On the hilly roads of Uttarakhand | Best Travel Story

Sharing Is Caring:

উত্তরাখণ্ডের নৈসর্গিক পাহাড়ি পথে – শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ

খণ্ড ১

[খাসির মাংস এবং জাগ্রত বিচুটি]

ভ্রমণ স্থলে পৌঁছানোর আগের কিছুটা সময়, শূন্য সময় ধরে নিতে পারি। অভিযানের শুরুতে বিচিত্র সব ঘটনা ঘটে, অনেকে ধর্তব্যের মধ্যে আনি না। আবার যেখানে বেড়াতে চলেছি, অনেককিছু দর্শনীয় বস্তু বা স্থানের মধ্যে একটাকেই নামে বা ক্ষেত্রের প্রাধান্য দিয়ে থাকি। যেমন, হাজারদুয়ারি, পুরীর মন্দির, সুন্দরবন। অথচ সেখানে হাজারো দেখার জিনিস থাকে। যদি সুন্দরবন একমাত্র দেখাই উদ্দেশ্য হয়। বাঘ, কুমির, হরিণ দেখার জন্য উৎসুক হই কেন? না দেখতে পেলে মন খারাপের গল্প করি কীসের দুঃখে। অরণ্য কেন্দ্রিক সামগ্রিক উপভোগ করাই হলো সুন্দরবন ভ্রমণের বিশেষত্ব।

আমাদের আজকের ভ্রমণের যে নামটি মুখে মুখে ঘুরছে ফিরছে এবং এখনো একই ভাবে অনড় আছি, তা হলো কৌশানী। আমাদের ভ্রমণের শেষ রাত্রিবাসের জায়গা। মজার হলো, ওই নামের ফুটফুটে দুরন্ত ছোট্ট মেয়েটি আমাদের ভ্রমণসঙ্গী। তার নামটাও কৌশানী। আমাদের কৌতূহলের বিষয় এটাই, নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা পাহাড়ি স্থানটি কতটা সুন্দর, আমাদের ছোট্ট মেয়ে কৌশানীর থেকেও। নিছক কৌতুক করে বললাম। পাঠক বন্ধুরা আমাকে প্রশংসা করে বলতেই পারে, একদম পাকা ঘোল ব্যবসায়ী। তাহলে মারাত্মক ভাবে ভুল করবেন। মেয়েটির চোখে দেখলে, রূপে মুগ্ধ হবেন। ওর সঙ্গে আমার কোথায় মিল সেটাই বরং বলে রাখি জেনে রাখুন। তাহলে ওদের সঙ্গে আমাকে আলাদা ভাবে চিনতে সুবিধা হবে।

কৌশানীকে নিয়ে উত্তরাখণ্ডের ভ্রমণ সূচিতে মোট পনের জন। রাত নটা-পঁয়তাল্লিশে হাওড়া থেকে বাগ-এক্সপ্রেস ছাড়ল। রায়বেরেলি পৌঁছাল সকাল দশটায়। যেখান থেক ভারতের একসময়ের কয়েকবারে জয়ী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গন্ধী দাঁড়াতেন। ওখান থেকে গন্তব্যের শেষ ষ্টেশন কাঠ-গুদাম। সবাই লাগেজপত্র নিয়ে নেমে পড়লাম। এইযে দুই রাত্রি, একদিন ট্রেনের মধ্যে কাটিয়ে চতুর্থ দিবসের প্রায় মধ্যভাগে এখন। এই দীর্ঘসময়ে কৌশানী ও আমি রেলকোম্পানির খাতায় দু’জনের নাম নেই। অথচ আমরা সশরীরে বিরাজ করেছি। শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ডিব্বাতে।

তিন জায়গায় আমাদের সিট পড়ে। কৌশানী তিন জায়গায় ছোট্ট পায়ে দাপিয়ে ফেরে। আমি আপার ও লোয়ারের মধ্যে ওঠা নামার সময় পেরিয়ে যায়। একমাত্র আমরা দু’জন টিটি’র ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পড়লাম না কেন সেটাই আশ্চর্যের বিষয় হতে পারে। ছোট্ট কৌশানীর বয়সের ছাড় আছে কিন্তু আমার বেলায় তা তো খাটে না। ফুটফুটে সুন্দর মুখের মামা বলে। ওর মা তো আমাকে সেই ছোট থেকে শিবেনদা বলে সেই অর্থে মামাই। তাই বলে ষাটোর্ধকে রেল কোম্পানি ভাড়া মুকুপ করবে কোন সুখে। আমি বিনা টিকিটের যাত্রী নই, সেই রহস্য প্রসঙ্গক্রমে জানতে পারবেন। আমাদের ভ্রমণ গোষ্ঠীর মধ্যে প্রাক্তন শিক্ষকের ছড়াছড়ি। আছে সরকারি ডাক্তার, সরকারি চাকুরে, রামকৃষ্ণ মিশনের নবীন মহারাজ, কাজলদি। একমাত্র আমি অতি সাধারণ, এগারো দিনের সফরসঙ্গী।

অললাইনে ট্যাভেরা ও ইনোভা দুটো গাড়ি কদিনের জন্য ভাড়া করে রেখেছিল। গাড়ি ষ্ট্যাণ্ডে ছিলো। ফোনের মাধ্যমে উভয়ের সাক্ষাৎ হয়ে গেল। আমরা দুটি দলে ওখান থেকে ভাগ হয়ে গেলাম। এই ভ্রমণের যিনি পূর্ণ পরিচালক পিযুষবাবু। আমাকে শিবুদা বলে ডাকে। আমিও মেজবাবু বলি। বেশ লম্বা চওড়া। গায়ের রঙ উজ্জ্বল। শারীরিক অসুস্থতার জন্য ঘন ঘন ওষুধ খায়। পা টেনে টেনে হাঁটে। এমনটা আগে ছিলো না। ,

সর্বাঙ্গ সুন্দর বলতে গেলে। এখনোও দেখতে সুন্দর তবে অতিরিক্ত মেদ শরীরে বাসা বেঁধেছে। শরীর আর নিজের বশে নেই। ওনার কি দোষ, এই সময়ের ব্যাধির প্রভাব যা সর্বত্র লক্ষ্যনীয়। অপ্রাসঙ্গিক কথার ফাঁকে সবাই গাড়িতে উঠে গেছি। গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আমাদের গাইড ম্যানের নির্দেশ যে যেই গাড়িতে উঠেছে, ভ্রমণের কটাদিন গাড়ির সে সেই সিটে, সেই গাড়িতে বসবে। একদিক দিয়ে ভালোই হলো আমার মানসিকতা অনুযায়ী।

ষ্টেশনের বাঁক ছাড়িয়ে বের হতেই, চোখে পড়ল পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে পাথর কাটা পথ বেয়ে আমাদের পথ চলা শুরু হলো। দৃষ্টি আর গাড়ির ভেতরে আবদ্ধ রইল না। কান কানপেতে পড়ে রইল গাড়ির কোণে, কুঁনো ব্যাঙের মতো। তবে গাড়ি থামলে দুটো গাড়ির মধ্যে কানে হেঁটে খবরাখবর ঘুরে বেড়াতে লাগল। পিযুষবাবু চালকের পাশে। ওখান থেকে জানিয়ে দিলো, ‘আমার হিসাবের মধ্যে খাসির মাংস খাওয়াবো। পরে যে যার খরচে খেতে হবে, খাওয়াটা একসঙ্গেই হবে’।

সামনের এক পাহাড়ের ঢালে দীর্ঘদিনের পুরোনো পদ্ধতিতে খাসির মাংস রান্না হয়। যতটুকু তেল মশলা না দিলে নয়, ঠিক ততটুকুই দেওয়া। প্রতিদিন একটা আস্ত খাসি আনে। ওখানেই কেটে রান্না করে। আবার ওখান থেকে রাতে বাড়িতে চলে যায়। এইভাবে দীর্ঘদিন চলে আসছে। নামেই হোটেল রাত্রিবাসের যায়গা নেই। গাড়ি সেখানেই এসে পথের পাশে দাঁড় করালো। হিন্দি বাংলায় মিশিয়ে শারীরিক ভাষায় বুঝিয়ে দিলো, ‘চৌদ্দা থালি চাওল আউর হাফ প্লেট করকে মাটন জলদি বানা দিজিয়ে’। ‘ঠিক হ্যায়’ বলে তারা তাদের কাজ শুরু করে দিলো।

ট্রেনের মধ্যে কদিন আটকে থেকে দম প্রায় বন্ধের জোগাড় হয়েছিল। হাতে পায়ে খিল ধরে যাওয়ার অবস্থায় ছিলাম। পাহাড়ের ঢালে মুক্ত প্রকৃতির কোলে যে কি আরাম। কী ভালোই না লাগছে। এখন মোবাইল মানে ক্যামেরা। সেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে। যেখানে মাংস ক্রমাগত কাঠের জ্বালে ফুটছে। তার পাশে একটা বড়ো পাথরের চাঁই। তার ওপারে রক্তের ছোপ। যে খাসির মাংস রান্না চলছে, এখানেই কাটা হয়েছে। গভীর খাদের পাশে বেড়ে ওঠা পাইনের ঝাঁঙড়া মাথা আমাদের উঁকি মেরে দেখছে। যেন অনায়াসে তাকে হাত দিয়ে ছোঁয়া যায়। বাস্তবে অসম্ভব ব্যাপার।

এই রাজ্যেই অসংখ্য পাইন গাছের সমাহার। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি। সেখান থেকে বেশ কয়েকতলা নিচে গাছের গোড়া। জানলাম উত্তরাখণ্ড জুড়ে পাইন গাছের আধিক্য। এই গাছের কাঠে ট্রেন লাইনের স্লিপার করা হতো। এখন তো ঢালাইয়ের স্লিপার। এখান থেকে তখন সারা ভারতে লাইন পাতার কাঠ পাঠানো হতো। মাপ মতো গাছগুলো কেটে গুদামজাত করে রাখতো। তাই এই ষ্টেশনের নাম ‘কাঠগুদাম’। আমরা ধাপা থেকে মাংস ভাত খেয়ে, যে যার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে শুরু করলো।

