New Novel Updates 2023 | অনুভূতির বান্দরবান (পর্ব ১)

Post Views: 424

অতনু দাশ গুপ্ত – সূচিপত্র [Novel Updates]

অনুভূতির বান্দরবান (পর্ব ১) – অতনু দাশ গুপ্ত [Novel Updates]

আদিত্যের অ্যাডমিশন হয়ে গেছে সাংবাদিকতা বিভাগে। কনফার্মেশন ম্যাসেজ গত সপ্তাহে এসেছে। ওর কোন আইডিয়া নেই খবর পৌঁছে গেছে আলপনার মায়ের কাছে। খুব সম্ভবত বাবাই জানিয়েছেন ওনাকে। সন্ধ্যায় ফোনে বাসায় আসতে বললেন। আলপনা বাসায় ফিরেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেবে বলে। ও ঢাকা চলে গেছে আট মাস হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কোচিংয়ের উছিলায় ঘর ছেড়েছে। আদিত্য, আলপনা একসাথে পড়েছে ক্লাস ফাইভ থেকে। বৃত্তি পরীক্ষার সময় থেকে ওদের পরিচয়। আদিত্য অতশত না ভেবে সটান সন্ধ্যায় গিয়ে হাজির ওদের বাসায়। কিছুটা আশ্চর্য হয়ে ও ভিন্ন এক আলপনাকে আবিষ্কার করলো। সাথে আরও দুই ছেলে – রুপক আর দোদুলের পরিচয় করিয়ে দিল। ঢাকায় কোচিং করার সময় এদের সাথে পরিচয়। এরাও ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসেছে। কথোপকথনের সময় আদিত্যের কেন জানি মনে হচ্ছিল এরা পরীক্ষা কম, বেড়ানোর ব্যাপারে বেশি আগ্রহী! তিনজন মিলে ঢাকা থেকে প্ল্যান করেই এসেছে বান্দরবান যাবে বেড়াতে। আলপনার ইচ্ছে আদিত্যও জয়েন করুক ওদের সাথে। ওখানে ডালিয়াদের বাসায় যাবে। সবাই একসাথে কোচিং করতো। ওর প্রথমে ইচ্ছে ছিল না, পরে আলপনা বলে বসলো আদিত্য কোথাও যেতে চায় না, মা-বাবার একমাত্র সন্তান হওয়ায় বেশ একটু ঘরকুনো স্বভাবের। অগত্যা রাজি হতে হল। রাতে আর বেশি সময় না কাটিয়ে আদিত্য চলে আসলো ওর বাসার দিকে। আন্টি রাতের খাবার খেয়ে যেতে অনুরোধ করলেন অনেকবার – মটরশুঁটি ভাজি, ডাল, পাবদা মাছের তরকারি। আদিত্য বুঝিয়ে শুনিয়ে ম্যাচের কথা বলে বের হয়ে গেল। ওর মহল্লার আশপাশের সবাই মিলে ব্যাডমিন্টন খেলার আয়োজন করেছে। প্রতি শীতেই সবাই মিলে চাঁদা তুলে খেলার আয়োজন করে। আজকের খেলা বেশ জমে ওঠার কথা – এক দলে টিপু দাদা আর আরেক দলে পাভেল স্যার। দুই মহারথীর মুখোমুখি খেলায় অংশ নিতে পেরে অনেক ভালো লেগেছে আদিত্যের। ফলাফল অবশ্য খুব একটা ভালো হয়নি দশ- ছয়, দশ- আটে হেরেছে আদিত্য, টিপু দাদার দল। তাতে কিছু যায় আসে না! বেশ জম্পেশ কয়েকটা ম্যাচ খেলে ফিরে এসে স্নান, খাওয়া-দাওয়ার পরে রাতারাতি শুয়ে পড়লো। তার আগে মা’কে ভ্রমণের ব্যাপারে অগ্রীম খবর জানিয়ে রাখলো। মায়ের কিছুটা ভয়ের কারণ বান্দরবান যাওয়ার পথের ওই সরু পাহাড়ি কাঁচা রাস্তা।

