Gaai | গাই | শওকত নূর | New Bengali Story 2023

Sharing Is Caring:
Gaai

শওকত নূর – সূচিপত্র [Bengali Story]

গাই – শওকত নূর [Gaai]

হেঁটে দু পাশের দু বাড়ির সীমান্ত প্রাচীর অতিক্রম করে যেতে যে পথটি মাড়াতে হয়, তা উল্লেখ করার মতো সরু। একাকী কোনও মানুষকে বিশেষ সতর্কতায় পা আগপিছ করে কোনমতে পাড় হয়ে যেতে হয়, দু ব্যক্তির যুগপৎ হাঁটার সম্ভাব্যতা প্রশ্নাতীত । নিত্য এখানে পা ফেলতে যুবক পানু মিয়ার মনটাও যেন নিভৃতে সরু হয়ে যায়। কোনও প্রকারে জায়গা টুকু অতিক্রম করে যেতে পারলেই যেন সংকীর্ণ প্রণালী থেকে উপসাগরে গিয়ে উপচে পড়া। উল্লেখ সমীচীন, ভৌগলিক ও জনমানুষের সূক্ষ্ম হিসেব নিকেশ ঘটিত ভাগ বন্টনের দেয়াল তোলাতোলির দায়ে পানু মিয়াদের গাঁ থেকে বহির্মুখী হতে হলে এ পথ মাড়ানো
অত্যাবশ্যক।

যাক সে কথা। সরল, সাদাসিধে ধবধবে ফর্সা মুখমণ্ডল, হ্যাংলা পাতলা, কোঁকড়া-চুল, কিঞ্চিৎ উঁচু- দাঁত কলেজ পড়ুয়া পানু মিয়া যখনই দু ঘরের ফাঁকা দিয়ে দু পায়ে তার শীর্ণ দেহটি ধাক্কে কিংবা টেনে নিয়ে চলতে থাকে, তখনই সে বাঁ পাশের ঘরটিতে নারীপুরুষের সমবেত হৈ হুল্লোড় অথবা উৎকট গান বাজনার শব্দপাত শুনতে পায়। ঠিক ডানের ঘরটি থেকে ভেসে আসতে থাকে অনুরূপ দ্বৈত-লিঙ্গ- কণ্ঠের শ্রাব্যাশ্রব্য চাপা গালাগাল কিংবা ফিসফাস। ঘর দুটি পেরিয়ে দু আঙিনার গা ঘেঁষে দুদিক থেকে উঁচানো কাঁটা ঝোপের বেড়া দুটি অতিক্রম কালে ডান বাম দু আঙিনা থেকেই তাগড়া ষাঁড় গরুর ভয়াল হোক্কা ডাক, ঘোরতর দড়ি-টান ছটফটানি, মাটিতে খুরের সজোর আঘাত, বাঁশের খুঁটিতে শিঙের ঠকঠকানি প্রভৃতি শুনে পানু মিয়ার ভীত শিহরিত না হবার ঘটনা থাকে নেহায়েতই বিরল। বুক-উঁচু বেড়া ডিঙিয়ে দুদিক থেকেই দুই বেপরোয়া প্রাণীর দ্বারা শিঙের ঘা খেয়ে ধরাশায়ী হওয়াা অসম্ভব কিছু নয়। দ্রুত চলার ফাঁকে দুদিকে তাকিমাকি করতে থাকে পানু মিয়া।

ঠিক তখনই বাঁয়ের ঘরটি থেকে অবধারিতভাবে ভেসে আসে তাচ্ছিল্য কণ্ঠটি, ও ভায়ে, চিপায় ক্যাঠায় যান? বেবাক প্রাণীহে ভয়-ডর পায়বার দরকার নাই। ডাইন বাড়ির ওইহান কিন্তুক আদতে ষাঁড় গরু না। ওডো হইতাছে বলদা, খাঁটি বলদা। আমার খানা আচাবুক ষাঁড় আছে। এই দুনিয়াত বুজ্জেননি ভায়ে, ষাঁড়ে ষাঁড় পালে, বলদায় পালে বলদা। ডাইনের ওই বাড়িহান বাড়ি ঠিকোই, তয় মাইনষের না, বলদার। কথা শেষে বাঁয়ের ঘরটি থেকে একক কিংবা সমবেত উচ্চস্বর নারী হাস্যরসের আবহ ভেসে আসে।

বাঁয়ের ঘরটিতে থাকে হান্নান মিয়া। বয়স ষাট এর কাছাকাছি। খুব সম্ভবত বয়স পঞ্চাশের পর অতিরিক্ত দুজন স্ত্রী গ্রহণ করেছে। এতে করে তার স্ত্রীর সংখ্যা তিন। তিন স্ত্রী নিয়েই তার সুখের সংসার। বাড়িতে ঘরের সংখ্যা তিন – দিনের বেলা স্ত্রীরা সম্ভবত পথের পাশের ঘরটিতে তার সাথে সমবেত হয়। পথচারী মাত্রই তাই হই হুল্লোড় ও হান্নান মিয়ার হাঁকডাক শুনতে বাধ্য হয়ে থাকে।