এগিয়ে চলেছি পাহাড়ি পথ দিয়ে। এই সুযোগে সদস্যের আংশিক পরিচয় দিয়ে রাখি। আমি বসে ছিলাম চালকের বরাবর গাড়ির পেছনের আসনে। আমাদের মাঝের সিট উলটিয়ে ঢুকতে হয়। তা চালক প্রতিবার ওই কাজটি করে থাকে। আমার বাঁ পাশে পিনাকীবাবুর পুত্র বুটু, পোষাকি নাম দীপাঞ্জন। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ছে।ওর পাশে পিনাকীবাবুর ছোটদা অর্থাৎ পিযুষবাবু। প্রকৃত তিন ভায়ের মধ্যে ছোট পিনাকী। মেজদাকে ওইভাবে ডেকে অভ্যস্ত। ভাইদের থেকে বড়ো কাজলদি, তিনি সবার কাছে দিদি। অন্য গাড়িতে আছে। জামাইবাবু গোলামচন্দ্র। সবাই তাঁকে মাষ্টারদা বলে ডাকে।নানা বিপ্লবী মাষ্টারদা নয়। আমার সামনের সিটে অর্থাৎ মাঝখানের সিটে তিনজন। কাজলদির ছোটি মাসি দুইদিকে পিনাকীবাবুর শ্বশুর ও শাশুড়ি। এক মাসি ও মাসতুতো বোন অন্য গাড়িতে। সামনের সিটে মহারাজ।

পাঠকবন্ধুরা একটা নামের শব্দ একাধিক বার ব্যবহার করেছি ইচ্ছে করেই, পিনাকী। শ্বশুর, শাশুড়ি ও ছেলে এসেছে কিন্তু স্ত্রীর কথা একবারও ওঠেনি। আসলে পত্নীকে অর্ধাঙ্গিনী বলে, তাঁর অর্ধ অঙ্গ না এলে সতী কী করে আসে। এবার মন খারাপ করে বলি, হঠাৎ অসুস্থতায় অপারেশন করতে হয়। বিশ্রামের জন্য বাড়িতে আছেন স্বামীর সেবার ভার নিজের কাঁধে নিয়ে। আমি, পিনাকী নামে এক সচ্ছল পারিবারিক ভ্রমণমণ্ডলীর অংশ হয়ে বিরাজ করছি। পিনাকী ও শিবেন, দুটোই মহাদেবের নাম এই যা মিল।

নীরবে গোমরা মুখে ভ্রমণ উপভোগ করা যায় না। কান যেমন সজাগ চাই , চোখ খোলা রাখতে হয়। রঙ্গ রসিকতার ছাঁকনিতে অপ্রয়োজনীয় খাদ যা আনন্দময় জীবনের বাধার কারণ, তা ছেঁকে ফেলতে হবে। নির্মল আনন্দ নিয়ে বাড়িতে ফিরতে হয়। তাই আমার দৃষ্টির বাইরের দৃশ্যাবলীতে আর কান পরিপার্শ্বিক ক্ষেত্রে শব্দ সচেতন। নিছক কথোপকথনে রসদ খুঁজে ফেরে। সবাই সরবে মজা করলেও আমি নীরবে বেশি আনন্দ উপভোগ করেছি। বাইরে থেকে সহজে বোঝার কথা নয়।

মাকে হারিয়েছে। ছোটি মাসিকে নিয়ে টুকিটাকি কথায় প্যাচে ফেলে মজা করে মাকে অনুভব করার একটা প্রয়াস পিযুষবাবুর মধ্যে লক্ষ্য করছিলাম। ‘দ্যাখো আবার মেসো ফোন করছে। বাইরে ছাড়া তো উচিত হয়নি। কতটা ভালো বাসে সবাই দেখলে। সঙ্গে আনতে পারতো’। মাসিকে রসিকতা করে বলল।
— পিযুষ তুইতো জানিস, মেসোর শারীরিক অবস্থার কথা। ঘর থেকে ফোঁটা কেটে কেটে পায়খানায় যায়। আমার কম জ্বালায়। কাজের মেয়ে আছে। সব বুঝিয়ে এসেচি। তবু যদি ফোন করে কী করব, শুনতে পাবেনে তবু আঁ আঁ করবে।
— ছেড়ে দাও তো ঝরঝলে মাল। আমার সঙ্গে চলে এসো, যা মালকড়ি আছে নিয়ে।একটা আশ্রয় বানিয়ে দুজনে থাকবো। মহাজের কথায় সবার সে কী হাসির ফোয়ারা গাড়ির মধ্যে।

হাসি ঠাট্টার মধ্যে ছোটি মাসির জীবনের অনেক দুঃখ যন্ত্রণায় কথা জানতে পারলাম। তাঁর উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা কাকে না দিয়েছেন। সবাই ভুলে গেছে, তাকে ভুল বুঝেছে। মনে পড়লে ভীষণ কষ্ট পান। তাঁর অকপট স্বীকারোক্তি। ছোটি মাসির থেকে বুঝলাম মানুষ সংসারের চাপ সরিয়ে একবার যদি মুক্ত পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়তে পারে। জীবনের অনেক কিছু থেকে হালকা হতে পারে। যে প্রিয় মানুষটা আর কোনদিন বাইরে বেরুতে পারবেনা। জীবনসঙ্গিনীকে ভ্রমণে যেতে বাধা দেয়নি। হাসি ঠাট্টা গল্প গুজবের মধ্যে পাহাড়ের গা’ঘেঁষা খাড়াই উৎরাই পথে হাওয়ার গতিতে এগিয়ে চলল আমাদের গাড়ি।

পিযুষবাবু বললেন হোটেলে উঠলে আজকে আর বের হতে পারবনা। যতটা পারি বাইরে ঘুরে নেব। ভ্রমণ সূচিতে ছিলনা। ড্রাইভারের কথায় একটা ঝর্ণা দেখতে চলেছি। সরু পথ দিয়ে বিপদজনক ভাবে এঁকেবেঁকে গাছগাছালির ভিতর দিয়ে প্রায় ঝর্ণার কাছে পৌঁছলাম। পেছনের গাড়ি সেও পাশে দাঁড়িয়ে গেছে। যে গাড়িতে ছিল ডাক্তারবাবু, মৌমিতা ডাক নাম মানতু। দুই মেয়ে, ঈশানী এবং কৌশানী। মাষ্টার, দিদির খুড়ততো বোন মহুয়া, টকাই মাসি ও মাসতুত বোন ঝুম্পা। সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম।

আমরা যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলাম তার তলা দিয়ে ক্রমাগত ঠান্ডা জল প্রবাহিত হচ্ছে। এই ঝরনার উৎস ঘন গাছের জন্য দেখতে পাচ্ছি না। সামনে পাথুরে খাঁজ কাটা পথ দিয়ে উঠতে হয়। খাড়াই ধাপ দেখে কে কে উঠবে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। ছোটিমাসি কোমরে বিশেষ বেল্ট পরা অবস্থায় পা বাড়িয়ে আছে। আমি, ডাক্তার, বড়মেয়ে, বুটু তো যাবোই। দিদির বুকে বিশেষ যন্ত্র বসানো আছে, একদম যাবেই না। মাষ্টার চুপচাপ থেকে সবার ওপরে চালটা দেন। তিনি অনেকটা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মতো বললেন ‘যেতে পারি, তবু কেন যাবো’। আমরা টিকিট কেটে ঝর্ণা দেখলাম বটে মন ভরলো না সেভাবে।

নিচে নেমে এক বিরাট শোরুমে একে একে সবাই ঢুকলাম। আমাদের মধ্যে বয়স্কদের বেশিরভাগ হাতে পায়ে গাঁটের ব্যথায় ভুগছে। দোকানিরা এই সময়টা বোঝে। অবাঙালি কথাবার্তায় বুঝিয়ে দিলেন তার হাতে ধরা একগুচ্ছ কাঁটা গাছের গুণাগুণ। শরীরের যেখানে ব্যথা, কয়েক ঘা সেই জায়গায় মারলে মুহূর্তে ব্যথা উধাও। এই গাছ পেস্ট করে চটি বানানো হয়েছে। পরলে পায়ের তলায় ব্যথা থাকবে না। ছোটিমাসি পায়ের সঙ্গে কোমরের অবস্থা ভীষণ খারাপ। ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা বেল্ট প্রায় সময় খোলেন না।যখন শুনলেন বিনামূল্যে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। ছোটিমাসি বেল্ট খুলে প্রস্তুত।

পায়ের কামিজ হাঁটু পর্যন্ত তুলে ছোট্ট টুলে বসে পড়লেন। লম্বা চওড়া দোকানের ছেলেটি ঝাঁটা পেটার মতো ঝপাঝপ কষিয়ে দিয়ে, এখন কেমন লাগছে জানতে চাইলেন। ছোটিমাসির কোমন তো রাঙা ফোড়ার মতো অবস্থায় ছিলো। গুচ্ছ গাছের ঠিক গুণগত ক্রিয়া আপাতত বোঝা গেলনা বটে। বোধহয় ‘বিষে বিষ ক্ষয়ে’ নির্বিষ বোধ করে বললেন, আগের চেয়ে ভালো বোধ করছি। পাশে বুটুর দিদিমা দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল। বিনা পয়সায় এই সুযোগ কে হাত ছাড়া করে। ভদ্রমহিলা বোকামি করলেন না। ব্লাউজের আস্তিন গুটিয়ে ষ্টুলে বসে পড়লেন। ছেলেটি গুচ্ছ কাঁটাগাছের বাড়তি কয়েক ঘা খোলা হাতে মারলেন। হাতে ব্যথা ছিলনা। ফাউ পরিসেবা পেতে গিয়ে এখন মনে হচ্ছে চিড়বিড় করছে। ক্রমশ বাড়বাড়ন্তের দিকে এগোচ্ছে বুঝতে পারছেন। মুখের বিরক্তি ভাব দেখে বুঝতে পারছি।

মধ্যম শালক পিযুষবাবু ওই ঝাঁটিগাছের পেষ্ট করা একজোড়া চটি কিনেছে। মাষ্টার চটি কেনার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। যখন দেখলেন বুটুর দিদিমা চিড়বিড়ুনিতে অস্থির হয়ে উঠছে। বুদ্ধিমান মানুষ বুঝে নিলেন কোথাও গড়বড় আছে। যে কথা দোকানী বলেছে নিজে শুনেছে। তবুও পিযুষবাবুর কাছে জানতে চাইলেন। ‘হ্যারে এরা তো হোম ডেলিভারি দেয় তাই না। ঠিকানা আছে অর্ডার করিয়ে নেবো’। এই বিষাক্ত চটির কথা আর মুখে এনেছিলেন কি না আমার জানা নেই। ওনার বাড়িতে যাতায়াত আছে চোখে পড়েনি। যাক অনেকটা সময় কাটিয়ে গাড়িতে উঠলাম।

