পুনম মায়মুনী – সূচিপত্র [Bengali Story]
মানিকের ঈদ আনন্দ – পুনম মায়মুনী [Golpo Dot Com]
নিঝুম রাত। চারিদিকে শুনশান নীরবতা। আকাশটাও যেন নিস্তব্ধ হয়ে আছে। মাঝে মাঝে নিশুতি রাতের পাখিগুলো করুণ সুরে থেমে থেমে ডেকে উঠছে। সেইসাথে নিলুফার বুকটাও কেমন ভারী হয়ে উঠে। বিছানায় শুয়েই খোলা জানালায় আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, চাঁদের আলোটা আজ বড়ো বেশী নিষ্প্রাণ! কিছুক্ষণ পরপর আকাশটা কাল মেঘে ঢেকে যাচ্ছে, আবারো মেঘের ফাঁকে উঁকি দিয়ে উঠছে দীপ্ত চাঁদটা। চাঁদ আর মেঘের এই লুকোচুরি খেলাটা ঠিক নিলুফার জীবনের সাথে কোথায় যেন মিলে যাচ্ছে। মানিকের মায়াভরা মুখটা ভেসে উঠে। বড় সাধ আর মায়ের মমতা দিয়ে নাম রেখেছিল তাঁর প্রথম সন্তানের নাম, মানিক। সারাজীবন আগলে রাখবে তাঁর বুকের ধন মানিককে। এটাই তো প্রত্যেক মায়েদের একান্ত চাওয়া। মা হিসাবে নিলুফারও চাওয়া ছিল ঠিক তাই-ই। কিন্তু সন্তান বেঁচে থেকেও আজ এই কঠিন নিষ্ঠুর সমাজ তাঁর মানিককে নির্মমভাবে কেঁড়ে নিয়েছে এক মা’য়ের বুক খালি করে।
প্রথম যেদিন তাঁর কোলজুড়ে মানিকের জন্ম, ঐ ছোট্ট স্নেহভরা মুখখানা ছিল নিলুফার পৃথিবী। মাতৃত্বে যেন জয় করেছিল সারা বিশ্বটাকে। শুকরিয়া আদায় করেছিল মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে। কিন্তু কিছুদিন পর যখন জানতে পারলো, শুধু একটি অঙ্গের জন্য মানিক অন্য মানব সন্তান থেকে আলাদা । জগতটাও নাকি হবে তাঁর আলাদা! মাত্র পাঁচ বছরের মানিককে, জোড় করেই মা’য়ের কোল থেকে একরকম ছিনিয়ে নিয়ে যায় ওরা। নিলুফা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না.. । প্রতিবাদ স্বরে চিৎকার করে বলেছিল সেদিন, ‘তা ক্যান অইবো?সবার পেডে যেমুন কইরা সন্তান আহে, আমার পেডেও আইসিলো। আমিও মানিকেরে মায়ের মমতা দিয়া ধারণ করসি, আদর, সোহাগ দিয়া লালন পালন করসি। সৃষ্টিকর্তা আল্লায় কি কইসে ওরা মানুষ না? তয় তুমরা কোন অধিকারে অগো সমাজ সংসার ত্যাগ করাও ? কিন্তু পরিবারের একজন লোকও বিশেষ করে মানিকের বাবা খালেকও সেদিন তাঁর সাথে গলা মিলিয়ে বলেনি, মানিক ওর মায়ের বুকেই থাকবো। মায়ের অধিকার, সন্তানের অধিকার তোমরা কাইড়া নিও না। আর যেন ভাবতে পারছে না নিলুফা, ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠে।
পাশে স্বামী খালেকের ঘুম ভেঙে যায়,
— কি রে, আইজও কান্দস? তোর পাগলামিডা অহন ছাড়?
আঁচলে মুখ চেপে ফুঁপিয়ে, ফুঁপিয়ে,
— সন্তানের লিগা মায়ে কান্দে, হেইডাও আমার পাগলামি? এতো নিঠুর তুমি হইও না গো!
— সুজন আর শরীফার কতা চিন্তা কর, মানিকের কতা ভুইলা যা। ও ঐহানে বালাই আসে।
— মা’য়ে ছারা সন্তান বালা থাহে কেমনে? তুমি ভুলবার পার, আমি ক্যান পারি না জানো? আমি যে মানিকের মা! আমার এই জঠরে লালন কইরা আমি ওরে জন্ম দিসি। তাই আমার শরীরের রক্তবিন্দু সবসময় আমারে তাড়া কইরা বেড়ায়, ওরে মায়ের অধিকার থিকা বঞ্চিত করার অপরাধে।
এবার শোয়া থেকে উঠে বসে নিলুফা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্বামীর চোখে চোখ রাখে,
— সুজন আর শরীফা যদি মা, বাবার আদর ভালোবাসা পায় তয় আমার মানিক কোন বিচারে অপরাধী অইলো, কও তো? কোন দোষে খেদাইয়া দিলা বনবাসে আবার সবার আড়ালে সন্তানের পরিচয় ও গোপন রাখলা?
খালেক নিলুফার কথার কোনো জবাব না দিয়ে পাশ ফিরে শোয়। খালেকের এহেন আচরণ নিলুফার অভ্যস্ত। তাই তাঁর মনে কোনো প্রতিক্রিয়ারই সৃষ্টি করেনি। নিলুফা ছোট একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে, — হুনসিলাম, আমগো নবী কইসে সৃষ্টিকর্তা মায়ের স্থান দিসে সবার উপরে। এমনি এমনিই দেয় নাই আল্লায়। বাবা আর মায়ের মধ্যে কতো… তফাৎ!
রোজকার মতো নিলুফা কাক ডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠোন ঝাড়ু দেয়। হাঁস, মুরগির খোঁয়াড় খুলে খাবার ছিটয়ে দেয়। শরীরটা আজ বড়োই ক্লান্ত লাগছে তাঁর একটা নীরব চাপা কষ্টে। মনটা ভীষণ চাইছে তাঁর মানিককে এক নজর দেখতে। মানিকও কতোদিন ফোন করে মন খারাপ করেছে, ‘মাগো তুমারে ছাড়া আমার এইহানে একদম ভালা লাগে না। প্রশ্ন করেছে, আমারে তোমাগো ধারে ক্যান রাহ না মা ? বাবায় কইসিলো কয়দিন পরেই আমারে লইয়া যাইবো আর তো আইলো না!’ কোন উত্তর দিতে পারেনি সেদিন নিলুফা। নীরবে শুধু চোখের জলে বুক ভাসিয়েছিল। আজ যেন কোন কাজেই হাত দিতে ইচ্ছে করছে না নিলুফার। কিন্তু উপায় নেই, এই সংসারের সে বড়ো বৌ। শ্বশুর-শাশুড়ি, দেবর-ননদ,স্বামী-সন্তান সকলের রান্নাবান্নার কাজ তাঁকেই এক হাতে সব সামলাতে হয়। সবাই যে ভরসা করে আছে তাঁর উপর। আর মাত্র কয়েকটাদিন বাকি কোরবানি ঈদ। সবাই ঈদ আনন্দে মশগুল, নতুন কাপড়, কোরবানির গরু -ছাগল কেনাকাটায়।
নিলুফা স্বামীর পাশে এসে দাঁড়ায়। কিছুটা আবদারের স্বরে বলে,
— এইবার মানিক আমগো লগে ঈদ করবো, ওর লিগাও একসেট কাপড় কিনবা?
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ননদ, নিলুফার কথা শুনে ফিক করে হেসে উঠে,
— ভাবী যে কি কও না? ওরে তুমি কোন পোষাক দিবা, পোলাগো না মাইয়াগো ?
শাশুড়ি ছুটে এসে নিলুফাকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলল,
— এহনও মানিক মানিক করস? ঐডার নাম তুই ভুলেও উচ্চারণ করিস না বৌ।
সাথে সাথেই নিলুফা স্পষ্টস্বরে উত্তর দেয়,
— আফনেরা পরিচয় না দিলেও আমার মুখ থিকা বারবার উচ্চারণ অইবোই মানিক, মানিক। ও আমার পথম সন্তান।আমি মানিকের মা!
নিলুফার মুখ থেকে একথা শুনে সুজন, শরীফা মাকে জাপটে ধরে,
— মা, মানিক কেডা ও আমগোর কী অয়?
শাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
— এইবার ‘ক’ তোর মানিক অগো ভাই না বইন লাগে?
একটু কঠিন স্বরে নিলুফাও তেমনি উত্তর দেয়,
— মানিক যেইডা পসন্দ করবো, ওরা হেইডাই ডাকবো।এইবার আমি ঠিকই মানিকরে আমার কাসে নিয়া আসমু। ও আমার লগে ঈদ করবো ওর ভাইবোনের লগে ঈদ করবো।
মানিককে ফিরিয়ে আনার কথা শুনে স্বামী খালেক তেড়ে আসে,
— তুই কইলেই অইবো। আমাগো একটা সমাজ আসে, মানসম্মান আসে। মানিকের কী পরিচয় দিবি তুই?