ডানের ঘরটিতে থাকে আফনান মিয়া; তারও বয়স ষাট এর কাছাকাছি। বয়স পঞ্চাশ থেকে ষাট এর মধ্যে সে দু দুজন স্ত্রী ছেড়ে তৃতীয় স্ত্রী গ্রহণ করেছে। দৃশ্যত এটিই চূড়ান্ত, একক এবং সর্বশেষ জীবন সঙ্গী। আফনান মিয়াও দৃশ্যত সুখী, যদিও জনশ্রুতি মতে তার আগের নিরীহ স্ত্রীদ্বয় তাকে গলগামছা অভিসম্পাতের ভেতর দিয়েই স্ব স্ব বাপের বাড়িতে বিদগ্ধ দিনাতিপাত করে। আফনান মিয়া ও তার স্ত্রী চাপাস্বরে যেসব গালাগাল বর্ষণ করে তা পথচারীদের উদ্দেশ্যে নয়, হান্নান মিয়া ও তার স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে। গালাগালের মধ্যে যেসব শব্দপাত থাকে তার মধ্যে, শালার চড়ুই, বাঐ, পাতিহাঁস, গাধা, ভেড়া, ভেড়ী প্রভৃতি।

পানু মিয়া ছাত্র মানুষ, পড়াশোনা ও শখের কাজবাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এই দুই বয়সী ব্যক্তির দৃশ্যমান জীবনের বাইরে গভীরে কোন কিছুতে ঢুঁ দেয়ার খেয়াল খুশি কখনোই তার জাগে না। যেতে হয় তাই দু বাড়ির ফাঁক গলিয়ে যায়, চোখ খোলা রাখতে হয় তাই যা নজরে পড়ে তা দেখে। কান বন্ধ রাখা চলে না তাই চলতি পথে তার কুহরে যা প্রবেশ করে তা শোনে, ব্যস। আঙিনা পেরিয়ে সদর পথের সদর হাওয়া, খোলা আসমান, খোলা মাঠ ঘাট তাকে শীঘ্রই সেসব থেকে ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়। মনের ভেতরে নিত্য একটাই ভাব জাগে, অতীতে দেখা চলচ্চিত্রের গানের ভাব: নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তা — একা –

রাস্তা একাকী চললেও তার নিজের বেশি দূর একাকী চলা চলে না। কিছু দূর যেতেই কেউ না কেউ সঙ্গী জোটে। বিশেষ করে স্টেশন মোড়ে পৌঁছতেই অবধারিতভাবে গাঁয়ের অন্যতম মাতবর ব্যক্তিত্ব জাফলং মিয়া চোখ মিটমিটিয়ে এসে গা ঘেসে হেঁটে বলবে, আরে, পানু মিয়া যে, তা কোন পথ মাড়ায়া আসলা, ভায়া?

পথতো একটাই।

জানি, তবুও কথার কথা জিগাই। তা ওই মশকরা বাড়ির চিপায় আসতে কী কী মশকরা শুনলা?

কই, নাতো কিছু শুনিনি।

আরে ভায়া, শুনছাও, শুনছাও, খামাখা সত্য গোপন করতাছ। হেঃ হেঃ হেঃ।

কী সত্য গোপন করব? শুনিইনি আমি কিছু।

আইচ্ছা হইল, শুইনাও না শুইনা থাকলে না শুনছ। কিন্তু গরু দুইটাক তো দুই ধারে দেখছ। নাকি দেইখাও দেখোনাই?

নাহ, গরুটরু কিছু চোখে পড়েনি। পানু মিয়া সান্নিধ্য ও ঝঞ্জাট এড়াতে ইচ্ছে করেই মিথ্যে বলে।

শালার দুইটাই আসলে মস্ত ধাউর, বুঝলা? গরুগুলানের লাহানই ধাউর।

স্পষ্ট বুঝতে পারছি না, কী বলছেন।

হাঃ হাঃ হাঃ, বুঝছো শতভাগই, কিন্তু স্বীকার করবা না। ঠি-ই-ক আছে, যাও গিয়া! তুমি স্বীকার না কর-লেও সত্য বলার লোকের অভাব নাই। ওই যে লাডু মিয়া আসতাছে। তার কাছেই সব শুনবার পারব, হেঃ হেঃ হেঃ!

শোনার এত আগ্রহ, তা নিজে গিয়ে দুই বাড়ির চিপায় দাঁড়িয়ে শুনলেই তো পারেন।

যাই না ক্যান, সেইখানেই তো একপালা গানরে ভাই। তা তুমি যাও গিয়া। কলেজে কেলাস শুরু হয়া যাব।

হ্যাঁ ঠিক বলেছেন, চলি।

আর-রে, লাডু মিয়া যে।

হ ভাই, আইসা গেছি।

হাঃ হাঃ হাঃ , আয়া ভলো করছ। ওই যে পানু মিয়া যায়। হালার মদন পোলাপাইন একটা।

হাঃ হাঃ হাঃ, ঠিক কথা কইছেন।

তা কও দেহি আইজ কী কী শুনলা।

কী-ই আর শুনব? রোজ রোজ যা শুনি, তাই। ভাই, ক্যাঠায় যাও, ষাঁড়ে ষাঁড় পালে এইসব।

তা ওই হান্নান হারামজাদার ঘরে কি একক মাইয়ালোকের কণ্ঠ শুনলা, নাকি হারামজাদিগুলান সব একত্র হইছে?

