The legend of Jagannath | জগন্নাথের কিংবদন্তি

Sharing Is Caring:
Legend of Jagannath

জগন্নাথের কিংবদন্তি | The legend of Jagannath

মহাভারতের সেই বিখ্যাত কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধের পরে তখন অনেকদিন কেটে গেছে। ভারতপুরুষ কৃষ্ণ তখন দ্বারকায় নিজের রাজ্য শাসন করছেন, আদর্শ রাজার সমস্ত কাজই তিনি করছেন। যুধিষ্ঠির সমগ্র আর্যাবর্তে ও স-সাগর-বসুধার সম্রাট হয়েছেন ‘কিং মেকার’ কৃষ্ণের আশীর্বাদে। একদিন কৃষ্ণের জীবনে নেমে এলো দুর্যোগের ঘনছায়া, তাঁর প্রাণপ্রিয় দাদা বলরাম শরীর ত্যাগ করে নিজধামে চলে গেলেন। স্বয়ং অবতার পুরুষকেও মানুষের শরীর ধারণ করলে পার্থিব জরা, ব্যাধি, শোকও ভুগতে হয়। কৃষ্ণও দাদা বলরামের শরীর বিয়োগে বেশ কিছুটা মানসিক শোক পেলেন। যিনি গীতায় বলেছেন, আত্মা অবিনশ্বর ও আত্মা জীর্ণ কাপড়ের মতো শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীর গ্রহণ করে, স্বয়ং তিনিও এবার শোক পেলেন। মহামায়ার মায়া এমনই। এই জন্যই লোকজন বলে, পঞ্চ ভূতের ফাঁদে, ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে। মহামায়ার মায়া এমনই কঠিন, পাথরও গলে জল হয়ে যায় তাঁর মায়ায়। দাদা বলরামের তিরোভাবের পর কৃষ্ণও বুঝতে পারছিলেন, তাঁর মানব জীবনের সমস্ত উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেছে, এবার তাঁর সমূলে ফিরে যাওয়ার সময় উপস্থিত। কিন্তু এখনও তিনি একজনের কাছে বচনবদ্ধ। সেই বচন পূরণ না হলে কৃষ্ণের সত্যরক্ষা ব্যহত হবে।

বলরামের বিরহে লীলা বিলাসে ক্লান্ত কৃষ্ণ একদিন কর্মের অবসর মতো একটি বড় গাছের উপর নিটোল সুন্দর রাঙা পা ঝুলিয়ে বসে ছিলেন। যেমনভাবে তিনি বৃন্দাবনের গাছে চড়ে আরাম করতেন তেমনভাবে বসে বিশ্রাম করতে লাগলেন। কোথায় সেই গোপবালক কৃষ্ণ কোথায় এই দ্বারকানাথ কৃষ্ণ। তাঁর লালচে আভা বিশিষ্ট রাঙা পা-কে সুন্দর পাখি ভেবে ভ্রমে বিষাক্ত বাণ মারে অন্ত্যজ ব্যাধ। তাঁর নাম জরা ব্যাধ। তিনি ছিলেন পূর্বজন্মের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। বিষাক্ত ভীষণ বাণের প্রথম আঘাতেই কৃষ্ণের প্রাণসংকট দেখা দিল। কৃষ্ণ মানব শরীর ছেড়ে যাত্রা করলেন নিজধামের দিকে, তাঁর পার্থিব শরীর পড়ে রইল পৃথিবীতে। জরা ব্যাধ তাঁর কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে উঠলেন। এমন সময় আকাশ মার্গে হঠাৎ দৈববাণী হলো জরা ব্যাধ যেন অনুতপ্ত না হন। এ ছিল বিধির বিধান, বিধির বিধান কে লঙ্ঘন করতে পারে? সবই পূর্বনির্ধারিত দৈবচক্র। হঠাৎ এমন অপঘাতে কৃষ্ণের মৃত্যুর বার্তা পেয়ে হস্তিনাপুর থেকে অর্জুন ছুটে এলেন দ্বারকায়। তাঁর সঙ্গে এলেন যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, নকুল ও সহদেব। অর্জুন তাঁর প্রিয়সখার মৃত্যুতে প্রচণ্ড বিচলিত হয়ে উঠলেন। কিন্তু কর্তব্যে একটুও বিচলিত হলেন না। মহাসমুদ্রের তীরে কৃষ্ণের পার্থিব দেহ সৎকারের সময় অর্জুন দেখলেন কৃষ্ণের প্রায় সম্পূর্ণ দেহ অগ্নিতে দাস হলেও কৃষ্ণের নাভিকমলকে অগ্নি স্পর্শ করতে পারছে না। আর ঠিক তখনই হলো আকাশমার্গে এক অভিনব দৈববাণী : “কৃষ্ণই সেই পরমব্রহ্ম পুরুষ, তিনি পূর্ণ সচ্চিদানন্দ বিগ্রহ, তাঁর কায়িক শরীরও পরম পবিত্র। হে কুন্তীপুত্র অর্জুন, এই অবিনশ্বর কৃষ্ণের নাভিকমলকে মহাসমুদ্রে শ্রদ্ধার সঙ্গে নিক্ষেপ করে কৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করো। মহাসমুদ্রেই কৃষ্ণের নাভিকমলের অনন্তশয়ন।অযথা বিলম্ব যেন আর না হয়।” দৈববাণী শুনে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুন সমস্ত নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে ভাসতে ভাসতে মহাসমুদ্রের মাঝে এগিয়ে চলল পরমব্রহ্ম পুরুষের সেই পবিত্র নাভিকমল। আর সেই দীপ্তিমান নাভিকমলকে লক্ষ্য করে মহাসমুদ্রের তীর ধরে দ্বারকা থেকে একটানা ছুটে চলতে লাগলেন অনার্য জরা ব্যাধ। তাঁর মনের যন্ত্রণা আজ সীমাহীন। শেষ পর্যন্ত কিনা তাঁর বিষাক্ত ভীষণ বাণেই মৃত্যু হয়েছে ভারতের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পুরুষ কৃষ্ণ। পশ্চিমভারতের দ্বারকা থেকে পূর্বভারতের নীলাচল শ্রীক্ষেত্র পর্যন্ত একা ছুটে চললেন জরা ব্যাধ। অবশেষে নীলাচলেই তিনি ভগবানকে স্বপ্ন দেখলেন আগামীকাল ভোরে যেন নাভিকমল জরা ব্যাধ সংগ্রহ করে নেন। জরা ব্যাধ পরের দিন সকালে উঠে মহাসমুদ্রে গিয়ে সেই নাভিকমল সংগ্রহ করে আনলেন। জরা ব্যাধ এক সময় মারা গেলেন এবং নবজন্ম নিলেন শবররাজ বিশ্বাবসু রূপে। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন তখন আর্যাবর্তের রাজাধিরাজ। আর উৎকলের শবরপল্লীতে গুপ্তপূজায় পূজিত হয়ে চলেছেন মহাপ্রভু নীলমাধব। শবরদের সঙ্গে নীলমাধব মহারঙ্গে বসবাস করতে লাগলেন। নীলমাধব দিব্যবিগ্রহে পরমব্রহ্ম এতটাই গুপ্ত অবস্থায় বিরাজমান রইলেন যে কোনো আর্যরাজাই তাঁর সংবাদ পর্যন্ত পেলেন না। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে গুপ্ত এক পীঠস্থানে গুহার অন্দরে পরম শ্রদ্ধায় নীলমাধব বিগ্রহের পূজা হতে লাগলো। শবরেরা প্রভু নীলমাধবের প্রতি আনুগত্যের কারণেই হোক, বা নীলমাধবের কৃপায় হোক শবরদের গ্রামের প্রতিটি মানুষের ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ লাভ হতে লাগলো।

