Mahagai | মহাগাই – শওকত নূর | 2023

Sharing Is Caring:
BENGALI STORY

মহাগাই | Mahagai – শওকত নূর [Bengali Story]

আমি একটা গাই। হ্যাঁ হ্যাঁ, গো প্রজাতির স্ত্রী শ্রেণিভুক্ত যে হাবাগোবা নিরীহ প্রাণীটির আপাদচিত্র চোখে ফুটে উঠেছে, আমি সেই গাই। অবশ্য মাহাত্ম্যের প্রসঙ্গটি কানে ধরে টেনে আনলে আমি ঢের আলোকপাতের বস্তু। আমার দুধ না হলে আপনাদের মনুষ্য প্রজাতির জীবন নীরস, অচল। আমার চামড়া আর মাংসের প্রসঙ্গটি না হয় বাদই রাখলাম। মাহাত্ম্যের বিষয়াদি থাক। আমি যে গাই, সে বিষয়বস্তুই আলোচনায় উবু হোক।

একটু ভেবে দেখুন আপনারা, মনে কল্পচিত্র বয়ে আনুন – ঘাসমাঠে বাঁধা আছি আমি, অথবা দড়িহীন ছাড়া অবস্থায় স্বাধীনই আছি – কী তাতে? কেউ কিন্তু সামান্যতম ভ্রুক্ষেপেও আনছেন না আমার অবস্থিতির বিষয়টি। বরং নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে এড়িয়ে বা পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন। মনে মনে তাচ্ছিল্যে উচ্চারণ করছেন, গা-ই দাঁড়িয়ে আছে! গা-ই! যদি গাই না হয়ে ষাঁড় হতাম, তবে কী করতেন? ভেবে দেখুন তো কতটা ভয় সমীহে দুরুদুরু বুকে কম্পমান পায়ে দৌড়ে কিংবা দ্রুত হেঁটে অতিক্রম করে যেতেন – যেন বেঁচে গেলেন একপাক এক মহাফাঁড়া থেকে।

আরো ভেবে দেখুন, ছেলেবেলার সেই খেলার মাঠের কথা। কেউ খেলায় খারাপ খেললে বলতেন,গাই কোনখানের, অথবা বলতেন, গাই মার্কা খেলা খেলেছিস। খুব বেশি খারাপ খেলে ফেললে রাগে ক্ষোভে বলতেন, শালার মররা গাই, পচা গাই কোনখানের! আবার বরাবরই খারাপ খেলে থাকে, এমন কোন দুর্বল খেলোয়াড় হঠাৎ কোন মুহূর্তে ভালো খেলে বসলে বলে উঠতেন, ও-রে বাপরে বা-প! এ দেখি গাইয়েও মাটি খুঁড়ে! অর্থাৎ শিঙ দিয়ে মাটি তো খুঁড়ে প্রবল প্রতাপশালী ষাঁড়। কাজেই দুর্বল গাইয়ের মাটি খোঁড়ার ঘটনা ঘটলে তা এভাবেই তাচ্ছিল্যে উচ্চারিত হবে। উচ্চারণ আপনারা করেনও আলবৎ সেভাবেই।

দুঃখের বিষয় কি জানেন, জীবনে আমার কোনদিন সেভাবেও মাটি খোঁড়া হলো না। যাক ওসব দুঃখ বিষাদের স্থূল কথামালা। এবারে বয়ান করা যাক আমি কার গাই, কী বৃত্তান্ত, কী সমাচার। কারণ, আমি নীলগাই, চমরী গাই কিংবা বনগাঁই নই -সাদারঙা বাঁকাশিঙা লোকালয়-গাই। লোকালয়ে গাই মানেই তার একজন মালিক থাকবে।