সবগুলানই একত্র হইছে কি না তা বুঝা গেল না। তবে একক কণ্ঠ যে না, সেইটা ইস্পষ্ট।

ময়ূরীর কণ্ঠ কি ঠাউর করবার পারলা? কিংবা কার কি কথা হইতেছে ময়ূরীর লগে?

না, তা পারি নাই।

তয় আর কী পারলা? আহারে আমার পরান পাখি,পরানের ময়ূরী। কী ফাঁকিই আমারে দিছে!

ময়ূরীর লাইগা আপনের এত পরান পুড়ে , তা ওই হান্নাইনায় তারে লওয়ার আগেই তারে লইয়া লইতেন।

চেষ্টা তো কম করি নাই, তা দৌড়ে পাইরা উঠবার পারিনাই।

ক্যানে?

বড় পোলায় বিদেশ থেইকা হঠাৎ চিঠি পাঠাইল বিপদে আছে। ম্যালা ট্যাকার ফ্যাঁকরা। ট্যাকার সন্ধানে যারপর নাই ব্যস্ত হইয়া পড়লাম। এই ফাঁকে ওই শালা হান্নাইনায়–। আরে শালার খাচরাডায় দেহি কলেজে না যাইয়া দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া আমগোর বেবাক কথা শুনতাছে। আইজ কলেজে যাব না নাকি?

ও শুনলে আর কী হইব?

যদি হান্নান মিয়ার কাছে কথা লাগাইয়া দেয়?

না, আপনেই না কইলেন হ্যায় মদন পোলাপাইন।

তা অবশ্যি ঠিক। কিন্তু ইস্টুপিডটায় কলেজে যাইতাছে না ক্যান?

যাইব কি, কলেজ তো হুনছি আইজ বন্ধ। কী চাহার সোমবার না কী একটা নাহি আছে, আমগো গ্যাদা কইল।

হইতে পারে, লও ওইদিকটায় গিয়া ব-ই।

জাফলং মিয়া লাডু মিয়াকে নিয়ে অদূরের গাছতলায় গিয়ে বসে। এদিকে এক্ষুণি বাড়ি ফিরবে নাকি আরো কিছুক্ষণ এদিকটায় ঘোরাফেরা করবে, সে বিষয়ে ভাবছিল পানু মিয়া। ভাবছিল, কলেজ বন্ধের বিষয়টি আগে জানা থাকলে কিছুতেই সে আজ বাড়ি থেকে বেরোত না। এদিক সেদিক পায়চারি করতে লাগল সে। এরই মধ্যে তার বড় বোনজামাই কোত্থেকে মোটরসাইকেল যোগে এসে তার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে গেল। বলল, কী রে, এখানে ব্যাগ কাঁধে দাঁড়িয়ে আছিস, কী ব্যাপার? আজতো কলেজই নেই।

হ্যাঁ। গতকাল কলেজে না যাওয়াতে জানতে পারি নাই।

তো চল আজ আমাদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসবি। তোদের বাড়িতে এক্ষুণি ফোন করে জানিয়ে দিচ্ছি। ওঠ পেছনে।

পানু মিয়া কোন উচ্চবাচ্য না করে মোটরসাইকেলের পেছনে চেপে তার বোনের বাড়িতে চলে যায়। বিকাল নাগাদ সে সেখানেই কাটায়। সেখান থেকে ফিরতি পথে সে যখন হান্নান মিয়া ও আফনান মিয়াদের বাড়ির সীমানায় পা রাখে, তখন রীতিমত সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। পানু মিয়া এর আগেও মাঝেমধ্যে ঠিক এমন সময়ে এ পরিসরটুকু অতিক্রম করতে গিয়ে খেয়াল করেছে জায়গাটা প্রচুর পাখপাখালিতে ভরপুর। দু পাশের দু বাড়ির গাছপালা, ঘরের চাল, উঠান, এমনকি গরুদুটির পিঠ ভর্তি হয়ে থাকে পাখিতে। আর যে তাদের কোলাহল!

এ গাঁয়ে পাখির সংখ্যা এমনিতে বেশি। কিন্তু এ বাড়ি দুটির মতো অতি মাত্রার পাখি তৃতীয় কোন বাড়িতে নেই। দুদিক থেকে প্রকট ক্যাচক্যাচানিতে তারা কানে তালা লাগিয়ে দেবে যেন। পানু মিয়া চলার ফাঁকে ভাবে, পাখিদের ঠিক এ দুটি বাড়ি এভাবে বেছে নেয়ার কী হেতু। কী বিশেষত্ব এ দুই বাড়ির? প্রাকৃতিক কোনও বিষয়, নাকি তারা নিজেরা কোলাহলে বলে এ দুই বাড়ির কোলাহল পছন্দ বশত নিকট সাহচর্য প্রদর্শন করে থাকে? ভাবনা ও হাঁটার ফাঁকে ঠিক দু আঙিনার মাঝামাঝি এসে থমকে দাঁড়ায় পানু মিয়া। হান্নান মিয়া আচমকা ডেকে উঠেছে ঘরের ভেতর থেকে,ও পানু ভায়া! পানু ভায়া যাইতাছোনি,ভায়া-হ?