Jagannath

এদিকে আর্যাবর্তের অবন্তীনগরে সূর্য বংশের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন দেবের রাজত্বের সূচনা হলো। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন ভগবান বিষ্ণুর পরম ভক্ত। তাঁর মতো নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব সেই সময়ে শবররাজ বিশ্বাবসু ছাড়া ভূ-ভারতে আর মাত্র একজনই ছিলেন, তিনি ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি। বিধির বিধান ছিল রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একটি মন্দির নির্মাণ করবেন নীলগিরিস্থ শ্রীক্ষেত্রে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন শ্রীক্ষেত্রে মহাবিষ্ণুর জন্য মন্দির নির্মাণ করাতে শুরু করেন। কিন্তু বিষ্ণুর কোনো সাকার বিগ্রহ তখন কোনো আর্য মানবই দেখতে পারেননি। বহুকাল পরে অবশেষে একদিন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন শুনতে পেলেন বিষ্ণুর সাকার বিগ্রহ নীলমাধবের কথা। রাজা জানতে পারলেন এই নীলমাধবই নাকি অনাদির আদি বিষ্ণুরই প্রথম সাকার রূপ। নীলমাধবের সংবাদ পাওয়া মাত্র প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ভারতের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমদিকে সর্বফলপ্রদ নীলমাধবের বিগ্রহের অনুসন্ধানে প্রতিনিধি পাঠালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। এর মধ্যে পূর্বদিকে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর প্রতিনিধি হয়ে গেলেন ব্রাহ্মণতনয় বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতি ব্রাহ্মণ শুধু নয় তিনি ধর্ম-কর্ম-কৃষ্টিতে দক্ষ। বিদ্যাপতি নীলমাধবের সন্ধানে যাওয়ার আগে শপথ নিলেন, হয় তিনি এক বছরের মধ্যে নীলমাধবের সংবাদ নিয়ে আসবেন নতুবা ঠিক এক বছর পর তাঁর মৃত্যুর সংবাদ এসে পৌঁছাবে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিদ্যাপতির ওপর নির্ভর করতেন, তিনি বিদ্যাপতির এমন শপথবাক্য শুনে ভাবে বিহ্বল হয়ে উঠলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন বিদ্যাপতিকে আনন্দে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

নীলমাধব দিব্যবিগ্রহের অনুসন্ধান করতে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর নির্দেশ পেয়েই যাঁরা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গিয়েছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই ধার্মিক বিদ্বান বিচক্ষণ ব্রাহ্মণতনয়। একের পর একজন করে এক বছরের মধ্যে তাঁরা সকলেই ফিরে এলেন অবন্তীনগরে। তাঁরা রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে নতশিরে স্বীকার করলেন তাঁরা রাজা প্রদত্ত কাজে ব্যর্থ হয়েছেন, তাঁরা কেউই নীলমাধবের সন্ধান তো দূরের কথা, নীলমাধবকে চাক্ষুষ করেছেন এমন কোনো মানুষের সন্ধান পর্যন্ত পাননি। সমস্ত কথা শুনে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কিছুটা আশাহতই হলেন। তবু তাঁর মনে একটি আশার শিখা অনির্বাণ হয়ে দেখা দিচ্ছিল। সবাই ফিরে এলেও তাঁর অনুগত ও সখা বিদ্যাপতি এখনও ফিরে আসেননি। বিদ্যাপতি শপথ করেছে ঠিক এক বছরের মধ্যে তিনি নীলমাধবের সন্ধান নিয়ে আসবেই। এখন পর্যন্ত যাঁরা গিয়েছিল তাঁরা সবাই খালি হাতে ফিরে এসেছে, ফেরেনি শুধু বিদ্যাপতি। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁর আরাধ্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে শুরু করলেন, বিদ্যাপতির যেন এই যাত্রা বিফলে না যায়। প্রায় এগারোটা মাস কেটে গেলেও ফিরলেন না বিদ্যাপতি। হাতে আর মাত্র এক মাস, এর মধ্যে যা হওয়ার তা হবে। ইন্দ্রদ্যুম্নর যত চিন্তা বাড়তে লাগলো, ততই তিনি চিন্তামণি বিষ্ণুকে প্রাণপণ প্রার্থনা করতে থাকলেন।