কে আমার মালিক? শুনে নিশ্চয়ই হাসবেন। মনুষ্য জনশ্রুতিতে তিনিও একজন গাই, মনুষ্য-গাই। এখানে এক ছোট্ট কাহিনী আছে। সে কাহিনী শোনাতে চলে যেতে হবে আমার সুদূর অতীত জীবনে, যখন আমার মালিক ছিলেন ভিন্ন এক মনুষ্য। পেশায় তিনি ছিলেন কৃষক, তবে স্বভাবে আচরণে বর্তমান মালিকের ন্যায় গাইবৎ নন, ছিলেন রীতিমত ষাঁড়বৎ। কতদিন শুনেছি মালিকের বাবাকে ক্ষোভে দুঃখে বলতে, ষাঁড়ের মতো কুঁদিস নাতো! ষাঁড়ের বাপ আছি আমি! আমার ঘরে মানুষ না জন্মাইয়া আস্তা ষাঁড় জন্মাইছে! ব্যাটা ষাঁড় কোনখানের প্রভৃতি। যাক সেসব। কিভাবে আমি মালিকান্তর হলাম, সে কথায় ফিরি।

বয়সে আমি তখন নবীন। স্বভাবে অতি নম্র, অতি দুর্বল, অতি মিতবাক। ঘাস খড় ধীরে চিবাই, মৌন মৃদু জাবর কাটি, ঝিমাই ঘুমাই প্রভৃতি। হালে যাবার বয়স তেমন হয়নি, কদাচিৎ গেলেও তেমন গতি দিই না। মালিক অপ্রসন্ন। যেহেতু বয়স অল্প, প্রজনন পরিপক্বতা আসেনি, গাইত্ব অপ্রাপ্তি সত্বেও এখন যে গাই অভিহিতি এসেছে তাও আসেনি। লোক-সাধারণে বকনা বলেই সম্বোধিত হই। গৃহস্থ বকনা হিসেবেই বিক্রির সিদ্ধান্ত নিলেন আমাকে। পাশেই ছিল প্রসিদ্ধ এক গোহাটা। কালু নামের এক ব্যক্তির নামে হাট। লোকমুখে কাইল্যার হাট নামে বহুল উচ্চারিত।

একদিন দুপুরবেলা আমাকে কথিত সে হাটে তোলা হলো। কত ক্রেতা এলো গেলো – সবাই আমাকে খুঁটিয়ে নাটিয়ে দেখে, কিন্তু দাম যা বলে তাতে গৃহস্তের মন ওঠে না। জাতে গাই হলে কী হবে, দামে আমার যথার্থ ষাঁড় বনা চাই। যতবার যত ক্রেতা দামে কম হাঁকে, ততবার গেরস্ত আমার বকনা হবার বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়ে আমার বুকে হাইলা লড়ির তীব্র ঘায়ে চেঁচিয়ে বলে,শালার গা-আ-ই! রোজ ঘাস খ্যাড় খাওয়াই না তরে? তর দাম হয় না ক্যান? ওই শালার গা-ই! গা-ই কোনখানের?

বেলা প্রায় ডুবে এলো। আরো কত ক্রেতা আসে যায়। সবাই গাই বা বকনা দামই আমার বলে। ষাঁড় দাম কেউ হাঁকেও না, গেরস্তও অনড়। মন তার কিছুতেই ওঠে না। তার তরফ থেকে সময় সময় আমার হাঁনার মধ্যে প্রবল ঘা পড়ে। হাঁনা বোঝেন তো? হাঁনা হচ্ছে বুকের পাশ। আমি ব্যাথায় কুঁকড়ে থাকতে গিয়েও সতর্ক হই। জানি আমার ষাঁড়ুয়া মালিক সে দোষেও আমাকে নতুন ক’ ঘা বসাবেন। কারণ, দামের সাথে বিক্রিতব্য প্রাণীর চাঙা দেখানো না দেখানোর একটা সম্পর্ক থাকেই। অতএব, কষ্ট চেপে তেমন দেখাবার প্রচেষ্টাতেই নিমগ্ন রইলাম।

দেখতে দেখতে বেলা ডুবে গেল। খানিকটা অন্ধকার ঘনিয়েছে। এমন সময় এক ক্রেতা এলেন। দেখতে ফর্সা- লকমা দাড়ি- খুদে চুল, হাবাগোবা, কণ্ঠে মেয়েলি টান, কার্তিক মাসের নাতিশীতোষ্ণতায় গায়ে জাম্পার, গলায় খাটো মাফলার চড়িয়েছেন। লুঙ্গি-নিতম্বে ঘন ঘন হাত বুলানোর সাথে পান চিবাচ্ছেন জোর শব্দে। পরক্ষণে উবু হয়ে পিক ফেলে হাঁটু চুলকাচ্ছেন। মাটিতে পায়ের নাগরায় খচখচ শব্দের তালে ঘাড় দুলিয়ে বিশেষ ভঙ্গিমায় আমার গেরস্তের উদ্দেশে বললেন, বাঁয়ো, এই হাঁড়গোরুডো কঁ-তো?

