কিছু আন্দাজ করতে পারতেছেন কি না।
বুঝতে পারছি না, আপনি পুরুষ হিসেবে অস্বাভাবিক ঠেকছে না কণ্ঠটা।
ধারণা ভুল আপনার। অচেনারা আড়াল থেকে এ ভুলটাই করে। আর যখন করে, কষ্টগুলো নতুন করে উথলে ওঠে।
দয়া করে খুলে বলুন।
আমি একজন বৃদ্ধ নারী। যে কণ্ঠটা আমার শুনছেন এটা মধ্যবয়সে দেখা দেয়। সাথে কিছু রোগও।
হতেই পারে।খুবই স্বাভাবিক। নানা বৈচিত্র্য, নানা সমস্যা নিয়েই আমরা মানুষ। বিশেষ করে বয়স হতে থাকলে নানা জনের নানা জটিলতাই থাকে। কী এমন বিষয়?
মানুষের জন্য তো সমস্যার সমাধান থাকে, থাকা সমীচীন। কিন্তু যখন সমাধানের প্রচেষ্টা না থেকে উল্টা শাস্তি থাকে, তখনই জীবন নিয়ে কথা জাগে।
খুলে বলুন সবকিছু।
হঠাৎ কণ্ঠের পরিবর্তন আর শারীরিক অসুস্থতার অজুহাতে স্বামী আমাকে নানা মিথ্যা অপবাদে তালাক দেন। অবশ্য বেশ কিছু দিন দুষ্ট লোকেদের দেয়া নানা গঞ্জনা তিনি সয়ে আসছিলেন। আড়ালে আবডালে অনেক বখাটেকেই আমি বলতে শুনেছি, মর্দা বেটি। আমি মুখ বুজে সইলাম, কিন্তু তিনি অজুহাত বানালেন। বিনা চিকিৎসায় ধুঁকলাম আমি। হতদরিদ্র, স্বল্পশিক্ষিত আমি- বাপের বাড়িতে আশ্রিত মুখ বুজে থাকি।
তারপর?
প্রায়ই মনের ভেতর ঝড় উঠত। বয়স সত্তরে আমার স্ট্রোক হয়। কথা বন্ধ, শরীরের নিচের দিক অবশ। হুইল চেয়ারে সীমিত চলাচল করি। রাতদিন অব্যক্ত যন্ত্রণায় চিৎকার পাড়ি। অনেকে ছুটে আসে, সান্ত্বনা দেয় – কত অল্প বয়সে স্বামীর ঘরে গিয়েছিলাম, আমি নিষ্পাপ, নির্দোষ- খোদা নিশ্চয়ই এ জগতেই আমাকে সব কষ্ট দিয়ে ও জগতে নিরঙ্কুশ পুরস্কারের ব্যবস্থা করেছেন প্রভৃতি। শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি- বলতে পারি না, নির্দোষ তবে এত দীর্ঘকালের কষ্ট কেন? দুঃসহ কষ্টের পরিপূর্ণ একটা যুগ, ভেবে দেখুন। কিছু একটা বলার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা-মুখেই এক সন্ধ্যায় আমি ওপারে প্রস্থান করি।
আচ্ছা, ওপারে কেমন আছেন আপনি? হায় সর্বনাশ! আপনিও তো দেখছি অন্যদের মতো মাটিচাপের সাথে চলে যাচ্ছেন নিচে। আপনি মায়ের মতো, অথচ আমারই চোখের সামনে এভাবে – -। হায়! কী হচ্ছে এসব? বড় ক্লান্ত লাগছে। আপনাদের মধ্যে আর কেউ কি? অনেক সময় তো পেরিয়ে গেল। আর কেউ থাকলে একটু জলদি যদি – -।
এমু সাহেব, আপনি শান্ত হোন। ঠান্ডা মাথায় সব বুঝে নিন – যে গেল, সেওতো ওপারেরই। আর মাঝরাত ঘনিয়েছে। সময়টা আপনার জন্য ঢের। লোকালয়ে ফিরতে হবে আপনাকে। আজকের মতো জীবনালাপ এখানেই সমাপ্ত হোক। জীবনালাপ এক নিঃসীম বিষয় – সে এত সহজে ফুরাবার নয়। আজকের মতো তাই প্রস্থান নিন। লোকালয় বহুদূরে। হেঁটে যাওয়া আপনার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে বৈ কী।
তবে?