অন্যদিকে অবন্তীনগর থেকে দীর্ঘ ছয় মাস একটানা পদব্রজে যাত্রা করে বহু কষ্টে বিদ্যাপতি পূর্বভারতের নীলগিরি অঞ্চলে এসে পৌঁছালেন। এই দুর্গম স্থানে আগে কখনও তিনি আসেননি। এখানে প্রায় আর্য জনগোষ্ঠীর কেউই নেই। সমগ্র পূর্বভারত তিনি তন্নতন্ন করে খুঁজেও নীলমাধবের কোনো সন্ধান করতে পারলেন না। তাঁর স্মরণে এলো রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে করে আসা নিজের শপথের কথা। অগ্নিকে আর মৃত্যুকে তিনি ভয় পান না, তিনি যে বৈদিক ব্রাহ্মণ। তিনি ভয় পান সত্য থেকে বিচ্যুত হতে। তিনি মনে মনে ভাবলেন সত্য রক্ষার জন্য যদি প্রাণ দিতে হয়, তবে তাই শ্রেয়। এসব বিষয় চিন্তা করতে করতে বিদ্যাপতি কোনো এক বড় জঙ্গলের মধ্যে পথ হারালেন। বহু চেষ্টার পরেও তিনি সেই বিরাট জঙ্গল থেকে বাইরে আসার কোনো পথ খুঁজে পেলেন না, বারবার ঘুরে ঘুরে সেই এক জায়গায় এসে পড়তে লাগলেন। বিচক্ষণ বিদ্যাপতি অচিরেই বুঝতে পারলেন তিনি পথ হারিয়ে একই জায়গায় ঘুরে চলেছেন। তখন দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, সন্ধ্যা নেমে আসছে বনের পথে। আকাশের তারা বা চাঁদের আলো বনের ভেতর প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে না, বন এমনই ঘন। আকাশের ধ্রুবতারা দেখেও পথ খোঁজার কোনো উপায় নেই আর। এবার বিদ্যাপতি বড় অসহায় বোধ করলেন। তবে কি এবার এই শ্বাপদসংকুল ঘন বনপথেই তাঁকে ঘুরে মরতে হবে? মর্মাহত বিদ্যাপতি মনের দুঃখে ব্যথিত হয়ে উঠলেন। কিছু সময় পরে নিজে সংযত চিত্তে মধুসূদন হরিকে স্মরণ-মনন-ধ্যান করতে লাগলেন। এই কঠিন বিপদে মধুসূদনই যে সহায়। সন্ধ্যায় বিদ্যাপতি একটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে রইলেন। হঠাৎ তিনি শুনতে পেলেন কারা যেন কাছেপিঠেই চলাফেরা করছে। ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি সতর্ক হয়ে বনপথের ওপর পাতার মর্মর ধ্বনি শুনতে লাগলেন। সেই শব্দ আরও কাছে এলে আরও একটি শব্দ শোনা গেল, মেয়েদের পায়েলের শব্দ। বিদ্যাপতি অবাক হয়ে গেলেন। এমন ঘনঘোর সন্ধ্যায় বনের পথে এমন ধ্বনি কার? কাছাকাছি কি কোন মানুষ রয়েছে, নাকি এ তাঁর ভ্রম? আওয়াজ শুনে সেই পথেই এগিয়ে গেলেন বিদ্যাপতি। দেখলেন এক নারী এই বনপথে নির্দ্বিধায় চলেছেন, এই বন যেন তাঁর কতকালের চেনা। এই নারীর বেশভূষা ও শৃঙ্গার দেখেই বিদ্যাপতি বুঝতে পারলেন তিনি অনার্য জাতিকা। বিদ্যাপতি নিজে এগিয়ে গিয়ে সেই নারীর সঙ্গে আলাপ করলেন এবং নিজের আপাত সংকটের কথা বিস্তারিত বললেন।সব কথা শুনে তাঁকে উদ্ধার করলেন সুন্দরী শবর কন্যা। তিনি শবররাজ বিশ্বাবসুর একমাত্র কন্যা ললিতা। বিদ্যাপতিকে ললিতা নিয়ে এলেন তাঁদের বাড়িতে। তাঁর পিতা শবররাজ বিশ্বাবসু সমস্ত অনার্য জাতির কাছেই শ্রদ্ধার পাত্র। শবরকন্যা ললিতা বিদ্যাপতির সেবা করলেন। ললিতা শবররাজ বিশ্বাবসুর কন্যা বলে শবরসমাজের সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। তাঁর গুণের অন্ত নেই, শবরসমাজে তিনি শ্রেষ্ঠ সুন্দরী। শবরদের গ্রামে সবাই কানাকানি করেন, ললিতা শবর সমাজের রত্ন, তিনি রূপে লক্ষ্মী, গুণে সরস্বতী। শবরকন্যা ললিতার প্রেমে পড়লেন ব্রাহ্মণতনয় বিদ্যাপতি। কিছুদিন শবর সমাজে থেকে শবর সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিলেন বিদ্যাপতি। বিদ্যাপতি ললিতাকে প্রেম নিবেদন করলেন। লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠলেন ললিতা। প্রথমে তাঁদের প্রেম রইল সকলের অগোচরে, তারপর প্রকাশিত হলো সকলের সামনে। কথায় আছে, গোপনে প্রেম রয় না ঘরে, আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে। এঁদের ক্ষেত্রেও তেমন হলো। শবররাজ বিশ্বাবসু প্রমাদ গুণলেন। ব্রাহ্মণ ও শবরের প্রেম আর্যরা স্বীকৃতি দেবে কখনও? এই একটি সংশয়ই তাঁকে কষ্ট দিতে লাগল। তিনি তাঁর আরাধ্য দেবতা নীলমাধবের কাছে গিয়ে মনের সমস্ত কথা বললেন। নীলমাধব বিগ্রহ তাঁর কাছে এক অদ্ভুত বার্তা এনে দিলেন। বিশ্বাবসু বিদ্যাপতি ও ললিতার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ বিষয়ে নীলমাধবের কাছে সম্মতি চাইলেন। নীলমাধবের বিগ্রহ থেকে আশীর্বাদী একটি সাদা ফুল আর একটি লাল ফুল গড়িয়ে পড়ল ধ্যানমগ্ন বিশ্বাবসুর হাতে। বিশ্বাবসু বুঝতে পারলেন নীলমাধব বিদ্যাপতিকে বিদ্যাপতি ও ললিতার সম্পর্কের ভবিষ্যৎ বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন। দুখানি ফুল মাথার কাপড়ে বেঁধে গ্রামে ফিরে এলেন শবররাজ বিশ্বাবসু। বিশ্বাবসু বুঝতে পেরেছেন, জাতপাত জাতিভেদ বর্ণভেদ এসব ঈশ্বরের সৃষ্টি নয়। ঈশ্বরের কাছে সকলেই সমান। মানুষে মানুষে যাবতীয় বিভেদ মানুষেরই তৈরি। নীলমাধবের সম্মতি নিয়ে, আশীর্বাদ পেয়ে একটা শুভ দিনের শুভ তিথিতে বিবাহ হলো বিদ্যাপতি ও ললিতার। ঈশ্বরের সেবায় নিবেদিত দুটি ভক্তের মনের মিল তো আগেই ঘটেছিল, এবারে ঘটল ব্রতের মিল। বিবাহের পরে সস্ত্রীক বিদ্যাপতি শবররাজ্যেই থেকে গেলেন। কিছুদিন পর বিদ্যাপতি আবিষ্কার করলেন রোজ ভোরে, দুপুরে, সন্ধ্যায় ও রাতে শবররাজ বিশ্বাবসু কয়েক ঘণ্টার জন্য কাউকে কিছু না বলে কোথাও যেন উধাও হয়ে যান। অনেকটা সময় পর তিনি আবার গ্রামে ফিরে আসেন, শবরদের রাজা হিসেবে তাঁর যাবতীয় কার্যকলাপ করেন। কিন্তু কোথায় যান বিশ্বাবসু কেউ জানেন না। এমনকি ললিতাও জানেন না তাঁর বাবা প্রতিদিন কোথায় চলে যান, সেখানে কিভাবে যান তিনি, আর কেন তিনি রোজ একাই যান সেটিও তিনি জানেন না। এদিকে বিদ্যাপতি লক্ষ্য করতে থাকেন বিশ্বাবসুকে। বিদ্যাপতি দেখেন পৃথিবীতে যদি প্রলয়ও কোনোদিন আসে তাতেও বিশ্বাবসুর এই নিয়মমাফিক গোপন ধীরগমন রোধ হওয়ার নয়। একদিন ললিতাকে একান্তে পেয়ে প্রশ্ন করতে বিদ্যাপতি জানতে পারলেন গভীর ঘন জঙ্গলের মধ্যে একটি গোপন পবিত্র জায়গায় আরাধ্য দেবতা নীলমাধবের পূজা করতে যান তাঁর বাবা শবররাজ বিশ্বাবসু। ললিতা আরও জানান, তাঁর বাবা নীলমাধবকে নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। এমনকি নিজের প্রাণের বিনিময়ে পর্যন্ত নীলমাধবের সেবাপূজার অধিকার আর কাউকে ছেড়ে দিতে পারবেন না। নীলমাধব তাঁর একান্ত সাধনা নেওয়ার জন্য আবির্ভূত হয়েছেন। নীলমাধব দিব্যবিগ্রহের ব্রতদাস বিশ্বাবসু। নীলমাধব প্রভু সমগ্র পৃথিবীতে একমাত্র শবররাজ বিশ্বাবসু ছাড়া আর কোনো মানুষের দৃষ্টিগোচর হননি। এমনকি ললিতাও দেখেননি নীলমাধবকে‌। নীলমাধবকে রোজ গভীর রাতে পূজা দিতে আসেন স্বর্গের দেবতারা। বিশ্বাবসুর সঙ্গে দেবতা নীলমাধবের এই অদ্ভুত সম্পর্কের কথা বাইরের কারও প্রকাশ্যে আসে না। বিশ্বাবসুও নিজের বিশুদ্ধ ভক্তির লোকদেখানো কোনো আচার অনুষ্ঠান করেন না। তিনি শবররাজ, মননে পরম বৈষ্ণব হয়েও সাধারণ মানুষের মতোই থাকেন। স্বধর্ম তিনি ত্যাগ করেননি। স্বধর্মে স্থির থেকেই তিনি নীলমাধবকে এত পেয়েছেন। তাঁকে পেতে হলে শুধু তাঁকে ধরে থাকতে হয়, কিছুই ছাড়তে হয় না। নীলমাধব জগন্নাথ এতটাই উদার দেবতা, এতটাই সবাইকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখেন। ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতি সবকিছু শুনে অবাক হয়ে গেলেন। এই অনুভূতি তাঁর আগে হয়নি। শাস্ত্র যতদূর বর্ণিতে পারে, বিশ্বাবসু যে তার থেকে অনেক এগিয়ে বসে আছেন। বিশ্বাবসু ও নীলমাধবের সম্বন্ধ যে শাস্ত্রোত্তীর্ণ। পৃথিবীতে কত শত শাস্ত্রজ্ঞ বৈষ্ণব রয়েছেন, কিন্তু বিশ্বাবসুর মতো এত অনায়াসে কে নীলমাধব বিষ্ণুকে কাছে পেয়েছেন! বিদ্যাপতির মনে বিচার আসল, শাস্ত্র তো আরাধ্যের কাছে পৌঁছানোর একটি পথ, আগে শাস্ত্র জেনে ঈশ্বরকে জানতে হয়। ঈশ্বরকে চেনার জন্য শাস্ত্র পড়া। ঈশ্বরকে পাওয়া হয়ে গেলে তখন আর শাস্ত্রের কিসে প্রয়োজন। তাঁর মনে বিচার এলো, ঈশ্বরই প্রয়োজন, শাস্ত্র তো বাহ্য বিষয়। আর শবররাজ বিশ্বাবসু ঈশ্বরকে সরাসরিই পেয়েছেন। তাঁর আর শাস্ত্রের প্রয়োজন কী! নীলমাধব স্বয়ং তাঁকে কৃপা করেছেন, তাঁর কাছে প্রকাশিত হয়েছেন। নীলমাধব স্বয়ং শাস্ত্র-সার। নীলমাধব শুধুমাত্র একটি বিগ্রহে সীমাবদ্ধ নন, তিনি অনন্ত প্রকাশমান। বিদ্যাপতি আরও কত কিছু মনে মনে ভাবতে শুরু করলেন। ভাবতে ভাবতে তাঁর প্রাণ আকুল করে উঠল। নীলমাধবের সন্ধানেই তাঁর এখানে আসা। সেই কাজ করতে এসে প্রেম ও দাম্পত্যের বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছেন বিদ্যাপতি। যেন সেই মূল উদ্দেশ্য আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন স্বয়ং নীলমাধব। এবারে নীলমাধবের সন্ধান যখন নিশ্চিতভাবে পাওয়া গেছে তখন আর সময় অপচয় করে লাভ নেই। এদিকে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নকে কথা দিয়ে এসেছেন তিনি এক বছরের মধ্যে নীলমাধবের সংবাদ তিনি পৌঁছে দেবেন ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে। এক বছর হতে তো আর বেশিদিন নেই।