পরের দিন সকালের জল খাবার সেরে নেওয়ার আগেই আলপনার মায়ের ফোন এল। আন্টি ওকে ‘বাবুই’ বলে ডাকেন। হয়তো ছোট মেয়ে বলে। যেমন আদিত্যের ডাক নাম ‘বাবু’। উনি ঠিক সাড়ে আটটার মধ্যে লিটন দার ফার্মেসীর সামনে অপেক্ষা করতে বললেন। ওরা তিনজন ওখানেই থাকবে। কিছুটা দেরী হয়ে গেলো পৌঁছাতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও। রূপক, দোদুল আগেই চলে গেছে বাস স্টপেজে। কারও আগে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই। আলপনাকে বেশ লাগছে দেখতে – নীল পায়জামা, ডেনিম জিন্স আর ফিরোজা রঙের কুর্তা। কানের দুলও মিলিয়ে পড়েছে ও। দুজনেই রিকশায় উঠে পড়লো। লিটন দা এখনো আসেননি ফার্মেসীতে, ক্যাশের ছেলেটা পরিষ্কারের কাজে ব্যস্ত। কালকে রাতের খাওয়া দাওয়া আর ব্যাডমিন্টন খেলার গল্পে মশগুল হয়ে কখন লিচুবাগান বাস স্টেশনে পৌঁছে গেছে দু’জনে খেয়াল করেনি। ওদেরকে খুঁজে পেতে কিছুটা সময় লাগলো। ফোন করে আলপনা-আদিত্য পৌঁছে গেল। মূল বাস স্টপেজ থেকে কিছুটা পাশের দিকে সারি করে রাখা বাসগুলো আকারে কিছু ছোট। বাইরে থেকে রঙের বাহার দেখে না বোঝা গেলেও ভেতর ঢুকে ওরা টের পেলো এগুলো আসলে লক্কর ঝক্কর টাইপের বাস। ট্রাফিক পুলিশকে নিয়মিত ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছে হয়তো। আদিত্য জানালার পাশে বসে পড়লো, পরে রূপকের কথায় জায়গা ছেড়ে দিলো। পেছনের সিটে আলপনা, দোদুল। রূপক কালো রঙের ডেনিমের জ্যাকেট আর প্যান্ট। ভেতরের টিশার্টটা যদিও হলুদ রঙের। ওর চোখে সানগ্লাস দেখে আদিত্যের মনে পড়ে গেল ওটা বেমালুম ভুলে বাসায় ফেলে আসার কথা। দোদুল সাদা-কালো স্ট্রাইপের সোয়েটার পড়েছে। আদিত্যের ছাই রঙের জ্যাকেট দেখে আলপনা রিকশায় উঠার আগেই বলেছিল -“এখনো এটা??” ওটা ক্লাস এইটে পড়ার সময় কেনা। এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে।