গেরস্তের চোখদুটো মুহূর্তে জ্বলজ্বলে হলো। লোকটার হাবাগোবা চেহারাসুরত ও বাচন ভঙ্গিমার সুবাদে তিনি ত্বরিত সিদ্ধান্তে সারাদিন হাঁকা দামের চেয়ে অনেকটা বেশি দামই হেঁকে বসলেন। ক্রেতা পানের পিক ফেলে ফ্যালফ্যালে চোখে চেয়ে বললেন, বাঁয়ো, গোরু এঁডো বা-লা। কিঁন্তুক দাঁমডো খানিক বেঁশি হ-য়া গেঁলো না?

বালা গোরুর মূইল্য তো বালাই হইব। নাকি মিছা কইলাম?

তা কঁতা ঠিক। রাতইও গনায়া আঁয়লো। টিঁক আছে, এই লইন টাঁহা। দঁড়ি ছাড়ার বঁবস্থা দেইন।

দাম চুকালে দড়ি ছাড়াবার ব্যবস্থা মাত্র নতুন ক্রেতা আমাকে নিয়ে তড়িঘড়ি বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। ঘন্টা খানেক পর পুবাকাশে চাঁদ উঠল। ফকফকা জোছনা। মাঝপথে নদী পড়ল। খেয়া পার হতে হবে। ক্রেতা আমাকে খেয়া নৌকায় তুলে লুঙ্গির কোঁচা থেকে পান বার করে আয়াসে চিবাতে লাগলেন। নৌকা মঝগাঙে পৌঁছলে খেয়ামাঝি আকস্মিক তার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, মুরাব্বি, এ গাই গোরুডো কত দেয়া কিনলেন?

গাঁ-আ-ই? এঁডোকি গাই গোঁরু? কী উল্টা পাল্টা কতা কঁয়তাছো? এডো গাঁ-আ-ই?

তয় কি বকনা?

আঁরে বাঁয়ো, কী কও তুমি আলিছাগুলি কঁতা? এঁডো আছে হাঁড়গোরু, হাঁড়!

এডো হাঁ-আ-ড়? কী কয়তাছেন মুরব্বি? হারা জেবোন এত গোরু দেখলাম, আইজ গোরু চিনবার হারলাম না? আমি দেব্যো দেখতাছি এইডো গাইগোরু। জোছনা রাইতে ভুল দেখব?

ভুলই দেখতাছ তুমি, বাঁয়ো। হাঁড়গোরুক গাই ঠাওরায়তাছো।

উহু, এইডো দেব্যো গাইগরু। বকনা হইলে হইবার পারে। তয় হাঁড় না। বিশ্বাস করা না করা মুরব্বি, আপনের ব্যাফার!

বাঁজে কতা কইও না বাঁয়ো, গোরু আমিও বালা চিঁনি। অঁহনই পরীক্ষা লঁয়তাছি।

ক্রেতা দ্রুত আমার পেছন দিকে এসে দু’হাতে লেজ উঁচিয়ে মাথানিচু চুপ করে থাকেন। যেন ভূত দেখে বাক হারিয়েছেন।

কী মুরব্বি, কতা কয়তাছুইন না কেরে? পরখে কী পায়লেন, এডো গাইগোরু, নাহি হাঁড়?