ছেলের সাথে যোগ দিয়ে শাশুড়ি আরও সামনে এসে একহাত কোমরে, অন্য হাতে আঙুল তুলে নিলুফাকে শাসিয়ে বলল,
— এইডা মানিকের ভাইগ্য! ওর ভাইগ্যই ওরে ঐহানে টাইনা লইয়া গেসে। তোর, আমার, সবার কী করনের আসে?
শাশুড়ির কথার পটে একটা বিদ্রুপের হাসি হাসে নিলুফা,
— মানিকের ভাইগ্য না। এইডা আফনেরা বেবাকে মিল্লা, মানিকগো ভাইগ্য সূতায় বাইন্দা শক্ত কইরা গিট্টু লাগাইয়া দিসেন। আর দোষ দেন মানিকগো? যতদিন আফনেরা ঐ গিট্টু না খুলবেন, ততদিন এই মানিকগো ভাইগ্য বদলাইবো না। পরিবার আর সমাজেও অগো কোনো স্থান অইবো না।
নিলুফা এবার আরও উচ্চস্বরে দৃঢ়কণ্ঠে বলতে থাকে,
— মানিকগো সব থিকা বড়ো পরিচয় অইলো, ওরা ও মানুষ। যেই সমাজের ডরে নিজের সন্তানের পরিচয় গোপন রাখতে অয়, পরিবারেও হেই সন্তানের কোন
জায়গা অয় না। মানুষ অইয়া মানুষের সম্মান দেয় না,মূল্য দেয় না হেই সমাজরে আমি ঘেন্না করি, ঘেন্না করি! নিজেকে আর সামলাতে পারে না নিলুফা । দৌড়ে নিজের ঘরে যেয়ে বালিশে মুখ গুঁজে বুক ফেটে কাঁদতে থাকে। দু’দিন ধরে অনবরত টিপ টিপ বৃষ্টি। আগামীকাল কোরবানি ঈদ, তাই নিলুফার কাজের চাপটাও একটু বেশি। দিনভর কাজ শেষে রাতে ঘুমাতে যায় কিন্তু কিছুতেই দু’টি চোখের পাতা এক করতে পারেনি । সারারাত বিছানায় শুয়ে এপাশ, ওপাশ করেছে। মানিকের জন্য বুকের ভিতরটা বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে। রাতের আঁধারটা যেন আজ কাটছেই না। মানিক যে তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে। সেও মানিককে কথা দিয়েছিল, এবারে বাড়ির সবার সাথেই সে ঈদ করবে। কিন্তু পরিবার, এই সমাজ মানিকদের সামনে যেন শক্ত প্রাচীর দিয়ে গেঁথে দিয়েছে। এ প্রাচীর যে তাঁকে ভাঙতেই হবে। তাঁকে পারতেই হবে। সন্তানের আনন্দ হাসির জন্য মায়েরা কোনকিছুরই তোয়াক্কা করে না, পাহাড় সমান বাঁধা আসলেও তাকে অতিক্রম করতে মায়েরা বিন্দু পরিমাণ পিছ পা হয় না ।
রাতের অন্ধকার কেটে আলোর রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিক। নিলুফা ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। মানিকের জন্য লুকিয়ে সে সামান্য কিছু টাকা জমিয়েছিল। সেই টাকার পুটলিটা সাবধানে কোমরে গুঁজে নেয়। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ে। বেশ খানিকটা পথ হেঁটে, তারপর বাস ধরতে হবে। উঠোনে পা ফেলতেই, খালেকের মুখোমুখি হয়ে যায় নিলুফা। খানিকটা অবাক হয়ে খালেক বলল,
— এতো সকাল সকাল কই যাস তুই?
আচমকা খালেককে সামনে দেখে বুকে সাহস রাখে নিলুফা, তারপর বেশ ভারী গলায় বলল,
— মানিকের কাসে, ওর লগে ঈদ করুম। ওরে আমি কতা দিসি।
— এই ঈদের দিনে সুজন আর শরীফারে তুই ফালাইয়া যাবি?
শান্ত অথচ দৃঢ়তার সাথে নিলুফা উত্তর দেয়,
— সুজন আর শরীফার লগে তুমি, তোমার পরিবার, সমাজ বেবাকেই তো আসো। আর আমার মানিকের লগে? কেউ নাই। সবার ঈদ আনন্দ আসে, আমার মানিকের নাই?
তাই আমি এক মা যাইতাসি সন্তানের লগে ঈদ করতে; আইজ তুমরা কেউ আমারে ঠেকাইয়া রাখতে পারবা না। বড়ো বড়ো পা ফেলে নিলুফা দ্রুত সামনের দিকে এগুতে থাকে।
মাতৃত্ব – পুনম মায়মুনী [Matritva]
তখনো আকাশের শেষ তারাটি জেগেছিল। চাঁদ আর পৃথিবীর বিদায় লগ্ন। চাঁদের সেই দীপ্ত হাসি ম্লান হতে চলেছে। উত্তরের হিম শীতল হাওয়া একটু একটু বইতে শুরু করেছে। হালকা ধোঁয়া ধোঁয়া আবরণে ঢাকা প্রকৃতিটা। চারিদিক নিস্তব্ধ। পাখিরাও যেন গভীর ঘুমে অচেতন।
শুধু উমার দু’চোখে ঘুম নেই। প্রায়ই উমা এভাবে নিশি রাতে চাঁদের সাথে, নিল জোছনার সাথে মনের কথাগুলো ব্যক্ত করে কাটিয়ে দেয়। কখনোবা ঘুমন্ত দু’বছরের মেয়ে বিন্দুর পাশে শুয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে।
বিছানায় সারা রাত ছটফট করে একসময় উঠে পড়ে উমা। জানালার পর্দাটা সরিয়ে দাঁড়ায়। লাইট পোষ্টের বাতিগুলো তখনো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। রাস্তার এক কোণায় দু’টো কুকুর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে শুয়ে ,একটু পর পর মুখ তুলে ঘেউঘেউ করে খেঁকিয়ে উঠছে।
একটা গাড়ির হর্ণের শব্দে উমার মুখটা ঘুরাতেই , গাড়ির দু’পাশের আলোটা উমার দু’চোখে নিক্ষেপ করে, ঠিক যেন শকুনির চোখের মতো রাশেদের নিষ্ঠুর ঐ দু’টো চোখ!
দারোয়ান গটগট করে বড় গেটটা খুলে দেয়। ব্রিফকেস হাতে রাশেদ গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভার সাবেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
তুমি আজই দেশে চলে যাও। কাজের লোক ছাড়া তোমার বেগম সাহেবের খুব কষ্ট হচ্ছে!” বলেই উপরে উঠে আসে।
উমা তখনো দাঁড়িয়ে। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় স্পটই বুঝা যাচ্ছে উমার অবয়ব।
রাশেদ উমার পিছনে এসে দাঁড়ায়,
আজও এভাবে দাঁড়িয়ে আছ ? কতদিন বলেছি আমার জন্য অপেক্ষা করোনা, কাজ ফেলে তো আর আসতে পারি না।
উমা রাশেদের দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকালো না, তেমনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। রাশেদ এবার দু’হাত দিয়ে উমার গাল দু’টো আলতো করে নিজের দিকে ফেরালো,
কি, কথা বলবে না? একি! তোমার চোখে জল।
উমা আর স্থির থাকতে পারলো না, গ্রিলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দে বিন্দুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।
রাশেদ মেয়েকে কোলে তুলে নিতে গেলে, হঠাত-ই উমা রাশেদকে এক ঝাপটায় সরিয়ে দেয়,
খবরদার তুমি আমার মেয়েকে ছুঁবে না।
খানিকটা রেগে গিয়ে রাশেদ বলল,
বিন্দু আমারও মেয়ে।
ও কথা বলতে লজ্জা করে না ? ঐটুকু একটা দুধের বাচ্চা সারাদিন বাবা বাবা বলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়ে, মেয়ের জন্য এতটুকুও সময় নেই তোমার?
ওর জন্য তো তুমিই আছ। ব্যবসার কাজে আমাকে কত জায়গায় যেতে হয়, এসব আমি কার জন্য করছি? গাড়ি বাড়ি ব্যাংক ব্যাল্যান্স সব তো তোমাদের জন্য আর কী চাও।
উমার যেন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায়,
এসব কিচ্ছু চাই না আমার। আর কত ব্যবসার ওজুহাত দেখাবে। রোজ রোজ মিটিং ,কনফারেন্সের নাম করে বন্ধুবান্ধব নিয়ে পার্টি করে মাঝ রাতে ঘরে ফিরবে । মেয়েদের কী পেয়েছ হাতের পুতুল, না? বিয়ে করে কিনে নিয়েছ যা খুশি তাই করবে আর আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করবো!