ছাতিমের তলে স্থির অশ্বারোহণে আপনি এক্ষুনি লোকালয়ে ফিরে যান। বিদায় আজ- আবারও দেখা হবার প্রত্যয়ে বিদায়। এটিই আজকের পাড়ভঙ্গুর শেষ ও বৃহত্তর মাটিচাপ। দু’ কানে হাত তুলুন, প্লিজ।
শব্দটা ভয়ানক হবে, সবাই একযোগে যাচ্ছি।
ছুটন্ত ঘোড়াটির উচ্চতা এত বেশি যে পড়ে যাওয়ার ক্রমাগত আশংকায় এগিয়ে চলছে এমু। সামনে একটি ছোট্ট ঝোরামত – ওপারে অস্পষ্ট দৃশ্যমান লোকালয়। বহুদূর অতিক্রান্তে ক্লান্ত ঘোরাটি টলে যেতে চায়। আশংকায় ঘামতে থাকে এমু। একসময় চিৎকার করে ওঠে। তখনই পাখপাখালির কোলাহল সহ ভোরের নানা শব্দপাত কানে ভেসে আসে। সদ্য ঘুম ভেঙেছে তার।
(বি. দ্র. গল্পের স্থান কাল পাত্রপাত্রী পুরোটাই কাল্পনিক। বাস্তব জীবনের কোথাও কোনও পরিসরে কোনও পাঠক সকাশে কোনও আঙ্গিক সাদৃশ্যপূর্ণ ঠেকলে তা হবে শাশ্বত অস্তিত্বমান কাকতালীয় ব্যাপার।)
অচেনা – শওকত নূর
অবশেষে যাওয়া হলো একজনের কাছে। নগর রাজপথ, চারপাশের চাকচিক্য পেরিয়ে যখন তার কার্যালয়ে হাজির হলাম, তখন সূর্য মধ্যাহ্ন-সীমা অতিক্রমান্তে অপরাহ্ন সীমায় ঢলেছে। দৃশ্যমান ঝরা ঘামে জবজবে আমার শরীর। আনন্দ কিংবা উৎফুল্লতার লেশ নেই মনে -মুখাবয়বে ; বরং মুখ কাঁচুমাচু, মাথা নিচু। তার টেবিলে হোঁচট খাওয়া সামলে ঊর্ধ্বে মুখ তুলতেই নজরে এলো, ওপাশের চেয়ারে উপবিষ্ট তার চোখেমুখে প্রসন্নের হাসি।খানিকটা আহলাদে কণ্ঠে বললেন, আপনি কাহারুল কাহার, এলেন তাহলে?
জি, স্যার। চিন্তিত বললাম আমি।
তা কী মনে করে হঠাৎ? বলা নেই, কওয়া নেই! মনে করবেন না কিছু।
এলাম স্যার, এইতো-।
বসুন ওপাশেই।
জি, স্যার।
একটু ব্যস্ত আছি। জলদি বলে ফেলুন কী মনে করে এই আগমন।
জি স্যার, মানে আমি এলাম -।
আপনার তো আসার কথা নয়, আমার ভাবনায়ও কখনো তা ছিল না। পিয়ন এসে জানাবার পর থেকেই ভাবছি এ নিয়ে। এখানে মফস্বলে বছর দুই আছি । অনেক ব্যবসায়ীই আসে। আবার আসেও না অনেকে।
স্যার, মানে?