ট্রেন দেরিতে কাঠগোলায় পৌঁছেছে। পথে খেতে আরও অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। শেষ ঝর্না দেখার উপলক্ষে, দোকানে কিছুটা সময় ব্যয় হলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।গাড়ি ক্রমশ আরও উপরের দিকে উঠছে। পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে এখন নৈনিতালের নয়না লেকের পাশ দিয়ে গাড়ি ধীর গতিতে আমাদের আবাসিকের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আগামীকাল এখানে বেড়াতে আসব। আমরা কততলা উপর থেকে নয়না লেক দেখছি মাথায় ঢুকছে না। এই লেক অনেকটা ডিম্বাকৃতির। যার আয়তন কত একর হবে, না জানলেও হবে। লেকের গায়ে অসংখ্য ভ্রমণার্থীদের জন্য আবাসিক গড়ে উঠেছে। পুরো লেকের চারিদিকে জোনাকির আলোয় যেন ছিলমিল করছে। লেকের জলতরঙ্গে আলো খেলে বেড়াচ্ছে। নৈসর্গিক অপরূপ সেই দৃশ্য দেখার মতই।

গাড়ি অল্পের জন্য থামিয়ে, আবার চলতে শুরু করল আঁকাবাঁকা পাহাড়ি ঘুর পথে। অনেকটা যাওয়ার পর, বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে প্রায় খাড়াই ওঠার মতো উঠে দোতলা বাংলো বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় আগু পিছু করে দুটো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। বোর্ডে লেখা দেখলাম, ইউথ হোষ্টেল নৈনিতাল (Youth Hostel.Nainital) সংরক্ষিত এরিয়া। পাহাড়ের বিশেষ জায়গায় এটি। এখানে বেশিরভাগ ভিআইপি মানুষের বাস। আমরা যেখানে উঠেছি সেই অর্থে হোটেল নয়, হোষ্টেল। যারা ক’দিন নিরিবিলি থাকতে চায় তারাই এখানে আসে।

তলায় মহিলাদের জন্য সুসজ্জিত দুটি এটাচ কক্ষ। ছেলেদের দ্বিতলে বড়ো ঘর (Dormitory)। আমরা ছেলেরা সাতজন। মহারাজের জন্য কোণায় সিঙ্গেল বেড ছাড়া হলো। পিযুষবাবু একা একটা খাট নিলেন। পায়ের গণ্ডগোল আছে,খাটটা নিজের সুবিধা মতো ব্যবহার করতে পারবে। রানিং খাটে আমার কোথাও অসুবিধা নেই। তবে মাস্টারদার কাছাকাছি থাকলে স্বস্তিবোধ করি। ডাক্তারবাবুর দেয়ালের ধারে সবাই উপযুক্ত মনে করলাম। মানুষটা নার্সিংহোম ছেড়ে এসেছেন। মুহূর্তে মুহূর্তে ফোন। কয়েকটা ফোন এবং ল্যাপটপ রয়েছে। ফোনের মধ্যে প্রায় সময় মুখ গুঁজে রয়েছে মনে হলো। জানতে পারলাম না উত্তরাখণ্ডে এসে কী কী দর্শন করলেন। তবে পা ছাড়িয়ে গেলেন নিশ্চিত। অর্ডার দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে হবে, পিযুষবাবু সবাইকে তেমন জানিয়ে দিয়েছে।

[লাভ-ভিউ থেকে নয়নালেকের সৌন্দর্য]

ট্রেনে দু’রাত, হোষ্টেল একরাত কাটালাম। উনিশে মে দু’হাজার-তেইশের সকাল। চা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়া হবে নয়না লেক সহ দর্শনীয় স্থানসমূহ দেখতে। সময় বেঁধে দেওয়া। তাতে কি? গাড়ির কাছে সবাই এলে তো যাত্রা শুরু হবে। এদিকে আমি, বুটু, কৌশানী পথে পায়ে উঁচু নিচু পথে সাপলুডো খেলতে খেলতে সর্বোচ্চ কোর এরিয়ায় পৌঁছে গেছি। আমার মনে হলো ওইতো পাহাড়ের শিখর দেখা যাচ্ছে ওর গোড়ায় যেতে আর কতটুকু সময় নেবে।

বিশাল বিশাল পাইন গাছের ফাঁক দিয়ে যে উচ্চতায় চুড়ো দেখছি। তলদেশ তো ফাঁকা দেখছি না, আবাসনে ভরে আছে। সেইসব ঘরবাড়ির মধ্যবর্তী অলিগলি পথে কৌতূহলী চোখে এগিয়ে চলেছি তো চলেছি। পাহাড়ের গোড়া আর ছুঁতে পারছি না। এমন সময় ফোন বেজে উঠলো। ফিরে যাওয়ার নির্দেশ। ডাক্তারবাবু আমাদের খুঁজে এগিয়ে আসছে। পথের এতটাই ঢাল, ওপর থেকে দেখছি ডাক্তারবাবু যেন তেনজিং নোরগে। পর্বতশিখর জয় করতে উঠছেন। পেছনে সর্বক্ষণের ল্যাপটপের ব্যাগ। সামনে ঝুঁকে লড়াই করে উঠে আসছে। আমরা একই পথে এসেছি তখন বুঝতে পারিনি।

ডাক্তার দীপাঞ্জনের থেকে মেয়েকে কাঁধে নিয়ে আগে আগে চললেন। নামার সময় তুলনামূলক ভাবে কষ্ট কম। এবার আমরা দু’জন পাশাপাশি এগিয়ে চলেছি। আমি রাস্তার বাঁদিক চেপে। বিভিন্ন পাহাড়ি ফুলের গাছ দুদিকে ভরে আছে। আমি গল্প করতে করতে দরদি হাতে ছুঁয়ে চলেছি ফুল গাছের পাতা। হঠাৎ হাত চিড়বিড়িয়ে উঠল। হাত ঝাড়তে লাগলাম। তাতে কী সুরাহা হলো বুঝতে পারলাম না। গাছটাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম।

আরে এতো সেই দোকানের ঝাঁটিগাছ। সম্ভবত বিচুটি, তবে পাতা বেশ চওড়া চকচকে। আমি চিড়বিড়ুনির জ্বালায় দু’কথা শুনিয়ে দিতে ছাড়িনি। আমরা সুন্দরবনের নিচু জলাভূমিতে পাতালে বাস করি। আর তুমি পাহাড়ের শীর্ষদেশে স্বর্গে বসবাস করছ তাতে কি? বনবিলাল হলে কি হবে স্বভাব বদলায় না। তুমি পাহাড়ের গায়ে থাকো আর আমাদের বাঁশবাগানে থাকো, স্বভাব তো বদলালো না। আচ্ছা করে শুনিয়ে, আর পেছনে তাকালাম না।

হোষ্টেলের কাছাকাছি এসে উপরে দিকে তাকালাম। গতকাল সন্ধ্যায় অতটা নজর করিনি। আমরা যে বাংলো টাইপের আবাসনে আছি। তার পাশে ঘন গাছের বন ভেবেছিলাম। সেটাই একটা পাহাড়। পাহাড়ের তলদেশ কেটে সমতলে পরিণত করে এই বাংলো। আমরা লক্ষ্য করলাম পাহাড়ের অনেক উঁচুতে গাড়ি চলছে। নিশ্চিত পথ আছে ওখানে।

পরে জানলাম আমাদের ওই পথে নয়না লেকে যাবো। চা টিফিন খেয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলাম। আমাদের দুটো গাড়ি নির্দিষ্ট গতিতে এগিয়ে চলল। নয়না লেকের বরাবর রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি।প্রথমে ‘লাভভিউ’ দেখার জন্য। খাড়াই পাহাড়ের পাশে অপ্রশস্ত পথ। পথের গা ঘেঁষে নেমে গেছে গভীর মরণ খাদ। খাদের ধারে সুসজ্জিত ফ্রেমের মধ্যে ভালোবাসার প্রতীক। ওই ফাঁকা জায়গায় মুখায়ব অক্ষয় করে রাখতে চায়। বলতে গেলে খাদের ধারে যেভাবে একটু ছোঁয়া পেতে প্রেমিক-প্রেমিকা চঞ্চল হয়ে ওঠে। অসতর্ক মুহূর্তে জীবন্ত প্রেমের সমাধি না ঘটুক চাইব।

আমরা লাভভিউ-তে চা বিস্কুট খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। পথে বেশকিছু দর্শনীয় জায়গায় ঘুরে নিলাম। নয়না লেকের পেছনের দিকে নেমে পড়লাম। গাড়ি নির্দিষ্ট সময়ে সামনের দিকে থাকার কথা বলে অন্যত্রে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য বেরিয়ে গেল। লেকের কাছাকাছি গাড়ি রাখলে খরচ অনেক বেশি। আমরা মূল রাস্তা ছেড়ে, লেকের ভিতরের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মন্দিরের দিকে চলে গেলাম। জুতো বাইরে রেখে নয়নাদেবীর মন্দির দেখলাম। দেবীকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। যেখানে ভোগ বিতরণ হচ্ছে শালপাতার খুপিতে সংগ্রহ করলাম। মহারাজের উত্তরাখণ্ডে আসার মূল কারণ, এখনকার দেব-দেবী, প্রাচীন মন্দিরগুলো দেখার জন্য আসা। নিজের মতো করে, একা একাই ঘুরে বেড়িয়ে সময় কাটালেন।

একটা সময় সবাই নয়না লেকের বোটিং এর ঘাটে উপস্থিত হলাম। পিড়াপিড়িতে মহারাজ বোটিং বিহার করলেন। আমি না না করে দিদির কথায় বোটিং-এ যেতে রাজি হলাম। পিযুষবাবু ও দিদি, সামনে বসলো। আমি মাঝে। পেছনে ডাঁড়ি দু’হাতে ডাঁড় টেনে মাঝখান দিয়ে এগিয়ে চলেছে। আমি ছবি তুলছি। চারিদিকে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছি। গতকালের সন্ধ্যায় ওপর থেকে সারা নয়না লেকটা মনে হয়েছিল অসংখ্য জোনাকির আলোয় ভরে আছে। এখন লেকের জলের ওপর থেকে মনে হচ্ছে তিন দিকের ঢাল যেল রঙিন টালি দিয়ে বাঁধানো। একদিকের পাহাড়ের ঢালে গাছে ভরে আছে। বোটিং দু’দিক থেকে চলছে, মাঝ বরাবর সীমানা। লম্বায় মেপে দেখিনি যতদূর দেখা যায় ততটা, প্রত্যেকের দেখার চোখের ওপর নির্ভর করছে।

