Gita Theory Discussion – Projjwal Mandal
গীতা তত্ত্ব – প্রোজ্জ্বল মণ্ডল
গীতা হিন্দুদের এক পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ।গীতা প্রতিটি হিন্দুর নিত্য পাঠ্য।গীতাতে মত আঠারো টি অধ্যায় ও সাতশো শ্লোক রয়েছে। গীতার অন্তর্নিহিত তত্ত্ব খুবই জটিল।গীতা তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হল। —
গীতোক্ত ধর্মের স্বরূপ
(অধ্যায় ২/১৬-২৯) যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের অনুসারে, অসৎ বস্তুর অস্তিত্ব নেই এবং সত্যের কোনকালে অভাব নেই। ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। পরমাত্মাই সত্য, শাশ্বত, অজর,অমর, অপরিবর্তনশীল এবং সনাতন; কিন্তু সেই পরমাত্মা অচিন্ত্য এবং অগোচর,চিত্তের তরঙ্গের অতীত। চিত্ত নিরোধ কিরূপে সম্ভব? চিত্ত নিরুদ্ধ করে পরমাত্মাকে লাভ করার বিধি-বিশেষের নাম নিষ্কাম কর্ম। এই কর্মকে করে যাওয়াই ধর্ম ও দায়িত্ব।
গীতা (অধ্যায় ২/৪০) তে বলেছেন যে, অর্জুন! এই কর্মযোগে আরম্ভের নাশ নেই। এই কর্মরূপ ধর্মের অল্প সাধনও জন্ম-মৃত্যুর মহাভয় থেকে উদ্ধার করে অর্থাৎ এই কর্মকে করে যাওয়াই ধর্ম। এই নিয়ত কর্মকে (সাধন-পথ) সাধকের স্বভাবজাত ক্ষমতানুসারে চার শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে। কর্ম অবগত হয়ে মানুষ যখন থেকে কর্মের অনুষ্ঠান করে, তখন সেই আরম্ভিক অবস্থাতে সে শূদ্র। ক্রমশঃ যখন বিধি আয়ত্তে আসে,তখন সেই বৈশ্য শ্রেণীভুক্ত। প্রকৃতির সংঘর্ষকে সহ্য করার ক্ষমতা এবং শৌর্যযুক্ত হলে সেই ব্যক্তিই ক্ষত্রিয় এবং ব্রহ্মের তদ্রূপ হওয়ার ক্ষমতা, জ্ঞান (ব্রহ্মজ্ঞান),বিজ্ঞান সেই অস্তিত্বের উপর নির্ভর থাকার ক্ষমতা-এরূপ যোগ্যতা লাভ হলে সেই ব্যক্তিই ব্রাহ্মণ।অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী ব্যক্তিই প্রকৃতপক্ষে ব্রাহ্মণ।
সেইজন্য যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণ (গীতা, অধ্যায় ১৮/৪৬-৪৭) বলেছেন যে, স্বভাবে যে ক্ষমতা আছে, সেই অনুসারে কর্মে প্রবৃত্ত হওয়া স্বধর্ম। গুরুত্ব কম হলেও স্বভাবে উপলব্ধ স্বধর্ম শ্রেয়স্কর ও ক্ষমতালাভ না করে অন্যের উন্নত কর্মের অনুকরণ ক্ষতিকর। স্বধর্মে মৃত্যুও শ্রেয়স্কর;পরের ধর্ম ভয়াবহ। কারণ বস্ত্র পরিবর্তন করলে পরিবর্তন কর্তার তো পরিবর্তন হয় না। তার সাধনার ক্রম আবার সেখান থেকেই আরম্ভ হবে, যেখানে ছেদ পড়েছিল। ক্রমে ক্রমে চলে অর্থাৎ ক্রমবিকাশের পথে সেই মুমুক্ষু ব্যক্তিই পরমসিদ্ধি অবিনাশী পদলাভ করেন অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন।শুদ্ধ মনই মুক্তির হেতু এবং বিষয়াসক্ত মনই বন্ধনের কারণ।আত্মতত্ত্ব উপলব্ধি করাই ধর্মের একমাত্র উদ্দেশ্য।এরই উপর জোর দিয়ে বলছেন যে, যে পরমাত্মা থেকে সকল প্রাণীর উৎপত্তি হয়েছে, যিনি সর্বব্যাপ্ত, স্বভাবে যে ক্ষমতা বিদ্যমান সেই ক্ষমতানুসারে তাঁকে উত্তমরূপে পূজা করে মানুষ পরমসিদ্ধি লাভ করে। অর্থাৎ নিশ্চিত বিধিদ্বারা এক পরমাত্মার চিন্তনই ধর্ম।
ভগবান স্পষ্ট বলেছেন যে, “অর্জুন ! অত্যন্ত দুরাচারীও যদি অনন্যভাবে আমাকে ভজনা করে (অনন্য অর্থাৎ অন্য নয়), আমা ভিন্ন অন্য কারও ভজনা করে না, কেবল আমাকে ভজনা করে, ‘ক্ষিপ্রং ভবতি ধর্মাত্মা’–সে শীঘ্রই ধর্মাত্মা হয়ে যায়, তার আত্মা ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।” অতএব শ্রীকৃষ্ণের অনুসারে-ধর্মাত্মা সেই, যে এক পরমাত্মাতে অনন্য নিষ্ঠার সঙ্গে নিযুক্ত। ধর্মাত্মা সেই, যে একমাত্র পরমাত্মার প্রাপ্তির জন্য নিয়ত নিষ্কাম কর্মের আচরণ করে। ধর্মাত্মা সেই, যে স্বভাবজাত ক্ষমতানুসারে পরমাত্মার খোঁজে রত।
অবশেষে শ্রী ভগবান বলছেন যে — “সর্বধর্মান পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।”-অর্জুন! সকল ধর্মের অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করে একমাত্র আমার শরণাগত হও। অতএব একমাত্র পরমাত্মার প্রতি সমর্পিত ব্যক্তিই ধার্মিক। একমাত্র পরমাত্মাতে শ্রদ্ধা স্থির করাটাই ধর্ম।সেই এক পরমাত্মার প্রাপ্তির নিশ্চিত নিষ্কাম ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করা ধর্ম।ধর্ম আচরণের বিষয়। সেই আচরণ কেবল একটাই—“ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন।” (২/৪১) এই কর্মযোগে নিশ্চয়াত্মিকা ক্রিয়া একটাই–ইন্দ্রিয়সমূহের চেষ্টা এবং মনের কার্যকে সংযম করে আত্মাতে (পরাৎপর ব্রহ্মে) প্রবাহিত করা (৪/২৭)।কর্মযোগ,জ্ঞানযোগ,রাজযোগ এবং ভক্তিযোগ প্রত্যেকটি মুক্তিমার্গ। ঈশ্বরের প্রতি আস্থা রেখে নিজের মোক্ষার্থে এবং জগতের কল্যাণ সাধনই ধর্ম।নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারাই চিত্তশুদ্ধি হয় এবং চিত্তশুদ্ধি দ্বারা জ্ঞান লাভ হয়।এই জ্ঞান মোক্ষ লাভের পাথেয় হয়।যিনি জীব ও ব্রহ্মের অভেদতত্ত্ব সম্পর্কে অবহিত তিনিই ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে অবগত।
গীতোক্ত জ্ঞানযোগ
প্রথমেই ব্রহ্মজ্ঞান সম্পর্কে ধারণা প্রয়োজন। যার দ্বারা অব্যক্ত হইতে স্থাবর পর্যন্ত বহুধা-বিভক্ত সর্বভূতে এক অবিভক্ত অক্ষর আত্মবস্তু দৃষ্ট হয় ,যার দ্বারা বিনাশশীল,সর্বভূতে নির্বিশেষ ভাবে অবস্থিত অবিনাশী পরমাত্মাকে দর্শন করা যায় এবং যার দ্বারা জীব ব্রহ্মের অভেদতত্ব প্রকাশিত হয় তাই হলো ব্রহ্মজ্ঞান।ব্রহ্মজ্ঞান থেকে মোক্ষলাভ হয়। অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী জন্ম মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হন।জ্ঞানী সম্যগদর্শী ব্যক্তি সমস্ত প্রাণীতে পরমাত্মার দর্শন করেন।এককথায় যা দ্বারা আত্মতত্ব উপলব্ধি করা যায় তাই হল ব্রহ্মজ্ঞান।গীতায় জ্ঞান বলতে ব্রহ্মজ্ঞানকেই বোঝানো হয়েছে।