ভাবছি, নিশ্চয়ই কোনও বড় ধরনের সমস্যায় পড়েছেন। কোন বিপদআপদও হয়ে থাকতে পারে। আপনার তো অনেকের মতো কোনও স্বার্থ মতলবে আসার কথা নয়।
এলাম স্যার, স্বার্থ ভাবনাতেই এলাম, বিপদগ্রস্ত হয়েও বলা যেতে পারে।
ও–। আচ্ছা, ধরে নিচ্ছি, তা-ই এসেছেন। মানুষ তো আর চিরকাল একরকম থাকে না। প্রয়োজনের তাগিদে হলেও পাল্টায় । তা বলুন, কী মনে করে আসা, কী করতে পারি আপনার জন্য।
স্যার, কথা তো অনেক। অনেক দিনের অনেক কথা। ভাবছি কোনটা থেকে শুরু করব, কিভাবে গুছিয়ে বলব সব ।
আচ্ছা, গোছাতে থাকুন। ফাঁকে আমি কিছু কাজ সেরে নিই।
জি, স্যার।
তিনি কাজে মনোনিবেশ করেছেন। টেবিলের ফাইলপত্রে মাথা ঝুঁকে গভীর মনোযোগে কীসব পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন। আমি ভাবনার ফাঁকে দৃষ্টি দিই তার পেট, বুক, মস্তকে। বয়স হয়েছে তার। মাথার চুল বলতে চাদি থেকে পেছন অব্দি যা আছে তা ধবধবে সাদা, ভ্রু জোড়া সাদাকালো, মুখমণ্ডলের চামড়ায় ভাজ এসেছে, তবে তা বয়সের তুলনায় অনুল্লেখযোগ্য। হঠাৎ তিনি ফাইলপত্র থেকে মুখ তুলে বললেন, কী খবর এবার বলুন, গোছানো হলো সব কথা?
জি, স্যার।
বলুন কী বিপদে পড়েছেন। কে একজন কিছুদিন আগে আপনার সাথে থেকে দুর্ঘটনায় মারা নাকি গেছেন, সেটাই কি বিপদ? নাকি ব্যক্তিগত অন্য কোনও বিষয়াদি? যাই হোক, বলুন সংক্ষেপে।
জি স্যার, সেটা থেকেই শুরু করতে চাচ্ছি। ব্যক্তিগত কথাও কিছু আছে।
আচ্ছা, শুরু করুন।
স্যার, উনি লেখক হতে চেয়েছিলেন। একটা লেখাও লিখেছিলেন সারা জীবনের সাধনায়। কোথাও ছাপা হচ্ছিল না তা। অনেক ধর্না দিয়েছেন নানা জায়গায়। আলাপবশত একদিন জানতে পারেন এক সৃজনশীল প্রকাশকের সাথে আমার চেনাজানা আছে; আমার ব্যবসায়ীক কাগজপত্র ওখান থেকে নিয়মিত ছাপা হয়।
আচ্ছা থামুন, মনে তো হচ্ছে বর্ণনাটা ঢের লম্বা হবে। কিন্তু অতটা সময় আমার হাতে নেই। অতএব, এক কাজ করুন।
জি, স্যার।
এই প্যাডের পাতায় বর্ণনাটা লিখে ফেলুন। ফাঁকে আমি কাজটা সেরে নিই। খুব জরুরি একটা কাজ। বয়স হয়েছে দেখছেন তো। কিন্তু কাজের চাপ কিছু কমেনি, বরং বেড়েছে। লিখুন কষ্ট করে।
জি, স্যার।
প্যাডটা টেনে নিয়ে পকেট থেকে কলম বার করে পৃষ্ঠা-শীর্ষ থেকে লিখলাম নিম্নরূপ :
(এক) লেখক ঘটনার বিবরণ
লেখকের লেখাসহ লেখককে নিয়ে আমি প্রকাশকের উদ্দেশ্যে নগর-পথে হাঁটছিলাম। তখন পড়ন্ত বেলা। বেশ জনাকীর্ণ পথ। মাঝেমাঝে থামছিলাম আমরা। প্রতিবার থামতে আমি দৃষ্টি ছুঁড়ছিলাম লেখকের আপাদমস্তকে। বয়সের বাঁধ অতিক্রম করে এক দুর্নিবার তারুণ্যসুলভ উচ্ছ্বাস আনন্দানুভূতি বোধ করি ভেতর থেকে ক্রম উদ্ভাসিত করে তুলছিল তাকে। সারাজীবন খুব খেটেখুটে ওই একটি সাহিত্যকর্মই দাঁড় করিয়েছেন তিনি। মনের সবটুকু দরদ ঢেলে দিয়ে লিখেছেন। আদ্যোপান্ত পড়েছি আমি সুপারিসর লেখাটার। ভালোও লেগেছে । নিজ কিংবা পর-জীবন, যেটি ঘিরেই তৈরি হয়ে থাক লেখাটা, তা বাস্তবতাকে বেশ টেনেছে এবং একটা ভবিষ্যৎ লেখাটার থাকবে। সেই অনুভবই সম্ভবত তাকে যারপরনাই উচ্ছ্বসিত করে তুলছিল।