মাঝখানে কল্পিত রেখা ছোঁয়ার আগে, সবকিছু উপভোগ করার আনন্দ উবে গেল। বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি শুরু। কার কী হয়েছিল ওই সময়ে বলতে পারবনা। ঠিক নয়নালেকের মাঝখানে যেখানে জল বুদবুদ করে উঠছিল। জল স্বচ্ছ কিন্তু যেদিকে আবাসিক নেই। পাহাড়ের গায় গজিয়ে ওঠা বৃক্ষরাজি। গাছগাছালি বৈকালিক ছায়া জলে পড়েছে। জল বেশ কালো দেখাচ্ছে আর ওই বুদবুদ।যেকেউ ভাবতেই পারে, তিনি মাছের মতো দৈত্যাকার কোনো জলদৈত্য যদি জলের ওপর মাথা তোলে।

মোচার খোলের মতো ছোট্ট বোটের কী অবস্থা হবে কল্পনা করুন। একসময় বোটটি আপাতত নিরাপদ মনে হলো। চালকের কাছে জানতে চাইলাম, ‘বুদবুদ কিসকা হ্যায়’? যা বলল এইরূপ। উঁচু পাহাড়ের ঝর্ণা বাহিত জল। এক পাহাড় থেকে আর এক নিচু পাহাড়ে বয়ে চলে। তেমন একটা ধারার জল পাইপের মাধ্যমে লেকের মাঝখানে ঢুকছে। বাড়তি জল, নয়না লেক থেকে নিচের পাহাড়ে ঝর্না হয়ে কোথাও ঝরে পড়ছে। লেকের জল বরাবরই এক থাকছে। ফলে নয়নালেকের জল দুষিত হচ্ছে না। এভাবে নতুন অনুভূতি বোটিং-এর মজা উপভোগ করলাম।

এবার হোটেলে খেয়ে দুই চালকের কথা মতো বড়ো রাস্তার মোড়ে রেলিং-এর ধারে সবাই গাড়ির অপেক্ষায় আছি। গুঞ্জন শুনে কাছে এসে দেখলাম। বুটুর দিদিমা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে বাচ্চা মেয়ের মতো। যেমন তেমন হোক এক্স শিক্ষিকা। কান্নার হেতু কি জানতে পারলাম। গাড়িতে যে ব্যাগটি ভুলে ফেলে গেছে, তাতেই তো সব টাকাপয়সা। গাড়িতে নামার পরে মনে পড়ে। ততক্ষণে গাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। অন্য কোথাও গ্যারেজ করার জন্য। পিযুষবাবুর আশ্বাসবাণীতে ছিল ব্যাগ কিছুই হবেনা। দীর্ঘক্ষণ হয়ে গেল গাড়ির দেখা নাই রে। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।, ডাক্তারবাবুর গাড়ি এসেছে। আমাদের গাড়ি আসেনি। যে গাড়িতে বুটুর দিদিমা উঠবে।

তেমাথার চলতি পথে গাড়ি দাঁড়াতে, ট্রাফিক পুলিশ তাড়া দিচ্ছে। ডাক্তারবাবু বড়মেয়ের জন্য কী কিনতে গেছে এখনো ফেরেনি। ঈশানী যদিও এলো তো ওর বাবাকে দেখতে পাচ্ছি না। আবার কিছুইতে ফোন ধরছে না। ওই এক আপনার ভালো মানুষ। বুটুর দাদাইকে ওই গাড়িতে একরকম জোর করে তুলে দেওয়া হলো। আমি অন্য গাড়িতে উঠতে রাজি হইনি। প্রথম গাড়ি ছেড়ে চলে গেল। বুটুর দিদিমার একান্ত কাছের মানুষ, ঘোর বিপদের সময় তাকে ছেড়ে অন্য গাড়িতে চলে গেল। এদিকে সেই অভিশপ্ত গাড়িটি এখনো টিকিটিও দেখা মিলছে না। মেজবাবু অর্থাৎ পিযুষবাবু সরল মনে জানিয়ে দিয়েছে। আমাদের কদিনের জন্য বুকিং করা গাড়ি। ও অন্য কোথায়ও বাইরে ভাড়া খাটতে পারবে না। আমাদের যা লাগেজ ওর মধ্যে আছে নিরাপদে থাকবে।

কথায় বলে ‘ঘর শত্রু বিভীষণ’। বুটু দিদিমার সঙ্গে রসিকতা করতে ছাড়ল না। ‘মেজজেঠু, এই দীর্ঘসময়ে বাইরে ভাড়া খাটে তো পার? আমরা তো আর দেখতে পাচ্ছি না। জেঠু ভাইপোর দুষ্টুমি বুঝে তৎক্ষণাৎ বলল, ‘তা পারে, ব্যাগ যখন ড্রাইভারের জিম্মায় রেখে আসেনি। প্যাসেঞ্জার নামিয়ে নিলে, ভাববে ওদের। এই কথা শোনা মাত্র বীভৎসভাবে দুই চোখের জল বাঁধ ভাঙা অবস্থায় বইতে লাগল।

এমন সময় ভিড় ঠেলে গাড়ি চলে এসেছে। ড্রাইভার পাল্লা খুলেতেই যেন রিং-এর মধ্যে গলে ভেতরে পড়লেন। প্রথমে ব্যাগ দু’হাতে থাবা মেরে তুলে নিলেন। পরে ভেতরে হাতড়িয়ে নিশ্চিত হলেন তাঁর সম্পদ সুরক্ষিত আছে। মুখে হাসির রেখা মেঘের আড়ালে স্পষ্ট উজ্জ্বল। ইতিমধ্যে ডাক্তারবাবু পৌঁছে গেছে। ফোন-পে মেরেছে। নেটের বিড়ম্বনায় ক্লিয়ার না হলে আসতে পারছিল না। আর কালবিলম্ব না করে গাড়িতে উঠে পড়লাম। পাহাড়ি পথ ঘুরে বাসায় ফিরলাম। উইথ হোষ্টেলে সেই রাত্রি বেশ মজা হলো। এখানে দু’রাত কাটালাম।

[জিমকরবেট জঙ্গল ও আলমোড়া]

সকালে চা টিফিন খেয়ে গাড়ি চড়লাম। বেশ অনেকটা পথ যাওয়ার পরে ‘হনুমান মন্দির’ চোখে পড়ল। তখনও সম্পূর্ণ হয়নি। যা কারুকার্য দেখলাম দুচোখ ভরে গেল। গর্ভগৃহের ওপর মন্দির। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে ভিতর বাহির ঘুরে ফিরে দেখলাম সবাই। আমরা আবার চলতে শুরু করলাম। এখন পাহাড়ি পথ থেকে সমতলে নেমে এসেছি। গ্রামের মধ্য দিয়ে, ঘন গাছপালা পেরিয়ে চলেছি।

এখন খাঁ খাঁ দুপুর, রমনগরের পথে। উদ্দেশ্য ‘রুদ্রাক্ষ হোটেলে আজ রাত্রিবাস করতে চাই। এখানে চারখানা ঘর ভাড়া করা ছিলো। ঘরগুলিতে আধুনিক চিন্তাভাবনার ছাপ লক্ষণীয়। একটি ঘরে আমি ছাড়া আরো দুজন পিযুষবাবু ও মহারাজ। হোটেল বয়কে দিয়ে ডিম ভাতের ব্যবস্থা করা হলো। ফ্রেস হয়ে নিলো সবাই। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকু নেই। ‘জিমকরবেট জঙ্গল সাফারি’তে বেরিয়ে পড়তে হবে। অললাইনে বুক করতে বলা হয়েছিল হোটেল কর্তৃপক্ষকে। তাঁরা সে দায়িত্ব পালন করেছেন।

হুটখোলা জিপগাড়ি তারাও হর্ন বাজিয়ে তাড়া দিচ্ছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না গেলে, আজকের মতো সাফারি বন্ধ হয়ে যাবে। আবার আজের না দেখলে, আগামীকাল এখানে থাকছি না। সেইভাবে দর্শনীয় সময়সূচি ঠিক করা। দুটো গাড়িতে ভাগ হয়ে উঠে পড়লাম। অলিগলি বেড় দিয়ে প্রধান সড়কে উঠল গাড়ি। গাড়ি তীর বেগে ছুটতে লাগল। সোজা গেট পেরিয়ে অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।

কাগজপত্র চেকিং-এর ব্যাপার। আমি পিনাকী নামে ছিলাম। নতুন করে পাঁচশ টাকায় আমার নামে অনুমতি পত্র সংগ্রহ করতে হলো। মূলকথা চেকিং-এর নামে বাঁহাতি টাকার লুট চলছে, নতুন করে বলার নেই। আমাদের একটি গাড়ি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে,বাঁদিকে তাকিয়ে দেখি, প্রকাণ্ড এক হস্তী দাঁড়িয়ে আছে। যেন হাতি অপেক্ষায় আছে, কখন ওর সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি পেরিয়ে যেতে চাইবে। অমনি ও ঠেলা মেরে উলটিয়ে দেবে।

খণ্ড ২

ড্রাইভারেরা বন্য জীবজন্তুর চলাফেরা তার মতিগতি ভালো ভাবে বোঝে। আমরা টু শব্দটি করছি না নিষেধ ছিলো। হাতির পথ পেরিয়ে যাওয়া,ওর মর্জির ওপর নির্ভর করছে। আমাদের ধৈর্য বিষিয়ে দিয়ে গজেন্দ্রগমনে পথ পেরিয়ে গেল। পথের ওপরে কলা গাছের মতো গাছ শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে মাথা ভেঙে আয়েশ করে খেতে লাগল। এমন প্রচলিত ধারণা ‘ভূত ছেড়ে গেলে চিহ্ন সরূপ গাছের ডাল ভেঙে দিয়ে যায়। এখন হাতির থেকে যে নিরাপদ ভাবতে পারি। যাক আপাতত বিড়ম্বনা মিটল। গাড়ি চলতে শুরু করল। কিছুটা গিয়ে ক্রমশ নিচের দিকে নামতে লাগল। যে পাহাড়ি প্রশস্ত খাদ দিয়ে বর্ষায় পাহাড় বাহিত ঝর্ণার জল দুই কূল ছুঁয়ে প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়। এখন ক্ষীণ জলধারা তলা দিয়ে বইছে। সেই জলের টান নেহাত কম নয়। আমাদের গাড়ি হাঁটু জলে হুড়মুড়িয়ে পেরিয়ে গেল। আবার খাড়াই পথে উপরে উঠে এলো। তখন নজর পড়ল দূরে অনেক হরিণ চরছে। দেখতে দেখতে বনের পথে গিয়ে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ালো। যেখানে আমাদের মতো অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এখানে গভীর জঙ্গলে ঢোকার সময় ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় দু’বার যোগাযোগ করতে হয়। আমাদের গাড়ির কাগজ দেখিয়ে গভীর জঙ্গলের পথে ঢুকতে চলেছি। গা ছমছমে পরিবেশ। কোথায় কী ঘাড়ের ওপর এসে লাফিয়ে পড়ে কে বলতে পারে। গভীর জঙ্গল পেরিয়ে আরও এক অফিসে পৌঁছলাম। সেখানে ওয়াচ টাওয়ার আছে। তবে সাধারণের জন্য নয়। গাড়ি থেকে নামার অনুমতি নেই। অদূরে হরিণেরা জল খাচ্ছে দেখতে পাচ্ছি। আমাদের শেষ গাড়ি। চারটের আগে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। গাড়ি ছেড়ে দিল। হরিণ, বুনোহাতি, কিছু পাখি ছাড়া তেমন কিছু চোখে পড়েনি। বনদপ্তরের সমস্তটাই আঁটোসাঁটো আয়োজন। তবে জব্বর আঁটুনি,ফোসকা গেরো মনে হয়েছে। ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে একমুখ ধুলো মেখে সন্ধ্যার দিকে রুদ্রাক্ষ আবাসিক হোটেলে ফিরলাম।