- জ্ঞানমার্গ সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন —
‘যে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পর্যুপাসতে ।
সর্বত্রগমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলং ধ্রুবম্ ॥
সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সৰ্বত্ৰ সমবুদ্ধয়ঃ ।
তে প্ৰাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ ॥’
— সর্বত্র সমবুদ্ধি, সকলেরই কল্যাণে নিরত, যাঁরা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে শব্দাদির অগোচর, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী,অচিন্ত্য,নির্বিকার,অচল ও শাশ্বত নির্গুণব্রহ্মকে উপাসনা করেন, তাঁরা আমাকেই প্রাপ্ত হন।
এখানে শ্রীভগবান জ্ঞানীর লক্ষ্য নির্গুণব্রহ্ম সম্বন্ধেও বললেন,আবার ‘সংনিয়ম্য ইন্দ্রিয়গ্রামম্’, ‘সৰ্বত্ৰ সমবুদ্ধয়ঃ’, ‘সর্বভূতহিতে রতাঃ’ বলে জ্ঞানমার্গের সাধনপদ্ধতিরও উল্লেখ করলেন।
জ্ঞান সম্পর্কে যেমন তিনি বলছেন, ‘ন হি জ্ঞানেন সদৃশং পবিত্রমিহ বিদ্যতে’–‘জ্ঞানের সদৃশ পবিত্র আর কিছুই এ জগতে নেই।’ এখানে জ্ঞান মানে ব্রহ্মজ্ঞান। ‘জ্ঞানাগ্নিঃ সর্বকর্মাণি ভস্মসাৎ কুরুতেহর্জুন।’ ‘জ্ঞানাগ্নি সমস্ত কর্মকে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়।’ আবার তিনি বলছেন, ‘ক্লেশোঽধিকতরস্তেষাম-ব্যক্তাসক্তচেতসাম্’–‘অব্যক্তের যাঁরা চিন্তা করেন, জ্ঞানের অনুশীলন যাঁরা করেন তাঁদের অত্যন্ত ক্লেশ হয়।করেন তাঁরা দেহবান। দেহ এবং জগতের সবকিছুকে উপেক্ষা করে নির্গুণ অব্যক্তকে লাভ করা অত্যন্ত ক্লেশকর।এই অব্যক্তই হচ্ছে পরমতত্ত্ব, নির্গুণব্রহ্ম।
- শঙ্করাচার্যের মতে —
‘তস্মাৎ গীতাসু কেবলাদেব তত্ত্বজ্ঞানাৎ মোক্ষপ্রাপ্তিঃ, ন কর্মসমুচ্চয়াৎ।’ অর্থাৎ গীতার সিদ্ধান্ত এই যে,কেবলমাত্র তত্ত্বজ্ঞানেই মুক্তিলাভ হয়, জ্ঞান ও কর্মের সমুচ্চয়ের ফলে নহে। তাঁহার মতে, ব্রহ্মাত্মৈক্যদর্শনরূপ জ্ঞান দ্বারা অজ্ঞান বিনাশপূর্বক নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি, ব্রাহ্মীস্থিতি বা ব্রহ্মনির্বাণলাভই গীতার উপদেশ। অজ্ঞানই দ্বৈতভাব-উৎপাদক। এই দ্বৈতভাব হইতেই সকল কর্ম হয়। দ্বৈতভাব-নাশান্তে নিষ্ক্রিয় আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইলেই সর্ব-কর্মসন্ন্যাস হয়। নিষ্কাম কর্ম, ভক্তি বা যোগ দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে মানুষ মুমুক্ষু হয়।আত্মজ্ঞানলাভ না হইলে নৈষ্কর্ম্যসিদ্ধি অসম্ভব।
- রামানুজাচার্যের মতে —
জীব (চিৎ), জগৎ (অচিৎ) ও ব্রহ্ম—এই তিনটি তত্ত্ব স্বতন্ত্র হইলেও ব্রহ্ম জগৎ ও জীববিশিষ্ট। তাঁহার মতে,ব্রহ্মের সঙ্গে জীব ও জগতের স্বজাতীয় ও বিজাতীয় ভেদ না থাকিলেও স্বগতোভেদ অবশ্য স্বীকার্য। তাঁহার দার্শনিক মত বিশিষ্টা-দ্বৈতবাদ ও তিনি ভক্তিধর্মের প্রচারক। তিনি বলেন, ‘বর্ণাশ্রমধর্ম অবশ্য পালনীয়।’ কারণ সকল শাস্ত্র এই বিষয়ে একমত —‘একশাস্ত্রার্থতয়ানুষ্ঠেয়ম্’। এছাড়া তিনি বলেছেন
— ‘অনভিসংহিত-ফলেন কেবল-পরম-পুরুষারাধনরূপেণানুষ্ঠিতেন কর্মণা বিধ্বস্ত-মনো-মলব্যাকুলেন্দ্রিয়ো
জ্ঞাননিষ্ঠায়াম্ অধিকরোতি।’
অর্থাৎ ফলাকাঙ্ক্ষা বিসর্জন করিয়া ঈশ্বরকে প্রসন্ন করিবার জন্য বর্ণাশ্রমধর্ম অনুষ্ঠিত হইলে ‘ভাবসংশুদ্ধি’ হয় এবং মানুষ জ্ঞানের অধিকারী হয়।
গীতোক্ত ভক্তিযোগ
ভক্তির মাধ্যমে যে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় তা গীতাতে উক্ত হয়েছে।ভক্তির প্রসঙ্গে ভগবান অর্জুনকে বললেন—
‘ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন ।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ ॥
–- হে শত্রুতাপন অর্জুন, অনন্যা ভক্তির দ্বারাই আমাকে জানতে,প্রত্যক্ষ করতে এবং আমাতে প্রবেশ করতে অর্থাৎ মুক্তিলাভে ভক্তেরা সমর্থ হয়।
ভগবান আরো বললেন—
‘ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।
অর্থাৎ, — ভক্তির দ্বারাই সাধক আমার সগুণ ও নির্গুণরূপ জানেন এবং সেই নির্গুণরূপ জানার পরেই আমাতে প্রবিষ্ট হন অর্থাৎ মুক্তিলাভ করেন।
এই ভক্তির কথা বলতে গিয়ে গীতাতে এক নতুন চিন্তাধারা এসেছে।সেটি হচ্ছে প্রপত্তি বা শরণাগতি — ভগবানের শরণ নেওয়া সর্বতোভাবে।এই প্রপত্তির কথা গীতার সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে।যেমন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন — ‘তমেব শরণং গচ্ছ সর্বভাবেন ভারত’ – হে ‘অর্জুন,তুমি সর্বতোভাবে তাঁরই – সেই ঈশ্বরেরই শরণাগত হও’; ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যাজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ – ‘সব ধর্মাধর্ম ছেড়ে একমাত্র আমারই শরণ নাও।’
- যিনি সকল প্রাণীর প্রতি দ্বেষহীন, মিত্রভাবাপন্ন, মমত্ববুদ্ধিশূন্য, নিরহঙ্কার,সুখে আসক্তি ও দুঃখে দ্বেষ – বর্জিত,ক্ষমাশীল,সাদা সমাহিতচিত্ত, তত্ত্ববিষয়ে স্থির, হর্ষ ও বিষাদ হইতে মুক্ত, নিঃস্পৃহ, পক্ষপাতশূন্য, ভয়হীন, নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠাতা, আসক্তিহীন, শত্রু ও মিত্রে সমবুদ্ধি সম্পন্ন এবং যিনি ইষ্ট প্রাপ্তিতে হৃষ্ট হন না, অনিষ্ট প্রাপ্তিতে দ্বেষ করেন না,উদ্বেগ হইতে মুক্ত এবং যিনি শুভাশুভ সকল কর্ম পরিত্যাগ করেছেন তিনি ভগবানের প্রিয় ভক্ত।(গীতা ১২/১৩-২০)।