BENGALI ARTICLE

একদিন মধ্যযামে সুযোগ মতো বিদ্যাপতি তাঁর স্ত্রী ললিতার কাছে অনুযোগ করলেন তিনিও দর্শন করবেন দিব্যবিগ্রহ নীলমাধবকে। বিদ্যাপতির এই অভিনব আবদারে ললিতা প্রথমে সম্মতি দিলেন না। কিন্তু প্রেমের বশ্যতায় তিনি নমনীয় হলেন। তিনি জানতেন তাঁর পিতা শবররাজ বিশ্বাবসু কোনোভাবেই শবরসমাজে বহিরাগত কাউকে নীলমাধবের দর্শন করতে দিতে চাইবেন না। একদিকে পিতা ও অন্যদিকে পতি, ললিতা মনের দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলেন। মনের সংশয় কাটিয়ে তিনি পিতার কাছে গিয়ে বললেন তাঁর কাছে তাঁর স্বামী বিদ্যাপতি নীলমাধবের দিব্যবিগ্রহের দর্শন আকাঙ্ক্ষা করেছেন। শবররাজ বিশ্বাবসু ললিতার এই প্রস্তাবে প্রথমে রাজি না হলেও, অবশেষে কন্যার স্বামীপ্রেমের প্রতি দুর্বল হয়েই শবর সমাজের বাইরে থেকে আগত ব্রাহ্মণ বিদ্যাপতির নীলমাধব বিগ্রহের দর্শনে নিমরাজি হয়ে মত দিলেন, তবে তিনি মত প্রদান করলেন নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে। ললিতা ও বিদ্যাপতির গৃহ থেকে নীলমাধবের বিগ্রহ পর্যন্ত সমস্ত যাত্রাপথই কালো মোটা কাপড়ে ভালো শক্ত করে দুই চোখ বেঁধে পথে যেতে হবে জামাতা বিদ্যাপতিকে। কারণ একটাই, নীলমাধবের গোপন অবস্থানভূমিকে চিনিয়ে দিতে সম্পূর্ণ নারাজ তিনি। নীলমাধব শুধুমাত্র বিশ্বাবসুর একান্ত পূজা লাভের জন্যই এখানে অবস্থান করছেন। একান্ত সাধনার অধিকার বিশ্বাবসু হারাতে চান না। নিজের একমাত্র জামাতা হলেও বিদ্যাপতিকে কোনোভাবে নীলমাধবের সন্ধান দিতে রাজি নন বিশ্বাবসু। অন্যদিকে বিদ্যাপতিও এত সহজে ছাড়ার পাত্র নন। তিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে নীলমাধবের সন্ধান দিতে পারুন বা না পারুন, নিজে একবার অন্তত প্রাণভরে নীলমাধবের দর্শন করতে চান। নীলমাধব যে সাক্ষাৎ মুক্তিদাতা, মর্তলোকে বিষ্ণুর প্রথম জীবন্ত সাকার বিগ্রহ। ললিতার নিয়ে আসা বিশ্বাবসুর শর্তসাপেক্ষ বার্তাতেই বিদ্যাপতি যেন নতুন আশার আলো দেখতে পেলেন। তিনি ললিতাকে বললেন, তিনি চোখ বাঁধা অবস্থায় সমস্ত পথও খালি পায়ে হেঁটে যেতে রাজি আছেন। কিন্তু একবার তো শ্বশুর মশাই তাঁকে নীলমাধব দর্শন করাতে নিয়ে যাচ্ছেন, যদি একবার মাত্র দর্শন করে মন না ভরে তবে রোজ কীভাবে তিনি দেখবেন নীলমাধবকে! স্বামীর মনোভাব বুঝতে পেরে ললিতাও চিন্তায় পড়ে গেলেন।

অবশেষে বিদ্যাপতির জীবনে সেই পবিত্র শুভদিন এলো। পূর্বকথা মতো সেদিন ভোররাতে সামান্য অন্ধকার থাকতে থাকতে বিশ্বাবসু এলেন জামাতার গৃহের দ্বারে, এসে ললিতা ও বিদ্যাপতির নাম ধরে ডাকলেন। তাঁরা বাইরে এলে বিশ্বাবসু বললেন শুভক্ষণ উপস্থিত এবার রওনা হতে হবে। শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত বিদ্যাপতিকে আগের শর্ত অনুযায়ী ভালো করে কালো রঙের মোটা কাপড়ে চোখ বাঁধা অবস্থায় নীলমাধবের কাছে নিয়ে চললেন শবররাজ বিশ্বাবসু। সরলমতি বিশ্বাবসু বুঝতে পারেননি তাঁর জামাতা এই শর্ত বজায় রেখেও তাঁকে ছল করতে পারেন। আর্য বিদ্যাপতি চতুর মানুষ, তাঁর পক্ষে অনার্য সরলমতি এক বৃদ্ধ শবরকে ঠকানো কোনো ব্যাপারই নয়। ভক্ত হলেই বোকা হতে হয় না, অথচ জামাতাকে বিশ্বাস করে শবররাজ বিশ্বাবসু সেই ভুল করেছিলেন। তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি তাঁর একমাত্র জামাতাই তাঁকে এভাবে ছল করতে পারেন। বিদ্যাপতি গৃহ থেকে রওনা হওয়ার সময়েই একটি ছোট্ট পুঁটলিতে করে কয়েক মুঠো পরিপক্ক সরষের দানা নিজের পরনের কাপড়ের খুঁটে অতি সাবধানে সকলের চোখের আড়ালে বেঁধে নিয়েছিলেন। তারপর সেই পুঁটলিতে অনেকক্ষণ ধরে শস্য ধীরে ধীরে মাটিতে পড়ার উপযোগী একটা ছোট ছিদ্র করে নিয়েছিলেন। বিদ্যাপতির গৃহের বাইরে থেকেই ছোট পুঁটলি থেকে পাকা সরষের দানাগুলি অল্প অল্প করে পথে পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু প্রকৃতির আলো আঁধারে সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সরষের দানার পতনের দৃশ্য কেউ দেখতে পাননি। তিনি সমগ্র পথে সরষের দানা ছড়াতে ছড়াতে গেলেন। একসঙ্গে পথ চলেও শবররাজ বিশ্বাবসু বিদ্যাপতির চক্রান্ত কিছুই বুঝতে পারেননি। বিদ্যাপতি ভেবেছিলেন এই সরষের দানা থেকে বর্ষায় প্রাকৃতিক উপায়ে গাছ বের হলে নীলমাধব বিগ্রহের বর্তমান অবস্থানভূমির খোঁজ পাওয়া সহজ হবে। বিদ্যাপতি জানতেন ছোট ছোট সরষের দানা থেকে খুব দ্রুত গাছ বের হয়। তাছাড়া সরষে ফুলের উজ্জ্বল হলুদ রঙ খুব সহজেই দূর থেকে চোখ পড়ে। এর ফলে পথ চিনতেও সুবিধা হবে।