ঘণ্টা আধেকের হাঁটা-পথ পেরিয়ে আমরা যখন এক ব্যস্ত সড়কের এপারে উপনীত হই, তাকে প্রকাশনালয়ের অবস্থান নির্দেশে বললাম, দেখুন, ওই যে ওই ওপারের যে অনুচ্চ ভবনগুলো, তার মাঝামাঝিতে অপেক্ষাকৃত একটা দীর্ঘ ভবন, ওটারই তিনতলায় আমাদের গন্তব্য। ওখানেই উদ্দিষ্ট প্রকাশনালয়।
এটুকু বলতেই কী হলো তার, আচমকা পথ বিভাজক থেকে লাফ দিলেন তিনি নিচের ব্যস্ত পথে। চোখের নিমিষে ঘটল ঘটনাটা। লেখার ফাইলটা চেপে ধরা আছে বুকে, যেন দু’ হাতে আরো বেশি শক্তি সঞ্চারণ ঘটেছে। ফেরাতে সমর্থ হলাম না আমি। নিচে পা ফেলে দু’ কদম এগোতেই সব শেষ। ছুটন্ত যানের ধাক্কায় ছিটকে ক’ হাত গিয়ে উবু-স্থির হয়েছেন তিনি। ফাইলটা বগলে ধরা আছে পূর্ববৎ। হাসপাতালে নেয়া হলো তৎক্ষণাৎ; তবে তা কর্তব্যকর্ম সম্পাদনের তাগিদ মাত্র।
তার অনাথ ছেলেমেয়ে দুটি সেই থেকে আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। মাঝেমাঝে নিজেকে কিছুটা হলেও অপরাধী বলে গণ্য হয়। ভাবনাগ্রস্ত হই, কী প্রয়োজন ছিল ওই উপকার সাধনে যাবার। তার ছেলেমেয়েরা আমাকে কোনও ভাবনা বিশ্লেষণে ন্যূনতম হলেও দায়ী কিংবা দোষী সাব্যস্ত করে কি না তা স্পষ্ট ধরা যায় না। আমি ভাবনা ঝেড়ে বারবার দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হই, বইটা যে করেই হোক দাঁড় করানো চাই। স্রেফ একটা সাফল্য মুকুট প্রয়াতের অনাথ ছেলেমেয়ে দুটির শিরস্থ করে তাদের থেকে দায়মুক্তি – এই আর কি। কিন্তু মৃত্যুই যেন লেখকের সৃষ্টিকর্মটির জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকাশক আমূল মত পাল্টেছেন। অখ্যাত মৃত কোন লেখকের একমাত্র লেখা ছাপার ঝুঁকিতে কিছুতে তিনি যাবেন না। যতদূর পা বাড়িয়েছি, একই মনোভাব পেয়েছি অন্য প্রকাশকদেরও।
দিনদিন আমি লেখকের ছেলেমেয়েদের কাছে মানবিক দায়বদ্ধতায় পড়ে যাচ্ছি । এমতাবস্থায় একটা উপকার যদি তার তথা আমার আপনি করতে পারেন-প্রথমত এই মনে করে আপনার এখানে আসা।
(দুই) ব্যক্তিগত সমস্যার বিবরণ
আমার পিঁয়াজ, মরিচ, হলুদ, রসুন তথা মসলা ব্যবসায়টা দীর্ঘদিন যাবতই আমাকে খুব ভোগান্তিতে ফেলছে। শুধু শারীরিক মানসিক ভোগান্তিই নয়, আর্থিকও। কোনও অদৃশ্য কারণে মালামালগুলো আমার আটকে যায় স্থানীয় নৌ বন্দরে। খালাস করতে করতে দ্রব্যগুলোর চড়া দাম এমন পর্যায়ে পড়ে যায় যে আমাকে বরাবর মুনাফার বদলে লোকসানের অংক কশতে বাধ্য হতে হয়। তিন ছেলে আমার। প্রত্যেকেই ছাত্র।নিয়মিত তাদের খরচ জোগাতে হয়। একটা প্রতিকার সম্ভব হলে প্রার্থনা করছি। এটা আগমনের দ্বিতীয় হেতু।