- রামানুজের গুরু যামুন তাঁর গীতাগ্রন্থে বলেন – নারায়ণই পরব্রহ্ম;একমাত্র ভক্তি দ্বারাই সেই নারায়ণকে প্রাপ্ত হওয়া যায়।স্ব – স্ব বর্ণের ধর্মানুষ্ঠান,সম্যক শাস্ত্রজ্ঞান এবং তীব্র বৈরাগ্য দ্বারা ঈশ্বরভক্তি লাভ হয়।শ্রীধর স্বামীর মতে,জ্ঞান ও ভক্তি স্বরুপত এক হলেও ভক্তিই মুক্তিদাত্রী।
গীতোক্ত কর্মযোগ
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজের নিকট – আত্মীয়দের দেখে অর্জুন বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন।তাই অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বলেন — অর্জুনকে আমরা তাই বলতে শুনি, ‘আমি ভিক্ষুবৃত্তি অবলম্বন করব—সন্ন্যাস গ্রহণ করব, আমি যুদ্ধ করব না।’তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, না–কর্মের প্রয়োজন রয়েছে।তাছাড়া কর্ম ছেড়ে কেউ থাকতে পারে না এক মুহূর্তও, শরীর যতক্ষণ আছে কর্মও ততক্ষণ আছে। শারীরিক কর্ম আপাতদৃষ্টিতে না থাকলেও মানসিক কর্ম থাকবেই। শ্রীকৃষ্ণ আরো বললেন, ‘ন কর্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে। ন চ সংন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥’—‘কর্মানুষ্ঠান না করে কেউ নৈষ্কর্ম্য-অবস্থা লাভ করতে পারে না, আর কর্মত্যাগ করলেই সিদ্ধিলাভ হয় না।’ কর্মের মধ্য দিয়েই—নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই কর্মবন্ধন মোচন হয়, চিত্ত শুদ্ধ হয়। সেই শুদ্ধ চিত্তে আত্মসাক্ষাৎকার হয়। কর্ম মানুষকে করতেই হবে। কর্ম ছাড়া সে থাকতেই পারে না।
- নিষ্কাম কর্মযোগই গীতার শ্রেষ্ঠ বানী।কর্ম সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন —
‘তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পূরুষঃ ॥'(গীতা ৩/১৯)
শ্রীভগবান অর্জুনকে বলিতেছেন – সেই হেতু সদা অনাসক্ত হইয়া কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠান কর। মানুষ অনাসক্ত হইয়া কর্ম করিলে পরম পদ প্রাপ্ত হয়। এই শ্লোকে ভগবান স্পষ্টই বলিয়াছেন যে, নিষ্কাম কর্মযোগ দ্বারা মুক্তিলাভ হয়।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্ম সম্পর্কে আরও বলেছেন — যাঁরা নিষ্কাম কর্মবিষয়ে শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হয়ে আমার এই মত সর্বদা অনুষ্ঠান করেন, তাঁরাও বন্ধন থেকে মুক্ত হন।(গীতা ৩/৩১)।
ভগবান অর্জুনকে তাই বলছেন, ‘নিয়তং কুরু কর্ম ত্বম্’—‘শাস্ত্রবিহিত কর্ম তুমি সর্বদা করো।’ গীতামতে বর্ণধর্ম ও আশ্রমধর্ম অনাসক্ত ভাবে পালন করলে মানুষ মুক্তিলাভ করে।
ভগবান তাই বলেছেন —
শ্রেয়ান্ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ ॥ (গীতা ৩/৩৫)।
অর্থাৎ,– স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হইলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বর্ণাশ্রমবিহিত স্বধর্মসাধনে নিধনও কল্যাণকর;কিন্তু অন্যের বর্ণাশ্রমোচিত ধর্মের অনুষ্ঠান অধোগতির কারণ বলিয়া বিপজ্জনক। সুতরাং ভগবান স্ব-স্ব বর্ণের ধর্মের অনুষ্ঠান করতে বলেছেন।নিষ্কাম বর্ণবিহিত কর্মই মুক্তির কারণ।
মহাভারতে অর্জুন তাই বলেছেন —
‘অসক্তঃ সক্তবদ্ গচ্ছন্ নিঃসঙ্গো মুক্তবন্ধনঃ ।
সমঃ শত্রৌ চ মিত্রে চ স বৈ মুক্তো মহীপতে ॥'(মহাভারত ১২/১৮/৩১)।
অর্থাৎ, যে অনাসক্ত বন্ধনহীন পুরুষ শত্রু-মিত্রে সমদর্শী এবং সক্তবৎ ব্যবহারশীল হন তিনি মুক্ত। হে মহীপতে, ইহাই গীতোক্ত মুক্তির আদর্শ। যাজ্ঞবল্ক্য-স্মৃতিতে (৩/২০৪-২০৫) সন্ন্যাসীর অবস্থা বর্ণনান্তে কথিত আছে, ‘সত্যশীল জ্ঞাননিষ্ঠ গৃহী সন্ন্যাসগ্রহণ না করিয়াও মুক্তিলাভ করেন।’ ব্যাধগীতাতে আছে ব্যাধ মাংস বিক্রয়রূপ স্বীয় বর্ণধর্ম নিষ্কাম ভাবে পালন করে আত্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন।মহাভারতে দেখা যায় অনাসক্তভাবে পরিষেবা দ্বারাই সতীসাধ্বী স্ত্রীর জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছিল। বাল গঙ্গাধর তিলক বলেছেন — “নিষ্কাম কর্মই গীতার ধর্ম; যেহেতু শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং পূর্ণ আত্মজ্ঞান সত্ত্বেও নিষ্কাম কর্ম অনুষ্ঠান ও প্রচার করেছিলেন ‘।
গীতোক্ত সন্ন্যাসযোগ
ভগবান শাস্ত্রীয় কর্মের ত্যাগ তথা কর্ম সন্ন্যাসের এবং শাস্ত্রীয় কর্মের অনুষ্ঠান তথা নিষ্কাম কর্মযোগের উপদেশ দিয়েছেন।এই দুটি একসঙ্গে অনুষ্ঠেয় নয়।তাই এই দুটির মধ্যে কোনটি প্রকৃত মোক্ষদায়ী তা অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করছেন। উত্তরে শ্রী ভগবান বললেন – কর্মের ত্যাগ ও কর্মের অনুষ্ঠান উভয়েই মুক্তিমার্গ,কিন্তু তাহাদের মধ্যে জ্ঞানহীন কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা নিষ্কাম কর্মের অনুষ্ঠান উৎকৃষ্টতর।কর্মযোগ দ্বারা চিত্ত শুদ্ধ হইলে জ্ঞান উৎপন্ন হয়।তখন জ্ঞানের পরিপাকের জন্য জ্ঞাননিষ্ঠার অঙ্গরূপে কর্মসন্ন্যাস কর্তব্য। অবিদ্বানের পক্ষে কর্মসন্ন্যাস অপেক্ষা কর্মযোগ সহজ বলে শ্রেষ্ঠ।তবে বৈরাগ্য থাকলে অবিদ্বানের কর্মসন্ন্যাস নিষিদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানযুক্ত নিষ্কাম কর্মযোগই সন্ন্যাস।অর্থাৎ,আত্মজ্ঞানের স্বরূপই সন্ন্যাস।