তাচ্ছিল্য স্বরে রাশেদ,
Of course ! আমার সংসারে থাকতে হলে সহ্য করতেই হবে তোমাকে বলে গট গট করে নিজের রুমে চলে যায় ।
রাশেদের বরাবরই এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে উমাকে আহত করে। ক্লান্ত দেহটা নিয়ে উমা ঘুমন্ত বিন্দুর পাশে শুয়ে ভাবতে থাকে রাশেদের এই প্রাচুর্য আর অহংকারের কথা । চারিদেয়ালের মাঝে এই ঐশ্বর্যপূর্ণ আসবাবপত্রগুলো প্রতি মুহূর্ত যেন তাঁর গলা চেপে ধরে ,বিষধর সাপের মত ফণা তুলে ছোবল মারে । অসহনীয় কষ্টে উমার বুকের ভিতর হাহাকার করে কাঁদে। এমন বিলাসিতার জীবন তো সে চায় নি? চেয়েছিল একটু শান্তি, একটু নির্মল ভালোবাসা। যে ভালোবাসা শুধুই উমার একার, একান্ত নিজের। এটাই যে উমার প্রাচুর্য। কেমন করে রাশেদকে বুঝাবে অর্থের বিনিময়ে ভালোবাসার সম্পত্তি কেনা যায় না, পৃথিবী সমান ঐশ্বর্যও স্বামীর ভালোবাসার কাছে অতি নগণ্য, মূল্যহীন।
উমার মনে পড়ে, এই অর্থ আর ভালোবাসা নিয়ে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল শানুর সাথে। শানুর যুক্তিতে উমা চরমভাবে পরাজিত হয়েছিল।পরাজয় বরণ করে রাশেদের হাত ধরে প্রবেশ করেছিল এই অন্দরমহলে কিন্তু এই মহল যে একটা বিষাক্তপুরী। বিষের জ্বালায় দগ্ধ হয়ে আজ সে ক্ষতবিক্ষত। যদি শানু এসে একবার স্বচক্ষে দেখে যেত? বীরদর্পে সে বলতো, তোমার কথা তুমি ফিরিয়ে নাও শানু, ”অর্থেই মানুষ সুখী হয়, ভালোবাসায় নয়”। তোমার এ ধারণা একেবারেই ভুল, তুমি হেরে গেছ শানু। আমায় আর বুঝাতে পারবেনা তোমার ঐ মিথ্যে যুক্তিতর্ক দিয়ে।তুমিও আজ আমার সুরে সুর মিলিয়ে বলবে, হ্যাঁ উমা আমি সেদিন ভুল বুঝেছিলাম তোমায় ভুল বুঝিয়েছি্লাম।
দু’হাতে বুক চেপে ধরে উমা, যদি একটু প্রান খুলে কাঁদতে পারতাম! বুকের শীতল জলগুলোও যেন রাশেদ শুষে নিয়েছে।
বিন্দু ঘুমের ঘোরে নড়েচড়ে ছোট্ট তুলতুলে হাতটা উমার হাতের উপর রাখে । মেয়ের স্পর্শে স্নেহ, মমতায় উমা্র বুকের ভিতরটা কী এক শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। আলতো করে ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমু খায়, মাগো, তুই কেন এত মায়া নিয়ে এসেছিস আমার কোলে, কেন এত মোহ তোর চোখেমুখে যেন আমার সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছি তোর এই ছোট্ট বুকে। বিন্দু তখন ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলে গভীর ঘুমে অচেতন।
দু’দিনের ছুটি কাটিয়ে সাবের কমলাকে নিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়। কমলার বুকটা কেমন ধুক ধুক করতে থাকে, এই প্রথম তাঁর ঢাকায় আসা। বুকের ভিতর খোকনের স্মৃতিগুলো তোলপাড় করে যেন আছড়ে পড়ছে! সাবের ট্রেনের জানালায় একমনে বসে দেখছিল, সারি সারি গাছগুলো কেমন করে পিছনদিকে দৌড়ে যাচ্ছে।
নিরবতা ভেঙ্গে কমলা মৃদুস্বরে বলে,
মামা, আমার জানি কিমুন ডর লাগতাসে! আমি কি শহরের কাম করতে পারমু?
সাবের নিঃশব্দ হেসে বলে,
আরে পারবি পারবি; বিবিসাহেব খুব ভালা মানুষ ঠাণ্ডা মেজাজের।
কমলা মাথা নাড়ায়,
‘হ’, ট্যাকা থাকলে মেজাজ অমুন ঠাণ্ডাই থাহে।
ছোট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে সাবেরও উত্তর দিল,
তুই ঠিকই কইছস, আমগো ট্যাকা নাই তাই মেজাজটাও থাহে সবসময় চড়া। কাউরে ভালাবাসতেও জানিনা!
লম্বা একটা হুইসেল দিয়ে ট্টেনটা কমলাপুর ষ্টেশনে এসে থামে।
ওদের পৌঁছাতে প্রায় সকাল দশটা বেজে যায়। কমলা তাঁর পুটলিটা বগলের তলায় নিয়ে সাবেরের পিছনে পিছনে গেটের ভিতর ঢুকে। কমলা চারিদিকে অবাক হয়ে দেখতে থাকে। তখনো তাঁর বুকের ভিতর ধুক ধুক করেই যাচ্ছে। সাবের কমলাকে নিয়ে সোজা দোতালায় উঠে আসে ।
উমা কমলাকে দেখে হাসিমুখে বলল,
ও, তুমিই কমলা?
কমলা ঘোমটাটা আরও একটু এঁটে বিনয়ের সাথে একটা সালাম ঠুকে উমার আরও কাছে এসে দাঁড়ায়।
উমা বলল,
অনেক দূর থেকে কষ্ট করে এসেছ, ফ্রেস হয়ে একটু রেস্ট নাওগে…। আজ কোন কাজ করতে হবে না তোমার। তারপর বাবুর্চিকে ডেকে বলল,
কমলাকে সার্ভেন্ট রুমটা দেখিয়ে দাও তো । আর ওর ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ এগুলোর দিকে খেয়াল রেখ।
উমা চলে যায় নিজের রুমে। কমলা উমার কথাগুলোর আগামাথা কিছুই বুঝলোনা। শুধু এইটুকুই বুঝলো আজ কোন কাজ করতে হবে না তাঁকে। তবে উমার সাবলিলভাবে কথা বলার ভঙ্গি দেখে কমলার অনেকটা ভয় কেটে যায়।
রোজকার অভ্যাসের মত খুব ভোরে কমলার ঘুম ভেঙ্গে যায়। গ্রামের বাড়ির সেই পাখির কলরব মানুষের হৈ হুল্লোড় কিছুই নেই এই শহরে। নিরব নিঃশব্দ চারিদিক। গুটি গুটি পায়ে কমলা সামনের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। চারপাশে কত বড় বড় দালান কোঠা। ছাদে বারান্দায় কত বাহারি গাছ ফুল লতায় পাতায় ভরা। এই প্রথম তাঁর শহর দেখা আবার রাজধানী। মামার মুখে শুনেছিল রাজধানীতে সব বড়লোকের কাড়বার। কত টাকা খরচ করে তাঁরা ফুলের বাগান করে নিচে ফোয়ারায় বৃষ্টির মত পানি ছিটায়। আর তারা শুধু একপেট ভাদের জন্য কত জায়গায় ঘুরে বেড়ায়! কমলা একমনে চারপাশের বাড়ির মানুষদের সুখ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকে।
বিন্দুকে দেখভার করার জন্যই মূলত কমলাকে রাখা। অল্পদিনের মধ্যেই বিন্দু কমলার খুব ভক্ত হয়ে যায়। কমলার ছেলে খোকন ঠিক বিন্দুর বয়সী, তাই বিন্দুর মাঝে যেন কমলা তাঁর খোকনকেই খুঁজে পায়। উমা প্রয়োজন ছাড়া কমলার সাথে খুব একটা বেশি কথা বলে না। তবুও উমার কথা ,আচার-আচরণের স্নিগ্ধতা কমলাকে মুগ্ধ করে। কিন্তু মাঝে মাঝেই উমার বিষণ্ণতা আর উদাস ছল ছল চোখে আকাশের দিকে চেয়ে থাকা মুখখানা দেখে উমাকে ঠিক মেলাতে পারে না । কিসের যেন একটা অভাব ঠেকে কমলার কাছে।
আজ ছুটির দিন। উমা ময়লা কাপড়গুলো লন্ড্রিতে দেওয়ার জন্য রাশেদের ঘরে ঢুকে। রাশেদ তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ভোরের হালকা সূর্য রোশনিতে রাশেদের মুখখানা আরো অপূর্ব লাগছে! নিঃসন্দেহে শানুর চেয়ে রাশেদ অনেক বেশি সুদর্শন। কিন্তু শানুর ছিল আকাশের মত বিশাল একটা সুন্দর মন আর হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা। যে ভালোবাসায় আছে সম্মান আর নির্ভরতা।আর রাশেদের আছে বিশ্রী কুৎসিত পাষণ্ড একটা মন। সেখানে কেউ কোনদিন শান্তি পাবেনা। তবুও এই রাশেদদের বাহ্যিক রূপ আর অর্থের কাছে বার বার হেরে যায় শানুদের মত সাধারণ চরিত্রবান লোকেরা। উমার ভিতর থেকে একটা উষ্ণ নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। রাশেদের ছড়ানো ছিটানো কাপড়গুলো উঠাতেই সাদা শার্টের উপর লিপিস্টিকের ছোপ ছোপ দাগ দেখে উমা শিউরে উঠে! তৎক্ষণাৎ পাশে রাখা রাশেদের ব্রীফকেসের ডালাটা খুলে। কিছু কাগজপত্রের মাঝে একটা লেডিস পার্স উমার নজরে আসে। তাড়াতাড়ি ভিতরটা দেখে নেয়, কিছু অরনামেন্টস আর লেডিস ঘড়ি পড়ে আছে। উমার আর বুঝতে বাকি রইলো না, প্রায় রাতে কেন রাশেদ দেরী করে বাড়ি ফেরে। রাশেদের অনেক কীর্তিকর্মের কথা জানে উমা। কিন্তু আজ রাশেদ যে একটা চরিত্রহীন নারী লিপ্সা এটা তাঁর জানা ছিল না। উমা যেন কিছুতেই মানতে পারছেনা। ঘৃনায় ক্ষোভে উমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। শক্ত করে চেপে ধরে পার্সটা। হঠাৎ রাশেদের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
উমা আর স্থির থাকতে পারলোনা, পার্সটা রাশেদের মুখের সামনে ধরে ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,
এটা কী? এই কী তোমার কাজ, তোমার ব্যবসা?