মোড়ের ওপর দোকান থেকে যে যা খাবে, যেমন পরিমাণে সেইভাবে রাতের খাবার এসেছিল। আরও তিনটি ঘরে খাবার দেওয়া হয়ে গেছে। আমাদের সুসজ্জিত ঘরে আমি, পিযুষবাবু, মহারাজ। রুটি টাইপের খাবার ভাগ করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়লেন। আমার দুটো দিলে, পিযুষদার একটা থাকে। আবার একটায় ওনার হবেনা এটাই স্বাভাবিক আমার চিন্তায়। এখন কী করবেন। আনতে যাওয়া তো এ মুল্লুকে নয়। তৎক্ষণাৎ বললাম, আমার একটা দিলেই হবে। একসঙ্গে বেড়াতে গেলে অনেককিছু মানিয়ে নিতে হয়। সামান্যতম উষ্মা প্রকাশ করে ভ্রমণের পুরো আনন্দটাই মাঠে মারা যেতে পারে। হিসাবে ছিলো কেউ একটা বেশি নিয়ে, একপিস কমে গেছে। হাসিমুখে নীরব থাকাটাই বুদ্ধিমানের পরিচয়। তুচ্ছ বিষয় মানিয়ে নেওয়াটাই আনন্দে থাকার প্রাথমিক ব্যবহারিক ধর্ম মনে করি।

এই প্রবাদটি বাউণ্ডুলের ক্ষেত্র খাটে ‘ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে’। যে পারিবারিক ভ্রমণার্থীদের সঙ্গী হয়ে এসেছি, তাদের ক্ষেত্রে ওই শ্লোক অচল। আমার ক্ষেত্রে হুবহু না হলেও কিঞ্চিৎ খাটে। এমন রাজকীয় আবাসিকে আছি তা কি হট্টমন্দির। খোলা বাজার আদৌ নয়। যাইহোক পাঠকের গ্রুপটির সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়ে রাখলাম। এখন ওইসব কথা থাক। আবার সকালে উঠতে হবে শুয়ে পড়লাম। এসি চলছে আমার ঠাণ্ডা লাগছে। হালকা চাদর গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি। একসময় ঘুমের মধ্যে মনে হলো গরম লাগছে। পিযুষবাবু উসপাশ করছে। মহারাজ চিন্তায় আছেন বুঝতে পারছি। হালকা আলোয় তাঁর মুখ দেখতে পাচ্ছি। দেখলাম গেরুরা কাপড় কোমরে আঁটোসাটৌ করে জড়িয়ে নিলেন। আড় চোখে দেখলাম,বেশ লম্বা দেখাচ্ছিল। সোজা দরজা খুলে বেরিয়ে গেলেন। আবার এসে শুয়ে পড়লেন। ইতিমধ্যে এসি চলতে শুরু করেছে। ভাবলাম কী অলৌকিক শক্তি রে বাবা। তবে সারা জীবনে এতো সাধনভজন সে কি বন্ধ এসি চালু করার জন্য। নিশ্চিত সে জন্য নয়।মহারাজ বললেন, এসি’র কন্টোলরুম জানা ছিলো। সবগুলো এসি চালিয়েছি। ভাড়া সেই ভাবে নিয়েছে এসি চালাবে না মানে।

রাতে ভালো ঘুম হলো। সকালে সবাই হাত মুখ ধুয়ে, পোষাক পরে প্রস্তুত। আমি এবং মাষ্টারদা স্থানীয় দোকান থেকে চা কিনে আনলাম। দুটো গাড়ি আমাদের সঙ্গেই ছিলো। সবাই গাড়িতে উঠতে ছেড়ে দিল। ক্রমশ সমতল ছেড়ে আবার উঁচুতে উঠতে শুরু করেছি। আবার ধীরে ধীরে ঠান্ডা অনুভব করছি। এখনো রামনগর ছাড়িয়ে যাইনি। আমরা এখন ‘গলুদেবে’র মন্দিরে। ব্রতীদের মনস্কামনা পূর্ণ হলে বিভিন্ন মাপের ঘণ্টা ঝুলিয়ে মানত চুকিয়ে যায়। এতটুকু জায়গা ফাঁকফোকর নেই যেখানে মাথা গলিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়ানো যায়। যে ঘন্টাগুলো এক-দু’মণ করে ওজন তলায় বসানো থাকে। আমার মনে হয়েছিল গুলদেব না হয়ে যদি “ঘণ্টাদেব” হতো মন্দ হতো না। মানুষের বিশ্বাসের কাছে কোনো যুক্তি খাটে না। যাইহোক আমাদের মানা না মানায় কিছু ওখানকার মানুষজনের কোনো যায় আসে না। প্রণাম করে এখন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। যাওয়ার পথে ‘বিবেকানন্দ ধ্যানাশ্রম’ সুন্দর জায়গাটি দেখে নিলাম।

এখন পথের এক হোটেলে খাওয়ার জন্য গাড়ি থেকে নেমেছি। প্রতিবারে যেমন হয় খাবার মেনু নিয়ে তুমুল গবেষণা চলে।পুরোটা জুড়ে থাকে মাংস নিয়ে। তা চলতে থাকে পিযুষবাবু ও ঈশানীর মধ্যে। মামা ভাগ্নির ব্যাপার। যাইহোক তারা কী মেনুতে ভোজন সেরেছে উৎসাহ বোধ করিনি। আমার মুখে লাগার মত হলেই হলো। আমি ঠান্ডা স্প্রাইট নিয়ে গাড়িতে বসলাম। বুটুর দিদিমাও খেয়েদেয়ে গাড়িতে বসেছে। কাচের ভেতর থেকে ছেখছে কৌশানী ও বুটু দু’জনার হাতে দুটো স্প্রাইটের বোতল। পাশে রেলিং-এর ধারে দাঁড়িয়ে হাত পা নেড়ে কীসব আলোচনা করছে ভাই বোনে।কৌশানীর চলনে বলনে হাবভাবে দেখে গা যেন জ্বলে যাচ্ছে বটুর দিদিমার। কেন হচ্ছে সত্যি বলছি আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার তো ভালোই লাগছে। ওই বয়সের সঙ্গে আর্থিক সচ্ছলতা থাকলে বরং একধাপ এগিয়ে থাকতাম। বুটুর দিদিমা ভাবলেন ও মেয়ে গোল্লায় যাক, আমার নাতির মতো ছেলে হয় না। ওই মেয়েটার কাছে কুটিটিও চাইলে পাওয়া যাবেনা। যদিও বাস্তবে তেমনটি নয়। কথায় বলে না ‘যার দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা’। ভাত খেয়েছে হজমের জন্য ঠান্ডা পানীয় চেয়ে খেতেই পারে। আবার পয়সা খরচের কি আছে। নাতির থেকে একঢোক খেলেই হলো। গাড়ির ভেতর থেকে আকারে মনের ইচ্ছা জানালো। নাতি ভাষা বুঝতে পারেনি। ইঙ্গিতের উত্তর, ইঙ্গিতে দিলেন নাত নেড়ে। যার অর্থ কী জানি না। রাগে গরগর করতে থাকে দিদিমা। অদূরে নিজের মানুষটি দাঁড়িয়ে ছিলো হাত দিয়ে ডাকলেন। একবোতল স্প্রাইট ভাগাভাগি করে খেয়ে, নতির ওপর রাগ তখনকার মতো কমলো

(রাতের আলমোড়া এবং নৈসর্গিক কৌশানী)

এখন রাতের আশ্রয়ে গাড়ি ছুটে চলেছে। গাড়ি চলেছেই তো চলেছে। কতটা উঁচুতে আমাদের গাড়ি কিছুই বুঝতে পারছি না। অনুমান কানে আসছে না তা নয়। দুইদিকে ফুলে ভরে থাকা বড়ো ছোট গাছ। মুহূর্তে মুহূর্তে বিপদজনক বাঁক কাটিয়ে চলতে হচ্ছে। তবে ড্রাইভার এসবের ভ্রুক্ষেপ করেনা। আমি কৌতূহলী চোখে দেখছি আর ভাবছি ‘আলমোড়া’ শব্দগত অর্থ কী হতে পারে। প্রাকৃতিক পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে আমার মনে এইরকম একটা অর্থ খাড়া হয়েছে। নিজের মতো করে বুঝেছি। “আল” অর্থে ভেড়ি। চাষাবাদের জমিতে জল ধরে রাখার মতো অনুচ্চ ভেড়ি। “মোড়া” কথাটার আমি যে অর্থে এখানে বোঝাতে চাইছি, তা হোলো আবৃত করে রাখা বা মুড়ে রাখা। আল কী দিয়ে মুড়ে রাখা আছে সমগ্র পাহাড়ি অঞ্চলকে সেটাই জ্ঞাতব্য বিষয়। চলন্ত গাড়ি থেকে আমরা দেখছি দুইদিক থেকে যে পাড়ের ঢাল নিচের দিকে নেমে গেছে। তার গায়ে বাড়িঘর যেন গিজগিজ করছে। অসংখ্য আবাসিক দিয়ে মুড়ে রাখা বলেই জায়গার নাম কি রাখা হয়েছে “আলমোড়া’। নামকরণের অন্য তথ্য থাকলে পাঠকের থেকে জানার অপেক্ষায় রইলাম।