ধীর গতিতে বিদ্যাপতির কাপড়ের আড়ালে বাঁধা সরষের পুঁটলি থেকে সরষের দানা পড়তে থাকল সমস্ত যাত্রাপথে। সরষের দানাগুলি ছোট ও হালকা বলেই বৃদ্ধ বিশ্বাবসু এত বড় ষড়যন্ত্রের বিন্দুমাত্র কিছুই টের পেলেন না। শবররাজ বিশ্বাবসুর সঙ্গে চোখ বাঁধা অবস্থায় যথাস্থানে পৌঁছে যখন বিদ্যাপতি দর্শন পেলেন স্বয়ং নীলমাধবের। তখন তাঁর মন-প্রাণ-চেতনা সবকিছু আনন্দে ভরে উঠল। নীলমাধবের অপরূপ রূপের দিকে চেয়ে তিনি আনন্দে অধীর হয়ে উঠলেন। আর শবররাজ বিশ্বাবসু তাঁর জামাতা বিদ্যাপতির এই তন্ময় অবস্থা দেখে নিশ্চিন্ত হলেন, তাঁর অবর্তমানে নীলমাধবের প্রধান উপাসক তিনি পেয়ে গেছেন। তাঁর জামাতাই হবেন নীলমাধব বিগ্রহের পূজারী। বিশ্বাবসুর কায়িক মৃত্যুর পরেও নীলমাধব আর শবরপল্লী থেকে কোথাও যাবেন না। গভীর বনের মধ্যে পুজোর সমস্ত উপকরণ আগে থেকেই জমা ছিল। শুধু সুগন্ধযুক্ত বনের সুন্দর সুন্দর ফুল আর মিষ্ট ফল সংগ্রহ করে এনে শবররাজ বিশ্বাবসু যখন নীলমাধব বিগ্রহের পূজায় বসলেন ঠিক তখনই আকাশমার্গে একটি দৈববাণী হলো। নীলমাধব এতদিন শবররাজ বিশ্বাবসুর একান্ত পূজা প্রদানের শর্তপাশে আবদ্ধ ছিলেন, এবার তিনি সকলের সামনে প্রকাশিত হতে চান, সকলের সামনে প্রকাশিত হয়ে সকলের কাছে পূজা পেতে চান। ভবিষ্যতে এক আর্যরাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নীলমাধবের সন্ধানে আসবেন, তিনিই হবেন সাকার বিষ্ণু নীলমাধবের নবরূপে নববেশের পূজার প্রচারক। আর যে বিদ্যাপতি এখন শবররাজের জামাতা তিনিই সেই মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নর দূত, তাঁরই প্রতিনিধি। দৈববাণীর মাধ্যমে সমস্ত গোপন কথা জানতে পেরে ভীষণ রেগে গেলেন শবররাজ বিশ্বাবসু। আর বিদ্যাপতি সমস্ত সত্য প্রকাশিত হয়ে যাওয়ায় তিনি পূজাস্থলে মাথা নিচু করে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইষ্টদেবতাকে আসন্ন হারাবার দুঃখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন শবররাজ। তিনি ভুলে গেলেন বিদ্যাপতি তাঁর জামাতা, তিনি বন্দী করলেন শবরসমাজের ভাবীকালের এই অপূরণীয় ক্ষতিসাধক বিদ্যাপতিকে। বিশ্বাবসু বিদ্যাপতিকে অভিশাপ দিলেন, যথার্থ সাধক ভিন্ন যদি কেউ নীলমাধবের সন্ধান করে এই পর্যন্ত চলে আসেন, তবেও সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। নীলমাধব কারও ক্ষমতার দাস নন। নীলমাধব কারও অধীন নন। কিন্তু মনে মনে চিন্তা করলেন, যা ভবিতব্য তাকে প্রতিরোধ করার জন্য কোনো পার্থিব ক্ষমতাই যথেষ্ট নয়। বিদ্যাপতিকে আটক করে রাখলেও নীলমাধব শবরপল্লী ত্যাগ করে যাবেন, বিদ্যাপতিকে মুক্ত করলেও একই ঘটনা ঘটবে। একে আটকানোর মতো কোনো ক্ষমতা তাঁর নেই। শবররাজ বুঝলেন তিনি বিদ্যাপতিকে আটকে রেখে কন্যা ললিতার প্রতিই বড় অন্যায় করছেন। ললিতাও বিদ্যাপতির এভাবে হঠাৎ বন্দী হওয়ার সংবাদ পেয়ে তিনিও বিশ্বাবসুর কাছে এসে বারবার কাকুতি মিনতি করতে লাগলেন। জামাতাকে মুক্ত করে দিলেন শবররাজ। এই ঘটনার পর বিদ্যাপতি আর শবররাজ্যে থাকতে চাইলেন না। তিনি ললিতার সঙ্গে গমন করলেন অবন্তীর পথে। পদব্রজে যাত্রা করে বিদ্যাপতি অবন্তী নগরে এসেই সঙ্গে সঙ্গে নীলমাধবের সংবাদ পৌঁছে দিলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে। রাজা ও রানি দুজনেই ধর্মপ্রাণ। নীলমাধব বিগ্রহের সংবাদ পেয়েই তাঁরা বিষ্ণুস্মরণ করলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মনে মনে ভাবলেন, পৃথিবীতে তিনি শ্রেষ্ঠ রাজা। তাঁর মনে জন্ম নিল নিজের ক্ষমতার অহংকার, বৈষ্ণবীয় ভক্তির অহংকার। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ভাবলেন মর্তলোকে সর্বফলপ্রদ নীলমাধব তাঁর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পাবেন সর্বজনীন দেবতা রূপে। তাঁর ক্ষমতার সামনে কোনো প্রতিবন্ধকই ঠাঁই পাবে না। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নিজেই চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে মহানন্দে পূর্বভারত অভিমুখে অভিযাত্রা করলেন। নীলগিরির শবরপল্লীতে পৌঁছে তিনি ঘিরে রাখলেন সমস্ত শবরদের। সেনাবাহিনীর অজস্র মানুষের ভিড়ের মধ্যেই শবররাজ বিশ্বাবসু অনায়াসে বিদ্যাপতিকে চিনতে পারলেন এবং সব বুঝে মনে মনে হাসলেন। যে রাজার ক্ষমতার এত অহংকার সেই রাজা আর যাই পান স্বয়ং বিষ্ণুর নীলমাধব বিগ্রহের সাক্ষাৎ পাবেন না। নীলমাধব সাধনার ধন। গায়ের জোর দিয়ে, ক্ষমতার দম্ভ দিয়ে তাঁকে পাওয়া যায় না। শবররা বুঝতে পারলেন তাঁদের আরাধ্য নীলমাধবকে কেড়ে নিতে এসেছেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। সবাই ‘নীলমাধব, নীলমাধব, নীলমাধব’ বলে হাহাকার করতে লাগলেন। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের নির্দেশে কড়া দৃষ্টিতে তাঁদের আটক করে রাখা হলো, কেউ যেন নীলমাধব বিগ্রহ অন্যত্র সরিয়ে না চলে যায়। বিদ্যাপতি সরষের বীজ থেকে জন্ম নেওয়া নতুন গাছগুলি দেখে চিনতে পারলেন। তাতে ছোট ছোট হলুদ রঙের উজ্জ্বল ফুল ফুটেছে। এই তাঁর রেখে যাওয়া চিহ্ন। সরষের গাছ ধরে ধরে সেই গুপ্তসাধনার গুহার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন বিদ্যাপতি, ইন্দ্রদ্যুম্ন ও তাঁর সহকারীগণ। তাঁরা সকলেই সাড়ম্বরে নীলমাধবকে রাজকীয় রাজপ্রাসাদের সুন্দর বিরাট ভব্যমন্দিরে নিতে যেতে চান। নীলমাধবকে আনতে তাই এত আয়োজন, এত উৎসাহ। গুহায় প্রবেশ করেই বিদ্যাপতি চিনতে পারলেন এই সেই নীলমাধবের গুপ্তগুহা। কিন্তু একি কাণ্ড দেখছেন তিনি! নীলমাধব কোথাও নেই! বদলে পড়ে আছে কয়েক লক্ষ রাজার সমান ধন সম্পদ। নীলমাধব নেই! তাঁর চিহ্নমাত্র নেই। ক্রমে সকলের চোখের সামনেই নিমেষে সমস্ত ধন-সম্পদ কর্পূরের মতো উবে গেল। ক্রমে সেই গুহাও লুপ্ত হয়ে গেল। একটু আগে যেখানে এতকিছু ছিল সেখানে এখন চারিদিকে শুধু বালি আর বালি, শূন্য আর শূন্য চারিদিকে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন এবার প্রমাদ গুণলেন। কাদের আটক করেছেন তিনি! এঁরা কি সকলে যাদু বা মায়া জানেন? এমন সময় দৈববাণী হলো, মহারাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর দোষেই এই অঘটন ঘটেছে। অহংকারের কণামাত্র থাকলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। ঈশ্বরকে পেতে হলে আমিত্বের অহংকার নাশ করতে হয়। আর নীলমাধব এতদিন শবরদের সঙ্গে থেকেছেন শবররা তাঁর প্রিয়জন। তাঁদের কষ্ট দিয়ে রাজা পাপের ভাগীদার হয়েছেন। নীলমাধব বিগ্রহ আর ফিরে পাওয়া যাবে না। যদি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন নিজেকে সংশোধন করে শবররাজ বিশ্বাবসুর আশীর্বাদ লাভ করতে পারেন তবে একদিন নীলগিরির দক্ষিণে মহাসমুদ্রে ভেসে আসবেন মহাদারু। তা থেকে নতুনভাবে তৈরি হবে নীলমাধব তথা বিষ্ণুর নতুন সাকার বিগ্রহ। দেবতার সেই নববিগ্রহ পরিচিত হবেন স্বয়ং দারুব্রহ্ম পুরুষোত্তম জগন্নাথ নামে। আর শবররা হবেন জগন্নাথের নিজের লোক, জগন্নাথের নিজের গণ। তাঁদের অধিকার থাকবে জগন্নাথের ওপর। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নর সমস্ত ভ্রান্তি ঘুচে গেল। তিনি বুঝতে পারলেন নিজের অজ্ঞাতেই কত বড় ভুল হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিদ্যাপতির ওপর পতিত বিশ্বাবসুর অভিশাপ এভাবেই লুপ্ত হয়ে গেল। শবরপল্লীতে ফিরে এসে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সকলকে মুক্ত করে দিলেন। তিনি নিজে নতজানু হয়ে ক্ষমা চাইলেন বৃদ্ধ শবররাজ বিশ্বাবসুর কাছে। বিশ্বাবসু ইন্দ্রদ্যুম্ন ও বিদ্যাপতিকে ক্ষমা করে দিলেন। দৈববাণী সকলের জ্ঞাত হলো। কিন্তু বিশ্বাবসু দুঃখে ব্যথিত হৃদয়ে প্রায় বোবা হয়ে গেলেন। আজ যা তিনি হারিয়েছেন তা বহু সাধনার পরেও সহজে কেউ পায় না।