সন্ন্যাসীকে এই প্রসঙ্গে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন – যিনি দুঃখ ও দুঃখের সাধনকে দ্বেষ করেন না এবং সুখ ও সুখের সাধনকে আকাঙ্ক্ষা করেন না,সেই রাগদ্বেষাদি – শূন্য কর্মযোগীকে নিত্যসন্ন্যাসী বলে জানবে।কারণ হে মহাবাহু, রাগদ্বেষাদি – দ্বন্দহীন ব্যক্তি সংসার বন্ধন থেকে অনায়াসে মুক্ত হন।– (গীতা ৫/৩)।অর্থাৎ,দ্বেষ ও আকাঙ্ক্ষা শূন্য বৈরাগী ব্যক্তিই প্রকৃতপক্ষে সন্ন্যাসী।সন্ন্যাসী সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন — যিনি পরমার্থদর্শী,সেই জিতেন্দ্রিয় পুরুষ বিবেক – বুদ্ধি দ্বারা নিত্য,নৈমিত্তিক,কাম্য ও নিষিদ্ধ সমস্ত কর্ম ত্যাগপূর্বক নিজে কিছু না করিয়া দেহেন্দ্রিয়াদিকে কোনো কর্মে প্রবর্তিত না করে দেহেন্দ্রিয়াদি – সংঘাতে আত্মাভিমানশূন্য,নিরায়াস ও প্রসন্নচিত্ত হয়ে নবদ্বার – বিশিষ্ট দেহনগরে অবস্থান করেন।– (গীতা ৫/১৩)।
সন্ন্যাসী সকল বস্তুতে সমদর্শী হয়ে থাকেন।জীবের অজ্ঞান-আচ্ছন্নতা সম্পর্কে শ্রীভগবান বলেছেন – আত্মা মানুষের কর্তৃত্ব,কর্ম ও কর্মফলপ্রাপ্তি সৃষ্টি করে না;কিন্তু অবিদ্যারূপিনী মায়াশক্তি কর্তৃত্বাদিরূপে প্রবর্তিত হয়।অর্থাৎ অবিদ্যা প্রভাবে কর্তৃত্ব ও কারয়িতৃত্বাদি আত্মাতে আরোপিত হয়।–(গীতা ৫/১৪)।কিন্তু জ্ঞানের দ্বারা অজ্ঞান,অবিদ্যা দূরীভূত হলে জীব মুক্ত হয়।
তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন — আত্মজ্ঞান দ্বারা যাঁদের অজ্ঞান বিনষ্ট হয়েছে, সূর্য যেমন সকল বস্তুকে অবভাসিত করে,তেমন তাঁদের আত্মজ্ঞান শ্রুতিস্মৃতি – প্রসিদ্ধ ব্রহ্মকে সর্ববস্তুতে প্রকাশিত করে।–(গীতা ৫/১৬)।অর্থাৎ কোনো কর্ম “আমি করি ও আমি করাই”এই অজ্ঞানতা দূর হয়।জ্ঞানীর লক্ষন উল্লেখ করতে গিয়ে ভগবান বলেছেন — যাঁদের বুদ্ধি ব্রহ্মনিষ্ঠ, ব্রহ্মে যাঁদের স্থিতি, যাঁরা ব্রহ্মপরায়ন,ব্রহ্মজ্ঞান দ্বারা যাঁদের সমস্ত পাপ ও পূণ্য বিধৌত হয়েছে, তাঁরা মোক্ষ লাভ করেন;তাঁদের আর পুনর্জন্ম হয় না।বিদ্বান ও বিনয়ী ব্রাহ্মণ,গরু, হস্তী,কুকুর ও চণ্ডালে ব্রহ্মজ্ঞানী সমদর্শী হন অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শন করেন।–(গীতা ৫/১৭-১৮)।
অতঃপর ব্রহ্ম তত্ত্বদর্শী সন্ন্যাসীর মোক্ষ লাভ সম্পর্কে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলছেন — যাঁদের মন সর্বভূতস্থ ব্রহ্মে নিশ্চল,এই জীবনেই তাঁরা সৃষ্টি বা জন্ম জয় করেন। তাঁরা ব্রহ্মে স্থিত,তাঁদেরকে দোষ – গন্ধও স্পর্শ করে না।তাঁরা নির্দোষ ব্রহ্মই সর্বভূতে এক আত্মরূপে বিরাজিত — এই প্রকার স্থির বুদ্ধি ও জ্ঞান দ্বারা মোহশূন্য ব্রহ্মবিৎ পুরুষ প্রিয় বস্তু পেয়ে উৎফুল্ল বা অপ্রিয় বস্তু পেয়ে উদ্বিগ্ন হন না।তিনি শব্দাদি বাহ্যবিষয়ে অনাসক্ত তিনি প্রত্যগাত্মাতে শ্বাশত সুখ অনুভব করেন এবং ব্রহ্মযোগ যুক্ত হয়ে অক্ষয় ব্রহ্মানন্দের অধিকারী হন।তাঁরা আত্মাতেই সুখ অনুভব করেন বাহ্য বিষয়ে নয়, ব্রহ্মজ্ঞানী সন্ন্যাসীগণ অন্তর্জ্যোতি ও ব্রহ্মস্বরূপ,তাঁরা ইহ জীবনেই ব্রহ্মানন্দ লাভ করেন।যাঁরা নিষ্কাম কর্ম দ্বারা পাপমুক্ত, শ্রবণ ও মনন দ্বারা সংশয়রহিত,জিতেন্দ্রিয় সকল জীবের কল্যাণে নিরত সেই সম্যগদর্শী সন্ন্যাসী ইহজীবনেই ব্রহ্মনির্বান লাভ করেন।–(গীতা ৫/১৯-২৫)।
গীতোক্ত গুণত্রয় পর্যালোচনা
ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রসংযোগ হইতে জগতের উৎপত্তি প্রদর্শনের দ্বারা ব্রহ্মই অবিদ্যাহেতু জীবভাব প্রাপ্ত হয়।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলেছেন — হে মহাবাহো,প্রকৃতিজাত সত্ত্বগুণ, রজগুণ ও তমগুণ – এই গুণত্রয় পরমার্থত নিষ্ক্রিয় আত্মাকে দেহাভিমান দ্বারা শরীরে আবদ্ধ করে।–(গীতা ১৪/৫)।ভগবানের মায়াশক্তিই গুণত্রয়ের অভিব্যক্তির কারণ।গুণ গুণীর যেরূপ অধীন,সেইরূপ এইগুলি অবিদ্যাত্মক(অচেতন) বলিয়া ক্ষেত্রজ্ঞের(চৈতন্যের) নিত্য পরতন্ত্র হওয়ায় এদের গুণ বলা হয়। অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেকটি গুণ সম্পর্কে অর্জুনকে অবগত করাচ্ছেন — সাত্ত্বিক গুণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন — হে নিষ্পাপ, এই গুণত্রয়ের মধ্যে সত্ত্বগুণ স্ফটিকমণির ন্যায় নির্মল, স্বচ্ছ চৈতন্যপ্রতিবিম্বগ্রহণে সমর্থ বলিয়া নিরুপদ্রব ও প্রকাশক”। এই সত্ত্বগুণ ‘আমি সুখী’” এইরূপ সুখাসক্তি এবং ‘আমি জ্ঞানী’ এইরূপ জ্ঞানাসক্তি দ্বারা আত্মাকে যেন আবদ্ধ করে।–(গীতা ১৪/৬)।
রজোগুণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে শ্রীভগবান বলেছেন — হে কৌন্তেয়, রজোগুণ রাগাত্মক তথা কামস্বরূপ। রজোগুণ তৃষ্ণা ও আসক্তি উৎপাদক।ইহা অপ্রাপ্তের অভিলাষ ও প্রাপ্তবিষয়ে মনের প্রীতির উৎপাদক।দৃষ্ট ও অদৃষ্ট ফলের নিমিত্ত কর্মে আসক্তি দ্বারা ইহা আত্মাকে যেন আবদ্ধ করে, অর্থাৎ যেন ‘আমি করি বা আমি করাই ‘ — এই অভিমান দ্বারা কর্মে প্রবর্তিত করে। তমোগুণ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ভগবান অর্জুনকে বলছেন – হে অর্জুন তমোগুণ অজ্ঞানজাত, আবরণশক্তিপ্রধান প্রকৃতির অংশসম্ভূত সকল দেহধারীর মোহজনক ও অবিবেককর বলে জানবে।তমোগুণ প্রমাদ, আলস্য ও নিদ্রা দ্বারা আত্মাকে দেহে আবদ্ধ করে।প্রতিটি ক্ষেত্রে দেখা যায় ত্রিগুণের পরিণামে আত্মাভিমানই বন্ধনের কারণ।
ভগবান আরো বলেছেন — হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়। রজোগুণ সত্ত্ব ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়। আর তমোগুণ সত্ত্ব ও রজোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়।যখন এই ভোগায়তন দেহের সমস্ত ইন্দ্রিয়দ্বার বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ দ্বারা উদ্ভাসিত হয়, তখন জানবে যে সত্ত্বগুণ বর্ধিত হয়েছে।হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, কর্মে প্রবৃত্তি ও প্রচেষ্টা, হর্ষ ও অনুরাগাদির অনিবৃত্তি এবং বিষয়ভোগের স্পৃহা—এই সকল রজোগুণের বৃদ্ধিকালে উৎপন্ন হয় এবং তমোগুন বৃদ্ধি পেলে কর্তব্যাকর্তব্য বিবেকের অভাব, অনুদ্যম, কর্তব্যে অবহেলা ও মূঢ়তা জন্মে।–(গীতা ১৪/১০-১৩)।