পাহাড়ের গা বেয়ে চলার পথে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। ওপারে ঘরগুলোতে কাচের পাল্লা থেকে অসংখ্য আলো ক্রমশ স্পষ্ট হতে শুরু করেছ। পিযুষবাবুর কথায় বুঝলাম, আমরা ওপারের কোনো এক হোটেলে আজকের রাতটা কাটাবো। আমরা যে পাহাড়ি পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, সে পথ আরো কতো দূরে গেছে জানিনা। মাঝে খাদ। তলা দিয়ে জল প্রবাহিত হচ্ছে। বিপরীত দিকের পথ ক্রমশ গা ঘেঁষছে। একটা সময় ছোট একটা ব্রিজ দিয়ে পেরিয়ে গেলাম। বেশ কিছুটা ঘুরপথে এসে দাঁড়ালাম ‘রুদ্রনাথ’ অফিসের সামনে। লাগেজ নিয়ে অফিসে মধ্যে গিয়ে সবাই বসলাম। যখন শুনলাম এটাই নাকি আবাসিক হোটেল। অবাক না হয়ে পারলাম না। ঢালা জায়গায় শুয়ে বসে রাত কাটাতে হবে নাকি। আমি একা আছি আমার অসুবিধা কীসের। অপেক্ষা করছি। কী হয় দেখি।

পিযুষবাবু কাগজপত্র ঠিক করে এসে বলল, আমাদের আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেতে হবে। আমার বুঝতে বিলম্ব হয়নি, অন্ধকার পুঁতিগন্ধময় কোনো গোডাউনে রাত কাটাতে হবে। নতুন করে ব্যাখ্যার কী বা আছে। পরমান্ন মানে আমার মায়ের হাতের খুঁদের জাউ। মনে পড়ে সারা দেশ জুড়ে ঘাসের দানা, খুঁদের জাউ প্রায় বাড়িতে হতো। আমার অভ্যাস আছে ঠিক মানিয়ে নেবো। সবাই কী করবে জানিনা, বড়োমেয়ে ওইতো একাই যুদ্ধ বাধিয়ে দেবে। যা রুচিশীল মেয়ে। দুইবোনকে আমি মেয়ে বলি। ওদের মা তো সেই ছোট থেকে আমাকে শিবেনদা বলে আগেই বলেছি। পরিচয় পর্ব চুলোয় যাক, শেষমেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় দেখি। আমাদের মালপত্রে হাত দিতে হলো না। হোটেল বয়েরা নিয়েই যাবে। আমরা একটা ছোট ঘরে ঢুকলাম,লিফট জানাই ছিলো। যখন সুইচ টিপে দিল, নিচে নামতে শুরু করেছে। সেটাই কপালে লেখা ছিলো। শেষে গিয়ে লিফট থেমে গেল। আর ভাবছি না যেখানে বলবে ঢুকে যাবো। লম্বা দাবায় হেঁটে চলেছি। আমাদের সঙ্গীসাথীরা চাবির নম্বর অনুযায়ী রুমে ঢুকে গেল একে একে। এখানে আমার সঙ্গী দীপাঞ্জন যাকে সবাই বুটু বলে চেনে। আমরা দাবার শেষপ্রান্তে গিয়ে ডানদিকে বেঁকে শেষের আগেরটিতে ঢুকে গেলাম চাবি মিলিয়ে। ঘরের মধ্যে ঢুকে অবাক। সাজানো গোছানো আসবাবপত্র। ঘর যেমন লম্বা, তেমন চওড়া। উচ্চতা অবশ্যই দশ ফুট। জোড়া বিছানা। মাথার দিকে কাচসেটিং করা এ্যালুমিনিয়ামের পার্টিশান। একদিকে কাচের পাল্লা। ভারী পর্দা সরিয়ে দেখলাম ঝুল বারান্দা। ইতিমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। এখন সন্ধ্যা সাতটার মতো বাজে। সামনে তাকিয়ে কী দেখছি সেটাই বুঝতে পারছি না। ভাষায় কী প্রকাশ করব। গায়ে গায়ে গড়ে ওঠা আবাসিক থেকে অসংখ্য জোনাকির মতো আলো ঠান্ডা বাতাসে খুশিতে দোলা খাচ্ছে। নৈসর্গিক পরিবেশ ভীষণ ভাবে উপভোগ করছি। শুধু আমরাই না বহুতল আবাসিকের প্রতিটি ব্যক্তি একই ভাবে দেখতে পাচ্ছে। আলমোড়া’য় এমন আবাসিক হাতে গোনা। আমরা প্রথম যেখানে এসে দাঁড়িয়ে ছিলাম হোটেলের ছাদে। সহজে কাউকে এপ্রিলফুল না করা গেলেও,আমি হয়েছিলাম। সেটাই আমার জীবনে চরমপ্রাপ্তি।

ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমাদের এক সারিতে থাকা প্রতিটি সদস্য-সদস্যাদের দেখতে পাচ্ছিলাম। ঠান্ডায় বাইরে না দাঁড়িয়ে ভেতরে এলাম। সামনের পর্দা আপাতত সরিয়ে দিলে বাইরের সৌন্দর্য দেখতে কোনো বাধা থাকছে না। সোফায় বসে সারাদিনের প্রয়োজনীয় কিছু লিখে রাখছিলাম। এমন সময় কপাটে নক করল কেউ। খুলে দেখি আমার একজন বয় রাতের খাবার দিয়ে গেল। দীপাঞ্জন দিদা-দাদুর কাছে পাশের ঘরে গিয়েছে। নিশ্চিত ওঁদের সাথে খেয়ে আসবে। দেখলাম না ওর খাবার এই ঘরে নিয়ে এসেছে। ভালোই হলো একসাথে খাওয়ার আনন্দ আছে। আমি খাতাপত্র গুছিয়ে রাখছি। দিপাঞ্জন খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। লক্ষ্য করলাম ভাতের সঙ্গে আলুটাইপের কিছু একটা ঘাঁট। আমার কী আছে আগে দেখে নিয়েছি। আমি জানতে চাইলাম, তুমি মাংস খাও না?
— হ্যাঁ।
— কিছু না মনে করলে বলি। আমার দুটো মাংসের পিস আছে। সত্যি বলছি আমি খেতে পারব না। তোমার একপিস দেবো? যদি বলো তাহলে দি। লেগ পিসের সঙ্গে কারি অনেকটা নিয়ে নিতে বললাম। আমি তখনও খেতে বসিনি। কপাটে কেউ নক করল। খুলে দেখি দিদি। ভাইপোর জন্য একপিস মাংস এনেছে। নিজের শরীর ভালো নয় দুটো খাবে না।

বুটুর অবস্থা দেখে,মহাভারতের পৌরাণিক চরিত্র যযাতি’র কথা মনে হলো। অভিশাপে জরাগ্রস্ত হয়ে যৌবন সুখ থেকে বঞ্চিত হয়।পুত্র নহুশ পিতার জরা নিজের শরীরে নিয়ে,পিতার যৌবন ভোগের সুযোগ করে দেয়। এখানে দিপাঞ্জন নহুশ হয়ে বেহুশ হয়ে পড়েছে। দাদু-দিদিমা’রা শারীরিক অসুস্থতার কারণে খাওয়ার ব্যপারে ভীষণ হিসেবি। নিজেরা যা খেতে পারবেনা মেয়ের নাতিকে খাইয়ে নিজেরা কষ্ট পেতে চান না। শরীর মন চাঙ্গা রাখার বিকল্প পথ আর নেই। আর গভীরে যাওয়ার কী দরকার আছে থাক। রাতের ঘুম ভালো হলো। সকালে ওখানকার বাজার ঘুরে দেখলাম। বিলিতি কুকুর আমরা বাড়িতে পুষি। ওখানে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখানকার কুকুরেরা ঝগড়ুটে মনে হলো না। তবে ক্ষণেকের দেখা বলে এমন ধারণা হতে পারে। তবে পাশে অন্য কুকুর ছিলনা। গাড়ি ছাড়বে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম।

আলমোড়া থেকে গাড়ি ছাড়লো। আমাদের শেষ আবাসিক গন্তব্য কৌশানী। মাঝপথে পথের পাশে হোটেলে খেয়ে নিলাম। ড্রাইভার সমেত পনের জন। আমাদের সঙ্গে চালক খাবে সেইভাবে কথা ছিলো। দীর্ঘ পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে বৈকালে কৌশানীতে পৌঁছলাম। এক বিধবা মহিলার বাড়িতে উঠলাম। ঘরোয়া ভাবে থাকা ও খাওয়ার বন্দোবস্ত। অললাইনে ঠিক করা ছিলো। গ্রাম্য পরিবেশে নির্জন পাহাড়ের ঢালে পুরোনো আমলের ছাদফেলা দোতলা বাড়ি। রাস্তার লাগোয়া ঢালাই সিঁড়ি সরাসরি দোতলায় আসা যায়। মালকিনের বাড়ির বারান্দা দিয়ে। ওই সিঁড়ির নিচে দিয়ে পাথর কাটা পথে নিচের ঘরে প্রথমে আমরা এসেছি। ওখানের ঢালাই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠা যায়। সরু পথে সাবধানে ওঠা নামা করতে হয়। এমনিতে পাহাড়ি অঞ্চলে সাপ লুডোর বোর্ড পাতা যেন। সাপের মুখে পড়লেই একেবারে খাদে পৌঁছে যাবে। বেড়াতে এসে স্থান কাল পাত্র বিবেচনায় চললে বিপদের ঝুঁকি কম থাকে। ধীরে সুস্থে সবাই এক জায়গায় জড়ো হলাম। যাদের শারীরিক অসুবিধা নিচের ঘরে থেকে গেল। ওপরের তিনটে ঘরের শেষ ঘরে গিয়ে উঠলাম আমি ও দিপাঞ্জন। ওই আমাদের কাছে গাইড। আমি অনেক কিছু ইচ্ছে করে ওর ওপর নির্ভর করে ভালোই আছি। যে যার ঘরে ঢুকে পড়লাম। গরম গরম চা বিস্কুট অল্প সময়ের মধ্যে হাতে পেলাম। বড়ো বড়ো গাছের ঘন বলয়ের মধ্যে থাকলেও বুঝতে পারছি সূর্য এখনো ডোবেনি। বারান্দায় বসে দেখতে পাচ্ছি সামনের বহু দূরে, অথচ মনে হচ্ছে ওইতো দেখা যাচ্ছে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। সোনালি আভায় ঝলমল করছে। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় মেঘেরা লুকোচুরি খেলছে। নজর ফেরাতে কেউ পারছি না। প্রতিটি জায়গা এতো সুন্দর ভাবে যে উপভোগ করছি পুরো কৃতিত্ব একটি মানুষের তিনি আর কেউ নয় পিযুষবাবু। কাজলদির মেজভাই। লোকেশান নিয়ে নেটে ভীষণ খেটেছে। সেই সুফল আমরা এখন ভোগ করছি।

