Kolkata to Kashmir Trip | আবেগের নাম কাশ্মীর | 2023

Sharing Is Caring:

আবেগের নাম কাশ্মীর – সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী [Kolkata to Kashmir Trip]

দীর্ঘদিনের ইচ্ছেরা অবদমিত মনের অন্তরতর গহীন কোণে … একবার কাশ্মীরে যেতে চাই। পা রাখতে চাই  ভূস্বর্গে। পারিবারিক আলাপ আলোচনা ফলপ্রসূ। ঠিক হলো ২০১৩-এর নভেম্বরে যাওয়া হবে কাশ্মীর উপত্যকায়। বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরের সাথে কথাবার্তা বলে কয়ে ঠিক হয়ে গেলো দিনক্ষণ। সমগ্র ভ্রমণসূচীতে আমাদের দুটি কাজ … খুব মন দিয়ে বেড়ানো আর আষ্টেপৃষ্ঠে উপভোগ করা। বাকী যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ট্যুর অপারেটরের। টিকিট কাটা থেকে শুরু করে বাড়ীর স্টেশনে ফিরিয়ে দেওয়া পর্যন্ত। উত্তেজনার পারদ চড়চড় করে চড়ছে যত যাবার দিন এগিয়ে আসছে।

নির্দিষ্ট দিনে বিকেলে শিয়ালদহ থেকে চেপে বসলাম রাজধানী এক্সপ্রেসে। এপথ বহু পরিচিত, তাই জানালা দিয়ে বাইরে না তাকিয়ে থেকে, ডুবে গেলাম ট্রেনে ওঠার মুখে হাতে ট্যুর অপারেটরের ধরিয়ে দেওয়া ঝকঝকে রঙীন ব্রোশিওরটিতে। জম্মু কাশ্মীরের ইতিহাসে মনঃসংযোগ করতে পারলাম না। চোখ টেনে ধরে রাখলো ছবির পর ছবি। কী নয়নাভিরাম! ছবিতেই যদি এমন মনোহরণ, তবে চাক্ষুষে না জানি কী হয়! নিউদিল্লী পৌঁছে গেছি পরের দিন দুপুর হবার আগেই। বিকেলে অমৃতসর শতাব্দী এক্সপ্রেসে চড়ে সেই রাতেই পৌঁছলাম অমৃতসর। পরদিন গাড়ীতে ভ্রমণ অমৃতসর শহরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য… স্বর্ণমন্দির থেকে শুরু করে জালিয়ানওয়ালা বাগ হয়ে বিকেলে ওয়াঘা বর্ডারের ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত রক্ষীদের ফ্ল্যাগ ডাউন অনুষ্ঠান পর্যন্ত। রাতের বিশ্রামটি ভারী গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। পরদিন ভোরেই গাড়ী রওনা হবে কাটরা (জম্মুর) উদ্দেশ্যে। গন্তব্য মাতা বৈষ্ণোদেবী। কাটরায় পৌঁছে খানিক বিশ্রামের পর খুব সামান্য পরিমাণে নৈশভোজের শেষে যাত্রা শুরু হলো, পদব্রজে মাতা বৈষ্ণোদেবী মন্দির দর্শনের উদ্দেশ্যে। পনেরো ষোলো কিলোমিটার রাস্তা শুধু যেতে, চড়াই ভেঙে। খুব অবাক হয়েছিলাম যে আমি রাত দশটায় হাঁটতে শুরু করে, সারারাত হেঁটে ভোর চারটের আশেপাশে পৌঁছে যেতে পেরেছি মন্দির চত্বরে। জয় মাতাদীর দর্শন প্রণাম সেরে ফেরাটা আর অবশ্য খুব সহজ হয়নি। ফিরতি পথে ছ-সাত কিলোমিটার হাঁটার পরে আমার পদযুগল জবাব দিয়েছিলো। বাকী পথ ঘোড়ার পিঠে চড়ে হোটেল পর্যন্ত। ফিরে সকাল এগারোটা থেকে টানা ঘুম, মাঝে একবার খাওয়ার বিরতি নিয়ে। বিশ্রাম জরুরি। পরের ভোরেই গাড়ী ছাড়বে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে। শ্রীনগর, জম্মু কাশ্মীরের রাজধানী শহর। আমার স্বপ্নের শহর। জম্মু ও কাশ্মীরের ইতিহাসও ভারী চমকপ্রদ ও বর্ণময়। তবে এ যাত্রায় সেই মোহময়ী ইতিহাসকে একপাশে সরিয়ে রেখে মন দিলাম প্রকৃতির অকৃপণ হাতে ঢেলে দেওয়া হৃদয় হরণ করা নৈসর্গিক সৌন্দর্যে।