জি ভাই।

এটুক্কা খাঁড়াও দেহি। জরুলি কথা আছে তোমার লগে।এই এক সেকেন্ড।

নিদারুণ অনিচ্ছা সত্ত্বেও পানু মিয়া দু আঙিনার মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে যায়। পিঠে পাখির ঝাঁক নিয়ে দু’দিকে দুটি ষাঁড় বিকট হোক্কা ডাকতে থাকে। বুক সমান উঁচু কাঁটা ঝোপের বেড়ার ওপর দিয়ে পর্যায়ক্রমে দু’দিকে তাকায় পানু মিয়া। হান্নান মিয়া ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে আঙিনা পেরোয়। বেড়ার গা ঘেষে দাঁড়ায়। পানু মিয়ার দিকে খাটো গলা বাড়িয়ে চাপাস্বরে বলে, ভায়া, কওছে হুনি আউজগা রাস্তার মোড়ে খাঁড়ায়া ওই জাফলং বদমাইশটায় কী কইছে তোমারে। হুয়ারে আমার সম্পর্কে কীসব নাকি কইছে তোমারে?

কই নাতো, কেউ কিছু বলেনিতো। কে বলল আপনাকে এসব?

ভায়া, কইছে কইছে, আমার সম্পর্কে নানান কথাই হারামজাদায় তোমারে কইছে। তুমি চাইপা যাইতাছ।

না না, আপনি মিছেই ভাবতেছেন। আপনার সম্পর্কে কেউ কিছুই বলেনি আমাকে।

লাডুয়ে কি তাইলে মিছা কথা কইল আমারে?

নিশ্চয়ই মিথ্যা বলেছে।

লাডু মিছা কয় আমারে! সে কইল তোমারে নাকি জায়জিলিমান দেখছে হারামজাদার লগে খাঁড়ায়া মেলাহন কথা কইতে। সুযোগ পায়া নাকি হারামজাদায় আমার আর ময়ূরীর সম্পর্কে যা তা কইতাছিল।

একদম মিথ্যা কথা।

অয় তালি সত্যি তোমারে কয়নাই কিছু?

হ্যাঁ হ্যাঁ, কিচ্ছু বলেনি।

মিছামিছি আমি তালি একশটা টাহা দিলাম লাডুরে।অয় আমার লগে—।

আমি যাই এখন।

না না, খাঁড়াও। ওই ময়ূরী, ময়ূরী–।

কী কন? ঘরের ভেতর থেকে হান্নান মিয়ার তৃতীয় স্ত্রীর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠ ভেসে আসে।

পানের বাটা লইয়া এইদিকে আয় দেহি। মিঠা জর্দা আন। ভালো সুপারি আনিস।

আনতাছি।

ময়ূরী ঘর থেকে বের হয়ে পানের বাটা হাতে পরম ঢংয়ে হাঁটতে হাঁটতে হান্নান মিয়ার অদূরে এসে দাঁড়াল। মাথায় এলো কোঁকড়া চুল, কপালে লাল টীপ, চোখে কাজল, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক। বাঁকা হাসি, চোখের চাউনিতে যেন ঝড়ো হাওয়া। হালকা এক নজর দেখে মাথা নিচু করল পানু মিয়া। ময়ূরী বেড়ার ওপর দিয়ে পানের বাটা বাড়িয়ে বাঁকা হাসি হেসে বলল, ভায়া, ভালো?

হ্যাঁ।

এই যে পান নেন, মিষ্টি পান। জর্দা সুপারি দুইটাই মিষ্টি, সুগন্ধি।

পান আমি খাই না।

একদিন খাইলে কিছু হইত না ভায়া, নেন। এই যে -হ!

আরে লও ভায়া, পানে কোন ক্ষতি নাই। মিষ্টি জর্দা পান, বড় সুস্বাদু। গিন্নি তোমারে সম্মান কইরা দিছে। নারীর সন্মানে অমর্যাদা করতে নাই। লও একখান খিলি-পান। হান্নান মিয়া আহলাদে বলে।

ভায়ার কি খিদা লাগছে? পেট খালি? পানি বিস্কুট আনি? ময়ূরী হেসে বলে।

না না, কিচ্ছু আনতে হবে না। একটা পানই নিচ্ছি, শুধু পান।

ভায়া, একখণ্ড সুপারিও নেন। খালি পান খাইতে নাই। ময়ূরী ডালা উঁচায়।

ঠিক আছে, চলি।

ভায়া, দিনের বেলা একদিন আসলে খুশি হমু। আসেন একদিন। যুগপৎ দুজন বলে।

সে দেখা যাবে, চলি।

ভালা থাইকেন।

আঙিনা পেরিয়ে পানু মিয়া যখন ঠিক দু ঘরের চিপায়, তখন বাঁ পাশের অর্থাৎ আফনান মিয়ার ঘর থেকে চাপা মেয়েলি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তার কানে, দ্যাখলেন তো দুই বদমাইশ ক্যামনে ভাও করতাছে সহজ সরল পোলাডারে! জাফলং মিয়ায় তো আস্তা দুইমুখা সাপ। সেও ভাবতাছে এই পোলাডারে হাত কইরা এই বাড়ির কথা লইব। কিন্তুক এই পোলায় কি সত্য কথা কইব তারে? হান্নাইনায় যা তা কইলেও এ কইব হ্যায় তারে কয়নাই কুনু কথা। জাফলইংয়ার কথাও চাইপা যাব এই বদগুলানের কাছে।