বাস ছেড়ে দিল কিছুক্ষণের মধ্যেই। লিচুবাগান বাসস্টপ থেকে এগিয়ে চললো ফেরিঘাটের দিকে। ফেরি দিয়ে ওরা পৌঁছে যাবে চন্দ্রঘোনা ফেরিঘাট হয়ে অপর পাশে রাইখালী বাজার। ওখান থেকে চন্দ্রঘোনা-বান্দরবান সড়ক হয়ে রাঙ্গামাটির পথ ধরে এগুবে বাস। এরপর ক্রমশ রাঙামাটির পথ হয়ে রাঙামাটি – বান্দরবান সড়ক হয়ে যেতে হবে। এরপর বাঙ্গালবানিয়া হয়ে দুধপুকুরিয়া – ধূপছড়ির পথ ধরে যাবে। শেষে বান্দরবান ক্যান্টনমেন্টের পথ ধরে মূল শহর বান্দরবানে প্রবেশ করবে ওদের বাস।
ফেরীতে ওদের বাসের পাশাপাশি আরও কিছু যানবাহন রয়েছে। আকারে খুব একটা বড় না এটা। দুটো যাত্রীবাহী মাইক্রোবাস, একটা মালবাহী লড়ি। বড়সড় শব্দে ফেরী চলতে লাগলো। কর্ণফুলী নদীর দূষণ চোখে পড়ছে সবার আর সেই সাথে তার বিকট গন্ধও নাকে আসছে। এগুলো কর্ণফুলী পেপার মিলের কাগজের মন্ড হয়ে যাওয়ার পর বাতিলকৃত বজ্য পদার্থ। যেগুলো নিষ্কাশনের অন্য কোন ব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের করেননি। কবে নাগাদ এর সমাধান হবে কেউ জানে না, আদও হবে কি না তাও জানা নেই। আদিত্য আর রূপকের মধ্যে বজ্য পদার্থ নিষ্কাশনের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হতে লাগলো। দুজনেই বজ্য পূনর্ব্যবহারের কথা বললো। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এভাবেই বজ্যকে কাজে লাগানো হয়। নতুবা যদি একান্তই কোন উপায় না থাকে সেক্ষেত্রে এগুলোকে প্রক্রিয়াজাতকরণ করে উন্নত ধরণের সারে রূপান্তরিত করা যেতে পারে। আলপনা আর দোদুল একে অপরের সাথে বিভিন্ন ব্যাপার নিয়ে গল্প করছে। মাঝে সাঝে রূপক কিছু কিছু মন্তব্য করে ওদেরকে গল্প করার আসরকে আরও জমিয়ে তুলছে! ফেরীর রাইখালী বাজার পৌঁছাতে বেশিক্ষণ সময় লাগলো না। ওপারে পৌঁছে বাসটা একটা ছোটখাটো জনপদের মধ্য দিয়ে যেতে লাগলো।