লেখা শেষে প্যাডটি তার দিকে বাড়িয়ে ধরি। ফাইলের কাজ শেষে প্যাডের পৃষ্ঠাগুলো ওল্টাতে থাকেন তিনি। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সম্ভবত বার দুই পড়লেন আমার তাৎক্ষণিক লিখিত বিবরণী। ঠোঁট চেপে বললেন, বইটার একটা ব্যবস্থা আমি করতে পারি। পরিচিত বেশ ক’জন প্রকাশকই আমার আছে। একজন একটু বেশি ঘনিষ্ঠ। নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে দিচ্ছি। সময় পেলে ফোনে কথাও বলতে বলব তার সাথে। আশা করি সফল হবে বইটা। এবার বলুন আপনার ব্যবসায়ীক প্রগতিতে কী করতে পারি। অবশ্য আপনি ইচ্ছা করলে কিন্তু ওইসব মরিচ পিঁয়াজের ব্যবসায় ছেড়ে লেখার কাজেও আত্মনিয়োগ করতে পারেন! যাহোক, সাজেস্ট করুন, যদি কোনও আইডিয়া মাথায় থেকে থাকে।
স্যার, কোনও ধারণা আমার নেই।
আপনার মালামালগুলো সময়মত খালাস হবে, মুনাফায় বিক্রি হবে- এইতো, নাকি?
জি, স্যার।
এ কোন জটিল সমস্যা বলে মনে হচ্ছে না আমার কাছে। আমি দেখব। আশা করি, শীঘ্র সমস্যাটা দূর হবে। আর কিছু?
জি না, স্যার। আজ তবে উঠি।
জি।
ধন্যবাদ, স্যার।
ধন্যবাদ।
বইটি ছাপা হয়েছে এবং তার একটি কপি মৃত লেখকের ছেলেমেয়েরা আমার কার্যালয়ে এসে দিয়ে গেছে। তারা আমাকে উষ্ণ ধন্যবাদের সাথে অবহিত করে গেছে, বইটির কাটতি ও সাফল্য এরই মধ্যে প্রত্যাশিত মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। শুনে এ বিষয়ে বেশ একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ফেলি আমি।
ব্যবসায়ীক প্রতিকূলতা ছাড়িয়ে অনেকটা গতিশীল পর্যায়ে আমিও আছি। দ্রব্যগুলোর উচ্চ দরদাম নিচে নেমে স্থিতিশীল হলেও সময়মত তা খালাশ হতে থাকায় ওসবের বেচা-বিক্রি বেড়েছে ঢের। ফলে দরপতনেও লাভের মুখ দেখছে ওগুলো। কার্যালয়ে বসে প্রতিদিন প্রতি ঘণ্টায় যেসব বড় বড় অর্ডার পাচ্ছি, তাতে সাফল্যানন্দে বুক ভরে উঠছে। আয়নায় তাকিয়ে নিজের প্রতিবিম্বে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করি, তা সুখ সাচ্ছন্দ্যব্যঞ্জক।
ব্যবসায়ীক ব্যস্ততা, ব্যবসায়ীক কর্মযজ্ঞের অতি বিস্তৃতিই একজন ব্যবসায়ীর উদ্দিষ্ট লক্ষ্যবিন্দু। সে বিন্দুতে আমি এখন সমাসীন। বহুদিন পর তাই এমন পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস! মনের আনন্দে একটা গানেও গলা চড়াই; সুর তাল লয়ে পরম উচ্ছ্বসিত হাত পা নাড়াতে থাকি।
কর্মচারীর ডাকে আচমকা ঘুম ভাঙে আমার। কাঁধে হাত রেখে চেঁচাচ্ছে সে, সাব, ও সাব, আপনি কি স্বপ্নে দেখতেছেন? ভয়ংকর কিছু দেখতেছেন নাকি? এমন হাত পা কাঁপাইতেছেন!
চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম মালামালের অসময়ে খালাস হয়ে মফস্বলের গুদামঘরে ওঠার পর সেগুলো দেখতে আসা গুদামঘরটি প্রায়ান্ধকার। লোডশেডিং! দুপুরে রেস্তোরাঁ-খাবার গ্রহণের পর চিন্তিত ক্লান্ত অবসন্ন এক ঘুমে বেলা পড়ে এসেছে। পায়ের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুলিদের ফেলে যাওয়া মালামালের বড়ছোট বস্তাগুলো। এক কোনে ধূলিধূসর মুখ থুবড়ে আছে কথিত মৃত লেখক শিমজান আলী শেহরান সাহেবের বহুল প্রত্যাখ্যাত জীর্ণ পুস্তক-পাণ্ডুলিপি। সামনেই টুলের ওপর স্থাপিত পত্রিকা পৃষ্ঠায় এতক্ষণের স্বপ্নে দৃষ্ট সহায়ক বিশিষ্ট ব্যক্তির হাস্যোজ্বল ছবি।
আমি চোখ খুলতেই কর্মচারীটি চলে গেছে। তড়িঘড়ি উঠে গুদাম কোনার দেয়ালে ঝুলন্ত অপ্রশস্ত আয়নাটির দিকে পা বাড়াই। ওর দিকে মুখ ধরা হয়নি গত ক’দিন।
ক’দিনের তেল পানি চিরুনি চালনাহীন ধূলি আস্তরিত চির-কোঁকড়া চুল, লালচে ভ্রু-গোঁফ, ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডলের বর্ণ রূপান্তর, কালচে বলিরেখা, প্রায় বুজে থাকা মরিচ লাল দুই চোখ – নিজ প্রতিবিম্বটি অচেনাপ্রায়!
শওকত নূর | Shawkat Noor
Ektu Chuye Deya | একটু ছুঁয়ে দেয়া | New Bengali Story 2023
New Bengali Novel 2023 | খুঁজে ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ১২) | উপন্যাস
Natun Bangla Kabita 2023 | রঞ্জনা বসু | Top New Poetry
Sunglass and our friendship | সানগ্লাসেই সৃষ্টি আমাদের বন্ধুত্ব | Bangla Galpo 2023
Anandabazar Bengali Short Story | Bengali Short Story | Pratilipi Horror Stories in Bengali | Lifestyle Web Stories in Bangla | Trending online bangla golpo pdf free download | Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids | Online Bengali Story Writing pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | Online Bengali Story Writing in english | Trending online bangla golpo pdf download
suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | Online Bengali Story Writing | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Trending Online Bengali Story Writing | Pdf Online Bengali Story Writing | Online Bengali Story Writing App | Full Online Bengali Story Writing Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Trending online bangla golpo pdf
Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | Online Bengali Story Writing 2024 | New Online Bengali Story Writing – Episode | Golpo Dot Com Series | Online Bengali Story Writing Video | Story – Online Bengali Story Writing | New Bengali Web Story Audio | New Bengali Web Story Video | Online Bengali Story Writing Netflix | Audio Story – Online Bengali Story Writing | Video Story – Online Bengali Story Writing | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Top Online Bengali Story Writing | Online Bengali Story Writing Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Trending online bangla golpo book pdf
Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New Online Bengali Story Writing | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Trending online bangla golpo free download