এছাড়া ভগবান বলেছেন — সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে ব্রহ্মলোকাদিতে গমন করে।রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে মনুষ্যলোকে আবারো জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে পশ্বাদি মূঢ় হীন জন্ম প্রাপ্ত হয়।–(গীতা ১৪/১৪-১৫)।সাত্ত্বিক কর্মের ফল নির্মল সুখ,রাজসিক কর্মের ফল দুঃখ ও তামসিক কর্মের ফল মূঢ়তা অর্থাৎ পশ্বাদি জন্মের মাধ্যমে অজ্ঞানতা।–(গীতা ১৪/১৬)। সাত্ত্বিক ব্যক্তিগণ দেবলোকাদিতে গমন করেন,রাজসিক ব্যক্তিগণ দুখবহুল মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন এবং তামসিক ব্যক্তিগণ পশ্বাদি হীন জন্মগ্রহণ করে।–(গীতা ১৪/১৮)। ত্রিগুণের ঊর্ধ্বে উঠে আত্মজ্ঞান লাভ করায় মনুষ্যের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
তাই ভগবান শ্রী কৃষ্ণ বলেছেন — যখন জীব কার্য-কারণ-বিষয়াকারে পরিণত ত্রিগুণ ব্যতীত অন্য কাউকেই কর্তা বলে দেখেন না এবং ত্রিগুণের অতীত ও তাদের কার্যসমূহের সাক্ষী আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি ব্রহ্মস্বরূপ অধিগত হন। দেহোৎপত্তির কারণ এই অবিদ্যাময় গুণত্রয় অতিক্রম করে গুণাতীত হওয়ার মাধ্যমে জীব জন্ম, মৃত্যু ও জরা-রূপ দুঃখ থেকে জীবনকালেই বিমুক্ত হন এবং ব্রহ্মানন্দরূপ অমৃতত্ব লাভ করেন।–(গীতা ১৪/১৯-২০)।তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে উপদেশ দিলেন — তুমি গুণাতীত হও, গুণাদির ঊর্ধ্বে চলে যাও।–(গীতা ২/৪৫ দ্রষ্টব্য)। গুণাতীতের লক্ষণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ভগবান বলেছেন — যিনি সুখে ও দুঃখে রাগদ্বেষশূন্য, আত্মরূপে অবস্থিত, মৃৎপিণ্ড, প্রস্তর ও সুবর্ণে সমাদৃষ্টিসম্পন্ন, নিন্দা ও প্রশংসায় যাঁর সমবুদ্ধি, যিনি শত্রুপক্ষে নিগ্রহ ও মিত্রপক্ষে অনুগ্রহ করেন না, যিনি দৃষ্টদৃষ্ট ফলার্থ সকল কর্ম ত্যাগ করে কেবলমাত্র দেহধারণ উপযোগী কর্মের অনুষ্ঠান করেন তিনি গুণাতীত বলে কথিত হন।–(গীতা ১৪/২৪-২৫)। গুণাতীত ব্যক্তি মোক্ষ লাভের অধিকারী হয়।
গীতায় আত্মার নিত্যতা
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজের নিকট – আত্মীয়দের দেখে অর্জুন বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন।তিনি স্বজনদের বিনাশ পূর্বক রাজ্য লাভের ইচ্ছা ত্যাগ করলেন।তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে মৃত্যুভয় নাশ করার জন্য এবং যুদ্ধে তাঁর আত্মীয়দের শুধু নশ্বর দেহের নাশ হবে কিন্তু আত্মার নয় এই শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাঁকে আত্মার নিত্যতা তথা আত্মার অবিনাশী রূপ অর্থাৎ আত্মার অমরত্বের শিক্ষা দিলেন।
তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন —
পূর্বে আমি কখনও ছিলাম না এমন নহে; তুমি কখনও ছিলে না তাহা নহে বা এই নৃপতিগণও ছিলেন না—ইহা সত্য নহে। এই দেহধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মা-রূপে বিদ্যমান ছিলাম। এই দেহত্যাগের পরেও যে আমরা কেহ থাকিব না, ইহাও নহে। বর্তমানে দেহ সত্ত্বেও আমরা নিত্য আত্মস্বরূপে বিদ্যমান আছি এবং দেহান্তে ভবিষ্যতেও নিত্য আত্মা-রূপে বিরাজমান থাকিব।-(গীতা ২/১২) যেমন দেহীর (আত্মার) এই দেহে কৌমার, যৌবন ও জরা ক্রমে উপস্থিত হয়, তাহাতে দেহীর কোনো পরিবর্তন হয় না, সেইরূপ দেহান্তরপ্রাপ্তিতে (মৃত্যুতে) দেহী অবিকৃত থাকেন। মৃত্যু দৈহিক বিকারমাত্র। এই জন্য দেহান্তর-প্রাপ্তি বিষয়ে জ্ঞানীগণ মোহগ্রস্ত হন না।-(গীতা ২/১৩)
পরবর্তী ক্ষণে অনিত্য বস্তুর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন —
হে কৌন্তেয়, ইন্দ্রিয়ের সহিত বিষয়ের সংযোগহেতু শীত ও উষ্ণ, সুখ ও দুঃখাদি দ্বন্দ্ব অনুভূত হয়। কিন্তু এই সকল দ্বন্দ্ব উৎপত্তি-বিনাশশীল; অতএব অনিত্য। হে অর্জুন, হর্ষ ও বিষাদশূন্য হইয়া অপ্রতিকারপূর্বক এই সকল সহ্য কর।-(গীতা ২/১৪)
পরক্ষণে আত্মার নিত্যতা জ্ঞানের ফল প্রসঙ্গে বলেছেন —
কারণ, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, সুখে দুঃখে অবিচলিত যে-জ্ঞানী ব্যক্তিকে শীতোষ্ণাদি দ্বন্দ্ব বিচলিত করতে পারে না, (অর্থাৎ আত্মার নিত্যত্ব-জ্ঞান হইতে বিচ্যুত করতে পারে না) তিনি অমৃতত্বলাভের প্রকৃত অধিকারী।- (গীতা ২/১৫)
- পরবর্তী সময়ে আত্মা তথা সৎ বস্তু তথা ব্রহ্মের স্বরূপ বর্ণনা করলেন —
যিনি এই সমগ্র জগৎ পরিব্যাপ্ত করে আছেন,তাঁকেই অবিনাশী আত্মা (বা ব্রহ্ম) বলে জানিবে। কেহই এই অব্যয় আত্মার বিনাশ করিতে সমর্থ হয় না।
[পরবর্তী শ্লোকে শ্রীভগবান অসৎ বস্তুর (অনাত্মার) স্বভাব বর্ণনা করছেন—]
প্রত্যক্ষাদি প্রমাণের অতীত, অবিনাশী ও নিত্য আত্মার এই সকল দেহ নশ্বর বলে উক্ত হইয়াছে। অতএব হে অর্জুন, তোমার এই জড়দেহ কালে বিনষ্ট হবেই; কিন্তু তুমি আত্মা-রূপে অবিনাশী।অতএব যুদ্ধ করে
স্বধর্ম পালন কর। (গীতা ২/১৮)
যিনি ইঁহাকে হন্তা বলিয়া মনে করেন এবং যিনি ইঁহাকে নিহত বলে ভাবেন, তাঁরা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেন না।আত্মা কারোর হত্যা করেন না এবং কারোর দ্বারা নিহতও হন না। কারণ, আত্মা অবিনাশী।-
(গীতা ২/১৯)
এই আত্মা কখনও জাত বা মৃত হন না। কারণ, পূর্বে না থাকিয়া পরে বিদ্যমান হওয়ার নাম জন্ম এবং পূর্বে থাকিয়া পরে না থাকার নাম মৃত্যু; আত্মাতে এই দুই অবস্থার কোনোটিই নাই। অর্থাৎ আত্মা জন্ম-ও মৃত্যু-রহিত, অপক্ষয়হীন এবং বৃদ্ধিশূন্য; শরীর নষ্ট হইলেও আত্মা বিনষ্ট হন না।–(গীতা ২/২০)