রাশেদ স্বাভাবিকভাবে উঠে বালিশটা কোলের উপর নিয়ে আয়েশ করে বসে একটা সিগারেট ধরায়। উমার প্রশ্নের কোন আমলই দিল না।
উমার রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যায়, পার্সটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মাটিতে,
ছিঃ! তুমি এতোটা নীচ অসভ্য অমানুষ! তোমার মত একটা চরিত্রহীনকে স্বামী হিসেবে ভাবতে আমার ঘেন্না করছে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
ফুটবলের মত বালিশটা ছুঁড়ে দিয়ে রাশেদ তেড়ে আসে উমার দিকে,
Shut up , Enough 2 Enough Don’t exceed your limits !
বাহ, স্বচক্ষে দেখার পরও বোবা হয়ে থাকবো সেটাই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছ? উমাও উত্তপ্ত হয়ে জবাব দেয়।
Un culture , Un social মেয়ে কোথাকার! সমাজে স্ট্যাটাস বজায় রাখতে হলে সামান্য এমন কিছু হয়েই থাকে।যখন জেনেই গেছ সুতরাং এখন থেকে এগুলো মানিয়ে নেওয়াটাই তোমার জন্য মঙ্গল।
তুমি স্ট্যাটাস বলছ কাকে, ঐ নগ্ন প্রেমকে? যার শিকারে স্ত্রীর চোখকে ধূলো দিয়ে, লেলিয়ে দিচ্ছ তোমাদের ব্যাক্তিত্বকে চরিত্রকে তোমাদের স্বত্বাকে পিষে হত্যা করছ। আর ঐ নোংরা সমাজকে মেনে নিতে বলছো আমাকে? সেই সমাজের মুখে আমি থুথু দেই!
ব্যবসার কী বুঝ তুমি? টাকা রোজগার করতে —
কথাটা কেড়ে নিয়ে উমা তীব্র কণ্ঠে বলল,
চাইনা ঐ দুর্গন্ধযুক্ত পাপের টাকায় তোমার সংসার করতে!
একটা বিদ্রুপের হাসি হাসে রাশেদ,
অস্বীকার করতে পারবে, তোমার সুখের জন্য শানুর বদলে কেন আমাকে জামাই হিসেবে বেছে নিয়েছিল তোমার বাবা-মা? শুধু এই টাকার জন্য।
অন্যায় করেছে চরম ভুল করেছে। তাঁদের সেই ভুলের মাশুল দিতে গিয়ে আজ আমার বুকে গড়ে উঠেছে এক বিশাল যন্ত্রণার পাহাড়! তোমার এই রাজপ্রাসাদের প্রতিটি কোণায় কোণায় আর অঢেল টাকায় কত গন্ধ শুঁকেছি কিন্তু কই ? সুখ নামের ঐ দু’টি শব্দ আজও তো খুঁজে পেলাম না!
উমা নিজেকে সংবরণ করে, তোমার কাছে সুখ নেই শাহেদ, মিথ্যার আশ্রয়ে কেন আমায় বেঁধে রেখেছ? তোমার কোন অধিকার নেই আমার জীবনকে উপহাস করার অপমান করার। বিশ্বাস কর এই কঠিন দেওয়ালের মাঝে আমি আর জিন্দা লাশ হয়ে থাকতে পারবোনা!
উমা ঘুমন্ত বিন্দুকে কোলে তুলে নেয়। তারপর রাশেদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আকুতির স্বরে বলে,
এবার আমায় রেহাই দাও প্লিজ! চিরদিনের মত আমি তোমায় মুক্তি দিয়ে গেলাম ,বলে সামনের দিকে পা বাড়ায় উমা।
রাশেদ দরাজ গলায় বলে উঠে,
দাড়াও, স্বইচ্ছায় যেতে চাও, যাও। তোমায় আমি বাঁধা দিব না তবে বিন্দুকে নিতে পারবেনা ওকে রেখে যাও।
বিন্দু আমার মেয়ে, ও আমার কাছে থাকবে।
সেটাতো আদালত বলবে, বিন্দু কার কাছে থাকবে? সেদিন নিয়ে যেও।
রাশেদের এমন কঠিন উচ্চারণে, উমা থমকে দাঁড়ায়। উমা খুব ভালো করেই জানে রাশেদের টাকার কাছে সে কখনোই জয়ী হতে পারবেনা।
উমা ধীরে ধীরে বিন্দুকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
রাশেদের ঠোঁটে যেন একটা বিজয়ের বক্র হাসি।
উমা অবসন্ন দেহে বালিশে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে।
বাইরে দাঁড়িয়ে কমলা সবই শুনতে পায় । এতদিন দালানের সুখ নিয়ে সে, যে রচনা করে গেছে তা ঝড়ের বেগের মত নিমিষেই একটানে সব মুছে দিল।
কমলা একমনে বসে চুলের বিনুনি গাঁথছিল। এমনসময় সাবের এসে হাজির। পিছনে উমাও দাঁড়িয়ে। কমলা তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ায়।
সাবের বলল,
কমলা, তোর খোকন খুব অসুস্থ । তোর স্বামী আইজ-ই তোরে দেশের বাড়ি নিয়া যাইতে কইলো।
উত্তেজিত হয়ে কমলা বলে উঠে,
না,না বিবিসাহেব আমি যামু না আমি আর ঐ পিশাচের ঘর করুম না! কতবার আমারে মাইরা ধইরা খেদাইয়া দিসে আর কোলের পোলাডারে কাইরা নিসে, বলে আঁচলে মুখ ঢেকে হুহু করে কাঁদতে থাকে।
উমা কমলার খুব কাছে এসে দাঁড়ায়। একটা হাত কমলার কাঁধে রেখে মায়ার স্বরে বলল,
আমি সব শুনেছি তবুও বলছি তুমি ফিরে যাও কমলা। অতিরিক্ত টাকায় কেউ হয়ে যায় অমানুষ আর অল্প টাকায় হয় কেউ অমানুষ! ওদের হিংস্র আচরণের জন্য খোকনকে তাঁর মায়ের আদর সোহাগ থেকে কেন বঞ্চিত করবে, খোকন তো কোন দোষ করেনি? ,ওকে ঠকানোর কোন অধিকার তোমার নেই।
ভেজা চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে উমার মুখের দিকে তাকায় কমলা।
তাঁর সারা শরীরে স্নেহের একটা শিহরণ জেগে উঠে , “খোকন যেন তাঁর অপেক্ষায় মা মা করে হাতছানি দিয়ে ডাকছে!”
অবশেষে, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জেনেও পুটলিটা বগলের তলায় নিয়ে কমলা সাবেরের পিছন পিছন পা বাড়ায়।
কমলাকে শেষ দেখা পর্যন্ত উমা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে আর মনে মনে ভাবতে থাকে,
‘নারীরা বারবার মাতৃত্বের কাছে কেন হেরে যায়’?