সকলের থেকে বিদায় নিয়ে গভীর বনের মধ্যে প্রবেশ করলেন। সেখানে তিনি একটি বড় চার শাখা বিশিষ্ট কৃষ্ণবর্ণের নিমগাছের নিচে ধ্যানে বসলেন। এই গাছটি অপূর্ব। এর একটি পাতাও নষ্ট হয়নি, কোনো পোকা গাছকে স্পষ্ট করেনি। বিশ্বাবসু্র ধ্যান জমে উঠল। বাহ্য পৃথিবীর সমস্ত বোধ তাঁর লুপ্ত হলো। ধ্যান ভঙ্গের পর বিশ্বাবসুর অনুভব হলো এই পৃথিবীর কণায় কণায় রয়েছেন নীলমাধব। নীলমাধব আর শুধুমাত্র বিগ্রহে সীমাবদ্ধ নেই, তিনি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছেন। বনের মহামহীরূহ থেকে শুরু করে বনপথের ধুলো সব সেই নীলমাধব। তাঁর হৃদয়ে বিরাজমান নীলমাধব। এই পৃথিবী, বায়ু, জল, আকাশ, অগ্নি সবকিছু নীলমাধব। নীলমাধবই সবকিছু হয়েছেন। সর্বত্র অখণ্ড নীলমাধব ছাড়া কোথাও আর কিছু নেই। শবররাজ আর শবররাজ নেই। তিনি এখন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ। অন্যদিকে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞের শেষ দিনে পূর্ণাহুতি দানের ঠিক আগে সংবাদ এলো এক বিরাট মহাদারু ভেসে আসছে। সেই দারুতে শঙ্খ ও চক্র চিহ্নিত রয়েছে। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন সেই দারুকে আনানোর সমস্ত আয়োজন করলেন। রাজার চতুরঙ্গ সেনা গিয়েও মহাসমুদ্র থেকে সেই পবিত্র নিমদারু তুলতে অক্ষম থাকলেও। রাজার কাছে সংবাদ গেল। তিনিও চেষ্টা করে অক্ষম হলেন। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন শবররাজ বিশ্বাবসু। পরনে তাঁর কষায় বস্ত্র। তিনি সব বুঝে বিদ্যাপতিকে নির্দেশ দিলেন মহাদারুর একদিন ধরার, অন্যদিকে তিনি মহাদারু ধরলেন। আলতো হাতে তোলার সঙ্গে সঙ্গে উত্থিত হলো মহাদারু। এতক্ষণ ধরে যে মহাদারু চতুরঙ্গ সেনা দিয়ে তোলা যাচ্ছিল না, সেটিই এবার এত সহজে উঠে আসায় সবাই বিশ্বাবসু ও বিদ্যাপতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠলেন। প্রকাশের দিনই জগন্নাথের মহাদারু সকলের কাছে প্রমাণ রাখলেন, তাঁর কাছে ব্রাহ্মণ-শববের কোনো ভেদাভেদ নেই। জগন্নাথ কারও একার নয়, তিনি সবার। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা প্রজাপতি থেকে সামান্য কীট পরমাণু প্রত্যেকের অধিকার রয়েছে তাঁর ওপরে। তাঁর কাছে যাঁর যেমন ভাব তাঁর তেমন লাভ।