ময়ূরী, বাদ দে এইসব আজাইরা কথাবাত্রা। চুপ কইরা থাক। বদেগোর কাম বদেরা করতে থাউক।

পানু মিয়া যখন হেঁটে ওপাশের পথ ধরেছে, তখন পেছনের দু ঘর থেকেই আহলাদে গানের সুর ভেসে আসে :
ডানে : কী সুখ দিলারে খোদা
সুখের সীমা নাই। হান্নান মিয়ার কণ্ঠ।

বাঁয়ে: সুখের সংসারে আমার
আইজ নাই দুখের ঠাঁই। আফনান মিয়া গাইছিল।

অদূরের মসজিদ-মাইক্রোফোনে আচমকা আযান বেজে উঠলে পেছনের দুটি কণ্ঠই ধুপ করে থেমে যায়। পানু মিয়ার চলার গতি দ্রুততর হয়।

ক’ দিন পর সাতসকালে আবারো কলেজের উদ্দেশ্যে হাঁটছিল পানু মিয়া। ফসলের মাঠ পেরিয়ে হান্নান মিয়া আফনান মিয়াদের বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছতেই এদিক থেকে বাড়ির ভেতরে প্রচণ্ড রকমের চিৎকার চেঁচামেচি ও ঠকঠক জাতীয় শব্দ শুনতে পায় সে। চেঁচামেচি করছে ময়ূরী, কিন্তু ঠকঠক শব্দটা কিসের? শক্ত কোন কিছুতে আঘাতজনিত শব্দ বলে মনে হচ্ছে। ইতঃস্তত দাঁড়ায় পানু মিয়া। এর মধ্যেও পথপ্রান্তের ঘর থেকে হান্নান মিয়ার গানের সুর ভেসে আসছে। সেই সুখ সংসারের গান।

এবারে ইতস্তত ঝেড়ে হাঁটা ধরে পানু মিয়া। দু আঙিনার বেড়ার ফাঁকায় পা দিয়ে বাঁয়ে নজর যেতে দেখে ময়ূরী কোমরে কাপড় পেচিয়ে এলোচুল রুদ্র মূর্তিতে কাঠের লাকড়ি দিয়ে আঙিনার অপর দুই ঘরের বন্ধ দরজায় মুহূর্মুহু তুমুল আঘাত করছে। মুখে অশ্লীল অশ্রাব্য যা আসছে তা-ই বলছেঃ ওই মাগী, ওই —-, বাইর ঘর থিকা, আইজ তগোর—– তর ভাতার–

ঘরের ভেতর থেকে ন্যূনতম সাড়াশব্দ ভেসে আসছিল না। অর্থাৎ ময়ূরীর দুই সতীন ভীত সন্ত্রস্ত স্ব স্ব ঘরের দরজা বন্ধ করে আছে। একবার শুধু এক ঘর থেকে অস্ফুট এক বাক্য ভেসে এলোঃ হো মা-ঃ আইজ মাগীর ইয়া উঠছে গো- ও-!

ক্রমাগত দরজায় আঘাতের সাথে একইরূপ বাক-বর্ষণ করেই চলেছে ময়ূরী। পানু মিয়া প্রায় দৌড় পর্যায়ের হাঁটা আরম্ভ করতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল। হান্নান মিয়া গান থামিয়ে চেঁচাচ্ছেঃ ক্যাঠায়? ও পানু ভায়া, চইলা যাইতাছ?৷ এক সেকেন্ড খাঁড়াও। তোমার কোন ভয় নাইক্কা! এই আইতাছি!

হান্নান মিয়া বেড়ার গা ঘেষে দাঁড়িয়ে চারপাশে নজর বুলিয়ে ভালোমত দেখে নিল। তার দৃষ্টি বিশেষভাবে ঘুরছিল আফনান মিয়ার আঙিনা ও ঘরের দরজায়। ঘরের দরজা খোলা কিন্তু কেউ নেই দৃশ্যপটে। এবারে হান্নান মিয়া হাসিমুখে নজর দিল ময়ূরীর কর্মকাণ্ডে। পানু মিয়ার দিকে গলা বাড়িয়ে বলল, দেখলা তো পানু ভায়া, কী তাগোদের তাগোদ!

কার?

আহা- কার আবার? আমার ময়ূরীর। তুমি কি ভাবছ আমি ওই আফনাইনারে তাগোদের পুরুষ কইতাছি?
আফনান মিয়া হইল একটা বলদা, বলদা। অর উঠানে যে পেরাণীডারে তুমি তাগোদের ষাঁড় ভাবতেছ, সেইডাও আদতে ষাঁড় না, একখান খাঁটি বলদা। বলদায় বলদা পালে সেইটাই তো স্বাভাবিক। হেঃ হেঃ হেঃ!

আচ্ছা, এবার যাই আমি, তাড়া আছে।

আহা ভায়া, আসল কথাটাই তো বলা হইল না।

বলুন জলদি।

ওই যে দেহেন, কী চোটপাট! অর ওই রহম চোটপাট আছে বইলাই তো অরে পরাণ দিয়া ভালোবাসি। চোটপাট যদি না থাকত, ওই বড় দুইটায় অরেই চুলের মুঠা ধইরা লাইত্থাইয়া খেদাইত। ইয়ার পর একোইভাবে একটায় আরেকটারে খেদাইত। বিবি থাকত কয়জন?একজন। কথা খেয়াল করতাছ না, ভায়া?