রাজাধিরাজ – পুনম মায়মুনী [Famous Places in Murshidabad]
ভ্রমণ করতে কার না ভালো লাগে! কেউ হয়তো পারিবারিক কোনো অসুবিধের কারণে, কেউবা অর্থনৈতিক কারণে আবার কারোর সখ-ই নেই বেড়াবার। তবে এ শ্রেণীর মানুষ মনে হয় খুব কমই আছে। ছোটবেলা থেকে ভ্রমণের খুব আকর্ষণ ছিল সেই থেকেই যেখানেই যাই দর্শনীয় স্থানগুলো এখনো সুযোগ পেলে সেগুলো দেখতে চেষ্টা করি।আর মনে হয় সৃষ্টিকর্তা তাঁর বান্দার আশা কখনই অপূরণ রাখেন না।
২০১৮ সালে গিয়েছিলাম পশ্চিমবাংলার মুর্শিদাবাদে “হাজার দুয়ারী”। যেখানে মুঘল সম্রাটদের রাজত্ব ছিল। আলিবর্দি খা, সিরাজুদৌল্লার কথা আমরা প্রায় সকলেই ইতিহাসে পড়েছি আর সিরাজদৌল্লা বলতেই যেন আনোয়ার হোসেন, লুতফুন্নেসা-রোজি সামাদ, আলেয়া-আনোয়ারা এদেরই মুখয়ব ভেসে উঠে। ছাত্র জীবনে আমার আব্বাও সিরাজদৌল্লার পাঠ করেছিল সে গল্প আমাদের বলতো। এ প্রজন্মের সন্তানেরাও সেই নবাবের পাঠ করে যাচ্ছে। ইতিহাস ইতিহাস-ই সেটা পরিবর্তনের নয়,যুগ যুগ ধরে থেকে যাবে। যাক্ বাংলার প্রাচীন কীর্তি কথা না জানলে এবং দর্শনীয় স্থানগুলো না দেখলে বাংলার গৌরবময় অধ্যায় অজানা থেকে যায়। দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার মুর্শিদাবাদ সেই সম্রাটদের বাসস্থানে যেখানে নবাবদের রাজত্ব ছিল। তাঁদের খাট, পালঙ্ক ব্যবহারিক আসবাবপত্র , নবাবদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর অনেক কিছুই যা এখনও ইতিহাস বহন করে চলেছে। একদিনে তাঁদের সেই রাজত্ব দেখা সম্ভব নয়। যেখানে ছিল পরিবারের বসবাস সেখান থেকে তাঁদের জলসাঘর বা শাসন ব্যবস্থার কোথায় যে কী হচ্ছে স্ত্রীদের জানার কোনোই সম্ভাবনা নেই, এটাই আমার মাথায় খেলেছিল সেদিন! অনেক দূরত্ব রেখে রেখে ছিল সেই জায়গাগুলো। ভিতরের অনেক কিছুই ছবি নেওয়া নিষেধ তাই অনেক কিছুই তোলা হয়নি।
অনেক কিছুই লেখার ছিল কিন্তু স্বল্প পরিসরে তা সংক্ষেপে জেনে নেই ইতিহাস ও নবাবদের কিছু কথা। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের দূরত্ব ২০৪ কিলোমিটার। শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লোকাল, লালগোলা প্যাসেঞ্জার এবং এক্সপ্রেস ট্রেন করে মুর্শিদাবাদ যাওয়া যায়।তবে বাই ইয়ারে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই। আমরা গিয়েছিলাম বীরভূম থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে । বীরভূম থেকে মুর্শিদাবাদ কাছেরই পথ।
মুর্শিদাবাদ এবং নবাব আলিবর্দি খাঁ
মুর্শিদাবাদ নবাবী আমলে বাংলার বর্তমানে বিহার ঝাড়খণ্ড ওড়িশা পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এই জেলার উত্তরে মালদহ জেলা ও বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলা, দক্ষিণে নদীয়া জেলা, দক্ষিণ-পশ্চিমে পূর্ব বর্ধমান জেলা, পশ্চিমে বীরভূম জেলা এবং উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়খণ্ডের পাকুড় জেলা অবস্থিত ৷জেলার বেশিরভাগ জনগোষ্ঠী বাংলাভাষায় কথা বলে। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার রাজধানী মুর্শিদাবাদ ন্যূনাধিক অর্ধশতাব্দী অর্ধ যাবৎ এক বৃহৎ জনবহুল সমৃদ্ধ নগরীরূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বাংলার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ এর প্রতিষ্ঠাতা এবং এর পূর্বনাম মুকসুদাবাদ।
১৭০৬ খ্রিস্টাব্দে দেওয়ান মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার প্রথম নবাব রূপে পরিগণিত হন এবং তিনিই ছিলেন বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব। প্রাদেশিক দেওয়ান, বাংলা এবং উড়িষ্যার তখন থেকেই মুর্শিদাবাদে এর সমৃদ্ধির সূত্রপাত। ১৭৫৭ খ্রীঃ পলাশী যুদ্ধের পর হতেই এর গৌরব ম্লান হতে থাকে। কথিত আছে আনুমানিক ১৬৬০ সালে মুর্শিদকুলি খাঁ দাক্ষিণাত্য মালভূমির এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন এবং মাত্র দশ বছর বয়সে ইস্পাহান শহরের হাজী শফি নামক একজন পদস্থ মুগল কর্মকর্তা তাঁকে ইরানে নিয়ে পিতৃস্নেহে লালন-পালন ও প্রয়োজনীয় শিক্ষাদান করেন।
হাজী শফির মৃত্যুর পর তিনি ভারতে এসে গোলকুন্ডার দীউয়ান ও ফৌজদার হিসেবে মুগল সরকারের চাকরিতে যোগদান করেন এবং মনসবদারি লাভ করেন। সম্রাট আওরঙ্গজেব বাংলার প্রদেশের জন্য একজন সৎ ও দক্ষ দীউয়ান খুঁজছিলেন। তিনি তরুণ মুর্শিদকুলী খানকে এ পদের যোগ্য মনে করেন এবং ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সম্মানসূচক করতলব খান উপাধি দিয়ে দীউয়ান হিসেবে বাংলায় নিয়োগ প্রদান করেন।
নতুন নিয়োগ পেয়ে করতলব খান ঢাকায় পৌঁছেন। তিনি রাজস্ব ও অর্থনৈতিক প্রশাসনে স্বীয় যোগ্যতার পরিচয় দেন। তিনি ছিলেন সৎ এবং সম্রাটের অত্যন্ত বিশ্বস্ত। কিন্তু রাজকীয় স্বার্থ রক্ষা করতে বাংলার নাজিম ও সম্রাটের দৌহিত্র আজিমুদ্দীনের (পরবর্তী সময়ে আজিম-উস-শান) সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাঁধে। ফলে করতলব খানের জীবন হুমকির সম্মুখীন হয়।ফলে ১৭০২ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট তাঁকে গঙ্গার তীরবর্তী (ভাগীরথী শাখা) মকসুদাবাদে দফতর স্থানান্তরের অনুমতি দেন। ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দাক্ষিণাত্য যান এবং এ সাক্ষাতে তিনি ‘মুর্শিদকুলী খান’ উপাধি লাভ করেন। এভাবে তাঁর পদমর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়।সম্রাট মকসুদাবাদের নাম পরিবর্তন করে তাঁর নতুন উপাধি অনুসারে মুর্শিদাবাদ রাখার অনুমতি দেন।
বাংলায় নওয়াবী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা মুর্শিদকুলী খানের কর্মজীবন শুরু হয় প্রাদেশিক দীউয়ান হিসেবে। একে একে বাংলা ও উড়িষ্যার নাজিম বা গভর্নর, বিহারের দীউয়ান এবং কয়েকটি জেলার ফৌজদারের পদ অলঙ্কৃত করার পর আঠারো শতকের প্রথম দিকে তাঁর কর্মজীবনের সমাপ্তি ঘটে। মুর্শিদকুলী খান মসজিদ নির্মাণে যত্নবান ছিলেন। তিনিই ঢাকার করতলব খান মসজিদ (বেগম বাজার মসজিদ ) নির্মাণ করেন।
কাটরা মসজিদ
মুর্শিদাবাদ শহরের উত্তর পূর্ব দিকে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি বিখ্যাত কাটরা মসজিদে অবস্থিত। নবাবের ইচ্ছানুসারে এখানে একটি বাজার স্থাপন করা হয়। কাটরা শব্দের অর্থ গঞ্জ বা বাজার। এই কারণে কাটরা মসজিদ নামে পরিচিত। মসজিদের দুই প্রান্তে ৭০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট গম্বুজ ভগ্নদশায় পড়ে আছে। এই গম্বুজের উপর থেকে মুর্শিদাবাদ নগরীর অনেকাংশ দেখা যায়। ভিতর চত্বরে এক সঙ্গে প্রায় দুই হাজার লোকের নামাজ পড়বার ব্যবস্থা ছিল।