পরদিন সকাল সাতটায় গাড়ীর চলা শুরু হলো… পীরপাঞ্জালের শিরা উপশিরা বেয়ে বেয়ে। কথা হারিয়ে গেছে, পাহাড়ের পর পাহাড়, পেরিয়ে আবার পাহাড়। যতদূর চোখ যায় কেবল পাহাড় আর পাহাড়। দিগন্ত বিস্তৃত পাহাড়চূড়া জমাট বরফে সাদা, তাতে সোনা রোদ পড়ে চকচক করছে গলানো সোনালী ধাতুর মতো। দূরান্তের ঐ পাহাড়রাজিই কি হিমালয়? হ্যাঁ, ঐতো হিমালয়… ট্যুর ম্যানেজারের উত্তর। ক্ষণে ক্ষণে বদলানো দৃশ্যপট। পথের প্রত্যেক বাঁক পেরোলেই নতুন কিছু, অবাক বিস্ময়ে চেয়ে দেখি। সঙ্গী কখনো নাম না জানা নদী, আবার কখনো পাহাড়ের ঢালে সবুজ ধানক্ষেত। কোথাও ঝর্ণার ঝিরঝিরে আওয়াজ কানে আসছে, কিন্তু চোখে ধরা দিচ্ছে না। এই দেখলাম বিয়াসকে, পরক্ষণেই গায়েব। বর্ণনাতীত অপরূপ পথশোভা! জানালা থেকে চোখ ফেরালেই ভয়, এই বুঝি কিছু দেখা বাদ পড়ে গেলো।

পথের দু’ধারে বুনোগাছের মতো বেদানা গাছের সার। পাকা টসটসে ফলগুলি পেকে ফেটে ঝুলে রয়েছে। গাড়ী থেমেছিলো কিছুক্ষণের বিরতি নিতে। ফিরন পরা দুই কিশোর পাহাড়ি পায়ে চলা পথ বেয়ে ছুটে এসে হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো রসালো ফলগুলি, ভারী সুস্বাদু, মিষ্টি… একটু আলাদা রকম। গাড়ীর আবার চলা শুরু। পথের দু’ধারে দু-একটি আপেল বাগান হয়তো ছিলো, কিন্তু তখন অন্য দৃশ্যে হতবাক আমরা।
এক বিশাল ভেড়ার পাল। তারা কিছুতেই পথ ছেড়ে পাশ দেবে না। অগত্যা গাড়ির সারি চলেছে শম্বুক গতিতে তাদের পিছনে। বহুক্ষণ এভাবে চলার পরে ভেড়ার দল ঢুকে পড়লো পথের ধারের কোনো এক গ্রামে, মেষপালক তরুণ দুটিকে অনুসরণ করে। গাড়িগুলো এবার গতি পেলো বটে, তার চেয়েও বেশি গতিতে সন্ধ্যা নামলো। ধীরে ধীরে গাঢ় অন্ধকারের বুক চিরে চলেছে সারি সারি পর্যটক বোঝাই গাড়ি। মাঝেমধ্যে চা-টা খাওয়া আর প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া গাড়ি থামেনি। সকাল থেকে চলতে চলতে ক্লান্তি তখন শরীর জুড়ে। চোখটা লেগে গিয়েছিলো। হঠাৎ হোওওও সোল্লাস চিৎকার। আমাদের গাড়ি তখন চলেছে বানিহাল (জওহর লাল নেহরু) টানেলের মধ্যে। ফোটোগ্রাফি মানা। সেনা পাহারায় টানেল পেরিয়ে আবার খোলা পথে। সমতলের বাসিন্দারা তখন ঠাণ্ডার কামড়ে জবুথবু। গাড়ির সব বন্ধ জানালা দরজার কাঁচের ফাঁক গলে চুঁইয়ে ঢুকে আসছে বরফশীতল বাতাস। রাত দশটার আশেপাশে শ্রীনগর পৌঁছনো গেলো অবশেষে।

ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে রাতের খাওয়া সেরে শুতে মধ্যরাত পার। পরদিন খুব সকালে ওঠা নেই। কারণ শ্রীনগর শহরটাই ঘোরার কথা সেদিন। সকালে চা জলখাবার খাওয়ার পরে বেরিয়ে পড়া গেলো গাড়ী নিয়ে। দ্রষ্টব্যের সংখ্যা অগণিত। যাই দেখি তাতেই অবাক বিস্ময়াভিভূত। প্রধান আকর্ষণীয়গুলির নামই উল্লেখ করছি… শঙ্করাচার্য মন্দির, নেহরু পার্ক,  নিশাত বাগ, শালিমার বাগ, চশমাশাহী, জুম্মা মসজিদ, নাগিন লেক বড়ো মনোলোভা। তবুও এই সময়ে ভূস্বর্গে রঙ-বেরঙের টিউলিপের সমারোহ থাকে না। তবে মরশুমি অন্যান্য অনেক ফুলের বাহার দেখলাম মোগল গার্ডেনে। ডাল লেককে কেন্দ্র করেই শ্রীনগর শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়ানো হলো দিনভর। বিকেলে শিকারা চড়ে ডাললেকে ভ্রমণ, ভাসমান বাজার ও ভ্রাম্যমাণ পশরা থেকে হলো কিছু কেনাকাটা। দেখা হলো চারচিনার দ্বীপও, ডাল লেকের বুকে। শুনলাম আর কিছুদিনের মধ্যেই ডাললেকের জল জমে কঠিন বরফে পরিণত হবে। তখন জমে যাওয়া ডাল লেকের বুকে শিকারার বদলে চলবে সাইকেল, ক্রিকেট খেলা হবে। প্রকৃতির কী নিদারুণ খেয়াল! ভূস্বর্গ কাশ্মীরের রূপ ঋতুতে ঋতুতে আমূল বদলে যায়। তাই বোধহয় কাশ্মীরের এই বৈচিত্র্যময় রূপই কাশ্মীরকে ভূস্বর্গের শিরোপা দিয়েছে। মোগল গার্ডেনগুলি পরিদর্শনের সময় পর্যটকদের অবশ্যই উচিৎ হবে কাশ্মীরের বিখ্যাত মিষ্টি কুলফি অপূর্ব “ফালুদা” খেয়ে বেড়ানোর ক্লান্তি দূর করা, আর চিনারের ছায়ায় ক্ষণেক দাঁড়ানো।