আমরা চা খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম, ধাপে ধাপে সারিবদ্ধ ঘরগুলো ক্রমশ নিচের দিকে নেমে গেছে। সর্বত্রে পাহাড়কে কেন্দ্র করে লোকালয় গড়েছে। কোথাও ব্যতিক্রম নেই। অভিজ্ঞতায় ভৌগোলিক গঠনশৈলী জেনেও বারংবার ভুল একই বিষয়ে হবেই হবে। মনে হবে ওইতো পাহাড়ের চুড়ো। দু’পা গেলেই ওর পাদদেশে পৌঁছে যাবেন। কিছুটা সময় ধ্যানস্থ অবস্থায় কাটিয়ে ফিরবেন। যতই যাবেন কতো পাহাড়ের মাথা মুণ্ডু আপনার চোখের সামনে যেন গজিয়ে উঠবে। আপনার আকাঙ্ক্ষিত পাহাড় ছোঁয়া কয়েক ঘণ্টায় সম্ভব হবে না। নিচের দিকে নামার ক্ষেত্রে একই অবস্থার শিকার হবেন। একসময় উৎসাহ হারিয়ে ফেলবেন। আমাদের বেলায় সেটাই হলো। ওপর থেকে দেখলাম, কয়েকটা বাড়িতে পরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। নকল পাহাড় বেয়ে ওপরে ওঠা বা রোপওয়েতে সাইকেল রেসিং-এর মজা পাওয়া। ছোটদের বড়োদের সবার উপযোগী বিনোদনের ব্যবস্তা আছে। বড়ো মেয়ে জেদ ধরলো ওখানেই যাবে। ভাবলাম ঘুরে আসা যাক। স্থানীয় লোকজনের জীবন যাপনের কিছুটা আঁচ করা যাবে। বেরিয়ে পড়লাম। দুইমেয়ে, ডাক্তারবাবু, দিপাঞ্জন এবং আমি। যে পথ দিয়ে আমরা এদিকে এসেছি, ওই পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। পাশে তাকিয়ে দেখছি নামার পথ চোখে পড়ছে না। আরো কিছুটা গিয়ে বাঁহাতি ঢাল পথে ঘুরে গেলাম। সুরু পথে ঘিঞ্জি বাড়ি ঘরের ভিতর দিয়ে নেমে গেলাম। এখন চলেছি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের দিকে। পথের দু’দিকে পাহাড়ি ফুলে ভরে আছে। হালকা ঠান্ডা বইছে। কুয়াশার আস্তরণ চোখে পড়ার মতো। চারিদিকে ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের তুলনা নেই। প্রশিক্ষকদের সঙ্গে আলতো গোছের কিছু কথাবার্তা হলো। চারদিকটা ঘুরে বেড়িয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ওপর থেকে দেখতে পেলাম আমাদের রাত্রি যাপনের বাসা। আবার আমাদের মাড়িয়ে আসা পথ দিয়ে ওপরে উঠতে হবে। মনে পড়ল চিরুনি খুঁজে পাচ্ছি না। ব্যাগের মধ্যে আছে কি নেই বুঝতে পারছি না। একটা কিনে নিলে হয়। লক্ষ্য করে হাঁটছি তেমন দোকান চোখে পড়ে কি না দেখে। ঢাল বেয়ে উঠতে গিয়ে ষ্টেশনারি দোকান দেখতে পেলাম। ভাবলাম হয়তো বাংলা ভাষা বুঝবে না। সামান্য নিরুনি কিনতে গিয়ে মানইজ্জৎ খোয়াবো ভাষার কারণে। আমি ছাড়া, আমাদের গ্যাঙে রীতিমতো হিন্দি ভাষার প্রয়োগ নিয়ে পরস্পরের মধ্যে বলতে গেলে কার্গিল যুদ্ধ বাধিয়ে চলেছে। বড়ো মেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রী। যেখানে হিন্দি’র গুরুত্ব আছে বাংলার থেকে। আমি বললাম ‘হ্যাঁ রে মা, একটা চিরুনি কিনে এনে দাও তো’?

— তুমি কিনে নাও না।
দেখলাম মামাতো দাদার সঙ্গে মুচকি হাসছে। ডাক্তারবাবু হাসার অবস্থায় নেই। ছোট মেয়ে কৌশানীর কাঁধে নিয়ে। আমি সোজা দোকান গিয়ে বললাম- ‘বাল ছানলে কে লিয়ে কোম্ব হ্যায়?
দোকানী ‘বাল আর কোম্ব'(comb)দুটি শব্দের মধ্যে বিক্রয়ের বস্তুটি খুঁজে পেয়েছেন। ছানাছানি ক্রেতার ব্যাপার। বড়ো চিরুনি একটা আমার সামনে বাড়িয়ে দিলেন। দেখে বললাম, ছোটাবালা?
— নেহি।
— ঠিক হ্যায়, কেতনা রুপিয়া?
— বিশ।
আমি আর কথা না বলে কুড়ি টাকার নোট দিয়ে বেরিয়ে এলাম। এতো কম সময়ে চিরুনি খরিদ করে চলে এলাম ওদের খুশী হবার কথা নয়। কী বলে কিনলাম জানতে চায়। আমি বলতে চাইলাম না। পিড়াপিড়ি করত লাগল। শেষে থার্ডডিগ্রি সহ্য করতে না পেরে বলে দিলাম। ওরা একটা বাক্য তথ্য সরূপ সংগ্রহে নিল “বাল ছানলেকে লিয়ে কোম্ব “। এই শব্দবন্ধ পিযুষবাবুর হাতে পড়ে কতভাবে যে প্রয়োগ করে ভ্রমণের শেষ কটাদিন আমাকে তিতিবিরক্ত করেছে। সবাই ভারি মজা করেছে। আমিও চাপা ভাবে উপভোগ করেছি।

ঘুমিয়ে পড়ার আগে রাতের সৌন্দর্য একনজরে দেখে নিলাম। নয়ানালেকের মতো নয়। অনেকটা খোলা জায়গা দেখতে পাচ্ছি। কাঞ্চনজঙ্ঘা শুভ্র মেঘের আকারে দেখতে পাচ্ছি। আকাশ ভরা তারা। পাহাড়ের যেন ঘুমে চোখ ঢুলুঢুলু। আমরাও ঢুলুঢুলু চোখে রাতের মতো ঘরের কপাট আটকে দিলাম। সকালেও চোখ ছাড়তে চাইছে না। কী যেন তাড়ানোর গুঞ্জনে পাশ ফিরি। আড় চোখে দেখি কেউ দোর ঠেলে ভিতরে ঢুকতে চাইছে। বুটু বিছানায় নেই। নিশ্চিত ওই হবে বাইরে গেছিল। সকালের সূর্যোদয় দেখতে। দোর মুক্ত হচ্ছে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। তলায় দেখি একটা বানর ঘরের ভিতরে কেউ জেগে আছে কি না পরখ করে নিচ্ছে। সুযোগ মতো ঘরে ঢুকে খাবারদাবার যা হাতের কাছে পাবে নিয়ে পালাবে। আমি আর অপেক্ষা না করে জানতে চাইলাম, “এ্যই কে রে?” অমনি দে ছুট। পরে জানতে পারলাম, আমার পাশের ঘরে থেকে মুড়ি,চানাচুর, বিস্কুট ইচ্ছা মতো নিয়েছে নষ্ট করেছে। সকালে কোলাহলের বিষয় বানরকুল নিয়ে। এদের আচরণ দেখে বাঁদরামি বলবেন কি করে। এরা যাকিছু করে পেটে খাওয়ার জন্য। দয়া করে কে কতটুকু দিয়ে থাকি। খাদ্যের ভাণ্ডার মানুষ নামক প্রাণীর হাতে। এমনকি বনের ফলমূল মানুষ সংগ্রহ করে মুনাফার সার্থে। প্রাপ্য অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয় বানরেরাও জানে।

কৌশানীতে আরও একটা রাত কাটাতে হবে। ২রা জুন, ভ্রমণ সূচিতে থাকা স্থানগুলো শেষ বারের মতো দেখে নিতে হবে। সকালে হালকা টিফিন খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। পুরোটাই পাহাড়ের গা কেটে তৈরি করা পথ। আমার এখন সর্বোচ্চে ঘোরাফেরা করছি। দু’তিনটে বাঁক কাটিয়ে গান্ধি আশ্রমে পৌঁছলাম। ওখান থেকে মাষ্টারদা নিজের জন্য এবং আমার জন্য দুটো বই কিনলেন। যার লেখক স্বয়ং গান্ধীজী-“আত্মকথা অথবা সত্যের প্রয়োগ”। ওখান থেকে আমরা এখন চলেছি, শ্রী বৈজুনাথধাম মন্দির এবং শ্রী বাগেশ্বরনাথ মন্দির দর্শনে। এবার আমরা লক্ষ্য করলাম যতই পাহাড় হোক, পাহাড়ের তলদেশে সমতলে পুরোদমে চাষাবাদ চলছে। বিশেষ করে ধানচাষ নজরে পড়ছে। আমরা অনেক খাড়াই -উতরাই, আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে এক পথের কোণে এসে দাঁড়ালাম। সামনে আরো উঁচু পাহাড়। দু-একটা ছোট ছোট ঘর দেখা যাচ্ছে। সরু পথ কোথায় যে এঁকেবেকেঁ দূরে মিশে গিয়েছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি ফুলগাছ দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো ফুলের বাগান। তার মধ্যে ঝুপড়ি দোকান ঘর সহ এক পরিবার বাস করে। চায়ের অর্ডার দিয়ে, ততক্ষণে চারপাশের খুঁটিয়ে দেখছিলাম। আমরা খাড়াই খাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এখন থেকে চাষাবাদে যুক্ত থাকা মানুষগুলো পুতুলের মতো দেখাচ্ছিল। দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দৃষ্টি এড়ায়নি কারো।