ঐতিহাসিকগনের লিখিত অনুযায়ী জানা যায়, মুর্শিদকুলি খাঁ বার্দ্ধক্যে উপনীত হলে মসজিদ সংলগ্ন নিজের একটি সমাধি ভবন নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৭২৫ খৃীঃ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। দুষ্কর্মের জন্য শেষদিকে তিনি খুবই অনুতপ্ত হয়েছিলেন এবং সাধুজনের পদধূলি তাঁর পাপ দূর করবে মনে করে সোপান শ্রেণির নীচে সমাধি প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করেছিলেন এবং তাঁর ইচ্ছানুযায়ী সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। মসজিদে কষ্টিপাথরের নির্মিত একখণ্ড ফলকে লেখা আছে; আরবের মুহাম্মদ উভয় জগতের গৌরব, যে ব্যক্তি তাঁর দ্বারের ধূলি লয়,তাঁর মাথায় ধূলি বৃষ্টি হউক।
মুর্শিদকুলি খাঁ ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর পালিত এক পুত্র ও দুই কন্যা ছিল। মৃত্যুর পর তাঁর পালিত কন্যার জামাতা (আজিমুন্নেসার স্বামী) সুজাউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত। তিনি দিল্লীর অনুকরণে শাহী মঞ্জিল, শাহী দরওয়াজা, দহপাড়া মসজিদ, ফরহাবাগ ও রোশনীবাগ নির্মাণ করেছিলেন। এই রোশনীবাগ বর্তমান হাজারদুয়ারী প্যালেসের সামনের দিকে ভাগীরথী নদীর পশ্চিমধারে অবস্থিত এবং এখানেই তিনি সমাহিত হন। নবাব সুজাউদ্দৌলার মৃত্যুর পর পুত্র সরফরাজ খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি অত্যন্ত অলস, অকর্মণ্য ও ভোগবিলাসী নবাব ছিলেন।
১৭৪০ খ্রীস্টাব্দে নবাব আলীবর্দি খাঁ গিরিয়ার যুদ্ধে নবাব সরফরাজ খাঁ ও মারাঠা দূত ভাস্কর পণ্ডিতকে বিশ্বাসঘাতকতা পূর্বক হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা পারস্য দেশের খোরাসান নামক স্থানের অধিবাসী ছিলেন। তাঁর বেগম সরফুন্নেসা অত্যন্ত জ্ঞানী, বিচক্ষণ ও দূরদর্শীনি মহিলা ছিলেন। তিনি সব ব্যাপারে তাঁর বেগমের পরামর্শ গ্রহণ করে চলতেন। আলিবর্দি খাঁ নিষ্কলুষ চরিত্রের একজন মানুষ ছিলেন ।তাঁর আঠারো বৎসর রাজত্বকালে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করত। খোসবাগে আলিবর্দি খাঁ’র সমাধি বিদ্যমান আছে ।
নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন আলীবর্দী খান-এর নাতি। আলীবর্দী খানের কোন পুত্র সন্তান ছিল না ছিল তিন কন্যা।আলীবর্দী খাঁ যখন পাটনার শাসনভার লাভ করেন, তখন তার তৃতীয়া কন্যা আমেনা বেগমের গর্ভে সিরাজ-উদ-দৌলা’র- জন্ম হয়। এ কারণে তিনি সিরাজের জন্মকে সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করে আনন্দের আতিশয্যে নবজাতককে নাতি হিসেবে গ্রহণ করেন। সিরাজ তার নানার কাছে ছিল খুবই আদরের।
নবাব আলিবর্দি খাঁ’র মৃত্যুর পর ১৭৫৬ খ্রীস্টাব্দে সিরাজদ্দৌলা নবাব হন । তাঁর দুই বেগম–লুতফুন্নেসা এবং ওমাতুন্নেসা। লুতফুন্নেসা প্রথমে নবাব আলিবর্দি খাঁ”র হারেমে ক্রীতদাসী ছিলেন। সিরাজ তাঁর অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বেগমরূপে গ্রহণ করেন। সিরাজ-উদ-দৌলা ছিলেন বাংলা-বিহার-ওড়িশার শেষ স্বাধীন নবাব। বাংলা ইতিহাসের এক প্রতিমূর্তি। পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয় ও মৃত্যুর পরই ভারতবর্ষে ১৯০ বছরের ইংরেজ শাসনের সূচনা হয়।
হাজারদুয়ারী প্রাসাদ
হাজারদুয়ারী প্রাসাদ, যা আগে বার কোঠি নামে পরিচিত ছিল, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদে কিলা নিজামতের ক্যাম্পাসে এটি গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। এই প্রাসাদ শহরের অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
দুপুরে এক হোটেল থেকে লাঞ্চ সেরে আমরা গঙ্গা নদীর ধার ঘেঁষে চওড়া রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম । মাঝে মাঝে নদীর পাশে বসার জন্য পাকা করা পুস্তা আবার সিঁড়ি নেমে গেছে নদীর জলে। অনেকে গোসল করছে হয়তো স্থানীয়রা হবে আবার হিন্দুশাস্ত্র মতে গঙ্গার জলে স্নান করে তাঁরা পবিত্র হয়। তাই নারী পুরুষ সবাই পবিত্র হওয়ায় ব্যস্ত। কিনার ঘেঁষে বড় বড় গাছগাছালির ছায়ায় ঘেরা । এতো মনোরম দৃশ্য দেখে গাড়িতে কিছুতেই বসে থাকতে পারলাম না। অনেক লোকের সমাগম। আমরা নেমে কিছুটা হালকা জায়গায় বসলাম । চারিদিক পাখির কলকাকলি আবার খাবারেরও ছড়াছড়ি! আর বাঙালিতো ভোজনরসিক। পানিপুরি মানে আমাদের ফুচকার মত যা লোভ সামলানো যায় না । আর আরেকটা খাবার আছে আমার ভীষণ প্রিয় পাপড়িচাট আর কিছু টুকটাক নাস্তা কফি খেয়ে আবার রওয়ানা হলাম হাজার দুয়ারীর উদ্দেশ্যে ।
সাধারণভাবে এরূপ নামকরণের অর্থ এক হাজার দরজার জন্য উক্ত প্যালেসকে “হাজার দুয়ারী”আখ্যা দেওয়া হয়েছে। হাজার দুয়ার সমন্বিত, তাই নাম হাজার দুয়ারি, যদিও এই হাজার দুয়ারের কিছু দুয়ার নকল, দেয়ালের গায়ে দরজার অনুকরণে ছবি আঁকা। বর্তমানে এই প্রাসাদটিকে একটি জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। টিকিট কেটে ভিতরে যেতে হয় ।আমরাও টিকেট কেটে ভিতরে গেলাম বিরাট এরিয়া । অনেকটা হেঁটে যেতে হয়। পাকা রাস্তার দু’পাশে সবুজ মাঠ । নানান গাছের সুশোভিত । হাতের ডানদিকে বিরাট মাঠের উপর ইমামবাড়া । পরের পর্বে ইমামবাড়ার কথা লিখব। প্রাসাদের ভিতরে ঢোকার আগে নিচেই সবার পার্স, মোবাইল সব রেখে খালি হাতে যেতে হয় । আর ছবি তোলা তো একেবারেই নিষেধ। প্রাসাদের উপরতলায় আশ্চর্যের একটা বিরাট আয়না আছে আপনি সামনে দাঁড়ালে নিজেকে কিছুতেই দেখতে পারবেন না কিন্তু পাশেরজন ঠিকই আপনাকে দিব্যি দেখতে পারবে।
প্রাসাদের পিছনদিকে বেশ কিছু দূরে একটি গেট আছে তার পিছন দিয়েই অনেক ছোট ছোট দোকানের মার্কেট সেখানে ঐতিহ্যবাহী এবং রাজকীয় কারুকার্য খচিত অনেক জিনিষপত্র বিক্রয় হয়। আমার তো কেনাকাটা আর উপহার দেওয়া আরেকটা ভীষণ পছন্দের বিষয়। একেতো চোখ ধাঁধানো সব জিনিষগুলো ছিল। নিজের জন্য, শ্বশুরবাড়ি, বাপেরবাড়ি সবার জন্যই পছন্দ করে কিনলাম। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিল ।ফেরার পথে রাস্তার পাশে সব খাবারের স্টলগুলো ,গাড়িতে বসেই গরম গরম লুচি ঘূর্ণি মজাদার দু’তিন রকমের মিষ্টি চা খেয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। ভারতে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি হয় সবাই জানি। নামগুলাও তেমন, লেংচা, বৈকুন্ডভোগ, খীরকদম্বো, চিত্তরঞ্জন, কালাকান্দ, দানাদার লড অরেঞ্জ, সিতাভোগ, রাজভোগ ক্ষীরভোগ অনেক নামের সমাহার, খেতেও দারুণ! স্নেক খাবারগুলাও ভীষণ সুস্বাদু খেতে। আমি বহুবার গিয়েছি ভারতে ঘুরাঘুরির সাথে সাথে সেখানকার খাবারগুলাও আমাকে খুব আকর্ষণ করে।
একদিনে এই নবাবদের রাজ্য দেখা সম্ভব না । তাই আমরা মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের কাছাকাছিই আমার শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়র হোটেলে গিয়ে উঠি অবশ্য আগে থেকেই বলা ছিল। এবার প্রাসাদের আরও কিছু জেনে নেই। এই প্রাসাদ ইতালির স্থাপত্যকলার এক জীবন্ত নিদর্শন।১৮২৯ খ্রীঃ ২৯ শে আগস্ট তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিস ও বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিগনের উপস্থিতিতে নবাব নাজিম হুমায়ুন-জা এই প্রাসাদের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। গাঁথুনির কাজে বহু পরিমাণ ডিমের কুসুম ব্যবহার করা হয়েছিল বলে শোনা যায়।