পরেরদিন শ্রীনগর থেকে গাড়ী করে খুব সকাল সকাল বেরিয়ে চললাম শোনমার্গ। দামাল সিন্ধু নদকে পাশে নিয়ে ফার, পাইন, মেপল, বার্চে ঘেরা পথ আর দূরান্তে পাহাড়রেখা… এপথের সৌন্দর্য বর্ণনা করার মতো কলমের জোর আমার নেই। একটিই শব্দে বলি… অভূতপূর্ব! ওখানে পৌঁছে ছোটগাড়ী নিয়ে আবার চলা কার্গিল পয়েন্ট পর্যন্ত। পথ কিন্তু মোটেই খুব সুগম নয়। যাবার পথে একটা গ্লেসিয়ার পড়বে, দৃশ্যমান ওখানে অমরনাথজীর ধাম। বালতাল থেকেই সেখানে যাওয়া যায় অমরনাথজী দর্শনে… বছরে কেবলমাত্র গোনাগুনতি মাসখানেক ঐ পথ খোলা থাকে আগষ্ট নাগাদ। আমাদের উদ্দেশ্য যেহেতু বেশিরভাগটাই বেড়ানো, তাই আমরা আগষ্টে না গিয়ে নভেম্বরে গিয়েছিলাম। দুর্গম পথ বেয়ে গাড়ী গিয়ে পৌঁছলো কার্গিল পয়েন্টে। ওখানেই সাধারণ মানুষের যাত্রাবিরতি। মূল ক্ষেত্রটি কেবলমাত্র সেনা বাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। গাড়ী থেকে নামার পরে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা হাওয়ায় আপনা থেকেই মাথা ঝুঁকে এলো সম্ভ্রমে সেনা বাহিনী ও সীমান্ত রক্ষীদের উদ্দেশ্যে। যেখানে আমরা একবেলায় জবুথবু কাবু, সেখানে আমাদের সেনাবাহিনীর ভাইয়েরা বছরভর আমাদের দেশের সুরক্ষার কাজে মোতায়েন। ওখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক ক্যান্টিন আছে। অবশ্যই পর্যটকরা কিছু খেয়ে দেখবেন… অতি চমৎকার সুস্বাদু খাবার। এক নদীর ধারে দাঁড়িয়ে ছিলাম ছবি তোলার উদ্দেশ্যে। নদীটি ভারত থেকে পাকিস্তানে চলেছে। কী নিশ্চিন্তে! কে বলবে দু-দেশের অসহ্য উত্তপ্ত সম্পর্কের কথা… কী শীতল শান্ত সিন্ধুর এই শাখানদী! ফিরতি পথে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। পথের অস্তিত্ব তেমন নেই। সারি সারি রসদবোঝাই সেনা গাড়ী। শোনমার্গ থেকে কার্গিল অভিমুখে। আসন্ন শীতের ভাণ্ডার মজুদ করার কাজে। আর বড়োজোর দিন সাতেক। তারপরই নাকি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাবে এই পথ, বরফ পড়ে। তার কিঞ্চিৎ নমুনা পেলাম। পথের পাশের ঘাসে আর সরু নালায় বরফের সাদা স্তর। ড্রাইভার ছেলেটি দেখালো ফেরার পথে গাড়ী চালাতে চালাতেই। শোনমার্গ হয়ে রাত প্রায় দশটা হলো শ্রীনগরের হোটেলে ফিরতে। 

পরদিন আবার খুব সকালে গাড়ী ছাড়লো। গন্তব্য গুলমার্গ… জিরো পয়েন্ট। ফেরার পথে আপেল বাগান আর জাফরান ক্ষেত দেখা। অবশ্য যাবার পথেই চোখে পড়েছে তারা পথের দু’ধারে। কী মনোরম পথশোভা! পথের দু’ধারে সার সার দাঁড়িয়ে পপলার গাছ, স্থানীয় মানুষের মুখে এর চালু নাম সফেদা। শোনা যায় এই পথশোভা নাকি বিশ্বসেরা। গুলমার্গ নামেই পরিচয়, ফুলে ঢাকা পথ। নভেম্বরে সে শোভা কিঞ্চিৎ কম। গুলমার্গে পৌঁছে গাণ্ডোলা (রোপওয়ে) চেপে খিলেন মার্গ। আগের রাতেই হালকা তুষারপাত হয়েছে। গুঁড়ো গুঁড়ো বরফে ঢাকা পায়ের নীচের পাথর। তখন আমরা দাঁড়িয়ে পৃথিবীর পঞ্চম উচ্চ শ্বেতশুভ্র তুষারে ঢাকা নাঙ্গাপর্বত শিখরে। বরফের মাঝখান থেকে মাঝে মাঝে সগর্বে মাথা উঁচিয়ে আছে ন্যাড়া পাথরের চাঁই। রোদের তীব্র তাপ ও উজ্জ্বলতা। চোখ ঝলসে যাওয়া রোদের প্রতিফলন। পরিষ্কার মেঘমুক্ত আকাশ, দূর দূরান্তে ছড়ানো নৈসর্গিক সৌন্দর্যের বর্ণনা দেবার ভাষা আমার ক্ষুদ্র ভাণ্ডারে নেই। গাইড জানিয়েছে এখান থেকে নাকি শ্রীনগরের ডাল, উলার, ঝিলম নদী, শঙ্করাচার্য মন্দির ইত্যাদি দৃশ্যমান হয়। তবে হাইপাওয়ার চশমা নিয়ে তা আমার দৃষ্টি পথের বাইরেই থাকলেও, দলের অন্যান্যরা দেখেছে। সময়াভাবে ওখান থেকে আলপাথার লেকে আর যাওয়া হলো না। খিলেন মার্গের ঐ জিরো পয়েন্ট থেকেই আবার গাণ্ডোলায় চেপে ফেরা গুলমার্গে। ফেরার পথে চোখে পড়লো বিদেশী পর্যটক কয়েকজনের স্কি করা। বেলা ঢলে পড়ার আগেই গুলমার্গ ছেড়ে গেলাম আপেল বাগান। বিস্তর ছবি তোলা, এবং গাছ পাকা আপেল কিনে খাওয়া হলো, নেওয়াও হলো। সন্ধ্যে হয়ে গেলে পাহাড় বড়ো রহস্যময়। কনকনে ঠাণ্ডা। ক্রমশঃ বাড়ছেই। হোটেলে ফিরলাম।