শ্রী ভগবান আরো বলছেন —
মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে,আত্মা সেইরূপ জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নূতন শরীর গ্রহণ করেন।–(গীতা ২/২২)
কোনো শস্ত্র এই আত্মাকে ছেদন করতে পারে না। অগ্নি ইঁহাকে দহন করতে পারে না। জল ইঁহাকে আর্দ্র করতে পারে না এবং বায়ু ইঁহাকে শুষ্ক করতে পারে না। –(গীতা ২/২৩)
এই অপরোক্ষ আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোচ্য, নিত্য,সর্বব্যাপী, স্থির, অচল এবং সনাতন। ( গীতা ২/২৪)
পরক্ষণেই শ্রীকৃষ্ণ বললেন — মৃত্যুর পরে পুনর্জন্ম হয় যা আত্মার দেহান্তর প্রাপ্তি মাত্র।এটাই গীতার প্রথম ও প্রধান শিক্ষা।আত্মার অমরত্ব তথা আত্মার নিত্যতায় বিশ্বাস করলে অর্জুনের মত যে কোনো মানুষ মৃত্যু ভয় জয় করতে পারে এবং সে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়।আত্মার নিত্যতা জ্ঞান আসার ফলে ক্ষুদাতৃষ্ণা, জন্মমৃত্যু প্রভৃতি জড় ধর্মের অধীনতা দূর হয়;সকল দুঃখ নাশ হয়;মানুষ মৃত্যুঞ্জয় ও মহাবীর হয়।
গীতোক্ত জন্মান্তরবাদ ও পুনর্জন্ম
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুন তাঁর প্রতিপক্ষ হিসেবে নিকট আত্মীয়দের দেখে বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন এবং যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত নেন।এমতাবস্থায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন যে অর্জুন তুমি শুধু তাঁদের দেহের বিনাশ করবে।আত্মা অবিনাশী হওয়ায় তাঁদের আত্মার হত্যা তো তুমি করতে পারো না।এখানে ভগবান আত্মার অমরত্বের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন — “পূর্বে আমি কখনও ছিলাম না এমন নয়; তুমি কখনও ছিলে না তাও নহে বা এই নৃপতিগণও ছিলেন না—এটাও সত্য নয়। এই দেহধারণের পূর্বে আমরা সকলেই নিত্য আত্মা-রূপে বিদ্যমান ছিলাম। এই দেহত্যাগের পরেও যে আমরা কেউ থাকব না, তাও নয়।বর্তমানে দেহ সত্ত্বেও আমরা নিত্য আত্মস্বরূপে বিদ্যমান আছি এবং দেহান্তে ভবিষ্যতেও নিত্য আত্মা-রূপে বিরাজমান থাকবো।”–(গীতা ২/১২)।
ভগবান আরো বলছেন — “এই আত্মা কখনও জাত বা মৃত হন না। কারণ, পূর্বে না থাকিয়া পরে বিদ্যমান হওয়ার নাম জন্ম এবং পূর্বে থাকিয়া পরে না থাকার নাম মৃত্যু; আত্মাতে এই দুই অবস্থার কোনোটিই নাই।অর্থাৎ আত্মা জন্ম-ও মৃত্যু-রহিত, অপক্ষয়হীন এবং বৃদ্ধিশূন্য; শরীর নষ্ট হলেও আত্মা বিনষ্ট হন না।”–(গীতা ২/২০)।পরবর্তী ক্ষণে পুনর্জন্ম এর সমর্থনে শ্রী ভগবান বলছেন — “মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে অন্য নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, আত্মা সেইরূপ জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে অন্য নূতন শরীর গ্রহণ করেন।”–(গীতা ২/২২)। এটাই গীতোক্ত পুনর্জন্মবাদের সর্বোৎকৃষ্ট প্রমাণ। দেহের তথা শরীরের দেহান্তরপ্রাপ্তিতে দেহীর তথা আত্মার মৃত্যু ঘটে না।আত্মা অবিকৃত থাকে এবং দেহের মৃত্যুর পর আত্মা অন্য দেহ প্রাপ্ত করে।
এইজন্য শ্রী ভগবান অর্জুনকে উপদেশ দিয়েছেন — “যেমন দেহীর (আত্মার) এই দেহে কৌমার, যৌবন ও জরা ক্রমে উপস্থিত হয়,তাতে দেহীর বা আত্মার কোনো পরিবর্তন হয় না,সেইরূপ দেহান্তরপ্রাপ্তিতে (মৃত্যুতে) দেহী অবিকৃত থাকেন। মৃত্যু দৈহিক বিকারমাত্র। এইজন্য দেহান্তর-প্রাপ্তি বিষয়ে জ্ঞানিগণ মোহগ্রস্ত হন না।”–(গীতা ২/১৩)।এখন থেকেও পুনর্জন্মের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।কেবলমাত্র পুনর্জন্ম হলেই তো হবে না সেই পুনর্জন্ম কীরূপে হবে তা ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন — “জাত ব্যক্তির মৃত্যু নিশ্চিত এবং স্বীয় কর্মানুসারে মৃত ব্যক্তির পুনর্জন্ম অবশ্যম্ভাবী।”–(গীতা ২/২৭)।
সুতরাং এখানে দেখা গেলো স্বীয় কর্মানুসারে মৃত ব্যাক্তির পুনর্জন্ম হয়।এবারে পুনর্জন্মের কারণ সম্পর্কে দেখা যাক।শ্রী ভগবান বলছেন — “পুরুষ (ভোক্তা, ক্ষেত্রজ্ঞ) প্রকৃতিতে অবস্থিত* হয়ে সুখ-দুঃখ-কার্য-করণরূপে পরিণত ও মোহাকারে অভিব্যক্ত প্রকৃতির গুণসমূহ ভোগ করেন। এই সকল গুণেতে আত্মভাবই পুরুষের দেবাদি সৎ জন্ম ও পশ্বাদি অসৎ জন্ম ও সদসদ্বযোনিরূপ মনুষ্য-জন্ম-গ্রহণের প্রধান কারণ।”–(গীতা ১৩/২২)।পুনর্জন্ম হিসেবে আত্মা কোন কোন প্রাণীর দেহে প্রবেশ করবে তা সম্পূর্ণরূপে পূর্বজন্মের স্বীয় কর্মের উপর নির্ভর করে।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলেছেন — “সত্ত্বগুণের বৃদ্ধিকালে মানুষ দেহত্যাগ করলে হিরণ্যগর্ভাদি উপাসকদিগের সুখময় ব্রহ্মলোকাদিতে গমন করে।”–(গীতা ১৪/১৪)।
“রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হলে কর্মভূমি মনুষ্যলোকে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হলে পশ্বাদি মূঢ়জন্ম প্রাপ্ত হয়।”–(গীতা ১৪/১৫)।এইপর দেখা যাক এই পুনর্জন্ম থেকে কিভাবে নিস্তার পাওয়া যায়।একমাত্র আত্মজ্ঞান তথা মোক্ষ লাভ করলে এই জন্ম – মৃত্যুর চক্র তথা পুনর্জন্মের থেকে উদ্ধার হওয়া যায়।যা লাভ করলে জীব সংসাররূপ মায়া,জন্ম-মৃত্যুর চক্র, জরা রূপ দুঃখ হইতে মুক্তি লাভ করে এবং জীবের ব্রহ্মপদ প্রাপ্তি ঘটে অর্থাৎ ব্রহ্মের স্বরূপ তথা পরমাত্মা কে জানতে পারেন ও যা লাভ সংসারে পুনর্জন্ম ঘটে না তাই হলো মোক্ষ বা মুক্তি।মোক্ষ হলো পুনর্জন্ম নাশক।আত্মজ্ঞান ব্যতীত পুনর্জন্ম রোধ হয় না।(গীতা ৮/১৬;৯/২১;১৫/৪ দ্রষ্টব্য)।ব্রহ্মজ্ঞান,ব্রহ্মনির্বাণ ও মোক্ষ একার্থবোধক।