চা বিস্কুট খেয়ে আবার গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি চলতে শুরু করেছ। পথের ধারে ঝাঁকড়া গাছে নানা রঙের ফুল থোকা থোকা ভরে আছে। গাড়িটি সামনে থেকে বাঁক নিয়ে ঘুরে ওপরের দিকে কয়েকতলা উঠে গেল। পাহাড়ের গা ঘেঁষে গাড়ি চলেছে। রাস্তার অপর দিকে অনেকটা করে সমতল। ঘরবাড়ি যেমন গায়ে গায়ে আছে। চাষাবাদের জমি চোখে পড়ার মতো। সময়ের শাকসবজি দেখতে পাচ্ছি। বেশ ঢলঢলে চেহারায়। ভালো লাগছে দেখে দেখে যেতে।

আমাদের গন্তব্যস্থল মন্দির চত্তরে পৌঁছে গেছি। ড্রাইভার পথের ইঙ্গিত দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য সরযু নদীর ওপরে ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে গেল। স্থানীয় লোকের দ্বারা পথের জটিলতা কাটিয়ে মন্দির গেলাম। প্রথমে শ্রী বাগেশ্বরনাথ মন্দির, পরে শ্রী বৈজুনাথ ধাম মন্দিরে ডালা দিলাম ও প্রণাম করে বেরিয়ে এলাম। প্রাচীন মন্দির কারুকার্য দেখার মতো। এখন গাড়িতে উঠতে হবে। কিছুতেই লোকেশান বুঝতে পারছিলাম না। সরযু ব্রিজ পেরিয়ে অনেক কষ্টে পার্কিং ষ্ট্যাণ্ডে গেলাম। এই সব দেবদেবীর স্থানে সবকিছুই যেন অলৌকিক। কোথায় থেকে যে গড়িয়ে আসছে জল। চলতি রাস্তার ওপর দিয়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে গাড়ি রাখার জায়গা গড়িয়ে চলেছে। তবে এই জল সরযু নদীর জল নয়। প্রস্রাবের গন্ধ তেমন মালুম হলো। এরাও পবিত্র স্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে যে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে বুঝতে বিলম্ব হল না। ভক্তিতে বেশিক্ষণ ভর করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। কোনমতে সেখান থেকে গাড়ি চেপে কেটে পড়লাম।

পিযুষবাবুর ড্রাইভার তাদের জানা হোটেলে সতের জনের জন্য দুপুরে খাওয়ার অর্ডার দিয়ে গেছে। পাহাড়ের গায়ে হোটেল। কোথায় থেকে ঝর্ণার জল পাইপের দ্বারায় এমন ভাবে রাখা আছে অনবরত জল পড়ে চলেছে। গাড়ি নিয়ে এদিকে এলে ওই জলে পরিষ্কার করে নেয় তাদের গাড়ি। আমাদের খাওয়ার মেনুতে তিন রকম ডালের আইটেম। কালো ডালের সাথে ঘি দিয়ে রান্না হয়েছিল। সবার মতো আমিও খিদের সময় বাদবিচার করিনি। পরে গা যেন কেমন হতে লাগল। ঠিক কোনটা খেয়ে যে কী হলো সঠিক বলতে পারব না। ওইযে শারীরিক অসুস্থতা শুরু হলো আর সস্তি পেলাম না। টি-গার্ডেনে এলাম। যখন শুনলাম প্রকৃত চায়ের বাগান পাহাড়ের ওপারে। শুনে আমার হয়ে গেছে। এর আগে আসামের চা বাগান দেখেছি। জলদা পড়ার আশেপাশের চা বাগান দেখেছি। দার্জিলিং দু-দুবার যাওয়া বাতিল হয়েছে থাক ওকথা। কিছুটা ধাপ পর্যন্ত উঠে শারীরিক দুর্বলতায় নেমে এলাম।

পিযুষবাবুর কথায় জানলাম। ড্রাইভারদের একটা সংস্কার আছে। ভ্রমণের শেষ দিনে তারাই মাংস রান্না করে, তাদের মেহমানদের পরিবেশন করার রীতি দীর্ঘদিন মেনে আসছে। ভালো লাগার কথা বাড়তি একসাজ মাংস খাওয়া যাবে। যখন জানলাম মাংসের সঙ্গে যাবতীয় তেল মশলার পুরো খরচ আমাদের বহন করতে হবে। মনে মনে না হেসে পারলাম না। মুখে কিছু বললাম না বটে, একটা গুরুভক্তির গল্প মনে পড়ল। কুলগুরু গরিব যজমানের বাড়িতে এসেছে। তাও সন্ধ্যার সময়। কী করবে মাথায় হাত। গুরুদেবের ঝোলাটা বেশ ভারী মনে হচ্ছে। পাঁচ বাড়ি তো ঘুরে এসেছে। গোপনে দেখলো চাল ডাল তেল নুন কিচ্ছুটি বাদ নেই। ওতেই রান্নার কাজ সেরে ফেলল। গুরুদেবের ভাত বেড়ে দিয়ে কর্তা সমানে পাখার বাতাস দিয়ে চলেছে। গুরু এতটা আশা করেনি। খুশিতে বলল,’বেশ ভালো আয়োজন করেছ। এতো কম সময়ে কী করে পারলে’। যজমান বলল, ‘গুরুদেব, সব তো আপনার। আমাদের শুধু পাখার বাতাস’। ড্রাইভার আমাদের খরচে মেহমানদের সেবা দেবার আনন্দ অর্জন করল, পুণ্যি নয়। তবে কটাদিন আমাদের সঙ্গে ভীষণ ভালো আচরণ করেছ। ভিন্ন ধর্মের মানুষ বলে বুঝতে পারিনি। উভয়ের মধ্যে দূরত্ব যা কিছু ছিলো ভাষাতে, আর কিছুতেই নয়।

শারীরিক অসুস্থতার জন্য সেই রাতে মাংস খাইনি। সকালে দিপাঞ্জনের সঙ্গে নিয়ে, বহু অনুসন্ধান করে দূরের দোকান থেকে এককেজি মুড়ি সংগ্রহ করে নিয়েছি। গ্রুপ ছবি তুলে আমরা গাড়িত উঠে পড়ি। এবার হাইরোড ধরে গাড়ি ছুটতে শুরু করল। মাঝে খাড়াই পাহাড়ের তলায় গাড়ি রেখে ছোট হোটেল থেকে সবাই খেয়ে নিল। একমাত্র আমি ছাড়া। গাড়ির আড়ালে বমি করে একটু স্বস্তি বোধ করলাম। গাড়ি আর কোথাও থামল না। ট্রেনের সময় ড্রাইভারদের জানা। চারটের সময় ষ্টেশনে পৌছে গেলাম কাঠগোলার আগের ষ্টেশনে। ছটায় আমাদের গাড়ি ছাড়ার কথা। দুজন গাড়ির চালক আমাদের বিদায় জানিয়ে, নিজেরা বিদায় নিলো হাত নাড়িয়ে।

এখন বাড়ি ফেরার টান। দেখার কৌতূহল নেই। আপারে জমাট করে বিছানা করে শুয়ে রাত কাটিয়ে দিলাম। দিন কেটে গেল দেখতে দেখতে। ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা। বিলম্বে গাড়ি ঢুকল হাওড়ায়। ডাক্তারবাবুর নিজের দুটো গাড়ি আগের মতো হাওড়ায় ঠিক সময়ে পৌঁছে গেছে। আমরাও গাড়িতে উঠে পড়লাম।

শিবপ্রসাদ পুরকায়স্থ | Shibaprasad Purakayastha

Jagannath Biography and Literature | Special Article

Lord Jagannath and Chaitanya Mahaprabhu | Best Article

A-Z of Cryptocurrency | Digital Currency | Best Article

A-Z of Cryptocurrency | Digital Currency | Best Article

Anandabazar Bengali Short Story | Bengali Short Story | Pratilipi Horror Stories in Bengali | Lifestyle Web Stories in Bangla | Trending online bangla golpo pdf free download | Short bengali story | Bengali story pdf | pratilipi bengali story | Short Stories for Children | English Stories for Kids | Moral Stories for Kids | story in english | story hindi | story book | story for kids | short story | story for girls | short story in english | short story for kids |

On the hilly roads of Uttarakhand pdf | Bangla golpo pdf | Bangla golpo story | bangla romantic golpo | choto golpo bangla | bengali story | Sunday suspense golpo | sunday suspense mp3 download | suspense story in hindi | suspense story in english 200 words | On the hilly roads of Uttarakhand in english | Trending online bangla golpo pdf download

suspense story in english 300 words | Suspense story examples | suspense story in english 100 words | suspense story writing | very short suspense stories for students | On the hilly roads of Uttarakhand | Top Bangla Golpo Online Reading | New Read Online Bengali Story | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Famous Bangla Golpo Online Reading | Shabdodweep Read Online Bengali Story | Shabdodweep Writer | Bangla Golpo Online Reading pdf | Famous Story – Trending On the hilly roads of Uttarakhand | Pdf On the hilly roads of Uttarakhand | On the hilly roads of Uttarakhand App | Full On the hilly roads of Uttarakhand Reading | Bangla Golpo Online Reading Blogs | Trending online bangla golpo pdf

Best Story Blogs in Bengali | Live Bengali Story in English | Bangla Golpo Online Reading Ebook | Full Bangla Galpo online | On the hilly roads of Uttarakhand 2024 | New On the hilly roads of Uttarakhand – Episode | Golpo Dot Com Series | On the hilly roads of Uttarakhand Video | Story – On the hilly roads of Uttarakhand | New Bengali Web Story Audio

New Bengali Web Story Video | On the hilly roads of Uttarakhand Netflix | Audio Story – On the hilly roads of Uttarakhand | Video Story – On the hilly roads of Uttarakhand | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2024 | Trending Bangla Golpo Online Reading | Top On the hilly roads of Uttarakhand | On the hilly roads of Uttarakhand Web Story | Best Read Online Bengali Story | Read Online Bengali Story 2024 | Trending online bangla golpo book pdf

Shabdodweep Bangla Golpo Online Reading | New On the hilly roads of Uttarakhand | Bengali Famous Story in pdf | Modern Online Bangla Galpo Download | Bangla Golpo Online Reading mp3 | Horror Adult Story | Read Online Bengali Story Collection | Modern Online Bangla Galpo mp4 | Modern Online Bangla Galpo Library | New Bengali Web Story Download | Full Live Bengali Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Literature | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Live Bengali Story Writer | Shabdodweep Writer | Trending online bangla golpo free download

Leave a Comment