করছি, বলুন।

সেই মত অবস্থায় আমার আর তিন বিবির হাউশ পুরাপুরি মিটত না। নিজের তাগোদেরও একটা বিষয় আছে। আমি হইলাম গিয়া ষাঁড়। ষাঁড় বইলাই তিনডারে লইয়া থাকবার পারতাছি।

ঠিক আছে, আমি যাই এবার।

আহা ভায়া, এতো ছটফট করলি কি আর হয়? মোদ্দ কথাটাই তো বলা হয় নাই।

আচ্ছা বলুন।

ওই আফনাইনায়, বুঝলা কি না, ভায়া? ওই আফনাইনায় হইতাছে একটা উক্কিষ্টো বলদা। বলদা বইলাই আগের দুইহানরে পর পর খেদাইয়া একটারে লইয়া ঘর করতাছে। বলদার কাম বলদায় করতাছে। শালার বলদা!

ঠিক আছে, আমি এবার যাই।

ভায়া, আরেক দিন ঘরের মইধ্যে আইও, নিরিবিলি কথা কমু। আউজগা এই তরিই থাউক। চইলা যাও।

আচ্ছা।

পানু মিয়া দ্রুত আঙিনা পেরিয়ে এপাশের খোলা পথে পা রাখে। অন্য দিনের মতো আজ আর ‘নীল আকাশের নিচে’ গানের ভাব মনে জাগছে না। ময়ূরীর তীব্র হাঁকডাক, দরজায় তুমুল বাড়ির শব্দ এখনো কানে উঠছে। যুগপৎ একটা হিসাবও মনের মধ্যে মিলে যাচ্ছে। হান্নান মিয়া কেন নিজেকে ষাঁড় আর আফনান মিয়াকে বলদা আখ্যা দেয় – সেই রহস্যের কুল কিনারার হিসাব। পৈতৃক ভিটাবাড়ি, সহায় সম্পত্তি, মোটা ভাত মোটা কাপড় আছে; হয়তো এ-ই বৈরিতা বিরোধিতা, শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা, নিত্য ফ্যাসাদ, হাসি রসিকতাই তাদের জীবন। চলতি পথে পানু মিয়ার তাতে অন্তর্ভুক্তিও তাদের জন্য সে অর্থবহ জীবনযাত্রার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পানু মিয়া ভাবনাঘোরে কখন স্টেশন মোড়ে পৌঁছে যায়।

সেখানে পৌঁছা মাত্র ওপাশের শিরিষ গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে জাফলং মিয়া খপ করে তার হাত ধরে ফেলে। কাতর স্বরে বলল, কী খবর, পানু ভায়া? শুনলাম তুমি আমার সম্পর্কে নানান ষড়যন্ত্রেরই সাক্ষীগোপালের ভূমিকা পালন কইরা চলছ। কথা ঠিক কইলাম কি না কও।

কী ষড়যন্ত্র?

ওই শালা হান্নাইনায় নাকি নানান গালিগালাজই আমারে নিত্য পারে, তোমারে নানান কথা শুনানবশত।

কী কথা?

ওই আমি নাহি একখান আবাল বাঁছুড়, নিত্যি রাস্তায় দাঁড়ায়া নাদাই, চোনাই। পাঁতিহাসও নাহি বলছে আমারে।খালি নাহি প্যাকপ্যাক করি আর পথেঘাটে আণ্ডা ঝাড়ি। কী কমু দুঃখের কথা?

আমি বলতে পারব না। জানি না এসব।

মাইনে? এতসব বদকথা তোমারে বলল, আর তুমিই বলতেছ বলতে পারবা না–।

বললাম তো আমি কিছু জানি না এসবের, আমাকে যেতে দিন।

আইচ্ছা যাও। ওই যে আফনান মিয়ায় চইলা আসছে। হারামজাদা লাডু কি মিছা কথা কইল? নগদ একশ টাহা লইয়া গেল। শেষ বাক্যটি বিড়বিড়িয়ে বলল জাফলং মিয়া।

স্টেশন সীমার শেষ প্রান্তের এক দোকানের সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়াল পানু মিয়া। ওদিকে তাকিয়ে দেখল, জাফলং মিয়া আফনান মিয়ার হাত ধরে তার সাথে নিবিড়ভাবে কী যেন বলাবলি করছে। দুজন মাথা ঝুঁকেও যেন কী বলল কতক্ষণ। ভাবে মনে হলো জাফলং মিয়া আফনান মিয়াকে কোনও বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছে। তার পকেটে গুঁজেও দিল একটা কিছু। ওদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে কলেজের উদ্দেশ্যে চলে গেল পানু মিয়া।

কলেজ থেকে ফেরার পথে বাড়ি দুটির চিপায় এসে প্রথমত অভিভুত হলো পানু মিয়া। আফনান মিয়ার ঘরের ভেতর থেকে পোলাও কোরমা জাতীয় খাবারের তীব্র সুগন্ধি ভেসে আসছে। আরো ভেসে আসছে চাপা কথোপকথনের শব্দ। লাডু মিয়াকে আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছে আফনান মিয়া ও তার স্ত্রী। সাথে হান্নান মিয়ার বিরুদ্ধে নানান ছবক দিচ্ছে। জায়গাটা দ্রুত অতিক্রম করে এলো পানু মিয়া।