পরদিন কোনো সমস্যার কারণে শ্রীনগর থেকে কোনো পর্যটকদের গাড়ী নিয়ে চলা বাতিল হলো। সে দিনটায় উলার লেক দেখা আর সন্ধ্যায় কেনাকাটার কথা ছিলো। সারাদিন ডাল লেকের পাশে পায়ে হেঁটে ঘোরা আর কেনাকাটা করেই কাটলো, উলার দেখতে না পাওয়ার আফশোষ বুকে করে।

পরেরদিন সকালে শ্রীনগর থেকে রওনা হলাম। এবার গন্তব্য পহেলগাঁও। পথের সৌন্দর্য তো গত ক’দিনে চোখ সওয়া হয়েছিলো। পহেলগাঁও পৌঁছে মনে হলো বিদেশি ক্যালেন্ডারের ছবির পাতায় এসে গেছি। সাধে কী এই কাশ্মীর উপত্যকা ভূস্বর্গ? ছবি তুলে এই সৌন্দর্য ধরে রাখার ক্ষমতা নেই। কিছু ছবি তোলা হলো স্মারক হিসেবে। বাদবাকী সবটাই মনের ক্যামেরাবন্দী। পহেলগাঁও লিডার নদীর উপত্যকায়। খানাবল, অনন্তনাগ, চন্দনবাড়ি ঘোরা হলো। এই চন্দনবাড়ি অমরনাথ গুহায় যাবার দ্বিতীয় পথে যাত্রা শুরুর জায়গা। নভেম্বরে সেপথ বন্ধ থাকে। আমরা আসলে ভূস্বর্গের নয়নাভিরাম নিসর্গ দর্শনার্থী। তাও মমলেশ্বর দর্শন হয়েছে। বাকি দেড় দিন কেবলমাত্র নীলাম্বরী নীলনয়না লিডার নদীর আর পীরপাঞ্জাল পর্বতশ্রেণীর শোভা দেখেই কাটিয়েছি আমরা। আরো দু-চারদিন থাকার ইচ্ছে ছিলো। কিন্তু সময়ের হিসেব নিকেশ আর বুকিং করে রাখা টিকিটের চোখ রাঙানি খেয়ে পহেলগাঁও ছাড়তেই হলো, বিরসবদনে।