Jagannath Idol

মহাসমুদ্রে ভেসে আসা দারু সংগ্রহ ও সংরক্ষণের পর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ব্যাকুল হয়ে উঠলেন জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাণের জন্য। তিনি তাঁর রাজ্যের বাছাই করা সূত্রকারদের সভায় ডেকে পাঠালেন। মহারাজ তাঁর সেই বরণীয় দারুশিল্পী তথা কারিগরদের লাগালেন নীলমাধব জগন্নাথের দারুমূর্তি গড়তে। নগরের বাছাই করা শিল্পীরা দারু দেখে মুগ্ধ হলেন। কিন্তু সেই দিব্যদারু এমনই পাথরের মতো শক্ত যে তাঁদের শিল্পকলার প্রধান অস্ত্র ছেনি, হাতুড়ি সহ সমস্ত যন্ত্র ভেঙে যাওয়ার অবস্থা দেখা দিল। তাঁরা সকলেই একে অপরের দিকে চেয়ে দেখে বুঝলেন এই দারুতে সামান্যতম আঁচড়াতেও তাঁরা সকলেই অক্ষম। এই কাজ তাঁদের সাধ্যের অতীত। এখন তা হলে উপায় কী? জগন্নাথের মূর্তি এবার গড়বে আর কে? তবে আর কীভাবে ঘটবে জগন্নাথ বিষ্ণুর সাকার বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা? রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর আহ্বানে সমগ্র আর্যাবর্তের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কারিগর এলেন, এঁদের মধ্যে কেউই সক্ষম হলেন না। ক্রমে দেশ-বিদেশে বার্তা গেল। কত শিল্পী এলেন, দেখলেন ও ফিরে গেলেন। কেউই কাজটি করতে সক্ষম হতে পারলেন না। বিগ্রহ নির্মাণ করতে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্নর মনের আকুলতা দেখে ও জগন্নাথের আদেশে জরাজীর্ণ এক বৃদ্ধ শিল্পীর ছদ্মবেশে এবার ইন্দ্রদ্যুম্নর সভায় এসে হাজির হলেন সমগ্র শিল্পী সমাজের আরাধ্য স্বয়ং দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। তিনি রাজাকে বললেন, তিনিই গড়বেন জগন্নাথের সাকার রূপ, স্বয়ং পুরুষোত্তম দেবতার মূর্তি। মহারাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আশ্চর্য হলেন এত বড় বড় সমর্থ ও অভিজ্ঞ শিল্পী যেখানে নিরস্ত্র হয়েছেন, সেখানে এক বৃদ্ধ শিল্পী পারবে লোহার চেয়েও শক্ত এই দিব্য মহাদারু থেকে দেবতার বিগ্রহ তৈরি করতে! তবু রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আগত সেই বৃদ্ধ সূত্রধরকে বললেন তাঁর সভার সকলের সামনে পবিত্র মহাদারুতে শিল্পসৃজনের উপকরণ দিয়ে একটি দাগ বসিয়ে নিজের ক্ষমতার প্রমাণ দিতে। ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মার ছেনি স্পর্শ করা মাত্রই মহাদারুতে প্রথম আঁচড় পড়ল। এই দৃশ্য দেখেই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁকে থামিয়ে দিলেন। এবং সেই বৃদ্ধ সূত্রধরকে আর নিজের ক্ষমতার পরিচয় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই সেটিও জানিয়ে দিলেন। বৃদ্ধ সূত্রধরই মূর্তি নির্মাণ করার দায়িত্ব পেলেন। তবে তিনিও এবার রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর কাছে একটি শর্ত রাখলেন। এখানে ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মা শর্ত রাখলেন মাত্র একটাই, সর্বমোট একটানা একুশ দিন ধরে একটি ঘরে তিনি অবিরাম কাজ করবেন। এর একুশ দিনের আগে তিনি নিজে কোনো প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে রুদ্ধ কক্ষের প্রধান দরজা খুলে সেই মূর্তিনির্মাণ কক্ষের বাইরে আসার আগে পর্যন্ত কেউ যেন ভুশেও তাঁর কাজের ঘরের ধারে কাছেও না আসে, দরজা খোলার চেষ্টা না করে। যদি কোনোভাবে এই শর্ত লঙ্ঘন করা হয়, তবে সেই অবস্থাতেই তিনি কাজ বন্ধ করে দেবেন। তাতে যদি মূর্তি নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়, তাতেও বৃদ্ধ সূত্রধরের কিছু করার থাকবে না। একপ্রকারের নিরুপায় হয়েই রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছদ্মবেশী বিশ্বকর্মার এই শর্তে সম্মতি প্রদান করে, সূত্রধরের শর্তাধীন হয়ে গেলেন। সূত্রধরের সমস্ত প্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রভৃতি পৌঁছে দিয়ে বাইরে থেকে মহাদারুর ঘরের দুয়ার বন্ধ করে দেওয়া হলো। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন স্বয়ং সেই ঘরে চাবিকাঠি নিজের কাছে সযত্নে তুলে রাখলেন। এই একুশ দিনে কেউ যেন অযথা সেই বৃদ্ধ সূত্রধরকে বিরক্ত না করে এবং রুদ্ধদ্বার কক্ষের কাছাকাছি কোথাও অযথা কোনো শোরগোল না করতে পারে তার যথাযোগ্য নিরাপত্তা মোতায়েন করলেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। শুরু হল ছদ্মবেশী দেবশিল্পী বিশ্বকর্মার নিপুণ হাতের কাজ। দরজার বাইরে থেকে শুধু শুনতে পাওয়া গেল কাঠের ওপরে ছেনি হাতুড়ির আঘাতের ঠুক্ ঠুক্ ঠাক্ ঠাক্ শব্দ। মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন অনেকাংশে নিশ্চিত হলেন এই বৃদ্ধ সূত্রধরই পারবেন তাঁর স্বপ্নের জগন্নাথ বিগ্রহের নির্মাণ করতে। ইন্দ্রদ্যুম্নের রানি গুণ্ডিচা দেবী প্রতিদিনই বহুবার মূর্তিনির্মাণ কক্ষের দরজায় কান পেতে শুনতে পান কাঠ কাটার বিচিত্র শব্দ। তাঁর মনের ভেতরে আনন্দ উছলে ওঠে। তিনি সুদিনের মুখ চেয়ে থাকেন। রুদ্ধ কক্ষের ভেতর থেকে যত বেশি করে শব্দ বাইরে আসে রানি গুণ্ডিচা দেবী ততই বেশি করে ঈশ্বরের পবিত্র নাম স্মরণ-মনন-ধ্যান করতে থাকেন। এভাবেই কেটে গেল এক টানা চোদ্দ দিন, চোদ্দ রাত। পরদিন ভোর থেকেই রুদ্ধ দরজার বাইরে অনেকক্ষণ বসে থেকেও আর ভেতর থেকে আসা কোনো শব্দ শুনতে পেলেন না রানি গুণ্ডিচা দেবী। তিনি সন্দেহ ভরে বারবার রুদ্ধ দরজায় স্থির হয়ে কান পেতে শুনে দেখলেন রুদ্ধদ্বার কক্ষ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ, কোনো শব্দই যে আর শোনা যাচ্ছে না। রানি গুণ্ডিচা দেবী এবার প্রমাদ গুণলেন, আবার কোনো অঘটন ঘটে গেছে নাকি। শেষে তীরে এসে তরী ডুববে! রানি গুণ্ডিচা দেবী ও রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন উভয়েই চিন্তায় পড়লেন। রানি গুণ্ডিচা অস্থির হয়ে উঠলেন, রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ঈশ্বরকে মনে প্রাণে ডাকতে লাগলেন। কোনোভাবেই যেন আর নতুন করে কোনো ছোট-বড় সমস্যা তৈরি না হয়। জগন্নাথের প্রতিষ্ঠার পথে যেন আর কোনো সমস্যা এসে না দাঁড়ায়। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নও মানসিক যন্ত্রণায় খুব ছটফট করতে লাগলেন। রানি গুণ্ডিচা দেবীও পূজার ঘরে বসে চোখের জল ফেলতে লাগলেন আর আর্তি করে মনের সমস্ত দ্বন্দ্ব কাটানোর জন্য দেবতার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে শেষ পর্যন্ত আর কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে রানি গুণ্ডিচা দেবী রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে দেবতার মূর্তি নির্মাণ কক্ষের দরজা খুলে ফেলতে অনুরোধ করলেন। প্রথমে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন মূর্তি নির্মাণ কক্ষের দরজা খুলতে অসম্মত হলেন। কিন্তু তিনিও নিঃসংশয় হতে পারলেন না। তাঁর মনের মধ্যে দ্বিধা চলতেই লাগল। অবশেষে সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে তিনি বিশ্বকর্মাকে দেওয়া শর্ত ভেঙে খুলেই ফেললেন মূর্তি নির্মাণ কক্ষের প্রধান দরজা। শর্ত ভেঙে দরজা খুলতেই একটা আলোর দীপ্তিতে নিমিষে সকলের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ধীরে ধীরে চোখ সয়ে এলে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও রানি গুণ্ডিচা কক্ষের ভেতরে প্রবেশ করে দেখলেন বৃদ্ধ কারিগর কক্ষের ভেতরে কোথাও নেই, তাঁর যন্ত্রপাতিও কিছু নেই ঘরের ভেতরে, শুধু পড়ে রয়েছে তিনটি রঙহীষ অসমাপ্ত দেববিগ্রহ। সেই অসমাপ্ত দেববিগ্রহের চোখ, কান, নাক, মুখ, হাত, পা কিছুই গড়া হয়নি। এভাবে শর্ত ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে যেন ক্ষমাহীন গর্হিত অপরাধ করে ফেলেছেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। একথা ভেবে মানসিক যন্ত্রণা ও দুঃখে খুবই ভেঙে পড়লেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। অনুতাপের অগ্নিতে দগ্ধ হওয়া ইন্দ্রদ্যুম্নকে দেখে বিষ্ণুরও কষ্ট হলো। ভগবান স্বয়ং তাঁকে দৈবাদেশ দিয়ে জানালেন, এই সমস্ত কাণ্ডই পূর্ব নির্ধারিত ছিল। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তো এই দৈব পরিকল্পনার একজন সামান্য পাত্র মাত্র। ঈশ্বরের ইচ্ছা ভিন্ন একটি পাতাও নড়ে না, সেখানে তাঁর ইচ্ছা ভিন্ন তাঁর অসমাপ্ত মূর্তি গড়া সম্ভব? ভগবান বিষ্ণু এই নতুন রূপেই শ্রীক্ষেত্রে কালে কালান্তরে পূজিত হতে চান। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আদেশ পেলেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার এই অসমাপ্ত বিগ্রহের অঙ্গরাগ করানোর। জগন্নাথের জন্য নির্দিষ্ট হলো নবঘনমেঘ সম শ্যামবর্ণ, বলরামের জন্য নির্দিষ্ট হলো বিষ্ণুশঙ্খ সম উজ্জ্বল শ্বেতবর্ণ ও ভগবতী সুভদ্রার জন্য নির্দিষ্ট হলো অতসীপুষ্প সম পীতবর্ণ। অসমাপ্ত বিগ্রহে প্রাকৃতিক রঙে আঁকা হলো চোখ, মুখ, নাসা ইত্যাদি। প্রাকৃতিক রঙ তৈরি করা হলো আতপ তণ্ডুল থেকে বিশুদ্ধ শ্বেতবর্ণ, ভূষাকালী থেকে বিশুদ্ধ কৃষ্ণবর্ণ, জবাকুসুম থেকে বিশুদ্ধ রক্তবর্ণ, হরিদ্রা থেকে বিশুদ্ধ পীতবর্ণ ও বিল্বপত্র থেকে বিশুদ্ধ শ্যামলবর্ণ। বর্ণে বর্ণে সেজে উঠলেন জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা। জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমার শুভতিথিতে স্নানযাত্রার পবিত্র দিনে মহাসমারোহে পালিত হলো জগন্নাথের জন্মোৎসব। এই তিথিই নির্দিষ্ট হলো জগন্নাথ মহাপ্রভুর জন্মতিথি রূপে। স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা জগন্নাথাদি বিগ্রহের পূজা ও প্রতিষ্ঠা করলেন। শ্রীধাম পুরীক্ষেত্র ক্রমে প্রসিদ্ধ হলো শঙ্খক্ষেত্র নামে। দেবী বিমলার আশীর্বাদে পুরীতে সহজলভ্য হলো জগন্নাথের মহাপ্রসাদ। সেই থেকে মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের পবিত্র দিব্যবিগ্রহ একভাবেই শ্রীক্ষেত্রে পরম শ্রদ্ধায় পূজিত হয়ে আসছে। দারুব্রহ্ম পুরুষোত্তম জগন্নাথ মুক্তিনাথ হয়ে বিরাজ করছেন এখানে। চারধামের মধ্যে তিনি তিনধামে লীলা সংহার করে এখনও লীলাময় হয়ে বিরাজ করছেন নীলাচলে।