এই প্রাসাদটি তিনতলা, প্রতিটি কক্ষের কারুকার্য অত্যন্ত মনোরম। একতলায় অস্ত্রাগার, অফিস-কাছারি, রেকর্ড রুম ইত্যাদি আছে। অস্ত্রাগারে মোট ২৬০০ টি অস্ত্র সজ্জিত আছে। এই অস্ত্রগুলির মধ্যে কতকগুলি বিখ্যাত অস্ত্র এবং যে ছোরার সাহায্যে মোহাম্মদীবেগ সিরাজ-উ-দ্দৌলাকে হত্যা করেছিল সেটিও সযত্নে রক্ষিত আছে। ২য় ও ৩য় তলায় আর্টগ্যালারী ও লাইব্রেরী আছে। আর্টগ্যালারীতে বহু বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর চিত্রকলা স্থান লাভ করেছে। এদের মধ্যে “The buril of sir John More, Adom & Eve, Black Bent” বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
লাইব্রেরী ঘরে ছোটবড় আকারেরর বহু বিষয়ের এবং বিদেশী ভাষায় লিখিত নানান গ্রন্থ সংগৃহীত আছে। আবুল ফজল রচিত আইন- ই-আকবরির পাণ্ডুলিপিও এখানে দৃষ্ট হয়। একটি বিরাট আকৃতি বিশিষ্ট সুবিশাল এলবাম আছে যা দৈর্ঘ্যে তিন হাত, প্রস্থে দুই হাত আর ওজন প্রায় বিশ কেজি। তাছাড়া বাগদাদের বিখ্যাত লেখক হারুন-অর্-রশিদের হস্ত লিখিত কোরআন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই হাজার দুয়ারী প্যালেসের সম্মুখভাগে দু’পাশে মনোরম বাগান শোভা পায়। একতলা প্যালেসের সম্মুখভাগে বিশাল সিঁড়ি “দরবার কক্ষ” পর্যন্ত উঠেছে। সম্মুখে লম্বা গোলাকার স্তম্ভরাজি যাতে সুন্দর নক্সার কাজ রয়েছে। সিঁড়ির দু’পাশের সম্মুখভাগে অবস্থিত দুইটি সিংহ মূর্তি এর সৌন্দর্যকে আরও অপরূপ করেছে।
নবাবদের অনেক কিছু দেখার আছে, লিখার আছে যেমন জাফরাগঞ্জ সমাধি ক্ষেত্র মীরজাফর ও ফ্যামিলি, ওয়াসেফ মঞ্জিল, পলাশি মনুমেন্ট, কাশিমবাজার রাজবাড়ি, জগৎশেঠের বাড়ি, সিরাজের প্রাসাদ– হীরাঝিল ইত্যাদি। সল্প পরিসরে যেগুলো না লিখলেই না সেগুলোর সম্বন্ধে কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি…
ইমাম বাড়া
হাজার দুয়ারী প্যালেসের পর ইমাম বাড়ার কথা না বললেই নয়, প্যালেসের ঠিক বিপরীত দিকে ইমাম বাড়া অবস্থিত। নবাব হুমায়ুন-জার পুত্র বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার শেষ নবাব নাজিম মনসুর আলী খাঁ ফেরাদুন-জা ১৮৪৭ খ্রীঃ প্রায় সাত লক্ষ টাকা ব্যয় করে বর্তমান ইমাম বাড়াটি নির্মাণ করেন। “মহরম উৎসব” প্রতি বছর মহরম মাসের প্রথম দশদিন ইমাম বাড়ার সম্মুখস্থ উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে জাঁকজমক সহকারে এক মেলার আয়োজন করা হয়।
মহরমের পঞ্চম ও শেষদিন গুলিতে তাজিয়াসহ বিরাট জৌলুস বেড় হয়।শেষদিন সকাল বেলা ইমাম বাড়া হতে হাসান হোসেনের নকল মৃতদেহ শবাধার ও তাজিয়াসহ প্রকাণ্ড জৌলুস কেল্লা ও শহরের রাস্তা অতিক্রম করে কারবালা অভিমুখে যাত্রা করে। ঐ শোভাযাত্রায় যুবকেরা ধারালো অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে নিজেদের বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত করে ;হায় হোসেন হায় হোসেন বলে মাতন করে থাকেন। এই দৃশ্য খুবই মর্মান্তিক ও হৃদয় বিদারক।
আজিমুন্নেসা
হাজারদুয়ারীর পাশের রাস্তা দিয়ে, আজিমুন্নেসা বেগমের জীবন্ত সমাধি। নশীপুর যাওয়ার পথে মহিমাপুর ফাঁড়ির বিপরীত দিকে মুর্শিদকুলির খাঁর কন্যা ও সুজার খাঁর স্ত্রী আজিমুন্নেসার সমাধি অবস্থিত। শোনা যায় একবার তিনি ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পরায় হেকিম সাহেবের নির্দেশমতো গাছের শিকড়ের সাথে রোজ একটি জীবন্ত মানুষের কলিজা থেকে ঔষধ তৈরি করে খাওয়ানো হতো। ফলে রোগ মুক্তি হলো কিন্তু তিনি নেশাগ্রস্থের মতো মানুষের কলিজা খাওয়ার প্রচণ্ড নেশায় মেতে উঠলেন! তারপর গোপনে নিজের ঘনিষ্ঠ লোক দিয়ে মানুষ মেরে তাঁদের কলিজা খাওয়া শুরু করে।
তাই তাঁকে “কলিজা খাকী বেগম” বলে অভিহিত করা হতো। এই সংবাদ স্বামী সুজা খাঁ এর কানে পৌঁছলে তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে নরহত্যার অপরাধের জন্য বেগমকে জীবন্ত অবস্থায় সমাধিস্থ করার আদেশ দেন এবং অপরাধ মুক্তির জন্য ঐ সমাধির উপর একটি মসজিদ তৈরি করেন।
নশীপুর রাজবাড়ী
ইতিহাস প্রসিদ্ধ কুখ্যাত দেবী সিংহ এই রাজবাড়ী তৈরি করেন। দেবী সিংহের আদিবাড়ী ছিল পানিপথে। মুর্শিদাবাদ যখন চরম উন্নতির শিখরে দেবী সিংহ তখন সুদূর পানিপথ হতে ব্যবসা করার উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদে আগমন করেন । পরে তিনি দেওয়ান রেজা খাঁ’র অধীনে চাকরী গ্রহণ করেন এবং পরে ইংরেজ কোম্পানির অধীনে রেভিনিউ কালেক্টর পদে ভূষিত হন। ৭৬-এর মন্বন্তরের পরে রাজস্ব আদায়ের জন্য তিনি প্রজাদের উপর যেরূপ অত্যাচার উৎপীড়ন করেন তাঁর তুলনা হয় না। কৃতকর্মের ফল স্বরূপ তাঁর দুই পত্নী থাকা সত্ত্বেও তাঁর বংশরক্ষা হয় নি । তিনি বিভিন্ন উপায়ে প্রচুর ধনসম্পত্তির অধিকারী হন এবং বসতবাড়ির জন্য “হাজারদুয়ারীর” অনুরূপ প্রাসাদ তৈরি করেন। দেবী সিংহ ১৮০৫ খ্রীস্টাব্দে পরলোক গমন করেন। নশীপুর ‘ঝুলনযাত্রার” জন্য বিখ্যাত। ঐ উপলক্ষে এখানে জাঁকজমকপূর্ণ মালা বসত। তখন পুরাণ অবলম্বনে ‘পুতুলনাচ’ দেখানো হত।
কাঠগোলা বাগান
নশীপুর রাজবাড়ি হতে উত্তর পূর্ব দিকে ১ কিমি পথ গেলেই অত্যন্ত সুন্দর মনোরম পরিবেশে একটি প্যালেস, বাগান ও পরেশনাথের মন্দির চোখে পরে, এটাই কাঠগোলা বাগান নামে বিখ্যাত। বিশাল এই বাগানটিতে মূল্যবান গাছ ও ফুলের বাগানে সুশোভিত।
১৭৮০ সালে কাঠগোলা বাগানের প্রতিষ্ঠিত করেন লক্ষীপৎ সিং দুগর। প্রায় ২৫০বিঘা জায়গা নিয়ে বিশাল বাগানের মধ্যে দোতালা অট্টালিকার সামনে বড় পুকুর। সেই পুকুরে থাকত নানা ধরনের রঙ্গীন মাছ। এখানে জৈন মন্দির ও প্রাসাদ ছাড়াও রয়েছে চিড়িয়াখানা, হেরেম ও শ্বেত পাথরে বাঁধানো পুকুর। এই বাগানের মধ্যস্থিত প্রাসাদে বহু মূল্যবান আসবাবপত্র, তৈজসপত্র ও মর্মরমূর্তি রক্ষিত আছে। সেকালে কাঠগোলা বাগানে জলসা হতো এবং অনেক লোকের সমাগম হতো। বর্তমানে কাঠগোলা বাগান একটি দর্শনীয় স্থান। যেই দু’জনের কথা না লিখলেই না। (অতি সংক্ষেপে)
১) মীরজাফর
নাবাব মীরজাফর ছিলেন আলীবর্দি খাঁর ভগ্নীপতি তার পিতার নাম আহম্মদ নাজাফি। পিতামহ হুসেন নাজাফি আরব দেশের অধিবাসী ছিলেন। হুসেন নাজাফি, ইব্রাহিম তাবাতাবাই-এর ২২তম বংশধর। মীরজাফর আহম্মদ নাজাফির দ্বিতীয় পুত্র। তিনি অত্যন্ত কূটনীতিজ্ঞ ছিলেন এবং ছলে বলে কৌশলে দু’বার নবাব নিযুক্ত হয়েছিলান।