এঁডো গাঁ-আ-ই। ক্রেতা ম্রিয়মাণ অস্ফুট বললেন।

খেয়ামাঝি বিদঘুটে হাসলেন। তার সাথে মাথানিচু শব্দহীন তাল মেলালাম আমিও। খেয়া ওপারে ভিড়লে আমাকে পাড়ে নামিয়ে আমার পিঠে হাতের দুই জোর থাপ্পড় বসিয়ে ক্রেতা বললেন, যা হাঁলার গাঁ-ই। বড় বুল হয়া গেছে তক হাঁড় ঠাউরায়া ক্রয় কয়রা। মঁস্ত ভুল হয়া গেঁছে! ক্যাঁডো জানতো তুই হাঁড় না, গাঁই? হাঁলার গাঁ-আ-ই!

পেছনে খেয়ামাঝির অস্ফুট তাচ্ছিল্যকর কণ্ঠ উচ্চারিত হলো, হালার গাইলোক। ইয়া(অশ্লীল) –দেছো কাইল্যার হাডে, লেইজ তুলতাছো আয়া খেওয়াগাডে! গাই আর কয় কাক!

খুব হাসি পেল আমার। মনে হচ্ছিল, আমি জাতিগতভাবে গাই হয়ে যতটা না গাই, এরা তারচে’ অনেক বড়মাপের গাই, মস্তগাই, মহাগাই! আমি প্রকৃতিগতভাবে, জন্মগতভাবে গাই- এটা কি আমার দোষ? আমার গাইত্বকে ষাঁড়ত্বে দেখতে চাওয়া, গাইত্বকে তাচ্ছিল্য করাই বরং এদের অপরাধ। ভাবতে ভাবতে গেরস্তের বাড়ি এসে পৌঁছলাম।

নতুন গেরস্থের বাড়িতে সারারাত আমার না খেয়ে কাটল। যেন কত বড় অপরাধ আমার গাই হয়ে জন্মানো! দিনের পর দিন আমার প্রতি অত্যাচার অবহেলা বাড়তে লাগল। ছুঁতা-সুযোগ পেলেই গেরস্ত তার ঠকার ঝাল আমার ওপর মেটান। যেহেতু তিনি আমাকে ষাঁড় ভেবে কিনেছেন, আমার প্রকৃত গাইত্ব প্রাপ্তির কোন ব্যবস্থাও তিনি নিলেন না। কোন ষাঁড় গোরুর ছায়া পর্যন্ত আমাকে মাড়াতে দেয়া হয় না। বলতে গেলে আমাকে পূর্ণ একাকীত্বে ঠেলে ফেলে রাখা হয়।

আমি প্রায় সারাক্ষণই বিমর্ষ থাকি। তবে মাঝেমাঝে কিছুটা উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি, যখন দেখি খেয়ামাঝির খেয়াঘাটে লেজ তুলে দেখা সংক্রান্ত ওই তাচ্ছিল্যোক্তিটি প্রবাদপ্রতিম হয়ে গেঁয়ো লোকজনের মুখে মুখে দেদারছে উচ্চারিত হয়,আর আমার নব্য অত্যাচারী হাবাগোবা গেরস্তকে তা যারপরনাই আহত বিষণ্ণ বিমর্ষ করে তোলে। মনে হয়, আমার অভিশপ্ত অপূর্ণ গাই জীবন কিছুটা হলেও সার্থক। কারণ, উন্নততর হবার অদৃশ্য আরোপিত ব্রত সত্ত্বেও আমার মালিক স্বভাবে চরিত্রে এক তথাকথিত আদর্শ গাই, মহাগাই!

(রম্যগল্প, সূত্র : প্রচলিত গেঁয়ো প্রবচন)

শওকত নূর | Shawkat Noor

দেবতা ৩৩ কোটি | 33 Crore Gods | প্রবোধ কুমার মৃধা

New Bengali Article 2023 | কবিতার অন্তরাত্মা

Best Bengali Story 2020 | কিছু নই | শওকত নূর

New Bengali Story 2023 | করিমের একদিন | তালাল উদ্দিন

Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder | bengali story pdf download | bengali story audio book | bengali story audio download | Mahagai Story | Mahagai Bengali Story | Mahagai new story | Mahagai viral video | Mahagai funds investment | Mahagai story credit | Mahagai – Amar Ujala Kavya | New version Mahagai | Viral story Mahagai | Mahagai helpline | Mahagai Secret key

Leave a Comment