অভিজিৎ পাল | Avijit Pal

ট্যাটুর ইতিহাস ও আমরা | History of Tattoo | Reasons for using tattoos | 2023

Advantages & Disadvantages of Tattoo | ট্যাটুর উপকারিতা এবং অপকারিতা | Bengali Article 2023

Is it possible to remove tattoo | ট্যাটু রিমুভ কি সম্ভব? | 2023

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

The legend of Jagannath | Legend of Jagannath Puri | Puri – Legend of Jagannath | History Legend of Jagannath | Legend of Jagannath History | News Legend of Jagannath | Legend of Jagannath in puri | Legend of Jagannath pdf | Pdf book Legend of Jagannath | Legend of Jagannath pdf download | Legend of Jagannath pdf bengali | Legend of Jagannath – temple puri | Legend of Jagannath 2023 | New Legend of Jagannath | Legend of Jagannath – video | Legend of Jagannath video | Legend of Jagannath viral video | New video Legend of Jagannath | Full video Legend of Jagannath | Article Legend of Jagannath | Legend of Jagannath article | Legend of Jagannath article bengali | Legend of Jagannath article pdf | Legend of Jagannath article video | Bengali article – Legend of Jagannath | English Article – Legend of Jagannath | Top article – Legend of Jagannath | Article history – Legend of Jagannath | 2023 article – Legend of Jagannath | Trending article – Legend of Jagannath | Viral article – Legend of Jagannath | Trending videos – Legend of Jagannath | new article – Legend of Jagannath | pdf article – Legend of Jagannath | new song – Legend of Jagannath | long article – Legend of Jagannath | trailer Legend of Jagannath | viral trailer – Legend of Jagannath | video clip – Legend of Jagannath | Legend of Jagannath video clip | new clip – Legend of Jagannath | top clip – Legend of Jagannath | best clip – Legend of Jagannath | short video – Legend of Jagannath | full video – Legend of Jagannath | news – Legend of Jagannath | Legend of Jagannath web story | Shabdodweep Founder | Shabdodweep Web Magazine

Leave a Comment