Kolkata to Kashmir Trip

পরবর্তী গন্তব্য পাটনী টপ। দুপুরে খাওয়া দাওয়া সেরে পহেলগাঁও থেকে গাড়ী ছাড়লো। সন্ধ্যা পার করে এসে পৌঁছলাম পাটনী টপ। এতো নিরিবিলি। শহরের ব্যস্ত কোলাহল থেকে অনেক দুরে। প্রাণভরে নির্জনতা উপভোগের এমন পাহাড়ী পর্যটন কেন্দ্র ভূভারতে আর দ্বিতীয়টি নেই। হাড়ের ভেতর পর্যন্ত শিরশির করে ওঠা ঠাণ্ডায় নৈশাহার, রিসর্টের খোলা এনক্লেভের লাগোয়া ডাইনিং হলে। ক’দিনের টানা ঘোরাঘুরিতে পথশ্রমে ক্লান্ত সবাই। ভোরবেলা ঘুম ভাঙলো অপরিচিত টি টি টুই টুই খস খস… নানান বিচিত্র আওয়াজে। উঠে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শাল মুড়ি দিয়ে আমাদের ঘর-লাগোয়া ব্যালকনির দরজা খুলতেই হিমশীতল বাতাসে ঠকঠক করে কেঁপে উঠলাম। আর বাইরে ঘনসবুজ পাইন আর দেবদারু বনের ফাঁকফোকর গলে আলোর ফলা ঝকঝক করছে। ঘাসে পাতায় বুনো ফুলের ওপরে মিহি পাতলা শিশিরের সর জমে বরফ, আলগোছে পড়ে রয়েছে। আর নাম না জানা বেশ বড়ো আকারের একজোড়া পাখি রিসর্টের সীমানা ঘেরার তারকাঁটায় বসে। এবং সম্ভবত এক বনবেড়াল দম্পতি, ব্যালকনির নীচের ধাপের সামনে বাঁধানোটুকুতে বসে দিব্যি নিশ্চিন্তে রোদ পোয়াচ্ছে। তাদেরই আওয়াজে আমার ঘুম ভেঙেছে। মেঘ কুয়াশার চাদর মোড়া পাটনী টপ জেগে উঠেছে। কিন্তু কোনো শব্দ দৌরাত্ম্য নেই। নৈঃশব্দ্য যে এমন আকন্ঠ উপভোগ্য তা কে জানতো! কী প্রশান্তি। জোরে একটি কথাও উচ্চারণ করে ঐ নীরবতা ভাঙতে ইচ্ছে হয় না।

সবাই উঠেছে, কিন্তু যে যার মতো ডুবে আছে এই নৈঃশব্দ্যের ধ্যান গম্ভীরতায়। সকালের চা জলখাবার পর্ব মিটিয়ে গাড়ী চললো, পাটনী টপ সংলগ্ন দ্রষ্টব্যের উদ্দেশ্যে। সুদ মহাদেও, নাথা টপ, তারপর সনাসার লেক। এর সৌন্দর্য বিবৃত করার ভাষাও যে জানা নেই আমার। নৈসর্গিক রূপে ভূস্বর্গের কোনো অংশের সাথে কোনো অংশের তুলনা চলে না। তবু আমার মনে হলো পাটনী টপ না এলে ভূস্বর্গের রূপের বৈচিত্র ও বৈশিষ্ট্য পুরো দেখা হতো না।

সম্বিৎ ফেরে আমার গাড়ীর সহযাত্রীদের উল্লাসধ্বনি শুনে। হাঁ করে চেয়ে ছিলাম আমি। ঠান্ডাটা তখন বেশ মালুম হচ্ছিলো। গাড়ি এগিয়ে চলেছে তখন। নাথা টপ থেকে আরো প্রায় ১০ কিমি। উচ্চতা ৮৫০০ ফুট। গাড়ী থেকে নেমেই মুখ থেকে আমার কোনো শব্দ বেরোলো না। সবাই আহা আহা করছে, আর আমার চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। সবুজ মখমলি তৃণভূমির গালিচা বিছানো। দূরে পাহাড়ের সারি, মাথায় তাদের বরফের চাদর মোড়া। আর সামনে একটা ছোট্ট মনোরম লেক, সনাসার। উপযুক্ত প্রচারের অভাবে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে কিছুটা উপেক্ষিত পাটনী টপ ও লেক সনাসার। ওখানে না গেলে আমরাও এই সৌন্দর্য থেকে বঞ্চিতই থেকে যেতাম। পাটনী টপ রিসর্টে ফিরে এলাম সন্ধ্যা হবো হবো সময়ে। পথে দেখেছি আমৃত্যু ভুলতে না পারার মতো একটি সূর্যাস্ত।