গীতোক্ত বর্ণভেদ প্রথা
বেদ অনুসারে বর্ন ৪ প্রকারের।যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র।বেদ ও গীতা অনুসারে এই বর্ণের বিভাজন জন্মের ভিত্তিতে নয়,বরং গুণ ও কর্ম অনুসারে হয়। জন্মের সময় সকলেই শূদ্র থাকেন।জন্মের পর গুণ ও কর্ম অনুসারে যে যার বর্ন বেছে নিতে পারেন।অর্থাৎ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেই যে তিনি ব্রাহ্মণ হবেন বা শূদ্রের পরিবারে জন্মগ্রহণ করলেই যে তিনি শূদ্র হবেন এমনটা নাও হতে পারে।শূদ্রের পরিবারে জন্মগ্রহণ করে যদি তাঁর ব্রাহ্মণের মত গুণ থেকে থাকে এবং তিনি যদি ব্রাহ্মণের মত কর্ম করে থাকেন তাহলে তিনি ব্রাহ্মণ বলে গণ্য হবেন।ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বর্ণভেদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে গীতাতে বলেছেন —
চাতুর্বর্ণ্যং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ ।
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম্ ॥(গীতা ৪/১৩)
— অর্থাৎ,গুণ ও কর্মের বিভাগ অনুসারে আমি চারটি বর্ণের সৃষ্টি করেছি।আমি মায়িক ব্যবহারে চতুর্বর্নের সৃষ্টিকর্তা হইলেও আমাকে পারমার্থিক দৃষ্টিতে অকর্তা বলে জানিবে।
সুতরাং,এখন থেকে স্পষ্টতই প্রমাণিত হল যে বর্ণভেদ জন্ম অনুসারে নয় বরং সত্ত্বাদি গুণ ও শমাদি কর্মের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত।অতঃপর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বর্ণভুক্ত ব্যাক্তিদের কর্ম সম্পর্কে বললেন।যথা —
ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদ্রাণাঞ্চ পরন্তপ ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈৰ্গুণৈঃ ॥(গীতা ১৮/৪১)
— অর্থাৎ,হে পরন্তপ, প্রকৃতিজাত (স্বভাবজাত)* ত্রিগুণানুসারেই ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রেরও কর্মসমূহ’ পৃথক পৃথরূপে বিভক্ত হইয়াছে।
- অতঃপর তিনি ব্রাহ্মণ,ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কর্ম নির্ধারণ করেছেন —
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জবমেব চ ।
বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম স্বভাবজম্ ৷।(গীতা ১৮/৪২)
— অর্থাৎ,বাহ্যেন্দ্রিয় ও অন্তরিন্দ্রিয়ের সংযম, কায়িক, বাচিক ও মানসিক তপস্যা; অন্তর্বহিঃ শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্বানুভূতি এবং শাস্ত্রে ও ভগবানে বিশ্বাস—এই সকল ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম। অর্থাৎ যিনি ব্রহ্মতত্ত্বকে বা ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রাহ্মণ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আরো বলছেন —
শৌর্যং তেজো ধৃতিদাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্ ।
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম স্বভাবজম্ ॥(গীতা ১৮/৪৩)
— অর্থাৎ,পরাক্রম, তেজ, ধৃতি, কর্মকুশলতা, যুদ্ধে নিপুণতা, দানে মুক্তহস্ততা ও শাসনক্ষমতা—এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত (স্বভাবজ সত্ত্বমিশ্র রজোগুণ দ্বারা প্রবিভক্ত) কর্ম।
বৈশ্য ও শূদ্রদের কর্মের সম্পর্কে ভগবান বলেছেন —
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম স্বভাবজম্ ।
পরিচর্যাত্মকং কর্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্ ॥(গীতা ১৮/৪৪)
— অর্থাৎ,কৃষি, গোরক্ষা ও বাণিজ্য বৈশ্যের স্বভাবজাত (স্বভাবজ তমোমিশ্র রজোগুণের দ্বারা প্রবিভক্ত) কর্ম। পরিচর্যা শূদ্রদিগের স্বভাবজাত(রজোমিশ্র তমোগুণের দ্বারা প্রবিভক্ত) কর্ম।
গীতায় যোগ চতুষ্টয়ের সমন্বয়
মহাভারতের যুগে ঈশ্বর সাধনার নানা পন্থ তথা মার্গ ছিল।যথা কর্মযোগ,জ্ঞানযোগ,ভক্তিযোগ ও রাজযোগ বা যোগ সাধনা। বিভিন্ন পন্থা বা মার্গের মধ্যে বিবাদ প্রায় লেগেই থাকতো।গীতায় ভগবান শ্রী কৃষ্ণ দেখিয়ে দিলেন যে ঈশ্বর সাধনার সমস্ত মার্গকে সমন্বিত ভাবে গ্রহণ করতে হবে।এগুলি প্রত্যেকটি পৃথক পথ যার প্রতি মাধ্যমে ঈশ্বরত্ব কে পাওয়া যায়।কিন্তু পরমে সব মার্গই একই ঈশ্বর্তত্বে মিলিত হয়।
- প্রথমেই কর্মযোগ প্রসঙ্গে ভগবান শ্রী কৃষ্ণের মত সম্পর্কে দেখে নেওয়া যাক —
নিকট আত্মীয় এর দের সঙ্গে যুদ্ধ করতে অনিচ্ছাপূর্বক অর্জুন গীতার বিষাদযোগে অর্জুন শ্রী ভগবানকে বলিতেছেন – ‘আমি ভিক্ষুবৃত্তি অবলম্বন করব,সন্ন্যাস গ্রহণ করব, আমি যুদ্ধ করব না।’তখন শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বললেন, না–কর্মের প্রয়োজন রয়েছে।তাছাড়া কর্ম ছেড়ে কেউ থাকতে পারে না এক মুহূর্তও, শরীর যতক্ষণ আছে কর্মও ততক্ষণ আছে। শারীরিক কর্ম আপাতদৃষ্টিতে না থাকলেও মানসিক কর্ম থাকবেই। শ্রীকৃষ্ণ আরো বললেন, ‘ন কর্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্যং পুরুষোহশ্নুতে। ন চ সংন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি ॥’–কর্মানুষ্ঠান না করে কেউ নৈষ্কর্ম্য-অবস্থা লাভ করতে পারে না, আর কর্মত্যাগ করলেই সিদ্ধিলাভ হয় না।’ কর্মের
মধ্য দিয়েই—নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই কর্মবন্ধন মোচন হয়, চিত্ত শুদ্ধ হয়। সেই শুদ্ধ চিত্তে আত্মসাক্ষাৎকার হয়। কর্ম মানুষকে করতেই হবে। কর্ম ছাড়া সে থাকতেই পারে না। তাই কর্মের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিটাই পালটে দিতে হবে। ভগবান অর্জুনকে তাই বলছেন, ‘নিয়তং “কুরু কর্ম ত্বম্’—‘শাস্ত্রবিহিত কর্ম তুমি সর্বদা করো।’মিলিত হবে।