এরপর দু’পাশের জনপদের বাজার, লোকজনের ভিড় ভাট্টা এসব পার হয়ে ক্রমশ পাহাড়ের সরু পথের দিকে এগুতে লাগলো বাস। আদিত্যের মায়ের শংকার কথা মনে পড়ে গেলো। রাস্তা তো নয়, এ তো যমের বাড়ি যাওয়ার উত্তম পন্থা! বাদিক ঘেঁষে পাহাড় আর ডানদিকে সাক্ষাৎ উন্মুক্ত যমদ্বার! দূরের সবুজ পাহাড়ের গায়ে ঘরগুলো দেখে ছোট্টবেলার খেলনার বাড়ির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। যেদিকে দুচোখ যায়, শুধু সবুজের অন্তহীন সমারোহ আর সুনীল আকাশের নীলাভ দিগন্তে মন হারিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য মনে মনে ভাবছে “এমন সময় কোথায় একটু দুদণ্ড শান্তিতে বসে প্রকৃতির সাথে একান্তে কথা বলবো। তা না কোন রাস্তা ধরে কোথায় চলেছি স্বয়ং ব্রহ্মাই জানেন!!” এরপর যা হলো তা আরও ভয়াবহ! এতদূর রাস্তা পিচঢালা পথ হওয়ায় ধূল-বালির কোন উপদ্রব ছিল না। ক্রমশ সে বাস কাঁচা রাস্তা হয়ে চলতে শুরু করলে আশপাশের পরিবেশ শুধুই ধূলোময় হয়ে উঠলো। আদিত্যের এলার্জির সমস্যা হচ্ছে। সবাই রুমাল, কাপড় যা দিয়ে পারে নাক-মুখ ঢেকে নিল। রাস্তা শুধু কাঁচা আর ধূলোময়লায় সয়লাব তা না, বেশ বিপদজনকও বটে! একপাশের গাড়ি পাহাড়ের গাঁ ঘেঁষে চলছে। বেশ লাগোয়া ভাবে, অপর পাশ থেকে অন্য গাড়ি আসলে তা এদিকের চালক দেখতেই পাবেন না! এক্ষেত্রে রাস্তার মোড়ে আসার আগেই এদিকের গাড়ির ড্রাইভার টানা হর্ণ বাজাতে শুরু করে যাতে অপর পাশ থেকে আসা গাড়ি সর্তকতা মেনে চলে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে একমুখী রাস্তা হওয়ায় এ দশা। অপর পাশে নেই কোন সুরক্ষা বেষ্টনী! কিছু কিছু জায়গায় যা-ও আছে সেটা গাড়িকে কতটা সাপোর্ট দেয় তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আর এসব রাস্তা দিয়েই এ অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের যাতায়াত! আশ্চর্য ঠেকলেও এটাই এনাদের বিধি। প্রকৃতির সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে বসবাস করা এ মানুষগুলোর দায়িত্ব তার হাতেই ছেড়ে দিতে হবে হয়তো। এসব ভাবতে ভাবতে চিন্তায় ছেদ পড়লো রূপকের কথায়! এতকিছু হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যেই! ওকে বেশ নির্ভার লাগছিলো। একমনে কানে লাগানো হেডফোনে গান শুনে যাচ্ছিল ও। হাবভাবে আদিত্যের মনে হচ্ছিল এ রাস্তায় ওর চলাচল প্রতিদিনকার। মুঠোফোন এখানে ব্যবহার করতে পারার কথা নয়। নেটওয়ার্ক নেই। পুরো বাস যাত্রায় দোদুল কিছুক্ষণ পর পর মুঠোফোনের সিগনাল চেক করে অনেকটা সময় পার করেছে! পেছনে দোদুল আর আলপনাও এতক্ষণ প্রায় চুপ থাকার পর মুখ খুলেছে।

রুপক আদিত্যকে জিজ্ঞেস করে বসলো, “তুমি টেইলর সুইফট শোনো??
আদিত্য – “হ্যাঁ, শুনি বটে! ওর “ডেলিকেট ” তো আমার ফোনের প্লে- লিস্টেই আছে!
রূপক – আর কেউ??
আদিত্য – এছাড়া আমি এলি গোল্ডিং কে খুব পছন্দ করি, এডেলের গানও শুনি মাঝেমধ্যে! আবার এড সেরনের গানও শোনা হয়। মনে পড়ে স্কুলে পড়ার সময় টাইটানিকের সেলিন ডিয়নের গানটা খুব শুনতাম।
একসময়ে দু’জনেই কিছুটা নস্টালজিক হয়ে পড়লো।
তারপর জেমস ক্যামেরুনের কথায় চলে গেল প্রসঙ্গ। সামনেই নতুন মুভিতে কেট উইন্সলেটও আছে এমনটা খবর এসেছে। ১৯৯৮ এর পর আবার ক্যামেরুন- কেট জুটি পর্দায় হাজির হচ্ছেন।

পেছনে ডালিয়ার ভাই ডিউকের ব্যাপারে কথা বলছে আলপনা আর দোদুল। শুনছিলাম সেই দাদা নাকি বাংলা পারে না! তবে উনি কি আধুনিক কালের “নতুন দা”?? ওরা বলাবলি করছিলো, ডালিয়ার দাদা ছোটকাল থেকেই পড়াশোনা করেছেন দার্জিলিং এ। তাই বাংলা বলতে অসুবিধা হয়। মনে হয় না উনি পড়তেও জানেন। কথা শুনে মনে হচ্ছিল আলপনা এই ব্যক্তিকে স্বচক্ষে অন্তত একবার দেখতে বেশ উৎসুক! কেমন একটা অদৃশ্য অনুরাগের লক্ষণ মনে হচ্ছে ওর হাবভাবে!