রাতে রিসর্টে বন ফায়ার, ভ্রমণসূচীর শেষ রাত। রাত পোহালো নিঃশব্দতার রাজ্যে। পরের সকালে রিসর্ট লাগোয়া পাহাড়ি জনপদটি পায়ে পায়ে হেঁটে ঘোরা হলো। চাকচিক্য বিহীন দোকানপাট থেকে সামান্য কেনাকাটা। সেদিনই রাতে ফেরার ট্রেন, জম্মু থেকে হাওড়াগামী হিমগিরি এক্সপ্রেস। আরো ক’দিন থাকতে ইচ্ছে হয়েছিলো এ নিঃশব্দ প্রকৃতিকে সঙ্গী করে। কিন্তু উপায় নেই। মধ্যাহ্ন ভোজনের পরে গাড়ী রওনা দিলো জম্মুর উদ্দেশ্যে। আবার কখনো যাওয়া হবে কিনা জানি না, তবুও আসার সময় ফিসফিস করে বলে এসেছি পীরপাঞ্জালের ঢালে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা দেবদারু – পাইনের বনকে, গিরিখাতে বয়ে চলা চঞ্চল নামহীনা ঝর্ণাকে, পথের বাঁকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলা পাহাড়ী বালক-বালিকাকে, চারণরত ভেড়ার দলকে, দূরের পাহাড়চূড়ার বরফকে, ঝকঝকে নীল আকাশ আর অমল ধবল মেঘখণ্ডকে… আমি আসবো, আবার তোমাদের কাছে আসবো। চিনারের ছায়ায়, লিডারের নীলাভ মায়ায়, সনাসারে প্রতিবিম্বিত কায়ায়, গুল-গুলশান-গুলফামের বাগিচায়, জাফরানি কাওয়ার ধোঁয়ায়, মেঘ-রোদ-কুয়াশার লুকোচুরি খেলায়… নিজেকে হারিয়ে ফেলতে আসবো আবার।

ভূস্বর্গ কাশ্মীর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বলছে, পথের দূরত্ব এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্গমতার কারণে পেশাদার ট্যুর অপারেটরের বা এজেন্টের সহায়তা অবশ্যই নেওয়া উচিৎ। সবরকম বুকিং এবং থাকা খাওয়ার যাবতীয় সুবন্দোবস্ত যেহেতু ট্যুর অপারেটরের দায়িত্বে থাকে, সেইহেতু বেড়ানোটি বড়ো নির্ঝঞ্ঝাট নিরুদ্বেগে হয়।

সংঘমিত্রা রায়চৌধুরী | Sanghamitra Roychowdhury

Natun Bangla Kabita 2023 | কল্যাণ সুন্দর হালদার | Top New Poetry

Driving Experience Canada 2023 | ড্রাইভিংয়ের যত কেচ্ছা (কানাডা পর্ব – ৫ এবং ৬)

Ananta Bikeler Rupkathara | অনন্ত বিকেলের রূপকথারা | New Bengali Story 2023

Natun Bangla Kabita 2023 | সুব্রত চক্রবর্ত্তী | Top New Poetry

Kolkata to Kashmir Trip | Kolkata to Kashmir Trip 2023 | Kolkata to Kashmir Trip 2013 | Sabuj Basinda | High Challenger | Kolkata to Kashmir Trip Guide | Kolkata to Kashmir Trip Guide Book | Kolkata to Kashmir Trip Video | Kolkata to Kashmir Trip Cost | Kolkata to Kashmir Trip Memory | Book – Kolkata to Kashmir Trip | Package of Kolkata to Kashmir Trip | Family package – Kolkata to Kashmir Trip | Kolkata to Kashmir Trip Flight | Flight Cost – Kolkata to Kashmir Trip | Story Kolkata to Kashmir Trip | Kolkata to Kashmir Trip – Bangla Galpo | Travel Story – Kolkata to Kashmir Trip | Full Guide – Kolkata to Kashmir Trip | Bengali Story – Kolkata to Kashmir Trip | Shabdodweep – Kolkata to Kashmir Trip | Kolkata to Kashmir Trip – Sanghamitra Roychowdhury

Leave a Comment