কর্ম সম্বন্ধে শ্রীকৃষ্ণ বললেন–
‘তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম সমাচর ।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ ॥'(গীতা ৩/১৯)
শ্রীভগবান অর্জুনকে বলছেন—সেই হেতু সদা অনাসক্ত হয়ে কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠান কর। মানুষ অনাসক্ত হয়ে কর্ম করলে পরম পদ প্রাপ্ত হয়। এই শ্লোকে ভগবান স্পষ্টই বলেছেন যে, নিষ্কাম
কর্মযোগ দ্বারা মুক্তিলাভ হয়।
- পরবর্তী অধ্যায়ে ভগবান যে জ্ঞানযোগ দ্বারা মুক্তিলাভ হয় তা ব্যক্ত করেছেন।।
জ্ঞানপথের প্রসঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ বললেন-
‘যে ত্বক্ষরমনির্দেশ্যমব্যক্তং পর্যুপাসতে ।
সর্বত্রগমচিন্ত্যঞ্চ কূটস্থমচলং ধ্রুবম্ ॥
সংনিয়ম্যেন্দ্রিয়গ্রামং সৰ্বত্ৰ সমবুদ্ধয়ঃ ।
তে প্ৰাপ্নুবন্তি মামেব সর্বভূতহিতে রতাঃ ॥'(গীতা ১২/৩-৪)
— সর্বত্র সমবুদ্ধি, সকলেরই কল্যাণে নিরত, যাঁরা ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত করে শব্দাদির অগোচর, অব্যক্ত, সর্বব্যাপী, অচিন্ত্য, নির্বিকার, অচল ও শাশ্বত নির্গুণব্রহ্মকে উপাসনা করেন, তাঁরা আমাকেই প্রাপ্ত হন।
- ভক্তির দ্বারা যে মোক্ষলাভ হয় তাও ভগবান বললেন।আবার ভক্তির প্রসঙ্গে ভগবান অর্জুনকে বললেন –
‘ভক্ত্যা ত্বনন্যয়া শক্য অহমেবংবিধোহর্জুন ।
জ্ঞাতুং দ্রষ্টুং চ তত্ত্বেন প্রবেষ্টুং চ পরন্তপ ॥(গীতা ১১/৫৪)
— হে শত্রুতাপন অর্জুন, অনন্যা ভক্তির দ্বারাই আমাকে জানতে,প্রত্যক্ষ করতে এবং আমাতে প্রবেশ করতে অর্থাৎ মুক্তিলাভ করতে ভক্তেরা সমর্থ হয়।
ভগবান আরো বললেন—
‘ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।
— ভক্তির দ্বারাই সাধক আমার সগুণ ও নির্গুণরূপ জানেন এবং সেই নির্গুণরূপ জানার পরেই আমাতে প্রবিষ্ট হন অর্থাৎ মুক্তিলাভ করেন।
- গীতার ৫ম অধ্যায়ে শ্রী ভগবান যোগসাধনা তথা রাজযোগ দ্বারা মোক্ষলাভ করার কথা বলেছেন। যোগসাধনা প্রসঙ্গে ভগবান বললেন –
‘স্পর্শান্ কৃত্বা বহিবাহ্যাংশ্চক্ষুশ্চৈবান্তরে ভ্রূবোঃ ।
প্রাণাপানৌ সমৌ কৃত্বা নাসাভ্যন্তরচারিণৌ ॥
যতেন্দ্ৰিয়মনোবুদ্ধিমুনির্মোক্ষপরায়ণঃ ।
বিগতেচ্ছাভয়ক্রোধো যঃ সদা মুক্ত এব সঃ ॥’
— বাহ্য বিষয়গুলি মনের বাইরে রেখে অর্থাৎ সেগুলি চিন্তা না করে ভ্রুযুগলের মধ্যে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, নাসিকার অভ্যন্তরে বিচরণশীল প্রাণ ও অপান বায়ুকে কুম্ভকের দ্বারা সমান করে – নিরুদ্ধ করে, যে মোক্ষপরায়ণ মুনি ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধিকে সংযত করেছেন এবং ইচ্ছা, ভয় ও ক্রোধ রহিত হয়েছেন, তিনি সর্বদাই মুক্ত।
এভাবে চারটি যোগের সমন্বয় এই গীতা শাস্ত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। হিন্দু ধর্মের চতুর্বর্গ পুরুষার্থের মধ্যে মোক্ষ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।যা লাভ করলে জীব সংসাররূপ মায়া,জন্ম মৃত্যুর চক্র, জরা রূপ দুঃখ থেকে মুক্তিলাভ করে তাই হল মোক্ষ।গীতা থেকে আমরা জানতে পারি যে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ ও যোগ সাধনা বা রাজযোগ দ্বারা মোক্ষ লাভ করা যায়।
গীতার উদারতা
গীতাতে সকল প্রকার মার্গে সাধনা লাভের মাধ্যমে ঈশ্বরত্ব কে লাভ করা যায় তার উল্লেখ আছে। গীতা সার্বজনীন ধর্মগ্রন্থ।গীতা শাস্ত্রের বিশেষ কোনো মার্গের মাধ্যমে আত্মজ্ঞান লাভের সংকীর্ণতা প্রকাশ পায়নি।গীতার ৪র্থ অধ্যায়ের ১১ তম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন — “যে যেভাবে আমায় আরাধনা করে,আমি সেই ভাবে তাকে কৃপা করি।সকল ধর্ম পিপাসু আমার পথেই বিচরণ করে।”আবার ৭ম অধ্যায়ের ২১ তম শ্লোকে শ্রী ভগবান বলছেন — “যারা ঈশ্বরের যেকোনো রূপ শ্রদ্ধাপূর্বক অর্চনা করতে ইচ্ছা করে,আমি তাদের সেই মূর্তিতে ভক্তি ও বিশ্বাস প্রদান করি।
৯ম অধ্যায়ের ২৩ তম শ্লোকে উক্ত হইয়াছে — “যারা শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে অন্য দেবতার উপাসনা করে, তারাও অবিধিপূর্বক আমারই উপাসনা করে।”ভগবানের যেকোনো একটি রূপকে ইষ্ট মনে করে উপাসনা করলেই মুক্তি লাভ করা যায়। ভক্তিযোগ, কর্মযোগ, রাজযোগ ও জ্ঞানযোগ প্রত্যেকটির মাধ্যমে মুক্তি তথা মোক্ষ লাভ হয় বলে গীতাতে উল্লেখ রয়েছে।ভক্তির দ্বারা যে মোক্ষলাভ হয় তা গীতার ১১তম অধ্যায়ের ৫৪ তম শ্লোকে উক্ত হয়েছে।কর্মযোগের মাধ্যমে যে মুক্তি মেলে তা গীতার ৩য় অধ্যায়ের ১৯ তম শ্লোকে উক্ত হয়েছে।আবার ৫ম অধ্যায়ের ২৭ ও ২৮ তম শ্লোকে রাজযোগের মাধ্যমে মুক্তি পাওয়ার উল্লেখ রয়েছে।আবার ১২ তম অধ্যায়ের ৩-৪ শ্লোকদ্বয়ে জ্ঞানযোগ এর মাধ্যমে মোক্ষ লাভের কথা উল্লেখ রয়েছে। এইরূপ সার্বজনীনতা ও উদারতা অন্য ধর্মগ্রন্থে দুষ্প্রাপ্য।
প্রোজ্জ্বল মণ্ডল | Projjwal Mandal
Syrian Poetic Vision Analysis of Adonis | Best Article
Jagannath Biography and Literature | Special Article
Short Biography of Sheikh Mujibur Rahman | Best Article
Lord Jagannath and Chaitanya Mahaprabhu | Best Article
Gita Theory Discussion | Bhagavad Gita discussion | gita discussion forum | listening gita theory discussion | gita discourse | bhagavad gita discourse | What is the theory in Gita? | What are the 5 main topics of Gita? | What is the main concept of the Bhagavad Gita? | Discussions On Bhagavad-gita | Gita Theory Discussion Page | Bhagavad Gita