সিরাজ-উ-দ্দৌলার অধঃপতনের মূলে ছিল মীরজাফর। মীরজাফর অত্যন্ত বিলাস ও আড়ম্বর প্রিয় ছিলেন । তিনি বহু মূল্যবান পোষাক পরিচ্ছদ ও হীরা জহরত খচিত গলার হার পড়তেন। তিনি অদূরদর্শী ছিলেন । পলাশী যুদ্ধের পর তিনি বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত হয়ে ইংরেজদিগের অবিরত অর্থের দাবী মিটাতে অপারগ হন এবং এর ফলে অবলম্বে তাঁকে সিংহাসনচ্যুত হতে হয়।
মীরজাফর ৭৪ বৎসর বয়সে ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দে ১৭ই জানুয়ারি পরলোক গমন করেন।
২) ঘসেটি বেগম
নবাব আলিবর্দি খাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা । ঢাকার শাসনকর্তা নবাব নোয়াজিস মহম্মদ খাঁ ছিলেন তাঁহার স্বামী। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন । এজন্য সিরাজের কনিষ্ঠ ভ্রাতা একরাউদ্দৌলাকে পুত্র রূপে গ্রহণ করেন । বেগমের অনু্রোধে নওয়াজিস মহম্মদ মোতিঝিল প্রাসাদ তৈরি করেন। এই প্রাসাদের সামনে একটি বিরাট ঝিল তৈরি করেন একসময় এই ঝিলে মুক্তার চাষ হতো। ঘসেটি বেগম ছিলেন ঐশ্বর্যশালিনী। তার ইচ্ছা ছিল তাঁর পালিত পুত্রকে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা । সিরাজকে ঘসেটি বেগম কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না । সিরাজের ধ্বংসই ছিল তাঁর কাম্য। সেজন্য তিনি ষড়যন্ত্রকারী মীরজাফর, জগৎশেঠ, রাজবল্লব, উমিচাঁদ এবং ইংরেজদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন ।
পলাশির রণক্ষেত্রে পরাজিত হয়ে মিরণের আদেশে বন্দী অবস্থায় সিরাজ নিহত হন এবং মীরজাফর বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার মসনদে বসেন। এই সময় থেকে নবাব আলিবর্দি খাঁর পরিবারবর্গের প্রতি অত্যন্ত অত্যাচার আরম্ভ হয়। আলিবর্দির বেগম ও তাঁর কন্যাদ্বয় ঘসেটি ও আমেনা এবং সিরাজউদ্দৌলার স্ত্রী ও শিশুকন্যাকে অযথা কষ্ট প্রদান করে বন্দীভাবে রাখা হয়।
বন্দী অবস্থায় তাঁর চূড়ান্ত যন্ত্রণা ভোগ করলে তাঁদের মুর্শিদাবাদ থেকে ঢাকায় নির্বাসিত করা হয়। মিরণ তাঁদের জীবিত থাকা অসহ্য মনে করে তাঁদের বিনাশ সাধনে প্রবৃত্ত হন। আলিবর্দি খাঁর বেগম এবং সিরাজের বেগম ও কন্যা কোনরূপে অব্যাহতি পান। কিন্তু ঘসেটি ও আমেনা বেগমকে নৌকা থেকে নদীগর্ভে নিক্ষেপ করা হয়।
মুর্শিদাবাদ ঘুরে আমরা আসার পথে… মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত কয়টা সিল্ক শাড়ি ও বিখ্যাত ছানাবড়া কিনে নিলাম…
পুনম মায়মুনী | Punom Mymoni
Poila Baisakh 1430 | স্মরণে-বরণে ১লা বৈশাখ
New Bengali Story 2023 | দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী (পর্ব ১) | শওকত নূর
Bishnupur Fair | ফিরে দেখা – বিষ্ণুপুর মেলা (১৯৮৮-২০২১)
New Bengali Article 2023 | সার্বজনীনতার খোঁজে
New Best Story Blogs | Top Best Story Blogs | Best Story Blogs in pdf | Sabuj Basinda | High Challenger | Best Story Blogs 2023 | Shabdodweep Best Story Blogs | Shabdodweep Writer | Best Story Blogs in India | World’s Best Story Blogs | Best Story Blogs in Online | Online Best Story Blogs | Free Best Story Blogs | Best Story Blogs in Bengali | Best Story Blogs in English | Full Bangla Galpo 2023 pdf | Full Bangla Galpo online | New Full Bangla Galpo | Golpo Dot Com – Episode | Golpo Dot Com Series | Horror Adult Story Video | Horror Adult Story Audio | Full Bangla Galpo Audio | Full Bangla Galpo Video | Full Bangla Galpo Netflix | Full Bangla Galpo Read | Full Bangla Galpo Download | Shabdodweep Competition | Story Writing Competition | Bengali Writer | Bengali Writer 2023 | Trend Full Bangla Galpo | Recent Full Bangla Galpo | Top Full Bangla Galpo | Popular Full Bangla Galpo | Best Full Bangla Galpo | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Golpo Dot Com Download | Bengali Famous Story – audio | Horror Adult Story | Horror Adult Story Collection | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Famous Story 2023 | Shabdodweep Bengali Famous Story | New Bengali Famous Story | Bengali Famous Story in pdf | Bengali Famous Story – audio | Bengali Famous Story – video | Bengali Famous Story mp3 | Full Bengali Famous Story | Bengali Famous Story – Tanushri Giri | Shabdodweep Magazine | Shabdodweep Web Magazine | Golpo Dot Com Writer | Shabdodweep Writer | Shabdodweep Poetry | Natun Bangla Galpo 2023 | Natun Bangla Galpo 2023 book | Horror Adult Story Ebook | Horror Adult Story in Bengali | Natun Bangla Galpo 2023 pdf book | Writer – Natun Bangla Galpo 2023 | Golpo Dot Com in pdf | Top Writer – Natun Bangla Galpo 2023 | Natun Bangla Galpo 2023 video series | Natun Bangla Galpo 2023 – web series | Natun Bangla Galpo 2023 – Latest version | Golpo Dot Com Full Download | Natun Bangla Galpo 2023 pdf book | web video – Natun Bangla Galpo 2023 | web reader – Natun Bangla Galpo 2023 | pdf reader – Natun Bangla Galpo 2023 | pdf publisher – Natun Bangla Galpo 2023 | Golpo Dot Com Translation | Shabdodweep Publisher | Shabdodweep Golpo Dot Com | Shabdodweep Publisher 2023 | Shabdodweep Video Publisher | Shabdodweep Audio Book | Bengali Horror Adult Story | Best Selling Horror Adult Story | Shabdodweep Video Book | bengali story | bengali story books for child pdf | bengali story books for adults | bengali story books | bengali story books for child | bengali story books pdf | bengali story for kids | bengali story reading | short story | short story analysis | short story characteristics | short story competition | short bengali story definition | short story english | short story for kids | Best Selling Golpo Dot Com | short bengali story generator | New Horror Adult Story | bengali story 2023 | short story ideas | short story length | long story short | long story short meaning | long bengali story | long story | long story instagram | story writing competition | story writing competition topics | story writing competition for students | story writing competition malayalam | story writing competition india | story competition | Top Horror Adult Story | Horror Adult Story Episode | Shabdodweep Horror Adult Story | 2023 Top Horror Adult Story | Top ranking Horror Adult Story | Golpo Dot Com 2023 | Top Golpo Dot Com