বাড়ির উঁচু ভিটা থেকে নিচুতে নেমে দু কদম এগোতেই পাশের আমগাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে খপ করে তার হাত ধরে ফেলল হান্নান মিয়া। ফিসফিস করে বলল, দেখলাতো ভায়া, আমার বিরুদ্ধে কেমন ষড়যন্ত্র হইতাছে। ওই লাডু হারামজাদা হইল তিন মুখা সাপ। হারামজাদা সবদিক তাল দিয়া টাহা খাইতাছে। আর দুই বলদা তা ট্যার পাইতাছে না। —

আচ্ছা যাই আমি।

যাও গিয়া। তয় আমি যে ঘরের পিছনে খাড়ায়া বদেগো কথা শুনছি, বদেরা জিগাইলে তুমি তা কোনদিন বইলা দিও না।

জি বলব না।

পরদিন কলেজে যাওয়ার পথে বাড়ি দুটির কাছাকাছি গিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়াল পানু মিয়া। দু ঘরের চিপায় তুমুল লড়াই চলছে দু বাড়ির দু মালিকের মধ্যে। নিঃশব্দ লড়াই। একবার হান্নান মিয়া ধাক্কে আফনান মিয়াকে ক হাত পিছিয়ে নিয়ে যায়, পরক্ষণেই উল্টো কাজটি করে আফনান মিয়া। কলেজে জরুরি ক্লাস, অথচ পথ অবরুদ্ধ। ইতঃস্তত করতে থাকে পানু মিয়া। মিনিট কয়েকের মাথায় হান্নান মিয়ার কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ওইঃ ভায়েক যাইতে দে! ডাইনে সর!

যাও ভায়া, যাও!

পানু মিয়া বিবদমানদের একপাশ দিয়ে কোনমতে দুকদম এগোতেই দু বাড়ির ভেতর থেকে তুমুল জোরে নারী কণ্ঠের গালাগাল শুরু হলো। কাহিল অবস্থায় প্রথমে বাম পাশ থেকে হান্নান মিয়া কাতর কণ্ঠে বলল,ময়ূ-রী চিল্লাইয়া কী হইব? চিল্লইশ না, ষাড় ছাইড়া দে, ষাঁড়!

হাজেরাহ! আমাগোরডাও ছাইড়া ধে-হ! আফনান মিয়ার কাহিল কণ্ঠ।

চোখের নিমিষে দু পাশ থেকে দুই ষাঁড় ছুটে গিয়ে ওপাশের পালানে নেমে তুমুল লড়াইতে লিপ্ত হলো। পানু মিয়া এরই মধ্যে বেশ কিছু দূর এগিয়ে গেছে। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখল একদিকে দুই পক্ষের নারী পুরুষে তুমুল লাফালাফি-গালাগাল, অন্যদিকে দুই ষাঁড়ের লড়াই।

ষাঁড় লড়াই ঘিরে বেশ লোক জড়ো হয়েছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে হান্নান মিয়ার লাল ষাঁড়টি দৌড়ে পালালে হান্নান মিয়া মাটি থেকে ইটার খণ্ড তুলে আফনান মিয়ার মাথায় আঘাত করে। আহত আফনান মিয়া প্রবল আক্রোশে পাশ থেকে গাছের ডাল তুলে হান্নান মিয়ার ঘাড়ে আঘাত করে। দুজনই মুহূর্তে মাটিতে লুকিয়ে পড়লে ময়ূরী আর আফনান মিয়ার স্ত্রী হাজেরা বেগম প্রবল বেগে দুপাশ থেকে দৌড়ে গিয়ে দুজনের চুল টেনে ধরে। একটু দেখার পর পানু মিয়া অতি দ্রুত কলেজের উদ্দেশ্যে প্রস্থান করে। এরই মধ্যে অনেকটা দেরি হয়ে গেছে তার।

কলেজ থেকে ফেরার পথে খানিকটা দূর থেকে পানু মিয়া লক্ষ্য করল বাড়ি দুটির পরিসরে পিন পতন নিরবতা। নির্বিঘ্নে পেরিয়ে গেল সে জায়গাটা। নিজ বাড়ির ভেতর আঙিনায় পা দিতেই তার বাবা প্রশ্ন করে বসলেন, বয়সী হান্নান মিয়া ও আফনান মিয়ার সাথে তার কী এমন খায়খাতির যে সদ্য ঝগড়াহত দু’জনই তাকে পালাক্রমে বাড়িতে খুঁজতে আসছে। পানু মিয়া যে জবাব করল তা তার বাবার কাছে খুব বেশি বোধগম্য হল না। তিনি অনুমান করলেন ওই দুই ব্যক্তির একজনও তার প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট কিছু না বললেও ভেতরে হয়তো পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। আর কাউকে না পেয়ে দুজনই সাক্ষী মানতে চাইছে সহজ সরল পানু মিয়াকে। অতএব, খাওয়া দাওয়া সেরে বিকল্প পথে এক্ষুনি যেন সে বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যে কেটে পড়ে, প্রয়োজনে দু একদিন যেন আত্মগোপন করে থাকে। তার বাবার কথামত পানাহার শেষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় পানু মিয়া।

পরদিন ভোরবেলা। বোনের বাড়ি থেকেই কলেজে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছল পানু মিয়া। আশ্চর্যজনকভাবে উদ্ভ্রান্ত দর্শন হান্নান মিয়া সেখানে গিয়ে হাজির। পানু মিয়া কলেজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে পথে কথা ওঠাল হান্নান মিয়া। পানু মিয়া দেখল তার বাবার অনুমান শতভাগই সত্যি। হান্নান মিয়া তাকে মামলার সাক্ষী হবার অনুরোধ জানাতেই সাতসকালে এতদূর হেঁটে
এসেছে। তাকে টাকা পয়সার প্রলোভনও দেখাচ্ছে সে।

পানু মিয়া তাকে বুঝিয়ে বলল মামলা মোকদ্দমায় না গিয়ে উভয়ে মিলেঝিলে চলতে। এও বোঝাল, সে যদি মামলা করে তবে আফনান মিয়াও তার বিরুদ্ধে মামলা করবে। ফলে তাকে জেল হাজতে থাকতে হবে। এ সময় জাফলং মিয়া তার ফেলে যাওয়া পরিবারের ওপর সুযোগ নিতে পারে। ব্যাপারটা তার জন্য মোটেও ভালো বা সুখকর হবে না। শুনে হান্নান মিয়া প্রথমে চোখ বড়বড় করল। তারপর চিন্তিত মনে দ্রুত পা বাড়িয়ে ভিন্ন পথে চলে গেল।

সেদিন কলেজ ছুটির পর পানু মিয়া বাড়িতে ফিরে যাবে নাকি বোনের ওখানেই গিয়ে উঠবে তা নিয়ে ইতঃস্তত করছিল। কিছুক্ষণ এলোবিক্ষিপ্ত ভাবার পর শেষ পর্যন্ত সে বোনের বাড়ির উদ্দেশ্যেই রওয়ানা হয়ে গেল। বাড়ির বার আঙিনার কাছাকাছি পৌঁছতেই তার চোখ রীতিমত চড়কগাছ হলো। সে কলেজ ছুটির পর মনে মনে যা ভেবেছিল, তা-ই অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছে। আফনান মিয়া দিব্যি ওখানকার বার আঙিনার জামগাছে হেলানে বসে আছে উদাস। তাকে দেখে নিমিষে অনেকটা চাঙা হয়ে উঠল যেন। ক্লান্ত অবসন্ন পানু মিয়ার জিজ্ঞাসাবাদে যা বেরিয়ে এলো তা হুবহু হান্নান মিয়ার আগমন হেতুর অনুরূপ।

পানু মিয়া সংক্ষেপে আফনান মিয়াকেও একরূপ পরামর্শে বিদায় জানাল। আফনান মিয়া গভীর ভাবনাচ্ছন্ন প্রস্থান করল।

পানু মিয়া এখন বাড়ি দুটির ফাঁকা দিয়ে নিয়মিত আসা যাওয়া করে। কান পেতে থাকে। দুপাশ নিস্তব্ধ, মাঝেমধ্যে বড়জোর চুড়ির টুংটাং কিংবা অলস হাই তোলার শব্দ ভেসে আসে। ওদিকে কাঁটাঝোপের বেড়াদুটির ওপর দিয়ে গলা উঁচিয়ে প্রতিদিন যে ভয়ংকর প্রাণী দুটির উদ্দেশ্যে সে দৃষ্টি ছোঁড়ে, তাদের কাউকেই আর চোখে পড়ে না। নিয়মিত দৃষ্টিতে আটকে যায় ঠায় বসা দুই গৃহকর্তার ভাজ করা দু হাঁটুর ফাঁকে চেপে ধরা সীসার পাত্রে চুৃঁইচাঁই সাদা তরলধারা বর্ষণকারী অতি নিরীহ দণ্ডায়মান দুটি গাই।

শওকত নূর | Shawkat Noor

New Bengali Article 2023 | কৃষিভিত্তিক সমাজ ও মুঠ উৎসব

Best Bengali Story 2020 | কিছু নই | শওকত নূর

New Bengali Story 2023 | তুতানের পৃথিবী | গল্পগুচ্ছ

Godhuli | গোধূলি | রম্যরচনা | জয়ন্ত কুমার সরকার | Best 2023

Gaai | gaay ka prastav | gaai aur gori | gaai par nibandh | gaai in hindi | gaai chhap besan | gaai par lekh | gaai ki nasle | gaay ki kahani | gaai meaning in english | gaai ko roti khilana | vlaamse gaai | ha hooo gaai galti | vlaamse gaai geluid | nil gaai | blauwe gaai | vlaamse gaai zeldzaam | vlaamse gaai in de tuin | vlaamse gaai betekenis | wat eet een vlaamse gaai | vlaamse gaai eet koolmees | Gaai Images | Gaai new bengali story | Gaai – natun bangla galpo | Gaai 2023 | Best story – Gaai | Gaai new movie | Gaai shortfilm | Top bengali story – Gaai | Gaai movie song | Gaai pdf story | Gaai short story | Gaai race competition | Shabdodweep Story – Gaai | Gaai in USA | Gaai in India | Gaai in Bangladesh | Shabdodweep Writer | Shabdodweep | Shabdodweep Founder

Leave a Comment